দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১৫

পনেরো

ব্যাপারটা এত সহজে হয়ে যাবে ভাবতেই পারেননি বনবিহারী। হোটেলে ফেরার পথে তাঁর যেমন খুব হালকা লাগছিল তেমনি অস্বস্তিও বাড়ছিল একসঙ্গে। কালীচরণকে জানাতে হবে। সে সঙ্গে না থাকলে আজকাল বেশ অসুবিধে হয়। দীর্ঘদিনের অভ্যেস থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। ভেবেছিলেন, ওকে চলে আসতে বলবেন। কিন্তু কালীচরণ এলে ওই বাড়িটার কি হবে? বাড়িটাকে বিক্রি করতে তিনি যদি ফিরে যান তাহলে কথা উঠবেই। ওই পালবাবু বা তার ড্রাইভার শম্ভুই প্রচার করবে। বাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে পড়তে হবে। আবার কালীচরণ যদি চলে আসে তাহলে বন্ধ বাড়িটা যে দুদর্শায় পড়বে তা কল্পনা করে শিহরিত হলেন বনবিহারী। যে বাড়িটায় এতকাল কাটিয়েছেন, তার ওপর যে মায়া তাঁর আছে তাতে ওটাকে পোড়োবাড়ি বলে ভাবতেই পারছেন না। আর মানুষ যদি বাস না করে তাহলে পাঁচভূতে বাড়িটা লুটেপুটে খাবে। কিন্তু তিনি নিয়মিত টাকা পাঠালেও কালীচরণ বেশিদিন ওখানে একা থাকতে চাইবে না।

হোটেলে ঢুকতেই একজন বেয়ারা বলল, ‘দিদি এখনও ফেরেননি।’

‘ফেরেনি মানে? কোথায় গিয়েছে?’

‘জানি না। বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছিল। আপনাদের ফ্লোরের বেয়ারাকে ইশারায় ডেকে বসতে বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেছেন। বেয়ারা কোনও কাজ করতে পারছে না। ওখানে আটকে গেছে।’

বনবিহারী দ্রুত ওপরে উঠে এলেন।

ঘরে ঢুকে দেখলেন বেয়ারা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তাঁকে দেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওঃ কি বিচ্ছু বাচ্চা! কিছুক্ষণ পরপর চোখ খুলে দেখছে আমি আছি কিনা। না দেখতে পেলেই হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে। আপনি এসে গেছেন, আমি যাচ্ছি।’

 বেয়ারা চলে যেতে বাচ্চা চোখ খুলল। বনবিহারীকে দেখে একগাল হেসে পা ছুড়ল। দৃশ্যটি এত ভালো লাগল বনবিহারীর যে ওর পাশে না বসে পারলেন না। নীচু হয়ে বললেন, ‘আর একবার হাসো বাবু, ঈশ্বরদর্শন করি।

হাসির বদলে কান্না দেখা দিল। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠল বাচ্চা। দ্রুত ওকে কোলে তুলে নিয়ে দোলাতে লাগলেন বনবিহারী, ‘আহা-হা! কেঁদো না কেঁদো না, মা এখনই এসে যাবে।’

বলামাত্র খেয়াল হল। মামণি কোথায় গেল? কলকাতার রাস্তায় অনভ্যস্ত একটি বোবা মেয়ে যদি পথ গুলিয়ে ফেলে তাহলে ফিরে আসা মুশকিল হয়ে যাবে। তাছাড়া এই শিশু জন্মাবার পরে কালীচরণের যত্নে মামণি যথেষ্ট সুন্দরী হয়ে উঠেছে। কলকাতায় লোভী নারীশিকারিদের অভাব নেই। বনবিহারী ভেবে পাচ্ছিলেন না মেয়েটা এভাবে বাইরে বের হল কেন?

তখনই তাঁর মাথায় আর একটা ভাবনা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল। এই শিশুকে তাঁর জন্যে ফেলে রেখে মামণি চিরদিনের জন্যে চলে যায়নি তো? কালীচরণ মাঝে মাঝে গজরাত, ‘এ কেমন মা, ছেলেটা সারারাত হেগেমুতে শুয়ে থাকল, একবারও উঠে দ্যাখেনি।’ এক-এক সময় বনবিহারীরও সেরকম মনে হত কিন্তু আবার মাঝে মাঝেই শিশুর ওপর ওর প্রবল স্নেহের দৃশ্যও দেখেছেন।

কিন্তু যে শিশু ওর শরীরে এসেছিল হঠাৎই, যাকে বহন করতে ও বাধ্য হয়েছিল অন্য কোনও পথ জানা না থাকায়, তার কাছ থেকে নিষ্কৃতি পেতে ও চাইতেও পারে। গঞ্জে সেটা সম্ভব ছিল না। মামণি জানত বাড়ির বাইরে বের হলেই সে অনেক ঝামেলায় পড়বে। প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তাকে। তাই সেই চেষ্টা সে করেনি। এই কলকাতার হোটেলে এসে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করল।

শীত করতে লাগল বনবিহারীর। এরকম হলে তিনি মামণিকে আদৌ বুঝতে পারেননি। শুধু বুদ্ধিমতী নয়, অত্যন্ত চতুর না হলে এরকম অভিনয় তাঁর সঙ্গে করে যেতে পারত না। কে জানে, হয়তো এই কলকাতা শহরে ওর পরিচিত কেউ আছে, সেই ছেলে ওদের দলের হওয়াও অসম্ভব নয়। মামণি মেনকার মতো শকুন্তলাকে ফেলে রেখে তার কাছে চলে যেতেই পারে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা কেটে গেল। বাচ্চাটা এখন চুপচাপ ঘুমাচ্ছে। বনবিহারী ছটফট করছেন। মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে তিনি যা ভাবছেন তা সত্যি নাও হতে পারে। হয়তো পথ হারিয়ে ফেলে এলোমেলো ঘুরছে মামণি। কিন্তু ও লিখতে জানে। এই হোটেলের নামটা মনে রাখলে সে লিখে পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে পারে। তা যখন চাইছে না তখন ভাবনাটা মিথ্যে নয়। এতদিন মেয়েটা তাঁর সঙ্গে আছে, একবারও লিখে ওর ঠিকানাটা জানায়নি। এমন কি নামও! নিজের ইতিহাস সযত্নে গোপন রেখে গেছে যে মেয়ে তার মাথায় এরকম মতলব থাকাই স্বাভাবিক। ওইটুকু মেয়ে কীরকম বোকা বানিয়ে দিল তাঁকে!

এখন তিনি কি করবেন? এইটুকু বাচ্চাকে সামলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সুন্দরবনে যে কাজের জন্যে যাচ্ছেন সেখানে একে রাখবেন কোথায়? কে দেখবে একে? ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে তাকালেন তিনি। আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে বেচারা। দেখলেই মায়া মনে আসে। বেচারা কোনওদিন জানবে না ওর বাবা কে ছিল, মায়ের সঠিক পরিচয় কি?

এখন কালীচরণকে চলে আসতে বলা ছাড়া কোনও উপায় নেই। সে এসে কিছুদিন ঠেকা দিক তারপরে বিকল্প ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

কিন্তু কালীচরণকে চিঠি লিখে জানিয়ে তার আসার জন্যে অপেক্ষা করার মতো সময় তাঁর হাতে নেই। অন্তত দিন পাঁচ-ছয় হোটেলে থাকতে হবে তাঁকে। অথচ নতুন চাকরিতে তাঁকে অনেক আগেই জয়েন করতে হবে। আরজেন্ট টেলিগ্রাম করলে কালীচরণ কালই জেনে যাবে। যদি বুদ্ধি করে কাল রাত্রে ট্রেন ধরে তাহলে পরশু পৌঁছে যাবে কলকাতায়। কালীচরণের নামে টেলিগ্রাম গেলে গঞ্জের লোক তা জেনে যেতে পারে আবার নাও পারে। সেই ঝুঁকি নিতেই হবে। বনবিহারী উঠলেন। একজন বেয়ারাকে ডেকে অনুরোধ করবেন যাতে সে কিছুটা সময় বাচ্চার পাশে বসে। এই ফাঁকে তিনি টেলিগ্রামটা করে আসতে পারবেন।

কিন্তু দরজা খুলতেই তিনি ম্যানেজারকে দেখতে পেলেন। হন্তদন্ত হয়ে এসে ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনাকে এখনই বউবাজার থানায় যেতে হবে।’

ছ্যাঁক করে উঠল বুক, গলা শুকিয়ে গেল বনবিহারীর, ‘কেন?’

‘তা জানি না। থানা থেকে ফোন এসেছিল। আপনার নাম করে বলল, এখনই ওই ভদ্রলোককে চলে আসতে বলুন।’ ম্যানেজার বললেন।

‘ও।’

‘কথায় বলে পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। কোনও ক্রিমিন্যাল ব্যাপার হলে কিন্তু আপনাকে হোটেল ছেড়ে দিতে হবে।’

‘থানাটা কোথায়?’

হদিশ জেনে নিয়ে বনবিহারী অনুরোধ করলেন তিনি না ফেরা পর্যন্ত যদি কেউ বাচ্চাকে দ্যাখে তাহলে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবেন। ম্যানেজার অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন।

বনবিহারী থানায় গেলেন। পরিচয় দেওয়ার পর বড়বাবুর ঘরে ঢোকার অনুমতি পেলেন। ঘরে ঢুকে নমস্কার করতেই মধ্যবয়সি ভদ্রলোক বললেন, ‘বসুন। আপনার মেয়ের নাম মামণি? নর্থবেঙ্গল থেকে এসেছেন?’

প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ ছিল না। দ্বিতীয় প্রশ্নটি থাকায় বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপরেই উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে ওর?’

‘ওর তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু দুটো ছেলেকে বেশ জখম করেছে।’

‘বুঝলাম না!’

‘ও যখন কথা বলতে পারে না তখন ওকে একা ছেড়েছিলেন কেন?’

‘আমার অজান্তেই ও বেরিয়ে যায়। এই প্রথম কলকাতায় এসেছে। বোধহয় কৌতূহলে—! কিন্তু কি হয়েছিল?’ বনবিহারীর উত্তেজনা কমে গিয়েছিল। না, গঞ্জের পুলিশ কোনও খবর পাঠায়নি।

‘সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে হোর্ডিং দেখছিল। হিরো-হিরোইনের ছবি। ওকে একা পেয়ে দুটো ছেলে কাছে ঘেঁষতে চায়। কোনও প্রস্তাব দেয়। সম্ভবত ও হেসেছিল তাতে ছেলে দুটোর মনে হয় প্রশ্রয় পাচ্ছে। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ওকে উঠতে বলে। ও সেটা উপেক্ষা করায় একজন কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ও হাত চালায়। ছেলে দুটো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেদম ঠ্যাঙায়। পাবলিক ভিড় করে এই দৃশ্য দ্যাখে। সেসময় আমাদের একটা পেটল জিপ ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। তিনজনকেই তুলে আনা হয় থানায়। কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ও বোবা। কি ঘটেছিল মুখে না বলতে পারলেও লিখে দিয়েছে। তখনই জানতে পারলাম ও হোটেলে উঠেছে, ওর নাম মামণি, নর্থ বেঙ্গল থেকে যাঁর সঙ্গে এসেছে তাঁর নাম বনবিহারী। হোটেলে ফোন করলে ম্যানেজার বলল আপনি মামণির বাবা।’ বড়বাবু বললেন।

‘এখন—!’

‘এখন আপনারা ছেলে দুটোর বিরুদ্ধে ইভটিজিং করেছে বলে ডায়েরি করতে পারেন। কিন্তু ওরাও মামণির বিরুদ্ধে মারধোরের নালিশ করতে পারে। আমি বলছি, যথেষ্ট শাস্তি পেয়ে গেছে ছেলে দুটো। আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে চুপচাপ হোটেলে যান। সোজাসুজি যাবেন না। একটু ঘুরপথে ট্যাক্সি নিয়ে যাবেন যাতে ছেলেদুটো হদিশ না পায়। ওদের আমি আরও একঘণ্টা বাদে ছাড়ব।’ বড়বাবু বললেন।

‘ওরা কি প্রতিশোধ নিতে পারে?’ বনবিহারী চিন্তিত।

‘সেটাই স্বাভাবিক। এদের তো কোনও পিছুটান নেই।’

‘মামণি কোথায়?’

‘আপনি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে থানার সামনে আসুন, আমার এক মহিলা কনস্টেবল ওকে ট্যাক্সিতে তুলে দেবে। আপনার সঙ্গে মেয়েটাকে কেউ দেখুক আমি চাইছি না।’ বড়বাবু বললেন।

বড়বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে থানার বাইরে আসতেই একটা ট্যাক্সি দেখতে পেলেন বনবিহারী। কোনও যাত্রী নেই। ড্রাইভারকে যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলে সে মাথা নাড়ল, ‘যাব বলেই তো দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় যাবেন?’

হোটেলের রাস্তাটা বলতে লোকটা হাসল। ‘মিটার ডাউন করতেই পৌঁছে যাবেন। এত কম রাস্তায় পোষায় না। আপনি পাঁচ টাকা বেশি দেবেন।’

‘আমি সোজা হোটেলে যাচ্ছি না, একটু ঘুরে যাব।’

‘তাহলে এক্সট্রা দিতে হবে না।’

বনবিহারী পেছন ফিরে দেখলেন একজন মহিলা মামণিকে সঙ্গে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে মামণি হাসল। বনবিহারী গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ওঠো।’

ট্যাক্সিওয়ালাকে ধর্মতলায় যেতে বললেন বনবিহারী। গাড়ি চলতে শুরু করলে মামণি হাউমাউ করে নিজের ডান হাতের কবজি দেখাতে লাগল। বনবিহারী দেখলেন সেখানে কালশিটে পড়ে গেছে। এক নাগাড়ে মুখাভিনয় করে যেতে লাগল মামণি। কীভাবে ছেলেটা ওকে ধরেছিল, কীভাবে সে ওদের মেরেছে। তারপর হঠাৎই চুপ করে গিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত নেড়ে জিজ্ঞাসা করল সে ঠিক করেছে কিনা!

কী বলবেন ভাবতে সময় লাগল। তারপর বনবিহারী ডান হাত ওর মাথায় রেখে ঈষৎ চাপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাছে চলে এল মামণি।

বনবিহারী বললেন, ‘যা করেছ ঠিক করেছ। কিন্তু কাউকে না বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলে কেন? ছেলেটার কথা একবারও চিন্তা করলে না? বেচারা সমানে কেঁদে গেছে। ভুলে যেও না, তুমি একজন মা। আর মাকে না পেলে সন্তান ভালো থাকে না।’

মামণি চুপ করে থাকল। কলকাতার খানিকটা ঘুরিয়ে মামণিকে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলেন বনবিহারী।

কালীচরণকে এখনই আসতে বলার আর দরকার নেই। অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার নিয়ে বনবিহারী জানলেন দুরকম পথে তাঁর কর্মস্থলে যেতে পারেন। টেনে লক্ষ্মীকান্তপুরে নেমে বাস ধরতে হবে। অথবা ধর্মতলা থেকে রামগঙ্গার সরাসরি বাস পাওয়া যায়। সকাল সাতটায় ছেড়ে সেটা রামগঙ্গায় পৌঁছয় বেলা এগারোটায়। আবার দুপুর একটায় কলকাতার পথ ধরে।

দিনটা কেনাকাটা করে কাটালেন। মামণি তাঁর কথা শুনে হোটেলের ঘর ছেড়ে বের হয়নি। মেয়েটার সম্পর্কে যা ভেবেছিলেন তা ঠিক নয়। ও এখনও শিশুসুলভ কৌতূহলে উলটোপালটা কাজ করে, মোটেই মতলববাজ নয়। এমনকী মহিলাসুলভ আচরণ করার ব্যাপারেও ও সতর্ক নয়। হোটেলের ঘরে জামাকপড় ছাড়ার সময় বনবিহারীর উপস্থিতি গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। উলটে লজ্জা পেয়েছেন বনবিহারী। অকারণে বাথরুমে ঢুকে গেছেন।

সকাল সাতটার সরকারি বাস র্ধ্মতলা ছাড়লে বনবিহারী স্বস্তি পেলেন। থানায় বড়বাবুর কথাটা কানে ছিল। কলকাতার গুন্ডা ছেলেছোকরাদের বিশ্বাস নেই। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই মামণির সন্ধান পায়নি। এখন কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মানে ওদের সম্পর্কে ভয় পাওয়ার আর কোনও কারণ নেই। জানলার পাশে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল মামণি। ছেলের ঘাড় একটু শক্ত হয়েছে। বনবিহারী বললেন, ‘ওই দ্যাখো, ওটাকে মনুমেন্ট বলে। আমাদের বাঁ-পাশে এবার ময়দান। ইংরেজিতে বলে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড।’

যেতে যেতে বনবিহারী জায়গাগুলোকে চেনাচ্ছিল। কলকাতা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর তিনি মুখ বন্ধ করলেন। এখন থেকে তাঁর অজানা জায়গাগুলো আসছে।

ডায়মন্ডহারবার, নামখানা হয়ে ওঁরা যখন রামগঙ্গার দিকে এগোচ্ছেন তখন বিরাট বাসটাকে নৌকো বলে মনে হচ্ছিল। গতি খুব কম, বাঁদিক-ডানদিকে দুলছে খারাপ রাস্তার জন্যে। মামণি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে জানলায় মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। ডায়মন্ডহারবারে বাস কিছুক্ষণ থামায় ওকে পুরি-তরকারি খাইয়ে দিয়েছিলেন। এতকাল বাইরের খাবার একদম খেতেন না বনবিহারী। আজ বাধ্য হয়ে দুটো রসগোল্লা খেয়েছেন। রসগোল্লা দেখে মামণি ঠোঁট বেঁকিয়েছিল।

রাস্তা একটু ভালো হতেই বাস গতি বাড়াল। সরু রাস্তা। আশে পাশে চাষের খেত, দূরে গ্রামের ঘরবাড়ি। এতক্ষণে সুন্দরবনের কাছাকাছি এসে যাওয়ার কথা। বনবিহারী লক্ষ করলেন যাত্রীদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। লক্ষ্মীকান্তপুরের মোড় ছাড়াবার পরে তো তাঁদের নিয়ে জনা পাঁচেক যাত্রী বাসে রয়েছেন।

শেষপর্যন্ত দূরে জঙ্গলের আভাস পাওয়া গেল। বাতাসে অন্যতর গন্ধ। মোটামুটি গঞ্জমতন একটা জনপদে বাস গিয়ে থামল। কন্ডাক্টর হাঁকলেন, ‘রামগঙ্গা।’

মামণিকে জাগিয়ে স্যুটকেস এবং ব্যাগ নিয়ে নীচে নামলেন বনবিহারী। বাচ্চাকে নিয়ে নেমে আসতে একটুও অসুবিধে হল না। বনবিহারী দেখলেন চারপাশে গ্রাম্য দোকান, একটা গ্যারেজ, রাস্তা মাটির। মাটির রং দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে পলিমাটি জমে আছে।

‘নমস্কার।’

বনবিহারী পেছন ফিরে দেখলেন লুঙ্গি এবং শার্ট পরা এক মধ্যবয়সি মানুষ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। বনবিহারী মুখেই বললেন, ‘নমস্কার!’

‘আপনি কি ডাক্তারবাবু?’ লোকটি বিনীত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ। আমি ডক্টর বনবিহারী—।’

‘সুস্বাগতম, সুস্বাগতম! আমি পরেশ মণ্ডল স্যার। কালই কলিকাতা অফিস থেকে খবর পেয়েছি। আপনার আসার অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছি। দিন, স্যুটকেসটা আমাকে দিন।’

‘না না। এটাকে নিতে কষ্ট হচ্ছে না।’ বনবিহারী প্রতিবাদ করলেন।

ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগল পরেশ মণ্ডল। ‘বদনাম হয়ে যাবে। লোকে আমাকে প্রচুর কুকথা শোনাবে। এই বাদা অঞ্চলে আপনি এখন থেকে ওদের কাছে ভগবান। বলবে—।’ কথা শেষ না করে চিৎকার করল সে, ‘অ্যাই ছোট্টু—। জলদি আয়। জলদি।’ একটি যুবক, যার পরনে শার্ট-ফুলপ্যান্ট, দৌড়ে এল।

পরেশ মণ্ডল বলল, ‘প্রণাম কর। স্যার এসে গেছেন। এর নাম ছোট্টু। ভালো নাম, ভালো নামটা যেন কি?’

ছোট্টু বনবিহারীকে প্রণাম করে মামণির পায়ের দিকে হাত বাড়াতেই মামণি তিড়িং করে লাফিয়ে অন্যপাশে সরে গেল। হাল ছেড়ে দিয়ে ছোট্টু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজ্ঞে কামাখ্যাচরণ।’

ছোট্টুর শরীরে শক্তি আছে। অতএব স্যুটকেস-ব্যাগের দায়িত্ব তাকেই দিতে হল।

হাঁটতে হাঁটতে পরেশ মণ্ডল বলল, ‘এই জায়গার নাম রামগঙ্গা। আপনি আসছেন শুনে তড়িঘড়ি কাল ব্রজ মণ্ডলের দোতলা ভাড়া নিয়েছি। মাসে আড়াইশো দেবেন। আমাদের যাবতীয় কাজ-কারবার এই রামগঙ্গায়। অফিসটাও এখানে। কিন্তু সমস্যা হল, এখানে এখনও ইলেকট্রিক আসেনি। সন্ধের পর মোমবাতি বা হ্যারিকেন জ্বালতে হয়।’

‘সর্বনাশ। এই গরমকালে পাখা ছাড়া মানুষ থাকে কি করে?’

‘অভ্যাস স্যার। অভ্যাসে কত কি সম্ভব হয়ে যায়।’ পরেশ মণ্ডল বলল, ‘অথচ দেখুন নদীর ওই পারে ইলেকট্রিক আছে। আলো জ্বলছে পাখা ঘুরছে।’

‘ওপারের নাম কি?’

‘আজ্ঞে পাথরপ্রতিমা। নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন?’

বনবিহারীর মনে হল সেকথা। না শুনলেও খবরের কাগজে বোধহয় পড়েছেন।

একটা ছোটখাটো দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পরেশ মণ্ডল হাঁকল, ‘বজ্রদা, অ ব্রজদা। বাইরে এসো।’

খাটো চেহারার একটি মানুষ লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বাইরে বেরিয়ে এসেই থমকে গেলেন। নগ্নবুকে হাত বোলালেন হেঁ হেঁ, বলবে তো, হেঁ, হেঁ—।’

‘ডাক্তারবাবু এসে গেছেন। তোমার কপাল কি ভালো। এখন বাড়িতেই ডাক্তারবাবু থাকলে রাতবিরেতে হাহুতাশ করতে হবে না। নাও, দরজা খুলে দাও।’ পরেশ মণ্ডল বলল।

ব্রজ মণ্ডল গলা তুলল, ‘পুঁটির মা চাবিটা নিয়ে এসো।’

তৎক্ষণাৎ ঘোমটায় মুখ ঢাকা এক মহিলা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে চাবি দিয়ে দিলেন। দোতলার সিঁড়ি বাড়ির ভেতর দিয়ে নয় দেখে স্বস্তি পেলেন বনবিহারী। ওপরের ঘরের সাইজ বেশ ছোট। দুটো ঘর, একটা রান্নাঘর আর বাথরুম। ব্রজ বলে যেতে লাগল, ‘রাম গঙ্গায় যে তিনটে বাড়িতে পাম্প আছে তারা জেনারেটার চালিয়ে জল তোলে। আমার জেনারেটার নেই। লোক ঠিক করে দেব, দু-বেলা খাওয়ার জল, রান্নার জল, স্নানের জল তুলে দিয়ে যাবে। ওসব নিয়ে মোটেই ভাববেন না। এখন বলুন, সব পছন্দ হয়েছে তো?

‘ঠিক আছে।’ বনবিহারী বলতে বাধ্য হলেন।

‘খাট-বিছানা নিয়ে আসা সম্ভব নয়।’

পরেশ মণ্ডল বলল, ‘দুটো তক্তাপোশ আর বিছানা বিকেলের মধ্যে ভাড়া করে পাঠিয়ে দেব। আমি বলি কি আজ দুপুরের স্নানখাওয়া আপনি, মানে আপনার লঞ্চেই করুন।’

‘লঞ্চ?’

‘হ্যাঁ। আমাদের কোম্পানির লঞ্চ। রোজ সকালে ওটায় চড়ে তো যেতে হবে বিভিন্ন গ্রামে পেশেন্ট দেখতে।’ পরেশ মণ্ডল বলল।

তৃতীয় জানলায় গিয়ে দাঁড়াতে বিরাট নদী চোখে পড়ল। নৌকো পারাপার করছে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই নদীর নাম কি?’

পরেশ মণ্ডল বলল, ‘কালজিরে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *