দশ বছরের ছেলেটি

দশ বছরের ছেলেটি

বাবা-কাকাদের বয়সি একজন মানুষ সেজেগুজে অফিস যাচ্ছেন। বাড়িতে তিনি পাজামা আর গেঞ্জি পরে থাকেন, বাড়িতে খালি-পা আর পাড়ায় বেরুবার সময় চটি। কিন্তু অফিস যাবার সময় মোজা আর ফিতে-বাঁধা জুতো, প্যান্ট আর ফুল শার্ট গুঁজে পরা। এক-একদিন তাঁকে কোট আর টাই পরতেও হয়, বড়ো চাকরি করেন তো! অফিসার হলে আর কেউ পাজামা কিংবা ধুতি পরে অফিস যায় না!

এই মানুষটিকে দেখলে এখন কি বোঝা যাবে, ইনি ছেলেবেলায় কেমন ছিলেন? দুষ্টু না শান্ত? পড়াশুনোয় খুব ভালো, না ফাঁকিবাজ? ভীতু না সাহসী? সত্যি কথা বলতেন, না গুলবাজ? এখন যিনি বড়ো রাস্তার মোড়ে এসে মিনিবাসের জন্য অপেক্ষা করছেন আর ঘন ঘন তাকাচ্ছেন হাতের ঘড়ির দিকে, তাঁকে দেখলে এসব কিছুই বোঝা যাবে না!

এক-একজন মানুষের ছেলেবেলার জীবনটা একেবারে অন্যরকম হয়!

এঁর নাম জীবনময় সেনগুপ্ত। ছেলেবেলায় এঁর নাম ছিল জীবু, কেউ কেউ বলত জীবে, দু-একজন বলত জীবা। এঁর যখন দশ বছর বয়েস, সেই সময়কার গল্প বলি। সে তখন থাকত একটা গ্রামে।

এখন বেশ লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান পুরুষ, সেই দশ বছর বয়সে জীবু ছিল ছোট্টখাট্ট একটা ছেলে, মাথায় চুল খোঁচা খোঁচা, দুটো দাঁত পড়ে গেছে, তখনও নতুন দাঁত ওঠেনি। মাথায় বুদ্ধি ছিল, কিন্তু পড়াশুনোয় তেমন মন ছিল না। মাস্টারমশাইরা বলতেন, এ ছেলেটা মন দিয়ে পড়লে ফার্স্ট হতে পারে। কিন্তু জীবু ফার্স্ট-সেকেণ্ড কিছুই হয় না, তবে পাস করে যায়।

জীবুর খুব সাঁতার কাটার নেশা। মাত্র এক বছর আগে সাঁতার শিখেছে, এখন সে যখন-তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের বাড়ির কাছাকাছি পুকুর-খাল-বিল-নদীর অভাব নেই। জীবু চিৎ সাঁতার কাটে, ডুব সাঁতার কাটে, এক ডুবে অনেকখানি চলে যায়।

রোজ রোজ এক জায়গায় সাঁতার কাটতে তার ভালো লাগে না। তাই এক পুকুর থেকে চলে যায় অন্য পুকুরে, কোনো দিন নদীতে। একদিন নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে সে একটা মস্তবড়ো সাপ দেখেছিল, কিন্তু তেমন ভয় পায়নি। সাপ দেখা তার অভ্যেস আছে।

এরকম সাঁতারের নেশার জন্য বাড়িতে খুব বকুনি খেতে হত তাকে। অনেকক্ষণ জলে থাকলে চোখ লাল হয়ে যায়। সেই সময় লাল চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরলে মা তো বকুনি দিতেনই, তার দুই দাদা মারধরও করত মাঝে মাঝে।

বাবা অবশ্য মারতেন না বা বকতেন না, শুধু বলতেন আমার এ ছেলেটার লেখাপড়া কিছু হবে না। বড়ো হয়ে তুই কী করবি রে জীবু? নৌকোর মাঝি হবি?

জীবু ভাবে, নৌকোর মাঝি হওয়া তো খুব ভালো কাজ, সারাদিন বেশ জলে জলে থাকা যাবে!

জীবুর ইস্কুলের বন্ধু মিন্টুও সাঁতার জানে, কিন্তু সে বেশিক্ষণ জলে থাকতে ভালোবাসে না।

জীবু একদিন দুপুর বেলা তালপুকুর নামে একটা বড়ো পুকুরে সাঁতার কাটছে। পুকুরটা খুব বড়ো, আর জলের রং কালো। মাঝখানটা খুব গভীর। এই দুপুরে আর কেউ নেই, জীবু পাড়ের কাছেই সাঁতার কাটছে, বেশি দূর যাচ্ছে না। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, এই পুকুরে কুমির আছে।

হঠাৎ মিন্টু ছুটতে ছুটতে এসে বলল জীবু, এই জীবু, তোকে কতক্ষণ থেকে খুঁজছি। উঠে আয়। শিগগির বাড়ি চলে যা।

জীবু জিজ্ঞেস করল, কেন? কী হয়েছে?

মিন্টু বলল, তোর বাবাকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে।

তা শুনে জীবুর মনে তেমন দাগ কাটল না। জ্ঞান হবার পর থেকেই সে দেখছে, বাবাকে মাঝে-মধ্যেই পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। বাবা আবার ফিরেও আসেন ক-দিন বাদে। এ আর এমনকী নতুন ব্যাপার।

পুলিশ আর মিলিটারির তফাত বোঝে না জীবু।

সে জল থেকে উঠতে চাইছিল না, মিন্টু বারবার তাড়া দিতে লাগল, ওঠ, ওঠ! বাড়ি যা, তোর মা কাঁদছে।

তা শুনে জীবুকে উঠতেই হল।

বাড়িতে এসে সে আড়ষ্ট হয়ে গেল।

ওদের বাড়ি একতলা, ইটের দেয়াল, টিনের চাল। সামনের দিকে একটা লম্বা টানা বারান্দা। সেখানে বসে ঠাকুমা কাঁদছেন খুব জোরে জোরে, মা দাঁড়িয়ে আছেন একটা বাঁশের খুঁটি ধরে, দু-চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, কিন্তু কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না।

আর তার বড়দাদা সত্যময় রাগে গজগজ করতে করতে বলছে, আমি আগেই বলেছিলাম, এখানে আর টেকা যাবে না, চলো ত্রিপুরায় চলে যাই, বাবা সেকথা কানেই নিলেন না!

জীবু কিছুই বুঝতে পারল না। অন্য দিন সে ভিজে গায়ে ফিরলে বকুনি খায়, আজ কেউ গ্রাহ্য করল না তাকে। সে ঘরে ঢুকে মাথা-টাথা মুছে অন্য প্যান্ট পরে এল।

খানিকবাদে সে বাড়ির লোকের কথা শুনে আন্দাজ করল যে পুলিশ আর মিলিটারি আলাদা। পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে কিছুদিন আটকে রেখে তবু ছেড়ে দেয়, মিলিটারি ধরে নিয়ে গেলে কেউ আর ফেরত আসে না।

জীবুর বাবা একজন নেতা। এবারে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন। সে জন্যই নাকি তাঁর ওপর মিলিটারির রাগ।

এরই মধ্যে খুব জোর শব্দ করে এই গ্রামের ওপর দিয়ে দুটো প্লেন উড়ে গেল। আগে কখনো প্লেনের শব্দ শোনা যায়নি এই গ্রামে।

মিন্টু বলল, জানিস তো জীবু, যুদ্ধ লেগে গেছে!

জীবু জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কার যুদ্ধ রে?

সেটা মিন্টুও ঠিক বলতে পারল না।

খানিকবাদে সত্যময় বলল, আমি যাচ্ছি মিলিটারি ক্যাম্পে, দেখি ওরা কী বলে?

মা সঙ্গেসঙ্গেই বললেন, না, তুই যাবি না।

সত্যময় বলল, বাবার খবর নিতে হবে না? যদি বাবাকে আটকে রাখতে চায়, তাহলে জামাকাপড় পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে তো!

ঠাকুমাও বারণ করলেন, দাদা শুনল না। জামা পরে বেরিয়ে গেল।

এক মিনিট পরেই দাদাকে ঠেলতে ঠেলতে ফিরিয়ে আনল একজন বুড়ো লোক। লুঙি আর সাদা ধপধপে পাঞ্জাবি পরা, হাতে একটা ছড়ি। ইনি মিন্টুর বাবা, সবাই একে বলে ফজলচাচা।

ফজলচাচা খুব মজার লোক, সবসময় সবার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে কথা বলেন। আজ তাঁর মুখখানা থমথমে।

তিনি জীবুর মাকে বললেন, বউঠান, আপনি পাগল হয়েছেন নাকি? এ ছেলেটাকে বাঘের মুখে পাঠাচ্ছিলেন? দাদাকে যখন ধরতে এসেছিল, তখন ছেলেরা কেউ বাড়িতে ছিল?

মায়ের বদলে, দাদাই উত্তর দিল, না, আমরা ভাইরা কেউ বাড়িতে ছিলাম না। আমি থাকলে বাবাকে কিছুতেই যেতে দিতাম না।

ফজলচাচা বললেন, তুমি থাকলে তোমাকেই ওরা ধরে নিয়ে যেত। মাথা গরম কোরো না। এখন মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করতে হবে।

বারান্দার একধারে বসে তিনি জীবুর দিকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কিরণময় কোথায়?

কিরণময় জীবুর মেজদা। তাঁকে অনেকক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

মাথা নাড়তে নাড়তে তিনি বললেন, ভালো নয়, এসময় বাড়ির বাইরে থাকা ভালো নয়। সারাদেশে কী কান্ড হচ্ছে, তোমরা তো কিছুই জান না। আমি কিছু কিছু খবর পেয়েছি।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ফজলচাচা বললেন, সত্যময়, আমার ছোটোভাই মিলনকে তো তুমি চিনতে? সে আর নেই।

সত্যময় দারুণ চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ? মিলনভাইয়ের কী হয়েছে?

ফজলচাচা বললেন, মিলিটারি তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। যতদূর যা শুনছি, আমাদের দেশের কোনো জওয়ান পুরুষদেরই ওরা আর বাঁচিয়ে রাখবে না।

তারপর তিনি মাকে বললেন, বউঠান, বেশি সময় নেই। দু-একদিনের মধ্যেই এই গ্রামে আক্রমণ হবে। আমি আমার বাড়ির মেয়েদের নদীর ওপারের গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই দিকে আমাদের মুক্তিবাহিনী আছে। সেখানে অনেকটা নিরাপদ। আপনারা খুব দরকারি কিছু জিনিস গুছিয়ে নিন, আপনারাও ওদের সঙ্গে যাবেন। এখানে থাকলে বাঁচবেন না।

মা আর্তগলায় বলে উঠলেন, কিরণ? সে কোথায় গেল? তার খবর না-পেলে কী করে যাব?

ফজলচাচা জোর দিয়ে বললেন, তার খবর পাওয়া যাবে। আমরা আছি। সত্য থাকবে, ছোটো ছেলেটাকে আপনি নিয়ে যান।

জীবু এই প্রথম কথা বললে। সে মাথা নেড়ে বলে উঠল, না আমি যাব না। আমি এখানেই থাকব।

জীবু ভাবছে এখানে একটা যুদ্ধ হবে। সে যুদ্ধ দেখতে চায়। দুম দুম করে গুলি চলবে, বেশ মজা হবে।

মা জোর করেই জীবুকে নিয়ে যেতে চান। জীবু কিছুতেই যাবে না। সত্য বলল, থাক ও আমার সঙ্গেই থাক।

আধঘণ্টার মধ্যে মা, ঠাকুমা আর পাশের বাড়ির দুই পিসিমাকে নিয়ে চলে গেলেন ফজলচাচা।

তারপরই বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু দাদা আর জীবু, আর ওদের বাড়ির রাখাল দুখিয়া।

মা না-থাকলে বাড়িটাকে আর বাড়ি মনে হয় না। সন্ধ্যে হয়ে রাতও এসে গেল। তবু কিরণের দেখা নেই। সন্ধ্যের পর সে কখনো বাড়ির বাইরে থাকে না। তিন ভাইয়ের মধ্যে কিরণই সবচেয়ে ডানপিটে। সে তরতরিয়ে গাছে উঠে যেতে পারে। একবার একটা পাগলা শেয়ালকে বর্শা দিয়ে গেঁথে মেরেছিল। নৌকা বাইতে পারে ভালো। সে কোথায় গেল? সত্য একবার বেরিয়ে কিরণের দুই বন্ধু রফিক আর বেলালের বাড়িতে খবর নিতে গেল। তারাও বাড়িতে নেই। তাদের বাড়ির লোকও চিন্তায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে।

দিনের বেলা ডাল-ভাত আর একটা তরকারি রান্না করা ছিল, তাই খেয়ে জীবু শুয়ে পড়ল দাদার সঙ্গে। সারাগ্রাম একেবারে নিস্তব্ধ। আজ যেন একটা কুকুরও ডাকছে না।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জীবু। জেগে উঠল জোরে ঝাঁকুনি খেয়ে।

সত্য তাকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলছে, ওঠ শিগগির ওঠ ; ওরা এসে পড়েছে।

জীবু, জিজ্ঞেস করল, ওরা মানে কারা?

উত্তর না-দিয়ে দাদা ছুটে গেল বাইরে।

ঘরটায় অন্ধকার ছিল, কোথা থেকে আলো আসছে?

দারুণ গোলমাল শোনা যাচ্ছে বাইরে।

জীবু বাইরে এসে দেখল, গ্রামের একদিকের আকাশ লাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে একসঙ্গে আগুন লেগেছে অনেকগুলো বাড়িতে। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে অনেক লোক।

তারপর শোনা গেল গুড়ুম গুড়ুম বন্দুকের শব্দ। আরেক রকম কট কট শব্দ। গাড়ির শব্দ। এ গ্রামে গাড়ি প্রায় আসেই না। এখন যেন চার-পাঁচটা গাড়ি এগিয়ে আসছে এদিকে।

একদল লোক ছুটতে ছুটতে চলে গেল বাড়ির পাশ দিয়ে। আর একদল ছুটতে ছুটতে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘পালাও, পালাও, ওরা গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সবাইকে শেষ করে দেবে। পালাও।’

কোথা থেকে দাদা এসে জীবুর হাত ধরে বলল, দৌড়ো। আমার সঙ্গেসঙ্গে থাকবি। কিছু নিতে হবে না। ওরা এসে পড়ল বলে!

দাদা এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে লাফিয়ে পড়ল উঠোনে। দৌড়োতে শুরু করল বাড়ির পিছন দিকে। পুকুরের ওপারে জঙ্গল। তারপর ধানের খেত।

আরও অনেক লোক দৌড়োচ্ছে ওদের সঙ্গে। অন্ধকারে কারুকে চেনা যাচ্ছে না। একদল আর একদলকে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

জীবু একবার জিজ্ঞেস করল দাদা, ওরা আমাদের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেবে কেন? আমরা কী দোষ করেছি?

দাদা বলল, আমরা যে বাঙালি, সেটাই আমাদের দোষ।

ধানখেতের ওপর দিয়ে খানিকটা দৌড়ে গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। এদিক দিয়েও গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছে কয়েকটা গাড়ি। সামনেও মিলিটারি, পেছনেও মিলিটারি।

তখন একটা সাংঘাতিক হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কে যে কোন দিকে ছুটবে তার ঠিক নেই। দাদার হাত ছেড়ে গেছে। দাদা কোন দিকে গেছে জীবু জানে না। কিন্তু থামবার উপায় নেই। পেছন থেকে অনেক লোক তাকে ঠেলছে।

হঠাৎ একটা গুলি লেগে জীবুর পাশের লোকটি ধড়াম করে পড়ে গেল মাটিতে। আর্তনাদ করতে লাগল বুক ফাটিয়ে। তবু কেউ থামল না, আরও গুলি আসছে এদিকে, আরও দু-একজন লোক মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।

জীবু ভেবেছিল, যুদ্ধটা একটা মজার খেলার মতন। কিন্তু এ তো খেলা নয়! মানুষ মরে যাচ্ছে। আর এ যুদ্ধ একতরফা। ওরাই শুধু গুলি চালাচ্ছে। গ্রামের মানুষের হাতে তো বন্দুক নেই।

কখন যেন জীবু একা হয়ে গেছে, আর কেউ নেই তার পাশে।

একবার থমকে সে পেছন দিকে তাকাল। অনেকটা দূরে চলে এসেছে, তবু দেখা যায়। গোটা গ্রামটাই দাউ দাউ করে জ্বলছে। জীবুদের বাড়িটাও আছে তার মধ্যে।

হুস করে একটা জিপগাড়ি এসে থামল তার খুব কাছে। হেডলাইটের জোরালো আলোয় দেখা গেল জীবুকে। দু-জন মিলিটারি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে তাড়া করে এল।

কিন্তু জীবু কিছুতেই ধরা দেবে না। সে আবার ছুটল একটা তিরের মতন।

মিলিটারি দু-জন চেঁচিয়ে কী যেন একটা হুকুম দিল, সে বুঝতে পারল না। একটা গুলি চলে গেল তার গা ঘেঁষে। তবু ধরা দিতে সে রাজি নয়। সে দৌড়ে ওদের হারিয়ে দেবে।

এক সময় জীবু দেখলে, সামনেই নদী। উঁচু বাঁধের ওপর সে উঠে এসেছে। বাঁধের ওপর দিয়ে সোজা দৌড়োতে গেলে তার গায়ে গুলি লাগতে পারে। নীচে চকচক করছে নদীর জল।

এক মুহূর্ত ভেবে নিল জীবু। তারপর ঝাঁপ দিল। অনেক নীচে ঝপাস করে গিয়ে পড়ল নদীর জলে। ওপর থেকে কয়েকটি গুলি ছুটে এল, কিন্তু লাগল না। নদীতে বেশ স্রোত। জীবু ভেসে যেতে লাগল সেই স্রোতের টানে।

অন্য কোনো ছেলে হলে রাত্তির বেলা অত উঁচু থেকে নদীতে লাফ দিয়ে মরেও যেতে পারত। কিন্তু জীবু যে ভালো সাঁতার জানে। গাছের ডালে উঠে সে অনেকবার নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে।

স্রোতে ভাসতে ভাসতে বেশ কিছুক্ষণ পর একটা নৌকোয় জীবুর মাথা ঠুকে গেল খুব জোরে। নৌকোটা ঘাটের কাছেই নোঙর করা।

নৌকোর ছইয়ের মধ্যে লণ্ঠনের আলো জ্বলছে। কথা বলছে কয়েকজন লোক। তাদের একজন বলল, কীসের শব্দ হল রে।

জীবুর মাথা এত জোরে ঠুকে গেছে যে তার প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মতন অবস্থা। কিন্তু ডুবে যাবার আগে সে নৌকোর একটা দড়ি ধরে ফেলেছে। সেই অবস্থায় ভাসছে।

নৌকোর একজন লোক জীবুকে দেখতে পেয়ে ওপরে তুলে নিল। সেটা একটা জেলেদের নৌকো। কাছেই তাদের গ্রাম। রাত্তিরে তারা মাছ ধরে। সকাল বেলা গ্রামে ফিরে যায়।

জীবু সেই জেলেদের গ্রামে আশ্রয় পেয়ে গেল।

মাথা ফেটে গিয়ে তার অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। জেলের বউ তাকে ছাগলের দুধ খেতে দিয়েছে। তিন দিন পর পান্তাভাত আর কুচো চিংড়ি মাছের ঝাল খেয়ে সে অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠল।

আসল গ্রামটা অনেক দূরে। নদীর ধারে জেলেদের পাড়াটা বস্তির মতন। সবাই খুব গরিব। এখানে এ পর্যন্ত মিলিটারি আসেনি। এত গরিবদের বস্তিতে তারা আসেও না। এরা যুদ্ধের কথাও বিশেষ কিছু জানে না। এরা সারারাত মাছ ধরে, সকাল বেলা সেই মাছ বিক্রি করে আসে, তারপর সারাদিন ঘুমোয়।

জীবুকে তারা আপন করে নিল।

জীবুর মুখে মিলিটারিদের আক্রমণের কথা শুনে তারা অবাক হয়ে এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। কেন মিলিটারি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়? কেন অকারণে মানুষ মারে?

জীবু এসব প্রশ্নের উত্তর জানে না।

একটা কথা সবাই অবশ্য বুঝেছে। জীবুর এক্ষুনি তাদের গ্রামে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। যদি মিলিটারিরা এখন সেখানে গেড়ে বসে থাকে? জীবু এখানেই থেকে যাক না, যতদিন ইচ্ছে!

লোকগুলির আন্তরিক ব্যবহার জীবুর ভালো লাগে। তবু সে মাঝে মাঝে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। তার বাবা এখন বেঁচে আছেন কিনা সে জানে না। দুই দাদার বা কী হল? মা-ঠাকুমা আর পিসিমারা কি নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছোতে পেরেছেন। ওঁরাও তো কেউ জানেন না যে জীবু কোথায় আছে। মা নিশ্চয়ই কাঁদছেন জীবুর জন্য!

যে বাড়িতে জীবু আশ্রয় পেয়েছে, সে বাড়ির একটা ছেলের নাম আব্বাস। জীবুরই সমবয়সি। কয়েকদিনের মধ্যেই জীবুর সঙ্গে তার ভাব হয়ে গেল। আব্বাস একেবারেই লেখাপড়া জানে না, অ-আ-ক-খও শেখেনি। এই জেলেদের বস্তিতে স্কুল বলে কিছু নেই, কোনো ছেলে-মেয়েই লেখাপড়া করে না। তাদের বাবা-মায়েরাও কখনো পড়াশুনো শেখেনি। বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনো করতেই বলে না। এটা দেখে জীবুর মজা লাগে। তাদের বাড়িতে তো রোজ সকালে বই খুলে না-বসলেই বকুনি খেতে হত!

জীবু এখন আব্বাসের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। সাঁতার কাটে, গাছে চড়ে। আব্বাস বই পড়তে পারে না বটে, কিন্তু যোগ-বিয়োগ জানে। উনতিরিশের সঙ্গে তেরো যোগ করলে কত হয়, তা সে মুখে মুখে বলে দিতে পারে। আকাশের দিকে তাকালে বুঝতে পারে, কখন ঝড় উঠবে।

একদিন আব্বাসের সঙ্গে জীবুও সন্ধ্যে বেলা মাছ ধরতে নৌকোয় উঠে বসল। তারপর আর ঘুম নেই সারারাত। বারবার নদীতে জাল ফেলা আর জাল টেনে তুললেই তার মধ্যে নানারকম মাছ। জ্যান্ত মাছগুলো যখন লাফায়, তখন দেখে যে কী আনন্দ হয়!

ওই দলের মধ্যে থেকে একজন এগিয়ে এসে বাংলায় বলল, আপনারা ভয় পাবেন না…

কয়েকদিন পর জীবুও জাল ফেলা শিখে গেল। বাবা যেমন বলেছিলেন, জীবু মাছ ধরে জেলেই হয়ে যাবে? এখানে থেকে যাবে সারাজীবন? বাবা কোথায়? দুই দাদা কোথায়? মা, ঠাকুমা—

একদিন রাত্তিরে মাছ ধরতে গিয়ে ওরা শুনতে পেল বন্দুকের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। এখনও যুদ্ধ চলছে? মিলিটারিরা এদিকেও এসে গেছে?

সে রাতে মাছ-ধরা নৌকোটা তাড়াতাড়ি ফিরে এল গ্রামে।

একটু পরেই দশ-বারো জন লোক বন্দুক হাতে নিয়ে ঘিরে ধরল সেই বাড়ি। লোকগুলোর মুখে কালো রুমাল বাঁধা। তাদের একজনের হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল।

জীবু এর আগে মিলিটারি দেখেনি। এরাই কী মিলিটারি? এবার কি এরা এবাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেবে?

ওই দলের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এসে বাংলায় বলল, আপনারা ভয় পাবেন না, আমরা আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। আজকের রাতটা এই গ্রামেই থাকব।

কে এসে বসে পড়ল মাটির দাওয়ায়। হাতের বন্দুকটা নামিয়ে রাখল পাশে।

বাড়ির সবাই ঘরের মধ্যে লুকিয়েছিল। এবারে আব্বাসের বাবা বেরিয়ে এসে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, হুজুর, মুক্তিবাহিনী কারে কয়?

সেই লোকটি হেসে বলল, আপনারা কিছুই জানেন না। তাই না? বসেন, আমার কাছে এসে বসেন, সব বুঝিয়ে বলছি।

আব্বাসের বাবা জিয়াদ উবু হয়ে বসলেন তার কাছে।

লোকটি বলল, দেশে একটা যুদ্ধ চলছে, আপনারা জানেন?

আব্বাসের বাবা বললেন, একটু একটু শুনেছি। কীসের যুদ্ধ বলেন তো!

জীবুও আড়াল থেকে শুনল। সেই প্রথম সে জানল যে যুদ্ধ চলছে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের। বেশিরভাগ সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ পশ্চিম পাকিস্তানেরই হাতে। তারা বাঙালিদের শেষ করে দিতে চাইছে। এখন বাঙালি ছেলেরাও অস্ত্র জোগাড় করে পালটা আক্রমণ করছে। তাদেরই বলে মুক্তিবাহিনী। পাশের দেশ ভারত থেকে তারা সাহায্য পাবার আশা করছে।

মুক্তিবাহিনীর সেই নেতাটির নাম জহির। সে আব্বাসের বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ভাই, আমরা দুই দিন কিছু খাইনি। বনেজঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে হয়। আজ আপনারা এই গ্রামের লোকেরা আমাদের চারটি ভাত খাওয়াবেন? একটু শোওয়ার জায়গা দেবেন!

একটু পরেই জেলে বস্তির সব লোক ছুটে এল মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের দেখার জন্য। ঘরে ঘরে উনুন জ্বলে উঠল, রান্না হল ভাত, ডাল, মাছের ঝোল।

মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা উঠোনে বসে কলাপাতায় ভাত খাচ্ছে তৃপ্তি করে, আর সব লোক দেখছে!

খাওয়া শেষ করার পর জহির উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অনেকদিন পর এমন পেট ভরে খেলাম। বড়ো ভালো লাগল। কিন্তু আপনাদের ধন্যবাদ দিতে চাই না। আমরা তো আপনাদের সন্তান। আমরা তো আপনাদেরই জন্য যুদ্ধ করছি। আজ রাত্তিরে আমরা ঘুমোব। আপনারা পাহারা দেবেন। খবরদার, আপনাদের মধ্যে কেউ শত্রুপক্ষকে খবর দিলে তাকে আমরা চরম শাস্তি দেব। বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু!

ভোর হতে-না-হতেই মুক্তিবাহিনীর দলটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার তারা ফিরে এল তিন দিন বাদে।

এরপর মাঝে মাঝেই তারা আসে। খায়, ঘুমোয়, আবার যুদ্ধ করতে চলে যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন ফেরে না, কিন্তু দেখা যায় নতুন মুখ।

জহিরের সঙ্গে জীবুর বেশ ভাব হয়ে গেছে।

জহিরের মুখেই সে শুনল যে তাদের গ্রাম সুতোহাটি একেবারে পুড়িয়ে দিয়েছে মিলিটারি। সেখানে ফিরে যাওয়া এখন ঠিক হবে না। তবে, জীবুর মা-ঠাকুমারা যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে সেই ভোলাগঞ্জে এখনও আক্রমণ হয়নি।

সত্যময় আর কিরণময় নামে কাউকে চেনে না জহির। তবে সে শুনেছে যে টাঙ্গাইলে মুক্তিবাহিনীতে কিরণময় নামে একটি ছেলে যুদ্ধ করছে খুব সাহসের সঙ্গে। সে জীবুর মেজদা হতেও পারে, না-হতেও পারে।

একইরকমভাবে দেড় মাস কেটে যাবার পর আবার বিপদ এল অন্যদিক থেকে।

নদী দিয়ে বয়ে চলে এল দুটো স্টিমার, তাতে মিলিটারি ভরতি। দিনের বেলা ধক ধক ধক ধক আওয়াজ করতে করতে এল স্টিমার দুটো, থেমে রইল মাঝনদীতে। ছোটো নৌকোয় করে মিলিটারিরা অন্য পাড়ে নেমে আক্রমণ চালাল সেদিকের গ্রামে।

তারা এদিকে এল না, আজ আসেনি, কাল তো আসতে পারে।

রাত্তির দশটায় চুপি চুপি এসে পৌঁছোল মুক্তিবাহিনী। আজ তাদের খাওয়া কিংবা বিশ্রামের দিকে মন নেই। নেমে বস্তির সবাইকে ডেকে মিটিং করল।

জহির বলল, এবার আপনাদেরও বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। ওরা কখন কোন দিকে আক্রমণ করবে ঠিক নেই। এবার ওদের ওপর একটা চরম আঘাত হানতে হবে। স্টিমার দুটোকে ধ্বংস করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের কাছে লিমপেট মাইন আছে। সেগুলো যদি কোনোরকমে স্টিমার দুটোর গায়ে আটকে আসা যায়, তাহলে উড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ওদের মেশিনগান ফিট করা আছে, সার্চলাইট ফেলে সারারাত পাহারা দেবে। স্টিমার দুটোর কাছে পৌঁছোনো যাবে কী করে?

তিনটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা যাব!

জহির বলল, তোদের সাহস আছে, বুঝলাম। কিন্তু তোরা পৌঁছোতে পারবি না। তার আগেই গুলি খেয়ে মরবি। তাতে কী লাভ হবে? অন্য উপায় ভাবতে হবে।

জীবু তক্ষুনি বলে উঠল, জহির ভাই, আমি যেতে পারি না; আমি ভালো সাঁতার জানি!

আব্বাসও সঙ্গেসঙ্গে বলল, আমিও ভালো সাঁতার জানি। আমি আর জীবু ঠিক পারব।

সঙ্গেসঙ্গে আব্বাসের মা ছুটে এসে আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, না, আমার ছেলেটা যাবে না। ওকে আমি যেতে দেব না।

জহির সেদিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে ধমকের সুরে বলল, আপনি কান্না থামান! এখন কান্নার সময় নয়। আপনি আপনার ছেলেকে যেতে দিতে চান না। জীবুর মা এখানে নেই, তাই তার জন্য কেউ কাঁদবে না! এটা আমাদের দেশের জন্য জীবনমরণের লড়াই। বাচ্চা ছেলে-মেয়ে থেকে বুড়োবুড়ি পর্যন্ত সবাই আমরা সৈনিক। প্রত্যেকেরই কিছু-না-কিছু ভূমিকা আছে। অনেককেই প্রাণ দিতে হতে পারে। আমারও মা আছে। আমি মরে গেলে আমার মা কাঁদবে না?

তারপর সে অন্যদের দিকে ফিরে বলল, নিষ্ঠুরের মতন শোনালেও আমি প্রথমে এই বাচ্চা ছেলে দুটোকে পাঠানোর পক্ষপাতী। ওরা ছোটো, ওরা সাঁতরে গেলে শব্দ কম হবে। শত্রুরা হয়তো ওদের দেখতে পাবে না। আগে ওরা চেষ্টা করে দেখুক!

জীবুর কাঁধ চাপড়ে জহির জিজ্ঞেস করল, কীরে, ভয় পাবি না তো?

জীবু জোরে জোরে দু-দিকে মাথা নাড়ল।

আব্বাস তার মায়ের বাহুবন্ধন ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে দাঁড়াল জীবুর কাছে।

জহির তাদের শিখিয়ে দিল, কী করে সেই লিমপেট মাইন লাগাতে হবে।

অমাবস্যার রাত, একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু-টি দশ বছরের ছেলে নেমে পড়ল নদীতে।

স্টিমার দুটো থেকে সার্চ লাইট ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। যেই আলোটা ওদের কাছে আসছে, অমনি ডুব দিচ্ছে দু-জনে। নদীতে এমনিই স্রোতের শব্দ আছে, ওদের সাঁতারের শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

বেশ সহজেই ওরা স্টিমার দুটোর কাছে পৌঁছে গেল। সার্চ লাইট অনেক দূরে দূরে পড়ে। ওপরে মিলিটারিদের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। জীবু আর আব্বাস দুটো স্টিমারের গায়েই কয়েকটা মাইন সেঁটে দিল।

তারপর সাঁতরাতে লাগল উলটো দিকে।

এবারে ওদের ওপরে সার্চ লাইট পড়ে গেল একবার। দেখে ফেলল মিলিটারিরা। সঙ্গেসঙ্গে গুলি চালাল। কিন্তু ডুব সাঁতার দিলে গায়ে গুলি লাগে না। এক-একবার ওরা মাথা তোলে, অমনি গুলি ছুটে আসে। আবার ডুব, বেশিক্ষণ দিতে হল না, বিকট বুম বুম শব্দে স্টিমার দুটো ধ্বংস হতে লাগল, দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল আগুন।…

এসব কতদিন আগেকার কথা।

এরপর আঠাশ বছর কেটে গেছে।

জীবু ঘুরতে ঘরতে আগরতলা হয়ে পৌঁছেছিল কলকাতায়, আশ্রয় পেয়েছিল এক মামার বাড়িতে। তার বাবার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মেজদা মণিময় যুদ্ধে অনেক লড়াই করে আহত হয়েছিল, বেঁচে গেছে শেষপর্যন্ত। সত্যময়ের খবর কেউ জানে না। ঠাকুমা আসবার পথেই মারা গিয়েছিলেন, মা পৌঁছেছিলেন কলকাতায় তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে।

জীবু এখন জীবনময় সেনগুপ্ত, লেখাপড়া শিখে বড়ো অফিসার হয়েছে। সেজেগুজে অফিস যাচ্ছে। মিনিবাস আসতে দেরি করছে বলে হাতঘড়ি দেখছে অনবরত। ওকে দেখে কে বিশ্বাস করবে যে দশ বছর বয়সে ও কী সাংঘাতিক সব কান্ড করেছিল!

জীবনময় অবশ্য সেইসব দিনগুলির কথা ভুলে যায়নি। অফিসে নানান ব্যস্ততার মধ্যেও মনে পড়ে যায়। সে একসময় মাছ ধরার নৌকোয় ঘুরে ঘুরে জাল ফেলে দিব্যি মাছ ধরা শিখেছিল, এখন ভাবলেও সে আপন মনে হাসে।

অফিস থেকে ফেরার পথে এক-একদিন সে নেমে পড়ে খিদিরপুরের একটা বস্তিতে। বস্তির ছেলে-মেয়েদের জন্য সন্ধ্যে বেলায় একটা স্কুল আছে, জীবনময় সেখানে পড়ায়। একটা জেলে বস্তির লোকেরা তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সেই ঋণ খানিকটা শোধ দিতে হবে তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *