দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ২৪

চব্বিশ

লঞ্চের ছাদে বসে জলের ওপর চোখ রেখেছিলেন বনবিহারী। কিন্তু তিনি কিছুই দেখছিলেন না। প্রবল শব্দে লঞ্চ এগিয়ে চলেছে জল কাটাতে কাটতে। দু-পাশে ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে। নদী এখানে বেশ চওড়া। দু-ধারের হিজল গাছের জঙ্গল অস্পষ্ট। অবশ্য সেদিকে মন ছিল না বনবিহারীর। তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন পাক খাচ্ছিল, মানুষ কি চায়?

চাওয়ার তো শেষ নেই। দেব বা দেবীর পুজোর সময় মানুষ বিদ্যা, বুদ্ধি, ধন, যশ-এর সঙ্গে আনন্দ এবং শান্তিও চেয়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ সুখের হোক এই প্রার্থনা করে। কিন্তু তাতেও তো চাওয়ার শেষ হয় না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমৃত্যু সে শুধু চেয়েই যায়। কিন্তু আজ মালতীর চাওয়ার কথা শোনা ইস্তক তাঁর সবকিছু গোলমেলে হয়ে গেল। সুন্দরবনের অজ পাড়াগাঁয় একটি নারীর মনে হয়েছে তার যৌবনই প্রধান শত্রুর ভূমিকা নিয়েছে। পৃথিবীর সব লম্পট পুরুষরা ওই যৌবনের জন্যে তার দিকে হাত বাড়িয়েছে আর সে এতদিন একা সেই নোংরা হাতগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। কিন্তু শরীরের ভেতর থেকে বিষ জমে যখন সেই যৌবনের একটিকে আক্রমণ করল তখন সে দ্বিতীয়টিকেও রাখতে চাইল না। তার বুকে কোনও নারীচিহ্ন না থাকলে সে লম্পটদের দৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পাবে বলে ভেবে নিয়েছে। তাহলে, মানুষ কখনও কখনও যৌবনমুক্ত হতে চায়!

‘চা।’

চমকে মুখ ফেরালেন বনবিহারী। সোনা চায়ের কাপ-ডিশ আর ওমলেট একটা ট্রে-তে চাপিয়ে নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপ-ডিশ তুলে নিলেন বনবিহারী, ‘ওটা থাক।’

‘না না। একবার রুগি দেখতে শুরু করলে খাওয়ার সময় পাবেন না। খেয়ে নিন।’ একটা কঠের বাক্সের ওপর টে নামিয়ে রেখে চলে গেল সোনা।

হাসলেন বনবিহারী। তিনি খাওয়ার সময় না পেলে অসুস্থ হতে পারেন ভেবে সোনা তাঁর ওপর জোর করল। অথচ ক’দিন-ই বা দেখছে সে তাঁকে। এই লঞ্চের কর্মচারীদের বুকে উত্তাপ আছে, প্রথম দিনেই সেটা অনুভব করেছিলেন বনবিহারী।

ওমলেটের টুকরো মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে বনবিহারীর আচমকা মনে প্রশ্নটা এল। তিনি তো মানুষ, তিনি কি চান? অনেক ভেবেও কুল পেলেন না তিনি। নিজের জন্যে আলাদা করে কিছু চাননি কখনও। দু-বেলা খাওয়া আর রাত্রে ঘুমের বাইরে যা চেয়েছেন তা তো নিজের জন্যে নয়। গঞ্জে একটা হাসপাতাল হোক, হাসপাতাল না হলে সরকারি হেলথ সেন্টার হোক চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই চাওয়াটা ছিল গঞ্জের গরিব মানুষদের জন্যে। এই যে মামণি আর সন্তানকে নিয়ে সব ছেড়ে সুন্দরবনে চলে এসেছেন এতে তাঁর নিজের কি লাভ হচ্ছে? তাঁর বাড়িটাকে নিশ্চয়ই দেখাশোনা করছে কালীচরণ। আরও কয়েক মাস যাতে কালীচরণের খাওয়া-পরার অসুবিধে না-হয় সে ব্যবস্থাও করেছেন। কিন্তু এসব কি তিনি কখনও চেয়েছিলেন? আজ হঠাৎ তাঁর মনে হল, এবার তিনি চাইতে পারেন! মামণির সব আছে শুধু সে কথা বলতে পারে না। এই বোবা মেয়েটাকে যদি কোনও সহৃদয় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে পারতেন তাহলে—! হ্যাঁ, এই চাওয়াটাই তিনি চাইতে পারেন। মামণির নতুন জীবনে সন্তানের জায়গা না হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি যে ক’দিন বেঁচে আছেন ততদিন সন্তানের দায়িত্ব তাঁরই। এই চাওয়াটা কীভাবে পূর্ণ হবে? কলকাতার কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন বলে স্থির করলেন বনবিহারী। বিজ্ঞাপনের ভাষাটা কি হবে? ভাবতে গিয়ে হেসে ফেললেন বনবিহারী। এই ধরনের বিজ্ঞাপনে ঠিক কী লিখতে হয় তা তাঁর জানা নেই।

ইঞ্জিনের দায়িত্ব গৌরাঙ্গকে ছেড়ে দিয়ে রতন এসে দাঁড়িয়েছিল বনবিহারীর পাশে। তাকে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর কত দূর?’

‘ওই বাঁকটা ঘুরলেই ঘাট। কিন্তু—!’

‘কিন্তু কি?’

‘প্রত্যেক মাসে যখন আমরা এখানে আসি তখন বেশ ভিড় দেখতে পাই। প্রচুর নৌকো আশেপাশের গ্রাম থেকে পেশেন্ট নিয়ে আসে। আজ তাদের দেখতে পাচ্ছি না।’ রতন বলল।

‘আজ যে আমরা আসব তা এরা জানে?’

‘নিশ্চয়ই জানে।’

লঞ্চ ধীরে ধীরে বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল ঘাটে কয়েকটা নৌকো বাঁধা রয়েছে কিন্তু কোনও মানুষ নেই। ব্যাপারটা কি বোঝার জন্যে লঞ্চের সব কর্মচারী উঠে এল ছাদে।

রতন বলল, ‘ঘাটে কেউ থাকে না বটে কিন্তু এমনি দিনে পারাপারের জন্যে লোক অপেক্ষা করে ওখানে। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে এখানে।’

বনবিহারীর ইতিমধ্যে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে একটিও পেশেন্ট অপেক্ষা করবে না এমন হতেই পারে না। যেখানে কোনও ডাক্তার নেই, হেলথ সেন্টার যদি বা থাকে কোনও কর্মচারী নেই, সেখানে বিনা পয়সায় ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করানো যাবে জেনেও লোকে নিশ্চয়ই বাড়িতে চুপ করে বসে থাকবে না।

লঞ্চটাকে পাড়ের কাছে না নিয়ে খানিকটা দূরত্বে রেখে গৌরাঙ্গ ভোঁ বাজাল। ঘাটের ওপাশে জঙ্গল। তার ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে গ্রামের দিকে। হঠাৎ সোনা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই যে, একটা নৌকো আসছে।’

দেখা গেল দুটো লোক দাঁড় বেয়ে একটা ছোট্ট নৌকো নিয়ে লঞ্চের দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নৌকোর ভেতরে একটি রমণী পাশ ফিরে শুয়ে আছে।

কাছাকাছি এসে লোক দুটো প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাঁচান, আমাদের বাঁচান।’ দড়ি ঝুলিয়ে লোক দুটোকে ওপরে তোলা হলেও রমণীকে তোলো গেল না। ওপর থেকে বোঝা যাচ্ছে সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

লোক দুটো ভয়ে কাঁপছিল। লঞ্চে ওঠার পর ওদের শরীর থেকে যেন সব শক্তি উধাও হয়ে গিয়েছিল। ছোটু হিরো সোনা তখন সিঁড়ি নামিয়ে রমণীকে ওপরে তোলার চেষ্টা করছে। রতনের ধমকে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে একজন বলল, ‘আমার মেয়েটাকে বাঁচান, ও মরে যাচ্ছে!’

রতন জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে?’

পেট থেকে বাচ্চাটা বেরুতে গিয়ে আটকে গিয়েছে। সব জল বেরিয়ে গেল তবু ওটা পেটে আটকে আছে। এ আমার জামাই। সবাই নিষেধ করেছিল, একজনের জন্যে তিনজনের জান কেন দেবে? কিন্তু বাপ হয়ে আমি আর বসে থাকতে পারিনি।’

‘তিনজনের জান কেন যাবে?’ রতন অবাক।

‘আপনারা কিছু জানেন না? কাল থেকে দু-দুটো বাঘ নদীর এপাশে এসে যাকে পারছে তাকে মারছে। দুটো মানুষের শরীর নিয়ে চলে গেছে ওরা। কিন্তু আবার ফিরে ফিরে আসছে বাঘ দুটো। ভয়ে কেউ ঘরের বাইরে বেরুতে পারছে না কাল থেকে।’

রতন গৌরাঙ্গকে বলল, ‘লঞ্চটাকে নদীর মাঝখানে নিয়ে চল।’

লঞ্চের টেবিলে রমণীকে শোওয়ানো হল। যন্ত্রণায় সে তখনও কাঁপছে। ছোটু এবং হিরো ছাড়া বাকিদের চলে যেতে বলা হল। বনবিহারী নাড়ি দেখলেন। খুব দুর্বল। পরদার কাপড় দিয়ে তিনদিক আড়াল করল হিরো। নিম্মাঙ্গের কাপড় সরিয়ে পরীক্ষা করলেন বনবিহারী। শিশুর মাথা আটকে গেছে মাতৃমুখে। ছোটুকে গরমজল আনতে বললেন বনবিহারী। ফরসেপ দিয়ে কাজ না হলে তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। একমাত্র পেট কেটে বাচ্চাটা বের করতে পারলে দুজনের প্রাণ বাঁচতে পারে। সেটা করার কোনও ব্যবস্থা এখানে নেই। তাছাড়া বনবিহারী সার্জেন নন, অপারেশন করার প্রয়োজন তাঁর হয়নি তাই ওই ব্যাপারে অভিজ্ঞতাও হয়নি। লঞ্চ ঘুরিয়ে যত জোরেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা হোক, পাথরপ্রতিমার হাসপাতালে পৌঁছাতে যে সময় লাগবে সেই সময় পর্যন্ত এই পেশেন্ট জীবিত থাকবে বলে মনে হয় না।

গরমজলে দীর্ঘদিন ব্যবহার না করা ফরসেপ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে বনবিহারী শিশুর মাথা ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। বনবিহারীর মনে হচ্ছিল শিশুটি আর জীবিত নেই। ইতিমধ্যে সোনা স্যালাইনের বোতল ঝুলিয়ে দিয়ে রমণীর শরীরের সঙ্গে নল যুক্ত করেছে। মিনিট তিনেক বাদে বনবিহারী আবিষ্কার করলেন শিশুর মাথা এবং শরীরকে ভেতর থেকে কিছু টেনে ধরেছে। আর এই কারণেই শিশু মায়ের শরীরের বাইরে আসতে পারছে না। ফরসেপ রেখে দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে কিছুটা ভেতর যেতেই বুঝতে পারলেন শিশুর গলার সঙ্গে মায়ের নাড়ি জড়িয়ে গেছে। আর একটু চাপাচাপি করলে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাবে শিশু। প্রায় কুড়ি মিনিটের চেষ্টায় নাড়ির বাঁধন ছিন্ন করতে সক্ষম হলেন বনবিহারী। এর জন্যে তাঁকে ছুরির সাহায্য নিতে হয়েছিল। এ ব্যাপারে মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। হয়তো এটা খুব পাশবিক ব্যাপার কিন্তু এ ছাড়া তাঁর সামনে অন্য কোনও উপায় নেই। হয়তো মায়ের শরীরে ক্ষত হচ্ছে, হয়তো শিশুর গলায়, গালে ছুরির দাগ বসেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফরসেপের সাহায্যে শিশুকে মায়ের শরীর থেকে বের করে আনলেন বনবিহারী। রক্তাক্ত শিশুর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে মৃত। ছোটু তাড়াতাড়ি তোয়ালে নিয়ে এসে শিশুকে মুড়ে ফেলল। রমণী এখন মৃতবৎ। তার শরীরে কোনও কুঞ্চন দেখা যাচ্ছিল না। এই সময় তোয়ালে কেঁপে উঠতেই বনবিহারী দ্রুত শিশুকে তুলে নিয়ে তার পশ্চাৎদেশে মৃদু আঘাত করতে লাগলেন। মিনিটখানেক পরে শিশুর মুখ ঈষৎ হাঁ হল এবং দুর্বল শব্দ বের হল। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আচমকা কান্না ছিটকে বের হল গলা থেকে। প্রবল বিক্রমে কাঁদতে লাগল শিশু।

এবার শিশুর মাকে নিয়ে ব্যস্ত হলেন বনবিহারী। লঞ্চের স্টকে যে ওষুধ ছিল তা থেকে যতটা সম্ভব কাছাকাছি ইনজেকশন শরীরে দিলেন। বুকের আওয়াজ এবং নাড়ি পরীক্ষা করার পর বনবিহারী মাথা নাড়লেন, এইসব মেয়েদের প্রাণশক্তি অল্পে হার মানতে জানে না।

ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলেন বনবিহারী। লোক দুটো উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিল! বনবিহারী বললেন ‘বাচ্চাটা বেঁচে যাবে।’

প্রৌঢ় চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে হাতজোড় করল। যুবক জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ্ঞে, সে কেমন আছে?’

‘মনে হচ্ছে সে-ও বেঁচে যাবে।’

বনবিহারীর কথা শেষ না হতেই দুটো মানুষ তাঁর পায়ের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি ভগবান। আমাদের কিছু নেই, সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকলাম।’

রতন এসে ধমকাতে লোক দুটো উঠে দাঁড়াল। ছোটু ওদের নিয়ে গেল নীচে শিশুর মুখ দেখাতে, রমণীর পাশে। রতন জিজ্ঞাসা করল, ‘মনে হচ্ছে আজ কেউ ভয়ে এখানে আসবে না। পরের গ্রামটায় যাবেন?’

জীবনে প্রথমবার এইরকম অপারেশন করে কাহিল হয়ে পড়েছিলেন বনবিহারী। তাঁর আচরণ ছিল নেহাতই আনাড়ির মতো। একটু এপাশ-ওপাশ হলেই শিশু এবং তার মায়ের প্রাণহানি হত। স্রেফ ওদের ভাগ্য ভালো বলেই বেঁচে গেছে। ভবিষ্যতে দ্বিতীয়বার এই কাজ আর করবেন না। রতনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পরের গ্রাম কতদূরে?’

‘ওপারে। মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগবে। ঘণ্টা দুই-আড়াই সময় পাওয়া যাবে।’ রতন বলল।

‘বেশ, চলো। দিনটা নষ্ট করে কি লাভ!’

‘আপনার শরীর ঠিক আছে তো?’

‘একটু ট্রেনশন হচ্ছিল, ঠিক হয়ে যাবে।’

রতন গৌরাঙ্গকে নিদের্শ দিতে গিয়ে থমকে গেল, ‘কিন্তু—!’

বনবিহারী তাকালেন। রতন বলল, ‘কিন্তু এদের কি হবে?’

‘এখন তো মেয়েটিকে নড়ানো যাবে না। যদি কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে তাহলে ফেরার পথে নামিয়ে দেওয়া যেতে পারে।’ বনবিহারী বললেন।

‘ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। তখন নদী পার হয়ে এপারে এসে ওদের নামিয়ে আবার আমাদের ওপারে কিনারা ধরতে হবে। আবার ওদের পক্ষে এতবড় নদী সন্ধ্যার সময় ওই ছোট নৌকোয় পেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়।’ রতন বলল।

‘তাহলে?’ বনবিহারী চিন্তিত হলেন।

‘একটা উপায় আছে। রাত্রে পাথরপ্রতিমায় গিয়ে হাসপাতালে ভরতি করে দেওয়া যেতে পারে।’ রতন পরামর্শ দিল।

লোক দুটোকে ডেকে আনা হল। হাসপাতালে যাওয়ার কথা শুনে দুজনেই আপত্তি জানাল। প্রৌঢ় বলল, ‘মেয়ে এখন কথা বলছে। আপনি যদি বলেন তাহলে ওদের গ্রামে নিয়ে যাই।’

বনবিহারী বললেন, ‘আগে তোমার মেয়ে হাঁটচলা করুক তারপর তো নিয়ে যাবে। হাসপাতালে দুদিন থেকে সুস্থ হলে তো কোনও সমস্যা থাকবে না।’

‘হাসপাতাল তো অনেকদূরে। সেখান থেকে বাড়ি নিয়ে যাব কি করে?’

প্রৌঢ়র প্রশ্ন শুনে রতনের দিকে তাকালেন বনবিহারী। রতন মুখ ঘুরিয়ে নিল।

ঘণ্টাখানেক পরে যথেষ্ট যত্নের সঙ্গে মা এবং শিশুকে নৌকোয় নামিয়ে দেওয়া হল। বনবিহারীর নির্দেশে স্যালাইনের বোতল খোলা হল না। শিশুটিকে তোয়ালেতে মুড়ে মায়ের পাশে শুইয়ে দেওয়া হল। প্রৌঢ় এবং যুবক নৌকো বাইতে বাইতে ক্রমশ চোখের আড়ালে চলে গেল। সকাল থেকে এই প্রথমবার বনবিহারীর মনে স্নিগ্ধতা ছড়াল। মানুষের ভালো হলে মন তৃপ্ত হয়।

সন্ধে সন্ধে ফিরে এসেছিল লঞ্চ। ঘাটে লাগামাত্র পরেশ মণ্ডল উঠে এল ওপরে। তার মুখ বেশ গম্ভীর। রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক’দিন ধরে শুধু তেল পোড়াচ্ছ কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। শুনলাম আজ যাওয়ার আগে পাথরপ্রতিমায় গিয়ে সময় নষ্ট করেছ। হেড অফিসে রিপোর্ট তো বানিয়ে বানিয়ে পাঠাতে পারি না।’

রতন বলল, ‘যে পেশেন্টকে তুলে এনেছিলাম তার অপারেশন ছিল। ডাক্তারবাবু তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। এইজন্যেই যেতে দেরি হয়ে গেল।’

‘আশ্চর্য! তুমি জানো না অজানা কোনও পেশেন্টের জন্যে লঞ্চ আটকে রাখার নিয়ম নেই? নিয়ে এসেছ, হাসপাতালে দিয়েছ, মরুক বাঁচুক, তোমাদের কর্তব্য শেষ।’

‘ডাক্তারবাবু চাইলেন—’

‘তাঁকে নিয়মগুলো বুঝিয়ে বলবে।’

‘ছোটমুখে বড়কথা হয়ে যাবে। আপনি বলে দেবেন। তাছাড়া আজ যদি ভোর ভোর বেরিয়ে যেতাম তাহলেও তো কোনও কাজ হত না।’

‘কেন?’

কোনও পেশেন্ট ছিল না। বাঘের ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি।’

‘যাঃ! গুল মেরো না।’

‘চলুন, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি, ঘুরে দেখবেন।’

‘হুম! বাঘের ভয়? বাঃ এই তো, এটাই রিপোর্ট করতে হবে। আমারা গিয়েছি কিন্তু পেশেন্টরা বাঘের ভয়ে আসেনি।’ মাথা নাড়ল পরেশ মণ্ডল, ‘তা যখন দেখলে কেউ ওই ঘাটে আসছে না তখন নদী পেরিয়ে অন্য গ্রামে গেলে না কেন?’

‘পার হয়ে যাইনি, তবে একটু দূরের গ্রামের পেশেন্টের জীবন বেঁচে গেছে ডাক্তারবাবুর জন্যে। পেটের বাচ্চা বেরুতে গিয়ে আটকে গিয়েছিল, আর একটু দেরি হলে দুটোই মরে যেত। ডাক্তারবাবু অনেক চেষ্টা করে নাড়ি কেটে ফরসেপ দিয়ে বাচ্চা বের করে দুজনকেই বাঁচিয়েছেন।’ রতন জানাল।

‘কোথায় তারা? নাম কী? কোন গ্রাম?’ পরেশ বেশ উত্তেজিত।

‘যারা এসেছিল তারা ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। নাম-ধাম সব সোনা লিখে রেখেছে।’

‘যাক, এটা একটা কাজের কাজ হয়েছে। ডাক্তারবাবু কোথায়?’

‘ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারাদিন খাননি, তারপর ওইরকম অপারেশন, আমরা ডাকিনি।’

‘ঠিক আছে, এখন ডাকো। আমি যে এসব কথা বলেছি তা আজই ওঁকে বলার দরকার নেই। আমি চললাম। আমার ভটভটি ছাড়ছে।’

বনবিহারী হেঁটে আসছিলেন। রতন তাঁর ঘুম ভাঙালে সোনা খাবারের কথা বলেছিল। তিনি রাজি হননি। বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। একটা ছোট ভিড় জমেছে সেখানে। মানুষজন গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক, মামণির কিছু হয়নি তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *