দশমীর রাত
পঞ্চাশের দশকের একেবারে গোড়ার দিকের কথা। সম্ভবত ১৯৫০-এর। বাবা-মা এবং ভাইবোনদের সঙ্গে শিলংয়ে গেছি পুজোর সময়ে। নবমীর দিন সকালে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোমন্ডপে এক তরুণের গলাতে গানটা প্রথমবার শুনেছিলাম:
সপ্তমী অষ্টমী গেল, নিঠুরা নবমী এল, ও নিশি পোহায়ো না আমার উমা মা যে যাবে চলে
সপ্তমী আর অষ্টমীতে ছিলাম সুখে দিনেরাতে, এ নিশি পোহালেই উমা মা তো ঘরে রবে না।
এই গানটি আমাকে আজীবন তাড়া করে ফিরেছে। দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকি না কেন, বিজয়ার দিনের মন খারাপ থেকে রক্ষা পাইনি।
আমি আঁতেল নই। অনেক কমিউনিস্ট বন্ধুবান্ধব থাকলেও নিজে মার্কামারা ‘কমিউনিস্ট’ বলতে যা-বোঝায় তা কখনোই নই, যদিও ঘোর সাম্যবাদী। মার্কামারা সাধারণ মানুষমাত্র। হিন্দু মা-বাবার সন্তান। একজন হিন্দু। ‘হিন্দু’ বলে পরিচয় দিতে আমি লজ্জিত নই। তবে ধর্মাচরণ করি না। কিন্তু করার মধ্যে কোনো দোষও দেখি না। মুসলমান, ক্রিশ্চান, পার্সি সকলেই নিজ নিজ ধর্মাচরণ করে থাকেন ঢক্কানিনাদ করে, আর হিন্দুরা করলেই তাকে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তাদের অপাঙক্তেয়, প্রাচীনপন্থী, অশিক্ষিত বলে অভিহিত করলে, তা নতমস্তকে মেনে নিতে হবে তেমন বুদ্ধিমত্তাতে আমার বিশ্বাস নেই। মূর্তিপুজো কেন যে দোষণীয় নয়, সে-সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ সুন্দরভাবে বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু আজকের এই নিবন্ধে সেই আলোচনার পরিসর নেই।
আমি হিন্দু বলেই, বর্ণচোরা, সুযোগসন্ধানী ‘বুদ্ধিজীবী’ হতে পারিনি বলেই, এখনও আগমনি গান শুনে ও গেয়ে উদবেলিত হই—
দেখ না নয়নে গিরি, গৌরী
আমার সেজে এল,দ্বিভুজা ছিল যে উমাদশভুজা কবে হল?
ঢাকের শব্দে এখনও মন বড়ো খুশি হয়ে ওঠে। পুজোর ক-দিন সুবেশ-সুবেশা ধনী-দরিদ্র প্রত্যেক নারীর আনন্দোচ্ছল প্রসাধিত মুখগুলি আমার মধ্যেও আনন্দের জোয়ার সঞ্চার করে। যদিও আমাদের দুর্গাপুজো অন্য ধর্মাবলম্বীদের মুখ্য উৎসবের চেয়ে অনেকটাই দীর্ঘসূত্রী, তবুও দশমীর দিন সকাল থেকেই মন বড়ো খারাপ হয়ে ওঠে। বাবা-মায়ের মন যেমন কন্যার বিয়ের পরদিন, যেদিন সে শ্বশুরালয়ে যাবে, সেদিন সকাল থেকেই বিষাদগ্রস্ত হয়ে ওঠে, কিছুই যেন, আর ভালো লাগে না, আমারও তেমনই হয়।
আমরাও উদবাস্তু। পূর্ববঙ্গের বরিশাল, ফরিদপুর হয়ে আমাদের শেষ দেশ ছিল উত্তরবঙ্গের রংপুরে। তাও পূর্ব পাকিস্তানে পড়াতে আমাদের উদবাস্তু হতে হয়। আক্ষরিক অর্থে নয়। কারণ আমার জন্ম কলকাতাতেই এবং বাবা কর্মসূত্রে দেশভাগের আগে থাকতেই কলকাতাতেই ছিলেন। তবে আত্মীয়রা প্রায় সকলেই পূর্ববঙ্গে ও উত্তরবঙ্গের বলেই দেশভাগের যন্ত্রণা মর্মে বেজেছে। রংপুর শহরের একপ্রান্তে ‘ধাপ’-এ আমাদের বাড়ি ছিল। লালমাটির পথ চলে গেছিল বাড়ির সামনে দিয়ে শঙ্কামারির শ্মশানে। বাড়ির কাছেই ছিল হরিসভা। আর হরিসভার লাগোয়া পুকুর। পুকুরপাড়ে ছিল কদমগাছ। হলুদরঙা ব্যাডমিন্টন বলের মতো কদমফুল ঝরে পড়ত বর্ষাকালে। হরিসভাতে কখনো অষ্টপ্রহর আবার কখনো চব্বিশ প্রহর কীর্তন হত। নানা পালা। দেশভাগের আগে আগে হত ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পাবন সীতা রাম/ঈশ্বর আল্লা তেরা নাম, সবকো সুম্মতি দে ভগবান।’ ওই ‘সুমতি’ কম মানুষই গ্রহণ করেছিলেন, বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা।
হরিসভাতেই প্রতিবছর একচালা দুর্গাপ্রতিমার পুজো হত। ঠাকুমা, মা, কাকিমা, পিসিরা নিজেদের বাড়ির এবং পাড়াপ্রতিবেশী, সবাই সেজেগুজে নতুন তাঁতের শাড়ি আর সেন্ট পাউডার ফুলেল তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পায়ে আলতা আর সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে মন্ডপে যেতেন। অবিবাহিত মেয়েরা স্নান করে উঠে সুগন্ধি ভেজা চুল পিঠের ওপর মেলে দিয়ে নতুন তাঁতের শাড়ির গন্ধ ছড়িয়ে দুব্বো ঘাস বাছতেন, ফল কাটতেন, পদ্মফুল সাজাতেন, ধূপ জ্বালাতেন পুজোর আগে আর আমরা শিশুরা ও কিশোরেরা নতুন জামা ও হাফপ্যান্ট পরে ঢাকিদের পাশে ভিড় জমাতাম। ঢাকের শব্দের সঙ্গে নাচতাম। পুজোর ক-দিন সববয়েসি মেয়েদের সুগন্ধি উপস্থিতিতে বিভোর হয়ে থাকতাম কিশোর আমি।
ওই তিনদিন যেমন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত, তেমন দশমীর দিনে সকাল থেকেই মন খারাপ লাগত। দশমীর সন্ধের পরে কলাগাছের ভেলার ওপরে প্রতিমাকে উঠিয়ে হরিসভার পাশের পুকুরে অনেক হ্যাজাক লণ্ঠন জ্বেলে পুকুর প্রদক্ষিণ হত। সারাপুকুর ঝলমল করত। অন্যান্য ভেলায় ঢাকিরা, কাঁসরঘণ্টা বাজিয়েরা এবং যুবকেরা অনেকেই উঠতেন। সববয়েসি মহিলারা বেঞ্চ ও চেয়ার পেতে পুকুরের তিন ধারে বসে সেই বিসর্জন দেখতেন। হরিসভার একটু দূরে ঘোঘটের ক্যানাল ছিল অবশ্য—তিস্তা থেকে আসা—কিন্তু সেখানে পৌঁছোতে হলে অনেকখানি পথ প্রতিমাকে নিয়ে যেতে হত। ঘোঘটের ক্যানাল ছিল, আমাদের বাড়ির পেছনের মস্ত বড়ো আলুখেত এবং ছোটো পুকুরের পেছনে। সেখানে ছোটো-বড়ো, মেয়ে-পুরুষ সকলের পক্ষে যাওয়াটা অসুবিধেরও ছিল। সেই ক্যানালের পাড় ধরে নিস্তব্ধ শারদদুপুরে দুধলি ডানা ছড়িয়ে ‘কোঁচ’ বক উড়ত আর গলা ছেড়ে আব্বাসউদ্দিনের গান গেয়ে ফিরত গবা পাগলা। তোরসা নদীর বগার গান।
প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পরে ‘গাঁটিয়া’ ফুটোতেন ধাপ-এর বড়োরা।
হরিসভার পাশ দিয়ে যে পথ গিয়েছিল তার পাশে বেণুকাকুদের বাড়ির সামনের মুথাঘাসে ভরা মাঠে অনেকখানি গভীর করে শুধু গর্ত করে তারমধ্যে বারুদঠাসা লোহার সরু হামানদিস্তার মতো চোং পুঁতে দেওয়া হত, যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে। তার পর সেই গর্তের মুখ থেকে বারুদ ছড়িয়ে নিয়ে আসা হত অনেকদূর পর্যন্ত। সেইটাই হত ‘পলতে’। তার পর সেই বারুদের শেষপ্রান্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হত। চিরবিড়ানি শব্দ করে সেই বারুদ বেয়ে আগুন দৌড়ে যেত, গাঁটিয়ার দিকে এবং তার পর তোপধ্বনির মতো শব্দ করে সেই গাঁটিয়া ফুটত আমাদের রোমাঞ্চিত করে। পোড়া বারুদের গন্ধ লাগত নাকে। সেদিন অনেক তারাবাজি, রংমশালও ফোটাত অল্পবয়েসিরা।
বিজয়ার পরদিন হরিসভার মাঠে গেলে হাওয়াইয়ের খোল, রংমশালের পোড়া কাগজ, তারাবাজির সরু সরু লোহার কাঠি দেখা যেত, শিশিরভেজা মাঠের ওপর। বারুদের গন্ধ মিশে থাকত শিউলির গন্ধের সঙ্গে। আর কিছুদিন পরে কার্তিক মাস পড়লে দেখা যেত, প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার সময় যে কলাগাছের ভেলা বানানো হত সেই পুকুরের মস্ত বড়ো বড়ো হলুদ-সবুজ জলঢোঁড়া সাপ কলাগাছের ভেলার কাঠের কাঠামোর ওপরে উঠে রোদ পোহাত আর ধোপার পাটে ধোপা কাপড় কাচত ‘ধপাধপ’ শব্দ করে। সেই শব্দ পুকুরের ওপরে ঝুঁকে পড়া গাছগাছালির গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হত ফড়িং-ওড়া মধুফুলের ঝোপেভরা সুগন্ধি দুপুরে পুকুরের পাড়ে পাড়ে।
পরবর্তীজীবনে কলকাতা, লণ্ডন, টরেন্টো, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং টোকিওতেও দুর্গাপুজো দেখেছি, দশমীও দেখেছি, কিন্তু রংপুরের সেই দশমীর স্মৃতি এখনও মন জুড়ে আছে। ছেলেবেলার সেই স্মৃতির মাধুর্য আর কোনো জায়গার পুজোর স্মৃতি ম্লান করতে পারেনি।
কলকাতাতে আমার পৈতৃকনিবাস রাজা বসন্ত রায়ের ‘কনীনিকা’র উলটোদিকে। ডক্টর নৃপেন্দ্রলাল দাশ বাড়ি করলেন। ডক্টর দাশ খুব নামি শল্যবিদ ছিলেন। তাঁদের আদিবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে। ডক্টর দাশ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সেক্রেটারিও ছিলেন। তাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। পুজোর তিন দিন পাড়ার কোনো বাড়িতে উনুন ধরত না। সকলেরই নিমন্ত্রণ থাকত দু-বেলা সেই বাড়িতে। ডক্টর দাশের দাদা, মুর্শিদাবাদের কান্দি কলেজের অধ্যক্ষ ও ব্যবসায়ী ছোটোভাইয়েরা, তাঁদের স্ত্রীরা এবং সকলের ছেলে-মেয়েরা আমাদের পরমাত্মীয় ছিলেন। বিজয়া দশমীর দিনে পাড়াতে ‘সমাজসেবী’র পুজো থাকা সত্ত্বেও আমরা লরিতে করে, ডক্টর দাশের বাড়ির প্রতিমা ভাসান দিতে গঙ্গাতে যেতাম। পরদিন হত বিজয়া সম্মিলনি। পাড়ার অনেক ছেলে-মেয়ে, ওঁদের ছেলে-মেয়েরাও গান গাইতেন। আমাকেও গাইতে হত।
আমাদের পুজো তিন দিনের হলেও দশমীর দিনেই পুজোর ক্রান্তিক্ষণ। সারাবছর ‘পুজো-পুজো’ উন্মাদনা আর পুজো শেষ হয়ে গেলেই মন খারাপ করা, আবার পরের বছরের পুজোর জন্য অপেক্ষা করা।
ছেলেবেলায় উত্তরপ্রদেশের বেনারসের কাছে মির্জাপুর হয়ে বিন্ধ্যাচলে যেতাম অনেক বছরই পুজোর ছুটিতে। বাবার প্রিয় জায়গা ছিল। পাহাড়, জঙ্গল, নদীঘেরা শিউপুরা গ্রামে পাথরের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতাম খুবই কষ্ট করে। থাকার অন্য জায়গা ছিল না। শেষের দিকে অবশ্য একটি ভালো বাংলোর হদিশ পেয়েছিলেন বাবা। সেখানে পাহাড়ের গায়ে বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির ছিল—মা দুর্গার মন্দির। বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরেও দুর্গাপুজো হত। পুজোর সময় সেখানে বাঙালিদের কয়েকটি পরিবার যেতেন, আমাদের মতো। দশমীর দিনে প্রত্যেকে প্রত্যেকের আস্তানায় যাওয়া-আসা হত এবং যেহেতু সে-পুজোর প্রতিমা বিসর্জনের কোনো ব্যাপার ছিল না দশমীর দিনই, আমরা শেষদিকে পাহাড়তলির যে বাংলোটি ভাড়া নিতাম দিন পনেরোর জন্য, সেখানে বিজয়া সম্মেলন হত। অন্যান্য পরিবারের সকলেই আসতেন। বিভিন্ন বয়েসি সুবেশা, সুগন্ধি মহিলাদের সমাবেশ হত। খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা ও গল্প হত। আশ্বিন শেষে মিষ্টি ঠাণ্ডা পড়ত বিন্ধ্যাচলে। কৈশোরের হ্যাজাক আর লণ্ঠন আর লণ্ঠনজ্বলা সেইসব হিমের রাতের উষ্ণস্মৃতি এখনও মনকে মথিত করে।
দশমীর দিনটিতে কলকাতাতে থাকলে আমি বাড়ি থেকে বেরোই না। ‘সানি টাওয়ার্স’-এ আমার ঘরের একদিকে দেওয়াল নেই, শুধুই কাচ। সেই ঘরে আরাম কেদারাতে বসে, পথের জনস্রোতের দিকে চেয়ে থাকি। ফেলে আসা তিনটি দিনকে আত্মস্থ করি। গতবছরের পুজোর পরে যেসব আত্মীয়বন্ধুকে হারিয়েছি, তাঁদের কথা মনে করি। পরের পুজোতে আমি নিজেও না থাকতে পারি। এইসব নানা ভাবনাতে মগ্ন হই দশমীর রাতে।