দস্যুর প্রতিহিংসা

দস্যুর প্রতিহিংসা

প্রথম পরিচ্ছেদ 

আষাঢ় মাস, অমাবস্যার রাত্রি; আকাশ ঘনঘটায় আচ্ছন্ন, মেদিনীমণ্ডল একেবারে ঘোর অন্ধকারে আবৃত। তাহার উপর থাকিয়া থাকিয়া, টিপি টিপি বৃষ্টি পড়িতেছে, দূরের দ্রব্য দূরে থাক, কোলের মানুষ পর্য্যন্ত দৃষ্টি গোচর হইতেছে না। এই ভয়াবহ অমানিশার গভীর অংশে, কোন স্থানে জনমানবের চিহ্ন মাত্র নাই, সময় সময় বহুদূর হইতে শৃগাল বা কুকুরের কণ্ঠস্বর অস্ফুট ভাবে কর্ণে প্রবিষ্ট হইতেছে। 

এইরূপ সময়ে একটি পুরাতন ও নিন্দনীয় পল্লির মধ্যস্থিত একখানি খোলার ঘরে মিট্‌ মিট্‌ করিয়া একটি কেরোসিনের আলো জ্বলিতেছে। এই পল্লিটি সর্বজনপরিচিত। এই স্থানের অধিবাসীগণের মধ্যে একটিও ভদ্রলোককে কেহ কখনও দেখিতে পান নাই। ইহার অধিবাসী মাত্রই নীচ বংশসম্ভূত ও নীচকর্ম্মে কৰ্ম্মান্বিত। চোর বল, জুয়াচোর বল, জালিয়াৎ বল, এই পল্লির মধ্যে অভাব নাই। জুয়াড়ি বল, চণ্ডুলি বল, আফিংচি বল, এই পল্লিতে যত অনুসন্ধান করিবে, ততই পাইবে। লাঠিয়াল বল, গুণ্ডা বল, বদমায়েস বল, এই পল্লির গৃহে গৃহে বাস করিয়া থাকে। পাপের প্রশ্রয় দিতে হইলে যাহা কিছু প্রয়োজন, তাহার সমস্তই এই পল্লির মধ্যে পাওয়া যায়। এক কথায়, এইরূপ পল্লি এই কলিকাতা সহরের মধ্যে চারি পাঁচটি ভিন্ন আর অধিক নাই, ইহাই মঙ্গল, নতুবা কোন ভদ্রলোক এই স্থানে একদিবসের নিমিত্তও বাস করিতে পারিতেন বলিয়া আমার বোধ হয় না। এই সমস্ত পল্লির মধ্যে পুলিস-কর্ম্মচারিগণও সময় সময় বিনা সাহায্যে প্রবেশ করিতে ভয় পাইয়া থাকেন। এরূপও সময় সময় হইয়াছে যে, স্থানীয় পুলিস-প্রহরী পাহারা দিবার কালীন একাকী ওই পল্লির ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, কিন্তু আর প্রত্যাবর্তন করে নাই। পরদিবস তাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। এইরূপ ভয়ানক পল্লির মধ্যে রাত্রি আন্দাজ দুইটার সময় পূর্ব্বকথিত একখানি খোলার ঘরে সামান্য একটি কেরোসিনের আলো কেন দেখা যাইতেছে? উহার মধ্যে নিশ্চয়ই কি একটা মহাপাপের আয়োজন হইতেছে; পাঠক মহাশয় যদি আপনার সাহসে কুলায়, তাহা হইলে একবার আমার সঙ্গে ওই স্থানে চলুন। ওই স্থানে গমন করিলেই ওই গৃহের অবস্থা অনায়াসে জানিতে পারিবেন। 

গৃহটি খোলার ও ক্ষুদ্র। গৃহের অবস্থা দেখিয়া বোধ হয়, উহাতে দুইটি লোক বাস করিয়া থাকে। কিন্তু এখন উহার ভিতর বসিয়া ৭/৮ জন লোক কথাবার্তায় নিযুক্ত আছে। উহারা যে সম্বন্ধে কথাবার্তা কহিতেছে, তাহা নিতান্ত সামান্য বিষয় নহে, একটি ভয়ানক কার্য্যের সূচনা করাই ওই কথাবার্তার মূল। পাঠকগণ উহাদিগের কথাবার্তার কিয়দংশ শ্রবণ করিলেই বুঝিতেপারিবেন, উহারা কিরূপ ভয়ানক কার্য্যের সূচনা করিতেছে। 

১ম ব্যক্তি। প্রসন্ন কুমারকে কোনরূপে এই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিতে না পারিলে আমরা কোনপ্রকারেই এই স্থানে আমাদিগের কার্যক্ষেত্র বিস্তার করিতে পারিব না। 

২য় ব্যক্তি। কোন্ প্রসন্নকুমারের কথা তুমি বলিতেছ? 

১ম। ডিটেকটিভ প্রসন্ন। যে প্রসন্ন আমাদিগের দলের কত লোককে একে একে ধরিয়া জেলে পাঠাইয়াছে। 

২য়। হাঁ, সে আমাদিগের কার্য্যে বড়ই ব্যাঘ্যাত দিয়া থাকে। তাহার সম্বন্ধে কোনরূপ ব্যবস্থা করা আমাদিগের নিতান্ত কৰ্ত্তব্য। 

৩য়। ওই সে দিবস মঙ্গল প্রভৃতি পাঁচজনকে এক মোকদ্দমায় জেলে দিয়াছে। 

৪র্থ। ভগেলু প্রভৃতি যে চারিজন ধরা পড়িয়া জেলে গিয়াছে, তাহাদিগকে ধরিয়া দিবার মূলই ওই ব্যক্তি।

৫ম। জেলে যাওয়া ত আমাদিগের কায, জেল ত আমাদিগের ঘর বাড়ী আছেই, কিন্তু আজ কয়েক বৎসরের মধ্যে আমাদিগের দলের কয়েকজনকে একে একে ধরিয়া যে ক্রমে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিয়াছে, ইহাই বড় দুঃখের বিষয়। তাহাদিগের স্ত্রীপুত্রগণের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, উহার স্ত্রীপুত্রগণেরও সেইরূপ অবস্থা ঘটিলে আমাদিগের মনে কিছু শান্তি হইতে পারে। আমার বিবেচনায়, উহাকে যত শীঘ্র পারা যায় শিক্ষা দেওয়া উচিত। 

১ম। তাহা হইলে আমি দেখিতেছি, আমি যে প্রস্তাব করিলাম, তাহাতে তোমাদিগের সকলেরই মত আছে।

৬ষ্ঠ। নিশ্চয়ই, এরূপ কার্য্যে আর অমত করিবে কে? 

১ম। এখন কিরূপ উপায়ে আমাদিগের মনস্কামনা পূর্ণ করা যাইতে পারে? 

২য়। উপায় আর কি? সুযোগমতে পশ্চাৎ হইতে উহার মস্তকে এক ডাণ্ডা বসাইতে পারিলেই দেখিতে দেখিতে সব কাৰ্য্য শেষ হইয়া যাইবে। 

১ম।ইহা নিতান্ত সহজ নহে, কারণ সে বড় হুঁসিয়ার লোক, বিশেষ সতর্কতার সহিত সে সহরের ভিতর চলা-ফেরা করে। এ পর্যন্ত আমি কখনও তাহাকে হাঁটিয়া যাইতে দেখি নাই। গাড়ি ভিন্ন প্রায়ই সে বাহির হয় না। এরূপ অবস্থায় তাহাকে লাটী মারিবার চেষ্টা করিতে গিয়া সফল-কাম হইবে না, লাভের মধ্যে হয় ত এই হইবে যে, যাহারা ওই কার্য্যে নিযুক্ত হইবে, তাহারা পরিশেষে ধৃত ও কারারুদ্ধ হইবে। এরূপ ভাবে কার্য্য করিতে আমি পরামর্শ দিতে পারি না। 

৩য়। আমি এক কথা বলি। তোমরা বিবেচনা করিয়া দেখ, ওই কার্য্য সম্ভবপর কি না। আমাদিগের মধ্যে কোন এক ব্যক্তি কোন একটি অপরাধ করিয়া ধৃত হই। আমরা ইতিপূর্বে জেল খাটিয়াছি ও পুলিসের অনেকেই আমাদিগকে চিনে, সুতরাং ধৃত হইবামাত্র পুলিসহস্তে লৌহ-হাতকড়ি পরাইয়া দিবে। ওইরূপ হাতকড়িতে আবদ্ধ হইয়া যখন থাকিব, সেই সময় সে নিকটে আসিলে ওই মহা অস্ত্র হাতকড়ির সাহায্যে তাহাকে এরূপ ভাবে আক্রমণ করিব যে, তাহাকে আর তাহার কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে হইবে না, চিরদিবসের নিমিত্ত সে এই কার্য্য পরিত্যাগ করিবে। 

১ম। তাহা ত হইল কিন্তু যখন তুমি ধৃত হইবে, তখন কেবলই যে তোমার হস্তে হাতকড়ি দিয়াই যে পুলিস তোমাকে ছাড়িয়া দিয়া বসিয়া থাকিবে, তাহা নহে। হয় তোমার কোমরে রজ্জু বেষ্টন করিয়া, না হয় তোমার হস্তে কাপড় বাঁধিয়া উহা হয় একজন, না হয় দুইজন প্রহরী ধরিয়া রাখিবে। তাহারা তোমাকে হঠাৎ প্রহার করিতে দিবে কেন? আর যদি কোন গতিকে সুযোগই পাও, তাহা হইলে প্রহার করিবার নিমিত্ত তুমি তোমার হাত উত্তোলন করিবামাত্রই তুমি প্রহরী কর্তৃক ধৃত হইবে। বিশেষ, সে যদি তোমার কাছে না আইসে, তুমি ধৃত হইলেই যে সে তোমার নিকট আগমন করিবে, তাহারই বা কারণ কি? এরূপ অবস্থায় তোমার উদ্দেশ্য সাধন হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই, লাভের মধ্যে এই হইবে যে, যে মোকদ্দমায় তুমি ধৃত হইবে, সেই মোকদ্দমায় তোমার জেল হইয়া যাইবে। এরূপ প্রস্তাবের আমি কোনরূপে অনুমোদন করিতে পারি না। 

৪র্থ। আর এক কাজ করিলে হয় না? 

১ম। কি? 

৪র্থ। যে ঘরে ও শুইয়া থাকে, সেই ঘরে রাত্রিতে আগুন লাগাইয়া দিলে কি হয়? 

১ম। মন্দ হয় না, কিন্তু উহা করিবে কি প্রকারে? সে কোন খোলার বাড়ীতে থাকে না, পাকা বাড়ীতে উপরের কোন ঘরে থাকে, সেই ঘরে আগুন কিরূপে লাগাইবে? আমাদিগের চক্ষে ইহাও একেবারে অসম্ভব! 

৫ম। যখন সে কোন মোকদ্দমার অনুসন্ধানে বাহির হয়, সেই সময় কোন সুযোগে যদি তাহার অনুসরণ করিতে পারা যায়, তাহা হইলে সুবিধা মত কোন না কোন উপায় অবলম্বন করিয়া তাহাকে শেষ করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। আমাকে এই কার্য্যের ভার দাও, দেখ, এক মাসের মধ্যে আমি এই কার্য্য শেষ করিয়া উঠিতে পারি কি না? 

১ম। পার আমি স্বীকার করি, কিন্তু আমার ইচ্ছা এই যে, যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া কার্য্য উদ্ধার করিতে হইবে তাহা অপরে যেন কোনরূপ অবগত হইতে না পারে। কার্য্য শেষ করিবার সময় যদি ধরাই পড়িতে হইল, তাহা হইলে ওরূপ কার্য্য করিয়া লাভ কি? তুমি যেরূপ প্রস্তাব করিতেছ, তাহাতে নিশ্চয়ই তোমাকে সরকারী রাস্তার উপর বা কোনরূপ প্রকাশ্য স্থলেই তাহাকে আক্রমণ করিতে হইবে, সুতরাং কোন না কোন লোক যে তোমাকে দেখিতে পাইবে, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যদি কার্য্য শেষ করিবার সময় কেহ তাহা দেখিতেই পাইল, যাহার দ্বারা কাৰ্য্য শেষ হইতেছে, তাহাকে যদি কেহ চিনিতেই পারিল, তাহা হইলে সে কার্য্য করিয়া লাভ কি? তোমার অবস্থাও পরিশেষে যদি তাহার অবস্থায় পরিণত হইল, তবে সেই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে আমি কখনই তোমাকে পরামর্শ দিতে পারি না। 

৬ষ্ঠ। আমাদিগের দলস্থিত সকল ব্যক্তিকেই যে ও চিনে, তাহা আমার বোধ হয় না; যাহাকে না চিনে, এমন কোন হিন্দু যদি কোন গতিকে উহার নিকট কোনরূপ চাকরী গ্রহণ করিতে পারে, তাহা হইলে এই কাৰ্য সম্পন্ন করা অতি সহজ হইয়া পড়ে। সুযোগমতে উহাকে কোনরূপ বিষ প্রয়োগ করিতে পারিলে, আমাদিগের অভিলষিত কার্য্য সহজেই সম্পন্ন হইয়া যায়। 

১ম। এ উপায় মন্দ নহে, কিন্তু ভাবিয়া দেখ, আমরা কাহাকে বিশ্বাস করিয়া এই কার্য্যে নিযুক্ত করিতে পারি? সাহাকে সে চিনে না, এরূপ ব্যক্তি কে আছে? আমি ত এরূপ কোন লোক আমাদিগের ভিতর দেখিতে পাইতেছি না। কারণ আমার বিশ্বাস যে, সে আমাদিগের সকলকেই চিনে। 

৭ম। এত ভাবয়া চিন্তিয়া আবশ্যক কি? চল, সকলে গিয়া একদিন রাত্রে উহার ঘরে চুরি করি। আবশ্যক হয়, ডাকাইতিই করা যাইবে। দ্রব্যাদি যত আনিতে পারি আর না পারি, উহাকে সাবাড় করিয়া আমরা চলিয়া আসিব। রাত্রিকালে বেশ পরিবর্তন করিয়া গমন করিলে আমাদিগকে কে চিনিতে পারিবে? চলিয়া আসিবার সময় যদি কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা পাই, বলপ্রয়োগ করিতে পরান্মুখ হইব না। 

১ম। ইহা একেবারেই সম্ভবপর নহে, কারণ তুমি জান, আজ-কাল সে কোথায় বাস করিয়া থাকে? 

৭ম। না। 

১ম। আজকাল সে থানার ভিতর তিন তালায় বাস করে। সেই স্থানে গিয়া চুরি বা ডাকাইতি করা একেবারে অসম্ভব। 

৮ম ব্যক্তি এ পর্যন্ত কোন কথাই কহে নাই, সে চুপ করিয়া বসিয়া এক ছিলিম তামাকু একাই শেষ করিতেছিল। সে কহিল, যাহার বুদ্ধিতে যেরূপ আসিল, সে তাহাই বলিল; আমিও এ সম্বন্ধে একটি কথা বলিতে চাই। দেখুন দেখি, আমার প্রস্তাব কতদূর সম্ভবপর হইতে পারে? এই বলিয়া সে ১ম ব্যক্তির কাণে কাণে কি বলিল। তাহার কথা শুনিয়া প্রথম ব্যক্তি কহিল, তুম যেরূপ কহিলে, তাহা যদি করিতে পারা যায়, তাহা হইলে মন্দ হয় না। আমার বিবেচনায় এইরূপ ভাবে চেষ্টা করা মন্দ নহে। 

এই বলিয়া ৮ম ব্যক্তি যাহা বলিয়াছিল, তাহা সে সকলকে চুপি চুপি বলিল। উহাতে সকলেই সম্মত হইল। পরদিবস হইতে তাহারা ওই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবে, এইরূপ পরামর্শ স্থির করিয়া সকলেই গাত্রোত্থান করিল। দেখিতে দেখিতে সকলেই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন পূৰ্ব্বক সেই গভীর রজনীর অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়া গেল। তাহারা যে কে কোথায় গেল তাহা আর দেখিতে পাওয়া গেল না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

যে আটজন লোক পূৰ্ব্বকথিত স্থানে সংমিলিত হইয়া ডিটেকটিভ প্রসন্নকুমারের সর্ব্বনাশ সাধনের মন্ত্রণায় নিযুক্ত ছিল, তাহারা পাঠকগণের সম্পূর্ণরূপ অপরিচিত হইলেও তাহারা যে কি চরিত্রের ও কোন্ শ্রেণীর লোক, তাহার অনেকটা আভাযপ্রাপ্ত হইয়াছেন, এক ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাইলেই অনেকটা বুঝিয়া উঠিতে পারিবেন। 

যে ব্যক্তি প্রথম প্রসন্নকুমারের সর্ব্বনাশ সাধনের প্রস্তাব করে, তাহার নাম গঙ্গারাম। গঙ্গারাম জাতিতে কাহার। সে সমস্ত পুলিসের নিকট গঙ্গা কাহার নামে পরিচিত। গঙ্গারাম যখন তাহার দেশ পরিত্যাগ করিয়া প্রথম কলিকাতায় আসে, তখন তাহার বয়ঃক্রম দশ বৎসর মাত্র। এই অল্প বয়সেই সে বদমায়েসের দলভুক্ত হয় ও সেই সময় হইতেই সে চুরি করিতে আরম্ভ করে। সেই সময় হইতেই ক্রমে সে পুলিসের নিকট পরিচিত হইয়া পড়েও সেই সময় হইতেই তাহার মধ্যে মধ্যে কারাবাস দণ্ড হয়। 

গঙ্গারাম তাহার বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, ক্ষুদ্র চোর হইতে ক্রমে বড় চোরে পরিগণিত হয়। যে সকল চুরি অপর চোরে সহজে করিতে পারে না, যে সকল চুরি করিতে বিশেষরূপে বিপদগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা, সে ক্রমে সেই সকল চুরিতে হস্তক্ষেপ করিতে আরম্ভ করে। পাকা দেওয়ালে সিঁদ কাটিয়া, তিন তালা-চারি তালা বাড়ীর ছাদে উঠিয়া লোহার সিন্দুক ভাঙ্গিয়া, বড় বড় বাড়ীতে বা দোকানে চুরি হইলেই পুলিস বুঝিতে পারিত, এ কার্য্য গঙ্গারামের। বাস্তবিকই গঙ্গারাম প্রায় ওইরূপ কার্য্য করিয়াই লোকের সর্বনাশ করিতে আরম্ভ করে। হঠাৎ ধরা পড়িলে অনেক সময় গঙ্গারাম বল প্রয়োগ করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইত না। ধৃতকারীকে সাংঘাতিকরূপে আহত করিয়া সে অনেক সময় তাহার হস্ত হইতে অব্যাহতি পাইয়াছে। 

এইরূপ গুরুতর অপরাধ করিয়া গঙ্গারাম যে কখন ধৃত হয় নাই, তাহা নহে, সে অনেক বার ধৃত হইয়াছে, অনেক বার জেলে গিয়াছে ও দুই একবার জেল হইতে পলায়নও করিয়াছে। কিন্তু সে কিছুতেই তাহার কার্য্য পরিত্যাগ করে নাই বরং উত্তরোত্তর সে ওই কার্য্যেই তাহার মন নিযুক্ত করিয়াছে ও ক্রমে ক্রমে দল সংগ্রহ করিয়া এখন নিজে দলপতি হইয়া বসিয়াছে। তাহার দলস্থিত সকলেই চোর ও ডাকাইত, সকলেই অনেকবার জেলে বাস করিয়াছে। দলের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতিই আছে। উহাদিগের জাতি বা ধর্ম্ম পৃথক হইলেও, কৰ্ম্মক্ষেত্র কিন্তু এক। যখন উহারা সকলে একত্রিত হইয়া কৰ্ম্মক্ষেত্রে উপস্থিত হয়, তখন উহাদিগের মনে জাত্যভিমান থকে না, হিন্দু-মুসলমান জ্ঞান থাকে না, পরস্পর পরস্পরকে আপন ভ্রাতা জ্ঞানে গ্রহণ করিয়া থাকে। 

গঙ্গারাম দলপতি বটে কিন্তু তাহার বাস করিবার নির্দিষ্ট স্থান নাই; যখন যে স্থানে সুবিধা পায়, তখন সেই স্থানেই বাস করিয়া থাকে। আহারের বন্দোবস্তও সেইরূপ। তাহার দলস্থিত ব্যক্তিগণের অবস্থাও প্রায় সেইরূপ; তবে কাহারও কাহারও থাকিবার স্থান সময় সময় দেখিতে পাওয়া যায়, কখন বা তাহাও পাওয়া যায় না। 

চুরি ডাকাইতি করিয়া সময় সময় যাহারা অনেক অর্থ আপনাপন অধিকারভুক্ত করিয়া থাকে, তাহারা সামান্য ভাড়া দিয়া কেন স্থিরভাবে একস্থানে বাস করে না, কেনই বা এক স্থানে আহারাদির বন্দোবস্ত করে না, তাহার কারণ পাঠকগণ কিছুমাত্র অবগত আছেন কি? পুলিস উহাদিগকে সর্ব্বদা নজরের উপর রাখিতে চান, রাত্রি-দিন উহারা কি করিতেছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত বিধিমত চেষ্টা করিয়া থাকেন, কিন্তু উহারা তাহা চাহে না। উহাদিগের গতিবিধি পুলিস যাহাতে জানিতে না পারে, তাহার নিমিত্ত সৰ্ব্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখিয়া থাকে; এই নিমিত্তই উহারা একস্থানে স্থির ভাবে বাস করিতে পারে না। উহাদিগের নিয়ম এই যে, উহারা সকলে পৃথক পৃথক ভাবে অবস্থিতি করিবে, কার্য্যকালে একত্রিত হইবে। থাকিবার নিমিত্ত উহারা প্রায় সর্ব্বদাই নূতন স্থানের অনুসন্ধান করিয়া থাকে। কোন অপরিচিত বস্তির মধ্যে কেহ একটি ঘর ভাড়া করিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিলে, যে পর্য্যন্ত না সেই বস্তির লোক জানিতে পারে যে, সে চোর বা যে পর্য্যন্ত না পুলিস জানিতে পারে যে, সে সেই স্থানে বাস করিতেছে, সেই পর্যন্ত সে সেই স্থানে বাস করিয়া থাকে, কিন্তু যে দিবস তাহার সেই স্থানে বাস করিবার বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে, সেই দিবস সেও সেই স্থান হইতে অন্তর্হিত হইয়া অপর কোন নূতন স্থানের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়। এইরূপে প্রায়ই তাহারা তাহাদিগের ঠিকানা পরিবর্ত্তন করিয়া থাকে, সুতরাং তাহাদিগের আহারের ও থাকিবার স্থানের কিছুমাত্র ঠিকানা নাই। কিন্তু যে যেখানেই থাকুক না কেন, উহাদিগের দলস্থিত ব্যক্তিগণ পরস্পর পরস্পরের সহিত যখন ইচ্ছা তখনই দেখা করিতে পারে, কারণ উহাদিগের পরস্পর পরস্পরকে খুঁজিয়া বাহির করিতে কিছুমাত্র বিলম্ব হয় না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

সন্ধ্যা হইতে সামান্য বাকী আছে, সূর্যকিরণ মৃত্তিকা পরিত্যাগ করিয়া বৃক্ষের অগ্রভাগ আশ্রয় করিয়াছে। এরূপ সময়ে গঙ্গারাম সহরতলীর একটি রাস্তার পার্শ্বস্থিত একটি সাঁকোর উপর একাকী বসিয়া কি চিন্তা করিতেছে, কোথা হইতে আর একজন আসিয়া তাহার নিকট উপবেশন করিল। গঙ্গারাম তাহাকে দেখিয়া কহিল “কি হে, সংবাদ কি?” 

আগন্তুক। সংবাদ ভাল। আমার কার্য্য আমি ঠিক করিয়া আসিয়াছি। 

গঙ্গা। বাড়ীটি কেমন? 

আগ। আমাদিগের কার্যোপযোগী। কাঁকুড়গাছির যে সকল জঙ্গলময় বাগান আছে, তাহার একটি খালি বাগানের মধ্যে মাঝারি গোছের একটি দোতালা বাড়ী আছে, উহার নিকটবর্ত্তী স্থানে কোন লোকজনের বসবাস নাই। উহার ভিতর আমরা যাহাই করি না কেন, কেহই তাহার কিছুই জানিতে পারিবে না। ওই বাড়ীটি আমি ঠিক করিয়া আসিয়াছি। 

গঙ্গা। কত দিবসের নিমিত্ত? 

আগ। এক মাসের জন্য। 

গঙ্গা। ভাড়া কি দিতে হইবে? 

আগ। বিশেষ কিছুই দিতে হইবে না, যাহার বাগান, তিনি কখনও বাগানে আসেন না, কোন সংবাদও লন না, কোন মালিও রাখেন না। নিকটবর্ত্তী এক বাগানের মালীর নিকট ওই বাড়ীর চাবি থাকে, ওই মালীকে গোটা পঁচিশ টাকা দিলেই আমাদিগের কার্য্য উদ্ধার হইবে। 

গঙ্গা। তুমি মালীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলে? 

আগ। করিয়াছিলাম, সে রাজি আছে, কিন্তু তাহাকে টাকা অগ্রে দিতে হইবে। 

গঙ্গা। অগ্রে টাকা না পাইলে সে আমাদিগকে ওই বাড়ীতে প্রবেশ করিতে দিবে কেন? 

উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এরূপ সময়ে আর এক ব্যক্তি সেই স্থানে আসিয়া উপবেশন করিল, উহাকে লক্ষ্য করিয়া গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিল “তুমি যে কর্য্যের ভার লইয়াছিলে, তাহার কতদূর হইয়াছে?”

২য় আগন্তুক। কাৰ্য্য এখনও শেষ হয় নাই, কিন্তু অনেকটা ঠিক হইয়াছে, দুই একদিনের মধ্যেই কার্য্য শেষ করিতে পারিব, এরূপ আশা আছে। 

গঙ্গা। ছেলে না মেয়ে? 

২য় আগ। ছেলেও আছে, মেয়েও আছে, যেটিকে সুবিধামত পাওয়া যায়। 

গঙ্গা। উভয়েই কি এক বাড়ীর? 

২য় আগ। না, এক বাড়ীর বা এক পাড়ার নহে। ভিন্ন ভিন্ন বাড়ীর ও ভিন্ন ভিন্ন পাড়ার। 

গঙ্গা। উভয়েই কি বড়লোকের সন্তান? 

২য় আগ। উভয়ের পিতাই সহরের মধ্যে গণ্য মান্য লোক, বড় জমীদার। 

গঙ্গা। তাহা হইলে উহাদিগকে আনিতে পারিবে? 

২য় আগ। সে বিষয় আপনাকে ভাবিতে হইবে না, যে কোন উপায়ে হউক, একজনকে না একজনকে আনিয়া আপনার নিকট উপস্থিত করিব। কিন্তু কোথায় যে লইয়া যাইব, তাহাই আমাকে বলিয়া দিন, কেবল তাহাই জানিবার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। 

গঙ্গা। বাড়ীও একরূপ স্থির হইয়াছে, কল্যই পাকা হইয়া যাইবে, ইনি সে সম্বন্ধে বেশ ভালরূপ বন্দোবস্ত করিয়া আসিয়াছেন। যেমন তুমি উহাদিগের একজনকে আনিতে সমর্থ হইবে, অমনি তাহাকে ওই বাড়ীতে লইয়া যাইও। 

২য় আগ। সে বাড়ীটি কোথায়? 

১ম আগ। কাঁকুড়গাছির মধ্যে একটি বাগানে। 

২য় আগ। কাঁকুড়গাছি বেশ নিৰ্জ্জন স্থান, বাড়ীটি আমরা দেখিব কি প্রকারে? 

১ম আগ। দেখিবার আর ভাবনা কি? আমার সহিত চল, আমি এখনই উহা তোমাকে দেখাইয়া আনিতেছি।

গঙ্গা। ভাল কথা, এখান হইতে কাঁকুড়গাছি অধিক দূরে নহে। চল, আমরা সকলে গিয়া একবার বাড়ীটি দেখিয়া আসি, যদি সুবিধা হয়, তাহা হইলে সেই মালীর সহিত বন্দোবস্ত করিয়া বাড়ী ঠিক করিয়া ফেলিব। 

২য় আগন্তুক ওই প্রস্তাবে সম্মত হইল। তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়া গিয়াছে, মেদিনী অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। সেই অন্ধকারে আপনাপন দেহ লুক্কায়িত করিয়া তিনজনেই সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিল, ক্রমে তাহারা কাঁকুড়গাছির সেই বাগানে গিয়া উপস্থিত হইল। দ্বিতীয় আগন্তুক মালীর নিকট হইতে সেই বাড়ীর চাবি ও একটি প্রজ্বলিত কেরাসিন ডিবা আনিয়া উপস্থিত করিল। ঘর খুলিয়া উহারা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ঘরের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিল। বুঝিল, বাড়ীটি তাহাদের মনের মত। 

সেই রাত্রেই ওই মালীকে অর্থ প্রদানে সন্তুষ্ট করিয়া এক মাসের নিমিত্ত ওই বাড়ীর চাবি উহারা গ্রহণ করিল। মালী প্রথমত ভাড়াস্বরূপ এক মাসের জন্য পঁচাত্তর টাকা চাহিয়াছিল, উহারা পঁচিশ টাকা দিতে চাহে, কিন্তু মালী অত অল্প টাকায় ওই বাড়ী দিতে সম্মত না হওয়ায়, পরিশেষে পঞ্চাশ টাকা সাব্যস্ত করিয়া তখনই ওই অর্থ প্রদান পূর্ব্বক ওই বাড়ী গ্রহণ করে। যে অর্থে ওই বাড়ী পাইবার সম্ভাবনা ছিল, তাহার দ্বিগুণ অর্থ লাগিলেও উহারা মনে করিল, নিতান্ত সস্তায় উহারা ওই বাড়ী গ্রহণ করিতে সমর্থ হইয়াছে। 

এইরূপে ওই বাড়ী সংগ্রহ হইবার পর দিবস হইতেই দলের দুইজন ওই বাড়ীতে বাস করিতে আরম্ভ করিল। ওই দুইজনই পাঠকগণের পরিচিত সেই প্রথম ও দ্বিতীয় আগন্তুক। উহাদিগের নাম রামচরণ ও কালীচরণ। রামচরণই এই বাড়ী সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছিল। 

এই বাড়ী ভাড়া করিবার দুই দিবস পরেই কালীচরণ একটি সপ্তম বর্ষীয়া বালিকাকে আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত করিল। বালিকাটি গৌরাঙ্গী, দেখিতে বেশ সুশ্রী। উহার দুই হস্তে কয়েকগাছি সোণার চুড়ি ভিন্ন অঙ্গে আর কোন অলঙ্কার ছিল না। 

ওই গৃহের একটি ঘরে বালিকার থাকিবার স্থান হইল। সে কাঁদিয়া কাঁদিয়া পরিশেষে চুপ করিল ও ক্রমে ঘুমাইয়া পড়িল। উহার আহারের নিমিত্ত একটু দুগ্ধ সংগ্রহ করিয়া রাখা হইয়াছিল। ওই দুগ্ধ ওই বালিকাকে পান করিতে দেওয়ায় সে তাহা পান না করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিল। 

রামচরণ কালিচরণকে জিজ্ঞাসা করিল, কি উপায়ে ও কেমন করিয়া তুমি এই বালিকাটিকে আনিতে সমর্থ হইলে? উত্তরে কালিচরণ কহিল, কয়েকটি বালকবালিকা তাহাদিগের বাড়ীর সম্মুখে খেলা করিতেছিল, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। আমি কতকগুলি ফুলের খেলনা লইয়া সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হই, ও একটি খেলনা একটি বালিকাকে দিয়া একটু অগ্রসর হই। অবশিষ্ট সকলে খেলনা চাহিতে চাহিতে আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতে থাকে। আমিও বালকবালিকাগণকে এক একটি খেলনা প্রদান করিতে করিতে অগ্রসর হইতে থাকি। যাহারা খেলনা আদৌ পায় নাই, তাহারা আমার সঙ্গ ছাড়িল না। নিকটেই একখানি গাড়ি আমি পূৰ্ব্ব হইতেই ঠিক করিয়া রখিয়াছিলাম, তাহার মধ্যেও কিছু ফুলের খেলনা ছিল, আমি ক্রমে সেই গাড়ির নিকটে আসিয়া উহার মধ্যে উঠি। এবং ফুলের খেলনা সকল বাছিয়া বাছিয়া বালকাবালিকাগণের মধ্যে বিতরণ করি, কেবল এই বালিকাকে দিই নাই। সে আমার নিকট খেলনা চাহিলে আমি তাহাকে গাড়ির ভিতর উঠিয়া আসিতে কহি। আমার কথা শুনিয়া, সে যেমন খেলনা লইবার প্রত্যাশায় গাড়ির ভিতর উঠিয়া আসিল, অমনি পূর্ব্বের বন্দোবস্ত অনুযায়ী কোচম্যান গাড়ি হাঁকাইয়া দেয়। পাছে সে কাঁদিয়া রাস্তায় লোক জড় করে, এই ভয়ে আমি উহার মুখ বন্ধ দিয়া ঢাকিয়া রাখি। অপর বালক বালিকাগণ তাহাদিগের সাধ্যমত আমাদিগের গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়াছিল, কিন্তু দেখিতে দেখিতে গাড়ি তাহাদিগের চক্ষুর অন্তরাল হইয়া পড়ে। আমরাও ক্রমে এই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হই। 

রাম। বালিকাকে লইয়া এইরূপে পলাইবার সময় রাস্তার কোন ব্যক্তি কিছুই কি জানিতে পারে নাই, বা কাহারও মনে কি কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয় নাই? 

কালি। কেহ যে কোনরূপ কিছু জানিতে পারিয়াছে, তাহা আমার বোধ হয় না। তবে গাড়ির নম্বর যদি কেহ দেখিয়া লিখিয়া লইয়া থাকে, তাহা আমি বলিতে পারি না। 

রাম। গাড়ির নম্বর খুলিয়া রাখিলেই ত হইত? 

কালি। আমরা ইচ্ছা করিয়াই যাহাতে গাড়ির নম্বর সকলে দেখিতে পায় তাহার উপায় করিয়া রাখিয়াছিলাম। এই স্থানে বোধ হয় পাঠকগণকে বলিয়া দিতে হইবে না যে, ওই কোচম্যানও উহাদিগের দলভুক্ত এক ব্যক্তি। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

রায় বাহাদুর কিশোরীলাল বর্ম্মণ কলিকাতার বাসিন্দা নহেন, তিনি পল্লিগ্রামের একজন বড় জমীদার। দশজনের মধ্যে তিনি বিশেষ গণ্য মান্য লোক। গবর্ণমেন্টও তাঁহাকে বিশেষরূপ খাতির করেন বলিয়াই তাঁহাকে রায় বাহাদুর উপাধি প্রদান করিয়াছেন। 

তাঁহার পিতা পিতামহ প্রভৃতি চিরকাল পল্লিগ্রামে বাস করিয়া আপনাপন জীবন শেষ করিয়া গিয়াছেন, কিন্তু কলিকাতায় আসিয়া কখনও বাসস্থান স্থাপন করেন নাই। তাঁহারা দেশে থাকিয়া, দেশের উৎপন্ন দ্রব্যাদি ব্যবহার করিয়া, দেশের প্রতিবেশীদিগকে লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিয়া, প্রজাদিগের সুখ দুঃখের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া, দিন অতিবাহিত করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু আজ-কাল আর তাহা হয় না; সকলেরই ইচ্ছা, এখন কলিকাতায় আসিয়া বসবাস করেন। যাঁহারা চাকরী বা ব্যবসা উপলক্ষে কলিকাতায় আছেন, তাঁহাদের ত কথাই নাই, যাঁহারা চিরকাল মফঃস্বলে বড় বড় চাকরী করিয়া এখন পেনসন গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই কলিকাতায় বাস করিয়া জীবনের অবশিষ্ট অংশ অতিবাহিত করিতেছেন। যাঁহারা কোনরূপ কর্ম্ম কার্য্য করেন না, অথচ পিতা পিতামহের পরিত্যক্ত কিছু সম্পত্তি আছে, তাঁহারাও কলিকাতায় আসিয়া বাড়ী ভাড়া করিয়া বসিয়াছেন। মফঃস্বলের জমীদারদিগের ত কথাই নাই, তাঁহারা সকলেই প্রায় আজ-কাল কলিকাতার একরূপ অধিবাসী হইয়া পড়িয়াছেন। কেহ বা বাড়ী ভাড়া করিয়া আছেন, কেহ বা নূতন বাড়ী প্রস্তুত করিয়া লইয়াছেন। 

কেন তাঁহারা দেশ ছাড়িয়া কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতেছেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে কেহ বলিয়া থাকেন, দেশের ডাক্তার কবিরাজ নাই, কোন দ্রব্যাদি পাইবার উপায় নাই, কি সুখে তবে দেশে থাকা যায়? কেহ বলেন, ম্যালেরিয়ার জন্য দেশে বাস করিবার কি যো আছে? সুতরাং কলিকাতায় না থাকিয়া আর কোথায় যাওয়া যায়? এইরূপ নানা কারণে তাঁহারা দেশ ছাড়িয়া কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। 

রায় বাহাদুর কিশোরী লাল বর্ম্মণও ওইরূপ কোন কারণ বশতঃ কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। নিজে একখানি বাড়ী খরিদ করিয়াছেন, ওই বাড়ীতেই তিনি তাঁহার পুত্র কলত্রাদির সহিত বাস করিয়া থাকেন। বাড়ীতে তাঁহার পৌত্র, পৌত্রী, দৌহিত্রী প্রভৃতি ছোট ছোট বালকবালিকা অনেকগুলি। উহারা প্রায়ই একত্রিত হইয়া কখনও বাড়ীর ভিতর, কখনও বাড়ীর বাহিরে রাস্তার উপর খেলা করিয়া থাকে। একদিবস সন্ধ্যার সময় সকলগুলি বাড়ীর সম্মুখে-রাস্তার উপর খেলা করিতেছিল, সন্ধ্যার পর সকলেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, কেবল মালতী নাম্নী একটি সপ্তম বর্ষীয়া বালিকা তাহাদিগের সহিত ফিরিল না। মালতী কিশোরী লালের পৌত্রী। দেখিতে বেশ সুশ্রী, গৌরাঙ্গী, তাহার পরিধানে একখানি অর্দ্ধময়লা কালা পেড়ে সাড়ী, দুই হাতে বার গাছি সোণার চুড়ি। 

ক্রমে মালতীর খোঁজ পড়িল, বাড়ীর নানা স্থানে, বাড়ীর বাহিরে, প্রতিবেশীগণের গৃহে গৃহে তাহার অনুসন্ধান হইল, কিন্তু কোন স্থানে তাহাকে দেখিতে পাওয়া গেল না। অপর বালকবালিকাগণ যাহারা তাহার সহিত একত্রে খেলা করিতেছিল, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায়, তাহাদিগের মধ্যে যাহারা একটু বড়, তাহারা কহিল, সে ফুলের খেলনা লইবার নিমিত্ত একটি ভদ্রলোকের সঙ্গে গাড়ি করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহারা ফুলের খেলনা পাইয়াছে। উহাদিগের এই কথা কেহই সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিল না, কেবল এইমাত্র বুঝিতে পারিল যে কোন ব্যক্তি ফুলের খেলনা বালকবালিকাগণকে প্রদান করিয়াছেন ও সেই ফুলের খেলনার লোভ দেখাইয়া মালতীকেও ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছেন। মালতী রায় বাহাদুরের পৌত্রী, তিনি তাহাকে অতিশয় ভালবাসিয়া থাকেন। তিনি নিজেও তাহার লোকজনকে লইয়া সমস্ত রাত্রি মালতীর অনুসন্ধান করিলেন। স্থানীয় পুলিসে এই সংবাদ প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের সাহায্য গ্রহণ করিলেন। তাঁহাদিগের সাহায্যেও মালতীর বিশেষ রূপ অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া গেল না। সহর ও সহরতলীর সমস্ত থানায় সংবাদ লওয়া হইল, কোন থানাতেই মালতীকে পথভ্রান্ত অবস্থায় আনীত হয় নাই। 

এইরূপ অনুসন্ধান করিয়া যখন মালতীকে কোন স্থানেই পাওয়া গেল না, তখন রায় বাহাদুর ও মালতীর পিতা একেবারে অস্থির হইয়া পড়িলেন। মালতীর মাতা ও পিতামহী, অন্নজল পরিত্যাগ করিয়া রায় বাহাদুরের অন্দরমহল ক্রন্দনে বিদীর্ণ করিতে লাগিলেন। অপরাপর স্ত্রীলোকগণও নিতান্ত মর্মাহত হইয়া কোনরূপে চক্ষুজল সংবরণ করিয়া, গৃহকার্য্য করিতে লাগিলেন সত্য, কিন্তু কোনরূপেই মনকে প্রবোধ দিতে পারিলেন না। 

মালতী মালতীপুষ্পের ন্যায় অতি যত্নে প্রতিপালিতা হইয়া এত বড়টি হইয়াছে, পিতামাতাকে ছাড়িয়া কখনও কোন স্থানে সে রাত্রিবাস করে নাই, কষ্টের লেশ কাহাকে বলে, সে তাহা কখনও জানিতে পারে নাই। এখনও পর্যন্ত সে হাতে করিয়া আহার করিতে শিখে নাই। সে এখন এত বড়টি হইয়াছে, তথাপি তাহার মাতা নিজ হস্তে তাহাকে আহার করাইয়া থাকেন। এরূপ অবস্থায় মালতী যে কত কষ্টভোগ করিতেছে, তাহা ভাবিয়া তাহার পিতামাতা ক্ৰমে আরও অস্থির হইয়া পড়িলেন। 

মালতীকে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যে সকল লোক চারিদিকে প্রেরিত হইয়াছিল, ক্রমে ক্রমে সকলেই প্রত্যাবৰ্ত্তন করিল কিন্তু কেহই তাহার কোনরূপ সন্ধান আনিতে পারিল না। প্রত্যেক থানা হইতে সংবাদ পাওয়া গেল, মালতী সেখানে নাই। যখন কোন স্থানেই মালতীকে পাওয়া গেল না, তখন মালতীর শোকে রায় বাহাদুর একেবারে অস্থির হইয়া পড়িলেন, অনন্যোপায় হইয়া তিনি পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। 

সর্বপ্রধান কর্মচারীর সহিত পূর্ব্ব হইতেই রায় বাহাদুরের পরিচয় ছিল। তিনি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া মালতীর হঠাৎ নিরুদ্দেশের কথা তাঁহাকে কহিলেন। যেরূপে সে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইয়াছে, তাহার সঙ্গী অপর বালকবালিকাগণ, তাঁহাকে সেই অপরিচিত ব্যক্তি কর্তৃক স্কুলের খেলনা বিতরণ সম্বন্ধে যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহার সমস্তই কর্মচারীকে কহিলেন। সে যে একখানি ঠিকা গাড়িতে ফুলের খেলনা লইবার নিমিত্ত উঠিয়াছিল, তাহাও তিনি তাঁহাকে কহিলেন। যাহাতে উপযুক্ত কৰ্ম্মচারীর হস্তে মালতীর অনুসন্ধানের ভার অর্পিত হয় তাহার নিমিত্ত তাঁহাকে বিশেষরূপ অনুরোধ করিলেন। 

সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী রায় বাহাদুরের কথা শুনিয়া অতিশয় দুঃখ প্রকাশ করিলেন। যাহাতে মালতীকে পাওয়া যায় তাহার নিমিত্ত তিনি বিশেষরূপ মনোযোগী হইবেন। উপযুক্ত কোন ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীর হস্তে তিনি মালতীর অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিবেন, বলিয়া তিনি রায় বাহাদুরকে বিদায় দিলেন। যাইবার সময় তাঁহাকে বলিয়া দিলেন, তিনি যে কর্ম্মচারীকে এই কার্য্যে নিযুক্ত করিবেন তিনি রায় বাহাদুরের বাড়ীতে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। আরও বলিয়া দিলেন, তাঁহাকে যেন উপযুক্তরূপ সাহায্য প্রদান করা হয়। 

প্রধান কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া রায় বাহাদুর তাঁহাকে বার বার ধন্যবাদ প্রদান করিয়া আপন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

রায় বাহাদুরকে বিদায় দিয়া সৰ্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী সাহেব, সুপ্রসিদ্ধ ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী প্রসন্নকুমারকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। সংবাদ পাইবামাত্র তিনি আসিয়া সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। রায় বাহাদুর মালতীর হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া সম্বন্ধে তাঁহাকে যাহা যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই তিনি প্রসন্নকুমারকে কহিলেন ও যাহাতে মালতীকে পাওয়া যায় তাহার নিমিত্ত তাঁহাকে বিশেষরূপে চেষ্টা করিবার আদেশ করিলেন। রায় বাহাদুরের সহিত প্রথমে সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহার নিকট সমস্ত অবস্থা বিশেষরূপে অবগত হইয়া, কাৰ্য্যক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইবার আদেশ প্রদান করিলেন। 

সর্বপ্রধান কর্মচারীর আদেশপ্রাপ্ত হইয়া প্রসন্নকুমার, আর কালবিম্ব না করিয়া, সেই স্থান হইতেই একেবারে রায় বাহাদুরের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। অতি অল্পক্ষণ পূর্বেই রায় বাহাদুরও তাঁহার নিজ বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন। ডিটেকটিভ প্রসন্নকুমারের আগমন সংবাদ পাইয়া তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন ও এ পর্যন্ত যাহা কিছু অবগত হইতে পারিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলেন। প্রসন্নকুমার রায় বাহাদুরের সমস্ত কথা স্থির ভাবে শ্রবণ করিয়া কহিলেন “আপনি বালকবালিকাগণের নিকট হইতে যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছেন, তাহার সমস্তই আমাকে বলিলেন সত্য, তথাপি আমি উহাদিগকে একবার নিজে দেখিয়া, দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।” 

প্রসন্নকুমারের কথা শুনিয়া, রায় বাহাদুর সেই সকল বালক-বালিকাগণকে সেই স্থানে আসিবার নিমিত্ত একটি পরিচারককে পাঠাইয়া দিলেন। সে কিছুক্ষণ পরে উহাদিগের সকলকে লইয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রসন্নকুমার উহাদিগের সকলকে বিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন ও তাহাদিগকে দুই চারিটি বাজে কথা জিজ্ঞাসা করিয়া বুঝিয়া লইলেন, উহাদিগের মধ্যে কে অচতুর—কে চতুর, ও কে তাঁহার কথার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইবে। 

উহাদিগের মধ্যে একটি পঞ্চম বর্ষীয়া বালিকা ছিল, তাহাকেই চতুরা বলিয়া বোধ হইল। প্রসন্নকুমার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা সকলে কোথায় খেলা করিতেছিলে? 

বালিকা। আমাদিগের বাড়ীর সম্মুখে রাস্তার উপর। 

প্রসন্ন। কে তোমাদিগকে ফুলের খেলনা দিয়াছিল? 

বা। একটি লোক। 

প্র। সে খেলনা কোথায় পাইল? 

বা। তাহার হাতে ছিল। 

প্র। সে কাহাকে প্রথমে খেলনা দেয়? 

বা। তাহা আমার ঠিক মনে নাই? কিন্তু একে একে আমাদিগের সকলকেই সে খেলনা দিয়াছিল? 

প্র। তোমরা তাহার গাড়ির নিকট গিয়াছিলে? 

বা। গিয়াছিলাম। 

প্র। কে কে গিয়াছিলে? 

বা। আমরা সকলেই গিয়াছিলাম। 

প্র। মালতী? 

বা। সেও গিয়াছিল। তাহাকে সেই ব্যক্তি গাড়ির ভিতর হইতে খেলনা লইতে বলে। 

প্র। মালতী গাড়ির ভিতর গিয়াছিল? 

বা। সে গাড়ির ভিতর খেলনা লইবার নিমিত্ত গমন করে, কিন্তু আর নামিতে পারে না, গাড়ি চলিয়া যায়।

প্র। সে ব্যক্তি তখন কোথায় ছিল? 

বা। সে তখন গাড়ির ভিতর বসিয়াছিল। 

প্র। সে মালতীকে গাড়ি হইতে নামাইয়া দেয় নাই? 

বা। না। 

প্র। যখন গাড়ি চলিয়া গেল, তখন তোমরা কোথায় ছিলে? 

বা। আমরা সেই গাড়ির নিকটেই ছিলাম। 

প্র। গাড়ি চলিয়া পাইবার সময় যখন মালতী নামিতে পারিল না, তখন তোমরা কি করিলে? 

বা। আমরা গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ কিছুদূর গিয়াছিলাম, কিন্তু গাড়ি থামিল না, চলিয়া গেল; আমরাও ফিরিয়া আসিলাম। 

প্র। যেস্থানে গাড়ি দাঁড়াইয়া ছিল ও যেস্থানে মালতী গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, সেই স্থান তুমি আমাকে দেখাইয়া দিতে পারিবে? 

বা। পারিব, আপনি আমার সঙ্গে চলুন, আমি এখনই তাহা আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি। 

প্র। যে লোকটি তোমাদিগকে ফুলের খেলনা দিয়াছিল, তাহাকে দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে? 

বা। পারিব। 

প্র। সে লোকটি দেখিতে কেমন বলিতে পার? 

বা। দরোয়ানের মতন। 

প্র। তুমি এখন আমার সহিত আইস ও যে স্থানে সেই গাড়িখানি দাঁড়াইয়া ছিল, তাহা আমাকে দেখাইয়া দাও। প্রসন্নকুমারের কথা শুনিয়া বালিকা তাঁহার সহিত গমন করিল ও যেখানে মালতী গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, সেই স্থানটি তাঁহাকে দেখাইয়া দিল। 

যে স্থানে গাড়িখানিকে দাঁড় করাইয়া রাখা হইয়াছিল, সেই স্থানের রাস্তা খুব প্রশস্ত ছিল না, কোন গতিকে দুইখানি গাড়ি সেই স্থান দিয়া যাতায়াত করিতে পারে। উহার নিকটে কোনরূপ দোকানও ছিল না, ওই রাস্তার দুই পার্শ্বে কতকগুলি গৃহস্থের পাকা বাড়ী। 

প্রসন্নকুমার ওই স্থানের প্রত্যেক বাড়ীর কর্তাকে জিজ্ঞাসিলেন, ওই স্থানে একখানি গাড়ি দাঁড়াইয়া থাকিতে কেহ দেখিয়াছেন কি না, বা একখানি গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ কতকগুলি ছোট ছোট বালকবালিকাকে কেহ দৌড়াইয়া যাইতে দেখিয়াছেন কি না? কিন্তু কাহারও নিকট প্রথমত তিনি কিছুই সদুত্তর পাইলেন না। এইরূপে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে তিনি আরও একটু দূরে গমন করিলেন, সেই স্থানে একটি যুবকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল, তাঁহার নিকট হইতে প্রসন্নকুমার জানিতে পারিলেন যে, সেই দিবস সন্ধ্যার সময় তাঁহার একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ির প্রয়োজন হয়, তিনি গাড়ি আনিবার নিমিত্ত সদর রাস্তায় গমন করিতেছিলেন, এমন সময় দেখিতে পান, ওই গলির ভিতর একখানি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। ওই গাড়ি খালি আছে কি না, ও উহা ভাড়ায় যাইবে কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত তিনি ওই গাড়ির নিকট গমন করেন ও দেখিতে পান, উহার ভিতর কতকগুলি ফুলের খেলনা আছে। ভাড়ায় যাইবে কি না, জিজ্ঞাসা করায়, কোচম্যান কহে, তাহার গাড়িতে একটি বাবু আসিয়াছেন, তাঁহারই অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছি, অপর ভাড়া যাইবার উপায় নাই। 

প্রসন্নকুমার তাহাকে আরও দুই চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলেন, ওই গাড়িতে দুইটি লাল রঙ্গের ঘোড়া ছিল, তিনি ঠিক বলিতে না পারিলেও তাঁহার বোধ হয়, ওই গাড়ির নম্বর ৫০৪ বা ৪০৫ হইবে। 

যুবকের নিকট হইতে প্রসন্নকুমার যাহা অবগত হইলেন, তাহাতে তিনি বুঝিতে পারিলেন, বালক-বালিকাগণ যাহা বলিয়াছে, তাহা প্রকৃত। আরও মনে করিলেন, ওই নম্বর লইয়া অনুসন্ধান করিলে হয়ত তিনি ওই গাড়ির চালককে পাইলেও পাইতে পারিবেন। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া যথাসময়ে তিনি মিউনিসিপাল আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই স্থান হইতে ৫০৪ ও ৪০৫ উভয় নম্বরের গাড়ির অধিকারী ও তাহাদিগের ঠিকানা জানিয়া লইয়া তাহাদিগের অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। একটু বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিবার পরই উভয় গাড়ির অধিকারীকে প্রাপ্ত হইলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানিতে পারিলেন ৫০৪ নম্বরের গাড়ি দুইটি লাল ঘোড়ার দ্বারা চালান হইয়া থাকে। সেই সময় ওই গাড়ির চালক সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না, গাড়ি লইয়া ভাড়া খাটাইবার নিমিত্ত সে বাহিরে গিয়াছিল। কখন যে সে প্রত্যাগমন করিবে, তাহার নিশ্চয়তা নাই। সুতরাং প্রসন্নকুমার মনে মনে ভাবিলেন, এখন অপর গাড়িখানির সন্ধান করা যাক, আবশ্যক হয় পুনরায় আসিয়া ওই গাড়োয়ানের সহিত সাক্ষাৎ করিবে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া প্রসন্ন কুমার যেমন সেই স্থান হইতে বাহির হইবেন, অমনি দেখিতে পাইলেন, ৫০৪ নম্বরের গাড়ি ফিরিয়া আসিতেছে। সুতরাং তখন অপর গাড়ির অনুসন্ধানে তাঁহাকে আর যাইতে হইল না। 

কোচম্যান আস্তাবলে গাড়ি আনিয়া গাড়ি হইতে ঘোড়া দুইটি খুলিয়া দিল। সহিস ঘোড়া লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

পাঠকগণ ইহার পূর্ব্ব হইতেই অবগত আছেন যে, যে গাড়ি করিয়া মালতীকে স্থানান্তরে লইয়া যাওয়া হইয়াছিল, সেই গাড়ির কোচম্যানও একজন বদমায়েস ও সেই ষড়যন্ত্রকারিগণের মধ্যে একজন। 

প্রসন্নকুমার এই গাড়োয়ানকে চিনিতেন না, গাড়োয়ান কিন্তু প্রসন্নকুমারকে উত্তমরূপে চিনিত। চালক প্রসন্নকুমারকে দেখিয়া এরূপ কোন ভাব প্রকাশ করিল না, যাহাতে বুঝিতে পারা যায় যে, সে প্রসন্নকুমারকে চিনে। 

প্রসন্নকুমার ওই আস্তাবলের ভিতর একখানি দড়ীর খাটিয়ার উপর সেই সময় বসিয়া ছিলেন। আস্তাবলের অধিকারী অনুগ্রহ করিয়া তাঁহার বসিবার নিমিত্ত ওই খাটিয়াখানি আনিয়া দিয়াছিলেন। 

প্রসন্নকুমার সেই কোচম্যানকে তাঁহার সন্নিকটে ডাকিলেন। কোচম্যান বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। প্রসন্নকুমার তাহার দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন “আমি তোমাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি, তুমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিবে কি?” 

কোচম্যান। কেন করিব না? আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি যতদূর অবগত আছি, তাহা আপনাকে বলিব। 

প্রসন্ন। তোমার মনে হয় কি, আজ তিন চারি দিবস হইল, একটি লোক তোমার গাড়ি ভাড়া করিয়া কতকগুলি ফুলের খেলনা লইয়া কোন একটি গলির ভিতর কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে? পরিশেষে একটি বালিকাকে সেই গাড়িতে লইয়া সে কোথায় চলিয়া যায়। 

কোচম্যান। হাঁ, মনে হয়। 

প্র। সে তোমার পরিচিত? 

কো। না। 

প্র। সে কোথায় থাকে বলিতে পার? 

কো। না, তাহা জানি না। 

প্র। সে তোমার গাড়ি কোথা হইতে ভাড়া করিয়াছিল? 

কো। আমি বড় রাস্তায় গাড়ির আড্ডায় ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলাম, সেই স্থান হইতে সে আমার গাড়ি ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া করিয়া লয়। 

প্র। তাহার সহিত আর কেহ ছিল? 

কো। না। 

প্র। সে ফুলের খেলনা কোথায় পাইল? 

কো। গাড়ি ভাড়া করিবার পূর্ব্বে সে উহা কোথা হইতে লইয়া আসিয়াছিল? 

প্রসন্নকুমারের এতগুলি প্রশ্নের উত্তরে কোচম্যান যাহা যাহা কহিল, তাহা একটিও প্রকৃত কথা নহে, সমস্তই মিথ্যা। কারণ কোচম্যান তাঁহাকে উত্তমরূপ চিনিতে। 

প্র। তোমার গাড়িতে করিয়া সে একটি বালিকাকে লইয়া গিয়াছিল? 

কো। গিয়াছিল। 

প্র। কোথায় লইয়া গিয়াছিল? 

কো। একটি বাড়ীতে। 

প্র। সে বাড়ীটা কোথায়? 

কো। সেই স্থানের নাম আমি জানি না। 

প্র। আমাকে সেই বাড়ীটি দেখাইয়া দিতে পার? 

কো। পারি। 

প্র। সে পাকা বাড়ী না খোলার বাড়ী? 

কো। পাকা বাড়ী। 

প্র। কি প্রকার স্থানে ওই বাড়ীটি স্থাপিত? 

কো। একটি বাগানের ভিতর। 

প্র। ওই বাগানের ভিতর গাড়ি যায়? 

কো। যায়। 

প্র। বালিকাটিকে কি তুমি ওই বাড়ীতেই রাখিয়া আইস? 

কো। হাঁ। 

প্র। আর ওই ব্যক্তি? 

কো। সেও ওই বাড়ীতে থাকে? 

প্র। তোমার গাড়িতে করিয়া কোন ব্যক্তি সেই স্থান হইতে আসে নাই? 

কো। না, আমি খালি গাড়ি লইয়া সেই স্থান হইতে ফিরিয়া আসি। 

প্র। তুমি সেই স্থানে গাড়ি হইতে নামিয়াছিলে? 

কো। আজ্ঞে হ্যাঁ। 

প্র। তুমি গাড়ি ছাড়িয়া কেন নামিলে? 

কো। গাড়িতে যে ফুলের খেলনা ছিল, তাহাই দিবার নিমিত্ত গাড়ি হইতে নামিয়াছিলাম। 

প্র। কোন্ সাথে তুমি ওই সকল খেলনা রাখিয়া আসিয়াছিলে? 

কো। যে ঘরে ওই ব্যক্তি ওই বালিকাকে লইয়া গিয়াছিল, সেই ঘরে আমি ওই খেলনা রাখিয়া আসিয়াছিলাম। 

প্র। ওই বাড়ী ও ওই ঘরটি আমাকে দেখাইয়া দিতে পারিবে? 

কো। কেন পারিব না, যাহা একবার দেখিয়াছি, তাহা কি আর কখন ভুলি? 

এবার কোচম্যান যে কয়েকটি উত্তর প্রদান করিল, তাহার একটিও মিথ্যা নহে। কিন্তু ইহার পর প্রসন্নকুমার তাহাকে 

আর যে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, সে তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিল না। 

প্র। ওই বাড়ীতে আর কাহাকেও দেখিয়াছিলে? 

কো। না–আর কাহাকেও আমি ওই বাড়ীতে দেখি নাই। 

প্র। বালিকাটিকে যখন গাড়ি করিয়া আনা হইয়াছিল, বা যখন তাহাকে ওই ঘরের ভিতর লইয়া যাওয়া হয়, তখন সে বোধ হয় খুব কাঁদিয়াছিল? 

কো। না, তাহাকে কাঁদিতে ত দেখি নাই! 

প্র। যে লোকটি তোমার গাড়ি ভাড়া করিয়া বালিকাটিকে লইয়া আসে, তাহাকে দেখিয়া কোন্ দেশীয় লোক বলিয়া বিবেচনা হয়? 

কো। সে বাঙ্গালী বাবু, ভদ্রলোক বলিয়া বোধ হয়। 

প্র। সে বালিকা সম্বন্ধে তোমকে কি কিছু বলিয়াছিল? 

কো। সে কহে ওই বলিকাটি তাহার কন্যা। 

কোচম্যানের সহিত এই সকল কথাবার্তার পর প্রসন্নকুমার তাহাকে সেই বাড়ীটি দেখাইয়া দিতে কহিলেন। কোচম্যান তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

প্রসন্নকুমার একজন অতিশয় সাহসী পুরুষ, তিনি কখনও কোনরূপ বিপদকে ভয় করিতেন না, যে স্থানে একাকী গমন করিলে তাঁহাকে বিপদে পতিত হইতে হইবে বুঝিতে পারিতেন, অথচ উপস্থিত মত সেই সময়ে কাহারও কোনরূপ সাহায্য গ্রহণ করিবার সুযোগ বা সময় পাইতেন না, সেই স্থান যাইতে তিনি কখনও পশ্চাৎপদ হইতেন না। এইরূপে অনেকবার তিনি অনেক স্থানে গমন করিয়া অনেক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন ও অনেকবার বিশেষরূপ বিপদগ্রস্তও হইয়াছেন, আবার নিজের বুদ্ধিবলে ও সময় সময় অপরের সাহায্যে তিনি সেই বিপদ হইতে মুক্তিলাভও করিয়াছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত তাঁহার সেই স্বভাবের কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই। 

তিনি যে সময় আস্তাবলে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত গমন করিয়াছিলেন, সেই সময় তাঁহার সহিত আর কেহই ছিল না, তিনি একাকীই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। কোচম্যান যখন তাঁহাকে সেই বালিকা সম্বন্ধে সংবাদ প্রদান করিল, তখনও তিনি একাকী। সেই অবস্থায় সেই কোচম্যানের সঙ্গে, সে যে স্থানে বা বালিকাকে লইয়া গিয়াছিল, সেই স্থানে একাকী গমন করিতে সম্মত হইলেন। 

কোচম্যান কি চরিত্রের লোক তাহা তিনি জানিতেন না, কোচম্যান কি অভিপ্রায়ে তাঁহার সহিত তখনই গমন করিতে সম্মত হইল, তাহাও তিনি একটু বিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া দেখিলেন না। বালিকাকে যাহারা অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহাদিগের মনে যে নিশ্চয়ই কোনরূপ কু-অভিসন্ধি আছে, – সেই স্থানে, সেই সময়, সেই অবস্থায় একাকী গমন করা কর্তব্য কি না, তাহাও একবার না ভাবিয়া তিনি সেই কোচম্যানকে সঙ্গে লইয়া তখনই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। অনেক দূর গমন করিতে হইবে জানিয়াও, তিনি সেই আস্তাবল হইতে কোন গাড়ি ভাড়া করিয়া লইবার চেষ্টা করিলেন না, কোচম্যানকে সঙ্গে লইয়া সেই আস্তাবল হইতে বহির্গত হইলেন। কিছুদূর গমন করিবার পর রাস্তা হইতে একখানি গাড়ি ভাড়া করিলেন। ওই গাড়োয়ান প্রসন্নকুমারকে চিনিত। উভয়েই ওই গাড়িতে আরোহণ করিয়া গন্তব্য স্থানাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। 

প্রসন্নকুমার আস্তাবল হইতে গাড়ি ভাড়া না করিয়া, রাস্তা হইতে যে কেন গাড়ি ভাড়া করিলেন; তাহার কারণ প্রসন্নকুমারই জানেন। আমরা কেবল এইমাত্র অনুমান করিতে পারি যে, হয়ত সেই আস্তাবলের কোচম্যানগণকে তিনি কোনরূপে বিশ্বাস করিতে সাহস করেন নাই, নতুবা তিনি ভাবিয়াছিলেন, তাহার পরিচিত কোন গাড়োয়ানের গাড়ি ব্যতীত অপর কোন গাড়িতে তিনি আরোহণ করিয়া ওই কার্য্যে গমন করিবেন না। 

অনেক কোচম্যান প্রসন্নকুমারের পরিচিত ছিল, প্রসন্নকুমার তাহাদিগের কাহাকেও ডাকিলে, অপর লাভজনক ভাড়া পরিত্যাগ করিয়া, প্রসন্নকুমারের নিকট ছুটিয়া আসিত। 

কলিকাতা সহরের কোচম্যান মাত্রই ভাল লোক নহে, উহারা সুযোগ পাইলে চূড়ান্ত বাদমাইসি করিতে ত্রুটি করে না, ইহা পাঠকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই অবগত আছেন। প্রসন্নকুমারও উহাদিগকে উত্তমরূপে চিনেন। তবে তাঁহার পরিচিত কোচম্যানগণ তাঁহার ওরূপ বশীভূত কেন? প্রসন্নকুমার যখন যে গাড়িতে যে অনুসন্ধানে গমন করেন, তাহার কাৰ্য্য সম্পন্ন হইলে, বা কোচম্যান কর্তৃক বিশেষরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হইলে তিনি দুই টাকা ভাড়ার স্থলে পাঁচ টাকা প্রদান করিয়া থাকেন। সময় সময় আরও অধিক পরিমাণে বক্‌সিস্ দিয়া থাকেন বলিয়াই কোচম্যানগণ তাঁহার ভাড়া পাইলে অপর কাহারও নিকট গমন করে না। 

গাড়ি ক্রমে কাঁকুড়গাছিতে গিয়া উপস্থিত হইল। যে বাগানের উদ্দেশে তিনি গমন করিতেছিলেন, গাড়ি গিয়া সেই বাগানের সম্মুখে উপস্থিত হইল। যে কোচম্যান তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে লইয়া গিয়াছিল, সে গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া প্রসন্নকুমারকে সঙ্গে লইয়া সেই জঙ্গলময় বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। যে গাড়িতে তাঁহারা সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই গাড়ির কোচম্যান তাহার গাড়ি লইয়া সেই স্থানে অপেক্ষা করিতে লাগিল। যে গাড়ি করিয়া মালতীকে অপহরণ করিয়া আনা হইয়াছিল, সেই গাড়ির কোচম্যান প্রসন্নকুমারকে সঙ্গে লইয়া জঙ্গলময় ও অপরিষ্কার বাগানের মধ্য দিয়া কিছুক্ষণ গমন করিয়া সেই গৃহের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। প্রসন্নকুমার ওই গৃহের চারিদিক একবার উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিলেন, কিন্তু অপর কোন ব্যক্তি তাঁহার নয়নগোচর হইল না। কোচম্যান প্রসন্নকুমারকে সঙ্গে লইয়া দুই তিনটি প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিয়া একটি প্রকোষ্ঠের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল ও ওই প্রকোষ্ঠটি দেখাইয়া দিয়া কহিল, ইহার মধ্যে বালিকাটিকে রাখা হইয়াছিল। 

কোচম্যানের কথা শুনিয়া প্রসন্নকুমার ওই ঘরটির অবস্থা একবার বাহির হইতে উত্তমরূপে দেখিলেন, সম্মুখ হইতে ওই ঘরে প্রবেশ করিবার কেবল একটিমাত্র দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা প্রভৃতি আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না। ওই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিবার যে দরজাটি দেখিতে পাইলেন, তাহার কপাট খুব দৃঢ় ও মোটা কাষ্ঠে নির্ম্মিত, এরূপ কপাট প্রায় সচরাচর কোন গৃহে বা বাগানবাড়ীতে দেখিতে পাওয়া যায় না। চোর ডাকাইতের হস্ত হইতে ধন বা বহুমূল্য দ্রব্যাদি রক্ষা করিবার মানসে পূর্ব্বে কেহ কেহ আপন বাসস্থানে এইরূপ দুই একটি প্রকোষ্ঠ প্রস্তুত করিয়া রাখিতেন। দস্যুগণ মনে করিলে ওই দরজা ভাঙ্গিয়া উহার মধ্যে সহজে প্রবেশ করিতে পারিত না। ওই দরজার বাহিরে আর একটা লৌহনির্ম্মিত দরজা ছিল। ওই ঘর বন্ধ করিতে হইলে প্রথমত কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত দরজা বন্ধ করিতে হইত, তাহার পর ওই লৌহনির্ম্মিত দরজা বন্ধ করা হইত। প্রসন্নকুমার যখন সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, সেই সময় ওই ঘরের লৌহ নির্ম্মিত দরজা খোলা ছিল, কাষ্ঠনির্ম্মিত দরজাতেও কোনরূপ তালা আবদ্ধ ছিল না, কেবল ভেজান ছিল মাত্র। 

কোচম্যান প্রসন্নকুমারকে ওই প্রকোষ্ঠটি দেখাইয়া দিলে তিনি সজোরে ওই কাষ্ঠের দরজাটি ঠেলিলেন, দরজা খুলিয়া গেল। সেই সঙ্গে অল্পবয়স্ক বালিকার করুণ অথচ ভগ্ন কণ্ঠস্বর তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল। প্রসন্নকুমার আর কোন দিকে লক্ষ্য না করিয়া বা তাঁহার সঙ্গী কোচম্যানকেও কোন কথা না বলিয়া একেবারে সেই প্রকোষ্ঠের ভিতর প্রবেশ করিলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে ওই কাষ্ঠনির্ম্মিত দরজা বাহির হইতে বন্ধ হইয়া গেল। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

প্রসন্নকুমার যখন বাহিরে ছিলেন, সেই সময় তাঁহার সঙ্গী কোচম্যানকে ভিন্ন আর অপর কোন ব্যক্তিকে তিনি সেই স্থানে দেখিতে পান নাই। কিন্তু দরজা বন্ধ করিবার সময় দুই তিনজনকে দেখিতে পাইলেন। তিনি বিশেষরূপ বিপদগ্রস্ত বুঝিতে পারিয়া, যাহাতে, ওই দরজা বাহির হইতে বন্ধ করিতে না পারে, এই আশায়, তিনি ভিতর হইতে জোর করিয়া টানিয়া ধরিলেন, কিন্তু যাহারা বাহির হইতে দরজা বন্ধ করিতেছিল, তাহাদিগকে পরাঙ্মুখ করিতে পারিলেন না, বা কোন গতিকে বাহিরে আসিতেও পারিলেন না। দরজা বাহির হইতে বন্ধ হইয়া গেল, তিনি সেই প্রকোষ্ঠের মধ্যে বন্দী হইলেন। কে যে তাঁহাকে বন্দী করিল, ও কেনই বা তিনি সেই স্থানে বন্দী হইলেন তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। যে কোচম্যান তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে আনিয়াছিল, সেও এই কার্য্যে মিলিত আছে কি না, তাহাও ভাবিয়া তিনি কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। বালিকার সকরুণ ভগ্ন কণ্ঠস্বর তখনও পর্যন্ত তাঁহার কর্ণ গোচর হইতে লাগিল। 

ওই ঘরের দরজা বন্ধ হইয়া গেলে, উহার ভিতর এরূপ অন্ধকার হইল যে, তিনি নিজে নিজেকে পর্য্যন্ত আর দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার পকেটে দেশালাই ছিল, তিনি তাহার দুই চারিটি কাটী জ্বালাইয়া ওই ঘরের অবস্থা একবার দেখিয়া লইলেন। দেখিলেন, ওই ঘরটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১০ ফিট করিয়া হইবে। যে দরজা দিয়া তিনি ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছেন, উহা ব্যতীত ওই ঘরের অপর কোন জানালা বা দরজা নাই, গুদাম ঘরের ন্যায় একেবারে গাঁথিয়া তোলা ও ভিতরকার দেওয়ালে অনেক দিবসের চুণ বালি ধরাইয়া পলস্তারা করা হইলেও, এখনও পর্যন্ত উহার কোন স্থান কোনরূপ নষ্ট হয় নাই। মেজে হইতে প্রায় ১২ ফুট উপরে দুইটি দেওয়ালে দুইটি করিয়া গোল ফোকর আছে, উহার পরিধি ৮ ইঞ্চির অধিক নহে। উহার মধ্য দিয়া একখানি হস্ত ও উত্তমরূপে প্রবিষ্ট করান যায় না। ওই ঘরের মধ্যে দ্রব্যাদি কিছুই নাই, মেজের অবস্থা দেখিয়া বোধ হয়, উহা ঝাঁট দিয়া সম্প্রতি পরিষ্কার করিয়া রাখা হইয়াছে। ঘরের অবস্থা দেখিয়া প্রসন্নকুমার অতিশয় চিন্তিত হইলেন। যিনি কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়া কখন ভীত হন নাই, আজ তাঁহার নিজের অবস্থা দেখিয়া তাঁহার মনে বিশেষরূপ ভয়ের সঞ্চার হইল। তিনি মনে মনে ভাবিলেন, যদি অপর কেহ এই ঘর হইতে তাঁহাকে বাহির না করে, তাহা হইলে তিনি নিজে কোনরূপেই এই ঘর হইতে বাহির হইতে পারিবেন না, এই ঘরের মধ্যেই তাঁহার ইহজীবনের কার্য শেষ হইবে। তাঁহার কোন বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রীপুত্র বা যে কর্মচারিগণের আজ্ঞা তিনি সর্ব্বদা প্রতিপালন করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের কাহারও সহিত আর তাঁহার সাক্ষাৎ হইবে না, ও কেহই জানিতে পারিবে না, যে তিনি কি অবস্থায় ও কোথায় তাঁহার জীবনের অবশিষ্ট কয়েক দিবস শেষ করিলেন। তাঁহার মনে এইরূপ ও অন্যান্য চিন্তা উদয় হওয়ায়, তাঁহার চক্ষু দিয়া জল আসিল, তিনি সেই অন্ধকার গৃহের মধ্যে নিজ উত্তরীয় বস্ত্র দ্বারা আপন চক্ষুজল মোচন করিতে লাগিলেন। 

বালিকার ভগ্নকণ্ঠ নিঃসৃত কোমল স্বর তখন পর্যন্ত প্রসন্নকুমারের কর্ণ গোচর হইতে ছিল। তিনি বুঝিলেন, যাহার নিমিত্ত তিনি এই মহাবিপদে পতিত হইয়াছেন, তাঁহার ন্যায় সেই বালিকাও বিপদগ্রস্ত হইয়া তাঁহার ঘরের পার্শ্ববর্তী কোন ঘরে আবদ্ধ আছে ও তাহার রোদনধ্বনি তাহার ঘরের সেই ক্ষুদ্র গহ্বর দিয়া, আগমন কবিয়া তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিতেছে। এ বালিকা যে তাঁহার পার্শ্বের ঘরে আবদ্ধ আছে, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু কে তাহাকে সেই স্থানে আনিয়া আবদ্ধ করিল ও ওই বালিকার উপর এরূপ অত্যাচার করিবার কারণই বা কি, তাহার কিছুমাত্র তিনি ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলেন না। যাহাকে উদ্ধার করিতে আসিয়া তিনি এইরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন, তাহাকে উদ্ধার করা দূরে থাকুক, কিরূপে নিজে এই বিপদ হইতে উদ্ধার হইতে পারিবেন, তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলেন; কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অনন্যোপায় হইয়া মনের দুঃখে সেই অন্ধকার ঘরের মেজের উপর তিনি বসিয়া পড়িলেন। 

কিয়ৎক্ষণ স্থিরভাবে সেই ঘরের মেজের উপর বসিয়া তিনি মনে মনে কেবল ঈশ্বরকে ডাকিতে লাগিলেন। তিনি যেরূপ বিপদগ্রস্ত, তাহাতে ঈশ্বর যদি তাঁহাকে উদ্ধার করেন, তবেই তিনি উদ্ধার হইতে পারিবেন, নতুবা এ বিপদ হইতে উদ্ধার হইবার তাঁহার আর কোনরূপ আশা নাই। এইরূপ কতক্ষণ তিনি সেই স্থানে বসিয়া অতিবাহিত করিলেন, পরিশেষে একবার তিনি গাত্রোত্থান করিলেন, দেশলাই জ্বালিয়া ওই ঘরটি আর একবার দেখিলেন। পুনরায় দরজার নিকট আসিয়া উহা ভিতর হইতে জোরে টানিয়া দেখিলেন, কিন্তু উহা নড়াইতেও পারিলেন না। ঘরের দেওয়ালে কোন স্থান যদি কোনরূপে ভাঙ্গিবার উপায় করিতে পারেন, তাহারও চেষ্টা দেখিলেন; কিন্তু কোন স্থানে তাহারও কোনরূপ সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিলেন না। তখন অনন্যোপায় হইয়া পুনরায় সেই ঘরের মেজের উপর গিয়া উপবেশন করিলেন। বসিয়া বসিয়া তিনি নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। তিনি পরিণাম ভাবিয়া ক্রমে হতাশ হইয়া পড়িলেন ও জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়া, নিজের উত্তরীয় বস্ত্র সেই ঘরের মেজের উপর বিছাইয়া তাহার উপর শুইয়া পড়িলেন। শুইয়া শুইয়া কত কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। নিজের চিন্তা, নিজের পুত্রের চিন্তা, বন্ধু-বান্ধবের চিন্তা, নিজের জীবনের চিন্তা প্রভৃতি কত চিন্তা আসিয়া তাঁহার মনে উদয় হইতে লাগিল। কতবার তাঁহার চক্ষু বহিয়া অশ্রুজল পড়িতে লাগিল, কতবার তিনি ঈশ্বরকে ডাকিতে লাগিলেন। এইরূপে যে কত সময় অতিবাহিত হইয়া গেল, তাহা তিনি জানিতে পারিলেন, না, বুঝিতে পারিলেন না যে, তিনি এইরূপে দিন যাপন করিতেছেন, কি রাত্রি অতিবাহিত করতেছেন। বালিকাটির কণ্ঠস্বর কখনও বা তাঁহার কর্ণ গোচর হইতে লাগিল, কখন বা তাহার স্বর একেবারেই শুনিতে পাইলেন না। এইরূপে সময় অতিবাহিত হইতে হইতে সর্ব্বদুঃখ ও সর্ব্বকষ্ট নিবারিণী নিদ্রাদেবী আসিয়া তাঁহাকে আশ্রয় প্রদান করিলেন। তিনি সেই ঘরের মেজের উপর নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। কতক্ষণ যে তিনি ওই ভাবে ওই স্থানে নিদ্রিত ছিলেন, তাহা বলিতে পারেন না। যেদিন তিনি ওই ঘরে আবদ্ধ হইয়াছিলেন, এখনও সেই দিন চলিতেছে কি দুই চারি দিবস ও রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে, তাহাও তিনি বুঝিতে পারিলেন না। এখন তিনি অতিশয় ক্ষুধিত হইয়া পড়িয়াছেন, ক্ষুধা অপেক্ষা তৃষ্ণা আরও প্রবল, কিন্তু উহা নিবারণের কোনরূপ উপায় নাই। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া সেই স্থানেই তিনি পড়িয়া রহিলেন; কখন চেতনা অবস্থায় কখনও বা নিদ্রিত অবস্থায় সময় অতিবাহিত হইতে লাগিল। 

প্রসন্নকুমার যাহার গাড়ি ভাড়া করিয়া ওই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, প্রসন্নকুমার গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া যাইবার পর সেই গাড়ির কোচম্যান প্রায় তিন চারি ঘণ্টা তাহার গাড়ি সেই স্থানে দাঁড় করাইয়া রাখে। পরে সে যখন দেখিল যে, প্রসন্নকুমার বা তাঁহার সঙ্গী লোকটি কেহই প্রত্যাগমন করিলেন না, তখন বাধ্য হইয়া সেই কোচম্যান তাহার গাড়ি সেই স্থানে পরিত্যাগ পূর্ব্বক বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই জঙ্গলময় বাগান অতিক্রম করিয়া ক্রমে সেই গৃহের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, সেই গৃহের কছুদূর অন্তরে একটি পুষ্করিণীর ঘাটের উপর দুইটি লোক উপবেশন করিয়া কি কথাবার্তা কহিতেছে। কোচম্যান প্রসন্নকুমার বা তাঁহার সমভিব্যাহারী ব্যক্তিকে সেই স্থানে দেখিতে না পাইয়া, উহাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল, ও উহাদিগকে প্রসন্নকুমার ও তাঁহার সঙ্গীর কথা জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে উহাদিগের মধ্যে এক ব্যক্তি কহিল, প্রায় তিন চারি ঘণ্টা হইল, যখন তাহারা এই বাগানের অপর প্রান্ত দিয়া ইহার ভিতর প্রবেশ করিতেছিল, তখন তাহারা একটি বাবু ও অপর এক ব্যক্তিকে সেইদিক দিয়া এই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া যাইতে দেখিয়াছে। তাহারা যে কে কোথায় গিয়াছে, তাহা তাহারা বলিতে পারে না। 

উহাদগের কথা শুনিয়া কোচম্যান বুঝিতে পারিল, কার্য্যগতিকে তাঁহারা এই বাগান হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছেন, তাহাকে বলিয়া যাইবার সময় পান নাই। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সে আপন গাড়িতে প্রত্যাগমন করিল, ও আরও দুই ঘণ্টা কাল সেই স্থানে অপেক্ষা করিয়া নিতান্ত ক্ষুণ্নমনে সে আপন গাড়ি লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। 

নবম পরিচ্ছেদ 

যে সময় প্রসন্নকুমার সেই কোচম্যানের সহিত মালতীর অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত সেই বাগানের ভিতর প্রবেশ করেন, সেই সময় সেই দস্যু সর্দ্দার গঙ্গারাম তাহার দুইজন প্রিয় অনুচর রামচরণ ও কালিচরণের সহিত সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, কিন্তু তাহারা এরূপ স্থানে ছিল যে, প্রসন্নকুমার তাহাদিগকে সেই সময় দেখিতে পান নাই। তাহাদিগের দলের অপর দস্যু সেই কোচম্যান যখন প্রসন্নকুমারকে লইয়া গিয়া ওই ঘর দেখাইয়া দেয়, ও বালিকার ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া যখন প্রসন্নকুমার সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করেন, সেই সময় উহারা দ্রুতগতি আসিয়া ওই কোচম্যানের সাহায্যে ওই ঘরের দরজা বাহির হইতে বন্ধ করিয়া দেয় ও উহাতে একটি মজবুত তালা বন্ধ করিয়া, পরিশেষে লৌহকপাট বন্ধ করিয়া দিয়া তাহাতেও একটি তালা দেয়। এইরূপে প্রসন্নকুমারকে আবদ্ধ করিয়া সেই কোচম্যান বাগানের অপর প্রান্ত দিয়া বাহির হইয়া যায়। দস্যু সর্দার গঙ্গারাম তাহার অনুচর রামচরণ ও কালিচরণের সহিত সেই স্থানে অপেক্ষা করিতে থাকে। 

ইতিপূৰ্ব্বে দস্যুগণ একস্থানে সম্মিলিত হইয়া প্রসন্নকুমারের সর্ব্বনাশ সাধন করিবার নিমিত্ত যে মন্ত্রণা করিতেছিল, তাহা এখন সার্থক হইল। প্রসন্নকুমারকে আবদ্ধ করিবার নিমিত্ত তাহারা যে জাল পাতিয়াছিল, প্রসন্নকুমার ঘুরিয়া ফিরিয়া আপনা হইতেই সেই জালে আসিয়া আবদ্ধ হইল। এখন দস্যুগণের মনস্কামনা পূর্ণ হইল। তাহাদিগের সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, যেরূপ অবস্থায় ও যে স্থানে তাহারা প্রসন্নকুমারকে আবদ্ধ করিতে সমর্থ হইয়াছে, সেই স্থান হইতে প্রসন্নকুমারকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা কাহারও পক্ষে নিতান্ত সহজ হইবে না। আর যদি অনুসন্ধন করিয়া কেহ বাহির করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলেও সে সময়সাপেক্ষ, ততদিবস অনশনে ওই ঘরের ভিতরই প্রসন্নকুমারের জীবনলীলা শেষ হইবে। 

দস্যুগণের মন্ত্রণার ফল পাঠকগণ স্বচক্ষে দর্শন করিলেন সত্য, কিন্তু উহারা যে কি মন্ত্রণা করিয়াছিল, তাহা কি আপনারা ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিয়াছেন? যদি না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে তাহার একটু আভাস এই স্থানে প্রদান করিতেছি। 

দস্যুদিগের মন্ত্রণায় পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হয় যে, কোন গতিকে প্রসন্নকুমারকে ইহজগৎ হইতে অন্তর্হিত করিতে না পারিলে কিছুতেই সুচারুরূপে তাহারা তাহাদিগের কার্য নির্ব্বাহ করিতে পারিবে না। আরও স্থিরীকৃত হয় যে, এরূপ কোন একটি অপরাধ করা আবশ্যক যে, সেই অপরাধের অনুসন্ধানের জন্য প্রসন্নকুমার নিয়োজিত হন এবং ওই অনুসন্ধানের সময় যখন তিনি জানিতে পারিবেন, কোথায় গমন করিলে তিনি তাহার অনুসন্ধানে কৃতকার্য হইতে পারিবেন, তখন সেই সময় তাঁহাকে সেই স্থানে গমন করিতেই হইবে। সেই স্থানে যদি তিনি একাকী গমন করেন, তাহা হইলে সেই স্থানেই দস্যুগণ তাহাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া লইবে। 

দস্যুদিগের মধ্যে এইরূপ মোটামুটি মন্ত্রণা স্থির হইলে, দলপতি এইরূপ স্থির করে যে, কোন নিভৃত স্থানে একটি নিভৃত বাড়ী স্থির করিতে হইবে। তাহাদিগের অভিলষিত বাড়ী প্রাপ্ত হইলে, তাহাদিগের মধ্যে কেহ কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া এই কলিকাতা সহরের কোন বিশেষ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির একটি বালক বা বালিকাকে কোনরূপে অপহরণ করিয়া সেই নিভৃত স্থানে লুকাইয়া রাখিবে। বড় লোকের বালক বা বালিকা চুরি হইলে নিশ্চয়ই হুলুস্থুল পড়িয়া যাইবে। চারিদিকে অনুসন্ধান আরম্ভ হইবে। পরিশেষে কোন ডিটেকটিভ কৰ্ম্মচারী নিশ্চয়ই এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবেন। যদি প্রসন্নকুমারের হস্তে এই অনুসন্ধানে ভার ন্যস্ত হয়, তবে তাহাদিগের মধ্যে কোন ব্যক্তি গোয়েন্দা হইয়া সেই অপহৃত বালক বা বালিকাকে দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত প্রসন্নকুমারকে সঙ্গে লইয়া সেই বাড়ীতে গমন করিবে। পরে সুবিধামত তাঁহাকে সেই স্থানে আবদ্ধ করিয়া তাঁহার জীবন নষ্ট করিবে। আর যদি প্রসন্নকুমারের হস্তে ওই অনুসন্ধানের ভার ন্যস্ত না হয়, তাহা হইলেও, ওই বালক বা বালিকা কোন স্থানে আছে, এই সংবাদ তাঁহাকে প্রদান করিলে বা সেই স্থান তাঁহাকে দেখাইয়া দিলে তিনি নিশ্চয়ই সেই স্থানে আগমন করিবেন, তাহার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যদি তিনি একাকী আগমন করেন, তাহা হইলে ওই বাড়ী ও বালকবালিকাকে দেখাইয়া দিবে ও সেই সাবকাশে তাহাদিগের মনস্কামনা পূর্ণ করিয়া লইবে। আর যদি একাকী না আসিয়া অপর লোকজনের সহিত আগমন করেন, তাহা হইলে কদাচ সেই বাড়ী দেখাইয়া দিলে না। 

এই পরামর্শ অনুযায়ী একজন কাঁকুড়গাছির বাড়ী স্থির করে, দ্বিতীয় ব্যক্তি মালতীকে অপহরণ করিয়া আনে, তৃতীয় যে কোচম্যানি করিত, সেই প্রসন্নকুমারকে সঙ্গে করিয়া ওই বাড়ীতে লইয়া আসে, ও সকলে মিলিয়া তাঁহাকে সেই বাড়ীর ভিতর আবদ্ধ করে। 

পূর্ব্বেই একপ্রকার স্থির হইয়াছিল যে, প্রসন্নকুমারকে কোনরূপে আবদ্ধ করিতে পারিলেই, তাহারা তখনই তাহাকে হত্যা করিবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাহারা যেরূপ বাড়ী প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহাতে তাহারা সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্নকুমারকে হত্যা করিবার বাসনা পরিত্যাগ করিল। তাহারা দেখিল, যে প্রকোষ্ঠের ভিতর প্রসন্নকুমার আবদ্ধ হইল, তাহার ভিতর হইতে তিনি কোনরূপেই বহির্গত হইতে পারিবেন না। সুতরাং অনশনে তাঁহাকে সেই স্থানেই জীবনের শেষ অংশ অতিবাহিত করিতে হইবে। 

যে গ্রামে ব্যাঘ্রের অতিশয় উৎপাত হয়, যে গ্রাম হইতে রাত্রিকালে গরু বাছুর, ছাগল, ভেড়া ও সুযোগমতে মনুষ্যগণকে ব্যাঘ্রে লইয়া যায়, হত্যা করে, সেই সকল গ্রামে সময়সময় ব্যাঘ্র মারিবার বিশেষরূপ চেষ্টা হইয়া থাকে—গ্রমের লোকে ব্যাঘ্র মারিবার খাঁচা প্রস্তুত করিয়া থাকে। মফঃস্বলের পাঠকগণের মধ্যে সেরূপ খাঁচা অনেকেই দেখিয়াছেন। ওই সকল খাঁচা প্রায় দশ ফিট, লম্বা চারি ফিট চওড়া ও পাঁচ ফিট উচ্চ হয়। উহার চারি পার্শ্বে খুব মজবুত রেলিং দেওয়া, উপর ও নিচে মজবুত তক্তা দ্বারা আবদ্ধ। ওই খাঁচার মধ্যে একদিকে একটি ভেড়া বা ছাগল থাকিতে পারে, এরূপ একটি বিভাগ করিয়া দেওয়া হয়। যে অংশে ছাগল বা ভেড়া রক্ষিত হইবে, তাহার চতুদিকের রেল সকল এরূপ ঘন ভাবে বসান, যাহাতে সেই স্থানে ব্যাঘ্র আসিয়া ওই রেলের ভিতর দিয়া তাহার হস্ত প্রবেশ করাইয়া ওই ছাগল বা ভেড়াকে কোনরূপে হত্যা করিতে না পারে। উহার উপর যে তক্তার ছাদ থাকে, তাহাতে এরূপ একটি দরজা রাখা হয় যে, তাহার ভিতর দিয়া ওই ছাগল বা ভেড়া উহার ভিতর অনায়াসে রাখা যাইতে পারে বা বাহির করিয়া লওয়া যাইতে পারে। ওই খাঁচার অপর প্রান্তে একটি দরজা এরূপ ভাবে প্রস্তুত করা হয় যে, উহার ভিতর দিয়া ব্যাঘ্র অনায়াসে ওই খাঁচার ভিতর প্রবেশ করিতে পারে। ওই খাঁচার যে অংশ রেল দ্বারা বিভাগিত করিয়া ছাগল বা ভেড়ার থাকিবার স্থান করা হইয়াছে, ওই রেলের গাত্রে যেদিকে বাঘ থাকিবার স্থান হইয়াছে, সেইদিকে ছেঁড়া জালের অংশ বা সেইরূপ কোন পদার্থ রাখা হয়। ব্যাঘ্র প্রবেশ করিবার দরজাটি উঠাইয়া, তাহাতে সংলগ্ন একগাছি দড়ী ওই জালের সহিত এরূপ ভাবে আটকাইয়া রাখা হইয়া তাকে যে, ওই জাল ধরিলে বা উহাতে সামান্য রূপ হাতের জোর পড়িলেই ওই দড়ী ওই জাল হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, ও সেই সঙ্গে ব্যাঘ্র প্রবেশ করিবার দরজাও পতিত হয় 

শিকারীগণ পূর্ব্ববর্ণিত ছাগল বা ভেড়ার ঘরের ভিতর একটি কি দুইটি ছাগল বা ভেড়া রাখিয়া উহার দরজা উপর হইতে উত্তমরূপে বদ্ধ করিয়া দেয়। ব্যাঘ্র প্রবেশের দরজা উঠাইয়া দিয়া, তাহার সংলগ্ন দড়ি ওই জালের সহিত পূর্ব্বকথিত রূপে সংলগ্ন করিয়া ওই খাঁচা ব্যাঘ্র আগমনের স্থানে পাতিয়া রাখে। রাত্রিকালে ব্যাঘ্র, ওই মেষ বা ছাগলের গন্ধ পাইয়াই হউক, বা কোনরূপে দেখিতে পাইয়াই হউক, অথবা তাহাদিগের চীৎকার শুনিয়াই হউক, সেই স্থানে আগমন পূৰ্ব্বক ওই খাঁচার ভিতর হস্ত ঢুকাইয়া উহাকে ধরিতে চেষ্টা করে। কোনরূপে উহার ভিতর হস্ত ঢুকাইতে না পারিলে, উহার ভিতর প্রবেশ করিবার চেষ্টা দেখে ও প্রবেশের পথ দেখিতে পাইলেই উহার ভিতর দিয়া যেমন প্রবেশ করিয়া থাকেও যেমন ওই ছাগল বা ভেড়ার দিকে গিয়া পুনরায় সেই ঘরের ভিতর হইতে ছাগল বা ভেড়াকে ধরিবার চেষ্টা করে, অমনি ওই জালে তাহার হস্ত বা পদের আঘাত লাগিবার সঙ্গে সঙ্গে ওই খাঁচার কপাট পড়িয়া যায়, ব্যাঘ্রও সেই খাঁচায় আবদ্ধ হইয়া পড়ে। শিকারীগণ দূর হইতে উহা দেখিতে পাইয়া, সেই স্থানে আগমন পূৰ্ব্বকে যে মেষ বা ছাগলের লোভে ব্যাঘ্র সেই খাঁচার ভিতর আবদ্ধ হইয়াছে, তাহার নিকট আগমন করে, ও উপরের কপাট খুলিয়া সেই মেষ বা ছাগলকে সেই খাঁচা হইতে বাহির করিয়া লয়। পরিশেষে সেই আবদ্ধ ব্যাঘ্রকে তাহারা হত্যা করিয়া থাকে। 

দস্যু সর্দ্দার গঙ্গারাম যে ব্যাঘ্রকে ধৃত করিবার মানসে খাঁচা প্রস্তুত করিয়াছিল, ও যে বাঘ্রকে প্রলোভিত করিবার মানসে মালতীকে অপহরণ করিয়া অপর প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করিয়াছিল আজ প্রসন্নকুমার সেই মালতীর উদ্দেশে সেই প্রকোষ্ঠরূপ খাঁচার ভিতর প্রবেশ করিয়া সেই স্থানেই আবদ্ধ হইলেন। এখন গঙ্গারাম ও তাহার অনুচরদ্বয় ভাবিল, যখন তাহাদিগের মনস্কানা পূর্ণ হইয়াছে, তখন নিরপরাধিনী মালতীকে আর আবদ্ধ করিয়া রাখা কোনরূপেই কৰ্ত্তব্য নহে। কিন্তু তাহারা সেই সময় তাহাকে ছাড়িয়া দিতে পারিল না। কারণ যে গাড়িতে প্রসন্নকুমার সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই গাড়ি তখন সেই স্থানেই উপস্থিত ছিল, পাছে সেই গাড়োয়ান দেখিতে পার, এই আশঙ্কায় তাহারা সেই সময় মালতীকে বাহির করিতে সাহসী হইল না, অথচ উহাকে পরিত্যাগ করিয়াও সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল না। অনেকক্ষণ পরে সেই গাড়োয়ান চলিয়া গেল। 

সন্ধ্যা হইল, সন্ধ্যার পর উহাদিগের বন্দোবস্ত অনুযায়ী, যে গাড়িতে করিয়া ওই বালিকাকে সেই স্থানে আনা হইয়াছিল, সেই গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তখন গঙ্গারাম মালতীর চক্ষু উত্তমরূপে কাপড় দিয়া বাঁধিয়া সেই ঘর হইতে তাহাকে বাহির করিল ও গাড়িতে তাহাকে স্থাপিত করিয়া যে স্থান হইতে তাহাকে অপহরণ করিয়া আসিয়াছিল, তাহার বিপরীত দিকে গমন করিয়া, একটি নির্জ্জন স্থানে ছাড়িয়া দিল। অনন্তর গাড়োয়ান আপন স্থানে প্রস্থান করিল। 

দশম পরিচ্ছেদ 

গয়ার মা একটি নিতান্ত দরিদ্র স্ত্রীলোক, জাতিতে কৈবর্ত্ত। তাহার বয়ঃক্রম পঁচিশ বৎসরের অধিক হইবে না কিন্তু দরিদ্রতা নিবন্ধন, তাহার শরীর কৃশ হইয়া পড়িয়াছে, হঠাৎ দেখিলে বোধ হয়, তাহার বয়ঃক্রম ৪০ উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। 

গয়ার মা কৈবর্ত্তের মেয়ে, সময়ে তাহার অবস্থা ভালই ছিল। তাহার স্বামীর দুইখানি লাঙ্গল বহিত। সে নিজে চাষ করিত, তদ্বব্যতীত আরও একটি চাকর ছিল। হালের গরু ব্যতীত তাহার আরও চারি পাঁচটি গাভী ছিল। উহাদিগের সেবা শুশ্রূষা করিবার নিমিত্ত আরও একটি বালককে সে প্রতিপালন করিত। তাহার ঘরে যে পরিমাণ দুগ্ধ হইত, তাহা আপনারা খাইয়া অবশিষ্ট বিক্রয় করিত। উহার ঘরে ধান চাল সৰ্ব্বদাই মজুত থাকিত। গঙ্গারাম নামক তাহার একটি পুত্র ছিল, তাহার বয়ঃক্রমও প্রায় ৭/৮ বৎসর হইয়াছিল। যে বাগানে আজ প্রসন্নকুমার আবদ্ধ, সেই বাগানের সন্নিকটে জমীদারের জায়গায়, গোলপাতার ঘর বাঁধিয়া সে বাস করিত। এইরূপে সুখ স্বচ্ছন্দে কিছুদিবস বাস করিবার পর, গয়ার মার অবস্থা একেবারে পরিবর্ত্তন হইয়া যায়। এক বৎসরের মধ্যে তাহার স্বামী ও পুত্রটি মারা যায়। গরু বাছুরগুলিও ক্রমে তাহাদিগের অনুগমন করে। চাষ আবাদ বন্ধ হইয়া যায়। ঘরে ধান চাউল প্রভৃতি যাহা কিছু মজুত ছিল, তাহাও ক্রমে নিঃশেষিত হইয়া পড়ে। ক্রমে গয়ার মার অতিশয় কষ্ট হয়, আহারাদির সংকুলান হওয়া দায় হইয়া পড়ে। জমীদারের খাজনাও ক্রমে বাকী পড়িতে আরম্ভ হয়। যে নিজের অন্ন সংস্থানে অসমর্থ, সে কোথা হইতে জমীদারের খাজনা দিবে? জমীদার তাহার উপর নালিস করিয়া ডিক্রী করেন, যথাসময়ে ঘর কয়খানি বিক্রয় হইয়া যায়। যে ব্যক্তি উহা খরিদ করে, সে উহা ভাঙ্গিয়া লইয়া যায়। গয়ার মা কিন্তু সেই স্থান পরিত্যাগ করে না। সে নিকটবর্তী বাগান হইতে তালপাতা, নারিকেলপাতা প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়া একটি বৃক্ষের অন্তরালে একখানি ক্ষুদ্র কুটীর প্রস্তুত করে, ও তাহাতেই কোনরূপ দিন অতিবাহিত করে। অনকে তাহাকে সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পরামর্শ দিয়াছিল, কিন্তু যেস্থানে তাহার স্বামী পুত্র বাস করিয়া গিয়াছে, সে সেই স্থান পরিত্যাগ করিতে চাহে না। অনেক দুশ্চরিত্র লোক তাহাকে স্ব স্ব ইচ্ছানুযায়ী কুপরামর্শ দিয়া তাহার ক্লেশ নিবারণের পথ দেখাইয়া দিয়াছিল, কিন্তু সেই সকল প্রস্তাবে সম্মত হওয়া দূরে থাকুক, তাহাদিগকে গালি দিয়া সে তাহাদিগের সংশ্রব একেবারে পরিত্যাগ করে। সে মনে মনে স্থির করিয়াছিল, যদি একান্তই অনশনে তাহাকে মরিতে হয়, সেই জঙ্গলের ভিতরই মরিবে, কিন্তু সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া সে লোকালয়ে গমন করিবে না, বা কোন দুষ্ট লোকের কোন পরামর্শ সে শুনিবে না। মনে মনে এইরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া গয়ার মা সেই স্থানেই বাস করিতে লাগিল। 

যে জমীদার উহার ঘর বিক্রয় করিয়া লইয়াছিলেন, তিনি পরিশেষে গয়ার মার অবস্থা শুনিয়া একদিবস সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, স্বচক্ষে তাহাকে দেখিয়া তাঁহার মন আর্দ্র হইল। কিয়ৎ পরিমাণ জমী দেখাইয়া দিয়া কহিলেন, ইহাতে গাছপালা লাগাইয়া কোন গতিকে তুমি তোমার জীবন অতিবাহিত কর। যতদিবস তুমি বাঁচিবে, ততদিবস সেই জমীর খাজনা তোমাকে দিতে হইবে না। 

গয়ার মা ওই জমীতে শাক সবজি নিজে পরিশ্রম করিয়া প্রস্তুত করিত ও তাহাই বিক্রয় করিয়া যে দুই চারি পয়সা পাইত, তাহার দ্বারাই কোন গতিকে নিজের আহারীয় ও পরিধেয় বস্ত্র সংস্থান করিত। জমীদার তাহার নিকট হইতে ওই জমীর খাজনা লইতেন না সত্য, কিন্তু সময় সময় গয়ার মা ওই জমীতে উৎপন্ন তরিতরকারি জমীদারের বাড়ীতে গিয়া দিয়া আসিত। যেস্থানে গয়ার মা বাস করিত, সেই স্থানে পুস্করিণী আদৌ ছিল না, সুতরাং গয়ার মার জল প্রাপ্তির বড়ই কষ্ট হইত। যে বাগানে প্রসন্নকুমার আবদ্ধ, সেই বাগানে একটি পুষ্করিণী ছিল, উহা হইতে জল সংগ্রহ করিয়া গয়ার মা তাহার সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিত ও তাহার ক্ষুদ্র তরকারির বাগানেও উহার জল লইয়া সেচন করিত। পুষ্করিণীর অপর প্রান্তে অর্থাৎ যেদিকে গয়ার মা বাস করিত, সেইদিকে জঙ্গলের মধ্য দিয়া ওই পুষ্করিণীতে নামিবার একটি ক্ষুদ্র রাস্তা ছিল, গয়ার মার যাতায়াতের নিমিত্তই বোধ হয় ওই রাস্তা আপনা হইতেই হইয়া গিয়াছিল। গয়ার মা ওই রাস্তা দিয়া পুষ্করিণী হইতে জল আনিত। সেই স্থানের জঙ্গল নিবন্ধন অপর কোন স্থান হইতে কেহই তাহাকে সহজে দেখিতে পাইত না। 

একদিবস বৈকালে জল আনিবার নিমিত্ত গয়ার মা যখন সেই পুষ্করিণীতে গিয়াছিল, সেই সময় ওই বাগানের গৃহের সম্মুখে সে দুই তিনজন লোককে দেখিতে পায় ও একটি বালিকার অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি তাহার কর্ণে প্রবেশ করে। কিন্তু গয়ার মা সে সম্বন্ধে আর কোনরূপ লক্ষ্য করে নাই। সে মনে করে, উহারা আসিয়া হয় ত সেই বাগানে বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহার পর তিন দিবস যায়। চতুর্থ দিবস দেখিতে পায়, দুই তিন ব্যক্তি পুষ্করিণীর ঘাটে বসিয়া কি কথাবার্তা কহিতেছে। সেই সময় প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে, বাগানের ভিতর অন্ধকার আসিয়া আচ্ছন্ন করিয়াছে। সেই সময় গয়ার মা শুনিতে পায়, একজন বলিতেছে “চল, আজ রাত্রিকালেই আমরা এই স্থান হইতে প্রস্থান করি, উহাকে যেরূপে আবদ্ধ করা হইয়াছে, তাহাতে আর কিছুই দেখিতে হইবে না, আপনা আপনিই এই ঘরের ভিতর মরিয়া পড়িয়া থাকিবে।” 

গয়ার মা এই কয়েকটি কথা শুনিল সত্য কিন্তু সে উহার মর্ম্ম ভালরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিল না, সুতরাং সেদিকে আর লক্ষ্যও করিল না। পুষ্করিণী হইতে জল লইয়া সে ধীরে ধীরে আপন কুটীরাভিমুখে প্রস্থান করিল। 

সে যাহা শুনিয়াছিল, সে সম্বন্ধে সে আর কোন কথা ভাবিল না, বা কোন কথা আর তাহার মনেও হইল না। পরদিবস দিবা দ্বিপ্রহরের সময় যখন গয়ার মা ওই পুষ্করিণীতে স্নান করিতে গমন করে, সেই সময় সে ওই বাগানের ভিতর কাহাকেও দেখিতে পায় নাই। কিন্তু পূর্ব্বদিবস সন্ধ্যার সময় সে যাহা শুনিয়াছিল, তাহাও তাহার কিছুই মনে নাই। সেইদিবস সন্ধ্যার পূর্ব্বে পুনরায় সে যখন জল লইতে আইসে, সেই সময়ও কোন ব্যক্তি তাহার নয়ন গোচর হয় নাই। কিন্তু হঠাৎ তাহার মনে হয়, কয়েকদিবস পূর্ব্বে সে ওই বাগানের ঘর হইতে বালিকার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়াছিল, সুতরাং নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি পরিবার লইয়া সেই বাগানে আসিয়া বাস করিতেছে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, তাহার কলসী সেইপুষ্করিণীর ধারে রাখিয়া সে ধীরে ধীরে ওই গৃহের সন্নিকটে আগমন করে, কিন্তু স্ত্রী কি পুরুষ কোন লোককে দেখিতে না পাইয়া সে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করে, দেখিতে পায়, সমস্ত ঘরই শূন্য অবস্থায় রহিয়াছে, কেবল একটি ঘরের কাষ্ঠ ও লৌহনির্ম্মিত উভয় দরজা বাহির হইতে তালাবন্ধ। 

এই ঘরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া পূৰ্ব্বে সে যাহা শুনিয়াছিল, তাহা হঠাৎ তাহার মনে হইল। তখন সে ভাবিল, যাহারা এই বাগানে ছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ বলিয়াছিল, উহাকে যেরূপে আবদ্ধ করা হইয়াছে, তাহাতে সে আপনিই এই ঘরের ভিতর মরিয়া থাকিবে। সে মনে মনে ভাবিল, তবে কি এই ঘরের ভিতর কাহাকেও আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে কিরূপে সেই মনুষ্যকে উদ্ধার করা যাইতে পারে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই ঘরে প্রবেশ করিবার আর কোন উপায় আছে কি না, তাহা গয়ার মা দেখিল ও বুঝিল, ওই দরজা ভিন্ন উহার ভিতর প্রবেশ করিবার আর কোনরূপ উপায় নাই। তখন সে ওই তালা ভাঙ্গিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সেই দুর্বলা স্ত্রীলোকের সামর্থ্য উহা কুলাইল না। অগত্যা দুঃখিত মনে, কি ভাবিতে ভাবিতে আপন কুটীর অভিমুখে প্রস্থান করিল।

একাদশ পরিচ্ছেদ 

পাঠকগণ ইহার পূর্ব্বে অবগত হইয়াছেন যে, দস্যুগণ প্রসন্নকুমারকে আবদ্ধ করিয়া মালতীকে ওই স্থান হইতে বাহির করতঃ একটি অপরিচিত স্থানে পরিত্যাগ পূর্ব্বক, আপন আপন স্থানে প্রস্থান করে। মালতী সেই অবস্থায় কিছুক্ষণ পড়িয়া থাকিয়া আপন চক্ষের বন্ধন কোনরূপে খুলিয়া ফেলে। তখন সে দেখিতে পায়, একটি অপরিচিত স্থানে অন্ধকারের ভিতর সে রহিয়াছে। এই কয়েকদিবস অনশনে বা অর্দ্ধাশনে ও দিনরাত্র কেবল রোদন করিয়া সে অতিশয় দুর্বল ও ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তাহার চলৎশক্তি একেবারে রহিত, ক্রন্দনশক্তি নাই বলিলেও হয়। তথাপি সেই সপ্তমবর্ষীয়া বালিকা নিতান্ত ভীত হইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিল। এইরূপ অবস্থায় অধিকক্ষণ যদি তাহাকে সেই : স্থানে থাকিতে হইত, তাহা হইলে তাহার অদৃষ্টে যে কি ঘটিত, তাহা বলা যায় না। 

সেই সময় একটি যুবক সেই স্থান দিয়া গমন করিতেছিল, ওই বালিকার ক্রন্দন শব্দে তাহার দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষিত হইল। তিনি বুঝিতে পারিলেন, পথভ্রান্ত হইয়া সেই বালিকাটি সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। তিনি উহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু মালতী কোন কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিল না, কেবল কাঁদিতে লাগিল। মালতীকে দেখিয়া তিনি বুঝিতে পারিলেন, সে কোন ভদ্র গৃহের কন্যা। তিনি উহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া কহিলেন “আমার সঙ্গে আইস, আমি তোমাকে তোমার বাড়ীতে পৌঁছাইয়া দিব।” 

যুবকের কথা শুনিয়া মালতী চুপ করিল ও তাঁহার সহিত যাইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহার আর চলিবার ক্ষমতা ছিল না, দুই এক পদ অগ্রসর হইতে না হইতেই সে সেই স্থানে পড়িয়া গেল। যুবক বুঝিলেন, উহার চলিবার ক্ষমতা নাই। তখন তিনি উহাকে আপন ক্রোড়ে লইয়া নিজ গৃহ অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। ওই স্থান হইতে তাঁহার গৃহ অধিক দূরে ছিল না। 

ওই যুবক ব্রাহ্মণ, কোন অফিসে কর্ম্ম করেন, অফিস হইতে বাড়ী যাইতে প্রায়ই তাঁহার রাত্রি হয়। বাড়ীতে তাঁহার মাতা ও স্ত্রী ভিন্ন আর কেহই নাই। মালতীকে লইয়া গিয়া, তিনি তাঁহাদিগের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন। যেরূপ অবস্থায় ও যেস্থানে তাহাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা তাবৎ তাঁহাদিগকে কহিলেন। মালতী উহাদিগকে দেখিয়া আরও ক্রন্দন করিতে লাগিল। তাঁহারা মালতীর অবস্থা দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলেন, যে, সে অতিশয় ক্ষুধিতা হইয়া নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তাঁহাদিগের ঘরে দুগ্ধ ছিল, সেই দুগ্ধ গরম করিয়া তখনই উহাকে একটু খাওয়াইয়া দিলেন। সে যেন একটু সুস্থ হইল। তখন তাহার নিকট হইতে উহারা ক্রমে ক্রমে যাহা অবগত হইতে পারিলেন, তাহাতে এই বুঝিলেন যে, কোন ব্যক্তি তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া, একটি ঘরের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, আজ তাহাকে ছাড়িয়া দিয়াছে। সে কাহার কন্যা ও কোথায় তাহার পিতা মাতা বাস করিয়া থাকেন, তাহা সে কিছুই বলিতে পারিল না। কেবল এই মাত্র বলিল যে, তাহার ঠাকুর দাদার নাম কিশোরী বাবু। ইহা ব্যতীত সে তাহার বিশেষ পরিচয় আর কিছুই প্রদান করিতে পারিল না। 

সেই রাত্রে উহার পিতা মাতার সন্ধান হওয়া নিতান্ত সুকঠিন, এই ভাবিয়া তাঁহারা মালতীকে অনেক বুঝাইয়া বিশেষ যত্নের সহিত আপনাদিগের বাড়ীতেই রাখিয়া দিলেন ও রাত্রে তাহাকে চারিটি অন্নও আহার করাইলেন। 

পর দিবস প্রাতঃকালে সেই যুবক মালতীকে একখানি গাড়িতে করিয়া লইয়া নিকটবর্ত্তী থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন, কি অবস্থায় ও কোথায় মালতীকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহার সমস্ত অবস্থা সেই থানার কর্ম্মচারীকে কহিলেন ও মালতীর নিকট হইতে যাহা কিছু অবগত হইতে পারা গিয়াছিল, তাহাও তাঁহাকে বলিলেন। কর্ম্মচারী মহাশয় সমস্ত অবস্থা শুনিয়া, একটু চিন্তা করিলেন, পরিশেষে কহিলেন, এই বালিকা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হইয়া প্রত্যেক থানায় বিলি করা হইয়াছে ও প্রত্যেক থানাতেই ইহার অনুসন্ধান করা হইতেছে। এই বলিয়া তিনি আর একজন কর্মচারীকে ওই বিজ্ঞাপনের কাগজখানি আনিতে কহিলেন। তিনি উহা আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত করিলেন। তখন উহা দেখিয়া সেই যুবক জানিতে পারিলেন, যে মালতী কাহার কন্যা ও কোথায় তাহার পিতা মাতা বাস করিয়া থাকেন, ও কিরূপ অবস্থায় কোন দিবস হইতে মালতী অপহৃত হইয়াছে। 

এ সম্বন্ধে এখন যাহা কিছু থানায় লেখা-পড়া করিবার প্রয়োজন, তাহা লিখিয়া লইয়া কৰ্ম্মচারী ওই যুবকের সহিত একজন প্রহরীকে পাঠাইয়া দিলেন। যুবক ওই প্রহরী ও মালতীকে লইয়া তাঁহার সেই গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিলেন ও রায় বাহাদুর কিশোরীলাল বর্ম্মণের বাসস্থান উদ্দেশে গাড়ি হাঁকাইতে কহিলেন। 

যেস্থানে মালতীকে পাওয়া গিয়াছিল, সেই স্থান হইতে কিশোরীলালের বাড়ী অনেক দূর ব্যবধান ছিল। তাঁহারা ক্রমে রায় বাহাদুরের বাড়িতে উপনীত হইলেন। গাড়ি দরজায় উপস্থিত হইবামাত্র, দ্বারবান্ মালতীকে দেখিতে পাইয়া বাড়ীতে সংবাদ প্রদান করিল। মালতীর আগমন সংবাদ শুনিয়া বাড়ীর ভিতর হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। সদর বাড়ীতে সেই সময় যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, সকলেই দৌড়িয়া আসিয়া দরজায় উপস্থিত হইলেন, অন্দর হইতেও প্রবীণা স্ত্রীলোকগণ বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যে সকল স্ত্রীলোকের বাহিরে আসিবার উপায় নাই, তাঁহারা গৃহের নানা স্থান হইতে উঁকি ঝুঁকি মারিতে আরম্ভ করিলেন। রায় বাহাদুরের স্ত্রী প্রবীণা ছিলেন, তিনি সেই যুবক বা অপর আর কাহাকেও দেখিয়া কোনরূপ লজ্জা না করিয়া সেই স্থানে আগমন করিলেন, ও মালতীকে গাড়ি হইতে ক্রোড়ে উঠাইয়া লইয়া, সকলকে কহিলেন, ইহার মা অগ্রে ইহাকে দেখুক, তাহার পর আর সকলে ইহাকে দেখিও, বলিয়া দ্রুতপদে অন্দরে প্রবেশ করিলেন। সেই সময় মালতীর মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না, কেবল তাহার চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা বহিতে লাগিল। 

রায় বাহাদুর সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি সে যুবককে ও সেই প্রহরীকে বিশেষ যত্নের সহিত নিজের বৈঠকখানায় লইয়া গিয়া বসাইলেন, ও কিরূপে, কোথায় মালতীকে পাওয়া গেল, তাহা তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রহরী কিছুই বলিতে পারিল না, যুবক যেরূপ উপায়ে মালতীকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, যেরূপে তাহাকে সেই স্থান হইতে আনয়ন করেন, তাঁহার বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ যেরূপে তাহাকে সান্ত্বনা করিয়া তাঁহাদিগের নিকট রাত্রে রাখিয়াছিলেন, ও পরদিবস তাহাকে থানায় আনিয়া যেরূপে তাহার পিতামহের সন্ধান পান, তাহা সমস্ত আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিলেন। রায় বাহাদুর তাঁহার কথা শুনিয়া অতিশয় বিস্মিত ও সন্তুষ্ট হইলেন, তিনি সেই যুবককে কিছু পারিতোষিক প্রদান করিতে ইচ্ছা করিলেন, কিন্তু যুবক তাহা গ্রহণে সম্মত হইলেন না, তখন তিনি সেই প্রহরীকে কিছু পারিতোষিক প্রদান করিয়া ও গাড়োয়ানকে সেই স্থানে আসিবার ও সেই যুবককে সেই স্থান হইতে পুনরায় তাঁহার বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিবার ভাড়া ও পারিতোষিক স্বরূপে আরও কিছু প্রদান করিয়া তাঁহাদিগকে বিদায় করিলেন। যুবক সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় রায় বাহাদুর তাঁহার নাম ও ঠিকানা লিখিয়া লইলেন ও তাঁহাকে কহিলেন, দুই একদিবসের মধ্যে তিনি তাঁহার বাড়ীতে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। 

রায় বাহাদুর যাহা বলিয়াছিলেন, কার্য্যেও তাহাই করিলেন। দুই তিন দিবস পরে রায় বাহাদুর সন্ধ্যার পর তাঁহার স্ত্রী মালতীকে সঙ্গে লইয়া সেই যুবকের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই সময় ওই যুবক অফিস হইতে প্রত্যাগমন করেন নাই, সুতরাং রায় বাহাদুর আর তাঁহার গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন না, তিনি বাহির হইতে সেই যুবককে ডাকার কাহার কোনরূপ উত্তর পাইলেন না কিন্তু দেখিতে পাইলেন, ওই বাড়ীর দরজার অন্তরাল হইতে একটি স্ত্রীলোক তাঁহাদিগকে দেখিতছেন, কিন্তু কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিতেছেন না। ইহা দেখিয়া রায় বাহাদুর মালতীকে সঙ্গে লইয়া সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন ও সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

তিনি ওই বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র একটি স্ত্রীলোক আসিয়া মালতীকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন। তিনি দেখিতে পাইলেন, ওই বাড়ীতে কেবল দুইটিমাত্র স্ত্রীলোক ভিন্ন আর কেহই নাই, উহাদিগকে দেখিয়াই তিনি বুঝিতে পারিলেন, উহাদিগের একজন সেই যুবকের মাতা ও অপর তাঁহার স্ত্রী মালতীকে তাঁহারা সেই রাত্রে যেরূপ যত্ন করিয়া আপন গৃহে স্থান প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার নিমিত্ত তিনি উহাদিগকে বিশেষরূপে ধন্যবাদ প্রদান করিয়া, পরিশেষে প্রণামী স্বরূপ তাঁহাদিগকে একশত টাকা প্রদান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। তাঁহারা কোনরূপেই টাকা গ্রহণ করিতে চাহিলেন না কিন্তু প্রণামীর টাকা গ্রহণ না করিলে রায় বাহাদুরকে বিশেষরূপে অপমানিত করা হইবে, এইরূপ বলিয়া তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া ওই টাকা প্রদান করিয়া চলিয়া আসিলেন। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

গয়ার মা একটু সামান্য ক্ষেতে গাছ পালা লাগাইয়া তাহারই উপস্বত্ব হইতে আপন জীবনধারণ করিত, ইহা পাঠকগণ অবগত আছেন। জমী খননাদি করিতে হইলে, যে দুই চারিখানি লৌহনির্ম্মিত যন্ত্রের প্রয়োজন, তাহাও গয়ার মার ছিল। ওই বাগান বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গয়ার মা, আপন কুঁড়ের মধ্যে গমন করিল ও সেই স্থান হইতে একখানি দা ও একটি বৃহৎ সাবল লইয়া সে পুনরায় ওই স্থানে আগমন করিল। উহাদিগের সাহায্যে সে লৌহনির্ম্মিত দরজার তালাটি অনেক কষ্টে ভাঙ্গিয়া ফেলিল, পরিশেষে কাষ্ঠ নির্ম্মিত দরজার তালাও ক্রমে ভাঙ্গিয়া সে উভয় দরজা খুলিয়া ফেলিল। 

দরজা খোলা হইলে গয়ার মা দেখিল, উহার মধ্যে একটি লোক মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে। মরিয়া গিয়াছে ভাবিয়া, প্রথমতঃ ওই ঘরের ভিতর একাকী প্রবেশ করিতে তাহার সাহসে কুলাইল না, সে কিছুক্ষণ স্থির ভাবে দরজার বাহিরে দাঁড়াইয়া উহাকে দেখিতে লাগিল। কিছুক্ষণ এইরূপে দেখিবার পর সে বুঝিতে পারিল যে, ওই ব্যক্তি মরে নাই, তাহার হাত পা নড়িতেছে। তখন সে সাহসে ভর করিয়া ধীরে ধীরে উহার নিকট গমন করিল। ওই ব্যক্তি গয়ার মাকে দেখিয়া, তাহার দিকে সজলনয়নে চাহিতে লাগিল, কিন্তু তাহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না, উহার মুখের ভাব দেখিয়া গয়ার মা বুঝিতে পারিল, তিনি জলপান করিতে চাহিতেছেন। গয়ার মা দ্রুতপদে তাহার গৃহ হইতে একঘটি জল আনিয়া মুখে ও চক্ষে সেচন করিল ও কিয়ৎ পরিমাণ উঁহাকে পান করাইল। জল পান করিয়া তিনি একটু সুস্থ হইলেন, ও তাঁহার মুখ দিয়া ধীরে ধীরে কথা বাহির হইল। তিনি অতি ক্ষীণস্বরে কহিলেন “মা, তুমি আমাকে রক্ষা কর। আমাকে এই স্থান হইতে বাহিরে লইয়া চল। আমার জীবন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে।” 

তাঁহার কথা শুনিয়া গয়ার মা কহিল “তোমার কোন ভয় নাই, আমি এখনই তোমাকে আমার কুঁড়ে ঘরে লইয়া যাইতেছি। তুমি কোনরূপে আমার অঙ্গে ভর দিয়া আমার সহিত আগমন কর।” এই বলিয়া গয়ার মা তাঁহাকে ধরিল, ধরিয়া উঠাইয়া বসাইল, ক্রমে জোর করিয়া তাঁহাকে তুলিয়া দাঁড় করাইল, ও নিজের বাহু বেষ্টন করিয়া তাঁহাকে ধরিয়া তাঁহার মস্তক তাহার বাম স্কন্ধের উপর স্থাপিত করিয়া ধীরে ধীরে কোনরূপে সেই ঘর হইতে বাহির হইল। 

প্রসন্নকুমারের অঙ্গে কিছুমাত্র সামর্থ্য ছিল না, তথাপি তাঁহার যতদূর সাধ্য তাঁহার পায়ে ভর দিয়া ও শরীরের ভার গয়ার মার শরীরের উপর রাখিয়া কোনরূপে গয়ার মার সহিত গমন করিতে লাগিলেন। এইরূপে ক্রমে গয়ার মা তাঁহাকে আপন কুটীরে লইয়া গেল। সেস্থান হইতে তাহার কুটীরে গমন করিতে হইলে দুই মিনিটের অধিক লাগে না, কিন্তু প্রসন্নকুমারকে লইয়া যাইতে তাহার প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা সময় অতিবাহিত হইয়া গেল। 

গয়ার মার যে একটু সামান্য বিছানা ছিল, সে তাঁহাকে লইয়া গিয়া তাহার উপর শয়ন করাইল, ও আর একটু জল তাঁহাকে পান করাইয়া সে তাঁহার কুঁড়ে হইতে বাহির হইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে কিছু দুগ্ধ আনিয়া উহা গরম করিয়া তাঁহাকে প্রদান করিল। প্রসন্নকুমার দুগ্ধ পান করিয়া বেশ সুস্থ হইলেন, তাঁহার শরীরে একটু বলের সঞ্চার হইল। তিনি তখন গয়ার মার নিকট আপনার পরিচয় প্রদান করিলেন। তাঁহার পিরাণের পকেটে কিছু অর্থ ছিল, তাহা লইয়া গয়ার মাকে দিলেন, কহিলেন “এই অর্থ দ্বারা কিছু খাদ্য কিনিয়া আন, এবং আমার বাড়ীতে কোনরূপে সংবাদ প্রদান কর।” গয়ার মা ওই অর্থ দ্বারা কিছু আহারীয় সংগ্রহ করিয়া আনিয়া তাঁহাকে খাওয়াইল। 

গয়ার মা তাহার জমীদারের বাড়ীতে প্রায় সদাসর্বদা যাইত। সুতরাং মনে করিল, তাহার জমীদারের নিকট গমন করিয়া এই সমস্ত কথা বলিয়া তাহার দ্বারাই যেরূপে হয় একটা বন্দোবস্ত করা কর্তব্য। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া, সে প্রসন্নকুমারকে তাহার মনের ভাব বলিয়া সে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। যাইবার সময় প্রসন্নকুমার তাঁহাকে গাড়ি করিয়া যাইতে উপদেশ দিলেন ও কহিলেন “যত শীঘ্র হয় এই কার্য্য সম্পন্ন কর।” 

প্রসন্নকুমারের কথা শুনিয়া গয়ার মা তৎক্ষণাৎ আপন জমীদারের বাড়ীতে গমন করিল, যাইতে যাইতে যেস্থানে গাড়ি পাইল, সেই স্থান হইতে উহা ভাড়া করিয়া লইল। জমীদারের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া প্রসন্নকুমারের সমস্ত অবস্থা তাঁহাকে কহিল। তিনি প্রসন্নকুমারকে জানিতেন, কিন্তু তাঁহার বাড়ী চিনিতেন না। গয়ার মার কথা শুনিয়া তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন। তিনি তাঁহার বাড়ীর সন্ধান করিয়া তাঁহার বাড়ীতে এই সংবাদ প্রদান করিবার নিমিত্ত নিজেই প্রস্তুত হইলেন। যে গাড়িতে গয়ার মা আসিয়াছিল, সেই গাড়িতে গয়ার মার সহিত আরোহণ করিয়া তিনি সেই স্থানের থানায় গমন করিলেন। সেই স্থান হইতে প্রসন্নকুমারের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

প্রসন্নকুমারের বাড়ীতে কেবলমাত্র তাঁহার স্ত্রী ও একটি পুত্র ছিল। প্রায় এক সপ্তাহ অতীত হইল, প্রসন্নকুমার বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছেন, তাহার পর তাঁহারা প্রসন্নকুমারের আর কোন সংবাদ পান নাই। না বলিয়া কহিয়া প্রসন্নকুমার এতদিবস কোন স্থানে থাকিতেন না। সুতরাং প্রসন্নকুমারের কোনরূপ সংবাদ না পাইয়া তাঁহার স্ত্রীপুত্র নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র তাঁহার প্রধান কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পিতার সংবাদ জিজ্ঞাসাও করিয়াছিলেন, ও তাঁহার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিয়াছিলেন যে, তিনিও প্রসন্নকুমারের কোনরূপ সংবাদ বা তাঁহার কোন পত্রাদি পান নাই। সুতরাং প্রসন্নকুমারের সংবাদের জন্য তাঁহারা নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া পড়িয়াছিলেন, কারণ তাঁহারা জানিতেন যে, প্রসন্নকুমারের অনেক শত্রু। কোনরূপে প্রসন্নকুমারের সংবাদ না পাইয়া তাঁহারা নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া পড়িয়াছন, এরূপ সময় সেই জমীদার গয়ার মার সহিত সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা উহাদিগের নিকট হইতে সমস্ত কথা শুনিয়া আর কালবিলম্ব না করিয়া একখানি গাড়ি আনিয়া উহাদিগের সহিত প্রসন্নকুমারের উদ্দেশে চলিলেন। বলা বাহুল্য, এরূপ অবস্থায় প্রসন্নকুমারের স্ত্রী তাঁহাদিগের সহিত গমন করিতে লজ্জিত হইলেন না। জমীদার মহাশয়ও সঙ্গে চলিলেন। 

তাঁহারা গয়ার মার সেই ক্ষুদ্র কুটীরে গমন করিয়া প্রসন্নকুমারকে যেরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইলেন, তাহাতে কোনরূপে আর চক্ষুজল সংবরণ করিতে পারিলেন না। পরিশেষে তাঁহাকে লইয়া আপন গৃহে আনয়ন করিলেন। গয়ার মাকেও সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিলেন। জমীদার মহাশয় তাহাদিগকে বাড়ীতে পৌঁছিয়া দিয়া আপন বাড়ীতে প্রস্থান করিলেন। 

বাড়ীতে আসিয়াই প্রসন্নকুমারের পুত্র একজন ডাক্তারকে আনাইলেন, তিনি প্রসন্নকুমারের নিকট সমস্ত অবস্থা শুনিয়া কহিলেন, আহারীয়, পানীয় ও নিৰ্ম্মল বায়ু সেবনের অভাবে প্রসন্নকুমারের এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় আর দুই চারি দিবস অতিবাহিত হইলে, প্রসন্নকুমারকে আর জীবিত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যাইত না। 

প্রসন্নকুমার কয়দিবস যে ওই ঘরের ভিতর আবদ্ধ ছিলেন, তাহা তিনি জানিতেন না। হিসাব করিয়া পরিশেষে জানিতে পারা গেল যে, প্রায় ৭ দিবস তিনি ওইরূপ অবস্থায় বিনা আহারে ও বিনা জল পানে অতিবাহিত করিয়াছেন। ঔষধ ও আহারীয়ের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া ডাক্তার মহাশয় প্রস্থান করিলেন। ক্রমে প্রসন্নকুমার সুস্থ হইয়া উঠিলেন। প্রসন্নকুমারের এই সংবাদ ক্রমে চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। তাঁহার প্রধান কর্ম্মচারী ইহা জানিতে পারিয়া নিজে আসিয়া প্রসন্নকুমারের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তাঁহার নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া কয়েকজন উপযুক্ত পুলিস কর্মচারীকে ইহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত করিলেন। যে কয়জন পুলিস কর্মচারী এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারা মনে করিলেন, যাহাদিগের দ্বারা প্রসন্নকুমারের এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল যাহারা প্রসন্নকুমারকে হত্যা করিবার সঙ্কল্প করিয়া প্রায় তাঁহার জীবন একরূপ শেষ করিয়া আনিয়াছিল, অনুসন্ধান করিয়া যদি তাহাদিগকে ধৃত করিতে ও উপযুক্তরূপ দণ্ডে দণ্ডিত করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে তাঁহাদিগের অবস্থাও যে ক্রমে ওইরূপ না হইবে তাহা কে বলিতে পারে? 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া তাঁহারা এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। প্রসন্নকুমারের নিকট সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া, সৰ্ব্ব প্রথম যে গাড়িতে করিয়া মালতীকে লইয়া গিয়াছিল, সেই গাড়ির কোচম্যানকে অর্থাৎ যে কোচম্যান প্রসন্নকুমারকে সঙ্গে করিয়া যেখানে তিনি আবদ্ধ হইয়াছিলেন, সেইখানে লইয়া গিয়াছিল, সেই কোচম্যানকে তাঁহারা সর্ব্বপ্রথমে ধৃত করিলেন। ওই কোচম্যান একেবারে সমস্ত কথা অস্বীকার করিল। সকলেই বুঝিল, কোচম্যানও ওই দস্যুদলভুক্ত। 

যে গাড়ি ভাড়া করিয়া প্রসন্নকুমার ওই বাগানে গমন করিয়াছিলেন, সেই গাড়ির কোচম্যানকেও পাওয়া গেল। সে ও প্রসন্নকুমার উভয়েই প্রথমোক্ত গাড়ির কোচম্যানকে দেখিয়া অগ্রেই চিনিতে পারিলেন, তথাপিও সে এখন কোন কথা স্বীকার করিল না। 

মালতীকে লইয়া গিয়া ওই বাগান দেখান হইল। সে ওই বাগান দেখিয়া অগ্রেই চিনিতে পারিল ও যে ঘরে তাহাকে আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছিল, তাহা সে দেখাইয়া দিল। 

পূৰ্ব্বকথিত কোচম্যান সমস্ত কথা অস্বীকার করিলেও অনুসন্ধানকারী পুলিস-কর্মচারিগণ সমস্ত কথা ক্রমে জানিতে পারিলেন। গঙ্গারাম রামচরণ ও কালিচরণ ক্রমে ধৃত হইল। 

যে মালীর নিকট হইতে উহারা ওই বাগান ভাড়া লইয়াছিল, সেই মালি উহাদিগকে দেখিবা মাত্র চিনিতে পারিল ও যেরূপ অবস্থায় উহারা ওই বাগান ভাড়া লইয়াছিল, তাহার সমস্তই সে বলিল। 

মালতী কালিচরণকে দেখিবা মাত্রই কহিল, এই ব্যক্তি সকলকে ফুল বিতরণ করিয়াছিল, ও আমাকে তাহার গাড়িতে করিয়া লইয়া যায়। গঙ্গারামকে দেখিয়া কহিল, এই ব্যক্তিই তাহাকে ঘরের ভিতর আবদ্ধ করে। রামচরণকে দেখিয়া কহিল, আমাকে সময় সময় সেই ঘরের মধ্যে আহারীয় দিয়া আসিত। 

গয়ার মা উহাদিগের চারিজনকেই দেখিয়া চিনিতে পারিল, ও কহিল, উপর্যুপরি ৩।৪ দিবস সে উহাদিগকে ওই বাগানের ভিতর দেখিয়াছে। 

অনুসন্ধানে উহাদিগের উপর ক্রমে আরও অনেক সাক্ষ্য পাওয়া গেল। মেছুয়া বাজারে যে প্রথম এই ঘটনার ষড়যন্ত্র হয়, তাহারও প্রমাণ পাওয়া গেল। ফুল বিতরণের ও সেই স্থানে গাড়ি রাখার আরও প্রমাণ সংগৃহীত হইল। পুলিসের অনুসন্ধান শেষ হইলে উহারা বিচারার্থ প্রেরিত হইল। উচ্চ আদালতে উহাদিগের বিচার হইল। জজসাহেব ও জুরিগণ এই মোকদ্দমা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিলেন। আসামীগণের সকলেই দোষী সাব্যস্ত হওয়ায়, জজ সাহেব তাহাদিগের সকলকেই দীর্ঘকালের জন্য নির্বাসিত করিলেন। 

পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কৰ্ম্মচারী, প্রসন্নকুমারের জীবন রক্ষা করিয়াছেন বলিয়া গয়ার মাকে সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক প্রদান করিলেন ও সেই দিবস হইতে প্রসন্নকুমার গয়ার মাকে আপন গৃহে স্থান প্রদান করিয়া তাঁহাকে মাতৃবৎ সেবা করিতে লাগিলেন। 

সম্পূর্ণ 

[ পৌষ, ১৩১৭ (?) ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *