দাঁতের আলো

দাঁতের আলো

আমার ভাইঝি ‘মৈয়া’র সম্প্রতি তিনটি দাঁত উঠিয়াছে, তাহাতেই তাহার নাকি মাটিতে পা পড়ে না! অবশ্য ঝিয়ের কোলে কোলেই কাটে, পা পড়িবার বয়স হয় নাই; তবে যাহারা বোঝে, তাহারা বলে, যদি বয়স হইতই, মাটিতে পা পড়িত না—এমনই দেমাক।

আমার সঙ্গে মা-ছেলের সম্বন্ধ; ডাকি ‘মৈয়া’। কথাটা মা’র মত কোমলও নয়, সরসও নয়। এ প্রান্তে ছোট ছোট পশ্চিমা শিশুরা ‘মৈয়া গে’ বলিয়া আবদার ধরে। ও হইয়া অবধি কি জাদুবলে আমার বয়সের গোটা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর ছাঁটিয়া দিয়া আমায় এই সব শিশুদের সামিল করিয়া দিয়াছে। আপিসে ইয়া-ইয়া জোয়ানদের উপর হুকুম চালাইয়া আপিস কাঁপাইয়া সন্ত্রস্ত করিয়া বাড়ির চৌকাঠ না ডিঙাইতে ডিঙাইতে আমি বদলাইয়া যাই। হাঁকি, “মৈয়া, ভুখ লেগেছে বড্ড–”

আমার বিশ্বাস, মৈয়া যে একজন মা, তাহা ওর বেশ স্পষ্টভাবে জানা আছে। ঝিয়ের কালোকৃষ্টি কোলের মধ্যে ব্যস্ত হইয়া উঠে, রাখা দায়; ফুটফুটে হাত-পা, টুকটুকে মুখখানি চঞ্চল হইয়া উঠে—পঙ্কিল জলে বায়ু-চালিত পদ্মফুলটির মত। মৈয়ার ছেলে আসিয়াছে, তাহার ভুখ লাগিয়াছে, স্তন্য দিতে হইবে, আর কি সে থাকিতে পারে?

বলি, “কোলে নাও মৈয়া।”

সঙ্গে সঙ্গে কোলে লয়, বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া গলা জড়াইয়া ধরে। সঙ্গে সঙ্গে প্রবালের মত রাঙা ঠোঁটের মাঝখানে সেই তিনটি দাঁতের বিকাশ

প্রশ্ন হইতে পারে, তিনটি দাঁত এমন কি ব্যাপার যাহার জন্য এত?

বিজ্ঞমাত্রেই ওই কথাই বলিবে। উদাহরণস্বরূপ ওর বড় বোন রাণুর কথাই বলি। বলে, “হ্যাঁ, বুঝতাম হাতি হয়েছে, ঘোড়া হয়েছে, মোটর-কার হয়েছে, দেমাকও হয়েছে। তিনটি দাঁত এমন কি সম্পত্তি, মেজকা, যে মৈয়ার তোমার ঠ্যাকার রাখতে জায়গা নেই? আমি তো বুঝি না বাপু।”

বলি, “একেবারে ঠ্যাকার হয়ে গেল রাণু?”

“হ্যাঁ, ঠ্যাকার বইকি! তোমার মৈয়াকে নিয়ে কিছু বললেই তোমার লাগে; কিন্তু দাঁত হয়ে পর্যন্ত যা সব কাণ্ড, তা দেখে ঠ্যাকার বলব না তো বলব কি? উনি আজকাল দুধ খাবেন না। দুধ খেতে যাব কেন? ওতে কি দাঁতের দরকার হয়? আমি খাব কয়লা, চায়ের কাপ, খোলামকুচি, দাদুর খড়ম, কুটকুট করে শব্দ হবে, লোকে বলবে হ্যাঁ, ছবুরাণীর দাঁত হয়েছে। অথচ পুঁজি তো সবে তিনটি। আর গজর গজর করে বকেই বা কেন এত? বড় যে মৈয়াকে তোমরা চেনো, অত বকবার মতলবটা কি বল দিকিন?”

রাণুকে এই তালে শিশুতত্ত্ব শিখাইবার লোভটা সংবরণ করিতে পারি না, বলি, “ওটা আপনা-আপনিই হয় রাণু, বকবার জন্য ওকে বড় একটা চেষ্টা করতে হয় না। ইংরিজিতে একে অটোমেটিক অ্যাকশন বলে, আর একটু বড় হলে তোমায় এসব বুঝিয়ে দোবখন। ওর দ্বারা ওদের জিবের একসারসাইজ হয়, তারপর ক্রমে—”

রাণু হাসিয়া বলে, “তুমি কিছুই ধরতে পার নি মেজকা। তোমরা মায়ে পোয়ে ঠিক এক রকম, কি যে কতকগুলো আউড়ে গেলে! ছবিরাণীর কথায় আবার ইংরিজি এল কোত্থেকে বুঝতে পারি না। না জান তো আমার কাছে শোন। বকে, কি না দাঁত তিনটি ঝিকমিক করবে; না হলে কথার মাথা নেই মুণ্ডু নেই, অত আবোল-তাবোল বকতে যাবে কেন বল তো?”

আমি অজ্ঞতার নীরব হাসি হাসিয়া কথাটা মানিয়া লই।

প্রকৃত তত্ত্বটা বুঝিতে পারিতেছি দেখিয়া রাণু আবার প্রশ্ন করে, “দাঁতে দাঁত দিয়ে এক-একবার ঘষে কেন বলতে পার, কুর-র কুর-র করে শব্দ করে?”

বলি, “তিনটি দাঁত ঝিকমিক করবে বলে।”

রাণু ধমক দিয়া উঠে, “বাস্, এইবার ঐ এক কথাই চলবে, ঝিকমিক করবে বলে; দাঁতের ওর যেন আর অন্য কাজ নেই। দাঁত ঘষবার আর কোন হেতু নেই, শুধু কখন কুট করে কামড় দিতে হবে, তার জন্যে ঘষেমেজে তোয়ের ক’রে রাখা; ওকে তুমি কম মানুষটি মনে কর নাকি? একবার যদি বাগিয়ে ধরতে পারলে তো তিনটি ছাপ না দিয়ে ছাড়বে না। আমি বাঘের মুখে হাত দিতে রাজী আছি, কিন্তু ও-মেয়ের কাছ থেকে একেবারে সাত হাত তফাতে থাকব, এই বলে দিলাম তোমায়।”

সাত হাতের প্রতিজ্ঞা সাত মিনিটও টিকে না। হাসিতে মুক্তাবৃষ্টি করিতে করিতে মৈয়া আসিয়া উপস্থিত হয়। সেই ঝিয়ের কোল, সেই রাঙা ঠোঁটে বাঁধানো তিনটি দাঁত, কিন্তু এত পরিচয়েও এটুকু পুরানো নয়।

রাণু গিয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে, ঝিয়ের কোল হইতে যেন ডাকাতি করিয়া কাড়িয়া লয়। হাসিতে গৌরবে একশা হইয়া গেল, “দেখ মেজকা, দেখ, কি চমৎকার মানায় হাসলে!”

মৈয়ার দাঁতে আঙুল টিপিয়া বলে, “আর কতটুকু দাঁত মেজকা, কুরকুর করে হাতে ঠেকে এমন চমৎকার!”

ভীত হইয়া তাড়াতাড়ি বলি, “হাত দিও না, দেবে এক্ষুনি কামড়ে রক্তপাত করে!”

“হ্যাঃ, তোমার যেমন কথা, ছবুরাণী আবার নাকি কামড়ায়! ক্ষীরে ঠেকলে দাঁতগুলো ভেঙে যাবে, এত নরম। তোমরা সবাই আমার ছবুরাণীর একটা বদনাম তুলে দিয়েছ, এতে যে তোমরা কি সুখ পাও! কি ছেলে তোমার ছবিরাণী, শুধু মায়ের নিন্দে, কি ছেলে তোমার?”

রাণু শেষের কথাগুলো মাথার একটা ঝাঁকানির সঙ্গে কপট গাম্ভীর্য ও হাসিতে মিলাইয়া এমনভাবে বলে যে, মৈয়া হঠাৎ হাসিতে একেবারে কুটিকুটি হইয়া পড়ে। তিনটি দাঁতে আলো ঠিকরাইয়া পড়িতে থাকে, কচি শরীরের কূল ছাপাইয়া লহর উঠে। থামিবার অবসর পায় না, থামিলেই রাণু সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ করিয়া দেয়, হাসির স্রোত দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে ঝাঁপাইয়া যেন চারিদিকে ছিটকাইয়া পড়ে।

.

বাড়ির নবীনতম সংবাদ-কাল বাবুলবাবুর শুভাগমন হইয়াছে, জন্মস্থান পূর্ণিয়া, বয়স ছয় মাস।

মানুষটি গম্ভীর প্রকৃতির। কপালটি প্রশস্ত হওয়ায় এবং মাথায় চুলের ভাগ অল্প হওয়ায় ভাবটি যেন একটু মুরুব্বীগোছের। আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া, পাতলা ঠোট দুইটি চাপিয়া শান্তভাবে সংসারের গতিবিধি নিরীক্ষণ করিতে থাকেন, এবং রহিয়া রহিয়া অনেকক্ষণ পরে পরে, সমস্ত শরীরটি দোলাইয়া এক-একবার উল্লাসে হাততালি দিয়া উঠেন; দেখিলে মনে হয়, হঠাৎ যেন জগৎ বিধানের কোনো গভীর তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছেন।

সিমলায় বাণিজ্য-বৈঠকে জাপানী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কি রফা হইল দেখিতেছিলাম, রাণু আসিয়া একটি গুরুতর সমস্যা হাজির করিল, বলিল, “আচ্ছা মেজকা, আমরা বড়রা ভাবি, কচি ছেলেমেয়েরা সুন্দর হয় ভাল চুল হলে, ভাল চোখ হলে, মোটা-সোঁটা নাদুস- নুদুস হলে, এই তো? কিন্তু ওরা নিজেরা কি ভাবে বল তো?”

এই রকম কোন প্রশ্ন উপস্থিত করিলে আমি রাণুর কাছে একটু ভয়ে ভয়েই উত্তর দিই; কারণ, ও যেমন এক দিকে শিশুদেরও শিশু বলিয়া জানে, অপর দিকে আমাকেও একটি শিশু বিশেষ বলিয়া ধরিয়া লয়। তবুও বলিলাম, “ওদের সুন্দর কুৎসিত সম্বন্ধে কি কোনো ধারণা আছে রাণু? ও-ধারণাটা জন্মাতে অনেক দেরি লাগে, বিশেষ করে নিজের সৌন্দর্য সম্বন্ধে। সর্বপ্রথমে ওদের জ্ঞান হয় খাওয়া নিয়ে—তোমায় একদিন বুঝিয়ে দোব যে, সেটা আত্মরক্ষা অর্থাৎ নিজেকে বাঁচাবার যে ইচ্ছে ইংরেজিতে যাকে বলে—”  

রাণু হো-হো করিয়া হাসিয়া বলিল, “তুমি যখন ওই রকম করে কি সব বলে যাও, আমার এত মিষ্টি লাগে মেজকা; ফুরসৎ থাকলে বসে বসে শুনতে ইচ্ছে করে। ছেলেরা নিজেদের কিচ্ছু জানে না, যত জান তুমি। কোন দিন বলে বসবে, ওই চিলটা যে উড়ে যাচ্ছে, তা ও নিজে না। ওমা! শঙ্খচিল! প্রণাম কর মেজকা, মাথায় বুদ্ধি দেন। ওমা! শঙ্খচিলকে বুঝি ওই রকম করে প্রণাম করে? হাত দুটো একত্তর করে এই রকম শাঁখের মত কর। হয় নি ও। হ্যাঁ, এইবার হয়েছে। অথচ বলবেন, ওঁর মতন কেউ কিচ্ছু জানে না। হ্যাঁ, কি যে বলছিলাম, আমরা ভাবি, চোখে চুলে রঙে ছেলেরা সুন্দর হয়। ওরা কিন্তু ভাবে, দাঁত যদি না রইল তো কিছুই নয়। হ্যাঁ মেজকা, ঠিক। আমি ভেবে সারা, বাবুল সর্বদা অমন ঠোঁট বুজে থাকে কেন, একটু ফিক করে হাসলে কখনও যদি, অমনই টপ করে ঠোট বুজে ফেললে। কোনো হদিস পাই না। তারপরে বুঝতে পারলাম, আহা, বেচারীর একটি মাঝের দাঁত বলে এত লজ্জা গো, আহা! তার ওপর দাদু যখন একদন্ত, হেরম্ব, লম্বোদর, গজানন বলে ঠাট্টা করেন, ও বেচারীর যেন মনে হয়, মা পৃথিবী, দ্বিধে হও, আর কত সইতে হবে! আহা, না বিশ্বাস হয়, এই দেখ।”

ছুটিয়া গিয়া বাবুলকে লইয়া আসে—আদর করিতে করিতে এবং আদরের অধিক আশ্বাস দিতে দিতে বলে, “না জাদু, তোমায় কেউ ঠাট্টা করতে পারবে না, চল তুমি, আমার সোনার মত একটি দাঁত কার আছে গো?”

কাছে আসিয়া বলে, “দেখি কেমন দাঁত, হাঁ কর তো জাদু আমার, বড় লক্ষ্মী ছেলে গো, বাবুলের মত লক্ষ্মী ছেলে—কর তো হাঁ।”

বাবুল অল্প একটু হাসির সহিত মুখটা গোঁজ করিয়া ঠোঁট দুইটি চাপিয়া ধরে, কোনোমতেই ঠোঁট খুলিবে না। একটা খেলা চলিতে থাকে, রাণু গাল দুইটি টিপিয়া ধরে, আঙুলের মধ্যে ঠোঁট দুইটি জড়ো করিয়া ধরে, চুমা খায়, শেষে কৃত্রিম রোষে ধমক দেয় পর্যন্ত; অবশেষে বিজয়িনীর ভঙ্গীতে আমার দিকে চাহিয়া বলে, “দেখলে তো? একটা গোটা রাজ্যি দিলেও হাঁ করবে না। আর তাও বলি মেজকা, দোষই বা দোব কি করে? কেউ কি নিজের খুঁত নিজে দেখাতে চায় মেজকা, তুমিই বল?”

বাবুলকে বুকে চাপিয়া দোল দেয় খানিকটা, তারপর বলে, “ওদিকে তোমার মৈয়ার গুমর তিনটি দাঁত বলে, আর এদিকে বাবুলবাবুর লজ্জা একটি দাঁত নিয়ে; তাহলে আর কি সন্দেহ রইল মেজকা যে, কচ্ছেলেরা নিশ্চয় ভাবে, দাঁত নিয়েই তাদের যা কিছু বাহার?”

হাতে আপাতত একটা দরকারী কাজ ছিল, অব্যাহতি পাইবার জন্য হাসিয়া বলিলাম, “না, আর মোটেই সন্দেহ রইল না।”

অভিমতটা যে রহস্যমাত্র, রাণুর মত মেয়ে তাহা না বুঝিয়াই পারে না; মুখটা একটু ভার করিয়া কহিল, “বেশ, কর না বিশ্বাস; নিজেই সব জান যখন—”

বাবুলকে লইয়া চলিয়া গেল। জানি, ও হারিবার পাত্রী নয়। এর পরে আরও গুরুতর প্রমাণ লইয়া হাজির হইবে, তখন ধীরে-সুস্থে ওকে বিশ্বাস করাইয়া ওর থিওরিটা মানিয়া লইয়া সন্তুষ্ট করা যাইবে। কাজের তাগিদে সে-সময়টা অন্যমনস্ক করিয়া দিতেছিল।

.

দিন দশেক হইল কর্মস্থানে আসিয়াছি। যতক্ষণ কাজের ভিড়ে থাকি, এক রকম কাটিয়া যায়। তাহার পর নিষ্কর্মতার সুপ্রচুর অবসরের মধ্যে মনটা যেন হাঁপাইয়া উঠে, দূরত্বের সমস্ত ব্যবধান ডিঙাইয়া বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হয়। সেখানে স্মৃতি-বিস্মৃতির আলো- ছায়ায় ব্যাকুল অনুসন্ধান চলিতে থাকে। উঠানের মাঝখানে যেন কোথা হইতে অনেকক্ষণ পরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি, ডাকিলাম, “মৈয়া কোথায় গা?”

ঘরের ছায়ার মধ্যে যেন খানিকটা আলো ফুটিয়া উঠে, মৈয়াকে কোলে লইয়া মুখে মুখ চাপিয়া রাণু বাহির হইল, “ও ছবু, তোমার ছেলে ডেকে ডেকে খুন হল আর তুমি কিনা দিব্যি—এ কেমনতর মা বাপু!”

বিদ্যুৎ-রেখার মত মৈয়া কোলে বাঁকিয়া পড়ে, ও আর থাকিবে না, কতক্ষণ পরে ছেলে আসিয়াছে।…দৃশ্যটা মিলাইয়া যায়। স্মৃতিমঞ্চে বাবুলের আবির্ভাব। গম্ভীর, নতদৃষ্টি; নিজের পায়ের বুড়া আঙুলটা ভক্ষণ করিতে হইলে মাথাটা নামাইয়া আনা দরকার, কি পা- টা তুলিয়া ধরা দরকার, সে সমস্যা মিটাইয়া উঠিতে পারিতেছে না, উভয় রকম পরীক্ষাই চলিতেছে।…মৈয়া আমার কোল হইতে ঝিয়ের কোলে যাইবে না, এক একবার ঘাড় বাঁকাইয়া দেখে আর প্রবল আপত্তিতে আমার গলা জড়াইয়া ধরে।…হঠাৎ সব মিলাইয়া যায়, যতই বেশি চেষ্টা করি, ততই সমস্তকে আড়াল করিয়া আমার বাসার সামনে তালগাছ দুইটার নির্মম রুক্ষতা স্পষ্ট হইয়া উঠে, কোন্ পথে যে মনটা বাড়ি গিয়া উঠিয়াছিল, কোনোমতেই ঠাহর করিয়া উঠিতে পারি না।

বাড়ি হইতে চিঠি আসিয়াছে, প্রয়োজনীয় খবর এক-একটি করিয়া দেওয়া আছে; কিন্তু নবপ্রবাসীর মন যে সব অপ্রয়োজনীয় খবরের জন্য বেশি কাতর, তাহার বিন্দুবিসর্গেরও উল্লেখ নাই।

কয়েকদিন এইভাবেই কাটিল। মনটা নিজের নির্জীবতায় ক্রমেই ভারি হইয়া কর্মের স্রোতে তলাইয়া যাইতে লাগিল।

এমন সময়, একদিন ডাকপিওন আপিসের চিঠি আর তিনখানা আমার নিজের চিঠি দিয়া একটা আকণ্ঠ ঢাকা সবুজ লেফাফা বাহির করিল। বলিল, “দেখুন তো বাবু, এটা কি আপনার চিঠি? একেবারে আন্ডারপেড, না আছে পুরো ঠিকানা, না আছে কিছু, শুধু বাংলা অক্ষর দেখে নিয়ে এলাম। ভাবলাম এখানে বাঙালি তো এক আপনিই আছেন, দেখি জিজ্ঞেস করে।”

প্রথমটা লইতে চাহিলাম না। ডাক-বিভাগের দয়ায় এক আনার কনসেশন টিকিট হওয়া পর্যন্ত রোজই গড়ে তিন-চারটা করিয়া পয়সা দণ্ড দিতে হইতেছে। একটা খাম ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে অন্যমনস্ক ভাবেই বলিলাম, “না ফেরত দেগে।”

পিওন একটু দূরে গেলে কেমন একটা কৌতূহল হইল। ঠিকানা নাই, কিছু নাই, এ আবার কেমনধারা চিঠি! একবার দেখিতে হয় তো! ডাক দিয়া ফিরাইলাম।

ঠিকানাটা পড়িয়া হাসিয়া বলিলাম, “হ্যাঁ, আমার চিঠিই বটে।” পকেট হইতে আড়াই আনা পয়সা বাহির করিয়া দিয়া তাহাকে বিদায় করিলাম। রাণুর চিঠি। ঠিকানার মধ্যে শুধু ছোট বড় অক্ষরে ‘মেজকাকা’; আর রাণুর নিজের ব্যাকরণের পদ্ধতিতে গ্রামের নামটা। শহরের পোস্ট-আপিসের কোনো বাঙালি কেরানী সেটাকে লাল কালিতে ইংরেজিতে লিখিয়া দিয়াছে। গ্রাম আর পোস্ট-আপিস একই হওয়ায় চিঠিটা আসিয়া নির্বিঘ্নে পৌঁছিয়াছে।

অন্য পত্র ছাড়িয়া আগ্রহের সহিত রাণুর পত্রই আগে খুলিয়া ফেলিলাম। হাতের লেখার খাতা থেকে ছেঁড়া, বড় বড় রুলটানা চারখানা পাতায় ঠাসা লেখা একখানি বৃহৎ লিপি। যথাযথ তুলিয়া দিলে সকলের বোধগম্য হইবে না বলিয়া বানান প্রভৃতি একটু-আধটু পরিবর্তিত করিয়া দিলাম—”

মেজকা, তোমার আর সব ভাল, কিন্তু টপ করে আমার কথা বিশ্বাস করতে চাও না—ওই এক কেমন রোগ। কচি ছেলেরা যদি দাঁত সব্বার চেয়ে ভাল না ভাববে তো ছবুরাণী অমন করে কথায় কথায় হাসতে যাবে কেন, আর বাবুলই বা মুখটি বুজে থাকবে কেন? বেশ, আমার কথাটা না হয় মিথ্যে, কিন্তু সেদিন যে কাণ্ডটা হল, তা কিসের জন্যে বল তো? দাদু বাইরে যান নি, সমস্ত দিন বেচারীকে ক্ষেপিয়েছেন, ‘একদন্ত গজানন’ ‘একদন্ত গজানন’ বলে। সমস্ত দিন মুখটি চুন, কিছু খাবে না, শুধু বায়না আর বায়না। সন্ধ্যের পরে কাকীমা বললেন, বড্ড গরমে ছেলেগুলো সেদ্ধ হচ্ছে রাণু, চল, ছাতে নিয়ে যাই। কাকীমা, আমি, ছবি, ছোট-কাকা আর বাবুল। জোছনা ফুটফুট করছে, আর তেমনই হাওয়া। আমি বললুম, মিথ্যে বল নি কাকীমা। তোমার মৈয়া তক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ল। উনি একটু আবার আয়েসী কিনা।

মাদুরে শুইয়ে দিলাম। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছিল, তা যদি দেখতে মেজকা! মুখটি একটু ফাঁক হয়ে গেছে। চাঁদের চেয়েও সাদা তিনটি দাঁত। বলে, চাঁদ ফেলে আমায় দেখ। ছোট- কাকা বললে চল বউদি, আলসের ওপর বসি, খুব হাওয়া লাগবে, অত চেপে-মারা পর্দা মানি না। বাবুলকে ছবুরাণীর কাছে ঝুমঝুমিটা দিয়ে বসিয়ে ওদিকে আলসের ওপর উঠে বসলাম। বসবে কি লোকে ছাই, তার কি জো আছে? ছেলে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। ছুটে গিয়ে সবাই দেখি, চোরের তিনটি আঙুল জাঁতি-কলে আটকে রয়েছে। দাঁত যে উপড়ে ফেলা যায় না, সে আর ও ছেলেমানুষ কি করে জানবে বল? ভাবলে দাঁতের গেরস্ত ঘুমুচ্ছে, এই ফাঁক-তালে একটা চুরি করে নিই। আমার তা হলে দুটি হবে দিব্যিটি। শয়তানিটা বোঝ একবার। এদিকে গেরস্ত ছবিরাণী যে কি হুঁশিয়ার মেয়ে, তা তো আর জানে না বাবু। না বিশ্বাস হয়, দাদুকে জিজ্ঞেস করে পাঠিও। তিনিই তো বললেন, এ ডাহা চুরির চেষ্টা।

আহা মেজকাকা, লজ্জানিবারণ হরি সত্যি সব দেখতে পান। বললেন, হ্যাঁ, তোর দাঁতের জন্য এত হেনস্তা? রস। তার পরদিন বাবুলের জ্বর, পেটের অসুখ, ছেলে যেন নেতিয়ে পড়ল। বললে পেত্যয় যাবে না, তার পরের পরদিন নীচে একটি দাঁত! আমিই প্রথমে দেখে সবাইকে বললাম। বাবুল আর সে বাবুল নেই মেজকাকা। কথায় কথায় হাসি, কথায় কথায় হাসি, আর কি দুরন্ত! ছবুরাণীর মত আর একটি দাঁত হলে ও ছেলে যে কি করবে ভেবে পাই না।

পাঁচটি কচি দাঁতের হাসিতে বাড়ি একেবারে আলো করে রেখেছে মেজকাকা। কি যে চমৎকার, না দেখলে পেত্যয় যাবে না। তুমি শিগগির একবার ছুটি নিয়ে এস। নায়েবকে সব কথা খুলে বললেই ছুটি দিয়ে দেবে। তাদেরও কচি ছেলে আছে তো; আর তাদেরও তো এই রকম একটি দুটি করে দাঁত ওঠে!

আজ উনিশ দিন ধরিয়া এই চিঠিরই প্রতীক্ষা করিয়াছি। এর অযথা কাকলি আমায় এক মুহূর্তেই আবার বাড়িতে আমার নিজের জায়গাটিতে লইয়া গিয়া দাঁড় করাইল, যেখানে গম্ভীর সাংসারিকতার বাহিরে মৈয়া, বাবুল, রাণু আর ওদের দলের যত সব অকেজোরা দিবারাত তাহাদের অর্থহীন খেয়াল-খুশির স্রোত বহাইয়া চলিয়াছে।

মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। ডাক পড়িয়া রহিল। সেগুলো সহকারীর ওখানে পাঠাইয়া দিতে হইবে, আপাতত সাহেবের নিকট দুইটা দিনের ছুটি লইতে হয়। শেফালি-স্তবকের মত রাঙায় সাদায় আলো-করা দুইটি কচি মুখের হাসি আমায় প্রবল আকর্ষণে টানিতেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *