দহনকালের শেষে – ২

০৬.

স্কুল ছুটির পর সপ্তাহে তিন দিন কোচিং ক্লাসে যায় শিঞ্জিনী। একদিন দেবারতি মিসের বাড়ি, বাকি দুদিন অন্য দুজায়গায়। হায়ার সেকেন্ডারির যে বিশাল কোর্স তাতে ভালো রেজাল্ট করতে হলে প্রাইভেট টিউশন ছাড়া গতি নেই। এই তিন দিন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায় তার। কোচিং ক্লাসের ব্যাপারটা ইন্দ্রনাথের জানা। তাই এই কটা দিন নাতনী দেরিতে ফিরলে তার দুশ্চিন্তা হয় না।

শিঞ্জিনীর সঙ্গে স্বর্ণালীও ওই তিনটে কোচিং ক্লাসে পড়তে যায়। ইচ্ছা করলে ওর বাবা বাড়িতে পড়িয়ে যাবার জন্য কয়েক গণ্ডা টিউটর রাখতে পারেন। কিন্তু তিনি চান তার মেয়েরা অন্য দশটা সাধারণ ফ্যামিলির মেয়েদের মতো একটু কষ্ট করে মানুষ তোক।

আজ দেবারতি মিসের ক্লাস। স্কুল ছুটির পর শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী ছুটতে ছুটতে বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। এখন চারটে বেজে পঁচিশ। পাঁচটায় দেবারতি মিসের ক্লাসে তাদের পৌঁছুতেই হবে। তিনি ইংরেজি পড়ান। কঁটায় কাঁটায় পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটা। তারপর অন্য ব্যাচ পড়তে আসবে।

দেবারতি মিস একটা বিখ্যাত মিশনারি স্কুলে সিনিয়র টিচার ছিলেন। কিন্তু সারাদিন বাড়িতে ব্যাচের পর ব্যাচ হায়ার সেকেন্ডারির ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে স্কুলে যাবার সময় পেতেন না। তাই বছর দুই হল চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নটা বাজতে না বাজতে এখন নাকেমুখে গুঁজে বাস কি ট্যাক্সি ধরতে হয় না। দশটায় স্কুলে হাজিরা দেবার হাঙ্গামা নেই। নিজের ফ্ল্যাটে বসে পড়িয়ে গেলেই হল। ফাঁকে ফাঁকে স্নান, খাওয়া, রেস্ট। তাছাড়া, স্কুল থেকে যা মাইনে পেতেন, প্রাইভেট টিউশন করে এখন তার পাঁচগুণ রোজগার। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সময়কে তিনি নিজের ইচ্ছামতো কাজে লাগাতে পারেন।

খুব ছোট্ট পরিবার ওঁদের। দেবারতি মিস আর একমাত্র ছেলে রজত। রজত শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। খুব সম্ভব, থার্ড ইয়ারে। ওখানেই হোস্টেলে থাকে। ছুটিতে মায়ের কাছে আসে।

দেবারতি মিস দারুণ পড়ান। এমন তৈরি করে দেন যে হায়ার সেকেন্ডারির ছেলেমেয়েরা চোখ বুজে এইটি-এইটি ফাইভ পারসেন্ট মার্কস পেয়ে যায়। যে দেড় ঘণ্টা তিনি ক্লাস নেন তার মধ্যে এতটুকু ফাঁকি নেই। বাজে গল্প করে সময় নষ্ট করা নেই। পৌঁছুতে পাঁচ-দশ মিনিট দেরি হলে নিজেদেরই ক্ষতি। তাই শিঞ্জিনীদের এমন তাড়াহুড়ো, এমন ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়।

দেবারতি মিসেস ফ্ল্যাট শিঞ্জিনীদের স্কুল থেকে অনেকটা দূরে। বাসে কি অটোয় যেতে হয়। বাস থেমে থেমে, লোক তুলতে তুলতে যায়। তাই সময় বেশি লাগে। তাই ওরা অটোই ধরে।

ছুটির পর ভীষণ খিদে পায়। কিন্তু ফাস্ট ফুড মিষ্টির দোকানে খেতে গেলে কম করে পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগবে। সময় বাঁচাবার জন্য শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী প্যাটিস কি কেক-টেক কিনে অটোয় বসে খেতে খেতে যায়।

দেবারতি মিসদের বাড়িটা এগারোতলা বিশাল এক হাইরাইজ। নাম আকাশ দীপ। বাড়িটার তিনতলায় ওঁদের তিন কামরার মস্ত ফ্ল্যাট।

আকাশ দীপ-এর সামনে অটো থেকে শিঞ্জিনীরা যখন নামল, পাঁচটা বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। ভাড়া মিটিয়ে বাড়িটার দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছে, স্বর্ণালী চাপা গলায় বলল, ওপর দিকে তাকিয়ে দ্যাখ

আগেই লক্ষ্য করেছিল শিঞ্জিনী। দেবারতি মিসদের রাস্তায় দিকের চওড়া ব্যালকনিতে রজত দাঁড়িয়ে আছে। কিছুদিন ধরেই তার চোখে পড়ছে, যেদিন এখানে সে পড়তে আসে, রজতকে ওই ব্যালকনিটায় দেখা যায়। প্রতি সপ্তাহে না হলেও, প্রায়ই। এখন ওদের কলেজ পুরোদমে চলছে। কোনওরকম ছুটি-ছাটা নেই। নিশ্চয়ই কিছু একটা ছুতো তৈরি করে শিবপুর থেকে চলে আসে। দেবারতি মিসকে হুটহাট চলে আসার কী কারণ দেখায়, শিঞ্জিনী জানে না। হয়তো মায়ের ধারণা, তাঁকে বেশিদিন না দেখলে ছেলের মন খারাপ হয়ে যায়, তাই না এসে পারে না। কিন্তু তার বাড়ি আসার কেন এত গরজ, আকর্ষণটা কোথায়, শিঞ্জিনী তা খুব ভালো করেই জানে। আর জানে স্বর্ণালী।

দেড় বছর দেবারতি মিসের কাছে পড়ছে শিঞ্জিনী। প্রথম যেদিন রজত তাকে দেখে তখন থেকেই মুগ্ধ হয়ে আছে। ঘোরটা কিছুতেই আর কাটছে না। আগে আগে দূর থেকেই তাকিয়ে থাকত। পরে সাহস বাড়ছিল। দেবারতি মিসের ক্লাস শেষ হলে রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা করত। এমনিতে খুব ভদ্র, মার্জিত। স্বর্ণালীর সামনেই সাধারণ দু-একটা কথা হত। পড়াশোনা কীরকম চলছে, হায়ার সেকেন্ডারির পর কোন সাবজেক্টে অনার্স নেবে, বাড়িতে কে কে আছে, ইত্যাদি। আপত্তিকর একটি শব্দও রজতের মুখ থেকে বেরুত না। কথাবার্তা এবং আচরণ কখনও শালীনতার সীমা ছাড়া না।

সপ্তাহ তিনেক আগে স্বর্ণালীর সামনেই একটা মুখ-আঁটা সাদা খাম তাকে দিয়ে রজত বলেছিল, এটা বাড়িতে গিয়ে পড়ো। যা লিখেছি তোমার বন্ধু স্বর্ণালীকেও জানাতে পারো।

সতেরো-পেরুনো এক তরুণীর কাছে এক ঝকঝকে অনাত্মীয় যুবকের প্রথম চিঠি। হৃৎস্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল শিঞ্জিনীর। তারপর চিঠিটা বইয়ের ব্যাগে পুরে খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, আপনি কী লিখেছেন, বুঝতে পারছি। তবু পড়ব, বন্ধুকেও পড়াব।

এই সময় অটো এসে গিয়েছিল। শিঞ্জিনীরা আর দাঁড়ায়নি, চটপট উঠে পড়েছিল।

যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই। রজতের চিঠিটা নিছকই প্রেমপত্র। উচ্ছ্বাস আবেগ প্রতিটি লাইন থেকে যেন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।

চিঠিটা স্বর্ণালীকেও পড়িয়েছে শিঞ্জিনী। সে খুশিই হয়েছিল, দেবারতি মিসের ছেলে। দারুণ স্টুডেন্ট। তোকে তো চিনি। যা মাথা গরম! না বলে দিস না।

শিঞ্জিনী উত্তর দেয়নি। জীবনে প্রথম যে পুরুষটিকে সে দেখে সে অনির্বাণ। এই নোংরা, জঘন্য লোকটা মৃদুলার মতো তার মনেও পুরুষদের সম্পর্কে চিরস্থায়ী ঘৃণা আর সন্দেহ সৃষ্টি করে রেখেছে। এর বাইরে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

স্বর্ণালী সেই চিঠির ব্যাপারে আরও অনেকবার জানতে চেয়েছে, কী রে, কী করবি?

শিঞ্জিনীর জবাব খুবই সংক্ষিপ্ত, দেখি–

সেই যে রজত চিঠি দিয়েছিল, তারপর মাঝখানে দুসপ্তাহ শিবপুর থেকে আসেনি। আজ আবার তাকে দেখা গেল।

বন্ধুর হাতে আঙুলের আলতো খোঁচা দিয়ে স্বর্ণালী বলল, ওপরে তাকা একবার।

তাকাবার কিছু নেই। শিঞ্জিনী বলল, রজত দাঁড়িয়ে আছে তো?

 ও বাবা, এর মধ্যে দেখা হয়ে গেছে!

 শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

স্বর্ণালী বলল, কীরকম চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে দ্যাখ—

 শিঞ্জিনী বলল, থাক তাকিয়ে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে না থেকে এখন চল তো–

আকাশ দীপ-এর বিশাল গেটের দিকে দুজনে পা বাড়িয়ে দেয়। এ-বাড়ির সিকিউরিটির ভীষণ কড়াকড়ি। মস্ত গোবদা একখানা খাতায় খোপ-কাটা ঘরে ভিজিটরদের নাম, ঠিকানা, কার সঙ্গে দেখা করবে, ইত্যাদি লিখতে হয়। কিন্তু শিঞ্জিনীরা দেড় বছর এখানে আসছে। সিকিউরিটি গার্ডরা সবাই তাদের চেনে। ওদের বেলা নিয়মটা শিথিল। ভিজিটরস বুকে কিছুই লিখতে হয় না।

যে মাঝবয়সি ইউনিফর্ম-পরা লোকটা খাতা-কলম নিয়ে গেটের কাছাকাছি বসে আছে, শিঞ্জিনীদের দেখে সে একটু হাসল। শিঞ্জিনীরাও হেসে তার পাশ দিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। একজোড়া লিফট আছে। কিন্তু সে দুটো সদাব্যস্ত। সারাক্ষণ ওঠা-নামা করছে। হয়তো গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামছিল, হঠাৎ ওপরে উঠে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা না করলে চড়া যায় না।

শিঞ্জিনীরা কোনওদিনই লিফটে করে ওপরে যায় না। তিনটে তো মোটে ফ্লোর। টকাটক সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়।

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে স্বর্ণালী বলল, আজ তোকে নিশ্চয়ই ধরবে।

শিঞ্জিনী আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। শুধু শুধু কি আর শিবপুর থেকে চলে এসেছে?

 চিঠিতে যা লিখেছে তার কী উত্তর দিবি?

 কিছু তো একটা দিতেই হবে। দেখা যাক—

একসময় ওরা তেতলায় পৌঁছে গেল।

.

শিঞ্জিনীরা ছাড়াও লোরেটো, গোখেল আর সাউথ পয়েন্টের আরও তিনটি মেয়ে এই ব্যাচটায় রয়েছে। সাড়ে ছটায় ছুটির পর পাঁচজন বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে আসে। শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী রাস্তার ওপারে চলে যায়। ওদিক থেকেই তাদের অটো বা মিনিবাস ধরতে হবে। অন্য তিনজন যাবে উলটো দিকে। তারা এধারের ফুটপাতে বাস-টাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

যতই উদাসীন থাকতে চেষ্টা করুক, ভেতরে ভেতরে স্নায়ুগুলো কিন্তু টান টান হয়েই আছে। নিজের অজান্তেই চোরা দৃষ্টিতে এধারে-ওধারে তাকাল শিঞ্জিনী। যা ভাবা গিয়েছিল, তা-ই। ডান পাশে, খানিক দূরে একটা প্রাইভেট টেলিফোন বুথ। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রজত আর হাত নেড়ে নেড়ে ইশারায় ওখানে যেতে বলছে।

স্বর্ণালীও রজতকে লক্ষ্য করেছিল। বলল, চল, ডাকছে

 শিঞ্জিনী আপত্তি করল না। নীরবে স্বর্ণালীকে নিয়ে রজতের কাছে চলে এল।

রজত বলল, কোথাও বসে কথা বলতে পারলে ভালো হয়। ওখানে একটা রেস্তোরাঁ আছে। চলো– রাস্তাটা যেখানে মোড় ঘুরে বাঁয়ে বেঁকে গেছে, সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সে।

শিঞ্জিনী বলে, না। সম্ভব নয় বলেই মনে হল, কথাটা বেশ রূঢ়ই হয়ে গেছে। পরক্ষণে সুর নরম করে বলল, এখন রেস্তোরাঁয় গেলে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। আমার দাদু ভীষণ চিন্তা করবেন।

.

প্রথমটা খতিয়ে গিয়েছিল রজত। শিঞ্জিনীদের রেস্তোরাঁয় না যাবার কারণটা এবার যুক্তিসঙ্গত মনে হল। সে বলল, তা হলে

যা বলার এখানেই বলুন।

 এই রাস্তায়!

শিঞ্জিনী জবাব দিল না।

রজত বলে, ঠিক আছে। অনেকে আমাদের লক্ষ্য করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। চলো, হাঁটতে হাঁটতে বলা যাক। স্বর্ণালীকে বলল, আমরা একটু আগে আগে হাঁটছি। তুমি পেছন পেছন এসো স্বর্ণালীর সামনে সে কথাটা বলতে চায় না।

ফুটপাত ধরে শিঞ্জিনী আর রজত পাশাপাশি ওধারের মোড়ের দিকে চলেছে ধীর গতিতে। তাদের দশ-বারো ফিট পেছনে স্বর্ণালী।

প্রচুর বাংলা-ইংরাজি লাভ স্টোরি পড়েছে স্বর্ণালী। কিন্তু কোনও প্রেমকাহিনিতেই এমন দৃশ্য আছে কিনা, তার মনে পড়ল না। ভীষণ মজা লাগছিল। কুল কুল করে পেটের ভেতর থেকে হাসি উঠে আসছে। ঠোঁট টিপে হাসিটাকে রুখে দিল সে।

রজত নীচু গলায় বলছিল, কিছু ভাবলে?

শিঞ্জিনী চকিতে ঠিক করে নিল, রজত অসন্তুষ্ট হয়, এমন কিছু করা বা বলা ঠিক হবে না। রজত খুব ভদ্র, কিন্তু চটে গেলে মানুষের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। দেবারতি মিসের কাছে তার নামে সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে লাগাতেও পারে। তখন দেবারতি মিস যদি পড়াতে না চান? এমন একজন ভালো টিচার কোথায় পাওয়া যাবে?

শিঞ্জিনী চোখের কোণ দিয়ে একবার রজতকে দেখে নিল। তারপর বলল, দেখুন, ফাইনাল পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। এখন অন্যদিকে মন গেলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আমি ভালো রেজাল্ট করতে চাই।

রজত একটু বিব্রত হল, মায়ের কাছে শুনেছি, তুমি ভালো স্টুডেন্ট রেজাল্ট তোমার ভালো হবেই।

পড়ায় কনসেনট্রেট করতে পারলে, তবেই না? তা ছাড়া

কী?

 আমার লাইফের একটা এইম আছে। আমি ভালো কেরিয়ার করতে চাই।

নিশ্চয়ই করবে।

এম.এ. পাশ না করতে পারলে সেটা সম্ভব নয়।

নিজের পায়ে দাঁড়াতে আমারও তিন-চার বছর লেগে যাবে। তোমার এম.এ. পর্যন্ত আমি ওয়েট করতে রাজি। তুমি কী বলো?

একটু নীরবতা।

তারপর শিঞ্জিনী বলল, আমার মা আছেন, দাদু আছেন। আমার সম্বন্ধে যা ভাবার তারাই ভাবেন। ওঁদের লুকিয়ে আমি কিছু করি না।

রজত হকচকিয়ে গেল, না, না, লুকোবার প্রশ্নই নেই। তুমি যদি বলো, আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করব।

শিঞ্জিনী চমকে ওঠে, না, না, একেবারেই না।

কেন বলো তো?

আমার দাদু এখন এসব পছন্দ করবেন না।

তা হলে?

শিঞ্জিনী বলল, আমার পরীক্ষা-টরীক্ষা হয়ে যাক। তারপর কী করা যায়, ভাবা যাবে। তার ইচ্ছা, ব্যাপারটাকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত টেনে দিয়ে যাওয়া। পরীক্ষা হয়ে গেলে রজতকে পাত্তাই দেবে না। পরিষ্কার জানিয়ে দেবে, তার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।

রজতকে হতাশ দেখায়। সে বলে, ঠিক আছে। পরীক্ষাটা হয়েই যাক। দু-তিন মাস পর আমারও একটা পরীক্ষা রয়েছে। এর মধ্যে বাড়ি আসা সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। খুব খারাপ লাগছে।

শিঞ্জিনী মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কোনও উত্তর দেয় না।

রজত বলল, তোমাদের ফোন নাম্বারটা লিখে দাও।

সচকিত শিঞ্জিনী বলল, কেন বলুন তো?

 দেখা না হোক, মাঝে মাঝে আমরা কথা বলতে পারব।

 ত্রস্ত সুরে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে শিঞ্জিনী, না না—

 রজত অবাক। জিগ্যেস করে, না কেন? ফোনে কথা বললে, দোষের কী আছে?

শিঞ্জিনী জানায়, তাদের টেলিফোনটা আছে দাদুর ঘরে, তার মাথার কাছে একটা টেবলের ওপর। বাইরে থেকে যার ফোনই আসুক, তিনিই প্রথমে সেটা ধরেন।

দাদু কড়া ধাতের সেকেলে মানুষ, ভীষণ রক্ষণশীল। অনাত্মীয় যুবক নাতনির সঙ্গে ফোনে গল্প করতে চাইছে, কিছুতেই তা বরদাস্ত করবেন না। এতে শিঞ্জিনী ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। রজত সম্পর্কে জেরা করে করে দাদু তাকে নাজেহাল তো করবেনই। এমনকী স্কুলে এবং কোচিং ক্লাসে যাবার সময় পাহারাদারও সঙ্গে দেবেন। বানিয়ে বানিয়ে ইন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রজতের মাথায় একটা ভীতিকর ধারণা তৈরি করে দিল।

রজত বেশ মুষড়ে পড়ে। খানিকক্ষণ কী ভেবে বলে, আমার একটা কথা রাখবে?

কী?

আমাকে তো ফোন করতে বারণ করলে। তুমিই বরং রাস্তায় কোনও বুথ থেকে আমার হোস্টেলে ফোন করো। সকালের দিকে এগারোটা পর্যন্ত আর বিকেলে পাঁচটার পর আমাকে হোস্টেলে পাবে।

রজত একেবারে নাছোড়বান্দা। মনে মনে শিঞ্জিনী ঠিক করে ফেলল, কোনওদিনই রজতকে ফোন করবে না। মুখে অবশ্য বলল, ঠিক আছে। তবে রোজ আমার ফোন এক্সপেক্ট করবেন না।

না, না, মাঝে মাঝে করলেই খুশি হব। শিঞ্জিনীর কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে বিপুল উৎসাহে হোস্টেলের ফোন নাম্বারটা লিখে দিল রজত।

কলম-টলম ব্যাগে পুরতে পুরতে ব্যস্তভাবে শিঞ্জিনী বলল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার কিন্তু আমাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। রজতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলন্ত একটা অটো থামিয়ে স্বর্ণালীকে ডেকে চোখের পলকে উঠে পড়ল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইল রজত।

অটো ফের ছুটতে শুরু করেছিল। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে, ঠোঁট টিপে মজাদার একটা ভঙ্গি করল স্বর্ণালী। তারপর শিঞ্জিনীর কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, দুজনে দারুণ জমে গিয়েছিলি।

তেরছা চোখে স্বর্ণালীকে দেখতে দেখতে রুক্ষ গলায় শিঞ্জিনী বলল, জমে গিয়েছিলাম। তোর তা-ই মনে হল।

বন্ধুকে নিয়ে একটু মজা করতে ইচ্ছা হয়েছিল স্বর্ণালীর। কিন্তু তার মেজাজ দেখে দমে গেল। জিগ্যেস করল, কী কথা হল তোদের?

সিটের ধার ঘেঁষে বসেছিল শিঞ্জিনী। কিছুক্ষণ চুপচাপ বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে সমস্ত বলে গেল।

স্বর্ণালী বলল, কিছু লুকোচ্ছিস না তো?

শিঞ্জিনী বলল, তোর কাছে আমি কিছু লুকোই?

 স্বর্ণালী জবাব দিল না।

শিঞ্জিনী ফের বলে, আমাদের ফ্যামিলির সব কথা তোকে জানিয়েছি। পুরুষদের আমি ঘৃণা করি। আই হেট দেম।

স্বর্ণালী চমকে ওঠে, রজতকে এসব বলেছিস!

পাগল! আরও কটা মাস দেবারতি মিসের কাছে পড়তে হবে না? ছেলেকে খেপিয়ে দিলে মা কি আমাকে কোলে বসিয়ে আদর করে পোলাও-মাংস খাওয়াবে? এই খাবার দুটো শিঞ্জিনীর খুবই প্রিয়।

স্বর্ণালী বলল, ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করতে চাইছিস?

কখনও কখনও ট্যাক্টফুল তো হতেই হয়। হায়ার সেকেন্ডারিটা হয়ে যাক। আই শ্যাল টোটালি ফরগেট ইট।

.

০৭.

যেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর শিঞ্জিনীর ঘরে এসে মৃদুলা বিমলেশ বসুমল্লিকের কথা বলেছিল, তারপর দিন দশেক কেটে গেছে।

আজ রবিবার। ছুটির দিন।

কালই মৃদুলা জানিয়ে দিয়েছিল, আজ বিমলেশের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবে। এগারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে শিঞ্জিনীকে নিয়ে বেরুবে। সে যেন তার মধ্যেই তৈরি হয়ে নেয়। লাঞ্চের ব্যবস্থা বাইরে করা হয়েছে।

ইন্দ্রনাথকে বিমলেশের কথা ঘুণাক্ষরেও জানায়নি মৃদুলা। তাকে শুধু বলেছে, দুপুরে এক কলিগের বাড়িতে তার আর শিঞ্জিনীর নেমন্তন্ন। উপলক্ষ, সহকর্মীটির ছেলের পৈতে।

কাঁটায় কাঁটায় এগারোটায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মৃদুলা। বাড়ির সামনে একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে যাওয়ায় সুবিধাই হল। নইলে মোড় পর্যন্ত হেঁটে যেতে হত। কেননা ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডটা ওখানেই।

গাড়িতে উঠে মৃদুলা ড্রাইভারকে বলল পার্ক স্ট্রিট চলুন—

রবিবার। তাই রাস্তা আজ প্রায় কঁকাই। ট্যাক্সি প্রায় ডানা মেলে উড়তে লাগল।

ব্যাক সিটের এক জানালার পাশে বসেছে মৃদুলা অন্য জানালার ধারে শিঞ্জিনী। মায়ের মুখে পার্ক স্ট্রিট শুনেই সে বুঝে গেছে ওখানেই কোথাও বিমলেশ তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ভদ্রলোক কেন তার সঙ্গে আলাপ করতে চান, কী বলবেন তিনি, কিছুই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। বিতৃষ্ণা, বিরক্তি, সেই সঙ্গে অনেকখানি কৌতূহল। সব মিলেমিশে মনের ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে। অন্যমনস্কর মতো জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী।

তিন ফুট দুরত্বে বসে মৃদুলা মেয়েকে লক্ষ্য করছিল। লহমার জন্যও চোখ অন্য কোনও দিকে সরায়নি।

ট্যাক্সি দু-তিনটে রাস্তা ঘুরে এখন টালিগঞ্জ রেলব্রিজের কাছে চলে এসেছে। মৃদুলা শিঞ্জিনীর দিকে এগিয়ে এসে ঘন হয়ে বসল। কোমল স্বরে ডাকল, রূপা

সামান্য চমকে উঠে মুখ ফেরায় শিঞ্জিনী, কী বলছ?

 খুব টেনশন হচ্ছে?

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

মৃদুলা এবার বলল, বিমলেশ বসুমল্লিকের সঙ্গে আলাপ হলে বুঝবি, পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব বেশি হয় না।

এমন স্তুতিবাক্য আগেও মায়ের মুখে শুনেছে। শিঞ্জিনী চুপ করে থাকে।

মৃদুলা থামেনি, আমার কথা বিশ্বাস কর, ওঁকে দেখলে তোর খুব ভালো লাগবে। দেখবি তোকে কত স্নেহ করবেন। রিল্যাক্স

শিঞ্জিনীর এবারও জবাব নেই।

 মৃদুলাও আর কিছু বলল না।

একসময় ট্যাক্সি পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা এয়ার-কন্ডিশড রেস্তোরাঁর সামনে আসতে মৃদুলা ড্রাইভারকে থামতে বলে। তারপর ভাড়া মিটিয়ে মেয়েকে নিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে চলে আসে।

এয়ার-কন্ডিশনড হওয়ায় ভেতরটা বেশ আরামদায়ক। নরম আলোয় চারদিক ভরে আছে।

রেস্তোরাঁটা দোতলা। এখানে বার নেই। শুধুই খাওয়ার ব্যবস্থা। একতলার বিশাল হলঘরে অসংখ্য টেবল পাতা। তার একপাশে ক্যাশ কাউন্টার।

এখনও লাঞ্চ টাইম শুরু হয়নি। অল্প কিছু লোকজন এধারে-ওধারে, নানা টেবলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে।

হলঘরটার মাঝখানে থেকে টাইলস-বসানো ঘোরানো সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে।

এ ধরনের দামি রেস্তোরাঁয় আগে কখনও আসেনি শিঞ্জিনী। তার অবাক এবং মুগ্ধ হবার কথা। কিন্তু কিছুই ভালো করে লক্ষ্য করছিল না সে। ভেতরে ভেতরে সেই টেনশনটা দ্রুত বেড়েই চলেছে। এই হলঘরে কোন লোকটা বিমলেশ বসুমল্লিক, কে জানে। মৃদুলা যথেষ্ট গুণকীর্তন করলেও আসলে তিনি ঠিক কেমন মানুষ?

মৃদুলা কিন্তু একতলার কোনও টেবলের সামনেই গেল না। সিঁড়ি দিয়ে মেয়েকে নিয়ে দোতলায় উঠে এল। এখানেও নীচের তলার মতোই মস্ত হল। তেমনই সারি সারি টেবল এবং চেয়ার পাতা। চারপাশ চমৎকার সাজানো। এখানেও ভিড়-টিড় নেই। নানা বয়সের কয়েক জোড়া পুরুষ এবং মহিলা কটা টেবলে বসে নীচু গলায় গল্প করছে। চার-পাঁচটা স্মার্ট চেহারার উর্দি-পরা বেয়ারা একধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে। এই মুহূর্তে তাদের বিশেষ তাড়া নেই। এখন সমস্ত কিছুই ঢিলেঢালা, আলস্য-জড়ানো।

হলঘরের শেষ মাথায় চৌকো পিলারের পাশে একটা টেবলে যিনি একা বসে ছিলেন, সোজা তার কাছে শিঞ্জিনীকে সঙ্গে করে চলে এল মৃদুলা।

আগে এঁকে না দেখলেও স্বর্ণালীর নিখুঁত বর্ণনাটা মস্তিষ্কের কোনও অদৃশ্য কম্পিউটারে ধরা ছিল। হুবহু সেই চেহারা। পরনে দামি ট্রাউজার্স আর শার্ট। চওড়া কবজিতে নামকরা কোম্পানির চৌকো ঘড়ি। শিঞ্জিনী শুনেছে, সফল মানুষদের চোখে-মুখে আলাদা দ্যুতি থাকে। এই মানুষটিকে ঘিরে তেমনই উজ্জ্বলতা।

বিমলেশ শিঞ্জিনীদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

মৃদুলা বলল, আগে পরিচয় করিয়ে দিই।

বিমলেশ হাত তুলে মৃদুলাকে থামিয়ে দিতে দিতে বললেন, কিচ্ছু করাতে হবে না। ওটা আমরা নিজেরাই করে নিচ্ছি। হাসিমুখে শিঞ্জিনীকে বললেন, ইউ মাস্ট বি শিঞ্জিনী-মানে রূপা। আমি বিমলেশ। আশা করি, আমার নামটা মায়ের মুখে শুনেছ।

নিজের মধ্যে কাঠিন্য অনুভব করল শিঞ্জিনী! একদৃষ্টে বিমলেশকে লক্ষ্য করতে লাগল সে। কোনও উত্তর দিল না।

বিমলেশের হঠাৎ যেন খেয়াল হল, শিঞ্জিনীরা দাঁড়িয়ে আছে। শশব্যস্ত বললেন, বসো-বসো-প্লিজ শিঞ্জিনীর হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে নিজে তার মুখোমুখি বসলেন।

একেকটা টেবল ঘিরে চারটে করে চেয়ার। মৃদুলা কিন্তু বসল না। বলল, পরিচয় তো হয়েই গেছে। আমি কাছেই একটা কাজ সেরে আসি। ম্যাক্সিমাম হাফ অ্যান আওয়ার।

শিঞ্জিনী বুঝতে পারল, বিমলেশ যখন তার সঙ্গে কথা বলবে, মৃদুলা তখন কাছে থাকতে চায় না। মায়ের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে সে। মৃদুলা তার কাঁধে হালকা একটু চাপ দিয়ে মৃদু হাসে। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়, কোনও ভয় নেই। ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একতলার সিঁড়ির দিকে চলে যায় সে।

যতক্ষণ মাকে দেখা যায়, তাকিয়ে থাকে শিঞ্জিনী। মৃদুলা একতলায় নেমে গেলে বিমলেশের দিকে সে চোখ ফেরায়। সদ্যপরিচিত একটি লোকের সামনে সে এখন একেবারে একা। শিরদাঁড়ায় অদ্ভুত এক শিহরন খেতে গেল তার। সেটা কি ভয়ে? তীব্র অস্বস্তিতে? অনুভূতিটা যে ঠিক কী, শিঞ্জিনী বুঝিয়ে বলতে পারবে না। কয়েক লহমা মাত্র। তারপরেই নিজেকে দৃঢ় করে নিল। নিজের অজান্তেই বুঝিবা এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সে।

বিমলেশ বললেন, লাঞ্চের এখনও দেরি আছে। কী খাবে বলো। কফি? সফট ড্রিংক?

শিঞ্জিনী বলল, কিছু দরকার নেই।

 তাই কখনও হয়? বিমলেশ একটা বেয়ারাকে ডেকে সফট ড্রিংক নিয়ে আসতে বললেন।

মুহূর্তে নকশা-করা কাঁচের গেলাসে ঠান্ডা পানীয় এসে গেল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা গেলাস তুলে নিল শিঞ্জিনী।

বিমলেশ গল্প শুরু করে দিলেন। প্রায় একতরফা। শিঞ্জিনীর পড়াশোনা কেমন চলছে, স্কুলের মিসরা কেমন পড়ান, হায়ার সেকেন্ডারিতে কত পারসেন্ট মার্ক সে আশা করছে, গ্র্যাজুয়েশনটা কোন কলেজ থেকে করতে চায়, কোন সাবজেক্টে অনার্স নেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

শিঞ্জিনী বুঝতে পারছিল, এসব ধানাইপানাই বকে জমি তৈরি করে নিচ্ছে বিমলেশ। আসল বক্তব্যটা কখন ঝুলি থেকে বেরুবে, সে জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে সে। নীরস গলায়, খুব সংক্ষেপে উত্তর দিতে লাগল সে।

লেখাপড়া ছেড়ে এবার শিঞ্জিনীর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে পড়লেন বিমলেশ। এখন ভীষণ পড়ার চাপ চলছে। শরীরের বিশেষ ভাবে যত্ন নেওয়া উচিত। তিনি মৃদুলাকে বলবেন, বড় ডাক্তারকে দিয়ে শিঞ্জিনীর জন্য একটা ডায়েট চার্ট যেন করিয়ে নেয়। এনার্জি বাড়ে এমন ট্যাবলেট বা টনিকেরও খুবই প্রয়োজন।

শিঞ্জিনীর পর ইন্দ্রনাথের অসুখ-বিসুখের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন বিমলেশ। তিনি কেমন আছেন, ঠিকমতো ওষুধ-টোষুধ খান কিনা, ফিজিওথেরাপিতে কতটা কাজ হচ্ছে, পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো এসব জানতে চাইলেন।

তাদের বাড়ির যাবতীয় খবরই যে বিমলেশ রাখেন, শিঞ্জিনী বুঝতে পারছিল। মৃদুলা ছাড়া আর কেই-বা এই সব খবরের সোর্স হতে পারে?

বিমলেশের আবোল-তাবোল বকা অসহ্য লাগছিল শিঞ্জিনীর। এক পলক ঘড়ি দেখে সে বলল, মা আধঘণ্টা সময় দিয়েছিল। চোদ্দ মিনিট কেটে গেছে। আমার সঙ্গে কেন আলাপ করতে চেয়েছেন, তা কিন্তু এখনও জানা হয়নি।

বিমলেশের মতো বয়স্ক, অভিজ্ঞ, সফল মানুষও সামান্য থতিয়ে গেলেন। একটু নার্ভাসও কি? তিনি যে শিঞ্জিনীদের কত বড় শুভার্থী, সাতকাহন ফেঁদে তা বোঝাবার পর আসল প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটার অন্য কোনও ব্যাপারেই আগ্রহ নেই। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বিমলেশ বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা তো বলতেই হবে।

সুস্বাদু, শীতল পানীয়ের গেলাসে দু-তিনটে হালকা চুমুক দিয়েছিল শিঞ্জিনী। এখন গেলাসটা হাতের ভেতর আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে চলেছে। বিমলেশের দিকে তাকিয়ে সে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল।

বিমলেশ বললেন, আমার সম্বন্ধে তোমার মায়ের কাছে নিশ্চয়ই সব শুনেছ?

শিঞ্জিনী বলল, সব নয়। খানিকটা। আপনি একজন বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। বনেদি ফ্যামিলিতে জন্ম। প্রচুর টাকা আপনার। সল্টলেকে বিরাট বাড়ি। উইডোয়ার। ব্যস, এই পর্যন্ত।

মেয়েটার মধ্যে নরম ভাব কম। কথাবার্তা চঁছাছোলা। চোখেমুখে, আচরণে, কথা বলার ভঙ্গিতে ছুরির ফলার মতো কী যেন আছে। এর সামনে সারাক্ষণ সতর্ক না থাকলে মারাত্মক অস্বস্তিতে পড়তে হবে।

বিমলেশ বললেন, এটা কি তোমার মা বলেছে, আমি একজন দুঃখী, নিঃসঙ্গ মানুষ।

কী চায় লোকটা? তার সহানুভূতি? কিন্তু কেন? শিঞ্জিনী বলল, বলে থাকতে পারে। মনে পড়ছে না।

বিমলেশ বললেন, তোমাদের কথাও শুনেছি। দুজনে অনেক দুঃখ পেয়েছ।

পৃথিবীতে বদ, লম্পট স্বামীর জন্যে অনেক ম্যারেড লাইফ ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও হবে। এই টাইপের পুরুষদের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা দুঃখই পেয়ে থাকে। আমরাও পেয়েছি। তার মধ্যেই বেঁচে থাকতে চেষ্টা করছি।

গুড। দ্যাট শুড বি দা স্পিরিট।

 শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

বিমলেশ বললেন, আমার একটা কথা বিশ্বাস করবে রূপা?

 শিঞ্জিনী একটু অবাক হল। বিমলেশের দিকে সতর্ক চোখ রেখে বলল, কী কথা?

হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন বিমলেশ, আমি তোমাদের সুখী করতে চাই রেস্তোরাঁর মৃদু আলোয় তার গলার স্বর কাঁপতে লাগল।

শিঞ্জিনী ইঙ্গিতটা মোটামুটি ধরতে পারছিল। তবু ঈষৎ রূঢ় গলায় জিগ্যেস করল, ওয়ার্ল্ডে দুঃখী মানুষের অভাব নেই। কিন্তু বেছে বেছে আমাদের সুখী করার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেন?

এমন মেয়ে আগে কখনও দেখেননি বিমলেশ। কত আর বয়স! মৃদুলার কাছে শুনেছেন, মাস তিনেক আগে সতেরো পেরিয়েছে। এই ধরনের সদ্যতরুণীরা বয়স্ক লোকেদের কাছে নিজেদের অনেকখানি গুটিয়ে রাখে। সঙ্কোচে। লজ্জায়। বিশেষ করে সবেমাত্র পরিচয় হয়েছে, এমন কারও সামনে। কিন্তু শিঞ্জিনী অন্য ধাতুতে তৈরি। সে যেন অস্ত্র উঁচিয়েই রেখেছে।

শিঞ্জিনীর প্রশ্নটা নিছক প্রশ্ন নয়। এর মধ্যে লুকনো রয়েছে তীব্র আক্রমণ। প্রস্তুত ছিলেন না বিমলেশ। মনে মনে তিন পা পিছিয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে দ্রুত রণ-কৌশলটা ভেবে নিলেন। তরল আবেগের ঢল নামিয়ে এই মেয়েকে ভাসিয়ে নেওয়া যাবে না। যা বলার সোজাসুজিই বলতে হবে।

বিমলেশ বললেন, তুমি বড় হয়েছ। তোমাকে কথাটা বলা যেতে পারে। হয়তো শুনেছ, আমাদের তৈরি বহু প্রোডাক্ট তোমার মায়ের ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ইন্ডিয়ার নানা সিটিতে পাঠায়। এই সূত্রেই তার সঙ্গে আলাপ। তারপর কখন যে আমাদের ভেতর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, বুঝতে পারিনি। বুঝতেই পারছ, সম্পর্কটা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি।

শিঞ্জিনী কিছু বলে না। পলকহীন তাকিয়ে থাকে।

বিমলেশ থামেননি, আমার ইচ্ছা এই সম্পর্কটা পার্মানেন্ট হোক।

শিঞ্জিনী এবারও জবাব দেয় না।

 বিমলেশ ব্যগ্রভাবে বললেন, চুপ করে আছ কেন?

শিঞ্জিনীর চারপাশের সৌরলোক দুলতে শুরু করেছিল। বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ি পেটার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল সে। মনে হচ্ছিল, সব আলো নিভে গেছে, বাতাস আর বইছে না।

নিজেকে ধাতস্থ করতে খানিকটা সময় লাগল শিঞ্জিনীর। বিমলেশের সঙ্গে আজকের এই সাক্ষাৎকার নিতান্ত আলাপ-পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সেটা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। কিন্তু ওঁরা যে এতদূর এগিয়েছেন, এবং সেটা তাকে জানানোর জন্য এই রেস্তোরাঁয় টেনে আনা হয়েছে তা ভাবতে পারেনি শিঞ্জিনী।

ব্যাপারটা এমনই অতর্কিত যে প্রথমটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সে। এবার খুব ঠান্ডা গলায় বলল, আপনার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছিলাম।

বিমলেশ বললেন, আমি যা চাই, তোমাকে বোঝাতে পেরেছি?

নিশ্চয়ই পেরেছেন। কিন্তু

 বলো—

আমার মা-ও কি তা-ই চায়?  

নিশ্চয়ই।

শিঞ্জিনী বলতে লাগল, আমার মা পুরুষদের ঘৃণা করত। তার কাছে পুরুষমানুষ মাত্রেই স্কাউন্ডেল। আপনি যে তার ধারণা পালটে দিতে পেরেছেন, সেটা বিরাট অ্যাচিভমেন্ট।

মেয়েটার কথায় কি শ্লেষ মেশানো রয়েছে? ঠিক বোঝা গেল না। ব্যাপারটা গায়ে মাখলেন না বিমলেশ। হেসে হেসে বললেন, তা বলতে পারো।

একটু নীরবতা।

 তারপর বিমলেশ বললেন, কী, তুমি তো কিছুই বললে না?

শিঞ্জিনী বলল, আপনারা ডিসিশন নিয়েছেন। ফর্মালি আমাকে শুধু জানালেন। এ নিয়ে আমার কী বলার থাকতে পারে?

বিমলেশ সচকিত। বললেন, কে বললে, আমরা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি? আমরা কী চাই, সেটা শুধু বলেছি। এখন সব কিছুই তোমার ওপর নির্ভর করছে।

মানে?

তোমার পারমিশান পেলে এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা এগুতে পারি।

তীক্ষ্ম গলায় শিঞ্জিনী বলে, যে স্টেজে আপনারা পৌঁছেছেন, সেখানে আমার পারমিশানের কি কোনও দরকার আছে?

বিমলেশ বললেন, সেটাই সবচেয়ে বেশি আর্জেন্ট। তা না হলে অনেক আগেই তো আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে চলে যেতে পারতাম। আসলে

আসলে কী?

তুমি কি বুঝতে পারছ না, মৃদুলাকেই শুধু নয়, আমি তোমাকে চাই মা–

ভদ্রলোক কথা বলেন চমৎকার। এবার কণ্ঠস্বরে আরও বেশি করে আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। তবে তিনি কতটা আন্তরিক বোঝা যাচ্ছে না। শিঞ্জিনী চুপ করে রইল।

বিমলেশ বলতে লাগলেন, তুমি যতদিন না রাজি হচ্ছ, আমরা কোনও সিদ্ধান্ত নেব না। ব্যাপারটা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেইখানেই আটকে থাকবে।

বিমলেশের চোখের দিকে তাকিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার কাছে কটা প্রশ্ন আছে।

 সোজা হয়ে বসলেন বিমলেশ, কী প্রশ্ন?

শিঞ্জিনী বলল, আপনি এত বড় একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। প্রচুর টাকা আপনার ইচ্ছা করলে আপনাদের লেভেলের বিরাট কোনও ফ্যামিলির ভার্জিন মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। তা না করে আমার মায়ের মতো একজন ডিভোর্সিকে পছন্দ করলেন কেন? যার আবার আঠারো বছরের একটি মেয়ে আছে–

বিমলেশ আস্তে মাথা নাড়লেন, খুব সঙ্গত প্রশ্ন। উত্তরটা হল, হিসেব কষে তো সব কিছু হয় না। হৃদয় একটা ভীষণ জটিল ব্যাপার রূপা। কার যে কাকে ভালো লেগে যায় সেটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

আমার সেকেন্ড প্রশ্ন হল, আমার মাকে না হয় আপনার ভালো লেগেছে। তার সঙ্গে আমায় জড়াচ্ছেন কেন?

তুমি কি জানো, তোমার মায়ের জীবনে তুমি কতখানি অংশ জুড়ে আছ?

কথাটা ঠিক বুঝলাম না।

 মৃদুলার সঙ্গে আলাপের পর থেকে একটা কথাই সে বারবার জানিয়েছে, তোমাকে ছাড়া তার জীবন ইনকমপ্লিট। তোমাকে বাদ দিয়ে সে কিছুই ভাবতে পারে না।

মায়ের জন্যেই তা হলে আপনার কাছে আমার এত ইমপর্টান্স?

তোমার জন্যেই তোমার ইমপর্টান্স। আমি একটা মেয়ে পেয়ে যাব। সেটা কি মস্ত প্রাপ্তি নয়?

যেভাবে বিমলেশ তাকে ভজাতে চাইছেন তাতে মনে হয়, লোকটা যথেষ্ট আন্তরিক কিংবা অত্যন্ত চতুর। কোনটা যে ঠিক, নিশ্চিতভাবে ধরা যাচ্ছে না। শিঞ্জিনী নিজের স্নায়ুমণ্ডলীকে সজাগ রেখে বলে, আমার থার্ড প্রশ্নটা হল, আপনি তো জানেন আমাদের মাথার ওপর দাদু আছেন?

বিমলেশ বললেন, নিশ্চয়ই জানি।

আমাকে এখানে ডাকিয়ে না এনে তার সঙ্গেই ত আপনার কথা বলা উচিত ছিল। কেননা, আমার মা তারই মেয়ে।

নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু সবার আগে যা চাই সেটা হল তোমার অনুমতি। যেদিন পারমিশন দেবে সেদিনই তোমার দাদুর সঙ্গে দেখা করব।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর শিঞ্জিনী বলল, আমার সম্বন্ধে আপনি কতটা জানেন?

বিমলেশ বললেন, তোমার মায়ের মুখে যা শুনেছি, ততটুকুই। হঠাৎ এ প্রশ্ন?

মা কি বলেছে দু-একটা একসেপশন বাদে আমি পুরুষমানুষদের বিশ্বাস করি না, ভীষণ ঘৃণা করি?

বলেছে। অবিশ্বাস আর ঘৃণা করাটাই তোমার পক্ষে স্বাভাবিক।

 স্বাভাবিক কেন?

বিমলেশের ব্যাখ্যাটা এইরকম। জন্মের পর থেকে শিঞ্জিনী তার বাবার যে কুৎসিত চেহারাটা দেখেছে সেটা তার মনে চিরস্থায়ী, ভীতিকর ছাপ রেখে গেছে। তার ধারণা, সব পুরুষই এক ধাঁচের। লম্পট। নোংরা। বদমাশ।

বিমলেশ বললেন, কি, আমি ঠিক বললাম?

অর্থাৎ অনির্বাণ সম্পর্কে মৃদুলার কাছে সব শুনেছেন বিমলেশ। উত্তর না দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আমার দাদু আর দেবকুমার আঙ্কল ছাড়া অন্য কারও সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধা নেই।

দেবকুমার আঙ্কল কে?

আমার বন্ধুর বাবা।

বিমলেশ হাসতে হাসতে বললেন, যে দুজন একসেপশনের কথা বললে, মানে তোমার দাদু আর আঙ্কল, তাদের জায়গায় পৌঁছুতে আমার কতদিন লাগবে?

আজই তো সবে আপনাকে দেখলাম। একদিনেই আপনার এই প্রশ্নের উত্তর চান? বিমলেশের চোখের দিকে চোখ রেখে পালটা প্রশ্ন করে শিঞ্জিনী।

বিমলেশ বিব্রত বা অপ্রতিভ হননি। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে লাগলেন, ঠিক। বেশ কিছুদিন না দেখলে, না মিশলে তুমি বুঝবে কী করে, আমি মানুষটা কেমন? বেশ, আমি অপেক্ষা করতে রাজি।

লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং হলের একটা টেবলও এখন আর ফাঁকা নেই। স্টুয়ার্ড এবং বেয়ারারা ব্যস্তভাবে এ-টেবল সে-টেবলে ছোটাছুটি করছে। এই ধরনের দামি, অভিজাত রেস্তোরাঁয় কেউ চিৎকার করে কথা বলে না। যত নীচু গলায় বলুক, চারপাশ থেকে গুঞ্জন উঠে আসছিল।

এই সময় মৃদুলা ফিরে এল। শিঞ্জিনীর ডান পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে লহমায় দুজনকে একবার দেখে নিয়ে হাসিমুখে জিগ্যেস করল, কাজটা সেরে আসতে আসতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তা তোমাদের আলাপ-টালাপ কীরকম হল?

শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।

বিমলেশ বললেন, ফাইন। শি ইজ আ নাইস ইয়াং লেডি। ভেরি স্ট্রেটফরোয়ার্ড। তুমি যা বলেছ, তার চেয়ে ওর পার্সোনালিটি অনেক বেশি।

শিঞ্জিনী সম্পর্কে একটি অপ্রিয় শব্দও উচ্চারণ করেননি বিমলেশ। বরং যা বলেছেন তার সবটাই প্রশংসা। তবু কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে মৃদুলার। নিজের মেয়েকে তার চেয়ে কে আর বেশি চেনে!

স্টুয়ার্ড টেবলের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ছোট নোট বই।

টেবলে সুদৃশ্য মেনু-কার্ড পড়ে ছিল। সেটা শিঞ্জিনীকে দিয়ে বিমলেশ জিগ্যেস করলেন, দেখে বলো, কী কী অর্ডার দেব?

কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার যা ভালো মনে হয় বলে দিন। তবে চিকেন ছাড়া আমি অন্য মাংস খাই না—

ও কে মৃদুলার সঙ্গে পরামর্শ করে অর্ডার দিলেন বিমলেশ। পোলাও ক্রিম-ভেটকি, প্রন কাটলেট, স্যালাড এবং আইসক্রিম। নোটবুকে টুকে নিয়ে চলে গেল স্টুয়ার্ড।

যান্ত্রিক নিয়মে কিছুক্ষণের ভেতর টেবলে লোভনীয় খাদ্যগুলো পৌঁছে গেল। খেতে খেতে নানারকম গল্প হতে লাগল। এলোমেলো, পারম্পর্যহীন। যে কারণে এই রেস্তোরাঁয় আসা, সে সম্বন্ধে কিন্তু একটি কথাও নয়।

মৃদুলা খাচ্ছে ঠিকই, তবে ভেতরে ভেতরে বেশ উতলা হয়ে আছে।

তার অনুপস্থিতিতে ওদের দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছে, জানার জন্য ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে। বাইরে অবশ্য তার কোনও প্রকাশ নেই।

শিঞ্জিনী এমন বালিকা নয় যে মায়ের মনোভাব বুঝতে পারছে না। সে কিন্তু ওদিক দিয়েই গেল না। প্রায় নিঃশব্দে খেতে লাগল।

উলটো দিকের টেবলে বসে প্লেট থেকে মাঝে মাঝে মুখ তুলে মৃদুলাকে লক্ষ্য করছেন বিমলেশ। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। দুই চোখ কৌতুকে চিক চিক করছে। মৃদুলার মনের গতিক তিনিও আঁচ করে নিয়েছেন। বললেন, ডোন্ট বি রেস্টলেস। পৃথিবীতে সব কিছুই সুলভ নয়। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।

ইঙ্গিতটা হয়তো বুঝতে পেরেছে মৃদুলা। সে হকচকিয়ে গেল, আমাকে দেখে কি রেস্টলেস মনে হচ্ছে?

উত্তর না দিয়ে ছুরি দিয়ে প্রন কাটলেট কেটে টুকরো করতে লাগলেন বিমলেশ।

.

লাঞ্চ শেষ হলে বিমলেশ তার গাড়িতে সল্টলেকে চলে গেছেন। আগে দু-একবার মৃদুলাকে বাড়ি পর্যন্ত লিফট দিতে চেয়েছেন তিনি। মৃদুলা রাজি হয়নি। তাদের এলাকায় কখন কার চোখে পড়ে যাবে, ইন্দ্রনাথের কানে খবরটা পৌঁছুবে। সব মিলিয়ে অশান্তি। স্ক্যান্ডল। এসব আদৌ পছন্দ নয় মৃদুলার। ফিরতে দেরি হলে সে ট্যাক্সি নেয়। তাছাড়া মিনিবাস-টাস তো আছেন।

শিঞ্জিনীকে নিয়ে ট্যাক্সিতেই বাড়ি ফিরছিল মৃদুলা। পার্ক স্ট্রিটে যাবার সময় যেমন, এখনও ঠিক তেমনি দুই জানালার পাশে দু-জনে বসে আছে।

ভবানীপুর পর্যন্ত কেউ একটি কথাও বলেনি। তারপর হঠাৎ মৃদুলা ডাকল, রূপা—

শিঞ্জিনী মায়ের দিকে তাকাল।

 মৃদুলা বলল, বিমলেশকে কেমন লাগল?

শিঞ্জিনী বলল, শিক্ষিত কালচার্ড মানুষ। সুন্দর কথা বলেন–

মৃদুলা যে প্রশ্নটা করেছে তার দুটো জবাব হতে পারে। ভালো বা মন্দ। কিন্তু শিঞ্জিনী তার ধার দিয়ে যায়নি।

উতলা ভাবটা কিছুতেই কাটছে না মৃদুলার। বিমলেশের সঙ্গে কী কথা হল, সবিস্তারে না জানা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই। এ এমন এক বিষয়, মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে সঙ্কোচ হয়। শিঞ্জিনী যে বিমলেশের সঙ্গে বেয়াড়াপনা করেছে কিংবা তার ওপর খেপে উঠেছে, বিমলেশের কথায় তার এতটুকু আভাস পাওয়া যায়নি। শিঞ্জিনী প্রায় চুপচাপ ছিল ঠিকই, তবে খাবার টেবলে তাকে বিমর্ষ, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিত, কিছুই মনে হয়নি। বরং মহার্ঘ খাদ্যবস্তুগুলো সে বেশ তৃপ্তি করেই খেয়েছে।

মৃদুলা মনে মনে কৌশল ঠিক করে নেয়। সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে অন্যভাবে তাকে সব জেনে নিতে হবে। কাল অফিসে গিয়ে কিংবা আজই শিঞ্জিনীকে বাড়িতে রেখে কোনও একটা ছুতো করে বাইরে বেরিয়ে প্রাইভেট টেলিফোন বুথ থেকে বিমলেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। লহমায় সে সব জেনে যাবে। কিন্তু তার তর সইছিল না।

মদুলা জিগ্যেস করল, বিমলেশ তোকে কী বলল?

এক পলক মাকে দেখে নিল শিঞ্জিনী। ভারি সরল মুখ। তার প্রশ্নটার মধ্যে যেন কোনওরকম অভিসন্ধি বা উদ্দেশ্য নেই। নেহাতই শিশুসুলভ অপার কৌতূহল।

মায়ের চাতুরি ধরে ফেলেছে শিঞ্জিনী। কিন্তু নিজে সে ধরা দিল না। বলল, কী আর বলবেন? আমার পড়াশোনা কেমন চলেছে, পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হল, দাদুর শরীর কেমন যাচ্ছে–এই সব।

এতক্ষণে সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে উঠল মৃদুলা, আর কিছু বলেনি?

 হ্যাঁ। খুব শান্ত গলায় জবাব দেয় শিঞ্জিনী।

 শ্বাস-আটকানো, চাপা স্বরে মৃদুলা জিগ্যেস করে, কী বলেছে?

কী বলতে পারেন, সেটা কি তুমি জানো না? সোজা মায়ের চোখের দিকে তাকায় শিঞ্জিনী।

মৃদুলা চমকে ওঠে। কিছু একটা উত্তর দিতে চায়, কিন্তু গলায় স্বর ফোটে না।

একটু চুপচাপ।

শিঞ্জিনী মায়ের চোখ থেকে চোখ সরায়নি। এবার বলল, মিস্টার বসুমল্লিক দাদুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমার পারমিশান চাইছিলেন–

তুই কী বললি?

মায়ের প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি শিঞ্জিনী। সে বলল, মিস্টার বসুমল্লিক তোমাকে তখন কী বলেছেন, মনে আছে?

মৃদুলা বলল, কী বলেছে?

ধৈর্য ধরতে।

মেয়ের সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে, মোটামুটি আন্দাজ করে নিল মৃদুলা। সে আর কিছু জিগ্যেস করল না।

.

০৮.

মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের পর ইন্দ্রনাথের কাছে এসে দিনগুলো মোটামুটি একই নিয়মে কেটে যাচ্ছিল। জীবনের আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতির মধ্যে বিশেষ হেরফের ঘটেনি। বড় হবার পর রাস্তায় বেরুলে লোকজনের নোংরা চোখের দৃষ্টি তীরের মতো গায়ে এসে বিধত। প্রথম প্রথম ভীষণ অস্বস্তি হত। পরে সয়ে গিয়েছিল। স্বর্ণালীদের বাড়ি ছাড়া অন্য বন্ধুদের বাড়ি গেলে তাদের কাকা-দাদারা আদর করার ছলে যা করত তাতে শরীর কুঁকড়ে যেত। ফলে তাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিল।

হঠাৎ কদিন হল দুদিক থেকে দুটো সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক দিকে রজত, অন্যদিকে বিমলেশ। রজত কথা দিয়েছে, আপাতত হোস্টেল থেকে আসছে না, শিঞ্জিনীর পড়া শোনায় যাতে বিঘ্ন না হয় সেটা মনে রাখবে। বিমলেশ জানিয়েছেন, তার অনুমতি ছাড়া মায়ের ব্যাপারে এগুবে না। কিন্তু মৌখিক এই প্রতিশ্রুতি কতটা বিশ্বাস করা যায়?

পরীক্ষার বেশিদিন দেরি নেই। প্রাণপণে ওই সব উটকো দুশ্চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিয়ে পড়ায় মন বসাতে চাইছে শিঞ্জিনী। রেজাল্ট তাকে ভালো করতেই হবে।

.

আজ অন্যদিক থেকে নতুন এক সংকট দেখা দিল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।

শনি ও রবি সপ্তাহের এই দুদিন শিঞ্জিনীদের স্কুল ছুটি থাকে।

আজ শনিবার। পড়া শেষ করে ইন্দ্রনাথের ঘরে এসে তার সঙ্গে গল্প করছিল শিঞ্জিনী। সারাদিন একা একা শুয়ে থাকেন। সঙ্গ দেবার লোক নেই। লেখাপড়ার ফাঁকে সময় পেলেই দাদুর কাছে এসে বসে সে।

শনিবার মৃদুলার হাফ-ডে অফিস। সে বাড়ি নেই। এখন এগারোটার মতো বাজে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল।

ইন্দ্রনাথ বললেন, দেখ তো দিদি-

ফোনটা তুলে শিঞ্জিনী বলল, কাকে চাইছেন? শিঞ্জিনীদের টেলিফোন নাম্বারটা বলে ওধার থেকে কেউ ভারী গলায় জানতে চায়, নাম্বারটা সঠিক কিনা।

কণ্ঠস্বরটা অচেনা। আগে আর কখনও শুনেছে কি? শিঞ্জিনী মনে করতে পারল না। আসলে খুব কম লোকজনই এ বাড়িতে ফোন করে। যারা করে তাদের গলা ভালো করেই সে চেনে। বেশ অবাক হয়েই বলল, হ্যাঁ।

লোকটা বলল, গলা শুনে মনে হচ্ছে তোমার বয়স কম। তুমি কি মৃদুলাদেবীর মেয়ে?

বিস্ময়টা সহস্র গুণ বেড়ে যায় শিঞ্জিনীর। অপরিচিত লোকটা তার মাকে তো চেনেই, গলা শুনেই আন্দাজ করে নিয়েছে সে অল্পবয়সি মেয়ে এবং মৃদুলা তার মা। এ বাড়িতে মৃদুলা আর সে ছাড়া অন্য কোনও মহিলা বা কম বয়সের মেয়ে যে নেই, সেটা তার জানা।

শিঞ্জিনী বলল, হ্যাঁ কিন্তু আপনি কে বলছেন?

উত্তর না দিয়ে লোকটা বলল, তোমার দাদু এখন কেমন আছেন? মাঝখানে তো ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন

দেখা যাচ্ছে, লোকটা এ বাড়ির নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখে। শিঞ্জিনী বলল, আগের থেকে অনেকটা ভালো। কিন্তু আপনার পরিচয় এখনও জানতে পারিনি।

পারবে, পারবে। তাড়া কীসের?

ইন্দ্রনাথ তিন-চারটে বালিশের ওপর মাথা রেখে আধশোওয়া মতো হয়ে ছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। চাপা, নীচু গলায় বললেন, কার সঙ্গে এত কথা বলছ?

হাতের ইশারায় ইন্দ্রনাথকে থামিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী লোকটাকে বলল, আপনি কি দাদুর সঙ্গে কথা বলতে চান?

লোকটা বলল, না। শুনেছি, তিনি বেড রিডন। তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আমি মৃদুলা দেবীর সঙ্গে কথা বলব।

কিন্তু মা তো এখন অফিসে।

আমার ধারণা ছিল উইকে পাঁচ দিন ওঁর অফিস। শনি-রবি ছুটি।

একটু চুপচাপ।

তারপর লোকটা বলল, ঠিক আছে, মাকে বোলো কাল সকাল নটায় তোমাদের বাড়ি আসব। মৃদুলাদেবীর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

শিঞ্জিনী বলল, মা ওই সময় বাড়িতে থাকবে কিনা, আমার জানা নেই। বাইরে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকতে পারে।

যে অ্যাপয়েন্টমেন্টই থাক, ক্যানসেল করতে বলবে। এবার পরিচয়টা দেওয়া যাক। আমার নাম সুরেশ্বর ভৌমিক। আবার বলছি, কাল ঠিক নটায় আসব। এতক্ষণ ভারী গলায় কথা বললেও সুরটা ছিল নরম। এবার তার স্বরে হুকুমের মতো কিছু একটা ফুটে বেরুল।

শিঞ্জিনী কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই খুট করে শব্দ হল। সুরেশ্বর ওধার থেকে লাইন কেটে দিয়েছে।

নাতনির দিকে তাকিয়ে ছিলেন ইন্দ্রনাথ। পলকহীন। শিঞ্জিনী টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই তিনি বললেন, কে ফোন করেছে দিদিভাই?

শিঞ্জিনী বলল, সুরেশ্বর ভৌমিক নামে একটা লোক

নামটা চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না। কী চায় সে?

তা কিছু বলেনি। কাল নটায় আসবে। মাকে বাড়িতে থাকতে বলল।

 খুকুর সঙ্গে তার কী দরকার?

 আমি কী করে বলব?

 ইন্দ্রনাথ বিরক্ত হলেন, জিগ্যেস করবে তো?

শিঞ্জিনী বলল, করতে যাচ্ছিলাম। লোকটা সময় দিলে না। ফোন নামিয়ে রাখল। কিছুক্ষণ চুপচাপ।

কপাল কুঁচকে, চোখ আধবোজা করে কী ভাবতে লাগলেন ইন্দ্রনাথ। তারপর স্বগতোক্তির টংয়ে বললেন, কে হতে পারে লোকটা? কে?

ইন্দ্রনাথ যে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন, বোঝা যাচ্ছে। অচেনা একটা লোক আচমকা ফোন করে অসুস্থ, শয্যাশায়ী মানুষটার শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে। শিঞ্জিনী কী করবে, ভেবে পেল না।

অনেকক্ষণ পর ইন্দ্রনাথ নাতনিকে বললেন, কাল আসুক, তখন লোকটার মতলব বোঝা যাবে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। যাও চান-টান করে খেয়ে নাও

শিঞ্জিনী উঠে পড়ল।

.

অন্যদিনের মতো আজও রাত করে বাড়ি ফিরল মৃদুলা। অফিস ছুটির পর কার সঙ্গে এতটা সময় কাটিয়ে এসেছে, শিঞ্জিনীর এখন আর অজানা নেই।

সন্ধের পর মালতী রুটি আলুর দম, বেগুনভাজা, অড়হর ডাল করে টেবলে গুছিয়ে রেখে গেছে। একটা বড় কাঁচের প্লেটে কটা বড় রাজভোগ ঢাকা দিয়ে রেখেছে। রাতে সন্দেশ, রাজভোগ বা পান্তুয়া, যা-ই হোক না, কোনও একটা মিষ্টি শিঞ্জিনীদের চাই-ই। শেষ পাতে মিষ্টি না থাকলে রাতের খাওয়াটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

রাতে বাড়ি ফিরে দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে বাইরের পোশাক পালটিয়ে মেয়েকে নিয়ে খেতে বসে যায় মৃদুলা। আজও তার হেরফের হল না।

সেদিন পার্ক স্ট্রিটে বিমলেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার পর থেকে প্রায় রোজ রাতেই খাওয়ার টেবলে বসে সতর্কভাবে শিঞ্জিনীকে লক্ষ্য করতে করতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা প্রশ্ন করে সে, বিমলেশ আমাদের বাড়ি আসতে চাইছে। তুই কি এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?

কোনওদিন জবাবটা এড়িয়ে গেছে শিঞ্জিনী। কোনওদিন বলেছে, আমাকে আরেকটু ভাবতে দাও। আসলে এর মধ্যেই সে মাকে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। তার ভয়, বাকিটুকুও তার হাতে থাকবে না। বিমলেশ বসুমল্লিককে তার খারাপ লাগেনি। সুন্দর কথা বলেন। চমৎকার ব্যবহার। ঘণ্টা দেড়েকের মতো একসঙ্গে কাটিয়েছিল। এই অল্প সময়ের ভেতর তাকে বেশ স্নেহপ্রবণ মনে হয়েছে। তার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীলও। সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে, তার মতামত ছাড়া মায়ের ব্যাপারে তিনি এগুতে চান না। সবই ঠিক, কিন্তু মৃদুলার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবার পর ওপরকার মায়াবী খোলসের ভেতর থেকে বিমলেশের অন্য কোনও ভয়ঙ্কর স্বরূপ বেরিয়ে পড়বে কিনা, সে সম্বন্ধে শিঞ্জিনীর মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মাকে পুরোপুরি হারালে সে বাঁচবে না।

খেতে খেতে টুকরো টুকরো কথা হচ্ছিল। ছুটির পর বিমলেশের সঙ্গে যে খানিকটা সময় কাটায়, আজকাল আর তা গোপন করে না মৃদুলা। বিমলেশের সঙ্গে শিঞ্জিনীর আলাপ হবার পর লুকোচুরির আর দরকার নেই।

আজ কোথায় গিয়েছিল, শিঞ্জিনীকে বিমলেশ কতটা ভালোবাসেন-এমনি নানা গল্প ফঁদতে যাচ্ছিল মৃদুলা, কিন্তু বাধা পড়ল।

শিঞ্জিনী হঠাৎ জিগ্যেস করল, সুরেশ্বর ভৌমিক বলে তুমি কাউকে চেনো?

যা বলতে যাচ্ছিল তা আর বলা হল না। কপাল কুঁচকে মৃদুলা জিগ্যেস করল, কে সুরেশ্বর ভৌমিক? কী করে?

নামটাই শুধু জেনেছি। কী করে বলতে পারব না। আজ এগারোটা-সাড়ে এগারোটায় ফোন করে তোমার খোঁজ করছিল।

কেন?

তা জানায়নি। কাল নটায় সে আসবে। তোমাকে বাড়িতে থাকতে বলেছে।

কে একটা উটকো লোক বলেছে বলে আমাকে থাকতে হবে? কাল আমার অন্য কাজ আছে। সকালে বেরুতে হবে। আমি লোকটার আর্দালি নাকি যে কঁঝিয়ে উঠতে গিয়ে থমকে গেল মৃদুলা। লহমায় চেহারাই পালটে গেল তার। মুখটা ফ্যাকাসে। কেমন যেন ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত।

মায়ের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল শিঞ্জিনী। ব্ৰস্তভাবে জিগ্যেস করে, কী হল মা?

ভয়ার্ত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না মৃদুলা। কাঁপা গলায় বলল, এই সুরেশ্বর ভৌমিক নিশ্চয়ই প্রোমোটার। ভীষণ নোটোরিয়াস

কী জন্যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, বুঝতে পারছ?

না-আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে মৃদুলা।

.

০৯.

পরদিন সকালে বেরুতে সাহস হয়নি মৃদুলার। বাড়িতেই থেকে গেল।

রোজ ভোরে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে পড়তে বসে শিঞ্জিনী। আজ বইয়ে মন বসাতে পারছিল না। বারবার পড়ার টেবল থেকে উঠে মায়ের কাছে চলে আসছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলার টেনশন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আর সেটা শিঞ্জিনীর মধ্যেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কাঁটায় কাটায় নটায় এয়ারকন্ডিশনড় মারুতি সুজুকিতে চেপে সুরেশ্বর ভৌমিক এসে গেল। মালতাঁকে বলা ছিল। সে সুরেশ্বরকে একতলার ড্রইংরুমে বসিয়ে ওপরে খবর দিয়ে গেল।

মৃদুলা একা ওইরকম একটা লোকের কাছে যাবে, এটা ভাবতে পারছিল না শিঞ্জিনী। সে তার সঙ্গে সঙ্গে চলল।

মৃদুলা বলল, তুই আসছিস কেন? পড়তে যা—

জেদের সুরে শিঞ্জিনী বলল, না, আমি তোমার সঙ্গে থাকব।

 মৃদুলা আর আপত্তি করল না। মেয়ে পাশে থাকায় খুব সম্ভব সে খানিকটা সাহস পাচ্ছে।

একতলায় বসার ঘরে চলে এল দুজনে। সুরেশ্বর একাই সেখানে বসে ছিল। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। ভারী, মজবুত চেহারা। চওড়া কাঁধ। চৌকো ধরনের মুখ। ভারী চোয়াল। থুতনিতে গভীর খাঁজ। গালের মাঝামাঝি পর্যন্ত জুলপি। কোকড়া চুলে পাক ধরেছে। চোখে নীলচে চশমা। পরনে দামি সাফারি স্যুট। বাঁ হাতের কবজিতে সোনার ব্যান্ডে নামকরা কোম্পানির ঘড়ি।

মৃদুলাদের দেখে উঠে দাঁড়াল সুরেশ্বর। বিগলিত সুরে বলল, আসুন আসুন– ভাবখানা এমন, যেন এ বাড়িটা তারই। সম্মানিত অতিথিদের সে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

মৃদুলা বলল, বসুন—

 বশংবদ ভঙ্গিতে সুরেশ্বর বলল, না, না, আগে আপনারা।

নিঃশব্দে বসে পড়ল মৃদুলা। তার পাশে শিঞ্জিনী। মুখোমুখি সুরেশ্বরও বসল।

ঘরে ঢোকার পর সুরেশ্বরের দিক থেকে লহমার জন্য চোখ সরায়নি মৃদুলা। বাইরের দিকটা কঠিন আবরণে মুড়ে রাখলেও ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তার। সে কি ভয়ে? স্নায়বিক চাপে? মৃদুলা টের পাচ্ছিল, হৃৎস্পন্দন শতগুণ বেড়ে গেছে।

সুরেশ্বর হেসে হেসে জিগ্যেস করল, আমার নামটা কি আপনার মনে আছে?

নিশ্চয়ই আছে। আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।

সুরেশ্বর লঘু সুরে বলল, কুখ্যাত বলুন।

তার কথা যেন শুনতে পায়নি মৃদুলা। বলল, কাল রাতে বাড়ি ফিরে শুনলাম, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আজ আসবেন। কোনও দরকার আছে?

আছে বইকি। না হলে ফর নাথিং আপনাকে বিরক্ত করতে আসব কেন?

মৃদুলা এবার আর কিছু বলে না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

সুরেশ্বর বলল, আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে। শিঞ্জিনীকে দেখিয়ে বলে, মামণি ছেলেমানুষ, ওর সামনে

ইঙ্গিতটা ধরতে পারে মৃদুলা। বলে, আলোচনাটা ওর সামনেই হোক।

একটু ভেবে সুরেশ্বর বলল, বেশ। আপনি যখন তাই চাইছেন—

মৃদুলা উত্তর দিল না।

মনে মনে বক্তব্যটা গুছিয়ে নিয়ে সুরেশ্বর শুরু করল, দু-আড়াই বছর আগেই আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ আপনার বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাই আর করিনি।

মৃদুলা বলল, আমার বাবা এখনও বেড-রিডন। অতি কষ্টে উঠে বসতে পারেন মাত্র। না ধরলে বিছানা থেকে নামতে পারেন না।

জানি। আশা করি, উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সুরেশ্বর বলতে লাগল, এবার কাজের কথায় আসা যাক। নিশ্চয়ই শুনেছেন আমি একজন প্রোমোটার। আপনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাতে তো বটেই, চারপাশের নানা এরিয়ায় আমি চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটা হাই রাইজ তুলেছি। বেশ কয়েকটার কাজ চলছে। অনেকগুলো প্রাইমারি স্টেজে রয়েছে। যেমন ধরুন, যে সব জায়গায় বাড়ি উঠবে সেই জমিগুলোর মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি, কারও কারও সঙ্গে ডিডস হয়ে গেছে, বেশ কটার প্ল্যান কর্পোরেশনে জমা দিয়েছি।

ও।

একটু চুপচাপ।

তারপর সুরেশ্বর আচমকা জিগ্যেস করে, আপনাদের এই বাড়িটা তো সাড়ে সাত কাঠা জায়গার ওপর।

সঠিক মাপই বলেছে সুরেশ্বর। রীতিমতো চমকে ওঠে মৃদুলা। এমন নির্ভুল তথ্য কোত্থেকে যোগাড় করল সুরেশ্বর?

মৃদুলা পুরোপুরি স্বীকার করল না, হয়তো হবে। কেন বলুন তো?

এখানে রাস্তা বেশ চওড়া। কর্পোরেশন চোখ বুজে এই ল্যান্ডে সাততলা বিল্ডিংয়ের প্ল্যান পাস করে দেবে।

এ বাড়িতে সুরেশ্বরের আবির্ভাবের হেতুটা আগেই আঁচ করেছিল মৃদুলা। এবার উদ্দেশ্যটা তার মুখ থেকেই সরাসরি জানা গেল।

মৃদুলা শুনেছে, সুরেশ্বর যদি কোনও জমি-টমির দিকে হাত বাড়ায়, কারও ক্ষমতা নেই তাকে রোখে। তার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শিহরণ খেলে গেল।

সুরেশ্বর থামেনি, আপনাদের সঙ্গে আমি খুব তাড়াতাড়ি ডিল করতে চাই। দুটো সাড়ে বারোশ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আপনারা পাবেন। বেস্ট কোয়ালিটির মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি করে দেব। তিনটে বেডরুম, বিরাট ড্রইং-কাম-ডাইনিং হল, কিচেন, স্টোর। প্রত্যেকটা বেডরুমের গায়ে অ্যাটচড বাথ, ব্যালকনি। বাথরুমে আর কিচেনে টাইলস বসিয়ে দেব। তাছাড়া- বলে থেমে গেল সে।

মৃদুলা জিগ্যেস করে, তাছাড়া কী?

 সুরেশ্বর হাসল, একটু ভাবুন না?

 অত চিন্তাশক্তি আমার নেই।

ব্ল্যাক আর হোয়াইট মিলিয়ে নগদ দশ লাখ টাকাও পাবেন। যদি বলেন কালো টাকা স্পর্শ করবেন না, নো প্রবলেম। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকেই পে করব।

মৃদুলা উত্তর দিল না।

সুরেশ্বর বলল, আরও একটা কথা আছে

কী?

যতদিন না এখানে নতুন বাড়ি কমপ্লিট হচ্ছে, আপনাদের থাকার জন্য কাছাকাছি একটা বড় ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করব। তার ভাড়া আমি দেব। বিল্ডিং তৈরি হতে ম্যাক্সিমাম দেড় বছর। তারপর আপনারা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে আসবেন।

মৃদুলা চুপ করে রইল।

সুরেশ্বর বলল, তা হলে পেপার-টেপারগুলো আমাদের লইয়ারকে দিয়ে তৈরি করে ফেলি। ধরুন ব্যাপারটা আট-দশ দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, আপনাদের বাড়ির দলিলের ফোটোকপি লাগবে

এবারও জবাব নেই মৃদুলার।

সুরেশ্বর কী বলতে গিয়ে থমকে গেল। কয়েক মুহূর্ত মৃদুলাকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করে বলল, কী, আপনি তো কিছুই বলছেন না?

কী বলব?

এই যে এতক্ষণ আমি বকে গেলাম, সে সম্বন্ধে আপনার তো কিছু বক্তব্য থাকতে পারে

মৃদুলা বলল, আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, আমাদের বাড়িটা আপনার হাতে তুলে দেব?

সুরেশ্বরের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়েই মিলিয়ে যায়। অন্য কোনও প্রোমোটার কি আপনাদের সঙ্গে ডিল করতে চাইছে?

মৃদুলা বলল, এই এরিয়ায় এসে ল্যান্ড যোগাড় করে হাই রাইজ তুলবে, এমন কোনও প্রোমোটার এখনও জন্মায়নি। ঠিক বলছি?

সুরেশ্বরের মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি। সে বলল, আপনি কী ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ধরতে পারছি। ব্যাপারটা হল, এই অঞ্চলের লোকজন আমাকে ভালোবাসে। পুরোনো বাড়ি জমি আমাকে দেয়। আমিও তাদের ঠকাই না। কথা যা দিই তা রাখি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর সুরেশ্বর ফের শুরু করে, আমার অফারটা কি আপনার পছন্দ হয়নি? যদি বলেন ক্যাশ টাকাটা আরও একটু বাড়িয়ে দেব। দশের জায়গায় পনেরো। আশা করি, এবার আর অসুবিধা নেই। বলতে বলতে উঠে পড়ে সে, বলুন দলিলের ফোটো কপিটা নিতে কবে আসব?

মৃদুলার মাথায় অপার্থিব কোনও শক্তি যেন ভর করে। সুরেশ্বরের চেয়ারটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে, আর মিনিট পাঁচেক বসে যান।

একটু অবাকই হয়েছিল সুরেশ্বর, কিন্তু মৃদুলার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু রয়েছে, হয়তো তার ব্যক্তিত্ব কিংবা সাহস, যা ঠিক অমান্য করা যায় না। আস্তে আস্তে সে বসে পড়ে।

মৃদুলা বলে, আমার বক্তব্যের কথা বলছিলেন না, সেটা কিন্তু জানাবার সুযোগ পাইনি।

ভেতরে ভেতরে সামান্য হলেও অস্বস্তি বোধ করে সুরেশ্বর। বাইরে অবশ্য তার প্রকাশ নেই। হেসে বলল, ঠিক আছে, বলুন

আপনি আমাদের অনেক খবরই রাখেন। নিশ্চয়ই জানেন, বাড়িটা আমার বাবার। দলিল-টলিল তার নামেই।

জানি।

বুঝতেই পারছেন, এই বাড়ির ব্যাপারে কারও সঙ্গে ডিল করার ক্ষমতা আমার নেই।

সুরেশ্বর বলল, আমি আরও কিছু জানি মৃদুলা দেবী

মৃদুলা সতর্ক ভঙ্গিতে বলে, কী?

আপনি যা বলবেন, এ-বড়িতে সেটাই শেষ কথা। আমার সঙ্গে যখন ডিল করবেন, ইন্দ্রনাথবাবু চোখ বুজে সই করে দেবেন।

এখানেই আপনার ভুল হচ্ছে।

 মানে?

বাবা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেও তার মতামত ছাড়া এ-বাড়িতে কিছুই হয় না। তিনি যখন থাকবেন না, তখন অবশ্য আলাদা কথা। তাছাড়া

কী?

এই বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন আমার বাবার ঠাকুরদা। বাড়িটার সঙ্গে বাবার ইমোশান, সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে। আমি জানি, উনি চান, বাড়িটা যেমন আছে তেমনই থাক।

এর কোনও মানে হয় না।

কীসের কথা বলছেন?

সুরেশ্বর বলল, ওই সব ইমোশান, সেন্টিমেন্ট। হার্ড রিয়ালিটির দিকটা ভাবুন। কার্পোরেশনের ট্যাক্স দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আপনাদের এতটা জমি। তার মাঝখানে ছোট পুরোনো একটা বাড়ি। নিজেরা বাস করা ছাড়া জমিটা ফালতু পড়েই আছে। কোনও কাজেই লাগছে না। আজকাল কেউ এভাবে ল্যান্ড ফেলে রাখে না। আমি যা বলছি করুন। যে দুটো ফ্ল্যাট পাবেন তার একটায় আরামে থাকবেন। ইচ্ছা করলে অন্যটা ভাড়া দিতে পারবেন। মিনিমাম সাত-আট হাজার টাকা ভাড়া পাবেন। ক্যাশ যা পাবেন সেটা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করলে মান্থলি দশ-বারো হাজার পেয়ে যাবেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকবে না। কত দিক থেকে লাভ, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর মতো একটানা কথাগুলো বলে সে থামল।

খুব শান্ত মুখে মৃদুলা জিগ্যেস করল, আমাদের লাভের কথা ভেবেই তা হলে অফারটা দিতে এসেছেন?

একদৃষ্টে কিছুক্ষণ মৃদুলাকে লক্ষ্য করল সুরেশ্বর। তার মুখে অদ্ভুত ঠান্ডা হাসি ফুটে ওঠে, আমি প্রোমোটারি করি। ফিলানথ্রপিস্ট নই। আমারও কিছু লাভ থাকবে বইকি। নইলে পেট্রোল খরচা করে আপনাদের কাছে আসব কেন? মৃদুলার মুখ থেকে চোখ না সরিয়ে বলে যেতে লাগল, আমাদের মতো সাধারণ পার্থিব মানুষ দুটো পয়সার আশা থাকে বলেই না চারদিকে ছুটে বেড়ায়?

একটু চুপচাপ।

তারপর মৃদুলা বলল, আপনার অফারটা শুনতে ভালো লাগছে, কিন্তু বাবা রাজি হবেন বলে মনে হচ্ছে না।

সুরেশ্বর বলল, বৃদ্ধ মানুষদের নিয়ে এই এক সমস্যা। পুরোনো সমস্ত কিছুই তারা আঁকড়ে থাকতে চান। টোটালি মিনিংলেস।

মৃদুলা উত্তর দিল না।

সুরেশ্বর বলল, ম্যাডাম, আপনাকে আমার বিশেষ অনুরোধ, বাবাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করান।

যদি রাজি না হন?

হবেন, হবেন। একমাত্র সন্তান আপনি। আপনার কথায় রাজি না হয়ে পারেন?

 মৃদুলা বলল, কিন্তু

তাকে থামিয়ে দিয়ে সুরেশ্বর বলল, এর মধ্যে কিন্তু টিন্তু কিছু নেই। আপনাদের অনেকটা সময় নষ্ট করেছি। এবার চলি–

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিগ্যেস করল, ডিলের কাগজপত্র নিয়ে কবে আপনার সঙ্গে দেখা করব?

মৃদুলা আর শিঞ্জিনীও উঠে দাঁড়ায়। মৃদুলা বলে, আপনি ধরেই নিয়েছেন, বাবা আপনার অফারটা মেনে নেবেন?

আমার তো সেই রকমই ধারণা। এখন পর্যন্ত যাকে যাকে অফার দিয়েছি, সবাই তা মেনে নিয়েছে। কবে দেখা করছি?

বাবার সঙ্গে কথা না বলে কী করে বলব?

সে তো বটেই। আপনাকে দিন পাঁচেক সময় দিচ্ছি। আশা করি, এর ভেতর সব ঠিক হয়ে যাবে। আসার আগে আপনাকে ফোন করব।

সুরেশ্বর চলে যাবার পর দোতলায় উঠতে উঠতে শিঞ্জিনী বলল, দাদু যদি রাজি না হয়, কী হবে মা? তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ।

সুরেশ্বর খুব ভদ্রভাবেই কথা বলেছে কিন্তু তার মধ্যে ছিল একটা চাপা হুমকির সুর। মৃদুলাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। সে বলল, দেখি বাবা কী বলে। তবে

কী?

শনির দৃষ্টি যখন এসে পড়েছে, কিছু করা যাবে বলে মনে হয় না।

ওপরে আসতেই চোখে পড়ল, বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ইন্দ্রনাথ খোলা দরজা দিয়ে বাইরের রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন। সুরেশ্বর ভৌমিকের সঙ্গে মৃদুলাদের কী কথা হয়েছে শোনার জন্য তিনি খুবই ব্যগ্র। হয়তো উল্কণ্ঠিতও।

শিঞ্জিনীকে তার ঘরে পাঠাতে চাইল মৃদুলা। সে কিছুতেই যেতে রাজি হল না। মায়ের সঙ্গে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল। এক কোনা থেকে দুটো চেয়ার টেনে এনে ইন্দ্রনাথের খাটের কাছাকাছি বসল।

শ্বাস-টানা গলায় ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, লোকটা বিদেয় হয়েছে?

হ্যাঁ আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল মৃদুলা।

 কী চায় সে?

সুরেশ্বরের সঙ্গে যা যা আলোচনা হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিল মৃদুলা, খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দিল না।

রুগণ, শয্যাশায়ী ইন্দ্রনাথের জীর্ণ শরীরে তীব্র উত্তেজনা চারিয়ে যায়। অসহ্য ক্রোধে তিনি ফেটে পড়েন, এটা মগের মুল্লুক? কী ভেবেছে লোকটা?

মৃদুলা বলল, কিন্তু বাবা, তুমি তো জানো, সুরেশ্বর ভৌমিক কী ডেঞ্জারাস টাইপের লোক।

জানি, জানি ইন্দ্রনাথের দুচোখ থেকে আগুনের ফুলকি বেরুতে থাকে, আমার জমি, আমার বাড়ি। সেটা দেব কি দেব না, তা কি ও ঠিক করবে?

মৃদুলা বলল, বাবা, তুমি এত রাগারাগি করো না। শান্ত হও। শরীরের তো এই হাল। এক্সাইটমেন্ট তোমার পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর।

মেয়ের কোনও কথাই কানে গেল না ইন্দ্রনাথের। তীব্র গলায় তিনি বলতে লাগলেন, এই বাড়ি আমার ঠাকুরদা বানিয়েছিল। রূপাকে ধরলে পাঁচ জেনারেশন আমরা এখানে আছি। বংশের কত স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সুরেশ্বর ভৌমিক এসে শাসাল, আর অমনি ভয়ে ভয়ে আমি সব তার হাতে তুলে দিলাম। দেশে আইন-কানুন নেই, পুলিশ নেই?

ইন্দ্ৰনাথ শুনেছেন, সুরেশ্বর ভৌমিক লোকটা ভীষণ খারাপ। কিন্তু কতটা বিপজ্জনক, তার স্পষ্ট ধারণা নেই। মৃদুলা জানে, সুরেশ্বর আইন-কানুন এবং পুলিশ-টুলিশের ঊর্ধ্বে। বাবাকে কী বলবে, সে ভেবে পেল না।

শিঞ্জিনীও সুরেশ্বর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। এজাতীয় লোকেরা নাকি বন্দুকবাজ পোষে। জমি-টমি দখল করার জন্য দরকার হলে তাদের লেলিয়ে দেয়।

সুরেশ্বর ভৌমিককে দেখার পর থেকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল শিঞ্জিনীর। এই প্রথম সে কথা বলল, দাদু, লোকটা মাকে পাঁচদিন সময় দিয়েছে। তারপর ফোন করবে। তুমি যদি আমাদের বাড়ি তাকে দিতে রাজি না হও, কী যে করবে, বুঝতে পারছি না।

রোগা, শীর্ণ একখানা হাত নাতনির কাঁধে রেখে ইন্দ্রনাথ বললেন, ফোন তো আমার ঘরেই আসবে। যা উত্তর দেবার আমিই দেব। চিন্তা কোরো না। এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমার পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনার দিকে ভালো করে নজর দাও।

মৃদুলা আর শিঞ্জিনী, দুজনেই জানে, ইন্দ্রনাথ ভীষণ একগুঁয়ে ধরনের মানুষ। শরীর ভেঙেচুরে গেছে, প্রায় পঙ্গু। তবু জেদটা প্রবল। যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেন, সেখান থেকে তাকে সহজে টলানো যায় না। সুরেশ্বরকে তিনি কী বলবেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, কে জানে।

.

১০.

বিমলেশ বসুমল্লিককে নিয়ে টেনশন তো ছিলই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন এক সমস্যা। সুরেশ্বর ভৌমিক।

মারাত্মক উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছে শিঞ্জিনীর। স্কুলে যাচ্ছে ঠিকই, ক্লাস করছে, টিউটোরিয়ালেও যাচ্ছে, বাড়ি ফিরে পড়ার টেবলেও বসছে। কিন্তু মন দারুণ বিক্ষিপ্ত। বইয়ের পাতার কালো কালো হরফগুলো কেমন যেন ঝাপসা, দুবোধ্য হয়ে যায়। এই উদ্বেগ আরও কিছুদিন চললে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের আশা নেই।

তবে একটা ব্যাপার শিঞ্জিনী আজকাল লক্ষ্য করছে, অফিস ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে আসছে মা। মাঝখানে যে ফিরতে ফিরতে আটটা নটা দশটা হচ্ছিল সেটা বন্ধ হয়েছে।

সুশীলা বালিকার মতো মৃদুলা যে বাড়ি ফিরছে তার কারণ হয়তো এইরকম। সুরেশ্বর ভৌমিক তার মাথায় আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। পাঁচদিন যদিও সময় দিয়েছে, তবু কেন যেন লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যদি হুট করে এর ভেতর ফোন করে বসে? ইন্দ্রনাথ হয়তো এমন কিছু বলে বসবেন যাতে সমস্যা আরও ঘোরালো হয়ে উঠবে। তাই বাবাকে আগলে আগলে রাখতে চাইছে সে।

অবশ্য মৃদুলার পক্ষে সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাকে অফিসে বেরুতে হয়। সেই ফাঁকেও তো সুরেশ্বরের ফোন আসতে পারে। তা হলে অবশ্য কিছু করার থাকবে না। তবু বাবার কাছে যতক্ষণ থাকা যায়।

এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ইন্দ্রনাথ বলেছেন, একটা অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে তাকে যেন মৃদুলারা থানায় নিয়ে যায়। সুরেশ্বর ভৌমিকের নামে তিনি একটা ডায়েরি করবেন।

মৃদুলা বুঝিয়েছে, সুরেশ্বর এখনও তাদের কোনও ক্ষতি করেনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে থানা গ্রাহ্যই করবে না।

ইন্দ্রনাথ মেয়ের ওপর বিরক্ত হয়েছেন তার মানে যতদিন না ক্ষতি করছে, মুখ বুজে বসে থাকব? আগে থেকে কোনও প্রিকশান নেব না?

এখনই থানায় ছুটলে তার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক হতে পারে, ইন্দ্রনাথকে তা বোঝানো মুশকিল। মৃদুলা এবং শিঞ্জিনী দুজনেই চুপ করে থাকে।

সুরেশ্বর ভৌমিকের কথার যে নড়চড় হয় না সেটা টের পাওয়া গেল। পাঁচদিন সময় দিয়েছিল সে। এর মধ্যে একবারও যোগাযোগ করেনি।

রবিবার সশরীরে এসে মৃদুলার সঙ্গে কথা বলে গেছে সুরেশ্বর। আজ শনিবার। গতকাল তার দেওয়া সময়সীমা পার হয়েছে।

একটা দিন এ-বাড়ির লোকজনের, বিশেষ করে মৃদুলা আর শিঞ্জিনীর প্রতিটি লহমা তীব্র উৎকণ্ঠায় কেটেছে। আজ ঘুম ভাঙার পর থেকে উদ্বেগটা শতগুণ বেড়ে গেছে। তাদের ধারণা, যে-কোনও মুহূর্তে সুরেশ্বরের ফোন আসবে।

শনিবার শিঞ্জিনীর স্কুলে পুরো ছুটি। এই দিনটা তার কোচিং ক্লাসও থাকে না। কাজেই বাড়ি থেকে বেরুবার প্রশ্ন নেই। শনিবার মৃদুলার হাফ-ডে অফিস। কিন্তু সেও আজ ছুটি নিয়েছে, এবং সকাল থেকে ইন্দ্রনাথের ঘরে বসে আছে। শিঞ্জিনী তার ঘরে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। মাঝে মাঝেই অস্থির পায়ে উঠে এসে ইন্দ্রনাথের ঘরে ঘুরে যাচ্ছে।

সারাদিন কেটে যাবার পর যখন সন্ধে কমতে শুরু করেছে সেই সময় সুরেশ্বরের ফোন এল। ইন্দ্রনাথ হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই ফোনটা তুলে নিল মৃদুলা।

আমি সুরেশ্বর বলছি।

 বুঝতে পারছি। বলুন

কবে ডিলের কাগজপত্র নিয়ে আসব?

আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, আমার বাবা রাজি হয়ে গেছেন?

এমন একটা চমৎকার অফার দিয়েছি। রাজি হওয়াই তো উচিত।

শিঞ্জিনীর কান এদিকেই ছিল। টেলিফোন বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে ইন্দ্রনাথ খাটের বাজুতে ঠেসান দিয়ে বসেছেন। সুরেশ্বর অন্য প্রান্ত থেকে কী বলছে শোনা না গেলেও মৃদুলার উত্তর শুনে বোঝা যাচ্ছে সে কী চায়।

উত্তেজিত ইন্দ্রনাথ ক্ষীণ, দুর্বল কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে চিৎকার করছেন, ফোনটা আমাকে দে খুকু। রাসকেলটাকে মজা দেখিয়ে ছাড়ছি।

টেলিফোনটা ইন্দ্রনাথকে দিল না মৃদুলা। নিজেই কথা বলতে লাগল, বাবা রাজি হননি। পোমোটারের হাতে তিনি নিজের বাড়ি-জমি কিছুতেই তুলে দেবেন না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সুরেশ্বর। তারপর বলে, কিন্তু ওই বাড়ি আর ল্যান্ড যে আমার চাই ম্যাডাম

মৃদুলা যেন নিজের অজান্তেই বলে ওঠে, না দিলে আপনি কি জোর করে কেড়ে নেবেন?

প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে সুরেশ্বর বলল, আমি আপনাকে আরও দুদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে যেভাবে হোক, বাবাকে রাজি করাবেন। তাকে বলবেন, সুরেশ্বর ভৌমিক যখন ঠিক করেছে এখানে একটা হাই রাইজ উঠবে তখন সেটা উঠবেই। দুদিন পর আবার কথা হবে। সেটাই হবে আমার লাস্ট ফোন।

বাবা যদি তখনও রাজি না হন?

সে ব্যাপারও ভেবে রেখেছি। তবে আজই তা বলছি না। দুটো দিন ধৈর্য ধরে থাকব। আচ্ছা নমস্কার।

মৃদুলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল সুরেশ্বর। এতক্ষণ ফোনে সে কী বলেছে, তা জানাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ইন্দ্রনাথ। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করলেন, তারপর ভীষণ কাহিল হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল তার।

.

১১.

আরও যে দুদিন সময় পাওয়া গেছে, তার মধ্যেও ইন্দ্রনাথের মনোভাবের তিলমাত্র পরিবর্তন হয়নি। তার শীর্ণ শরীরের কাঠামোটার ভেতর একটি অনমনীয় জেদি মানুষ আছে। তাকে টলানো প্রায় অসম্ভব। একটা বদ লোক বড় বড় দুটো ফ্ল্যাট এবং প্রচুর নগদ টাকার লোভ দেখাচ্ছে, আর তিনি নাচতে নাচতে তার ফাঁদে পা দেবেন, তেমনি বান্দাই নন ইন্দ্রনাথ। ঠাকুরদার তৈরি বাড়ি ভেঙে সেই জায়গায় হাই-রাইজ তুলে চড়া দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করবে। বিহারি পাঞ্জাবি মারাঠি মারোয়াড়ি গুজরাটি এমনি নানা জাতের কুড়ি-বাইশটা ফ্ল্যাট-মালিকের সঙ্গে বাস করতে হবে–এই চিন্তাটা তাকে খেপিয়ে তুলেছে। প্রশ্নটা অধিকারবোধের। আমার বাড়ি যেমনই হোক–সেকেলে, সাদামাঠা, রঙচটা কার্নিসভাঙা-সেটা আমারই। তার কোনও ভাগীদার অবাঞ্ছনীয়।

এ হল একটা দিক। অন্য দিকটা আরও অসহ্য। সুরেশ্বর বুঝিয়ে দিয়েছে, জমি-বাড়ি না পেলে কী একটা ব্যবস্থা করবে। মতলবটা পরিষ্কার। যেনতেন প্রকারে বাড়ি-টাড়ি দখল করবে। এটাই ইন্দ্রনাথের মাথায় একটা বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

.

ঠিক দুদিন পর আবার সুরেশ্বরের ফোন এল, কী ডিসিশন নিলেন?

মৃদুলা বলল, আপনাকে আগে যা বলেছিলাম, এখনও তাই বলছি। বাবা রাজি নন। তিনি চাইছেন, বাড়িটা যেমন আছে তেমনি থাক।

আপনি নিজে কী চাইছেন?

বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাব না।

এটাই আপনাদের শেষ কথা?

 হ্যাঁ।

ধন্যবাদ।

 ওধারে ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ হল।

.

১২.

আট-দশদিন কেটে গেল।

এর ভেতর আর কোনওরকম যোগাযোগ করেনি সুরেশ্বর। এ-বাড়িতে আসেওনি, ফোনও করেনি। স্পষ্টাস্পষ্টি না বলে দেবার পর সে কি তা হলে হাত গুটিয়ে নিয়েছে? লোকটা যে ধরনের সাঙ্ঘাতিক তাতে আদৌ বিশ্বাস হয় না। গোপনে কী ফন্দি আঁটছে, বোঝারও উপায় নেই।

তবে এটা ঠিক, লোকটা চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় ইন্দ্রনাথদের টেনশন কমতে শুরু করেছে।

.

আজ বুধবার। স্কুল ছুটির পর কোচিং ক্লাসে গিয়েছিল শিঞ্জিনী। সপ্তাহের এই দিনটা জয়ব্রত স্যারের বাড়ি স্বর্ণালী আর সে ইকনমিকস পড়তে যায়। দেবারতি মিসের মতো জয়ব্রত স্যারও পাঁচ-ছজনের একেকটা ব্যাচ করে পড়ান। শিঞ্জিনীদের ব্যাচে সে আর স্বর্ণালী ছাড়া অন্য স্কুলের আরও চারজন ছেলেমেয়ে আছে।

যেদিন কোচিং ক্লাস থাকে, বাড়ি ফিরতে দেরি হয় শিঞ্জিনীর। প্রায় আটটা বেজে যায়।

আজ যখন ফিরল, আটটা বাজতে বারো মিনিট বাকি। সে বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মালতী জানাল মৃদুলা এখনও ফেরেনি। ইন্দ্রনাথ মেয়ের জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। খবরটা দিয়ে আর সে দাঁড়াল না। তার রাতের খাবার গোছগাছ করাই ছিল। সেটা নিয়ে তাদের বস্তিতে চলে গেল।

সুরেশ্বর যেদিন প্রথম এ-বাড়িতে এল, তারপর থেকে অফিস ছুটির পর বাইরে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না মৃদুলা। চার্টার্ড বাস ধরে ছটা-সোয়া ছটার ভেতর ফিরে আসে। মাকে আরও বেশি করে নিজের কাছে পাচ্ছিল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ পাচ্ছিলেন তাঁর মেয়েকে।

কিন্তু আজ মৃদুলার দেরি করার কারণ কী? মা কি ফের তার সেই পুরোনো অভ্যাসে ফিরে গেছে? যেমনটা চার মাস ধরে করে আসছিল? অর্থাৎ বিমলেশ বসুমল্লিকের সঙ্গে নাটক বা সিনেমা দেখা বা দামি হোটেলে খাওয়া বা মোটরে করে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়া–এই সব?

একদিন বিমলেশ বসুমল্লিকের কথা স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল। মস্তিষ্কের অদৃশ্য কুঠুরি থেকে সে যেন আবার বেরিয়ে আসে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথার মতো একটা কষ্ট হতে থাকে তার।

দোতলায় এসে বাইরের বারান্দায় জুতো খুলে প্রথমে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল শিঞ্জিনী। যেদিন যেদিন কোচিং ক্লাস থাকে, নাতনি দেরি করে ফেরে। সেটা তার জানা আছে। আজ শিঞ্জিনীর জন্য নয়, আজ তিনি মেয়ের জন্য ভীষণ উতলা। বললেন, কদিন ধরে তোমার মা ঠিক সময়ে ফিরছিল। আটটা বাজতে চলল। আজ এত দেরি করছে কেন বলো তো? একটু থেমে জিগ্যেস করলেন, তোমাকে কি কিছু বলে গেছে?

শিঞ্জিনী আস্তে মাথা নাড়ে, কই, না! বিমলেশ বসুমল্লিকের নামটা তার মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল। দ্রুত সামলে নিল। বিমলেশের কথা এখনও তাকে জানানো হয়নি। জানালে উৎকণ্ঠা শতগুণ বেড়ে যাবে।

ইন্দ্রনাথ বললেন, সেই প্রোমোটারটা কোনও শয়তানি করল কি?

বিমলেশের চিন্তাটাই মাথায় পাক খাচ্ছিল শিঞ্জিনীর। সুরেশ্বর ভৌমিকের কথা এই মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও সে ভাবেনি। মায়ের সঙ্গে কী ধরনের শয়তানি করতে পারে লোকটা? মা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, প্রচণ্ড সাহসী। তবু সংশয় থেকেই যাচ্ছে। সুরেশ্বর সাধারণ মাপের ক্রিমিনাল নয়। অত্যন্ত ধুরন্ধর এবং নিষ্ঠুর। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সে না পারে এমন কোনও কাজ নেই। খুনখারাপি, ঘরে আগুন থেকে যাবতীয় দুষ্কর্ম। একটি মহিলার পক্ষে তাকে ঠেকানো কতটা সম্ভব?

অন্যমনস্কর মতো ইন্দ্রনাথ বললেন, সেই নটায় বেরিয়েছ। স্কুল, কোচিং ক্লাস করে, নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। যাও, আগে হাতমুখ ধুয়ে রেস্ট নিয়ে কিছু খেয়ে নাও। তারপর পড়তে বসো।

ইন্দ্রনাথের খাট থেকে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে মেঝেতে নামাতে নামাতে শিঞ্জিনী বলল, কদিন মা ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরছে। তার আগে তো বেশ দেরি করত। হয়তো কোনও

কারণে আটকে গেছে। তুমি এত ভেবো না।

ইন্দ্রনাথের চোখ বুজে আসছিল। নিশ্চয়ই বস্তিতে যাবার আগে মালতী তাকে রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গেছে।

শিঞ্জিনী নিজের ঘরে গিয়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে পোশাক পালটে ফেলল। মালতী তার ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিল। ভীষণ খিদে পেয়েছে। খাওয়া চুকিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে জিরিয়ে নিল। তারপর পড়ার টেবলে গিয়ে টেবলল্যাম্প জ্বেলে পড়তে বসে গেল।

.

কতক্ষণ বইয়ের ভেতর ডুবে ছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ রাতচরা কোনও পাখির কর্কশ ডাকে চমকে উঠল শিঞ্জিনী। সমস্ত এলাকা এখন নিঝুম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবাই ঘুমের আরকে ডুবে আছে। দক্ষিণ দিকের আগাছায় ভরা মাঠ, পানাপুকুরে ঠাসা জলাটার ওধারে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর প্রায় সব বাতি নিভে গেছে। দু-একটা জানালায় ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়ে।

আকাশে ছাড়া ছাড়া কিছু মেঘ আছে। তবে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। মহাশূন্যে লক্ষ কোটি তারার মেলা। ক্ষীণ একটি চাঁদও দেখা যাচ্ছে।

স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে শিঞ্জিনীর চোখ সামনের দেওয়াল ঘড়িতে আটকে যায়। একটা বেজে সতেরো। চমকে উঠল সে। মা তো এখনও ফিরে আসেনি! এলে নীচে কলিংবেল বাজাত।

বিমলেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে চলে এসেছে মৃদুলা। এখন একটা বেজে সতেরো। এ তো ভাবাই যায় না। কী হতে পারে মায়ের? মারাত্মক কোনও অ্যাকসিডেন্ট?

মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যেতে থাকে শিঞ্জিনীর। দিশেহারার মতো সে দৌড়ে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে আসে। দাদু ওষুধ খেয়ে অসাড়ে ঘুমোচ্ছে।

কোচিং থেকে ফিরে যখন শিঞ্জিনী এ-ঘরে আসে, বেশি পাওয়ারের বাল্বটা জ্বলছিল। সেটা নিভিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিতে ভুলে গিয়েছিল সে।

অন্যদিন মা থাকে। আজ একটি রুগণ ঘুমন্ত বৃদ্ধ ছাড়া এ-বাড়িতে আর কেউ নেই। শিঞ্জিনীর গা ছম ছম করতে লাগল। একতলায় খাবার টেবলে রুটি বা পরোটা, ডাল, তরকারি, মাংস-টাংস গুছিয়ে রেখে গেছে মালতী। মায়ের জন্য মন যেভাবে তোলপাড় হচ্ছে, খাওয়ার কথা তার মাথাতেই এল না। একা একা নিজের ঘরে সে চলে যাবে, সে সাহসটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। শিঞ্জিনীর গা ছম ছম করতে লাগল।

যতই অথর্ব পঙ্গু হোক, যতই ঘুমিয়ে থাকুক, একটা জীবন্ত মানুষ তো। শিঞ্জিনী এতটুকু শব্দ না করে ঘরের কোণ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে দাদুর খাটের পাশে বসে রইল।

এ-ঘরে ইন্দ্রনাথের শিয়রের দিকের টেবলে একটা পুরোনো ঘড়ি আছে। মাঝে মাঝেই সেটার দিকে শিঞ্জিনীর চোখ চলে যাচ্ছে। দেড়টা বাজল, দুটো বাজল, তিনটে বাজল। ঘড়ির কাটা যান্ত্রিক নিয়মে ঘুরেই চলেছে।

স্নায়ুগুলো টান টান করে বসেই রয়েছে শিঞ্জিনী। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি মা এল, এই বুঝি নীচে কলিং বেলবেজে উঠল।

.

একসময় সকাল হল।

কখন সূর্য উঠেছে, খেয়াল করেনি শিঞ্জিনী। খোলা-দরজা-জানালা দিয়ে অঢেল বোদ এসে পড়েছে ইন্দ্রনাথের ঘরে।

সারা রাত লহমার জন্যও ঘুমোয়নি শিঞ্জিনী। কপালের দুপাশের শিরাগুলো দপ দপ করছে। যন্ত্রণায় মাথা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আয়নার সামনে গিয়ে এখন যদি সে দাঁড়াত, দেখতে পেত, তার চুল উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটো লাল টকটকে। গালে চোখের জলের শুকনো দাগ।

এদিকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইন্দ্রনাথের। চোখ মেলে নাতনিকে খাটের পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হলেন। তারপর ভালো করে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলেন, এ কী, তুমি এখানে বসে আছ! রাত্তিরে ঘুমোওনি?

না। আস্তে মাথা নাড়ল শিঞ্জিনী।

 কেন?

ধরা ধরা, ভাঙা গলায় কারণটা জানাল শিঞ্জিনী।

কনুইয়ে ভর দিয়ে ধড়মড় করে নিজের জরাজীর্ণ শরীরটা টেনে তুললেন ইন্দ্রনাথ। লহমায় একটা মানুষের চেহারা এতটা ভেঙেচুরে যেতে পারে, ভাবা যায় না। এমনিতেই রোগে রোগে শরীরে প্রায় কিছুই ছিল না। চামড়া আর হাড়ের কাঠামো মাত্র। সেটা এখন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

রুদ্ধশ্বাসে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, সারা রাত খুকু ফেরেনি। ফোনও করেনি?

না।

আমাকে জানাওনি কেন?

 ঘুম ভাঙালে তোমার শরীর খারাপ হত।

উদ্ভ্রান্তের মতো ইন্দ্রনাথ এবার বললেন, কেন এল না মেয়েটা? কেন? কী হল ওর?

তিনটে সম্ভাবনার কথা আগেই মাথায় এসেছিল শিঞ্জিনীর। এক, দুর্ঘটনা। দুই, বিমলেশের সঙ্গে বাইরে কোথাও গিয়ে হয়তো আটকে পড়েছে মৃদুলা। তিন, সুরেশ্বর ভৌমিক এমন কিছু করেছে যাতে তার পক্ষে ফেরা সম্ভব হয়নি।

অস্থির অস্থির ভাবটা খানিক কাটিয়ে উঠে ইন্দ্রনাথ বললেন, মালতী তো এখনও আসেনি?

 শিঞ্জিনী বলল, সে কি এত তাড়াতাড়ি আসে?

এক কাজ করো। আমাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাও। মুখ-টুখ ধুয়ে বাসি পোশাক পালটে নেব। আমার হলে তুমিও মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে এসো!

মালতী রোজ সকালে এসে দাদুকে বাথরুমে ঘুরিয়ে এনে ফিটফাট করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সে যতক্ষণ না আসে, ইন্দ্রনাথ অপেক্ষা করেন। আজ তার কেন এত তাড়া, বোঝা যাচ্ছে না।

ইন্দ্রনাথ আবার বললেন, তুমি এসে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করবে। ওরা স্ট্রেচারে করে আমাকে থানায় নিয়ে যাবে। তুমিও সঙ্গে থাকবে।

কয়েক পলক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শিঞ্জিনী। তারপর বলে, থানায় যাবে কেন?

একটা মেয়ে সারারাত বাড়ি ফিরল না। থানায় খবর দিতে হবে না? ওরাই নানা জায়গায় খোঁজ করে–

ইন্দ্রনাথের কথা শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে ওঠে। ইন্দ্রনাথ ব্যগ্র সুরে বলেন, দেখো তো দিদি

টেলিফোন তুলে হ্যালো বলতেই একটা অচেনা ভারীমতো গলা ভেসে এল, আমি মৃদুলাদেবীর মেয়ে শিঞ্জিনীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে শিঞ্জিনীর। ভয়ে ভয়ে সে বলে, আমিই শিঞ্জিনী। আপনি কে বলছেন?

আমাকে তুমি চিনবে না। তোমার মা আমাদের কাছেই আছেন। তার জন্যে চিন্তা কোরো না। নিজেদের দিদির মতো সম্মান দিয়ে তাকে আমাদের কাছে রেখেছি।

মাকে ফোনটা দিন। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। সারা রাত আমি ঘুমোতে পারিনি।

খুব স্বাভাবিক। তোমাদের আগেই ফোন করা উচিত ছিল। ভুল হয়ে গেছে।

আমার দাদু ভীষণ অসুস্থ। মায়ের কিছু হলে তিনি বাঁচবেন না। ব্যাকুলভাবে শিঞ্জিনী বলতে লাগল, আমরা আপনাদের কোনও ক্ষতি করিনি। প্লিজ, মাকে ছেড়ে দিন। নইলে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দিন।

এখন কোনওটাই সম্ভব নয়। দাদুকে টেনশন করতে বারণ করো। তোমাকে তো আগেই বলেছি, মৃদুলাদেবীকে খুব যত্ন করে, মর্যাদা দিয়ে আমাদের কাছে রেখেছি।

মাকে আটকে রাখার কারণটা কী? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

কারণ একটাই। আমরা তোমাদের দারুণ একটা অফার দিয়েছিলাম। তোমার দাদু রাজি হলেন না। তাই বাধ্য হয়ে লোকটা বলতে লাগল, সে যাক। কাল এই সময় আবার ফোন করব। তোমার দাদুকে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব। তিনি সই করে দিলে এক ঘণ্টার ভেতর মৃদুলা দেবী বাড়ি পৌঁছে যাবেন।

সুরেশ্বরই যে এই লোকটাকে দিয়ে ফোন করাচ্ছে, আগেই টের পাওয়া গেছে। শিঞ্জিনী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই লাইন কেটে দিল লোকটা।

দম বন্ধ করে তাকিয়ে ছিলেন ইন্দ্রনাথ। নাতনির মুখে সব শোনার পর আতঙ্কগ্রস্তের মতো বললেন, ওরা নিয়ে যাক আমার জমি-বাড়ি। যা লেখাতে চায়, লিখিয়ে নিক। শুধু আমার খুকুকে ফিরিয়ে দিক। তাঁর মনোবল, সুরেশ্বর ভৌমিকের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস, সব চুরমার হয়ে গেছে।

কিন্তু লহমায় বদলে গেল শিঞ্জিনী। ভয়, শঙ্কা, উৎকণ্ঠা–সব যেন উধাও হয়ে যায়। একটা লোক মাকে আটকে রেখে, চাপ দিয়ে সর্বস্ব লিখিয়ে নিতে চাইছে, কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছে না সে। ইন্দ্রনাথের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ। চব্বিশ ঘণ্টা সময় পাওয়া গেছে। যা করার এর মধ্যেই তাকে করতে হবে। হঠাৎ দুর্জয় সাহস যেন তার মাথায় ভর করেছে।

শিঞ্জিনী বলল, দাদু, আমি এখন একটু বেরুব। তুমি না বলো না

নির্জীব সুরে ইন্দ্রনাথ জিগ্যেস করলেন, কোথায় যাবে?

দু-একজনের সঙ্গে দেখা করব। যদি বাড়ি-টাড়ি বাঁচানো যায় আর মাকে উদ্ধার করে আনতে পারি।

চকিত হয়ে উঠলেন ইন্দ্রনাথ, তোমার মতো একটা বাচ্চা মেয়ের পক্ষে ওই রকম বদমাশ ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কতটুকু কী করা সম্ভব? ওরা যদি টের পায়, তুমি কিছু একটা করতে যাচ্ছ, তোমার মায়ের বিপদ তো বাড়বেই, তোমারও ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে?

শিঞ্জিনী বলল, কেউ কিছু জানতে পারবে না।

বাধা দেবার ক্ষমতাও শেষ হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রনাথের। বললেন, দেখো, যদি কিছু করতে পারো। কিন্তু খুব সাবধান

.

কী করবে মোটামুটি তার একটা পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল শিঞ্জিনী। মালতী এলে তার হাতে ইন্দ্রনাথ এবং বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।

বড় রাস্তার মোড়ে একটা টেলিফোন বুথ রয়েছে। সেখান থেকে প্রথমে শিবপুরে রজতের হোস্টেলে ফোন করল শিঞ্জিনী। তার গলা শুনে রজতের মনে হল, আকাশের চাঁদ যেন হাতের মুঠোয় নেমে এসেছে।

তুমি যে আমাকে ফোন করবে, ভাবতে পারিনি। উঃ, কী ভালো যে লাগছে!

শতধারায় রজতের উচ্ছ্বাস ফেটে বেরিয়ে আসছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আমি একটা ভীষণ বিপদে পড়েছি। আপনি কি সাহায্য করবেন?

তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে থমকে গেল রজত। একটু চুপ করে থেকে বলল, কী বিপদ? কী ধরনের সাহায্য?

বিপদের বিবরণ শুনিয়ে শিঞ্জিনী বলল, আপনার মায়ের বহু পুরোনো ছাত্র অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বড় বড় পোস্টে রয়েছেন। তাদের ব্যাপারটা জানালে আমাদের প্রবলেমটা হয়তো

আগেই দমে গিয়েছিল রজত। বলল, পোমোটার, কিডন্যাপিং–এ সব ব্যাপারে নিজেকে জড়ালে মা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। আচ্ছা, রাখছি।

.

রজতের কাছ থেকে সাহায্যের কোনওরকম আশাই নেই। শিঞ্জিনী টেলিফোন বুথ থেকে সোজা চলে এল থানায়। অফিসার-ইন-চার্জকে তার সমস্যার কথা সবিস্তার জানাল।

খুব মনোযোগ দিয়ে অফিসার শিঞ্জিনীর কথা শুনলেন। সহৃদয় সুরে বললেন, ব্যাপারটা সাঙ্ঘাতিক। কাল একটা কিডন্যাপিংয়ের খবর পেয়েছি। তবে কে কিডন্যাপড হয়েছে, কারা এই নোংরা কাজটা করেছে, এখনও কিছুই জানা যায়নি। তোমার টেনশনটা বুঝতে পারছি মা। আমরা খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করব। তোমাদের ঠিকানা রেখে যাও। তোমার মায়ের সন্ধান পেলেই যোগাযোগ করব। একটু থেমে বললেন, সুরেশ্বর ভৌমিক বিরাট প্রোমোটার। সলিড প্রমাণ ছাড়া তার গায়ে তো হাত দেওয়া যায় না।

.

শিঞ্জিনীর মাথায় জেদ চেপে গেছে। পুলিশ অফিসার যে এড়িয়ে গেলেন তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না।

দুজায়গায় ব্যর্থ হবার পর ফার্ন রোডে স্বর্ণালীদের বাড়ি চলে এল শিঞ্জিনী। স্বর্ণালীর বাবা দেবকুমার আঙ্কল বাড়িতেই ছিলেন। তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তাদের বাড়ির সবার প্রতি ওঁর গভীর সহানুভূতি।

সব শুনে দেবকুমার সিঁটিয়ে গেলেন। সুরেশ্বর ভৌমিকের নাম এবং তার কার্যধারা সম্বন্ধে যাবতীয় খবরই রাখেন। বুঝিয়ে দিলেন, এমন লোকের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তোলার ক্ষমতা তার নেই।

.

বিপর্যস্ত, হতাশ শিঞ্জিনী কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না। স্বর্ণালীদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনের মতো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিমলেশের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মা বলেছিল, এই লোকটার পুলিশ, প্রশাসন এবং মন্ত্রিমহলে প্রচুর যোগাযোগ এবং প্রভাব।

বিমলেশ সম্পর্কে শিঞ্জিনীর মনে যা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে তা হল প্রচণ্ড আক্রোশ। সেই সঙ্গে বিদ্বেষ। তার অফিসের ঠিকানাটা মায়ের মুখে শুনেছিল। আশ্চর্য, সেটা মনেও আছে। কখন যে ট্যাক্সি নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল, খেয়াল নেই।

একটা বিশাল হাইরাইজের তিনটে ফ্লোর জুড়ে বিমলেশের পিকক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর বিশাল অফিস। তাঁর সঙ্গে সহজে দেখা করা গেল না। রিসেপশানের স্মার্ট ঝকঝকে সুন্দরী তরুণীটি তাকে রুখে দিল। চেয়ারম্যান অর্থাৎ বিমলেশ আজ ভীষণ ব্যস্ত। শিঞ্জিনী যেন অন্য দিন আসে।

ফিরে যাবার জন্য শিঞ্জিনী আসেনি। একটা শ্লিপ লিখে রিসেপশনিস্ট মেয়েটাকে দিয়ে কঠোর সুরে বলল, এটা আপনাদের চেয়ারম্যানকে পাঠিয়ে দিন। নইলে আপনি অসুবিধায় পড়বেন।

কয়েক লহমা শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটি। তারপর নিজেই স্লিপটা নিয়ে চলে গেল।

কয়েক মিনিটের ভেতর প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে এলেন বিমলেশ। তার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়, তুমি!

শিঞ্জিনী বলল, বিশেষ দরকারে আপনার কাছে আসতে হল। আমরা খুব বিপদে পড়েছি।

রিসেপশানে আরও লোজন রয়েছে। তাদের সামনে কোনও প্রশ্ন করলেন না বিমলেশ। শিঞ্জিনীকে চমৎকার-সাজানো বিশাল এক চেম্বারে এনে বসালেন। নিজে তার সামনে বসলে বসতে বললেন, কী হয়েছে, বলো

শিঞ্জিনী যা যা ঘটেছে, কাল রাতটা কী নিদারুণ উল্কণ্ঠায় তাদের কেটেছে, সব জানাল। সেই সঙ্গে সুরেশ্বর ভৌমিকের ক্রমাগত চাপ এবং হুমকির ব্যাপারটাও।

সমস্ত শোনার পর মুখটা থমথমে হয়ে যায় বিমলেশের। বললেন, ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন বলো, কী খাবে?

কিচ্ছু না। দাদু বাড়িতে খুব ভাবছে। এখনই আমাকে ফিরে যেতে হবে।

বিমলেশ অনুমান করে নিলেন, এখন খাওয়ার মতো মনের অবস্থা নয় শিঞ্জিনীর। তিনি জোর করলেন না। বললেন, ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। সে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বিমলেশের গাড়িতে ওঠার ইচ্ছা ছিল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হল শিঞ্জিনী।

.

১৩.

সকালে শিঞ্জিনী যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, ঘড়িতে তখন সোয়া আটটা। বিমলেশের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরেছিল সাড়ে বারোটায়। এতক্ষণ কোথায় কোথায় ঘুরেছে, কার কার সঙ্গে দেখা করেছে, সব ইন্দ্রনাথকে বলেছে সে। শুধু বিমলেশের সঙ্গে মৃদুলার সম্পর্কটাই জানায়নি।

সেই বারোটা থেকে ইন্দ্রনাথ আর শিঞ্জিনী উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে। এমনকী মালতী। সে-ও সব জেনে গেছে।

সন্ধের খানিক আগে, তখনও মরা মরা একটু রোদ চারদিকে আলগাভাবে জড়িয়ে আছে, সেই সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। সেই সঙ্গে মৃদুলার ডাক ভেসে আসে, রূপা রূপা-মালতী।

রূপা ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নীচে এসে দরজা খোলে। মালতীও দৌড়ে এসেছে।

মাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে শিঞ্জনী। তারপর দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। ভাঙা ভাঙা, জড়ানো গলায় বলে, কাল কী হয়েছিল তোমার মা? সুরেশ্বর ভৌমিকরা তোমাকে কীভাবে ধরে নিয়ে গেল?

মৃদুলাও কাঁদছিল। বলল, সুরেশ্বরের গানম্যানরা বন্দুক দেখিয়ে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে সব শুনিস। রাস্তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, উনি না বাঁচালে কী যে হত!

ফুটপাতের ধার ঘেঁষে একটা এয়ার-কন্ডিশনড টোয়েটা। সেটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিমলেশ। শিঞ্জিনীর সঙ্গে চোখাচোখি হতে নরম গলায় বললেন, তোমার মাকে দিয়ে গেলাম। সুরেশ্বর আর কোনও গোলমাল করবে না। আচ্ছা, চলি–

হঠাৎ অদ্ভুত এক আবেগ শতধারায় বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে যেতে লাগল শিঞ্জিনীর। বিমলেশ গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন, মাকে ছেড়ে দৌড়ে তার কাছে চলে আসে সে, প্লিজ, যাবেন না

দাদু পঙ্গু মানুষ। নির্জীব, শয্যাশায়ী। কবে আছেন, কবে নেই। এদিকে শকুনের পাল, হাঙরের দঙ্গল তাদের ছিঁড়ে খাবার জন্য দাঁত-নখ শানিয়ে রেখেছে। মাথার ওপর বিমলেশের মতো একজন শক্তিমান মানুষ না থাকলে তারা বাঁচবে না।

বিমলেশ বললেন, যেতে বারণ করছ?

হ্যাঁ। ধরা গলায় শিঞ্জিনী বলল, আসুন

এই ডাকটার জন্য কতদিন অপেক্ষা করে আছেন বিমলেশ। তাঁর মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে ওঠে। আশ্চর্য সুন্দর। মায়াময়। বললেন, তুমি যখন যেতে বলেছ, নিশ্চয়ই তোমাদের বাড়ি যাব–

দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে শিঞ্জিনীর।

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই উপন্যাস রচিত। স্থান এবং চরিত্রগুলির নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে কল্পনার আশ্রয়।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *