দশ লক্ষ পাউন্ডের ব্যাংক নোট
The £1,000,000 Bank-Note
আমার যখন সাতাশ বছর বয়স তখন আমি জনৈক খনির দালালের করণিক ছিলাম। স্টক লেন-দেনের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবেও আমাদের নাম ছিল। জগতে তখন আমি একা; নিজের বুদ্ধি আর সুনাম ছাড়া নির্ভর করবার মত আর কিছুই ছিল না। কিন্তু সেই পথ ধরেই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম।
শনিবার বিকেলটা ছিল সম্পূর্ণ আমার নিজের হাতে; সাধারণত ঐ সময়টা আমি উপসাগরে একটা ছোট পালতোলা নৌকাতেই কাটাতাম। একদিন সাহস করে কিছুটা বেশী দূর যেতে গিয়ে সমুদ্রে পড়ে গেলাম। ক্রমে রাত হল; প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছি; এমন সময় লণ্ডনগামী একটা দুই মাস্তুল ওয়ালা জাহাজ আমাকে তুলে নিল। ঝ ঞ ক্ষুব্ধ দীর্ঘ সে যাত্রা; আমার জাহাজ-ভাড়া হিসাবে তারা আমাকে দিয়ে সাধারণ নাবিকরে কাজ করিয়ে নিল। লণ্ডনে যখন জাহাজ থেকে নামলাম তখন আমার পোশাক নোংরা ও শতচ্ছিন্ন, আর পকেটে ছিল একটি মাত্র ডলার। সে টাকায় চব্বিশ ঘন্টা খাওয়া-থাকা চলল। পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টা অনাহারে ও অনাশ্রয়ে কাটল।
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় পোর্টল্যাণ্ড প্লেস ধরে পথ চলছিল, এমন সময় দাসীর হাত ধরে যেতে যেতে একটি শিশু মাত্র এক কামড় খাওয়া একটি মিষ্টি বড় নাসপাতি জঞ্জালের মধ্যে ফেলে দিল। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম; সেই নোংরা বস্তুটির দিকে আমার উৎসুক দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। মুখে জল এল, পেট খাই-খাই করতে লাগল, সমস্ত সত্তা দিয়ে আমি ওটাকে নিতে চাইলাম। কিন্তু যতবার ওটাকে নেবার চেষ্টা করি ততবারই কোন না কোন পথচারীর চোখ আমার উপর এসে পড়ে, আর আমিও খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কতার ভান করি। এই একই ঘটনা বারবার ঘটতে লাগল, আর আমিও ন্যাসপাতিটা নিতে পারলাম না। ক্রমে এক সময় আমার পিছনের বাড়ির একটা জানালার পর্দা উঠে গেল, আর সেখান থেকে একটি ভদ্রলোক বলে উঠলছ:
দয়া করে ভিতরে আসুন।
ঝকঝকে উর্দিপরা খানসামা দরজা খুলে দিয়ে আমাকে একটা সুসজ্জিত ঘরে নিয়ে গেল। দুটি বয়স্ক ভদ্রলোক সেখানে বসে ছিল। চাকরকে পাঠিয়ে দিয়ে তারা আমাকে বসতে বলল। এইমাত্র তাদের প্রাতরাশ শেষ হয়েছে; ভূক্তাবশিষ্ট ভোজ্যগুলি আমাকে প্রায় অভিভূত করে ফেলল। এ সব খাবার দেখে মাথা ঠিক রাখা আমার পক্ষে তখন খুবই শক্ত; কিন্তু যেহেতু তারা আমাকে সেগুলি চেখে দেখতে বলল না, তাই অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলাম।
আসলে ব্যাপার হচ্ছে একটু আগেই সেখানে এমন কিছু ঘট ছিল যার কথা তখন আমি কিছুই জানতাম না; জানলাম বেশ কিছুদিন পরে; সেই কথাই এবার আপনাদের বলব। দুদিন আগে এই দুটি বয়স্ক প্রবীণ ভাইয়ের মধ্যে কোন একটা বিষয় নিয়ে বেশ গরম-গরম তর্ক হয়েছিল এবং সব বিতর্ক মিটিয়ে নেবার বৃটিশ প্রথা অনুসারেই তারা একটা বাজী ধরে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে একমত হয়।
আপনাদের হয়তো স্মরণ আছে, এক সময় ব্যাংক অব ইংলণ্ড দশ লক্ষ পাউণ্ডের দুখানা নোট বের করেছিল। অন্য একটি দেশের সঙ্গে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনে-দেনের বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্যই নোট দুখানি বের করা হয়েছিল। যে কোন কারণেই হোক তার একখানি নোট ব্যবহার করা হয়েছিল, কিন্তু অপরখানি তখনও ব্যাংকের সিন্দুকেই ছিল। এখন, কথায় কথায় দুই ভাইয়ের মাথায় হঠাৎ এই অদ্ভুত চিন্তাটা ঢুকল যে, যদি কোন সম্পূর্ণ সৎ ও বুদ্ধিমান নবাগত লোক ঘটনাচক্রে নির্বান্ধব অবস্থায় লণ্ডনে এসে হাজির হয় এবং ঐ দশ লক্ষ পাউণ্ডের নোট খানি ছাড়া আর কোন টাকা তার কাছে না থাকে এবং নোট খানা কি ভাবে তার কাছে এল তারও কোন কারণ দর্শাতে সে না পারে তাহলে তার কপালে কি ঘটতে পারে। ভাই ক বলল, সে না খেয়ে মারা যাবে। ভাই খ বলল, না, তা হবে না। ভাই ক বলল লোকটি ঐ নোট খানা কোন ব্যাংকে বা অন্য কোথাও দেখাতে পারবে না, কারণ তাহলে তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এইভাবে তর্ক হতে হতে এক সময় ভাই খ বলল, বিশ হাজার পাউ ও বাজী রেখে সে বলেছে যে ঐ দশ লক্ষের দৌলতে লোকটি ত্রিশ দিন বেঁচে থাকবে এবং জেলখানার বাইরেও থাকবে। ভাই ক রাজী হল। ভাই খ ব্যাংকে চলে গেল এবং নোট খানা কিনে ফেলল। একজন ইংরেজের মতই কাজ বটে। তারপর তার একজন করণিককে দিয়ে গোল গোল হস্তাক্ষরে একখানি চিঠি লেখাল। সেই থেকে দুই ভাই সারা দিন জানালায় বসে আছে,-এমন একটি লোককে খুঁজছে যাকে এটা দেওয়া যায়।
তারা অনেক লোককে যেতে দেখল যাদের মুখে সতোর ছাপ আছে, কিন্তু তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান নয়; আবার অনেকে বুদ্ধিমান হলেও যথেষ্ট সৎ নয়। অনেকের আবার দুটো গুণ থাকলেও তারা যথেষ্ট গরীব নয়, বা গরীব হলেও নবাগত লোক নয়। কোন না কোন একটা এটি বেরিয়েই পড়ছিল, এমন সময় আমি হাজির হলাম। সব কিছুই তাদের মনোমত হল এবং দুজনের সম্মতিক্রমেই আমি নির্বাচিত হলাম। আর তাই কি জন্য আমাকে ডাকা হয়েছে সেটা জানবার জন্য আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। তারা আমার সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন করে অচিরেই আমার সব কথা জেনে নিল। শেষ পর্যন্ত তারা জানাল যে, আমাকে দিয়ে তাদের কাজ চলবে। খুবই খুসি হয়ে জানতে চাইলাম, কাজটা কি। তখন একজন আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, ওর মধ্যেই সব কথা লেখা আছে। খামটা খুলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে বলল, না; আমি যেন খামটা নিয়ে আমার বাসায় চলে যাই এবং যত্ন সহকারে সব কথা পড়ি ও কোন। তাড়াহুড়া না করি। বিচলিত বোধ করে বিষয়টা নিয়ে আর একটু আলোচনা করতে চাইলাম, কিন্তু তারা তাতে রাজী হল না। অগত্যা সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমাকে এ রকম একটা কঠোর ঠাট্টার বিষয়বস্তু করে তোলায় মনে খুব আঘাত পেলাম; অপমানিত বোধ করলাম; কিন্তু অর্থবান ও শক্তিমান মানুষদের আঘাতের জবাবে প্রত্যাঘাত করার মত অবস্থা আমার নয় বলে বাধ্য হয়ে সব কিছু সয়ে গেলাম।
এবার হয়তো জগতের সকলের চোখের সামনেই ন্যাসপাতিটা তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলতাম, কিন্তু ততক্ষণে সেটাও উধাও হয়ে গেছে; একটা দুর্ভাগ্যজনক প্যাঁচে পড়ে এটাও হারালাম; এ কথা ভেবে ঐ দুটি লোক সম্পর্কে আমার মনোভাব আরও কঠোর হয়ে উঠল। ঐ বাড়িটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়া মাত্রই খামটা খুলে দেখলাম তার মধ্যে টাকা রয়েছে! আপনাদের বলছি, সঙ্গে সঙ্গে লোক দুটি সম্পর্কে আমার মনের ভাব বদলে গেল। মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে নোট ও টাকা-পয়সা ভেস্টের পকেটে ঢুকিয়ে একটা সম্ভার খাবার দোকানে ঢুকে পড়লাম। আঃ, কী খাওয়াই খেলাম! তারপর খামের ভিতর থেকে সব কিছু বের করে নোটের ভাঁজ খুলে এক নজর দেখেই আমার মূৰ্ছা যাবার উপক্রম হল। পঞ্চাশ লক্ষ ডলার! ওরে বাবা! আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল।
নোটটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রায় এক মিনিট স্থানুর মত বসে ছিলাম; তারপর আমার সম্বিত ফিরে এল। তারপরেই প্রথম চোখে। পড়ল দোকানের মালিককে। চোখ দুটো নোটের উপর রেখে সেও যেন পাথর হয়ে গেছে। সমস্ত দেহ-মন দিয়ে সে যেন প্রার্থনা করছে, কিন্তু তাকে দেখে মনে হল সে যেন হাত-পা কিছুই নাড়তে পারছে না। মুহূর্তের মধ্যেই আমার কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। নোট টা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে নির্বিকারভাবে বললাম:
দয়া করে এটা ভাঙিয়ে দিন!
তখন তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এল। নোট টাকে সে কিছুতেই ছুঁল না; বরং ওটা ভাঙিয়ে দিতে না পারার জন্য হাজারবার ক্ষমা চাইতে লাগল। সে বারবার নোট টাকে দেখতে চাইল, দেখে দেখে যেন তার আশা মিটছে না; কিন্তু নোট টাতে কিছুতেই হাত লাগাল না, যেন বস্তুটি এতই পবিত্র যে সাধারণ মানুষের মাটির হাত দিয়ে ওটাকে ছোঁয়া উচিত নয়। আমি বললাম:
আপনার অসুবিধার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু আমিও নাচার। দয়া করে এটা ভাঙিয়ে দিন। আমার কাছে আর কিছু নেই।
কিন্তু সে বলল, তাতে কি; এই সামান্য বিলের টাকা পরে যে কোন সময় পেলেই তার চলবে। আমি বললাম, বেশকিছুদিনের মধ্যে আমার হয় তো আর এ অঞ্চলে আসা হবে না; কিন্তু সে বলল, তার জন্য কি; সে ততদিন অপেক্ষা করতে পারবে; তাছাড়া, আমার যা কিছু দরকার, যখন দরকার আমি নিতে পারি, আর হিসাবটাও আমার যতদিন খুসি বাকি রাখতে পারি। সে আরও বলল, পোশাকের ব্যাপারে লোকের চোখে ধূলো দিয়ে বেড়াতে ভালবাসি বলে যে আমার মত একজন ধনী ভদ্রলোককে বিশ্বাস করতে পারবে না এমন লোক সে নয়। সেই সময় আরও একজন খদ্দের ঘরে ঢুকতেই সে আমাকে ইঙ্গিতে ঐ শয়তানটার দৃষ্টির আড়ালে যেতে বলল এবং আমাকে নমস্কার করতে করতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। আমি সেখান থেকে সোজা গিয়ে হাজির হলাম সেই দুই ভাইয়ের বাড়িতে পুলিশের হাতে পড়বার আগেই তাদের ভুলটা শুধরে দেওয়াই ভাল। আমার কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল; আসলে বেশ ভয়ই পেয়েছিলাম, যদিও এ ব্যাপারে আমার কোন দোষই ছিল না; কিন্তু মানুষকে তো আমি ভাল করেই চিনি; তারা যখন দেখবে যে এক পাউণ্ডের নোট মনে করে একখানা দশ লাখ পাউণ্ডের নোট তারা একটা ভবঘুরে লোককে দিয়ে ফেলেছে, তখন নিজেদের ক্ষীণ দৃষ্টিতে দোষ না দিয়ে তারা প্রচণ্ড রেগে যাবে সেই লোকটার উপর। বাড়িটার কাছে গিয়ে কিন্তু আমার উত্তেজনা অনেকটা হ্রাস পেল, কারণ সেখানে তখন সকলেই চুপচাপ; তাতেই বুঝতে পারলাম যে ভুলটা তখনও ধরা পড়ে নি। ঘন্টা বাজালাম। সেই চাকরটাই এল। আমি ভদ্রলোক দুজনের খোঁজ করলাম।
তারা চলে গেছেন।
চলে গেছেন? কোথায় গেছেন?
বেড়াতে।
কোথায়?
মনে হয়, ইওরোপীয় মহাদেশে।
মহাদেশে?
হ্যাঁ স্যার।
কোন্ পথে-মানে কোন্ রুটে?
তা বলতে পারব না স্যার।
তারা কখন ফি রবেন?
বলেছেন তো মাসখানেকের মধ্যে।
এক মাস! এ যে সাংঘাতিক কথা! কি করে তাদের সঙ্গে একবার কথা বলা যায় বলতে পার? ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী।
আমি তো কিছুই বলতে পারব না। তাঁরা যে কোথায় গেছেন সে বিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই।
তাহলে তাদের পরিবারের কারও সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।
পরিবারের সকলে আগেই চলে গেছেন: মাসখানেক হয়ে গেল-মনে হয় মিশর ও ভারতবর্ষেই গেছেন।
দেখ বাপু, একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। তারা হয়তো রাতের আগেই ফিরে আসবেন। তখন তাদের বলে দিও, আমি এসেছিলাম, এবং ভুলটা সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝেই আসব। তারা যেন কোন রকম ভয় না করেন।
তারা এলে বলব, তবে আসবেন বলে মনে হয় না। তারা বলেই গেছেন যে, এক ঘন্টার মধ্যেই আপনি এখানে এসে তাদের খোঁজ করবেন, আর তখন আমাকে বলতে হবে যে সব ঠিক আছে; যথাসময়েই তারা এখানে ফিরে এসে আপনার জন্য অপেক্ষা করবেন।
কাজেই তাদের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম। কী যে গোলক ধাঁধায় পড়লাম! মাথা খারাপ হবার জোগাড়! যথাসময়ে তারা এখানে আসবেন। তার অর্থ কি? ওহো, চিঠি টা থেকে হয় তো কিছু জানা যাবে। চিঠির কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। বের করে পড়লাম। চিঠিতে এই রকম লেখা ছিল:
মুখ দেখলেই বোঝা যায় তুমি বুদ্ধিমান ও সৎ লোক। আমাদের ধারণা, তুমি গরীব ও নবাগত। এই সঙ্গে কিছু টাকা দিলাম। ত্রিশ দিনের জন্য বিনা সুদে এটা তোমাকে ধার দেওয়া হল। ঐ সময়ের পরে এই বাড়িতে এসে দেখা করো। তোমাকে নিয়ে একটা বাজী ধরেছি। আমি যদি জিতি, তাহলে আমার সাধ্যায়ত্ত যে কোন একটা কাজ তুমি পাবে-যে কোন কাজ বলতে, যে কাজ তুমি জান এবং ভালভাবে করবার যোগ্যতা রাখ।
কোন স্বাক্ষর নেই, ঠিকানা নেই, তারিখ নেই।
এ তো দেখছি আরও গাডড়ায় পড়লাম। কী খেলা চলছে তার কিছুই জানি না; আমার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা, না কি আমার প্রতি করুণা হচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। একটা পার্কে গিয়ে বসলাম। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবলাম। কি করা উচিত তাও ভাবলাম।
ঘন্টাখানেক চিন্তা-ভাবনার পরে এই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হলাম।
হয় তো লোক দুটি আমার ভাল করতে চাইছে, হয় তো মন্দ করতে চাইছে; সেটা বুঝবার কোন উপায় নেই-অতএব সে কথা থাক। তাদের মাথায় একটা কোন খেলা, একটা মতলব, একটা পরীক্ষার ধান্দা চলছে; সেটা যে কি তাও বুঝ বার কোন উপায় নেই-অতএব সেটাও থাক। আমাকে নিয়ে একটা বাজী ধরা হয়েছে; সেটা যে কি তাও জানবার উপায় নেই-অতএব সে কথাও থাক। অনিশ্চয়তার ব্যাপারগুলির এখানেই ইতি; বাকি অংশটা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই পড়ছে এবং সেটাকে নিশ্চিতভাবে অনুমান করাও চলে। যদি ব্যাংক। অব ইংলণ্ড-এ গিয়ে এই বিলটা দেখিয়ে মালিকের নামে জমা দিতে চেষ্টা করি, তাহলে ব্যাংক সে কাজটা করবে, কারণ সেই মালিককে আমি না চিনলেও ব্যাংক চেনে; কিন্তু তারা জানতে চাইবে বিলটা আমার হাতে কেমন করে এল; তখন আমি যদি সত্য কথা বলি তাহলে স্বাভাবতই তারা আমাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেবে আর মিথ্যা বললেও আমার জেল অনিবার্য। আবার যদি বিলটা কোথাও ভাঙাতে চেষ্টা করি, বা এটাকে রেখে টাকা ধার করি, তাহলেও ঐ একই ফল হবে। কাজেই আমি চাই বা না চাই, লোক দুটি ফিরে না আসা পর্যন্ত এই বিরাট বোঝা আমাকে বয়ে বেড়াতেই হবে। বিলটা আমার পক্ষে একেবারেই অকেজো, এক মুঠো ছাইয়ের মতই অকেজো; তবু এটাকে সযত্নে রেখে দিতে হবে এবং ভিক্ষা করে জীবন চালিয়েও এটার উপর সতর্ক নজর রেখে চলতে হবে। এটা কাউ কে দেওয়াও চলবে না; যদি সে চেষ্টা করি, তাহলেও কোন সৎ নাগরিক বা কোন গুণ্ডা-ডাকাত, কেউ ই এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইবে না। এ ব্যাপারে দুই ভাই সম্পূর্ণ নিরাপদ। বিলটা যদি হারিয়ে ফেলি বা পুড়িয়ে ফেলি, তাহলেও তারা নিরাপদ, কারণ তারা ব্যাংককে বলে টাকা দেওয়া বন্ধ করতে পারবে; কিন্তু ইতিমধ্যে পুরো একটা মাস বিনা বেতনে, বিনা লাভে আমাকে সব কষ্ট সহ্য করে চলতে হবে-যতদিন না সেই অজানা বাজীটা জিততে আমি সাহায্য করতে পারি এবং তার ফলে প্রতিশ্রুত চাকরিটা পেয়ে যাই। চাকরিটা তো অবশ্যই পেতে চাই; তাদের মত লোকের হাতে তো ভাল চাকরিই থাকবার কথা।
চাকরি না পেয়েই অনেক কিছু ভাবতে লাগলাম। মনের আশা ক্রমেই উঁচুতে উঠতে লাগল। মাইনেটা বেশ মোটা হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এক মাসের মধ্যেই তো চাকরিটা পেয়ে যাচ্ছি; তার পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অচিরেই মন-মেজাজ বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। ইতিমধ্যে আবার রাস্তায় বের হতে শুরু করেছি। একটা দর্জির দোকান দেখতে পেয়ে ভারী ইচ্ছা হল এই ছেঁড়া পোশাক ছেড়ে আবার ভদ্রলোকের মত পোশাক পরি। কিন্তু টাকা আছে কি? না, দশ লাখ পাউণ্ড ছাড়া আমার কিছুই নেই। কাজেই নিজেকে জোর করে ঠেলে নিয়ে চললাম। শ্রীঘ্রই আবার ফিরে এলাম। লোভ আমাকে নির্মম ভাবে তাড়া করতে লাগল। এই প্রচণ্ড আত্ম-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছবার দোকানটাকে এ-পার ও-পার করলাম। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলাম। দিতেই হল। জানতে চাইলাম, তাদের হাতে কোন বে-মাপের স্যুট আছে কি না। যাকে কথাগুলি বললাম সে আর একটি লোকের দিকে ঘাড়টা বাড়িয়ে দিল, কিন্তু আমার কথার কোন জবাব দিল না। তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে আর একজনের দিকে ঘাড়টা হেলিয়ে দিল, মুখে কিছু বলল না। তার কাছে যেতেই সে বলল:
একটু পরে আপনার সঙ্গে কথা বলছি।
তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে রইলাম। তারপর সে আমাকে একটা পিছনের ঘরে নিয়ে গেল এবং এক বোঝা দামী সট বের করে সব চাইতে খারাপটা আমার জন্য বেছে দিল। গায়ে দিলাম। মাপমত হল না, দেখতেও ভাল লাগল না, তবে জিনিসটা নতুন বলেই আমার মনকে টানল; তাই কোন রকম আপত্তি না করে বরং একটু সংকোচের সঙ্গেই বললাম:
দামটার জন্য আপনারা যদি কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেন তাহলে বড় ভাল হয়। আমার কাছে খুচরো টাকা নেই।
মুখে একটা অদ্ভুত বিদ্রুপের ভঙ্গী ফুটিয়ে লোকটি বলল:
ওঃ, নেই বুঝি? অবশ্য থাকবে যে সে আশাও আমি করি নি। আপনার মত ভদ্রলোকদের কাছে তো মোটা টাকাই থাকার কথা।
বিরক্ত গলায় জবাব দিলাম, দেখুন বন্ধু পরনের পোশাক দেখেই একজন অপরিচিত লোকের বিচার করতে নেই। এই সমুট টার দাম আমি অবশ্যই দিতে পারি; শুধু একটা বড় নোট ভাঙানোর অসুবিধায় আপনাকে ফেলতে চাইছিলাম না।
ভঙ্গীটাকে ঈষৎ বদলালেও আগেকার মতই সে বলল:
আপনাকে আঘাত দেবার ইচ্ছা আমার ছিল না; আর তিরঙ্কুরের কথাই যদি তুললেন তো বলি, যে মাপের নোট আপনার সঙ্গে আছে সেটা ভাঙিয়ে দিতে আমরা পারব কি না সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াটা আপনার কাজ নয়। আসলে আপনার নোট টা আমরা ভাঙিয়ে দিতে পারব।
নোট টা তার হাতে দিয়ে বললাম:
ওঃ, খুব ভাল কথা; আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
পুকুরে একটা ইট ফেললে যে রকম চারদিকে একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে তেমনি বিস্ফোরিত হাসি ফুটিয়ে লোকটি নোটটা হাতে নিল; কিন্তু নোট খানির উপর নজর পড়তেই সে হাসি জমাট বেঁধে হলুদ বর্ণ ধারণ করল; মনে হল বুঝি ভিসুভিয়াসের মুখ থেকে উদগারিত লাভা সেখানে জমাট বেঁধে আছে। একটা হাসিকে এ ভাবে সহসা থেমে যেতে আমি কখনও দেখি নি। বিলটা হাতে নিয়ে লোকটি দাঁড়িয়েই ছিল; ব্যাপার কি জানবার জন্য এগিয়ে এসে মালিক বলল:
আরে, ব্যাপার কি? গোলমালটা কিসের? কি চাই?
আমি বললাম: গোলমাল কিছু নেই। আমি নোটের ভাঙানির জন্য অপেক্ষা করছি।
বেশ তো; ভাঙানিটা দিয়ে দাও টড, ভাঙানিটা দিয়ে দাও।
টড পাল্টা জবাব দিল: ভাঙানিটা দিয়ে দাও! কথাটা বলা খুবই সহজ স্যার; নিজে একবার হিলটা দেখুন।
মালিক বিলটা একবার দেখে নিয়েই একটা না একটা শিস দিয়ে উঠল, আর তার পরেই বাতিল স্যুটের বস্তাটার উপর লাফিয়ে পড়ে একটার পর একটা স্যুট টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে নিজের মনেই উত্তেজিতভাবে বলতে লাগল:
একজন অসাধারণ লাখপতি লোককে কেউ এমন অখাদ্য সট বেচে! টড একটা মুখখু-জন্ম-মুখখু। ওর রকম-সকমই এই রকম। কোন লাখপতি খদ্দের এলেই তাকে এখান থেকে তাড়িয়ে তবে ছাড়বে; আর তার কারণও আছে-ও যেন একজন লাখপতি আর একটা বাউণ্ডুলের তফাৎই বোঝে না-কোন দিন না। আমি দেখছি স্যার। দয়া করে পরনের পোশাকগুলো খুলে ফেলুন, আগুনে ফেলে দিন। এই সার্ট আর স্যুট টা আপনাকে পরাবার অনুমতি দিন; ঠিক এই জিনিসই তো চাই, ঠিক এই জিনিস-সাদাসিধে, দামী, গুরুগম্ভীর, অভিজাত একজন বিদেশী রাজপুত্রের জন্য তৈরি করা হয়েছিল-আপনি হয়তো তাকে চিনবেন স্যার, হ্যাঁলিফ্যাক্স-এর। মহামহিম হস্পোদার, এটা আমাদের কাছে রেখে একটা শোক-পক সুট নিয়ে গেলেন, কারণ তার মায়ের মৃত্যু তখন আসন্ন-অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান নি। কিন্তু-বাঃ, বেশ মানিয়েছে; ট্রাউজারটাও চমৎকার মাপমত হয়েছে; এবার ওয়েস্টকোট; আহা, এবারও চমৎকার! এবার কোট–হায় প্রভু! একবার তাকিয়েই দেখুন! একেবারে ঠিকঠাক! সারা জীবনে এমন মপমত পোশাক আমি কখনও দেখি নি।
আমি সন্তোষ প্রকাশ করলাম।
ঠিক বলেছেন স্যার, ঠিক বলেছেন; আপাতত এতেই চলে যাবে। তারপর দেখুন না আপনার মাপতম আমরা কী জিনিস বানিয়ে দিই। এস হে ট ড, খাতা-কলম নিয়ে এস। লেখ-পায়ের ঝুল ৩২ – ইত্যাদি। আমাকে একটা কথাও বলার সুযোগ না দিয়ে সে অনবরত আমার মাপ নিতে লাগল আর ড্রেস-সুট, মনিং-স্যুট, শার্ল ও আরও সব কিছুর অর্ডার নিখে নিতে লাগল। এক সময়ে সুযোগ পেয়ে আমি বললাম:
কিন্তু মশায়, আপনি যদি অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা না করেন, অথবা এই বিলটা ভাঙি য়ে না দেন, তাহলে তো এ সব অর্ডার আমি দিতে পারব না।
অনির্দিষ্টকাল! ওটা তো একটা কথাই নয় স্যার। বলুন অনন্তকাল-হ্যাঁ, এটাই লাগসই কথা। টুড, এই অর্ডার গু লি তাড়াতাড়ি তৈরি করে অবিলম্বে ভদ্রলোকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও। ছোট খাট খদ্দেরদের না হয় কদিন দেরী হবে। ভদ্রলোকের ঠিকানাটা লিখে নাও, আর-
আমি শিগগির বাড়ি বদলাবো। নিজেই এসে নতুন ঠিকানাটা দিয়ে যাব।
ঠিক আছে স্যার, ঠিক আছে। একটা মিনিট– চলুন স্যার। আপনাকে বাইরে পৌঁছে দিয়ে আসি। আচ্ছা-শুভদিন স্যার, শুভদিন।
এরপর কি যে ঘটতে পারে সে তো বুঝতেই পারছেন? আমার যা কিছু দরকার তাই কিনতে লাগলাম আর ভাঙনি চাইতে লাগলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনীয় আরাম ও বিলাসের সব রকম সামগ্রী আমার হাতে এসে গেল, আর হ্যাঁনোভার স্কোয়ার-এর একটা ব্যায়বহুল হোটেলে আমি বাসা বাঁধলাম। রাতের খাবারটা সেখানেই খাই, কিন্তু প্রাতরাশটা সারি হ্যারিস-এর সেই সাধারণ ভোজনালয়ে যেখানে দশ লাখ পাউণ্ডের নোট দেখিয়ে প্রথম খানা খেয়েছিলাম। আমার জন্য হ্যারিস-এরও বরাত ফিরে গেছে। চারদিকে জনরব রটে গেছে, যে আধ-পাগলা বিদেশী ভেস্টের পকেটে দশ লাখ পাউণ্ডের বিল নিয়ে ঘোরে সে হচ্ছে এই দোকানের আসল মুরুব্বি। বাস, তাতেই হয়ে গেল। যে হোটেল চালিয়ে হ্যারিস-এর কোনরকমে দিন গুজরান হচ্ছিল, সেই হোটেলই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়েছে, সকাল-সন্ধা সেখানে লোকের ভীড় উপচে পড়ছে। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে আমাকে টাকাও ধার দিচ্ছে; না করলে শোনে না; কাজেই পথের ফকির হয়েও আমার হাতে অঢেল টাকা; খরচ করতে লাগলাম যথেষ্ট বড়লোকদেরই মত। জানি, একদিন এ তাসের ঘর ভেঙে পড়বে, কিন্তু একবার যখন জলে নেমেছি, তখন সাঁতার তো কাটতেই হবে, নইলে তো সলিল-সমাধি অনিবার্য। রাতের অন্ধকারে এই বিপদের দিকটাই সামনে এসে দাঁড়ায়, কুটি করে, ভয় দেখায়; আমি আর্তনাদ করি, ছট ফট করি, চোখে ঘুম আসে না। কিন্তু দিনের আলোয় এই দুঃখের দিনটা মিলিয়ে যায়, বেশ চালের উপর হেঁটে বেড়াই, সুখের নেশায় মেতে উঠি।
আর এটাই তো স্বাভাবিক। পৃথিবীর এই বৃহৎ শহরের আমি একটি অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে উঠেছি, আর তাতেই আমার মাথা ঘুরে গেছে-একটু খানি নয়,অনেকখানি। ইংরেজী, স্কচ, বা আইরিশ ভাষায় এমন একখানি খবরের কাগজও আপনি পাবেন না যাতে ভেস্ট-পকেটে লাখ পাউণ্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই লোকটির কথা এবং তার সর্বশেষ কার্যকলাপের কথার একাধিক উল্লেখ নেই। প্রথম প্রথম আমার নামের উল্লেখ থাকত ব্যক্তিগত চুটকির কলমে; তারপর আমার স্থান হল নাইট দের উপরে, ক্রমে ব্যারনেট দের উপরে, ব্যারনদের উপরে-এমনি করে ধীরে ধীরে উঠতে উঠতে আমার খ্যাতি বাড়তে বাড়তে একেবারে তুঙ্গে উঠে গেল। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, এতদিন পর্যন্ত আমি যা পেয়েছি তা যশ নয়, তাকে বলা যেতে পারে অখ্যাতি। কিন্তু তারপরেই এল চরম পদক্ষেপ-অভিষেকও বলা যেতে পারে-যার ফলে আমার ভঙ্গুর অখ্যাতির সব মালিন্য মুহূর্তের মধ্যে ঘুচে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল যশের শাশ্বত সুবর্ণ দিপ্তী। পঞ্চ -এ আমার ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হল! হ্যাঁ, এতদিনে আমি মানুষ হলাম; আমার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত হল। এখন আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা চলে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে মিশে থাকে শ্রদ্ধা, কঠোরতা নয়; আমাকে দেখে লোকে হাসে স্মিত হাসি, অট্টহাসি নয়। সে দিন চলে গেছে। পাঞ্চ -এ আমাকে এমনভাবে আঁকা হয়েছে যেন ছেঁড়া পোশাক পরে জনৈক গোমাংস-খাদকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি টাওয়ার অব লণ্ডন-এর দিকে ছুটে চলেছি। কল্পনা করুন তো, যে যুবকটি কোন খোঁজই এতদিন কেউ রাখত না, আজ হঠাৎ সে যে কথা বলে তাই সকলের মুখে মুখে ফেরে, যেখানে যায় সেখানেই শোনে একই চুপি-চুপি কথা, ঐ যে তিনি যাচ্ছেন; ঐ তো তিনি! সে যখন প্রাতরাশে বসে সকলে তার চারদিকে ভীড় করে দাঁড়ায়, যখন কোন অপেরা-বক্সে গিয়ে বসে তখনই হাজারটা অপেরা-গ্লাস তার মুখের উপর পড়ে। এক কথায় বলতে গেলে-সারাটা দিনই আমি যেন গৌরবের সাগরে ভেসে বেড়াতে লাগলাম।
কি জানেন, পুরনো ছেঁড়া সট টা তখনও রেখে দিয়েছি; মাঝে মাঝে সেটা পড়ে বের হই এবং মজা করবার জন্যই টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে প্রথমে অপমানিত হই এবং তারপরেই দশ লাখপাউণ্ডের বিলটা বিক্রেতার মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে তাকে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলি। কিন্তু এ খেলা বেশীদিন চালাতে পারলাম না। সচিত্র পত্র-পত্রিকাগুলোর দৌতলে পোশাকটা এতই পরিচিত হয়ে উঠল যে সেটা পরে বাইরে গেলেই ভীড় জমে যেত এবং কোন কিছু কিনতে গেলেই দোকানী সব কিছুই ধারে দেবার জন্য এমনভাবে উঠে পড়ে লাগত যে নোট টা বের করবার ফুরসুতই পেতাম না।
যশ লাভের দশম দিবসে জাতীয় পতাকার প্রতি কর্তব্যের খাতিরে মার্কিন মন্ত্রীমহোদয়কে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলাম। যথাযোগ্য সমাদরের সঙ্গেই সে আমাকে গ্রহণ করল, আমার কর্তব্যপরায়ণতার ভূয়সী প্রশংসা করল এবং সেদিনকার ভোজসভায় যোগ দেবার জন্য আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাল। দুজনে নানা কথা হল। কথাপ্রসঙ্গে জানলাম মন্ত্রী ও আমার বাবা বাল্যকালে সহপাঠী ছিল, পরে ইয়েল-এও এক সঙ্গে পড়েছে, এবং বাবার মৃত্যুকাল পর্যন্ত দুজনই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তাই সে আমাকে অনুরোধ করল, সময় পেলেই যেন আমি তার বাড়িতে যাই ও কিছু সময় কাটাই; আমিও সানন্দেই রাজী হলাম।
বস্তুত, শুধু রাজী নয়, এতে আমি খুসিও হলাম। এই খেলাঘর যখন ভাঙবে তখন হয় তো এই মন্ত্রী আমাকে সমূহ বিনষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে পারবে; সেটা কি ভাবে সম্ভব হবে তা আমি জানি না। তবে যা হোক একটা পন্থা সেই বের করতে পারবে। লণ্ডনে আসার পরেই তার সঙ্গে দেখা হলে হয়তো মনের সব কথাই খোলাখুলি তাকে বলতাম, কিন্তু এত বিলম্বে তাকে সব কথা বলবার সাহস আমার হল না; এখন যে আমি গভীর জলে পড়ে গিয়েছি; এখন আর কোন নবপরিচিতকে আত্মপরিচয় দেওয়া চলে না। অবশ্য জল। যত গভীরই হোক, এখনও একেবারে অথৈ জলে পড়ি নি, কারণ ধার-কর্জ যতই যা করে থাকি, আমি আমার সাধ্যের মধ্যেই চলতে চেষ্টা করছি-তার অর্থ আমার মাইনের মধ্যেই। অবশ্য আমার মাইনে কত হবে তা আমি জানি না, তবে ধনী ভদ্রলোকের সামর্থ্য ও আমার উপযুক্ততার কথা বিবেচনা করে একটা ধারণা তো করতেই পারি। আমার ধারণা মতে মাইনে হবে বছরে ছ শ থেকে হাজার; অর্থাৎ প্রথম বছর ছ শ, এবং যোগ্যতার প্রমাণের ভিত্তিতে বছর বছর বাড়তে বাড়তে সেটা উর্ধ সীমায় গিয়ে পৌঁছবে। সেদিক থেকে দেখতে হলে আমার বর্তমান ঋণের পরিমাণ প্রথম বছরের মাইনের সম পরিমাণ। সকলে আমাকে টাকা ধার দিতে চেষ্টা করছে, আমিই নানা ছুতোনাতায় তাদের এড়িয়ে চলেছি। আমার ঋণের পরিমাণ শ পাউণ্ড নগদ ধার, আর তিন শ পাউণ্ড থাকা-খাওয়া ও কেনাকাটার ব্যয়। কাজেই বাহুল্য খরচ বাঁচিয়ে সাবধান মত চলালে দুবছরের মাইনেতেই আমি সব বিলি ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব। এই ভাবে একটি মাস শেষ হয়ে যাবে, আমার ভাবী মনিব ভ্রমণ শেষ করে ফিরে আসবে, আবার আমি সুদিনের মুখ দেখতে পাব।
চোদ্দ জনের একটি মনোরম ভোজ-সভা। শোরডি চ-এর ডিউক ও ডাচেস এবং তাদের কন্যা লেডি আন-গ্রেস-ইলিনর-সেলেসিট-ইত্যাদি-ইত্যাদি-দ্য-বোহান, নিউ গোট–এর আর্ল ও কাউন্টে স, ভাইকাউট চীপসাইড, লর্ড ও লেডি ব্ল্যাথারস্কইট, কিছু উপাধিবিহীন নারী-পুরুষ, মন্ত্রী ও তার স্ত্রী এবং কন্যা, ও সেই কন্যার বাইশ বছরের ইংরেজ বান্ধবী পোশিয়া ল্যাংহাম। দু মিনিটের মধ্যেই আমি সেই বান্ধবীটির প্রেমে পড়ে গেলাম। আর বিনা চশমাতেই দেখতে পেলাম যে সেও আমার প্রেমে পড়ে গেল। সেখানে আরও একজন অতিথি ছিল, একজন মার্কিন-কিন্তু আমি গল্পের সুতোটা হারিয়ে ফেলছি। ক্ষুধা বাড়াবার জন্য সকলেই যখ বসবার ঘরে অপেক্ষা করছে এবং বিলম্বে আগতদের ঠাণ্ডা চোখে দেখছে, এমন সময় চাকর এসে ঘোষণা করল:
মিঃ লয়েড হেস্টিংস।
আনুষ্ঠানিক ভদ্রতা-বিনিময় সাঙ্গ হওয়া মাত্রই হেস্টিংস আমাকে দেখতে পেয়ে সোজা এগিয়ে এসে সাদরে হাতটা বাড়িয়ে দিল; তারপর করমর্দন করতে গিয়ে হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে বিব্রত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল:
ক্ষমা করবেন স্যার, মনে হচ্ছে যেন আপনাকে আনি চিনি।
সে কি অবশ্যই চেনেন।
না। আপনি-আপনিই কি-
ভেসট-পকেট ওয়ালা দানব তো? আমিই সেই লোক। ওই ডাক-নামে আমাকে ডাকতে ভয় পাবেন না; আমি ওতে অভ্যস্ত।
আচ্ছা, আচ্ছা, আশ্চর্য ব্যাপার। একবার কি দুবার ঐ ডাক-নামটার সঙ্গে তোমার নামটা জুড়ে দিতে আমি শুনেছি, কিন্তু তুমিই যে ঐ নামের সঙ্গে যুক্ত হেনরি অ্যাডামস্ তাতো আমি ভাবতেই পারি নি। আরে, ছ মাসও তো হয় নি তুমি ফ্রি স্কে-তে ব্লেক হপকিন্স-এর দোকানে মাসমাইনের করণিকের চাকরি করতে, আর একটা বাড়তি ভাতার জন্য রাত জেগে কাগজপত্র মেলাবার কাজে আমাকে সাহায্য করতে। সেখান থেকে একেবারে খোদ লণ্ডনে আবির্ভাব, প্রকাণ্ড লাখপতি, ও বিরাট খ্যাতি! আরে, একে আরব্য রজনীর কাহিনি ছাড়া আর কি বলা যায়! আরে বাবা, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না; একটু খানি সময় দাও; মাথার মধ্যে সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
আসল ব্যাপার কি জান লয়েড, তোমার অবস্থা আমার চাইতে বেশী খারাপ কিছু নয়। আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না।
আরে বাবা, এ যে অবাক কাণ্ড, নয় কি? এই তো সেদিনকার কথা, তিন মাসও হয় নি, দুজন একসঙ্গে গিয়েছিলাম খনি-মজুরদের রেস্টুরাল্টে–
না; হোয়াট চীয়ার-এ।
ঠিক, হোয়াট চীয়ারই বটে। হ্যাঁ, সকাল দুটোর সময় সেখানে গিয়েছিলাম, আর টানা ছঘণ্টা কঠোর খাটনির পর একটা করে চপ ও এক কাপ কফি। তখনই তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম আমার সঙ্গে লণ্ডনে আসতে বলেছিলাম যে ছুটির ব্যবস্থা আমিই করে দেব, আর আমার কাজকর্ম ভাল চললে যাতায়াতের খরচ ছাড়াও বাড়তি কিছু দেব; কিন্তু তুমি কিছুতেই রাজী হও নি। অথচ সেই তুমি আজ তো এখানে এসেছ। কী অবাক ব্যাপার বল তো! এখানে তুমি কেমন করে এলে, আর এই অবিশ্বাস্য রকমের খ্যাতিই বা অর্জন করলে কেমন করে?
ওঃ, সেটা নেহাৎই একটা আকস্মিক ঘটনা। সে এক লম্বা কাহিনী-একটা রোমান্সও বলতে পার। সবই তোমাকে বলব, কিন্তু এখন নয়।
কখন?
এই মাসের শেষে।
তার তো এখনও পক্ষকালের বেশী বাকি। আমার কৌতূহলের উপর বড় বেশী চাপ পড়বে। ওটাকে এক সপ্তাহ কর।
তা পারব না। কেন যে পারব না সেটা তুমি ক্ৰমে জানতে পারবে। কিন্তু তোমার ব্যবসাপত্র কেমন চলছে?
এক নিঃশ্বাসে তার ফুর্তির আমেজ উধাও হয়ে গেল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলল: পয়গম্বরের মতই তুমি কথা বলেছিলে। আসল পয়গম্বর। আমার না আসাই উচিত ছিল। সে বিষয়ে কোন কথা বলতেও মন চায় না।
কিন্তু তোমাকে বলতেই হবে। এখান থেকে বেরিয়ে আজ রাতটা তুমি আমার সঙ্গে খাবে, আমার কাছে থাকবে। তার পর সব কথা বলবে।
তুমি বলছ? সত্যি বলছ? তার চোখ জলে ভরে এল।
হ্যাঁ; সব কথা আমি শুনতে চাই, প্রতিটি শব্দ।
তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এখানে এসে যে হাল হয়েছে তারপরেও কোন মানুষ যদি আমাকে সহানুভূতি দেখায়, কারও কণ্ঠ স্বর, কারও চোখের দৃষ্টি যদি আমার দিকে, আমার অবস্থার দিকে আসে-হা ভগবান! তার জন্য আমি যে তোমার পায়েও পড়তে পারি!
সে সজোরে আমার হাতটা চেপে ধরল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিল, নৈশ ভোজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করল–কিন্তু নৈশ ভোজ হল না। না; যা স্বাভাবিক তাই ঘটল, ইংরেজ প্রথামত যা ঘট বার কথা তাই ঘটল-কে আগে যাবে, কে আগে বসবে সে প্রশ্নের মীমাংসা হল না, ফরে ভোজও হল না। ইংরেজরা সব সময়ই নৈশ ভোজে যাবার আগে নৈশাহার সেরে নেয়, কারণ ঐ ঝুঁকিটার কথা তারা জানে; কিন্তু নবাগত লোককে তো কেউ সাবধান করে দেয় না, তাই সে ধীর পায়ে সেই ফাঁদে পা বাড়ায়। অবশ্য আজ কারোরই কোন। অসুবিধা হয় নি, একমাত্র হেস্টিংস ছাড়া আমরা আর কেউই নতুন নই বলে নৈশাহার সেরেই এসেছিলাম, আর মন্ত্রীমহোদয়ও নিমন্ত্রণ। জানাবার সময়ই হেস্টিংসকে বলে দিয়েছিল যে ইংরেজ প্রথামত নৈশাহারের কোন ব্যবস্থাই থাকবে না। প্রত্যেকেই একটি করে মহিলাকে নিয়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই বিতর্ক দেখা দিল। শোরডি চ-এর ডিউক দাবী করল, সেই সকলের আগে যাবে এবং টেবিলের প্রধান আসনটি দখল করবে, কারণ পদমর্যাদায় সে একজন মন্ত্রীর চাইতে বড় যেহেতু মন্ত্রী প্রতিনিধিত্ব করছে মাত্র একটি জাতির, আর সে একজন রাজার প্রতিনিধি; কিন্তু তার কথা না মেনে আমিও আমার দাবী পেশ করলাম, কারণ সংবাদপত্রের কলমে আমার নাম সকলের উপরের দিকেই ছাপা হত। অনেক কথা-কাটাকাটি হল, কিন্তু অগ্রাধিকার-সমস্যার কোন সমাধানই হল না। সুতরাং সকলে মিলে আবার দল বেঁধে বসবার ঘরে ফিরে আসা হল এবং এক প্লেট করে সার্ডিন মাছ ও স্ট্রবেরির লাঞ্চ দিয়েই ভোজনপর্ব সমাধা করা হল।
আমাদের সময় কিন্তু বেশ ভালই কাটল; মিস্ ল্যাংহাম ও আমার সময়। আমি বললাম, আমি তাকে ভালবাসি; শুনে তার মুখটা লাল হতে হতে তার চুলটাই লাল হয়ে উঠল, আর সেও বলল, সে আমাকে ভালবাসে। আহা, এমন সন্ধা আর ফিরে আসবে না!..তাকে সব কথা খুলে বললাম; ওই দশ লাখ পাউণ্ডের নোট খানা ছাড়া আমার যে আর কিছুই নেই, আর সে নোটের মালিকও যে আমি নই-সে কথাও তাকে বললাম। শুনে সে শুধু হাসতে লাগল।…
আমি বললাম, প্রিয়া পোশিয়া, ঐ দুটি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে যেদিন আমাকে দাঁড়াতে হবে, সেদিন তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো?
একটু সরে গিয়ে সে বলল, -না; আমি সঙ্গে গেলে তুমি হয়তো মনে জোর পেতে। কিন্তু সেটা কি উচিত হবে, তোমার কি মনে হয়?
না, তা বোধ হয় হবে না; বরং আমার তো আশংকা, সেটা অনুচিতই হবে। কিন্তু বুঝতেই তো পারছ, ঐ দিনটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে-
তাহলে তো উচিত হোক আর অনুচিত হোক আমাকে যেতেই হবে, একটা উদার উৎসাহের সঙ্গে সে কথাগুলি বলল। ও, তোমাকে সাহায্য করতে পারলে আমি যে কত খুসি হতাম!
সাহায্যের কথা কি বলছি প্রিয়া? তুমি সব করতে পারবে। তুমি এত সুন্দরী, এত মনোরমা, এতই আকর্ষণীয়া, যে তুমি পাশে থাকলে সে বুড়োদের ঘাড় ভেঙে আমি আমার মাইনের অংকটা অনেক বাড়িয়ে নিতে পারব।
ওরে দুষ্টু খোসামুদে! তুমি যা বললে তার মধ্যে এক ফোঁটা সত্যি নেই; তবু তোমার সঙ্গে আমি যাব। হয় তো এ থেকেই তোমার শিক্ষা হয়ে যাবে যে সব মানুষই তোমার চোখ দিয়ে জগৎটাকে দেখে না।
আমার সন্দেহ কি দূর হয়েছিল? আমার আত্মবিশ্বাস কি ফিরে পেয়েছিলাম? এই ঘটনা থেকেই সেটা বুঝে নাওঃ মনে মনে প্রথম বছরেই আমার মাইনেটাকে বারো শতে তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাকে বলি নি পরে অবাক করে দেব বলে।
বাড়ি ফিরবার সারাটা পথ অনিশ্চয়তার মধ্যেই কেটে গেল। হেস্টিংস কত কথা বলল তার একটা শব্দও আমার কানে ঢুকল না। দুজনে যখন আমার ঘরে ঢুকলাম তখন তার মুখে আমার নানাবিধ আরাম ও বিলাস উপকরণের প্রশংসা শুনে তবে আমার সম্বিৎ ফিরে এল।
এখানে একটু ক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাকে চোখ ভরে দেখতে দাও। হয়রে! এ যে প্রাসাদ-একেবারে রাজপ্রাসাদ! একটা মানুষ যা চায় সবই তো এখানে আছে-আরামদায়ক আগুন আর রাতের খাবার। হেনরি, এ সব দেখে তুমি যে কত বড় ধনী তাই শুধু বুঝছি না, হাড়ে হাড়ে, মর্মে-মর্মে বুঝতে পারছি আমি কত গরীব,-কত শোচনীয়। কত পর্যুদস্ত, বিধ্বস্ত, সর্বস্বান্ত!
চুলোয় যাক! এই কথা গুলি শুনে আমার বুকের ভিতরটা শিরশির করে উঠল। হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে বুঝতে পারলাম যে আমার পায়ের নীচে মাত্র আধ ইঞ্চি পুরু শক্ত আস্তরণ, আর তার নীচে ই আগ্নেয়গিরির মুখ। আমি জানতাম না এতদিন ধরে শুধু স্বপ্নই দেখেছি; কিন্তু আজ-আজ আমার ঘাড়ে ঋণের বোঝা, পৃথিবীর কোথাও নিজের বলতে আমার একটা সেন্ট পর্যন্ত নেই, একটি সুন্দরী মেয়ের সুখ ও দুঃখ আমার হাতে, অথচ যে মাইনে হয় তো কোন দিন আমি পাব না তার স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই আমার সামনে। নেই। ওঃ ওঃ, ওঃ, আমার সর্বনাশ হয়েছে। সে সর্বনাশের হাত থেকে উদ্ধার নেই! কেউ অদ্ধার করতে পারবে না!
হেনরি, তোমার প্রতিদিনের উপার্জন থেকে অন্যমনস্কভাবে যেটু কু ঝড়তি-পড়তি ফেলে দেবে-
ওঃ, আমার প্রতিদিনের উপার্জন! এই নাও, গরম স্কচ! মনকে চাঙ্গা করে তোল। অথবা, না-তুমি ক্ষুধার্ত এখানে বসে পড়, আর-
আমার জন্য এক কামড়ও নয়; ও পাট শেষ হয়ে গেছে। আজকাল আর খেতে পারি না। কিন্তু মাতাল না হওয়া পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমি মদ খাব। এস!
পিপের পর পিপ আমিও তোমার সঙ্গে আছি! ঠিক আছে? তাহলে শুরু হোক। লয়েড, তাহলে টানতে টানতেই তোমার গল্পটা বলে যাও।
গল্পটা বলব? আবার?
আবার? আবার মানে?
মানে, একই গল্প কি তুমি আবার শুনতে চাও?
অবার শুনাতে চাই? তুমি যে অবাক করলে। থাম, ও বস্তু আর গলায় টে ল না। আর দরকার নেই।
দেখ হেনরি; তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। এখানে আসবার পথেই কি পুরো গল্পটা তোকামে বলি নি?
তুমি বলেছ?
হ্যাঁ, আমি।
কিন্তু দিব্যি করে বলছি, তার একটা কথাও আমি শুনি নি।
হেনরি, তাহলে তো ব্যাপার গুরুতর। আমি ভয় পাচ্ছি। মন্ত্রীর বাড়িতে তুমি কি নিয়ে মেতে ছিলে?
তখনই সব কিছু মনে পড়ে গেল। পুরুষ মানুষের মত সবই স্বীকার করলাম।
এই পৃথিবীর প্রিয়তমা কন্যাকে আমি করেছিলাম-বন্দিনী!
তখনই সে ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরল। ঝাঁকুনি দিতে দিতে আমার হাতটা ব্যথা করে দিল; আর তিন মাইল পথ হাঁটতে হাঁটতে যে গল্প সে আমাকে বলেছিল সেটা শুনতে পাই নি বলে সে মোটে ই আমাকে দোষারোপ করল না। শান্ত, সুবোধ বালকটির মত বসে পড়ে সমস্ত গল্পটা আর একবার বলল। সংক্ষেপে কাহিনীটি এই: একটা বড় সুযোগের আশায়ই সে ইংলণ্ডে এসেছিল; গুল্ড আণ্ড কারী এক্সটেনশন-এর মালপত্র বিক্রির দায়িত্ব নিয়েই সে এসেছিল; কথা ছিল, দশ লাখ ডলারের বেশী যত সে বিক্রি করতে পারবে তার সবটাই তার প্রাপ্য হবে। এখানে এসে সে কঠোর পরিশ্রম করেছে, সব রকম সুযোগের সদ্ব্যাহার করেছে, সৎভাবে যত রকম চেষ্টা করা যায় তার কিছুই বাকি রাখে নি, প্রায় সব টাকা খরচ করে ফেলেছে, একজন পুঁজিবাদীরও মন গলাতে পারে নি, এবং এই মাসের শেষেই তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এক কথায়, সে সর্বস্বান্ত হয়েছে। তার পর হঠালাফিয়ে উঠে সে চীৎকার করে বলে উঠল:
হেনরি, তুমি আমাকে বাঁচাতে পার! তুমিই পার, এই পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই পার। তুমি কি তা করবে? করবে না কি?
কি করতে হবে বল। খুলে বল না হে।
চুক্তির প্রয়োজনীয় দশ লাখ ও ফিরে যাবার খরচ টা তুমি আমাকে দাও! না, না, আপত্তি করো না!
আমার বুকের মধ্যেও একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি যেন প্রায় বলতেই যাচ্ছিলাম, লয়েড, আমি নিজেও তো ফকির-একেবারে কপর্দকহীন, ঋণগ্রস্ত। কিন্তু হঠাৎ একটা চিন্তা আমার মাথার মধ্যে জ্বলে উঠল, ঠোঁট দুটোকে চেপে ধরলাম, নিজেকে পুঁজিবাদীর মত নিরাসক্ত ঠাণ্ডা করে তুললাম। তারপর সংযত ব্যবসায়িক ভঙ্গীতে বললাম:
আমি তোমাকে বাঁচাব লয়েড–
তাহলেই আমি বেঁচে গেছি! ঈশ্বর তোমাকে চিরদিন করুণা করুন। আমি যদি কোন দিন-
আমাকে শেষ করতে দাও লয়েড। আমি তোমাকে বাঁচাব, কিন্তু ও পথে নয়; কারণ যে কঠোর পরিশ্রম তুমি করেছ, যে ঝুঁকি তুমি নিয়েছ, তার পরে ও কাজ করলে তোমার প্রতিও সুবিচার করা হবে না। খনির শেয়ার কেনার দরকার আমার নেই: ও কাজ ছাড়াই লণ্ডনের মত ব্যবসায়িক শহরে আমার মূলধন খাটাবার অনেক সুযোগ আমি পাব; সব সময় সেই কাজই আমি করে চলেছি; কিন্তু এবার শোন তোমার জন্য কি করব। খনির ব্যাপার সবই আমি জানি; এর প্রচুর মুনাফার কথাও আমি জানি; কেউ চাইলে দিব্যি করে সে কথা বলতেও পারি। যথেচ্ছভাবে আমার নাম ব্যবহার করে এক পক্ষ কালের মধ্যেই তুমি নগদ ত্রিশ লাখের শেয়ার বিক্রি করবে এবং সেটা আমরা দুজন সমান অংশে ভাগ করে নেব।
আমার কথা শুনে উন্মাদ আনন্দে সে এমন ভাবে নাচতে শুরু করে দিল যে আমি যদি জোর করে ধরে তাকে বেঁধে না ফেলতাম তাহলে সব আসবাবপত্রকে ভেঙে সে জ্বালানিতে পরিণত করত এবং ঘরের অন্য সব জিনিস ভেঙ্গে একেবারে তচনচ করে ফেলত।
সেখানেই শুয়ে পড়ে পরিপূর্ণ সুখে সে বলতে লাগল।
আমি তোমার নামটা ব্যবহার করতে পারব! তোমার নাম-ব্যাপারটা ভেবে দেখ! আরে বাবা, লণ্ডনের সব ধনীরা তো দল বেঁধে ছুটে আসবে; শেয়ারের জন্য তারা লড়াই শুরু করে দেবে! আমি মানুষ হয়ে গেলাম, চিরদিনের মত মানুষ হয়ে গেলাম; যতদিন বেঁচে থাকব, তোমাকে কোন দিন ভুলব না!
চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই লণ্ডন শহরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল! আমাকে কিছুই করতে হল না; দিনের পর দিন শুধু ঘরে বসে বসে দর্শনার্থীদের লবলাম:
হ্যাঁ; আমার নাম উল্লেখ করতে আমিই তাকে বলেছি। লেকটি কে আমি চিনি, আর খনিটাও আমার জানা। তার চরিত্র নিন্দার অতীত, এবং সে যে অর্থ চাইছে খনিটার দাম তার চাইতে অনেক বেশী।
ইতিমধ্যে আমার প্রতিটি সন্ধাই মন্ত্রীর ভবনে পোশিয়ার সঙ্গে কাটতে লাগল। খনি সম্পর্কে কিছুই তাকে বলি নি; মনের বাসনা, একদিন তাকে হঠাৎ খবরটা দিয়ে চমকে দেব। আমার মাইনের কথা নিয়েই আলোচনা করতাম; মাইনে ও ভালবাসা ছাড়া আর কোন কথা আমাদের ছিল না; কখনও ভালবাসার কথা, কখনও মাইনের কথা, আবার কখনও বা ভালবাসা ও মাইনের কথা একসঙ্গে। আমাদের এই ছোট খাট প্রেমের ব্যাপারে মন্ত্রীর স্ত্রী ও কন্যা যে আগ্রহ দেখাতে লাগল, আমাদের প্রেমের ব্যাপারে যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে এবং মন্ত্রী যাতে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ও সন্দেহের উর্ধ্বে থাকে সে জন্য দিনের পর দিন তারা সে সব ছিল-চতুরির আশ্রয় নিতে লাগল-আহা, সত্যি, তাদের ভালবাসার তুলনা হয় না!
শেষ পর্যন্ত মাসটা সেদিন শেষ হল, সেদিন লণ্ডন অ্যাণ্ড কাউন্টি ব্যাংক-এ আমার নামে দশ লাখ ডলার জমা পড়ল, এবং হেস্টিংসেরও একটা সুরাহা হয়ে গেল। যথাসাধ্য ভাল ভাবে সাজসজ্জা করে গাড়িতে চেপে পোর্টল্যান্ড প্লেস-এ গেলাম, বাড়ির অবস্থা দেখেই বুঝতে পারলাম আমার পাখিরা নীড়ে ফিরে এসেছে, মন্ত্রীর ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই আমার সোনাকে পেয়ে গেলাম এবং যথাশক্তি মাইনে সম্পর্কে কথা বলতে বলতে সেখান থেকে যাত্রা করলাম। সে এতই উত্তেজিত ও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে যে তার সৌন্দর্য যেন সহ্যের সীমা ছাড়ীয়ে গিয়েছিল। আমি বললাম:
প্রিয়, যে ভাবে তুমি তাকাচ্ছ তাতে তো বছরে তিন হাজারের একটি পেনিও কম মাইনের কথা বললে মহা অপরাধ হবে।
হেনরি, হেনরি, তুমি কি আমাদের সর্বনাশ করবে!
ভয় পেয়ো না। ঐ চাউনিটা ঠিক রেখো। আর আমার উপর ভরসা রেখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
এইভাবে সারাটা পথ আমি তাকে সাহস দিতে লাগলাম, আর সে আমাকে বার বার বোঝাতে লাগল:
দেখ, দয়া করে একটা কথা স্মরণ রেখো, অনেক বেশী মাইনে চাইলে হয় তো সবটাই ফস্কে যেতে পারে; তখন কিন্তু জীবিকা অর্জনের আর কোন পথই আমাদের হাতে থাকবে না, বুঝলে?
সেই একই চাকর আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেল; ভিতরে সেই দুই বৃদ্ধ ভদ্রলোক উপস্থিত। অবশ্য এই আশ্চর্য জীবটি কে আমার সঙ্গে দেখে তারাও অবাক হয়ে গেল। কিন্তু আমি বললাম:
সব ঠিক আছে মসাইরা; ইনিই আমার ভবিষ্যতের ভরসা ও সঙ্গিনী।
তাদের সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দিলাম, আর তাদের দুজনকেও নাম ধরেই সম্বোধন করলাম। তাতে তারা মোটেই অবাক হল না; তারা জানত, ডিরেক্টরীটা দেখেই ওটা আমি জেনে নিতে পেরেছি। তারা আমাদের বসতে বলল, আমার সঙ্গে অতি ভদ্র ব্যবহার করল এবং মেয়েটির সংকোচ কাটিয়ে তুলতেও সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগল। তখন আমি বললাম:
ভদ্রমহোদয়গণ, প্রতিবেদন পেশ করতে আমি প্রস্তুত।
আমার লোকটি বলল, শুনে আমরা খুসি হলাম। কারণ আমার ভাই আবেল ও আমি যে বাজী ধরেছি এবার তার মীমাংসা করতে পারব। তুমি যদি আমাকে জিতিয়ে দিয়ে থাক, তাহলে আমার সাধ্যায় যে কোন চাকরি তুমি পাবে। দশ লাখ পাউণ্ডের নোট টা কি সঙ্গে আছে?
এই যে স্যার, নোট টা তার হাতে দিলাম।
আমি জিতেছি! চীৎকার করে সে আবেল-এর পিঠে একটা চড় মারল। এবার কি বলতে চাও ভায়া?
আমি বলতে চাই, ইনি বেঁচে আছেন। আর আমি বিশ হাজার পাউণ্ড হেরেছি। না দেখলে এ কথা আমি বিশ্বাস করতাম না।
আমি বললাম, আমার আরও কিছু বলবার আছে, আর সে কাহিনী বেশ লম্বা। আমার ইচ্ছা, শীঘ্রই আর একদিন এসে আমার এই সারা মাসের ইতিহাস আপনাদের শুনিয়ে যাব। আমি বলছি, সে ইতিহাস শোনবার মতই। ইতিমধ্যে, এটার দিকে একবার তাকান।
সে কি গো? বিশ লাখ পাউণ্ড জমার সাটিফিকেট। এটাও কি তোমার?
আমার। আপনি যে সামান্য ধারটা আমাকে দিয়েছিলেন তাকেই কাজে লাগিয়ে ত্রিশ দিনে এটা আমি উপার্জন করেছি। আর কাজে লাগানো মানে আর কিছুই না, শুধু টুকিটাকি জিনিস কিনেছি আর বিলটা ভাঙিয়ে দিতে বলেছি।
বল কি, এ যে অবাক কাণ্ড! এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার গো!
কোন চিন্তা নেই, আমি প্রমাণ করে দেব। বিনা প্রমাণে আমার কথা বিশ্বাস করবেন না।
এবার পোর্শিয়ার অবাক হবার পালা। দুই চোখ বড় বড় করে সে বলল:
হেনরি, এটা কি সত্যি তোমার টাকা? আমাকে তুমি মিথ্যা বলেছ?
সত্যি তাই প্রিয়া। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে।
ঠোঁট ফুলিয়ে সে বলল:
অতটা নিশ্চিন্ত হয়ো না। তুমি কী দুই যে আমাকে এ ভাবে ধোঁকা দিয়েছ।
আহা ও নিয়ে মাথা ঘামিও না সোনা ও নিয়ে মাথা ঘামিও না; তুমি তো জান, ওটা একটা ঠাট্টা মাত্র। এস, আমরা যাই।
আরে, দাঁড়াও, দাঁড়াও। একটা চাকরির কথাও তো আছে। আমি তোমাকে চাকরিটা দিতে চাই, দেখুন, আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু সত্যি আমার চাকরির দরকার নেই।
কিন্তু তুমি খুব ভাল একটা চাকরি পেতে পার।
সর্বান্তঃকরণে আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি; কিন্তু সে চাকরিটাও আমি চাই না।
হেনরি তোমার জন্য আমার লজ্জা হচ্ছে। তোমার হয়ে আমি কি কাজটা করতে পারি?
নিশ্চয় পার। শুধু অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই হল। তুমিও চেষ্টা করে দেখতে পার।
পোর্শিয়া আমার লোকটির দিকে এগিয়ে গেল, তার কোলে চড়ে বসল, দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে ঠিক মুখের উপর চুমো খেল। তখন দুই বৃদ্ধ হো-হো করে হেসে উঠল, আর আমি তা হতবাক, ভয়ার্তও বলতে পারেন। পোশিয়া বলল: বাবা, ও বলছে ওর নেবার মত চাকরি আপনার হাতে নেই; এতে আমি যে কত বড় আঘাত-
প্রিয়া, ইনি তোমার বাবা?
হ্যাঁ, আমার সৎ-বাবা, আমার বড় আদরের বাবা। এখন বুঝতে পারছ, মন্ত্রীর বাড়িতে সেদিন এদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা না। জেনে তুমি যখন আমার বাবার ও আবেল কাকার পরিকল্পনা নিয়ে গভীর ভদ্বেগ প্রকাশ করছিলে তখন আমি কেন হেসেছিলাম?
অবশ্য আর বোকামি না করে আমি সরাসরিই আসল কথাটা তুললাম।
আপনি আমার অতি প্রিয় গুরুজন, তাই আগে যা বলেছি সে কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমি চাই এমন একটা পদ যা আপনার হাতে অবশ্যই আছে।
বল।
জামাতা।
আচ্ছা, আচ্ছা! কিন্তু তুমি তো জান, এ পদে এর আগে তুমি কখনও কাজ কর নি, চুক্তির শর্ত পূরণ করতে এ ব্যাপারে কোন সুপারিশ-পত্র তো তুমি দাখিল করতে পারবে না; অতএব-
পরীক্ষা করে দেখুন-আমি আপনার কাছে ভিক্ষা চাইছি, ত্রিশ বা চল্লিশ বছরেরে জন্য আমাকে পরীক্ষা করে দেখুন, তারপর যদি-
ঠিক আছে, ঠিক আছে; এ তো অতি সামান্য প্রার্থনা; ওকে সঙ্গী করে নাও।
আমরা কি সুখী? অভিধানের অসংক্ষিপ্ত সংরণেও এত শব্দ নেই যা দিয়ে এ কথার বর্ণনা দেওয়া যায়। আর দুএক দিন পরে ঐ ব্যংক-নোট নিয়ে আমার অভিযান ও তার পরিণতির কথা যখন সারা লণ্ডন জানতে পেল, তখন কি লণ্ডনবাসীরা খুসি হয়েছিল? হ্যাঁ।
পোর্শিয়ার বাবা সেই বন্ধুর মত বিলটা নিয়ে ব্যাংক অব ইংলণ্ড-এ গেল ও সেটা ভাঙিয়ে আনল। ব্যাংক তখন সেই বিলটাকে বাতিল করে দিয়ে সেটা আবার তাকেই উপহার দিল, আর বাবাও আমাদের বিয়ের উপহার স্বরূপ সেটা আমাদের দান করল। সেই থেকে সেই বিলটা ফ্রেমে বাঁধা হয়ে আমাদের বাড়ির সব চাইতে পবিত্র স্থানটিতে অবস্থান করছে। কারণ এটার জন্যই তো আমার পোর্শিয়াকে আমি পেয়েছি। এটা না পেলে তো আমি ল শুনেই থাকতাম না, মন্ত্রীর বাড়িতে যেতাম না, এবং ওকেও কখনও দেখতেই পেতাম না।
তাই তো সব সময়ই আমি বিল, হ্যাঁ, এটা দশ লাখ পাউণ্ডের নোট, সে তো দেখতেই পাচ্ছেন; কিন্তু সারা জীবনে এটা দিয়ে মাত্র একটি বস্তুই কেনা হয়েছে, আর তাও কেনা হয়েছে সে বস্তুটি র মাত্র এক-দশমাংশ মূল্য দিয়ে।
[১৮৯৩]