দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

দাউদাউ আগুন – ১

এক

এখানে রাত নামে সন্ধের গায়ে গায়ে। পক্ষটা যদি শুক্ল না হয় তাহলে অন্ধকার হামলে পড়ে। খানিক বাদেই চরাচর কুচকুচে অন্ধকার। রাত দশটার আগেই আলো নিভিয়ে যে যার বিছানায়। তারপর সেই সূর্য ওঠার সময় হওয়া পর্যন্ত শান্তির ঘুম।

ওপাশে চায়ের বাগান এপাশে গঞ্জ। ছোটখাটো দোকান, কাঠ চেরাই-এর কল, একটা জুনিয়ার স্কুল, চায়ের দোকান, সেলুন এবং ভাটিখানা। গঞ্জের পেটকাটা রাস্তা দিয়ে আজকাল বাস যাচ্ছে সকাল থেকে সন্ধে। তাই দোকানপাট বাড়ছে, বাড়ছে লোকসংখ্যাও। ডাক্তারখানা বন্ধ করে যখন ডাক্তার বনবিহারী পথে নামেন তখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পথঘাট। এই এলাকার পঁচিশ মাইলের মধ্যে একমাত্র চিকিৎসক হলেন তিনি। মানুষের সেবা করা হল একজন চিকিৎসকের ধর্ম। এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন বলেই বনবিহারী সংসারী হননি। যদ্দিন তাঁর মা জীবিত ছিলেন তদ্দিন তাঁকে সংসারী করার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু বনবিহারী তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, ‘দ্যাখো, আমি তো আর পাঁচটা সংসারী মানুষের মতো সকালসন্ধে বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। রাত দুপুরেও ডাক এলে ছুটতে হয় আমাকে। যাকে বউ করে এই সংসারে আনবে সে তো জ্বলে পুড়ে মরবে। তুমি আমার মা বলে যেটা মেনে নাও তা বাইরের মেয়ে মানবে কেন?’

মা শেষ চেষ্টা করেছেন, ‘তোর কথা ঠিক হলে পৃথিবীর কোনও ডাক্তার বিয়ে করত না।’

‘অন্যেরা কীভাবে ম্যানেজ করে জানি না কিন্তু ডাক্তার হিসেবে আমার কাছে পেশেন্টের দাবি স্ত্রীর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’ বনবিহারী বলেছিলেন।

এসব অনেক আগের কথা। এখন মা নেই। বাড়ি সামলায় কালীচরণ। তাঁর থেকে বড়জোর বছর পাঁচেকের ছোট। তবে কালীচরণ বিয়ে করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বউ তাকে নেয়নি। ছাব্বিশ বছর আগে মায়ের আশ্রিত হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল সে। এখন তার হাতেই সব ভার। সেসময় বনবিহারী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কালীচরণ, এতদিন শুনতাম, মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে কারণ স্বামী তাকে নেয় না। কিন্তু কখনও কোনও স্বামীকে বউ নেয় না বলে একা থাকতে দেখিনি।’

কালীচরণকে ঈশ্বর অবহেলা করেছেন। মুখাবয়ব অনেকেরই সুন্দর হয় না কিন্তু ওর পিঠে কুঁজ দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল তাঁর? সেই সঙ্গে বাঁ-পা সামান্য ছোট করে দিয়েছেন বলে বেচারাকে লেংচে হাঁটতে হয়। কালীচরণের বাবার চায়ের দোকান ছিল সদরে। ভালো বিক্রি হত। তিন ভাই মিলে বাবাকে সাহায্য করত। বড় ছেলে কালীকে সংসারী করতে পাত্রী খুঁজলেন তার বাবা। হিরের আংটি বাঁকা হলেও তার মূল্য কমে না বলে শেষ পর্যন্ত এক গরিব বাপের মেয়েকে পাওয়া গেল। বিয়ের পরই মেয়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হল। সে স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে শোবে না। বছর খানেকের মধ্যে কালীচরণের বাবা মারা যেতেই বউ তার দেওরের প্রেমে পড়ে গেল। এবং এ ব্যাপারে তার লাজলজ্জা ছিল না। দেওরও বউদিকে বউ ভাবতে পছন্দ করল। একটুও প্রতিবাদ করেনি কালীচরণ। চুপচাপ সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল পথে। ভাসতে-ভাসতে এসে ঠেকেছিল এই গঞ্জে। বনবিহারী তখন তরুণ ডাক্তার। এই গঞ্জের প্রথম। তাঁর ডাক্তারখানায় তখন দু-বেলা ভিড়। একদিন কয়েকজন ধরাধরি করে নিয়ে এল কালীচরণকে। অসুস্থ, ধুঁকছে। লোকটা নাকি দিন চারেক এই গঞ্জে এসেছে। কাজ চেয়েছিল কয়েকটা দোকানে, কিন্তু চেহারা দেখে কেউ তাকে পছন্দ করেনি। বনবিহারী পরীক্ষা করে বুঝলেন কয়েকদিন অভুক্ত থাকায় ওর ওই অবস্থা হয়েছে। বাড়ি নিয়ে গিয়ে একটু-একটু করে খাবার দেওয়ার পর কালীচরণ দুদিনেই চাঙ্গা হয়ে উঠল। ওর সঙ্গে কথা বলে মা খুব খুশি। থেকে গেল সে এই বাড়িতে।

প্রশ্ন শুনে কালীচরণ ম্লানমুখে বলেছিল, ‘সবার কপাল তো সমান হয় না বাবু। ওসব নিয়ে আর আমি ভাবি না।’

ছোট্ট টর্চটার ব্যাটারির আয়ু প্রায় শেষ। বনবিহারীর বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল। দুপাশে কোনও দোকান খোলা নেই। সেই দুপুরের পর আর খাওয়া জোটেনি। হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বাড়ির দিকে। এখন রাত্রে জলে সামান্য শিরশিরানি এলেও স্নান করবেন প্রথমে। তারপর কালীচরণের হাতে গড়া তিনটি রুটি, ডাল আর আলুর তরকারি। রাত্রে মাছ-ডিম খেতে চান না তিনি।

খিদে পেলেও মন প্রফুল্লও ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত জমিটার টাকা পাওয়া গেল। মুখার্জির শ-মিলের পেছনে আগাছায় ভরতি হয়ে পনেরো বিঘে জমি পড়েছিল আদ্যিকাল থেকে। তিন শরিকের ঝগড়ায় জমি বিক্রি হচ্ছিল না। অথচ ওই জমি ছাড়া পিচরাস্তার কাছাকাছি আর কোনও বড় জমি এই গঞ্জে নেই যেখানে একটা হেলথ সেন্টার খোলা যায়। গত দশ বছর ধরে অনেকবার বনবিহারী ছুটাছুটি করেছেন সদরে। সরকারি কর্তাদের বোঝাতে চেয়েছেন এই গঞ্জে একটি হেলথ সেন্টারের প্রয়োজন কতখানি? শেষ পর্যন্ত কর্তারা রাজি হয়েছেন একটা শর্তে। জমি তাঁদের হাতে তুলে দিতে হবে বিনামূল্যে, বাকিটা তাঁরা করে নেবেন। পনেরো বিঘের দাম যা তিন শরিক শেষ পর্যন্ত মিলিত হয়ে দাবি করল তার পরিমাণ প্রচুর। বনবিহারী সঞ্চয়ী নন। চিকিৎসা করে মোটা ফি নেওয়া দূরের কথা, যে যা দেয় তাতে না বলেন না। অনেকে দিতেও পারে না। কাঠ চেরাই কলের মালিকেরা যে ডোনেশন দিয়েছিলেন তাতে অর্ধেক দাম হয়েছিল। বাকিটা তিন বছরে রুগিদের কাছ থেকে নিয়েছেন বনবিহারী। অসুখ সেরে গেলে রুগিকে অন্তত দু’টাকা জমিকেনার বাক্সে ফেলতে হবে। আজ গঞ্জের বড় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী এসে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বাকি টাকাটা তিনি দিয়ে দিতে রাজি আছেন যদি তাঁর মায়ের নামে হেলথ সেন্টারের পরিচিতি হয়। বনবিহারী বলেছিলেন, ‘আপনার সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু এতদিন ধরে যাঁরা চাঁদা, ডোনেশন দিয়েছেন, তাঁদের কি জবাব দেব আমি?’

‘তাদের বলুন, আমি তো বেশির ভাগ টাকাই দিচ্ছি।’ ব্যবসায়ী বলেছিলেন।

‘না ভাই। এ ব্যাপারে সবাই সমান। এই গঞ্জের নামেই হেলথ সেন্টার হবে। হয়তো আমি দেখে যেতে পারব না, পরে কেউ না কেউ করবে।’

ব্যবসায়ী কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ‘আপনি আজব লোক তা জানি। কিন্তু এতটা আজব তা জানতাম না। ঠিক আছে, টাকাটা পাবেন।’

মাথার ওপর থেকে একটা পাহাড় নেমে গেল যেন। এর পরে আজ যত রুগি এসেছে তাদের কারও কাছ থেকে ফি নেননি। বলেছিলেন, ‘আমাকে যা দিতে ইচ্ছে করছে তা আজ ওই হেলথ সেন্টারের বাক্সে ফেলে দাও।’

স্নান সেরে খেতে বসলেন বনবিহারী। মাটিতে আসন পেতে খাওয়াই তাঁর পছন্দ। তাতে তাড়াতাড়ি হজম হয়। রুটির টুকরো ডালে ভিজিয়ে মুখে পুরে বললেন, ‘কালী, আজ আমার স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। জমির দাম দিতে আর অসুবিধে হবে না। বুঝলি!’

‘বুঝলাম। কিন্তু রাত প্রায় বারোটা বাজে।’

‘অ।’ একটু হোঁচট গেলেন বনবিহারী, ‘তুই নিশ্চয়ই খেয়ে নিয়েছিস?’

কালীচরণ জবাব না দিয়ে রান্নঘর গোছাতে চলে যেতেই বাইরের দরজায় শব্দ হল। সেই সঙ্গে গলা শোনা গেল, ‘ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!’

বনবিহারী ব্যস্ত হলেন। কালীচরণকে ডাকার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত নিজেই এঁটো হাতে উঠে বাইরের ঘরের দরজা খুললেন। দুটি ছেলেকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা আলোয় আবছা দেখে তিনি চিনতে পারলেন না।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে?’

‘আপনি ডাক্তারবাবু?’ ছেলেদের একজন জিজ্ঞাসা করল।

হেসে ফেললেন বনবিহারী। এই এলাকা তো বটেই, আশেপাশের যে-কোনও মানুষ তাঁকে ভালো ভাবে চেনে। এরা নিশ্চয়ই বাইরের ছেলে। বললেন, ‘কি দরকার, বলতে পারো।’

‘আপনাকে এক্ষুনি যেতে হবে। একজন খুব অসুস্থ।’ দ্বিতীয় ছেলেটি বলল।

‘কোথায়?’

‘নাথুয়ার রাস্তায়।’

‘কি হয়েছে তাঁর?’

‘আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘তোমরা কারা?’

‘আমরা ওর বন্ধু। প্লিজ কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। চলুন।’

একটু দাঁড়াও।’

বনবিহারী হাত ধুয়ে ফেলে জামা গলালেন মাথায়। কালীচরণ ছিটকে এল তাঁর সামনে, ‘একি! না খেয়ে যাচ্ছেন যে! না না। আগে খেয়ে নিন।’

‘ওদের তাড়া আছে। নিশ্চয়ই কেউ খুব অসুস্থ।’ ব্যাগটা নিলেন তিনি, ‘ওগুলো তুলে রাখো। আমি যাব আর আসব।’

দরজার দিকে এগোলেন বনবিহারী।

কালীচরণ পেছন-পেছন বেরিয়ে এসে বলল, ‘বাবুকে আপনারা খেতেও দিলেন না।’

বনবিহারী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আঃ, থামো তো।’ তারপর গলার স্বর বদলে বললেন, চলো।’

দুটো সাইকেল পাশে রাখা ছিল। সে দুটোয় দুজন উঠে বসল। একজন বলল, ‘উঠুন।’

‘সাইকেলে?’ বনবিহারী ইতস্তত করল।

‘অনেকটা পথ। হেঁটে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’

‘ও।’

সেই অন্ধকার মধ্যরাতে বনবিহারীকে সাইকেলের রডে বসিয়ে ছেলেটি বেশ জোরেই প্যাডেল ঘোরাতে লাগল। ঘুমন্ত গঞ্জের মধ্যে দিয়ে, স্কুলের মাঠ পেরিয়ে, শ-মিলগুলোকে ডিঙিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইকেল দুটো ঢুকে পড়ল খুঁটিমারির জঙ্গলে। তারপর বড় রাস্তা ছেড়ে সরু জঙ্গুলে পথ দিয়ে সাইকেল চলল কিছুক্ষণ। হঠাৎ সামনে চলা সাইকেলের ছেলেটি চিৎকার করল, ‘আমরা। ডাক্তার নিয়ে আসছি।’ সঙ্গে-সঙ্গে কিছু পাখি ডেকে উঠল, কাঁচা ঘুম ভাঙা বানরগুলো বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে নিল খানিক। সাইকেল থামল একটা বাতিল কাঠের ঘরের সামনে। সেখানে এই অন্ধকারেও আরও দুটো ছেলেকে দেখা যাচ্ছিল।

সাইকেলের রডে বসে কোমরে ব্যথা জন্মেছিল, বনবিহারীর কয়েক সেকেন্ড লাগল শরীরটাকে সচল করতে। দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দুটোর একজন বলল, ‘আপনাকে এখানে আসার জন্যে ধন্যবাদ। আসুন।’

মাথা নীচু করে বনবিহারী ছেলেটির সঙ্গে ভেতরে ঢুকে দেখলেন একটা কুপি জ্বলছে। ঘরের এককোণে বাঁশের মাচার ওপর শুয়ে আছে যে তার পরনে শালোয়ার কামিজ। পেট ভয়ঙ্কর উঁচু। ওরা ঘরে ঢোকামাত্র মেয়েটি কাতরে উঠল, ‘আঃ।’

‘কি হয়েছে?’ বনবিহারী মেয়েটিকে লক্ষ করছিলেন।

‘বাচ্চা হবে। কিন্তু হচ্ছে না। একটু আগে খুব যন্ত্রণা পেয়ে চিৎকার করছিল।’

‘এখানে ফেলে রেখেছ কেন?’

‘অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, তাই।’

‘আমি ওকে পরীক্ষা করব। বাইরে যাও।’ গম্ভীর গলায় বললেন বনবিহারী।

ছেলেটি দ্রুত বাইরে চলে গেল। বনবিহারী মেয়েটির কাছে গেলেন। প্রচণ্ড ঘেমে গেছে মেয়েটি। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কখন থেকে যন্ত্রণা হচ্ছে?’

মেয়েটি একবার তাঁর দিকে তাকাল, তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁতে দাঁত চাপল।

এই গঞ্জ এলাকায় শিশু জন্মায় আঁতুর ঘরে। গ্রাম্য দাই সেই সময় সাহায্য করে। যাদের মনে আশংকা আছে তারা কিছুকাল আগে সদরে গিয়ে হাসপাতালের সাহায্য নেয়। এই প্রসব সংক্রান্ত ব্যাপারে বনবিহারীর কোনও ভূমিকা সচরাচর থাকে না। তিনি ডাক্তার জানা সত্ত্বেও এটা তাঁর বিষয় নয় তা এলাকার মানুষ জেনে গেছে।

আজ একটু অসহায়বোধ করলেন বনবিহারী। তিনি অনুমান করছেন, মেয়েটির প্রসব যন্ত্রণা যদি শুরু হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে শিশুর জন্মপথ সংকীর্ণ হওয়ায় বেরুনো সম্ভব হচ্ছে না। যদি হাড়ের গঠনের কারণে শিশু বেরিয়ে না আসতে পারে তাহলে একমাত্র উপায় মায়ের পেট কেটে ওকে বের করে আনা। সেটা সদরের হাসপাতাল ছাড়া সম্ভব নয়। বনবিহারী পরীক্ষা করে দেখলেন মেয়েটির শালোয়ার সিক্ত হয়নি। অর্থাৎ এখনও কিছু সময় পাওয়া যাবে। তিনি বাইরে এসে দাঁড়াতেই সেই ছেলেটি এগিয়ে এল। এই অন্ধকার জঙ্গলে এখন আকাশের আলো একটি ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে। ছেলেটির মুখাবয়ব স্পষ্ট নয়। বনবিহারী বললেন, ‘আর দেরি না করে এখনই সদরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’

ছেলেটি হাসল, অল্প শব্দ হল, ‘আপনি অবাস্তব কথা বলছেন।’

‘তার মানে?’

‘হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যদি সম্ভব হত তাহলে আপনাকে বিরক্ত করতাম না।’

‘কিন্তু হাসপাতাল ছাড়া ও বাঁচবে না। ওর এখনই অপারেশন দরকার।’ বনবিহারী বিরক্ত হলেন এবার। ‘আমি বুঝতে পারছি না এর মধ্যে অবাস্তবতা কোথায়? একটা গাড়ি জোগাড় করে ওকে নিয়ে গেলে কত সময় লাগবে?’

মাথা নাড়ল ছেলেটি, ‘প্রথম কথা আমাদের পক্ষে এত রাত্রে গাড়ি জোগাড় করা সম্ভব নয়। জঙ্গলে কারও গ্যারাজ নেই। গঞ্জে যাদের গাড়ি আছে তারা এতরাত্রে বিশ্বাস করবে না আমাদের, কারণ আমরা অপরিচিত। গায়ের জোরে হয়তো ওদের গাড়ি দিতে বাধ্য করতে পারি, কিন্তু সেটা বোকামি হবে। তাছাড়া আমাদের পক্ষে ওকে নিয়ে সদরে যাওয়া আত্মহত্যার সামিল হবে।’

হঠাৎ মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠল। কোনও কথা নয়, একটা জান্তব ধ্বনি ওই ঘর থেকে ছিটকে জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ছে। দুটো ছেলে দ্রুত ঢুকে গেল ভেতরে। তারপরেই বোঝা গেল ওরা ওর মুখ চেপে ধরেছে।

বনবিহারী এবার প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কারা? এই জঙ্গলে লুকিয়ে আছ কেন? এই মেয়েটি কি তোমাদের কারও স্ত্রী?’

যে ছেলেটি কথা বলছিল সে মাথা নাড়ল, ‘আপনি একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করে ফেলেছেন। প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে বলছি, ও আমাদের কারও স্ত্রী নয়। ও অবিবাহিতা। ধরে নিচ্ছি আমাদের কেউ ওর ভাবী সন্তানের বাবা। কেউ যখন স্বীকার করতে চাইছেই না, তখন আমরা শিশুর জন্যে অপেক্ষা করছি। বাবার চেহারার আদল কিছুটা হলেও যদি সন্তানের মধ্যে থাকে তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনি এক কাজ করুন। গঞ্জে গিয়ে গাড়ি চাইলে যে কেউ আপনাকে খুশি হয়ে দিয়ে দেবে। সেই গাড়িতে আমরা ওকে তুলে দিচ্ছি। আপনি সদরের হাসপাতালে ওকে নিয়ে যান।’

‘আমি?’

‘আমরা শুনেছি আপনি মানুষের উপকার করেন।’

‘কিন্তু আমি একে চিনি না। এই জঙ্গলের গভীরে ও এই অবস্থায় কেন পড়ে আছে তাও আমার অজানা। কিন্তু মেয়েটি এই অবস্থায় এখানে থাকলে নির্ঘাত মারা যাবে। ওর কথা একবার ভাবো।’

‘ভাবছি বলেই আপনাকে ডেকে এনেছি।’ ছেলেটি বলল, ‘আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ ওকে সদরের হাসপাতালে ভরতি করিয়ে দিন। ও যদি এখানে মারা যায় তাহলে আপনি দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।’

‘তোমরা কি পুলিশের ভয়ে এখানে লুকিয়ে আছ?’

‘ভয়ে নয়। ধরা দিয়ে ওদের সুবিধে করে দিতে চাই না।’

গোঙানি একটু কমেছিল, আচমকা বেড়ে গেল।

বনবিহারী আর পারলেন না। বললেন, বেশ। আমাকে গঞ্জে পৌঁছে দাও। দেখি গাড়ির জোগাড় করতে পারি কিনা।’

ছেলেটির নির্দেশে একজন সাইকেলে বসিয়ে বনবিহারীকে নিয়ে গঞ্জে চলে এল। এখন মধ্যরাত। চারধার নিস্তব্ধ। বনবিহারীর কথামতো তাঁকে একজন করাতকলের মালিকের বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে নামিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, ‘একটা কথা আপনাকে বলা দরকার। আপনার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে বুঝেছি যে আপনাকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু আপনি যদি বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাহলে আগামীকাল দিনের আলো ফুরোবার আগেই আপনাকে মারতে বাধ্য হব।’ কথাগুলো বলে সাইকেল ঘুরিয়ে ছেলেটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ব্যাপারটা বনবিহারী এতক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন। দেশজুড়ে সরকার বিরোধী যে সশস্ত্র আন্দোলন বিক্ষিপ্তভাবে চলছে তার খবর তিনি রাখেন, কিন্তু এই তল্লাটে সেরকম ঘটনা এখনও ঘটেনি। স্কুল পোড়ানো, মূর্তি ভাঙা, সেপাইদের গলা কাটা, জোতদারদের খুনের ঘটনা মানুষের আর পছন্দ হচ্ছে না। ওরা যে এত কাছের জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে এই খবরটাই অজানা ছিল। কিন্তু আগামীকাল ওরা মেরে ফেলতে পারে তাঁকে এই ভয়ে তিনি ভীত নন। এখন বাড়ি ফিরে বিছানায় শুলেও তিনি ঘুমোতে পারবেন না। যন্ত্রণাকাতর মেয়েটি তাঁকে কিছুতেই ঘুমাতে দেবে না। ওকে হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই।

অন্ধকার বাড়ি। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলেন বনবিহারী। বেশ কিছুক্ষণ বাদে একটা গলা শোনা গেল, জানতে চাইছে কে?

বনবিহারী চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি ডাক্তারবাবু।’

যে লোকটি দরজা খুলল তাকে এ বাড়ির গাড়ি চালাতে দেখেছেন তিনি। বললেন, ‘জানি পালমশাই ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু উপায় নেই, ওঁকে খবর দাও।’

মিনিট তিনেক বাদে হন্তদন্ত হয়ে বলরাম পাল নেমে এলেন লুঙ্গির গিঁট আঁটতে-আঁটতে। খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘কি ব্যাপার? আপনি! এখন!’

‘খুব বিপদে পড়ে বাধ্য হয়েছি আসতে।’

‘সে তো বুঝতেই পারছি।’

‘আপনার গাড়িটাকে পাওয়া যাবে? একজন পেশেন্টকে বাঁচাতে হলে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।’

নিশ্চয়ই। শম্ভু! গাড়ি বের করে ডাক্তারবাবু যেখানে যেতে বলবেন সেখানে যাও। আপনি কোনও দ্বিধা করবেন না। যান।’

‘ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি জিজ্ঞাসা করলেন না পেশেন্ট কে?’

‘আপনি কারও উপকার করতে চাইছেন যার গাড়ি নেই। আমি তো আপনাকে জানি। তাহলেই হবে।’ পালবাবু বললেন।

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘তবু আপনাকে জানানো আমার কর্তব্য। একটি আসন্নপ্রসবা মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশন না করালে সে মারা যাবে। তাই আমি তাকে নিয়ে যেতে আপনার সাহায্য চাইলাম। মেয়েটির সঙ্গে আমার কোনও পূর্ব পরিচয় নেই।’

‘ও। ঠিক আছে। আর দেরি করবেন না। শম্ভু গাড়ি বের করে ফেলেছে।’

গাড়ি চালু করে পাশে বসা বনবিহারীকে শম্ভু জিজ্ঞাসা করল, ‘কোনদিকে যাব?’

‘খুঁটিমারি ফরেস্টে। ওখানেই পেশেন্ট আছে।’

সেদিকে গাড়ি ঘোরাল শম্ভু। লোকালয় ছাড়বার পরে জঙ্গলে ঢোকার মুখে ছোট্ট সেতুর মুখে দুটো সাইকেলে তিনটি মুর্তি দেখা গেল গাড়ির হেডলাইটে। ছেলে দুটো হাত নেড়ে থামতে বলছিল। তৃতীয়জন মাটিতে বসেছিল। গাড়ি থামামাত্র ওরা পেছনের দরজা খুলে বসে থাকা মেয়েটিকে সন্তর্পণে তুলে দিয়ে বলল, ‘শো, শুয়ে পড়।’

তারপর দরজা বন্ধ করে বনবিহারীকে বলল, ‘কৃতজ্ঞ থাকলাম।’

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কেউ যাবে না?’

‘সম্ভব নয়। আপনি তো আছেন। ও হ্যাঁ, এটা রাখুন।’ ছেলেটি পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে এগিয়ে ধরল।

তোমরা যখন যাচ্ছ না তখন আর ওগুলো আমাকে দিচ্ছ কেন?’

‘হাসপাতালেও তো মিনিমাম খরচ লাগবে অপারেশনের জন্যে।’

বনবিহারী বললেন, ‘শম্ভু, গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা সদরে চল।’

শম্ভু বলল, ‘ডাক্তারবাবু, ছোটমুখে বড় কথা বলছি বলে কিছু মনে করবেন না। ওরা যখন দিতে পারছে তখন নেবেন না কেন? নইলে তো আপনাকেই দিতে হবে। আর যদি পুরোটা খরচ না হয় আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফান্ডে চাঁদা বাবদ দিয়ে দেবেন। টাকাটা নিন।’

অতএব নিতান্ত অনিচ্ছায় টাকা নিলেন বনবিহারী।

শম্ভু গাড়ি ঘুরিয়ে সদরমুখো হল।

কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি আবার গোঙাতে লাগল। নির্জন রাস্তা, দুপাশে জঙ্গল, চাষের মাঠ আর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে ওঠা মেয়েটির যন্ত্রণার শব্দ অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করছিল। শম্ভু গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাচ্ছে। ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন বনবিহারী। মেয়েটি কে, ছেলেগুলো কোত্থেকে এল এসব স্বাভাবিক প্রশ্ন শম্ভু একবারও করেনি। পালবাবু একজন বুদ্ধিমান ড্রাইভার পেয়েছেন।

যে-কোনও হাসপাতালেই ভোরের দিকে ঘুমঘুম ভাব জড়ানো থাকে। মফস্বলের হাসপাতালে তো কথাই নেই। বনবিহারীর আশংকা হচ্ছিল গর্ভস্থ শিশুর চারপাশে যে জলের আড়াল আছে তা যদি ভেঙে যায় তাহলে ওকে জীবিত অবস্থায় বের করা খুব মুশকিল হয়ে পড়বে।

সদরে পৌঁছতে প্রায় ভোর। হাসপাতালের আলোগুলো এখন হলুদ। চারধার চুপচাপ। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত ইমার্জেন্সিতে চলে গেলেন বনবিহারী। সেখানে একটি তরুণ ডাক্তার চেয়ারে বসেই ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে ডেকে তুলে পেশেন্টের কথা জানালেন। তরুণ ডাক্তার বললেন, ‘সকাল দশটার আগে কিছুই করা যাবে না।’

‘কেন?’

‘অপারেশন যিনি করবেন তিনি শহরে ওই সময় ফিরবেন।’

‘ততক্ষণ তো পেশেন্ট বাঁচবে না।’

এইসময় একজন পিওন গোছের লোক ঘরে ঢুকে বনবিহারীকে দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এল, ‘ডাক্তারবাবু আপনি এখানে? কি হয়েছে?’

বনবিহারী সংক্ষেপে সমস্যার কথা জানালেন। লোকটা তরুণ ডাক্তারকে বলল, ‘উনি শুধু ডাক্তারই নন, এই জেলার সবাই ওঁকে শ্রদ্ধা করে। আপনি নতুন এসেছেন বলে ওঁকে জানেন না। ওঁকে ফিরিয়ে দিলে বড় সাহেবরা খুব অসন্তুষ্ট হবেন।’

তরুণ ডাক্তার বললেন। ‘ও। আমি ভরতি করে নিচ্ছি। কিন্তু আপনি বললেন অপারেশন করতে হবে, সেটা তো এখনই সম্ভব নয়।’

‘কেন?’

‘সার্জেন আসবেন দশটার পরে। অ্যানাসথেসিস্টকে খবর দিয়ে আনতে হবে। অপারেশন থিয়েটার রেডি করতেও সময় লাগবে।’

‘কেন? এখানে রোজ অপারেশন হয় না?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘গতকাল হয়নি।’

পিওনটি বলল, ‘আপনি এদিকের ব্যবস্থা করুন, আমি ওকে ভেতরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি।’

মেয়েটিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। সমানে ককিয়ে কেঁদে এখন বোধহয় সেই শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে।

হাসপাতালের খাতায় পেশেন্টের নাম লেখার সময় বিপদে পড়লেন বনবিহারী। মেয়েটির নাম ওরা তাঁকে বলে দেয়নি। অত ভোরে কাজ করতে হচ্ছে বলে কিছুটা বিরক্ত কেরানিটি বনবিহারীর পরিচয় শুনে কলম ধরেছিল, সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘পেশেন্টকে নিয়ে এসেছেন অথচ তার নাম আপনি জানেন না?’

‘এটা সত্যি কথা। আমি জানি না।’

‘ঠিকানা?’

‘আমি খুঁটিমারি জঙ্গলের ভেতরে ওকে এই অবস্থায় প্রথম দেখি। ওই জঙ্গল নিশ্চয়ই ওর ঠিকানা হতে পারে না। না, ঠিকানাও জানি না।’ মাথা নাড়লেন বনবিহারী।

‘আশ্চর্য! ডাক্তারবাবু, ধরুন পেশেন্ট মারা গেল, তাহলে আমরা কী জবাব দেব? তখন তো হাতে দড়ি পড়বে। আপনার নাম আমি শুনেছি কিন্তু এই কাজটা ঘোরতর অন্যায় বলে কি মনে হচ্ছে না আপনার?’ কেরানি জিজ্ঞাসা করল।

‘তাহলে কি করা যায়?’ বনবিহারী চিন্তিত।

‘এমন অচেনা পেশেন্টকে আপনি বাঁচাতে চাইছেন কেন?’

কোনও মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে আমি দিতে পারি না।’

‘তাহলে কোনও নার্সিংহোমে নিয়ে যান অথবা মিথ্যে কথা বলুন।’

‘তার মানে?’

‘নার্সিংহোমে গেলে ওরা বেশি টাকা নিয়ে অপারেশন করে দেবে। আর আপনি যদি ওর নামধাম মিথ্যে করে এখানে বলেন তাহলে আমি তাই খাতায় লিখে নেব। অপারেশন হয়ে যাবে।’ কেরানি উপদেশ দিল।

‘নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার টাকা আমার কাছে নেই। ওরা আমাকে এই টাকা দিয়েছে।’ টাকাগুলো গুনলেন বনবিহারী, ‘বারোশো টাকা। আপনি এক কাজ করুন। পুলিশকে ব্যাপারটা জানান।’

‘পুলিশ? পুলিশ কিন্তু আপনাকে জড়াবে!’

‘কী করা যাবে? তাতে যদি মেয়েটি বাঁচে তাহলে আমার আপত্তি নেই।’ এইসময় একজন নার্স এসে বলল, ‘ডেলিভারি কেস কে নিয়ে এসেছেন?’

বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘আমি।’

‘পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ। এখনই কিছু না করলে বাঁচানো যাবে না। খুব গম্ভীর গলায় ঘোষণা করল নার্স।

অসহায় চোখে তাকালেন বনবিহারী। এইসময় আর একজন ডাক্তার যিনি এখন দায়িত্বে আছেন, এগিয়ে এলেন। নার্স বলল, ‘ওনার পেশেন্ট।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘দেখুন, দশটার আগে তো এখানে কিছু করা সম্ভব নয়। আপনি ওকে ইমিডিয়েটলি কোনও নার্সিংহোমে নিয়ে যান।’

নার্স বলল, ‘এই অবস্থায় নেওয়া খুব ঝুঁকি হয়ে যাবে। তাছাড়া সেখানে গিয়ে ডাক্তার জোগাড় করে ব্যবস্থা করতেও তো সময় লাগবে।’

বনবিহারী এগিয়ে গেলেন, ‘দেখুন, আমি একজন ডাক্তার। আপনিও। আমি জেনারেল প্র্যাকটিস করি, সার্জারির সঙ্গে অনেককাল সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই রকম ক্ষেত্রে, যেখানে মরাবাঁচার প্রশ্ন, সেখানে কিছুটা চেষ্টা তো করতে পারি!’

অন্য ডাক্তারটি ইতস্তত করতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি সরকারি ডাক্তার নন। আপনাকে যদি অপারেশন থিয়েটারে কাজ করতে দেওয়া হয় তাহলে কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেবে। তারপর পেশেন্ট যদি মারা যায় তাহলে তো কথাই নেই। তাছাড়া আপনি অ্যানাসথেসিস্টকে তো পাচ্ছেন না এখন।’

এইসময় একটি আয়া গোছের মহিল ছুটে এসে বলল, ‘বাচ্চার মাথা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বেরুচ্ছে না।’

বনবিহারী উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘আর সময় নষ্ট করবেন না। ওদের ওটিতে নিয়ে চলুন। মাথা দেখা যাচ্ছে যখন তখন ফরসেপে চেষ্টা করা যাক।’

ডাক্তার বেশ নার্ভাস হয়ে গিয়ে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন নার্সকে। নার্স ছুটে গেল।

পাঁচ মিনিটের মাথায় ওরা মেয়েটিকে ঘিরে অপারেশন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটি এখন নিঃসাড়ে পড়ে আছে। বনবিহারী ওর পালস দেখলেন। খুব দুর্বল। তিনি ওকে জাগাবার চেষ্টা করলেন।

নার্স ফরসেপ রেডি করছিল। ডাক্তার ভদ্রলোক সেটা হাতে নিয়ে শিশুকে গর্ভ থেকে বের করার চেষ্টা শুরু করলেন।

বনবিহারী বললেন, ‘সতর্ক থাকবেন। যদি নাড়ি শিশুর গলায় জড়িয়ে গিয়ে থাকে তাহলে বিপদ হবে।’

প্রায় পনেরো মিনিট ধৈর্য ধরে চেষ্টার পরে মাথাটা বের করে আনতে পারল যন্ত্র। না, গলায় নাড়ি জড়িয়ে নেই। ধীরে-ধীরে বাকি শরীর বাইরে আনার পর ডাক্তারের মুখে হাসি ফুটল। হাসিমুখে নার্স বাচ্চাটাকে তোয়ালেতে জড়িয়ে একটু চেষ্টা করতেই শিশু কেঁদে উঠল।

বনবিহারী দেখলেন মেয়েটি ধীরে ধীরে চোখ খুলছে। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে ডাক্তার ওর শরীরে ইঞ্জেকশন দিলেন।

বাইরে বেরিয়ে বনবিহারী ডাক্তারকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন। ডাক্তার এখন খুশি। বললেন, ‘ভাগ্যিস সিজার করতে হয়নি। তাহলে আর বাঁচানো যেত না।’

এইসময় কেরানি এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘বেবির মায়ের নাম কী লিখব?’

বনবিহারী হাসলেন, ‘খানিক বাদে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করে আপনাকে বলব।’

দশ মিনিট পরে যখন খোঁজ নিতে বনবিহারী নার্সের কাছে যাচ্ছেন তখন দেখা গেল সে-ই হন্তদন্ত হয়ে আসছে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছে ওরা?’ নার্স বলল, ‘বেবি ভালো আছে। কিন্তু ওর মা যে বোবা তা এতক্ষণে বুঝতে পারলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *