দস্তুরমতো পথ
“গুরুপরম্পরা অর্থাৎ সেই শক্তি যা গুরু হতে শিষ্যে আসে, আবার তাঁর শিষ্যে যায় তা ভিন্ন কিছুই হবার নয়। উড়ধা—আমি রামকৃষ্ণের শিষ্য, একি ছেলেখেলা নাকি?” স্বামীজী লিখছেন স্পষ্টভাষায়। স্বামীজী একটি ছেলে সম্পর্কে মঠের ভাইদের নির্দেশ দিচ্ছেন : “সেই যে বোম্বাই থেকে এক ছোকরা মাথা মুড়িয়ে তারকদার সঙ্গে রামেশ্বর যায়, সে বলে, আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য। রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য! না-দেখা, না-শোনা—একি চ্যাংড়ামো নাকি? গুরুপরম্পরা ভিন্ন কোন কাজ হয় না—ছেলেখেলা নাকি? সে ছোঁড়াটা যদি দস্তুরমতো পথে না চলে, দূর করে দেবে।”
একটি কথা পাওয়া গেল, ‘দস্তুরমতো পথ’। সেই পথটা কি? আমি রামকৃষ্ণের শিষ্য, এই বললেই হয়ে যাবে! দেওয়ালে তাঁর ছবি, একপাশে মা সারদা, অন্যপাশে স্বামীজী। মাঝে মাঝে মালা ঝোলাই। তাঁদের একটি-দুটি উক্তি আমার মনে লেগে আছে। সেইগুলোই কপচাই। লাগসই জায়গায় লাগিয়ে দিই। মুখে এমন একটা ভাব করে থাকি, যেন আমার পা দুটো শুধুমাত্র সংসারে আছে, মাথা ঠেকে আছে ‘রামকৃষ্ণলোকে’। স্বামীজী যাকে ‘দস্তুরমতো পথ’ বলছেন সে-পথে আংশিক সমর্পণ নয়। সম্পূর্ণ সমর্পণ। ছোটখাট সংস্কার নয়, সম্পূর্ণ সংস্কার। জীবনটাকে একেবারে ঢেলে সাজানো। চিন্তায়, ভাবনায়, জীবনচর্যায়, বিশ্বাসে, নিষ্ঠায় সম্পূর্ণ রূপান্তর। বাইরের লোক-দেখানো বিজ্ঞাপন নয়। জীবনটা কাপড়ের দোকানের শো উইন্ডো নয়। ভিতরের আগুনকে জ্বালাতে হবে। ‘স্পিরিচুয়াল ফায়ার’।
স্বামীজীর সেই প্রবল ধমক—”আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়।” আর কি করতে হবে? “লোকের সঙ্গে ঝগড়া করা নয়, সকলের সঙ্গে মিশতে হবে। ভাব ছড়া গাঁয়ে গাঁয়ে, ঘরে ঘরে যা—তবে যথার্থ কর্ম হবে। নইলে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা আর মধ্যে মধ্যে ঘণ্টা নাড়া, কেবল রোগবিশেষ। স্বাধীন হ, স্বাধীন বুদ্ধি খরচ করতে শেখ। অমুক তন্ত্রের অমুক পটলে ঘণ্টার বাঁটের যে দৈর্ঘ্য দিয়েছে, তাতে আমার কি?”
আচারের চেয়ে বিচার বড়। স্বয়ং ঠাকুর সেকথা বারে বারে বলেছেন। স্বামীজীর তেজ কোথা থেকে এসেছিল! ঠাকুরকে আমরা সদা ভাবাবিষ্ট, শান্ত, সমাহিত পুরুষ বলেই মনে করি। তাঁর চাবুকের মতো মহাসত্তার কথা অস্বীকার করতে চাই। ভুল। ঠাকুর কেন অবতার! অবতার আর মহাপুরুষে কি তফাত! মহাপুরুষ নিজের মুক্তি খোঁজেন, অবতার আসেন জীবকে মুক্তির সন্ধান দিতে। তিনি প্রয়োজনে চাবকান, বাক্যের দ্বারা বিদ্ধ করেন। শিক্ষিত ভণ্ড মানুষের, আত্মকেন্দ্রিক মানুষের মুখোশ তিনি পাকা সার্জেন যেভাবে ছুরি চালান, সেইভাবে সামান্য আঁচড়েই খুলে ফেলে দিতেন। ঠাকুর বিশাল বক্তৃতা দিতেন না, মহাদম্ভে বা দাপটে সকলকে হতচকিত করতেন না। তাঁর অস্ত্র ছিল গল্প, অস্ত্র ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যাওয়া। অস্ত্র ছিল প্রকৃত মানুষের সঙ্গে ভণ্ড মানুষ, ভোগী মানুষ, নীচ মানুষের তফাতটি ধরিয়ে দেওয়া। কিছু বলার প্রয়োজন নেই। দর্পণটি তুলে ধরামাত্রই সে বুঝতে পারবে-শকুন আকাশের বহু উঁচুতে ঘুরপাক খায় নজর থাকে ভাগাড়ে। পদ্মলোচনের শাঁখ। ভোঁ ভোঁ বাজে; কিন্তু মন্দিরে যে মাধব নেই। ঠাকুর হৃদয়কে বলছেন, হৃদে পালিয়ে আয় লোকটার পয়সা হয়েছে। এঁড়েদার ঘাটে বসে আছেন ভদ্রলোক, ঠাকুর নামছেন নৌকা থেকে। দেখে জিজ্ঞাসা করলেন : “কি ঠাকুর আছ কেমন?” তিন সন্ন্যাসী বসে আছেন। ঠাকুর দেখছেন। একজন আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে। ঠাকুরের মন্তব্য— “বিবাহিত সন্ন্যাসী তাই মেয়েদের দিকে অমন আড়ে আড়ে চাইছে।” ঠাকুর এমন সূক্ষ্মভাবে মানুষকে মানুষের উদাহরণ দিয়েই ধরিয়ে দিতেন, স্বামীজী যা সোচ্চারে বলেছেন—”একি চ্যাংড়ামো নাকি!” ঠাকুর ছিলেন মৃদু, অন্তর্ভেদী। স্বামীজী সেই গুরুপরম্পরায় বিস্ফোরক; কারণ ঠাকুর তাঁকে তৈরি করেছিলেন সেই ধারায়। যাতে তিনি আসল কথাটি বোমা ফাটানোর মতো বলতে পারেন- “রামকৃষ্ণ পরমহংস এমন ছিলেন, তেমন ছিলেন; আষাঢ়ে গপ্পি—গপ্পির আর সীমা-সীমান্ত নাই। হরে হরে, বলি একটা কিছু করে দেখাও যে তোমরা কিছু অসাধারণ—খালি পাগলামি! আজ ঘণ্টা হলো, কাল তার ওপর ভেঁপু হলো, পরশু তার ওপর চামর হলো, আজ খাট হলো, কাল খাটের ঠ্যাঙে রুপো বাঁধানো হলো—চক্রগদাপদ্মশঙ্খ—আর শঙ্খগদাপদ্মচক্র” ইত্যাদি।
আঘাতের পর আঘাত হানছেন স্বামীজী—”একেই ইংরেজীতে imbecility (শারীরিক ও মানসিক বলহীনতা) বলে—যাদের মাথায় ঐরকম বেলকোমো ছাড়া আর কিছু আসে না, তাদের নাম imbecile (ক্লীব)—ঘণ্টা ডাইনে বাজবে না বাঁয়ে, চন্দনের টিপ মাথায় কি কোথায় পরা যায়—পিদ্দিম দুবার ঘুরবে না চার বার—ঐ নিয়ে যাদের মাথা দিন-রাত ঘামতে চায়, তাদেরই নাম হতভাগা; আর ঐ বুদ্ধিতেই আমরা লক্ষ্মীছাড়া জুতোখেকো আর এরা ত্রিভুবনবিজয়ী। কুঁড়েমিতে আর বৈরাগ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।”
অতঃপর আবার কঠোরতর আঘাত—”যদি ভাল চাও তো ঘণ্টা- ফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান নর-নারায়ণের- মানবদেহধারী হরেক মানুষের পুজো করগে—বিরাট আর স্বরাট। বিরাট রূপ এই জগৎ, তার পুজো মানে তার সেবা—এর নাম কর্ম; ঘণ্টার ওপর চামর চড়ানো নয়, আর ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট বসব কি আধঘণ্টা বসব—এ বিচারের নাম ‘কর্ম’ নয়, ওর নাম পাগলা গারদ। ক্রোর টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন, তো এই ঠাকুর আঁটকুড়ির বেটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন; এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বিদ্যা বিনা মরে যাচ্ছে!”
‘দস্তুরমতো পথ’ ও নয়। দেহে মন্দির হও, মনের ইজারা দাও মাধবকে।