দস্যু বনহুরের মৃত্যুদন্ড

দস্যু বনহুরের মৃত্যুদন্ড

‘দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড’ কান্দাই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার বড় বড় অক্ষরে লেখা শব্দটার দিকে তাকিয়ে আছে মনিরা। গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। অব্যক্ত একটা বেদনা গুমড়ে কেঁদে ফিরছে তার মনের মধ্যে। তুষের আগুনের চেয়েও সে জ্বালা তীব্র দাহময়।

মনিরার জীবন শিশুকাল থেকেই দুঃখ আর ব্যথায় গড়ে উঠেছে তিল তিল করে। স্নেহ মায়া মমতার অভাব সে পায়নি কোন দিন, কিন্তু তবু সে বড় অপেয়া। জীবনভর শান্তির ছোঁয়া কোনো সময় তার জীবনকে সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত করতে পারেনি। চন্দ্র গ্রহণের মত কালকুট রাহুগ্রস্ত মনিরা। বসন্তের আহ্বানে বসুন্ধরা যেমন ফুলে ফুলে ভরে উঠে, তেমনি প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী মনিরার দেহমনে এসেছে ভাবের আবেগ, যৌবনের কোঠায় পা দিয়েই পেয়েছে নির্মম আঘাত, মায়ের মৃত্যুশোক ভুলতে না ভুলতেই স্নেহময় মামাজানকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে। হাঁ, ভুলে গিয়েছিলো মনিরা তার শিশুকালের সাথী মনিরকে, বিস্মিত হয়েছিলো তার সব কথা। অতো ছোটবেলায় ছিলোনা কোনো প্রীতির বন্ধন, ছিলোনা হৃদয়ের নিভৃত কোণের কোনো স্পন্দন। মনির হারিয়ে গিয়েছিলো- এতটুকু অনুভূতি জাগেনি কোনো দিন তার মনে।

কালের অতলে তলিয়ে গিয়েছিলো সেদিনের সেই নৌকাডুবির কথা। স্বপ্নের মতও মনে হতো না তার, মনে হতো একটা গল্পে শোনা কাহিনীর মত। তার জীবনে একদিন যে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো, ভাবতেও পারতো না মনিরা কোনো সময়।

জীবন জোয়ারে ক্ষুদ্র একটা স্মৃতিকণা কুটার মতই ভেসে গিয়েছিলো কোন্ অজানার অতলে। সেদিন কি মনিরা ভেবেছিলো, আবার একদিন এই ক্ষুদ্র স্মৃতিটুকু তার মনের গহনে প্রচণ্ড আলোড়ন জাগাবে।

সব কথা ছাপিয়ে আজ বারবার মনে পড়ছে– নাহার মঞ্জিলে কেন গিয়েছিলো সে–মনে পড়ছে স্বামীর প্রতিটি কথা। সেতো যেতে চায়নি, মনিরাই তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো ঐ অলক্ষুণে প্রেতপুরীতে। যেখানে সে হারিয়েছে তার জীবনের সব আলো। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুলে। কাঁদে মনিরা।

নির্বোধ শিশুর মতই অঝোরে কাঁদে মনিরা, কোনো সান্ত্বনাই সে খুঁজে পায় না আজ। অকূল সাগরে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে মনিরা। দিশেহারার মত ঝাপসা চোখে তাকায় সে আংগুলের ফাঁকে পাশে পড়ে থাকা পত্রিকাখানায়, দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড’, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠে– না না, এ হতে পারে না, এ হতে পারে না– ওর মৃত্যুর পূর্বে আমি মৃত্যুবরণ করে নেবো।

মনিরা বালিশে উবু হয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করেন মরিয়ম বেগম। দরজার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে তাকান কক্ষমধ্যে। মনিরাকে বিছানায় লুটিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে দেখে হৃদয়টা তার যেন চুরমার হয়ে। যায়। অতি কষ্টে নিজকে সংযত করে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে মনিরার পাশে গিয়ে বসেন, হাত রাখেন তার পিঠে– মা মনিরা!

না, হঠাৎ মামীমার করস্পর্শে মনিরা তার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে– একি হলো মামীমা।

পুত্রের মৃত্যুদণ্ড সংবাদ শ্রবণে কোন্ মা না বিচলিত হয়। কোন্ মার হৃদয়ে না দারুণ আঘাত লাগে। বিশ্বের সবকিছু ত্যাগ করতে পারে কিন্তু কোনো মা কি পারে সন্তানকে ত্যাগ করতে। দস্যু বনহুরের মৃত্যু সংবাদ শোনা অবধি মরিয়ম বেগমের হৃদয়ে তুষের আগুন জ্বলছিলো, চূর্ণ-বিচূর্ণ অন্তর নিয়ে তিনি ছটফট করছিলেন। পৃথিবীর কোথাও যেন নেই এতটুকু শান্তির ছোঁয়াচ। যেদিকে তাকাচ্ছিলেন সব যেন গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছিলো। আলো, এতটুকু আলো যেন নেই কোথাও।

ঘরে, বাইরে, খোলা ছাদে একটু শান্তির জন্য বারবার গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন মরিয়ম বেগম। কিসের সন্ধানে হাহাকার করে উঠছিলো তার মন। তখনও মুক্ত জানালায় দাঁড়িয়ে তাকাচ্ছিলেন সীমাহীন আকাশের দিকে। নেই কোথাও একটু শান্তি নেই। বুকের মধ্যে তার কান্নার রোল উঠছিলো কিন্তু চোখে পানি আসছিলো না। বুকটা যদি পাথরের তৈরি হতো, তাহলে এতক্ষণ ফেটে চৌচির হয়ে যেতো। লোহা হলেও বুঝি গলে যেতো– এত আগুন সহ্য হতো না।

মরিয়ম বেগম মনিরার কথায় কোনো জবাব দিতে পারলেন না। বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠলো একটা ব্যথার কাটা। হৃৎপিন্ডটা যেন হাতুড়ির আঘাতে কেউ থেতলে দিচ্ছিলো কাবাবের মাংসখণ্ডের মত কুচি কুচি করে।

মনিরার কান্নার সঙ্গে যোগ দিয়ে তারও ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, কিন্তু কান্না যে আসছিলো না। জমাট বরফের মত জমে গিয়েছিলো তার বুকের ভিতরটা।

বলে উঠলেন মরিয়ম বেগম– কাদিস না মনিরা। দেখছিস না, আমি মা হয়ে কেমন পাষাণ হয়ে গেছি! বুকটা আমার পাথরের মত শক্ত হয়ে উঠেছে। কাঁদতে চাইলেও কান্না বেরোয় না। মনিরা, শুধু আজ নয় আমি ছাব্বিশটা বছর ধরে ওর জন্য কেঁদেছি। কেঁদে কেঁদে শুকিয়ে গেছে আমার ভিতরটা, আর এক ফোঁটা অশ্রু নেই আমার চোখে।

মামীমা, আমি যেন আর পারছি না! ওর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। সেদিন ওকে আমি জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম, আমি জানতাম না নিজের মাথায় নিজে কুঠারাঘাত করতে চলেছি। মামীমা, যেতে চায়নি– ও যেতে চায়নি—

মনিরার চোখের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠে মরিয়ম বেগমের বুকের বসন। চোখের অশ্রু নেই, মুখে কথা নেই! পলক পড়ছে কিনা বোঝা যায় না। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত বসে থাকেন তিনি।

অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে কিছুটা হাল্কা হয়ে আসে মনিরার বুকের ভিতরটা। আঁচলে চোখ মুছে নিয়ে সোজা হয়ে বসে সে। বলে– মামীমা, ওকে বাঁচানোর কি কোনো উপায় নেই?

আচম্বিতে মরিয়ম বেগম যেন পাল্টে যান, দৃঢ় কণ্ঠে বলেন– না। ওকে বাঁচাতে চাইনে। ওকে মরতে দে… ওকে মরতে দে…তবু নিশ্চিন্ত হবো। তিল তিল করে যে তুষের আগুন আমার বুকের মধ্যে দাহ করে চলেছে, একবারে সে আগুন নিভে যাবে– নিভে যাবে–

এ তুমি কি বলছো মামীমা! এ তুমি কি বলছো?

আর সহ্য হয় না। কোন অলক্ষুণে মুহূর্তে ওর জন্ম হয়েছিলো। কোন অশুভ মুহূর্তে—

না না, তুমি জানো না মামীমা, অলক্ষুণে সে নয়, অশুভ মুহূর্তেও তার জন্ম হয়নি।

তুই জানিসনে মনিরা, ওর জন্মাবার পর থেকে আমি মনে শান্তি পাইনি। কেন যেন ওর মুখের দিকে তাকালেই মন আমার আনন্দের চেয়ে নিরানন্দে ভরে উঠতো। কেন জানিস? মনে হতো এত সুন্দর জিনিস কোনোদিন থাকবার নয়। ফুল ফোটে-ঝরে যায়। চাঁদ হাসে, আবার অন্ধকার আসে। কেন যেন আমার মনে হতো ওকে আমি ধরে রাখতে পারবো না, কখন হারিয়ে ফেলবো–কখন হারিয়ে যাবে–যেমন মানিক সিন্দুকে রেখেও মালিক শান্তি পায় না। ঠিক আমার অবস্থাও তেমনি ছিলো–কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন মরিয়ম বেগম শেষ পর্যন্ত আমার। আশঙ্কায় পরিণত হলো, হারালাম আমার মাথার মনি– পারলাম না কিছুতেই তারে ধরে রাখতে– পারলাম না– মরিয়ম বেগমের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে আসে দু’ফোঁটা তপ্ত অশ্রু।

মনিরা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো– মামীমা, আমিও পারলাম না ওকে ধরে রাখতে– কিন্তু–আমি বেঁচে থাকবো আর ও চলে যাবে! না না, এ হতে পারে না–এ হতে পারে না–মনিরা।

কক্ষ থেকে বেরিয়ে পাশের কক্ষে চলে যায়।

*

ক্ষিপ্তের ন্যায় পায়চারী করে চলেছে রহমান। দক্ষিণ হাতের মুঠায় তার কান্দাই দৈনিক পত্রিকা। মাঝে মাঝে পত্রিকাখানায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অধর দংশন করছে সে। চোখেমুখে ফুটে উঠেছে একটা ক্রুদ্ধ হিংস্র ভাব। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ফুটে উঠেছে তার ললাটে। ভোরে শিশির বিন্দুর মতই চকচক করছে দরবার-কক্ষের মশালের আলোতে।

একটা পাথরখণ্ডের পাশে দণ্ডায়মান নূরী। আজ তার শরীরে ঘাগড়া আর ওড়না নয়। চুলটাও সাপের মত বিনুনী করে ঝুলে পড়েনি পিঠের উপরে। পুরুষের মত প্যান্ট আর চোস্ত সার্ট, মাথার পাগড়ি, চুলগুলো তারই মধ্যে বেশ করে জড়ানো। মুখভাব গম্ভীর ইস্পাতের মতই শক্ত হয়ে উঠেছে।

দরবার কক্ষের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য দস্যু। বলিষ্ঠ মজবুত চেহারা, শরীরে জমকালো পোশাক, মাথায় পাগড়ি এবং প্রত্যেকের হাতেই রাইফেল আর বন্দুক। মুখে গালপাট্টা বাঁধা সকলের। এরা দস্যু বনহুরের পাতাল গহ্বরের অনুচর, নিতান্ত প্রয়োজন নাহলে এদের বাইরে বের করা হয় না। এরা যেমন দুর্ধর্ষ, তেমনি ভয়ঙ্কর। এরা মারতেও ভয় করে না, মরতেও না। যেমন সাহসী তেমিন তেজোদীপ্ত এরা। দস্যু বনহুরের অংশগুলি হেলনে এরা উঠে এবং বসে।

রহমান আজ সর্দারের এই বিপদ মুহূর্তে এদের বের না করে পারলো না।

কায়েসও অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছে তাদের সর্দারের জন্য। সেও উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। সকলেরই মুখোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে একটা কঠিন ভাব।

থমকে দাঁড়িয়ে বলে উঠে রহমান- ভাইসব, তোমরা জানো আজ আমরা রাজাহারা প্রজা হয়ে পড়েছি। সর্দার আজ পুলিশের কারাকক্ষে বন্দী, শুধু বন্দী নয় তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। হঠাৎ উন্মাদিনীর ন্যায় হেসে উঠে নূরী– হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ তারপর হাসি থামিয়ে বলে– দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড হাঃ হাঃ হাঃ। দাঁত পিষে বলে আবার নূরী– কার সাধ্য দস্যু বনহুরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। রহমান, তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও, আজ রাতে কান্দাই পুলিশ অফিসে হামলা চালাবো।

রহমান কিছু বলবার পূর্বেই ক্রুদ্ধ অনুচরগণ বজ্রধ্বনি করে উঠে– নূরী রাণী কি জয়! নূরীরাণী কি জয়! আজ আমরা কান্দাই পুলিশ অফিসে হামলা চালাবো।

রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে পুলিশ অফিসে হানা দিয়ে সর্দারকে উদ্ধার করা যাবে না নূরী। এতে রক্তপাত ছাড়া লাভ হবে না কিছু।

নূরী দাঁতে দাঁতে পিষে বলে উঠলো শুধু পুলিশ অফিস নয় রহমান, সমস্ত শহরে আগুন জ্বালিয়ে দেবো। আমার হুরকে ওরা হত্যা করবে– এত সাহস ওদের।

নূরী, বিচারে সর্দারকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, এর জন্য দায়ী নয় পুলিশ বাহিনী বা কান্দাইয়ের জনগণ।

তবে কে দায়ী?

দায়ী আইন। পুলিশ আইনের দাস, তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছে।

রহমান!

নূরী, তুমি যেভাবে উত্তেজিত হচ্ছে তাতে ফল হবে না, খুব চিন্তা করে কাজ করতে হবে।

তবে কি করতে চাও রহমান? এতগুলো অনুচর থাকতে তোমরা সর্দারের মৃত্যু দেখতে চাও?

উপায় কি?

এবার নূরী ক্ষিপ্তের ন্যায় চিৎকার করে উঠে– রহমান, তুমি সর্দারের মৃত্যু কামনা করো! একে বন্দী করো কায়েস।

রহমান এবার হেসে উঠলো– নূরী, তুমি উন্মাদ হয়ে পড়েছে।

না, আমি উন্মাদ হইনি।

তাহলে তুমি এতক্ষণে আমাকে বন্দী করবার জন্য কায়েসকে নির্দেশ দিতে না।

তুমি বিশ্বাসঘাতক।

নূরী, জবান সংযত করে কথা বলো। নারী বলে তোমাকে ক্ষমা করলাম। অন্য কেউ হলে এতক্ষণ তার বুকের রক্তে দরবার কক্ষের মেঝে লালে লাল হয়ে উঠতো। যাক, শোন, বাজে চিন্তা করবার সময় নেই, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিন সর্দারকে জম্বুর কারাকক্ষের গুপ্তস্থানে গুলীবিদ্ধ করে হত্যা করা হবে।

উঃ! এত বড় কথা বলতে পারলে রহমান।

যা ঘটতে যাচ্ছে তা বলতে পারবো না? শোন নূরী, তুমি দস্যুকন্যা এতে সহজে মুষড়ে পড়লে চলবে না। সর্দারকে রক্ষা করবার উপায় খুঁজতে হবে।

প্রাণ দিয়েও আমি তোমাকে সাহায্য করবো রহমান।

হাঁ, তাই চাই। সর্দারকে হাঙ্গেরী কারাকক্ষে এখন বন্দী করে রাখা হয়েছে।

সেখান থেকে একবার হুর পালাতে সক্ষম হয়েছিলো!

হাঁ নূরী, কিন্তু এবার তাকে পূর্বের মত রাখা হয়নি। লৌহ পাত দিয়ে তৈরি সেই কক্ষ। শুধু তাই নয়, লৌহ কারাকক্ষের চারপাশে সদাসর্বদা রাইফেলধারী পাহারাদার দণ্ডায়মান। এক জন দু’জন নয়, শত শত পুলিশ ফোর্স সমর প্রাঙ্গণের সৈনিকের মতই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে যেন বিপক্ষ বাহিনী তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এইভাবে তারা প্রস্তুত হয়ে আছে।

তাই বলো, না হলে কি কেউ সিংহশাবককে বন্দী করে রাখতে পারে। আমার হুর তাহলে …তাহলে মুক্তি পাবে না।

শোন নূরী।

বলো?

আগামী সপ্তাহে প্রথম দিন বেলা দু’টায় প্রকাশ্য কান্দাইর রাজপথ দিয়ে শত শত পুলিশ ফোর্স পরিবেষ্টিত হয়ে সর্দারকে নিয়ে যাওয়া হবে জম্বুর কারাকক্ষে। ওখানে একটা গুপ্তকক্ষ আছে, সেই কক্ষে তাকে হত্যা করা হবে গুলীবিদ্ধ করে। কিন্তু যখন তাকে পুলিশ ভ্যানে শত শত পুলিশফোর্স বেষ্টিত করে কান্দাই থেকে চব্বিশ মাইল দূরে জন্ধুর কারাকক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন একটি মাত্র সুযোগ তাকে উদ্ধার করবার।

হঠাৎ নূরীর চোখ দুটো উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠলো, খুশিভরা গলায় বলে উঠলো সে ঐ মুহূর্তে আমার মনে হয় পালাতে সক্ষম হবে রহমান? আমার হুর পালাতে সক্ষম হবে …

নূরীর কথায় রহমান কিছুমাত্র খুশি না হয়ে বললো– যা ভাবছো তা অসম্ভব নূরী। সর্দারের সমস্ত শরীর থাকবে লৌহ শৃঙ্খলাবদ্ধ। হাতে থাকবে লৌহ হাতকড়া, কোমরে গলায় পিঠে — সমস্ত দেহটা জড়ানো থাকবে লৌহ শিকলে কি উপায়ে সে পুলিশ ফোর্সকে পরাজিত করে পালাতে সক্ষম হবে, বলো? একটু থেমে বললো রহমান–হাঙ্গেরী কারাগার হতে যখন কান্দাই রাজপথ দিয়ে পুলিশ ভ্যানগুলো জন্ধু অভিমুখে রওয়ানা দেবে ঠিক সেই মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে হবে আমাদের। রক্ত ক্ষয় হবে প্রচুর, কিন্তু যেমন করে হোক উদ্ধার করতে হবে সর্দারকে।

আমিও তোমাদের সহায়তা করবো রহমান।

কিন্তু তুমি যে,–

আমি নারী তাই ভয় পাচ্ছো? কিন্তু জানো না– আমি যেমন কোমল হৃদয়, তেমনি ভয়ঙ্করী– নূরীর দু’চোখে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।

রহমান স্তব্ধ নিশ্বাসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো নূরীর মুখের দিকে, তারপর বললো– বেশ তাই হবে। এবার ফিরে তাকালো। সে অনুচরগণের মুখে ভাই, আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা এখন সম্মুখে। প্রাণের মায়া বিসর্জন দিয়ে সর্দারকে উদ্ধার করতে হবে।

সমস্বরে বলে উঠে অনুচরগণ … আমরা সর্দারের জন্য প্রাণ দেবো। আমরা সর্দারকে উদ্ধার করবো। আমরা শপথ করছি।

শত শত অনুচর কণ্ঠের বজ্রধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো দস্যু বনহুরের দরবারকক্ষ।

রহমান তার দক্ষিণ হাতখানা উর্ধ্বে তুলে ধরে মুষ্টিবদ্ধভাবে বলে উঠে সাবাস! সাবাস ভাই!

সমস্ত দস্যগণের চোখে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়।

মশালের আলোতে চক চক করে উঠে তাদের চোখগুলো। বলিষ্ঠ দেহের মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠে ইস্পাতের মত। মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠে তাদের। সর্দারের মুক্তি কামনায় সবাই। আজ বদ্ধপরিকর।

তখনকার মত দরবারকক্ষ ত্যাগ করবার জন্য আদেশ দেয় রহমান অনুচরগণকে।

সবাই কুর্ণিশ জানিয়ে বিদায় গ্রহণ করে।

রহমান এবার পত্রিকাখানা মেলে ধরে টেবিলে। নূ

রী ঝুঁকে পড়ে বলে রহমান, কবে সেই দিন?

আগামী মঙ্গল বার–আজ থেকে আটদিন পর।

আজও বুঝি ঐ দিন?

হাঁ, আজ ঐ দিন, মঙ্গলবার। নূরী আমাকে এক্ষুণি একটু বাইরে বের হতে হবে চলো। দরবারকক্ষ হতে বাইরে বেরিয়ে আসে রহমান আর নূরী।

দস্যু বনহুরের দরবারকক্ষ হতে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেলো কেউ বুঝতে পারবে না সেখানে কোনো দরজা বা কোনো গর্ত আছে। একটা পাথরের বিরাট চাপ ছাড়া কিছু মনে হবে না।

দস্যু বনহুর যখন ঐ দরবারকক্ষে তার অনুচরদের নিয়ে আলাপ আলোচনায় রত থাকে, তখন দরজা এমনভাবে বন্ধ থাকে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবেনা এটা পাথরখন্ড নয়; কোনো দরজা বা কোনো কক্ষে প্রবেশপথ। দরবারকক্ষের কোনো কথাবার্তা বাইরে থেকে শোনবার উপায়। নেই। এতটুকু শব্দও বাইরে আসে না।

পাথরখণ্ডের দুই পাশে দু’জন রাইফেলধারী দস্যু অনুচর সদাসর্বদা পাহারায় নিযুক্ত রয়েছে।

রহমান আর নূরী বাইরে আসতেই রাইফেলধারী পাহারাদ্বয় কুর্নিশ জানালো। সর্দারের অনুপস্থিতিতে রহমানকে তারা সর্দারের মতই সমীহ করে। সে যেভাবে তাদের পরিচালনা করে সেইভাবেই কাজ করে তারা। তার কথায় উঠে-বসে।

নূরী চলে গেলো তার নিজ কক্ষের দিকে।

রহমান এগিয়ে চললো সম্মুখে। তার ড্রেস পরিবর্তন কক্ষে প্রবেশ করলো।

যখন সে ড্রেস পরিবর্তন কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো তখন তাকে ঠিক একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার বলে মনে হচ্ছিলো। পিস্তলটা পকেটে রেখে নূরীর পাশে এসে দাঁড়ালো।

হঠাৎ একজন অপরিচিত লোক মনে করে নূরী কঠিন কণ্ঠে বললো-”কে তুমি? কেন এখানে এলে?

অন্যদিন হলে রহমান কিছুটা ঠাট্টা করতে ছাড়তো না, কিন্তু আজ তার মন অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পূর্ণ। একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো–নূরী আমি শহরে যাচ্ছি।

রহমানের কন্ঠস্বর চিনতে পেরে আশ্বস্ত হলো নূরী। বললো এবার সে–শহরে যাচ্ছো?

হাঁ।

দুলকীকে নিয়ে যাবে না?

না, সেই কারণেই তো এই ড্রেস।

ফিরবে কখন রহমান?

কবে ফিরবো, কখন ফিরবো জানি না। নাও ফিরতে পারি।

এসব তুমি কি বলছো রহমান?

হাঁ নূরী, পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আহমদের গাড়ির ড্রাইভার আজ থেকে রহমান–বুঝলে?

পুলিশ ইন্সেপেক্টার আহম্মদ

হাঁ, যে আমাদের সর্দারকে বন্দী করেছে।

তুমি তুমি–

আমি তারই গাড়ির ড্রাইভার হয়ে সব সংবাদ সংগ্রহ করবো। তারপর–তারপর–থেমে যায় রহমান।

নূরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

রহমান পকেটে হাত রেখে পিস্তলটার অস্তিত্ব অনুভব করে নিয়ে পা বাড়ালো সামনের দিকে।

নূরী অস্ফুট কণ্ঠে বললো–খোদা হাফেজ।

*

মিঃ আহমদ ও মিঃ জাফরী গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।

মিঃ আহমদ গাড়িতে উঠে বসে মিঃ জাফরীকে বললেন–আপনিও আসুন আমার গাড়িতে, আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবো।

মিঃ জাফরী বললেন–আমার গাড়ি এতক্ষণও এলো না কেন বুঝতে পারছিনে।

হয়তো গাড়ির কোনো অসুখ ঘটেছে। বললেন মিঃ আহমদ।

মিঃ আহমদের হ্যস্যপূর্ণ কথায় মিঃ জাফরী হেসে গাড়িতে উঠে বসলেন।

ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয় সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন।

এক মুখ ধোয়া উদগীরণ করে বললেন মিঃ আহমদ –মিঃ জাফরী আমি কল্পনাও করতে পারিনি এত সহজে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হবো।

আপনার সূতীক্ষ্ণ বুদ্ধি কৌশলের জন্যই গভর্ণর খুশি হয়ে আপনাকে নতুন নামে ভূষিত করেছেন এবং লক্ষ টাকা পুরস্কার দিয়েছেন। দস্যু বনহুরকে আজও কেউ বন্দী করতে সক্ষম হয়নি।

বন্দী তো দূরের কথা তার দর্শন লাভই সম্ভব ছিলো না।

এবার শুধু বন্দীই নয় মিঃ আহমদ, আপনার অক্লান্ত চেষ্টায় দস্যু বনহুরকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা সম্ভব হলো।

ড্রাইভারের হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হলো নিজের অজ্ঞাতে দাঁতে দাঁত পিষে আপন মনে বললো– সর্দারকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা দুনিয়ার কারও পক্ষে সম্ভব নয়, যতক্ষণ না পরওয়ার দেগার তার আয়ু শেষ না করে–

ড্রাইভারকে বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুনে বললেন মিঃ আহমদ ড্রাইভার?

জ্বী, বড় শীত লাগছে, দাঁত ঠক ঠক করে কাঁপছে আমার।

শীতে দাঁত কাঁপলেও কাজ শেষ না করে উপায় নেই। চলো মিঃ জাফরীকে তার বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে।

ড্রাইভার মিঃ জাফরীর বাংলো অভিমুখে গাড়ি চালিয়ে চললো। দৃষ্টি তার গাড়ির সম্মুখে সীমাবদ্ধ থাকলেও কান ছিলো পিছনে। পুলিশ ইন্সপেক্টার দ্বয়ের কথোপকথন শুনছিলো সে মনোযোগ সহকারে।

মিঃ জাফরী এক সময় বলে উঠলেন–মিঃ আহমদ, দস্যু বনহুরকে হাঙ্গেরী কারাগার থেকে জন্ধুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে?

কেন?

আমার মনে হয় তাকে হাঙ্গেরী কারাগারেই হত্যা করা সমীচীন হবে।

কিন্তু আইনে তাকে যেভাবে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাতে জম্বুর কারাকক্ষ ছাড়া উপায় নেই। ত্রিফলার সঙ্গে তার হাত দু’খানা, আর পা নিচে ফলার সঙ্গে বাঁধা থাকবে, চক্রাকারে এই ত্রিফলা ঘুরতে থাকবে, সেই অবস্থায় তাকে গুলী করে হত্যা করা হবে। কারণ, তার মত দুর্ধর্ষ দস্যুর মৃত্যু আর কোনো উপায়ে দেওয়া যায় না।

এইবার শয়তানকে উচিত সাজা দেওয়া হবে।

শুধু উচিত নয় মিঃ জাফরী। ত্রিফলা যখন চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে তখন দূর থেকে তার হাতে পায়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলী ছোঁড়া হবে।

যতক্ষণ না দস্যুর মৃত্যু ঘটেছে ততক্ষণ আমি যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছিনে মিঃ আহমদ।

হো হো করে হেসে উঠলেন মিঃ আহমদ–কেন বলুন তো?

মিঃ জাফরী বললেন–দস্যু বনহুরের অসাধ্য কিছু নেই।

মিঃ আহমদ এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–অগণিত পুলিশ ফোর্স পরিবেষ্টিত হয়ে দস্যু বনহুরকে নিয়ে যাওয়া হবে জম্বুর কারাকক্ষে। তার হাত পা সব থাকবে লৌহশিকলে আবদ্ধ এসব তো আপনি শুনেছেন–তবু আশঙ্কা?

নানা কথাবার্তার মধ্যে মিঃ জাফরীর বাংলোর সামনে এসে গাড়ি থামলো।

সেদিনের মত বিদায় নিয়ে নেমে পড়লেন মিঃ জাফরী।

মিঃ আহমদ বললেন ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে–বাসায় চলো।

রহমানের পরিচিত এসব পথ। এ শহরের কার বাসা কোথায়, সব তার নখদর্পণে, কাজেই কোনো অসুবিধা হলো না।

মিঃ আহমদকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভার বেশি রহমান ছুটি পেলো। রাতেও তার বিশ্রাম নেই।

রহমান এবার চললো চৌধুরী বাড়ির দিকে। বেশ কয়েক দিন হলো বৌরাণীর সন্ধান সে নিতে পারেনি। সর্দারের মৃত্যুদণ্ড সংবাদে নিশ্চয়ই বৌরাণী পাগলিনী প্রায় হয়ে পড়েছে। তাকে সান্ত্বনা দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন।

কিন্তু এত রাতে চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে বৌরাণীর সঙ্গে দেখা করা কি সম্ভব হবে? দেখা না করলেও তো নয়। যেমন করে হোক উপায় খুঁজে নিতে হবে তাকে।

রহমান বাসযোগে তাদের শহরের আস্তানায় ফিরে এলো, নিজের গাড়ি নিয়ে রওয়ানা দিলো চৌধুরী বাড়ির দিকে।

কান্দাই শহর, মস্ত বড় শহর–শহরের প্রায় এক প্রান্তে চৌধুরীবাড়ি।

রহমান যখন চৌধুরী বাড়ি গিয়ে পৌঁছলো তখন অবাক হলো বাড়ির সবাই যেন বেশ উকুণ্ঠার সঙ্গে চলাফেরা করছে। বৈঠকখানা কক্ষে সরকার সাহেব আরও কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন।

এত রাতে চৌধুরীবাড়িতে সবাই জেগে, ব্যাপার কি?

রহমান দূর থেকে লক্ষ্য করছে, এগুবো কিনা ভাবছে সে। এমন সময় গাড়ি বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন সরকার

সাহেব এবং আর একজন ভদ্রলোক। ভাল করে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলো রহমান। দেখতে পেলো–ভদ্রলোকটার গলায় স্ট্যাথিসকোপ ঝুলছে নিশ্চয়ই কোনো ডাক্তার কিন্তু এত রাতে ডাক্তার কেন?

রহমান আতঙ্কিত হলো, তাহলে কি বৌরাণীর কোনো অসুখ! নিজকে ধরে রাখতে পারলো না সে এগুলো সম্মুখের দিকে। একটা ফুলঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে কান পাতলো রহমান। ঐ শোনা যাচ্ছে তাদের কথাগুলো, সরকার সাহেব বলছেন–ডাক্তার সাহেব মনিরা বাঁচবে তো?

ডাক্তার একটু চিন্তা করে বললেন–ওর পেটে আর বিষ নেই। সব আমি যন্ত্র দ্বারা বের করে নিতে সক্ষম হয়েছি; তবে এখনও আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নই।

রহমানের কানে যেন কে গরম সীসা ঢেলে দিলো, বৌরাণী তাহলে বিষ পান করেছে। সর্দারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ জানতে পেরে সে এই কাজ করেছে।

ডাক্তার গাড়িতে উঠে বসলেন।

 রহমান ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

একটা গাছের নীচে বসে মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো রহমান–সর্দার নেই কার কাছে গিয়ে বলবে বৌরাণী বিষ খেয়েছে, এখন কি উপায়ে তাকে বাঁচানো যায়। সর্দারের উপস্থিতকালে এ ঘটনা ঘটলে তাকে এত ভাবতে হতো না। কিন্তু যেমন করে থোক বৌরাণীকে বাঁচাতেই হবে। হঠাৎ মনে পড়লো আস্তানায় একটা ওষুধ আছে সেই ওষুধ পান করালে যত বিষাক্ত জিনিসই ভক্ষণ করুক না কেন, অল্পক্ষণের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করে। রহমান আর বিলম্ব না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, কিছুদূরে তার গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। ফিরে গেলো গাড়ির পাশে।

দ্রুত হস্তে গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভ আসনে উঠে বসলো রহমান। গাড়ি এবার উল্কাবেগে ছুটতে শুরু করলো।

এ পথ, সে পথ করে যে পথ এগুলে শীঘ্র হবে সেই পথে গাড়ি চালিয়ে চললো।

রাত বেড়ে যাওয়ায় পথে প্রায় জনহীন, কোনো অসুবিধা হলো না রহমানের।

জঙ্গলের নিকট যেখানে তার অশ্ব দুলকী বাঁধা ছিলো সেই খানে পৌঁছে আশ্বস্ত হলো, কায়েস দুলকী রেখেছে ঠিক তার কথামতই। রহমান তাকে বলেছিলো হঠাৎ কখন না কখন আস্তানায় দরকার পড়ে কাজেই সব সময় দুলকীকে যেন পথের বাঁকে তাদের সেই গোপন জঙ্গলে বেঁধে রাখা হয়।

রহমান এবার দুলকীর পিঠে চেপে বসলো।

দুলকী তার মনিবের কথা যেন বুঝতে পারলো। ঠিক তাদের আস্তানার পথ ধরে দ্রুত ছুটে চললো। যেমন করেই হোক এই রাতেই তাকে আবার শহরে ফিরতে হবে। আবার তাকে যেতে হবে চৌধুরী বাড়ি না হলে বৌরাণীকে বাঁচানো যাবে না।

ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে ছুটে চলেছে দুলকী। রহমানের শরীর বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। এখনও তার দেহে ড্রাইভারের ড্রেস।

পূর্বের সেই আস্তানা এখন আর নেই। এখন দস্যু বনহুর মাটির নিচে কৌশলে তার আস্তানা। তৈরি করেছে। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে এ আস্তানা তৈরি করতে। পুলিশের সাধ্য নেই। এই আস্তানার সন্ধান পায়।

রহমান যখন আস্তানায় পৌঁছলো তখন রাতের শেষ ভাগ। দুলকী থেকে নেমে সুড়ঙ্গপথে অগ্রসর হলো সে। বনহুরের কক্ষের একটা শিশিতে ঐ ওষুধ ছিলো।

রহমান বনহুরের কক্ষ থেকে ওষুধের শিশি নিয়ে যখন বের হতে যাবে, অমনি নূরী এসে দাঁড়ালো তার সম্মুখে–রহমান তুমি।

রহমান এত দ্রুত বের হতে যাচ্ছিলো, শুধু একটা শব্দ করলো–হাঁ।

কখন এলে? কোথায় যাচ্ছো আবার?

এখন সময় নেই বলবার ফিরে এসে বলবো নূরী।

নূরী কিছু বলবার পূর্বেই রহমান ছুটে বেরিয়ে যায়।

শুনতে পায় নূরী সুড়ঙ্গ পথে দ্রুত অশ্বপদ শব্দ। বুঝতে পারে রহমান চলে গেলো।

নূরীর দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়। এত রাতে রহমান কেনই বা এসেছিলো, আবার এমনভাবে কেনইবা চলে গেলো। কি যেন গোপনে নিয়ে গেলো সে। কি নিয়ে গেলো–বনহুরের কক্ষ থেকেই সে কিছু নিয়ে গেলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু কি নিয়ে গেলো সে?

নূরী যখন এসব চিন্তায় ব্যস্ত তখন রহমান দুলকীর পিঠে বন জঙ্গল ভেঙে ছুটছে। কোনো দিকে তার খেয়াল নেই। রাত ভোর হবার আগেই তাকে চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছতে হবে।

অশ্ব চালনায় রহমান বনহুরের সমকক্ষই ছিলো। তীরবেগে ছুটে চললো দুলকীর পিঠে রহমান।

চৌধুরী বাড়ির পেছনে এসে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো রহমান। দুলকীকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে পিছন পাইপ বেয়ে দ্রুত উঠে গেলো উপরে যে পথে বনহুর মনিরার কক্ষে প্রবেশ করে থাকে।

রহমান মনিরার কক্ষে প্রবেশ করে দেখলো–বিছানায় শায়িত মনিরা, শিয়রে একটা চেয়ার ঠেস দিয়ে চোখ বুজে আছে বৃদ্ধা মরিয়ম বেগম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি।

রহমান পকেট থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করলো পাশের টেবিলেই ছিলো ওষুধ খাওয়ানোর গেলাস–ঐ গেলাসে শিশি থেকে ওষুধ ঢেলে মনিরার মুখের কাছে নিয়ে গেলো। চারিদিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিলো রহমান।

মনিরার ঠোঁটের ফাঁকে ওষুধটুকু ঢেলে দিলো সে অতি সন্তর্পণে। ঠিক সেই মুহূর্তে আজান ধ্বনি ভেসে এলো দূর কোনো মসজিদ থেকে।

রহমান সোজা হয়ে দাঁড়াবার পূর্বেই জেগে গেলেন মরিয়ম বেগম, চোখ মেলে তাকিয়েই অজানা-অচেনা একটা লোককে কক্ষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন তিনি –কে–কে–

রহমান যেমনি জানালা দিয়ে পালাতে যাবে অমনি সরকার সাহেব রিভলভার হাতে মেঝেতে এসে দাঁড়ালেন–খবরদার, পালাতে চেষ্টা করলেই মরবে।

রহমান অগত্যা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।

ফিরে তাকালো সে সরকার সাহেবের দিকে। রহমানকে সরকার সাহেব জানতেন, কারণ অনেক দিন সে এ বাড়িতে এসেছে নানা ছদ্মবেশে। আজ রহমানের শরীরে ড্রাইভারের ড্রেস এখনও বিদ্যমান।

সরকার সাহেব রহমানকে চিনতে পারলেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে রিভলভার চেপে ধরলেন তার বুকে। গম্ভীর কঠিন কণ্ঠে বললেন কে তুমি? কি কারণে এখানে এসেছিলে?

রহমান তার মুখ থেকে ছাট করা দাঁড়ি আর গোঁফ খুলে ফেললো।

সরকার সাহেব বলে উঠলেন–আপনি!

সরকার সাহেব রহমানকে চিনলেও মরিয়ম বেগম তাকে দেখেননি কোনোদিন, তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন–কে এই বলিষ্ঠ যুবক, কি এর নাম, কেনই বা এখানে এসেছিলো আর সরকার সাহেবই বা তাকে চিনলেন কি করে।

মরিয়ম বেগম যখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন সরকার সাহেব আর রহমানের দিকে, তখন রহমান বললো–মা, আমিও আপনার একজন হতভাগ্য সন্তান। আপনার পুত্র দস্যু বনহুর। আমাদের সর্দার–

তুমি তুমি আমার মনিরের অনুচর সঙ্গী?

হাঁ, আমি বৌরাণীর বিষপানের কথা জানতে পেরেছি এবং সেই কারণেই এখানে এসেছি। আমাদের আস্তানায় এমন একটা ওষুধ ছিলো যে ওষুধ পান করলে সব রকম বিষক্রিয়া বিনষ্ট হয়ে যায়।

কই, কোথায় সে ওষুধ? বললেন সরকার সাহেব।

মরিয়ম বেগম আগ্রহভরা কন্ঠে বলে উঠলেন–এনেছো? এনেছো তুমি সেই ঔষুধ?

হাঁ মা, এনেছিলাম। বৌরাণীকে খাইয়ে দিয়েছি।

আনন্দভরা গলায় বলে উঠেন মরিয়ম বেগম–সত্যি তুমি আমার মনিরাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছো? এবার আমার মনিরা বেঁচে উঠবে?

যদি আয়ু থাকে তবে নিশ্চয়ই বেঁচে উঠবে; ওষুধ আমি তাকেই খাইয়ে দিয়েছি।

সরকার সাহেব আর রহমান মনিরার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো।

সরকার সাহেব হাতের রিভলভারটা রাখলেন টেবিলে।

রহমান বললো–প্রকাশ্যে আসার সুযোগ করে উঠতে পারিনি। তাছাড়া আপনারা যদি এ ওষুধ বৌরাণীকে পান করতে না দেন, সেই জন্যই আমি গোপনে তাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি।

সরকার সাহেব রহমানের হাত মুঠায় চেপে ধরলেন–আমি ভুল করে আপনাকে–না না, তাতে কি, আপনি তো জানতেন না আমি কে, আর কি উদ্দেশ্যেই বা এসেছিলাম।

হাঁ, জানতামনা বলেই এমন একটা অঘটন ঘটাতে যাচ্ছিলাম—

সরকার সাহেবের কথা শেষ হয় না, মনিরা অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠে পানি–একটু পানি– দাও–

মুহর্তে মরিয়ম বেগম এবং সরকার সাহেবের মুখ খুশিতেই দীপ্ত হয়ে উঠে।

রহমানের চোখে মুখেও আনন্দের দ্যুতি খেলে যায়।

একসঙ্গে সবাই ঝুঁকে পড়ে মনিরার মুখের উপর।

রহমানের পাশের ঢাকা দেওয়া পানির গেলাসটা তুলে দেয় মরিয়ম বেগমের হাতে।

মরিয়ম বেগম একটু পানি ঢেলে দেন মনিরার ঠোঁটের ফাঁকে।

ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে সবাই তাকিয়ে আছে মনিরার মলিন মুখের দিকে।

ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো মনিরা।

মরিয়ম বেগম উদগ্রীব কণ্ঠে ডাকলেন–মা মনিরা!

মনিরা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলো–এত অন্ধকার কেন? এত অন্ধকার কেন?

কই, কোথায় অন্ধকার মা?

সরকার সাহেব ওদিকের জানালাটা খুলে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক রৌদ্র এসে লুটিয়ে পড়লো মনিরার বিছানায়।

রহমান বললো এবার–বৌরাণী।

রহমানের কণ্ঠস্বরে মনিরা ফিরে তাকালো। কিন্তু মনিরা তাকে দেখতে পেলো না। বিষপানে তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আবার বলে উঠলো– কে কে তুমি? আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছিনে, দেখতে পাচ্ছিনে–

বৌরাণী, বৌরাণী আমি রহমান।

রহমান, রহমান তুমি এসেছো? কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনে– উঠে বসতে যায় মনিরা।

মরিয়ম বেগম মনিরাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে বলে উঠেন সরকার সাহেব, একি হলো একি হলো আমাদের।

সরকার সাহেবের গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো, বললেন তিনি বেগম সাহেবা, ডাক্তার বলেছিলেন, যে বিষ মনিরা পান করেছে যদি বেঁচে থাকে তবে সে আর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। না।

অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন মরিয়ম বেগম–সরকার সাহেব।

রহমানের দু’চোখ ডিমের মত গোলাকার হয়ে উঠলো–একি অঘটন ঘটে গেলো বৌরাণীর।

মনিরা এতক্ষণে বুঝতে পারলো কি হয়েছে তার। মনে পড়লো ধীরে ধীরে সব কথা সে তো বিষ পান করেছিলো; তবু এখনও বেঁচে আছে। যে বিষ সে পান করেছে, বাঁচবারতো কথা না। মনিরা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো–আমি মরতে চাই। আমি মরতে চাই। এ জীবন নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না না না না।

একি পাগলামি করছো মা মনিরা? বললেন সরকার সাহেব।

মরিয়ম বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

রহমান বললো–বৌরাণী, আপনি এত অবুঝ জানতাম না। আপনি বিষ পান করলেন কেন? কেন আপনি এ ভুল করলেন বৌরাণী?

রহমান, এ জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কি হবে বলো? যার জন্য বেঁচে থাকবো সেই যদি চলে যায়। না না, আমাকে তোমরা মেরে ফেলো। মেরে ফেলো রহমান, ওর মৃত্যু সংবাদ যেন শুনতে না হয়।

বৌরাণী, আমাদের দেহে প্রাণ থাকতে আমাদের সর্দারের মৃত্যু হবে এ কথা আপনি চিন্তা করতে পারলেন। দস্যু বনহুরকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এমন সাধ্য কারও নেই–

রহমান!

হাঁ বৌরাণী, সর্দারকে আমরা উদ্ধার করবোই করবো। আমাদের জীবন দিয়েও তাকে আমরা ফিরিয়ে আনবো। কিন্তু বৌরাণী এ আপনি কি করলেন, আপনি কেন এ ভুল করলেন।

মরিয়ম বেগম নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছিলেন।

সরকার সাহেব দাঁড়িয়েছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না।

রহমান বললো–আমি আর বিলম্ব করতে পারছিনে। অনেক কাজ আছে।

মনিরা বলে উঠলো–চলে যাচ্ছো রহমান?

হাঁ বৌরাণী, আবার আসবো।

সরকার সাহেব বললেন–মনিরা, রহমানই তোমাকে এই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলো। তার ওষুধই তোমাকে এখনও জীবিত রেখেছে।

অস্ফুট কন্ঠে বললো মনিরা রহমান।

আসি বৌরাণী, খোদা হাফেজ।

খোদা হাফেজ! বললো মনিরা।

মনিরার অবস্থা একটু আরোগ্যের দিকে কিন্তু সে এখন আর দেখতে পায় না। দুনিয়ার সমস্ত আলো তার চোখে অন্ধকার। শহরের বড় বড় ডাক্তার বিমুখ হয়ে ফিরে গেলেন একবাক্যে সবাই বললেন বিষাক্ত ওষুধ পানে তার দৃষ্টি শক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আর কোনো দিন সে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবে না।

এই বিপদ মুহর্তে মরিয়ম বেগম নিজেও চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। কেঁদে কেটে আকুল হলেন তিনি। বিপদের উপর বিপদ–একে পুত্রশোকে কাতর তার উপর মনিরার চোখ দুটো চির দিনের জন্য অন্ধ হয়ে গেলো। তিনি যেন অকুল সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলেন।

সুযোগ পেলেই আসে রহমান, নানারকম প্রবোধ বাক্যে মনিরা ও মরিয়ম বেগমকে সান্ত্বনা দেয় সে।

মনিরা নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও দুঃখিত নয়, তার সদা-সর্বদা চিন্তা স্বামীর জন্য। রহমানকে বলে মনিরা–কেন আমি বেঁচে রইলাম? কেন আমাকে মরতে দিলে না রহমান? দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও আমার দুঃখ নেই কেমন করে সহ্য করবো ওর মৃত্যু সংবাদ?

বৌরাণী, সর্দারের মৃত্যুসংবাদ আপনাকে শুনতে হবে না। দৃঢ় কণ্ঠে বললো রহমান।

সত্যি তাই যেন হয় রহমান, তাই যেন হয়।

*

মাঝে মাত্র আর দুটো দিন আছে দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ডের। দু’দিন পর জন্ধু কারাগারে বনহুরকে ত্রিশূল বিদ্ধ করে গুলী করা হবে।

পত্রিকায় পত্রিকায় এ সংবাদ ছাপা হলো। লোকের মুখে মুখে সমস্ত শহরবাসীর ঘরে ঘরে প্রচার হলো দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ডের খবর। শুধু শহরেই নয়–দেশ হতে দেশান্তরে এ খবর গিয়ে পৌঁছলো।

দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড সংবাদে খুশি হলো অনেকেই আবার অনেকে গোপনে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো। দীনহীন অনাথগণ অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলো।

গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, পথে-ঘাটে-মাঠে সবাই জানতে পারলো দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ডাদেশের কথা। সকলেরই একমাত্র বলার বস্তু হলো ঐ এক সংবাদ।

ধনপতিগণ নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে খুশির সাথে এ সংবাদ পরিবেশন করতে লাগলো। এবার থেকে তারা নিশ্চিন্ত মনে তাদের কারবার ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারবে। আর দস্যু বনহুরের ভয়ে তাদের কম্পিত হৃদয় নিয়ে কালাতিপাত করতে হবে না। টাকা পয়সা নিয়ে পথ-ঘাট চলতে তেমন করে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন হবে না। কত নিশ্চিন্ত এখন তারা। আরও অনেক কথা ধনবানদের মনে উদিত হলো বিশেষ করে কালো বাজারে যারা বেশ। ফেঁপে উঠেছে তাদের মনে আনন্দের বান বয়ে গেলো। বনহুর গ্রেপ্তারের পর হতে একটা খুশিভাব তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো।

ধনবানগণ যেমন হয়েছিলো খুশি, অসহায়-অনাথ আতুর যারা, বনহুরের অনুগ্রহে যারা। আজও বেঁচে আছে তাদের হৃদয়ে শেল বিদ্ধ হলো। অন্তরে শুধু আঘাতই পেলো না তারা তাদের বেঁচে থাকবার আশা ধূলিসাৎ হলো। বেচারা অন্ধ-আতুর-খঞ্জ সবাই খোদার কাছে দস্যু বনহুরের জন্য দোয়া চাইতে লাগলো।

বৃদ্ধা জরাগ্রস্ত অসহায় তারাও জায়নামাজে বসে দু’হাত তুলে বললো–হে পরওয়ারদেগার বনহুরকে তুমি রক্ষা করে নাও।

জানি না খোদা মেহেরবান অনাথ-অসহায় দীনহীনদের দোয়া কবুল করলেন কিনা।

মরিয়ম বেগম পুত্রের জন্য খোদার দরগায় ফরিয়াদ জানালেন জায়নামাজে বসে মাথা ঠুকে দোয়া করতে লাগলেন তিনি। তাঁর ললাটের রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো সেজদার স্থান। মায়ের এই আকুল আহ্বানে আকাশ বাতাস নীরবে যেন অশ্রু বিসর্জন করে চললো।

মনিরা এখনও শয্যাশায়ী, উঠা-বসা তার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর।

খবর পেয়ে মনিরার বান্ধবীগণ এলো দেখা করতে। কিন্তু মনিরার অবস্থা দেখে তাদের দুঃখের সীমা রইলো না। সবাই মনিরার করুণ অবস্থায় মর্মাহত হলো।

মনিরার অসুস্থতার কারণ কি খুঁজে কেউ পেলো না। সবাই নানা কথা বলে তাকে সান্ত্বনা। দিতে লাগলো।

একটা ব্যাপার ঘটেছিলো–বান্ধবীরা আজও জানে না মনিরা বিবাহিতা, তার একটা সন্তানও জন্মেছে। এ কথা কেউ শোনেনি বা জানে না এখনও।

মনিরা কারও সঙ্গে মিশতো না বা কারও বাড়ি যেতো না তাই বান্ধবীরাও তার কাছে আসতো কম।

অবশ্য দস্যু বনহুরের সঙ্গে যে তার একটা সম্বন্ধ আছে, এটা গোপনে কেউ কেউ জানতো। কিন্তু তার সঙ্গে যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ঘটে গেছে এটা কেউ জানতো না।

মনিরার কোলে যখন নূরকে অনেকেই দেখে অবাক হয়েছিলো তখন বলতো মনিরা আমার বোনের ছেলে কিনা, আমাকে বড় ভালোবাসে, ‘আম্মা বলে ডাকে।

মরিয়ম বেগমও সায় দিতেন মনিরার কথায়। কাজেই অবিশ্বাস করবার কিছুই ছিলো না।

সেদিন মনিরার বান্ধবীগণ অনেকেই এলো মনিরাকে দেখতে। সবাই ওকে ঘিরে ধরে বললো–হঠাৎ কি হলো মনিরা তোর?

মনিরা কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করেই রইলো।

মরিয়ম বেগম বললেন–একটা কঠিন অসুখ হয়েছিলো মা তাই ওর এই অবস্থা। চোখ দুটো নষ্ট হয়ে গেছে।

সবাই ব্যথায় অনুতাপে মুষড়ে পড়লো, দুঃখ করলো অনেকে।

মরিয়ম বেগম এক সময় বেরিয়ে যেতেই বললো সাহানা মনিরার বিশিষ্ট বান্ধবী সে আচ্ছা। মনি, চিরদিন কি তুই এমনি করে কাটিয়ে দিবি?

কি রকম? বললো মনিরা।

বিয়ে করবিনে?

বিয়ে! হাসলো মনিরা বিয়ে আমার হয়ে গেছে অনেক দিন।

নেকামি করিসনে মনি, সত্যি তুই ভুল করেছিস।

ভুল! কেন?

বিয়ে না করে।

আজ সত্যি কথা না বলে পারলো না বললেন মনিরা। আঁচলে অশ্রু মুছে বললো এতদিন তোদের কাছে যে কথা গোপন করেছি আজ বলবো তোরা বিশ্বাস করবিতো?

নিশ্চয়ই করবো। বললো সাহানা।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলেন সরকার সাহেব–সঙ্গে তার ডাক্তার।

তখনকার মত বলা আর হলো না।

বান্ধবীগণ সেদিনের মত বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

সাহানা অবশ্য মনিরার অনেক খবরই জানতো। দস্যু বনহুরই যে চৌধুরীবাড়ির ছেলে–এ কথাও সে জানতো, আরও জানতো, মনিরার সঙ্গে প্রেমও ঘটেছে বনহুরের। জানতো না তাদের আর কোনো সম্পর্কের কথা।

মনিরার বান্ধবীদের মধ্যে অনেকেরই বিয়ে হয়েছিলো–বাকিও ছিলো অনেকের। তারা কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলো। মনিরার বান্ধবী মহলে মনিরা ছিলো সকলের চেয়ে সুন্দরী আর গুণবতী। তাই অনেকেই তাকে ঈর্ষা করতো ভিতরে ভিতরে।

বান্ধবী মহলে মনিরা ছিলো তাদের আলোচনার বস্তু। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যদিও মনিরার সান্নিধ্য আজকাল তাদের বড় একটা ঘটে না। মনিরা তো কারও বাড়ি যাবেই না, ওরা এসে দেখা করে তার সঙ্গে। তবুও সবাই ঈর্ষা করে মনিরাকে। বড় লোকের মেয়ে বড় লোকের ভাগ্নী তাই নাকি এত অহঙ্কার ওর।

আজ অনেক দিন হলো বান্ধবীরা মনিরার বাড়ি আসা ছেড়েই দিয়েছিলো। বাইরে থেকে নানা জনে নানা রকম মনোভাব পোষণ করতো তার সম্বন্ধে। মনিরা, রূপবতী, গুণবতী, ধনবতী– তাই নাকি তার গর্ব। সেই কারণে বান্ধবীরা তাকে এড়িয়ে চলতো সম্পূর্ণরূপে। কিন্তু আসলে মনিরা ছিলো ভিন্ন রকম। গর্ব বলে তার কিছুই ছিলো না, নিজেকে অপয়া বলে সব সময় সরিয়ে রাখতো সবার কাছ থেকে।

আজ মনিরার বান্ধবীদের সেই ভুল ভেঙে গেলো, যখন তারা নিজের চোখ দেখলো মনিরা তাদের কাছে ঠিক পূর্বের ন্যায়ই আছে এতটুকু অহঙ্কার বা গর্ব নেই। মনিরার ব্যথায় সবাই ব্যথিত হলো। বাড়ি ফিরে দুঃখ করতে লাগলো সকলে। মনিরা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে–এটাই তাদের বড় দুঃখের কারণ।

সবচেয়ে বান্ধবীদের মধ্যে জুলেখাই ছিলো মনিরার প্রিয় বান্ধবী। বহুদিন বিদেশে শিক্ষা লাভ করার পর ফিরে এসেছে জুলেখা, মনিরার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশী ব্যথিত হলো সে।

জুলেখা ধনবান জাহাঙ্গীর শাহর সর্বকনিষ্ঠা কন্যা। জাহাঙ্গীর শাহ কান্দাই শহরের বিশিষ্ট ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। চৌধুরী বাড়ির প্রায় সমকক্ষই বলা চলে তাদের।

চৌধুরী সাহেব আর জাহাঙ্গীর শাহ বন্ধু লোক ছিলেন। এক সঙ্গে মেলামেশা, খানাপিনা বা ফাংশনে যোগদান করা সবই ছিলো তাঁদের এক সাথে। জাহাঙ্গীর শাহ ধনবান ব্যক্তি হলেও তাঁর মন বা হৃদয় নীচ ছিলো না। ন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনই ছিলো তাঁর নীতি।

চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে তাই জাহাঙ্গীর শাহর হৃদ্যতা কোনোদিন এতটুকু লাঘব হয়নি।

চৌধুরীবাড়ি আর শাহবাড়ির দূরত্ব ছিলো বেশ কিছু, প্রায় মাইল দুই। তবু চৌধুরী বাড়ির সঙ্গে মেলামেশায় কোনোদিন বিঘ্ন ঘটেনি শাহবাড়ির।

মনিরা আর জুলেখার মধ্যেও ছিল তাই অভেদ্য ভালবাসা। উভয়ে উভয়ের কাছে ছিলো এক মন এক প্রাণ। জুলেখার সঙ্গে মনিরা যেমনভাবে মিশতো তেমন করে আর কারও সঙ্গে মিশতে পারেনি। যদিও মনিরা ছিলো আর্টসের ছাত্রী ও জুলেখা সায়েন্সের ছাত্রী। স্কুলজীবনের প্রীতি তাদের দুজনকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছিলো শক্ত করে। কলেজ জীবনেও ওরা দুজন দু’জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি কোনোদিন।

মনিরাই ওকে নিজের গাড়িতে কলেজে নিয়ে যেতো প্রতিদিন। একসঙ্গে কলেজে যাওয়া থেকে একসঙ্গে সব কিছু চলতো ওদের দুজনের মধ্যে।

হঠাৎ জুলেখার সঙ্গে মনিরার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো ওরা উভয়ে যখন কলেজ থেকে পাশ করে বের হলো। মনিরা মামা মামীর নয়নের মণি, কাজেই তাকে কান্দাই শহরেই এম এ ক্লাশে ভর্তি হতে হলো আর জুলেখা চলে গেলো বিদেশে। পিতামাতার ইচ্ছা-সর্বকনিষ্ঠা কন্যা জুলেখাকে তাঁরা বিলেতে পাঠিয়ে লেখাপড়া শেখাবেন। আরও দুটি কন্যা শাহ্ সাহেবের কাজেই কনিষ্ঠাকে দূরে পাঠাতে তাঁরা দ্বিধা করলেন না। বিশেষ করে জাহাঙ্গীর শাহর ইচ্ছা–কন্যাকে তিনি ডক্টর করবেন।

পিতার বাসনা পূর্ণ করবার জন্য জুলেখা বিদেশে যাত্রা করলো।

এরপর থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো উভয়ের। মনিরাও সেদিন এরোড্রামে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে গিয়েছিলো জুলেখাকে। উভয়ের মধ্যে ছিলো এতো গভীর ভালবাসা মনিরা জুলেখাকে বিদায় দিতে গিয়ে কিছুতেই অশ্রুসম্বরণ করতে পারেনি।

জুলেখা বিদেশে চলে যাবার পর বেশিদিন ক্লাশ করতে পারেনি মনিরা। নানা দুর্যোগের ঘনঘটা তার জীবনাকাশে এক অন্ধকারময় বিভীষিকা এনে দিয়েছিলো। মামুজানের আকস্মিক মৃত্যু, চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিলো মনিরার সমস্ত হৃদয়টাকে। এম এ পড়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মনিরা আর ক্লাশ করতে পারেনি।

সেই থেকে মনিরার জীবনে শুরু হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত।

জাহাঙ্গীর শাহ কন্যাকে বিদেশে পাঠিয়ে হঠাৎ কঠিন অসুখে পড়ে গেলেন, শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর শাহও বন্ধুর পথ অনুসরণ করলেন–মৃত্যু হলো তাঁর। এক পুত্র এবং তিনকন্যা রেখে তিনি পরপারে যাত্রা করলেন।

পুত্র উপযুক্ত ছিলো, কাজেই তাঁর কারবার এবং সংসার দেখা শোনার দায়িত্ব গ্রহণ করলো সে–ই। জাহাঙ্গীর শাহর পুত্রের নাম ছিলো নাসির শাহ্।

পিতা যেমন ছিলেন সৎ ব্যক্তি, পুত্র তেমন ছিলো অসৎ। নানা ভাবে অর্থ উপার্জনে কুৎসিত পন্থা অবলম্বন করলো। ক্লাব পার্টি–এসব ছিল নাসির শাহের নেশা। এমন কি মদ পানও করতো সে।

জুলেখা বিদেশে, অন্য বড় বোন দুটি বিয়ে হয়ে তারা শ্বশুর বাড়ি, কাজেই নাসির শাহর কাজে বাধা দেবার কেউ ছিলো না।

সংসারে শুধু মাত্র বৃদ্ধা মা তাঁর কথা কানেই নিতো না নাসির শাহ্। নিজের ইচ্ছামত সে কাজ করতো মা কিছু বললে বলতো তুমি আমার চেয়ে বেশি বোঝো না মা। কি করতে হয় না হয় আমিই জানি।

জাহাঙ্গীর শাহ্র স্ত্রী সুলতান বেগম আর কিছু বলতেন না। তিনি জানতেন, সন্তান তাঁর কত মন্দ।

দীর্ঘ সাত বছর পরে ফিরে এলো জুলেখা শুধু ডক্টর উপাধি লাভ করে নয়, হাতে-নাতে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বিলেতে কিছুদিন কাজ করার পর দেশে ফিরে এলো সে।

জুলেখা দেশে ফিরেই প্রথমে পিতার অভাব অনুভব করলো দারুণভাবে। কিন্তু যিনি গেছেন। আর তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না, তাই জুলেখা বৃদ্ধা মাকে বুকে চেপে ধরে পিতার অভাব পূরণ করল।

বড় ভাই নাসির শাহ্ বোনকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নিয়ে এলো এরোড্রাম থেকে।

জুলেখা দেশের মাটিতে পা রেখেই আর একজনকে সন্ধান করছিলো, সে হচ্ছে মনিরা।

কিন্তু বাড়িতে কয়েক দিন কাটানোর পর যখন মনিরার কোনো সন্ধান পেলো না জুলেখা, তখন সে স্বয়ং গেলো তার সঙ্গে দেখা করতে।

চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছে মনিরার সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ ঘটলো জুলেখার তখন বিস্ময়ে আরষ্ট হয়ে গিয়েছিলো সে–মনিরা আজ দৃষ্টিহীন–অন্ধ। কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না মনিরা সত্যই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নিজকে সংযত রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছিলো জুলেখার পক্ষে মনিরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলো সে–মনিরা, তুই অন্ধ হয়ে গেছিস। এ যে আমি বিশ্বাস করতে পারছিনে–

অনেক কেঁদেছিলো জুলেখা মনিরাকে বুকে আঁকড়ে ধরে। অনেক প্রশ্নই করেছিলো সে তাকে। কিন্তু মনিরা শুধু নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছিলো, একটি জবাবও দেয়নি–দিতে পারেনি সে।

কি করে দেবে মনিরার অন্তরের বেদনা যে কাউকে বলবার নয়। মনের আগুন মনেই জ্বলছে। ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার গণ্ড বেয়ে। প্রিয় বান্ধবীকে পেয়েও মনের গোপন ব্যথা জানাতে পারে না সে।

মনিরা কিছু না বললেও জুলেখা আন্দাজ করে নিয়েছিলো নিশ্চয়ই মনিরার জীবনে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য সে আজ এমনভাবে মুষড়ে পড়েছে। তার মনে নানারকম কথাই জাগলো। হয়তো মনিরা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে এভাবে ভেঙে পড়েছে।

বাড়ি ফিরেও জুলেখা মনিরাকে নিয়েই চিন্তা করতে লাগলো। কি করে মনিরার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা যায়। সে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার মানুষের জীবন নিয়েই তাকে গবেষণা করতে। হবে। রোগীকে আরোগ্য লাভ করানোই এখন তার জীবনের ব্রত।

মনিরা সম্বন্ধে বাড়িতে কারও সঙ্গে আলোচনা করা সমীচীন মনে করলো না জুলেখা। কারণ সে জানতো, মনিরাকে বিয়ে করার জন্য এক সময় তার বড় ভাই নাসির শাহ্ উন্মাদ হয়ে উঠেছিলো যদিও প্রকাশ্যে নাসির মনিরাকে কোনোদিন কিছু বলেনি বা বলাবার সুযোগ পায়নি, কিন্তু গোপনে সে অনেক কৌশল অবলম্বন করেছিলো।

জুলেখা ভাইকে জানতো, চরিত্রহীন ভাইয়ের পাশে কোনো সময় মনিরাকে কল্পনা করতে পারতো না।

একদিনের কথা আজও মনে পড়ে জুলেখার। সেদিন কলেজ থেকে ফিরে জুলেখা আর মনিরা তাদের বাসায় ঘরে বসে গল্প করছিলো। বাইরে তখন ঝুপঝাঁপ বৃষ্টি পড়ছে। অল্পক্ষণের মধ্যে বৃষ্টির বেগ এত বেড়ে গেলো বাইরে বের হওয়াই মুস্কিল হয়ে পড়লো। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে মনিরা উদগ্রীব হয়ে উঠলো বাসায় ফিরবার জন্য। সেদিন কিন্তু মনিরা জুলেখাদের বাড়িতে কলেজ থেকে ফিরেছিলো। জুলেখাদের বাসায় যাবে বলে মনিরা ছেড়ে দিয়েছিলো। নিজেদের। গাড়ি, ফেরার সময় ওদের গাড়িতে ফিরবে আর কি। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। গল্পে গল্পে বেলাও শেষ হয়ে গেলো। বৃষ্টির বেগ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। মনিরা বারবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে। হাসছিলো জুলেখা। এমন সময় নাসির সেই কক্ষে প্রবেশ করলো। ভাইকে হঠাৎ তাদের বসবার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে একটু চমকে উঠেছিলো জুলেখা।

নাসির হেসে বলেছিলো–এসো মনিরা, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

নাসির শাহর ভিতরের খবর অতো জানতো না মনিরা। জুলেখার বড় ভাই হিসেবে সে তাকে। যথেষ্ট সম্মান করতো। আজ মনিরা সত্যি বিপদে পড়ে গিয়েছিলো, সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে অনেক্ষণ, মামা-মামী হয়তো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, শীঘ্র তাকে বাড়ি পৌঁছতেই হবে।

নাসির শাহর কথায় মনিরা খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ালো–চলি তাহলে জুলেখা?

কিন্তু জুলেখার মুখে নজর পড়তেই মনিরা চমকে উঠলো। গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে ভাইয়ের মুখের দিকে দৃঢ়কণ্ঠে বললো জুলেখা–তুমি যাও ভাইয়া। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। ড্রাইভারের সঙ্গে আমিই যাবো।

নাসির শাহ্ ক্রুদ্ধভাবে একবার জুলেখার দিকে তাকিয়ে গট গট করে বেরিয়ে গেলো কক্ষ। থেকে।

এই রকম আরও বহুবার মনিরাকে হাতের মধ্যে আনার জন্য চেষ্টা নিয়েছিলো নাসির শাহ। জুলেখাকেও এজন্য অনেক কথা বলেছে সে। কিন্তু জুলেখা প্রিয় বান্ধবীর অমঙ্গল চিন্তা করতে পারেনি কোনোদিন।

বিলেত থেকে ফিরে নাসির শাহর আচরণ দেখে জুলেখার মন একেবারে ভেঙে গিয়েছিলো। মদপান আর ক্লাব ফাংশন তার নিত্য সহচর। চরিত্রহীন ভাইয়ের জন্য জুলেখা প্রাণে ব্যথা পেয়েছিলো যেমন, ঘৃণাও হয়েছিলো তেমনি এবং সেই কারণেই মনিরা সম্বন্ধে কোনো কথা বাড়িতে কারও কাছে বলতে পারলো না।

বান্ধবী হয়ে বান্ধবীর চিন্তায় মগ্ন রইলো।

*

অসংখ্য অশ্বারোহী দস্যু সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান। সকলেরই পিঠের সঙ্গে রাইফেল ঝুলছে। কারও কারও হাতে তীর ধনু আর বর্শা।

প্রত্যেকের দেহে জমকালো পোশাক পায়ে বুট, মাথায় পাগড়ি আর গালপাট্টা বাঁধা। এক একজনের চেহারা অতি ভয়ঙ্কর। মস্ত মস্ত গোলাকার চোখ, মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল-শরীরের রং প্রায় সকলেরই কালো। মস্ত মস্ত একজোড়া গোঁফ, দেখলেই ভয় হয়। অনেকেরই মুখে এখানে– সেখানে ক্ষতিচিহ্ন।

সকলের মাঝখানে অশ্বপৃষ্ঠে রহমান, দ্বিতীয় অশ্বে নুরী। নূরীর দেহেও আজ পুরুষের ড্রেস পিঠে রাইফেল ঝুলছে। মাথায় পাগড়ি গালপাট্টা বাঁধা তাকে দেখলে কেউ নারী বলে ভ্রম করবে না। একটা সুন্দর যুবক বলেই মনে হয়।

রহমান সবাইকে লক্ষ্য করে বললো–ভাই, আজ আমাদের সর্দারকে উদ্ধারের দিন। আমরা নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও সর্দারকে রক্ষা করবো। হয়তো আমাদের অনেকেই আর ফিরে আসবে না। কিন্তু দেহে প্রাণ থাকতে সর্দারকে উদ্ধার না করে ফিরবো না বলো, তোমরা শপথ। করো আমার সামনে।

অসংখ্য কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো আমরা শপথ করছি, সর্দারকে উদ্ধার না করে ফিরবো না। বনভূমি প্রকম্পিত হলো দস্যগণের বজ্রধ্বনিতে। রহমান আনন্দসূচক শব্দ করলো–সাবাস!

রহমানের ইংগিতে সমস্ত দস্যু অনুচর নিজ নিজ অশ্বের লাগাম টেনে ধরলো। এবার উল্কাবেগে ছুটতে শুরু করলো অশ্ব গুলো। রাত্রির অন্ধকারে তারা জম্বুর গমনপথের দুই পাশে ছোট ছোট পাহাড় আর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকবে।

রাত্রি ভোর হবার পূর্বেই হাঙ্গেরী কারাগার থেকে দস্যু বনহুরকে নিয়ে পুলিশ ভ্যান জম্বুর পথে রওয়ানা হবে। জম্বুর কারাকক্ষে ত্রিফলা বিদ্ধ করে গুলী করে হত্যা করা হবে।

পথের দুই পাশে জঙ্গলে আর পাহাড়ে লুকিয়ে পড়লো বনহুরের অনুচরগণ। সবাই অধীর। আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো।

ওদিকে হাঙ্গেরী কারাগার প্রাঙ্গণে এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালো প্রায় পঁচিশখানা পুলিশ ভ্যান। অগণিত পুলিশফোর্স গুলীভরা রাইফেল হাতে সতর্কভাবে দণ্ডায়মান যেন পুলিশ বাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করছেন কয়েকজন পুলিশ অফিসার। প্রত্যেকের দেহেই সরকারি ড্রেস কোমরে বেল্টে গুলী ভরা রিভলভার।

পুলিশ সুপার কাওসার আহমদ স্বয়ং মিঃ আহমদ ও মিঃ জাফরী সহ বনহুরের কারাকক্ষের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। সংগে কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ।

বনহুর তার মৃত্তিকা শয্যায় বসেছিলো হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে একটু পূর্বে তাকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতক্ষণ বনহুর নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়েছিলো।

পুলিশ সুপার কাওসার আহমদের আদেশে কারাকক্ষের দরজা কড় কড় শব্দে খুলে গেলো।

উদ্যত রিভলভার হাতে কারাকক্ষে প্রবেশ করলেন পুলিশ ফোর্সসহ স্বয়ং পুলিশ সুপার ও পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয়।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো নিজের ইচ্ছায়।

পুলিশ সুপার ও পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয় রিভলভার উদ্যত করে আছেন বনহুরের বুক লক্ষ্য করে।

তাছাড়াও পুলিশগণ গুলীভরা রাইফেল বাগিয়ে ধরে আছে তার চারপাশে। মিঃ আহমদের নির্দেশে একজন পুলিশ বনহুরের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। আরও কয়েকজন বনহুরের সমস্ত শরীরে শিকল দ্বারা মজবুত করে বেঁধে ফেললো। বনহুরের মুখে নেই তবু ভীতির চিহ্ন, দীপ্ত সে মুখমণ্ডল। পুলিশ ফোর্স পরিবেষ্টিত হয়ে পুলিশ ভ্যানে উঠে বসলো দস্যু বনহুর। মাঝখানের ভ্যানে বনহুর, সম্মুখে এবং পিছনে বহু সংখ্যক পুলিশ ভ্যান। হাঙ্গেরী কারাকক্ষ হতে ভ্যানগুলো বেরিয়ে সোজা চলতে শুরু করলো।

আজ কান্দাইয়ের পথের দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অসংখ্য জনতা,সবাই একনজর দেখতে চায় দস্যু বনহুরকে। যে দস্যুর নামই শুধু তারা শুনে এসেছে এতদিন, আজ একবার চাক্ষুস। দেখতে চায় তারা।

পরে স্থান যদি না পায় সেইজন্য গভীর রাত থেকে পথের ধারে ভীড় করে জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়েছে সবাই। পথের দুই পাশে কোথাও তিল পরিমাণ স্থান নেই। লোকে লোকারণ্য। বৃদ্ধ যুবক, শিশু-নারী-পুরুষ সবাই দস্যু বনহুরকে দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে।

কান্দাইয়ের মহারাজ এলেও পথের ধারে এত ভীড় জমে উঠেনা,দস্যু বনহুরকে দেখবার জন্য প্রতিটি নরনারীর যত ভীড় জমে উঠেছিলো।

শুধু পথের দুই পাশে নয়, প্রত্যেকটা বাড়ির ছাদে এত নারী পুরুষ জমে গেছে, দেখলে বিস্ময় জাগে। শুধু মানুষ আর মানুষ কান্দাই শহরে এত মানুষ আছে, আজ যেন সবাই তা বুঝতে পারে।

গাছের শাখায় শাখায়, প্রাচীরের উপরে যে কোনো উচ্চ স্থানে যেখানে থেকে বনহুরকে দেখা। যাবে সব জায়গায় ভীড় আর ভীড়।

কান্দাই পথ আজ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে।

লক্ষ লক্ষ লোকের দৃষ্টি আজ পথের দিকে। পা ব্যথা হয়ে গেছে তবু কারও নড়বার নামটি নেই। কারণ, একটু সরে পড়লেই তার স্থানে যদি অন্য কেউ এসে দাঁড়িয়ে পড়ে!

স্থানচ্যুতির ভয়ে কেউ একটু নড়ছে না পর্যন্ত। সকলেরই চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে দস্য বনহুরকে দেখবার বিপুল উন্মাদনা। অন্তরের সমস্ত অনুভূতি নিয়ে প্রতীক্ষা করছে সবাই একটুখানি দেখবে তাকে। যার নাম শুনে তাদের হৃদকম্প শুরু হতো। যার নামে দেশবাসীর মনে এত আতঙ্ক।

যার নামই শুধু শুনে এসেছে এতদিন, কোনদিন তাকে দেখেনি কেউ,সেই দস্যু বনহুরকে আজ স্বচক্ষে দর্শন করবে। একটু স্থানের অভাবে যদি তাকে দেখতে না পায়। এমন সুযোগ আর কোন দিন তাদের জীবনে আসবে না।

দস্যু বনহুরকে স্বচখে দেখেছে–এটাই হবে যে তাদের মস্তবড় একটা বলবার মত কথা। বংশানুবংশক্রমে তারা বলতে পারবে তাদের পুত্র-কন্যাদের কাছে রং লাগিয়ে চটকদার কাহিনী হিসাবে।

কিন্তু এত আগ্রহশীল দর্শকবৃন্দের আশা সফল হবে কিনা কে জানে।

অসংখ্য পুলিশ ফোর্স পরিবেষ্টিত দস্যু বনহুরকে তাদের নজরে পড়বে কিনা তাইবা কে বলতে পারে!

দর্শকগণ নীরবে দাঁড়িয়ে নেই, তাদের মধ্যে বনহুরকে নিয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে। তার চেহারার নানা জনে নানা রকম বর্ণনা দিচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সে সব কথা। কেউ বলছে,দস্যু বনহুরের বিরাট চেহারা, মস্তবড় মাথা, বড় বড় চোখ, হেইয়া গোঁফ, হাতগুলী লোহার-সাড়াশির মত শক্ত, দেহটা রাক্ষসের মত দেখতে। কেউ বলছে, বনহুর মানুষই নয়–একটা অসুর; কেউ বলছে, বনহুর সুন্দর সুপুরুষ, এত সুন্দর মানুষ নাকি হয় না।

দর্শকগণ যখন বনহুরকে নিয়ে নানা রকম আলোচনায় ব্যস্ত, তাকে দেখার জন্য উদগ্রীব, তখন পুলিশ ভ্যানগুলো জনসমুদ্রের মাঝ দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে।

মধ্যের ভ্যানটিতে দস্যু বনহুর এবং পুলিশ ইন্সপেক্টারদ্বয় রয়েছেন আর আছে কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ।

কান্দাই শহরের বিশিষ্ট পথ ধরে ভ্যানগুলো এগিয়ে চলেছে। অসংখ্য জনতা ভীড় করে ঝুঁকে আসছে ভ্যানগুলোর দুই পাশে, সবাই দেখতে চায় দস্যু বনহুরকে।

পুলিশ ভ্যান এগুনো সম্ভব হচ্ছে না আর। একেবারে জনগণ ভ্যানের উপরে এসে পড়েছে সবাই জটলা করে।

পুলিশ কিছুতেই হটাতে পারছে না তাদের। গাড়ি যখন থেমে পড়লো অমনি অসংখ্য জনতা জটলা করে ঝুঁকে পড়লো বনহুরের ভ্যানটার উপরে।

একেবারে এভাবে জনতা ভেঙে পড়বে কল্পনা করতে পারেনি পুলিশ বাহিনী বা ইন্সপেক্টারদ্বয়।

জনতাকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়লো। সমস্ত পুলিশ বাহিনী ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো জনতার চাপে।

ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুর শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় লাফিয়ে পড়লো জনসমুদ্রে। হট্টগোল আর কলরবে জনতার ভীড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

পুলিশ রাইফেল উদ্যত করে আছে কিন্তু গুলী ছুঁড়তে সক্ষম হলো না, অসংখ্য জনতার মধ্যে কোথায় গুলী ছুঁড়বে তারা।

মিঃ আহমদ ও মিঃ জাফরী চিৎকার করে উঠলেন–গ্রেপ্তার করো, গ্রেপ্তার করো, দস্যু বনহুর পালিয়েছে…

লক্ষ কণ্ঠের কলরবে পুলিশ অফিসারদ্বয়ের কণ্ঠ মিশে গেলো। পুলিশ তবুও ভীড় ঠেলে ছুটলো, জনগণের ভীড়ে খুঁজতে লাগলো দস্যু বনহুরকে।

এদিকে জনতা যখন জানতে পারলো দস্যু বনহুর তাদের মধ্যেই আত্মগোপন করে পালিয়েছে, তখন এক মহা হই হুল্লোড় শুরু হলো। যে যেদিকে পারলো পালাতে লাগলো। ভয়ে সকলেরই মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হলো।

পুলিশ বাহিনী কিছুতেই জনতাকে আয়ত্তে আনতে পারছে না। যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। ‘চাচা আপন জীবন বাঁচা’ এ অবস্থা সকলের। যে যার টাকা-পয়সা, অলঙ্কার সামলানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। যুবতীগণ যেদিকে পারলো নিজেদের সামলাতে লাগলো, ভয় দস্যু বনহুর তাদের কাউকে হরণ করে নিয়ে না যায়। কর্তাগণ ছুটলেন নিজ নিজ বাড়ি সামলাতে।

আধঘন্টার মধ্যেই জনসমুদ্র, জনহীন রাজপথে পরিণত হলো। শুধু পুলিশের বাঁশির শব্দ আর তাদের ভারী বুটের আওয়াজ বিক্ষিপ্তভাবে শহরের রাজপথ অলিগলি মুখর করে তুললো।

সঙ্গে সঙ্গে কান্দাই শহরের রাজপথে যানবাহন, লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো। শুধু পুলিশের ভ্যানগুলো এদিক থেকে সেদিক উল্কাবগে ছুটাছুটি করতে লাগলো।

প্রতিটি বাড়িতে পুলিশ অনুসন্ধান চালালো।

প্রত্যেকটা অলিগলি, বাড়ির ছাদ, সিঁড়িঘর, আনাচে-কানাচে খুঁজতে লাগলো পুলিশ বাহিনী।

শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, যার যার নিজ নিজ বাড়িতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করে চললো বাড়ির মালিকগণ। সকলেরই বুক দুরু দুরু কাঁপছে। আতঙ্কগ্রস্ত হৃদয় নিয়ে সবাই খাটের নিচে, দরজার পাশে, আলমারীর পেছনে, বাথরুমে সন্ধান চালিয়ে চলেছে।

কিন্তু কোথায় বনহুর, সেকি হাওয়ায় উড়ে গেলো।

সমস্ত শহর তন্নতন্ন করে সন্ধান চললো। হোটেল-রেষ্টুরেন্ট-ক্লাব, সিনেমা হল, ছোটখাটো দোকানপাট সব জায়গাতেই খোঁজাখুজি চললো, কিন্তু কোথাও বনহুরকে খুঁজে পাওয়া গেলো না।

পুলিশ মহলে ভীষণ তোড়জোড় শুরু হলো। প্রত্যেকটা রাস্তায়, পথের বাঁকে ষ্টিমার ঘাটে, ফেরিঘাটে, টেলিফোন যোগে জানিয়ে দেওয়া হলো–দস্যু বনহুর পালিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ফোর্স ছুটলো। স্থানে স্থানে পাহারায় নিযুক্ত রইলো পুলিশগণ।

পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আহম্মদ কয়েকজন পুলিশ অফিসার সহ হন্তদন্ত হয়ে ছুটাছুটি শুরু করলেন। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে তাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিলো, অনেক অসাধ্য সাধন করেই তবে তিনি জয়ী হতে পেরেছিলেন।

দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে তিনি নিজেকে কৃতার্থ মনে করেছিলেন। তাঁর দক্ষ বুদ্ধি কৌশলকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলো। যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। পুরস্কৃতও হয়েছিলেন–সরকার বাহাদুর লক্ষ টাকা তাঁকে দিয়েছেন দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য।

পুলিশ সুপার কাওসার আহমদ সাহেব আজ স্বয়ং উপস্থিত থেকে দস্যু বনহুরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবেন। সমস্ত দেশবাসীকে ভয়ঙ্কর দস্যুর কবল থেকে নিষ্কৃতি দেবেন। আজ থেকে হবে সকল চিন্তার অবসান। কিন্তু সব পণ্ড হয়ে গেলো, পুলিশ বাহিনীর এত পরিশ্রম সব বিফলে গেলো। পুলিশ সুপার ব্যস্তভাবে এখানে সেখানে, বিভিন্ন থানা, পুলিশ অফিসে টেলিগ্রাম করে চললেন।

সমস্ত পুলিশ বাহিনীর ব্যস্ততার সীমা নেই। বাসায় ফেরা তো দূরের কথা, এতটুকু নিশ্বাস ফেলার সময় নেই কারও।

*

পুলিশ সুপার কাওসার আহমদ সাহেবের বাসা।

পড়বার ঘরে বসে সুফিয়া বইয়ের পাতা উল্টে চলেছে, কয়েক দিন পর তার এম, এ, ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু কিছুতেই বইয়ে মন দিতে পারছে না। যেদিন শুনেছে সুফিয়া দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার হয়েছে, সেদিন হতেই তার বুকের মধ্যে একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে। দস্যু বনহুরের সঙ্গে তার যে একটা গভীর সম্বন্ধ রয়েছে।

আজ কদিন থেকে সুফিয়ার চোখে ঘুম নেই, আহারে রুচি নেই। সব সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন। বারবার মনে পড়ছে তার কথা–কার দয়ায় আজ সে ফিরে পেয়েছে নিজের জিন্দেগী, নিজের ইজ্জৎ। ঝিন্দ রাজকুমার মঙ্গল সিন্ধের লালসাপূর্ণ কবল থেকে যে তাকে রক্ষা করেছিলো, সে অন্য কেউ নয়–স্বয়ং দস্যু বনহুর।

শুধু তাকে রক্ষা করেনি সে, বড় ভাইয়ের স্নেহ-মায়া-মমতা দিয়ে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলো। সুফিয়া আজও ভুলতে পারেনি তাকে, কোনো দিন ভুলতে পারবে না।

দস্যু হলেও তার অন্তরের যে পরিচয় সুফিয়া পেয়েছে, তা ফেরেস্তার চেয়েও মহান। শুধু মানুষ হলেই নয়; হৃদয় যার উন্নত–মহৎ, সেই তো মানুষ।

পৃথিবীর সবাই যদি দস্যু বনহুরকে ঘৃণা করে, তার সুন্দর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে সুফিয়া পারবে না তাকে অবিশ্বাস করতে।

আজ দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড।

সুফিয়া পিতাকে বিদায় দিয়ে তার নিজের ঘরে এসে বই নিয়ে বসেছে, কিন্তু বইয়ের পাতা উল্টেই যাচ্ছে শুধু সে একটা অক্ষর তার চোখে পড়ছে না। মন তার চলে গেছে দূরে–বহু দূরে সেই অতীতে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে…বিনয় সেন বেশে দস্যু বনহুর, আর নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে স্মরণ হতে লাগলো। সৌম্য-সুন্দর পুরুষোচিত দীপ্ত একখানা মুখ ভেসে উঠতে লাগলো সুফিয়ার চোখের সামনে, সে কিছুতেই নিজকে সংযত রাখতে পারছে না। দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড সংবাদে অসহ্য একটা বেদনা অনুভব করছে সুফিয়া মনের কোণে; ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার গণ্ড বেয়ে পুস্তকের উপরে…হঠাৎ একটা শিকলের শব্দ ঝনাৎ করে উঠে তার কানে; চমকে ফিরে তাকায় সুফিয়া, বিস্ময়ে আরষ্ট হয়ে যায় সে। তার বইয়ের সেলফের পেছন থেকে এগিয়ে আসে দস্যু বনহুর। সমস্ত শরীরে তার শিকল বাধা, হাতে হাতকড়া।

সুফিয়া বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে দাঁড়িয়ে, মুখে তার কোনো কথা বের হচ্ছে না–একি সে স্বপ্ন দেখছে না সত্য!

বনহুর বুঝতে পারে, সুফিয়া তাকে এখানে দেখে বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছেছে। বিস্মিত হবার কারণও বটে। বনহুর তার সামনে এসে দাঁড়ালো–সুফিয়া, মৃত্যুর কবল থেকে পালিয়ে এসেছি।

এতক্ষণে অস্কুটধ্বনি করে উঠলো সুফিয়া ভাইয়া। ঠিক সেই মুহূর্তে টেবিলে ফোনটা বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং করে। সুফিয়া রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো তার পিতার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ–হ্যালো সূফিয়া; বড় দুঃসংবাদ।

হ্যালো, বলুন? বললো সুফিয়া। গলার আওয়াজ কেমন কেঁপে গেলো তার।

ওদিক থেকে বললেন পুলিশ সুপার–দস্যু বনহুর পালিয়েছে, আমাদের পুলিশ ফোর্সের চোখে ধূলো দিয়ে সে অসংখ্য জনতার মধ্যে আত্মগোপন করেছে…

সুফিয়া কোন কথা বলতে পারছে না, চুপ করে শুনে যাচ্ছিলো। ওপাশ থেকে আহমদ সাহেবের ব্যস্তকণ্ঠ–হ্যালো সুফিয়া, হ্যালো…

হ্যালো বলুন আব্বা?

সুফিয়া, তোমার গলার আওয়াজ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। হ্যালো হ্যালো সুফিয়া, কি হয়েছে?

কিছু না।

সুফিয়া, দস্যু বনহুর এখন শহরের মধ্যে কোনো স্থানে আত্মগোপন করে আছে। শহরের বিভিন্ন পথে-ঘাটে সর্বস্থানে তার সন্ধানে পুলিশ বাহিনী ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করছে। সমস্ত পথে পুলিশ পাহারায় নিযুক্ত রয়েছে। কোনোক্রমে সে এখন শহরের বাইরে পালাতে পারবে না। হ্যালো সুফিয়া…হ্যালো…

বলুন আব্বা, বলুন, হ্যালো…বলুন?

প্রত্যেকটা বাড়িতে আনাচে-কানাচে, রান্নাঘরে, শোবার ঘরে খুঁজে দেখা হচ্ছে। হ্যালো সুফিয়া, আমাদের বাসায় তোমরা সাবধানে থাকবে…

সুফিয়া এবার বললো–ভয় নেই আব্বা, পুলিশ সুপারের বাড়িতে দস্যু বনহুর আসতে সাহসী হবে না।

ওদিক থেকে শোনা গেলো মিঃ আহমদ সাহেবের কণ্ঠ–তুমি জানো না সুফিয়া, দস্যু বনহুর কত সাংঘাতিক!

সাবধানেই থাকবো, চিন্তা নেই। সুফিয়া রিসিভার রেখে দিলো।

বনহুর বললো–সুফিয়া, মিথ্যে কেন বললে? আমি তো এসেছি।

সুফিয়া বনহুরের দিকে তখন তাকিয়ে আছে। সুন্দর মুখমণ্ডলে মলিন একটা ছাপ, ললাটের পাশে এক জায়গায় কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। চুলগুলো এলোমেলো রুক্ষ, হাতে হাতকড়া, সমস্ত শরীরে শিকল জড়ানো।

এমন সময় বাইরে শোনা গেলো মিসেস সুপারের কণ্ঠস্বর–সুফিয়া!

সুফিয়া চমকে উঠলো, তাড়াতাড়ি বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–ভাইয়া, আপনি শীঘ্র বাথরুমে প্রবেশ করুন, আম্মা এদিকে আসছেন।

বনহুর সুফিয়ার কথায় দ্রুত বাথরুমে প্রবেশ করলো।

পরক্ষণেই কক্ষে প্রবেশ করলেন মিসেস আহমদ, কন্যাকে লক্ষ্য করে বললেন–এখানে কার যেন কথা শুনলাম সুফিয়া?

কই, নাতো? আমিই পড়ছিলাম। আমার যেন মনে হলো কোনো পুরুষ-কণ্ঠ?

পুরুষ-কণ্ঠ! আমার ঘরে! …কি যে বলো আম্মা? সত্যি তুমি দিন দিন কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। আমার ঘরে পুরুষ আসবে কোথা থেকে!

কি জানি, তবে ওদিকে বোধ হয় রাজু কথা বললো। যাই দেখি রাজু বাজার নিয়ে বোধ হয় ফিরেছে।

রাজু পুলিশ-সুপার আহমদ সাহেবের বিশ্বাসী চাকর। যত দাস-দাসীই থাক বেগম সাহেবা রাজুকে ছাড়া কারও হাতে বাজারের টাকা দেবেন না। রাজুর বাজার নাকি সবচেয়ে তার মনপুতঃ হয়। বাসায় বেশ সংখ্যক চাকর-বাকর থাকা সত্ত্বেও সুপার গৃহিণীর অভ্যাস নিজ হাতে তরকারিটুকু কুটবেন, রান্নার সময় বাবুর্চির পাশে দাঁড়িয়ে রান্নাটা দেখবেন। কোনো কোনো দিন সখ করে তিনি নিজেও উনানের পাশে মোড়টা নিয়ে নিজ হাতে রান্না করবেন এসব তার অভ্যাস।

তাই রাজু যখন বাজার থেকে ফেরে তখন বেগম সাহেবা যেখানেই থাকুন না কেন, হাজির হবেন রান্না ঘরের দরজায়। অসুখ-বিসুখ হলেও তাঁর স্বস্তি নেই, চাদর মুড়ি দিয়ে এসে বসবেন মোড়াটা টেনে নিয়ে। রাহেলার মা ঝিঙ্গা কুটতে পারে ভালো, বেগম সাহেবা নিজে না পারলে ওকে দিয়েই কুটিয়ে নেন। ওটা এমনি করে কাটো, ওটা বেশি বড়ো করিসনে হঠাৎ যদি কোনোটা ভুল করে বসে তবে সুপার গৃহিণী রেগে আগুন হন, বলেন–নাঃ তোদের দিয়ে কিছু হবে না, যত। সব অকেজো। দে বটিটা, আমাকে দে দেখি, আমিই কুটছি।

রাহেলার মা অতি সাবধানে বেগুনটা বা আলুটা কাটছিলো কিংবা মাছের টুকরো করছিলো, বেগম সাহেবার বিরক্তিপূর্ণ কথাতে তাড়াতাড়ি বটি ছেড়ে দিয়ে সরে বসতো।

বেগম সাহেবা তরকারি কাটতে কাটতে বলতেন–দেখ একটু শিখে নে, দুদিন অসুখে পড়ে থাকলে যেন তরকারিটা অন্ততঃ কাটতে পারিস। সুপার-গৃহিণীর সংসারে প্রতি অত্যন্ত মোহ, কাজেই সবকিছু তিনি নিজে দেখাশুনা করিয়ে নেন।

আজও রাজুকে বাজারে পাঠিয়ে বেগম সাহেবা প্রতীক্ষা করছিলেন কখন ফিরবে সে। স্বামী সেই সাত সকালে এক কাপ চা মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। আজ দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড, কাজেই সারাটা দিন তিনি ব্যস্ত থাকবেন। কখন ফিরবেন ঠিক নেই।

এই বেলাটুকুর মধ্যে কতবার যে বেগম সাহেবা দস্যু বনহুরকে বদদোয়া করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। দস্যু বনহুরের জন্য আজ তার স্বামীকে রাত ভোর না হতেই ছুটতে হয়েছে অফিসে। কখন ফিরবেন না ফিরবেন তারও ঠিক নেই। শুধু কি আজই, এমনি অসময়ে ছুটতে হয়েছে বিশ্রাম ত্যাগ করে। তাই সুপার-পত্নীর যত রাগ ঐ দস্যু বনহুরের উপরে।

অবশ্য সুফিয়া মাকে বলেছিলো বহুদিন, আম্মা, দস্যু বনহুরকে তুমি দেখতে পারো না কেন? সে না হলে আজ তোমার কন্যাকে ফিরে পেতে না জানো?

বেগম সাহেবা বলতেন, যত বড় দস্যই হোক তোর আব্বার নাম শুনলে থরথর করে কাঁপে জানিস। তার ভয়েই দস্যু বনহুর তোকে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে।

সুফিয়া হেসে বলতো, তুমি জানো না আম্মা, দস্যু কোনোদিন কাউকে ভয় করে না, আর সে, তো দুঃসাহসী দস্যু বনহুর। বেশি কথা বলে মাকে বিরক্ত করতে চাইতো না সে, সরে যেতো। আলগোছে।

আজ সকাল থেকে মা দস্যু বনহুরকে উদ্দেশ্য করে যখন গালমন্দ করছিলেন, নীরবে সরে থেকেছে সুফিয়া। মনের অবস্থা তার মোটেই ভাল নয়, কাজেই মায়ের সঙ্গে কথা বাড়াতে মন তার চাইতো না। চুপচাপ সরে ছিলো পড়ার ঘরে।

সুপার-গৃহিণী চলে যেতেই সুফিয়া বাথরুমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, চাপাস্বরে ডাকলো– ভাইয়া!

বাইরে বেরিয়ে এলো বনহুর, বললো সে–সুফিয়া, আমাকে কতক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পারবে, তার চেয়ে পুলিশের হাতেই তুলে দাও।

ভাইয়া আপনার ঋণ জীবনে পরিশোধ করতে পারবো না। আমার জীবন দিয়েও আপনাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করবো।

কিন্তু পারবে?

দৃঢ়কণ্ঠে বললো সুফিয়া–পারবো।

সুফিয়া বোন, কি করে তা সম্ভব হয়। তবে কোনোক্রমে রাত অবধি যদি আমাকে…

আপনাকে এ অবস্থায় আমি ছেড়ে দিতে পারিনে ভাইয়া। শিকলে আপনার সমস্ত শরীর বাঁধা, হাতে হাতকড়া।

সুফিয়ার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো।

বনহুর বললো–উপায় কি বলো?

ভাইয়া, আপনার হাতকড়া খুলে দিলে আপনি…

সুফিয়াকে কথা শেষ করতে দেয় না বনহুর, বলে উঠে–হাত কড়ার চাবি সংগ্রই করতে পারবে সুফিয়া?

পারবো।

সত্যি?

হাঁ, আমি কৌশলে একটা হাতকড়া যোগাড় করে নেবো, নিশ্চয়ই সঙ্গে চাবি থাকবে। ভাইয়া, পুলিশ সুপারের মেয়ের একটা হাত কড়ার চাবি সংগ্রহ করতে বেশি সময় লাগবে না,

কিন্তু নয় সুফিয়া, তুমি আমার হাত দুটো মুক্ত করে দাও, তাহলেই দেহের শিকলের দিকে তাকিয়ে বললো বনহুর–এগুলো খুলে ফেলতে আমার বেশি সময় লাগবে না।

তাই দেবো ভাইয়া, আপনাকে মুক্ত করে দেবো।

সুফিয়া!

ভাইয়া, আপনি আমার শোবার ঘরে চলুন, এই তো ভিতর দিয়ে দরজা। চলুন কেউ আসবে না আমার ঘরে। আমার বিছানায় আপনি শুয়ে থাকুন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো বনহুর–সুফিয়া।

চলুন ভাইয়া।

সুফিয়া বনহুরকে সঙ্গে করে শোবার ঘরে প্রবেশ করলো। সুফিয়ার মা তখন সংসারের কাজকর্ম চাকর-বাকরগণকে দেখিয়ে দিতে ব্যস্ত।

সুফিয়ার কোনো ভাই-বোন ছিলো না, কাজেই তার ঘরে একমাত্র মা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতো না। আর করতো রাহেলার মা। সে ঘর পরিস্কার করতো, ঘর গোছাতো সুফিয়ার বই পত্তর গুছিয়ে রাখতো। চাকর বাকর অনেক থাকলেও সহসা কেউ সুফিয়ার কক্ষে যেতো না।

কাজেই বনহুরকে তার কক্ষে লুকিয়ে রাখতে তেমন কোনো কষ্ট হলো না। কিন্তু হঠাৎ যদি তার মা এসে পড়েন বা রাহেলার মা–তাহলে কি হবে, সুফিয়া একটু চিন্তিত হলো বইকি।

বনহুর সুফিয়ার কক্ষে প্রবেশ করে বললো–তোমার ঘরে আমার প্রবেশ অন্যায় সুফিয়া। তুমি পুলিশ সুপারের কন্যা। আর আমি একজন ঘৃণিত দস্যু।

না না ভাইয়া এ কথা আপনি বলবেন না, দস্যু হলেও আপনি মহান আমার জীবন রক্ষাকারী।

সুফিয়া, তোমাদের বাড়ির চারপাশে পুলিশ পাহারায় নিযুক্ত রয়েছে, দরজায় রাইফেলধারী। পুলিশ আর একজন দস তোমার কক্ষে।

দস্যু হলেও আপনি আমার ভাইয়া; আর আমি আপনার বোন। ভাইয়া, আপনি আমার বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করুন।

দস্যু বনহুর আর সুফিয়ার মধ্যে যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন তারা অত্যন্ত চাপা এবং নীচুস্বরে বলছিলো। কক্ষের বাইরে কেউ শুনতে পাচ্ছিলো না।

বনহুর সুফিয়ার বিছানায় বসলো।

সুফিয়া নিজ হাতে বনহুরের ললাটের রক্ত মুছে দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। তারপর দরজার পাশে গিয়ে উচ্চকণ্ঠে ডাকলোরাহেলার মা! রাহেলার মা!

যাই আপা…রাহেলার মায়ের কণ্ঠ শোনা গেলো।

অল্পক্ষণে রাহেলার মা এসে দাঁড়ালো–আপা আমায় ডাকছেন?

হাঁ, শোন্ এক কাপ চা আর কিছু গরম সিঙ্গারা নিয়ে আয়, এখনও কিছু নাস্তা করতে পারিনি তেমন করে। শোন এনে আমাকে বাইরে থেকে ডাকবি।

আজ নতুন নয়–সুফিয়া নিজের ঘরে কারও যাওয়া পছন্দ করতো না; বলতো তার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে। সুফিয়া প্রায়ই শাসিয়ে দিতো রাহেলার মাকে–খবরদার, আমার ঘরে ঢুকবি নে।

তাই আজ সুফিয়ার কথায় কিছুমাত্র অবাক হলো না রাহেলার মা, অবাক হলো হঠাৎ অসময়ে চা-সিঙ্গারা খাবার জন্য এত আগ্রহ কেন সুফিয়ার। বললো সে–আচ্ছা, আসছি আপামণি।

চলে গেলো রাহেলার মা।

অল্পক্ষণের মধ্যেই রাহেলার মা গরম সিঙ্গারা আর চা নিয়ে দরজার পাশ থেকে ডাকলো– আপামনি, চা…সিঙ্গারা…

দড়বড় বেরিয়ে এলো সুফিয়া, রাহেলার মার হাত থেকে চা-সিঙ্গারার ট্রে নিয়ে চলে গেলো। ভিতরে যাবার সময় বললো–নিজের কাজ করগে যা, আমি যখন ডাকবো তখন আসবি।

চলে যায় রাহেলার মা নিজের কাজে।

বেগম সাহেবা তরকারি কাটছিলেন, রাহেলার মাকে বললেন–দিয়ে এসেছিস বাছার চা আর সিঙ্গারা?

হাঁ; দিয়ে এলাম আম্মা।

বেশ করছিস বাছা মেয়েটা সময় মত খাবে না; হঠাৎ কখন সে কি খেতে ইচ্ছা করে ঠিক নেই। না খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে গেলো। বেগম সাহেবা আপন মনেই বিড় বিড় করে বলতে। লাগলেন।

সুফিয়া বনহুরের সম্মুখে খাবার রেখে বললো–ভাইয়া একটু মুখে দিন।

সুফিয়া, আমার হাত দুটো বাধা, খাবো কি করে, শুধু একটু বিশ্রাম করতে দাও।

আমি খাইয়ে দিচ্ছি ভাইয়া।

সুফিয়া!

বোন ভাইকে খাইয়ে দেবে এতে আপত্তি কিসে? সুফিয়া নিজের হাতে বনহুরের মুখে তুলে। দিতে লাগলো।

সত্যই বনহুর অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলো সুফিয়ার হাতে খেতে তার আপত্তি রইলো না।

এদিকে পুলিশ সুপারের কন্যাহস্তে দস্যু বনহুর যখন খাবার খাচ্ছিলো তখন পুলিশ সুপার দস্যু বনহুরের সন্ধানে পুলিশ ফোর্সদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন–একটা লোক যেন শহরের বাইরে যেতে না পারে কোন যানবাহনও নয়। শহরের প্রত্যেকটা রাস্তায় কড়া পাহারা থাকবে পুলিশ-সুপারের। নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ দল কাজ করতে লাগলো।

আজ গোটা দিন ধরে স্বস্তি নেই কারও।

পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে পুলিশ-গার্ড পর্যন্ত।

কোথায় আজ দস্যু বনহুরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে দেশবাসী নিশ্চিন্ত হবে, আর হলো কি।

কথাটা অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্ত শহরে প্রচারিত হলো। রেডিও অফিস থেকে বললেন পুলিশ সুপারের জরুরি ঘোষণা।

সুফিয়ার টেবিলে রেডিওতে একটা পল্লীগীতি হচ্ছিলো, সুফিয়া যখন বনহুরের মুখে চায়ের কাপ তুলে ধরলো ঠিক সেই মুহর্তে শোনা গেলো পুলিশ সুপারের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, “পুলিশ বাহিনীর যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও দস্যু বনহুর পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে বিপুল জনতার মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে। শহরের যে কোন গোপন স্থানে সে এখন আত্মগোপন করে আছে। আজ তার মৃত্যুদণ্ডের তারিখ ছিলো। তাকে হাঙ্গেরী কারাগার থেকে জম্বুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, কিন্তু আমাদের পুলিশ বাহিনীর সমস্ত সতর্কতা ভেদ করে দস্যু পালিয়েছে।”

বনহুর সুফিয়ার মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো।

সুফিয়া বললো–আব্বার গলা এটা।

বনহুর নির্বাক হয়ে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তখনও তাকিয়ে আছে সুফিয়ার মুখে।

*

মনিরা অন্ধ।

শুধু অন্ধই নয়, অসুস্থ। আজ স্বামীর মৃত্যুদণ্ড দিবস।

মনিরা খাটের সঙ্গে মাথা আছড়ে কাঁদছিলো, ভোর থেকে এখন পর্যন্ত এক মুহূর্ত তার কান্না। থামেনি। খাটে মাথা ঠুকে রক্ত বের করে ফেলেছে মনিরা, তবু মনে এতটুকু সান্ত্বনা পাচ্ছে না। মনিরার এ অবস্থা, বাড়ির সকলেরই মনে শান্তি নেই। গোটা বাড়িময় একটা করুণ ভাব ফুটে উঠেছে।

মরিময় বেগম আজ আর মনিরাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তার পাশে বসে নাই, নিজের ঘরে জায়নামাজে বসে দুহাত তুলে পুত্রের জন্য অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন। মায়ের হৃদয় আজ গুমড়ে। গুমড়ে কেঁদে উঠছে। সব ব্যথা এতদিন তিনি নীরবে সহ্য করে এসেছেন, এমন কি স্বামীর মৃত্যুও তাকে এতখানি বিচলিত করেনি। আজ মরিয়ম বেগম সমস্ত দুনিয়াকে অন্ধকার বিভীষিকাময় দেখছেন। পৃথিবীর সবাই যেন কাঁদছে আজ তাঁর সন্তানের জন্য। আকাশ বাতাস, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম। নদী, পাহাড়-পর্বত, সবাই যেন হাহাকার করছে, শুধু তার সন্তানের জন্য……

পাশের ঘরে মনিরার কান্নায় প্রতিধ্বনিই মরিয়ম বেগমের হৃদয়ে এই ভাবের সৃষ্টি করে চলেছে। বেচারী মনিরা, কিইবা এমন বয়স হয়েছে–এই বয়সেই সংসারের সব ব্যথা তাকে হজম করতে হচ্ছে। শিশুকালে পিতা মাতাহারা আশ্রয়স্থল হিসেবে একমাত্র মামুজানকে পেলো সে। তাঁকেও হারালো অল্পদিনের মধ্যে। নারীর মাথার মণি স্বামী–আজ সেই স্বামীকেও বেচারী হারাতে চলেছে। তাই শুধু নয়, নিজের দৃষ্টিশক্তিও হারিয়েছে সে…

চৌধুরী বাড়ির এই গুমোট ভাব দাসদাসীর মনে একটা অহেতুক চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই কিন্তু জানে না চৌধুরীবাড়ির ভিতরের গোপন রহস্য। জানতেন সরকার সাহেব আর সামান্য একটু জানতো নকিব।

সরকার সাহেব আজকাল একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েছেন। চৌধুরী বাড়ির আনন্দে তার। আনন্দ, চৌধুরী বাড়ির দুঃখে তার দুঃখ। আজ কতদিন হলো চৌধুরী বাড়ির আনন্দে ভাটা পড়েছে। কারও মুখে হাসি নেই, কারও মনে শান্তি নেই। সব সময় একটা বিমর্ষ থমথমে ভাব বাড়িটার সর্বত্র। সরকার সাহেব চৌধুরী বাড়ির একজন হিতাকাঙ্ক্ষী, কাজেই তার মনে যে দারুণ একটা অশান্তির করাল ছায়া আচ্ছন্ন থাকবে তাতে তার আশ্চর্য কি!

এই বাড়িতে একদিন কিনছিলো আর কি না হতো! সব সময় হলঘর গমগম করতো আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবে। চৌধুরী সাহেব ছিলেন সদা হাস্যালাপী মানুষ। একদণ্ড লোকজন না হলে তিনি যেন হাঁপিয়ে উঠতেন। তার বাড়িতে প্রায়ই খানা-পিনা-পার্টি ও ফাংশন লেগেই থাকতো। শহরের বাড়িতে যত না হতো, তার চেয়ে অনেক বেশি হতো তার দেশের বাড়িতে। বছরান্তে সপরিবারে চৌধুরী সাহেব নৌকাযোগে দেশে যেতেন। যে ক’দিন দেশের বাড়িতে থাকতেন নানা রকম উৎসব আর আনন্দ চলতো।

এ গ্রাম, সে গ্রাম থেকে আত্মীয়কুটুম্ব এসে বাড়ি সরগরম হয়ে উঠতো। বন্ধুবান্ধবে মুখর হয়ে উঠতো বৈঠকখানা। মেয়ে মহলেও তেমনি ভীড় জমতো। যেখানে যে আত্মীয়া এসে জড়ো হতো সবাই চৌধুরী বাড়িতে। মরিয়ম বেগম বহুদিন পর তাঁর আত্মীয়দের পেয়ে অনেক খুশি হতেন। অভাব নেই কিছুর–রান্নার উঠানে রান্না চলেছে, গল্পের আসরে গল্প বৈঠকখানায় চৌধুরী সাহেব পুরুষদের নিয়ে মেতে থাকেন। খাবার সময় হলে ডাক পড়তো উঠানে। চৌধুরী সাহেব সঙ্গী সাথীদের নিয়ে পরম আনন্দে ভোজন করতেন।

সরকার সাহেবের এসব কি ভুলবার! কোনোদিন তিনি এ বাড়ির কারও বিষণ্ণ মুখ দেখেননি, অবশ্য শিশু মনির হারিয়ে যাবার পর কিছুদিন চৌধুরী বাড়ির রূপ বদলে গিয়েছিলো সম্পূর্ণরূপে। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে চৌধুরী সাহেব এবং বেগম সাহেবা উন্মাদ প্রায় হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু সেও তো আজ পঁচিশ বছর আগের কথা।

পুত্রহারা চৌধুরী সাহেব তারপর নিজকে সুস্থির করে নিতে পেরেছিলেন অনেক কষ্টে। আল্লাহ যা করেন তার উপর তো হাত বাড়াতে পারবেন না। তিনি নিজের অদৃষ্টের উপর বিশ্বাস রেখে সন্তানের স্মৃতি মুছে ফেলেছিলেন মন থেকে।

আবার তিনি পূর্বের ন্যায় হাসি-খুশিতে মুখর হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে মনিরাকে পেয়ে তিনি ভুলতে সক্ষম হয়েছিলেন প্রিয় পুত্র মনিরকে। কন্যা সমতুল্য মনিরা মামা-মামীর সমস্ত হৃদয় জয় করে নিতে পেরেছিলো।

মনিরার হাসি-খুশি মুখ সন্তানহারা স্বামী-স্ত্রীর মনে এনেছিলো এক অনাবিল আনন্দ। চঞ্চল শিশু মনিরা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো, ভুলে গেলেন চৌধুরী সাহেব মনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজ পুত্রের মুখ।

যদিও চির হাস্যময় চৌধুরী সাহেব পুত্রের অন্তর্ধানে একেবারে অসাড়ের মত স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তাঁর এই ভাবগম্ভীর মুহূর্তগুলো বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি, মনিরার উচ্ছল হাসি-খুশি আবার তাঁকে পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক করে তুলেছিলো। অন্তরের ব্যথার আগুনে গুমড়ে আগুন মরলেও নিজেকে বেশিক্ষণ চিন্তাযুক্ত রাখতে পারেননি। মনিরাকে বুকে নিয়ে পুত্রস্মৃতি ভুলতে চেষ্টা করেছেন। মরিয়ম বেগমও স্বামীর মনের কথা বুঝতেন কিন্তু কি করবেন যা গেছে তা কি আর ফিরে আসবে! তাই তিনিও স্বামীকে সান্ত্বনা দিতেন, নানা রকম প্রবোধ বাক্যে স্বামীর মনের ব্যথা মুছে ফেলতে চেষ্টা করতেন।

বছর গড়িয়ে যাচ্ছিলো, চৌধুরী বাড়ির রূপ আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছিলো। আবার ভাবগম্ভীর চৌধুরী সাহেব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে হলঘর সরগরম করে তুলতেন। মনিরাই তাদের এখন সব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। মনিরাকে লেখাপড়া, গান-বাজনা শেখানো হয়ে উঠেছিলো চৌধুরী সাহেব ও তার গৃহিণীর চরম লক্ষ্য। বছরে চৌধুরী বাড়িতে নানা রকম উৎসব লেগেই থাকতো। আজ মনিরার জন্ম উৎসব, কাল মনিরার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আনন্দ উৎসব, পরশু বান্ধবীদের নিয়ে পার্টি। তারপর চৌধুরী সাহেবের নিজস্ব ফাংশানের তো কথাই ছিলো না।

আজ সরকার সাহেব হলঘরে বসে এসব কথাই ভাবছিলেন। এতদিন তবু নানা কথায় সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়ে বেগম সাহেবা আর মনিরাকে প্রবোধ দিয়ে এসেছেন। যদিও তিনি জানতেন এ সব বলা তার বৃথা, তবুও না বলে পারতেন না।

কিন্তু আজ তার মুখে কোনো কথা সরছে না।

স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন স্থবিরের মত, সম্মুখে রেডিওটা ভোলা, একটু পূর্বে খবর হয়ে গেছে, এখন পল্লীগীতি হচ্ছিলো।

সরকার সাহেবের কোনো দিকে খেয়াল নেই, তিনি নিশ্চুপ বসে শুনছিলেন, পল্লীগীতি নয় খবর। কিন্তু কখন যে খবর শেষ হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই তার।

হঠাৎ সরকার সাহেবের চিন্তাধারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। রেডিওতে শোনা যায় একটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠের জরুরি ঘোষণা–”পুলিশ বাহিনীর যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও দস্যু বনহুর পুলিশভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে বিপুল জনতার মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে”…

এটুকু শুনেই সরকার সাহেবের মুখচোখ খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলো, তিনি আর শুনবার ধৈর্য ধরতে পারলেন না, ছুটলেন সিঁড়ি বেয়ে উপরে–বেগম সাহেবা, বেগম সাহেবা-মা মনিরা, মা মনিরাও পালিয়েছে, ও পালিয়েছে…মনির পালিয়েছে…

সরকার সাহেবের কলকণ্ঠ মরিয়ম বেগমের কানে পৌঁছতেই তিনি জায়নামাজ থেকে উঠে ছুটে চললেন সরকার সাহেবের দিকে।

মনিরার কানেও সরকার সাহেবের গলার আওয়াজ গিয়ে পৌঁছেছিলো। মনিরা অন্ধ–সে কথা নিজে ভুলে গেলো, উঠিপড়ি করে সেও এগুতে লাগলো।

মরিয়ম বেগমের চোখে অশ্রু মুখে হাসির ছটা, তিনি চিৎকার করে বলছেন আর ছুটছেন– আমার মনির পালিয়েছে? আমার মনির পালিয়েছে…।

মনিরার দৃষ্টিশক্তি নেই। সে কানে শুনতে পাচ্ছে বটে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। বার বার দেয়ালে টক্কর খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, আবার উঠছে, এগুচ্ছে, আবার হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যাচ্ছে, তবু মুখে দীপ্ত হাসির ছটা।

অপূর্ব সে মুহূর্ত, ওদিক থেকে সরকার সাহেব সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে আসছেন, ও ঘর থেকে মরিয়ম বেগম ছুটে আসছেন, ও ঘর থেকে মনিরা একবার উঠছে, একবার পড়ছে, আবার দেয়াল ধরে ধরে হাতড়ে এগুচ্ছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে সরকার সাহেব এসে দাঁড়ালেন দোতলার বারান্দায়। মরিয়ম বেগমও এসে সম্মুখে দাঁড়ালেন, চোখেমুখে তার ফুটে উঠেছে দীপ্ত উচ্ছ্বাস।

সরকার সাহেব খুশিতে আত্মহারা হয়ে ব্যস্তকণ্ঠে বললেন–পালিয়েছে, বেগম সাহেবা ও পালিয়েছে।

কে…কে পালিয়েছে সরকার সাহেব, আমার মনির?

হাঁ হাঁ বেগম সাহেবা…

মনিরা তাড়াতাড়ি আসতে আবার পড়ে গেলো হোঁচট খেয়ে। অস্ফুট কণ্ঠে বললো–সে পালিয়েছে!

মরিয়ম বেগম দ্রুত মনিরাকে তুলে ধরলেন।

সরকার সাহেব বললো–আসুন, রেডিও ঘোষণা শুনুন।

মনিরার কক্ষে ছিলো একসেট রেডিও। যখন খুশি মনিরা রেডিও খুলে দিয়ে গান শুনতে খবর শুনতো। আজ কদিন সে রেডিও স্পর্শ করেনি।

মরিয়ম বেগম আর মনিরা সহ সরকার সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করলেন।

সরকার সাহেব দ্রুতহস্তে রেডিও চালু করে দিয়ে বললেন–শুনুন শুনুন বেগম সাহেবা। মনির শোনো মা, আমি বলেছিলাম–আমাদের ছোট সাহেবকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না…

রেডিওতে তখনও পুলিশ-সুপারের গম্ভীর কণ্ঠের ঘোষণা চলেছে। তিনি জনগণকে বারবার দস্যু বনহুর সম্বন্ধে সাবধান হবার নির্দেশ দিচ্ছেন।

রেডিওর পাশে ঝুঁকে পড়লেন সরকার সাহেব, মরিয়ম বেগম আর মনিরা। তাদের নিশ্বাস পড়ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। স্তব্ধ হয়ে শুনছেন তারা পুলিশ-সুপারের সাবধান বাণী।

পুলিশ সুপারের কণ্ঠস্বর–”বিপুল জনতা তাকে দেখবার জন্য পথের ধারে এমনভাবে ভিড় করে” শেষ পর্যন্ত জনতা পুলিশ ভ্যানের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, যার জন্য দস্যু পালাতে সক্ষম হয়। পুলিশ কিছুতেই জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সক্ষম হয়নি। দস্যু বনহুর যখন জনতার মধ্যে উধাও হলো তখন শুধুমাত্র জনতার জীবনহানির আশঙ্কায় পুলিশ গুলী ছেড়েনি। দস্যু বনহুরের হাতে এখনও হাতকড়া এবং তার শরীরে মজবুত করে শিকল আটকানো আছে। যে তাকে পুনঃ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে তাকে পঁচিশ হাজার টাকা বখশীস দেওয়া হবে। আমি আবার আপনাদের সাবধান করে দিচ্ছি আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ির সর্বত্র সর্তক দৃষ্টি রাখুন, দস্যু বনহুর আপনাদের মধ্যেই আত্মগোপন করে আছে…

মনিরা দু’হাতে টেবিলের রেডিও চেপে ধরে আনন্দভরা কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো– তুমি বেঁচে আছো! তুমি বেঁচো আছো–

মরিয়ম বেগম দু’হাত উপরে তুলে ধরে–হে পাক পারওয়ারদেগার, তুমি রহমানুর রাহিম, তোমার অসাধ্য কিছু নেই। আমার মনিরকে তুমি বাঁচিয়ে নাও, ওকে যে আমি তোমার দরগায় সঁপে দিয়েছি।

সরকার সাহেব চোখে অশ্রু মুখে হাসি নিয়ে বললেন–বেগম সাহেবা, ছোট সাহেবের কেউ অমঙ্গল করতে পারবে না। সে যে অতি উত্তম পুরুষ।

মনিরা অন্ধ হয়েছে তবু তার দুঃখ নেই ব্যথা নেই সে জন্য। আজ তার আনন্দ মৃত্যুর কবল থেকে তার মনির উদ্ধার পেয়েছে।

মরিয়ম বেগম আবার গিয়ে জায়নামাজে বসলেন, খোদার কাছে পুত্রের মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন। না জানি কোথায় কি অবস্থায় এখন সে আছে। যেখানেই থাকে ওকে তুমি রক্ষা করো দয়াময়। ওকে তুমি উদ্ধার করো…

*

বেলা বেড়ে আসছে, রহমান দলবল নিয়ে প্রতীক্ষা করছে এই পথেই তাদের সর্দারকে নিয়ে পুলিশ ভ্যানগুলো আসবে। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা গড়িয়ে চললো। এতক্ষণও কোনো সাড়াশব্দ নেই পুলিশ ভ্যানের।

নূরী সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেলো, রহমানকে লক্ষ্য করে বললো–রহমান, আমাদের এই আক্রমণ প্রস্তুতি পুলিশবাহিনী হয়তো জ্ঞাত হয়েছে। তাই তারা সাবধানতা অবলম্বন করে অন্য পথে জম্বুর কারাগারে গমন করেছে।

রহমান উদ্যত রাইফেল সোজা করে উঠে দাঁড়ালো–জম্বুর কারাগারে যাবার এই একমাত্র পথ। নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা ঘটে গেছে।

নূরী বলে উঠলো–রহমান, আমার মন বলছে–হুঁরকে পুলিশ বাহিনী ধরে রাখতে পারেনি। রহমান, সে নিষ্পাপ, সে পবিত্রতাকে কেউ জঘন্যভাবে হত্যা করতে সক্ষম হবে না

রহমান বলে ওঠেনূরী, আইনের কাছে নিষ্পাপ বা পবিত্রতার প্রশ্ন কোনো কাজ করে না। সর্দারকে ওরা আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। পুলিশ কিছুতেই তাদের আইন ভঙ্গ করবে না।

কিন্তু আমার মন বলছে তাকে ওরা মৃত্যুদণ্ড দিতে সক্ষম হবে না।

সাবাস নূরী, খোদার কাছে এই প্রার্থনাই করো আমরা যেন সর্দারকে উদ্ধার করতে পারি।

রহমানের কথা শেষ হয় না,একটা পুলিশ ভ্যান দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকে দেখতে পায় তারা।

পুলিশ ভ্যানখানা অত্যন্ত বেগে এগিয়ে আসছে। যেখানে সে অনুচর আত্মগোপন করেছিলো সবাই রাইফেল বাগিয়ে প্রস্তুত হয়ে নেয়।

রহমান আর নূরী পাশাপাশি দুটো টিলার পাশে ছিলো। উভয়ের হাতেই গুলীভরা রাইফেল। রহমান চোখে দূরবীণ লাগিয়ে দেখছিলো, বললো সে–মাত্র একটা পুলিশ ভ্যান দেখতে পাচ্ছি।

নূরী বললো এবার তাহলে হুরকে এটাই আনছে নাকি?

রহমান হাসলো–এত বড় দুঃসাহস হবে পুলিশ বাহিনীর। দস্যু বনহুরকে একটি মাত্র পুলিশ ভ্যানে করে আনবে তারা অন্য কারাগারে?

দাও দূরবীণটা আমাকে দাও দেখি। নূরী রহমানের হাত থেকে দূরবীণ নিয়ে টিলার পাশে। উবু হয়ে শুয়ে পড়ে। ভাল করে লক্ষ্য করতেই দেখতে পায় ঐ ভ্যানে শুধুমাত্র কয়েকজন পুলিশ হাতে রাইফেল সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। না তার হুর নেই ওর মধ্যে।

নূরীর মনে সান্ত্বনা আসে, দূরবীণটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে–এরা তাহলে এভাবে আসছে কেন?

দূরে ভ্যানটা পথের বাঁক ঘুরে ফিরে এগিয়ে আসছে।

রহমান বললো–কেমন করে বলবো বলো?

অন্যান্য দস্যু বাঁশি যুঁকিয়ে সজাগ হয়ে নিলো।

রহমান ক্ষান্ত থাকবার ইংগিতে বাঁশিতে শব্দ করলো।

কাজেই অন্যান্য দস্যু কেউ আর গুলী ছুঁড়বার জন্য প্রস্তুত হলো না।

রহমান তাড়াতাড়ি একটা বড় টিলার আড়ালে গিয়ে নিজের দস্যু ড্রেস পালটে অন্ধ ভিখারী সেজে নিলো তারপর বললো–নূরী, আমি এদের কাছে খবর নিয়ে আসি, সর্দার কোথায়।

নূরী বললো–ওরা যেভাবে এগিয়ে আসছে তাতে তোমার মত ভিখারীর সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে কথা বলবে বলে মনে হয় না।

তুমি চুপ করে দেখো নূরী। নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। নইলে একখানা পুলিশ ভ্যান এমন দ্রুত গতিতে জম্বু অভিমুখে ছুটতো না।

রহমান ছোট ছোট টিলা আর ঝোপঝাড় পেরিয়ে ছুটতে থাকে গাড়ি এতদূর এসে পড়বার পূর্বেই তাকে পথে পৌঁছতে হবে।

রহমান অত্যন্ত দ্রুত কাজ করলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই পথে এসে দাঁড়ালো। দ্রুত হস্তে কাঁধের ঝোলা থেকে কতকগুলো লোহার কাঁটা বের করে পথের ধুলোর মধ্যেই লুকিয়ে সোজা করে রাখলো। তারপর সেই স্থান হতে অনেক দূরে সরে গিয়ে খুড়িয়ে চলতে লাগলো আর বলতে লাগলো সে–আল্লা একটা পয়সা দে। আল্লা একটা পয়সা দে–

এদিকে পুলিশ ভ্যানটা দ্রুত এসে পড়লো সেই স্থানে। হঠাৎ পেছনের চাকার হাওয়া বেরিয়ে গেলো পুলিশ ভ্যানটার। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেমে গেলো।

পুলিশ ফোর্স গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। তাদের কাছে পৃথক চাকা ছিলো, চাকা লাগানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই– সকলেরই চোখেমুখে ব্যস্ততার ছাপ।

এগিয়ে আসে ভিখারী, হাত পাতে পুলিশদের সামনে–আল্লা একটা পয়সা দে। আল্লা। একটা পয়সা দে–

একজন পুলিশ ধমক দিলো–ভাগ এখান থেকে, বেটা আমরা জ্বালায় বাঁচছি না, একটা পয়সা–মুখ ভেংচে বললো সে।

ভিখারী আবার হাত পাতলো আর একজনের সামনে একটা পয়সা দে–একটা পয়সা–

অন্য একজন পুলিশ বললো–বেচারা খোঁড়া ভিখারী, দিয়ে দাও একটা আনা। এই এদিকে আয়, নে। পুলিশটার প্রাণে দয়া আছে, পকেট থেকে একটা আনি বের করে ভিখারীর হাতে দিলো।

ভিখারী হাত উঁচু করে দোয়া করলো, তারপর বললো–বাবু তোমরা কোথায় যাবে।

যে পুলিশটা পয়সা দিয়েছিলো সেই বললো–দস্যু বনহুরের নাম শুনেছিস বুড়ো?

দস্যু বনহুর! হাঁ শুনেছি বাবা, তাকেই ধরতে যাচ্ছো বুঝি?

দস্যু বনহুর পালিয়েছে, তাই জম্বুতে খবর দিতে যাচ্ছি আমরা।

দস্যু বনহুর পালিয়েছে? এত জোয়ান জোয়ান লোক তোমরা অথচ একজনকে ধরে রাখতে পারলে না? আল্লা একটা পয়সা দে– একটা পয়সা দে– ভিখারী চলে গেলো বিপরীত দিকে।

ততক্ষণে গাড়ির চাকা পাল্টানো হয়ে গিয়েছিলো, পুলিশগণ গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিলো। রহমান ছুটলো তার দলবলের নিকটে। রহমানকে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে আসতে দেখে তার দল বল সবাই তাকে ঘিরে ধরে। নূরী ব্যস্তকণ্ঠে বলে ওঠে–রহমান খবর কি রহমান?

রহমান আনন্দধ্বনি করে ওঠেনূরী তোমার কথাই সত্য হলো! সর্দার পুলিশের হাত থেকে পালিয়েছে।

রহমান!

হাঁ নূরী, সত্য। সেই সংবাদ নিয়েই পুলিশ ভ্যানটি জন্ধুর পথে যাচ্ছে।

আমি জানতাম ওকে কেউ বন্দী করে রাখতে পারবে না। কেউ ওকে হত্যা করতে সক্ষম হবে না। আর কি সংবাদ রহমান? এখন আমার হুর কোথায়? কেমন আছে সে?

পাগলী, সে সংবাদ আমি কি করে জানবো?

রহমান বাঁশির শব্দে সমস্ত অনুচরগণকে একত্রিত করলো। তারপর তাদের সর্দারের সংবাদ জানালো।

সবাইকে ডেকে একটা সভা করলো।

রহমান সুউচ্চ একটা পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে অনুচরদের লক্ষ্য করে বললো–ভাইরা সর্দার আমাদের রক্তক্ষয় হতে রক্ষা করলেন। তিনি নিজকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন পুলিশের হাত থেকে। কিন্তু তিনি এখন কোথায় কিভাবে আছেন আমরা কিছু জানি না। পুলিশদের নিকটে শুধু এইটুকুই জানতে পেরেছি–দস্যু বনহুর পালিয়েছে।

অনুচরগণ আনন্দধ্বনি করে উঠলো।

তাদের সংঘবদ্ধ কণ্ঠস্বর প্রকম্পিত হয়ে উঠলো বনাঞ্চল।

রহমান বললো এবার–ভাইগণ, আমরা এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নই, যতক্ষণ না সর্দার আস্তানায় ফিরে এসেছেন। কাজেই আমাদের কাজ এখন অনেক বাকি। এই দণ্ডে আমরা কয়েকজন ছদ্মবেশে শহরে প্রবেশ করবো। গোপনে অনুসন্ধান করতে হবে–কোথায় কিভাবে আছেন তিনি। নিশ্চয়ই পুলিবাহিনী সমস্ত শহরটাকে কড়া পাহারায় রেখেছে, আমাদের অতি সাবধানে কাজ করতে হবে। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা–শহরে প্রবেশ করা কঠিন হবে। একটু নিশ্চুপ থেকে কি যেন ভাবলো রহমান, তারপর বললো–যে পুলিশ ফোর্স অল্পক্ষণ পূর্বে জম্বু অভিমুখে চলে গেলো তারা নিশ্চয়ই ফিরে আসবে এবং এই পথেই আসবে।

নূরীর চোখ উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠলো, আনন্দসূচক কণ্ঠে বললো সে–ঠিক বলেছো রহমান, ঐ সুযোগেই একমাত্র পথ শহরে প্রবেশ করবার।

হাঁ, পুলিশ ভ্যানটাকে আটকাতে হবে এবং গাড়িতে যে ক’জন পুলিশ ছিলো তাদের সাবধানে। আটকে রাখতে হবে। তাদের পোশাকগুলো এবং ভ্যানটা হলেই আমাদের চলবে।

নূরী বললো–সাবাস বুদ্ধি তোমার রহমান।

মুখ গম্ভীর করে ব্যথাভরা কণ্ঠে বললো রহমান-কই আর বুদ্ধি খাটাতে পারলাম। সর্দারকে জান দিয়ে উদ্ধার করতে পারলে নিজকে ধন্য মনে করতাম, কিন্তু সর্দার সে সুযোগ আমাদের দিলেন কই। একটু চুপ করে থেকে বললো রহমান-এবার আমাদের কিছু সংখ্যক অনুচরকে কান্দাই প্রবেশ পথে পাহাড়িয়া অঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকতে হবে, যতক্ষণ না ঐ পুলিশভ্যানটা ফিরে আসে। তারপর নূরীর দিকে তাকিয়ে বললো–নূরী তুমি বহুক্ষণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে, তোমার মনি বড় পেরেশান হয়ে পড়েছে, যাও এবার তোমার ছুটি।

নূরীর মনে মনির কথা উদয় হতেই চিন্তিত হলো। অশ্বযোগে সোজা সে আস্তানায় ফিরে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে পুরুষ ড্রেস পাল্টে নিলো। তারপর এগিয়ে চললো যেখানে নাসরিন আর জোবাইদা মনিকে নিয়ে খেলা করছিলো সেখানে।

নূরী নিকটবর্তী হতেই তার কানে এলো মনির কণ্ঠস্বর বলো না, আমার বাপি কোথায়? বলোনা নাসু, আমার বাপি কোথায়? কোথায় গেছে সে?

মনি নাসরিনকে নাসু বলে ডাকতো, এটা অবশ্য নূরীর শেখানো বুলি। আর জোবাইদাকে জুবি বলতো মনি। নূরী নিজেই সঙ্গিনীদের আদর করে এই নামে ডাকতো। আম্মির মুখে শুনে শুনে মনিরও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো ঐ নাম দুটো।

মনির কথা শুনে আড়ালে লুকিয়ে পড়লো নূরী।

মনি যদিও কথাটা নাসুকে জিজ্ঞাসা করলো কিন্তু জবাব দিলো জোবাইদা–তোমার বাপি কে মনি? যাকে তুমি বাপ বলে ডাকো, তিনিতো আমাদের সর্দার।

আমার বাপি তো তোমাদের সর্দার।

হেসে বললো জোবাইদা–তোমার আম্মির এখনো বিয়েই হয়নি।

আম্মির বিয়ে হয়নি?

না।

বিয়ে কেমন বলোনা জুবি?

তোমার আম্মিকে জিজ্ঞেস করো।

নূরী আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এসব কি হচ্ছে?

একসঙ্গে মুখ টিপে হাসে নাসরিন আর জোবাইদা।

মনি কিছু বুঝতে না পেরে একবার তার আম্মির একবার নাসরিন আর জোবাইদার মুখে তাকায়।

নূরী অভিমানে মুখ ভার করে মনিকে তুলে নেয় কোলে, তারপর নিজের ঘরে চলে যায়।

কানের কাছে জোবাইদা আর নাসরিনের কথাগুলোর প্রতিধ্বনি হতে থাকে। জোবাইদার কণ্ঠ– তোমার আম্মির বিয়েই হয়নি, বাপি পাবে কোথায় মনি তোমার আম্মির বিয়ে হয়নি, তোমার আম্মির বিয়েই হয়নি।

নূরী মনিকে বুকে চেপে ধরে অস্ফুট কন্ঠে বলে–না না, বিয়ে আমার হয়ে গেছে–বিয়ে আমার হয়ে গেছে–হুঁর আমার স্বামী।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে জোবাইদা আর নাসরিন।

জোবাইদা বলে-নূরী, তুমি যা বলছে তা সম্পূর্ণ নিছক ভিত্তি হীন। নূরী, আমরা তোমার সঙ্গিনী, শিশুকাল হতে একসঙ্গে খেলাধূলো করে আজ এত বড় হয়েছি! আগে ছোট ছিলাম, তুমিও ছিলে, খেয়ালের বশে যা করেছে বা আমরা করেছি তা তেমন কোনো দোষণীয় নয় কিন্তু আজ আমরা বড় হয়েছি, তুমিও হয়েছে। সব বুঝতে শিখেছো জানো মুসলমান হলে কলেমা না পড়ে কোনোদিন বিয়ে হয় না। সর্দার তোমাকে বিয়ে করেনি, কলেমা পাঠ করে তোমাকে বিয়ে করেনি

নূরী ফিরে তাকালো জোবাইদার দিকে, চোখে তার ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে।

নাসরিন নূরীর কোল থেকে মনিকে নিজের কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

ছোটবেলা থেকেই নাসরিন নূরীর অত্যন্ত প্রিয়, দুজনের মধ্যে ভাবও অত্যন্ত বেশি। জোবাইদার সঙ্গেও নূরীর ভাব কম নয় তবে জোবাইদা একটু স্পষ্টভাষী। কাউকে কোনো কথা বলতে তার মুখ আটকায় না। ন্যায় কথা বলতে কাউকে সে পরওয়া করে না।

নাসরিন বুঝতে পারলো, দুই সখীর মধ্যে এখন তর্ক-বিতর্ক শুরু হবে, ছোট বেলা হলে কিল চড়ও হতো অনেক। অবশ্য এখন আর সে সব হয় না, শুধু কথা কাটাকাটি চলে।

সর্দারের সঙ্গে নূরীর মেলামেশাটা শুধু জোবাইদার নয়, আস্তানার অনেকের চোখেই বাধতো। দস্যু হলেও তারা মানুষ, কাজেই নিয়মের ব্যতিক্রম সবার কাছেই দৃষ্টিকটু মনে হয়।

সর্দারের সঙ্গে ব্যাপারটা–কাজেই মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে সাহসী হতো না।

তাছাড়া অনুচরগণ সবাই জানতো তাদের সর্দার সম্পূর্ণ উদাসীন এ ব্যাপারে। নূরীকে যতদূর সম্ভব বনহুর এড়িয়ে চলে–এটা সবাই ভালভাবে লক্ষ্য করেছে। সর্দারকে তারা দোষ দিতে পারে না, বরং তাকে অন্তরে অনুচরগণ গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে।

শ্রদ্ধা করলেও নূরীর সঙ্গে সর্দারের মেলামেশা নিয়ে দু’চারটা গোপন আলোচনা যে চলে না, তা নয়।

এতদিন সবাই জানতো–সর্দার নূরীকেই বিয়ে করবে। এমনকি নাসরিন জোবাইদা ও তাদের বৃদ্ধা দাইমা জহুরাও সেই রকম মনে করতো, কাজেই তারা কোনো দিন এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলেনি, কিন্তু এখন আর ব্যাপারটা তারা সামান্য বলে অবহেলা করতে পারে না। সর্দারের দিক দিয়ে তাদের বলবার কিছু খুঁজে না পেলেও নূরীর দিকটা সকলের মনে রেখাপাত করতে শুরু করেছে।

সেদিন দাইমা শুয়ে শুয়ে বলেছিলো নাসরিন আর জোবাইদাকে– আমরা ডাকুর বেটি বটে কিন্তু ধর্ম ছাড়া নই। কালু খাঁ আমাকে এনেছিলো বনহুরকে মানুষ করবার জন্য হুসনাপুর গ্রাম। থেকে। বয়স তখন আমার শেষ হয়ে গিয়েছিলো, চল্লিশেরও বেশি হবে, সেই থেকে আমি আছি। এই আস্তানায়। কালু খাঁ ডাকাত ছিলো কিন্তু সে কোনো দিন পরস্ত্রীকে স্পর্শ করেনি। আর বনহুর তারই হাতে গড়া মানুষ, অথচ সে নূরীর সঙ্গে যা তা ভাবে মিশছে ধর্মে এটা সইবে না। আমার বাবাও ডাকু ছিলো কিন্তু লম্পট ছিলো না।

নাসরিন আর জোবাইদা বৃদ্ধার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো– তবেতো এটা ভারী অন্যায়। নাসরিন আর জোবাইদা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিলো অনেক।

সর্দার নূরীকে বিয়ে করবে, এই ভরসা নিয়েই এতদিন তারা কোনো কথা বলেনি, কিন্তু এখন তো নূরীর বয়স কম নয়। যৌবন তার কানায় কানায় ভরে উঠেছে সর্দার তবু তাকে বিয়ে করছে না, কারণ খুঁজে পায় না নাসরিন আর জোবাইদা।

আসলে বনহুর যে গোপনে মনিরাকে বিয়ে করেছিলো এ কথা আস্তানায় বিশিষ্ট কয়েকজন। অনুচর ছাড়া আর কেউ জানতো না। রহমান সবাইকে রীতিমতভাবে নিষেধ করে দিয়েছিলো, এ কথা তারা ছাড়া আর কেউ যেন জানতে না পারে।

রহমানকেও তারা কম ভয় করতো না, দস্যু বনহুরের প্রথম অনুচর রতনের অন্তর্ধানের পর রহমানই সর্দারের দক্ষিণ হাত ছিলো। কাজেই রহমানের নির্দেশেও তাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটা অসম্ভব নয়।

দস্যু বনহুরের অনুচর হওয়া তাদের জীবনের বড় সম্পদ। তাছাড়া সর্দার তাদের সবদিকে সুবিধা করে দিয়েছিলো। অর্থের কোনো অভাব তারা জানতো না। প্রতিটি অনুচরের সুখ– সুবিধার দিকে ছিলো বনহুরের নিপুণ দৃষ্টি। কারও অসুখ হলে বনহুর নিজে তার পাশে বসে অসুখের বর্ণনা শুনে সেইমত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো। বছরে একমাস ছুটি হতো সবার যার যার নিজ দেশে ফিরে যেতো তখন তারা।

দেশের এই বেকার সমস্যার প্রাক্কালে এমন একটা সুযোগ হারাবার ভয় কার না আছে। তাছাড়াও মৃত্যুভয়ও রয়েছে বটে। দস্যু আস্তানায় যেমন অর্থের কোনো হিসেব নেই, তেমনি অপরাধ করলে মৃত্যুরও কোনো সময় নেই। দোষ করলে শাস্তি গ্রহণ করতেই হবে।

কাজেই তারা জানতো তাদের সর্দার বিবাহিতা। তারা নীরবেই থাকতো। আর যারা যে। অনুচরগণ আজও জানে তাদের সর্দার এখনও অবিবাহিত; তারা নূরী আর সর্দার সম্বন্ধে গোপনে দু’একটা কথা আলোচনা করতো অবশ্য সর্দারকে তারা ভালভাবেই জানে। সর্দারের সম্বন্ধে তাদের মধ্যে এতটুকু সন্দেহের ছোঁয়াচ নেই। কারণ তারা সবাই জানে তাদের সর্দার একজন দেব সমতুল্য মানুষ। ইতিপূর্বে অনুচরদের অনেকেই অন্য দস্যুর সহচর হিসেবে কাজ করেছে। তখন তারা দেখেছে তাদের দলপতি বা সর্দারের আসল রূপ। মদ তাড়ি ভাং পান করা ছাড়াও সর্দার নারীদের নিয়ে যা তা ছিনিমিনি খেলতো তাদের হাতে কোনো মেয়ে পড়লে ইজ্জত বলে কিছু থাকতো না। আর দস্যু বনহুর ঠিক তার বিপরীত দস্যু হলেও কোনো নেশা তার ছিলো না। জীবনে সে কোনেদিন মদ স্পর্শ করেনি তাড়ি ভাং বা ঐ ধরনের কোনো নেশাও তার নেই। বনহুর নারীদের সম্মান করে মা-বোনের মত।

যে দস্যুদলের সর্দার এমন, তার অনুচরগণ কোনোদিন জঘন্য হতে পারে না, দস্যু বনহুরের অনুচরদের মধ্যে অনেকেরই অবশ্য গোপনে এসব নেশা ছিলো কিন্তু প্রকাশ্যে তারা কোনোদিন সর্দারের সামনে এইসব ব্যবহার করতে সাহসী হতো না।

সেই সর্দারের চরিত্র নিয়ে অনুচরগণ কুৎসিত ইংগিত করবে এ কখনও হতে পারে না। বরং অনুচরগণ সর্দারকে অন্তরে অন্তরে ধন্যবাদ জানাতো; নূরীর মত সর্বসুন্দরী চঞ্চলা মেয়েকে ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েও সর্দার তাকে এড়িয়ে চলে।

কিন্তু সর্দার তেমন করে না মিশলেও নূরী তো সর্দারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে। এটাই অনেকের মনে দ্বন্দ্ব জাগিয়েছিলো। তবে প্রকাশ্যে কেউ কোনো কথা বলতে সাহসী হতো না।

সবাই ব্যাপারটা নিয়ে তেমন করে না ভাবলেও জোবাইদা চুপ থাকতে পারলো না। আজ সে বলেই বসলো নূরীকে সর্দারের সঙ্গে এভাবে মেশা তার অন্যায় শুধু নয়–পাপ।

নূরী তীব্রকণ্ঠে বললো–না, পাপ নয়। হুরের সঙ্গে বিয়ে আমার হয়ে গেছে অনেকদিন।

হাসলো জোবাইদা –এটা কল্পনার যুগ নয় নূরী। বনে বাস করলেও আমরা পৃথিবীর মানুষ। অসংযত ব্যাপার আমরা মেনে নিতে পারিনে। নূরী রাগতঃ গলায় বলে উঠলো– জোবাইদা, আমার মুখের উপর এতবড় কথা বলতে পারলি?

সব কিছুরই সীমা আছে, সর্দারকে বলো–তোমাদের বিয়ে হওয়া একান্ত প্রয়োজন। নূরী এবার আপনা আপনি নরম হয়ে এলো, ধীরে ধীরে জোবাইদার পাশে এসে দাঁড়ালো –জোবাইদা, এ কথা আমি অনেক দিন ভেবেছি, কিন্তু ওকে বলতে পারিনি। তাছাড়া ওর দিক থেকেও আমি তেমন কোনো সাড়া পাইনি কোনদিন। জোবাইদা, তুই বিশ্বাস কর হুরের মত মানুষ আর দ্বিতীয় জন নেই। তুই আমার শিশুকালের সাথী, সব তুই জানিস। তোকে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, বনহুরের সঙ্গে আমার অস্পৃশ্য কোনো কিছু ঘটেনি আজও। জোবাইদা আমি অনেক সময় নিজকে সংযত রাখতে পারিনি, নিজকে সঁপে দিয়েছি বনহুরের বাহুর মধ্যে কিন্তু তোকে কি করে বোঝাবো আমি–সে কত পবিত্র, কত নির্মল নিষ্পাপ

নূরীর কথাগুলো এক একটা যেন জোবাইদার হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিলো। চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিলো সে নূরীর মুখের দিকে। নিশ্বাস পর্যন্ত পড়ছিলো কিনা বোঝা যাচ্ছিলো না।

আবার বললো নূরী মানুষ কোনোদিন ফেরেস্তা নয়। হুরও পুরুষ মানুষ আমি তার মধ্যে পুরুষোচিত মনোভাব জেগে উঠতে দেখেছি, কিন্তু সে নিজকে তখন কঠিনভাবে সংযত করে রেখেছে। কোনোদিন দূর্বল হয়নি আমার কাছে পাষাণ দেবতার মতই সে অবিচার করেছে আমার উপর। জেবাইদা হুরের এই হৃদয়হীন আচারণে আমি ক্ষুদ্ধ হয়েছি কিন্তু পারিনি ওকে কিছু বলতে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সব রাগ অভিমান দুঃখ বেদনা ভুলে গেছি। জোবাইদা আমি কি করে বলবো তোকে আমার মনের দুঃখ ব্যথার কথা।

জোবাইদা নূরীর হাত দু’খানা মুঠায় চেপে ধরলো আমাকে মাফ করে দাও নূরী। না জেনে আমি তোমাকে রূঢ় কথা বলেছি।

*

সুফিয়া নিজের পড়ার ঘরে বইয়ের সেলফের পেছনে কম্বল আর চাদর বিছিয়ে সুন্দর করে বিছানা তৈরি করে দিলো। বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো সুফিয়া–ভাইয়া এবার আপনি এখানে। নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম করুন। এই কক্ষে অন্য কেউ প্রবেশ করে না, তাছাড়াও আমি দরজায় তালা

আটকিয়ে রাখছি। যতক্ষণ আপনাকে মুক্ত করে দিতে না পারবো ততক্ষণ আমি নিশ্চিন্ত নই।

বনহুর সুফিয়ার তৈরি বিছানায় বসে পড়ে বললো–সুফিয়া, আমার জন্য তোমাকে না কোনো বিপদে পড়তে হয়।

না না, আমার জন্য আপনি মিছামিছি ভাবছেন ভাইয়া। ইনশাআল্লাহ আপনার বোন আপনাকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। আমি এক্ষুণি পুলিশ অফিসে যাবো এবং কৌশলে চাবি সংগ্রহ। করবো।

কিন্তু এটা কি সম্ভব হবে সুফিয়া?

হবে, আমি যে কোনো উপায়ে চাবি জোগাড় করবোই–

বনহুর আর সুফিয়ার মধ্যে যখন কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন গাড়ি বারান্দায় মোটরের হর্ন বেজে ওঠে।

সুফিয়া বলে–ভাইয়া, আমার আব্বা এসেছেন।

সুফিয়া, তুমি যাও।

হাঁ, আমি যাচ্ছি, দরজায় তালা লাগিয়ে দিচ্ছি–সুফিয়া দ্রুতপদে পড়বার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলো।

ততক্ষণে পুলিশ সুপার কাওসার আহমদের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা যায় সুফিয়া, সুফিয়া–

কাওসার আহমদ সাহেবের কন্যাকে ডাকা একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছিলো। যখনই যেখান থেকে ফিরুন, হলঘরের বারান্দায় পা দিয়েই ডাকবেন–সুফিয়া, সুফিয়া কোথায় তুমি মা?

সুফিয়া জানতো তার আব্বা তাকে কত স্নেহ করেন কত ভালবাসেন। যেখানেই থাক, সুফিয়া আসতো পিতার পাশে। ঘরে প্রবেশ করলে নিজের হাতে জামাকাপড় খুলে নিয়ে স্লিপিং গাউনটা এগিয়ে দিতো সে। হেসে হেসে কথা বলতো পিতার সঙ্গে। নানা খবর সংগ্রহ করতো সুফিয়া তাঁর নিকট থেকে।

মিঃ আহমদ কন্যাকে কাছে পেলে মনে আনন্দ বোধ করতেন। কন্যার কাছে তিনি মুখর হয়ে উঠতেন ছোট্ট শিশুর মতই। মিসেস আহমদ রাশভারী মানুষ, স্বামীর সেবা বড় একটা করে উঠতে পারতেন না। বাড়িতে চাকর বাকর দাস দাসী তো আর কম নয় কাওসার আহমদ তার নিজের যত কাজ চাকর-বাকর আর গার্ডদের দিয়ে সমাধা করে নিতেন। অনিচ্ছা বা ইচ্ছা সত্ত্বেও তিনি স্ত্রীকে অযথা বিরক্ত করতেন না।

তারপর সুফিয়া বড় হয়ে পিতার সেবার ভার নিজ হাতে তুলে নিয়েছেন। চাকর বাকর থাক তবু সুফিয়ার পিতা বাইরে যাবার সময় তাঁর জামা-কাপড় নিজ হাতে এগিয়ে দিতো, আবার ফিরে এলে খুলে নিতো। চা-নাস্তা নিজেই পরিবেশন করে খাওয়াতো পিতাকে। কন্যার হাতে স্বামীর সেবার দায়িত্বভার তুলে দিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন বেগম সাহেবা।

প্রতিদিনের স্বভাব অনুযায়ী আজও কাওসার আহমদ বাসায় ফিরে কন্যাকেই ডাকলেন।

ব্যস্তভাবে সুফিয়া এসে দাঁড়ালো পিতার সামনে–আব্বা, দস্যু বনহুরের সন্ধান পেয়েছো?

দস্যু বনহুর ফসকে গেলে তাকে পাকড়াও করা অত সহজ নয় মা, অত সহজ নয়।

সুফিয়ার পড়বার ঘরের পাশেই ছিলো সুপারের বিশ্রামকক্ষ। পিতা পুত্রীর আলাপ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো বনহুর। সে চুপচাপ দেয়ালে ঠেস দিয়ে শুনছিলো পুলিশ সুপার ও সুফিয়ার কথা বার্তা।

পিতার কথায় বললো সুফিয়া–আব্বা, দস্যু বনহুর কি করে পালালো? শুনেছিলাম অগণিত পুলিশ ফোর্স পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাকে জম্বুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে?

মিঃ কাওসার আহমদ সোফায় হতাশভাবে বসে পড়ে বললেন–অগণিত পুলিশ ফোর্সের বেষ্টনী ভেদ করেই সে পালিয়েছে।

আশ্চর্য তো!

শুধু আশ্চর্যই নয় মা, কল্পনার অতীত।

আব্বা, তোমরা তো জানোই সে দুর্ধর্ষ। বেশ করে হাতে হাতকড়া পরিয়ে মজবুত করে বেঁধে ভ্যানে তুললেই পারতে?

সে কথা তোকে বলতে হবে মা। দক্ষ পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আহমদ তাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। তিনি স্বয়ং নিজের হেফাজতে পুলিশ পরিবেষ্টিত করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দস্যু বনহুরের হাতে শুধু হাতকড়াই নয় তার সমস্ত শরীর ছিলো লৌহশিকল দিয়ে তালাবদ্ধ।

সুফিয়ার দু’চোখ ছানাবড়া। করে বলে–হাতে হাতকড়া শরীরে শিকল বাঁধা তবু কি করে পালালো দস্যু বনহুর?

জনতা। জনতাই তাকে পালাবার সুযোগ এনে দিয়েছে। দস্যু বনহুরকে যে পথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সে পথের দু’পাশে জনতা তাকে দেখবার জন্য এত ভীড় করেছিলো, সে কথা তোকে বলে বুঝাতে পারবো না মা।

এমন সময় সেই কক্ষে প্রবেশ করেন সুপার গৃহিনী। স্বামীকে লক্ষ্য করে বলেন–শুনলাম দস্যু বনহুর নাকি ভেগেছে।

হাঁ।

তা ভাগবে না। তোমাদের যেমন বুদ্ধি হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়িয়া পরিয়ে দিয়েছিলে?

হাতে হাতকড়া পরানো ছিলো কিন্তু–সত্যি বলেছো বেগম, পায়ে বেড়ি না পরিয়ে মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছিলো।

পাশের ঘরে বনহুরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

সুফিয়ার কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। সে বুঝি চাবির চিন্তায় আছে।

পুনরায় শোনা গেলো পুলিশ সুপারের গলা–যে কারণে আমি দস্যু বনহুরের হাতকড়া ও তার শরীরে বাঁধা শিকলের তালার চাবি নিজের কাছে রেখেছিলাম।

সুফিয়ার আনন্দসূচক কণ্ঠস্বর–সত্যি আব্বা, চাবি তোমার কাছেই ছিলো। দস্যু বনহুর

তাহলে চাবিবদ্ধ অবস্থায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাক নিশ্চিন্ত হলাম, চাবি তাহলে সে আর পাচ্ছে। না। কোথায় রেখেছো আব্বা?

এই যে আমার পকেটেই রেখেছিলাম মা। মিঃ কাওসার আহমদ চাবি দুটো বের করে কন্যা আর স্ত্রীকে দেখালেন ভেবেছিলাম জম্বুর কারাগারে দস্যুর মৃতদেহ থেকে হাতকড়া আর শিকল খুলবার সময় এ দুটো চাবি কাজে লাগবে।

সুফিয়ার আর কোনো কথা শোনা যায় না।

বনহুরের চোখ দুটো দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সুফিয়ার বাসনা তাহলে পূর্ণ হবে। এক্ষণে সুফিয়া পাশে থাকলে সে ওর হাত দুটো চেপে ধরে অন্তরের স্নেহ জানাতো।

শোনা গেলো বেগমের গলা দস্যুটা মরলে তবু দেশে শান্তি ফিরে আসতো।

সুফিয়ার চোখ দুটো মায়ের কথায় অশ্রুসজল হলো, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো–ছি আম্মা, দস্যু তোমার কি অন্যায় করেছে? বরং সে তোমাদের যে উপকার করেছে তা জীবনে পরিশোধ করতে পারবে না।

মিসেস সুপার বলে ওঠেন–তুই জানিস নে সুফিয়া কেন সে তোকে ওভাবে উদ্ধার করে এনেছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো প্রচুর অর্থ পাবে। তোর আব্বা তাকে পুরস্কৃত করবেন–

আম্মা, দস্যু হলেও তার হৃদয় অত নীচু নয়। অর্থের লালসা তার মোটেই নেই, তাছাড়া পুরস্কার বা প্রতিদান সে কারও কাছে চায় না।

সুফিয়া একটা দস্যুর হয়ে কথা বলা উচিত নয়। তোমার মা যা বলছেন সত্য। নিশ্চয়ই দস্যু বনহুরের কোনো উদ্দেশ্য ছিলো–

আব্বা, তুমিও ভুল করছে।

সুফিয়া! রাগতঃ কণ্ঠস্বর পুলিশ সুপারের।

বনহুর পাশের ঘরে গম্ভীর হয়ে পড়ে সুফিয়ার ছেলে মানুষি কথাগুলো শুনে চিন্তিত হয় সে। ভাবে–কি দরকার এই মুহূর্তে সেই পুরোনো কথাগুলো তোলার বড় বোকামি হচ্ছে সুফিয়ার। এক্ষণে বনহুর সম্বন্ধে তারও নিন্দা করা উচিত ছিলো।

পরক্ষণেই শুনতে পেলো সুফিয়ার কণ্ঠ–তোমাদের কোনোরকম কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। দস্যু হলেও সে মানুষ, অপরাধী সে হতে পারে কিন্তু সে আমার জীবন রক্ষাকারী–

সুযোগ পেলে সে-ই এখন ভক্ষক হয়ে দাঁড়াবে। বললেন বেগম সাহেবা।

সুফিয়া, কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে সুফিয়ার পড়ার ঘরে একটা কিছুর শব্দ হয়।

মিঃ কাওসার আহমদ বললেন–কিসের শব্দ হলো?

সুফিয়া তাড়াতাড়ি বললো–আমি দেখে আসি আব্বা।

বেগম সাহেবা বলে উঠলেন–ভালভাবে দেখো সুফিয়া। শেষে দস্যুটা না আমাদের বাসায় এসে লুকিয়ে পড়ে।

হাসলেন পুলিশ-সুপার–হ্যাঁসালে বেগম, আমার বাসায় আসবে দস্যু বনহুর এমন সাহস তার হবে–

সুফিয়া ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে।

একটু পরে ফিরে আসে সুফিয়া হেসে বলে–মিনি বিড়ালটা আমার বইয়ের সেলফ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে, তারই শব্দ হলো।

পুলিশ সুপার বললেন–বোধ হয় ইঁদুর দেখেছে তোমার মিনি। হাঁ, আব্বা ঠিক বলেছো। মিনি ইঁদুর ধরবে বলে ঐ ঘরে ঢুকেছে। আমি তালা আটকে রেখেছি– তাড়াহুড়ো করে বললো সুফিয়া এবার আলু দস্যুকে খুঁজতে খুঁজতে সব ভুলে গেছো। তোমার খাবার সময় চলে গেছে কখন। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে সে–এখন বেলা চারটে, খেয়াল আছে?

বেগম সাহেবার এতক্ষণে যেন হুশ হলো তাই তো সেই যে সাত সকালে একটু নাস্তা আর এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়েছিলেন। বাইরের জিনিস খাবার অভ্যাসও নেই তাঁর। বেগম সাহেবা হাঁকলেন–বাবুর্চি, টেবিলে সাহেবের খাবার দাও।

সুফিয়া পিতার কোটটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো আম্মা, তুমি যাও একটু দেখোগে। আব্বার খাবারগুলো বাবুর্চিকে বলো যেন গরম করে দেয়।

তুই কোটটা আলমারীতে রেখে দে সুফিয়া। কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালেন বেগম সাহেবা।

মিঃ কাওসার আহমদ বললেন–সাবধানে রেখো মা সুফিয়া, কোটের পকেটেই চাবি দুটো আছে কিন্তু।

আমাকে অত করে বুঝিয়ে বলতে হবে না আব্বা। তুমি খেতে যাও, আমি সব ঠিক করে রাখছি।

পুলিশ সুপার এবং সুপার গৃহিণী কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সুফিয়ার চোখ দুটো জ্বলে উঠলো খুশিতে এমনভাবে সুযোগ এসে যাবে হঠাৎ তার হাতের কাছে ধারণাও করতে পারেনি সে। ভেবেছিলো অফিসে গিয়ে কৌশলে চাবি সংগ্রহ করবে কিন্তু তাকে এত কিছু করতে হলো না।

ডাইনিং রুম থেকে ভেসে আসছে পিতার কণ্ঠস্বর খেতে খেতে মায়ের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছেন তিনি। এটাই সুবর্ণ সুযোগ। সুফিয়া এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে আলমারীতে উঠিয়ে রাখা কোটের পকেট থেকে চাবি দুটো দ্রুত হস্তে বের করে নেয়। তারপর লঘু পদক্ষেপে ফিরে আসে নিজের কামরায়। সুফিয়ার পড়বার ঘরের দরজা ছিলো তার শোবার ঘরের মধ্য দিয়ে সুফিয়া তালা খুলে প্রবেশ করে চাপা কণ্ঠে ডাকলো–ভাইয়া।

বনহুর একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। অবশ্য যতক্ষণ পুলিশ সুপার, বেগম সাহেবা ও সুফিয়ার কথাবার্তা চলছিলো, ততক্ষণ কান পেতে সব শুনছিলো সে।

পুলিশ সুপার খেতে গেলেন তারপর সুফিয়া বেশ কিছুক্ষণ নীরব রয়েছে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো বনহুর, তাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলো সে। সুফিয়ার কণ্ঠস্বরে উঠে বসে সুফিয়া।

ভাইয়া, আমি চাবি এনেছি–কই দেখি হাতটা সুফিয়া চট পটু বনহুরের হাতের হাতকড়া খুলে ফেললো, তারপর দেহের শিকলের তালা খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

বনহুর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ কণ্ঠে বললো বোন সুফিয়া, তোমাকে কি বলে আমার অন্তরের আন্তরিকতা জানাবো ভেবে পাচ্ছিনে।

ভাইয়া, আপনাকে মুক্ত করতে পেরেছি এর চেয়ে আনন্দ আমার আর কিছু নেই।

দস্যু বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে এসেছিলো, বললো –সুফিয়া চিরদিন তোমার কথা স্মরণ থাকবে আমার।

সুফিয়া হাতকড়া আর লৌহশিকলটা অতি সাবধানে লুকিয়ে রাখলে নিজের বইয়ের সেলফের পেছনে। তারপর সে চাবি দুটো নিয়ে ফিরে গেলো পিতার কক্ষে। আলমারী খুলে চাবি দুটো কোটের পকেটে রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো।

এমন সময় খাওয়া শেষ করে এলেন পুলিশ সুপার এবং বেগম সাহেবা।

সামান্য একটু বিশ্রাম করার পর এক্ষুণি আবার তাঁকে বেরুতে হবে।

সোফায় বসে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন পুলিশ সুপার।

বেগম সাহেবা আর একটা সোফায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বললেন–দেখো সাবধানে যেও, দস্যু বনহুর না কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসে। এমন জাদরেল দস্যু কোনোদিন দেখিনি বাবা।

পুলিশ জীবনেই এমন দস্যু দেখিনি, আজ আঠারো বছর আমার চাকরী হলো!

পাশের ঘরে যখন পুলিশ সুপার এবং পুলিশ সুপার গৃহিণী দস্যু বনহুরকে নিয়ে আলাপ আলোচনায় রত তখন সুফিয়ার পড়ার ঘরে দস্যু বনহুর পায়চারী করে চলেছে। সন্ধ্যা অবধি তাকে এই কক্ষে প্রতীক্ষা করতে হবে।

খোদার কাছে লাখো শুকরিয়া করলো বনহুর কেমন করে তিনি তাকে বাঁচিয়ে নিলেন। আর অন্তরের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে আন্তরিক মোবারকবাদ জানালো সে সমস্ত দেশবাসীকে। আজ তাদের হৃদয়ের নিবিড় টানে তারা ছুটে গিয়েছিলো তাকে এক নজর দেখবে বলে। বিপুল জনতার কঠিন চাপে পুলিশ বাহিনী অতিষ্ঠ হয়ে না উঠলে আজ তার মুক্তির অন্য কোনো পথ ছিলো না। শত শত নাগরিকের আগ্রহভরা ব্যাকুল আঁখি ভেসে ওঠে বনহুরের চোখের সামনে। কিন্তু আনেকেই তাকে দেখতে পায়নি, সামান্য কিছু সংখ্যক জনতা তাকে দেখতে পেরেছে মাত্র। যারা তাকে দেখতে পায়নি তাদের জন্য ব্যথা অনুভব করে সে মনের কোণে।

অল্পক্ষণ পর পুলিশ সুপার বেরিয়ে গেলেন, অনেক কাজ এখনও তাঁর বাকি। দস্যু বনহুরকে পুনরায় গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত পুলিশ অফিসারদের স্বস্তি নেই। সমস্ত শহরময় একটা ভীতিকর ভাব বিরাজ করছে। রেডিও বারবার সাবধান বাণী ঘোষণা করছে। দস্যু বনহুর শহরের কোনো গোপন স্থানে আত্মগোপন করে আছে। তাকে যে কেহ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলে এবং পুলিশের নিকটে ধরিয়ে দিতে পারলে তাকে উপযুক্ত পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হবে।

*

নাসির শাহ কোনো কাজে বোন জুলেখার চেম্বারে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো।

জুলেখা তার সহপাঠি ডক্টর হামিদকে বলছে–আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম মনিরার চোখে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।

হাঁ মিস জুলেখা আপনার নিকটে আপনার বান্ধবী সম্বন্ধে সব শোনার পর আমিও অনেক বই ঘেটেছি তাতে বোঝা গেলো আপনার বান্ধবীর দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ডক্টর, আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহলে হয়তো বেচারী মনিরার জীবন ব্যর্থ নাও হতে পারে।

ডক্টর হামিদের কণ্ঠস্বর–আপনি আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেন, আমি আপনার বান্ধবীর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবো।

ধন্যবাদ ডক্টর। জুলেখার কণ্ঠস্বর।

পরক্ষণেই জুতোর শব্দ শোনা যায়। বোধ হয় ডক্টর হামিদ জুলেখার নিকট বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছেন।

তাড়াতাড়ি আড়ালে গা ঢাকা দিলো নাসির শাহ। জুলেখার বান্ধবী মনিরা অন্ধ হয়েছে। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো সে–মনিরা–সেই মনিরা একদিন যে মনিরাকে পাবার জন্য নাসির শাহ্ উন্মাদ হয়ে উঠেছিলো। মনিরাকে হাতের মুঠোয় পাওয়া তার পক্ষে কঠিন ছিলোনা কিছু, কিন্তু জুলেখাই সব পণ্ড করে দিয়েছে। মুখের শিকার হাতছাড়া করে দিয়েছে। বোন হলে কি হবে নাসির শাহ্ সেই থেকে জুলেখাকে কঠিন চোখে দেখতো। অবশ্য জুলেখাকে বুঝতে দিতো না সে কিছু কারণ জুলেখা তাদের সবার ছোট বোন।

নাসির শাহ জুলেখার কাছে ভিজে বিড়াল হয়ে থাকলেও জুলেখা চালাক মেয়ে ভাইয়ের মনের খবর সে জানতো। নিজ সহোদর হলে কি হবে, বিশ্বাস করতো না সে কোনো সময় তাকে।

নাসির শাহ মনিরাকে বিয়ে করার প্রস্তাবও করেছিলো জুলেখার কাছে। জুলেখা ক্রুদ্ধকণ্ঠে তিরস্কার করেছিলো তোমার মত লম্পটের হাতে মনিরার মত রত্ন শোভা পাবে না।

এরপর নাসির শাহ আর কোনদিন বোন জুলেখাকে এ সম্বন্ধে বলেনি। ভিতরে ভিতরে সে সব সময় জুলেখার প্রতি বিষাক্ত মনোভাব পোষণ করে এসেছে।

জুলেখার কথায় হতাশ হয়নি সেদিন নাসির শাহ। হতাশ হয়েছিলো যেদিন শুনেছিলো দস্যু বনহুরের সঙ্গে মনিরার সম্বন্ধ আছে।

নাসির শাহ যেমন চরিত্রহীন কুৎসিতমনা মানুষ, ভীতুও ছিলো তেমনি। দস্যু বনহুরকে চোখে কোনোদিন না দেখলেও ভয় করতো তাকে ভীষণ। অবশ্য বেশ কিছুদিন আগের ব্যাপার এসব।

এখন আর নাসির শাহ আগের সেই দুর্বলমনা নাসির নেই। আগের চেয়ে এখন তার দুরন্তপনা অনেক বেড়ে গেছে। অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনই তার পেশা আর নেশা মদ পান ও নারী।

সন্ধ্যার পর তার গোপন আস্তানায় মদ আর নারীর আমদানী চলে পুরো দমে।

নাসির শাহ্ তার শয়তান সহচর মদ আর নারীর মধ্যে ডুবে গেলো ধীরে ধীরে। মনিরার প্রতি আকর্ষণ কমে এলো অনেক শিয়াল ও দ্রাক্ষাফলের মতই হলো মনিরা আর তার সম্বন্ধ।

হঠাৎ আজ সেই মনিরার কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করায় নতুন করে স্মরণ হলো মনিরাকে।

একটু পূর্বেই রেডিও ঘোষণা শুনেছে–দস্যু বনহুর পলাতক। নিশ্চয়ই সে এখন নিজের জীবন নিয়ে ত্রাহি ত্রাহি করছে। মনিরার সঙ্গে তার আর কোনো সম্বন্ধ নেই।

নাসির শাহর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির প্যাঁচ খেলে যায়। মনিরা এখন অন্ধ। সে গোপনে সন্ধান নিয়ে জেনেছিলো দস্যু বনহুর নাকি রাত্রিকালে মনিরার সঙ্গে দেখা করে থাকে মনিরার কক্ষে।

কথাটা সে হাওয়ায় শোনার মতই শুনেছিলো একদিন, আজ সেই কথাই তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। জুলেখার চেম্বারে প্রবেশ না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে তার গোপন আড্ডা অভিমুখে।

সঙ্গীদের নিয়ে চলে তার আলোচনা।

মনিরাকে এখন কৌশলে চুরি করে আনা অতি সহজ ব্যাপার। দৃষ্টিশক্তিহীন মনিরাকে বনহুরের রূপ ধরে বাড়ির বাইরে আনতে হবে অদূরে অপেক্ষা করবে আমাদের গাড়ি ব্যাস তারপর আর মনিরার সন্ধান কে পায় দেখা যাবে।

নাসির শাহ্ যখন চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করে মনিরাকে চুরি করে নিয়ে ফিরে আসবে তখন যেন তারদলবল সবাই সাবধানে প্রতীক্ষা করে।

নাসির শাহ্ যেমন জঘন্য মনোবৃত্তির মানুষ ছিলো তেমন শয়তান ছিলো তার অনুচরবর্গ। নাসির শাহর ইংগিতে তারা যে কোনো কুকর্ম করতে কুণ্ঠিত হতো না।

নাসির শাহর মুখে নতুন একটা কুযুক্তি শুনে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো তারা। কিভাবে মনিরাকে চুরি করা যায় এ নিয়ে নানাভাবে চললো তাদের মধ্যে আলোচনা।

শুধু আলাপ আলোচনা নিয়ে মশগুল থাকবার বান্দা নয় নাসির শাহর অনুচর ও দলবল। তারা রীতিমত মদ পান এবং নেশাও করলো।

নানা রকম ফুর্তি গান বাজনায় গোটা বিকেলটা কাটিয়ে দিলো।

নাসির শাহর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু বললো–কাজটা কিন্তু যত সহজ মনে করছো ঠিক। ততখানি সহজ নয়।

কেন? বললো নাসির শাহ।

সুচতুর বন্ধু বললো–চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করবে কি করে?

নাসির শাহ হেসে বললো–সে চিন্তা করেই কাজে নামছি বন্ধু।

কিভাবে কার্য সিদ্ধি করবে মনস্থ করেছো চাঁদ?

নাসির শাহর সাঙ্গপাঙ্গ আর বন্ধুর দল কেউ কেউ তাকে ঠাট্টা করে চাঁদ বলে ডাকতো।

নাসির শাহ বন্ধুদের কথায় খুশি হতো কি রাগ করতো ঠিক বোঝা যেতো না। নিশ্চুপই থাকতো তখন সে।

কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো নাসির শাহ–সব আমি মনের মধ্যে ঠিক করে রেখেছি বন্ধু। নাসির শাহ কাঁচা লোক নয়, বুঝেছো? একটা কুৎসিত হাসির রেখা তার মুখে ফুটে উঠে বিলীন হয়ে যায়।

ওদিকে জুলেখা যখন বান্ধবীর মঙ্গল চিন্তায় বিভোর এদিকে তার ভাই নাসির শাহ তখন কিভাবে তাকে নষ্ট চরিত্রা করবে এবং তাকে কিভাবে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবে সেই চিন্তায় মগ্ন। রাত বেড়ে আসে নাসির শাহর গুপ্ত পরামর্শ শেষ হয়। সবাই উঠে পড়ে।

কিন্তু মদের নেশায় সবাই ঢুলু ঢুলু।

*

মনিরা আজ এক দণ্ডের জন্যও রেডিওর সুইচ অফ করেনি। রেডিও আঁকড়ে ধরে বসে আছে সে। রেডিওই আজ যে তার এক মাত্র আপন জন, অতি ঘনিষ্ঠ এবং পরম বন্ধু। বুকের মধ্যে যেন একটা ঝড়ের তাণ্ডব চলেছে। না জানি কোন মুহূর্তে রেডিও ঘোষণা করবে দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার হয়েছে। এই সংবাদ যেন তাকে শুনতে না হয়, মনিরা খোদার কাছে বারবার প্রার্থনা করছে।

সমস্ত দিন আজ মনিরা পানি বিন্দু মুখে করেনি। মরিয়ম বেগম অনেক সাধ্য সাধনা করেছেন–মা, খোদা ওর সহায়। তুই এবার কিছু মুখে দে–মা।

না, মামীমা, আমি এখন মুখে কিছুই দিতে পারবো না, যতক্ষণ না জানবো–সে নিশ্চিন্ত।

সেই সংবাদ তুই কেমন করে পাবি মা?

আমার মন বলবে। আমার মন বলবে মামীমা। ঐ যে শোনো শোনো মামীমা এখন পুলিশ বাহিনী সমস্ত শহর চষে ফিরছে। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য উপযুক্ত পুরস্কার ঘোষণা করছে।

রেডিও ঘোষণা তখন স্পীডে হচ্ছিলো।

মনিরার চোখে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। রেডিও আঁকড়ে ধরে কান পেতে শুনতে থাকে সে।

সমস্ত দিনটা কেটে গেলো।

দেয়াল ঘড়ি সন্ধ্যা সাতটা ঘোষণা করলো। মনিরা চোখে দেখতে পায় না, কানে শুনতে পায়। সন্ধ্যার প্রাকৃতিক দৃশ্য সে অন্তরে অন্তরে অনুভব করে। এই রাতের প্রতীক্ষায় মনিরা অপেক্ষা করছে।

মনিরা বললো–মামীমা দেখো তো বাইরে সূর্যের আলো নিভে গেছে কি?

হাঁ মনিরা সূর্যের আলো বিদায় নিয়েছে।

অন্ধকার হয়নি এখনও?

তেমন করে হয়নি।

মামীমা, আজ পৃথিবীটা কি অন্ধকার হতে জানে না?

মরিয়ম বেগম কোনো জবাব দেন না মনিরার কথায়। তিনি বুঝতে পারেন মনিরা কেন। বারবার আজ রাত্রির আগমন প্রতীক্ষা করছে। পুলিশের হাত থেকে মনির পালাতে সক্ষম হয়েছে বটে কিন্তু এখন সে মুক্ত নয়। শহরের কোনো নিভৃত কোণে হাতে-হাতকড়া দেহে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় আত্মগোপন করে আছে। না জানি কত কষ্ট হচ্ছে তার। সারাটা দিন পেটে কিছু পড়েছে কিনা কে জানে।

ক্রমে রাত বেড়ে আসে।

সমস্ত পৃথিবী অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়। শহরে জ্বলে ওঠে অসংখ্য আলোর বন্যা। আজ অন্যান্য দিনের মত শহরে জনগণের ভীড় নেই। কেমন যেন নীরব থমথমে ভাব সমস্ত শহরটাকে আচ্ছন্ন। করে রেখেছে। দু’চার জন পথিক অতি সন্তর্পণে পথ চলছে মাত্র। কোন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তারা বাইরে বেরিয়েছে বলে মনে হয়না। পথ চলতে গিয়েও ভীতভাবে চারিদিকে লক্ষ্য করছে। তাদের ভয়ের একমাত্র কারণ দস্যু বনহুর।

গোটা শহরে যানবাহন চলাচল করলেও সংখ্যায় অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ অনেক কম। নিতান্ত কাজের চাপে তারা হয়তো গন্তব্য স্থানে চলেছে।

শুধু পুলিশ ভ্যান আর পুলিশ ফোর্স।

শহরের পথে পথে আজ পুলিশ ভ্যানের ছুটাছুটি চলেছে। অগণিত অসংখ্য পুলিশ সমস্ত শহরে ছড়িয়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে।

সবাই সতর্কভাবে পাহারায় নিযুক্ত আছে।

পুলিশ বাহিনীর ভারী বুটের আর মাঝে মাঝে হুইসেলের তীব্র আওয়াজ কানে এসে পৌঁছুচ্ছে।

মনিরা পাথরের মূর্তির মত বসে আছে খাটের পাশে। মরিয়ম বেগম নামাজ পড়লেন নিজ ঘরে।

রাত ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।

সমস্ত বাড়িটা এক সময় সুপ্তির কোলে ঢলে পড়লো। মরিয়ম বেগম কখন যে জায়নামাজে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন নিজেই টের পাননি।

সরকার সাহেব নিচের তলায় তাঁর নিজের বিশ্রাম কক্ষে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছেন। আজ ক’দিন তাঁর নানা রকম ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। পর পর এটা না ওটা বিপদ চলেছেই চৌধুরীবাড়িতে। বিশেষ করে মনিরার বিষ পান ও তার অন্ধ হয়ে যাবার পর সব সময় বাড়িতে ডাক্তার আর ডাক্তার লেগেই রয়েছে।

সারাদিন সরকার সাহেবকেই নানাদিকে সামলিয়ে চলতে হয়, বিশ্রাম করবেন কখন।

বয়স তো তাঁর কম নয়, পঞ্চাশের উপর হবে। মজবুত গঠন তাই এখন তিনি শক্ত এবং সুস্থ আছেন অন্যান্য সঙ্গী সাথীর চেয়ে। ক’দিন পর আজ সরকার সাহেব একটু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছেন।

মরিয়ম বেগমের অবস্থাও তাই, আজ কদিন হলো এক নাগাড়ে ঘুম জেগেছেন। ক্লান্তি আর অবসাদে দেহমন সবই ভেঙে পড়েছে, তিনি নামাজের বিছানায় একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়েছেন।

দেয়াল ঘড়িটা রাত দুটো ঘোষণা করলো। মনিরা তখনও জেগে বসে আছে চিত্রার্পিতের মত খাটের এক পাশে।

মনিরার বুকের মধ্যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে না জানি ভোরের সংবাদ তার কানে কি সংবাদ পৌঁছাবে।

মনিরা কিছুতেই আজ নিজকে সুস্থির করতে পারছে না। মনের মধ্যেও অন্ধকার, বাইরেও অন্ধকার দুনিয়াটাই বুঝি সম্পূর্ণ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। একটু আলো একটু আলোর জন্য লালায়িত হয়ে উঠলো মনিরা।

ঠিক এমন সময় নিচে শোনা গেলো পুলিশের বিক্ষিপ্ত বাঁশির শব্দ সঙ্গে সঙ্গে একটা শোর হাঙ্গামা।

চমকে উঠলো মনিরা, তাড়াতাড়ি উঠিপড়ি করে এগিয়ে গেলো পেছনের জানালার পাশে, দেখতে সে কিছু পাচ্ছেনা তবু বুঝতে পারলো।

পুলিশের বাঁশির শব্দ আর লোকজনের কলকণ্ঠ শুনে মনিরা সংজ্ঞা হারার মত হয়ে পড়লো। নিশ্চয়ই তার স্বামী এ পথে আসছিলো তার সঙ্গে দেখা করতে। হায় কি হলো মনিরা আর্তনাদ করে ডাকলো মামীমা, মামীমা সরকার সাহেব সরকার সাহেব—

মনিরার আর্তকণ্ঠে মরিয়ম বেগমের ঘুম ছুটে গেলো। শুধু তারই নয় মনিরার কণ্ঠস্বরে চাকর বাকরের দল তারাও জেগে উঠলো।

মরিয়ম বেগম ছুটে গেলেন মনিরার কক্ষে।

ততক্ষণে চাকর বাকরের দলও যে যেদিক থেকে পারে ছুটে এলো। ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে সবাই হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

মরিয়ম বেগম এগিয়ে গিয়ে মনিরাকে চেপে ধরলেন–কি হয়েছে মনিরা কি হয়েছে? ব্যস্ত কণ্ঠস্বর তাঁর।

মনিরা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো–শুনতে পাচ্ছো না মামীমা, ওকে আবার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

মনির, আমার মনির আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। কি করে জানলি মনিরা। কি করে জানলি তুই?

সে ঐ পথে আসছিলো, তোমার-আমার সঙ্গে দেখা করতে।

মরিয়ম বেগম দু’হাতে মাথা ধরে মেঝেতে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললেন– আবার একি হলো আল্লাহ। উঠে দাঁড়ালেন তিনি কোথায়? কোথায় আমার মনির একনজর ওকে আমি দেখবো মরিয়ম বেগম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে চললেন।

সরকার সাহেবেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, তিনি দড়বড় উঠে আসছিলেন, সিঁড়ির মুখে বেগম সাহেবকে এলোমেলো উন্মদিনীর ন্যায় কাঁদতে কাঁদতে নামতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না।

সরকার সাহেবকে দেখেই মরিয়ম বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন–সরকার সাহেব। মনিরকে আবার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। শীঘ্র যান শীঘ্র যান দেখুন, একবার আমাকে দেখতে দিন।

মরিয়ম বেগম বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছিলেন সরকার তাঁর পথরোধ করে বললেন– বেগম সাহেবা আপনি অপেক্ষা করুন আমি দেখছি।

সরকার সাহেব বেরিয়ে গেলেন।

ততক্ষণে বাইরের হট্টগোল কমে এসেছে অনেক। মাঝে মাঝে পুলিশ ভ্যানের ছুটাছুটির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

অল্পক্ষণ পর ফিরে এলেন সরকার সাহেব মুখমণ্ডল তার বিষণ্ণ মলিন।

মরিয়ম বেগম ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠলেন–কি হলো সরকার সাহেব, কি হলো বলুন? আমার মনির–

হাঁ, সে পেছন প্রাচীর টপকে ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো। অমনি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।

হায় হায়, একি হলো সরকার সাহেব? একি হলো? কোথায় আমার মনির, আমি ওকে একনজর দেখবো।

বেগম সাহেবা তাকে গ্রেপ্তার করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মরিয়ম বেগম দু’হাতে মুখ চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

মরিয়ম বেগমের কান্নার শব্দ গিয়ে পৌঁছলো দোতলার কক্ষে মনিরার কানে। বুঝতে পারলো, তার স্বামী পুনরায় পুলিশের হাতে বন্দী হয়েছে।

মনিরা ধপ করে পড়ে গেলো খাটের পাশে কপাল কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।

ঝি-চাকরের দল সবাই ব্যস্ত হয়ে কেউ ছুটে গিয়ে মনিরাকে তুলতে চেষ্টা করলো কেউ ছুটলো নিচে–আম্মা, আম্মা আপামনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।

মরিয়ম বেগম হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন।

সরকার সাহেব আর অন্যান্য চাকর-বাকর সবাই অনুসরণ করলো বেগম সাহেবাকে।

মরিয়ম বেগম মনিরার কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন মনিরা সংজ্ঞাহীন পড়ে আছে মেঝেতে রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে মেঝের কার্পেট।

সরকার সাহেব তাড়াতাড়ি মনিরার মাথাটা হাতের উপর তুলে নিয়ে ব্যস্তভাবে বললেন–পানি নিয়ে এসো, পানি। মনিরা অজ্ঞান হয়ে গেছে।

কে কোন দিকে ছুটলো ঠিক নেই। কেউ পানি নিয়ে দৌড়ে এলো, কেউ ছেঁড়া কাপড় নিয়ে

মরিয়ম বেগম তো মাথা কুটে বিলাপ শুরু করলেন।

সরকার সাহেব মনিরাকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলেন, তারপর মাথায় ও চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে লাগলেন।

অনেক চেষ্টা করেও জ্ঞান ফিরে এলোনা। সরকার সাহেব বললেন–এখনও মনিরার জ্ঞান ফিরছে না বেগম সাহেবা–উপায়?

মরিয়ম বেগম পাগলিনীর ন্যায় কাঁদছিলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন–ডাক্তার ডাকুন সরকার সাহেব ডাক্তার ডাকুন। আমার সব গেছে মনিরাও যদি চলে যায় তবে কি নিয়ে বাঁচবো। শীগগীর ডাক্তার ডাকুন–

নকীব পাখা নিয়ে মনিরার মাথায় বাতাস করছিলো আর বারবার গামছায় চোখ মুছছিলো সেও বলে উঠলো–ডাক্তার ডাকেন সরকার সাহেব নইলে আপামনিকে বাঁচানো যাবে না–

হাঁ, তাই ডাকছি। সরকার সাহেব তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোন করলেন।

*

গভীর রাতে কোথা থেকে ফোন এলো। ডক্টর বোস সবেমাত্র একটা কঠিন কেস অপারেশন করে ফিরে এসেছেন। আজ তাঁর হসপিটাল থেকে ফিরতে রাত দুটো বেজে গিয়েছিলো। কেবলমাত্র খেয়ে দেয়ে শয্যা গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন তিনি, অমনি টেবিলে ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে।

ডক্টর বোস অনিচ্ছাসত্বে রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে কানে ধরলেন–হ্যালো স্পিকিং ডক্টর বোস। কে আপনি? কোথা থেকে বলছেন? চৌধুরীবাড়ি থেকে–কি বললেন চৌধুরী কন্যা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছে? না না, এ আমাদের কর্তব্য, আচ্ছা আসছি।

ডাক্তার বোস চিরকুমার। বয়স যদিও চল্লিশের উপর তবু তাঁকে যুবক বলে ভ্রম হয়। শক্ত মজবুত গঠন স্বাভাবিক স্বাস্থ্য–খুব মোটা বা একেবারে ছিপছিপে নয়। অলসতা বলতে তাঁর নেই, রোগীর সেবা করাই তাঁর জীবনের ব্রত। কান্দাই শহরে ডাক্তার বোস একনাগাড়ে প্রায় পাঁচ বছর আছেন। হসপিটালে সার্জনের পোষ্টে আছেন তিনি। কান্দাইয়ের অনেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। চৌধুরীবাড়ির সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি ঘটেছে। কারণ মরিয়ম বেগমের মাঝে মাঝে এটা-ওটা অসুখ লেগেই থাকে। ডাক্তার বোসই চিকিৎসা করেন। মনিরার জন্য তাঁকে প্রায়ই চৌধুরী বাড়িতে যেতে হতো কাজেই ডাক্তার বাসের চৌধুরীবাড়ি অপরিচিত নয়।

ডাক্তার বোস ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করলেন নাইট ড্রেস পাল্টানোর জন্য কিন্তু রুমে প্রবেশ করেই বিস্মিত হলেন–তিনি কিছু পূর্বে হসপিটাল থেকে ফিরে ড্রেস পাল্টে নাইট ড্রেস পরার সময় নিজ হাতে বাগানের দিকের শাসটিা বন্ধ করেছিলেন–মাত্র অর্ধঘন্টা আগের কথা, অথচ এখন শার্সটি সম্পূর্ণ খোলা দেখতে পেলেন। ফিরে তাকাতেই তাঁর চোখ ছানাবড়া হলো, পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক।

ইতিপূর্বে একে কোথাও দেখেছেন বলে মনে হলো না, কিন্তু মুখটা পরিচিত লাগছে যেন।

ডাক্তার বোস অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন যুবকের দিকে। সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারা চোখ দুটিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি রেখা। হাত দুটিকে বুকের সঙ্গে রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে।

ডাক্তার বোস বলে উঠলেন কে আপনি?

হাসলো যুবক ম্লান এক টুকরো হাসি, তারপর বললো–আমার পরিচয় দেবো পরে। আগে বলুন–সরে এলো যুবক ডাক্তার বোসের পাশে–আগে বলুন আমার কথা রাখবেন?

যদি রাখবার মত হয় রাখবো কিন্তু আমি প্রথমে জানতে চাই আপনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন? আর কে আপনি?

শেষ প্রশ্নের জবাব পাবেন পরে কিন্তু প্রথমে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। আমি এখানে কোনো মন্দ উদ্দেশ্যে আসনি। এইমাত্র আপনি আলাপ করছিলেন যেখানে যাবার জন্য, সেখানে আমাকেও নিয়ে যেতে হবে।

চৌধুরীবাড়িতে? বললেন ডাক্তার বোস।

হাঁ, আমাকে সেখানে যেতে হবে–জরুরি।

কিন্তু আপনার পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত আমি আপনার কোনো কথা শুনতে রাজি নই। তাছাড়া আমি ডাক্তার, চৌধুরীবাড়ি যাবো আমি রোগী দেখতে।

ডাক্তার আপনার কর্তব্যের চেয়ে আমার কর্তব্য কোনো অংশে কম নয়, মনিরা আমার স্ত্রী।

আপনি—

আমি দস্যু বনহুর।

আপনি দস্যু বনহুর। চৌধুরী কন্যা মনিরা আপনার বিবাহিতা স্ত্রী?

হাঁ ডাক্তার। এ কথা বাইরের কেউ জানে না, আজ আপনাকে না বলে পারলাম না। ডাক্তার জানি আপনি একজন মহান ব্যক্তি। দেশ ও দশের জন্য নিজকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজের জন্য আপনি কোনো সময় ভাবেন না। সত্যি আপনার মহৎ জীবনকে আমি অভিনন্দন জানাই।

বনহুর যখন কথাগুলো বলছিলো, তখন ডাক্তার বোস দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিলেন তার দিকে। ওকে প্রথম দেখেই কেমন ধোঁকা লেগেছিলো মনে। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিলো চোর বা দুষ্টলোক বলে। কিন্তু চেহারা দেখে সন্দেহ তার সীমাবদ্ধ হয়নি। চোর বা দুষ্ট লোক হলে সে ওভাবে প্রকাশ্যে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। মনের কোণে একবার জেগেছিলো ডাক্তার বোসের দস্যু বনহুর পলাতক আছে। তবে কি সেই? সমাধান খুঁজে পাবারপূর্বেই বনহুর নিজের পরিচয় দিয়েছিলো।

ডাক্তার বোসকে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বনহুর বললো আবার ডাক্তার আপনি জানেন আজ বেলা আটটায় আমি পুলিশ ভ্যান থেকে তাদের সতর্ক পাহারার বেষ্টনী ভেদ করে পালাতে সক্ষম হয়েছি। সমস্ত শহরে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তারের জন্য ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। রেডিওতে বারবার সাবধান বাণী প্রচার করা হচ্ছে। এতদসত্ত্বেও আমি আপনার বাগানে এসে আত্মগোপন করে ছিলাম, এ শহরে একমাত্র আপনার উপর আমার বিশ্বাস–আমি আপনার সাহায্য পাবো।

এতগুলো কথা বলে থামলো বনহুর।

ডক্টর বোস নিশ্চুপ বনহুরের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলেন এবং গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করছিলেন। তিনি বললেন–কি সাহায্য আপনি আমার কাছে কামনা করেন?

বনহুর যেন অনেকটা আস্বস্ত হলো, বললো সে–এ শহরে প্রতিটি রাস্তায় এখন পুলিশ কড়া পাহারা দিচ্ছে। আমি আপনার এখানে অনেক চেষ্টায় এসে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। আমি যে মুহূর্তে আপনার বাগান বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি ঠিক সেই দণ্ডেই আপনি চৌধুরীবাড়ি থেকে ফোন পেলেন। ডাক্তার, আপনি আমাকে চৌধুরী বাড়ি নিয়ে চলুন।

কি করে তা সম্ভব?

ডাক্তার, আপনার সহকারী বলে পরিচয় দেবেন। তাছাড়া আপনার গাড়ি পুলিশদের অতি পরিচিত; কোথায় কখন রোগী দেখতে যাচ্ছেন–সে কথা কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। পুলিশ বাহিনী আপনার চিহ্ন করা গাড়ি দেখলেই ছেড়ে দেবে।

কিন্তু হঠাৎ যদি—

গ্রেপ্তার হই?

হাঁ, কেউ যদি চিনে ফেলে?

সে জন্য দায়ী আপনি নন। ডাক্তার দস্যু বনহুর নিজে মরতে প্রস্তুত আছে, তবু হিতাকাঙ্ক্ষীকে সে কোনো দিন মরতে দেবে না। কিন্তু ছলনাকারী বা অবিশ্বাসীকে ক্ষমা করতে জানে না দস্যু বনহুর। ডাক্তার আপনি যদি আমার সঙ্গে কোনো রকম চাতুরি করেন তাহলে মৃত্যু আপনার অনিবার্য। শেষ অংশের কথাগুলো দাঁতে দাঁত পিষে বললো বনহুর। চোখে মুখে জেগে উঠলো তার পৌরুষ ভাব। দক্ষিণ হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো।

ডাক্তার বোস মুগ্ধ হলেন।

দস্যু বনহুরের নামই তিনি এতদিন শুনে এসেছেন, আজ সেই দুর্ধর্ষ দস্যু তার সামনে দণ্ডায়মান। কল্পনার দৃষ্টি দিয়ে এতদিন এই দস্যু সম্বন্ধে তাঁর যে একটা মনোভাব জন্মেছিলো নিমিষে তা মুছে গেলো। দস্যু হলেও বনহুর মানুষের মত একজন মানুষ যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় উক্তি করতে কিছুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করেনা।

ডাক্তার বোস দস্যু বনহুরের পিঠে হাত রাখলেন–আমি শপথ করলাম, আপনাকে আমি যথাসাধ্য সাহায্য করবো।

ধন্যবাদ ডাক্তার, ধন্যবাদ।

ডাক্তার বোস নিজের পরিচ্ছদ পাল্টে নিলেন, এবং দস্যু বনহুরকে তাঁরই অন্য এক সেট ড্রেস পরবার অনুমতি দিলেন।

*

ডাক্তার বোস এবং তাঁর সহকারী ডাক্তার চন্দনের বেশে দস্যু বনহুর গাড়িতে চেপে বসলো।

কান্দাইয়ের পথ ধরে ডাক্তার বোসের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে চললো চৌধুরী বাড়ি অভিমুখে। ডাক্তার বোসের গাড়িতে হসপিটালের চিহ্ন অঙ্কিত ছিলো কাজেই পুলিশবাহিনী প্রতিটি রাস্তায় সতর্ক পাহারায় নিযুক্ত থাকলেও এ গাড়িটিকে কোনো রকম বাধা দিলো না তারা।

শত শত পুলিশ ফোর্স দাঁড়িয়ে রইলে। পথের ধারে দস্যু বনহুর ডাক্তার বোসের সাথে চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছে গেলো।

চৌধুরীবাড়ির গাড়ি বারান্দায় ডাক্তার বোসের গাড়ি পৌঁছতেই সরকার সাহেব এগিয়ে। এলেন–আপনি এসে গেছেন ডাক্তার বাবু, মা মনির সংজ্ঞা এখনও ফিরে আসেনি।

ডাক্তার বোস গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন পরে নামলো চন্দন বেশী দস্যু বনহুর।

ডাক্তার বোস চন্দনকে লক্ষ্য করে বললেন–সরকার সাহেব এ আমার সহকারী চন্দন। রাতের ব্যাপার কিনা তাই সঙ্গে নিয়ে এলাম হঠাৎ যদি কোনো দরকার পড়ে।

খুব ভাল করেছেন ডাক্তার বাবু। চলুন আপনারা। সরকার সাহেব ব্যাগ হাতে নিলেন– চলুন।

ডাক্তার বোস ও চন্দন এগিয়ে চললো সিঁড়ি বেয়ে উপরে।

সরকার সাহেব আর দু’জন চাকর তারাও অনুসরণ করলো ডাক্তার বোস ও চন্দনকে।

ডাক্তার বোস কক্ষে প্রবেশ করতেই মরিয়ম বেগম মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালেন, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন– ডাক্তার বাবু, মা এবার আর বাঁচবে না।

ডাক্তার বোস মনিরার পাশে এগুবার পূর্বেই চন্দন দ্রুত এগিয়ে গেলো খাটের পাশে। মনিরার ছিন্নলতার মত চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারছিলো না সে। একি চেহারা হয়ে গেছে মনিরার! জীর্ণ হয়ে গেছে দেহ ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখমণ্ডল চোখ দুটো বসে গেছে কালো হয়ে গেছে চোখের নিচে। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে বললো চন্দন বেশী বনহুর ডাক্তার আগে রোগী দেখুন।

ডাক্তার বোস মনিরাকে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন।

মরিয়ম বেগম ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন আমার মা বাঁচবে তো ডাক্তার বাবু?

ডাক্তার বোস বেশ কিছুক্ষণ ধরে মনিরাকে পরীক্ষা করে সোজা হয়ে বসলেন, ললাটে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো।

বনহুর ব্যাকুল আগ্রহে তাকাচ্ছিলো ডাক্তার বোসের মুখের দিকে কিন্তু বলতে পারছিলো না কিছু। মাঝে মাঝে সে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন মনে ভাবছিলো অপরাধী সন্তান আমি; তোমার পাশে দাঁড়িয়েও তোমাকে পরিচয় দিতে পারছিনে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো মা।

ডাক্তার বোস যখন কিছু চিন্তা করছেন তখন মরিয়ম বেগম বলে উঠলেন–কেমন দেখলেন?

ডাক্তার বোস বললেন–অবস্থা খুব ভাল নয় অত্যন্ত উত্তেজিত বা কোনো দুশ্চিন্তার জন্য তার এমন হয়েছে। আচ্ছা বেগম সাহেবা, আমি আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবো সঠিক। জবাব দেবেন?

বলুন ডাক্তার বাবু?

কক্ষে তখন চৌধুরীবাড়ির চেনা-অচেনা অনেকে রয়েছে। বনহুর হঠাৎ কোনো কথা বলতেও পারছে না, এদিকে মনের চলঞ্চলতা কিছুতেই যেন চেপে রাখতে পারছে না। মনিরার মাথায় হাত রাখবার জন্য মনটা তার অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে যে অপরাধী নিজেকে প্রকাশ করার নেই কোনো উপায়।

ডাক্তার বোস বুঝতে পারলেন–বনহুর, চৌধুরী-কন্যার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন লক্ষ্য করে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তবু তিনি মরিয়ম বেগমকে বললেন–হঠাৎ আজ এভাবে অজ্ঞান হয়ে যাবার কারণ কি? নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটেছিলো যা তার মনে ভীষণ আঘাত করেছে?

মরিয়ম বেগম সন্দিগ্ধভাবে তাকালেন চন্দনের ছদ্মবেশী বনহুরের দিকে।

ডাক্তার বোস বললেন–সে অপরলোক নয়, আমার সহকারী চন্দন সেন। আপনি সমস্ত খুলে বলনু?

মরিয়ম বেগম বললেন এবার পর পর কয়েকটা দুর্ঘটনা মনিরার জীবনে ঘটেছে যা অত্যন্ত। বেদনাদায়ক। সব কথা বলা যায় না সবার কাছে।

কিন্তু আপনি ভুল করছেন বেগম সাহেবা, ডাক্তার আর উকিলের কাছে কোনো কথা গোপন করা উচিত নয়। কারণ তা করলে ডাক্তার রোগীর আসল রোগ সম্বন্ধে সঠিক চিকিৎসা করতে সক্ষম হন না। আর উকিল বা ব্যারিষ্টারের নিকটে যদি আসল কথা গোপন রেখে সাজানো কাহিনী বলেন এতে উকিল বা ব্যারিষ্টার কোনো সময় সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারবেন না। কাজেই আপনি বুঝতে পারছেন আপনার কন্যা মনিরার জীবন এখন সঙ্কটাপন্ন। তাকে সঠিক চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলতে হবে।

মরিয়ম বেগম অনেক চিন্তা করে বললেন–আজ সকাল থেকে মনিরার মনের অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। সমস্ত দিন কিছুই মুখে দেওয়াতে পারিনি।

কিন্তু আসল কথা আপনি চেপে যাচ্ছেন, সংক্ষেপে বলুন ব্যাপারটা?

মরিয়ম বেগম কি ভাবে আসল কথা বললেন সে কথা যে কাউকে বলবার নয়। কেন যেন বিবর্ণ হয়ে উঠলেন তিনি, ঢোক গিলে বললেন এবার ডাক্তার বাবু আমার মনিরার বিয়ে হয়েছে। সে বিবাহিত।

ডাক্তার বোস কিছুমাত্র অবাক না হয়ে বললেন–বলুন?

বিয়ের পর ওর স্বামী কোনো কারণবশতঃ দূরে বহু দূরে চলে গেছে, যেখান থেকে আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

ডক্টর বোস তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মরিয়ম বেগমের মুখের দিকে।

মরিয়ম বেগম বললেন আবার–জানেন তো ডাক্তার বাবু, মেয়েদের স্বামীই সর্বস্ব। মনিরা সেই কারণেই সদা বিষণ্ণ থাকে। লোকে জানে মনিরার এখনও বিয়ে হয়নি।

হুঁ বুঝলাম মনিরার বিয়ে আপনারা গোপনে সমাধা করেছিলেন।

হাঁ ডাক্তার বাবু।

স্বামীর বিরহ-বেদনা মেয়েদের জীবনের চরম এক পরাজয়। কথাটা বললেন ডাক্তার বোস।

মরিয়ম বেগম বললেন–আজ রাত দুটো কিংবা আড়াইটা হবে যখন আমাদের বাড়ির পাশ থেকে দস্যু বনহুরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, ঐ সময় হঠাৎ মনিরা সংজ্ঞা হারিয়ে– বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে মরিয়ম বেগমের কণ্ঠস্বর।

চমকে ফিরে তাকায় বনহুর মায়ের মুখের দিকে মুখে-চোখে তার রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠেছে।

ডাক্তার বাসের মুখমণ্ডলেও একরাশ বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে তিনি হতভম্বের মত প্রশ্ন করে বসেন–দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার হয়েছে।

এবার বললেন সরকার সাহেব–হাঁ ডাক্তার বাবু একঘন্টা পূর্বে আমাদের বাড়ির পেছন বাগানবাড়ির প্রাচীরের পাশে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। হঠাৎ ঐ সংবাদ শুনে মনিরা অজ্ঞান হয়ে পড়েছে– তারপর থেকে আর জ্ঞান ফিরেনি।

ডাক্তার বোস সকলের অলক্ষ্যে একবার চন্দনবেশী বনহুরের মুখে তাকালেন।

বনহুর বললো এবার–ডাক্তার, আমার মনে হচ্ছে দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার সংবাদেই মিসেস মনিরা সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেছেন। এখন কি করা দরকার?

ডক্টর বোস বললেন–ব্যাপার অত্যন্ত জটিল চন্দন। আমার মনে হচ্ছে মিসেস মনিরাকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে তার স্বামীকে একান্ত প্রয়োজন। নইলে একে বাঁচানো দুষ্কর হবে।

মরিয়ম বেগম ধরাগলায় বললেন–কিন্তু কোনো উপায় নেই। ডাক্তার বাবু।

ডাক্তার বাবু তখন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

বনহুর বলে উঠলো উপস্থিত যেভাবে মিসেস মনিরার জ্ঞান ফিরে আসে সেই চেষ্টা করুন ডাক্তার।

হাঁ, আমি উপস্থিত মনিরার জ্ঞান ফিরে আনার চেষ্টা করছি। ডাক্তার বোস একটা ইনজেকশান দিলেন এবং নাকে একটা ওষুধ ধরলেন।

ব্যাকুল আগ্রহে সবাই তাকিয়ে আছে মনিরার মুখের দিকে। প্রতিটি ব্যক্তির চোখে মুখে সেকি আকুলতা।

ডাক্তার বোস পর পর ইনজেকশান ও নাকে ওষুধ ধরতে লাগলেন।

ভোর হবার কিছু পূর্বে জ্ঞান ফিরে এলো মনিরার। জ্ঞান ফিরতেই অস্ফুট কণ্ঠে বললো– মামীমা তুমি কোথায়? হাত বাড়ালো মনিরা সামনে।

মরিয়ম বেগম পাশেই ছিলেন সরে এসে ঝুঁকে পড়লেন এই যে মা আমি।

মনিরা বেদনাভরা কণ্ঠে পুনরায় বলে উঠলো–মামীমা, ওকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে? চলে গেছে পুলিশ ওকে নিয়ে?

মরিয়ম বেগম আঁচলে অশ্রু মুছলেন।

ডাক্তার বোস গম্ভীরভাবে একবার তাকালেন সহকারী চন্দনবেশী বনহুরের মুখের দিকে।

ডাক্তার বোস এবং বনহুর বুঝতে পারলো–পুলিশ দস্যু বনহুর ভ্রমে কাউকে গ্রেপ্তার করেছে এবং সেই সংবাদ শুনেই মনিরা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলো।

বনহুর ভ্রুকুঞ্চিত করে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো, কে সেই লোক যে আজ গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু কে তার মনের প্রশ্নের জবাব দেবে।

মনিরা তখন চিৎকার করে বলছে–বলো বলো, মামীমা ওকে ধরে নিয়ে চলে গেছে? আমাকে একটিবার দেখতে দিলো না আমাকে একটি বার দেখতেও দিলো না ওরা–

ডাক্তার বোস মনিরাকে শান্ত হবার জন্য গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–এত উত্তেজিত হলে খারাপ হবে। এখন ঘুমাতে চেষ্টা করো।

না না, আমি ঘুমাতে পারবো না ডাক্তার বাবু যতক্ষণ না জানবো সে মুক্ত।

বনহুর মনিরার পাশে ঝুঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো।

ডাক্তার বোস কক্ষস্থ অন্যান্য সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বনহুর কিছু বলবার পূর্বেই বলে। উঠলেন–মনিরা, সে মুক্তই আছে। বিশ্বাস করো আমার কথা–সে মুক্ত আছে।

ডাক্তার বাবু আমাকে আপনি মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন আমি–আমি নিজের কানে শুনেছি– সে এখানেই আসছিলো। আমার সঙ্গে দেখা করতে–

সরকার সাহেব মরিয়ম বেগমের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মনোভাব–কথাটা ডাক্তার বাবু জেনে ফেললেন, এটা কি উচিৎ হচ্ছে–

মরিয়ম বেগম বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, তাঁর মুখভাবও কেমন ভয়ার্ত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

ডাক্তার বোস সুচতুর ব্যক্তি তিনি সরকার এবং মরিয়ম বেগমের মুখোভাব লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন তারা বেশ ঘাবড়ে গেছেন। মনে করেছেন ডাক্তার তাঁদের ভিতরের রহস্য জেনে ফেললেন। কাজেই তিনি যেন কিছুই বুঝতে পারেননি এমনি ভাব দেখিয়ে বললেন মনিরার মনের। অবস্থা এখন স্বাভাবিক নয়। এখন তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেওয়া দরকার। আমি একটা ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি–খেলে ঘুমাবে।

ডাক্তার বোস দেখলেন তাঁকে এবার উঠতে হয়। তাঁর সঙ্গী সম্বন্ধে এখন তিনি বেশি চিন্তিত কারণ রাজপথ বেয়ে তাকে শহরের বাইরে যেতে হবে।

ডাক্তার বোস মনিরাকে ঘুমের ওষুধ দিলেন। এবং তাকে কোনো চিন্তা করতে বারণ করলেন।

ডাক্তার বোস উঠে দাঁড়ালেন, দেয়ালঘড়িটায় তখন ভোর ছটা ঘোষণা করলো।

বনহুর বিদায়কালে ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকালো মনিরার মুখের দিকে মনিরা তাকে এত কাছে পেয়েও চিনতে পারেনি, মায়ের চোখে চশমা নেই, হয়তো তাই তিনি চিনতে পারলেন না।

বনহুরের মুখে আজ কোনো মেকাপ করা দাড়ি গোঁফ ছিলো না তবে মাথায় ক্যাপ ছিলো একটু অন্য ধরনের আর চোখে ছিলো কালো চশমা।

মনিরা যে দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছে এ কথা বনহুর এখনও জানে না। অসুস্থ মনিরা যখন মামীমাকে বলছিলো–মামীমা তুমি কোথায়? তখন বনহুর কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলো বটে কিন্তু পরক্ষণেই ভেবেছিলো হঠাৎ সংজ্ঞা লাভের পর ঐ রকমই হয় বা হয়ে থাকে। কাজেই সে জানতে পারলো না তার মনিরা সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন।

মনিরা সংজ্ঞালাভের পর বনহুর কোনো কথা বলেনি। কথা বললে তার কণ্ঠস্বর নিশ্চয়ই চিনতে পারতো মনিরা। মরিয়ম বেগমের মনেও যে বনহুরের কণ্ঠস্বর একটা আলোড়ন জাগায়নি তা নয়। কিন্তু ডাক্তার বোস যাকে নিজ সহকারী বলে পরিচয় দিলেন তার সম্বন্ধে অন্য কোনো রকম চিন্তা করা অবান্তর।

ডাক্তার বোসের সঙ্গে বিদায় নিলো বনহুর।

যাবার সময় ইচ্ছা করেই একটা কথা বললো–মিসেস মনিরা, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান। যা। শুনেছেন বা জেনেছেন–সব মিথ্যা।

কে, কে আপনি? মনিরা ব্যস্তকণ্ঠে প্রশ্ন করলো।

ডাক্তার বোস বললেন–চন্দন এসো, শীঘ্র বাসায় ফিরে যেতে হবে।

আর বিলম্ব না করে পা বাড়ালেন তিনি সিঁড়ির পথে।

ডাক্তার বোস ও তাঁর সহকারী বিদায় গ্রহণের পর মনিরা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লো। বললো সে–মামীমা, ডাক্তার ছাড়া কে এসেছিলো আমার ঘরে?

মরিয়ম বেগম মনিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন–ডাক্তার বোসের সহকারী চন্দন সেন।

অস্ফুট কণ্ঠে বললো মনিরা–মামীমা, তুমি ভুল করেছো! তুমি ভুল করেছো মামীমা। চন্দন নয় মনিরার মুখমণ্ডল দীপ্ত হয়ে উঠলো–সে বন্দী হয়নি! সে বন্দী হয়নি।

মনিরা, তুই কি পাগল হয়ে গেলি মা?

না মামীমা, আমি পাগল হইনি। সে এসেছিলো, আমি শুনতে পেয়েছি তার কণ্ঠস্বর। তুমি চোখ থাকতেও তাকে চিনতে পারলে না, মামীমা…সে বন্দী হয়নি।

হাঁ, ঐ যে আমাকে বলে গেলো–যা শুনেছি, যা জেনেছি–সব মিথ্যা।

মামীমা, তোমার ছেলে বন্দী হয়নি…

সরকার সাহেব নিজে দেখে এসেছেন আমার মনিরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে…

না না না, সরকার সাহেব ভুল দেখেছেন…সেই কণ্ঠস্বর..সেই কণ্ঠস্বর–এ কি কোনো দিন। ভুলবার, আর কেউ না বুঝলেও আমি তাকে তার কণ্ঠস্বরে চিনতে পেরেছি…

মনিরার মুখমণ্ডলে একটা আনন্দের লহরী খেলে যায়।

মরিয়ম বেগম তাকিয়ে থাকেন অবাক হয়ে।

*

পথের শেষে বনাঞ্চলের ধারে একটা নিভৃত স্থানে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর।

ডাক্তার বোসও পথে নেমে দাঁড়ালেন।

বনহুর ডাক্তার বোসের দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ কন্ঠে বললো– ডাক্তার, আমি চিরকৃতজ্ঞ। অর্থ দিয়ে আপনাকে আমি ছোট করতে চাইনে। আমার হৃদয়ের

অফুরন্ত শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।

ডাক্তার বোসের মুখেও ফুটে উঠেছে একটা দীপ্ত উজ্জল মধুর ভাব; তিনি বলে ওঠেন–দস্যু বনহুরের বন্ধুত্ব লাভ আমার জীবনের এক পরম সম্পদ হয়ে রইলো।

ডাক্তার বোস গাড়িতে উঠে বসলেন।

ডাক্তার বোস স্বয়ং গাড়ি ড্রাইভ করে এসেছিলেন, কাজেই ড্রাইভার ছিলো না, তিনিই গাড়ি ষ্টার্ট দিলেন।

বনহুর হাত নাড়তে লাগলো।

ডাক্তার বোসের গাড়ি যতক্ষণ পথের বাঁকে অদৃশ্য না হলো, ততক্ষণ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো বনহুর সেইদিকে।

বনহুরকে এবার আস্তানায় ফিরে যেতে হবে।

নির্জন পথ ধরে অগ্রসর হলো সে।

পথ চলছে আর ভাবছে নানা কথা। আজ পথে কোনো পাহারা নেই। কাজেই নিশ্চিন্ত মনে এগুচ্ছে সে।

দু’ধারে বন আর তার মাঝখান দিয়ে পথ।

এটা কান্দাই শহর ছেড়ে অনেক দূর। এপথে কোনো যানবাহন চলাচল করে না। ক্কচিৎ কোনো যানবাহন নিতান্ত প্রয়োজনে আসে বটে কিন্তু অত্যন্ত সাবধান সহকারে। এপথ অতি দুর্গম। বন্য হিংস্র জন্তু ও ডাকাতের ভয় আছে বলে কান্দাইবাসী এদিকে আসতে চায় না।

দস্যু বনহুর এই পথেই অগ্রসর হচ্ছিলো।

হঠাৎ একটা মোটরের শব্দ বনহুরের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো।

মুহূর্তে পাশের ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করলো সে। বিশেষ করে এ পথে মোটর গাড়ি আশ্চর্য বটে। বনহুর একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে দৃষ্টি রাখলো পথের দিকে।

হাঁ, সত্য বটে একটা গাড়ি এদিকে দ্রুত আসছে। যদিও গাড়িটা তখনও বনের আড়ালে ছিলো, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না, তবুও শব্দটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো।

বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই বনহুরের দৃষ্টিপথে গাড়িখানা প্রকাশ পেলো। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখলো–একটা পুলিশ ভ্যান দ্রুত এগিয়ে আসছে। বারো-তেরো জন সশস্ত্র পুলিশ ভ্যানে দাঁড়িয়ে আছে। আরও অবাক হলো বনহুর পুলিশ বাহিনী গাড়িতে দাঁড়িয়ে জয়ধ্বনি করছে। খুশিতে যেন আত্মহারা তারা। ব্যাপার কি, হঠাৎ পুলিশ ভ্যান এদিকেই বা আসছে কেন, আর পুলিশরা আনন্দধ্বনিই বা করছে কেন।

বনহুর হাটু গেড়ে ঝোপটার পাশে বসে রইলো চুপ করে।

পুলিশ ভ্যান দ্রুত এগিয়ে আসছে।

বনহুর ততই অবাক হচ্ছে। ভ্যানের উপরে পুলিশরা দু’হাত উপরে তুলে আনন্দভরা চিৎকার করছে।

আরও অবাক হলো বনহুর, পুলিশ ভ্যানটা এসে যখন দাঁড়িয়ে পড়লো পথের এক পাশে জঙ্গলের কিনারে।

বনহুর স্তব্ধ নিশ্বাসে দেখছে।

ভ্যান থেকে পুলিশরা নেমে পড়লো লাফ দিয়ে পথের বুকে। ভ্যানের পাশে ওরা দাঁড়ালো গোলাকার হয়ে, তারপর আর একবার জয়ধ্বনি করে উঠলো গোলাকার হয়ে, তারপর আর একবার জয়ধ্বনি করে উঠলো সবাই একসঙ্গে–জয়…সর্দারের জয়। দস্যু বনহুরের জয় দস্যু বনহুরের জয়,

বনহুর হঠাৎ যেন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো– এ যে তারই অনুচর দল। ভাল করে লক্ষ্য করতেই বনহুর চিনতে পারলো হাবিলদারের ড্রেসে রহমানকে।

খুশি যেন তাদের ধরছে না, ব্যাপার কি?

বনহুর আর একটু কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো।

রহমান বলছে–সর্দার কোথায় এখনও জানি না। যতক্ষণ তিনি আমাদের মধ্যে ফিরে না। এসেছেন ততক্ষণ আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নই।

অন্য একজন বললো-ভাগ্যিস, তুমি এই ফন্দিটা বের করেছিলে দোস্ত। পুলিশ ভ্যান আটকিয়ে পুলিশদের বন্দী করে তাদের ড্রেস পরে একেবারে পুলিশ সেজে গিয়েছিলাম।

আর একজন বলে উঠলো–পুলিশ-সুপার পর্যন্ত আমাদের চিনতে পারেননি।

রহমান বললো এবার–আমি মনে করেছিলাম, নিশ্চয়ই সর্দার আজ চৌধুরীবাড়ি যাবেন। তাই এমনভাবে ডিউটি বেছে নিয়েছিলাম একটাও আসল পুলিশ সেখানে থাকতে দেইনি। ভাগ্য, সর্দারের রূপ নিয়ে কোনো বেটা আজ গিয়েছিলো, তবেই তো নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি কতকটা। দস্যু বনহুর বলে গ্রেপ্তার করে হাঙ্গেরী কারাগারে পৌঁছে দিয়েছি। এখন পথের পুলিশ পাহারা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই সর্দার এই সুযোগে শহর থেকে সরে পড়তে পারবেন। রাখে আল্লা মারে কে। সরদারকে আল্লাহ রক্ষা করবেন।

বনহুরের কাছে এবার সব পরিস্কার হয়ে এলো। রহমান দলবল নিয়ে তাকে উদ্ধারের চেষ্টায় পুলিশ সেজেছিলো। কিন্তু কে সে যে এখন দস্যু বনহুরের রূপ নিয়ে হাঙ্গেরী কারাগারে বন্দী হয়েছে?

বনহুর আর নিজেকে আত্মগোপন করে রাখতে পারলো না। এবার সে মাথার ক্যাপ খুলে বেরিয়ে এলো ঝোপের আড়াল থেকে, গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলো– রহমান।

এক সঙ্গে পুলিশ ড্রেস পরিহিত তার অনুচরবর্গ বিস্ময়ে চমকে উঠলো।

রহমান অস্কুট আনন্দধ্বনি করে উঠলো–সর্দার!

বনহুর তার বিশ্বস্ত অনুচরগণের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। উজ্জ্বল দীপ্ত তার মুখমণ্ডল, হাসিভরা মুখে বললো বনহুর রহমান, সত্যিই রাখে আল্লা মারে কে– আমি তার কাছে হাজার শুকরিয়া করছি।

পুলিশ ভ্যান রাস্তায় পড়ে রইলো। বনহুর তার দলবল নিয়ে গহন বনে প্রবেশ করে।

*

আস্তানায় ফিরে আসতেই একটা আনন্দের বন্যা বয়ে চললো অনুচরগণের মধ্যে।

সমস্ত অনুচর দস্যু বনহুরকে অভিনন্দন জানালো নতুন করে। নানা রকম উৎসব আর আনন্দ শুরু হলো আস্তানায়।– বনহুর অবাক হলো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে। সবাই এসে বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে গেলো, কিন্তু নূরী তো এলো না!

বনহুর কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। কেমন একটা অস্থির ভাব তাকে চঞ্চল করে তুলেছে। নূরীর সাক্ষাৎ না পাওয়ায় তার মনে এ অশান্তি।

সন্ধ্যায় একটা বড় রকম উৎসবের আয়োজন করেছে রহমান। সর্দার জয়ী হয়ে ফিরে এসেছে, এটা যে তাদের কত বড় খুশির বিষয় তারা অন্তরে অন্তরে উপলব্ধি করেছে।

বনহুর প্রতি মুহূর্তে নূরীর আগমন প্রতীক্ষা করেছে কিন্তু কোথায় নূরী। এত বড় একটা বিপদ থেকে সে উদ্ধার লাভ করে এলো, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো সে, অথচ নূরী একটি বার এলো না তার কাছে।

বনহুর রহমানকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলো আস্তানায় ফিরে–নূরীকে দেখছিনা কেন রহমান! ও ভাল আছে তো?

জবাবে বলেছিলো রহমান সর্দার, নূরী এ কদিন সব সময় আপনার জন্য কাঁদাকাটি করেছে, এমন কি আহার নিদ্রা তার ছিলো না।

এত যার ব্যথা তার জন্য এখনও সে এলো না কেন? বনহুর নিজ বিশ্রামকক্ষে চিন্তিতভাবে পায়চারী করছিলো।

বনহুর নূরীকে না দেখলেও নূরী তাকে দেখেছিলো গোপন স্থান থেকে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলো তার হুর ফিরে এসেছে বলে। অতি কষ্টে নিজকে সামলে রেখেছিলো নূরী কোনোরকমে। লাখো লাখো শুকরিয়া করেছিলো সে খোদার দরগায়।

নূরী এবার শিশু মনিকে কোলে করে বনহুরের বিশ্রাম কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ালো, মনির কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো-মনি, যাও তোমার বাপি এসেছে।

মনি খুশিতে ডগমগ হলো, নূরীর কোল থেকে নেমে ছুটে গেলো কক্ষে। বনহুর মনির পদশব্দে ফিরে তাকাতেই মনি জড়িয়ে ধরলো তাকে–বাপি!

বনহুর তুলে নিলো কোলে, চুমোয় চুমোয় মনির মুখ ভরিয়ে দিয়ে বললে–তোমার আম্মি কোথায় মনি?

নূরী তখন আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো, বনহুরের কথাটা কানে যেতেই অনাবিল একটা শান্তিতে ভরে উঠলো তার মন। খুশিতে উজ্জল হলো তার চোখ দুটো, কিন্তু গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা অশ্রু।

মনি তখন বলছে বাপি, আম্মি ঐ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বনহুর তাকালো দরজার দিকে।

নূরী সেই মুহূর্তে সরে যাচ্ছিলো, বনহুর মনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত সরে এসে নূরীর দক্ষিণ হাতখানা খপ করে চেপে ধরলো।

নূরী মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো, কোনো কথা বললো না বা বনহুরের মুখের দিকে তাকালো না।

বনহুর নূরীর মুখখানা তার নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো–এ কি, তোমার চোখে আজ পানি কেন নুরী?

নূরীর ঠোঁট দু’খানা কেঁপে উঠলো শুধুমাত্র কোনো কথা সে বলতে পারলো না। বনহুর মনিকে লক্ষ্য করে বললো–যাও, খেলোগে মনি।

মনি একবার নূরী আর বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো।

বনহুর নূরী সহ কক্ষে প্রবেশ করলো, দক্ষিণ হাতে নূরীর চিবুক ধরে উঁচু করে বললো–কি হয়েছে তোমার বলো না?

হঠাৎ নূরী দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বনহুর নূরীকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিয়ে বললো– কি অন্যায় আমি করেছি, বলো? জবাব দাও নূরী?

অন্যায় তুমি করোনি, করেছি আমি।

নূরী!

হুর, তুমি আমাকে স্পর্শ করো না।

কেন?

না না, বলতে পারবো না। বলতে পারবো না আমি।

আমিও কিছুতেই ছাড়বো না তোমাকে…বনহুর নূরীকে আরও নিবিড়ভাবে টেনে নেয় কাছে।

নূরী কোনো কথাই বলতে পারে না, বনহুরের প্রশস্ত বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

বনহুর সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় নূরীর মাথায়-পিঠে।

নূরী ভুলে যায় কিছুক্ষণ পূর্বে জোবাইদার সঙ্গে তার কথাগুলো, ভুলে যায় বনহুরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি। ভুলে যায় সমস্ত পৃথিবীটাকে, ভুলে যায় সে নিজের অস্তিত্ব…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *