দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১৪

চোদ্দো

পাঁচ দিনের মাথায় চিঠি এল। এনজিও সংস্থাটি বনবিহারীকে কলকাতার অফিসে গিয়ে অবিলম্বে দেখা করতে বলেছে। চার লাইনের ঝরঝরে ইংরেজিতে লেখা চিঠি। বলা হয়েছে চিঠি লেখার সাতদিনের মধ্যে যেতে হবে। কলকাতা থেকে চিঠি আসতে চারদিন লেগে গেল, এত দেরি সচরাচর হয় না। কিন্তু সময়টা রাখতে হলে আজ রাত্রেই রওনা হতে হয়। এত তাড়াতাড়ি সেটা কি করে সম্ভব?

কালীচরণকে ডাকলেন তিনি। প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মামণি কোথায় আছে?’

‘বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে।’

‘শোন। আমাকে একটা জরুরি কাজে আজই কলকাতায় যেতে হবে। চারদিনের মধ্যে ফিরে আসব। এই ক’টাদিন ওদের নিয়ে সাবধানে থাকতে হবে তোমাকে।’ বনবিহারী বললেন।

‘চারদিন? আপনি থাকবেন না? ওঃ ব্বাবা!’

‘কেন কি হল?’

‘ওদের নিয়ে থাকতে আমি পারব না।’

‘কেন?’

‘আপনার ভয় দেখিয়ে মামণিকে রোজ বাড়িতে আটকে রাখছি। আপনি না থাকলে ও সাপের পাঁচ পা দেখবে। একবার বাড়ি থেকে বের হলে লোকের মুখ বন্ধ থাকবে না।’

‘আমি ওকে বলে যাব যাতে বাড়ির বাইরে না যায়।’

‘আপনি এখানে থাকলে একরকম হবে! তাছাড়া আশেপাশের লোকজন তো উঁকিঝুঁকি মারবে। কাকে আমি কি গল্প বলব! তার চেয়ে আপনি ওদের সঙ্গে নিয়ে যান!’

‘আমি যাচ্ছি কাজে, ওদের সঙ্গে নিয়ে কোথায় রাখব?’ কথাটা বললেন বটে কিন্তু মনে হল এছাড়া কোনও উপায় নেই। কেউ জিজ্ঞাসা করলে কালীচরণ বলবে তিনি ভাগনিদের মালদায় পৌঁছতে গিয়েছেন। কলকাতায় গিয়ে যে হোটেলে উঠবেন সেখানে দুটো ঘর নিতে হবে। মামণি যদি বাইরে বের হয় তাহলে ওখানে কেউ ওকে চিনবে না। কৌতূহলীও হবে না। তারপর যদি মামণিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোনও আশ্রমে রেখে দিতে পারেন তাহলে তো কথাই নেই।

কিন্তু আর একটা চিন্তা মাথায় এল।

যদি ফিরে আসতে হয়? যদি তাঁকে ওরা চাকরির পক্ষে উপযুক্ত বলে মনে না করে? তাহলে এখানে ফিরে না এসে মধুপুর-গিরিডি লাইনের মহেশমুন্ডায় গিয়ে দেখতে হবে জমি অক্ষত আছে কিনা। থাকলে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করে ফিরতে হবে এখানে। ব্যাপারটায় অনেক ঝামেলা আছে। মামণিরা সঙ্গে থাকলে সেটার সমাধান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। অথচ ওদের এখানে রেখে যেতে স্বস্তি বোধ করছেন না বনবিহারী।

শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক করলেন তিনি। শেষ রাত্রে ট্রেন ধরলে কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু ওইসময় দশ মাইল দূরের স্টেশনে পৌঁছতে গাড়ি দরকার। দুটো ট্যাক্সি এখানে থাকে, বললেই চলে আসবে কিন্তু সবার কানে কথাটা পৌঁছে যাবে। পালবাবুর সাহায্য নিলে তিনি খবরটা ফাঁস করতে চাইবেন না এমন আস্থা তাঁর হয়েছে।

আজ সন্ধ্যাবেলায় চেম্বার খুললেন না তিনি। একটা বড় কাগজে লিখলেন, ‘বিশেষ প্রয়োজনে এখন চেম্বার বন্ধ থাকবে।’ কালীচরণকে বললেন কাগজটা চেম্বারের বন্ধ দরজায় সেঁটে দিয়ে আসতে। তারপর সেখান থেকে পালবাবুর বাড়িতে গিয়ে বলবে যে আজ রাত তিনটের সময় তিনি স্টেশনে যাবেন। খবরটা যেন তৃতীয় ব্যক্তির সামনে সে না দেয়।

সন্ধ্যা সাতটায় কালীচরণ ফিরে এসে জানাল সে দুটো কাজই ঠিকঠাক করে এসেছে। যাবতীয় দরকারি কাগজপত্র, ব্যাঙ্কের চেকবুক, জামাকাপড়ের সঙ্গে বাক্সবন্দি করে তিনি মামণিকে ডেকে পাঠালেন। স্যুটকেস দেখেই মামণির কপালে ভাঁজ পড়ল। বনবিহারী বললেন, ‘শোনো আমি কয়েকদিনের জন্যে কলকাতায় যাচ্ছি।’ সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো মামণির মাথা দু’পাশে দুলতে লাগল। হেসে ফেললেন, তিনি, ‘আহা, শোনোই না, তুমি বাচ্চাটাকে নিয়ে আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে?’

সঙ্গে-সঙ্গে মুখ স্থির, চোখ বড় হয়ে গেল। তারপর একগাল হেসে মাথা নেড়ে মামণি জানতে চাইল, সত্যি?

‘হ্যাঁ। সত্যি, ভোর তিনটের সময় বেরুতে হবে। তোমার আর বাচ্চার যাবতীয় জিনিস একটা স্যুটকেসে ভরে নাও। কালীচরণকে বলো, সে তোমার জন্যে স্যুটকেস বের করে দেবে। বাচ্চার ওষুধ, দুধ, ফিডিং বোতল একটা হাত ব্যাগে নিয়ে নেবে। যাও।’ বনবিহারী কথা শেষ করা মাত্রই ছিলা থেকে বেরুনো তীর হয়ে গেল মামণি।

খাওয়া-দাওয়ার পর কালীচরণকে পইপই করে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে কি কি করতে হবে। কেউ কিছু জানতে এলে কি বলতে হবে তাও বোঝালেন। জরুরি কিছু খবর থাকলে কুরিয়ারে চিঠি পাঠাবেন। বড় হরফে লেখা বাংলা চিঠি কালীচরণ পড়তে পারে।

রাত্রে ঘুম এল না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করলেন দুটো পর্যন্ত। এই বাড়ি, এই গঞ্জ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তিনি। ভাগ্য যদি বিরূপ না হয় তাহলে হয়তো আর এখানে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। কালীচরণ এই বাড়িটা দেখাশোনা করবে যতদিন বাঁচবে। সেই বাল্যকাল থেকে সে এই বাড়িতে আছে, তার স্বীকৃতি দিতে তিনি বাকি জীবনটা ওকে কর্তৃত্ব দিয়ে যাবেন। ওর খাওয়া-দাওয়ার জন্যে প্রতিমাসে কিছু টাকা মানি অর্ডার করতে হবে।

তিনি না ফিরলে হয়তো লোকে অবাক হবে। আলোচনা হবে। কারণ খুঁজতে চাইবে। পুলিশও কৌতূহলী হবে। কিন্তু ওদের কারও চোখে যখন তিনি অপরাধী নন তখন কি তাঁর সন্ধানে ভারতবর্ষ তোলপাড় করবে? মনে হয় না।

ঠিক তিনটের সময় গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। কালীচরণ নিঃশব্দে দরজা খুলে অন্ধাকারেই মালপত্র তুলে দিয়ে এল ডিকিতে। বনবিহারী বারান্দায় বেরিয়ে দেখলেন। ড্রাইভার শম্ভু গাড়ি থেকে নামেনি। কাছে গিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘তোমাকে কষ্ট দিলাম।’

কিন্তু শম্ভু কোনও কথা বলল না। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মামণি বেরিয়ে আসলে কালীচরণ পেছনের দরজা খুলে দিল। মামণি ভেতরে ঢুকে গেলে বনবিহারী বললেন, ‘আমি সামনে বসছি। তুমি ওকে সিটের ওপর ভালোভাবে শুইয়ে দাও। দেখো, ঠান্ডা যেন না লাগে।’

গাড়িতে উঠে বসে বললেন, ‘কালী চললাম। আমার সবকিছু তোমার দায়িত্বে রইল।’

‘চললাম বলছেন কেন? কাজ শেষ হলেই তো ফিরে আসছেন।’

মাথা নাড়লেন বনবিহারী। তারপর খেয়াল হল। কালীচরণকে দিয়ে যাবেন বলে দশটি একশো টাকার নোট একটা খামে ভরে রেখেছিলেন। শম্ভু গাড়ি চালু করা মাত্র তিনি বললেন, ‘এটা রেখে দাও। কাজে লাগবে।’

কালীচরণ খামটা নেওয়া মাত্র গাড়ি চলতে শুরু করল। মুখ ফিরিয়ে জায়গাটা দেখার চেষ্টা করলেন বনবিহারী। অন্ধকারে ডুবে আছে চরাচর। পাশের বাড়িটা অস্পষ্ট। ওই মহিলা কতক্ষণ জেগেছিলেন কে জানে! প্রতিটি মানুষ কম-বেশি অনুতপ্ত।

পিচের রাস্তায় উঠে এল গাড়ি। হেডলাইটের আলো অন্ধকার সরাচ্ছে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি ব্যাপার শম্ভু, তুমি চুপচাপ কেন?’

শম্ভু কথা বলল না। যেন খুব মন দিয়ে গাড়ি চালাতে সে ব্যস্ত।

‘শম্ভু?’

‘আমার কথা বলা নিষেধ। বাবু বলেছেন মুখ খুললেই ফাঁসিয়ে দেবেন।’ বেশ জোরে কথাগুলো বলল শম্ভু।

দশ মাইল পথ, ফাঁকা রাস্তা, অতএব দ্রুত পৌঁছে গেল গাড়ি।

প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত এল না শম্ভু। জিনিসপত্র নামিয়ে দিয়ে চুপচাপ গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে গেল। মামণির কোলে ঘুমন্ত বাচ্চা, ফলে স্যুটকেস দুটো বনবিহারীকেই বইতে হল। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে শেড-এর নীচে মামণিকে দাঁড়াতে বলে স্যুটকেস রেখে একটু দাঁড়ালেন বনবিহারী। এই স্টেশনের স্টেশনমাস্টার তাঁর কাছে কয়েকবার গিয়েছেন ওষুধ নেওয়ার জন্যে। ভদ্রলোক অনেকদিন যাননি। অবশ্য এত রাত্রে তাঁর স্টেশনে ডিউটি দেওয়ার কথা নয়। যদি থাকেন তাহলে একপ্রস্থ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। বনবিহারী এগোলেন।

এখন প্ল্যাটফর্মে কয়েকটি ভবঘুরে ঘুমাচ্ছে। টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখলেন ভেতরে আলো জ্বলছে। যাঁর টিকিট বিক্রি করার জন্যে জেগে থাকার কথা তিনি একটা টুলের ওপর পা তুলে দিয়ে চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেন।

বনবিহারী জানলায় শব্দ করতে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সোজা হলেন ভদ্রলোক, ‘কোথায়?’

‘কলকাতা। দুটো টিকিট।’

‘কোন ক্লাস?’

একমুহূর্ত ভাবলেন বনবিহারী। অনেককাল টেনে ওঠেননি। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রিজার্ভেশন পাওয়া যাবে?’

‘যাবে। এই ফর্ম ভরতি করুন। এসি থ্রি টায়ার।’

পকেট থেকে কলম বের করে ফর্ম ভরতি করলেন বনবিহারী। নিজের নাম লিখতে গিয়ে বুঝলেন একটা প্রমাণ রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু বেনামে টিকিট কাটতে পারলেন না তিনি। মামণির নাম লেখার সময় টাইটেলটা লিখতে গিয়ে নিজের টাইটেল ব্যবহার না করে অন্য কিছু লেখার ভাবনা মাথায় এল না।

‘এগারোশো বাইশ টাকা। খুচরো দেবেন নইলে ফেরত দিতে পারব না।’

ভেতরের পকেট থেকে টাকা বের করে গুনে এগিয়ে দিলেন বনবিহারী, ‘ট্রেন কি লেটে আসছে?’

‘না। আজ একবার কারেক্ট টাইমে আসছে।’ বলে টিকিট তৈরিতে ব্যস্ত হলেন ভদ্রলোক। শেষে বললেন, ‘ঠিক প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান। এস থ্রি কম্পার্টমেন্টের নয় আর ষোল নাম্বার বার্থ।’

ফিরে গেলেন বনবিহারী মামণির কাছে, ‘টিকিট পাওয়া গিয়েছে।’

মামণি হাসল। এমন নির্মল হাসি খুব কম দেখেছেন বনবিহারী। ঈশ্বর যে কেন মাঝে-মাঝে এত নির্মম হয়ে যান, ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নেওয়ার কি দরকার ছিল! এই স্টেশনে বসার জন্যে কোনও বেঞ্চি নেই। ওদের নিয়ে ওয়েটিং রুমে অবশ্য যাওয়া যায় কিন্তু সেখানে কোনও পরিচিত লোক টেনের জন্যে অপেক্ষা করতে পারে। বনবিহারীর মনে হল বাচ্চাটাকে মামণির কোল থেকে নিয়ে ওকে একটু স্বস্তি দিলে ভালো হয়। তিনি হাত বাড়ালে মামণি মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে কান্নার অভিনয় করল। অর্থাৎ কোলবদল হলে বাচ্চা কেঁদে উঠবে।

ঠিক সময়ে দূরে ইঞ্জিনের আলো দেখতে পেয়ে স্যুটকেস দুটো তুলে ওদের নিয়ে প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন বনবিহারী। বেশ বড় ট্রেন কিন্তু জানলা দরজা বন্ধ। যেন একটি ঘুমন্ত ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। কম্পার্টমেন্টের গায়ে নাম্বার লেখা আছে। এস থ্রি কোচটি সামনেই। কিন্তু তার জানলা, দরজা বন্ধ। বনবিহারী দরজায় ধাক্কা দিলেন। কিন্তু ভেতরে কেউ জেগে আছে বলে মনে হল না। অথচ ট্রেন এখানে বেশি সময় দাঁড়ায় না। বনবিহারী কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না যখন তখন মামণি তাঁর হাত ধরে টেনে দেখাল পাশের কম্পার্টমেন্ট থেকে লোক নামছে। দ্রুত স্যুটকেস এবং মামণিদের নিয়ে সেই কম্পার্টমেন্টে উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

কালো কোট পরা টিটি এগিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলে বনবিহারী তাঁকে সমস্যার কথা বললেন। ভদ্রলোক বললেন, ‘ওই করিডোর দিয়ে পাশের কম্পার্টমেন্টে চলে যান।’

এগিয়ে গিয়ে দেখলেন বনবিহারী। ট্রেন এখন ছুটছে। দুটো কম্পার্টমেন্টকে যুক্ত করা হয়েছে যেখানে তার ওপর ইস্পাতের ঢাকনা ফেলে যাতায়াতের পথ করা হয়েছে। প্রথমে একটা, পরে দ্বিতীয় স্যুটকেসটা ওপাশের বেসিনের পাশে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আসতে পারবে?’

কোনও জবাব না দিয়ে গটগট করে নড়তে থাকা ঢাকনার ওপর দিয়ে চলে এল মামণি। বনবিহারী মাথা নাড়লেন। মামণির বয়স এবং স্বাস্থ্য যা সহজেই পারে তা তাঁর পক্ষে অস্বস্তির মনে হয়।

কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে অল্প আলোয় নয় এবং ষোল নাম্বার বার্থ খুঁজে পেয়ে গেলেন তিনি। প্যাসেজের পাশে ওপর-নীচের বার্থ। স্যুটকেস দুটো সিটের নীচে রেখে রেলের দেওয়া বালিশ চাদর কম্বলে বিছানা করে নীচের বার্থে মামণিকে শুতে বলে ওপরের বার্থে উঠে গেলেন তিনি। উঠতে অসুবিধে হল না। বনবিহারী লক্ষ করলেন মামণি তার পাশের পরদা টেনে দিল। বালিশ মাথা রেখে কম্বল টেনে নিলেন বনবিহারী। বেশ আরামদায়ক যাত্রা। সারাদিন এবং সারারাতের উদ্বেগের পর এখন টেনের দুলুনিতে ঘুম এসে গেল তাঁর।

ট্রেনটা কলকাতায় পৌঁছাল বিকেলে। দুটো রিকশা নিয়ে কাছের সূর্য সেন স্ট্রিটের একটা মধ্যবিত্ত হোটেলে চলে এলেন বনবিহারী। চারধারে এত গাড়ির শব্দ, রাস্তায় এত লোক তাঁকে বিব্রত করছিল। নির্জন গঞ্জে থাকতে থাকতে এই কোলাহল বেশ ভয়ঙ্কর বলে মনে হচ্ছিল।

বনবিহারী ভেবেছিলেন দুটো সিঙ্গল রুম নেবেন। কিন্তু কাউন্টারের লোকটি বলল, ‘আমাদের সব ঘরই ডাবল বেডের। আপনাদের তো একটা ঘর হলেই চলে যাবে।’

বনবিহারী মামণির দিকে তাকালেন। সে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

খাতায় নাম-ধাম লেখার পর লোকটি বলল, ‘অ্যান্ড ফ্যামিলি লিখে দিন।’

বাধ্য হয়ে তাই লিখলেন বনবিহারী।

দোতলার ঘরটি রাস্তার ধারে নয় বলে বাইরের শব্দ কম পাওয়া যাচ্ছে। ঘরটি বড়, দুটো খাট দুপাশে, বাথরুম সংলগ্ন। মামণি বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়েছিল একটা খাটে। এখন সে হাত-পা নাড়ার চেষ্টা করছে। ওইটুকু বাচ্চাকে এতটা জার্নির ধকল স্পর্শ করতে পারেনি। বনবিহারী বললেন, ‘তুমি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তুমি এলে আমি যাব।’

দরজায় শব্দ হল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকল হোটেলের বেয়ারা। কিছু খাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করল। দুটো করে টোস্ট, ওমলেট আর চায়ের অর্ডার দিলেন তিনি।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে চা-খাবার খেয়ে বনবিহারী বললেন, ‘তুমি বিশ্রাম নাও। আমি একটা ফোন করে আসছি।’

মাথা নাড়ল মামণি, তার আপত্তি নেই।

হোটেলের কাউন্টার থেকে চিঠিতে লেখা নাম্বারে ফোন করলেন বনবিহারী। একবারেই রিঙ শোনা গেল। তারপর ওপাশ থেকে ইংরেজিতে প্রশ্ন ভেসে এল, কে বলছেন?

বনবিহারী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন চিঠি পেয়ে তিনি এইমাত্র কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন। ভদ্রলোক এবার বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় উঠেছেন আপনি?’

‘সূর্য সেন স্ট্রিটের একটা হোটেলে।’

‘ও। ওখান থেকে গণেশ অ্যাভিন্যু বেশি দূরে নয়। খাদি গ্রামোদ্যোগের পাশের বাড়ির তিনতলায় আমাদের অফিস। আধঘণ্টার মধ্যে চলে আসুন। কথা হবে।’

ফাঁপরে পড়লেন বনবিহারী। দু-ঘণ্টা লেগে যেতে পারে যেতে আসতে। ততক্ষণ মামণি একা থাকতে চাইবে? গিয়ে বললে হয়তো বুঝবে না। তিনি রিসেপশনিস্টকে বললেন, ‘আমি গণেশ অ্যাভিন্যু যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরব। মেয়েটা বাচ্চাকে নিয়ে একা ঘরে আছে। ও কখনও কলকাতায় আসেনি। আমাকে না দেখলে নার্ভাস হয়ে যেতে পারে। একটু খেয়াল রাখবেন?’

‘নিশ্চয়ই। আপনি ঘুরে আসুন, মেয়ের কোনও অসুবিধে হবে না।’

বাইরে বেরিয়ে এলেন বনবিহারী। ডাক্তারি পড়ার সময় এই শহরে কয়েক বছর ছিলেন তিনি। হোস্টেল আর কলেজের বাইরে তাঁর কোনও জীবন ছিল না। সহপাঠীদের মতো খরচ করার টাকা তাঁর পকেটে থাকত না। তবু ট্যাক্সিতে উঠে মনে হল সেই কলকাতা এখন এত বেশি বদলে গেছে যে তার অচেনা মনে হচ্ছে।

খাদি গ্রামোদ্যোগের দোকানের সামনে পৌঁছে ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে গিয়ে বনবিহারী জানতে পারলেন মিটারে যা টাকা দেখাচ্ছে তার অনেক বেশি ভাড়া দিতে হয়। প্রতিবাদ করতেই একটা রেন্টকার্ড এগিয়ে দিল ড্রাইভার। মন তেতো হয়ে গেল। এটা কেন হবে? ভাড়া যা দেয় তাই মিটার দেখাবে না কেন? এটা তো ঠিক নয়।

চিঠির ঠিকানা মিলিয়ে তিনতলায় অফিসে উঠে এলেন বনবিহারী। বেয়ারাকে নাম বলতেই সে তাঁকে নিয়ে গেল ঝকঝকে এক অফিস ঘরে। সেখানে দুজন কেতাদুরস্ত মানুষ কথা বলছিলেন। যিনি ওপাশের চেয়ারে বসেছিলেন তাঁর বয়স ষাটের ওপরে। বেয়ারা তাঁকে নীচু স্বরে পরিচয় দিতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন, ‘বসুন, এক মিনিট।’

তারপর দ্বিতীয় জনের সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা বললেন খানিক। বনবিহারী অবাক হলেন, এই দুই ভদ্রলোক যে মাড়োয়ারি তা চেহারা এবং পোশাকে বুঝতে পারেননি তিনি।

‘আমি শাওন আগরওয়ালা। এ আমার ছেলে বসন্ত। আপনার অ্যাপ্লিকেশন আমি পেয়েছি, যে বছরে আপনি এম.বি.বি.এস. পরীক্ষা দিয়েছিলেন সেই বছরের মেধা তালিকায় আপনি বেশ ওপরের দিকে ছিলেন। আপনি ইচ্ছে করলে সরকারি হাসপাতালে বা কলকাতার নার্সিংহোমে ডাক্তারি করতে পারতেন। তা না করে কেন একটা রিমোট গ্রামে এতদিন ডাক্তারি করলেন?’ ভদ্রলোক তাকালেন।

‘প্রথমেই বলে রাখি, গ্রাম বলতে যে ধারণা মনে আসে জায়গাটা সেরকম নয়। গ্রাম এবং শহরের মাঝমাঝি জায়গা। ওখানেই আমার বাড়ি। তখন মা জীবিত ছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল যেন আমি ওখানকার মানুষদের চিকিৎসা করি কারণ ওখানে কোনও হেলথ সেন্টার দূরের কথা ডাক্তারও ছিল না। অমি এই ক’বছরে অনেক কিছু শিখেছি।’ বনবিহারী বললেন।

‘কীরকম?’ বসন্ত জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমাদের শেখানো হয়েছিল প্যাথলজিস্টের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে রোগ নির্ধারণ করে চিকিৎসা করা যাতে পেশেন্ট ঠিকঠাক ওষুধ পায়। একইসঙ্গে রেডিওলজিস্ট যে এক্সরে রিপোর্ট দেবেন তা কাজটা অনেক সহজ করে দেয়। কিন্তু আমি যেখানে কাজ করেছি সেখানে ওইসব রিপোর্ট পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এখনও নেই। স্টুল, ইউরিন, ব্লাড পরীক্ষা করাতে পেশেন্টকে বহুদূরের শহরে যেতে হবে। সেই যাওয়া আসার খরচ করতে অনেকেই পারেন না। অথচ চিকিৎসা না করলে ওঁরা বেঘোরে মারা যাবেন। প্রথম প্রথম ভুল হত। ধীরে-ধীরে পেশেন্টের কি কি অসুবিধে হচ্ছে জেনে তার ওপর নির্ভর করে ওষুধ দিতে লাগলাম। কাজ হলে মনের তৃপ্তি বাড়ত।’ বনবিহারী বললেন।

‘ওষুধ কোথায় পেত ওরা?’ বসন্ত জিজ্ঞাসা করলেন।

‘একজন একটি ওষুধের দোকান খুলেছিল। যেসব ওষুধ দোকানে থাকত না সেগুলো শহর থেকে সে আনিয়ে নিত দিনে দিনে।’

‘আপনার মা—?’ শাওনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

‘চলে গেছেন।’

‘আমাদের দেওয়া বিজ্ঞাপন আপনাকে আকর্ষণ করল কেন?’

‘এখন একটু-একটু করে আমাদের জায়গাটা আধুনিক হয়ে উঠছে। হেলথ সেন্টার চালু হতে চলেছে। আমার মনে হচ্ছিল যদি আরও রিমোট জায়গায় অসহায় মানুষদের চিকিৎসার কাজটা করতে পারতাম তাহলে ডাক্তারি পড়াটা কাজে লাগত।’

বসন্তবাবু ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘আমাদের এনজিও পশ্চিমবাংলার তিনটে জায়গায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে সুন্দরবনের গভীরে যেসব গ্রাম আছে যার মানুষরা এখনও আধুনিক চিকিৎসার সাহায্য পায় না তাদের কাছে পৌঁছতে চাইছি আমরা। মুশকিল হল ওরকম জায়গায় কোনও ভালো চিকিৎসক গিয়ে বেশিদিন থাকতে চান না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন বর্ষায় সুন্দরবনের নদী ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তখন নদী পার হতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয় যা অনেকেই নিতে চান না। আমাদের অফিস গঙ্গারাম বলে একটা জায়গায়। লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে যেতে হয়। নদীর এপারে গঙ্গারাম অন্যদিকে পাথরপ্রতিমা। আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের উপকৃত করবে। গঙ্গারামে আপনি থাকার জায়গা পাবেন, আমরাই ব্যবস্থা করে দেব। আমাদের একটা বড় লঞ্চ আছে। সেই লঞ্চের নীচের তলাটা আমরা আধুনিক চিকিৎসা-সরঞ্জামে সাজিয়ে নিয়েছি। ছোটখাটো অপারেশন সহজেই সেখানে করা যায়। দুজন হেলপার আপনি পাবেন যারা লঞ্চেই কাজ করে। আজ রাত্রে আপনি ভেবে দেখুন। যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আপনার ডিগ্রির সার্টিফিকেট নিয়ে কাল সকাল এগারোটায় চলে আসবেন।’

‘আমি তো আপত্তি জানাবার কোনও কারণ দেখছি না। তবে—!’

‘ও হ্যাঁ’, বসন্ত বললেন, ‘আমরা আপনাকে আপাতত তেরো হাজারের বেশি মাসে দিতে পারছি না। টাকাটা কি আপনার কাছে কম মনে হচ্ছে।?

‘তেরো হাজার?’

শাওনবাবু বললেন, ‘ওখানে খরচ খুব কম। লঞ্চে থাকার সময় খাওয়া-দাওয়া সেখানেই করবেন। তার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা। আপনি তিনমাস কাজ করুন। যদি আপনার ভালো লাগে আর আমাদের কাছে রিপোর্ট আসে যে মানুষ আপনাকে পেয়ে খুশি হয়েছে তাহলে তিনমাস পরে টাকাটা নিশ্চয়ই বাড়িয়ে দেওয়া হবে।’

‘ঠিক আছে। আমাকে কবে জয়েন করতে হবে?’

‘আমরা তো দেরি করতে চাই না। আপনি চাইলে কালই জয়েন করতে পারেন। তবে সাতদিনের বেশি দেরি করবেন না।’ বসন্ত বললেন।

‘আমি আগামীকালই গঙ্গারামে যেতে চাই।’

‘অনেক ধন্যবাদ। তাহলে কাল সার্টিফিকেটটা নিয়ে আসবেন। সকাল এগারোটায় আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি থাকবে। বসন্ত, তুমি গঙ্গারামের অফিসকে জানিয়ে দাও উনি দুপুরের ট্রেনে লক্ষ্মীকান্তপুরে যাচ্ছেন। ওদের কেউ যেন স্টেশনে ওঁকে নিতে আসে।’ শাওনবাবু বললেন।

বেরিয়ে এলেন বনবিহারী। কলকাতায় এখন সন্ধার আলো জ্বলে উঠেছে। বনবিহারী ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলেন হোটেলে ফিরবেন বলে। মামণি এতক্ষণ একা ঠিকঠাক আছে কিনা তাঁর সন্দেহ হচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *