তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

দর্শকের দরবারে

দর্শকের দরবারে

মিনতি কুণ্ডু দরগা রোড। আপনি প্রশ্ন করেছেন, কলকাতা শহরটা কার? ঠেলাওয়ালার, রিকশাওয়ালার, হকারদের, না লরি-চালকদের?

শ্রীমতী কুণ্ডু, খুব বাঁকা-বাঁকা কথা শিখেছেন! অ্যাঁ। মেয়েরা অবশ্য অল্প বয়সেই পেকে যায়। আপনি একটু বেশি পেকেছেন। জেনে রাখুন, কলকাতা যারই হোক, আপনার নয়, আপনার পিতারও নয়। দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে, মুখ বুজে থাকবেন। অসুবিধে হলে, ইউরোপ, আমেরিকা চলে যান। কেউ তো ধরে রাখেনি। আপনার প্রশ্ন, খোঁচা মারা প্রশ্ন। অসম্মানজনক তো বটেই। আপনি জানেন না, কলকাতা কার? প্রশ্ন করে জানতে হবে? একে বলে, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার! সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি না, দেব না। উত্তর নিজেই খুঁজে নিন। অযথা উত্যক্ত করবেন না।

বিধান সরখেল, বাজে শিবপুর রোড। আপনি লিখছেন, আমার বয়েস ষাট পেরল। রাতে আমি এক কাপ দুধ ছাড়া, আর বিশেষ কিছুই গ্রহণ করি না। জীবনের প্রয়োজন নামাতে-নামাতে একেবারে চাহিদার শেষ স্তরে নামিয়ে এনেছি। ইদানীং এক-এক চুমুক দুধ খাই আর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি, পোকা গিলে ফেললুম, না তো! মহাশয়, দুধে আজকাল যেসব পোকা থাকে, তা কী জাতীয় পোকা! উইপোকা, বা ছারপোকা নয় তো! উইপোকা হলে কিন্তু পাকস্থলীর পার্চমেন্ট খেয়ে শেষ করে দেবে! ছারপোকা হলে, মিউকাস মেমব্রেনের তলায় গোপনে বংশ বৃদ্ধি করবে। উদরের অভ্যন্তরভাগ চুলকে উঠলে, কীভাবে চলুকোবো! হাতের আঙুল তো পৌঁছবে না।

সরখেল মশাই, আপনার এই আতঙ্ক অজ্ঞাতজনিত। জেনে রাখুন, দুধের পোকা দুধই। যেমন বেদান্তবাদীরা বলেন, জলের বিম্ব জলই। আর একটু স্পষ্ট করে বলি, সবই ব্রহ্মোদ্ভুত। আপনিও যা, পোকাও তাই। খাদ্যও যা, খাদকও তা। মায়াচ্ছন্ন বলেই আপনার এই ভেদজ্ঞান। রোজ সকালে একপাতা পরিমাণ গীতা পড়ুন না! বয়েস তো হল! এখনও কীট-বিজ্ঞানীর মতো পোকামাকড় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? পারেনও বটে! বৈরাগ্য আর কবে আসবে! সব সময় এই শ্লোকাংশটি মনে-মনে বলবেন, ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্ম-কর্মসমাধিনা। তার অর্থ কি—যত পোকাই আপনি গিলুন না কেন, সবই আপনার জঠরাগ্নির পথে ব্রহ্মে লীন হয়ে যাচ্ছে। আপনার বরাতেও, আজ হোক, কাল হোক, সেই একই পরিণতি নাচছে। আপনার জন্যে অবশ্য অনেক কাঠকুটো, চিতার প্রয়োজন হবে। আপনি অনেক বড়জাতের পোকা। আপনাকে জল, কী দুধের সঙ্গে গিলতে হলে স্বয়ং ব্রহ্মকে সশরীরে অবতীর্ণ হতে হবে। ব্রহ্ম সরাসরি কিছু গ্রহণ করেন না। তাঁর উদর হল, চিতা। সে চিতা মানুষকেই তৈরি করতে হয় পয়সা খরচ করে।

আমাদের গরুহীন গোশালা থেকে কৃত্রিম সহজপাচ্য যে দুধ জনসাধারণে পরিবেশিত হয়, তার আর এক নাম সাইকোলজিক্যাল দুধ। দুগ্ধ বিশ্বাসে গ্রহণ করলে দুগ্ধ, জল বিশ্বাসে গ্রহণ করলে ধবল পানীয়। সরখেল মশাই, জলে দু-একদানা পোকা থাকলে অত লম্ভঝম্পের কী আছে! পোকায় মানুষ মরে না। পাকির আহার পোকা! জানেন কি, হাঁড়িচাচা পাখি শোঁয়াপোকা খায়। জীবজগতের কোনও খবরই রাখেন না! ষাট বছর বয়েস নিয়ে বসে আছেন থেবড়ে।

জেনারেল নলেজও তেমন নেই, বেশ বোঝাই যাচ্ছে। এ যুগ হলে আর চাকরি মিলত না। দুধের বদলে জল খেয়েই জীবন ধারণ করতে হত।

ফরাসীদের প্রিয় খাদ্য পচা পানীয়। ভোজসভায় সম্মানিত অতিথিদের সামনে সেই পানীয়খণ্ড রাখা হয়। খোঁচালেই কিলবিল করে বেরিয়ে আসে মোটা-মোটা পনীর পোকা। সম্মানিত অতিথিরা কাঁটা দিয়ে গাঁথার জন্যে টেবিলের চারপাশে ছোটাছুটি করতে থাকেন। সে এক মজা! ভোজের সঙ্গে মিশে যায় শিকারের আদিম আনন্দ। পনীরের চেয়েও সুস্বাদু এই পনীর পোকা। তেমনি পুষ্টিকর।

জাপান কি করেছে, খবর রাখেন? সেখানে পেট্রোলিয়াম প্রাোটিন তৈরি হয়েছে। পেট্রোলিয়াম জেলিতে সে দেশ পোকার চাষ সফল করেছে। এক-একটা পোকা এক একটা পাঁঠার সমান প্রাোটিন সমৃদ্ধিতে। বনসাইয়ের দেশ তো! বিশাল বটকে যারা টবে খাটো চারা বানাতে পারে, তারা পাঁঠাকে পোকার আকার দেবে, এ আর এমন কি আশ্চর্যের! সে দেশের মানুষ অবশ্য সরাসরি পেট্রল পোকা খাচ্ছে না। গন্ধের জন্যে, তারা খাচ্ছে, ভাবে সপ্তমী করে। ওই পোকা খাওয়ানো হচ্ছে শিলমাছকে। বাড়তি প্রাোটিনে শিল গায়ে-গতরে ফুলে উঠছে। সেই গতরওয়ালা শিল যাচ্ছে মানুষের পেটে। মানুষের গতর ফুলছে।

সরখেল মশাই, পুরোনো সব ধারণা পালটাবার সময় এসেছে। পৃথিবী প্রগতির পথে তরতর করে ছুটছে। তবু যদি আপনার মন খুঁতখুঁত করে, সাদা জলে এক ফোঁটা ক্লোরিন ফেলে খান।

বিজয় মাখাল, গণেশ অ্যাভিনিউ। আপনি প্রশ্ন করছেন, দীর্ঘজীবন লাভের উপায় কী?

হাসালেন মশাই! এই বাজারওে দীর্ঘজীবন লাভের বাসনা! বেশ বোঝা যাচ্ছে, আমাদের পরিকল্পনায় এখনও বেশ খামতি আছে, তা না হলে বেঁচে থাকার ইচ্ছে প্রবল হয় কী করে! আমরা সেই যুগের প্রবর্তনা করতে চাই, যে যুগের মানুষ তারস্বরে শুধু বলবে—’ছেড়ে দে-মা কেঁদে বাঁচি।’ তবু যখন দীর্ঘজীবনের বাসনা, তখন শুনুন, নিদ্রাই হল দীর্ঘজীবন লাভের গোপন কথা। রাতের বেলা গেঁজে ওঠা পান্তা মেরে কাঁথায় কেতরে পড়ুন।

দরবার শেষ হল। এখনও যাঁরা খাড়া আছেন, তাঁরা কাটা কলাগাছের মতো লটকে পড়ুন। শুভ রাত্রি।

দর্শকের দরবারে দ্বিতীয় অধিবেশন

নিমচাঁদ মিত্র লেন থেকে মিনু কারফরমা লিখছেন, গত ২৫ বৈশাখ আমার স্বামী রাত ন’টার সময় পাড়ার পানবিড়ির দোকানে আমার জন্যে ছাঁচি পান কিনতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। ফেরার পথে রাস্তায় শুয়ে থাকা একটি কালো কুকুরের পেটে পা তুলে দেওয়ায়, সেই অসভ্য, বদমেজাজি বাঁদর কুকুর আমার স্বামীকে কামড়ে-কুমড়ে ফর্দাফাই করে দিয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, কুকুরটাকে নজরে রাখতে হবে আর আমার স্বামীকে তলপেটে ছত্রিশটা ইনজেকসান নিতে হবে। আমিও চাকরি করি। অফিস কামাই করে সেই কালো কুকুরটাকে নজরে রাখার চেষ্টা করছি। মুশকিল হল, পাড়ায় কালো কুকুরের সংখ্যা একাধিক। কোন কুকুরটা কামড়েছিল, কেমন করে বুঝব? খুনি মানুষকে ফিংগারপ্রিন্ট দেখে ধরার ইচ্ছে থাকলে ধরা যায়। কুকুর ধরার উপায় কি? কুকুরের দাঁত পরীক্ষা করে ধরার কোনও উপায় আছে কি? থাকলে, সেই দফতর কোথায়? লোডশেডিং না হলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। আমার প্রস্তাব, কালো কুত্তা আর লোডশেডিং একই পাড়ায় একসঙ্গে থাকা উচিত নয়। আমার স্বামীর ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে আমাকেই বিধবা হতে হবে, আমারই কপাল পুড়বে। সানতালডি, কি ব্যান্ডেল বিধবা হবে না। আপনারা জনদরদী, প্রতিকারের ব্যবস্থা করে আমাদের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় করুন।

শ্রমতী কারফরমা, আপনার দুর্ভাগ্যে আমরা ব্যথিত। এই দুর্ঘটনার জন্যে লোডশেডিং বা কুকুর কেউই দায়ী নয়। লোডশেডিং আমাদের প্রাত:কৃত্য। ওটি না হলে আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হবে। আর কুকুর! কুকুরের কাজ কুকুর করেছে। আপনার স্বামীকে কুকুরে কামড়ায়নি, কামড়েছেন আপনি। বেচারা প্রেমের দংশনে এখন ভুগে মরুন। এই ঘটনা থেকে যে সত্যটি জানা গেল, তা হচ্ছে ডগ-বাইট আর লাভ-বাইট একই প্রকারের। যে স্বামী স্ত্রীর ছাঁচিপান সেবার জন্যে রাত ন’টার সময় বিপদসঙ্কুল রাস্তায় বেরোন, তিনি জরু-কী গোলাম। আপনি কি সেই ভদ্রমহোদয়ের দ্বিতীয় পক্ষ? না, বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা? না, সদ্যবিবাহিত? আপনার লজ্জা করে না, কারফিউয়ের সময় স্বামীকে ঠোঁট রাঙাবার জন্যে পান কিনতে পাঠান? জেনেশুনে নিজের লালসা পরিতৃপ্তির জন্যে পরের ছেলেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে সিঁথির সিঁদুরের জন্যে প্যানপ্যান করছেন! আসলে, স্বামী আপনার কাছে একটি সিম্বল মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ইনসিওরেনসের সিম্বল। একটু ধমকধামক দিলুম বলে কিছু মনে করবেন না। আমরা আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী। সন্ধের পর রাস্তায় বেরোবার কী দরকার। ঘরে বসে প্রেমালাপ করবেন, ঝগড়া করবেন, উল বুনবেন। এই গ্রীষ্মকাল, পিঠে ঘামাচির চাষ করতে পারেন না?

হালফিল কাগজে পড়েছেন, লোডশেডিং আরও বাড়বে। সুতরাং এ অন্ধকার যান্ত্রিক উপায়ে দূর করা যাবে না। একমাত্র পথ, সাধনভজন। অন্তরের আলোয় আলোকিত না হলে, টিকটিকি-লোভী বেড়ালের মতো হাঁ করে এই ডাণ্ডা আলো আর ঘটি আলোর দিকে সারারাত তাকিয়ে বসে থাকতে হবে। ডাণ্ডা আলোর যুগ চলে গেছে। এখন ডাণ্ডাবাজি, বোমবাজির যুগ। শ্রীমতী, সন্ধেবেলা রাস্তাঘাট তাদের জন্যে ফাঁকা করে দিন, যারা নিজেদের সামলাতে জানে, যারা গণতন্ত্রের সেবক, যারা নতুন যুগের উদয়-সূর্য।

আমরা অবশ্য দুটি বিকল্প পরিকল্পনার জন্যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের কথা ভাবছি। দুটি নয়, তিনটি।

প্রথম পরিকল্পনা : রাস্তার জেব্রাক্রসিংয়ে যে সাদা রং লাগানো হয়, সেই সাদা রঙ কালো কুকুরের গায়ে লাগালে, সহ্য করতে পারবে কিনা। পারলে ক’মাস অন্তর লাগাতে হবে। খরচের পরিমাণ কী দাঁড়ায়! সে খরচ আসবে কোথা থেকে। খরচ অবশ্য আমরা ট্যাকস চাপিয়ে তুলে নিতে পারব। যেমন, বাসের কী ট্রামের টিকিটের ওপর সিনেমার টিকিটের মতো প্রমোদকর বসিয়ে দেতো। বাসে-ট্রামে ভ্রমণ তো এখন প্রমোদ ভ্রমণই। সিনেমার চেয়ে কম কিসে! সেকস আছে, ভায়োলেনস আছে, নায়ক আছে, নায়িকা আছে, খলনায়ক আছে।

দ্বিতীয় পরিকল্পনা : কুকুরকে বাগে আনার জন্যে কিছু বাঘ ছেড়ে দিলে কেমন হয়! সন্ধেবেলা ছাঁচিপান কেনার বায়নাও কমবে। রাতবিরেতে ফূর্তি করে বাড়ি ফেরার সময় ছেনতাই হলে, পুলিশের কাছে গিয়ে কাঁদুনি গেয়ে তাদের আর উত্যক্ত করা হবে না। মিথ্যে মিথ্যে ফিরিস্তি গাইতে হবে না, আমার সাতশো টাকার ঘড়ি গেছে, গেছে হয়তো দেড়শো টাকার মাল; আমার তিন ভরির হার গেছে, গেছে হয়তো গিল্টিমাল। বাঘ ছাড়লে শহরটা হয়তো অভয়ারণ্যের চেহারা নেবে। টুরিস্ট অ্যাট্রাকসান বাড়বে। তা ছাড়া কবি গাহিয়াছেন, বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি, আমরা হেলায় নাগের খেলাই নাগেরই মাথায় নাচি। কবিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। কবির মর্যাদা রক্ষা জাতীয় কর্তব্য।

তৃতীয় পরিকল্পনা : ম্যানহোলের ঢাকা আমার প্রিয় ভাইয়েরা চম্পট করে দিয়েছে। যে ক’টা পড়ে আছে, সে ক’টাও আমরা নিজেদের গরজেই সরিয়ে দেব, আর ওই হল-এ মিথেনগ্যাস ভরে, রাতে শহরের মানুষকে আলেয়ার খেলা দেখাবার পাকাপাকি ব্যবস্থা করব। পৃথিবীর কোনও শহরে এমন ব্যবস্থা আছে! আমেরিকায় আছে? হনুলুলুতে আছে? কামস্কাটকায় আছে? নেই। সাধে বলে হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো। কোন শহরে গোলগাল মানুষ ঝপাং করে জলে পড়ে যায়? পোল হল ভাগের মা। নিজের গঙ্গা পাবে না। গঙ্গা পাবে পোলচারী!

আচ্ছা, শুভ রাত্রি! নার্স ইওর বেবি। যাঁদের নাক ডাকে, তাঁরা সারারাত জেগে থাকুন। নিজে না ঘুমিয়ে অন্যকে ঘুমোতে দিন। লক্ষ্মী ছেলে!

দর্শকের দরবারে তৃতীয় অধিবেশন

মধুমিতা মজুমদার, গুলু ওস্তাগর লেন। আপনি লিখেছেন, কলকাতার একটি পথচিত্র তৈরি করলে সাধারণ পথচারীর সবিশেষ উপকার হয়। নাবিকদের জন্যে ‘ন্যাভিগেশন-চাট’ যেরকম অপরিহার্য, পথচারীদের জন্যেও পথচিত্র অনুরূপ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ইদানীং। এই চার্ট কলকাতা-হাওড়া স্ট্রিট ডাইরেকটরির মতো সকলের পকেটে পকেটে থাকবে প্রাণের দায়ে। খুব বিক্রি হবে। বিক্রয়লব্ধ অর্থ রাজকোষে যেতে পারে, অথবা শহীদ বেদি নির্মাণে ব্যয় করা যেতে পারে। এই পথচিত্রে একটি সেতুচিত্রও যেন যুক্ত হয়। কোন সেতুতে ক’টা গর্ত আছে, কোন পাশে কী ভাবে আছে, তাদের আকার আকৃতি কী রকম, যেমন কোনোটায় পা গলে, কোনোটায় কোমর গলে, কোনোটায় পুরো মানুষটা গলে, সবই যেন চিহ্নিত করা হয়। কোন সেতু শুধু মনের জোরে বাতাসে ভাসছে, সেটিও জানাতে দ্বিধা করবেন না। এদেশে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, বাতাসে ভাসমান নিরালম্ব সেতু থাকাও বিচিত্র নয়। এহল সেই দেশ, যেখানে ঘি-লেস-ঘি, তেল-লেস-তেল, মেডিসিন-লেস-মেডিসিন, দুধ-লেস-দুধ, মানুষ-লেস-মানুষ পাওয়া যায়। সুতরাং গার্ডার-লেস, জয়েন্ট-লেস, নাট-বল্টু লেস, ফ্যান্টম-সেতু থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ডার্ক সাইড অফ দি মুনের মতো, সেতুরও একটি তলদেশ আছে। ওপরটাই যখন ভালো করে দেখা সম্ভব হয় না, তলায় তখন কী ঘটছে, ঘটবে ঈশ্বরই জানেন। সেতু-নির্দেশ বাজারে ছাড়লে দায়িত্ব পুরোপুরি জনসাধারণে বর্তাবে। কর্তৃপক্ষ ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাবেন। কিছু ঘটলে বুক ফুলিয়ে বলা যাবে, আমরা তো বলেইছিলাম, ও পথে বাড়াসনে তুই পা! নিজের দায়িত্বে পারাপার হতে গিয়ে পগারপারে গেছ। কমপেনসেসানের প্রশ্নও থাকবে না। মহাশয়, আপনি কি কখনও লণ্ড্রি-বিলের ফুট-নোটটি পড়ে দেখেছেন! না পড়ে থাকলে কি লেখা আছে শুনবেন, কাটা, ছেঁড়া, পোড়া, চুরি, হারানো, কোনও কিছুর জন্যেই লণ্ড্রি—দায়ী নয়। তার মানে, কাচতে দিয়ে জামাকাপড় যে ফিরে পাচ্ছ, এই তোমার বাপের ভাগ্যি। সেই একই কায়দায় জনজীবনের বৃহত্তর ব্যবস্থায় এই রকম একটি পাদটীকা জুড়লে কেমন হয়, চাপা পড়লে, খুন হলে, রেলে কাটা পড়লে, গর্তে কী গহ্বরে তলিয়ে গেলে, বাসের ভেতর ভিড়ের চাপে চিঁড়ে চ্যাপটা হলে, ডাকাতে চলমান ট্রেন থেকে লাথি মেরে ফেলে দিলে, ট্রেন উলটে পটল তুললে, ঘরের মধ্যে বোমা ছুঁড়ে মানুষ মরে কি-না পরীক্ষা করলে অর্থাৎ জীবন-মৃত্যুর কোনও ব্যাপারে কোম্পানি দায়ী নয়।

পথচিত্রে দেখানো যেতে পারে, এক। কোন পথ বাস্তবে আছে, কোন পথ শুধুই নামে আছে। দুই। কোন পথের দু-পাশ আছে, এক পাশ আছে, মাঝখান আছে। তিন। ম্যানহোল ও গর্ত ডাইরেক্টারি, কোন পাশে কোথায় কী ভাবে ফাঁদ পাতা হয়েছে। আমরা তো শত্রুপক্ষ নই যে, মাইন পেতে ব্যাটেলিয়ানকে ব্যাটেলিয়ান উড়িয়ে দিতে হবে! আমাদের সম্পর্ক তো ব্যাধ আর খরগোশের নয়, ফাঁদ পেতে ধরতে হবে?

শ্রীমতী মধুমিতা, বয়েস আপনার কত চিঠিতে তার উল্লেখ নেই, তবে বেশ ডেঁপো হয়েছেন। মনে রাখবেন, বিদ্রূপ হজম করার শক্তি আমাদের আছে। আপনার লজ্জা করে না, সব কাজ আমাদের করে দিতে হবে কেন? নিজেরা কিছু করতে শিখুন। চোখ আর কান সজাগ রাখুন। বর্ষায় ভরাডুবি হলে বিপদ আরও বাড়বে, তার জন্যে মাথা খাটিয়ে একটা কিছু বের করুন। কোমরে মাপ-মতো পাতকুয়ার পাড় বেঁধে হাঁটাচলা করলে, গর্তে পড়ে গেলেও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমবে। কোমরেই আটকে থাকবেন। পরে প্রিয়জন এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে জগৎটাকেও চেনা হবে। পিতা আপন, কী মাতা আপন, কী পুত্র আপন, কী প্রেমিক-প্রেমিকা আপন, স্বামী আপন, কী স্ত্রী আপন? দেখা যাবে, অনেকেই পড়ে রইলেন, কেউই আর উদ্ধার করতে এল না। যাক, আপদ গেছে বলে সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে রইল। সেই সব বেওয়ারিশ মালেদের আমরা ডিসপোজালে ঝেড়ে দেব। হাফ দামে, লাটের মাল। শ্রীমতী মধুমিতা, এই পৃথিবীতে কেউ কারুর নয়, মা-লক্ষ্মী। সেতু আপনার নয়, পথঘাট আপনার নয়, শহর নয়, গ্রাম নয়। কেন মিছিমিছি মাথা ঘামিয়ে রাতের ঘুম নষ্ট করছেন! আমরা এখন যে সব পরিকল্পনার কথা ভাবছি, তা হল, লোহার পাতের প্রতি এক ধরনের মানুষের ভীষণ দুর্বলতা। গণতান্ত্রিক ব্রিজের প্রতিটি নাট-বল্টু জনসাধারণের। রাগ করে খুলে নিলে কিছু করার নেই। তবু আমরা অনুরোধ করে দেখব। ব্রিজের সামনে নোটিশ ঝুলিয়ে দেব—’একটু-একটু করে ব্রিজ খুলে নিসনি রে পাগলা! শেষে নিজেই আর নদী পেরোতে পারবি না।’ ইতিমধ্যে আমরা বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলব, খরচ যা লাগে লাগুক, আমরা প্লাস্টিকের ব্রিজ তৈরি করাব। আর একটা পরিকল্পনাও আমাদের মাথায় ঘুরছে, ঢালাই ব্রিজ। পুরো ব্রিজ ঢালাই করে বসিয়ে দাও। চুরি করতে হলে পুরো ব্রিজটাই তুলে নিয়ে যেতে হবে।

আমরা রাস্তা সম্পর্কে নতুন এক গবেষণায় ব্যস্ত। ম্যানহোলের তলায় কি আছে? নিশ্চয়ই একটা তল আছে। অতল বলে কিছু নেই। ডাঙা আর গর্ত, দুটো আলাদা শ্রেণি, পাশাপাশি থাকায় যত শ্রেণি-সংঘাত। গর্ত হল শোষিত শ্রেণি। আমরা ক্লাসলেস শহর গড়তে চাই। ডাঙা আর রাখব না। ম্যানহোলে, ম্যানহোলে, হোলে হোল করে শহরটাকে হলো করে হেলের লেভেলে, নামিয়ে দেব। উত্থানের পতন আছে। কিন্তু পতনের পতন নেই। মানুষ যেখানে পড়ে, আমরা সেইখানে নেমে গিয়ে মানুষের জয়গান গাইব।

শুভরাত্রি। শুয়ে পড়ুন। স্বপ্ন দেখুন, অটোভানের, বিদেশের রাস্তাঘাটের সাজানো শহরের। ও সবই হল তামসিকতা। জয় নরকের জয়।

দর্শকের দরবারে চতুর্থ অধিবেশন

সোনালি শর্মা, গড়বেতা। আপনি লিখছেন, মান্যবরেষু! (মান্যবরেষু লেখায় বড় খুশি হলুম। আমাদের আজকাল কেউ আর তেমন মানেটানে না। অমান্য করাটাই যুগধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের স্কুলে শ্যামল সাহা বলে একটা ছেলে, হেডমাস্টার মশাইয়ের কাছা খুলে দিয়েছিল বলে তাকে রাস্টিকেট করা হয়েছিল। আর এখনকার কালে! কাছা খুলতে পারলে, সে জাতীয় বীরের সম্মানে ষাঁড়ের পিঠে চেপে ঘুরে বেড়ায়। মহাদেবের মতো সম্মান পায়।)

যাক, আপনি লিখছেন, পশ্চিমবঙ্গে ছোটবড় কত সাঁকো আর সেতু আছে আপনারা জানেন কি? জেলা পলিটিকসে মানুষই জেরবার। কারুর একটা চোখ আছে, তো আর একটা নেই, হাত আছে তো পা নেই, পা আছে তো হাত নেই। সব সময় যুদ্ধ চলেছে। ডাকাতও তেমনি বেড়েছে। কে ডাকাত আর কে ডাকাত নয়, বোঝাই দায়। ফলে যার যাকে সন্দেহ হচ্ছে, তাকেই পিটিয়ে দিচ্ছে। শত্রুমিত্র চেনা যাচ্ছে না বলে সকলেই সকলের শত্রু। এই অবস্থায় নদী, নালা, সাঁকো সেতু, শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি, এত এলেবেলে ব্যাপার, মাথা না ঘামালেও চলে। পা দুটো থাকা মানেই চলা। পথ থাকলেও চলবে, না থাকলেও চলবে। মানুষের চলা, কারুর বাপের ক্ষমতা নেই থামায়। গ্রামের জন্য বা জেলা শহরের জন্য আমি ভাবছি না। যদ্দিন পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়ে বাঁশ আছে, তদ্দিন খানাখন্দ পেরোবার ভাবনা আমরা করি না। বাঁশ দিয়েই সব ব্যবস্থা করে নেব। আমার ভাবনা খোদ কলকাতাকে নিয়ে। সেখানে আপনাদের বসবাস, চলাফেরা। কত বড় বড় লোক, চৌপর দিন শহর চৌরস করে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের জীবনের কত দাম? একজন ধনী মানুষ দীর্ঘজীবী হওয়া মানে, দশের কত লাভ! কত সিল্কের শাড়ি কিনবেন, জমি কিনবেন, গাড়ি কিনবেন। গয়না গড়াবেন, সারা জীবনে এক বাগিচার মতো কমলালেবু, আপেল, লিচু, আম, আনারস শেষ করবেন। এক সরোবর মাছ। তেমন খাইয়ে হলে একপাল ছাগল কালিয়া-ফর্মে গর্ভে স্থান করে নেবে। কত টন চাল আর গম খাবেন তার কোনও হিসেব নেই। এই অঙ্ক, কেউ কি কখনও করেছেন—ষাট বছর বাঁচলে একজন মালদার যত মাল খাবেন, আশি বছর বাঁচলে তার কত গুণ বেশি খাবেন! একটু পুরো ডিস্টিলারি খেয়ে ফাঁক করে দেবেন। অর্থনীতির পালে যাঁরা বাতাসের টান ধরান, তাঁদের জীবনের দাম নেই। সাদা টাকাকে এক চক্কর ঘোরালেই কালো টাকা। কালোর কদর তো এঁদেরই হাতে! অন্যদেশে এই কালোপ্রীতি কত সম্মান, কত পুরস্কার নিয়ে আসতে পারত। একজন গরিব মানুষের জীবনের কী দাম? তায় আবার হারাধনের দশটি ছেলে, সব ক’টাই অপঘাতে মরে। একজন গরিব মানুষ সারা জীবনে বড়জোর গোটাচারেক কুমড়ো আর এক কুইন্টাল বোগড়া চাল খাবে। অর্থনীতিতে তার খাতির একটা আলপিনের চেয়ে বেশি হতে পারে না। এই সব বড় মানুষ আর আপনাদের নিরাপত্তার জন্য আমার এক ক্ষুদ্র পরিকল্পনা সবিনয়ে পেশ করছি :

ব্রিজের তলায় লম্বা করে জাল ঝুলিয়ে দিন। মহাশয় আপনি নিশ্চয় ক্যারামবোরড দেখেছেন? চারটে পকেটেই জাল লাগানো থাকে। পকেটে ঘুঁটি পড়ে জালে ঝুলতে থাকে। খেলা-শেষে উদ্ধার করা হয়। ঠিক সেই কায়দা! লম্বা একটা জাল পোলের তলায় ফিট করে দেওয়া হোক। ম্যাগনেটিক জাল হলে লাগাবারও সমস্যা নেই। লোহার সঙ্গে টানে সেঁটে থাকবে। সহজে চুরি করা যাবে না।

আজকাল হঠাৎ-হঠাৎ মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি, কিশোর-কিশোরী। এই ছিল, এই নেই। অনুসন্ধানে কর্তৃপক্ষকে প্রায়শই বিরক্ত হতে হয়। মানুষ ছিল, মানুষ নেই, এ আর নতুন কথা কি! তার জন্য কর্তৃপক্ষকে ধরে কেন টানাটানি? মানুষ কেন অদৃশ্য হয়, তার কতকগুলি সুচিন্তিত কারণ খুঁজে বের করা হয়েছে। কেউ নিরুদ্দেশ হলে যেকোনও একটি কারণের মধ্যে ফেলতে পারলেই সমাধান হয়ে গেল, যেমন মহিলা হলে, ছেলেবন্ধুর সঙ্গে সংসার-সংসার খেলা করতে বেরিয়েছেন, কিংবা বোম্বে গেছেন নায়িকা হতে। কিংবা কোথাও গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছেন দাবি আদায়ের ছলে। যেই কাগজে বেরোবে, ‘মান্তু, ফিরে আয়, যা করতে চাস কর। বাপ-মা আর চোখ খুলছে না।’ অমনি কলিংবেল বেজে উঠল মান্তু আ গিয়া। বুড়ো অদৃশ্য হওয়া মানেই, হয় দেনার দায়ে, কি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আতঙ্কে কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছেন। তেমন আলো-বাতাসের সাপ্লাই পেলে যে গুহাতেই থাকুন চালিয়ে যাবেন অনেকদিন। আর তা না হলে পরস্ত্রীর সঙ্গে দূরে বহুদূরে চলে গেছেন প্রেমালাপ করতে-করতে। সময়, তারিখ, বার, দিক, স্থান-কাল-পাত্র সব ভুল হয়ে গেছে। বয়েস কোনও ব্যাপারই নয়। দুটি মাত্র কারণে মানুষ হাওয়া হয়ে যায়, এক, প্রেম, আর এক, চিত্রতারকা হবার টানে! তৃতীয় কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে—দেখুন গিয়ে, ব্রিজের তলায় জালে আটকে ঝুলছে কি না!

উটমুখো-নরনারী নীচে থেকে চিৎকার করে খোঁজ নিচ্ছেন, প্রফুল্ল আছে, প্রফুল্ল? সাধুচরণ, তুমি কি জালে পড়েছ? পতিব্রতা স্ত্রী বিরহকাতর গলায় চিৎকার করবেন—হ্যাঁ গা, তুমি জালে জড়িয়ে আছ।

শ্রীমতী শর্মা, ঔদ্ধত্যের একটা সীমা আছে। তবে জেনে রাখুন, পুরোনো লছমন-ঝুলাটা আমরা হাফ-প্রাইসে কেনার তালে আছি। অথবা আমাদের রেজিমেন্ট গিয়ে যারা ট্রেন খোলে, ড্রেন খোলে, পার্কের রেলিং খোলে, বিশাল উঁচু বাতিস্তম্ভ থেকে বালব খোলে, তারা গিয়ে উটিকে রাতারাতি খুলে এনে বলবে—এই নাও দড়ির পোল, বদলে দাও লোহার পোল।

দর্শকের দরবারে পঞ্চম অধিবেশন

গাদাগাদা চিঠি এসেছে, স্যার। যথারীতি গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটিয়ে দি!

না হে, কিছু-কিছু চিঠির জবাব আমি দিতে চাই, দর্শকের দরবারের কায়দায়। জনসংযোগের বড় সুন্দর মাধ্যম। চিবিয়ে-চিবিয়ে উত্তর দেব, সব চিঠির নয়, কিছু-কিছু নির্বাচিত চিঠির। তুমি ঘোষণা করে দাও, দরবার চালু…।

সময়, স্যার? কোন সময়ে দেবেন? মাঝরাতে ঘুম আসে না, সারারাত দেশের চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারি না।

দেশের চিন্তা না গেঁটে বাতের ব্যথা?

ডোন্ট বি সিলি। ঘরের শত্রুর সাজা জানো?

এখন রাত বারোটা। যাঁরা দাঁতের যন্ত্রণায়, পেট মোচড়ানো ব্যথায়, খিদের জ্বালায়, মশার কামড়ে, কী গৃহবিবাদে চোখ জবাফুলের মতো লাল করে ঘরে-ঘরে বিনিদ্র, তাঁরা এবার তটস্থ হোন, দর্শকের দরবারে শুরু হচ্ছে। কান খাড়া রাখলেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাবেন। ব্যাপক তরঙ্গে এই অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। ক্যালেন্ডার-মুক্ত যেকোনও দেওয়ালের দিকে তাকান।

নমস্কার। আমি বলছি। আপনারা সব কে কেমন আছেন, ভাই। আমি ভালো আছি। রাতে কম খাবেন। লঘুপাক হলেই ভালো হয়। শুধু বাতাস আর জল আরও ভালো। মন ফসফস করলে দুটি হালকা ধরনের ফুলবাতাসা। বাত, মানে আমাদের বাত আর আপনাদের আশা, দুয়ে মিলে সন্ধি করে বাতাসা। বড় মিঠে জিনিস। জলে ভিজিয়ে খেলে পেট ঠান্ডা। পেট ঠান্ডা মানে মাথা ঠান্ডা। ঠান্ডা মাথাই হল অগ্রগতির হাতিয়ার। ঠান্ডা জিনিস খাবেন। পান্তাভাত, লাউ, কুমড়ো। মাছ, মাংস, ডিম, নাই-বা খেলেন! পয়সা বাঁচবে। দুশ্চিন্তা কমবে। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করবে না, ঘুষ নেওয়ার ইচ্ছে হবে না।

প্রথম চিঠি। হরেনচন্দ্র কাবাসী, গুমথুন লেন, কলকাতা। আপনি লিখছেন, সংবাদপত্র দৃষ্টে অবগত হইলাম, আগামী পঞ্চাশ বৎসরেও কলিকাতার জলজমা সমস্যার কোনওরূপ সমাধান সম্ভব নহে। আকন্ঠ পচাজলে নিমজ্জিত হইয়া, খলরবলর করিয়া পাঁকাল মাছের মতো নিত্য জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে হইবে। উক্ত সমস্যা সমাধানে দীর্ঘকাল ধরিয়া যে হাজার-হাজার টাকা খরচ হইল, তাহাতে কোন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হইল? রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হইল। বিশাল-বিশাল পাইপ আসিল, যানচলাচল বিপর্যস্ত হইল। সংবাদপত্রের শিরোস্তম্ভে, বিজ্ঞাপনের চৌখপ্পরে প্রচুর কাব্য-নির্যাস ঝরিয়া পড়িল, বিশিষ্টাঞ্চলে বিশাল-বিশাল বিজ্ঞাপন-পাটাতনে লিখিত হইল, তিলোত্তমা তিলেতিলে তিলাইয়া উঠিতেছে। হায় ঈশ্বর! তিল অবশেষে তাল হইয়া, সব তালগোল পাকাইয়া, জনসাধারণের গ্যাঁটের কড়ি কর হিসাবে করায়ত্ত করিয়া জাদুকর এখন নাচিয়া-নাচিয়া বলিতেছেন, খেল খতম, পয়সা হজম।

কাবাসীমশাই, পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? জনসাধারণ, ট্যাক্সের টাকা, টাকা কোথায় গেল, এসব প্রশ্নের কোনও মানে হয় না। বলতে হয় তাই বলেছেন, লিখতে হয় তাই লিখেছেন। সরকার চালাতে গেলে টাকা চাই। লক্ষ্য করুন, আমি সরকার বলেছি, দেশ বলিনি কিন্তু। দেশের চেয়ে সরকার বড়। প্রজার অর্থেই সরকার চলে। কীভাবে চলে, কে চালায়, এসব কথা সাধারণ মানুষের মনে থাকে না, মাথাও ঘামায় না। মন্দিরে প্রণামীর থালায় পয়সা ফেলে, পরের দিন মা কালীকে এসে কেউ প্রশ্ন করে না, হিসেব দাও। করলেও উত্তর পায় না; কারণ, দেবদেবীরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না।

কাবাসীমশাই, আপনি একটি গবেট। আপনার চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছি না, তবে অনুমান করতে পারছি। মাথাটা কাতলা মাছের মতো মোটা, ড্যাবাড্যাবা বুদ্ধিহীন অনুজ্জ্বল চোখ, নীচের ঠোঁট পুরু, সব সময়েই ফাঁক হয়ে থাকে, নাকটা থ্যাবড়া। সব কথাতেই বোকার মতো প্রশ্ন করেন, অ্যাঁ, কী বললে? সহজে কোনও কথা বুঝতে পারেন না। সাধারণ একটা যোগ করতে পরিবেশনকারীর মতো অক্ষরের সিঁড়ি বেয়ে অনবরতই ওপর-নীচ করেন। লোকে আপনাকে ইডিয়েট, ডানস, হুলো ইত্যাদি বলে, আপনি শুনতে পান না। আপনার কানের পাতায় কড়ানে-কড়ানে চুল আছে।

কাবাসীমশাই, এই দেশে আমরা একটা আধ্যাত্মিক ওয়ার্কশপ খুলেছি। এই পরীক্ষাগারে আমরা দুটো সত্যের ক্লিনিকাল পরীক্ষা চালিয়েছি। এক নম্বর, আমরা পরীক্ষা করে দেখতে চাই, টাকা মাটি, না মাটি টাকা? দু-নম্বর, কর্মে আমাদের অধিকার আছে, কর্মফলে নয়। আমাদের দেখতে হবে, এই ভাব সত্যি-সত্যিই মনে আনা সম্ভব কিনা?

কাবাসী, ভাইয়া আমার, দুটি সত্যই সত্য, একেবারে পরীক্ষিত সত্য। মাটিতে টাকা ঢালতে-ঢালতে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, মাটিই টাকা। আর আমরা এ প্রমাণও পেয়েছি, কর্মই হল সব, ফলটা কিছুই নয়। ভাই রে, এ হল সেই বৃক্ষ, যার ফুল আছে ফল নেই। ডিয়ার কাবাসী, বয়েস নিশ্চয়ই অনেক হল, কোন অন্ধকারে পড়ে আছেন ভাই, সব কিছুতেই ফল খোঁজেন? ফল না খুঁজে আঁটি খুঁজুন।

জীবনের সেইটিই সার সত্য। আঁটি চুষতে-চুষতে, জীবনের যে ক’টা দিন বাকি আছে কাটিয়ে শ্রীহরি বলে বিদেয় হন। রাত অনেক হল। শুভরাত্রি। এবার শুয়ে পড়ুন। কাল ঠিক সময়ে অফিসে হাজিরা দিন। যা নেই তা আছে মনে করে, ললিপপ চোষা শিশুর মতো মুখটি হাসি-হাসি করুন। বলুন, হাসি-হাসি পরব ফাঁসি দেখবে বিশ্ববাসী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *