2 of 3

দাঁত

দাঁত

০১.

তার নিজের ভিতরে যে এত বড় একটা গুণ লুকিয়ে ছিল সারাজীবনে শশধরবাবু টের পাননি, টের পেলেন তার কর্মজীবনের শেষদিনে।

ষাট বছর বয়েস পূর্ণ হতে সওদাগরি একটা অফিসের বড়বাবুর পদ থেকে অবসর নিলেন শশধরবাবু। এই উপলক্ষে একটা ছোটখাটো বিদায় সংবর্ধনা সভা হয়েছিল, সেখানে যথারীতি তার সহকর্মীরা এবং উপরওয়ালা কেউ কেউ শশধরবাবুর সুখী ও শান্তিপূর্ণ অবসরজীবন কামনা করে এবং তার উজ্জ্বল কর্মময় জীবনের প্রশংসা করে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন।

সভার শেষে শশধরবাবুর পালা, বিদায়সভায় তাঁকেও অবশ্য কিছু বলতে হবে, এটাই রীতি।

একটু দূরেই বড়সাহেব, মেজসাহেব বসে রয়েছেন। এতকাল তাদের দেখলে শশধরবাবুর গলা শুকিয়ে যেত, মুখের মধ্যে জিব কেমন জড়িয়ে যেত, সাহেবদের প্রশ্নের উত্তরে কোনও রকমে হু হাঁ করে দায় সারতেন। চাকরি শেষ হয়ে যাওয়ার জন্যই হোক অথবা যেকোনও কারণেই হোক, আজ কিন্তু কোনও রকম বিচলিত বোধ করলেন না শশধরবাবু।

বরং বলা উচিত জীবনে তার এই প্রথম বক্তৃতা তিনি এমনভাবে দিলেন, সবাই চমকিত ও বিস্মিত বোধ করল। শশধরবাবু নিজেও খুব কম অবাক হলেন না।

উঠে দাঁড়িয়ে, বিদায় উপলক্ষে তার গলায় যে মোটা রজনীগন্ধার মালাটা পরিয়ে দেওয়া। হয়েছিল, সেটি পরিচ্ছন্নভাবে খুলে টেবিলের উপর রেখে চমৎকার বলতে আরম্ভ করলেন শশধরবাবু: প্রিয় সভাপতি, জীবনে এই প্রথম কোনও সভায় আমার কথা বলার সুযোগ হল, চিরকাল শুধু শুনেছি.. এইভাবে আরম্ভ করে সাবলীলভাবে বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে চললেন, এমন কী কালস্রোতে জীবন-যৌবন ভেসে যায়, কবে ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথে পড়েছিলেন, সেটা যে তার মনে আছে সেটা পর্যন্ত তিনি জানতেন না, সেইসব মর্মস্পর্শী কাব্যময় পংক্তি তার বক্তৃতার মধ্যে অনায়াসে ঢুকে গেল।

 কবে পঁচিশ বছর আগে একটা সিলিং পাখা খুলে তার টেবিলের উপর পড়ে গিয়েছিল। একবার গুলি চলেছিল পুলিশের, দুপুরবেলা অফিসে বসে কিছুই জানতে পারেননি, সন্ধ্যায় রাস্তায় বেরিয়ে কারফিউ, আর বাড়ি ফিরতে পারেন না, অবশেষে অফিসে ফিরে এসে আরও কয়েকজনের সঙ্গে টেবিলের উপর শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিলেন। গল্পের মতো ঝরঝরে ভাষায় সব বলে গেলেন। শশধরবাবু।

আরেকবারের কথা বললেন শশধরবাবু, সেও দশ বছর আগের কথা। অফিস পালিয়ে টেস্ট ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেনে। মাঠে ঢোকার মুখে গেটের কাছে বড়সাহেবের সঙ্গে দেখা। কী রকম ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, ভয় পেয়েছিলেন সেদিন–সেই সময় বড়বাবুর পদে তার প্রমোশনের ফাইলটা আবার বড়সাহেবেরই কাছে।

প্রায় তিরিশ চল্লিশ মিনিট ধরে প্রাঞ্জলভাবে বহু সুখ-দুঃখের কথা বললেন শশধরবাবু। বড়সাহেব রাশভারি লোক, উঠতে যাচ্ছিলেন, শশধরবাবু বলা আরম্ভ করতেই কিন্তু তিনি পর্যন্ত স্মিতহাস্যে চেয়ারে বসে শশধরবাবুর বক্তৃতা শুনতে লাগলেন।

শশধরবাবু শেষ করার পরে সমবেত শ্রোতৃবৃন্দ প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে হাততালি দিল।

চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সকলেরই একটা বিষাদভাব মনে আসে। ভাল বক্তৃতা করতে পারার আবেগে ও আনন্দে শশধরবাবুর মনের মধ্যে কিন্তু বিষাদভাবটা রইল না। বরং অবসর জীবনে সময় কাটানোর মতো একটা নতুন দিকের সন্ধান পেয়ে গেলেন।

শশধরবাবু টালিগঞ্জে পৈতৃক বাড়িতে থাকেন। সেখানে মুখরা স্ত্রী এবং বাকনিপুণা একমাত্র পুত্রবধূর উঠতে বসতে কথার মারপ্যাঁচে তার জীবন ওষ্ঠাগত। তা ছাড়া দুই বালক নাতি রয়েছে, তাদের অত্যাচারও তার উপরে কিছু কম নয়।

সওদাগরি অফিসে বড়বাবুর কাজ করে শশধরবাবুর বুদ্ধি যথেষ্টই পাকা। বক্তৃতার দিকটা আবিষ্কার করার পরে তিনি মনে মনে একটা ছক কষে ফেললেন। তারপর ছক অনুযায়ী চলতে লাগলেন।

 ব্যাপারটা আর কিছু নয়, সভা-সমাবেশের বিজ্ঞপ্তিগুলো একবার সকালবেলায় খবরের কাগজ পেয়েই খুঁটিয়ে দেখে নিতে হবে। সূর্যোদয়ের ক্ষণ থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কত রকমের অনুষ্ঠানে যে সারা দিনরাত ভরে থাকে এই শহরের অলিগলি, সেটা দু-চারদিনের মধ্যেই অনুধাবন করলেন শশধরবাবু।

যেমন ধরা যাক আজ সাতাশে জানুয়ারি, রবিবার। প্রথমে দেখতে হবে বাড়ির কাছাকাছি কী কী প্রোগ্রাম পাওয়া যায়। বাড়ির সবচেয়ে কাছে কেওড়াতলা শ্মশান এবং সুখের বিষয় সেখানে প্রায়ই কিছু না কিছু থাকে। মহাপুরুষের এবং ততো-মহানয় এমন পুরুষদেরও মৃত্যুতিথি অনেক সময়েই ঘটা করে পালিত হয় শ্মশানে। সবচেয়ে সুবিধে হল অনুষ্ঠানটা হয় প্রায় সকালের দিকে, ফলে বিকালের দিকে আবার অন্য অনুষ্ঠানে যাওয়া যায়।

কেওড়াতলা শ্মশানের ব্যাপারটা কয়েকদিনের মধ্যেই রপ্ত করে ফেললেন শশধরবাবু। স্বর্গত মহাপুরুষের কয়েকজন নিকট ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন, কয়েকজন অতি ধান্দাবাজ এবং কম সংখ্যক অতিশয় সরল প্রকৃতির লোক, একটি সাদা ফুলের মালা, পাঁচ টাকার সুগন্ধি ধূপ, একাধিক দেশাত্মবোধক গান তদুপরি কিছু বক্তৃতা–পুরো ব্যাপারটার সরলীকরণ এভাবে করা যেতে পারে।

ওই বক্তৃতার জায়গাটায় ঢুকে গেলেন শশধরবাবু। প্রায় সব অনুষ্ঠানেই সভাপতির বাঁধাধরা গৎ আছে, আর কেউ যদি কিছু বলতে চান…অসংকোচে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যান শশধরবাবু। তারপর ঝড়ের মতো বক্তৃতা। বাগদেবী তখন শশধরবাবুর জিহ্বায় আরোহণ করেন, কিছু জানুন না জানুন, বিগত মহাপুরুষটি সম্পর্কে শশধরবাবু গড়গড় করে যে আত্মত্যাগ, যে সমাজ সচেতনতা… ইত্যাদি। দিয়ে আরম্ভ করে এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ দিয়ে শেষ করে দেন বক্তৃতা। অবস্থা বুঝে পাঁচ থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত বক্তৃতা করেন তিনি। প্রায় সব সময়েই নতুন শ্রোতা পাওয়া যায়। শ্মশানের সভাগুলিতে। সাধারণত এক মহাপুরুষের মৃত্যুবার্ষিকীতে যাঁরা আসেন অন্য, প্রাতঃস্মরণীয়ের স্মরণ সভায় তাদের দেখা যায় না।

সকালের দিকে এধরনের একটা সভা জুটে গেলে বক্তৃতার পরে অনেকদিনই অনুষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাছাকাছি কোনও দোকানে বসে চা-সিঙ্গাড়া জলখাবার হয়ে যায়। দু-একবার যে এর পরে ভোজনের নিমন্ত্রণ পাননি তাও নয়।

সকালের বক্তৃতাটা থাকলেও খবরের কাগজ খুঁটিয়ে দেখে কাছাকাছি কোথাও এক বৈকালিক সভাও সংগ্রহ করে ফেলেন শশধরবাবু।

একরকম অনুমানেই বাছতে হয়, সেজন্যে দু-একবার একটু অসুবিধাও হয়। পণপ্রথা নিবারণী সমিতির এক সভায় গিয়েছিলেন সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে এক বহুতল অট্টালিকার মনোরম ফ্ল্যাটে। কিন্তু সেটা পুরো মাড়োয়ারি ভদ্রলোকদের সভা, হিন্দিতে বক্তৃতা হচ্ছে। শশধরবাবুর আবার হিন্দি একদম আসে না। ফ্ল্যাট নম্বর ভুল হয়েছে এরকম মুখভাব করে কেটে পড়লেন।

অবশ্য অনেক সময় মনোমতো অনুষ্ঠানও জুটে যায়। একদিন সন্ধ্যায় মিলনপল্লী নবযুবক সংঘের রজত জয়ন্তী উৎসবে গিয়ে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হল শশধরবাবুর। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে সভায় যান তিনি, সঙ্গে কালো ফ্রেমের রাশভারি চশমা, মাথায় সাদাপাকা চুলে তাকে বেশ সম্ভ্রান্তই দেখায়। নবযুবক সংঘের প্রধান অতিথি আসেনি। যদিও তাকে সেখানে কেউই চেনে না তবু একজন কর্মকর্তা এসে বলল, আপনার নামটা নামটা যদি বলেন? শ্রীশশধর চক্রবর্তী। তিনি নাম জানানোর মিনিটখানেক পরে শশধরবাবু শুনলেন মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, প্রধান অতিধির অনুপস্থিতিতে আমাদের বিশিষ্ট অতিথি শ্রীযুক্ত শশধর চক্রবর্তী মহাশয় প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করবেন।

শশধরবাবুকে পঁচিশটি প্রদীপ জ্বালিয়ে নবযুবক সংঘের রজত জয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধন করতে হল, বললেন চমৎকার, এই পঁচিশটি শিখা যেদিন পঞ্চাশে পৌঁছাবে, যেদিন এই রজত স্বর্ণে পরিণত হবে, সেদিন এই পৃথিবীতে আমি হয়তো থাকব না কিন্তু নবযুবক সংঘের স্বপ্ন বেঁচে থাকবে।কম্পিত কণ্ঠে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক প্রায় আধ ঘণ্টার বক্তৃতা শেষ করলেন প্রচুর করতালির মধ্যে।

ক্রমশ কতরকম যে অনুষ্ঠানে গেলেন শশধরবাবু। রাজবন্দিদের পুনর্মিলন উৎসব থেকে নিখিল বঙ্গ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির বার্ষিক সম্মেলন, বজরঙ্গবলী ব্যায়ামাগারের পুরস্কার বিতরণী উৎসব থেকে জগমোহিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা–সভায় যাওয়া নেশার মতো হয়ে উঠল শশধরবাবুর।

কর্মজীবনে বাড়িতে তবু সকাল সন্ধ্যা থাকতে হত তাকে। এখন আর তাও থাকেন না। সংসারে তার খুব কাজ বা প্রয়োজন নেই, তার অনুপস্থিতি নিয়ে কেউ বড় একটা মাথা ঘামায় না তিনি নিজেও বেঁচে যান ঝামেলা, ঝগড়া, খিটিমিটির মধ্যে থাকতে হয় না। শাশুড়ি বধুর কলহে যখন তার বাড়ির ত্রিসীমানায় কাকপক্ষীটি পর্যন্ত বসতে সাহস করছে না তখন তিনি চেতলা বাজারের নতুন তরকারির স্টল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন: মানুষের জীবনে সবুজ তরকারি কতটা প্রয়োজনীয়, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–ওরে নবীন, ওরে আমার কঁচা, ওরে সবুজ ইত্যাদি ইত্যাদি।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে স্নান করে ফিটফাট হয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে চা আর রুটি-তরকারি খেয়ে শশধরবাবু রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে পড়েন, পথে যেতে যেতে সেদিনের বক্তৃতার বিষয়টা একবার ভেবে নেন। তারপর সকালের অনুষ্ঠান শেষ হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম। অনেকদিন, বিশেষ করে শীতকালে, দুপুরের দিকেও সভাসমিতি পাওয়া যায়, সেদিন আর বিশ্রামের অবকাশ থাকে না। আবার কোনও দিন গৃহযুদ্ধের মধ্যে বিশ্রাম করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেদিন হাঁটার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। আস্তে আস্তে বিকেলের সভায় গিয়ে পৌঁছান। হঠাৎ যদি কখনও এমন হয়, কাছাকাছি বা কিছু দূরেও কোনও পছন্দমতো অনুষ্ঠান না পান, সেদিন সন্ধ্যাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মাটি হয়ে যায়।

বক্তৃতা জিনিসটা সোজা কাজ নয়। ভাল বক্তা সহজে পাওয়া যায় না। এদিক ওদিক নানা জায়গায় নানা রকম বক্তৃতা করে ক্রমশ শশধরবাবুর নাম ছড়িয়ে পড়ল। তাকে আর নিজে থেকে যেতে হয় না, আজকাল কিছুদিন হল বক্তৃতার জন্যে রীতিমতো ডাক আসা শুরু করেছে তার। শুধু কাছে পিঠে নয়, গড়িয়া দমদমে তারপরে একদিন কাকদ্বীপে একদিন উলুবেড়িয়ায় তিনি বক্তৃতা করে এলেন। যেকোনও সভায় সানন্দে যেতে শশধরবাবু প্রস্তুত, তাঁকে নিয়ে গেলেই হল, তবে বুঝতে পারলে রাজনৈতিক সভা বর্জন করেন, সেটা একটু বিপজ্জনক মনে করেন তিনি।

এইভাবে মোটামুটি চলছিল। কিন্তু অন্য একটা বাধা এসে পড়ল। মাড়ির কয়েকটা দাঁত আগেই পড়ে গিয়েছিল, হঠাৎ সামনের দুটো নড়বড়ে দাঁত এক সপ্তাহের মধ্যে পড়ে গেল।

ফোকলা দাঁতে বক্তৃতা করা শুধু কঠিন নয় হাস্যকরও বটে। বাধ্য হয়ে ডেনটিস্টের কাছে যেতে হল শশধরবাবুকে। দাঁতের ডাক্তার ভাল করে দেখে বললেন, সব দাঁতেরই প্রায় শেষ অবস্থা। সবকটাই তুলে ফেলে দুপাটি দাঁতই যদি বাঁধিয়ে ফেলেন, পরে হাঙ্গামা কম হবে।

অগত্যা তাই করতে হল। সব দাঁত তোলা, তারপর বাঁধানো–সব মিলিয়ে প্রায় দশ-পনেরো দিন নষ্ট হল। এই সময়টুকু সভাসমিতি কিছুই করা হল না।

সে যা হোক, দাঁত বাঁধানোর পর নব উদ্যমে বক্তৃতার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শশধরবাবু। নতুন দাঁত নিয়ে প্রথম দু-এক সপ্তাহ একটু অস্বস্তি হয়েছিল, তবে কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেল, বরং বলা উচিত নতুন দাঁতে শশধরবাবুর বক্তৃতার তোড় বেড়ে গেল।

 এখন শ্রীশশধর চক্রবর্তীকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে হুট করে ডাক দিলেই চলে না। রীতিমতো কয়েক সপ্তাহ আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। শশধরবাবুকে পাওয়া যাবে না জেনে অনেক সময় অনেক অনুষ্ঠানের তারিখ আগে-পিছিয়ে দিতে হয়। ইতিমধ্যে শহরতলির একটি সারস্বত সমাজ শ্ৰীযুক্ত শশধর চক্রবর্তীকে বাগ্মীভারতী উপাধি দিয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে শশধরবাবুর ডাক আসা আরম্ভ হয়েছে। তার নিজের পাড়ায় প্রতিপত্তি বেড়েছে, এমন কী নিজ বাড়িতে পর্যন্ত সম্মান বেড়ে গেছে।

০২.

কলকাতা থেকে মাইল ষাটেক দুরে একটি মাঝারি শহরে একটি সিনেমা হলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হল-মালিকের গাড়িতে চেপে এক অপরাহ্নে এসে পৌঁছালেন শশধরবাবু। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান, সেখানে শশধরবাবু ছাড়াও জনৈকা বিগতযৌবনা তবে-এখনও-তত-লোলচৰ্মানন চিত্রতারকা এবং আরও কেউ কেউ চিত্রজগতের কেষ্টবিষ্টুও থাকছেন। সন্ধ্যায় উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর নৈশভোজ, তারপর রাতেই গাড়িতে করে কলকাতা ফেরা। এ বয়েসে এসব উত্তেজনা যথেষ্টই উপভোগ করছেন শশধরবাবু। শহর ও শহরতলির ভিড় পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় পড়ে গাড়িতে আসতে আসতে বিকেলের হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। গাড়ি যখন নবনির্মিত সিনেমা হলটির কাছে এসে পৌঁছাল, তখন লোকজনের কোলাহলে তার ঘুম ভাঙল।

ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ শশধরবাবুর খেয়াল হল, কী যেন একটা গোলমাল হয়েছে কোথায়। গাড়ি থেকে নেমে সিনেমা হলের মালিকের সঙ্গে হলের করিডোরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে দেয়ালে লাগানো নতুন ঝকঝকে আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে শশধরবাবু গোলমালটা ধরতে পারলেন। তাঁর মুখটা কেমন ফাটা বেলুনের মতো চোপসানো, চোয়ালটা ঝুলে পড়েছে। সর্বনাশ! বাঁধানো দাঁতজোড়া ফেলে এসেছেন, এখন বক্তৃতা দেবেন কী করে, আর নৈশভোজ বোধহয় শুধু ডাল কিংবা সুপ খেয়েই কাটাতে হবে।

অনুষ্ঠানের এখনও বেশ কিছু সময় বাকি আছে। হলের করিডোরের বাঁপাশে। হল-মালিকের সুন্দর সুসজ্জিত কক্ষ। সেখানে সাদরে নিয়ে শশধরবাবুকে সোফায় বসালেন হলের মালিক নগেন পাল মহাশয়।

নগেন পালকে দেখে একটু আশ্বস্ত হলেন শশধরবাবু, খুব কাঠখোট্টা নয়, সিনেমা হলের মালিক। হিসেবে বেশ একটু নরম গোছের চেহারা। বিপদের কথাটা আগেই বলে রাখা ভাল এই ভেবে শশধরবাবু দন্তহীন ফোকলা মাড়িতে যতটা বিনয় আনা সম্ভব সেটুকু এনে জিব দিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, একটা বড় ভুল হয়ে গেছে মশায়। আজ আমার বক্তৃতা করা হবে না।

নগেনবাবু অবাক, কলকাতা থেকে এত রাস্তা এসে এখন বলে কী লোকটা! নগেনবাবুর একটু খটকাও লাগল, এই অস্পষ্ট জিব-জড়ানো কথা বলা লোকটা বিখ্যাত বক্তা শশধর চক্রবর্তী, কোনও ভুল হল না তো?

ব্যবসায়ী মানুষ নগেনবাবু, নিজের কৌতূহল এবং খটকা চেপে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন, কী হল?

শশধরবাবু সরাসরি জানালেন, আমার বাঁধানো দাঁতজোড়া ভুলে ফেলে এসেছি। এখন বক্তৃতা করব কী করে, আর আপনার নৈশভোজই বা খাব কী করে?

নগেনবাবু এই কথা শোনামাত্র বললেন, দাঁতজোড়া ফেলে এসেছেন? তাতে কী হয়েছে, এটা কোনও সমস্যাই নয়। দশ মিনিট বসুন, আমি আসছি। এই বলে দ্রুত দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে একটি বেয়ারাকে নির্দেশ দিলেন, এই অফিসঘরে মিস্টার চক্রবর্তীকে চা-জলখাবার দে, আমি এখনই আসছি।

ঠিক দশ মিনিট নয়, পনেরো-ষোলো মিনিটের মাথায় ফিরে এলেন নগেন পাল। হাতে একটি ছোট থলে। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা ভোয়ালে বার করে তার উপরে উপুড় করে ঢাললেন থলেটা। অন্তত পনেরো-বিশজোড়া বাঁধানো দত। অর্থাৎ তিরিশ-চল্লিশটা পাটি।

শশধরবাবু স্তম্ভিত। এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি। এত দাঁতের পাটি পেল কোথায়, নগেন পালের কি সঁতেরও ব্যবসা আছে? তিনি হতবাক হয়ে ভাবতে ভাবতেই নগেন পাল এক এক জোড়া দাঁতের পাটি বেছে নিয়ে এগিয়ে দিলেন, দেখুন তো ফিট করে কিনা?

না, এ জোড়া একটু ছোট মনে হচ্ছে, ঠিক মাড়ির উপরে বসছে না। শশধরবাবুর দ্বিধা দেখে নগেন পাল আরেক জোড়া এগিয়ে দিলেন। একটু ইতস্তত করে দ্বিতীয় জোড়াও শশধরবাবু পরখ করলেন, না এটা আবার একটু বড়, টাকায় ঠেকে যাচ্ছে।

বার বার তিনবার। কী আশ্চর্য, তৃতীয়বারের মাথায় দাঁতের পাটিজোড়া একেবারে কাপে কাপে ফিট করে গেল শশধরবাবুর। এমনকী তাঁর নিজের যে দাঁতজোড়া ভুল করে বাড়িতে ফেলে এসেছেন তার থেকেও স্বচ্ছন্দ যে এ জোড়া!

দুই মাড়িতে দুই জোড়া দাঁত লাগিয়ে আত্মপ্রত্যয় ফিরে পেলেন শশধর চক্রবর্তী।

এর পরে আড়াই ঘণ্টা ঝড়ের মতো কেটে গেল। নতুন দাঁত মাড়িতে বসিয়ে দুর্দান্ত বক্তৃতা করলেন শ্রীযুক্ত শশধর বাগ্মীভারতী। সিনেমা যে জীবনের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে গেছে, একালের শিশুরা যে মা-মা বলে না কেঁদে সিনেমা-সিনেমা বলে কাঁদে, একটি নতুন সিনেমা হল নবকালের নব বিশ্ববিদ্যালয়–ভাল দাঁতের সুবিধা পেয়ে শশধরবাবু প্রাণখুলে বক্তৃতা করলেন। যেসব ভাবী দর্শকেরা শুধুমাত্র চিত্রতারকার আকর্ষণে এসেছিল, তারা পর্যন্ত শশধরবাবুর বক্তৃতা শুনে থ মেরে গেল।

 চিত্রতারকা ইত্যাদিরাও অল্পবিস্তর বললেন বিস্তর সিটির মধ্যে। সভা শেষ, এরপর নৈশভোজ।

চমৎকার খাওয়ালেন নগেন পাল। ঘি-আলুভাজা, পাকা রুই, গলদা চিংড়ি, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া, বেলডাঙ্গার মনোহরা খুব পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেলেন শশধরবাবু। নতুন দাঁতজোড়া সর্বতোভাবে সাহায্য করল তার ভোজনে। বছর কুড়ি আগে প্রথমবার যখন দাঁত নড়েছিল তার, তারপর আর কোনওদিন এত আরাম করে খাননি শশধরবাবু।

 নৈশভোজন শেষ হল। এবার ফেরার পালা। শশধরবাবু বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধোয়ার সময় জলের কলে দাঁতের পাটিজোড়া খুলে ভাল করে ধুয়ে নিয়েছেন। ব্যবহৃত দাঁত ফেরত দেওয়া উচিত বা শোভন হবে কিনা এইসব ভাবতে ভাবতে নগেনবাবুর কাছে এসে বললেন, এই যে আপনার দাঁতজোড়া।

নগেনবাবু বিনীতভাবে বললেন, ও আমার কোনও কাজে লাগবে না। আপনার যখন ফিট করে গেছে আপনি রেখে দিন।

বিনামূল্যে একজোড়া ভাল দাঁত পেয়ে গেলেন, শশধরবাবু খুশিই হলেন। তবু একটু সংকোচের সঙ্গে মাড়ির খাপে দাঁতের পাটি লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করলেন নগেনবাবুকে, আচ্ছা, এত দাঁতের পাটি আপনার কাছে, আপনার কি দাঁতেরও ব্যবসা আছে?

নগেন পাল হাত কচলিয়ে বললেন, আরে না না, দাঁতের ব্যবসা নয়। আমার আছে। নার্সিংহোম। দেখেননি শহরে ঢুকতে কোল্ড স্টোরেজের পাশেই নগেন্দ্র সেবা কেন্দ্র! ওটাও আমারই।

শশধরবাবুর সংশয় গেল না, নার্সিংহোমে, মানে ওই নগেন্দ্র সেবা কেন্দ্রে এত দাঁত দিয়ে আপনি কী করেন? ওটা সঁতের রোগীর নার্সিংহোম, দাঁতের হাসপাতালের মতো কিছু?

নগেনবাবু বিশদভাবে হাসলেন, তা নয়। ওটা এমনিই সাধারণ নার্সিংহোম। তবে আজকাল অনেক বুড়োহাবড়া রোগীকে বাড়িতে রেখে ছেলেবউ, আত্মীয়স্বজন সেবাযত্ন করতে চায় না। অসুখ-বিসুখ হলেই হাসপাতালে নার্সিংহোমে পাঠিয়ে দেয়। একটু থেমে নগেনবাবু বিভ্রান্ত শশধরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা সেই বুড়ো রোগীরা যখন মারা যায়, তাদের চশমা, দাঁত সবই তো আমার ওখানে পড়ে থাকে। এসব জিনিস আত্মীয়স্বজন কদাচিৎ ফেরত নিতে আসে। আমি বিষয়ী লোক, সব গুছিয়ে রেখে দিই, কখন কার কাজে লাগে। এই তো আপনার কাজে লাগল। আপনার দাঁতজোড়া, যতদূর মনে হচ্ছে, বরদাপ্রসন্নবাবুর, আমাদের এলাকার শেষ রায়বাহাদুর, লাস্ট ডিসেম্বরের ঠান্ডায় আমার ওখানেই কেঁসে গেলেন।

রায়বাহাদুরি দাঁত মাড়িতে চাপিয়ে হতভম্ব শশধর চক্রবর্তী ফ্যাল ফ্যাল করে নগেন পালের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

০৩.

বাগ্মীভারতী শ্রীযুক্ত শশধর চক্রবর্তী বক্তৃতা করা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বাঁধানো দাঁত ব্যবহার করাও ছেড়েছেন, নিজের আসল দাঁতজোড়া, সেই সঙ্গে উপহার পাওয়া রায়বাহাদুরি ত–দুটি সেটই কালীঘাটের গঙ্গায় ফেলে দিয়ে এসেছেন। এক ফোকলা দাঁত বৃদ্ধ ভদ্রলোক দুটি দামাল শিশুর সঙ্গে বারান্দায় খেলছে, এ দৃশ্য এখন শশধরবাবুর বাড়িতে কেউ বক্তার সন্ধানে গেলেই দেখতে পাবেন। তবে তিনি আর কোথাও যান না, বক্তৃতার অনুরোধ নিয়ে কেউ এলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভাগিয়ে দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *