দহনকালের শেষে — উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়
০১.
স্কুল ছুটির পর অন্য দিনের মতো সামনের বিশাল গেটটা খুলে দেওয়া হয়েছে। এক ১লহমাও কারও তর সইছিল না। আগে বেরুবার জন্য এখন তুমুল হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি।
এই নামকরা কো-এড স্কুলটায় ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত তেরশোরও বেশি ছাত্রছাত্রী। তারা ঢলের মতো হুড় হুড় করে বেরিয়ে আসছিল। চারপাশ কলরবে মুখর।
ক্লাস চলার সময় বিশাল কমপাউন্ডের ভেতর প্রকাণ্ড দুটো চারতলা বাড়িতে টু শব্দটি শোনা যায় না। এখানে ডিসিপ্লিনের ভীষণ কড়াকড়ি। কিন্তু ছুটির বেল বাজলে তার লেশমাত্র থাকে না। তখন কে কী করল, এই নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল আদৌ মাথা ঘামান না।
ভিড়ের ভেতর পথ করে করে ক্লাস টুয়েলভের একটা দঙ্গল বেরিয়ে এসেছিল। বাইরের ফুটপাতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবার জন্য অনেক মা, বাবা কি বাড়ির লোক ভিড় করে আছে। রাস্তার ধার ঘেঁষে বিরাট বিরাট স্কুল-বাস দাঁড়ানো। প্রায় ডজন খানেক। সেগুলোর সামনে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। তা ছাড়া, একের পর এক আসছে কত না প্রাইভেট কার। মারুতি, ফিয়াট, অ্যামবাসাডর, সান্ত্রো।
রাস্তায় এসে ক্লাস টুয়েলভের সেই দঙ্গলটা ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ইলেভেনে ওঠার পর স্কুল-বাসের সুযোগ নেই। ধরেই নেওয়া হয়, তখন ছাত্রছাত্রীরা যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে। নিজেদের যাতায়াতের ব্যবস্থা তাদেরই করে নিতে হয়। অনেকের বাড়ি থেকেই গাড়ি আসে। যারা কাছাকাছি থাকে, হেঁটেই চলে যায়। বাকি সবাই বাস, মিনিবাস কি অটোতে।
টুয়েলভের দুটি মেয়ে–শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী–ডান দিকের ফুটপাত ধরে একটু জোরে জোরেই হাঁটছিল।
গরমের লম্বা ছুটির পর আজই স্কুল খুলেছে। অন্য স্কুলে ভ্যাকেশনের পর প্রথম দিনটা একটু ঢিলেঢালা ভাব থাকে। দু-তিনটে পিরিয়ডের পর ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু এই স্কুল যেদিন খোলে সেদিন থেকেই পুরো ক্লাস।
জুন মাস শেষ হয়ে এল। আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী, এর মধ্যে পুরোদমে বর্ষা নেমে যাবার কথা। কিন্তু সেভাবে আরম্ভই হয়নি। মেঘের আনাগোনা অবশ্য চলছেই। তবে তেমন জমাট বাঁধছে না। মাঝে মাঝে দু-এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয়। ব্যস, এই পর্যন্ত।
এখন, এই বিকেলবেলায় পশ্চিম আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। রোদের রং মলিন হয়ে যাচ্ছে। তবু ভাবগতিক দেখে মনে হয়, খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি নামবে না। নামলেও সন্ধের পর।
শিঞ্জিনী আর স্বর্ণালী প্রায় একবয়সি। সতেরো থেকে আঠারোর মধ্যে। দুজনেরই সুশ্রী, ঝকঝকে চেহারা। তবু শিঞ্জিনীই বেশি করে চোখ টানে। সতেরো-পেরুনো এই সদ্য যুবতীর শরীর সবে ভরে উঠেছে। লম্বা ধাঁচের মুখ উজ্জ্বল চোখে গভীর দৃষ্টি। গায়ের রঙে পাকা গমের আভা। মসৃণ ত্বক। ঘন চুল কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা। হাইটও বেশ ভালো। সাড়ে পাঁচ ফিটের কাছাকাছি। হাত-পা-গলা, সব কিছু ক্রমশ নিখুঁত হচ্ছে। তবে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মেয়েলি নরম ভাবটা তার মধ্যে কম। কোথায় যেন একটা গোপন রুক্ষতা রয়েছে।
দুজনের পরনে স্কুল ড্রেস। প্লিট-দেওয়া নেভি-ব্ল রঙের হাঁটু ঝুল স্কার্ট আর ধবধবে সাদা জামা। পায়ে কালো জুতো, সাদা মোজা। বুকে-আঁটা পেতলের গোল প্লেটে স্কুলের নামটা মিনে-করা।
স্কুল পেছনে ফেলে ডান পাশে মিনিটখানেক হাঁটলে একটা সরু গলি। গলিটা তিনটে পাক খেয়ে ট্রামরাস্তায় গিয়ে পড়েছে। ওখান থেকে ছুটির পর রোজই বাস বা মিনিবাস ধরে শিঞ্জিনীরা। দুজন একই দিকে থাকে, তবে এক এলাকায় নয়। স্বর্ণালীদের বাড়ি গোলপার্কের পাশে, ফার্ন রোডে। শিঞ্জিনীদের আরও এগিয়ে টিভি সেন্টারের কাছাকাছি।
স্বর্ণালীদের ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের বড় বিজনেস। ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সের হ্যাঁন্ডিক্রাফট অর্থাৎ হস্তশিল্পের নানা জিনিস ওরা বিদেশে পাঠায়। জাপান, থাইল্যান্ড এবং ইউরোপের নানা দেশ থেকে কী সব আনিয়ে এখানকার বাজারে বিক্রি করে।
স্বর্ণালীদের অঢেল টাকা। বাড়িতে তিন-চারটে দামি গাড়ি। সাম্রো, সিয়েলো, মারুতি-থাউজেন্ড ইত্যাদি। যে কোনও একটায় সে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারত। কিন্তু ওর বাবা অন্য ধাতের মানুষ। দেশভাগের পর সর্বস্ব খুইয়ে এপারে চলে এসেছিলেন। কপর্দকশূন্য। প্রথম জীবনে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কটা বছর ভালো করে খাওয়া পর্যন্ত জোটেনি। কিন্তু জেদ ছিল অদম্য, লক্ষ্য অভ্রান্ত। যেভাবে হোক, দাঁড়াতেই হবে। এই কলকাতা শহরে কত মানুষ রাস্তা থেকে উঠে এসে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছে। তিনিই বা পারবেন না কেন? বিপুল পরিশ্রমে ধীরে ধীরে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করে নিয়েছেন। এখন তাঁর বিরাট ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, গাড়ি বাড়ি। ব্যবসাতে লাখ-লাখ টাকা খাটছে। কিন্তু অতীত ভোলেননি। তার দুই মেয়ে–স্বর্ণালী আর তার দিদি সুদীপ্তা। তিনি চান না, মেয়েরা সারাক্ষণ আরামে ডুবে থাকুক। একটু কষ্ট করতে শিখুক ওরা। তাই স্বর্ণালীর স্কুলে বা সুদীপ্তার কলেজে তিনি গাড়ি পাঠান না। ট্রামে-বাসেই গাদানো ভিড়ে ওদের যাতায়াত করতে হয়। এই নিয়ে দুই বোনেরই কোনও ক্ষোভ নেই। নিজেদের গাড়ি এলে হুস করে বাড়ি পৌঁছে যাবে। এখন বরং বন্ধুদের সঙ্গে অনেকটা বেশি সময় কাটানো যায়।
গলিতে ঢুকে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বারবার শিঞ্জিনীর দিকে তাকাচ্ছিল স্বর্ণালী। চোখাচোখি হলেই মুখ অন্য দিকে সরিয়ে নিচ্ছে সে।
শিঞ্জিনীর কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। এতক্ষণ সমানে কলকল করছিল স্বর্ণালী। গরমের ছুটিতে কী কী করেছে, কোথায় কোথায় গেছে, কোন কোন আত্মীয়স্বজন তাদের বাড়িতে এসেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর হঠাৎ চুপ করে গিয়ে তাকে দেখছে। দেখেই যাচ্ছে। এভাবে তার তাকানোর কারণ কী?
কী ভেবে শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, তুই কি আমাকে কিছু বলবি?
একটু দ্বিধান্বিত দেখাল স্বর্ণালীকে। তারপর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
আর কোনও প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করতে লাগল শিঞ্জিনী।
ওরা বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। বাসস্ট্যান্ডের গা ঘেঁষে যে শেডটা, তার তলায় মোটামুটি ভিড় রয়েছে। শেডের দিকে না গিয়ে স্বর্ণালী শিঞ্জিনীকে নিয়ে খানিক দূরে একটা বড় বাড়ির ঝুল বারান্দার নীচে এসে দাঁড়াল। এখানে অন্য লোকজন নেই।
শিঞ্জিনী বেশ অবাক হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে কিছুটা উদ্বিগ্নও ক্লাস ফাইভ থেকে একই স্কুলে, একই ক্লাসে তারা পড়ছে। স্বর্ণালী তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আগে কখনও তো এমনটা করেনি।
স্বর্ণালী বলল, তুই যদি কিছু মনে না করিস, কথাটা বলব।
মনে করার মতো কি কিছু?
ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে তোর কিন্তু জানা দরকার।
তা হলে তো শুনতেই হয়।
গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে স্বর্ণালী বলল, তুই তো জানিস, আমার বাবা নাটক দেখতে ভীষণ ভালোবাসে।
স্বর্ণালী ছাড়া অন্য কোনও বন্ধুর বাড়িতে একেবারেই যায় না শিঞ্জিনী। ওর বাবা দেবকুমার আঙ্কল তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। নাটকপাগল মানুষ। গ্রুপ থিয়েটারের ভালো নাটক থাকলে, যত ব্যস্ততাই থাক, সময় বার করে বাড়ির সবাইকে নিয়ে দেখতে ছুটবেনই। একাডেমি কি শিশির মঞ্চে।
শিঞ্জিনী বলল, জানি– সে ভেবে পেল না, দেবকুমার আঙ্কলের নাটক দেখার মধ্যে এমন কী আছে যা তার মন খারাপ করে দিতে পারে!
স্বর্ণালী বলল, এবার গরমের ছুটি পড়ার দিন সাতেক পর বাবা আমাকে, দিদিকে আর মাকে নিয়ে একাডেমিতে একটা নাটক দেখতে গিয়েছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল, আমরা যে রোটায় বসেছি তার উলটো দিকের রোয়ের একেবারে শেষে মৃদুলা আন্টি আর এক ভদ্রলোক পাশাপাশি বসে আছেন। তখনও নাটক শুরু হয়নি। হল-এ আলো জ্বলছিল। ভাবলাম আন্টির সঙ্গে কথা বলে আসি। কিন্তু শেষ না করে সে চুপ করে গেল।
মৃদুলা শিঞ্জিনীর মায়ের নাম। সে জিগ্যেস করল, কিন্তু কী?
স্বর্ণালী বলে, আন্টি পাশের ভদ্রলোকটির সঙ্গে হেসে হেসে খুব গল্প করছিল। আমি গেলে ওদের ডিসটার্ব করা হত। তাই যাইনি।
মৃদুলা নাটক দেখতে গেছে, এটাই চমকে দেবার মতো খবর। শিঞ্জিনী আঠাবোয় পা দিয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছরে কোনওদিন মনে হয়নি, নাটক সম্পর্কে মায়ের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে। কখনও তার মুখে কোনও নাটকের নামও শোনেনি শিঞ্জিনী। তবে সিনেমা খুব দেখে মৃদুলা। হল-এ গিয়ে নয়, বাড়িতে বসে; রাত্তিরে টিভি চালিয়ে। বাংলা হিন্দি বা ইংরেজি, সব রকমের ছবি। সেই মা রাতারাতি নাটকের এমন সমঝদার হয়ে উঠল যে একাডেমিতে ছুটেছে। সেন্টিমেন্টে বোঝাই, সস্তা, প্যানপেনে বাংলা ড্রামা নয়। গ্রুপ থিয়েটারের খটমট, জটিল নাটকের অনুরাগিণী! আশ্চর্য!
মা কখনও তার কাছে কিছু লুকোয় না। সারাদিন অফিসে কী করেছে, সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কোন বিষয়ে তার মতে মেলেনি, সহকর্মীদের মধ্যে যারা একটু ফাজিল তারা কী ধরনের মজা করেছে–সব শিঞ্জিনীকে বলা চাই। কিন্তু এই নাটক দেখার ব্যাপারটা একদম গোপন করে গেছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার মায়ের ওই সঙ্গীটি। মনের প্রান্তসীমায় মেঘ জমতে থাকে শিঞ্জিনীর।
তিন-চার মাস ধরে মায়ের কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে। আগে অফিস ছুটি হলে এক মুহূর্তও বাইরে সময় নষ্ট করত না মৃদুলা। চার্টার্ড বাসে পার্ক স্ট্রিট থেকে বাড়ি আসতে ঘন্টাখানেক। ছটার ভেতর পৌঁছে যেত। ট্র্যাফিক জ্যাম থাকলে আরও তিরিশ-চল্লিশ মিনিট বেশি লাগত। সাতটার পর বাড়ি ফিরেছে, এমনটা কখনও হয়নি। কিন্তু গত তিন-চার মাস ফিরতে ফিরতে নটা, সাড়ে নটাও হয়ে যাচ্ছে। জিগ্যেস করলে বলে, অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। ওভারটাইম খাটতে হচ্ছে।
মায়ের দেরি করে ফেরার সঙ্গে ওই ভদ্রলোকটির কি কোনও সম্পর্ক আছে? শিঞ্জিনীর বুকের ভেতর ধারালো শালার মতো কী যেন বিধে যায়।
স্বর্ণালী বলল, আন্টি আর ওই ভদ্রলোককে এই ছুটিতে আমি আরও দুজায়গায় দেখেছি।
শিঞ্জিনী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। চমকে উঠে বলল, কোথায় কোথায়?
স্বর্ণালী জানায়, বাবার সঙ্গে তারা সবাই একদিন সন্ধেবেলায় নামকরা একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিল। সেখানে মৃদুলাদের দেখেছে। অন্য একদিন এয়ার-কন্ডিশনড মার্কেটে।
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না। দমবন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
স্বর্ণালী এবার বলে, তিনবারই একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়েছে। যেভাবে আন্টিরা হাসছিল, কথা বলছিল, মনে হয়েছে দুজনে খুব ইন্টিমেট।
সেই শলাটা বুকের গভীরে আরও অনেকটা ঢুকে যায়। অদ্ভুত এক কষ্ট বুক থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
স্বর্ণালী বন্ধুর দিকে সামান্য ঝুঁকে জিগ্যেস করে, তুই চিনিস ভদ্রলোককে?
গলার কাছে লোহার বলের মতো কী যেন আটকে আটকে যাচ্ছে। কোনওরকমে শিঞ্জিনী বলল, কীরকম দেখতে বল তো?
স্বর্ণালী প্রায় নিখুঁত একটা বর্ণনা দিল। মৃদুলার সঙ্গীটি রীতিমতো সুপুরুষ। বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। টান টান শরীর। রং বাদামি। হাইট বেশ ভালো। ছফিটের আশেপাশে। চওড়া বুক, মজবুত কবজি। জুলপিতে সামান্য পাক ধরেছে। চুল ব্যাক ব্রাশ করা। সরু শৌখিন গোঁফ। পরনে দামি সাফারি স্যুট। চোখে রিমলেস চশমা।
শিঞ্জিনী ভেবে পেল না, লোকটা কে হতে পারে। তাদের কোনও আত্মীয়স্বজন? নাকি পারিবারিক কোনও বন্ধু? কিন্তু কবছর ধরেই আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধনগুলো ভীষণ আলগা হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধবরা কবেই তাদের বাড়ি যাওয়া-আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে কি মায়ের কোনও কলিগ? মৃদুলার সহকর্মীদের অনেককেই চেনে শিঞ্জিনী। ফি বছর অফিসের অ্যানুয়াল ফাংশানে মা তাকে নিয়ে যায়। সেখানেই তার এই কলিগদের সঙ্গে শিঞ্জিনীর আলাপ হয়েছে। ওদেরই কি কেউ? আকাশ-পাতাল হাতড়েও স্বর্ণালীর বর্ণনার সঙ্গে তাদের কারও চেহারার মিল খুঁজে পেল না সে।
অবশ্য মায়ের সব সহকর্মীকেই যে শিঞ্জিনী চেনে, তা নয়। লোকটা কি ওই অপরিচিতদের মধ্যে পড়ে?
স্বর্ণালীর চোখ শিঞ্জিনীর মুখের ওপর স্থির হয়ে ছিল। সে বলে, কী রে, চিনতে পারলি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী, না। একটু থেমে জিগ্যেস করে, আর কিছু বলবি?
না।
চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সাড়ে পাঁচটার ভেতর বাড়ি না ফিরলে দাদু অস্থির হয়ে উঠবে।
গল্ফ গ্রিনের একটা মিনিবাস পেয়ে দুজনে উঠে পড়ল। মোটামুটি ফঁকা। বসার জায়গাও পাওয়া গেল। জানালার ধারে বসেছে শিঞ্জিনী। পাশে স্বর্ণালী।
শিঞ্জিনীর মুখ জানালার বাইরে ফেরানো। উলটোদিক থেকে সাঁ, সাঁ, ছুটে আসছে বাস, ট্যাক্সি, জিপ, ভ্যান, নানা ধরনের ঝকঝকে প্রাইভেট কার। ওধারের উঁচু উঁচু বাড়িগুলো ছিটকে ছিটকে পিছিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। চারদিক থেকে গাড়ির শব্দ, মানুষের কোলাহল উঠে আসছে।
শিঞ্জিনী কিছুই দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিল না। সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা। যেন এক আধ-চেনা অবাস্তব শহরের মাঝখান দিয়ে সে চলেছে। যার সঙ্গে তার আদৌ যোগ নেই। আসলে সেই চিন্তাটা অদৃশ্য পোকার মতো মাথায় হুল ফুটিয়ে চলেছে। বিরতিহীন।
শিঞ্জিনী নিজেকে প্রাণপণে বোঝাতে চাইল, মা যদি কারও সঙ্গে হঠাৎ একদিন থিয়েটার দেখতে গিয়েই থাকে, মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খান খান হয়ে মাথার ওপর ভেঙেও পড়বে না। পরক্ষণে মনে হয়, যুক্তিগুলো বড় পলকা, ভঙ্গুর। একদিন না হয় একাডেমিতে গেছে, কিন্তু তার পরও একই লোকের সঙ্গে তাকে আরও নানা জায়গায় দেখা যাবে কেন?
এটা তো পরিষ্কার, দুজনের মধ্যে চোখে পড়ার মতো যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তা স্বর্ণালীর চোখ এড়ায়নি। একজন অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে একজন মহিলার পরিচয় হতেই পারে। তাদের মধ্যে সাধারণ ভদ্রতার সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারে। তেমন শোভন ব্যাপার মা আর ওই লোকটার ভেতর যদি থাকত, স্বর্ণালী নিশ্চয়ই তাকে এত কথা বলত না।
এই লোকটা সম্পর্কে মায়ের কেন এমন গোপনীয়তা? বুকের ভেতরটা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠতে থাকে শিঞ্জিনীর।
স্বর্ণালী বন্ধুর দিক থেকে লহমার জন্যও চোখ ফেরায়নি। অস্বস্তি বোধ করছিল সে। যথেষ্ট অপ্রস্তুতও। নীচু গলার ডাকল, এই রূপা–
শিঞ্জিনীর ডাকনাম রূপা। স্বর্ণালীর ডোনা। দুজনে ছেলেবেলার বন্ধু। পরস্পরকে তারা ডাকনামেই ডেকে থাকে।
শিঞ্জিনী দুরমনস্কর মতো সাড়া দেয়, কী বলছিস?
আমার দিকে তাকা–
শিঞ্জিনীর মুখ ফেরায়। স্বর্ণালী বলে, আমার হয়তো দেখার ভুল হয়েছে। কী বলতে কী বলে ফেলেছি। তুই এই নিয়ে আন্টিকে কিন্তু কিছু বলিস না। ফরগেট ইট।
স্বর্ণালী খুব সিরিয়াস মেয়ে। আলগা কোনও মন্তব্য করে না। ঠিকমতো না জেনে, না বুঝে আলটপকা কিছু বলে বসে না। শিঞ্জিনী বুঝতে পারছে, তার মন খারাপ দেখে ব্যাপারটা লঘু করে দিতে চাইছে স্বর্ণালী। সে উত্তর দিল না।
স্বর্ণালী উতলা হল, কী রে কিছু বললি না যে?
কী বলব?
ওই যে আন্টিকে জানাতে বারণ করলাম।
ওটা এমনই এক প্রসঙ্গ, অপ্রিয় এবং অস্বস্তিকর, মায়ের সামনে কোনও মেয়ের পক্ষে উত্থাপন করা অসম্ভব। বরং কিছু দিন অপেক্ষা করে মায়ের মতিগতির দিকে লক্ষ্য রাখা যাক। তারপর কী করবে বা করা উচিত, এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ নীরব থেকে শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে, জানাব না।
প্রমিস?
শিঞ্জিনী যান্ত্রিক সুরে বলল, প্রমিস।
গোলপার্কে স্বর্ণালী নেমে গেল। আবার মিনিবাসের দৌড় শুরু হয়েছে। দুধারের দৃশ্যাবলি কিছুক্ষণ আগের মতোই ফের ঝাপসা। চতুর্দিকের শব্দপুঞ্জ কান ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, ভেতরে প্রবেশ করছে না।
শিঞ্জিনী একতাল তলতলে মোম নয় যে একটুতেই গলে যাবে। কিংবা শো-কেসে সাজানো ঠুনকো বাহারি পুতুল নয় যে টোকা দিলেই ভেঙে শতখান হবে। তার বন্ধুদের, বা তার বয়সি অন্য দশটা মেয়ের থেকে সে আলাদা। অল্প বয়সের কথা তেমন মনে নেই। জ্ঞান হবার পর থেকে এলোপাতাড়ি ঘা খেতে খেতে সে বড় হয়ে উঠেছে। একের পর এক আঘাত। সবই মনের ওপর। সে যে কী নিদারুণ যাতনা।
এই তো সেদিন কৈশোর পেরুল। কিন্তু এই বয়সেই তার সবটুকু কমনীয়তা কেউ যেন নিঙড়ে বার করে নিয়েছে। ভেতরটা তার রীতিমতো রুক্ষ। কঠিন। সহজে সে কাতর হয় না।
কিন্তু স্বর্ণালী আজ যে খবরটা দিল তাতে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে। মা-ই তার সব। মাকে ঘিরেই তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড! পরস্পরকে জড়িয়ে বেশ তো ছিল তারা। হঠাৎ কোত্থেকে অচেনা ওই লোকটা তার আর মৃদুলার মাঝখানে এসে যে জুড়ে বসল।
নিজের অজান্তে শিঞ্জিনীর দুচোখ বাষ্পে ভরে যেতে থাকে।
.
০২.
কনডাক্টরের হাঁকডাকে হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে শিঞ্জিনীর। মিনিবাস তাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে থেমেছে।
টের পায়নি, কখন যেন চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গালে গড়িয়ে এসেছিল। মিনিবাসে এত মানুষের ভেতর সে কেঁদেছে। একটু লজ্জা পেল শিঞ্জিনী। দ্রুত রুমাল দিয়ে চোখ মুছে চারদিকে তাকাল। না, কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি।
বাসে উঠে স্কুলব্যাগটা কোলে নামিয়ে রেখেছিল। সেটা ফের পিঠে ঝুলিয়ে নানা বয়সের পাঁচ-ছটি পুরুষ এবং মহিলার সঙ্গে নেমে এল শিঞ্জিনী।
বাসরাস্তার উলটো দিকে, কোনাকুনি যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, ওটার প্রায় শেষ মাথায় তাদের বাড়ি। কবছরে জায়গাটা পুরোপুরি বদলে গেছে। ছেলেবেলায় এখানে কটাই বা বাড়ি-টাড়ি দেখেছে! কিছু কিছু একতলা কি দোতলা। সেগুলো পুরোনো, দেওয়ালে শ্যাওলার পুরু ছোপ, কার্নিস ভাঙা। টিন বা টালির চাপ-বাঁধা বস্তিই বেশি। প্রচুর ফাঁকা জায়গা। সেখানে খাড়া খাড়া তাল গাছ, বেঁটে বেঁটে খেজুর। বেশ কটা আঁশফলের বাগান। ঝোঁপঝাড়। প্রায় সারাদিনই ঝিঁঝির ডাক। তক্ষকের ডাক। রাতের দিকে গম্ভীর, কর্কশ গলায় পেঁচারা ডেকে যেত।
আচমকা প্রোমোটারদের নজর এসে পড়ল জায়গাটার ওপর। লহমায় বস্তি উধাও। বেশিরভাগ পুরোনো পাকা বাড়ি উধাও। ফাঁকা মাঠ উধাও। আঁশফলের বাগান উধাও। পানাপুকুরগুলো ঝটিতি বুজিয়ে ফেলা হল। একের পর এক উঠতে লাগল হাইরাইজ। সেগুলো ডানা মেলে আকাশ ছুঁতে চায়। কী সব আর্কিটেকচার! যেদিকেই তাকানো যাক, চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
কয়েকটা সেকেলে বাড়ি এখনও কোনওরকমে টিকে আছে। তবে আয়ু আর কদিন? এক বছর, দুবছর, তিন বছর। তারপরেই ওগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে মাথা তুলবে আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং।
তাদের রাস্তাটার ভোলও পালটে গেছে। কবছর আগেও ছিল খানাখন্দে বোঝাই। এখন দশ ইঞ্চি অ্যাসফাল্টে মোড়া। মসৃণ পথের ওপর দিয়ে ঝকঝকে নতুন মডেলের গাড়িগুলো যেন উড়তে থাকে।
সমস্ত তল্লাট জুড়ে তখন সারাদিন কেমন একটা ঝিমুনিভাব। নির্জীব আলস্য গায়ে জড়িয়ে নিঝুম পড়ে থাকত জায়গাটা। এখন সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চারদিক সরগরম।
বড় রাস্তা পেরিয়ে ওপারে চলে এল শিঞ্জিনী। কোনাকুনি রাস্তাটার মোড়ে সাইকেল রিকশার জটলা। সেটার গায়ে পাড়ার একটা ক্লাব। তরুণ সমিতি। আগে ছিল টিনের চালা। এখন প্রোমোটারদের কাছ থেকে জবরদস্তি টাকা আদায় করে বেশ বড় একতলা বাড়ি তোলা হয়েছে।
সমিতির কটা ছেলে, চোয়াড়ে চেহারা, পঁচিশ-ছব্বিশের মতো বয়স, ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে হই হই করে গজল্লা করছিল। ক্লাবটা ওদের স্থায়ী গুলতানির আখড়া। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস, যখনই এ পথে আসা যাক, ক্লাবের সামনে ওদের পাওয়া যাবেই।
শিঞ্জিনী ক্লাবের পাশ দিয়ে এগিয়ে যায়। ওকে দেখে ছোকরাগুলোর হল্লা থেমে গিয়েছিল। ওদের দিকে কখনও তাকায় না সে, আজও তাকাল না। তবু হাঁটতে হাঁটতে টের পেল, পাঁচ-ছজোড়া চোখ তার পিঠে ফলার মতো বিধছে। আগে অস্বস্তি হত, ভীষণ ভয় লাগত। এখন আর সে গ্রাহ্য করে না।
শুধু ওরাই কি, রাস্তায় বেরুলেই অসংখ্য চোখ তাকে গিলতে থাকে। এমনকী, বন্ধুদের বাড়ি গেলেও নিস্তার নেই। ওদের দাদাদের, কাকাদের কিংবা অন্য আত্মীয়দের তার সম্পর্কে একটু বেশি রকমের উৎসাহ। গেলে সারাক্ষণ তার সঙ্গে লেপটে থাকতে চায়। কারও কারও বাবা পর্যন্ত আদরের ছলে গায়ে-মাথায় এমনভাবে হাত বুলোয় যে শরীর কুঁকড়ে যায়। কোনটা আদর, কোনটা স্নেহ, আর কোনটা এসবের বাইরে অন্য কিছু, তা না-বোঝার মতো নাবালিকা শিঞ্জিনী নয়। তার চোখে এই লোকগুলোর মুখ আর মানুষের মুখ থাকে না, জন্তুর মুখ হয়ে যায়। আর এই জন্তুদের লকলকে জিভ থেকে সর্বক্ষণ লালা ঝরতে থাকে।
স্বর্ণালীদের বাড়িটাই একমাত্র জায়গা যেখানে সে নির্ভয়ে যেতে পারে। ওখানে কেউ তাকে উত্যক্ত করবে না। দেবকুমার আঙ্কল চমৎকার মানুষ। সহৃদয়। স্নেহপ্রবণ। স্বর্ণালীর মা অনুপমা আন্টি, ওর দিদি সুদীপ্তাও তা-ই। নিজের বাবাকে নিয়ে শিঞ্জিনীর বিরাট একটা দুঃখ আছে। সে জন্য তার প্রতি স্বর্ণালীদের অপার সহানুভূতি। ওদের বাড়িতে গেলে তার গোপন যন্ত্রণা অনেকখানি জুড়িয়ে যায়। তাই সময় পেলেই সে ওদের কাছে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসে।
লম্বা রাস্তাটা ফুরিয়ে এসেছিল। শিঞ্জিনী বাড়িতে পৌঁছে গেল।
অনেকখানি জায়গার মাঝখানে ওদের বুড়োটে, সেকেলে বাড়িটা নেহাতই সাদামাটা। ছিরিছাঁদহীন। কবছর আগে গোলাপি রং করা হয়েছিল। বর্ষার জলে ধুয়ে ধুয়ে রংটা ফিকে হয়ে গেছে। চারদিকের সীমানা ভাঙাচোরা বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা।
রাস্তার দিকে কাঠের গেট। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকলে ফুলের বাগান। পরিচর্যার অভাবে ফুলগাছগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে আছে। বাড়ির পেছন দিকে দু-চারটে ফলের গাছ। পেয়ারা, নারকেল, বাতাবি আর গন্ধরাজ লেবু। বাকি সবই আগাছা।
বাগান পেরিয়ে কলিংবেল টিপতেই মালতী দরজা খুলে দিল।
মালতী শিঞ্জিনীদের কাজের মেয়ে। বয়স চল্লিশের আশে-পাশে। পেটানো, মজবুত স্বাস্থ্য। চেহারায় শক্ত, পুরুষালী ভাব। চৌকো মুখ। খর চোখ। কপালের মাঝখানে মস্ত সিঁদুরের টিপ। সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর।
অনেক আগেই পাঁড় মাতাল, রগচটা স্বামীর সঙ্গে মালতীর কাটান ছাড়ান হয়ে গেছে। তবু বিলুপ্ত দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কেন যে সে সিঁদুরটা ধারণ করে, সেই জানে।
মালতী সকালে শিঞ্জিনীদের বাড়িতে আসে। রান্নাবান্না, কাপড়-কাঁচা, ঘর ধোয়া-মোছা থেকে সারাদিন যাবতীয় কাজকর্ম দশভুজা হয়ে সামলায়। সন্ধের পর রাতের রুটি-তরকারি, মাংস-টাংস বেঁধে নিজের খাবার বেঁধে নিয়ে চলে যায়। ওরা থাকে বেশ খানিকটা দূরে, একটা বড় গোরস্থানের পাশের বস্তিতে। সেখানে তার সঙ্গে থাকে তার একমাত্র ছেলে আর ছেলের বউ। ছেলে রিকশা চালায়।
মালতী বলল, কী গো রূপাদিদি, তোমার আজ এত দেরি যে? দাদু কতবার যে তোমার কথা বলেছে?
এটাই ভেবেছিল শিঞ্জিনী। মালতীর পাশ দিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলল, আমি আগে দাদুর কাছে যাচ্ছি। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও।
এ-বাড়িতে সবসুদ্ধ ছখানা ঘর। একতলায় তিনটে। দোতলাতেও তা-ই। নীচের তলার দুটো ঘরে রান্না এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। বাকিটায় রাজ্যের অকেজো বাতিল জিনিসের পাহাড়।
দোতলায় একটা ঘর মৃদুলার, একটা শিঞ্জিনীর, একটা তার দাদু ইন্দ্রনাথের। ইন্দ্রনাথ তার দাদামশায়। মা তার একমাত্র সন্তান।
ত্বরিত পায়ে সিঁড়ি টপকে টপকে ওপরে উঠে এল শিঞ্জিনী। বাইরের প্যাসেজে জুতো খুলে ইন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকল।
দাদুর ঘরটা বেশ বড়। পনেরো ফিট বাই কুড়ি ফিট। মাঝখানে পেল্লায় ভারী খাট। নকশাদার ছত্রির মাথায় আধময়লা মশারি গুটিয়ে রাখা হয়েছে।
দেওয়াল ঘেঁষে তিনটে ঢাউস আলমারি। একটা মস্ত ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল। কটা বেতের মোড়া। সব সেকেলে ডিজাইনের আসবাব। পালিশ উঠে উঠে কবেই ভেতরকার কাঠ বেরিয়ে পড়েছে। সিলিং থেকে চার ব্লেডের আদ্যিকালের একটা ফ্যান ঝুলছে। ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ তুলে ওটা আস্তে আস্তে ঘুরে চলেছে। ভালো মালমশলা দিয়ে তৈরি, তাই এখনও নিষ্ঠাভরে সারভিস দিয়ে যাচ্ছে। দুই দেওয়ালে মোটা মোটা শিক বসানো জোড়া জানালা। সেগুলোর পাল্লা খোলা রয়েছে।
খাটের মধ্যিখানে ফ্যানের তলায় উঁচু উঁচু দুটো বালিশে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে আছেন ইন্দ্রনাথ। তাঁর দুপাশে দুটো কোলবালিশ। মাথার দিকে একটা মাঝারি টেবলে ডাঁই-করা ওষুধ। হার্টের সুগারের। রক্তচাপের। এবং আরও নানা রোগের। আর আছে রামায়ণ এবং মহাভারত। মূল সংস্কৃত থেকে রাজশেখর বসুর চমৎকার অনুবাদ। একটা টেলিফোনও রয়েছে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে এই যন্ত্রটা দিয়েই তার যেটুকু যোগাযোগ।
ইন্দ্রনাথের চোখ দুটো বোজা। পরনে হাফহাতা পাতলা পাঞ্জাবি এবং পাজামা। শিঞ্জিনীর পায়ের শব্দ তার কানে যায়নি।
ঘুমোচ্ছন কি? তাকে জাগানো ঠিক হবে? একটু ইতস্তত করল শিঞ্জিনী। তারপর নীচু গলায় ডাকল, দাদু
এক ডাকেই চোখ মেললেন ইন্দ্রনাথ। নাতনিকে দেখে দুই কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইলেন।
শিঞ্জিনী ব্যস্তভাবে বলে উঠল, উঠো না, উঠো না। শুয়ে থাকো
নাতনির আপত্তি কানে তুললেন না ইন্দ্রনাথ। রীতিমতো কষ্ট করেই পিঠে বালিশ রেখে খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বসলেন। এই সামান্য পরিশ্রমেই হাঁফ ধরে গিয়েছিল। জোরে জোরে শ্বাস টেনে খানিকটা ধাতস্থ হলেন।
রং মাটি খসে গেলে প্রতিমার যে কাঠামোটা পড়ে থাকে, ইন্দ্রনাথ অবিকল তা-ই। শীর্ণ, নিজীব। হাড়ের ওপর খোলসের মতো ঢিলে চামড়া জড়ানো। মুখটা শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। সারা শরীর জুড়ে অজস্র ভাঙচুর। চোখের তলায় কালি। মাংস ঝরে যাওয়ায় চোখ থুতনি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।
বছর দুয়েক আগে একটা বড় রকমের স্ট্রোক হয়েছিল। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। তারপরই সেরিব্রালের ছোবলে বাঁ দিকটা অসাড় হয়ে যায়। তারপর শয়ে শয়ে ট্যাবলেট, ইঞ্জেকশন। নিয়মিত ই সি জি। টি এম টি। করোনারি এনজিওগ্রাফি। ডাক্তার। আয়া। অবিরাম শুশ্রূষা। ইন্দ্রনাথের শিয়রে বসে মৃদুলা আর শিঞ্জিনীর রাত জাগা। এমনি কত কী। আশা ছিল না, নেহাত আয়ুর জোরে টিকে গেলেন ইন্দ্রনাথ। পক্ষাঘাতে অবশ দিকটাকে সচল, সক্রিয় করার জন্য কী করা হয়েছে।
অ্যাটাকের ধাক্কা খানিকটা সামলানোর পর ফিজিওথেরাপিস্ট ডাকা হয়েছিল। প্রথমদিকে রোজ এসে সে ম্যাসাজ এবং এক্সারসাইজ করাত ইন্দ্রনাথকে। এখন সপ্তাহে তিন দিন করাচ্ছে। মাস দুয়েক হল সাড় অনেকটাই ফিরে এসেছে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত ভালোই নাড়াতে পারেন ইন্দ্রনাথ। ধরে ধরে দুবেলা কয়েক মিনিট করে তাঁকে হাঁটানোও হয়। আর কিছুদিন পর অন্যের সাহায্য ছাড়াই খুব সম্ভব হাঁটতে পারবেন। অবশ্যই ঘরের মধ্যে। বাড়ির বাইরে ডাক্তাররা কবে বেরুতে দেবেন, কে জানে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, স্কুল ড্রেস এখনও ছাড়োনি দেখছি। সোজা আমার ঘরে চলে এসেছ বুঝি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী।
ইন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক আছে, দুমিনিট বসে যাও। পরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিও। আঙুল বাড়িয়ে খাটের একটা কোনা দেখিয়ে দিলেন।
রুগ্ণ, অশক্ত, তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাওয়া এই মানুষটির মধ্যে কোথায় যেন ব্যক্তিত্বের সামান্য একটু তলানি এখনও পড়ে আছে। তার অনুরোধ বা হুকুম কিছুই অমান্য করা যায় না। পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে জড়সড় হয়ে বসল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ এবার কী বলবেন, সেটা তার জানা। কঁচুমাচু মুখে বলল, ছুটির পর বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। অনেকক্ষণ বাদে মিনিবাস এল। সবগুলো ক্রসিংয়ে ভীষণ জ্যাম। তাই বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। স্বর্ণালীর কথা শুনতে শুনতে খানিকটা সময় নষ্ট হয়েছে তা তো আর দাদুকে বলা যায় না।
নিস্তেজ চোখে কয়েক লহমা নাতনির দিকে তাকিয়ে রইলেন ইন্দ্রনাথ। বললেন, তুমি যতক্ষণ না ফিরে আসো, আমার কী উৎকণ্ঠা যে হয়। সেটা কি তুমি বোঝ?
রোজই তো ঠিক সময়ে ফিরে আসি। যেদিন যেদিন কোচিং ক্লাসে যাই, ফিরতে দেরি হয়। রাস্তায় জ্যাম হলে আমি কী করতে পারি?
জ্যামের দোহাই দিতে হবে না। খবরের কাগজে পড়ি, পরিবেশ ভীষণ নোংরা হয়ে গেছে। তোমাদের বয়সি মেয়েদের পদে পদে বিপদ।
ইন্দ্রনাথ কি তার কথা বিশ্বাস করেননি? একটু জোর দিয়ে শিঞ্জিনী বলল, তুমি তো বাড়ি থেকে বেরোও না। কলকাতার ট্রাফিকের কী অবস্থা হয়েছে, তোমার ধারণা নেই।
ইন্দ্রনাথ বললেন, আচ্ছা আচ্ছা। এখন গিয়ে হাতমুখ ধোও। কিছু খেয়ে রেস্ট নাও। পরে তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শিঞ্জিনী বলল, কী কথা?
তাড়াহুড়োর কিছু নেই। মালতাঁকে দিয়ে তোমাকে ডাকিয়ে আনব। তখন শুনো।
দোতলায় পাশাপাশি তিনটে ঘর। সামনে দিয়ে রেলিং-ঘেরা টানা বারান্দা চলে গেছে।
শিঞ্জিনীর ঘরটা বারান্দার শেষ মাথায়। ইন্দ্রনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে জুতোজোড়া ফের পায়ে গলিয়ে সেখানে চলে এল সে।
একধারে সিঙ্গল-বেড় খাটে ধবধবে, নিভাজ বিছানা! আরেক পাশে লেখাপড়ার জন্য টেবল-চেয়ার। জামাকাপড়ের একটা আলমারি। বইরের র্যাক। মাথার ওপর মান্ধাতা আমলের সেই চার ব্লেডওলা ফ্যান।
স্কুলের জুতোমোজা খুলে দেওয়ালের গা ঘেঁষে রেখে দিল শিঞ্জিনী। বইয়ের ব্যাগটা রাখল পড়ার টেবলে। আলমারি থেকে লম্বাঝল স্কার্ট আর ঢোল্লা জামা বার করে চানঘরে ঢুকে গেল। সেকেলে বাড়ি হলেও দোতলার প্রতিটি বেডরুমেই অ্যাটাচড বাথ।
মিনিট পনেরো বাদে স্নান সেরে পোশাক পালটে চানঘর থেকে শিঞ্জিনী যখন বেরিয়ে এল, নিজেকে অনেকখানি তাজা লাগছে। বছরের এই সময়টা দিনের বেলা ভ্যাপসা গরমে গায়ের চামড়া যেন সেদ্ধ হয়ে যায়। স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার স্নান না করতে পারলে ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে।
তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মাথা মুছে, চুলে বারকয়েক চিরুনি টেনে, ফ্যান চালিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল শিঞ্জিনী। তার মাথায় দিকে মস্ত জোড়া জানালা। ডান ধারের দেওয়ালেও অবিকল তেমনই আরেক জোড়া।
কিছুক্ষণ চোখের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি রেখে চুপচাপ পড়ে রইল শিঞ্জিনী। তারপর বুকে বালিশ চেপে মাথার দিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তাদের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের পর খানিকটা পোতো জমি। নানা ধরনের ঝোঁপঝাড় আগাছায় বোঝাই। এই জমিটার গা ঘেঁষে কচুরিপানায় ঠাসা বেশ বড় একটা জলা। ওগুলো এই অঞ্চলের এক সময়ের জমিদার সরকার-বাবুদের। সরকারদের কাউকে কোনওদিন চোখে দেখেনি শিঞ্জিনী। সে শুনেছে ওই ফাঁকা জমি আর জলা নিয়ে বহুদিন ধরে মামলা চলছে।
জলার ওধারে চার-পাঁচটা উঁচু উঁচু নতুন বাড়ি উঠেছে। আরও কয়েকটার কাজ চলেছে। কবছরে ডানধারেও ছ-সাতটা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে।
যেভাবে একের পর এক স্কাইস্ক্রেপার হচ্ছে তাতে কঁকা জমি বলতে এই এলাকায় কিছু থাকবে না।
নেহাত মামলা চলছে, তাই শিয়রের দিকের মাঠ আর জলাটা টিকে আছে। নইলে কবেই হাইরাইজে হাইরাইজে ছেয়ে যেত। আকাশ দেখা যেত না। ওদিক থেকে হুহু করে যে হাওয়া আসে তাও বন্ধ হয়ে যেত। শিঞ্জিনী আগে অনেকবার ভেবেছে, সরকারদের মামলাটা চিরকাল চলুক। তাদের বাড়ির ওধারটা বরাবর ফাঁকা থাকুক।
স্কুল ছুটির পর শিঞ্জিনীর চোখে পড়েছিল, পশ্চিম আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সেই মেঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
মেঘ, অদূরে ফাঁকা জমি, জলা, বা বড় বড় আকাশছোঁয়া বাড়ি-কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না শিঞ্জিনী। সেই চিন্তাটা তার মাথায় আবার ফিরে এসেছে। মায়ের সঙ্গী ওই লোকটি কে? তার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক কতখানি গভীর? নতুন করে পরিচিত লোকজনদের মুখ ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু না, স্বর্ণালীর বর্ণনার সঙ্গে এবার কাউকে মেলানো যাচ্ছে না।
সূর্য ডুবে গেছে। যে বিষণ্ণ আলোটুকু চারপাশে গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, একটানে কেউ যেন সেটা টেনে নিয়েছে। বাইরে আবছা আঁধার নেমে এসেছে। অবশ্য চারপাশের বাড়িগুলোতে হাজার আলো জ্বলে উঠেছে।
খুট করে সুইচ টেপার শব্দ কানে এল। সেই সঙ্গে মালতীর গলা, সন্ধে হয়ে গেল। অমন চুপ করে শুয়ে আছ যে! শরীর খারাপ লাগতেছে?
আলোয় ঘর ভরে গেছে। ধড়মড় করে উঠে বসল শিঞ্জিনী। বলল, এমনি শুয়ে ছিলাম। শরীর ঠিক আছে।
এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করল না মালতী। তার হাতে সাদা প্লেটে দুখানা পরোটা, আলুর তরকারি আর একটা বড় সন্দেশ এবং জলের গেলাস। একটা ছোট নীচু সাইড টেবল শিঞ্জিনীর খাটের কাছে টেনে এনে তার ওপর প্লেট এবং গেলাসটা রেখে বলল, খাও। আমি চা নিয়ে আসছি।
সকালে দুধ খায় শিঞ্জিনী, বিকেলে এক কাপ চা। খিদে পেয়েছিল, প্লেটটা তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল সে। সেই চিন্তাটা কিন্তু চলছেই। নাছোড়বান্দা বিষাক্ত পোকার মতো মাথা ভেতর কামড় দিয়ে বসে আছে।
মিনিট দশেক বাদে মালতী চা নিয়ে এল। বলল, চা খেয়ে দাদুর ঘরে যেও। উনি যেতি বুলেছেন। অনেক বছর কলকাতায় আছে মালতী। কিন্তু তার কথায় এখনও গেঁয়ো টান। দাদুর খবরটা দিয়ে সে চলে গেল।
শিঞ্জিনীর মনে পড়ল, ইন্দ্রনাথ তখন বলছিলেন কী একটা জরুরি কথা বলবেন। কী বলবেন? দেরি করে ফেরার জন্য বকুনি তো দিয়েছেনই। তারপর আর কী বলার থাকতে পারে?
চা খেয়ে ইন্দ্রনাথের ঘরে চলে এল শিঞ্জিনী। দাদু আগের মতোই বিছানায় শুয়ে আছেন। জোরালো আলোয় ঘর ভরে রয়েছে। নিশ্চয়ই মালতী জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে।
পয়সার জন্য খাটতে এসেছে বলে তার কাছে কিন্তু দায়সারা ভাবটা নেই। এ বাড়ির মানুষগুলোকে সত্যিই সে ভালোবাসে। সবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। কখন কী করতে হবে, তাকে বলে দিতে হয় না। নিঃশব্দে নিজের কাজটি সে করে যায়। বেশিরভাগ সময় চোখ বুজে শুয়ে থাকেন ইন্দ্রনাথ। এখন কিন্তু তাকিয়েই আছেন। নাতনির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনকার মতো বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে শিঞ্জিনীকে কাছে বসালেন। কোমল গলায় বললেন, জলখাবার খেয়েছ?
আস্তে মাথা কাত করল শিঞ্জিনী, হ্যাঁ।
দেওয়ালে টাঙানো একটা ওয়াল ক্লকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছটা চল্লিশ। এবার তো পড়তে বসবে।
হ্যাঁ।
তার আগে এক কাজ করো, মাথার কাছের সেই টেবলটা দেখিয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন, আমার ওই ডায়েরিটা দাও তো
ওষুধপত্র, রামায়ণ-মহাভারত এবং টেলিফোনের পাশে ইন্দ্রনাথের একটা নীল মলাটওলা ডায়েরি আর কলমও থাকে। সেটা তুলে এনে তাঁকে দিল শিঞ্জিনী। ইন্দ্রনাথ সরু সরু, রোগা আঙুলে পাতা ওলটাতে লাগলেন।
শিঞ্জিনী জানে, রোজই দু-চার লাইন কী যেন লেখেন ইন্দ্রনাথ। ডায়েরি লেখাটা তার বহুকালের অভ্যাস। অবশ্য তিনি কী লেখেন সে সম্পর্কে শিঞ্জিনীর বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই।
পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক জায়গায় এসে থামলেন ইন্দ্রনাথ। নাতনির হাতে ডায়েরিটা দিয়ে বললেন, এখান থেকে পর পর পাতাগুলো দেখে যাও
শিঞ্জিনী সামান্য উত্তেজনা বোধ করল। নিজের গোপন দিনলিপি যে দাদু পড়তে দেবেন, সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু ডায়েরির পাতার দিকে তাকাতেই তার চক্ষুস্থির। তারিখটা আট এপ্রিল। দাদু লিখেছেন, আজ খুকু অফিস ছুটির পর সাড়ে ছটার মধ্যে বাড়ি আসে নাই। সে ফিরিল আটটা বাজিয়া বত্রিশ মিনিটে। জিজ্ঞাসা করায় বলিল, অফিসে ওভারটাইম চলিতেছে। তাই ফিরিতে দেরি হইয়াছে।
খুকু মৃদুলার ডাকনাম। শিঞ্জিনী পাতার পর পাতা উলটে যেতে লাগল। কোনওদিন মা ফিরেছে পৌনে নটায়, কোনওদিন নটা পাঁচে, কোনওদিন দশটা বেয়াল্লিশে। কবে, কখন ফিরেছে, ইন্দ্রনাথ সমস্ত লক্ষ্য করেছেন এবং তাঁর দিনলিপিতে লিখে রেখেছেন।
শিঞ্জিনীর সারা শরীরে তড়িৎ প্রবাহ খেলে গেল। কোনও কিছুই অসুস্থ, রোগজৰ্জর মানুষটার নজর এড়িয়ে যায় না।
কালকের তারিখ পর্যন্ত দেখার পর ডায়েরিটা বন্ধ করে ধন্ধ-ধরা মানুষের মতো ইন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী। আজকের পাতাটা ফাঁকা। খুব সম্ভব মা ফিরে এলে ঘড়ি দেখে সময়টা লিখে রাখবেন।
শিঞ্জিনীর মনে হয়েছিল, তার সম্বন্ধে হয়তো আরও অভিযোগ আছে দাদুর। কিন্তু দুম করে তিনি যে মায়ের প্রসঙ্গ তুলে বসবেন, ভাবতে পারেনি।
নাতনির হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে পাশে রাখলেন ইন্দ্রনাথ। বললেন, কী বুঝলে রূপাদিদি?
ইন্দ্রনাথ সঠিক কী জানতে চান, বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে শিঞ্জিনী।
ইন্দ্রনাথ বললেন, লক্ষ্য করেছ, এপ্রিল মাসের সেকেন্ড উইক থেকে খুকু সাড়ে আটটার আগে কোনওদিন বাড়ি ফেরেনি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী করেছে।
স্বর্ণালী একদিনই মায়ের নাটক দেখার কথা বলেছিল। হঠাৎই একাডেমিতে ওদের দেখে ফেলেছে। তাছাড়া একদিন দেখেছে হোটেলে আর একদিন মার্কেটে। মা আরও কতদিন ছুটির পর সেই লোকটার সঙ্গে নাটক বা সিনেমা দেখতে গেছে, কিংবা ডিনার খেতে গেছে কোনও হোটেলে, বা বেড়াতে গেছে অন্য কোথাও, স্বর্ণালীর জানার কথা নয়। সে তো সর্বক্ষণ ওদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে নেই। ইভনিং শোয়ে গেলে বা বাইরে রাতের খাওয়া সারলে দশটা সাড়ে-দশটার আগে বাড়ি ফেরা আদৌ সম্ভব নয়।
শিঞ্জিনী নীরবে বসে থাকে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, জিগ্যেস করলে খুকু বলে, অফিসে নাকি ওভারটাইম চলছে
দেরি করে আসার কৈফিয়ৎ হিসেবে একই কথা শিঞ্জিনীকেও বলেছে মৃদুলা। সে উত্তর দেয় না।
ইন্দ্রনাথ এবার বলেন, কাজের বেশি প্রেশার থাকলে অফিসে দু-চার দিন ওভারটাইম হয়। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন? তোমার কী মনে হয়?
শিঞ্জিনী বলে, কী মনে হবে। আমি কি চাকরি করি যে অফিসে কী হয় না-হয় আমি জানব!
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর ইন্দ্রনাথ বলেন, কী এমন বয়স তোমার মায়ের। মাত্র একচল্লিশ। এখনও যথেষ্ট সুশ্রী। যতক্ষণ না ফেরে, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি। মনে হয়, দম আটকে আসছে। তোমাদের দুজনকে নিয়ে আমার যে কী দুশিন্তা!
শিঞ্জিনী একটু ভয়ে ভয়ে বলল, এত টেনশন করো কেন? আজকাল কোনও মেয়ে বাড়িতে বসে থাকে! কত কাজে তাদের বেরুতে হয়। অত চিন্তা করলে চলে! বলল বটে, কিন্তু টের পাচ্ছে, মাকে নিয়ে নিজের দুর্ভাবনা একেবারেই কাটছে না। মাথার ভেতর সেই অদৃশ্য পোকাটা অবিরাম দাঁত বসিয়ে যাচ্ছে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, সে তুমি বুঝবে না। শরীরের যা হাল, কবে আছি কবে নেই। যেদিন থাকব না সেদিন তোমাদের যে কী হবে, ভাবতেও সাহস হয় না। মানুষ আর মানুষ নেই। শকুন, শেয়াল কি নেকড়ে হয়ে গেছে।
দাদু বাড়ি থেকে বেরুতে পারেন না। কেউ সাহায্য না করলে বিছানা থেকে নামার শক্তিও নেই। প্রায় পঙ্গু, শীর্ণ, রোগকাতর। কিন্তু মাথাটা এখনও পরিষ্কার। ভাবনাচিন্তার মধ্যে এতটুকু জড়তা নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি টের পান, কলকাতার মানুষ অনেক বদলে গেছে। রাস্তাঘাটে মেয়েরা আর ততটা নিরাপদ নয়।
ইন্দ্রনাথের ধারণা সবটাই যে অমূলক তা নয়। বাইরে বেরুলে শিঞ্জিনী টের পায় মানুষ কতটা নোংরা হয়ে গেছে।
হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল হতে অদ্ভুত এক ভয় ঠান্ডা স্রোতের মতো শিঞ্জিনীর শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার।
এই তো আর কিছুক্ষণ বাদে রাতের খাবার তৈরি করে দিয়ে মালতী চলে যাবে। মা কখন ফিরবে ঠিক নেই। ইন্দ্রনাথের আচমকা যদি কিছু হয়ে যায়, মালতী তত আর তাকে বসে বসে পাহারা দেবে না। মা না ফেরা পর্যন্ত শিঞ্জিনীকে এত বড় বাড়িতে একা একা থাকতে হবে। শকুনের পাল কি তা লক্ষ্য করবে না? কৈশোর-পেরুনো একটি মেয়ের পক্ষে তাদের ঠেকানো কি সম্ভব? মা-ও যদি থাকে, হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কতটা যুঝতে পারবে?
যতই রোগাভোগা হোক, শরীর যতই জীর্ণ হয়ে যাক, তবু একজন পুরুষমানুষ তো! দাদু যেন মাথার ওপর মস্ত এক দোয়া, সব ঝড়ঝাঁপটা থেকে আগলে আগলে রাখছেন। তিনি মারা যাবেন, ভাবতেও পারে না শিঞ্জিনী।
ইন্দ্রনাথ বললেন, দেরি করে ফেরা নিয়ে মায়ের সঙ্গে তোমার কোনও কথা হয়েছে?
শিঞ্জিনী বলল, আমি নিজে থেকে কিছু জিগ্যেস করিনি। মা তোমাকে যা বলেছে, আমাকেও ঠিক তাই বলেছে।
মায়ের জবাবদিহিতে ইন্দ্রনাথ যে সন্তুষ্ট নন, তার মনে যে সংশয়ের কুয়াশা জমেছে তা টের পাওয়া যাচ্ছিল।
ইন্দ্রনাথ বললেন, আমি খুকুর অফিসে ফোন করে জেনে নিতে পারতাম কবে কঘণ্টা সে ওভারটাইম খেটেছে। কিন্তু এখনও ফোনটা করিনি। কেন জানো?
নিজের অজান্তেই যেন শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, কেন?
ভয়ে।
কীসের ভয়?
হয় ওর অফিস থেকে এমন খবর দেবে, যাতে আমার আরেকবার স্ট্রোক হয়ে যাবে।
দেখাই যাচ্ছে, ওভারটাইমের ব্যাপারটা ইন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেননি। তার মনে হয়েছে, এটা ছুতো। তবু মেয়ের দেরি করে ফেরার অজুহাতটা যাচাই করে দিতে সাহস হয় না। যদি জানতে পারেন, মৃদুলা মিথ্যে ওজর দিয়ে চলেছে, উৎকণ্ঠা শতগুণ বেড়ে যাবে। জানার উপায় আছে, অথচ জানতে পারছেন না। বুড়ো মানুষটার কী যে চাপা কষ্ট!
শিঞ্জিনী কী উত্তর দেবে, ভেবে পেল না। মায়ের ওভারটাইমের রহস্যটা আজই স্বর্ণালীর কাছে মোটামুটি জেনেছে সে। দাদুর মানসিক যাতনা অনেকদিন ধরেই চলেছিল। আজ থেকে তারও শুরু হয়েছে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, তুমি এ নিয়ে মাকে কিছু বলতে যেও না। আর কিছুদিন দেখি। তারপর যা বলার, আমিই বলব।
স্বর্ণালী যখন খবরটা দেয় শিঞ্জিনী ভেবেছিল, মাকে সোজাসুজি সেই লোকটার কথা জিগ্যেস করবে। পরে ঠিক করেছে, আপাতত চুপচাপ থাকাই ভালো। মৃদুলার গতিবিধি আর কিছুদিন লক্ষ্য করা যাক। তারপর কিছু একটা করা যাবে।
শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে।
ইন্দ্রনাথ বললেন, অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। পড়ার ক্ষতি হচ্ছে। এবার যাও।
.
০৩.
নিজের ঘরে ফিরে এসে সামনের জোড়া জানালার মোটা শিক ধরে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনী। তাদের বাড়ির পেছনের অংশ, আধভাঙা বাউন্ডারি ওয়ালের পর ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই অনেকটা জমি, জলা-সব এখন ঘন আঁধারে ডুবে আছে। জলার ওধারে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। মনে হয় একেকটা অলীক স্বপ্নপুরী।
নিঝুম ফাঁকা মাঠ আর জলার দিক থেকে একটানা ঝিঁঝির ডাক উঠে আসছে। অদৃশ্য এই পোকাগুলো কোথায় যেন মাইফেল বসিয়ে দিয়েছে। রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজও মাঝে মাঝে ভেসে আসে।
কবছর আগেও ওই জলার দিকটায় সন্ধের পর থেকে শিয়ালেরা কোরাসে ডেকে উঠত। ওধারের হাইরাইজগুলো আকাশে মাথা তোলার পর প্রাণীগুলো তল্লাট ছেড়ে উধাও হয়েছে।
সেই অজানা লোকটা আর মাকে ঘিরে দুশ্চিন্তাটা এক লহমাও পিছু ছাড়ছে না। মাথার ভেতর অবিরল পাক দিয়ে চলেছে।
কতক্ষণ দূরে তাকিয়ে ছিল খেয়াল নেই। মালতী ডাকল, রূপাদিদি।
একটু চমকে ঘুরে দাঁড়ায় শিঞ্জিনী। দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মালতী। সে বলল, কী গো, এখনও পড়তে বসোনি!
মালতী বেশ অবাকই হয়েছে। অন্যদিন স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেয়েই পড়তে বসে যায় শিঞ্জিনী। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না। তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল মালতী।
শিঞ্জিনী জানালার পাশ থেকে সরে এল, এইবার বসব।
মালতী একদৃষ্টে তাকিয়েই ছিল। বলল, তোমার কী হয়েছে, বলো দিকিন?
কী হবে?
ইস্কুল থিকে আসা অব্দি দেখছি, সব্বেক্ষণ কী ভেবেই চলেছ।
তার মুখেচোখে ভেতরকার উদ্বেগ বা মানসিক চাপ যে ফুটে বেরিয়েছে, তা মালতীর নজর এড়িয়ে যায়নি। একটু হেসে শিঞ্জিনী বলল, ধুৎ, কী আবার ভাবব।
দেখো রূপাদিদি, তোমার য্যাখন চার বছর বয়স সেই ত্যাশন থিকে এ বাড়িতে কাজে লেগিচি। কোলে পিঠে করে তোমায় মানুষ করিচি। তোমার ধাত আমার জানা আছে। মুখ দেখল পেটের কথা টের পাই।
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।
মালতী বলল, আমাকে য্যাখন বলতে চাইছ না, বলো নি। শোনো, আমার রান্না হয়ে গ্যাছে। পরোটা, ছোলার ডাল আর মাংস। খাবার টেবিলে সব গুছিয়ে রাখা আছে। য্যাখন খাবে গরম করে নিও। বাবাকে খই-দুধ খাইয়ে দিয়েছি। এবার বাড়ি ফিরব। আমার সনগে নীচে চলো। বাইরের দোরটা বন্ধ করে দেবে।
অন্যদিনের মতো একটা কানা-উঁচু স্টেনলেস স্টিলের বড় থালায় মালতীর খাবার গুছিয়ে রাখা ছিল। সেটা গামছা দিয়ে বাঁধা। থালাটা নিয়ে চলে গেল সে। আর শিঞ্জিনী রাস্তার দিকের দরজায় খিল দিয়ে ফের ওপরে উঠে সোজা নিজের পড়ার টেবলে গিয়ে বসল।
আগস্টে প্রি-টেস্ট। নভেম্বরের শেষে টেস্ট। পরের বছর মার্চের গোড়ায় ফাইনাল। পর পর এতগুলো পরীক্ষা। পড়ায় মন না দিলে রেজাল্ট ভালো করা যাবে না। একরকম জোর করেই মা আর সেই লোকটার চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল শিঞ্জিনী। তারপর আর কোনওদিকে খেয়াল নেই।
সেই ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় থেকেই নিজের জীবনের একটা লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিল শিঞ্জিনী। আজকাল মেয়েরা চোখ-ধাঁধানো কেরিয়ারের দিকে ঝুঁকছে। কেউ হচ্ছে ডাক্তার। কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কেউ চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট। কেউ আর্কিটেক্ট। কেউ আই এ এস। কেউ বা যাচ্ছে ফরেন সারভিসে। কিন্তু শিঞ্জিনীর ইচ্ছা, নামকরা কোনও কলেজে পড়াবে। এই স্বপ্নটা কীভাবে তার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, কে জানে। কিন্তু মুখের কথায় তত কলেজের চাকরি হয় না। সে জন্য ইউনিভার্সিটির সবগুলো পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করা চাই। শিঞ্জিনী লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভালো। মেধাবী। কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটলে তার ইচ্ছাপূরণ না হওয়ার কারণ নেই।
কখন যেন একসময় নীচে কলিংবেল বেজে ওঠে। চমকে বই থেকে মুখ তোলে শিঞ্জিনী। মা বোধ হয় ফিরে এল। নিজের অজান্তে, স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে তার চোখ টেবল ক্লকের দিকে চলে যায়। নটা বেজে আটত্রিশ।
চেয়ার থেকে উঠে নীচে নেমে এল শিঞ্জিনী। এ সময় মা ছাড়া আর কারও আসার সম্ভাবনা নেই। তবু নিশ্চিত হবার জন্য আই-হোলে চোখ রেখে নিল সে। হ্যাঁ, মা-ই। দরজা খুলতেই মৃদুলা ভেতরে ঢুকে পড়ে। একটু কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলে, আজও ফিরতে দেরি হয়ে গেল। এত কাজের প্রেশার
শিঞ্জনী উত্তর দিল না।
দরজার ভেতর দিকে এক জোড়া কড়া লাগানো আছে। পাশের কুলুঙ্গিতে তালা চাবি থাকে। মৃদুলা সেগুলো বার করে দরজায় খিল দিয়ে, কড়ায় তালা লাগিয়ে চাবিটা জায়গামতো রেখে দিল। শুধু গ্রিলের ওপর তারা ভরসা করে না। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য তাই ভেতর থেকে তালার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে শিঞ্জিনী লক্ষ্য করল, মায়ের পরনে মেরুন রঙের দামি সিল্ক। পায়ে নতুন ডিজাইনের বাহারি স্ট্র্যাপ লাগানো জুতো। প্লাক করা ভুরু। মুখটা তেলতেলে, মসৃণ। খুব সম্ভব হালকা করে স্নো মেখেছে। মুখ ডিম্বাকৃতি। নখ ম্যানিকিওর করা। কাঁধ পর্যন্ত শ্যাম্পু করা ফাপানো চুল। কপালে মেরুন রঙের টিপ। তার শাড়ি-টাড়ি থেকে মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল।
মৃদুলার বয়স একচল্লিশ। কিন্তু বত্রিশ-তেত্রিশের বেশি মনে হয় না। মেদহীন, ঝকঝকে চেহারা। বাদামি, নিভাজ ত্বক। তার মধ্যে কোথায় যেন একটা লুকনো চুম্বক রয়েছে। যার আকর্ষণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা খুব কম পুরুষেরই আছে। মৃদুলার যে একটি বড় মেয়ে আছে, এবং সে আসছে বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে, ভাবাই যায় না। ইন্দ্রনাথের দুশ্চিন্তা অকারণে নয়।
আগে সাজগোজের দিকে মৃদুলার লক্ষ্য ছিল না। সাধারণ সিনথেটিক শাড়িতে যাতায়াতের সুবিধা। তাই পরত সে। চুলে দ্রুত বারকয়েক চিরুনি চালিয়ে নিত। দুই ভুরুর মাঝখানে ছোট একটি টিপ, সামান্য পাউডার বা স্নো, হাতে একটা চৌকো ঘড়ি। ব্যস, এটুকুই। কিন্তু ইদানীং সাজের মাত্রটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। শিঞ্জিনীর অনভ্যস্ত চোখে কেমন যেন খোঁচা দেয়।
ছেলেবেলা থেকেই শিঞ্জিনী দেখে এসেছে, মা সুন্দরী, বয়সও তেমন কিছু নয়, তবু তার ছিল প্রবল ব্যক্তিত্ব। নিজের চারপাশে সারি সারি অনেকগুলো কাঁচের দেওয়াল তুলে রেখেছিল মৃদুলা। সে সব ভেদ করে তার খুব কাছে ঘেঁষার সাহস কারও হয়নি। তার সেই মা কি বদলে গেছে?
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চোরা চোখে মৃদুলার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল শিঞ্জিনী। সারাদিন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে একটানা কাজ, তারপর ওভারটাইম। এত পরিশ্রমের নিট ফল কী? ক্লান্তি, অবসাদ, দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসা। কিন্তু মায়ের চেহারায় তার চিহ্নমাত্র নেই। চুল পরিপাটি আঁচড়ানো। শাড়ির ভঁজে এতটুকু হেরফের হয়নি। ঘামে নষ্ট হয়ে যায়নি স্নো-পাউডারের প্রলেপ। বরং এত রাতেও তার চোখেমুখে আশ্চর্য তরতাজা ভাব। মনে গোপন আনন্দ থাকলে তার দ্যুতি বাইরে বেরিয়ে আসে। তেমনই কিছু একটা মায়ের সর্বাঙ্গে মাখানো।
মৃদুলা বলল, তুই খেয়ে নিয়েছিস তো?
শিঞ্জিনী বলে, না! তুমি না ফিরলে আমি কখনও খাই?
কতদিন বলেছি, আমার জন্যে ওয়েট করবি না। নটা পর্যন্ত দেখে খেয়ে নিবি।
একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না।
সামান্য বিরক্ত হল মৃদুলা, এর কোনও মানে হয়।
শিঞ্জিনী চুপ করে থাকে।
মৃদুলা বলে, ধর, অফিসের কাজে বা অন্য কোনও কারণে কদিনের জন্যে আমাকে বাইরে যেতে হল। তখন কী করবি? খাবি না?
শিঞ্জিনী চকিত হয়ে ওঠে, তুমি বাইরে যাবে নাকি?
মৃদুলা বলল, ওটা একটা কথার কথা। যদি যাই
শিঞ্জিনী আর কোনও প্রশ্ন করল না।
দোতলায় উঠলেই প্রথম ঘরটা ইন্দ্রনাথের। সেখান থেকে তার দুর্বল স্বর ভেসে এল, খুকু এলি? পায়ের আওয়াজ শুনে তিনি টের পান কোনটা মেয়ের কোনটা নাতনির আর কোনটা মালতীর। বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে তার ইন্দ্রিয়গুলো প্রখর হয়ে উঠেছে।
রাত্তিরে ইন্দ্রনাথের ঘরের দরজা ভেজানো থাকে। নিজের খাট থেকে নেমে খিল আটকে যে আবার বিছানায় উঠবেন, সে শক্তি তাঁর নেই। মৃদুলা পাশের ঘরেই থাকে। মাঝে মাঝে উঠে এসে বাবাকে দেখে যায়।
মৃদুলা সাড়া দিল, হ্যাঁ। ইন্দ্রনাথের ঘরের দরজাটা সামান্য ঠেলে মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, তুমি এখনও জেগে আছ? ঘুমের ওষুধটা খাওনি?
ইন্দ্রনাথের রাতের খাওয়া হয়ে গেলে মালতী একটা অল্প পাওয়ারের নীলাভ আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। ওটা ভোর পর্যন্ত জ্বলে।
মৃদু আলায় মশারির ভেতর আবছাভাবে ইন্দ্রনাথের শীর্ণ কাঠামোটা দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন, খেয়েছি তো। কিন্তু তুই না ফেরা পর্যন্ত চোখে ঘুম যে আসে না।
আমি কি বাচ্চা মেয়ে? মৃদুলা বলল, কাজ থাকলে দেরি তো হবেই। কেন এত চিন্তা করো?
মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন, আর কত দিন তুই আমাকে এমন কষ্ট দিবি?
মৃদুলা থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলে, অনেক রাত হয়েছে। এবার ঘুমিয়ে পড়ো। আর জেগে থাকলে শরীর খারাপ হবে। ইন্দ্রনাথকে আর কোনও অভিযোগ তোলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দেয় সে।
মাঝখানের ঘরটা মৃদুলার। সেখানে এসে সে বলল, তুই নিশ্চয়ই পড়ছিলি?
আস্তে মাথা নাড়ে শিঞ্জিনী, হ্যাঁ।
একটানা পড়লে চোখে খুব স্ট্রেন হয়। ভালো করে চোখ ধুয়ে নীচে খাবার ঘরে চলে আয়। আমিও বাইরের শাড়ি-টাড়িগুলো পালটে আসছি। বেশি দেরি করিস না।
নিজের ঘরে এসে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে শিঞ্জিনী। যে বইটা পড়তে পড়তে মাকে দরজা খুলে দিতে নীচে নেমে গিয়েছিল, সেটা টেবলে খোল পড়ে আছে। এক সময় বইটা বন্ধ করে চোখে জল ছিটিয়ে, ভালো করে মুছে একতলায় নেমে এল সে।
মৃদুলা তার আগেই চলে এসেছে। তার পরনে এখন বাহারি নাইটি। কিচেনে খাবার গরম করছিল। মেয়ের পায়ের শব্দে মুখ ফিরিয়ে বলল, বস।
মালতীর কাজে কোনও খুঁত নেই। টেবলের মাঝখানে প্লেট, ফাঁকা জলের গেলাস, জলভর্তি স্টেনলেস স্টিলের জগ ইত্যাদি গুছিয়ে রেখে গেছে। ক্যাসেরোলে পরোটা রয়েছে। আর আছে প্ল্যাস্টিকের কৌটোয় কটা ক্ষীরের পানতুয়া।
শিঞ্জিনী একটা চেয়ারে বসে প্রথমে গেলাসে জল ভরল তারপর মৃদুলা এবং তার নিজের জন্য দুটো বড় প্লেট এবং সেগুলোর পাশে ছোট ছোট কটা গোল পোর্সিলিনের বাটি সাজিয়ে রাখল।
খাবার গরম হয়ে গেছে। মৃদুলা কিচেন থেকে এসে মেয়েকে পরোটা, ছোলার ডাল, মাংস ইত্যাদি দিয়ে নিজেও নিল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়ার পর মৃদুলা জিগ্যেস করল, তোর প্রি-টেস্ট যেন কবে?
পরোটার কোনা ছিঁড়ে চামচে করে ছোলার ডাল তুলে একসঙ্গে মুখে পুরে চিবোচ্ছিল শিঞ্জিনী। বলল, বেশি দেরি নেই।
পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে?
হচ্ছে।
এখন অন্য কোনও দিকে মন নয়। হায়ার সেকেন্ডারিটা খুব ইমপর্টেন্ট ব্যাপার। ভালো রেজাল্ট না করলে বড় কলেজে চান্স পাবি না।
জানি। নীরস গলায় শিঞ্জিনী বলল, অন্য কোনও দিকে মন দেবার মতো সময় আমার নেই।
একটু থমকে গেল মৃদুলা। আন্দাজ করতে চেষ্টা করল, মেয়ের কথায় সূক্ষ্ম কোনও ইঙ্গিত আছে কিনা। কিন্তু সেরকম কিছু বোঝা গেল না। তবে বেশ গম্ভীর আর অন্যমনস্ক মনে হল। সে বলল, টিচাররা কেমন ক্লাস নিচ্ছেন?
শিঞ্জিনী বলল, কোনও প্রবলেম নেই। আমাদের টিচারদের মধ্যে কেউ ফাঁকিবাজ নন।
কোচিং ক্লাস কেমন চলছে।
ভালো।
একটু চিন্তা করে মৃদুলা বলল, তোদের ফাইনালও এসে গেল। মাত্র কটা মাস বাকি। টিউটোরিয়ালে একসঙ্গে অনেক ছেলেমেয়েকে পড়ানো হয়। তোর কি মনে হয়, বাড়িতে এসে আলাদা করে পড়াবে, এমন দু-একজন টিউটর দরকার?
শিঞ্জিনী মাথা নাড়ে, না। লাগবে না।
এরপর অনেকটা নীরবে খেয়ে যায় দুজনে। শিঞ্জিনীর কেন যেন মনে হয়, মৃদুলা তার পড়াশোনা সম্পর্কে যা বলল তা নেহাতই দায়সারা। আগে প্রতিদিন খাবার টেবলে বসে কোন মিস কী পড়ালেন, কী নোট দিলেন, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করত। খুব ভালো ছাত্রী ছিল মৃদুলা। শুধু মেয়ের পড়া সম্পর্কেই খোঁজখবর নিত না, ক্লাস আর টিউটোরিয়ালের নোটগুলো খাতা খুলে দেখত। সেগুলো মেয়ে ঠিকমতো রপ্ত করেছে কিনা, নজর রাখত। শিঞ্জিনী আর ইন্দ্রনাথের জন্য অনেকটা সময় দিত সে।
খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। নতচোখে কিছুক্ষণ ইতস্তুত করার পর হঠাৎ মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকায় মৃদুলা। ভেতরে ভেতরে কী একটা দ্বিধা তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। দ্বিধাটা কাটিয়ে সে ডাকে, রূপা-।
শিঞ্জিনীর চোখও ছিল নিজের প্লেটের দিকে নামানো। মায়ের ডাকে চোখ তোলে সে, কিন্তু কোনও প্রশ্ন করে না।
তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
বলো।
এক ভদ্রলোক তোর সঙ্গে আলাপ করতে চান।
হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে গেল শিঞ্জিনীর। স্বর্ণালী মায়ের সঙ্গে তিনবার যাকে দেখেছিল সেই লোকটাই কী? মায়ের মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে সামান্য চাপা গলায় জিগ্যেস করল, কে ভদ্রলোক?
মৃদুলা বলল, ওপরে গিয়ে সব বলব। এখন খেয়ে নে।
.
০৪.
মিনিট পনেরো আগে ওপরে উঠে এসেছে শিঞ্জিনী। ভেবেছিল, খাওয়া-দাওয়ার পর ঘন্টা দুই পড়বে। হায়ার সেকেন্ডারির বিশাল কোর্স। তার ওপর পরীক্ষার পর পরীক্ষা। রাত্তিরে বারোটা, সাড়ে বারোটা পর্যন্ত না পড়লে থই পাওয়া যাবে না।
শুতে শুতে রোজই মাঝরাত পার হয়ে যায় শিঞ্জিনীর। এখন সবে দশটা সতেরো। কিন্তু পড়ায় একেবারেই মন বসছে না। খাটের কোনায় বসে সামনের দিকের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। মৃদুলা কখন আসবে এবং কী ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাবে, সে জন্য দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছে।
ঝিঁঝিরা সেই বিকেল থেকেই ডেকে চলেছে। অদৃশ্য এই পোকাগুলোর এনার্জি আছে। মুহূর্তের জন্য থামে না। এখন ঝিল্লিস্বরের সঙ্গে জলার দিক থেকে ব্যাঙেদের কনসার্টও ভেসে আসছে। সূর্যাস্তের ঠিক আগে পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছিল। এখন দক্ষিণ দিকটাও মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে। তারা বা চাঁদ কিছুই চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে আকাশটাকে কোনাকুনি চিরে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে যায়। অনেকক্ষণ বৃষ্টিটা গড়িমসি করেছে। এবার বোধহয় মনস্থির করে ফেলেছে। যে-কোনও সময় দিগদিগন্ত ভাসিয়ে নেমে আসবে।
রাতের খাওয়া চুকলে মৃদুলার কিছু কাজ থাকে। এঁটো প্লেট এবং অন্যান্য বাসন রান্নাঘরের সিঙ্কে ঠিক করে গুছিয়ে রাখে। পরদিন মালতী এসে মাজবে।
বাসন-কোসন রাখা হলে, আঁচিয়ে, একতলার প্রতিটি ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ওপরে উঠে আসে মৃদুলা। দোতলায় সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেট বসানো আছে। সেটা টেনে ঢাউস তালা লাগায়। এত সব করতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। নীচের দরজায় তালা, দোতলায় তালা। নিরাপত্তার বন্দোবস্ত যতটা জোরদার করা যায় আর কী।
অন্যদিন এসব সারা হলে নিজের ঘরে চলে যায় মৃদুলা। আজ সোজা মেয়ের ঘরে এল। শিঞ্জিনী খাটের যে দিকটায় বসেছে, তার উলটো দিকে বাজুতে হেলান দিয়ে বসল।
দুবেলাই খাওয়ার পর ভাজা মৌরি খায় মৃদুলা। মৌরির স্বাদটা তার খুব ভালো লাগে। ফুরিয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ সেটা যেন জিভে জড়িয়ে থাকে।
চোখের কোণ দিয়ে মেয়েকে একবার লক্ষ্য করল মৃদুলা। তার ভঙ্গিটা বেশ সতর্ক। সতেরো-পেরুনো তরুণী মেয়েকে কীভাবে কথাটা বলবে, মনে মনে তার মহড়া দিয়ে নিচ্ছে যেন।
সেই বিকেল থেকে ভীষণ উতলা হয়ে আছে শিঞ্জিনী। মাকে কাছাকাছি বসে থাকতে দেখে উকণ্ঠটা হঠাৎ শতগুণ বেড়ে যায়।
মৃদুলা জানালার বাইরে তাকাল। মেঘে ফাটল ধরিয়ে বিদ্যুৎ চমকেই যাচ্ছে। দূরে কোথায় যেন বাজ পড়ল।
যেন মেয়েকে নয়, বাইরের অদৃশ্য কারও উদ্দেশে মৃদুলা বলল, খেতে বসে যে ভদ্রলোকের কথা বলছিলাম তাঁর নাম বিমলেশ বসুমল্লিক।
শিঞ্জিনী উত্তর দিল না।
মৃদুলা বলতে লাগল, ওঁরা লেদার গুডসের খুব বড় ম্যানুফ্যাকচারার। জুতো, সুটকেস, বড় বড় ব্যাগ, এমনি নানা জিনিস ওঁদের কারখানায় তৈরি হয়।
কোনওরকম আগ্রহ বোধ করল না শিঞ্জিনী। শুধু বলল, ও–
মৃদুলা বলল, ওঁদের একটা বিরাট ফ্যাক্টরি আছে পানিহাটিতে। খুব শিগগিরই বি টি রোডে নতুন আরেকটা কারখানা খুলবেন। লেদারের আরও কী কী জিনিস সেখানে তৈরি হবে।
আগের মতোই একটি মাত্র শব্দ শিঞ্জিনীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ও-
হোল ইন্ডিয়ায় ওঁদের প্রোডাক্টের বিরাট ডিমান্ড। প্রতি সপ্তাহে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু থেকে অসম, মণিপুর পর্যন্ত ট্রাক বোঝাই হয়ে ওঁদের মাল যায়। বিদেশেও ওঁদের বড় মার্কেট। প্রচুর এক্সপোর্ট করে।
ও।
উদ্দীপ্ত মুখে মৃদুলা বলে, নামকরা অ্যারিস্টোক্রাট ফ্যামিলির ছেলে। শোভাবাজারে ওঁদের প্রকাণ্ড বাড়ি। একশ বছরের পুরোনো। তবে বিমলেশ সল্ট লেকে আলাদা তিনতলা বাড়ি করেছেন। উনি সেখানেই থাকেন।
এই মধ্যরাতে আকাশ যখন মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টি প্রায় পড় পড়, সারা শহর নিঝুম, সেই সময় একজন চূড়ান্ত সফল, অর্থবান মানুষের জীবনকাহিনি যেভাবে মা ফেঁদে বসেছে, সহজে তা থামবে বলে মনে হয় না। শিঞ্জিনী ক্লান্তি বোধ করছিল। মনে মনে বেশ বিরক্তও। আজ আর পড়াশোনার আশা নেই। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারলে কাল ভোর ভোর উঠে বই নিয়ে বসা যেত। মায়ের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে না, সেটা আদৌ সম্ভব।
মৃদুলা থামেনি। সে আরও জানায়, মানুষ হিসেবে বিমলেশ চমৎকার। অমায়িক। সহৃদয়। এত যে পয়সা, কিন্তু তিলমাত্র অহমিকা নেই।
মায়ের মুখে কোনও অনাত্মীয় পুরুষের এমন ঢালাও স্তুতি আগে কখনও শোনেনি শিঞ্জিনী। এত উচ্ছ্বসিত হতেও দেখেনি। অবাক বিস্ময়ে সে শুধু মাকে দেখেই যাচ্ছিল। পলকহীন। বুঝতে পারছিল, আসল প্রসঙ্গে আসার আগে মৃদুলা জমি তৈরি করে নিচ্ছে।
মৃদুলা এবার জানায়, একবার বিয়ে হয়েছিল বিমলেশের, স্ত্রী জয়তী ছিল সুন্দরী, শিক্ষিতা। হিষ্ট্রির এমএ। একটা বড় কলেজে পড়াত। ম্যারেড লাইফটা ওদের বেশ সুখেরই ছিল। কিন্তু হঠাৎই জয়তীর ব্রেন ক্যানসার ধরা পড়ল। খুবই অ্যাডভান্সড স্টেজে। তখন আর কিছু করার ছিল না। মাত্র তিন মাসের ভেতর জয়তীর মৃত্যু ইল। এমন একটা শোকাবহ ঘটনার একেবারে ভেঙে পড়েছিল বিমলেশ। দুঃখটা সামলে নিতে অনেক সময় লেগেছে তার। ওরা নিঃসন্তান। একটা ছেলে বা মেয়ে হলে তবু একটা সান্ত্বনা থাকত। তাকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে নিতে পারত। কিন্তু তার উপায় নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সে সম্পূর্ণ একা।
এত সব কথা জানার পরও টু শব্দটি করে না শিঞ্জিনী। তার কাছে এগুলোর কোনও গুরুত্ব নেই। একেবারেই অর্থহীন। অনাবশ্যক। তবু শুনতে হচ্ছে। এ যে কী মানসিক যাতনা!
বিমলেশকে নিয়ে মৃদুলার উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। ভদ্রলোকের নাকি নানা মহলে দারুণ ইনফ্লুয়েন্স। পুলিশ, প্রশাসন, পলিটিক্যাল পার্টি তো আছেই। এমনকী বেশ কজন মন্ত্রীর সঙ্গেও যথেষ্ট দহরম মহরম। বিগ বিজনেস বা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে গেলে বিভিন্ন লেভেলের ক্ষমতাবান লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেই নয়।
ধৈর্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় শিঞ্জিনী। এতক্ষণ ঠোঁট টিপে বসে ছিল। এবার তীব্র, ঝাঝালো গলায় বলে, আমাকে পড়তে দিলে না। যাকে চিনি না, জানি না, দেখিনি, তার লাইফ হিষ্ট্রি কি সারারাত শুনিয়ে যাবে?
মৃদুলা হতচকিত। মেয়ের দিক থেকে এমন বাধা আসবে, ভাবতে পারেনি। সে প্রায় বোবা হয়ে যায়।
শিঞ্জিনী থামেনি। আগের মতোই কটু স্বরে বলল, লোকটা সম্পর্কে কেন এত কথা বলছ? তার প্রচুর টাকা, বিরাট বিজনেস, অ্যারিস্টোক্রাট ফ্যামিলিতে জন্ম–এসব শুনে আমার কী লাভ?
এর মধ্যে অনেকটা সামলে নিয়েছে মৃদুলা। একটু হেসে বলল, ভদ্রলোক সম্পর্কে তোর যাতে পরিষ্কার একটা ধারণা হয়, সেই জন্যেই এত কথা বলা।
সোজাসুজি মায়ের চোখে চোখ রেখে শিঞ্জিনী জিগ্যেস করে, এই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন কেন?
আমি তোর কথা বলেছি। তাই ওঁর ভীষণ ইচ্ছে, তোর সঙ্গে আলাপ করেন।
আমার সঙ্গে আলাপ করার কারণটা কী?
কারণ আবার কী? ওঁর ইচ্ছে হয়েছে। তাই
কী আশ্চর্য, কলকাতায় আমার বয়সি হাজার হাজার মেয়ে আছে। তাদের বাদ দিয়ে আমার সম্বন্ধে তার এত ইন্টারেস্ট কেন?
যে সুরে, যে ভঙ্গিতে শিঞ্জিনী কথা বলছে তাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটতেই পারে। কিন্তু নিজেকে সংযমে বেঁধে রাখে মৃদুলা। শান্ত মুখে বলে কারণ তুই আমার মেয়ে।
এবার থতমত খেয়ে যায় শিঞ্জিনী, তোমার মেয়ে বলেই আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান! স্ট্রেঞ্জ! আর কোনও পারপাস নেই?
প্রহেলিকার আবরণে নিজেকে মুড়ে রাখে মৃদুলা। হেসে হেসে বলে, হয়তো আছে। হয়তো আমি জানি। তবে যা বলার তিনিই তোকে বলবেন।
শিঞ্জিনী বুঝতে পারে, বিমলেশ বসুমল্লিকের উদ্দেশ্যটা মায়ের কাছ থেকে কিছুতেই জানা যাবে না। তাকে খুঁচিয়ে লাভ নেই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর শিঞ্জনী বলে, একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না।
কী?
তুমি একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে ছোটখাটো অফিসার। বিমলেশ বসুমল্লিকের মতো একজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের সঙ্গে তোমার কীভাবে পরিচয় হল?
ওঁদের কোম্পানির বহু জিনিস আমরা ট্রাকে করে ইন্ডিয়ার নানা সিটিতে পাঠাই। দুবার দুটো গোলমাল হয়েছিল। একবার মাল ঠিক সময়ে জায়গামতো পোঁছয়নি। আরেকবার রাস্তায় সব জিনিস লুঠ হয়ে যায়। দুবারই মিস্টার বসুমল্লিক আলোচনার জন্য আমাদের ডেকে পাঠান। কোম্পানির তরফ থেকে আমি ওঁর অফিসে গিয়ে দেখা করি। এইভাবেই আলাপ হয়েছিল।
শিঞ্জনী উত্তর দিল না।
একটু চিন্তা করে মৃদুলা জিগ্যেস করল কী বলব ভদ্রলোককে? দেখা করবি?
শিঞ্জিনী অনুমান করে নেয়, বিমলেশের সঙ্গে পরিচয় করতে যতক্ষণ না রাজি হচ্ছে, মা তাকে ছাড়বে না। নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লেগে থাকবে। কদিন পর প্রি-টেস্ট। এসময় উটকো ঝঞ্ঝাট তার ভালো লাগছে না। আবার কৌতূহল যে হচ্ছিল না, তা নয়। এই লোকটার সঙ্গেই যে মাকে স্বর্ণালী কলকাতায় তিন জায়গায় দেখেছে, এ নিয়ে তার সংশয় নেই। বিমলেশ সম্পর্কে একদিকে তার বিতৃষ্ণা, অন্যদিকে আগ্রহ। কিছুক্ষণ দুইয়ের টানাপোড়েন চলল। তারপর নীরস গলায় শিঞ্জিনী বলল, ঠিক আছে, তোমার যখন এত ইচ্ছে, মিস্টার বসুমল্লিককে আমাদের বাড়ি আসতে বলো। আমার সঙ্গে পরিচয় হবে দাদুর সঙ্গেও।
মৃদুলা চমকে ওঠে, না না
কী না?
উনি এখন এ বাড়িতে আসবেন না?
শিঞ্জিনী অবাক, কেন?
মৃদুলা বলল, আগে তোর সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর যদি মনে হয়, আমাদের বাড়িতে আসা যায়, তখন আসবেন। সমস্ত কিছু তোর ওপর নির্ভর করছে।
আমার ওপর নির্ভর করছে মানে?
সেটা ওঁর সঙ্গে দেখা হলেই বুঝতে পারবি।
আমাদের বাড়ি উনি আসবেন না। তা হলে দেখাটা হবে কী করে?
তার ব্যবস্থা আমি করব। অনেক রাত হয়ে গেছে। এবার শুয়ে পড়। বলতে বলতে উঠে পড়ল মৃদুলা।
.
০৫.
মৃদুলা চলে যাবার পর জোরালো টিউবলাইট নিভিয়ে সবুজ রঙের নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দিল শিঞ্জিনী। তারপর দরজায় ছিটকিনি আটকে বিছানায় চলে এল। বুকে বালিশ চেপে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে সে।
কখন দুর্যোগ শুরু হয়েছিল, খেয়াল নেই। অঝোরে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে। ছাঁটটা উলটো দিক থেকে আসছে বলে জানালা দিয়ে জল ঘরে ঢুকছে না। উঁচু বাড়িগুলোর বেশিরভাগ ঘরেরই আলো নিভে গেছে। দু-একটা যা-ও জ্বলছে কেমন যেন অলৌকিক মনে হয়। আকাশ ঝলসে দিয়ে কড় কড় শব্দে বাজ পড়ছে। ব্যাঙের ডাক বন্ধ। ঝিঁঝিদের অর্কেস্ট্রা থেমে গেছে। ঝড়ো হাওয়া সাঁই সাঁই ঘোড়া দাবড়ে চলেছে দিগ্বিদিকে। আর বড় বড় গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে ঝাঁপিয়ে যাচ্ছে অবিরল। হঠাৎ যেন কলকাতায় এই অঞ্চলটাকে ভূতে পেয়েছে।
মৃদুলার কথাই ভাবছিল শিঞ্জিনী। একদিন মা-ই ছিল তার সর্বস্ব। মাকে ঘিরেই ছিল তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। তাকে ছাড়া মা-ও আর কিছু ভাবতে পারত না। পরস্পরকে নিয়েই তারা এতকাল বিভোর হয়ে ছিল।
কিন্তু আজ বিকেলে স্বর্ণালীর কাছে যা শুনেছে এবং কিছুক্ষণ আগে মৃদুলা যা বলে গেল, তাতে একটা সংকেতই রয়েছে। মা আর আগের মা নেই। শিঞ্জিনীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। কেমন অচেনা অচেনা লাগছে তাকে। এতদিন দুজনে একসঙ্গে বসলে তাদের যত কথা হত নিজেদের নিয়েই। আজ তাদের ভেতর আরেক জন ঢুকে পড়েছে। বিমলেশ বসুমল্লিককে চোখে দেখেনি শিঞ্জিনী, কিন্তু তার অস্তিত্ব প্রবল ভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে।
শিঞ্জিনী অবাক হয়ে ভাবে, মৃদুলা একদিন তার জন্য কী করেছে। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে তিনটে বছর শ্বশুরবাড়ির, বিশেষ করে অনির্বাণের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। সে এক নিদারুণ সংঘাত। তখন দিনরাত আতঙ্কের মধ্যে কাটত মৃদুলার। ঘুমত না, ঠিকমতো খেত না, কেমন যে পাগল পাগল অবস্থা। একটা দুঃস্বপ্ন সর্বক্ষণ তাকে তাড়া করে বেড়াত। অনির্বাণ তখনও তার স্বামী। তার ভয়, এই বুঝি শিঞ্জিনীকে অনির্বাণরা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। বিরতিহীন। ঝড়ের মাতামাতি আরও বেড়েছে। বাইরের মতোই শিঞ্জিনীর বুকের ভেতরটা এখন উথালপাথাল।
নিজের অজান্তে কখন যেন হঠাৎ একটা টাইম মেশিন শূন্য থেকে নেমে এসে তাকে তুলে নিয়ে সেই কোন ছেলেবেলায় পৌঁছে দেয়।
.
তখন শিঞ্জিনীর কত আর বয়স। চার কি পাঁচ। ওরা থাকত বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর পেছন দিকের একটা রাস্তায়। সেখানে অনির্বাণদের মাঝারি ধরনের তেতলা বাড়ি। টাকাপয়সার সমস্যা নেই। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করত সে। পোস্টটা বেশ উঁচুর দিকে। তার বাবাও অনেক টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে গেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে ভালো ইন্টারেস্ট পাওয়া যেত।
বাড়িতে সবসুদ্ধ পাঁচটি মানুষ। অনির্বাণ, তার বিধবা মা রত্নময়ী, এক তরুণী বিধবা বৌদি যার নাম তরুলতা, মৃদুলা আর শিঞ্জিনী। তরুলতা অবশ্য মাঝে মাঝে তার বাপের বাড়ি পাতিপুকুরে চলে যেত। কখনও পনেরো-কুড়ি দিন, কখনও বা এক-দুমাস কাটিয়ে আবার ফিরে আসত। যখনই ফিরত, মৃদুলার সঙ্গে তুলকালাম শুরু হয়ে যেত। শিঞ্জিনী লক্ষ্য করেছে, প্রতিটি সংঘর্ষে রত্নময়ী আর অনির্বাণ তরুলতার পক্ষে। অন্যদিকে মা একা। কুৎসিত কলহে, তুমুল চিঙ্কারে সারা বাড়ি নরক হয়ে উঠত। এই মহাযুদ্ধের কারণ কী, সেটা বোঝার বয়স তখনও হয়নি শিঞ্জিনীর।
এসব অনেক পরের কথা। সে শুনেছে, মৃদুলা আর অনির্বাণের বিয়েতে প্রেমের নামগন্ধও ছিল না। ঘটকালিটা করেছিল খবরের কাগজ। ম্যাট্রিমোনিয়াল কলমে বিজ্ঞাপন দেখে ইন্দ্রনাথ যোগাযোগ করেছিলেন। মৃদুলাকে দেখে, তার সঙ্গে কথা বলে খুবই পছন্দ হয়েছিল অনির্বাণদের। বিশেষ করে তরুলতার। যেদিন মৃদুলাকে ওরা দেখতে আসে, সেদিনই নাকি মা আঁচ করেছিল, অনির্বাণ বা রত্নময়ী নন, ওদের বাড়ির আসল কী তরুলতা। ও বাড়িতে তার কথাই শেষ কথা। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করে না।
তরুলতা মৃদুলার কানে কানে নাকি বলেছিল, আমিই তোমাকে পছন্দ করে নিয়ে যাচ্ছি। এই কথাটা সবসময় মনে রেখো।
বিয়ের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে তরুলতা কথা বলেছিল। এটা করতে হবে, ওটা না করলে চলবে না। অমুকটা চাই, টমুকটা চাই। অতজন বরযাত্রী আসবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। রত্নময়ী আর অনির্বাণ নীরবে ঘাড় কাত তার প্রতিটি কথায় সায় দিয়ে গিয়েছিল।
মৃদুলার মা অন্নপূর্ণা তখনও বেঁচে। তরুলতার এই কর্তালি তার পছন্দ হয়নি। বরং খারাপই লেগেছে। যেখানে রত্নময়ী মাথার ওপর রয়েছেন, বিধবা পুত্রবধূ কেন এত ফরফর করে।
অন্নপূর্ণার এই খুঁতখুঁতুনিকে আমল দেননি ইন্দ্রনাথ। একরকম তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনিতে তার এবং অন্নপূর্ণার কারও স্বাস্থই ভালো নয়। দুজনেই পাল্লা দিয়ে ভুগতেন। বেঁচে থাকতে থাকতে একমাত্র মেয়ের বিয়েটা চুকিয়ে ফেলতে চেয়েছেন ইন্দ্রনাথ। কখন কার কী হয়ে যাবে, কে বলতে পারে। এটাই ছিল তাদের জীবনের শেষ বড় দায়িত্ব।
তরুলতাকে নিয়ে অন্নপূর্ণার মনে সামান্য একটু খিচ যে রয়েছে তা বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছিলেন রত্নময়ী। তার একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও পেশ করেছিলেন। তরুলতা তার বড় ছেলে সুকুমারের স্ত্রী। কবছর আগে রাস্তা পার হতে গিয়ে বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় সুকুমারের মৃত্যু হয়। কী আর এমন বয়স তরুলতার! সবে একত্রিশ। ছেলেপুলে হয়নি। ইচ্ছা করলে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারত। লেখাপড়া জানা মেয়ে, একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়া অসম্ভব ছিল না। এমনকী, ফের বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে পারত। তার সামনে অফুরান ভবিষ্যৎ। রত্নময়ী অনেকবার বুঝিয়েছেন, ফের তার বিয়ে করা উচিত। কিন্তু কোনও কথাই কানে তোলেনি। শ্বশুরবাড়িতে থেকে শোককাতর শাশুড়ি এবং দেওরটিকে আগলে আগলে রেখেছে। ধীরে ধীরে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তরুলতার ওপর নির্ভর না করে উপায় নেই। তাদের সংসারের রক্তমাংসে সে জড়িয়ে গেছে।
একমাত্র মেয়ের বিয়ে। শিঞ্জিনী শুনেছে, রীতিমতো ধুম-ধাম করেই সেটা দিয়েছিলেন ইন্দ্রনাথ। লং প্লেয়িং রেকর্ডে সানাই, চোখধাঁধানো আলো, গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো ছাঁদনাতলা এবং বাসরঘর, নামকরা কেটারারদের দিয়ে ভোজের ব্যবস্থা। সব কিছুই নিখুঁত।
ইন্দ্রনাথ মেয়েকে দিয়েছিলেনও প্রচুর। দুসেট গয়না, খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবল, রঙিন টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ডিভান, এমনি কত কী। মৃদুলার জন্মের পর থেকেই তার বিয়ের জন্য মাসে মাসে ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ে গেছেন ইন্দ্রনাথ। বিয়ের সময় সুদে আসলে সেটা কয়েক লাখে দাঁড়িয়ে ছিল। সবটাই তিনি খরচ করেছেন।
শ্বশুরবাড়িতে যাবার পর কিছুদিন কোনও গোলমাল নেই। সব মসৃণ নিয়মেই চলছিল। যেমন অন্য দশটা মেয়ের জীবনে ঘটে, অবিকল তা-ই।
প্রথমটা লক্ষ্য করেনি মৃদুলা। বিয়ের পর পর যে-কোনও তরুণীর শরীরে এবং মনে ঘোর লেগে থাকে। সেই ঘোরটা কেটে গেলে এমন কিছু কিছু ব্যাপার চোখে পড়তে লাগল যা ভীষণ চোখে পড়ে। তার ভুরু কুঁচকে যেতে লাগল।
তরুলতা মাঝে মাঝে অনির্বাণের দিকে কেমন করে যেন তাকায়। ঠোঁট টিপে নিঃশব্দে অদ্ভুত হাসে। তার চাউনি আর হাসির মধ্যে কীসের যেন সংকেত থাকে। তাছাড়া, একটু আড়াল হলেই অনির্বাণকে জড়িয়ে ধরে নাকটা তার গালে কি গলায় ঘষতে থাকে। চাপা, ফিসফিস গলায় কী যেন বলে।
ততদিনে শিঞ্জিনী পেটে এসে গেছে। দেখেশুনে অদ্ভুত শঙ্কায় মন ভরে যেত মৃদুলার। সারাক্ষণ বুকের ভেতর থির থির কাঁপুনি। এক ঝাক বিষাক্ত পোকা যেন মাথায় অবিরাম হুল ফুটিয়ে চলেছে। কী যে কষ্ট! কী যে নিদারুণ যাতনা!
মৃদুলা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কী করবে, কী করা উচিত, প্রথম দিকে ভেবে পাচ্ছিল না। একবার ভেবেছিল, মা-বাবাকে সব জানায়। পরক্ষণে মনে হয়েছে, তাঁরা ভেঙে পড়বেন। সে মনস্থির করে ফেলেছিল, অনির্বাণের সঙ্গে বোঝাঁপড়াটা নিজেই করে নেবে। এর মধ্যে আপাতত অন্য কাউকে জড়াবে না।
একদিন রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া চুকে যাবার পর শোওয়ার হতাড়জোড় চলছে, মৃদুলা বলেছিল, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। বসো খাটের এক কোনায় নিজে বসে অন্য প্রান্তটা দেখিয়ে দিয়েছিল সে।
মৃদুলার স্বরে চাপা কাঠিন্য মেশানো। একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতে তাকাতে খাটের অন্য কোনায় বাজুতে আলগা করে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিল অনির্বাণ। জিগ্যেস করেছে, কী কথা?
আমি যা বলব, তোমার কিন্তু ভালো লাগবে না।
ঠিক আছে। বলো–
একটু চুপচাপ।
তারপর পরিবেশটা লঘু করার জন্যই হয়তো অনির্বাণ বলেছে, আমি গর্দান দেবার জন্যে প্রস্তুত।
থমথমে মুখে মৃদুলা বলেছে, হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। যা বলব তার সঙ্গে তোমার আমার ভবিষ্যৎ অনেকখানি জড়িয়ে আছে।
দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিল অনির্বাণের। সে কোনও প্রশ্ন করেনি।
তরুলতার সঙ্গে অনির্বাণকে কবে কখন, কোন অবস্থায় দেখেছে, তাদের টুকরো টুকরো কী কথা কানে এসেছে, এবার তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গেছে মৃদুলা। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেয়নি। তারপর জিগ্যেস করেছে, অস্বীকার করতে পারো?
হতচকিত অনির্বাণ কী উত্তর দেবে, ভেবে পায়নি।
মৃদুলা গলায় স্বর উঁচুতে তুলে বলেছে, এ সবের মানে কী?
সরাসরি আক্রমণ এবং অতর্কিত। বর্ম পরে সেটা ঠেকাবার মতো যথেষ্ট সময় পায়নি অনির্বাণ। তবু খানিকটা সামলে নিয়ে বলেছে, তুমি ভুল বুঝেছ
মৃদুলার কপাল কুঁচকে গেছে, মানে?
তুমি যা ভাবছ তা নয়। বৌদি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো মনে করে। দিদি কি তার ভাইকে আদর করতে পারে না?
আমি যথেষ্ট সাবালিকা। দিদির আদর কী, সেটা আমাকে বোঝাতে হবে না। একটা কথা তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। এ ধরনের ব্যাপার আমি পছন্দ করি না।
অনির্বাণ বলেছিল, তুমি একটা ভুল ধারণা তৈরি করে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছ। এর কোনও মানে হয় না।
মৃদুলা উত্তর দেয়নি।
পরদিন তরুলতা মৃদুলার একটা হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে কাছে বসিয়েছিল। মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে গলার স্বরে অপার স্নেহ ঢেলে দিয়ে বলেছে, কী পাগল মেয়ে রে তুই! অনির্বাণ খুব দুঃখ পেয়েছে। মাথা থেকে ওই সব চিন্তা বার করে দে।
মৃদুলা চুপ। সে বুঝতে পারছিল, আগের রাতে সে যা যা বলেছে, অনির্বাণ সবই তরুলতাকে জানিয়ে দিয়েছে।
তরুলতা ফের বলেছে, তোকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল কে? আমি তো? আমার মত না থাকলে তুই কি এ বাড়ির বউ হয়ে আসতে পারতিস?
তরুলতা কী ইঙ্গিত দিতে চাইছে, মোটামুটি আঁচ করতে পারছিল মৃদুলা। কী চাইছিল সুন্দরী বিধবা তরুণীটি? যেহেতু তার পছন্দের জোরে বিয়েটা হয়েছে তাই মৃদুলাকে মুখ বুজে তার সব কিছু মেনে নিতে হবে?
মৃদুলা ফুঁসে উঠতে যাচ্ছিল তার আগেই হেসে হেসে ফের তরুলতা বলেছে, তুই দুঃখ পাস, এমন কিছু কি আমি করতে পারি? সন্দেহ আর দুশ্চিন্তাকে যদি প্রশ্রয় দিস, নিজের তো বটেই, পেটে যে বড় ইচ্ছে তারও ক্ষতি। এসময়টা মেয়েদের আনন্দে থাকতে হয়।
তরুলতা মিষ্টি মিষ্টি কথায় তাকে বোঝাতে চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু বুকের ভেতর সন্দেহের সে কাটাবন মাথা তুলতে শুরু করেছিল তা নির্মূল হয়নি।
রত্নময়ীর সঙ্গেও এই নিয়ে কথা হয়েছে মৃদুলার, তিনিও অন্যরকম কিছু বলেননি, তরুলতা যখন বউ হয়ে এ বাড়িতে এল, অনির্বাণ তখন সদ্য যুবক। মাত্র সতেরো কি আঠারো বছর বয়স। নিজের ভাইবোন নেই, স্বামীর ভাইটিকে বড় মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছিল তরুলতা। দুজনের সম্পর্কটা বড় মধুর। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র নোংরামি বা আবিলতা নেই। ইত্যাদি।
এরপর তরুলতা আর অনির্বাণ অনেকটা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। এমন কিছু চোখে পড়েনি যা আপত্তিকর। কিন্তু কোনও কোনও দিন রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলে মৃদুলা দেখতে পেত, পাশের জায়গাটা খালি, অনির্বাণ নেই। কখন যে উঠে গেছে, টের পাওয়া যায়নি।
চকিতে অ্যাটাচড বাথরুমের দিকে তাকিয়েছে মৃদুলা। সেটার দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। তড়িৎপ্রবাহের মতো কিছু একটা খেলে গেছে তার। বিছানা থেকে নামতে যাবে, তখনই ফিরে এসেছে অনিবার্ণ। জিগ্যেস করলে সে বলেছে, ঘুম আসছিল না, তাই বাইরের বারান্দায় গিয়ে পায়চারি করতে করতে সিগারেট খাচ্ছিল।
অনির্বাণের অজুহাতে খুঁত নেই। তবু বুকের সেই কাটাবনটা ক্রমশ ডালপালা ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
আর একদিন অনির্বাণকে বিছানায় না দেখে, দোতলায় শেষ মাথায় তরুলতার ঘরের সামনে গিয়েছিল মৃদুলা। বারান্দার দিকের জোড়া জানালার একটা পাল্লা ছিল ভোলা। ভেতরে অল্প পাওয়ারের নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছিল না।
মৃদুলা জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে দরজার পাল্লায় কান রেখে দাঁড়িয়েছিল। ঘরটা নিঝুম। সেখানে কোনও সাড়াশব্দ নেই।
সে যখন নিজেদের বেডরুমে ফিরে আসবে, হঠাৎ তরুলতার ঘরে বেশি পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠেছে এবং দড়াম করে দরজাটা খুলে গেছে। ফিরে আসা হয়নি মৃদুলার। পা দুটো কেউ পেরেক ঠুকে বারান্দায় গেঁথে দিয়েছে!
বিচিত্র হেসে তরুলতা বলেছিল কী রে, এখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস!
মৃদুলা এতটাই হকচকিয়ে গেছে যে উত্তর দিতে পারেনি।
আয়, ভেতরে আয় মৃদুলার হাত ধরে নিজের খাটে বসিয়ে তরুলতা জিগ্যেস করেছে, তারও কি অনির্বাণের মতো ইনসমনিয়ার ধাত নাকি?
অনির্বাণ বরাবরই অনিদ্রার ভোগে কিনা, মৃদুলার জানা ছিল না। তরুলতার কথাগুলোর মধ্যে কোনও ইঙ্গিত আছে কি? মৃদুলা বলেছিল, না। হঠাৎ আপনার এটা মনে হল কেন?
রহস্যময় হাসি লেগেই ছিল তরুলতার মুখে। সে বলেছে, ইনসমনিয়া বোধ হয় ছোঁয়াচে রোগ। এক ঘরে থাকা, এক বিছানায় শোওয়া। স্বামীর হলে স্ত্রীরও হতে পারে, তাই না রে?
মৃদুলা এক পলক তরুলতার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল।
হঠাৎ তরুলতার মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। হাসছিল ঠিকই, কিন্তু সে হাসি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিষ ঝরতে শুরু করেছিল। মৃদুলা কিছু বোঝার আগেই এক টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তরুলতা। খাটের চাদর বালিশ ওলটপালট করে, ড্রেসিং টেবলের দেরাজ আর আলমারির পাল্লা খুলে, এমনকী মৃদুলাকে জোর করে মেঝেতে বসিয়ে খাটের তলাটা দেখিয়ে জিগ্যেস করেছিল, পাওয়া গেল? তার গলায় সাপের শিসের মতো চাপা আওয়াজ। দুই চোখ জ্বলছিল।
মৃদুলা ভয় পেয়ে গেছে। তরুলতার মধ্যে এমন একটা হিংস্র চেহারা লুকনো ছিল, সে ভাবতে পারেনি। আড়ষ্ট হতে হতে বলেছে, কী পাওয়া যাবে?
যাকে খোঁজার জন্যে মাঝরাতে আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলি।
কারা যেন খড়ি পেতে ভূ-ভারতের সব খবর আগাম জেনে যায়, তরুলতা কি তাদের কেউ? রাতদুপুরে মৃদুলা যে এখানে হানা দেবে, তা কি সে টের পেয়ে গিয়েছিল? অনির্বাণকে হাতেনাতে ধরতে এসে চূড়ান্ত নাকাল হতে হয়েছে। না, তরুলতা ছাড়া এ-ঘরে আর কেউ নেই। মৃদুলার জবাব দেবার কিছু ছিল না। নতচোখে সে দাঁড়িয়ে থেকেছে।
যে হিংস্রতা আগুনের হলকার মতো বেরিয়ে এসেছিল, লহমায় অদৃশ্য খাপের ভেতর সেটা পুরে ফেলেছে তরুলতা। ফের তাকে আগের মতোই দেখাচ্ছিল। মুখে স্নিগ্ধ হাসি, দুচোখে অপার মায়া। মৃদুলার কপালে চুমু খেয়ে, স্নেহতরল গলায় বলেছিল, এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে নেই। বাচ্চাটার কথা একটু ভাববি তো? চল মৃদুলার কাঁধটা হাতে জড়িয়ে নিয়ে বারান্দার আধাআধি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তরুলতা।
কোনও মানুষ যে চকিতে এতটা বদলে যেতে পারে, কে জানত। এই ফণা-তোলা সাপিনী, পরক্ষণে মমতাময়ী নারী। পৃথিবীর সেরা নাট্যসম্রাজ্ঞীও বোধ হয় এতটা পেরে উঠত না।
ঘরে আসতেই চোখে পড়েছিল, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ শুয়ে আছে। চোখের তারা জ্বলে উঠেছিল মৃদুলার। জিগ্যেস করছিল, কোথায় গিয়েছিল?
মধ্যরাতে মৃদুলা কেন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তা জানাতে চায়নি অনির্বাণ। শুধু বলেছে, ছাদে গিয়েছিলাম
চাঁদ দেখতে?
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। মহাশূন্য থেকে হলুদ বর্ণের গোলাকার চাঁদ নীচের পৃথিবীতে জ্যোৎস্না চেলে যাচ্ছিল অবিরাম। অপার্থিব আলোয় ভরে যাচ্ছিল কলকাতা নামে খানাখন্দে আবর্জনায় বোঝাই, ভাঙাচোরা, কুৎসিত এই মহানগর।
অনির্বাণ যে ডাহা মিথ্যে বলেছে, সেটা তার মুখচোখের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। মৃদুলা শ্লেষের সুরে বলেছিল, এক বছরের ওপর আমাদের বিয়ে হয়েছে। এর ভেতর কতবার পূর্ণিমা এসেছে। আগে কখনও চঁদ দেখতে ছাদে উঠেছ বলে তো মনে পড়ে না।
আগে উঠিনি বলে, কোনওদিন উঠব না, তার কি কোনও মানে আছে? আজ ইচ্ছে হয়েছিল তাই ছাদে গিয়েছিলাম।
হঠাৎ এই প্রকৃতিপ্রেম চাড়া দিয়ে উঠল যে? কারণটা কী?
কোনও কারণ নেই।
তীব্র, কটু গলায় মৃদুলা বলেছে, আছে, আছে। লায়ার–মিথ্যেবাদী।
আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ভ্যাজর ভ্যাজর থামাও- বলে পাশ ফিরে শুয়েছিল অনির্বাণ।
অসহ্য ক্রোধে কপালের দুপাশের রগগুলো যেন ছিঁড়ে পড়বে। জ্বলন্ত চোখে অনির্বাণের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেছে মৃদুলা। এই পুরুষটির বেশিরভাগটাই দখল করে নিয়েছে এক কুহকময়ী নারী। তার ভাগে পড়েছে ছিটেফোঁটা। যার ষোল আনা প্রাপ্য সে কণিকা পরিমাণ নিয়ে খুশি থাকবে কেন?
মৃদুলা পরিষ্কার টের পাচ্ছিল, ওরা দুজনে বজ্জাতিটা চালিয়ে যাচ্ছে সঙ্গোপনে। সুকৌশলে। কিন্তু কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না।
মৃদুলার মাথায় দুরন্ত এক জেদ চেপে গিয়েছিল। যেভাবে হোক, অনির্বাণকে তরুলতার মুঠি থেকে বার করে আনবে।
এসব শিঞ্জিনীর জানার কথা নয়। সে তখন মায়ের গর্ভে জ্বণের আকারে। জন্মের বহুকাল পরে সে যখন বেশ বড় হয়েছে, মৃদুলা ধারাবাহিক তাকে সমস্ত জানিয়েছিল।
সেই যে সেদিন মাঝরাতে অনির্বাণের খোঁজে মৃদুলা তরুলতার ঘরে হানা দেয়, তার মাস তিনেক বাদে সে মা-বাবার কাছে চলে এসেছিল। মেয়ের প্রথম সন্তান জন্ম নিতে চলেছে, তার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন ইন্দ্রনাথ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা ভালো নার্সিংহোম ঠিক করা হয়েছিল।
বাপের বাড়ি এসেছিল ঠিকই, কিন্তু তার মনটা পড়ে থাকত বেলগাছিয়ায়। সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠা। তার সামনে প্রকাশ্যে অনির্বাণ আর তরুলতা নষ্টামি করত না। হয়তো চক্ষুলজ্জায়, হয়তো সাহসের অভাবে। এখন তো ওবাড়ি ওদের কাছে মুক্তাঞ্চল। যা ইচ্ছা করে বেড়াতে পারে। বাধা দেবার কেউ নেই। শাশুড়ি দেখেও দেখবেন না। শুনেও শুনবেন না। অন্ধ ও বধির হয়ে থাকবেন।
একেকবার মৃদুলার মনে হয়েছে, মা-বাবাকে সব খুলে বলে। পরক্ষণে তার অহংবোধে ধাক্কা লেগেছে। কী নেই তার? সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যৌবন।একটি পুরুষকে মুগ্ধ করার মতো সমস্ত কিছু। এ যুদ্ধটা তারই। যা করার সে নিজেই করবে। এর ভেতর অন্য কাউকে টেনে আনবে না। কোনও ভাবেই নয়।
নার্সিংহোমে ভর্তির আগে এবং পরে অনির্বাণ আর তরুলতা মাঝে মাঝেই মৃদুলাকে দেখতে আসত। বেশিরভাগ সময় আলাদা আলাদা, কখনও কখনও একসঙ্গে। রত্নময়ীর যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। তিনি বেশি আসতে পারতেন না।
অনির্বাণ আর তরুলতাকে একসঙ্গে দেখলে মাথায় আগুন ধরে যেত মৃদুলার, মুখ শক্ত হয়ে উঠত। ওদের সঙ্গে কথা বলত ঠিকই, তবে খুবই নীরস গলায়।
তার মনোভাব হয়তো বুঝতে পারত তরুলতা। কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করত, বোকা মেয়ে, অত ভাবিস কেন? তোর স্বামী তোরই আছে।
দাঁতে দাঁত চেপে মৃদুলা বলত, না, নেই।
হেসে হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাইত তরুলতা, কী যে বলিস!
ঠিকই বলি। আর সেটা আপনি নিজেও ভালো করে জানেন।
তোর পাগলামিটা আর কাটল না। অকারণে কী যে সন্দেহ?
অহেতুক কি সে সন্দেহ?
অহেতুক?
চোখের তারায় নিষ্ঠুরতা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেছে তরুলতার। খুব নরম গলায় বলেছে, নয়তো কী? আমার লঘুগুরু জ্ঞান নেই?
বিদ্রুপের সুরে মৃদুলা বলেছে, আছে বুঝি!
তরুলতা উত্তর দেয়নি।
মৃদুলা ভেবেছে, সে অনির্বাণের বৈধ স্ত্রী, তার সন্তানের জননী হতে চলেছে। তার জোর অনেক বেশি। শেষ দেখে তবে ছাড়বে। অন্য একটা চিন্তাও পাশাপাশি তার মাথায় ভর করত। একটা পোকায়-খাওয়া, দুশ্চরিত্র মানুষের জন্য শক্তিক্ষয় করার মানে হয় না। সঙ্গে সঙ্গে সেই গোঁ-টা তাকে পেয়ে বসত। একটা পুরুষকে সে জয় করে নিতে পারবে না?
.
শিঞ্জিনী শুনেছে তার জন্মটা মসৃণ নিয়মে হয়নি। মৃদুলার কী একটা শারীরিক সমস্যার কারণে দু-তিনটে বড় অপারেশন করতে হয়েছিল। স্বাভাবিক ডেলিভারি হলে যে সময় প্রসূতি আর বাচ্চাকে ছেড়ে দেবার কথা, তারও পর পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন নার্সিং হোমে থাকতে হয়েছিল মৃদুলাকে।
ইন্দ্রনাথ তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও অনেকদিন লেগেছে। এর মধ্যে যথারীতি তরুলতা আর অনির্বাণ তাকে এবং শিঞ্জিনীকে দেখতে এসেছে। রত্নময়ীও তিন-চার দিন নাতনিকে দেখে গেছেন।
হ্রদের ওপর দিকটা প্রশান্ত হলেও জলতলে প্রবল চোরা ঘূর্ণি থাকে। অনির্বাণদের দেখামাত্র নিজের মধ্যে তেমন কিছু তীব্রভাব অনুভব করত মৃদুলা।
শিঞ্জিনীর যখন সাত মাস বয়স, শ্বশুরবাড়ি ফিরে গিয়েছিল মৃদুলা। তার দিন সাতেকের মধ্যে সংসারে বড় রকমের একটা বিস্ফোরণ ঘটাল সে।
মৃদুলা আগেই লক্ষ্য করেছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে অনির্বাণদের কোনওরকম মাখামাখি ছিল না। মাখামাখি দূরের কথা, কেউ তাদের বাড়ি আসত না, তারাও কারও বাড়ি যেত না। তবে ঝগড়াঝাটি ছিল না। উদাসীনভাবে পরস্পরকে তারা এড়িয়ে চলত।
আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন যেন আলগা আলগা। কারও বাড়িতে কোনও কাজ থাকলে–বিয়ে, শ্রাদ্ধ, মুখেভাত-~~কেউ এসে নেমন্তন্ন করে যেত। ব্যস, এই পর্যন্ত। বেশির ভাগ জায়গায় অনির্বাণরা যেত না। কাউকে দিয়ে উপহার পাঠিয়ে দিত।
সেদিন মধ্যমগ্রামে অনির্বাণের এক মামাতো ভাইয়ের বিয়ে। সম্পর্কটা খুব কাছের। না গিয়ে উপায় নেই। অনির্বাণ রত্নময়ী আর মৃদুলাকে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে বিয়েবাড়ি গিয়েছিল। তরুলতাকে বারবার বলা সত্ত্বেও যায়নি। শিঞ্জিনীকে নিয়ে বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল। আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে রত্নময়ী আর অনির্বাণ কদাচিৎ গেলেও তরুলতা কখনও যেত না।
বিয়েবাড়িতে গিয়ে একটা ব্যাপার নজরে পড়েছে মৃদুলার। আত্মীয়দের অনেকেই, বিশেষ করে মহিলারা তাকে লক্ষ্য করছিল। তাদের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যাতে সে আদৌ স্বস্তি বোধ করছিল না।
এদিকে রত্নময়ী মৃদুলার কাছছাড়া হচ্ছিলেন না। প্রায় তার গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে ছিলেন। এবং সারাক্ষণ তাকে আগলে আগলে রাখছিলেন। কেউ তাকে কিছু জিগ্যেস করলে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। মৃদুলাকে মুখ খুলতেই দিচ্ছিলেন না। নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। শাশুড়ির এই আচরণ খুবই দৃষ্টিকটু লেগেছে মৃদুলার। অত্যন্ত অস্বাভাবিকও।
একসময় কে যেন রত্নময়ীকে অন্য একটা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। মৃদুলাকে একা রেখে যাবার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না তার। কিন্তু বিষয়টা এমন জরুরি যে না গিয়েও উপায় ছিল না।
যে ঘরে মৃদুলা আর রত্নময়ীকে বসানো হয়েছিল সেটা প্রমীলা রাজ্য। শুধু মহিলা আর মহিলা। হাসি-ঠাট্টা-গল্পে তারা আসর জমিয়ে রেখেছিল। বিয়েবাড়িতে যেমন হয় আর কী। এরা সবাই অনির্বাণদের আত্মীয়। এখানে এসেই তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মৃদুলার। হয়তো তার বৌভাতে এরা গিয়েও ছিল। সেই কবে অল্পক্ষণের জন্য এদের দেখেছে। যাতায়াত না থাকায় তাদের মুখ ভুলেও গিয়েছিল।
রত্নময়ী চলে যাবার পর হঠাৎ একটি মহিলা–বেশ সুন্দরী, চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, মেদহীন ছিপছিপে চেহারা, হাতে গোছ গোছ সোনার চুড়ি, গলায় হীরের নেকলেস, কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ, নাম লতিকা উঠে এসে মৃদুলার পাশে ঘন হয়ে বসেছিল। খানিক আগেই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সম্পর্কে অনির্বাণের কীরকম বৌদি। কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে সে বলেছে, রত্নময়ী মাসি তোমাকে পাহারা দিচ্ছিলেন, তাই ভালো করে কথা বলতে পারিনি। তুমি দেখতে এত সুন্দর। শুনেছি, খুবই শিক্ষিত। মা-বাবার একমাত্র সন্তান। কলকাতায় বাড়ি আছে। বাবার টাকা-পয়সার অভাব নেই। দেশে তোমার মতো মেয়ের জন্য কোনও সৎ পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না? তোমার বাবা ভালো করে খোঁজখবর না নিয়েই বিয়েটা দিয়ে দিলেন।
লতিকা কী ইঙ্গিত দিয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবু চকিত হয়ে উঠেছে মৃদুলা মানে!
লতিকা বলেছিল, অনির্বাণের কথা বলছি। তরুলতার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা কী, টের পাওনি? জঘন্য, নোংরা মেয়েমানুষ। ওর জন্যে অনির্বাণের দাদা সুকুমার বাসের নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। রত্নময়ী মাসিরা অবশ্য অ্যাকসিডেন্টও বলে চালায়। একটু চুপ করে থেকে তীব্র, চাপা গলায় বলেছে, অ্যাকসিডেন্টও নয়, আত্মহত্যাও নয়। ওটা খুন। সুকুমার ছিল সরল, ভালোমানুষ। তরুলতা আর অনির্বাণ ওর ওপর এমন মানসিক নির্যাতন শুরু করেছিল যে শেষ পর্যন্ত চরম পথটাই বেছে নিয়েছে। সুকুমারের জন্যে এত কষ্ট হয় যে বলে বোঝাতে পারব না।
সুকুমারের মৃত্যুরহস্য এতদিনে পরিষ্কার হয়েছিল। মৃদুলা জিগ্যেস করেছে, সুকুমারদা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত তো একদিনে নেননি। দিনের পর দিন নিজের স্ত্রী আর ভাইয়ের আচরণে কষ্ট পেতে পেতে তবেই না ভেবেছিলেন বেঁচে থাকার অর্থ নেই।
নিশ্চয়ই।
আত্মহত্যা, বা অ্যাকসিডেন্ট বা খুন, যাই হোক না, আমার শাশুড়ি কি তার কারণটা বুঝতে পারেননি? তা হলে মুখ বুজে ছোট ছেলে আর বড় বউর কুকীর্তি সহ্য করে গেছেন কেন?
আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর নেই। মনে হয়, রত্নময়ী মাসি তরুলতাকে ভীষণ ভয় পায়।
একটু নীরবতা।
তারপর লতিকা বলেছে, নিশ্চয়ই অনির্বাণ আর তরুলতার নানা ব্যাপার তোমার চোখে পড়েছে। ব্যাপার বলতে কী বোঝাতে চাইছি, আশা করি বুঝতে পারছ।
অবশ্যই বুঝতে পেরেছে মৃদুলা। লতিকা ঠিক কী বলতে চায়, শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল সে।
লতিকা এবার বলেছে, এমন একটা জঘন্য মেয়েমানুষের সঙ্গে এক বাড়িতে আছ কী করে? ও যে ধরনের নোংরা চরিত্রের মহিলা তাতে একদিন তোমার অবস্থা ঠিক সুকুমারের মতো করে ছাড়বে। যে করে থোক, ওকে তোমাদের বাড়ি থেকে তাড়াও। পারলে
এই সময় রত্নময়ী ফিরে এসেছিলেন। লতিকা আর এক মুহূর্তও বসে থাকেনি। ঝটিতি উঠে গিয়ে খানিক দূরে অন্য মহিলাদের জটলায় মিশে গিয়েছিল।
কপাল কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে কয়েক পলক লতিকার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন রত্নময়ী। তবে লতিকা সম্পর্কে সেই মুহূর্তে মৃদুলাকে কোনও প্রশ্ন করেননি।
লতিকা উঠে যাবার আগে মৃদুলার মাথায় কোনও বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ আগেই সে জেনেছে, সুকুমারের জীবনটা অনির্বাণ আর তরুলতা নষ্ট করে দিয়েছে। তাকেও তিল তিল করে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মৃদুলা তখনই মনস্থির করে ফেলেছিল, কোনওভাবেই আর বরদাস্ত করবে না।
বিয়েবাড়ি থেকে বেড়া আগুনের ভেতর দিয়ে পুড়তে পুড়তে যখন রত্নময়ীদের সঙ্গে ফিরে এসেছিল, তখন মাঝরাত পার হয়ে গেছে। ফিরেই তরুলতার দিকে তোপ দাগতে শুরু করেছিল, এ-বাড়িতে আপনার আর জায়গা হবে না। কাল সকালে উঠেই চলে যাবেন।
মৃদুলা তখন অগ্নিমুর্তি। তাকে এমন চেহারায় আগে কখনও দেখেনি তরুলতারা। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
তরুলতা তোতলাতে তোতলাতে বলেছে, কী-কী বলছ তুমি! এর–এর মানে কী?
প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে অনির্বাণ আর রত্নময়ী পালটা আক্রমণের জন্য ততক্ষণে নিজেদের প্রস্তুত করে নিয়েছেন।
রত্নময়ীর মাথায় খুন চলে গিয়েছিল, এত সাহস তোমার! বড় বৌমাকে তাড়াতে চাইছ! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! মাথা নীচু করে যদি থাকতে হয় তো এ বাড়িতে থাকবে। নইলে দরজা খোলা আছে। চিৎকার করতে করতে তাঁর গলার স্বর চিরে বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল, ওর সম্বন্ধে তোমার কানে বিষ ঢালল কে? নিশ্চয়ই লতিকা?
বিয়েবাড়িতে লতিকাকে তার পাশে দেখে কিছু একটা সন্দেহ যে রত্নময়ী করেছেন, তখনই আন্দাজ করা গিয়েছিল। একবার কামানের গোলা ছোঁড়া হয়ে গেছে। আর পিছু হটার উপায় নেই। গলার স্বর আরও চড়িয়ে মৃদুলা বলেছে, অন্যের বিষ ঢালতে হবে কেন? জানেন না, আপনার বড় বৌমাটি কত বড় বদমাশ, দুশ্চরিত্র। নিজের স্বামীকে তো শেষ করেছেই—
বাধা দিয়ে অনির্বাণ গর্জে উঠেছে, বৌদি সম্পর্কে আর একটা বাজে কথা বললে তোমাকে এক্ষুনি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।
মৃদুলা খুব ঠান্ডা গলায় বলেছে, তোমার এত ক্ষমতা!
হ্যাঁ, হ্যাঁ। এটা আমাদের বাড়ি। যখন–।
তোমাদের বাড়ি! মানে তোমার আর ওই বজ্জাত মেয়েমানুষটার।
বিদ্রুপে মুখ কুঁচকে গেছে মৃদুলার। গলার স্বর শাণিত করে, টেনে টেনে এবার সে বলেছে, তোমাদের কীর্তির কথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারও জানতে বাকি নেই। ধরো, কাল পাড়ার লোজন আর তোমার আত্মীয়দের ডাকিয়ে আনলাম। বিয়ের পর যা আমার চোখে পড়েছে, দিনের পর দিন যেভাবে মানসিক টরচার সহ্য করেছি- সব তাদের বললাম। তারপর জিগ্যেস করলাম, এই নোংরা ব্যাপারগুলোর প্রতিবাদ করেছি বলে তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে চাইছ। তাদের জিগ্যেস করব, আপনারা কী বলেন?
রত্নময়ীদের মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মৃদুলাকে থামিয়ে দিয়ে ত্রস্ত সুরে অনির্বাণ বলেছে, সত্যিই তুমি ওদের ডাকবে নাকি?
তার কথা কানেই তোলেনি মৃদুলা। একটানা সে বলে যাচ্ছিল, তারপর ধরো, একদিন তোমার অফিসে গিয়ে তোমাদের জেনারেল ম্যানেজার, ডাইরেক্টরস বোর্ডের মেম্বার আর কলিগদের সঙ্গে দেখা করে তোমাদের গুণকীর্তন করলাম
বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল অনির্বাণকে। কাঁপা গলায় সে জিগ্যেস করেছে, আমাদের অফিসেও যাবে?
মৃদুলা বলেছে, কী মনে হয় তোমার? বাড়ি থেকে যখন বার করে দিতে চাইছ, আর মুখ বুজে আমি যদি তোমার এই হুকুমটা তামিলই করি, লোকে কী বলবে? ভাববে দোষটা আমার। যাবার আগে সবার সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া দরকার কিনা, তুমিই বলো
বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থেকেছে অনির্বাণ। কী উত্তর দেবে, ভেবে পায়নি।
মৃদুলা এবার তরুলতা আর রত্নময়ীর দিকে তাকিয়েছে, আমি এতক্ষণ যা বললাম সেটা ঠিক না? আপনারা কী করতে বলেন?
দুই রমণী একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিল।
মাথাটা আস্তে আস্তে ডাইনে-বাঁয়ে নাড়তে নাড়তে মৃদুলা এবার বলেছে, আমি কারও কাছেই যাচ্ছি না। একটা কথা পরিষ্কার করে আপনাদের বুঝিয়ে দিতে চাই। আমি কিন্তু সুকুমার দত্তের মতো দুর্বল নই। কোনওদিন গাড়ির তলায় লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে পারব না। লোকজন জুটিয়ে সিন ক্রিয়েটও করব না। কারও সাহায্যেরও আমার দরকার নেই। যা করার আমি নিজেই করব।
বড় হবার পর এই ব্যাপারটা নিয়ে শিঞ্জিনীর সঙ্গে মৃদুলার অনেকবার কথা হয়েছে। উত্তেজিত শিঞ্জিনীর একটাই প্রশ্ন বা অভিযোগ। কেন মা তার বাপের বাড়ি ফিরে আসেনি? ওই রকম একটা কদর্য পরিবেশে একটা বদ, নোংরা লোকের সঙ্গে কেন অনেক আগেই সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেনি?
মৃদুলা মেয়েকে প্রতিবারই এক উত্তর দিয়ে গেছে। অনিবার্ণকে ভালোবেসে সে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকেনি। এটা হল অহংবোধ এবং অধিকারের প্রশ্ন। একটা নষ্ট মেয়েমানুষ তার নিজস্ব পুরুষটিকে ছিনিয়ে নেবে, সেটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই বেলগাছিয়াতেই থেকে নিদারুণ শক্তি পরীক্ষায় নেমেছিল সে।
বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে সেদিন মৃদুলা যে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিল তার ফল কিন্তু হাতেনাতেই ফলেছিল। পরদিন পাতিপুকুরে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল তরুলতা। মৃদুলা শুনেছে, সেখানে তার শয্যাশায়ী বৃদ্ধা মা আর তাকে দেখাশোনার জন্য দু-তিনটে কাজের লোক ছাড়াও দূরসম্পর্কের এক পিসি ছিল। পিসি বিধবা। জগৎ-সংসারে তার কেউ নেই। তরুলতাদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যাবার জায়গা ছিল না তার। টাকা-পয়সার অভাব অবশ্য ছিল না। মৃত্যুর আগে তরুলতার বাবা ব্যাঙ্কে প্রচুর রেখে গেছেন। সেখান থেকে যথেষ্ট ইন্টারেস্ট পওয়া যেত।
যাবার আগে তরুলতা বলেছিল, আমি চললাম। এবার শান্তিতে থাকতে পারবি তো?
তরুলতা কী ইঙ্গিত দিয়েছিল, তখন বুঝতে পারেনি মৃদুলা। আশ্চর্য, অত কাণ্ডের পরেও দিন কুড়ি-বাইশ বাদে পাতিপুকুর থেকে ফিরে এল সে। মৃদুলার একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলেছিল, রূপাটার জন্যে মন ভীষণ খারাপ লাগছিল। তাই চলে এলাম। রাগ করিস না– শিঞ্জিনীর ডাকনাম রূপা তারই দেওয়া।
কয়েকটা দিন মোটামুটি ভালোই কাটল। তারপর সেই আগের মতোই লুকিয়ে-চুরিয়ে নষ্টামি শুরু হল। মেয়েমানুষ একবার খারাপ হয়ে গেলে তার স্বভাব কি সহজে শোধরায়? শিঞ্জিনীর টানে তরুলতা বেলগাছিয়ায় এসেছে, পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি মৃদুলা। ওদের নজরে নজরে রেখেছিল। একদিন ধরেও ফেলেছে দুজনকে। তারপর ফের অশান্তি। আবার তরুলতাকে পাতিপুকুরে পাঠিয়ে দিয়েছে মৃদুলা। কিন্তু দু-চার মাস পর আবার সে ফিরে এসেছে।
পাতিপুকুর আর বেলগাছিয়া, এই করেই কবছর কাটিয়ে দিয়েছে তরুলতা। অনিবার্ণকে অনেক বুঝিয়েছে মৃদুলা, একটা নষ্ট মেয়েমানুষের দখল থেকে তাকে বার করে আনতে শতভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হয়নি।
হঠাৎ মৃদুলা জানতে পারল, তরুলতা যখন পাতিপুকুরে থাকে সেই সময় মাঝে মাঝেই অফিসে যাবার ছুতো করে সেখানে চলে যায় অনির্বাণ। ওর যা কাজ তাতে কয়েক মাস পর পর দু-চার দিনের জন্য দিল্লি, চেন্নাই কি হায়দ্রাবাদে টুরে যেতে হয়। অফিস থেকেই পাঠায়। অনেক সময় এই সব ট্যুরে তরুলতাকে গোপনে সঙ্গে নিয়ে যায় সে। তরুলতার অথর্ব পঙ্গু মায়ের সাধ্য নেই তাদের ঠেকান। এই খবরগুলো পাওয়ার পরই মৃদুলা মনস্থির করে ফেলে। মেয়েকে নিয়ে সোজা চলে আসে মা-বাবার কাছে।
তারপর আইন-আদালত। ডিভোর্সের মামলা। একমাত্র মেয়ের বিবাহিত জীবনের এমন শোকাবহ পরিণামের ধাক্কাটা সামলাতে পারেননি অন্নপূর্ণা। আগেই নানা রোগে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। মৃদুলা পাকাপাকি তাদের কাছে চলে আসার চার মাসের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
ইন্দ্রনাথের শরীর-স্বাস্থ্যের হাল ভালো ছিল না। অসুখে-বিসুখে তিনিও যথেষ্ট কাহিল। কিন্তু মনের জোর ছিল প্রচণ্ড। মামলার সময় সর্বক্ষণ মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহস যুগিয়েছেন। নিজের সঞ্চয় ভেঙে জলের মতো টাকা খরচ করেছেন।
ডিভোর্সের কেসটা প্রায় একতরফাই হয়েছিল। পাছে জেরার মুখে পারিবারিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির পচা দুর্গন্ধ বেরিয়ে পড়ে তাই অনিবার্ণরা কোর্টে কদাচিৎ এসেছে। তবে শিঞ্জিনীকে ওরা সহজে ছাড়তে চায়নি। তাকে পাওয়ার জন্য তিন বছর মামলা চালিয়ে গেছে। বেলগাছিয়ার পরিবেশটা কেমন সবিস্তারে কোর্টকে জানিয়ে মৃদুলার আর্জি ছিল, ওখানে থাকলে মেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে। শিঞ্জিনীর জীবন যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য মৃদুলার কাছেই তার থাকা দরকার। আদালত তার পক্ষই রায় দিয়েছিল। তবে ইচ্ছা করলে অনির্বাণ সপ্তাহে একদিন মেয়েকে তার দাদামশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতে পারে।
অনির্বাণ কিন্তু কোনওদিনই প্রাক্তন শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে দেখতে আসেনি। প্রথম দিকে বছরখানেক মাঝে মাঝে ফোন করত। তারপর কবেই তা বন্ধ হয়ে গেছে।
বিয়ের আগেই এম.এটা পাশ করেছিল মৃদুলা। মামলা-টামলা চুকে যাবার পর কম্পিউটারের কী একটা ট্রেনিং নিয়ে বিরাট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে সে। ইচ্ছা করলে অনেক আগেই ফের বিয়ে করতে পারত কিন্তু অনির্বাণের সঙ্গে কটা বছর কাটিয়ে পুরুষ সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা সে ভাবতেও পারত না। শিঞ্জিনীই ছিল তার সর্বস্ব।
যে মৃদুলা মেয়েকে পাওয়ার জন্য কটা বছর দাঁতে দাঁত চেপে অবিরল যুদ্ধ করে গেছে, পুরুষ জাতিকে যে চরম ঘৃণা করে, আজ তার মুখে বিমলেশ বসুমল্লিকের নাম শোনা গেল। বিদ্বেষ নয়, অশ্রদ্ধা নয়, অচেনা শিল্পপতিটি সম্পর্কে তার প্রতিটি কথা থেকে বেরিয়ে আসছিল চাপা উচ্ছ্বাস। নাকি স্তুতি?…
….জানালার বাইরে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। আজ রাতে থামবে বলে মনে হয় না। মেঘ ডাকার বিরাম নেই। কাছে-দূরে সমানে বাজ পড়ছে।
শিঞ্জিনীর খেয়াল হল, তার দুচোখ জলে ভরে গেছে।