দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১৬

ষোলো

ব্রজ মণ্ডল একটা বিড়ি বের করল লুঙ্গির ভাঁজ থেকে। সেটার দু’দিকে দু’বার টান দিয়ে পরেশ মণ্ডলকে বলল, ‘আগুন আছে?’

পরেশ মণ্ডল অসন্তুষ্ট হল, ‘আচ্ছা, কেউ শুধু নিজের জন্যে আগুন চায়?’

‘কি করব! একটার বেশি তো নেই। থাকলে দাও নইলে পুঁটির মাকে ডাকতে হয়।’

পরেশ মণ্ডল অনিচ্ছায় দেশলাই এগিয়ে দিল। দুটো কাঠি খরচ করে বিড়িটা ধরিয়ে বেশ জোরে টান দিয়ে ব্রজ মণ্ডল জিজ্ঞাসা করল, ‘মেয়েটা ডাক্তারের কে হয়?’

‘কি হতে পারে?’

‘মেয়ে হতে পারে। মেয়ের বাচ্চা যখন আছে তখন জামাই কোথায়? আবার বেশি বয়সের বউও হতে পারে। তবে সেটা না বলেই মনে হয়।’ ব্রজ মণ্ডল মাথা নাড়ল। ‘কেন?’

‘অল্পবয়সি বউ হলে এর মধ্যে কত খুঁত ধরত। ঘ্যানঘ্যান করত। এ তো কথাই বলে না। ঠোঁট সেলাই করে বসে আছে।’

এই সময় বনবিহারী ওদের কাছে এগিয়ে এলেন, ‘পরেশবাবু, চলুন জায়গাটা একবার দেখে আসি। নদীর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।’

‘বেশ তো চলুন তবে দয়া করে আমাকে বাবু বলবেন না ডাক্তারবাবু। আপনি সম্মানিত লোক, বয়সেও বড়, আমাকে পরেশ বলেই ডাকবেন।’

‘বেশ তাই ডাকব।’

ব্রজ মণ্ডল বলল, ‘এতদূর রাস্তা ভেঙে এলেন। এখনই বের হবেন? একটু বিশ্রাম নিলে হত না? এই জায়গা আর নদী তো পালিয়ে যাচ্ছে না।’

‘না না, আমার এমন কিছু পরিশ্রম হয়নি যে বিশ্রাম নিতে হবে।’ বনবিহারী কথা শেষ করে দেখলেন পুঁটির মা প্রায় দৌড়ে ওপর থেকে নেমে আসছে। তাকে মামণির কাছে যেতে দেখে তিনি চলে এসেছিলেন। নীচে নেমে পুঁটির মা ইশারায় ব্রজ মণ্ডলকে ডেকে ভেতরে ঢুকে গেল উত্তেজিত ভঙ্গিতে। কৌতূহলী ব্রজ মণ্ডল দ্রুত তাকে অনুসরণ করল।

পরেশ মণ্ডল অবাক হয়ে বলল, ‘এটা কি হল?’

বনবিহারী বললেন, ‘মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা খুব উত্তেজিত হয়েছেন।’

ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ব্রজ মণ্ডল ‘আচ্ছা, ওই মহিলা আপনার মেয়ে বোধহয়, কথা বলতে পারে না?’ বোবা?’

‘হ্যাঁ, ও বাকশক্তিরহিত।’

‘আহা! ভগবানের কী লীলা! পুঁটির মা বলল শুধু গোঙানি ছাড়া কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না।’ ব্রজ মণ্ডল সহানুভূতিতে মাথা নাড়ল।

‘হ্যাঁ। ওকে ওর মতো থাকতে দিলে ও ভালো থাকবে। চলুন পরেশ।’ পা বাড়ালেন বনবিহারী। মাঝখানে অনেকটা খোলা জায়গা, চারপাশে ছোটখাটো দোকান। বেশিরভাগই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের। পাশাপাশি দুটো মাছ ধরার আড়ৎ। কিন্তু তার ঝাঁপ বন্ধ। পরেশ বলল, ‘এখানে তো ইলেকট্রিক নেই। পাইকাররা মাছ কিনে ট্রাকে চাপিয়ে পাঠাত। পাথরপ্রতিমা থেকে বরফ নিয়ে আসা হত লঞ্চে চাপিয়ে। অসুবিধে হচ্ছিল খুব। তাই ওই বেচাকেনা চলছে পাথরপ্রতিমাতেই।’

‘পাথরপ্রতিমা!’ বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘জায়গাটার নাম কাগজে পড়েছি।’

পরেশ হাসল, ‘মোটামুটি বর্ধিষ্ণু জায়গা। তবে আর একটি কারণে খ্যাতি আছে।’

‘কি কারণ?’

‘পাথরপ্রতিমার মেয়েরা পরিশ্রম করতে পারে। ডায়মন্ডহারবার-কলকাতা তো বটেই, দিল্লি-বোম্বেতেও ওরা চলে যাচ্ছে বাড়ির কাজ করতে। হাজার দেড় হাজার পাঠাচ্ছে বাড়িতে প্রতি মাসে। এরকমটা বোধহয় আর কোথাও দেখা যায় না।’ পরেশ বলল।

সামনেই একটা মন্দির। তিনজন লোক তার চাতালে বসো। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মন্দির দেখছি। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ কি হিন্দু?’

‘মিলিয়ে মিশিয়ে। তবে হিন্দুরা বোধহয় সংখ্যায় বেশি।’

‘এই যে পরেশবাবু। শুনছ—!’ একটা চিৎকার ভেসে আসতে পরেশ পাশ ফিরল। বনবিহারী দেখলেন লাঠি হাতে এক প্রৌঢ় একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসছেন।

‘বলুন হালদারমশাই।’

‘ব্যথাটা যে কমছে না। একটা ভালো মলম দাও।’

‘আপনি বরং ডায়মন্ডহারবারে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখান। আর অবহেলা করবেন না। তেমন বুঝলে কলকাতাতেই যান।’

‘আঃ। জ্ঞান দিও না তো। তুমি তো নিজের পকেটের পয়সায় কেনা ওষুধ আমাকে দিচ্ছ না। গৌরী সেনের টাকায় ওষুধ আসছে। খালে-বিলে বিলোচ্ছ, আমাকে দিলে তোমার পুণ্যি হবে। ইনি কে?’ প্রৌঢ় বনবিহারীকে দেখালেন।

‘ইনি আমাদের নতুন ডাক্তারবাবু, আজ এইমাত্র এসেছেন।’

‘আরে, এ তো দারুণ খবর। নমস্কার নমস্কার। দেখুন তো হাতের কাছে বাড়া ভাতের থালা আর পরেশ আমাকে ধান চাষ করতে মাঠে পাঠাচ্ছে। হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, আপনার চেহারা দেখে আমার সমীহ হচ্ছে। আপনার দেওয়া ওষুধে কাজ হবে। ওহো, পরেশ, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কি, আমার পরিচয়টা ওঁকে দাও।’ প্রৌঢ় লাঠিটা শূন্যে ঝুলিয়ে নিতে নিতে বললেন।

‘ডাক্তারবাবু, ইনি হলেন মাধবচন্দ্র হালদার। প্রচুর জমিজমা ছাড়া এখানকার পঞ্চায়েতের সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতা। নিজে পঞ্চায়েতের নির্বাচনে দাঁড়ান না, কিন্তু যারা নির্বাচিত হয় তারা সবাই ওঁর পছন্দের মানুষ। তিনটি বাস, চারটে টাক আছে। খুব বর্ধিষ্ণু পরিবারের কর্তা ইনি।’ পরেশ বলল।

‘ভটভটিগুলোর কথা বললে না?’ মনে করিয়ে দিলেন মাধবচন্দ্র।

‘ও হ্যাঁ। ঘাটে গেলে দেখবেন সবসময় একটা করে ভটভটি নৌকো যাত্রী নিয়ে কালজিরের বুকে ছুটে যাচ্ছে। এর সত্তরভাগের মালিক ইনি।’ পরেশ বলল।

‘তাহলে তো আপনি রীতিমতো ধনী ব্যাক্তি।’ বনবিহারী হাসলেন।

‘আজকাল কাউকে ধনী বললে গালাগালের মতো শোনায়। মনে হয় লোকটা গরিবের রক্ত চুষে ধনের ভাণ্ডার বাড়াচ্ছে। আমি তার উলটো। ওই যে ভটভটিগুলো, যারা চালায় তাদের বলেছি, তোরাই এখন থেকে নৌকোগুলোর মালিক। ডিজেল কিনবি, মেশিনটা ঠিকঠাক রাখবি। কত কামাচ্ছিস তা আমি দেখব না। দিন গেলে দুশো টাকা আমাকে দিলেই কৃতার্থ বোধ করব। ভাড়া বাবদ যা পাবি তার বাকিটা তোদের। ওরা খুব খুশি।’ সগর্বে বললেন মাধবচন্দ্র, ‘ছাড়ুন এসব কথা। আপনি এসে গেছেন বলে খুব ভরসা পাচ্ছি। আমার দুটো অসুখ আছে। যদি সারিয়ে দিতে পারেন তাহলে—!’

‘এখনই উনি এলেন, ওকে একটু স্থিতু হতে দিন। তারপর বলবেন।’ পরেশ বাধা দিল।

‘বেশ, বেশ। তাহলে আজ রাত্রের আহারটা আমার বাড়িতেই হোক।’ বললেন মাধবচন্দ্র।

বনবিহারী হাসলেন, ‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই যাব আপানার বাড়িতে। তার আগে সবকিছু বুঝে নিই। আমি এখানে নতুন, একটু পুরোনো হয়ে নিই।’

পরেশকে হাঁটতে দেখে বনবিহারী অনুসরণ করলেন। মাধবচন্দ্র বিরক্ত চোখে তাদের যেতে দেখলেন। হাঁটতে হাঁটতে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভদ্রলোক কি বাতের রোগী?’

‘ইউরিক অ্যাসিড খুব বেশি। তবু নিয়মিত ওষুধ খাবেন না। ভাবেন মলম মালিশ করলেই ব্যথা কমে যাবে। দু-দুবার বিয়ে করেছিলেন, ভাগ্যে স্ত্রী নেই। দুই ছেলে, দুই মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বছরখানেক হল ছোট মেয়ের মাসশাশুড়িকে বিয়ে করেছেন। ভদ্রমহিলা বিধবা ছিলেন। তাই নিয়ে খুব অশান্তি। ছেলে-মেয়েরা বছরখানেক হল রামগঙ্গায় আসছে না। কিন্তু বাপের প্রচুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকায় নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছে।’ পরেশ জানাল।

‘জামাই-এর মাসিকে বিয়ে করেছেন?’

‘আজ্ঞে। বছর চল্লিশকে বয়স। নিজেকে ইতিমধ্যেই রামগঙ্গার ফার্স্ট লেডি বলে মনে করছেন। এই যে, কালজিরের সামনে এসে গেছি।’ পরেশ হাত তুলল।

এখন বিকেল ফুরিয়ে যেতে যেতেও ফুরায়নি। বিরাট নদীটাকে কি চমৎকার মায়াময় বলে মনে হল বনবিহারীর। স্রোত রয়েছে। ঘোলাজল বয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। সামনেই বাঁধানো ঘাট। সেখানে দুটো ভটভটি নৌকো দাঁড়িয়ে। যাত্রীরা বসে আছে। ডানদিকে একটা বড় গাছের ডালে একটা মাঝারি লঞ্চ বাঁধা রয়েছে।

ভটভটি থেকে কেউ চিৎকার করল, ‘ও পরেশদা, যাবে নাকি?’

‘না হে। ডাক্তারবাবুকে সব ঘুরিয়ে দেখাতে এনেছি।’ পরেশ চিৎকার করে বলল।

‘ডাক্তারবাবু? নতুন ডাক্তারবাবু?’

‘হ্যাঁ হে।’

‘নমস্কার ডাক্তারবাবু।’ একটা লোক ভটভটির ওপর উঠে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর হাতজোড় করল। বনবিহারী হাত জোড় করলেন। ভটভটি চলতে শুরু করল।

পরেশ বলল, ‘এই হল আপনার বাহন। এতে করে আপনাকে সুন্দরবন চষে বেড়াতে হবে। আসুন আমার সঙ্গে।’

পাড় থেকে একটা তক্তা উঠে গেছে লঞ্চের ডেকে। পরেশ তাঁকে হাত ধরে তার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসতেই ডেকের ওপর জনা পাঁচেক মানুষ চলে এল। পরেশ বলল, ‘আমাদের নতুন ডাক্তারবাবু।’

সঙ্গে সঙ্গে ওরা নীচু হয়ে বনবিহারীর পায়ে হাত দিতে লাগল। বনবিহারী লক্ষ করলেন এদের বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি নয়।

‘এ হচ্ছে রতন। লঞ্চের পাইলট। দুর্দান্ত চালায়। জল-ঢেউ ওর কথা শোনে। এ হচ্ছে গৌরাঙ্গ, রতনের অ্যাসিস্টেন্ট। গুরুর কাছে ভালো তালিম পাচ্ছে। এ হচ্ছে সোনা। লঞ্চের কুক। ওর বাবা ফাটাফাটি রান্না করত। ও তার অর্ধেকটা পারে। এ হচ্ছে ছোটু আর ও হিরো। ওষুধের নাম ওদের মুখস্থ। হিরো ভালো ব্যান্ডেজ বাঁধতে পারে, ছোটুর ইনজেকশন দেওয়ার হাত চমৎকার, এই দুজন আপনার সহকারী।’

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওষুধের স্টক কীরকম?’

ছোটু বলল, ‘ওই তো মুশকিল। যা আছে তাতে হচ্ছে না। আগের ডাক্তারবাবু একটা লিস্ট দিয়ে গিয়েছিলেন পরেশদাকে—।’

পরেশ বাধা দিল, ‘এসে গেছে বাবা এসে গেছে। আজ সন্ধায় পাথরপ্রতিমায় পৌঁছে যাবে। রাত্রে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করব। কাল সকালে কাজে লাগাস। চলুন, লঞ্চটা ঘুরে দেখবেন।’

সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামলেন। রতন আলো জ্বালিয়ে দিল। দুপাশে দুটো কেবিন। একজন লোক এক-একটা কেবিনে শুতে পারে। বালিশ-বিছানা রয়েছে। মাঝখানের ঘরে টেবিল। সম্ভবত এখানেই পেশেন্ট দেখা হয়। দুপাশের আলমারিতে ওষুধ সাজানো রয়েছে। পেছনে রান্নাঘর এবং কর্মীদের শোওয়ার জায়গা। দুটো টয়লেট রয়েছে লঞ্চে।

বনবিহারী হিরোকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছোটখাটো অপারেশন কীভাবে করো তোমরা?’

‘আমরা তো করি না। আগের ডাক্তারবাবু শুধু পাকা ফোঁড়া কাটতেন। পুঁজ বের করে ব্যান্ডেজ করে দিতাম আমি।’ হিরো বলল।

‘এটা তো সুন্দরবনের শুরু। যেসব গ্রাম বনের ভেতরে আছে সেখানে নিশ্চয়ই বাঘ বা কুমিরের কামড়ে আহত হয় মানুষ। তাদের জন্যে কি ব্যবস্থা?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

পরেশ বলল, ‘তাদের জন্যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লঞ্চ আছে। তাড়াতাড়ি নিয়ে আসে পাথরপ্রতিমায় বা ডায়মন্ডহারবারে।’

ঘুরে লঞ্চের সামনের দিকের ডেকে উঠলেন বনবিহারী। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘বাঃ! সুন্দর।’

রতন বলল, ‘রামগঙ্গা ছাড়িয়ে কিছুটা গেলে, এখানে বসলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।’

একটা চওড়া বসার জায়গা দেখলেন বনবিহারী। স্বচ্ছন্দে দুটো লোক ওখানে শুতে পারে। বললেন, ‘এখানেও তো শোওয়া যায়।’

‘যায়। কিন্তু আমরা শুই না।’ রতন বলল।

‘কেন?’

‘রাতে খুব ঠান্ডা হাওয়া বয়। অসুখ করে যেতে পারে। তাছাড়া ভাটার টানে লঞ্চ পাড়ের দিকে চলে গেলে বাঘ স্বচ্ছন্দে চলে আসবে এখানে।’

সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছিল নদীর ওপর। পরেশ বলল, ‘এখন ফিরে চলুন। কাল সকাল সকাল বেরুতে হবে আপনাদের। লঞ্চেই খাওয়ার ব্যবস্থা। স্নানও এখানেই করতে পারবেন। সকাল আটটায় বের হলে সন্ধের মুখে ফিরতে পারবেন।’

‘এখান থেকে কতটা দূরে যাব আমরা?’

‘মুখে বললে ঠিক বুঝতে পারবেন না। জল ভেঙে তো যাওয়া। মোটামুটি ষোলটা গ্রাম ঘুরতে হয় আমাদের। ডাক্তারবাবু যখন চলে গেলেন তখনও ওষুধ দিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের। তা ধরুন, দিনে তিনটে গ্রাম ঘুরতে পারলেই এক হপ্তার কাজ হয়ে যায়।’ পরেশ বলল।

‘ওইসব গ্রামের নাম, কবে কোথায় যাচ্ছি—।’

‘কোনও চিন্তা করবেন না। কাল সকালেই আপনার হাতে রুটিন ধরিয়ে দেব। কবে কোন গ্রামে যেতে হবে। আপনাকে শুধু একটাই কাজ করতে হবে। খাতায় গ্রামের নামের পাশের ফাঁকা জায়গায় লিখবেন কজন পেশেন্ট দেখলেন। তাদের কি ধরনের অসুখ, কি কি ওষুধ দিতে হল আর কি কি ওষুধ দিতে পারলে উপকার হত কিন্তু সঙ্গে না থাকায় দিতে পারলেন না। আপনার এই রিপোর্ট হেড অফিসে পাঠাতে হবে। তারা ঠিকঠাক ছবি পাবেন। নতুন ওষুধ এসে যাবে তারপরেই।’

হাওয়া দিচ্ছিল। লঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন বনবিহারীরা। নদীর উলটো পাড়ে পাথরপ্রতিমায় আলো জ্বলছে এখন। ঝকমকাচ্ছে ইলেকট্রিক। এপাড় রামগঙ্গা ওর তুলনায় খুব ম্যাড়মেড়ে। কুপি বা লণ্ঠনের আলো যেমন হয় আর কি! বনবিহারীর খুব ভালো লাগছিল। জঙ্গল, চা-গাছের দেশ ছেড়ে এই জলের দেশে প্রথম আসার পর যে বৈচিত্র্য তা তো লাগবেই কিন্তু তার সঙ্গে বুনো গন্ধ টের পাচ্ছেন তিনি। মনে হচ্ছে এখানে তিনি খুব নিরাপদ।

‘তাহলে এবার ফেরা যাক। ডাক্তারবাবু ঝাল-মিষ্টি কি বেশি রান্নায় খান তা তোমরা জেনে নাও। সেই বুঝে কাল রাঁধবে।’ পরেশ বলল।

‘আমি সবকিছুই খাই, বেশি বাড়াবাড়ি রকমের না হলেই হল। বুঝলে পরেশ, আমার তো ইচ্ছে করছে এই লঞ্চের কেবিনেই থেকে যাই। যেখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, কাজ করেছি সেখানকার কেউ কখনও লঞ্চের দেখা পায়নি। বই-এ পড়েছি।’ বনবিহারী বেশ খুশি খুশি গলায় বললেন।

‘এক-আধদিন থাকতে পারেন। আমি বলব তার বেশি উচিত হবে না।’

‘কেন? এখানে তো সবই আছে।’

‘তা আছে। কিন্তু আপনি তো একা থাকবেন না। কোনও মহিলার পক্ষে ওই ছোট কেবিনে দিনের পর দিন বাস করা খুব কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া শিশু আছে। ঠান্ডা জলীয় বাতাস লাগবেই।’ পরেশ হাসল, ‘আপনি এখানে থাকতে চাইলে রতনরা অস্বস্তিতে পড়বে। বুঝতেই পারছেন।’

বনবিহারী পেছনে দাঁড়ানো রতনদের দিকে তাকালেন। ওরা হাসার চেষ্টা করল।

অন্ধকারে যেতে অসুবিধে হবে বলে লঞ্চের আলো জ্বালিয়ে ওরাই নামিয়ে দিল বনবিহারীকে। এখনও ভটভটি যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করছে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভটভটি সার্ভিস কখন বন্ধ হয়?’

‘গরমকালে রাত ন’টায় শেষ নৌকো যায়, শীতে সাড়ে সাতটায়।’

‘ঝড়বাদলে অসুবিধে হয় না?’

‘খু-উব। তবে এরা খুব এক্সপার্ট। তেমন বুঝলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। তখনই তো ঝামেলা লেগে যায়।’ পরেশ বলল।

‘কীরকম?’

‘মাধবদা কোনও যুক্তি শুনতে চান না। তাঁর প্রাপ্য দুশো টাকা তাঁকে দিতে হবেই। এরা বলে আবহাওয়ার জন্যে নৌকো বন্ধ ছিল। রোজগার হয়নি, দেবে কোত্থেকে? মাধবদার যুক্তি হল, চুক্তি মানে চুক্তি। যখন ভোর থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত গাদাগাদা টাকা এরা রোজগার করে তখন তো দুশোর বেশি দিতে আসে না।’ পরেশ বলল।

‘তারপর?’

‘চিৎকার-চেঁচামেচি, গালাগালি। শেষে একটা রফা হয়ে যায়।’

রামগঙ্গা এখন অন্ধকারে মোড়া। কয়েকটা দোকানে হ্যারিকেন জ্বলছে। মন্দিরে কাঁসর বাজছে। বনবিহারী শ্বাস নিলেন, ‘যাই বলো, লঞ্চে একটা রাত কাটাতেই হবে।’

‘সেটা দেখবেন আপনি হয়ে যাবে। তবে সারাদিন ওরা আপনাকে সমীহ করে চলবে, সেবা-যত্ন করবে। তারপরেও যদি পাকাপাকি আপনি লঞ্চে থেকে যান তাহলে ওদের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। একটু-আধটু ফুর্তি করা বন্ধ হয়ে যাবে।’ পরেশ হাসল, ‘হাড়ভাঙা খাটুনির পর আপনার সামনে বাংলা নিয়ে কি করে বসবে?’

‘ও।’ গম্ভীর হলেন বনবিহারী।

বুঝতে পেরে পরেশ বলল, ‘তাই বলে ভাববেন না ওরা মদ খেয়ে মাতলামি করে! লঞ্চে বসে মদ খাওয়া ঠিক নয়। হেড অফিস জানলে ওদের চাকরি চলে যাবে। কিন্তু বাড়াবাড়ি করে না যখন তখন ও ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। আপনিও হয়তো কোনওদিন জানতে পারবেন না। কিন্তু আপনি তো আর হেড অফিসের লোক নন, তাই বললাম।’

এইসময় একজন লোক অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল, ‘পরেশদা, দিয়ে এলাম।’

‘আবার আমার খরচা বাড়াবি ভাই। আমি তো পৌনে ন’টার ভটভটিতে চাপব। যেতে যেতে সোওয়া ন’টা। ততক্ষণে ঠিক পচে যাবে।’

‘না গো। তোমাকে দিইনি আজ। খবর পেলাম নতুন ডাক্তারবাবু এসেছেন। তা দুটো দেড় কেজির ভেটকি পেয়েছিলাম। একটা দিয়ে এলাম।’ লোকটি বলল।

‘সর্বনাশ। কাকে দিলি?’

‘ওই যে, ব্রজদার বউকে। ডাক্তারবাবুরা তো আজ রান্নাবান্না করছেন না। তাই ব্রজদার বউ বলল, তিনিই রান্না করে দেবেন।’

‘দামটা তিনিই দেবেন তো?’

‘ছি ছি ছি। কি যে বলো! ডাক্তারবাবু প্রথম এলেন রামগঙ্গায়। আজ আমি তাঁকে ওটা না হয় এমনি খেতে দিলাম।’

‘তাহলে নমস্কার করে ফ্যাল। ইনিই সেই ডাক্তারবাবু!’

‘তাই বল।’ ধুপ করে প্রণাম করল লোকটা, ‘আমি মাখন।’

‘কিন্তু মাখন, বিনা পয়সায় মাছ দেবে কেন? কত দাম বলো?’

‘তা হয় না ডাক্তারবাবু। এই যে ব্রজদার বউ রেঁধে দেবেন, আপনি সেই রান্নার দাম নিশ্চয়ই দেবেন না। আচ্ছা চলি।’ লোকটা যেমন এসেছিল তেমনি উধাও হয়ে গেল।

পরেশ বলল, ‘তাহলে আজ চলি। অফিস বন্ধ করতে হবে।’

‘কাল সকালে লঞ্চে দেখা হবে। বনবিহারী বললেন।

‘না। আমি ডাঙার লোক। লঞ্চে ওঠার হুকুম নেই। আমি যখন ভটভটিতে এখানে আসব ততক্ষণে আপনার লঞ্চ অনেক দূরে।’ পরেশ নমস্কার করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *