দশে দিক

দশে দিক

রাষ্ট্রপতি ভবনে নিজের অফিসে চুপ করে বসে রয়েছেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি অরুণ চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে রয়েছেন ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় বীরেন্দ্র মেহতা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ। অরুণের রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার আগে রঞ্জিতের মুখে তিনি এ কী খবর শুনলেন?

বীরেন্দ্র মেহতার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাননীয় হরভজন সিংহ। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষটি কম কথা বলতেন, শুনতেন বেশি। পড়শি দেশের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলতেন। ভারতের বিদেশনীতিও সেই রকমই ছিল। নতুন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের নীতি হল, ‘আমরা ভালোর ভালো। মন্দের যম।’ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ওয়ারিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে বীরেন্দ্র সবসময় প্রস্তুত। ভারত এবং ওয়ারিস্তান দুটি দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। যুদ্ধ লাগলে দুটি দেশই ধ্বংস হয়ে যাবে। সব জেনেও বীরেন্দ্র যুদ্ধের পক্ষে। এই কঠিন সময়ে এ কী ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেল? কাইমেরার তিন সদস্য প্রথমা, ষষ্ঠী এবং অভিনন্দনের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

কাইমেরা হল ভারতবর্ষের গোপনতম ইনটেলিজেন্স উইং। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনের জন্যে এই উইং তৈরি করেছিলেন রাষ্ট্রপতি অরুণ চট্টোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী হরভজন সিংহ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ। গত কয়েক বছর ধরে কাইমেরা অজস্র গোপন মিশনে সফল হয়েছে। কিছু মিশনে ব্যর্থও হয়েছে। কাইমেরার পাঁচ এজেন্টের মধ্যে একজন মারা গেছে। তার নাম ধ্রুবিকা বসু। অন্য এক এজেন্ট, আয়েষা খাতুন এই মুহূর্তে লন্ডনে। বাকি তিনজন ওয়ারিস্তানে একটা গোপন মিশনে গেছে, যার নাম ‘মিশন এক্স’। এই মিশনের কথা এতক্ষণ পর্যন্ত রঞ্জিত ছাড়া কেউ জানতেন না। একটু আগে তিনি অরুণ আর বীরেন্দ্রকে ‘মিশন এক্স’-এর কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ প্রথমা, ষষ্ঠী আর অভিনন্দনের সঙ্গে টেলি যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই বীরেন্দ্র কাইমেরা সংক্রান্ত প্রতিটি ক্লাসিফায়েড নথি পড়ে ফেলেছেন। সেগুলো পড়ার পরে তাঁর বক্তব্য হল, সময় এবং অর্থের অপব্যয় ছাড়া কাইমেরার আর কোনও গুরুত্ব নেই। ভারতবর্ষের বিদেশ নীতি বদলেছে। নতুন ভারতবর্ষ গোপনে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন করবে না। নতুন ভারতবর্ষ ময়দানে নেমে যুদ্ধ করবে। কাজেই কাইমেরার অবলুপ্তি ঘটবে। এতে অরুণ বা রঞ্জিতের সায় না থাকলেও উপায় নেই। অরুণ বিদায় নিচ্ছেন। রঞ্জিত বসের কথা শুনতে বাধ্য।

নীরবতা ভেঙে বীরেন্দ্র বললেন, ‘মিশন এক্স-এর পরিণতি জানার জন্যে আমরা আর দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করব। আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্সের প্রধানদের সঙ্গে আমার ডিনার আছে রাত ন’টা থেকে। এখন সন্ধে সাতটা বাজে। লেটস ওয়েট ফর টু আওয়ারস।’

অরুণ চুপ। রঞ্জিতের মুখে কোনও এক্সপ্রেশান নেই। তিনি টেবিলে রাখা স্যাটেলাইট ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভালো বা খারাপ, খবর এলে এই ফোনেই আসবে।

ওয়ারিস্তানের আশিকানা প্রাসাদের তিনতলার করিডোর দিয়ে দৌড়চ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরাজ। তাঁর সঙ্গে দৌড়চ্ছেন সেনাপ্রধান আজাদ। এক সান্ত্রী খবর দিয়েছে যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মায়া মল্লিকের বেডরুমে ঢুকেছে আর্মির পোশাক পরা এক মহিলা। ইমরাজ আন্দাজ করছেন মেয়েটি ইন্ডিয়ান এজেন্ট প্রথমা লাহিড়ী। যে দীর্ঘদিন ধরে ওয়ারিস্তানকে জ্বালাচ্ছে।

ইমরাজের একটাই ভয়। তিনি পৌঁছনোর আগে মায়া প্রথমাকে খুন না করে ফেলেন। প্রথমা অনেক গোপন তথ্য জানে। ওর পেট থেকে আগে কথা আদায় করতে হবে। তারপর খুন।

মায়ার শোওয়ার ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দুম দুম করে দরজা ধাক্কালেন ইমরাজ। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি সেনাপ্রধান আজাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী করে জানা গেল যে কেউ মায়ার ঘরে ঢুকেছে?’

আজাদ বললেন, ‘মিনিট পনেরো আগে আশিকানা প্রাসাদের সমস্ত আলো হঠাৎ নিবে গিয়েছিল। কোনও মোবাইল বা স্যাটেলাইট ফোন কাজ করছিল না। সিসিটিভি ক্যামেরা বা মোশন সেন্সর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যায়।’

আবার দরজা খটখট করে ইমরাজ বললেন, ‘মোস্ট প্রোব্যাবলি জ্যামার ইউজ করা হয়েছিল।’

আজাদ বললেন, ‘অন্ধকারের মধ্যে তিনতলার এক সান্ত্রী দেখতে পায় যে মায়া ম্যাডামের ঘরে আর্মির ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে ঢুকছে। মায়া ম্যাডাম ছাড়া এই প্রাসাদের অন্য কোনও মেয়ে ওই পোশাক পরে না। সান্ত্রী বিপদের গন্ধ পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। ততক্ষণে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।’

‘মায়া! দরজা খুলুন!’ চিৎকার করে ওঠেন ইমরাজ। আজাদ বলেন, ‘ম্যাডাম, আর ইউ অল রাইট?’

কোনও উত্তর নেই। ইমরাজ আর আজাদ একে অপরের দিকে তাকালেন। দু’জনে একসঙ্গে হোলস্টার থেকে অস্ট্রিয়ান কোম্পানির তৈরি গ্লক হ্যান্ডগান বার করে দরজার লকিং সিস্টেমের দিকে তাক করে বললেন, ‘ওয়ান…টু…’

দরজা খুলে গেল। আর্মির ইউনিফর্ম পরা, হাতে একে ফিফটি সিক্স ধরে রাখা মায়াকে দরজা খুলতে দেখে ইমরাজ আর আজাদ একসঙ্গে গ্লক নামিয়ে নিলেন।

‘কে ঢুকেছে?’ ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করলেন ইমরাজ। উত্তরও পেয়ে গেলেন। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে প্রথমা। শক্তিশালী নাইলনের দড়ি দিয়ে হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। কপাল থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। চোখ আগুনের মতো জ্বলছে।

মায়া বললেন, ‘এ হল ইন্ডিয়ার এজেন্ট প্রথমা লাহিড়ী। আমি একে কবজা করে ফেলেছি। আজাদ, আপনি খুঁজে বার করুন, সান্ত্রীদের মধ্যে ইন্ডিয়ার এজেন্ট কে আছে? কে আশিকানা প্রাসাদের ইলেকট্রিক সার্কিটের মেইন সুইচ অফ করেছিল?’

‘এবং কে জ্যামার ইউজ করেছিল?’ প্রথমার দিকে গ্লক তাক করে বললেন ইমরাজ।

‘জ্যামার এই কুত্তিটার সঙ্গে ছিল!’ প্রথমার কপালে একে ফিফটি সিক্সের নলের বাড়ি মারলেন মায়া। যন্ত্রণায় প্রথমার মুখ কুঁচকে গেল। ইমরাজ দেখলেন মেঝেতে একটা জ্যামার পড়ে রয়েছে। সিনচান দেশে তৈরি, লম্বা অ্যান্টেনাওয়ালা এই ডিভাইস দিয়ে মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট ফোন, জিপিএস, সিসিটিভি, ইলেকট্রনিক সেন্সর—সব কিছু ব্লক করে দেওয়া যায়। জ্যামার হাতে নিয়ে ইমরাজ দেখলেন সেটা অফ করা রয়েছে। টেবিলে জ্যামার রেখে তিনি এগিয়ে গেলেন প্রথমার দিকে। ওর কপালের ক্ষতস্থানে তর্জনী গুঁজে বললেন, ‘কেন এসেছিলি? আমাকে খুন করতে?’

প্রথমা উত্তর দিল না। সে চোখ বুঁজে ব্যথা সহ্য করছে। তার রগে গ্লক ঠেকিয়ে ইমরাজ বললেন, ‘এখানে বলবি? না টর্চার চেম্বারে নিয়ে যাব?’

প্রথমা চুপ। তার গালে সপাটে থাপ্পড় কষিয়ে ইমরাজ বললেন ‘বল!’

‘আপনি মেয়েদের গায়ে হাত দেবেন না!’ ইমরাজকে বললেন মায়া, ‘আমিই ওকে বুঝে নিচ্ছি।’

‘কী ভাবে?’ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ইমরাজ।

টেবিল থেকে একটা চিরকুট তুলে ইমরাজকে দেখালেন মায়া। ‘এইটা প্রথমার কাছে ছিল। আমি ওর বুকে একে ফিফটি সিক্স ঠেকাতেই খেয়ে ফেলার চেষ্টা করছিল। অনেক কষ্টে মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বার করেছি। এতে কতগুলো ছবি আঁকা রয়েছে। কীসের ছবি বুঝতে পারছি না।’

ইমরাজ দেখলেন চিরকুটে অনেকগুলো ছবি পেন দিয়ে আঁকা রয়েছে। বাচ্চাদের হিজিবিজি ড্রয়িং-এর মতো। ছবিগুলো দেখে তিনি বললেন, ‘তিনটে লাইনে কয়েকটা ছবি আঁকা আছে। প্রথম আর দ্বিতীয় লাইনে চারটে করে ছবি। শেষ লাইনে দুটো।’

মায়া বললেন, ‘কী আঁকা আছে?’

ইমরাজ বললেন, ‘প্রথম লাইনের প্রথম ছবিতে বাজ পড়ছে। দ্বিতীয় ছবিতে একটা গিঁট। তিন নম্বর ছবিতে একটা পশম। শেষ ছবিতে একটা গদা। এগুলোর মানে কী?’

‘আমার মনে হয় এগুলো হিন্দু মিথোলজির সঙ্গে রিলেটেড।’ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন মায়া, ‘অক্সফোর্ডে থাকার সময়ে আমি রামায়ণ, মহাভারত আর পুরাণ পড়েছি। এগুলো দেবতার অস্ত্র। বজ্র দেবরাজ ইন্দ্রের অস্ত্র। বরুণদেবের অস্ত্র হল পাশ।’

‘পাশ আবার কী রকম ওয়েপন?’ জিজ্ঞাসা করলেন আজাদ।

‘নাগপাশ মানে সাপের বন্ধন। ওই ‘বন্ধন’ বা ‘গিঁট’ শব্দটি এসেছে ‘পাশ’ থেকে।’ বললেন মায়া, ‘গদা হল কুবেরের অস্ত্র। আর যমের অস্ত্র পশম।’

‘সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এগুলো কী সিগনিফাই করছে?’ ইমরাজ চিন্তিত।

চিন্তিত মায়াও। তিনি ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, মোবাইলে ফোন করছেন, আবার ভাবছেন। হঠাৎ বিদ্যুতের বেগে ঘুরে প্রথমার বুকে একে ফিফটি সিক্স চেপে ধরে চিৎকার করে উঠেছেন, ‘বলবি? না ট্রিগার টিপব?’

মায়া এত জোরে চেঁচিয়েছেন যে ইমরাজ ঘাবড়ে গেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, ‘প্লিজ! মেয়েটাকে এখনই মেরে ফেলবেন না!’

ইমরাজ একাই ঘাবড়াননি। ঘাবড়েছে প্রথমাও। সে প্রাণভয়ে বলে ফেলল, ‘দিক! ওগুলো দিক!’

‘মানে?’ একে ফিফটি সিক্স নামিয়ে প্রথমার সামনে চেয়ার টেনে বসলেন মায়া।

প্রথমা বলল, ‘দিক মানে ডিরেকশান। হিন্দু শাস্ত্রে প্রতিটি দিকের জন্যে একজন করে ঈশ্বর আছেন। এঁদের দিকপাল বলা হয়। ইন্দ্র, বরুণ, কুবের এবং যম যথাক্রমে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ দিকের ঈশ্বর।’

‘অত কিছু জানতে চাই না। চার দিকের ঈশ্বররা কী করতে চাইছেন? মোদ্দা কথাটা কী?’

প্রথমা বলল, ‘ওয়ারিস্তান সমুদ্র ঘেরা একটা দ্বীপ। তাকে চারদিক দিয়ে আক্রমণ করতে আসছে ভারতীয় নৌবাহিনী।’

মায়া, ইমরাজ আর আজাদ একে অপরের দিকে তাকালেন। আজাদ ঘরের কোণে চলে গিয়ে ফোন করে নিচু গলায় কিছু বললেন। ও প্রান্তের উত্তর শুনে ফোন কাটলেন। মেঝেয় পড়ে থাকা বন্ধ জ্যামারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের স্যাটেলাইট পিকচার বলছে দূরদূরান্তের সমুদ্রে কোথাও কোনও ভারতীয় রণতরী নেই। এই মেয়েটা মিথ্যে কথা বলছে।’

মায়া আচমকা প্রথমার গালে ঘুষি মারলেন। প্রবল জোরে চিৎকার করে উঠল প্রথমা। মায়া হিশহিশ করে বললেন, ‘টেল মি দ্য ট্রুথ!’

ইমরাজ চিরকুটটা মন দিয়ে দেখছেন। এবার বললেন, ‘দ্বিতীয় লাইনে আঁকা রয়েছে ত্রিশূল, দণ্ড, খড়গ এবং অঙ্কুশ। এগুলোর মানে কী?’

মার খেয়ে প্রথমা কথা বলার অবস্থায় নেই। উত্তেজিত হয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন মায়া। হঠাৎ ছাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেয়েটাকে অন্যভাবে টাইট দিতে হবে। তবে ও মুখ খুলবে।’ তারপর আজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সিলিঙে যে হুকটা লাগানো আছে, ওর সঙ্গে নাইলনের দড়িটা বাঁধুন।’

আজাদ অবাক হয়ে বললেন, ‘নাইলনের দড়ি কোথায় পাব?’

প্রথমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে মায়া নাইলনের দড়ি তুলে দিলেন আজাদের হাতে। প্রথমা নড়াচড়া করছে না। কারণ ইমরাজ তার দিকে গ্লক তাক করে রেখেছেন।

ঘরের কোণ থেকে অ্যালুমিনিয়ামের ফোল্ডিং মই এনে তাতে চড়ে সিলিং পর্যন্ত হাত গেল। মায়া হুকুম করলেন, ‘দড়িটা হুকে গলিয়ে অন্য প্রান্ত নীচে নিয়ে আসুন। এক প্রান্ত ইন্ডিয়ান স্পাইটার পায়ে বাঁধব। অন্য প্রান্ত জানলায় গিঁট দিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখব।’

নাইলনের দড়ি গলানো সেরে নেমে এসেছেন আজাদ। দড়ির এক প্রান্ত দিয়ে প্রথমার পা বাঁধলেন মায়া। হ্যাঁচকা টানে প্রথমাকে শূন্যে ঝুলিয়ে জানলার রডে দড়ির অন্য প্রান্ত বেঁধে দিলেন। নিজের মোবাইল থেকে কাউকে একটা ফোন করলেন। উত্তেজিত ফোনালাপের শেষে ইমরাজকে বললেন, ‘অক্সফোর্ডে আমার এক বন্ধু আছে। নাম বাশা। ওয়ারিস্তানের লোক। পড়াশুনো করেছে ইন্ডোলজি নিয়ে। বাশাকেই ফোন করেছিলাম।’

ইমরাজ জানতে চাইলেন, ‘কী বললেন বাশা?’

‘বললেন যে ত্রিশূল হল ঈশান বা শিবের অস্ত্র। দণ্ড অগ্নিদেবের। খড়গ নৈঋতের এবং অঙ্কুশ বায়ুদেবের। এই চার দেবতা আবার চারটি দিককে রক্ষা করেন। ঈশান উত্তর-পূর্বের দেবতা। উত্তর-পশ্চিমের দেবতা হলেন অগ্নি। দক্ষিণ-পশ্চিমের দেবতা হলেন বায়ু এবং দক্ষিণ-পূর্বের হলেন নৈঋত। বাকিটা কথা মেয়েটা বলবে।’

প্রথমার সারা শরীরের সব রক্ত মাথায় এসে জমা হচ্ছে। মুখ লাল টকটক করছে। চোখের সাদা অংশ লাল হতে শুরু করেছে। মাথা ঘুরছে। সে বলল, ‘ওয়ারিস্তানের উত্তর-পূর্বে শ্যামলদেশ আর উত্তর-পশ্চিমে মালব্যনগর। দক্ষিণ-পূর্বে সিংহদ্বীপ আর দক্ষিণ-পশ্চিমে সুবর্ণভূমি। এই চার দেশের এয়ারফোর্স রেডি। ওরা খুব শীঘ্র মুভমেন্ট শুরু করবে। কয়েকশো এফ সিক্সটিন ওয়ারিস্তানের দিকে উড়ে আসবে। শুরু হবে কার্পেট বম্বিং!’

ইমরাজের আবার ইচ্ছে করছে প্রথমাকে পেটাতে। কিন্তু এখন সময় নেই। তিনি মোবাইলে নিজের দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ফোন কেটে বললেন, ‘মেয়েটা আবারও মিথ্যে কথা বলছে। মাল্টি-কান্ট্রি সার্জিকাল স্ট্রাইকের কোনও খবরই নেই।’

আজাদ হঠাৎ খেপে গিয়ে দৌড়ে গেল প্রথমার দিকে। ভারি মিলিটারি বুট দিয়ে মুখে মারল এক লাথি, যে ভাবে খেলোয়াড়রা ফ্রি কিক মারে। বিকট চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল প্রথমা। তার শরীর দুলছে পেন্ডুলামের মতো। দোলাচলের রাস্তায় রক্ত দিয়ে আলপনা আঁকা হয়ে যাচ্ছে।

‘ইডিয়েট!’ আজাদের দিকে একে ফিফটি সিক্স তাক করে মায়া বললেন, ‘বলেছি না, মেয়েদের গায়ে হাত দেবেন না?’

ইমরাজও রেগে গেছেন আজাদের ওপরে। তিনি বললেন, ‘মাথায় চোট লেগে মেয়েটার মেমরি চলে গেলে ওর পেট থেকে খবর বার করব কী করে?’

আজাদ গজগজ করে বলল, ‘কুত্তিটা শুধু মিথ্যে কথা বলছে আর আমাদের সময় নষ্ট করছে। ওকে বাঁচিয়ে রেখে লাভটা কী?’

ইমরাজ চিরকুটটা দেখে বললেন, ‘শেষ লাইনে দুটো চিহ্ন আঁকা রয়েছে। পদ্মফুল আর চক্র। এর মানে কী? সত্যি কথা বল। এইটাই তোর লাস্ট চান্স।’ তিনি হাঁটু গেড়ে বসে প্রথমার রগে গ্লক ঠেকিয়েছেন।

প্রথমার জ্ঞান ফিরছে। তার মাথা দপদপ করছে, দৃষ্টি বিভ্রম হচ্ছে, যন্ত্রণায় সারা শরীর অসাড়। উল্টো অবস্থায় ঝুলে থাকার জন্যে গা গুলোচ্ছে, বমি পাচ্ছে, ব্যালান্সের অভাব হচ্ছে। এর থেকে মরে যাওয়াও ভালো। এইভাবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। সে কি মরেই যাবে? লাল চোখ মেলে সে বলল, ‘পদ্ম মানে ব্রহ্মা। চক্র মানে বিষ্ণু’

‘তার মানে কী?’ গ্লক দিয়ে আবার প্রথমাকে খোঁচালেন ইমরাজ।

মায়ার ফোন বাজছে। তিনি চমকে উঠে ফোন ধরলেন। চুপ করে শুনলেন অন্য পক্ষের কথা। তারপরে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো। তাই নাকি? এটা আমি জানতাম না! অভিনন্দন!’

‘কার ফোন?’ জিজ্ঞাসা করলেন ইমরাজ।

‘অক্সফোর্ড থেকে বাশা ফোন করেছিল। ও ব্রহ্মা আর বিষু�র ব্যাখ্যাটা দিল। এই দুজনে যথাক্রমে ঊর্দ্ধ এবং অধঃ এই দুই দিকের দেবতা। ইংরিজিতে যাকে বলে জেনিথ এবং নাদির। আকাশ এবং পাতাল। তাই ওকে কনগ্র্যাচুলেট করলাম।’

প্রথমার দিকে তাকিয়ে ইমরাজ বললেন, ‘সত্যি কথা বলার এটাই শেষ সুযোগ। এই দুই দিক থেকে কে বা কারা অ্যাটাক করছে? নাকি পুরোটাই তোর বানানো গল্প?’

প্রথমা মায়ার দিকে তাকিয়েছিল। ইমরাজের প্রশ্ন শুনে গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আকাশ থেকে আশিকানা প্রাসাদের ছাদে নেমে এসেছি আমি নিজে। আমিই ঊর্দ্ধ। আমিই জেনিথ। আমার উদ্দেশ্য একটাই। তোদের গল্প বলে ব্যস্ত রাখা। যাতে আসল কাজটা ঠিকঠাক হয়ে যায়।’

‘দশটা মিথ্যের মধ্যে একটা মিথ্যেকে সত্যি প্রমাণ করেই ছাড়ল।’ লাথি মারার জন্যে আবার পা তুলেছেন আজাদ। তাঁকে থামিয়ে প্রথমার চিবুকে একে ফিফটি সিক্সের নল ঠেকিয়ে মায়া বললেন, ‘আসল কাজটা কী?’

‘আসল কাজ হবে পাতাল থেকে,’ হাঁফাচ্ছে প্রথমা, ‘আশিকানা প্রাসাদের নীচে একটি সুড়ঙ্গ আছে। যার কথা ওয়ারিস্তান মিলিটারি ছাড়া আর কেউ জানে না। সেখানে ঢোকার রাস্তা আশিকানা প্রাসাদের দক্ষিণ দিকের পাঁচিলের ঠিক ভিতরে। আর বেরোনোর রাস্তা সমুদ্রের নীচে। এই সুড়ঙ্গ বানিয়েছে ওয়ারিস্তানের মিলিটারি। উদ্দেশ্য একটাই। শত্রু আক্রমণ করলে সুড়ঙ্গের শেষে লাগানো দরজা খুলে ওখানে রাখা সাবমেরিন চেপে পালানো যাবে।’

‘মিলিটারি সিক্রেট তুই কী করে জানলি?’ প্রথমার মাথায় একে ফিফটি সিক্সের নলের বাড়ি মেরে জিজ্ঞাসা করলেন মায়া।

‘আপনাদেরই কেউ বলেছে।’ ক্রুর হাসল প্রথমা, ‘ওয়ারিস্তানে দেশদ্রোহীর অভাব নেই!’

মায়া আবার প্রথমাকে মারতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে ইমরাজ বললেন, ‘ওই সুড়ঙ্গে কী হবে?’

‘সুড়ঙ্গের পাশে প্যারা-ড্রপ করেছেন ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের এক কম্যান্ডো। তাঁর সঙ্গে আছে টাইমার দেওয়া শক্তিশালী বোম্ব। উনি অলরেডি সুড়ঙ্গে ঢুকে, বোম্ব রেখে টাইমার অন করে দিয়েছেন। এবার সাবমেরিন চালিয়ে নিরাপদ দূরত্ব চলে যাবেন। তারপরেই ঘটবে বিষ্ফোরণ। আমি সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। গোটা আশিকানার সঙ্গে ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে আমিও উড়ে যাব। জয় হিন্দ!’

আতঙ্কিত ইমরাজ মোবাইলে কথা বলছেন। ফোন কেটে বললেন, ‘মেয়েটা ঠিকই বলছে। সুড়ঙ্গে একজন ইন্ডিয়ান স্পাই ঢুকেছে। গুলিগোলা শুরু হয়েছে। আমি চললাম। চলুন আজাদ।’

‘আমিও যাব।’ দাবি করলেন মায়া।

‘না!’ দরজা আটকে ইমরাজ বললেন, ‘আপনি মেয়েটার ওপরে নজর রাখুন। ওকে আমাদের পরে দরকার লাগবে।’

ইমরাজ আর আজাদ চলে যাওয়ার পরে দরজা বন্ধ করলেন মায়া। টেবিল থেকে জ্যামার নিয়ে প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন। একে ফিফটি সিক্স টেবিলে রেখে প্রথমার বাঁধন খুলে দিলেন। নাইলনের বাঁধন থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমা মেঝেয় হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

প্রথমার দিকে নজর নেই মায়ার। তিনি সিলিঙের হুকে বাঁধা দড়ি ধরে পরপর তিনবার টান মারলেন। একটু পরেই সিলিং থেকে গোল একটা দরজা পাশে সরে গেল, যেভাবে ম্যানহোল সরে যায় রাস্তা থেকে। এখন ওই গোল বৃত্ত দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে।

এবার দেখা গেল একটা ছেলের মুখ। ষষ্ঠীর মুখ। সে নিচু গলায় বলল, ‘প্রথমার কী হয়েছে?’

‘শি উইল বি অলরাইট।’ কঠিন মুখে বললেন মায়া, ‘দড়িটা সিলিং-এর হুক থেকে খুলে ছাদের রেলিং-এর সঙ্গে ভালো করে বাঁধো। না হলে উঠতে পারব না।’

দশ সেকেন্ডের মধ্যে ষষ্ঠী মায়ার হুকুম তামিল করেছে। দড়ির প্রান্তে তিনটে ঢাউস স্যুটকেস বেঁধে মায়া হুকুম করলেন, ‘লিফট দেম, কুইক!’

তিন দফায় মোট দশটা স্যুটকেস উঠল। সেইটুকু সময়ের মধ্যে প্রথমার চোখেমুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছেন মায়া। এবার তিনি বললেন, ‘টাইম টু গো।’

প্রথমা কথা বলার অবস্থায় না থাকলেও শারীরিক সক্ষমতার অভাব নেই। ট্রাপিজ আর্টিস্টের কুশলতায় দড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। তারপরে ষষ্টীর সাহায্য নিয়ে মায়াকে টেনে তুলল।

আশিকানার বিস্তীর্ণ ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওয়ারিস্তানের চপার। আসলে এটি ভারতীয় চপার। ওয়ারিস্তান এয়ারফোর্সের রং চাপানো হয়েছে।

চপারে দশটা স্যুটকেস তুলে ষষ্ঠী পাইলটের আসনে বসল। প্যান্টের পকেট থেকে জ্যামার বার করে অন করলেন মায়া। আশিকানার ছাদে জ্যামার রেখে দিলেন। আবার আশিকানা প্রাসাদের টেলি-কমিউনিকেশান সিস্টেম ব্লক হয়ে গেল। মায়া আর প্রথমা চপারে উঠতেই ষষ্ঠী ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। রোটর ব্লেডের শপশপ আওয়াজ তুলে চপার উড়ে গেল আশিকানা প্রাসাদ থেকে।

ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে চপার। নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মায়া আপনমনে বলছেন, ‘ওয়ারিস্তানে জন্ম হলেও বড় হয়েছি লন্ডনে। পড়াশুনো অক্সফোর্ডে। সারা জীবন লিবারাল আবহাওয়ায় কাটিয়ে পারিবারিক রাজনীতির টানাপড়েনে ওয়ারিস্তানে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভোটে জিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হতেও সমস্যা হয়নি। কিন্তু এত পিতৃতান্ত্রিক, এত স্বৈরাচারী, এত ধর্মান্ধ একটা দেশে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দু’ বছর মন্ত্রী থাকাকালীন এটা বুঝে গেলাম। ডিফেন্স মিনিস্টার কী পরবে, কী খাবে, কোথায় যাবে—সেটা ঠিক করে দেবে আমার অধীনে কাজ করা মিলিটারি। আমি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে অক্সফোর্ড চলে যেতে চেয়েছিলাম। ইমরাজ আর আজাদ ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পুতুল ডিফেন্স মিনিস্টার হয়ে আশিকানা প্রাসাদেই বন্দি থাকতে হবে। এক সুতো বেচাল করলে খুন হয়ে যাব। তাই রঞ্জিত গগৈয়ের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলাম।’

প্রথমা ফার্স্ট এইড বক্স খুলে নিজের ক্ষতয় মলম বোলাচ্ছে। সেই কাজ সেরে মায়াকে বলল, ‘রঞ্জিত স্যার আমাকে আর ষষ্ঠীকে ওয়ারিস্তানে পাঠিয়েছিলেন আপনাকে নিয়ে আসার জন্যে। আপনি নিজস্ব জ্যামার দিয়ে আশিকানা প্রাসাদের টেলি-কমিউনিকেশান সিস্টেম পাঁচ মিনিটের জন্যে ব্লক করে দিয়েছিলেন। অফ করে দিয়েছিলেন আশিকানার পাওয়ার সাপ্লাইয়ের মেইন সুইচ। সেই সুযোগে আমাদের চপার আশিকানার ছাদে নামে। সব ঠিকঠাক চলছিল। চারতলার ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে তিনতলায় আপনার ঘরে ঢোকার সময়ে সান্ত্রী আমাকে দেখে ফেলে।’

‘আশিকানার মধ্যে মেয়েদের প্যান্টশার্ট পরার অনুমতি নেই।’ বললেন মায়া, ‘সান্ত্রীর তাই সন্দেহ হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে সিলিং-এর ট্র্যাপ ডোর দিয়ে ঢোকালে এই ঝামেলা পোহাতে হত না।’

‘আমার ভয় করছিল, ইমরাজ প্রশ্ন না করে বসে যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বেডরুমে নাইলনের দড়ি আর অ্যালুমিনিয়ামের মই কোথা থেকে এল?’ বলল প্রথমা।

তার কথা শুনে মায়া হেসে ফেলেছেন। পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ইমরাজ আর আজাদ দরজায় নক করা শুরু করতেই বুঝলাম, পালানো যাবে না। অন্য উপায় ভাবতে হবে। থ্যাঙ্ক ইউ প্রথমা, এত বড় আর জটিল গপপোটা মুহূর্তের মধ্যে বানিয়ে ফেলার জন্যে।’

প্রথমা মৃদু হাসল।

মায়া বললেন, ‘তুমি চিরকুটে দশটা চিহ্ন আঁকছ, আমি শেলফ থেকে একে ফিফটি সিক্স বার করছি, তোমার কপালে নলের বাড়ি মেরে রক্ত বার করে দিচ্ছি, জ্যামার অফ করে মেঝেতে ফেলে রাখছি, নাইলনের দড়ি দিয়ে তোমার হাত-পা বেঁধে দিচ্ছি…কত কাজ ওই কয়েক সেকেন্ডে দু’জনে মিলে করেছি। তাই না?’

‘আর আপনার ওই ইন্ডোলজিস্ট বন্ধু বাশা? উনি কি সত্যিই আছেন? না আপনার কল্পনা?’

‘বাশা সত্যিই অক্সফোর্ডে থাকে। ও সত্যিই ইন্ডোলজিস্ট। কিন্তু আমি ওকে আদৌ ফোন করিনি। আমি বারবার ফোন করছিলাম ষষ্ঠীকে। ব্যাকআপ প্ল্যানের জন্যে। এয়ারফোর্সের কম্যান্ডো অভিনন্দন কাপুর আশিকানার সীমানার মধ্যে ল্যান্ড করার খবর ষষ্ঠী আমাকে দিতেই আমি ফোনে ‘অভিনন্দন’ শব্দটা উচ্চারণ করে তোমাকে ইঙ্গিত করেছিলাম যে দশ দিকপালের গল্প শেষ করো। বাই দ্য ওয়ে, গল্পটা ভালোই বানিয়েছিলে।’

‘আমি এত কিছু জেনেছি উইকিপিডিয়া থেকে। ওখানেই দেখেছি যে হিন্দু ধর্মে দশ দিকপালের কথা বলা আছে। উইকিপিডিয়া ভুল হলে আমার গল্পও ভুল।’ হাসছে প্রথমা, ‘এই মিশনের নাম ছিল মিশন এক্স। এক্সকে রোমানে দশ-এর মতো দেখতে। ওই থেকেই দশ দিকপালের আইডিয়া মাথায় এল। তার সঙ্গে ইন্ডিয়ান এয়ার অ্যাটাক আর মাল্টি কান্ট্রি সার্জিকাল স্ট্রাইকের গল্প জুড়ে দিলাম। ওটা না করলে অতটা সময় পাওয়া যেত না। তবে আমার খারাপ লাগছে অভিনন্দনের জন্যে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে মিগ টুয়েন্টি থ্রি নিয়ে উড়ে এসে ও ওয়ারিস্তানের মাঠে প্লেনটা ক্র্যাশ করিয়ে দেয়। প্লেন ক্র্যাশ করার ঠিক আগে প্যারাড্রপ করে ঢুকে পড়ে আশিকানা প্রাসাদের দক্ষিণ প্রাচীরের মধ্যে। যেখানে সুড়ঙ্গটা আছে। ওর কাছে কোনও টাইমার দেওয়া বোম্ব নেই। ওয়ারিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ও নিজেকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। যাতে সবার মন সুড়ঙ্গের দিকে ঘুরে যায়। যাতে আপনি সফলভাবে আশিকানা থেকে পালাতে পারেন।’

নিচু গলায় মায়া বললেন, ‘আমি যাতে সফলভাবে পালাতে পারি, সেটা নিশ্চিত করার জন্যে অভিনন্দন ধরা দিয়েছেন। প্রথমা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো যে ওঁর কিছু হবে না। আমি ইমরাজের সঙ্গে ফোনে কথা বললে ও ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের কম্যান্ডো অভিনন্দন কাপুরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।’

প্রথমা বলল না যে অভিনন্দন এয়ারফোর্সের কমান্ডো নয়, কাইমেরার এজেন্ট। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীকে এত কথা বলার প্রয়োজন নেই।

পাইলটের আসন থেকে ষষ্ঠী বলল, ‘আমরা অনেকক্ষণ আগেই ভারতের আকাশ সীমায় ঢুকে গেছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যে দিল্লি পৌঁছে যাব। আমি বরং স্যারকে ফোন করে দিই।’

‘দু’ঘণ্টা হয়ে গেছে,’ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন বীরেন্দ্র মেহতা। ‘রাত ন’টা বাজে। ডিনারে যাওয়ার আগে আমি মিশন এক্সকে ফেলিয়োর বলে ঘোষণা করছি।’

‘এক মিনিট স্যার!’ স্যাটেলাইট ফোন কানে দিয়েছেন রঞ্জিত। ফোন কেটে বললেন, ‘কাইমেরার এক এজেন্ট অভিনন্দন কাপুর ওয়ারিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়েছে।’

‘একটা খারাপ খবর শুনিয়ে শান্তি হল না?’ হিমশীতল গলায় বললেন বীরেন্দ্র। ‘আর একটা শোনাচ্ছেন?’

‘খারাপ খবরটাই শুধু দিয়েছি স্যার!’ বললেন রঞ্জিত, ‘ভালো খবরটা হল, প্রথমা আর ষষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া গেছে। ওরা আকাশপথে দিল্লির হেলিপ্যাডে পৌঁছে গেছে। এখানে আসতে আর পাঁচ মিনিট লাগবে।’

‘কী করে?’ বিস্মিত হয়ে বললেন বীরেন্দ্র।

মৃদু হেসে রঞ্জিত বললেন, ‘আপনাকে এতক্ষণ পুরো সত্যি কথা বলিনি স্যার। মিশন এক্স-এর ওয়ান পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা ছিল ওয়ারিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মায়া মল্লিককে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া। সেই কাজটা করতেই প্রথমা, ষষ্ঠী আর অভিনন্দন ওয়ারিস্তানে গিয়েছিল। মিশন এক্স ইজ সাকসেসফুল স্যার। উনি এখন দিল্লিতে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিনিময়ে উনি ওয়ারিস্তান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আমাদের হাতে তুলে দেবেন। উনি দশ স্যুটকেস ভর্তি ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট আর একাধিক ল্যাপটপ নিয়ে ওয়ারিস্তান ছেড়েছেন।’

‘অভিনন্দনের কী হবে?’ জানতে চাইলেন অরুণ।

‘একটু নেগোশিয়েট করতে হবে। তবে ওকে ওরা দু’এক দিনের মধ্যে ছেড়ে দেবে।’ হাসলেন রঞ্জিত।

দরজা খুলে গেল। প্রথমা আর ষষ্ঠী ঘরে ঢুকে একসঙ্গে বলল, ‘জয় হিন্দ স্যার!’

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *