দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২৫

পঁচিশ

ভিড় করে থাকা মানুষগুলো বনবিহারীকে দেখে নড়ে উঠল। একজন এগিয়ে এসে নীচু গলায় বলল, ‘বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, একটু দেখুন।’

‘কে?’ খসখসে গলায় জিজ্ঞাসা করলেন বনবিহারী।

‘পুঁটির মা।’

বনবিহারীকে এগোতে দেখে ভিড় রাস্তা করে দিল। নামটা শোনামাত্র বুকে জমে ওঠা চাপটা কমে গেল। তিনি চোখ তুলে মামণিকে দেখতে পেলেন না। নীচের ঘরে ঢুকে ওদের দেখতে পেলেন। হ্যারিকেনের আলোয় পুঁটির মায়ের মাথার পাশে বসে থাকা মামণিকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মহিলার একজন বলল, ‘বিকেলে খবরটা আসা মাত্র মাটিতে পড়ে গেল। যখনই জ্ঞান ফিরছে কেঁদে উঠছে, কাঁদলেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।’

বনবিহারী বুঝলেন বাড়িওয়ালা ব্রজ মণ্ডল আর বেঁচে নেই। সকালেই শুনে গেছেন ওঁকে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করাতে শহরে নিয়ে যাওয়া হবে। মনে হয়নি হঠাৎ চলে যাবেন। বনবিহারী ঝুঁকে পুঁটির মায়ের পালস দেখলেন। খুব দুর্বল। স্টেথো চেপে বুকের শব্দ শুনলেন। এই অবস্থায় জ্ঞান ফিরিয়ে এনে কোনও কাজ হবে না।

‘কি বুঝছেন?’ পেছন পেছন আসা একজন প্রশ্ন করল।

‘বজ্রবাবুর শরীর এখন কোথায়?’

‘পাথরপ্রতিমার হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতে গিয়েছে কয়েকজন। এত দেরি হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না। ঘাটও তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’

‘যদি নিয়ে আসে তাহলে এখনই কি দাহ করবেন?’

‘নিয়ে এলে ওটা না করে তো উপায় নেই। মড়া বাসি করা উচিত নয়।’

‘তাহলে হাসপাতালে ফোন করে দিন যেন কাল সকালে নিয়ে আসে। এই মহিলার শরীরের যে অবস্থা তাতে জ্ঞান ফিরিয়ে স্বামীর কাজ করানো যাবে না। চেষ্টা করলে ওঁর ভালো হবে না। আমি ওঁকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিচ্ছি। সারারাত ঘুমিয়ে থাকলে নার্ভের ওপর চাপ কমবে।’ ব্যাগ খুললেন বনবিহারী।

লোকটা চলে গেল। ঘুমের ইনজেকশন পুঁটির মাকে দিয়ে বনবিহারী উঠে দাঁড়ালেন, ‘আপনাদের কেউ যদি রাত্রে এঁর কাছে থাকেন তাহলে ভালো হয়!’

মহিলা দুজন পরস্পরকে দেখলেন। মামণি মাথা নাড়ল। তারপর হাত বুকে ঠেকিয়ে বুঝিয়ে দিল সে রাত্রে পুঁটির মায়ের কাছে থাকবে। বাইরে বেরিয়ে এসে বনবিহারী লক্ষ করলেন ভিড় বেশ পাতলা হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সন্তানের কথা মনে পড়ল তাঁর। মামণি তো নীচে বসে আছে, সন্তান কোথায়? ওকে ঘুম পাড়িয়ে ওপরে রেখে এলে এতক্ষণে তার জেগে উঠে চেঁচামেচি করার কথা। কিন্তু ওপর থেকে কোনও আওয়াজ ভেসে আসছে না। বনবিহারী দ্রুত ওপরে এসে দেখলেন দরজা ভেজানো। ভেতরে অন্ধকার। আলো জ্বালাতে শূন্য বিছানা চোখে পড়ল। সন্তান ঘরে নেই। কোথায় গেল বাচ্চাটা? মামণি কি আশেপাশের কারও বাড়িতে ওকে রেখে এসেছে?

নীচে নেমে আসতেই একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ছেলেকে খুঁজছেন তো?’

চমকে উঠলেন বনবিহারী। কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।

কোনও চিন্তা করবেন না। ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছি। এসব দেখে খুব কাঁদছিল। এখন মজা করে খেলছে।’ লোকটি হাসল।

‘খেলছে?’

‘ওখানে আরও দুটো বাচ্চাকে পেয়ে গেছে তো।’

‘ও, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ওর এখন খেয়ে শোওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। যদি ওকে নিয়ে আসেন তাহলে—।’ কথা শেষ করলেন না বনবিহারী।

‘না-না, ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু। ওইটুকুনি বাচ্চা, যা খাবে তা আমার ওয়াইফ ঠিক করে দেবে। ওর বাচ্চার খুব শখ। নিজের নেই তো।’

‘এই যে বললেন ওখানে আরও দুটো বাচ্চা রয়েছে—!’

‘পাশের বাড়ির বাচ্চা। আমার ওয়াইফের কাছে এলে ভালো থাকে বলে দিয়ে যায়।’ মাথা নাড়ল লোকটি, ‘আপনার ছেলেকে নিয়ে কোনও চিন্তা করবেন না। ওর মা তো আজ রাত্রে ব্রজদার ওয়াইফের পাশে থাকবেন। আপনি একা পুরুষমানুষ বাচ্চাকে সামলাবেন কি করে! তাই আজকের রাতটা ও আমার ওয়াইফের কাছেই থাকুক। দুজনে ভালো থাকবে!’

পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ বললেন, ‘ঠিক কথা। ডাক্তারবাবু, আপনি চিন্তা করবেন না। বউমার কাছে বাচ্চারা ভালো থাকে কেন জানেন? তিনি ওদের গল্প বলেন, গান শোনান। আপনার ছেলের কপাল খারাপ, সে মায়ের মুখে ঘুমপাড়ানি গান শোনার সুযোগ পায়নি। ভগবান ওর মায়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়েছেন, কি করা যাবে। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। যান, বিশ্রাম করুন।’

ওপরে যাওয়ার আগে ব্রজ মণ্ডলের স্ত্রীকে আর একবার দেখে গেলেন বনবিহারী। গভীর ঘুমে রয়েছেন। নাড়ি আগের থেকে অনেক স্থির। এক ফাঁকে মামণির দিকে তাকাতে সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বনবিহারী কিছু না বলে ওপরে উঠে এলেন।

সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল। বনবিহারী ঘরে ঢুকে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তাঁর শরীরে একটা অস্বস্তি তীব্র হচ্ছিল। নিয়ম ভেঙে তিনি স্নান করলেন। স্নান সেরে খাটে বসে টের পেলেন তাঁর খিদেবোধটাই নেই। সন্তানের বিছানার দিকে তাকালেন। এখানকার মানুষ ওকে তাঁর ছেলে বলে ভাবছে। স্বাভাবিক ভাবে মামণি যদি ওর মা হয় তাহলে তিনি ওদের চোখে মামণির স্বামী। বয়সের এত পার্থক্য থাকা সত্ত্বের মামণিকে তাঁর স্ত্রী বলে ভেবে নিতে পেরেছে ওরা। ওদের কোনও দোষ নেই। একঘরে দুজন নারীপুরুষ বাচ্চা নিয়ে দিনের পর দিন সংসার করে থাকলে অন্য সম্পর্কের কথা মাথায় আসবে কেন? তিনি মেয়ে বা পুত্রবধূকে সন্তানসহ এখানে এনে একঘরে থাকছেন বলে তো কেউ ভাববে না।

কিন্তু এই ভাবনা শেষ পর্যন্ত মামণির ক্ষতি করবে! ডাক্তার বনবিহারীর স্ত্রী না হয়েও ওই পরিচয়ে পরিচিত হলে ভবিষ্যতে তিক্ত অভিজ্ঞতা হওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া এভাবে চললে সন্তানের পরিচয় কি হবে? সবাই জানছে সন্তানের বাবা তিনি। এটা যে-কোনওভাবেই বৈধ নয় তা ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি বলতেও পারবেন না। এক্ষেত্রে একটাই রাস্তা রয়েছে। মামণি এবং সন্তানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা অবিলম্বে বৈধ করে নেওয়া উচিত। কিন্তু কীভাবে? পুরোহিত ডেকে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করা এই বয়সে সম্ভব নয়। আজকাল ওই বিয়েকে আইনসঙ্গত বলে মনে করাও হয় না। ম্যারেজ রেজিস্টারের কাছেই যেতে হবে। খোঁজ করলে পাথরপ্রতিমা বা ডায়মন্ডহারবারে ম্যারেজ রেজিস্টার পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেখানে গেলে খবরটা এখানে চলে আসবে চটপট। তাতে আর এক ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। বনবিহারী সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা কলকাতায় গিয়ে সারবেন। একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে তিনি জানেন এই বিয়ে করতে হলে আগে নোটিশ দিতে হয়। সেই নোটিশে দুজনকেই সই করতে হবে। অর্থাৎ নোটিশ দেওয়ার জন্যে একবার আর বিয়ে নথিভুক্ত করতে আর একবার তাঁদের কলকাতায় যেতে হবে।

এই জীবনে অকৃতদার থাকবেন বলে ভেবেছিলেন বনবিহারী। কিন্তু বিধাতার যদি ভিন্ন ইচ্ছে হয় তাহলে সেটা না মেনে উপায় কি! মামণি এবং সন্তানকে এখানে ফেলে রেখে তিনি উধাও হতে পারেন না। হঠাৎ অন্য একটা কথা মনে আসতেই কিঞ্চিৎ প্রফুল্ল হলেন বনবিহারী। গঞ্জের বেশিরভাগ মানুষ মামণিকে দ্যাখেনি। দেখেছে পালবাবুর ড্রাইভার শম্ভু আর তাঁর বাড়ির কালীচরণ। কালীচরণ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। শম্ভু এখনও পালবাবুর গাড়ি চালাচ্ছে কিনা জানা নেই। চালালেও ওইটুকু ঝুঁকি নিতেই পারেন। বিয়ের পর তাই মামণি আর সন্তানকে নিয়ে যদি গঞ্জে ফিরে যান তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পাঁচজনে জানবে বনবিহারী বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। আড়ালে একটু হাসাহাসি করবে হয়তো তার ওপর বাচ্চা সমেত বউ এনেছেন বলে একটু বাঁকা কথাও বলাবলি হবে। কিন্তু এগুলো থিতিয়ে যেতে সময় লাগবে না। আর একবার থিতিয়ে গেলে এখনকার থেকে অনেক শান্তির জীবন যাপন করা যাবে।

বনবিহারী নিশ্চিত প্রস্তাবটা শুনে মামণি খুব খুশি হবে। ও তো তাই চায়। তিনি দূরত্ব রেখেছেন বলে ওর অভিমান বেড়েছে। হঠাৎ লজ্জা পেলেন বনবিহারী। বিয়ের পর তো আর তাঁকে দূরত্ব রাখতে দেবে না মামণি। তখন তিনি কী করবেন? একটা বড় শ্বাস ফেলে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি। তখন যা হওয়ার তা হবে। যা স্বাভাবিক তাই মেনে নিতে হবে।

কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিলেন বনবিহারী, হঠাৎ চিৎকারটা কানে ঢোকা মাত্র তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। বলো হরি, হরি বোল, বলো হরি, হরি বোল। চিৎকারটা ক্রমশ তীব্র হয়ে এগিয়ে আসছে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন তিনি। তাহলে ওরা এই রাত্রে নদী পেরিয়ে ব্রজ মণ্ডলের মৃতদেহ নিয়ে এল?

বনবিহারী বিছানা থেকে নামলেন। তৈরি হয়ে নীচে নামতেই শুনলেন ওরা এখনই শ্মশানে যেতে চাইছে। মড়া বাসি করে লাভ নেই, রাত থাকতে থাকতে দাহ করে ফেলা উচিত। কেউ জিজ্ঞাসা করল, ‘মুখাগ্নি করবে কে?’

‘আমি।’ বনবিহারী দেখলেন মামণিকে ধরে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে পুঁটির মা।

একজন বলল, ‘না না, আপনার শরীর ভালো নেই, আপনাকে যেতে হবে না।’

আর একজন বলল, ‘মেয়েছেলেরা তো শ্মশানে যায় না।’

‘যার কেউ নেই সে যায়। অমি যাব।’ পুঁটির মা দুর্বল গলায় বলল।

যার বাড়িতে সন্তান রয়েছে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবু কী বলেন? ওঁর কি এই শরীর নিয়ে শ্মশানে যাওয়া উচিত?’

‘শ্মশান কতদূরে?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘বেশিদূর নয়, নদীর ওই ধারে।’

‘গেলে যদি উনি শান্তি পান—, তবে হেঁটে না গিয়ে ভ্যান রিকশায় যাওয়া উচিত।’ বনবিহারী বললেন।

একটা ভ্যান রিকশা নিয়ে আসা হল। তাতে পুঁটির মাকে নিয়ে উঠে বসল মামণি। বলো হরি, হরি বোল ধ্বনি দিতে দিতে ব্রজ মণ্ডলকে নিয়ে চলে গেল সবাই। একজন অতিবৃদ্ধ লোক মাটিতে হাঁটুমুড়ে বসেছিল। বনবিহারী আকাশের দিকে তাকলেন। এই মধ্যরাতের আকাশে এখন অজস্র তারার ভিড়। মনে হচ্ছে অনেকটা নীচে নেমে এসেছে ওরা। ব্রজ মণ্ডলের আত্মা কি ওই আকাশে মিলিয়ে যাবে? লোকটা ভালো ছিল। বাড়িওয়ালা হিসেবে কখনও নিজেকে জাহির করেনি।

‘কে? কে ওখানে?’ মিনমিনে গলায় প্রশ্ন ভেসে আসতে বনবিহারী তাকালেন। সেই বৃদ্ধ মানুষটি চোখের ওপর হাত রেখে তাঁকে দেখার চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘আমি ডাক্তারবাবু।’

‘অ। নতুন ডাক্তার! শোনো, আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।’

‘রাত্রে কিছু খাননি?’

‘না। দিনরাতে একবার খেতে দেয় বউটা। আমার বউসোহাগী ছেলের বউ। পাঁচ বাড়ির বাচ্চা জড়ো করে খাওয়ায়, গান শোনায় কিন্তু বুড়ো শ্বশুর খেতে চাইলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। খেতে দাও।’ বুড়ো মাথা দোলাল।

যতক্ষণ ব্রজ মণ্ডলকে নিয়ে ভিড়টা এখানে ছিল ততক্ষণ বুড়োকে দেখতে পাননি বনবিহারী, কথাও শোনেননি। বুঝলেন এর বউমার কাছেই সন্তান আজ ঘুমোচ্ছে।

‘এখানে কীভাবে এলেন?’

‘হেঁছড়ে হেঁছড়ে। ব্রজ চলে গেল বলে এলাম। মাঝে-মাঝে আমাকে খেতে দিত ব্রজ। তা তুমি কীরকম ডাক্তার যে ওকে বাঁচাতে পারলে না? অবশ্য কি বা করতে পারো তুমি! ভগবান যাকে নেবে বলে ঠিক করে তাকে কে রাখতে পারে! তা তুমি কি খেতে দেবে না শুধু কথা বলাবে?’ বুড়ো রেগে গেল।

বনবিহারী ওপরে উঠলেন। যেখানে খাবার থাকে সেখানে গিয়ে ঢাকনা সরিয়ে সরিয়ে দেখলেন ভাত আর ডিমের ঝোল রাঁধা আছে। তা থেকে একটা ছোট থালায় কিছুটা তুলে নেমে এলেন। নিঃশব্দে বুড়োকে দিলেন তিনি।

খাবার দেখে খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হল বুড়োর, ‘বাঃ। ডিম এনেছ! কতদিন ডিম খাইনি।’ দ্রুত হাত চালিয়ে খাবারটা পেটে চালান করে দিয়ে বুড়ো প্লেটটা সামনে রেখে বলল, ‘যাই।’

‘জল খাবেন? এনে দেব?’

‘না। জল খেলে গলা থেকে ডিমের স্বাদ চলে যাবে। এখন আমি শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখব। আচ্ছা ডাক্তার, বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার তফাত কি?’

‘অনেক তফাত। বেঁচে আছেন বলে আপনি খেতে পারলেন, মরে গেলে পারতেন না।’

‘দূর! কারও কারও কোনও ফারাক নেই। আমি কি বেঁচে আছি? কবে মরে গেছি!’

শরীরটাকে মাটির ওপর দিয়ে হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলে গেল বুড়ো।

বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিল না। বারংবার বৃদ্ধের কথা মনে আসছিল। একটা মানুষ নিজেকে মৃত ভেবে নিয়ে পৃথিবীতে বাস করছে। লোকটার খাওয়ার ধরন দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়নি ও ক্ষুধার্ত, পেটে খাবার চালান করার জন্যে খাচ্ছে, উপভোগ করছে না। ব্রজ মণ্ডলের মরে যাওয়া নিশ্চয়ই মরে বেঁচে যাওয়া নয়, আবার এই বুড়োর বেঁচে থাকা মানে বেঁচে থেকে মরে যাওয়া নয়। বুড়ো মৃত্যুকে বেশ উপভোগ করছে।

কিছুক্ষণ উশখুশ করার পর বনবিহারীর মনে হল দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত থাকার জন্যে তাঁর ঘুম আসছে না। অন্য রাত বা সময় হলে এখন খাওয়ার কথা তিনি ভাবতেনই না। মধ্যরাতে খেলে তাঁর অম্বল হতে পারে। কিন্তু এখন সেটাকে আমল দিলেন না। খাট থেকে নেমে বেশ ঠান্ডা হয়ে থাকা ডিমের ঝোল আর ভাত খেতে লাগলেন চোখ বন্ধ করে।

মামণি চলে গেল শ্মশানে। পুঁটির মায়ের সঙ্গে অন্য কোনও স্ত্রীলোক তো যেতে পারত! বনবিহারী খেতে খেতে মাথা নাড়লেন। গেছে যাক। এর ফলে ওর মনে যদি নরম অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে বেড়ে যায় তাহলে একসঙ্গে বাস করে তিনি শান্তি পাবেন।

ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। বলো হরি হরি বোল ধ্বনি দিতে দিতে শ্মশানযাত্রীরা ফিরে এল। নীচে তাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। বনবিহারী ভাবলেন একবার নেমে ওদের সঙ্গে দেখা করে আসবেন। কিন্তু ক্লান্তি তাঁকে বাধা দিল। এখন নিশ্চয়ই মামণি ওপরে উঠে আসবে। তাঁকে না বলে শ্মশানে যাওয়ার জন্যে তিনি কোনও কটু কথা বলবেন না ওকে। বিয়ের সিদ্ধান্তটা ওকে জানাতে হবে। তবে এই শ্মাশান ফেরা ভোরের সময়ে নিশ্চয়ই নয়। কাল একটা ভালো মুহূর্ত বেছে নিয়ে বলতে হবে। মামণি কি তখন খুব লজ্জা পাবে?

নীচের কথাবার্তা থেমে গেল। বোঝা গেল যারা এসেছিল তারা ফিরে গেছে যে যার বাড়িতে। কিন্তু মামণি ওপরে আসছে না কেন? নাকি পুঁটির মা একা থাকবে বলে তার কাছেই থেকে গেছে! সেটাই স্বাভাবিক ভেবে আবার ঘুমের চেষ্টা করলেন বনবিহারী। এখন তাঁর শরীর-মনে কোনও অস্থিরতা নেই।

একটু বেলায় ঘুম ভাঙল তাঁর। আর সেটা এমনি এমনি নয়, সোনার ডাকে। দরজার বাইরে থেকে সোনা ডাকছিল, ‘ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু!’

দরজা খুলে সোনাকে দেখে অবাক হলেন, ‘কি ব্যাপার? তুমি!’

‘আটটা বেজে গেছে। আজ বালিচরণপুরে যেতে হবে। আপনি আসছেন না দেখে রতনদা আমাকে খোঁজ নিতে পাঠাল।’ সোনা বলল।

একটু লজ্জিত হলেন বনবিহারী, ‘যাও, আমি আসছি।’

 তৈরি হয়ে নীচে নেমে এসে দেখলেন বাড়িওয়ালার দরজা বন্ধ। একটু ইতস্তত করে বাইরে থেকে বেশ জোরে জোরে বললেন, ‘আমি কাজে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরব।’ তারপর হাঁটতে শুরু করলে সোনা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি দিদিকে কথাগুলো বললেন?’

‘হ্যা।’ মাথা নাড়লেন বনবিহারী।

‘দিদি তো এখানে নেই। ভোরের প্রথম ফেরিতে পাথরপ্রতিমায় চলে গেছেন।’ সোনা বলল।

 শোনামাত্র দুটো পা থেমে গেল বনবিহারীর। কী বলছে সোনা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *