দশম অধ্যায়। আঁধারে আলো

দশম অধ্যায়। আঁধারে আলো

৫৬

দুঃখ করে কাল কাটাবার সময় সেটা ছিল না গণপতি। অনেক কাজ ছিল। দেশ পার্টি কোনওটাই থেমে ছিল না এতদিন। আমরা পাণ্ডুর গল্প বলব বলে অন্যদের ছবিগুলো স্থির করে রেখেছিলাম। এবার তাদের দিকে তাকাব। পাণ্ডু কৌরব পার্টি থেকে পদত্যাগ করার পর কী কী হল, সেগুলো দেখি এবার।

মহাগুরু চরকার ওপর ঝুঁকে পড়েছেন। গুচ্ছের সাংবাদিক পায়ের কাছে বসে আছে।

ধৃতরাষ্ট্র তার সাদা হাঁটার লাঠির মাথাটা খামচে ধরে আছে। তর্জনী রয়েছে দিল্লির দিকে বা ভবিষ্যতের দিকেও বলা যায়।

কর্ণ, তার কপালের অর্ধচন্দ্র মাঝে মাঝেই জ্বলে উঠছে। কিছু মুসলমান উচ্চবংশের মানুষদের অনর্গল বুঝিয়ে চলেছে।

পঞ্চপাণ্ডব মনের আনন্দে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তাদের দাড়িওয়ালা গুরুর কাছে।

আর প্রিয়া দুর্যোধনী? সে তার অসুস্থ মায়ের অন্ধকার ঘরের মেঝেতে বসে পুতুল খেলে যাচ্ছে। ছোট ছোট খদ্দরের জামাকাপড় পরা পুতুলগুলো নিয়ে তার সংসার-সংসার খেলা।

‘কী করছ প্রিয়া?’

‘পুতুল খেলছি, মা।’

‘কী খেলা?’

‘সংসার পাতছি। এই পুতুলটাকে বেঁধে রেখেছি। এইটা জেলে যাচ্ছে, এই পুতুলটার শরীর খারাপ। তাই শুয়ে আছে, আর এই পুতুলটা একাই ইংরেজ তাড়াবে। সে সাহসী মেয়ে আর শেষে সেই জিতবে।’

গণপতি, এবার আমরা পঞ্চপাণ্ডব আর জয়প্রকাশকে দেখব।

ছটি ছেলে দ্রোণকে ঘিরে গোল হয়ে বসেছে। পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রোণাচার্যের ছেলে অশ্বত্থামা। তারা একসঙ্গে বসে শিখছে, ইতিহাস, বিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, নীতি, অঙ্ক, বেদ, মার্গসঙ্গীত, নাচ এবং বচনশৈলী। এ ছাড়াও ছিল দ্রোণের নিজস্ব কিছু শিক্ষা।

দ্রোণ-এর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। সেই পাতকুয়ো থেকে বল তুলে দেওয়ার। দড়ি, গুলতি, তির-ধনুক, সঠিক নিশানায় পাথর ছোড়া, বন্দুকবাজি এবং শেষে মলোটড বোমা—কিছুই বাদ পড়ল না। কালে কালে তারা রাস্তা আটকানো থেকে ব্রিজ ধসানো সবই দ্রোণ-এর হাত ধরে শিখে ফেলল। গঙ্গাজি এইধরনের সিলেবাস ঠিক করে দেননি। কিন্তু জয়প্রকাশ দ্রোণ বলতেন যে দেশের জন্য সংগ্রাম অনেক ভাবেই করা যায়। সব পথেরই খোঁজ রাখা উচিত।

কেউ-কেউ অন্যদের তুলনায় একুট বেশি দক্ষতার পরিচয় দিল। সেটা অবশ্য দ্রোণ এদের কৌশলগুলো শেখাতে বেশি সময় দিয়েছিল বলেই। অশ্বত্থামা তার বাবার ঘরে শুত বলেই সংকেত, যোগাসন এবং প্রাণায়ামে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে ছিল। অর্জুন সেটা টের পেয়ে অনুরোধ করেছিল, সেও শিক্ষকের পায়ের কাছে শোবে। কিছুদিনের মধ্যেই অশ্বত্থামার মতোই সেও অন্যদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে গেল।

একদিন দ্রোণ একটা ম্যাগাজিন থেকে একটা ছবির পাতা ছিঁড়ে ছেলেদের দেখাল। একজন ইংরেজ রাজনীতিবিদের ছবি।

‘এই লোকটি তোমাদের নিশানা। তোমাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে তোমাদের পছন্দের অস্ত্র—বন্দুক, গ্রেনেড, পাথর, তির-ধনুক…। তোমাদের কাজ ওকে আক্রমণ করা।’

ছেলেরা সমবেত সম্মতি জানাল।

‘যুধিষ্ঠির। অস্ত্র ওঠাও। নিশানার দিকে চোখ রেখে বলো কী দেখছ।’

‘আমার নিশানাকে দেখছি।’

‘আর কিছু?’

‘একজন রাজনৈতিক স্বৈরাচারীকে দেখছি, যার জন্ম নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখে, ১৮৭৪ সালে। বেশ বর্ধিষ্ণু পরিবার, বাণিজ্য দপ্তরে প্রেসিডেন্ট হয়েছে চৌত্রিশ বছর বয়সে, গৃহ সচিব হয়েছে ছত্রিশ-এ, নৌবাহিনীর প্রথম লর্ড, ঔপনিবেশিক সচিব, রত্নভাণ্ডারের প্রধান…।’

‘যুধিষ্ঠির, জায়গায় ফিরে যাও।’ দ্রোণ বিরক্ত হয়ে বললেন।

‘নকুল, তুমি কী দেখছ?’

মোটা, বুড়ো এক রাজনৈতিক, যাকে লোকে অকারণে মান্য করে। লোকটা চটুলও বটে…’

‘ভীম?’

‘একটা মোটা লোক যে চুরুট খেতে ভালোবাসে, কিন্তু আপনি বললে লোকটাকে মেরে ফেলব…’

‘সহদেব?’

‘ইংরেজ অত্যাচারী, আমাদের দেশের শত্রু, আমাদের ঘৃণা করে। আবার প্রচুর স্বাধীনতা সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে সেটা ঢেকে রাখে। ওর কাছে স্বাধীনতা মানে সাহেবদের স্বাধীনতা।’

‘অশ্বত্থামা? তুমিও কি এই সব দেখছ?’

‘বটেই তো!’

‘অর্জুন, তুমি বলো?’

চোখ সরু করে ছবিটা দেখল অর্জুন। ‘আমি নিশানা ছাড়া কিছু দেখছি না।

‘লোকটার প্রতিষ্ঠা, পরিচয় এ-সব?’

‘কিচ্ছু না। আমার ও সব জানার দরকার নেই। আমি শুধু ওর মাথাটাই দেখছি।’

দ্রোণ শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘অস্ত্র ওঠাও, অর্জুন! আক্রমণ করো।’

অর্জুন টান টান হয়ে, নিশানার ওপর তাক করতেই একটা ঝোড়ো বাতাস ঘরে ঢুকে ছবিটাকে উপড়ে নিয়ে দ্রোণের হাতে গিয়ে ফেলল।

‘তোমাকে আমি আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দিয়ে যাব।’

সে গুড়ে বালি। একদিন মুখ ভার করে অর্জুন ঢুকল। সে ক্লাসে প্রথম হয়েছে কিন্তু আরেকটি ছেলেও হয়েছে। এই ছেলেটি গরিব এবং সরকারি স্কুলের ছাত্র। ‘ওর নাম একলব্য।’ অর্জুন বলল।

‘আরে! সে তো এই প্রাসাদের এক দাসীর ছেলে!’ ভীম বলল। সে সব দাসীদের খোঁজ রাখত।

নকুল-সহদেব দৌড়োল। খুব শিগগিরি তারা ফিরে এল একটা কালো ছেলেকে নিয়ে, তার সারা গায়ে ধুলো আর পরনে ছেঁড়া শার্ট। সে নিচু হয়ে দ্রোণের পা ছুঁল।

‘প্রথম হয়েছ? কে তোমার গুরু?’

‘আপনি, স্যার!’

‘আমি! তুমি আমার ছাত্র নও তো!’

‘স্যর! আপনি ওঁদের পড়াতেন, আর আমি দরজার বাইরে থেকে শুনতাম—’

‘আড়ি পাততে? আমার শিক্ষার জন্য আমায় দক্ষিণা না দিয়ে!’

‘দুঃখিত স্যার, দেব স্যার, যা পারি।’

‘কী দিতে পারো?’

‘আমার মা এখানে দাসীর কাজ করে, কত আর দিতে পারি?’

‘পারবে। শুধু শপথ করো, যা চাইব, দেবে।’

‘হ্যাঁ…স্যা…স্যা…র। দেব।’ ছেলেটির গলার স্বর যেন কেঁপে উঠল।

‘তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা দাও।’

‘ডান হা-হাতের বু-বুড়ো আঙুল!’

‘বুঝতে পারলে না? প্রথম হলে কী করে?’

‘কিন্তু তাহলে আমি তো স্যর কোনওদিন লিখতে পারব না স্যার! আপনি আমায় মার্জনা করুন, আর যা হোক কিছু চেয়ে নিন।’

‘তুমি লুকিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেছ, এটা অনুচিত। আমি তোমায় শাস্তি দিচ্ছি না, শুধু দক্ষিণা চাইছি।’

ছেলেটি দ্রোণের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে, ‘স্যর, আমায় পড়াশোনা করে আমার মায়ের কষ্ট ঘোচাতে হবে। আমায় ছেড়ে দিন স্যার…’

‘ওসব আমি জানি না, আমার দক্ষিণা চাই।’

যুধিষ্ঠিরকে বিচলিত দেখাল। অর্জুনকে দেখে মনে হচ্ছিল যে সে বেশ খুশি হয়েছে।

‘আমি দিতে পারব না, স্যর।’

‘নিজেকে আমার ছাত্র বলছ! দক্ষিণা দিতে পারবে না?’

‘না।’

দ্রোণ এবার চোখমুখ হিংস্র করে ছেলেটির মুখের এত কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন যে তাঁর দাড়িগুলো ওর মুখে লাগছিল। থুথু ছিটিয়ে রাগী গুরু বললেন, ‘তোমার কোনও যোগ্যতাই নেই আমার ছাত্র হওয়ার। চলে যাও নচ্ছার ছেলে। আর কোনওদিন যদি তোমাকে ধারে কাছে দেখি, আমি নিজে আমার দক্ষিণা কেড়ে নেব।’

ছেলেটি ছুটে পালিয়ে গেল। দ্রোণ হা হা করে অট্টহাসি হেসে উঠলেন। যুধিষ্ঠির হাত তুলল, ‘যদি ছেলেটি আপনাকে দক্ষিণা দিতে রাজি হত, আপনি নিতেন?’

দ্রোণ এবার হেসে উঠলেন, ‘মহাকাব্যগুলো ভালো করে পড়ো।’

পরের বারের পরীক্ষায়, অর্জুন একাই প্রথম হয়েছিল।

তুমি ভাবনায় পড়েছ দেখছি, গণপতি। সব প্রশ্নের উত্তর আমি তোমায় দিতে পারব না। দ্রোণ-এর এই আচরণের পিছনে কি গূঢ় কোনও কারণ আছে? নাকি হিসলপ তাকে যা করেছে সেই ব্যবহার আরেকটি গরিব ছেলেকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন? ছেলেটি রাজি হলে কি তার বুড়ো আঙুল কাটা যেত? না কি, দ্রোণ তাকে ক্লাসের সদস্য করে নিতেন? আমি এর উত্তর জানি না গণপতি। যে জানত, তার চিতাভস্ম অনেক দিনই গঙ্গা থেকে সমুদ্রে বয়ে গেছে।

৫৭

এবার অন্য চরিত্রগুলির দিকে তাকানো যাক। ওই কর্ণ পার্টির সম্ভ্রান্ত বয়স্ক সদস্যদের তো কী সব বোঝাচ্ছে। দেখি তো ও কী বলছে!

‘মহোদয়, আমার বক্তব্য খুব সহজ। এই নির্বাচন ছিল নতুন গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রথম ব্যালট। আমরা ছিলাম মুসলমান সম্প্রদায়ের একমাত্র মুখপাত্র। আমরা মুসলমানদের জন্য রক্ষিত আসনে প্রার্থী দিয়েছিলাম যাদের পক্ষে বা বিপক্ষে একমাত্র এই সম্প্রদায় ভোট দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের শেষে দেখা যাচ্ছে যে কৌরব মুসলমানেরা, মহাগুরুর শিষ্য তারা, আমাদের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। আমাদের যতই খারাপ লাগুক, বাস্তবকে মানতে হবে।

‘তাহলে আমরা কী করব? অনেকে শুধু মন খারাপ করে ঘরের কোণে বসে ভাবনাচিন্তা করতে পছন্দ করেন। আমি সেই দলে পড়ি না। আমরা নির্বাচনে লড়েছি ক্ষমতার জন্যে। পার্টি হিসেবে আমরা টিকে থাকতে পারব তখনই, যখন আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকবে। এর অনেক রাস্তা আছে। আমার মতে, সব থেকে সোজা রাস্তা হল কৌরবদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করা। অন্তত একটা অঞ্চলে, যেখানে আমাদের ফল ভালো। সেখানে আমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারি।’

কর্ণের চারিদিকে বসা বরিষ্ঠ মুসলমানেরা তাদের হেনা লাগানো মাথা ও দাড়ি সম্মতিসূচক ভাবে নাড়াতে থাকল। কেউ কেউ আবার চুপ করে থাকল। ওদের ভাবতে দিয়ে, গণপতি চলো যাই কৌরবদের দিকে। সেখানেও বেশ উত্তেজিত আলোচনা চলছে।

‘কেন আমরা ওদের সঙ্গে মিলিত সরকারের কথা ভাবব?’ ধৃতরাষ্ট্রের গলা শোনা গেল, ‘আমরা উত্তরের প্রভিন্স-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। কেন আমরা অন্য কারুর সঙ্গে হাত মেলাতে যাব, তাও আবার কর্ণর ওই গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লের দলের সঙ্গে?’

‘সেটাই তো কৌশল! আমাকে ক্ষমা করবেন সকলে, আমি আপনাদের দলের সদস্য নই।’ বিদুর উপস্থিত ছিল। বলল, ‘আমরা ওদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেব। ব্রিটিশরা ধাক্কা খাবে যখন দেখবে যে দেশের দুই পরাক্রমী শত্রু এক হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।’ বিদুর খানিকক্ষণ থেমে, তারপর সুচারু আমলার মতো যোগ করল, ‘যদিও আপনাদের রাজনৈতিক বিচারটাই অগ্রাধিকার পাবে।’

‘বিদুর ভাই-এর কথা রাজনৈতিক বিচারে মেনে নেওয়া কঠিন।’ বলে উঠল মহম্মদ রফি। সে ছিল উত্তরের প্রভিন্সের এক বর্ধিষ্ণু মুসলিম পরিবারের বংশধর এবং কৌরব পার্টির সদস্য।

‘আমাদের ভোটারদের কাছে কী জবাব দেব? যে শয়তানকে আমরা দূরে রেখে আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালিয়েছি, তাদের সঙ্গেই আবার বন্ধুত্ব করছি? আমরা ঘোষণা করেছি যে কৌরব পার্টিই একমাত্র দেশীয় দল যে সব ধর্মের সব জাতের ভারতবাসীর জন্যে লড়াই করছে, মুসলমানরা আমাদের এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন যদি আমরা কয়েকটি মন্ত্রক মুসলিম পার্টির হাতে তুলে দিই তাহলে কৌরব পার্টিতে যথেষ্ট বিক্ষোভ দেখা দেবে। যারা এতদিন আমাদের বলল, ‘আমরা মুসলমানদের প্রতিনিধি নই, তাদের সঙ্গে এই সন্ধির মানে কী? কৌরব পার্টির মুসলমান সদস্যদের এই বন্ধুত্বের ফলে মনে হতেই পারে যে কৌরব পার্টিতে মুসলমান সদস্যদের কোনও মূল্য নেই, পার্টি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতেই চালিত হয়। আমি ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত। আমরা কৌশলের থেকে নীতিতেই জোর দেব বেশি।’

ধৃতরাষ্ট্রকে ঘন ঘন মাথা নাড়তে দেখা গেল।

‘আমরা কর্ণর দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে, মুসলমান বন্ধুদের কাছে বড্ড ছোট হয়ে যাব,’ একজন সদস্য বলল।

‘শোনো, শোনো!’ গুঞ্জন উঠল, ‘ভি ভি খুব সুন্দর বলেছে।’

শেষে গঙ্গাজি তর্কের শেষ করলেন, ‘তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন কোনও মিলিত সরকার হবে না।’

‘বেজম্মাদের দল!’ কর্ণ কঠিন গলায় বলল। বোঝা যাচ্ছিল যে সে জোর করে রাগ চেপে রেখেছে, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের আগেই বলেছি যে ক্ষমতা দখলের অন্য উপায় আছে, আমরা এবার সেদিকে এগোব। কৌরবদের সঙ্গে আমরা খোলাখুলি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেব।’

৫৮

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। জার্মান বোমা ফাটল পোল্যান্ডে। তার জের ভারতে এসে পৌঁছোল।

‘তাহলে ব্যাপারটা কীভাবে করা হবে, স্যার রিচার্ড?’ ভাইসরয় তাঁর দৈনন্দিন মিটিং-এর সময় তাঁর সুপুরুষ প্রধান আপ্ত সচিবকে বললেন, ‘এই রাজপ্রাসাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নির্দেশিকা পড়ে যাব? নাকি আমাদের নিজস্ব কোনও আইনকানুন আছে?’

‘যুদ্ধ নিয়ে তেমন উদাহরণ আর কী দেব আপনাকে! আমাদের দপ্তরের কাউকে দিয়ে আইনের বিচার্যগুলি খতিয়ে দেখে নিতে বলতে পারি। তবে আপনি নিজের মতো এগোতে পারেন।’

‘গতবারে আমরা কী করেছিলাম?’ ভাইসরয় বলেন। তিনি আলগোছে একটা তেরো শতকের ছোট শিবলিঙ্গ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। সেটা তিনি পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করতেন।

‘শেষবার মানে কি পঞ্চম আফগান যুদ্ধ? নাকি সতেরোতম ওয়াজিরিদের আক্রমণ? আমরা প্রোটোকলের চেয়ে বন্দুক-কার্তুজের দিকেই মন দিয়েছিলাম তখন। ব্রিটিশরা ভারতে যুদ্ধ ঘোষণা করার সময় কামানের তোপ দেগে ব্যাপারটা জাহির করেছে। সেটাই রেওয়াজ। এমন উদাহরণও আছে যখন সাহেবরা যুদ্ধটাকে পিকনিক করার পর্যায় নিয়ে গেছে। স্যর ফ্রান্সিস ইয়াং হাসব্যান্ড পাঁচটা ঘোড়া আর ক্রিসমাসে বিতরণ করার জন্য কিছু উপহার নিয়ে গেলেন আর সাম্রাজ্যের সঙ্গে তিব্বতকে জুড়ে দিলেন। কেউ তিব্বতকে ঠিক অধিগ্রহণ করতে চাইছিল না। কিন্তু স্যর ফ্রান্সিস বলেছিলেন, তাঁকে দেখেই তিব্বতের সেনাপতিরা আত্মসমর্পণ করেছিল। তাই তাঁর আর গতি ছিল না। ভুলবশত তাঁর বন্দুক-এর ট্রিগার চেপে গিয়েছিল আর তারপর সব সেনাপতিরা হাঁটু গেড়ে তাঁর পায়ের কাছে পড়েছিল। এসব হয়েছিল তিব্বতের পেটালা রাজপ্রাসাদের কাছে। উপায়ান্তর না দেখে স্যর ফ্রান্সিস তাদের নতি স্বীকার মঞ্জুর করলেন। একসঙ্গে বসে ঠিক করলেন, কী করে তিব্বতের উন্নতিসাধন করা যায়। নাঃ কোনও যুদ্ধ ঘোষণা হয়নি, ইওর এক্সলেন্সি!’

‘স্যর রিচার্ড,’ ভাইসরয় এবার শিবলিঙ্গ ছেড়ে একটা রত্নখচিত ছুরি তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন, সেটা মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর ছুরি ছিল এককালে। এখন খাম খোলার কাজে লাগে।

‘বুঝেছি, বুঝেছি। কিন্তু বড় যুদ্ধটার খবর এখানে এক সপ্তাহ পরে পৌঁছেছিল তাই আর ঘোষণা করতে হয়নি। পৃথিবীর এই অংশে সে যুদ্ধের খুব একটা প্রভাব পড়েনি। শুধু কিছু ভারতীয় সৈন্যকে ফ্রান্স আর মেসোপটেমিয়াতে পাঠানো হয়েছিল।’

‘স্যর রিচার্ড, এবারে জাপানিরা জার্মানদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের প্রাচ্যের গড়গুলো দখল করার চেষ্টা করতে পারে। আজকের যুগে কয়েক হাজার মাইল অতিক্রম করা কোনও সমস্যাই নয়। এইবারে ভারতে যুদ্ধ ঘোষণা হলে, এই দেশকে তার স্বাধীনতার জন্য লড়তে হবে।’

‘মজার কথা হল, এই যে কৌরব পার্টি আর তার মহাগুরু এমনিতেই মনে করে যে তারা স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে।’ স্যর রিচার্ড ভাইসরয়কে বোঝালেন।

‘আমি জানি।’ ভাইসরয় বললেন, ‘কিন্তু ওরা এই দুই ধরনের লড়াইয়ের পার্থক্য বোঝে। মহাগুরু আর তার বন্ধুদের এই অহিংস আন্দোলন গণতন্ত্রের জন্য। ওরা নিশ্চয়ই নাৎজি বা ফ্যাসিবাদকে স্বরাজ মনে করে না। পাণ্ডুর অনওয়ার্ড অরগানাইজেশন-এর কথা অবশ্য আলাদা। গঙ্গা দত্ত সর্বসমক্ষে অ্যাম্বুলেন্স অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রোগ্রামে আমাদের সমর্থন করেছে।

‘কিছুই ভুলিনি, ইওর এক্সলেন্সি,’ স্যর রিচার্ড বললেন। তিনি হস্তিনাপুরকে নিজের উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া এক খণ্ড জমি বলেই মনে করতেন। ‘কিন্তু জল আর রক্ত দু-ই তারপর অনেক বয়ে গেছে তো! আজ গঙ্গা দত্ত আর হিটলার দুই-ই আমাদের বিরদ্ধে সমানভবে স্থির প্রতিজ্ঞ।’

ভাইসরয় কঠিন চোখে তাকালেন তাঁর বরিষ্ঠ কর্মীটির দিকে। ‘তোমার একচোখামি ধরা পড়ে যাচ্ছে, স্যর রিচার্ড। ভারতের ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জার্মানির খুনেটির অনেক তফাত রয়েছে। গঙ্গা দত্ত এবং কৌরবরা নিশ্চয়ই খুশি হবে আমরা নাৎজি জার্মানিকে আক্রমণ করলে। হিটলারের কড়া সমালোচক এরা। কিন্তু যুদ্ধ ঘোষণার আগে আমাদের কি ওদের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া উচিত? এখন তো ভারতীয়দের নির্বাচিত প্রতিনিধি, মন্ত্রী ইত্যাদি আছে…’

‘ওদের এ ব্যাপারে টেনে আনা কেন?’ স্যর রিচার্ড দৃশ্যত বিরক্ত।

‘বোঝার চেষ্টা করো একটু। ভারতের হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতে গেলে, তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নিতেই হবে।’ ভাইসরয় জোর দিয়ে বললেন।

‘স্যার, আপনি ভারতে ইংল্যান্ডের রাজার সর্বোচ্চ প্রতিনিধি। রাজার শত্রুর বিরুদ্ধে আপনি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন, ভারতবর্ষ সেই রাজারই রাজত্ব। ভারত ইংল্যান্ড দ্বারা শাসিত তাই ইংল্যান্ড যুদ্ধ ঘোষণা করা মানেই ভারতে যুদ্ধ ঘোষণা হওয়া। আপনি বিশ্বাস করেন না যে গঙ্গা দত্ত অত্যন্ত নৃশংস কারুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইংরেজ তাড়াবার প্ল্যান ভাঁজতে পারে। আমি আপনার ভাবনার সম্মান করি। ভারতীয়রা নির্বাচিত হয়ে তাদের প্রভিন্স সামলাচ্ছে, সেখানেও তারা ইংরেজ গভর্নরদের অধীনে রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার ভার তাদের নয়, আমাদের’, স্যর রিচার্ড সোজা তাকালেন ভাইসরয়ের দিকে।

‘আমরা কৌরবদের সঙ্গে কথা বললে তারা খুশি হবে।’

‘সেই কারণেই বলার দরকার নেই। ওদের মনে হতে পারে যে আমরা ওদের পরামর্শ চাইছি। আমাদের উপনিবেশ আমরা সামলাচ্ছি, ওদের কী? স্যর, ওরা নেংটি পরার দল, অর্বাচীন। ওদের সঙ্গে কথা বলার রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক কোনও প্রয়োজন নেই।’

‘দেখি কী করি।’

‘স্যর, আপনি ওদের সঙ্গে কথা বললেই ওরা ঢাক ঢোল পিটিয়ে চারিদিকে ব্যাপারটা রাষ্ট্র করবে। আমাদের লজ্জা ঢাকবার জায়গা থাকবে না।’

‘তুমি খুব ভুল বলোনি, স্যার রিচার্ড। আমি যুদ্ধের শুরুতেই একটা রাজনৈতিক চাপানউতোর চাই না এখানে।’ ভাইসরয় ভাবনায় পড়ে গেলেন।

শেষে যুদ্ধ ঘোষণা হল কৌরব মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা না করেই। প্রতিবাদে মহাগুরুর সঙ্গীরা সবাই পদত্যাগ করল। একজন প্রতিনিধির যুদ্ধ ঘোষণার কোনও এক্তিয়ার নেই যেখানে দেশের নিজস্ব নির্বাচিত সদস্যরা রয়েছে। ধৃতরাষ্ট্র বলল, কৌরব পার্টি তার ফ্যাসিবাদের প্রতি ঘৃণা থেকেই ভাইসরয়ের সঙ্গে যোগস্থাপনে আগ্রহী হত। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক পথে তো ইংরেজরা হাঁটলই না! কৌরব পার্টি ভারতীয়দের অনুরোধ করল, ইংরেজদের যুদ্ধের প্রয়াসে মদত না দিতে। বিদুর সাধ্যমতো সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, পদত্যাগ শ্রেষ্ঠ উপায় নয়।

‘তুমি রাজনীতি বোঝো না।’ ধৃতরাষ্ট্র বলেছিল।

‘কিন্তু আমি প্রশাসন বুঝি। আমি জানি পদ ততক্ষণ ছাড়া উচিত নয়, যতক্ষণ না আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে, দাঁড়াবার কতখানি জায়গা পাব।’

সবক’টা পদত্যাগ পত্রের ভাষা এক ছিল। ভাইসরয় চোখে অন্ধকার দেখলেও, স্যার রিচার্ড তখনও সোনালি রোদের আভাস পাচ্ছিলেন।

‘আপনি এটা ভাবছেন না কেন যে ধুতিওয়ালাগুলোর মন্ত্রীত্ব চলে গেল। ওদের কোনও সাংবিধানিক ক্ষমতা রইল না! ভাবুন তো ওই বিশ্বাসঘাতকগুলো যদি যুদ্ধের সময় খাদ্য সরবরাহ, কৃষি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকত, আমাদের কী অসুবিধে হত!’

‘তাও ঠিক।’

‘এই মওকায় আমরা ওইসব জরুরি দপ্তরগুলো হয় নিজেরা চালাব নয়তো অন্যান্য পার্টিদের বা সংখ্যালঘুদের দিয়ে দেব। তারাও তো নির্বাচনে লড়েছিল। সংখ্যার অভাবে এতদিন মসনদ পায়নি। কৌরব পার্টির অনিবার্য মৃত্যু ঘটবে। যুদ্ধের পরে আমাদের সামনে একটা দুর্বল পার্টির কিছু রাজনৈতিক নেতা পড়ে থাকবে। আপনি ওদের সঙ্গে পরামর্শ না করে খুব ভালো করেছেন।’

ভাইসরয় তবু দ্বিধান্বিত, ‘হোয়াইট হল ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখবে তো, স্যার রিচার্ড? আপনি একটা দারুণ রিপোর্ট ড্রাফট করুন তো!’ তিনি শিবলিঙ্গটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। হঠাৎ যেন ছ্যাঁকা খাওয়ার ভঙ্গিতে হাত সরিয়ে নিলেন।

৫৯

হোয়াইট হল স্যার রিচার্ডের ভাবনাচিন্তার সঙ্গেই সহমত হল। কৌরবরা ঘরে বসে রইল পদত্যাগ করে। আঞ্চলিক প্রশাসন চালাতে লাগল অন্য ছোটখাটো পার্টিরা। ব্রিটিশরা প্রয়োজন অনুযায়ী এইসব দলকে অনুমোদন দিয়ে দিত। মহম্মদ আলি কর্ণের মুসলিম গ্রুপ কোনও প্রভিন্সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কৌরবরা পদত্যাগ করায় তিনটে প্রদেশে তারা সংখ্যালঘু সরকার তৈরি করল। ধীরে ধীরে তারা চেষ্টা করতে লাগল মানুষের সমর্থন পাওয়ার। সকলের হৃদয় জয় করতে হবে।

হতাশায় ভেঙে পড়ল কৌরব পার্টির কর্মীরা। তারপর শেষ চেষ্টা করার মতো করে, গঙ্গাজির আহ্বানে শুরু হল এক নতুন সত্যাগ্রহ—’ইংরেজ ভারত ছাড়ো।’

কথাটা যেন আগুন ধরিয়ে দিল মানুষের মনে। দেওয়ালে, পোস্টারে, নোটিশ বোর্ডে সর্বত্র লেখা হল, ‘ভারত ছাড়ো, ভারত ছাড়ো…!’ খবরের কাগজওয়ালারা নতুন বুলি তৈরি করল, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ক্যুইট ইন্ডিয়া।’ সারাদিন ধরে শহরে, গ্রামে, রাস্তার মোড়ে, দোকান বাজারে মানুষ মন্ত্র বলার মতো করে বলে চলল, ‘ক্যুইট ইন্ডিয়া! ক্যুইট ইন্ডিয়া!’

ইংরেজ বুঝল যে একটা গোটা দেশ জেগে উঠেছে। সকলের প্রাণ একযোগে স্পন্দিত হচ্ছে।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজ পদক্ষেপ নিল। পার্টির সব থেকে বরিষ্ঠ নেতারা গ্রেফতার হলেন। পরদিন মাঝারি মাপের নেতাদেরও জেলে ভরে দেওয়া হল।

হঠাৎ যেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ছেদ পড়ল। জয়প্রকাশ দ্রোণ এবার পঞ্চপাণ্ডব-এর দায়িত্ব মুলতুবি রেখে একা লড়াই চালাতে লাগল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। দুটো ব্রিজ উড়িয়ে আর একটা মালগাড়ি উলটিয়ে তবে দ্রোণ ধরা পড়ল। একটা সুরক্ষিত জেলে তাকে রাখা হল।

৬০

তা হলে গণপতি, যা দাঁড়াল তা হল এই যে কৌরবরা যখন জেলে পচতে লাগল, পাণ্ডু তখন বার্লিন আর সিঙ্গাপুর থেকে লড়াই চালাচ্ছিল।

কর্ণ তিনটে আঞ্চলিক সরকার নিয়ে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সূর্যের তেজ নিয়ে জ্বলতে লাগল। তাঁর পার্টিতে তাঁর নাম হল খলিফা-এ-মশরিখ বা প্রাচ্যের খলিফা। মুসলিম গ্রুপ-এর অন্তঃস্থল থেকে নতুন চাহিদা উঠে এল। মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে আলাদা করে নিয়ে একটা নতুন দেশ তৈরি করা হোক। নাম দেওয়া হোক কর্ণিস্থান—বিচ্ছেদস্থল। পার্টির যুবারা মিলে একটা ফ্ল্যাগ তৈরি করে ফেলল। রং সবুজ। ওপরে একটি অর্ধচন্দ্র। যেমনটি রয়েছে কর্ণের কপালে।

কিন্তু ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যেত কর্ণ যেন ক্লান্ত। পুষ্পার্ঘ্যে স্নান করেও, সূর্যাস্তের পর তার মুখেচোখে কেমন ম্লানভাব জেগে ওঠে। কখনও মনে হয় শুধু তার কপালের অর্ধচন্দ্রটাই জেগে আছে।

কখনও-কখনও সে নৈশভোজের আসর ছেড়ে একা বেরিয়ে যেত অন্ধকারে। কেন?

‘বেশ রাত হয়ে গেছে।’ আমি একদিন বলেছিলাম।

‘হ্যাঁ। কী অন্ধকার!’

‘তোমার অন্ধকার ভালো লাগে না, তাই না?’

সে যেন অল্প জ্বলে উঠল, ‘আমি অন্ধকারকে ঘেন্না করি। আমি ভালোবাসি সূর্যকে। তার সোনালি আভায় আমি উদ্ভাসিত হই, উত্তপ্ত হই তার তেজে। কিন্তু যেই আঁধার নামে, মনে হয় ছায়াগুলো বড় হয়ে আমায় ঘিরে ধরছে। হাড়ের ভেতর অবধি কেঁপে ওঠে। ভি ভি, আমি আলো না জ্বালিয়ে ঘুমোতে পারি না। আবার যখন সূর্য ওঠে, মনে হয় ধীরে ধীরে আমার ধমনীতে প্রাণ ফিরে আসছে।’ হঠাৎ সম্বিত ফিরে সে বুঝল, আমার সঙ্গে কথা বলছে। একটা বাঁকা হাসি তাঁর ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ল, ‘শুভ রাত্রি, ভি ভি।’

আর একজনের কথা আমরা ভুলেই গেছি! অম্বা। সেই তন্বী সুন্দরী রাজকন্যা যার জীবন মহাগুরু নিজের অজান্তেই নষ্ট করে দিয়েছিলেন। সে সৌন্দর্য হারিয়ে এখন জিঘাংসায় জর্জরিত এক নারী। প্রত্যাখ্যান-এর কষ্ট তাকে কুরে কুরে খেয়েছে আর সেই ছাপ তার মুখে বলিরেখা হয়ে ফুটে উঠেছে। প্রথমে সে অন্যান্য রাজা মহারাজাদের দিয়ে চেষ্টা করেছিল মহাগুরুকে শিক্ষা দিতে। তারপর সে ভাড়াটে গুন্ডাদের কাছেও গিয়েছিল। যখন কারো সাড়া পেল না, তখন অম্বা হঠযোগ এবং তান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে ঝুঁকল। বীভৎস সব তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ আরম্ভ করল। খুব কঠিন কিছু আসন অভ্যাস করল যাতে দিনের পর দিন এক চুল না নড়ে থাকতে হয় বা অসম্ভব শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে হয়। শেষে ঘোরের মধ্যে না জাগ্রত অবস্থায় না কি স্বপ্নে, একটা কালো মূর্তি অম্বার চোখের সামনে উদয় হল। তার হাতে ত্রিশূল।

‘তুমি যা চাও তা পাবে।’ মূর্তিটি বলে উঠল, ‘কিন্তু এটা জেনে রাখো যে গঙ্গা দত্ত তখনই মারা যাবে, যখন সে আর এই পৃথিবীতে থাকতে চাইবে না। সেই মৃত্যু যখন আসবে তখন তাকে শেষ করবে এমন একজন যে অন্যদের চেয়ে আলাদা।’

তারপর চেহারাটা অদৃশ্য হল। অম্বা চোখ খুলে একটা ধোঁয়া দেখল। তার মনে হল সে এক অসীম শক্তির স্পর্শ পেয়েছে। নতুন উপলব্ধিকে সঙ্গে নিয়ে উঠে দাঁড়াল তার প্রতিশোধের আগুন নিয়ে।

শেষে অম্বা বম্বের এক এঁদো গলির এক নোংরা ডাক্তারখানায় গিয়ে পৌঁছোল। ডাক্তারকে বলল, ‘আমার দুধহীন স্তন কেটে ফেলে দাও ডাক্তার। আমার যোনি বন্ধ করো। আমায় পুরুষে পরিণত করো।’

৬১

যুদ্ধ থামল। গুলি, বোমা, রকেট-এর মতো গোলা, মৃত্যু মিছিল সব শেষ হয়ে গেল এক মুহূর্তে। জার্মান বাঙ্কার-এ একটা গুলি গিয়ে পড়ল। হাজার সূর্য আছড়ে পড়ল জাপানের ওপর। কিন্তু ভারতবর্ষে তখনও হিংসা শুরু হয়নি।

এই জিত যে হারের সমান হবে, ইংল্যান্ড বুঝতে পেরেছিল। আত্মরক্ষা করতে গিয়ে তাকে অনেক চোট পেতে হয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, এই জয়ের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আগেই ইংল্যান্ডের মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে রায় দেয়। তাদের কাছে ডিম আর রান্নার গ্যাস বেশি জরুরি ছিল। লেবার পার্টি যখন ক্ষমতায় এল তখন ইংল্যান্ডের গোঁড়া উপনিবেশপন্থীরাও বুঝতে পেরেছিল যে ব্রিটিশ রাজের দিন ফুরিয়েছে।

জেল থেকে বেরিয়ে কৌরব পার্টি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল। তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দিশাহীন হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে কর্ণের পার্টি এখন অনেক পরিণত। এ ক’বছরে ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সেই পার্টি তার নিজের লক্ষ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা এবার যেন দ্বিমুখী দৌড়ে পরিবর্তিত হল।

নির্বাচন হল। কিন্তু কৌরবদের ফল আশা অনুরূপ ভালো হল না। ছ’বছর রাজনৈতিক ময়দান থেকে দূরে থাকার অভাব কি আর ছয় সপ্তাহের নির্বাচন কার্যক্রম দিয়ে পূরণ করা যায়? দল বেশিরভাগ প্রদেশে জিতলেও মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলি মুসলিম গ্রুপের হাতেই রইল। এবার তাদের মুখে ভাঙনের কথা, দেশভাগের কথা শোনা গেল।

কিন্তু একটা সুযোগ এসেছিল মিলিত হওয়ার। ব্রিটিশ সরকার ঠিক করল, পাণ্ডব স্বতন্ত্র সেনায় যারা যোগ দিয়েছিল ইংরেজ সেনা ছেড়ে দিয়ে, তাদের বিচার হবে। পাণ্ডু মারা গেলেও তার সঙ্গীদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার এটাই তো সময়! একজন হিন্দু, একজন মুসলমান এবং একজন শিখকে পাণ্ডু অনুগামীদের মধ্যে থেকে বিচারের জন্যে বেছে নেওয়া হল। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। এই তিন বন্দিকে ঘিরে জাতীয়তাবাদের প্রবল ঢেউ উঠল, তারা হয়ে উঠল স্বাধীনতার প্রতীক। কর্ণ এবং ধৃতরাষ্ট্র সেই প্রথম এক পথে হাঁটতে শুরু করল। পাণ্ডু জীবন দিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল।

কিন্তু ব্যাপারটা বেশি দূর গেল না। দুই পার্টির আইনজীবীরা একে অপরের সঙ্গে কথা অবধি বলল না। কর্ণ জানতে পারল, মুসলমান বন্দিটি কর্ণস্থানকে সমর্থন করে না। সে চুপ করে গেল।

এইবার লাগল দাঙ্গা। কর্ণ বুঝিয়ে দিল, সে কয়েকটা অঞ্চলের প্রভুত্ব নিয়ে খুশি থাকছে না। তাঁর চাই একটা আস্ত দেশ—কর্ণস্থান। ব্রিটিশরা শুরুতে এই বিভাজন চায়নি। তাদের কষ্ট করে গড়ে তোলা দেশ তারা দু-টুকরো করে দিতে কষ্ট বোধ করেছিল। কর্ণ কোনও আপসে যেতে রাজি নয়, সে তাঁর দলকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’-এর নির্দেশ দিল। দাঙ্গা বেঁধে গেল সারা দেশে—মৃত্যু মিছিল; রক্তের নদী বইতে লাগল। সবাই বুঝল দেশভাগ হওয়া ছাড়া গতি নেই। মহাগুরু অবশ্য তখনও সেটা বিশ্বাস করেননি।

তিনি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হেঁটে বেড়াতে লাগলেন, দাঙ্গার আগুন নেভাতে। কিন্তু তাঁর সেই পুরোনো ইন্দ্রজাল কাজ করছিল না।

হিন্দু-মুসলমানদের এই দাঙ্গাকে মার্কিন এবং ইংরেজ কাগজগুলি ‘সিভিল ওয়ার’ নাম দিল। ব্রিটিশ লেবার পার্টির সরকার ঠিক করল ভাইসরয় বদল দরকার। যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর আরও শান্তিতে হতে পারে।

ডিকাউন্ট ড্রুপ্যাডকে পাঠানো হল। লম্বা, স্মার্ট ড্রুপ্যাড। সর্বদা ভালো পোশাক পরে থাকতেন। সুন্দর গল্প করে লোকের মন জয় করতে পারতেন। এ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি বা কৃষ্টির সঙ্গে অবশ্য তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন না।

‘ইঞ্জিয়া! কী মজা!’ ড্রুপ্যাডের স্ত্রী জর্জিনা প্রবল উৎসাহে উচ্চারণটাও ভুল করল। সাহেব তখন বেডরুমের আয়না দেখে কলার ঠিক করছিলেন।

—’তুমি এত অল্প বয়সে একটা দেশ চালাবে?’

‘আরে আমি যুবক বলেই তো পাঠানো হচ্ছে আমাকে।’ ড্রুপ্যাড গালে কোলন লাগাতে লাগাতে বললেন, ‘বুড়ো কাউকে পাঠালে মনে হত যে আমরা ইন্ডিয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি, বয়েসের জন্যে।’

—’আমরা ছাড়ছি কেন?’

‘আমাদের আর শক্তি নেই বলে। কিন্তু আমরা ব্যাপারটা স্টাইলে করব!’ ড্রুপ্যাড রুপোর কাঁচি নিয়ে সযত্নে গোঁফ ছাঁটছিল। খাড়া নাকের দুপাশে সরু গোঁফদুটো যেন ইংরেজি ‘আই’ অক্ষরের মাত্রা।

‘খুব ভালো! আমরা ইন্ডিয়াতে হানিমুন করেছিলাম মনে আছে?’

লর্ড ড্রুপ্যাড ঢুলু ঢুলু চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ‘এবারে সবার চোখ আমাদের দিকে থাকবে। সাবধান!’

‘ওয়াহ! ইন্ডিয়ার বিছানাগুলো যা নরম না!’ বলে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল সে।

‘শোনো। ওদেশে যাওয়ার আগে শেক্সপিয়রের দ্য টেমিং অফ দ্য শ্রু পড়ে নেবে। মনে রাখবে, আমরা সেখানে ব্রিটিশ সরকারের প্রধান প্রতিনিধি। দরকার হলে গাম্ভীর্যের ভেক ধরতে হবে।’ ড্রুপ্যাড স্ত্রীকে সাবধান করলেন।

‘আমরা ওদেশে কীসের প্রতীক?’

‘আত্মসমর্পণের।’

‘কী দারুণ!’ জর্জিনা বিছানায় এলিয়ে পড়ল।

‘মোটেই না! আমরা সেখানে যাচ্ছি ব্রিটিশ রাজের আনুষ্ঠানিক অপসারণ ঘটাতে। বুঝলে?’

‘আমাকে একটু খুলে বলো।’

‘খুলে আর কী বলব? আমাদের ঘিরে খবর হবে, আমরা মহাগুরুর সঙ্গে চা খাব দিল্লিতে, পাগড়ি পরা একজন ঘোড়সওয়ার আমাদের গাড়ির আগে থাকবে আর আমাদের সমস্ত আদেশ তামিল করার জন্য থাকবে প্রচুর চাকরবাকর।’

‘আর কাজ?’

‘সে তো করবে অফিসার আর আমলারা। আমরা যাচ্ছি ফেয়ারওয়েল পার্টি করতে। রং, গানবাজনা, আলো আর পোশাকের বাহারে ভারতীয়দের চোখ ঝলসে দেব।’

‘লেবার পার্টির সরকার এই চায়?’

‘ঠিক তা নয়। আমাদের দেশে এখন যা রেশন সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে সরকার আমাদের কৃচ্ছসাধন করতেই বলবে। কিন্তু ইন্ডিয়া পৌঁছে গেলে আমাদের কে আর দেখতে আসছে? তখন তো আমরা ইংরেজ ট্যাক্সপেয়ারের টাকা নষ্ট করছি না! ভারতের নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে এবং আমরা যথেষ্ট রইসি করতে পারব।’

‘উফফ! অসাধারণ।’

‘আমরা নিজেরাও ফুর্তি করব। অন্যদেরও ভালো রাখব। ইংরেজ সরকার খুশি হবে। তারা সমস্যাটার সমাধান চায়। ভারতে ইংরেজ অফিসাররাও খুশি থাকবে। আমরা দুজনে মিলে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেব। ভারতীয়রা নিজেদের দেশ ফিরে পেয়ে খুশি হবে।’

‘আমাদের এই সব বড়লোকি দেখে ইন্ডিয়ানদের রাগ হবে না তো?’

‘বোকার মতো কথা বলছ!’ আমরা তো আসলে ভারতে গিয়ে আমাদের রাজত্বের অন্তিম ক্রিয়াদি সম্পন্ন করব।’ তারপর জুতোর গোড়ালিতে ভর দিয়ে গোল হয়ে এক পাক ঘুরে নিয়ে একটা ঝকমকে হাসি দিলেন ড্রুপ্যাড। তিনটে আয়না সেই হাসি ফিরিয়ে দিল।

পাঁচহাজার মাইল দূরের দেশটায় তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার আগুন জ্বলছে।

৬৩

ভাইসরয় হিসেবে ড্রুপ্যাড রাজসিক অভিরুচির পরিচয় দিয়েছিলেন। ঝাড়বাতি আর আলোর রোশনাইয়ের নীচে হিরে জহরতের ঝিলিক আর স্কটিশ ব্যাগপাইপারদের বাজনা! সব মিলিয়ে এক কল্পনাতীত স্বপ্ন। তাঁর খিদমত খাটার জন্য ছিল ৯১৩টি কোমরবন্ধ আর উর্দি পরা চাকরবাকর, যারা সুগন্ধি চালের জল থেকে, ভাইসরয়ের কুকুরদের জন্য শ্রেষ্ঠ মুরগির মাংস নিয়ে চোখের নিমেষে হাজির হয়। ৫০০ ঘোড়সওয়ার ভাইসরয় ও তাঁর স্ত্রীকে সুরক্ষা যোগাত, ৩৬৮ মালি তাঁদের বাগানের পরিচর্যা করত আর কাক তাড়াত।

ভাইসরয় হিসেবে অভিষেক যেদিন হল সেদিন ড্রুপ্যাড, এবং তার স্ত্রী এত সোনা দানা, মেডেল আর জমকালো জামাকাপড় পরেছিলেন যে রাজার অভিষেক বলে মনে হচ্ছিল। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই তিনি ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে হিসেব নিকেশে বসলেন। এত শিগগির সব কিছু এগোচ্ছিল যে তাঁর গদির মেয়াদও চটজলদি ফুরিয়ে গেল।

‘মাত্র পাঁচ মিনিট?’ ধৃতরাষ্ট্র লাঠি নিয়ে বেরোতে বেরোতে হোঁচট খেল, ‘ওর হাতে আমাদের জন্য মাত্র এতটুকু সময় নাকি?’

‘এর বেশি উনি নাকি মনোসংযোগ করতে পারেন না।’ বলল কৌরব পার্টির নতুন প্রেসিডেন্ট, মহম্মদ রফি, ‘আমাদের কপালে দুঃখ আছে।’

‘আমি ওদের মোটেই ভাববার সময় দেব না।’ নতুন ভাইসরয় বললেন। তাঁর স্ত্রী তখন পোশাক বদলাতে সাজঘরে ঢুকেছে। ভাইসরয় সবেমাত্র নিজের বহুমূল্য জামাকাপড় এবং মণিমাণিক্য ছেড়ে ফেলেছেন। ‘আমার আগের জন এই ভুলটা করেছিলেন। ওদের কথা বলবার সুযোগ দিতে নেই।’

‘কিন্তু তাহলে সমস্যার সমাধান করবে, কী করে?’

‘আমি বলব, কিন্তু শুনব না। ওদের দরদাম করবার সুযোগ দেব না।’

‘সব গোষ্ঠী যদি রাজি না হয়?’

‘আমরা ওদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দেব। যারা মানবে না তাদের বলব মুখ বন্ধ রাখতে। ডার্লিং, তুমি ওই হিরের টায়রাটা আবার পরো তো! তোমার দিকে কয়েকপলক চেয়ে থাকি।’

কোন স্ত্রী খুশি না হবে? জর্জিনা উৎসাহে নিজের গাউনটা কাঁধ থেকে ফেলে দিল। তার নগ্ন শরীরটা মনে করিয়ে দিচ্ছিল কীরকমভাবে ব্রিটেন একদিন কাঙাল সেজে হাত বাড়িয়ে এদেশে এসে ঢুকেছিল, আমাদের মুকুট ছিনিয়ে নেবে বলে।

‘তুমি আমার মুকুটের মণি।’ ড্রুপ্যাড স্ত্রীকে চুমু খেলেন, ‘তুমি আমার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। তোমাকে দিয়েই এই মর্কটগুলোর মুগ্ধ আনুগত্য আমি আদায় করব।’

৬৪

অনেক দূরে হস্তিনাপুরের একটি অন্ধকার ঘরে টিম টিম করে গান্ধারীর মৃত্যুশয্যার পাশে একটা কেরোসিনের লণ্ঠন জ্বলছিল।

‘তিনি কি এসেছেন?’ গান্ধারীর আওয়াজ এতই ক্ষীণ, প্রিয়া দুর্যোধনী তার মায়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে শুনতে চেষ্টা করছিল।

‘না, মা, এখনও আসেনি।’ প্রিয়া পর্দা দেওয়া দরজার দিকে তাকাল, ‘খবর পাঠানো হয়েছে। মা, চিন্তা কোরো না।’

গান্ধারী বিছানার সঙ্গে আরও মিশে গেল। আমার সেই রাত্রের কথা মনে পড়ল যেদিন প্রিয়া এ জগতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।

‘জল…।’ কেমন যেন একটা ব্যাকুলতা শোনা গেল গান্ধারীর গলায়। প্রিয়া পেতলের জগটা থেকে গেলাসে জল ভরল। গান্ধারী নিজেকে তুলে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তারপর অভ্যস্ত হাতে প্রিয়া মায়ের শরীরটা সামান্য তুলে গেলাস থেকে একটু ঈষৎ উষ্ণ জল খাইয়ে দিল। শুকনো গলাটা ভিজল। কিছুটা গাল গড়িয়ে পড়ল।

‘ভালো ছেলে!’ গান্ধারী মেয়ের হাত শক্ত করে ধরল, ‘তুমি আমার ছেলে, আমার সব।’ কথাগুলো হাঁপাতে হাঁপাতে গান্ধারী বলল।

‘অন্ধকার!’ সহসা গান্ধারী চিৎকার করে উঠল। আর হাতটা উঠে গেল চোখের পট্টিটার দিকে। তারপর প্রাণহীন হয়ে বুকের ওপর পড়ে গেল।

‘মা!’ দুর্যোধনী মায়ের শরীরের ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদে উঠল। সেই একবারই তাকে কাঁদতে দেখেছিলাম, ‘মা! আমায় একা ফেলে রেখে যেও না।’

তার হাত থেকে শব্দ করে জলের গেলাসটা পড়ে গেল। একটা সরু জলের ধারা দরজার দিকে বয়ে গেল।

ঠকঠক লাঠির শব্দ দরজার বাইরে পাওয়া গেল। পর্দাটা অবশেষে নড়ল।

‘বাবা! বাবা! মা আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন।’

‘কেঁদো না, সোনা।’ কোমলভাবে মেয়েকে ধৃতরাষ্ট্র বলল, ‘দ্যাখো, তোমার চোখের জলে আমার পা ভিজে গেছে। আমার কাছে এসো।’

দু-এক মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপর দুর্যোধনী দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জাপটে ধরল। ধৃতরাষ্ট্র হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে মেয়েকে আড়াল করল। গান্ধারী মৃত্যুর পরেও একাই পড়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *