দর্শনাতীত
ছন্নের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি বিরাট বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে। সবে এসেছি ‘দ্যাশ’ থেকে– হাইকোর্টটি দেখিয়ে দেবার মতো কোনও খাটাশকে পাচ্ছিনে। কিন্তু রমণীজাতি দয়াশীলা– বেদরদীরা বলে হরবকৎ শিকার-সন্ধানী–আমার সঙ্গে কথা কইলে নিজের থেকে। আমি তখন বিবর্ণ বিস্বাদ বদখদ কোনও এক মাংস, ততোধিক বিজাতীয় হর্স-ক্যাবেজ (সচরাচর এ বস্তু ঘোড়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দেওয়া হয়) খাবার চেষ্টা করছি, চোখের জলে নাকের জলে। সব শুনে বললে, ‘দর্শন? তা হলে শ্নিটকে মিস করো না; বুড়ার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, কখন যে পটল তুলবে (জর্মনে বলে ‘আপজেগলেন’) ঠিক নেই।’
পোড়ার দেশে লেকচার-রুমে সিট রিজার্ভ করতে হয়। প্রাগুক্ত যুবতীটি ধানীলংকার মতো এফিশেন্ট। সাত দিন পরে প্রথম লেকচারে গিয়ে দেখি, একদম পয়লা কাতারে পাশাপাশি দু-খানা চেয়ার রিজার্ভ করে বসে আছে প্রফেসারের চেয়ার থেকে হাত আষ্টেক দূরে।
অধ্যাপক এলেন ঘণ্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক পরে। বয়েস আশি না, মনে হবে সোয়া শো– যেভাবে আস্তে আস্তে পা ফেলে ফেলে ঘরে ঢুকলেন। ইয়া বিরাট লাশ। ফ্রলাইন উজুল লাফ দিয়ে গেলেন তার দিকে। বুড়ো রোষ-কষায়িত লোচনে তার দিকে তাকিয়ে হাত দু খানা অল্প তুলে ধরলেন। উরজুল একদিকের ওভারকোটটা তার দেহ থেকে মুক্ত করার পর তিনি অতি কষ্টে শরীরে একটু মোচড় দিলেন। এই গুহ্যতম তান্ত্রিক মুষ্টিযোগ প্রসাদাৎ তিনি তাঁর ওভারকোটের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ করলেন। শেষনাগকেও বোধ হয় তাঁর বাৎসরিক খোলস থেকে মুক্ত হতে এতখানি মেহন্নত বরদাস্ত করতে হয় না।
ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে উঠে চেয়ারে আসন নিলেন। সচরাচর অধ্যাপকরা প্ল্যাটফর্মের নিকটতম কোণে উঠেই বক্তৃতা ঝাড়তে আরম্ভ করেন। ইনি চুপচাপ বসে রইলেন ঝাড়া পাঁচটি মিনিট। ধবধবে সাদা কলারের উপর হাঁড়িপানা তার বিরাট মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তাতে অন্তত ডজনখানেক কাটাকুটির দাগ। লেকচার আরম্ভ না হওয়া পর্যন্ত ফিসৃফিস্ করে কথা কইতে বারণ নেই। আমি উরজুলকে শুধালুম, মুখে ওগুলো কিসের দাগ?
‘ফেনসিঙের। সিনেমাতে দেখনি, লম্বা সরু লিকলিকে তলওয়ার দিয়ে একে অন্যের কলিজা ফুটো করার পাঁয়তারা কষে? পষ্ট বোঝা সাচ্ছে, তলওয়ার নাকের কাছে এলেও ইনি পিছু-পা তো হইনি, মাথাটা পর্যন্ত পিছনের দিকে ঠেলে দেননি। প্রত্যেকটি কাটাতে ক’টা স্টিচ লেগেছিল ওঁকে শুধোতে পার।’
আমি বললুম, ‘উনি-না দর্শনের অধ্যাপক!’
‘হ্যাঁ, কিন্তু বাপ-পিতামো ছিলেন কট্টর প্রাশান ঐতিহ্যের পাঁড় জেনারেল গুষ্টি। তাদের বর্মের মতো শক্ত হৃদয় ভেঙে ইনি দর্শনের অধ্যাপক হয়ে গেলেন। কৈশোরে বোধ হয় সে মতলব ছিল না। তাই দুঁদে দুঁদে ফেনসারদের চ্যালেঞ্জ করে এসব অস্ত্র-খেলার কলেকশন আপন মুখে নিয়ে বাকি জীবন দর্শন পড়াচ্ছেন। তাইতে বাপ-দাদার ততোধিক মনস্তাপ যে, এমন পয়লানম্বরি তলওয়ারবাজ হয়ে গেল মেনিমুখো মেস্টার-মেলের একজন।’
আমি বললুম, ‘পেন ইজ মাইটিয়ার দেন সোর্ড!’
‘ছোঃ! ভদ্রলোক জীবনে এক বর্ণ কাগজে কলমে লেখেননি– সাত ভলুমি কেতাব দূরে থাক, এক কলমের প্রবন্ধ পর্যন্ত না। কলমই ওঁর নেই। বোধ হয় টিপসই দিয়ে–’
অধ্যাপক ছাদ-ছোঁয়া গ্যালারির উপর-নিচ ডান-বাঁর উপর চোখ বুলিয়ে আরম্ভ করলেন– ওহ্, সে কী গলা! যেন নাভিকুণ্ডলী থেকে প্রণবনাদ বেরুচ্ছে, ‘মাইনে ডামেন্ উনট হেরেন।’—‘আমার মহিলা ও মহোদয়গণ!’ তার পর গলায় দম নিয়ে বললেন, ‘অন্যবারের মতো এবারেও আমি রেকটরকে’ –তার পর গলা নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেও সমস্ত ক্লাসই শুনতে পেল ‘আস্ত একটা গাধা–’
আমার তো আক্কেল গুড়ুম। রেকটর যিনি কি না বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বময় কর্তা, তাঁকে গর্দভ বলে উল্লেখ করা– তা সে বিড়বিড় করেই হোক আর রাসভকণ্ঠেই হোক– এ যে অবিশ্বাস্য!
অধ্যাপক বলে যেতে লাগলেন, ‘রেকটরকে আমি অনুরোধ জানালুম, আমাকে এই টার্ম থেকে নিষ্কৃতি দিতে। অর্বাচীন বলে কি না, আমাকে না হলে তার চলবে না। এ উত্তর আমি ইতোপূর্বেই শুনেছি। তার পূর্বের রেকটর–’ আবার বিড়বিড় করলেন, ‘বলদ, বলদ! স্রেফ বলদ— তাকেও আমি একই অনুরোধ করেছিলুম, এবং একই উত্তর পেয়েছিলুম। তার পূর্বেই রেকটর কিন্তু কাহিনী সম্প্রসারিত করার প্রয়োজন নেই এবং তার পূর্বেরও সবাই একই উত্তর দেয়। বস্তুত, মাইনে ডামেন্ উট হেরেন, গত বাইশটি বৎসর ধরে আমি এই একই উত্তর শুনে আসছি। মনে হচ্ছে, অরিজিনালিটি রেকটর সম্প্রদায়কে এড়িয়ে চলেন। তা সে যাক, তাদের বক্তব্য, আমাকে ছাড়া চলবে না, আমি ইনডেনস্পে্নসিবল!’
এবার তিনি স্বয়ং সিন্ধি বলদের মতো ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তবে কি সাতিশয় সন্তাপের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে, জর্মনি এমনই চরম অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এদেশে আর দার্শনিক নেই? কিন্তু এই আমার শেষ টার্ম। আমি মনস্থির করে ফেলেছি।’ তার পর চোখ বন্ধ করে খুব সম্ভব প্রথম বক্তৃতায় প্রথম কী বস্তু দিয়ে আরম্ভ করবেন তার চিন্তা করতে লাগলেন। উরজুল আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘তাঁর শেষ টার্ম! এ ভয় তিনি নিদেন পঁচিশ বচ্ছর ধরে দেখাচ্ছেন প্রতি টার্মের গোড়ায়।’ বুড়ার চোখ বন্ধ হলে কী হয়, কান দিব্য সজাগ। চোখ খুলে বললেন, ‘নো, আবার নো। এই আমার শেষ টার্ম কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
তার পর গ্রিক দর্শন নিয়ে আরম্ভ করলেন। তাঁর পড়াবার পদ্ধতি অনুকরণ করা অসম্ভব। কারণ, তাঁর পড়ানোটা সম্পূর্ণ নির্ভর করত তাঁর স্মৃতিশক্তির ওপর। যে স্মৃতিশক্তি বিধিদত্ত। কোন সালের, কোন বইয়ের, কোন অধ্যায়ে, এমনকি মাঝে মাঝে কোন পাতায় কী তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো বলে যেতে লাগলেন কোনও প্রকারের নোট না দেখে। প্রত্যেকটি সেন্টেন্স স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভাষা সরল। এবং মাঝে মাঝে তো, আরিস্তত বোঝাতে গিয়ে হঠাৎ মারেন দু হাজার বছরের ডুব-সাঁতার। এ যুগের কে তার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা করেছেন, কোথায়, কোন পরিচ্ছেদে তার সবিশদ বর্ণন। আমি হতভম্ব।
ঘণ্টা পড়তে আস্তে আস্তে উঠলেন। ফ্রলাইন উরজুল তাঁকে পুনরায় ওভারকোট পরিয়ে দিলেন। ধীরে মন্থরে করিডরে নামালেন।
আমি উরজুলকে বললুম, ‘এ কী কাণ্ড! গণ্ডাখানেক রেকটরকে ইনি গাধা-বলদের সঙ্গে–?’
“ওহ্! এরা সবাই এসব জানেন। এঁরা সবাই তার ছাত্র।’
‘ওঁকে ছুটি দেয় না কেন?’
‘সক্কলেরই বিশ্বাস, সঙ্গে সঙ্গে তিনি পটল তুলবেন বলে। মাধ্যাকর্ষণ নয়, দর্শনাকর্ষণ তাকে ইহলোকে আটকে রেখেছে।’
এখানে রোল-কল হয় না। টার্মের গোড়াতে ও শেষে আপন আপন স্টুডেন্টস বুকে অধ্যাপকের নাম দু বার সই করিয়ে নিতে হয়।
গোড়ার দিকে ভিড় ছিল বলে হালকা হলে পর আমি আমার বুক’ নিয়ে পাতলুম। এযাবৎ অন্য কারও সঙ্গে তিনি বাক্যবিনিময় করেননি। আমাকে দেখে চেয়ারে আরামসে হেলান দিয়ে বললেন, “আহ! বাহ্ বাহ্! তার পর? আচ্ছা। বলুন তো আপনি কি জর্মন বেশ বুঝতে পারেন?’
আমি বললুম, ‘অল্প, অল্প।’
‘বেশ, বেশ। তা– তা, আমি কোন দেশ থেকে এসেছেন?’
‘ইন্ডিয়া।’
কেন যে এতখানি তাজ্জব হয়ে তাকালেন বুঝতে পারলুম না। বললেন, ইন্ডিয়া? কিন্তু ইন্ডিয়াই তো দর্শনের দেশ। আপনি এখানে এলেন কেন?’
আমি সবিনয়ে বললুম, ‘নিশ্চয়, কিন্তু আধুনিক দর্শনে জর্মনির সেবা ও দান তো অবহেলার বিষয় নয়।’
কী আনন্দে, কী গর্বে অধ্যাপকের সেই কাটাকুটি-ভরা মুখ যেন প্রসন্ন হাস্যে ভরে গেল, সেটি অবর্ণনীয়। শুধু মাথা দোলান আর বলেন, ‘বস্তুত তাই, প্রকৃতপক্ষে তাই।’
এবারেও যখন তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করলেন তখন আমি যে ‘তুমি’ শুনতে পেলুম। তার বিরাট সাদা মাথাটা আমার দিকে ঠেলে কাছে এনে বেদনা-ভরা গলায় বললেন, কিন্তু জানো, ভারতীয় দর্শন– অবশ্য সব দর্শনই দর্শন– শেখবার সুযোগ আমি পাইনি। ব্যাপারটা হয়েছে কী, আমার যৌবনে ভারতীয় দর্শনের জর্মন-ইংরেজি অনুবাদ পড়তে গিয়ে দেখি সব পরস্পরবিরোধী বাক্যে পরিপূর্ণ। আমি বললুম, “এ কখনই হতে পারে না। ভারতের জ্ঞানী। ব্যক্তিরা এরকম কথা বলতে পারে না। যারা অনুবাদ করেছেন তাঁরা কতখানি জর্মন জানেন জানিনে, কিন্তু দর্শন জানেন অত্যল্প, এবং ভারতীয় দর্শনে তাদের অপরিচিত যে দৃষ্টিভঙ্গি, দৃষ্টিকোণ সেটা আদৌ বুঝতে পারেননি।” ছেড়ে দিলুম পড়া, বিরক্তিতে। কিন্তু জানো, বছর দশেক পূর্বে আমার ছাত্র–’ তিনি রেকটরের নাম করলেন—‘অমুক ভারি ব্রিলিয়ান্ট ছেলে আমাকে বললেন, এখন নাকি কম্পিটেন্ট অনুবাদ বেরুচ্ছে। কিন্তু ততদিন আমি বড় বুড়িয়ে গিয়েছি। নতুন করে নতুন স্কুলে যাবার শক্তি নেই। বড় দুঃখ রয়ে গেল।’
আমি একটু ভেবে যেন সান্ত্বনা দিয়ে বললুম,’ তার জন্য আর অত ভাবনা কিসের, স্যার? হিন্দুরা পরজন্মে বিশ্বাস করে। আপনি এবারে জন্ম নেবেন কাশীর কোনও দার্শনিকের ঘরে।’
এবার তাঁর যে কী প্রসন্ন অট্টহাস্য! শুধু বললেন, ‘ওই তো! ওই তো! বাহ্ বাহ্! বেশ, বেশ। যাক, শেষ দুশ্চিন্তা গেল।’
তার পর শুধালেন, ‘বক্তৃতা সব বুঝতে পার তো?’
আমি বললুম, ‘আজ্ঞে, জর্মন ভালো জানিনে বলে মাঝে মাঝে বুঝতে অসুবিধে হয়।’
অধ্যাপক বললেন, ‘তখন হাত তুলো; আমি সব ভালো করে বুঝিয়ে বলব।’
আমি কাঁচু-মাঁচু হয়ে বললুম, ‘আমার জর্মন জ্ঞানের অভাববশত সমস্ত ক্লাস সাফার করবে– এটা কেমন যেন–’
গুরু গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন– প্রত্যেকটি শব্দ যেন আমার বুকের উপর হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে– ‘আমি একশ’জনকে পড়াব, না একজনকে পড়াব, কাকে পড়াব আর কাকে পড়াব না, সেটা স্থির করি একমাত্র আমি।’
***
আমার দুর্ভাগ্য, আমি খুব বেশিদিন তাঁর কাছ থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ পাইনি। পরের টার্মেই ওপারে চলে যান।
তার পর প্রায় ৩৫ বৎসর কেটে গিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত সংস্কার যে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে পৃথিবী নামক জায়গাটিতে একবারের বেশি দু বার পাঠান না। একই নিষ্ঠুর স্থলে একাধিকবার পাঠিয়ে একই দণ্ড দেওয়ার মধ্যে কোনও বৈদগ্ধ্য (রিফাইনমেন্ট) নেই। তবু যখন কোনও যুবাজনের মুখে ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা শুনে মনে হয়, এ-তরুণ এর কিছুটা গভীরে ঢুকতে পেরেছে, তখন আপন অজান্তে তার চেহারায় জর্মনগুরুর বিরাট কাটাকুটি-ভরা, হাঁড়াপানা চেহারার সাদৃশ্য খুঁজি।