আঠারো
বনবিহারী স্থির হয়ে বসেছিলেন। মামণির দুটো হাত তাঁর কোমরকে সাপের মতো জড়িয়ে ধরে আছে। ফোঁপানি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ওর শরীরের চাপ ক্রমশ বিভ্রান্ত করছিল তাঁকে। তারপর মনে হল মেয়েটা মা হয়ে গেলেও ওর মনের শৈশব কাটেনি। দুঃখ পেলে, আবেগে কান্না এলে কাউকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে শান্ত করতে চায়। তাই এই মুহূর্তে ওর সঙ্গে বাবার মতো ব্যবহার করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা সহজ হয়ে গেলেন তিনি। আবার ওর মাথায় হাত রাখলেন। গলায় সহানুভূতি এনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে?’
নিজের ডান হাত বনবিহারীর কোমর থেকে ওপরে তুলে গলা, গাল ছুঁয়ে ঠোঁটের ওপর এসে একটা আঙুল যেখানে চেপে ধরল মামণি যার অর্থ হল, কথা বলো না। আবার হাত নামিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল মামণি। বনবিহারী কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। কয়েক সেকেন্ড পাথরের মতো বসে থাকার পর তাঁর অস্বস্তি শুরু হল। মামণির ঊর্ধ্বাঙ্গের চাপ তাঁর পায়ের ওপরে। নরম, তুলতুলে সেই অনুভূতিকে একটু একটু করে আরাম জড়াচ্ছে। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি। কোনও নারীশরীর কখনও এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে তাঁর জীবনে আসেনি। বনবিহারী চোখ বন্ধ করলেন। মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত, কাঁদলে শরীর আরও কাহিল হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও ঘুমিয়ে পড়বে। আর তখন সন্তর্পণে ওকে কোল থেকে নামিয়ে উঠে যাবেন তিনি।
ঘটনা যে ওঁর ভাবনামতো ঘটবে তা নিজেই আশা করেননি বনবিহারী। ঘুমে কাদা হয়ে যাওয়া মামণির শরীরটাকে নীচে নামিয়েও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর নিঃশব্দে উঠে চলে এলেন ঘেরা বারান্দায় যেখানে রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। গ্রিলের এপাশে ত্রিপল টাঙানো হলেও একদিকের ছিলতে ফাঁক গলে আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেই আকাশ দেখতে দেখতে শ্বাস ফেললেন বনবিহারী। একটা ভয়ংকর সমস্যা থেকে উদ্ধার পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছিল। মেয়েটা যে তাঁর কাছে আশ্রয় চাইছিল, পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে তা তিনি বুঝতেই পারেননি। মামণি স্বাস্থ্যবতী। ওর শরীরের প্রবল স্পর্শে যে মাদকতা আছে তা তাঁকে প্রায় টলিয়ে দিয়েছিল। যদি নিজেকে সংযত রাখতে না পারতেন, যদি—যদি—! চোখ বন্ধ করে ফেললেন বনবিহারী। তাঁর ভেতরে যে একটা ভয়ঙ্কর ক্ষুধার্ত প্রাণী ঘুমিয়েছিল তা আজ স্পষ্ট টের পাচ্ছেন।
ঘরে ফিরে কুঁজো থেকে এক আঁজলা জল নিয়ে মুখেঘাড়ে বোলালেন তিনি। তারপর তক্তাপোশের ওপর বসলেন। নীচের বিছানায় পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে মামণি। ও কি করে মা হল? শিশুর মতো মনের গড়ন যার, মেয়ে হয়েও শরীর সম্পর্কে উদাসীন এই মেয়ে ঘর ছাড়ল কি করে?
শুয়ে পড়লেন বনবিহারী। কিন্তু ঘুম এল না সহজে। এতটা কাল প্রকৃত ব্রহ্মচারীর মতো জীবন যাপন করেছেন। কখনও শরীরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেননি। সমস্ত মেয়ে বা মহিলা, দশ থেকে নব্বই হলেও সবাইকে মা বলে সম্বোধন করেছেন। অথচ আজ কেন মনে হচ্ছে অযথা নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন। এখন এই বয়সে পৌঁছে আর পেছনে তাকাবার কোনও মানে হয় না। এই বয়সে মানুষকে মুখোশ পরে থাকতে হয়, মুখ দেখালে কুৎসা ছড়াবে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বনবিহারী জানেন না, ভোর রাতে বাচ্চার চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। আধা অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখলেও তাঁর চোখ বিস্ফারিত হল। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা শিশু শুধু উপুড় হয়নি একেবারে তাঁর শরীরের কাছে চলে এসে কাঁদছে। ঝটপট কোলে তুলে নিয়ে বিছানা হাতড়ে বুঝলেন বেশ কয়েকটি জায়গা এখনও ভিজে রয়েছে। অর্থাৎ জলবিয়োগ করেই শিশু কাঁদেনি। পা ছুড়ে শরীর সরিয়েছে। এর আগে ওকে কখনই নিজে নিজে উপুড় হতে দ্যাখেননি বনবিহারী। আজ থেকে এ শরীর নাড়াতে শিখল। ফলে তক্তাপোশ মোটেই নিরাপদ জায়গা নয় যদি না দুটো দিক উঁচু করে দেওয়া হয়।
শিশু কেঁদেই যাচ্ছিল। ওকে কোলে নিয়ে বনবিহারী মামণির কাছে এসে ডাকলেন। দ্বিতীয়বারে চোখ মেলল মামণি। বনবিহারী শিশুটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘বেচারার খিদে পেয়েছে। নাও, ওকে খাওয়াও।’
সজোরে মাথা নাড়ল মামণি। না। তারপর বুকের ওপর হাত ছুঁইয়ে আঙুল নেড়ে বোঝাল সেখানে কিছু নেই।
বনবিহারী স্তম্ভিত। এই মেয়ের শিশুর মস্তিষ্ক! নইলে খোলাখুলি তাঁকে কি করে জানাল যে বুকে দুধ নেই।
সকাল আটটার মধ্যেই মোটামুটি বাজার করা হয়ে গেল। স্টোভ, কেরোসিন, রান্নার জিনিসপত্র থেকে সবজি, মশলা কিনে কয়েক দফায় বাড়িতে পৌঁছে দিলেন তিনি। তাই দেখে গালে হাত দিল মামণি। সে ভেবে পাচ্ছিল না এসব কি করে সামলাবে। বনবিহারী সবকিছু গুছিয়ে রেখে মামণিকে স্টোভ জ্বালাতে শিখিয়ে দিলেন। প্রথমে একটা সসপ্যানে জল গরম করতে স্টোভের ওপর বসিয়ে দেওয়া হল।
বনবিহারী ভাবছিলেন মাছ কিনে আনবেন কি না। এক বিঘৎ লম্বা পার্শে মাছ এখানে চল্লিশ টাকা কিলোয় বিক্রি হচ্ছে। আড়াইশো মাছ আনলেই তাঁদের চলে যাবে। তিনি মামণিকে জিজ্ঞাসা করলেন তরকারি কাটতে পারবে কিনা? মামণি ইশারায় জানাল কি দিয়ে সে কাটবে? হেসে ফেললেন বনবিহারী। সব কিনেছেন কিন্তু বঁটি কিনতে ভুলে গেছেন। আবার বের হলেন তিনি। এই যে নতুন সংসার পাতার ব্যাপারটা তাঁর খুব ভালো লাগছিল। কালীচরণ দেখলে নিশ্চয়ই অনেক খুঁত বের করত। তাঁকে কিছুই করতে দিত না। কিন্তু এসব নিজে করলে যে আনন্দ পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে বঞ্চিত হতেন।
সিঁড়িতে পা দিতেই পরেশ মণ্ডলকে দেখতে পেলেন, হন্তদন্ত হয়ে আসতে। সে কথা বলার আগেই ব্রজ মণ্ডল তাকে ধরল, ‘এই যে পরেশবাবু, আপনি কাল একটা খাট পাঠিয়েছেন? তিনজনের শরীর ওই ছোট্ট খাটে ধরবে?’
পরেশ পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় মুছল, ‘কাল একটাই পেয়েছিলাম। আজ পাথরপ্রতিমা থেকে আনিয়ে দেব। মাসে কুড়ি টাকা ভাড়া।’
ব্রজ মণ্ডল মাথা নাড়ল, ‘ভালো কথা। তা ডাক্তারবাবুকে দেখলাম সকাল থেকেই বাজারহাট করছেন। রান্নাবান্না শুরু হয়ে গেছে নাকি?’
পরেশ মণ্ডল চোখ কপালে তুলল, ‘একি! এর মধ্যেই রান্না করে খাবেন কেন? দুপুরে লঞ্চে আপনাদের জন্যে রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। রাত্রে ব্রজবাবুর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে, যা খরচ হবে তার দাম ধরে দিলেই হবে।’
বনবিহারী বললেন, ‘লঞ্চের রান্না বেশ ভালো তবে অত মশলা আমার যে সহ্য হয় না।’
‘ঠিক আছে ডাক্তারবাবু, বলে দিলে আপনি যেমন চান তেমনই পাবেন। স্নান হয়ে গেছে?’
‘স্নান? না তো!’
‘ও হো, আমার উচিত ছিল কালই আপনাকে বলে যাওয়া! ঠিক আছে ওটা লঞ্চেই সেরে নেবেন। ভালো বাথরুম আছে ওখানে। আর দেরি করলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। চলুন।’
‘যাব? কোথায়?’
‘তেঁতুলতলার ঘাট, বিরাটবাজার, অচিন্ত্যনগর, বুড়োবুড়ির তট, ঘনশ্যামনগর আর রাখালপুরে এই সপ্তাহে লঞ্চ নিয়ে যাবেন। আজ তিনটে জায়গায় বলা হয়েছে আপনি যাবেন আর সেই মতো রুগিরা লঞ্চে এসে আপনাকে দেখাবে। মনে হচ্ছে আজ দু-জায়গার বেশি যেতে পারবেন না। কাল থেকে সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় বেরুতে পারলে প্রোগ্রাম ঠিক থাকবে। আপনার জন্যে সবাই লঞ্চে অপেক্ষা করছে।’ পরেশ মণ্ডল বলল।
‘বেশ। আমি এক মিনিটের মধ্যে আসছি।’ ওপরে উঠতে গিয়ে থেমে গেলেন বনবিহারী। ঘুরে বললেন, ‘লঞ্চ নিশ্চয়ই এখন ফিরবে না, তাহলে ওদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা—।’
‘আহা,’ বনবিহারীকে থামিয়ে দিল পরেশ মণ্ডল, ‘ওদের নিয়ে চলুন। ভেতরে কেবিন আছে। সেখানে বিশ্রাম নেবে।’
ভেতর থেকে পুঁটির মায়ের গলা ভেসে এল, ‘ভালো করে বাচ্চাকে কাপড়ে ঢেকে রাখবেন। নদীর হাওয়া যেন গায়ে না লাগে।’
কালজিরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মামণি মুগ্ধ। চোখে-মুখে আলো ফুটল। লঞ্চ থেকে নেমে এসেছিল ছোটু। সে-ই শিশুকে কোলে নিয়ে তক্তাপোশের ওপর দিয়ে তরতর করে হেঁটে ওপরে উঠে গেল। ওপাশে ভটভটি নৌকো আসা-যাওয়া করছে। পায়ের তলায় তক্তা, কাঁধ বরাবর দড়ি টাঙানো, মামণি স্বচ্ছন্দে তাদের সাহায্যে লঞ্চে উঠে গেলেও বনবিহারী থমকালেন। পা পিছলালেই জলে পড়তে হবে। সারেঙ রতন ডেকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি যাব ডাক্তারবাবু?’
‘না না ঠিক আছে।’ বনবিহারী দড়ি ধরে সন্তর্পণে পা ফেললেন। ওইটুকু দূরত্ব পার হতে গিয়ে তাঁর মনে হল শরীরটা আর নিজের দখলে নেই।
শিশুকে নিয়ে ছোটু নেমে গেছে লঞ্চের পেটে। মামণি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেছে ছোটুর সঙ্গে। রতনের সহকারী গৌরাঙ্গ লঞ্চ ছাড়ল। দড়ির বাঁধন থেকে তাকে মুক্তো করতেই সেটা এগিয়ে যেতে লাগল দ্রুতগতিতে।
বনবিহারী রতনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পরেশবাবু উঠেছেন?’
‘না। উনি লঞ্চে যান না। অফিসে থাকেন।’ রতন বলল।
‘নদী যখন ভয়ংকর হয় তখন লঞ্চ ডুবে যায় না তো?’
‘না না। আমি নদীর স্বভাব-চরিত্র জানি। তাই আগে থেকে সাবধান হয়ে যাই। আপনি এর আগে লঞ্চে উঠেছেন?’
‘অনেক আগে ছেলেবেলায়। সেটা বিশাল লঞ্চ। জাহাজ বলতে পারো। মনিহারি সকরিকলিঘাটে যাতায়াত করত।’ বনবিহারী হাসলেন।
ওঁরা এখন লঞ্চের পেটের বড় ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রতন বলল, ‘আপনি বসুন। এখানে বসে রুগি দেখতে পারেন, নয় তো মাটিতে টেবিল-চেয়ার পেতে দেব। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা বিরাটবাজারে পৌঁছে যাব।’
‘এই কালজিরে কি এই এলাকার একমাত্র নদী?’
‘না। আরও আছে। যেমন, মৃদঙ্গভাঙা, চালতাধনিয়া। থাকতে থাকতে সব চিনে যাবেন।’ রতন ওপরে উঠে গেল।
নদীর দিকে তাকালেন বনবিহারী। কলকাতার অফিস বলেছিল, ‘লঞ্চে যখন থাকবেন তখন আপনার ইচ্ছাই শেষ কথা।’ কিন্তু কিছু না জেনে শেষ কথা বলার মতো মুর্খ তিনি নন। ইতিমধ্যে নদীর ওপারে জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। এদিকের জানলায় গিয়েও একই দৃশ্য দেখলেন। লঞ্চ যাচ্ছে নদীর মাঝখান দিয়ে। মাঝে-মাঝে ভটভটি নৌকো তার পাশ কাটিয়ে যাওয়া-আসা করছে। ওই জঙ্গল যখন সুন্দরবনের তখন নিশ্চয়ই বাঘ রয়েছে ভেতরে। লঞ্চ থেকে কোনও প্রাণীকেই দেখা যাচ্ছে না।
এই সময় লঞ্চের কুক সোনা এল দুটো প্লেট নিয়ে। টেবিলে নামিয়ে বলল, ‘জলখাবার খেয়ে নিন ডাক্তারবাবু। দিদি কোথায়?’
বনবিহারী দেখলে গোটা পাঁচেক লুচি আর সুজি রয়েছে প্লেটে। বললেন, ‘সে বোধহয় ওপরে গিয়ে জল দেখছে।’
সোনা সিঁড়ির মুখে গিয়ে চেঁচাল, ‘অ্যাই ছোটু, দিদিকে নিয়ে নীচে আয়। জলখাবার দিয়েছি। অ্যাই ছোটু।’
ওপর থেকে সাড়া ভেসে এলে সোনা টেবিলের কাছে ফিরে এল। বনবিহারী বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলি। আমি পেটের রুগি। ওষুধ খাই। বেশি মশলা দিয়ে আমার জন্যে রান্না করো না।’
‘ও। শুধু সেদ্ধ করে দেব?’
‘অ্যা? না না। ঝোল-টোল করতে পারো তবে যতটা কম মশলা দেবে ততটা আমার উপকার হবে।’ বনবিহারী বললেন।
এই সময় ছোটু নেমে এসে বলল, দিদি নামতে চাইছে না।’
‘কী বলল? ওপরেই খাবার খাবে?’
‘কি করে বলবে? দিদি তো কথা বলতে পারে না।’
‘অ্যাঁ!’ সোনা তাকাল বনবিহারীর দিকে। তারপর সামলে নিয়ে একটা প্লেট তুলে দিল ছোটুর হাতে, ‘নিয়ে যা। ওপরেই খেয়ে নিক।’
বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা এখানে কী জল খাও?’
‘টিউবয়েলের জল এনে সেদ্ধ করে নিই।’ সোনা বলল।
খুশি হলেন বনবিহারী। সোনা চলে গেলে জলখাবার খেতে খেতে নদীর দিকে তাকালেন। নদী চওড়া হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও তিনি ভাবেননি এইভাবে লঞ্চে নদীর ওপর দিয়ে রুগি দেখতে যাবেন। কোথায় উত্তর বাংলার একটা সাধারণ গঞ্জ আর কোথায় সুন্দরবনের নদী! মধ্য পঞ্চাশে এসে এভাবে শেকড় তুলে আবার শেকড় নামানো কতখানি সম্ভব হবে তা এখনও বুঝতে পারছেন না। তবে যা করছেন তা নিতান্ত বাধ্য হয়েই। সাদা কথায় পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে। নিজে কোনও অপরাধ না করেও তো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। এখন মনে হল যদি পুলিশকে সবকথা খুলে বলতেন তাহলে কি হত? দুই-এক বছরের জন্যে জেলে থাকতে হত। লোকে তাঁর সম্পর্কে দুর্নাম ছড়াত। তার বেশি কিছু নিশ্চয়ই হত না। কিন্তু ওই বোবা মেয়েটাকে নিশ্চয়ই পুলিশ আরও বেশি শাস্তি দিত! বাচ্চাটা মানুষ হত অনাথ আশ্রমে। এইটে চাননি বলেই তাঁকে চলে আসতে হল এত দূরে।
হু-হু করে হাওয়া বইছে। লঞ্চের ছাদের ওপর পাতা চৌকিতে বসে মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছিল মামণি। ছোটু তার সামনে জলখাবারের প্লেট ধরলে সেটাকে চৌকির ওপর রাখতে ইশারা করল সে। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা হাওয়া এসে লুচিগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে নদীর বুকে ফেলে দিল। ছোটু চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই যাঃ। তখন থেকে বলছি খেয়ে নিন, খেয়ে নিন অথচ কানেই তুলছেন না। গেল তো সব! বোবারা কানে কালা হয় নাকি?’
ইঞ্জিনঘর থেকে কথাটা শুনতে পেয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রতন বলল, ‘এই ছোটু কার সঙ্গে কথা বলছিস তা ভুলে যাস না।’
‘আমি অন্যায় কী বলেছি? লুচিগুলো খেয়ে নিলে তো উড়ে যেত না।’
‘তাই বলে যে বোবা তাকে কালা বলবি? রতন ধমকাল, ‘ডাক্তারবাবু শুনলে কি ভাববেন? সোনাকে গিয়ে বল আর একটা প্লেট বানিয়ে দিতে।’
হঠাৎ মামণি লাফিয়ে উঠল। দূরে জলের ভেতর থেকে কিছু একটা উঠছে নামছে। ছোটু হেসে বলল, ‘ওটা শুশুক।’
মামণি রতনের দিকে তাকিয়ে শুশুকটাকে হাত বাড়িয়ে চিহ্নিত করে গোঙাতে লাগল। রতন জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বলছেন বুঝতে পারছি না।’
মামণি হাত দিয়ে লঞ্চটাকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল সে ওই প্রাণীর কাছে যেতে চায়। রতন মাথা নাড়ল। লঞ্চের গতিপথ পরিবর্তন করল সে।
ছোটু হাসল, ‘ওখানে যাওয়ার আগেই ওটা পালিয়ে যাবে।’
লঞ্চ এগোতেই শুশুকটা ডুবে গেল জলের গভীরে। দৌড়ে রেলিং-এর পাশে চলে গিয়েও তাঁকে খুঁজে পেল না মামণি। খুব হতাশ হল সে।
ছোটু চেঁচাল, ‘অত ঝুঁকে দাঁড়িও না। জলে পড়ে গেলে তোলা যাবে না।’ কথাটা কানেই গেল না মামণির।
রতন চেঁচাল, ‘ওনাকে নীচে নিয়ে যা।’
ছোটু পাশে গিয়ে ইশারা করল নীচে যাওয়ার জন্যে।
ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিল না মামণি।
ছোটু রতনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখলে?’
‘ভালো করে বল।’ বাতাস টপকে কথা বলল রতন।
‘কি বলে ডাকব? ছোটু জিজ্ঞাসা করল।
তোর যা ইচ্ছে তাই বল।’
‘ডাক্তারবাবুর কে হয় তা জানো?’
‘না।’
‘ওইটুকু বাচ্চার মা যখন তখন বউ হতে পারে না।’
‘কি করে বুঝলি? অনেকে বেশি বয়সেও বিয়ে করে।’
‘ধ্যাৎতেরিকা’, ছোটু বলল, ‘তাহলে দিদিই বলি।’
‘তাই বল।’
ছোটু চেঁচাল পাশে দাঁড়িয়ে, ও দিদি, দিদি?’
তার দিকে তাকাল মামণি। ছোটু বলল, ‘আপনাকে ডাক্তারবাবু নীচে ডাকছে। বাচ্চাটা কাঁদছে বোধহয়। চলুন।’
মাথার চুল হওয়ায় এলোমেলো, মুখে বিরক্তি। কিন্তু নীচের দিকে পা বাড়াল মামণি। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামাতে গিয়ে পিছলে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ছোটু ধরে ফেলায় আছাড় খেলো না।
নীচের ঘরে বসে জল দেখছিলেন বনবিহারী। তাঁর সামনে গিয়ে ইশারায় জানতে চাইল, মামণি, কেন ডাকছেন?
‘খাওয়া হয়েছে।’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে হাসিতে উচ্ছল হল মামণি। লুচি উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা প্রায় নাচের ভঙ্গি করে দেখাতে লাগল। ছোটু বুঝিয়ে দিতে মাথা নাড়লেন বনবিহারী। ছোটু বলল, ‘উনি রেলিং-এর কাছে গিয়ে বেশি ঝুঁকছিলেন। বিপদ হতে পারত। আমার কথা কানেই তুলছিলেন না।’
হঠাৎ মামণির মনে পড়ল বাচ্চাটার কথা। চারপাশে তাকিয়ে সে বনবিহারীকে জিজ্ঞাসা করল হাতের ইশারায়। বনবিহারী বললেন, ‘যাক, শেষ পর্যন্ত মনে পড়ল। ছোটু ওই কেবিনটা ওকে দেখিয়ে দাও।’
কেবিনের দরজাটা খোলাই ছিল। ছোটু দেখিয়ে দিতে সেখানে গিয়ে গালে হাত রাখল মামণি। অবাক হয়ে দেখতে লাগল। তাই দেখে বনবিহারী উঠে এলেন। কেবিনের বিছানায় উপুড় হয়ে একসঙ্গে দুটো হাত আর দুটো পা ছুড়ছে শিশু। আর সেইসঙ্গে মুখ থেকে মাঝে মাঝে অস্ফুট শব্দ বের করছে।
মামণি এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিতেই চিৎকার শুরু হল। কিছুতেই কোলে থাকবে না সে। বিরক্ত মামণি বিছানায় নামিয়ে দিতেই সে উপুড় হল। হয়ে আগের মতো হাত-পা ছুড়তে লাগল। এখন চিৎকার বন্ধ। বনবিহারী বললেন, ‘সামনেই জীবনের মহাসমুদ্র। তাই এখনই সাঁতার শেখার চেষ্টা করছে। ভালো, খুব ভালো।’