কুড়ি
রামগঙ্গায় লঞ্চ ঢুকল সন্ধের পরে। ছোটু জানাল এখন পাথরপ্রতিমায় গিয়ে কোনও লাভ হবে না। সন্ধের পরে ডাক্তারবাবুদের পাওয়া যাবে না ওখানে। বনবিহারীও এইরকম আন্দাজ করেছিলেন। কাল সকালে লঞ্চ নিয়ে বেরুবার পথে পাথরপ্রতিমার হাসপাতাল হয়ে যেতে হবে। মালতীর সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবেন তখন।
বনবিহারী রতনকে ডাকলেন। রাত্রে লঞ্চ ওর দায়িত্বে থাকে। বললেন, ‘শোনো, ওরা আজ রাত্রে লঞ্চেই থাকবে। তোমরা যা খাবে তাই দিও। খরচ যা হবে তা আমি দিয়ে দেব। মালতীকে একটা কেবিনে শুতে দিও। কালীচরণ যে-কোনও জায়গায় ঘুমাতে পারবে।’
রতন মাথা চুলকালো, ‘সেখানেই সমস্যা হয়ে গেল ডাক্তারবাবু।’
‘কি সমস্যা?’
‘লঞ্চে এতগুলো ব্যাটাছেলের সঙ্গে একজন মেয়েমানুষের রাত্রে থাকার হুকুম নেই। মাঝনদীতে এই হুকুমটা থাকে না, কিন্তু এখানে এসে নোঙর করলে হুকুমটা মানতেই হবে নইলে চাকরি যাবে আমাদের।’ রতন বলল।
‘এ নিয়ম কে করেছে? বনবিহারী বিরক্ত হলেন, ‘ওর সঙ্গে কালীচরণ আছে।’
‘আছে ঠিকই। কিন্তু সে তো মেয়েমানুষের স্বামী নয়।’ রতন জবাব দিল, ‘কোম্পানির অফিস থেকে কি কি করা যাবে না লিখে পাঠিয়েছিল।’
‘তাহলে কি করা যায় ওদের নিয়ে?’ ফাঁপরে পড়লেন বনবিহারী।
‘একটা ফাঁক আছে। হুকুমে বলা হয়েছে কোনও মেয়েমানুস একলা হলে রাত্রে লঞ্চে রাখা যাবে না। কিন্তু একজনের বেশি হলেও রাখা যাবে কিনা তা বলা হয়নি। আপনি যদি বাড়িতে গিয়ে ওদের এখানে পাঠিয়ে দেন তাহলে একজনের বেশি মেয়েমানুষ হয়ে যাবে। সঙ্গে বাচ্চাও থাকবে। আপনি নিশ্চিত থাকুন, ওদের কোনও অসুবিধে হবে না।’ রতন বলল।
একটা রাস্তা পেয়ে খুশি হলেন বনবিহারী। হিরোর হাত ধরে নড়বড়ে তক্তায় পা ফেলে লঞ্চ থেকে নেমে এলেন। সন্ধের পরে রামগঙ্গায় খেয়াঘাট ঘুমিয়ে পড়ে। এখন যাত্রা পারাপার বন্ধ। ভটভটি নৌকাগুলো পরপর গায়ে গা লাগিয়ে পড়ে আছে।
রামগঙ্গার দোকানগুলোয় ঝাঁপ পড়ছে। অন্ধকার বাড়ছে রাস্তায়। সারাদিন একা থাকার পর মামণির প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে পারছিলেন না। নিশ্চয়ই খুশিতে নেই মেয়েটা। কিন্তু তিনি কি করতে পারেন! এই চাকরি করতে গেলে তাঁকে এতটা সময় জলে থাকতেই হবে।
বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখলেন দোতলায় অন্ধকার। একতলায় বাড়িওয়ালার ঘর থেকে আলো বেরিয়ে আসছে।
বনবিহারীর গলা খাঁকারি দিলেন, সঙ্গে-সঙ্গে পুঁটির মায়ের গলা ভেসে এল, ‘কে?’
‘আমি বনবিহারী!’
‘ও ডাক্তারবাবু!’ দরজা খুলে পুঁটির মা বলল, ‘ওরা আমার এখানে আছে। সারাদিন একা থাকতে থাকতে ভয় পাচ্ছিল। উনি নেই এখন, তবু আসুন না। চা খেয়ে যাবেন।’
‘না না। আমি চা খেয়েছি। ওপরের দরজা খোলা আছে?’
‘হ্যাঁ, এই তো নামল ওরা।’ পুঁটির মা বলল।
সোজা ওপরে চলে এলেন বনবিহারী। আলো জ্বালা হয়নি তা নয়। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে আলো এত টিমটিমে করে রেখে গেছে মামণি যে বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। আলো বাড়িয়ে নিয়ে জামাগেঞ্জি ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে তোলা জলে হাত-মুখ ধুলেন তিনি। দুপুরের খাবার অবেলায় খেতে পারেননি কিন্তু এখন বেশ খিদে-খিদে পাচ্ছে। বাচ্চা কোলে নিয়ে মামণি এল। এসে দরজা বন্ধ করে দিল।
‘আমি জানি একলা থাকতে খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কি করব! চাকরিটাই এইরকম!’ বনবিহারী কথা শেষ করামাত্র বাচ্চাটিকে খাটের ওপর শুইয়ে দিয়ে একগাল হেসে হাত তুলে মামণি জানাল, ঠিক আছে, অত বলতে হবে না।
বনবিহারী ভরসা পেলেন। বললেন, ‘তুমি একটা উপকার করবে?’
মুখ নেড়ে জিজ্ঞাসা করল মামণি, কি?
‘বহুদূরের একটা দ্বীপে গিয়েছিলাম ওষুধ দিতে। সেখানে একটি বউ এসেছিল, তার বুকে ব্যথা হয়। পরীক্ষা করে দেখি টিউমার হয়েছে। অপারেশন না করলে বাঁচবে না। অত গরিব কিন্তু বেশ হাসিখুশি মেয়েটি। বুকে মৃত্যু বাসা বেঁধেছে তা ওর জানা নেই। ও যার সঙ্গে থাকে তাকে সুদ্ধু নিয়ে এসেছি লঞ্চে। কাল হাসপাতালে পাঠাব। কিন্তু লঞ্চে কোনও মেয়ের একা থাকার নিয়ম নেই। তুমি ওর সঙ্গে আজকের রাতটা থাকবে?’ বনবিহারী অনুরোধ করলেন।
চুপচাপ শুনছিল মামণি। এবার নিজের ডান দিকের স্তনে বাঁ-হাত রেখে গোঙানির মাধ্যমে জানতে চাইল বুকে ব্যথা কিনা!
‘বোধহয় ব্যথা শুরু হয়নি।’
আঙুল তুলে বনবিহারীকে দেখিয়ে সেই আঙুল নিজের স্তনে ছুঁইয়ে মামণি জানতে চাইল বনবিহারী মেয়েটির স্তন স্পর্শ করেছেন কিনা!
অবাক হয়ে গেলেন বনবিহারী। বুঝতে তিনি ভুল করেননি। বললেন, ‘আমি ডাক্তার। কোনও পেশেন্টকে যখন পরীক্ষা করি তখন ডাক্তার হিসেবেই করি। বুঝলে?’
বালিকা ছাত্রীর মতো মুখ নাড়ল মামণি, সে বুঝেছে।
‘তাহলে চলো। বেশি রাত হওয়ার আগেই তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
মামণি হাত বাড়িয়ে রাঁধা খাবার দেখাল। বনবিহারী বললেন, ‘তুমি লঞ্চে খাবে। ওরা রাঁধছে। ফিরে এসে আমি ওখান থেকে খাবার নিয়ে নেব।’
মামণির যেন হঠাৎ উদ্যম বেড়ে গেল। একটা প্ল্যাস্টিকের থলেতে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ভরে নিয়ে সে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে গেল। তারপর দরজার দিকে এগোল।
বনবিহারী ডাকলেন, ‘আরে! বাচ্চাটাকে নিয়ে যাও!’
জোরে জোরে মাথা নাড়ল মামণি। আঙুল দিয়ে দেখাল বিছানা, বাচ্চা ওখানেই থাকবে।
‘তুমি ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবে না?’
মামণি মাথা নেড়ে না বলল।
‘আশ্চর্য! ও তোমাকে ছাড়া সারারাত একা থাকতে পারবে? দুধ খেতে চাইবে। কাঁদবে।’
ঠোঁট ওলটাল মামণি। তাতে তার কিছু এসে যায় না।
ফাঁপরে পড়লেন বনবিহারী। বাচ্চাটা এখন ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ঘুম ভাঙলেই ও অস্থির হয়ে উঠবে। যে মামণি সবসময় বাচ্চা আঁকড়ে থাকে তার আচমকা এই পরিবর্তনের কারণ বনবিহারী বুঝতে পারছিলেন না।
বনবিহারী ভাবলেন বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও লঞ্চে উঠবেন। ওখানে গেল মামণির মন পালটাতে পারে। তোয়ালেতে বাচ্চাকে জড়িয়ে তিনি মামণির পেছন পেছন নীচে নেমে এলেন। বাড়িওয়ালার ঘরের দরজা বন্ধ। অন্ধকার রাস্তায় কোনওরকমে হেঁটে বনবিহারী মামণি এবং বাচ্চাকে নিয়ে লঞ্চঘাটায় চলে এলেন। লঞ্চের ভেতর আলো জ্বলছে। বনবিহারী চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘রতন, রতন! ছোটু!’
এদিকের দরজা খুলে ছোটু উঁকি মারল। বনবিহারী বললেন, ‘আমি, তক্তাটা নামাও।’
‘এই ডাক্তরবাবু এসেছেন। তাড়াতাড়ি।’ ছোটু চেঁচিয়ে বলতেই ভেতরে যেন হুটোপুটি লেগে গেল। বনবিহারী বুঝতে পারলেন না ওরা কি করছে। তারপর রতন এবং ছোটু বেরিয়ে এসে লঞ্চের পাশে তুলে রাখা লম্বা তক্তা বের করে পাড়ের সঙ্গে জুড়ে দিল।
ছোটু চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি যাব?’
শোনামাত্র মামণি তক্তার ওপর পা রেখে হাত বাড়াল। তরতর করে চলে এল ছোটু, সাবধানে মামণিকে নিয়ে গেল লঞ্চে। সেখানে পা রেখে ইশারা করল মামণি। ছোটু আর রতন তক্তা তুলে নিয়ে যেখানে ছিল সেখানে রেখে দিল। বনবিহারী দেখলেন। মামণি স্বচ্ছন্দে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজাটা বন্ধ করে দিল রতন। ওরা ধরেই নিয়েছে ডাক্তারবাবু রাত্রে লঞ্চে থাকবেন না।
প্রথমে খুব রেগে গেলেন বনবিহারী। তারপর নিজেকে সামলালেন। একটা অল্পবয়সি মেয়ে মা হয়েছে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। মা হওয়ার পর থেকে সে বন্দি হয়ে আছে শিশুর জন্যে। প্রকৃতি জোর করে ওর ঘাড়ে যে বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে তা থেকে ও একদিনের জন্যেও মুক্তি পায়নি। এই একটা রাত ও যদি হাতপাঝাড়া হয়ে থাকে, একটু আনন্দ পায়, পাক না।
বনবিহারী বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। সিঁড়িতে ওঠার আগে একটু দ্রুত পা চালালেন যাতে বাড়িওয়ালা বা তার স্ত্রী দেখতে না পায়। ওপরে উঠে কোল থেকে নামিয়ে বাচ্চাটাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠল সে। তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিয়ে ‘না না’ বলে ভোলাবার চেষ্টা করতে দেখলেন কান্না থেমে গেছে। আবার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে।
এবার নিজে বিছানায় কাত হয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর সন্তর্পণে ওকে বিছানায় নামাতেই তীব্র কান্না ছিটকে বের হল মুখ থেকে। রেগে গেলেন বনবিহারী। ধমক দিলেন। ‘চুপ! একদম কাঁদবে না।’
বাচ্চা আচমকা চুপ করে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বনবিহারীকে দেখল। তারপর দুটো কচি পা আকাশে ছুড়ে জলবিয়োগ করে স্বর্গীয় হাসি হাসল। বনবিহারী হেসে ফেললেন। তাড়াতড়ি ওকে কোলে তুলে নিয়ে দেখলেন তোয়ালে চুঁইয়ে তখনও তরল পদার্থ বিছানায় নেমে যায়নি। তোয়ালে পালটে বিছানায় শোওয়ানো মাত্র আবার বাচ্চার গলায় কান্না ফুটল।
রাত বারোটা পর্যন্ত এই চলল। ততক্ষণে হাঁপিয়ে উঠেছেন বনবিহারী। কিছুতেই ঘুম পাড়াতে পারছেন না। বোতলে দুধ ভরে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন। দুবার টেনেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে। বিছানায় শুয়ে সে হাসছে, পা ছুড়ছে কিন্তু পাশ থেকে বনবিহারী উঠতে চাইলেই তার গলায় কান্না সোচ্চার হচ্ছে। ফলে রাতের খাবার খেতে পারছিলেন না বনবিহারী। তিনি মনে করলেন, মামণি থাকলে বাচ্চাটা কখনই এমন কাণ্ড করত না।
অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বনবিহারীর মনে হল এবার ওর একটা নাম দেওয়া দরকার। ওর মায়ের পক্ষে কখনওই সেটা সম্ভব নয়। নাম নিয়ে অনেক ভাবলেন তিনি। কোনওটাই মনের মতো হচ্ছিল না।
হঠাৎ শব্দ মনে এল। মামণির সন্তান ও। ওর বাবার নাম তাঁর জানা নেই। ওর নাম সন্তান রাখলে কীরকম হয়! কোনও মানুষের নাম সন্তান আছে কিনা তিনি জানেন না। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তো সন্তানদলের কথা লিখেছেন। তিনি বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, ‘সন্তান?’
সঙ্গে সঙ্গে সে মুখ ঘোরাল। বনবিহারীর গলার স্বরে এই প্রতিক্রিয়া হল তা তিনি জানেন। শুনতে শুনতে যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবে তখন বুঝবে ওই নামে ওকে ডাকা হচ্ছে। কিন্তু সন্তানের উপাধি কি হবে? হেসে ফেললেন তিনি। ওর মায়ের উপাধিও তাঁর কাছে গুপ্ত। তাই ওর পুরো নাম হোক সন্তান গুপ্ত। বনবিহারী সন্তানকে আদর করতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিলেন। ওর চোখে ঘুম এসে গেছে।
লঞ্চ পাড়ে বাঁধা থাকলেও ছাদে উঠে বেশ মজা লাগছিল মামণির। সামনে কালো জল। ওপারে আলো জ্বলছে। ঢেউ-এর ধাক্কায় দুলছে লঞ্চ। তার খুব ইচ্ছে করছিল জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এই সময় হিরো এসে তাকে ডাকল, ‘দিদি, ও দিদি।’
আধা অন্ধকারে ছেলেটাকে দেখল মামণি। রোগা, খাটো অল্পবয়সি হিরোর সঙ্গে বুটকার খুব মিল আছে। বুটকাও তাকে দিদি বলে ডাকত। তাকে খুব সাহায্য করত। দলের সবাই যখন পুলিশের হাত খুন হয়ে গেছে তখন বুটকাও নিশ্চয়ই বেঁচে নেই।
‘ও দিদি, নীচে নেমে এসো। খাবার দেওয়া হয়েছে।’
খাবারের কথা শোনামাত্র খিদে পেয়ে গেল মামণির। বাধ্য মেয়ের মতো নেমে এল লঞ্চের পেটে। টেবিলে খাবার রেখে সোনা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখামাত্র বলল, ‘সব ঠান্ডা হয়ে গেছে বোধহয়। খেয়ে নিন।’
মামণির এতক্ষণে খেয়াল হল। ওকে এখানে থাকতে বলা হয়েছে আর একজন মহিলাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে। সেই মহিলার সঙ্গেই তার দেখা হয়নি। সে হাত নেড়ে, মুখে অস্ফুট শব্দ বের করে জিজ্ঞাসা করল সেকথা। রতন বা সোনা বুঝতে পারল না। খুব বিরক্ত হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল মামণি। এবার হিরো আন্দাজ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘মালতীদিদির কথা জিজ্ঞাসা করছ? তার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। ওই ওপাশের কেবিনে সে আছে। আর এপাশের কেবিনে তুমি থাকবে।’ বলে ঘরের একপাশে শুয়ে থাকা একটা মানুষকে দেখাল সে, ওই যে। ওর নাম কালীচরণ। মালতীদিদির সঙ্গে এসেছে।’
মামণি দেখল লোকটাকে। হাঁ করে ঘুমাচ্ছে।
খেতে বসল মামণি। ভাত ডাল ভাজা আর মাছের ঝোল। ঝোলে খুব ঝাল। সোনা বলল, ‘বুঝেছি। কাল যদি থাকো তাহলে তোমার জন্যে কম ঝাল দেব।’
মামণিকে নির্বিকার হয়ে খেতে দেখে সোনা হিরোকে বলল, ‘তুই তো ওর কথা বুঝতে পারলি, এবার আমার কথা ওকে বুঝিয়ে বল।’
হিরো বলল, ‘কাল ঝোলে ঝাল কম দিও, উনি ঠিক বুঝে নেবেন।’
খাওয়া হয়ে গেলে বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে নিল মামণি। হিরো তাকে বাথরুম টয়লেট দেখিয়ে দিল। তারপর কেবিনের দরজা টেনে দু’পাশে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখানে ঘুমাও। আরামসে।’
মামণি মাথা নাড়ল, না। তারপর উলটোদিকের কেবিনের দরজায় শব্দ করল। হিরো দাঁড়িয়ে দেখছিল, মামণি তাকে ইশারা করল চলে যেতে।
দরজা খুলছে না দেখে মামণি দু’হাতে সেটা দু’দিকে টানল। কেবিনে আলো জ্বলছে। আর একফালি শোওয়ার জায়গার একপাশে জড়সড় হয়ে বসে আছে একটা বউ। দেখেই বুঝতে পারল তার থেকে বয়সে ঢের বড়। বউটা অবাক হয়ে তাকে দেখছে।
এই মেয়ের বুকে মৃত্যু বাসা বেঁধেছে? দেখলে বিশ্বাসই হয় না। কিন্তু মামণি জানে বনবিহারী মিথ্যে বলার মানুষ নন। সে একপাশে গিয়ে বসল। তারপর ইশারায় জানাল সে কথা বলতে পারে না। বলে হাসল। মালতী অবাক হয়ে দেখছিল এতক্ষণ। এবার তার মুখ থেকে কথা বের হল, ‘বোবা?’
দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি। ছেলেবেলায় কেউ তাকে বোবা বললে খুব রাগ হত। এখন হল না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে মামণি নিজের ডানবুকে আঙুল ছুঁইয়ে ইশারায় জানতে চাইল ওখানে ব্যথা কিনা? দুবার জানতে চাওয়ার পর বুঝতে পারল মালতী। মাথা নেড়ে হাসল সে, ‘ব্যথা নেই। হলেও খুব কম। ডাক্তার বলেছে বুক কেটে ফেলে দেবে। তাই শুনে খুব মন খারাপ আমার!’
মামণি মুখ নেড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
মালতীর মুখ মলিন হল, ‘মেয়েমানুষের যদি বুক না থাকে তাহলে আর কি থাকল বলো। সবাই বলত, মালতী, তোর মেমসাহেবের মতো বুক। গ্রামের লোকের বুক জ্বলত। তাই নজর লেগে গেছে এখানে।’
হাত নেড়ে বোঝাল মামণি, ভালো হয়ে যাবে।
‘বসে বসে ভাবছিলাম যাক দূর হয়ে। আমার তো বাচ্চাকাচ্চা নেই যে তাদের পেট ভরাতে কাজে লাগবে। পুরুষদের নজর বাঁচাতে হিমসিম খেতে হয়। ডাক্তারবাবুকে বলব দুটোই বাদ দিক। তাহলে জ্বালা জুড়োয়।’ মালতী হাসল, ‘তুমি কে গো?’
মামণি বনবিহারীকে নকল করল। কানে স্টেথিষ্কোপ ঢোকানোর ভঙ্গি করে আঙুল তুলল। মালতী জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তার?’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মামণি। তারপর নিজের বুকে হাত রেখে বোঝাতে চাইল সে ডাক্তারের কাছের লোক। তিনবারের বার বুঝল মালতী। একগাল হেসে বলল; ও বুঝেছি। তুমি ডাক্তারের বউ। তোমার থেকে তো অনেক বড়।’
মামণি একটু ভাবল। ভাবল ভুলটা ভাঙিয়ে দেবে। কিন্তু তা না করে শ্বাস ফেলল শব্দ করে। যেন খুব কষ্ট পেল। মালতী বলল, ‘তা হোক। ডাক্তারের খুব শক্ত শরীর। অনেকদিন বাঁচবে। তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার স্বামীর মনে কোনও পাপ নেই।’
চোখ বড় করল মামণি।
‘হ্যাঁ গো। আমার বুক দেখল, আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল। আমার কি ভয় করছিল। কিন্তু পুরুষমানুষের স্পর্শ যে মায়ের মতো হয় তা আমি এই প্রথম জানলাম। বুকে আঙুল দিচ্ছেন না পায়ের পাতায় তা ওঁর স্পর্শে বোঝা গেল না। তাই বললাম, তোমার ভাগ্য ভালো। বয়সে একটু না হয় বড়, কিন্তু নিষ্পাপ মানুষ।’ মালতী মাথা নাড়ল।
হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল মামণির। বহুদিন হয়ে গেল সে বনবিহারীর আশ্রয়ে আছে। বনবিহারী তার বাবার বয়সি। কিন্তু বৃদ্ধ হতে এখনও অনেক বাকি। আজ এই মেয়েটির কথা শোনার পর তার মনে হল সে শুধু বনবিহারীর কাছ থেকে নিয়েই যাচ্ছে। বনবিহারী না থাকলে বাচ্চা হতে গিয়ে জঙ্গলেই মরে যেত সে। বনবিহারী তাকে আশ্রয় না দিলে জেলের ভাত খেতে হত। পাঁচজনের কাছ থেকে তাকে আড়াল করতে বনবিহারী এই সুন্দরবনে চলে এসেছেন। কোনওদিন তাকে স্পর্শ করেননি। কেন? আচ্ছা সে যদি বনবিহারীকে বলে তাকে বিয়ে করতে হবে তাহলে কি আপত্তি করবেন? ভাবতেই লজ্জা পেল সে।
মালতী জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল দিদি?’
মাথা নেড়ে না বলে সে উঠে দাঁড়াল, ইশারায় বলল ঘুমিয়ে পড়তে। হঠাৎ মালতী জিজ্ঞাসা করল, ‘একটা কথা বলব?’
মাথা নাড়ল মামণি, হ্যাঁ।
‘ঝটপট চলে এলাম। কারও সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। কোনও ছেলেকে বলতে পারি না, পুরুষমানুষ মানেই তো ডাক্তারবাবু না।’ উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিল মালতী, তারপর শাড়ি সরিয়ে বুকের বোতাম খুলল। বিস্ফারিত চোখে মামণি মালতীর স্তন দেখল। দুটোই উদ্ধত, সুগঠিত।
মালতী বলল, ‘এই বুকে কিছু দেখতে পাচ্ছ দিদি?’
মাথা নাড়ল মামণি, না।
‘টিপলে শক্ত কিছু হাতে ঠেকে। তখন লাগে। দ্যাখো।’
হাত বাড়াল মামণি। মসৃণ চামড়ার নীচে শক্ত ঢেলাটাকে টের পেল সে। হাত সরিয়ে সে ওপরের দিকে মুখ করে নমস্কার করল।
মালতী ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর কান্না চাপতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।