দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১৩

তেরো

ছাত্রাবস্থায় কম্প্যুটারের সাহায্য পাননি বনবিহারী কারণ তখন ওই যন্ত্রটির অস্তিত্ব এদেশে ছিল না বললেই চলে। ফলে কাজ চালানোর মতো কম্প্যুটার-ব্যবহার তিনি কখনও করেননি। এই গঞ্জে কোনও কম্প্যুটার সেন্টার নেই। থাকলেও সেখানকার কর্মীদের সাহায্য নিতেন না তিনি। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে সমস্যা বাড়বে।

কাল রাত্রে বাড়ি ফিরে খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। আজ সকালে ঘুম ভাঙলে কালীচরণকে ডেকে বললেন, ‘এখনই সদরে যাব। খুব খিদেও পেয়েছে। ঝটপট লুচি আর তরকারি চাই। হবে?’

মাথা নাড়ল কালীচরণ, ‘সারারাত না খেয়ে থাকলে খিদে তো পাবেই।’

মুখ হাত পা ধুয়ে বাইরের পোশাক পরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন বনবিহারী, মামণি এল লুচির প্লেট নিয়ে। টেবিলে রেখে এগিয়ে এসে বনবিহারীর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল।

বনবিহারী অস্বস্তি কাটিয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্কু।’

লুচি, বেগুন ভাজা এবং সম্ভবত গতরাত্রের তরকারি গরম করে মামণির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে কালীচরণ। খাওয়া শুরু করে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি খাবে না?’

মাথা নাড়ল মামণি, না। তারপর বনবিহারীর পোশাক দেখিয়ে আঙুল নেড়ে জানতে চাইল তিনি কোথায় যাচ্ছেন?

‘একটা দরকারি কাজে সদরে যাচ্ছি। এগারোটার মধ্যে ফিরে আসব।’ বেগুন ভাজতে গিয়ে বড্ড বেশি তেল ব্যবহার করেছে কালীচরণ, প্লেটে গড়িয়ে গেছে।

শোনামাত্র সোজা হল মামণি। বুকে আঙুল ঠুকে জানাল সে-ও সঙ্গে যাবে।

ফাঁপরে পড়লেন বনবিহারী। হেসে বললেন, ‘আমি একটা জরুরি কাজ নিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে লোকজন থাকবে। তোমার একটুও ভালো লাগবে না।’

মাথা নাড়ল মামণি। সে তবু যাবেই।

বনবিহারী বললেন, ‘তুমি বুঝতে পারছ না, ওরা পুলিশের লোক।’

হঠাৎ থমকে গেল মামণি। চোখ বড় হয়ে গেল তার। একটু ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে ঘর থেকে চলে গেল। খারাপ লাগছিল বনবিহারীর। মিথ্যে তিনি বলেন না। কিন্তু এই জেদি মেয়েটাকে মিথ্যে না বললে থামানো যেত না। পুলিশ সঙ্গে যাচ্ছে শুনে ওর যাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গেল। পুলিশের বিরুদ্ধে ওর মন বিষিয়ে আছে? এতদিন সেটা টের পাননি বনবিহারী। হঠাৎ একটা অন্য ধরনের উদ্বেগে আক্রান্ত হলেন তিনি।

বাড়ির সামনে হাইওয়ে থেকে বাসে উঠলেন বনবিহারী। আজ সকালে চেম্বার বন্ধ থাকবে। বেলা এগারোটার মধ্যে যদি ফেরেন তাহলে চেম্বারে গিয়ে বসবেন। বনবিহারীর আর ভালো লাগছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল এই তল্লাট থেকে বহুদূরে চলে যেতে পারলে তিনি স্বস্তি পাবেন। এখানকার লোকজন যদি দ্যাখে প্রায়ই তাঁর চেম্বার বন্ধ থাকছে তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর ওপর থেকে ভরসা চলে যাবে।

বাস ছুটছিল ফাঁকা রাস্তা পেয়ে। দুপাশে গাছগাছালি, চাষের মাঠ, মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট নদীর সাঁকো। সদরে পৌঁছে গেলেন ঠিক সোওয়া নটার। বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিয়ে হাসপাতাল পেরিয়ে শহরের জমজমাট অংশে পৌঁছেই সাইবার কাফে দেখতে পেলেন। রিকশা থেকে নেমে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলেন এই সকালেই প্রচুর ছেলে-মেয়ে কম্প্যুটারের সামনে বসে অনুশীলন করছে।

বাঁ-পাশের রিসেপশনের সামনে দাঁড়াতেই একটি তরুণ জিজ্ঞাসা করল, ‘বলুন?’

‘একটা ই-মেল করতে চাই! এখান থেকে কি সম্ভব হবে?’

‘নিশ্চয়ই!’ ছেলেটি একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কি লিখতে চান আর যাকে পাঠাবেন তার মেল নাম্বার এখানে লিখে দিন।’

বনবিহারী লিখলেন, ‘এম বি বি এস উঁইদ টোয়েন্টি ফোর ইয়ার্স এক্সপেরিয়েন্স ওয়ান্টস টু জয়েন ইউ। রেডি ফর ইন্টারভিউ।’ নিজের পুরো নামটা লিখে চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলো থেকে নিয়ে আসা বিজ্ঞাপনের ই-মেল নাম্বারটা বড় করে লিখে দিলেন। তারপরেই খেয়াল হল, যদি উত্তর আসে তাহলে ওরা কোন ঠিকানায় পাঠাবে? শেষে নিজের বাড়ির ঠিকানাটা বিশদে লিখলেন।

মেল পাঠিয়ে ছেলেটি যে দক্ষিণা চাইল তার অঙ্ক শুনে অবাক হলেন বনবিহারী। একটা টেলিগ্রাম পাঠাতেও এর চেয়ে বেশি টাকা লাগে।

ভাবনায় ছিল না, তবু শহরে যখন এসেছেন তখন কিছু জিনিস কিনলেন তিনি। বেশিরভাগই বাচ্চাটার জন্যে। একটা পিঙ্ক রঙের সালোয়ার কামিজ কিনলেন মামণির জন্যে। দোকানদার তাঁকে আশ্বস্ত করল, ওটা ফ্রিসাইজ, যত লম্বা বা স্বাস্থ্যবতী হোক চমৎকার মানিয়ে যাবে।

ফিরতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল। এসময় চেম্বারে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। বাড়ির সামনে বাস থেকে নেমে পড়লেন তিনি।

দরজা খুলে কালীচরণ খবর দিল থানা থেকে বড়বাবু সেপাই পাঠিয়ে ছিলেন। একটা চিঠি দিয়ে গেছে লোকটা। খামটা খুললেন বনবিহারী। তাঁর হাত কাঁপছিল। টাইপ করা চিঠি, ‘আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। একদিন চা খেতে চলে আসুন। নমস্কার।’ নাম ঠিকানা ছাড়া সাদা কাগজে টাইপ করা হয়েছে শব্দগুলো। ছেলেটাকে নিশ্চয়ই মেরে ফেলেছে লোকটা। গ্রেপ্তার করে কোর্টে তোলার ঝামেলা নিশ্চয়ই নেবে না। আর এই কাজটা করার জন্যে হয়তো ওর প্রমোশন হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা হবে তত তাঁর পক্ষে মঙ্গল। চিঠিটাকে ছিঁড়ে ফেলে তিনি মামণির খোঁজ করলেন। কালীচরণ বলল, ‘সে রান্না করছে।’

‘ডাক ওকে।’

নিজের ঘরে গিয়ে জামা খুললেন বনবিহারী। এতক্ষণে তাঁর পাঠানো ই-মেল নিশ্চয়ই পেয়ে গেছে ওরা। হয়তো এরকম কয়েকশো বা হাজার মেল ওদের কাছে যাবে। ফলে ওরা যে তাঁকে খবর দেব তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর দিন পনেরো তিনি অপেক্ষা করবেন। তারপর বিহারের সেই জমিতে কিভাবে থাকা যায় তার খোঁজ করতে যাবেন। একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে গেলে বাড়িওয়ালাকে বলতে হবে তিনি আপাতত আর চেম্বার করবেন না। এই বাড়ি বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। তাহলেই হাজারটা প্রশ্ন ধেয়ে আসবে।

দরজায় শব্দ হল। মামণি এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ গম্ভীর। ঘামে চিকচিক করছে নাক। হাসলেন বনবিহারী। তারপর শিশুর জন্যে নিয়ে আসা জিনিসগুলোর প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। নিরাসক্ত মুখে সেটা নিয়ে খুলে দেখল মামণি। মুখের ভাবান্তর হল না। এমনকী নতুন ধরনের ঝুমঝুমিটা তুলে আওয়াজ করল না। চলে যাচ্ছিল সে।

দ্বিতীয় প্যাকেটটা হাতে নিয়ে তাকে ডাকলেন বনবিহারী, ‘এটা তোমার জন্যে।’

ঠোঁট টিপে প্যাকেটটা দেখল মামণি। তারপর বনবিহারীর এগিয়ে ধরা হাত থেকে সেটা নিয়ে খুলল। পিঙ্ক রঙের সালোয়ার কামিজ দেখেই ওর ঠোঁটে হাসি ফুটল। এগিয়ে এসে বাঁ-হাত বাড়িয়ে বনবিহারীর চুল এলোমেলো করে দিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হকচকিয়ে গেলেন বনবিহারী। এই মেয়ের আনন্দ প্রকাশ করার অভিব্যক্তির সঙ্গে তিনি পরিচিত নন। তিনি বিয়ে করেননি তাই সন্তানস্নেহ কি জিনিস তা শুধু কল্পনাই করতে পারেন। বাৎসল্য ব্যাপারটা বোঝেন কিন্তু সন্তান তার পিতামাতার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার খুশি হয়ে করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি নিতান্তই অজ্ঞ। এই যে মামণি তাঁর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে গেল তা কি সব মেয়ে তাদের বাবার সঙ্গে করে? যদি করে তাহলে সেইসব বাবাদের কি তাঁর মতো অস্বস্তি হয়?

খেতে বসে বনবিহারী লক্ষ করলেন উলটোদিকের চেয়ারে বসে মামণি খাবার মুখে দিয়ে হেসে ফেলল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাসির কি হল?’

মামণি আঙুলের ইশারায় যা বলল তা বোধগম্য হল না তাঁর। তিনি বললেন, ‘আবার বলো, আমি বুঝতে পারলাম না।’

ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালীচরণ বলল, ‘ও কখনও এইরকম তরকারি রাঁধেনি। আজ প্রথমবার রেঁধে দেখছে বেশ ভালো হয়েছে।’

সঙ্গে সঙ্গে মামণি আঙুল নেড়ে বোঝাল কালীচরণ ঠিক বলেছে।

বনবিহারী বললেন, ‘আচ্ছা?’

কালীচরণ বেশ গর্বিত গলায় বলল, ‘আমি এখন ওর সব কথা বুঝতে পারি।’

বনবিহারী মাথা নাড়লেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। সবসময় কাছাকাছি থাকলে এটা সম্ভব। এইসময় বাচ্চার কান্না ভেসে এল। বেশ জোরে চেঁচাচ্ছে। এঁটো হাত বেসিনে ধুয়ে ছুটে ভেতরে চলে গেল মামণি। কালীচরণ বলল, ‘হাগু করে ফেলেছে।’

অবাক হলেন বনবিহারী, ‘কি করে বুঝলে?’

‘কান্নার ধরন দেখে। ও হো, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। পাশের বাড়ির দাদা দুদিনের জন্যে ভাই-এর বাড়ি গিয়েছে বউকে নিয়ে। আমার সঙ্গে যাওয়ার সময় দেখা হতে বললেন, বাড়িতে শাশুড়ি মা একা আছেন, আমরা যদি খেয়াল রাখি তাহলে উনি নিশ্চিন্ত হন।’

‘ও। তুমি কি বললে?’

‘আমি ঘাড় নেড়েছিলাম কিন্তু ওর খবর নিতে আমি যাব না।’

‘কেন?’

‘কুচুটে মেয়েমানুষ। সব সময় অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে চায়। এই বাড়িতে ঢুকতে দিইনি বলে আমার ওপর খুব রাগ।’ কালীচরণ বলল।

হেসে ফেললেন বনবিহারী। মামণি ফিরল একটা কাপড় বাঁ-হাতে ধরে প্রবল ঘেন্না নিয়ে। কালীচরণ বলল, ‘ওই কলতলায় রেখে দাও। তোমাকে ধুতে হবে না।’

হাত থেকে কলতলায় নামিয়ে বেসিনের কল খুলে হাতে সাবান ঘষে আবার খেতে এল মামণি।

বনবিহারী বললেন, ‘ও তো শিশু। তোমারই সন্তান। অত ঘেন্না হচ্ছে কেন?’

বাঁ-হাত এমন ভাবে নাড়ল মামণি যার মানে কথাটাকে পাত্তা দিচ্ছে না সে।

বিকেলবেলায় চেম্বারে বেশ ভিড়। তার মধ্যে মম্মথ মাস্টার এসে বললেন, ‘কি ডাক্তার, আজকাল প্রায়ই চেম্বার বন্ধ রাখছ কেন?’

বনবিহারী হাসলেন। মুখে কিছু বললেন না।

‘না-না। হেসো না। তোমার ওপর নির্ভর করে থাকে সবাই।’

‘অনেকদিন তো চিকিৎসা করলাম। এখন হাঁপিয়ে উঠেছি। কোনওদিন ছুটি না নেওয়ায় মাঝে-মাঝে মন বিদ্রোহ করে।’ বনবিহারী বললেন।

‘তা স্বাভাবিক। তুমি এক কাজ করো। আগেভাগে নোটিশ দিয়ে দিন সাতেকের জন্যে কোনও জায়গা থেকে ঘুরে এসো। জানা থাকলে আমাদের সুবিধে হবে আর তোমারও বিশ্রাম হয়ে যাবে।’ মম্মথবাবু উপদেশ দিলেন।

‘ভাবছি তাই করব। কলকাতায় একটা নামি ভ্রমণসংস্থা ভারততীর্থ ভ্রমণ করায়। ওদের সঙ্গে গিয়ে তীর্থ দর্শন করার ইচ্ছে আছে।’

‘কিন্তু সেটা তো সাতদিনে হবে না ডাক্তার।’

বনবিহারী মাথা নাড়লেন। যেন খুব সমস্যায় পড়েছেন।

কথাটা চাউর হয়ে গেল দ্রুত। চেম্বারে বা রাস্তায় যার সঙ্গেই দেখা হয়, একই প্রশ্ন শুনতে হয়, ‘আপনি নাকি তীর্থ করতে যাচ্ছেন ডাক্তারবাবু? কবে যাচ্ছেন? কতদিন পরে ফিরবেন? কোন কোন তীর্থে যাবেন?’ জবাবটা যেন সবার ক্ষেত্রে এক হয়-সে ব্যাপারে সচেতন আছেন তিনি। লোকে মানছে, একটা চিকিৎসা করতে করতে ডাক্তারবাবুর একঘেঁয়েমি লাগা স্বাভাবিক, একটু ঘুরে বেড়িয়ে এলে, তাঁর ভালো হবে তবু তিনি না থাকলে অসুখ হলে যে বিপদে পড়তে হবে তাও তো ঠিক।

দুপুরে চেম্বার বন্ধ করছেন এমন সময় পালবাবু এলেন, ‘নমস্কার ডাক্তারবাবু।’

বনবিহারী বললেন, ‘নমস্কার। ভেতরে গিয়ে বসবেন?’

‘না না। আমি অসুখ নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আপনার পেশেন্টরা তো চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ। এই সময় আমি স্নানখাওয়া সারতে বাড়িতে যাই।’

‘জানি জানি। চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।’ পালবাবু বললেন।

অস্বস্তি হচ্ছিল। এই লোকটি সব জানে। জেনেও মুখ খোলেনি এতদিন। আজ হঠাৎ চলে এল কেন?

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পালবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শুনলাম আপনি নাকি তীর্থ করতে যাচ্ছেন। শুনে কীরকম গুলিয়ে গেল!’

‘কেন?’

‘এতদিন জানতাম আপনি ধর্মটর্মের ঊর্ধ্বে। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান আপনার কাছে এক। পুজোর চাঁদা দেওয়ার সময় বলেন, মূর্তিপুজোর জন্যে দিচ্ছি না, উৎসবে আনন্দ করতে চাইছ সেই কারণে দিচ্ছি। তাই আপনি তীর্থে যাচ্ছেন শুনে হকচকিয়ে গিয়েছি।’

‘কথাটা ভুল রটেছে। একই কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। তাই ভাবছি ভারতভ্রমণে বের হব। ভারতভ্রমণ মানে তীর্থ করতে যাওয়া নয়।’ বললেন বনবিহারী।

‘তাই বলুন! মানুষের স্বভাব হল নিজের মতো করে কথা তৈরি করে নেওয়া। তা কোথায় কোথায় যাবেন?’

‘দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর—, টাভেল এজেন্ট যেখানে নিয়ে যাবে।’

‘বাঃ। ওসব জয়গায় কখনও যাওয়া হয়নি। একা যেতে ভরসা হয় না। আপনার সঙ্গে যাওয়া যাবে?’ পালবাবু প্রশ্ন করতেই বিপাকে পড়লেন বনবিহারী। কিন্তু পালবাবুই তাঁকে রক্ষা করলেন, ‘অবশ্য যাব বললেই কি যাওয়া যায়? দুদিন না থাকলে ব্যবসার সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনার মতো ঝাড়া হাত-পা তো নই। কিন্তু—’ গলা নামালেন পালবাবু ‘আপনি কি ওদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন?’

বনবিহারীর বুকের ভেতর আওয়াজ শুরু হল, ‘মানে?’

‘আরে, যে মেয়েটাকে বাঁচাতে হাসপাতাল থেকে বাচ্চা সমেত নিয়ে এসেছিলেন তাদের এখানে ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না ডাক্তারবাবু।’

‘আপনি দেখছি এখনও ওসব মনে রেখেছেন।’

‘রাখব না? রাতদুপুরে আমার ঘুম ভাঙিয়ে কাতর গলায় গাড়ি চাইলেন, আমার ড্রাইভার নিয়ে গেল আপনাদের হাসপাতালে, ভুলে যাব? ভুলিনি কিন্তু কাউকে বলিনি। এমনকী ওয়াইফকেও নয়। আমার বাবা বলেছিলেন মেয়েমানুষের পেটে কথা থাকতে চায় না।’ পালবাবু হাসলেন।

হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলেন বনবিহারী, ‘ক’দিন থেকে আমি আপনার কথাই ভাবছিলাম। বোধহয় তাই আপনার দেখা পেলাম। দেখুন, আপনি ছাড়া আর কেউ ওদের কথা জানে না। হ্যাঁ, আপনার ড্রাইভার অবশ্য জানে। কিন্তু সে তো মাইনে করা লোক। তাই বলছিলাম, যে ক’দিন থাকব না সে-ক’দিন যদি আপনি একটু ওদের দেখাশোনা করেন তাহলে আমি নিশ্চিন্তমনে ঘুরে আসতে পারি।’ দাঁড়ালেন বনবিহারী।

অবাক হয়ে গেলেন পালবাবু, ‘আমি?’

‘হ্যাঁ। আপনিও তো ওদের গার্জেনের মতো।’

‘কি আবোল-তাবোল বলছেন ডাক্তারবাবু? আমি ওদের গার্জেন হব কেন? কোনওদিন দেখিনি ওদের।’ বেশ জোরে প্রতিবাদ করলেন পালবাবু।

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘আমিও তো আগে কখনও দেখিনি। মাঝরাতে পেশেন্ট দেখতে গিয়ে জড়িয়ে পড়লাম।

এখনও মেয়েটির কোনও পরিচয় আমি জানি না। শুধু মানবিক কারণে আমি ওদের আশ্রয় দিচ্ছি বলে ভাবলেন না। যদি পুলিশকে সব ঘটনা বলি বা পুলিশ যদি জানতে পারে তাহলে আমি একা নই, আপনি এবং আপনার ড্রাইভারকেও জেলে যেতে হবে।’

‘অ্যাঁ? আমি কি করেছি?’ হাঁ হয়ে গেলেন পালবাবু।

‘মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়িটা আপনি দিয়েছিলেন।’

‘আমি তো কিছু না জেনে দিয়েছিলাম।’

‘কথাটা পুলিশকে বিশ্বাস করাতে পারলে ভালো। আপনার ড্রাইভার হাসপাতালে মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে খাতায় কলমে স্বীকৃতি দিয়ে এল আর আপনি কিছুই জানতেন না একথা কি পুলিশ মেনে নেবে?’ বেশ গম্ভীর গলায় কথাগুলো বললেন বনবিহারী।

পালবাবু মাথা নাড়লেন, ‘এসব কথা উঠছে কেন আমি বুঝতে পারছি না। ওইসব কথা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি। ড্রাইভার একে ওকে দত্তক নেওয়াতে চাইছিল, আমি নিষেধ করে দিয়েছি মুখ খুলতে। ডাক্তারবাবু, আপনি ওই ভারতভ্রমণে ওদের সঙ্গে নিয়ে যান। হরিদ্বার-টরিদ্বারে অনেক আশ্রম আছে, সেখানে রেখে আসুন। তাতে আমাদের সবার মঙ্গল হবে।’

‘বাঃ। এই এতক্ষণে একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছেন।’ বনবিহারী বললেন, ‘এবার আমি চলি। বেশ বেলা হয়ে গেছে।’

‘নিশ্চয়ই। একটা কথা, যেদিন যাবেন সেদিন আমার ড্রাইভার আপনাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে। শেষরাত্রের ট্রেনটা যদি ধরেন তাহলে ভালো হয়। তখন কেউ জেগে থাকবে না তাই। জানতেও পারবে না। আচ্ছা, নমস্কার।’ পালবাবু উলটোদিকে হাঁটতে আরম্ভ করলেন।

খারাপ লাগছিল বনবিহারীর। জীবনে কখনও কাউকে শাসিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কোনও কথা বলেননি। কিন্তু এই লোকটার উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। নিশ্চয়ই ভেবেছিল তিনি নরম মানুষ তাই কোনও সুযোগ নিতে পারবে। কিন্তু ফোঁস করতেই গুটিয়ে গেল। মানুষই মানুষকে সৎ থাকতে দেয় না।

বাড়ির কাছাকাছি এসে বড় রাস্তা ছেড়ে মাঠে নামলেন বনবিহারী। পাশের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল একটি বালিকা। তাঁকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বলল, ‘বড়মা’র শরীর খুব খারাপ, আপনাকে ডাকতেছে।’

তাকালেন বনবিহারী। বড়মা কি সুনয়নী দেবী? তাঁর আবার কি হল? ওই বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বনবিহারীর মনে পড়ল কালীচরণের কথা। সুনয়নী দেবীর মেয়ে-জামাই কোথায় যেন গিয়েছে। শাশুড়িকে প্রয়োজন হলে দেখাশোনা করার অনুরোধ করে গেছে ছেলেটি।

বালিকা তাঁকে ভেতরে নিয়ে এল। একটা ঘরের দরজায় পৌঁছে বলল, ‘বড়মা, ডাক্তারবাবুকে ধরতে পেরেছি। নিয়ে এসেছি।’

‘এ কি কথা! ধরতে পেরেছি! যা, দরজা টেনে দিয়ে যা। বিকেলে ঠিক সময়ে আসিস বাপু। উঃ, আমি মরে যাব।’

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি যেন মুক্তি পেয়েছে এমনভাবে দৌড়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

ঘরের পরদা সরালেন বনবিহারী। সুনয়নী বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। বছর পঞ্চাশের বাঙালি মহিলাদের অনেককে আজকাল প্রৌঢ়া বলা যায় না। উনি যে একটু সাজগোজ পছন্দ করেন তা বোঝা যাচ্ছে।

‘কি হয়েছে আপনার?’

‘আমি আর বাঁচব না।’

‘ও। কিন্তু কেন বাঁচবেন না জানতে পারি?’

‘ব্যথা। সর্বাঙ্গে ব্যথা। উঃ!’ মুখে যন্ত্রণায় ছাপ ফুটল।

‘মেয়ে-জামাইকে যেতে দিলেন কেন?’

‘আমি বললেই যেন যাওয়া বন্ধ করত। এই পৃথিবীতে কেউ কারও জন্যে নয়।’

‘তাহলে আর কে আছেন বাড়িতে?’

‘কেউ না। ওই মেয়েটা আসে, দুপুরে চলে যায়। বিকেলে আসে সন্ধ্যার পর আর থাকে না। এই বাড়িতে মেয়ের কাছে এসেছিলাম বেড়াতে। এখন হয়ে গেছি বাড়ির পাহারাদার। উঃ কি কষ্ট! চোখ মেললেন সুনয়নী।

‘উঠে বসুন। নীচে নামুন।’

‘আমি পারব না ডাক্তারবাবু।’

‘চেষ্টা করুন। উঠুন।’

যেন অনেক কষ্টে উঠে বসলেন সুনয়নী। একটা চেয়ার খাটের কাছে টেনে নিয়ে বসলেন বনবিহারী, ‘কোথায় কোথায় ব্যথা হচ্ছে?’

‘পায়ে, হাঁটুতে কোমরে, হাতে, বুকে—!’

বুকে? বুকেও ব্যথা হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ। কখন এপাশে কখন ওপাশে। মনে হয় সবসময় আমার শরীরে একটা ব্যথা ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ মুখ নামালেন সুনয়নী।

‘আপনার এখনই ব্লাড টেস্ট করা দরকার। মেয়ে-জামাই কবে ফিরবে?’

‘বলে তো গেছে পরশু।’

‘জামাইকে আমার কাছে পাঠাবেন, সব বলে দেব।’

‘এখন একটা কিছু ওষুধ দিন। ওঃ!’ বুক চেপে ধরলেন সুনয়নী দেবী।

‘আচ্ছা শুয়ে পড়ুন।’

‘সুনয়নী চিৎ হয়ে শুলে প্রথমে পালস দেখলেন বনবিহারী। নাড়ি চঞ্চল। তবে অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্টেথো বের করে বললেন, ‘আমার দিকে পেছন ফিরে শুলে ভালো হয়।’ সুনয়নী তাই শুলেন।

পিঠ পরীক্ষা করলেন বনবিহারী। কোনও অস্বাভাবিক শব্দ কানে এল না। বললেন, ‘আবার চিৎ হয়ে শুন।’

চিৎ হলেন সুনয়নী। সন্তপর্ণে বুকের মাঝখানে স্টেথো রাখলেন বনবিহারী। সুনয়নী বললেন, ‘ওখানে নয়, ডানদিকে।’

এই বয়সেও মহিলা প্রায় নিটোল স্তন ধারণ করে আছেন। ডান দিকে স্টেথো সরাতে স্তনের ওপর চাপ পড়তেই তড়াক করে উঠে বসলেন সুনয়নী। হকচকিয়ে গিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘কি হল?’

‘আপনাকে দেখার পর থেকে আমি এইটে চাইছিলাম। রাত্রে চেম্বারে ফেরার পথে একবার আসুন না। আসবেন?’

বনবিহারী কোনও কথা না বলে ব্যাগ নিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে চলে এলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *