দশম অধ্যায়—শুম্ভ বধ
ঋষি কহিলেন, প্রাণতুল্য ভ্রাতা নিশুম্ভকে নিহত এবং সৈন্যগণকে হন্যমান দেখিয়া শুম্ভ ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, হে বলিত্বাভিমান-দূষিতে! দুর্গে! তুমি গর্ব্ব করিও না। তুমি অভিমানিনী; কিন্তু যুদ্ধকালে অন্য সকল শক্তিগণের বল আশ্রয় করিয়া যুদ্ধ করিতেছ! দেবী কহিলেন, রে দুষ্ট! এই জগতে একা আমিই বিদ্যমানা। আমা ব্যতীত অপর দ্বিতীয়া কে আছে? এই সকল শক্তিস্বরূপা আমার বিভূতি আমাতেই প্রবেশ করিতেছে দেখ। অনন্তর ব্রহ্মাণীপ্রমুখ সমস্ত শক্তিসমূহ দেবীর শরীরে বিলীন হইয়া গেলেন। তখন অম্বিকা একাকিনীই বিদ্যমানা রহিলেন। অনন্তর দেবী কহিলেন, রে শুম্ভ! আমি স্বকীয় বিভূতি দ্বারা এই স্থলে বহুরূপে অবস্থিতি করিতেছিলাম, এক্ষণে সেই সকল রূপের সংহার করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে একাকিনী রহিয়াছি,—তুই স্থির হ। ১–৫
ঋষি কহিলেন, অনন্তর অবলোকনকারী দেবগণ ও অসুরগণের সম্মুখে দেবী ও শুম্ভাসুর, এই উভয়ের দারুণ যুদ্ধ উপস্থিত হইল। পুনর্ব্বার সেই দেবী ও শুম্ভাসুরের শরবৃষ্টি, শাণিতশস্ত্র ও দারুণ অস্ত্রসমূহের পরস্পর প্রহার দ্বারা সর্ব্বলোকভয়-জনক যুদ্ধ আরম্ভ হইল। চণ্ডিকা যে শত শত দিব্যাস্ত্র সকল প্রক্ষেপ করিলেন, সেই দিব্যাস্ত্রসমূহকে শুম্ভাসুর তৎপ্রতিঘাত-ক্ষম (সেইসব অস্ত্র প্রতিঘাতে সক্ষম) অস্ত্রসমূহ দ্বারা ভগ্ন করিয়া ফেলিল এবং শুম্ভাসুর যে সকল দিব্যাস্ত্র পরিত্যাগ করিল, সেই সকল দিব্যাস্ত্রগণকেও পরমেশ্বরী চণ্ডিকা অবলীলাক্রমে উগ্র হুঙ্কারোচ্চারণাদি দ্বারা ভগ্ন করিলেন। অনন্তর সেই মহাসুর শত শত শর বৃষ্টি করিয়া দেবীকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। দেবীও কুপিতা হইয়া বাণসমূহ দ্বারা তাহার ধনুচ্ছেদন করিলেন। ধনুক ছিন্ন হইলে দৈত্যপতি শক্তি গ্রহণ করিল; দেবী শুম্ভের করস্থিত সেই শক্তিকে চক্র দ্বারা ছেদন করিলেন। তখন দৈত্যাধিপেশ্বর শুম্ভ খড়্গ ও দীপ্তিসম্পন্ন শতচন্দ্রবিশিষ্ট চর্ম্ম গ্রহণ করিয়া দেবীর প্রতি ধাবমান হইল। তখন আগতপ্রায় শুম্ভের খড়্গ ও সূর্য্যকিরণ সদৃশ নির্ম্মল চর্ম্মকে চণ্ডিকা ধনুর্ম্মুক্ত নিশিত (শাণিত) বাণসমূহ দ্বারা ছেদন করিলেন। ৬–১৩
তখন হতাশ্ব, হতসারথি ও ছিন্নধন্বা শুম্ভাসুর অম্বিকা বিনাশে উদ্যত হইয়া ভয়ঙ্কর মুদ্গর গ্রহণ করিল। দেবীও সম্মুখাগত অসুরের মুদ্গর নিশিত শরনিকর দ্বারা ছেদন করিলেন। তথাপি সেই মহাসুর মুষ্টি উদ্যত করিয়া অতিবেগে সেই দেবীর প্রতি ধাবিত হইল। দৈত্যপুঙ্গব সেই মুষ্টি দেবীর হৃদয়ে আঘাত করিল। দেবীও করতল দ্বারা শুম্ভের বক্ষঃস্থলে তাড়না করিলেন। করতল-প্রহারে পীড়িত হইয়া দৈত্যরাজ মহীতলে নিপতিত হইল এবং তৎক্ষণাৎ পুনর্ব্বার উত্থিত হইল। অনন্তর দেবীকে গ্রহণ করিয়া লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক শুম্ভ শূন্যে অবস্থিত হইল। দেবীও শূন্যে নিরবলম্বনা হইয়া তাহার সহিত নিযুদ্ধ (হাতাহাতি যুদ্ধ) করিতে লাগিলেন। অনন্তর আকাশে শুম্ভ ও চণ্ডিকাদেবী, প্রথমে সিদ্ধ ও মুণিগণের বিস্ময়জনক যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। সেই অসুরের সহিত বহুক্ষণ যুদ্ধ করিয়া দেবী তাহাকে ঊর্দ্ধে উত্থাপিত করত ভ্রামিত করিতে লাগিলেন এবং তৎপরে ধরণীতলে নিক্ষেপ করিলেন। ১৪–২০
তখন দুষ্টাত্মা অসুর ধরণীতলে নিপতিত হইয়া অতিবেগে মুষ্টি উদ্যত করত চণ্ডিকার নিধনেচ্ছায় ধাবিত হইল। সেই সর্ব্বদৈত্যেশ্বর শুম্ভকে আগত দেখিয়া দেবী স্বকীয় শূল দ্বারা তাহার হৃদয় ভেদ করত তাহাকে ভূমিতে পাতিত করিলেন। দেবীর শূলাগ্র দ্বারা শুম্ভাসুরের হৃদয় বিক্ষত হইলে, সে গতপ্রাণ হইয়া যখন ভূমিতলে পতিত হইল, তৎকালে সমুদ্র, দ্বীপ ও পর্ব্বতের সহিত সমস্ত পৃথিবী বিচলিত হইল। অনন্তর সেই দুরাত্মা অসুর নিহত হইলে সকলই প্রসন্ন হইল—জগৎ অতীব স্বাস্থ্য লাভ করিল, গগন অতি নির্ম্মল হইল। যে সকল অনিষ্ঠসূচক মেঘ ও উল্কাগণ ইতিপূর্ব্বে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিল, শুম্ভ নিপাতিত হইলে তাহারা অদৃশ্য হইল এবং নদী সকল পূর্ব্বতন পথ দ্বারা প্রবাহিত হইল। অনন্তর সেই অসুর নিহত হইল দেখিয়া সকল দেবগণের মানস অতিশয় হর্ষনির্ভর হইল, কোন গন্ধর্ব্ব মনোহর গান আরম্ভ করিল, কোন কোন গন্ধর্ব্বগণ বাদ্য করিতে লাগিল এবং অপ্সরোগণ নৃত্য করিতে লাগিল। তখন অনুকূল বায়ু সকল বহিতে লাগিল, দিবাকর সুপ্রভ হইলেন, প্রশান্ত হোমাগ্নি সকল প্রজ্বলিত হইতে লাগিল এবং প্রশান্ত দিক্সমূহে শব্দ হইতে লাগিল। ২১–২৭
দশম অধ্যায় সমাপ্ত॥১০॥
—