দর্পণের মুখ – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

দর্পণের মুখ – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

সতীশকে আমি এড়িয়ে যেতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না। তার আগেই ও আমাকে ধরে ফেলল। ধরে ফেলল মানে দেখে ফেলল। এবং দেখামাত্রই যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মুখোমুখি হয়ে গেছে হঠাৎ, এমনি মুখভঙ্গি করে বলে উঠল, ‘বাবু, আপনি এখানে?’

কোন কারণ ছিল না, তবু ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা ঢাকার জন্যে কিনা কে জানে, মুখখানা আমার স্বতঃই একবার ও-সির শুন্য চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপর কাগজপত্রগুলোর দিকে ঘুরে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে সতীশের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, ‘এসেছি—এসেছি একটা কাজে।’

থানারই কেউ-একজনের মত গলায় সতীশ বলে উঠল, ‘কিন্তু বড়বাবু তো বেরিয়ে গেলেন।’ ‘জানি। আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে গেলেন—এখুনি ফিরে আসবেন।’

‘বড়বাবুর সঙ্গে আপনার বুঝি আগে থেকেই চেনা-জানা আছে?’

সতীশের এই অহেতুক গায়ে-পড়া ভাবটা আমার ভাল লাগল না মোটেই। তবু ভদ্রতার খাতিরে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখেই জবাব দিলাম, ‘না, আজই প্রথম আলাপ হল।’

পাছে ঘরের মধ্যে সতীশ ঢুকে পড়ে এবং আমার কাছে দাঁড়িয়ে কোনরকম পরিচিতির সুযোগ গ্রহণ করে ভবিষ্যতে, বিশেষ করে থানার আর-পাঁচজন অধস্তনের সামনে, সেই আশঙ্কায় সতীশকে ডিঙিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম বাইরের ঘরটাতে। ঘরের পাখাটা যে ঘুরতেই থাকল, বেরিয়ে আসার সময় তাড়াতাড়িতে সেটা বন্ধ করতে পর্যন্ত খেয়াল রইল না আমার।

ধুলো-বালির আস্তরণ-পড়া পুরোন আমলের ভারী ভারী কাঠের আলমারি আর টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চে ভর্তি ঘরখানায় তখন হিজিবিজি মানুষের এলোমেলো গলায় যেন একটা বিচ্ছিরি কলরোলের সৃষ্টি হয়েছে। ওধারের টেবিলে দুটো লোককে নিয়ে একজন সাব-ইন্সপেক্টর তখন খুবই চেঁচামেচি করছিলেন। লোক দুটো বোধ হয় দাগী আসামী। কোমরে দড়ি জড়িয়ে দুজনকে একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। এধারে, একটা বেঞ্চের সামনে একজন ফিরিওলার সঙ্গে সিগ্রেট নিয়ে বচসা করে চলেছে একজন কনস্টেবল। একজন দেবে না, আরেকজন নেবেই। কোণের দিকে একটা টেবিলে ডায়েরী লিখতে ব্যস্ত একজন সাব-ইন্সপেক্টর, সামনেই তাঁর গেঞ্জি-গায়ে বসে এক ভদ্রলোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে একনাগাড়ে বকে চলেছেন। ভদ্রলোকের পাশেই কিশোর বয়সের একটি ছেলে রক্তাক্ত কপাল নিয়ে কাতর। সঙ্গে ওরই বয়সী কি দু-এক বছরের এধার-ওধার আৱো জনাতিনেক ছেলে। ঘটনাটা হয় পাড়াসংক্রান্ত, কিংবা পারিবারিক। ভদ্রলোকের পেছনে, কিছুটা তফাতে একজন কনস্টেবল সমেত ময়লা থান-পরনে কৃশকায়া এক মহিলা, কোন বাড়ির কাজের লোক বোধ হয়, কাঁদো-কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে। দায়টা বাসনচুরির হলেও হতে পারে, কিংবা লকআপ থেকে জুয়াড়ী ছেলেকে খালাস করা।

জানলা দিয়ে পশ্চিমের চড়া রোদ এসে পড়েছিল টেবিলে, কিছুটা মেঝেয়। সাব-ইন্সপেক্টরের সিগারেটের ধোঁয়ায় গরাদের ছায়াগুলো রোদটাকে যেন সমান্তরাল রেখায় খণ্ড খণ্ড করে দিয়েছে। ধুলো উড়ছে, মাছিও এক-আধটা, পাখার হাওয়ায় গরম নিশ্বাস। এক কথায় সমস্ত পরিবেশটাই কেমন যেন অস্বস্তিকর, মাথা ধরে যাওয়ার মত। এই গুমোট থেকে খানিক হালকা হওয়ার জন্যে সদর-ফটকের দিকে এগোতে যাচ্ছি, ওধারের টেবিল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক চড়া গলা খাদে নামিয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনি যেন চলে যাবেন না স্যার, বড়বাবু এখুনিই এসে পড়বেন।’

সস্মিত মুখে আমিও জবাব দিলাম সঙ্গে সঙ্গে, ‘না, না, যাইনি কোথাও, এখানেই আছি।’

আড়চোখে একবার দেখে নিলাম সতীশকে। আমার পেছন পেছন এসে খানিকটা তফাতে থেমে পড়ে একজন কনস্টেবলের সঙ্গে ফিসফিস করে কিসব কথা বলছে। সতীশ যতই অবাক হোক না কেন, আমি কিন্তু এখানে তাকে দেখে একটুও আশ্চর্য হলাম না। মাসে মাসে এক-আধবার তাকে আসতেই হয় এখানে। আসতে হয় বটে, তবে কোন আসামী হিসেবে নয়। না গুণ্ডা-আইনের, না বোমাবাজির, ছিনতাই কিংবা চুরি-ডাকাতির। সে বয়সও আর ওর নেই। সতীশ এখানে আসে একটা বিশেষ কারণে, যে-কারণ জানেন এখানকার বড়বাবু এবং তারই অধস্তন কয়েকজন মাত্র কর্মচারী। এখানে আসলেই সতীশের বুক-পকেটটা চুপসে যায় বটে, কিন্তু বুকটা ফুলে ওঠে খুব। একটু আড়ালে গিয়ে ফিসফাস দু-চারটে কথা হয় বড়বাবুর সঙ্গে, অধস্তনরা চোখ বড় বড় করে কান খাড়া করে শোনে, তারপর তাদের কাছ থেকে অভয় পেয়ে সে যখন থানার বাইরে বেরিয়ে আসে, চিন্তার কোন ভাঁজই তার কপালে থাকে না। জীবনযাত্রার সঙ্গে মসৃণ হয়ে যায় সব কিছু।

বাইরে থানার কম্পাউন্ডে একটা গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ালাম। একধারে পুরোন ভাঙাচোরা রিক্সার সার, আরেক দিকে একটা ধুলোকাদা মাখা কোন্ মান্ধাতা আমলের মোটরগাড়ি দোমড়ানো-মোচড়ানো অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। ওধারে খোলা জায়গাটায় ভুঁড়িওলা একজন হিন্দুস্থানী পৈতে-বার-করা খালি গায়ে মাটির ওপর ঠুকে ঠুকে খাটিয়া থেকে ছারপোকা ঝাড়ছে। আর, তারই সামনে দাঁড়িয়ে তারই এক দেশোয়ালী ভাই বাঁ-হাতে খৈনি ডলতে ডলতে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সেদিকে।

চেয়ে আমিও ছিলাম, তবে চেয়েই ছিলাম। মন ছিল অন্য দিকে। ভাবছিলাম গতকালের ঘটনাটা। অর্থাৎ হঠাৎ কেমন বোকা বনে যাওয়ার ব্যাপারটা। অথচ আমি জন্মেছি কলকাতায়, মানুষ হয়েছি কলকাতায়, এবং অধুনা-কলকাতার হালচালও আমার অজানা নয়। তবু হঠাৎ কোথা দিয়ে যে কি ঘটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। ঘড়ি খুইয়ে, টাকা-পয়সা ঘুচিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, মনে হল আমি যেন আর আমাতে নেই। গিয়েছিলাম বিয়েবাড়ির একটা নেমন্তন্ন সারতে। কথায় কথায় ফিরতে রাত হয়ে গেল। রাস্তার মোড়ে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়ালাম, কিন্তু বাস আসার কোন লক্ষণই যখন দেখলাম না, ভাবলাম চৌমাথার মোড়ে যাই, কোন-না-কোন গাড়ি পাবই। তখন রাত সাড়ে এগারটা প্রায়, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, পথে কোন লোক-চলাচল নেই বললেই চলে। হেঁটে গেলেও অনেকটা, তার ওপর বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। তাই বাধ্য হয়েই একখানা রিক্সা করলাম এবং সেই রিক্সাই যখন অন্ধকার রেলব্রিজের তলা দিয়ে চলেছে, হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার মত তিনদিক থেকে কালো অন্ধকারের চেয়েও কালো তিনটে ছায়া বেরিয়ে এসে ঘিরে ধরল রিক্সাখানাকে। তাদের একজনের হাতে একখানা ছুরি, একজনের হাতে একটা লাঠি, বাকীজনের শূন্য হাত আমার ঘড়িওলা কব্জিটা ধরে।

‘টুঁ শব্দটি করেছ কি একদম খতম!’

‘ঘড়িটা চটপট খুলে ফেললা গুরু!’

‘পকেটে কি আছে, বের করো তো চাঁদু!’

রিক্সাওলার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে তিনজনেরই আদেশ শিরোধার্য করে নিলাম। এবং বলা বাহুল্য, নিঃস্ব পকেট আর রিক্ত কব্জি নিয়ে যে কি বিমূঢ় আচ্ছন্নতার মধ্যে বাড়ি ফিরলাম, তা অবর্ণনীয়। টাকা-পয়সা আমার বিশেষ কিছু ছিলও না, চিন্তাও করি না আমি তার জন্যে, কিন্তু ঘড়িটা আমার বিয়ের যৌতুক এবং বেশ দামীও বটে।

পরদিন অফিসে গিয়ে আমার এক রিপোর্টার বন্ধু নিখিলেশকে সমস্ত ঘটনাটা খুলে বললাম। শুনেই নিখিলেশ বললে, ‘থানায় একটা ডায়েরী করিয়েছিস?’

‘থানায় ডায়েরী করিয়ে কি লাভ বল? শুধু শুধু হয়রান হওয়া।’

‘নাঃ, তুই দেখছি এখনও সেই ভাল মানুষ প্রফেসরই রয়ে গেছিস। শুধু শুধু হয়রান হতে যাবি কেন? তুই সংবাদপত্রের একজন রিপোর্টার, তুই তো জানিস, রিপোর্টারদের পুলিশে কি-চোখে দেখে। তোর মাল খোয়া গেছে জানলে, পুলিশ নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে উদ্ধার করতে। আর, পুলিশ পারে না হেন কাজ আছে নাকি?’

‘কিন্তু’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিখিলেশ ফের বলে উঠল, ‘আচ্ছা, দাঁড়া, দাঁড়া, আমিই দেখছি চেষ্টা করে। ডি-ডি-র স্ন্যাচিং-এ আমার এক ইন্সপেক্টর বন্ধু আছে। অলোক—অলোক সান্যাল। দেখি, তাকে পাই কিনা।’

বাঁ হাতে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডায়াল করতে শুরু করল নিখিলেশ। একবার, দুবার, তিনবার। চারবারের বার অলোককে কানেকশানে পেয়েই কথা বলতে আরম্ভ করল সে। গড়গড় করে ঘটনাটা বিবৃত করবার পর, ওপার থেকে অলোক সান্যাল কি বললেন জানি না, তবে মুখের কাছ থেকে রিসিভারটা সরিয়ে নিখিলেশ আমায় জিজ্ঞেস করলে, ‘ছোঁড়াগুলোকে দেখলে তুই চিনতে পারবি?’

বললাম, ‘সবাইকে পারব না, তবে যে ছেলেটি আমার পকেট হাতড়ে টাকা-পয়সাগুলো বের করেছিল, তাকে বোধ হয় চিনতে পারব। কেননা, অন্ধকার হলেও মুখটা তার খুবই চেনা-চেনা মনে হয়েছিল আমার।’

রিসিভারটা আবার মুখের কাছে ধরল নিখিলেশ। জানাল খবরটা। তারপর খানিক চুপ থেকে সেটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘তুই এক কাজ কর। ঘন্টাখানেকের মধ্যে তুই চলে যা একবার লোকাল থানায়। আগে একটা ডায়েরী করিয়ে দিবি, তারপর সোজা গিয়ে দেখা করবি ও-সি-র সঙ্গে।’

এক ঘণ্টায় হল না, হেস্টিংসে একটা রিপোর্টিংয়ের কাজ সেরে থানায় পৌঁছতে পৌঁছতে আমার প্রায় ঘন্টা দুই লেগে গেল। বাইরের ঘরে সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে ডায়েরী লেখাবার জন্যে প্রসঙ্গটা পারতেই তিনি বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘ও, আপনিই সেই মিস্টার চ্যাটার্জি? বসুন—বসুন…আচ্ছা, বসতে হবে না, আপনি একেবারে সোজা ওই সামনের ঘরে বড়বাবুর কাছে চলে যান। উনি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছেন।’

বুঝলাম, লালবাজার থেকে ইতিমধ্যেই এখানে খবর পৌঁছে গেছে।

মিস্টার ও-সি-র আপ্যায়নেও কোন ত্রুটি পেলাম না। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই সমস্ত ঘটনাটা একবার আমার মুখ থেকে নিজের কানে শুনে নিলেন তিনি। তারপর সবেমাত্র কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে রিসিভারটা কানে তুলে নিলেন তিনি, কথা বললেন কিছুক্ষণ, তারপর একসময় বেশ উত্তেজিত ভাবেই দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ‘আচ্ছা, আমি এখুনি আসছি।’ রিসিভারটা ঝনাৎ করে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ লজ্জিত গলায় বললেন, ‘আপনি দয়া করে একটু বসুন স্যার, আমি এখুনি ঘুরে আসছি। একটা জরুরী কেস আছে। দিনকাল যা হয়েছে, একটা বেলা যায় না, যেদিন কোন-না-কোন গণ্ডগোল—’

কথা শেষ না করেই ভদ্রলোক চেয়ারের পাশ থেকে সরে এলেন এবং দরোয়াজাকে ইশারা করে কি বলে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ব্যস্ত মানুষ ও-সি তাঁর সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক সৌজন্যে আমিও উঠে দাঁড়ালাম এবং তাঁকে অনুসরণ করে দৃষ্টিটা আমার ঘরের দরজাগোড়ায় পৌঁছতেই হঠাৎ যেন আটকে গেল।

সেই পরিচিত চেহারা। গায়ে নীল হাফশার্ট, পরনে আধময়লা খাটো ধুতি, পায়ে টায়ারের চপ্পল। মাথায় ছোট করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা কোঁচকানো চুল, গালে দিন তিন-চারের জমা দাড়ি, মুখে নিরীহ নিস্পৃহ ভাব, কিন্তু চোখজোড়ায় চারদিকে নজর রাখা দৃষ্টি। শরীরটা ইদানীং প্রচণ্ড রকম ভেঙে গেলেও চিনতে সতীশকে আমার এতটুকুও অসুবিধে হল না।

একটা সময় ছিল যখন সতীশের সঙ্গে আমার প্রতিদিন দুবেলা দেখা হত। কিন্তু আজ বছর তিনেক হল ওর সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ নেই। না, কোন ঝগড়া বা বাকবিতণ্ডা তার সঙ্গে আমার হয়নি, একজনের হয়ে সালিশী মানতে গিয়ে সতীশের ব্যবহারটা আমার কাছে এমনই অশোভন আর অশালীন ঠেকেছিল যে বাধ্য হয়ে আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি। ঘটনার দিন কয়েক পরে, পরপর ক’দিন সে আমার বাড়িতে হানা দিয়েছিল অবশ্য, জানি না, নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চাইতে, নাকি একজন বাঁধা খদ্দের হাতছাড়া হবার সম্ভাবনায়, কিন্তু আমি দেখা করিনি বা দেখা করার কোন প্রয়োজনও বোধ করিনি।

সতীশের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের নয়, পরিচিতের। তার আদি পরিচয় সে খবরের কাগজের একজন হকার, আর আমি তার একজন নিয়মিত খদ্দের। দীর্ঘকালের আনাগোনায় যা হয়, অর্থাৎ ভদ্র সম্পর্ক, ঠিক তাই ঘটেছিল, তার বেশি কিছু নয়। শুনেছি, ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর সে যখন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় কলকাতায় চলে আসে, তখন নাকি খুবই দুরবস্থার মধ্যে দিন কেটেছে তার। তারপর একদিন সামান্য কিছু টাকা সংগ্রহ করে সে শুরু করে দেয় খবরের কাগজ বেচার ব্যবসা। এবং তাই থেকেই একদিন অকুল পাথার থেকে সে তার বুড়ো বাবা-মা আর ছোট ছোট দুটো ভাইকে ডাঙায় এনে তোলে। তবে আমার সঙ্গে যখন আলাপ, তখন তার বাবা-মা দুজনেই স্বর্গে গেছেন, ছোট ছোট ভাই দুটোও বড় হয়ে আলাদা হয়ে গেছে। সতীশ তখন বিবাহিত এবং দুটি সন্তানের জনক। এবং একটি রমরমা বইয়ের দোকানের মালিক।

সতীশের দোকানটা একেবারে চৌমাথার মোড়ে। বাজারের কোণায়, ট্রাম এবং বাসস্টপের ধারে। থলে-হাতে সকাল-সন্ধেয় অসংখ্য মানুষের যাতায়াত, অফিসটাইমে অপেক্ষমান যাত্রীদের ভিড়। এবং সেই কারণেই দোকানটা চলে ভাল। অবশ্য দোকান ঠিক বলা চলে না একে। পাশাপাশি দুটো স্টেশনারী আর জুতোর দোকানের মাঝে হাত দেড়েক চওড়া একটা ছোট ফাঁক, যে ফাঁকটা জুতোর দোকানের মালিক প্রসন্ন মণ্ডল একসময় নিতান্ত অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তার শো-কেস তুলে দিয়ে ভাড়া দিয়ে দিয়েছিল সতীশকে।

সতীশ তখন খবরের কাগজ বেচত ফুটপাথে বসে। শীর্ণকায়, পরিশ্রমী এবং মিষ্টভাষী সতীশের আকুতিতে সাড়া না দিয়ে পারেনি প্রসন্ন। বুড়ো বাবা-মা আর ছোট ছোট দুটো ভাইকে নিয়ে ফরিদপুর থেকে সবে-আসা সতীশকে ভীষণ ভাল লেগে গেল প্রসন্নর এবং সেই ভাল লাগার নিদর্শন হিসেবে নামমাত্র ভাড়ায় সে ওই শো-কেসটা ছেড়ে দিল তাকে।

এসব ইতিবৃত্ত পরে সতীশেরই মুখ থেকে আমার শোনা।

সামান্য অদলবদল করে, নিজের স্বল্প সঞ্চয় ভেঙে কয়েকদিনের মধ্যেই সতীশ একটা দোকান লাগিয়ে দিল সেখানে। দোকান না বলে সেটাকে স্টল বলাই বোধ হয় শ্রেয়—বইয়ের স্টল। বই বলতেও নামী-দামী লেখকের কিছু নয়, বটতলার বেশি-কমিশনের কিছু উপহারের বই, খানকয়েক চলতি মাসিক-সাপ্তাহিক, আর—আর সস্তা দামের ছেলেদের ডিটেকটিভ সিরিজ। ছোট্ট একটা জলচৌকি আর একটা টুলও করিয়ে নিল সতীশ। জলচৌকির ওপর খবরের কাগজ সাজিয়ে টুলে বসে সকালে খবরের কাগজ বেচে সতীশ আর সন্ধের সময় মাসিক আর সাপ্তাহিক পত্রিকা বিছিয়ে খদ্দেরের প্রত্যাশায় এদিক-ওদিক চায়।

খদ্দের অবশ্য আসে না যে তা নয়, টুকটাক লেগেই আছে। একে বাজারের ধার, চৌমাথার মোড়, তার ওপর ঘিঞ্জি গেরস্ত পাড়া—ডাইনে-বাঁয়ে এদিকে-ওদিকে মাইল দেড়েকের মধ্যে দ্বিতীয় আর কোন দোকানও নেই। সেদিক থেকে সতীশ খুবই ভাগ্যবান এবং ভাগ্যই তাকে বুদ্ধি দান করে যেন দোকানটা খুলিয়ে দিয়েছে।

আমি তখন সতীশের দোকানের একজন নিয়মিত খদ্দের। সকালে বাজার যাবার সময় একখানা করে খবরের কাগজ কিনি, পাঁচ-দশ টাকার নোটের বদলে হিসেব করে খুচরো পয়সাই দিই এবং অযথা অন্যান্য কোন পত্র-পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করি না। সম্ভবত সেই কারণেই সতীশ আমাকে একটু অন্য চোখে দেখে। ফলে, অনেক সময় দূর থেকে আমাকে দেখলেই ভাঁজ-করা কাগজখানা তাড়াতাড়ি আর-এক ভাঁজ করে হাসিমুখে এগিয়ে ধরে আমার দিকে, আমিও কাগজখানা চোখের সামনে মেলে ধরে অপর খদ্দেরের বিরক্তির কারণ না হয়ে, স্রেফ খুচরো পয়সাগুলো তার হাতে তুলে দিয়ে চলে আসি সেখান থেকে।

এমনি প্রতিদিন, মাস এবং বছর।

দুপুরবেলা দোকানটা বন্ধ রাখে সতীশ। ঘণ্টা তিনেকের জন্যে। স্নান-খাওয়া আছে, একটু বিশ্রাম আছে, তারপর আবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে মালপত্র কিনে আনাও আছে। শুক্র-শনিবারে দোকান খুলতে আরো একটু দেরি হয়, কেননা সেদিন ধর্মতলা যেতে হয়। সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো বেরোবার দিন। অনেক সময় শরীর বয় না, তবু করতে হয়। কারণ কর্মচারী রাখার সামর্থ্য সতীশের নেই, অথচ ছেলেদুটোও খুব ছোট। সন্ধের দিকে মাঝে-মধ্যে ছুটিছাটার দিন আমাকে দেখলে ডাকে সতীশ। ইচ্ছে—আমি দু-দণ্ড দাঁড়াই, আর ও দুটো মনের কথা বলে। তা আমি ওকে নিরাশ করি না কখনো। খদ্দের সামলাতে সামলাতে, থেমে-থেমে অনেক সুখ-দুঃখের কথা বলে সতীশ। ঘুম থেকে ওঠে সেই কোন ভোর চারটেয়, কাগজ আনতে দৌড়তে হয় শেয়ালদা সেন্টারে। সকালের জলখাবার খাওয়া হয় না, দোকান থেকে সামান্য কিছু মিষ্টি কিনে এক গ্লাস জল খেয়ে কাগজ বেচতে বসে। বেলা দশটা নাগাদ রুটি-গুড় পাঠায় ওর বউ ছোট ছেলেটাকে দিয়ে। বড় ছেলেটার জন্যে একজন মাস্টার রেখেছে কুড়ি টাকা দিয়ে—দুবেলা পড়িয়ে যায়।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার বড় ছেলে কোন ক্লাশে পড়ে সতীশ?’

‘পড়ে—দাঁড়ান বলছি—’পয়সা গুণতে গুণতে একটু থামল সতীশ। তারপর আমতা আমতা করে বলল, ‘বোধ হয় কেলাশ থিরিতে—না, না, টু-এ—ঠিক বলতে পারব না বাবু, আমার গিন্নিই সব করে কিনা। বোঝেন তো, এখনকার দিনে টাকাপয়সা ছাড়া ছেলে মানুষ করা যায় না। তাই তো আমি রয়েছি রোজগারের ধান্দায়, আর আমার গিন্নি রয়েছে ছেলেদের পেছনে।’

হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সতীশ। বলে, ‘একটু দাঁড়ান বাবু, সাইকেলটা নিয়ে আসি।’

চলে যায় সতীশ। পাঁচ মিনিট সাত মিনিট দশ মিনিট পার হয়ে যায়, সতীশের দেখা নেই। আমি দাঁড়িয়ে থাকি ঠায়, এক-আধটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করি, খদ্দের এলে দাঁড় করিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে বিরক্ত যে না হই এমন নয়, কিন্তু যখনই ভাবি বেচারা একা লোক, দোকান ফেলে যেতে পারে না, তখন আর বিরক্তি থাকে না। তাছাড়া, এই ফাঁকে আমারও তো কিছু বই নাড়াচাড়া করা হয়ে যায়। খানিক বাদে যখন সাইকেল নিয়ে ফেরে সতীশ, দেখি হ্যান্ডেলে ঝোলানো একটা ব্যাগে কিছু কাঁচা আনাজ। বুঝি, শুধু সাইকেল আনা নয়, আমাকে দোকান পাহারায় রেখে সতীশ একেবারে বাজার সেরে ফিরেছে।

সাইকেলে চাবি দিয়ে, গাড়িবারান্দার থামে ঠেসান দিয়ে রেখে সতীশ আবার টুলে এসে বসে। দাঁড়ান খদ্দেরদের চাহিদা মিটিয়ে ফের শুরু করে তার কথা, ‘সকালের চেয়ে রাত্রে বাজার সস্তা। একটু দেখেশুনে কিনলে ভাল জিনিস অনেক কম দামে পাওয়া যায়। বাজার যা পড়েছে, এই দোকান থেকে সংসার চালান দায়, নেহাত খবরের কাগজ বিক্রি করি, তাই চলে যায় কোনরকমে।’

এমনি কত কথা। ইদানীং যে কাগজই বেরোক না কেন, হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘দেখুন না, কেমন করেছে—বিক্রি হবে?’

আমি এই ব্যবসার কিছুই বুঝি না। তবু ছবি, ভেতরের ছাপা, সূচিপত্র দেখে মন্তব্য করি, ‘দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে চলবে। আজই বেরোল?’

একটু চুপ করে থেকে ঈষৎ চাপা গলায় সতীশ বলে, ‘এটা এখনও বাজারে বেরোয়নি, কাল-পরশু নাগাদ বেরোবে।’

‘তবে তুমি পেলে কোথ্থেকে?’

‘আমি ঠিকই পাই আগে-ভাগে।’ মুখে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে আগের মতই চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে সতীশ, ‘টানা মাল।’

‘টানা মাল আসে কোথ্থেকে?’

‘নানান জায়গা থেকে। দপ্তরীবাড়ির ছোঁড়ারা দেয়, অফিসের কর্মচারীরা দেয়, এমন কি রেলের পোস্টাপিসের বাবুরা পর্যন্ত বাইরের প্যাকেট খুলে মাল পাচার করে—’

তার কথা শেষ হবার আগেই আমি আবার বলে উঠি, ‘কত দিয়ে কেনো?’

‘দেড় টাকার বই চার-ছ’ আনায়।’ আবার একটু থামল সতীশ, মুখে সেই বিজেতার হাসি, ‘কি বলেন, লোকসান হবে?’

মনে মনে এই অন্যায়টাকে সমর্থন করতে পারি না মোটেই। তবু কি জানি কেন, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘লোকসান হবে কেন, ভালই তো!’

আমার কথা শুনল কিনা জানি না, সতীশ বলেই চলল, ‘যত বড় কম্পানিই হোক, সব ঘর থেকেই মাল বেরিয়ে আসে। তাছাড়া, না রাখলে আমাদের উপায়ও নেই। খদ্দেরকে বেরোয়নি বললে চোখ কপালে তুলে বলে, ‘সেকি! বউবাজারের মোড়ে বেরিয়ে গেছে দেখলাম!’

যুক্তি চোরেরও থাকে, সাধুরও থাকে। সুতরাং হাসিমুখে চুপ করে যাওয়া ছাড়া উপায় কি!

দিন কাটতে থাকে। দোকানের হালকা তাকগুলো সতীশ ভরিয়ে ফেলে। নানান ধরনের বই সে আনতে শুরু করল। রাশিফল-লগ্নফল, পাঁচালী-ব্রতকথা, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, বাড়িভাড়া আদায়ের রসিদ, দুর্গাপূজা-কালীপূজার বিলবই, এমন কি ক্যালকাটা-হায়দ্রাবাদ-পুণার রেসগাইড ও রেজাল্ট পর্যন্ত। দিল্লী এবং বোম্বাইয়ের বহুরঙা কভারের হিন্দি এবং ইংরিজি ম্যাগাজিন, মনোহারিণী ছবি সমেত ক্রাইম-থ্রীলার কাঠের ক্লিপে আর ইঁটের গ্যালারীতে যেভাবে হঠাৎ ওঠা-বসা শুরু করল দিনের পর দিন, বোঝা যায় সতীশের বুকস্টল আকারে যত ছোটই হোক, এখন আর স্টল নয়, স্টোরের পর্যায়ে উঠে গেছে।

একদিন বললাম সতীশকে, ‘জায়গা তো এইটুকু, এদিকে বইয়ের সংখ্যা যে পরিমাণে বাড়ছে, এরপর তো রাখার জায়গা পাবে না।’

একটু হেসে সতীশ বলল, ‘জায়গা তো এখনই পাই না। বাড়িতে একখানা ঘর তো বইয়ে ঠাসা। বই থাকলে ইঁদুরের উৎপাত বাড়ে বলে গিন্নি তো প্রায়ই রাগারাগি করে।’

আজকাল বেশির ভাগ দিনই দোকানের সামনে দাঁড়ান যায় না। আধখানা ফুটপাথ জুড়ে বই, মাঝে হাত দুয়েক জায়গা ছেড়ে সামনেই সারি সারি ফলের টুকরি। চুপড়িতে সাজান মন্দিরের চুড়োর মত হরেক রকমের ফল। মাঝের ওই যাতায়াতের পথটুকুতে লোক-চলাচল আছে, মুখোমুখি দুই দোকানদারের খদ্দের আছে। কোন সময়ে ফলওয়ালার সঙ্গে দর নিয়ে খদ্দেরের কথা-কাটাকাটি চলছে, কোন সময়ে সতীশকেও দেখি এক-একজন খদ্দেরের সঙ্গে বচসা করতে। অযথা কাউকে বই ঘাঁটাঘাঁটি করতে দিতে সতীশ নারাজ। সাজান প্রচ্ছদে রঙিন অর্ধ-নগ্নিকার দিকে দৃষ্টি পড়লে, পলকের জন্যে হলেও, পথিক বোধ হয় পথ হারিয়ে ফেলে। ফলে, দাঁড়ান দূরের কথা, যাতায়াত করাই এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সময়ে সময়ে। তবু, ওরই ফাঁকে দেখি, এক-একজন খদ্দের কত ভদ্র। আসে, বই নেয়, দাম দেয়, চলে যায়। অনেক সময় চেনা খদ্দেরদের বই খবরের কাগজের প্যাকেট করে রেখে দেয় সতীশ। খদ্দের এলেই দিয়ে দেয়। একদিন এমনি একটি খদ্দের এসে সতীশকে একখানা দশ টাকার নোট দিয়ে চেঞ্জ ফেরত নিল না দেখে অবাক হয়ে তাকাতেই সতীশ বোধ হয় বুঝে ফেলল আমার প্রশ্নটা। বলল, ‘কি হল, অবাক হচ্ছেন কেন?’

বললাম, ‘বইখানার দাম কত?’

‘দশ টাকা।’

‘অত চটি বই—দশ টাকা দাম? কি বই ওখানা?’

চুপ করে রইল সতীশ, কোন কথা বলল না।

এই সময় ট্রাফিক পুলিশের বোধ হয় ডিউটি বদল হল। ফুটপাথের কোণায় দুপুরের ডিউটির পুলিশটিকে দেখে সতীশ তাড়াতাড়ি গ্যালারী থেকে একখানা হিন্দি মাসিক তুলে নিয়ে এগিয়ে ধরল তার দিকে। পুলিশটি চলে গেলে মুখখানা একটু ব্যাজার করে বলল, ‘তা মাসে প্রায় পনের-বিশ টাকার বই গচ্চা দিতে হয়। এছাড়া থানে চড়ানো তো আছেই।’

‘থানে চড়ানো!’ অবাক হয়ে বললাম, ‘সেটা আবার কি?’

সতীশ অনুকম্পার হাসি হেসে বলল, ‘সেকি! কলকাতায় থাকেন, পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করেন, আর থানে চড়ানো বোঝেন না? পুজো—পুজো—লালবাড়ির পুজো।’ পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে সতীশ আমার আগের প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘কি জিজ্ঞেস করছিলেন যেন—অতটুকু চটি বই দশ টাকা? তা তো হবেই, ওগুলো যে নোংরা সেক্সের বই। কমিশন কত জানেন? সিক্সটি পার্সেন্ট।’

সতীশ তাহলে নোংরা নিষিদ্ধ বইও বেচে! আর বেচে বলেই লালবাড়িকে হাতে রাখার জন্যে মাসিক বরাদ্দ করে রেখেছে। বললাম, ‘কেনে কি এইসব ছেলেছোকরার দলই?’

‘শুধু ছেলেছোকরার দল কেন, বুড়োরাও কেনে।’

বিকৃতরুচি বুড়োরা কি করে, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না, কিন্তু ছেলেছোকরাদের এই বিকৃত পথে পা বাড়ানর পথ প্রশস্ত করাটাকে আমি একটা জঘন্যতম অপরাধ বলেই মনে করি। যারা এই বই ছাপে, তাদের চেয়ে এই বই যারা বেচে সেই সতীশের দলকেই আমি মনে মনে দোষী সাব্যস্ত করি বেশি। দুটো পয়সার জন্যে, এরা নিজেরাও জানে না, সমাজের কি ক্ষতি এরা করে চলেছে।

আমার মনের ভাব মুখে পড়েছিল কিনা জানি না, সতীশ বলে উঠল, ‘কি ভাবছেন? ভাবার কিছু নেই। পয়সা রোজগার করতে হলে এ ধরনের কাজ একটু-আধটু করতেই হয় বাবু। সেই জন্যেই তো ছেলেদের কাউকেই দোকানের দিকে ঘেঁষতে দিই না। আপনি শিক্ষিত মানুষ, আপনি তো বোঝেন, লেখাপড়ার বয়সে শুধু লেখাপড়া নিয়েই থাকতে হয়। তাই তো ছেলে দুটোকে আমি এসব থেকে যতটা পারি আলাদা করে রাখি। সময়মত তাদের বই কিনে দিই, স্কুলের মাইনে দিই, মাস্টারের ব্যবস্থা করে দিই—’

‘তোমার ছেলেরা লেখাপড়ায় কেমন, সতীশ?’ ফস করে আমার মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে এল।

‘ভাল বাবু—খুব ভাল। ছোটটা গত বছরে দুটো বিষয়ে ফেল করেছিল বটে, তবে অন্য বিষয়ে ভাল নম্বর ছিল বলে ওর মা একবার বলতে-না-বলতেই মাস্টাররা কেলাশে তুলে দিয়েছে।’

একখানা বই নিয়ে খুচরো পয়সা রাখা টিনের কৌটোটা আড়াল করে, ময়লা ছোপধরা এলুমিনিয়মের বেড়ান গেলাসটা টুলের পেছন থেকে বার করে সতীশ বলল, ‘একটু দাঁড়ান বাবু—জল খেয়ে আসি।’

রাস্তা পার হয়ে ও-ফুটপাথে একটা মিষ্টির দোকানে গিয়ে ঢুকল সতীশ। খানিক পরে হাতে এক গেলাস জল নিয়ে দাঁতের ফাঁকে জিভ ঠোকরাতে ঠোকরাতে ফিরে এল সে। আড়চোখে একবার পয়সার কৌটোটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘এ তল্লাটে এরকম হারামী লোক আর নেই। শালা চশমখোর।’

বুঝতে না পেরে আমি মুখ তুলতেই ফের বলল, ‘বলছি ওই মিষ্টির দোকানের মালিকের কথা। খদ্দেরদের মানুষ বলেই জ্ঞান করে না।’

‘তা যাও কেন ওর দোকানে?’

‘যাই, কিছু সুযোগ সুবিধে আছে বলে—’ সতীশের মুখে আবার সেই রহস্যময় হাসি।

সুযোগ সুবিধে যে কি, সেটা অবশ্য ভেঙে বলল না সতীশ। তবে বুঝতে আমার বিশেষ অসুবিধে হয়নি যখন বাড়ি ফেরার মুখেই দেখলাম, ওই দোকানেরই একটি কর্মচারী সতীশের সামনে এসে চুপি চুপি দাঁড়াতেই একটা আধুলি তুলে দিল তার হাতে এবং দিলও হাতটা একটু নিচু করে। এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে লোকটিও একটু ঝুঁকে পড়ে আধুলিটি হাতে নিয়ে সুট করে যেন হাওয়ায় মিশে গেল।

দুপুর ছাড়া সতীশ বড়-একটা দোকান বন্ধ রাখে না, কিন্তু পরপর হঠাৎ দুদিন দোকানটা বন্ধ দেখে কেমন অবাক লাগল। সকালের দিকে একজন হিন্দুস্থানী বন্ধ দোকানের সামনে কাগজ বেচে। খদ্দের টিকিয়ে রাখার জন্যে সেটা সতীশেরই ব্যবস্থা কিনা কে জানে। তৃতীয় দিন সন্ধের দিকে দোকানে আলো জ্বলতে দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখি, দোকানের পাটাগুলো খুলে ঘর্মাক্ত শরীরে সতীশ টুলের ওপর বসে বই বাছাই করছে।

বললাম, ‘কি ব্যাপার, বিয়ে খেতে গেছলে নাকি দুদিন?’

সতীশ একবার তাকাল আমার মুখের দিকে, তারপর কোলের বইগুলো জলচৌকিতে নামিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘আর বলেন কেন, ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গেছলাম—কোর্টে যেতে হয়েছিল।’

দোকান সাজানর দিকে বিশেষ আগ্রহ দেখলাম না সতীশের। নিজের থেকেই বলে চলল, ‘তের-চোদ্দ বছর আগে ডানকুনিতে কাঠা সাতেকের মত একটা ছোট্ট বাগান আর খানদুয়েক ঘর কিনেছিলাম। সম্পত্তিটা একজন বিধবার, মেয়ের বিয়ে দেবার সময় বেচেছিল। সস্তায় পেয়ে গেলুম, আমিও নিয়ে নিলুম—’

‘বেশ তো, তার জন্যে এতকাল পরে কোর্টে ছুটতে হল কেন?’

‘কোর্টে ছুটতে হল কি, বুড়ীর এক ছেলে তখন জামসেদপুরে কাজ করত, সে তখন জানতেও পারেনি যে তার মা সম্পত্তিটা বেচে দিচ্ছে। এখন সে দাবী করছে—’

‘সম্পত্তিটা কার নামে ছিল?’

‘নামে বুড়ীরই ছিল, কিন্তু ছেলের কথা হচ্ছে যে আমি নাকি অশিক্ষিত মেয়েছেলে পেয়ে তার মাকে ঠকিয়ে নিয়েছি। তাছাড়া তারও নাকি একটা মতামত নেওয়া উচিত ছিল।’

‘কিনেছিলে কত টাকায়?’

‘দুখানা পাকাঘর বাগান সমেত সাড়ে পাঁচশ টাকায়। দামে অবশ্য সস্তা, কিন্তু প্রয়োজনে কে টাকা দেয় বলুন! মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না, আমি কোথায় বিপদের দিনে—’

‘তা কি হল শেষ পর্যন্ত?’

‘আইনত সময় পার হয়ে গেছে, তবু উকিলের পরামর্শ মত ছেলেটার হাতে একশটা টাকা গুঁজে দিয়ে কোর্টে গিয়ে একটা পাকা বন্দোবস্ত করে এলুম।’

‘একশ টাকায় রাজী হল?’

‘নেশাখোর মানুষ, হতেই হবে। তাছাড়া ফালতু পাওয়া তো! কাগজে কলমে অবশ্য হাজার টাকা লেখা হয়েছে—’

সতীশ দোকান সাজাতে শুরু করল। টুলটা সরিয়ে ইঁটের গ্যালারী সাজাতে সাজাতে বলল, ‘কেন, আমার এখানকার জায়গাটা—যেখানে আমি এখন থাকি, সেটাও তত পেয়ে গেছলুম খুব দাঁওয়ে! পৌনে দু-কাঠা জমির ওপর পাকা দেয়াল টালিছাওয়া চারখানা ঘর, ঘরের কোলে রোয়াক, কল-পায়খানা সবশুদ্ধ চার হাজার টাকায়। বাপ মরে গেল, সব বেচে দিয়ে বার বছরের ছেলেকে নিয়ে মা দেশে চলে গেল। কলকাতা আক্রা-গণ্ডার জায়গা-চালান দায়, তাই চলে গেল দেশ-পাড়াগাঁয়ে। সেই ছেলে এখন ডাক্তার হয়েছে, বেহালায় জমি কিনে বাড়ি করেছে। কই, সে তো আসছে না—হাজার হোক, শিক্ষা-দীক্ষার একটা গুণ আছে তো।’ একটু থেমে গলার সুর বদলে সতীশ বলল, ‘সেই জন্যেই তো ছেলেদের জন্যে এত ভাবি বাবু। আমার ছেলেবেলাটা যে কি কষ্টে কেটেছে, তা আমি জানি আর ভগবানই জানেন। ছেলেদের যাতে আর সেই কষ্ট ভোগ করতে না হয়, তারা যাতে দুটো খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারে, তার জন্যেই তো দিন-রাত এই মুখে রক্ত তুলে খাটা—’

পকেট-ডায়েরীর একটি খদ্দের এসে পড়ায় সতীশ পড়ল তাকে নিয়ে, আর আমি সেই ফাঁকে ‘পরে দেখা হবে’ বলে চলে এলাম। সতীশ শুধু একজন ছোট দোকানদার নয়, ছোটখাটো জমিদারও বটে। কলকাতায় বাড়ি, ডানকুনিতে ঘর সমেত বাগান, সোনারপুরেও একটা পুকুর আর কিছু ধানজমি তো এই সেদিন আমার দেখতাই কিনল। রুগ্ণ স্বামীর চিকিৎসার জন্যে জলের দরে বেচতে বাধ্য হল একটি বউ। নাঃ, সতীশকে খুবই করিৎকর্মা বলতে হবে।

অথচ সতীশকে দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। পরনে সেই নীল হাফশার্ট, মোটা ধুতি আর টায়ারের চপ্পল। সস্তায় হবে বলে বাজার করে বেলায় কিংবা রাত্রে, সব্জীগুলো শুকননা আর মাছগুলো পচা না হলেও তাজা নয়। ছেলেদুটো এখন কোথায় পড়ে জানি না, আগে তো পড়ত কর্পোরেশনের অবৈতনিক স্কুলে।

একদিন ছুটির এক দুপুরে সতীশ আমার বাড়ি গিয়ে হাজির। আমি লেখাপড়া লাইনের লোক বলে সে একজন ভাল মাস্টারের খোঁজ দিতে বলে আমাকে। টাকার জন্যে কোন চিন্তা নেই, যা লাগে খরচ করতে সে রাজী। দিন কয়েক পরে সেই মাস্টারের সন্ধান দিতে গিয়েই সতীশের দোকানের সামনে একটা গোল ভিড় আর কিছু লোকের হৈচৈ-চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। দেখি, এক বুড়ো ভদ্রলোকের সঙ্গে সমানে উত্তেজিত হয়ে কথা-কাটাকাটি করে চলেছে সতীশ। একটুক্ষণ শুনলাম এবং তাতে এইটুকুই বুঝলাম, ভদ্রলোক সকালে একখানা দু টাকার নোট দিয়েছিলেন কাগজ কেনার সময়ে। সতীশ নাকি তাকে খুচরোটাই ফেরত দিয়েছিল, টাকাটা দেয়নি। ভদ্রলোক অন্যমনস্ক ছিলেন বলে খেয়াল করেননি তখন সেটা। আর সতীশ বলছে, বুড়োর যদি খেয়াল না থাকে, তার জন্যে কি সে দায়ী? এই নিয়ে অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্ক। দেখেশুনে বুড়ো ভদ্রলোক মিথ্যে বলছেন বলে মনে হল না। এদিকে সতীশও আমার চেনা। যদ্দূর জানি, টাকা-পয়সার ব্যাপারে সে বোধ হয় নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করে না। তাছাড়া, ব্যবসায়িক নীতি তার বেশির ভাগ সময়েই সততার ধার ঘেঁষে যায় না। এর আগে একবার একটি ছেলে, খুবই বাচ্চা, একটি পত্রিকা সংস্থা থেকে জমা-দেওয়া পত্রিকার হিসেব চাইতে এসেছিল। বিভিন্ন দোকান থেকে ফেরত বইয়ের একটা গাড্ডি ছিল তার সঙ্গে। গাড্ডিটা সতীশের কাছে নামিয়ে রেখে সে গিয়েছিল জল খেতে। ফিরে এসে দেখে গাড্ডির দড়িটা আলগা। জিজ্ঞেস করতেই সতীশ যেন ঝঁজিয়ে উঠল। বলল, ‘তোর গাড্ডি আলগা কি আঁট, আমি তার কি জানি। এই নে আমার ফেরত বই, এ মাসে একখানাও বিক্রি হয়নি!’

সতীশ তার কাউন্টার থেকে ফেরত বইগুলো দিতেই ছেলেটি বলল, ‘এই বইগুলো তো আমারই গাড্ডিতে ছিল। দেখ না, এতে অবিনাশের দোকানের রবার স্ট্যাম্প মারা। আমি তো এখন অবিনাশের দোকান থেকেই আসছি।’

গাড্ডিটা খুলে বইগুলো গুণে দেখল ছেলেটি। পুরো দশখানাই কম। যেগুলো, ছেলেটি বলছে, তার গাড়ি থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে।

সন্ধ্যের সময় সতীশ নিজে থেকেই সেই প্রসঙ্গ টেনে আবার বলল, ‘লাইনে ঘেন্না ধরে গেল বাবু লাইনে ঘেন্না ধরে গেল! এমন ব্যবসা আবার মানুষে করে!’

আমি শুধু একবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘শেষ পর্যন্ত কী হল?’

‘কি হবে আবার, চলে গেল। বাচ্চা ছেলে হলে কি হবে, এরা অনেক রকম কায়দা জানে। আপনি না থাকলে আজ একটি চড়ে ওর মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিতাম।’

সেবারেও আমি প্রথম থেকে ছিলাম না, এবারও নয়। তবু বুড়ো ভদ্রলোককে দেখে সজ্জন মনে হল বলেই তাঁর হয়ে বললাম, ‘খেয়াল করেননি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে যে উনি মিথ্যে কথা বলছেন, এটা তুমি ভাবছ কেন?’

সতীশ আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, কি ভাবল, তারপর গজগজ করতে করতে মুখ ব্যাজার করে চটের তলা থেকে একটা টাকা বার করে বুড়ো ভদ্রলোকের হাতের দিকে এগিয়ে ধরে আমাকে বলল, ‘নিন, ভাল করে দেখে নিতে বলুন—’

ঘৃণা নয়, সতীশের প্রতি কেমন একটা অনুকম্পা জাগল সেদিন আমার। মাস্টারের সন্ধান দেওয়া তো দূরের কথা, সতীশের দোকান মাড়ান পর্যন্ত বন্ধ করে দিলাম তার পর থেকে।

‘বাবু!’

ডাক শুনে পেছন ফিরতেই দেখি সতীশ। কনস্টেবলের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে কখন যে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি, হঠাৎ ডাক শুনেই চমকে উঠলাম। পলকের জন্যে এধার ওধার একবার নজরটা বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও বলে উঠল, ‘আপনাকে অনেকদিন দেখিনি বাবু, বাইরে গেছলেন নাকি কোথাও?’

বললাম, ‘না। অন্য কাজে ব্যস্ত।’ বাইরের আলোয় সতীশকে আর একবার আপাদমস্তক দেখে নিলাম, ‘কিন্তু তোমার চেহারার এই হাল হয়েছে কেন, সতীশ? অসুখ-বিসুখ কিছু—’

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সতীশ বলল, ‘না, কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি বাবু, মনে বড় অশান্তি চলেছে। সংসারে থাকতে আর ভাল লাগে না—কিন্তু—’ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে সতীশ আবার সেই আগের কথাতেই ফিরে এল, ‘কিন্তু আপনি হঠাৎ এখানে কেন বাবু? বড়বাবুর সঙ্গে আপনার জানা-চেনা আছে বুঝি?’

সিগারেট ধরাতে ধরাতে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, ‘বললাম তো, আজই প্রথম আলাপ হল।’

সতীশের চোখে-মুখে কৌতুহল, ‘তবে?’

কি জানি কেন, এই ‘তবে’র রুক্ষ জবাবটা গলা দিয়ে বেরিয়েও কেমন যেন ঠোঁটে এসে আটকে গেল আমার। সতীশের আজকের শীর্ণ শুকনো মুখখানাই এর জন্যে অবশ্য দায়ী কিনা জানি না। তবে আমার মনের সমস্ত দৃঢ়তা যে চিড় খেল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। অনেককাল হল সতীশের দোকান ছেড়েছি, এর মধ্যে একটা দিনও তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, কথাবার্তা হয়নি। আজ এখানে এই যে দেখা—হয়তো এমনও হতে পারে যে এই শেষ। মনে হল, কি লাভ ওকে তাচ্ছিল্য করে, ওর মনে দুঃখ দিয়ে? তাই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে নিয়ে গতকালের সমস্ত ঘটনাটা ওকে খুলে বললাম।

শুনেই চমকে উঠল সতীশ। অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘সেকি! শহরের লোক হয়ে আপনার মত লেখাপড়া জানা মানুষও এই ভুল করল? অত রাত্রে ওইসব অঞ্চল দিয়ে কেউ যায় আসে? আপনি কি জানেন না, রেলব্রিজের তলাটা কি সাংঘাতিক জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল!’ একটু চুপ থেকে স্বগতোক্তির সুরে সতীশ বলল, ‘দেশে আর আইন বলতে কিছু নেই বাবু, আইন বলতে কিছু নেই। দলবাজির পাল্লায় পড়ে দেশটা একেবারে রসাতলে চলে গেছে। ছেলেছোকরার দল যা হয়ে উঠেছে—সব সময়েই যেন চড়া মেজাজ। আর কেবলই মুখের রা—দাও, দাও। একশ টাকা দামের জামা দাও, দেড়শ টাকা দামের প্যান্ট দাও বন্ধুবান্ধব নিয়ে হোটেল বাজি করব টাকা দাও—। তোমার থাক আর নাই থাক, তবু দাও- যেখান থেকে পার দাও।’ আবার সুর বদলে গেল সতীশের, ‘তা বাবু, যে ছোঁড়াগুলো আপনাকে ধরেছিল, তাদের সব বয়েস কিরকম?’

বড়জোর আঠার-উনিশ! অবশ্য অন্ধকারে গলার স্বর শুনে তো তাই মনে হল।’

একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল সতীশ। খানিক পরে বলল, ‘এই আবহাওয়ায় আমার ছেলে দুটোর যে কি গতি হবে, তাই ভাবি। আমাকে একজন ভাল মাস্টার দেখে দিতে পারেন বাবু?’

‘কেন, মাস্টার নেই কোন?’

‘আছে, কিন্তু রোজ কামাই, রোজ কামাই। আর জানেনই তো, এখন লেখাপড়ার কি হাল দাঁড়িয়েছে। একগাদা বই—স্কুলে পড়াশুনো হয় না, তারপর যদি বাড়িতেও কেউ ভালভাবে দেখার না থাকে, তাহলে আর ছেলেদের পড়াশুনো হয় কেমন করে? আপনি শিক্ষিত লোক, অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে, তাই আপনাকে বলছি। আপনি তো জানেন, আমি মুখ্যসুখ্যু মানুষ, দিনরাত কারবার নিয়েই পড়ে থাকতে হয় আমাকে—’

সতীশকে থেমে যেতে হল। যে কনস্টেবলটির সঙ্গে সে কথা বলছিল কিছুক্ষণ আগে, এই সময় ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সে সতীশকে ডেকে নিয়ে গেল।

সতীশকে আমি মনে মনে পছন্দ করি না—এটা ঠিক, কিন্তু ওর জন্যে আমার মনের কোথায় যেন এখনো একটু ক্ষীণ দুর্বলতা রয়েছে। এই কারণে যে টাকা রোজগারের ক্ষেত্রে সে যে-পথই অনুসরণ করুক না কেন, ছেলে মানুষের ক্ষেত্রে সে কিন্তু খুবই সজাগ। একসময় শিক্ষকতার লাইনে ছিলাম বলেই বোধ হয় আজও কোন অভিভাবককে তার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ভাবিত হতে দেখলে খুশিই হই মনে মনে।

সতীশের সঙ্গে গল্প করতে করতে ইতিমধ্যে ঘণ্টা দেড়েক সময় পার হয়ে গেছে। সিগারেট ধরাবার জন্যে পকেটে হাত গলাতেই খেয়াল হল, শেষ সিগারেটটা বার করে খালি প্যাকেটটা অনেক আগেই ফেলে দিয়েছি রাস্তায়। তাই সামনের দোকানটার দিকে এগোতে যাচ্ছি, হঠাৎ কানে এল একখানা চলমান জীপের গর্জন। তাকিয়ে দেখি ও-সি-র গাড়ি। অর্ধ-বৃত্তাকারে বাঁক নিয়ে গাড়িটা এসে থামল থানার দরজাটার ঠিক সামনেই। সজাগ হয়ে উঠল ফটকের বন্দুকধারী সেপাইটি।

জীপ থেকে নেমে এলেন ও-সি। কিন্তু সঙ্গের কনস্টেবল দুজনের সঙ্গে ওরা কারা? দুজন মাঝবয়সী, একজন বুড়ো আর জনা দুই অল্পবয়সী ছোকরা? ও-সি-র সামনে এক-এক করে নামান হল ওদের, তারপর কারো কলার ধরে, কারো বা পিঠে ধাক্কা দিয়ে, কাকেও বা রুলের গুঁতো মেরে একে একে ঢুকিয়ে দেওয়া হল থানার ভেতরে। শেষে ও-সি নিজেও ঢুকে গেলেন।

সিগারেট কেনা আর হল না। একটু তফাতে থেকে ও-সি-র পেছনে পেছনে আমিও গিয়ে ঢুকলাম ভেতরে। জুতোর আওয়াজ তুলে ঘর্মাক্ত ও-সি এগিয়ে গেলেন তাঁর ঘরের দিকে, আমিও এগোতে যাচ্ছি, বাইরের ঘরের কোণের টেবিলের সাব-ইন্সপেক্টরটি সবিনয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘আপনি আর একটু অপেক্ষা করুন স্যার, বড়বাবু আপনাকে নিজে থেকেই ডেকে পাঠাবেন।’

যাক, সময় যখন পাওয়া গেছে সিগারেটটা এই ফাঁকে কিনে নেওয়া যেতে পারে। যাদের নিয়ে অভিযান সেরে ফিরলেন এইমাত্র ও-সি, একে একে তাদের বিলিব্যবস্থা করতেও তো খানিক সময়ের দরকার। তাছাড়া, ক্লান্ত ঘর্মাক্ত ও-সি নিজেকে ধাতস্থ করতেও নিশ্চয় কিছু সময় নেবেন।

সাব-ইন্সপেক্টরকে জানিয়ে আবার বেরিয়ে এলাম বাইরে, কিন্তু সিগারেট কেনা আর হল না। তার আগেই হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যে আমি কেমন হকচকিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণের অনন্য স্থান-কাল-পাত্র পর্যন্ত যেন ভুলে যাবার যোগাড় হল আমার।

ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সতীশ যে কখন আবার আমার জন্যে গাছতলাটায় এসে দাঁড়িয়েছিল, খেয়াল করিনি। থানার কম্পাউন্ডের শেষ-বরাবর পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই হঠাৎ ঝড়ের মত ছুটে এল সে। আর এসেই আছড়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল আমার পা দুখানা। সেই সঙ্গে শুরু হল কান্না। ডুকরে ওঠা আকুল কান্না। আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাউ হাউ করে সে বলে উঠল, ‘আমাকে বাঁচান বাবু, আমাকে বাঁচান। আপনার ঘড়ি-টাকা-পয়সা যা গেছে, ‘আমি সব ক্ষতিপূরণ করে দোব। বদ সঙ্গে মিশে আমার ছেলেই এই কাজ করেছে। তাকে আপনি বাঁচিয়ে দিন বাবু। আপনিই বলে দিন, কি করলে ছেলেটা আমার শুধরে যাবে। আমি লেখাপড়া শিখিনি বাবু, ছেলেবেলায় ভীষণ বিপাকে পড়েছিলাম বলে শুধু টাকা রোজগারের দিকেই নজর দিয়েছিলাম-ধর্ম-অধর্মের কথা কোনদিন ভাবিনি। আমার ভুলে, আমার পাপেই আজ আমার ছেলের এই অবস্থা—’

রাস্তার মধ্যে এই নাটকীয় ঘটনা থেকে বাঁচবার জন্যে সতীশকে টেনে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথাই। সে যেন আরো জোরে আমার পা দুখানা চেপে ধরল। মনে হল, অনেক দিন ধরে অনেকবাষ্পই তার মনে জমা ছিল, আজ ছেড়ে দেওয়ার এই সুযোগটাকে যেন সে নষ্ট করতে চায় না। তাই বলেই চলল, “দুঃখের কথা আর কি বলব বাবু, আমার বড় ছেলেটাও একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। সই জাল করে আমার ব্যাঙ্কের সব টাকা সে তুলে নিয়েছে, মায়ের গয়নাগুলো পর্যন্ত চুরি করে বেচে দিয়েছে। এর ওপর আবার আজ ক’মাস হল পাড়ার একটি মেয়েকে ফুসলে নিয়ে পালিয়ে গেছে কোথায়। তার পেছনেও পুলিশ হুলিয়া নিয়ে ঘুরছে!’

আমি যেন কেমন থতিয়ে গেলাম হঠাৎ। সতীশের কথা এবং আচরণ—দুইই যেন দুই মেরু থেকে টেনে আনা। সিনেমার মন্টাজের মত আমার চোখের সামনে তার প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ছবিটা নিমেষের জন্যে একবার ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। কানে বেজে উঠল রসাতলে-যাওয়া আজকের যুবসমাজ সম্বন্ধে এই কিছুক্ষণ আগে দেওয়া তার বক্তৃতাটা। সতীশ কিসব বকছে উল্টোপাল্টা? ওর মাথার ঠিক আছে তো? নাকি নিজের ছেলেদের সম্বন্ধে এতদিন সরব হয়ে শুধু নিজের মনের আকাঙক্ষাই মিটোতে চেয়েছে?

সতীশ তখনও বলে চলেছে, ‘ছেলেদের এই কীর্তির কথা বুক ফাটলেও মুখ ফুটে কাকেও কোনদিন বলতে পারিনি। তাই আপনার মত মানুষের কাছেও আমি অনেক মিথ্যে বলেছি, অনেক অভিনয় করেছি। আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ বাবু, আমার দোষ নেবেন না। আমাকে ক্ষমা করুন—দয়া করে ক্ষমা করুন—’

বলার কথা সতীশের হয়তো আরো অনেক ছিল, কিন্তু তার আগেই ও-সি-র ঘর থেকে আমার ডাক পড়ল। সতীশের কাছ থেকে অতিকষ্টে নিজেকে ছিনিয়ে কনস্টেবলটির পিছু পিছু আমি এগিয়ে গেলাম ও-সি-র ঘরের দিকে। পেছন থেকে সতীশের কান্না-জড়ান চাপা গলা যেন তখনও আমার কানে ভেসে আসছে, ‘আমাকে বাঁচান—আমার নাবালক ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দিন বাবু—’

সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে ও-সি আমাকে বসতে বললেন। তারপর টেবিল থেকে মোটা রুলকাঠটা তুলে নিয়ে হঠাৎই দাঁড়িয়ে উঠলেন তিনি এবং চোখের পলক ফেলবার অবকাশ না দিয়েই বুটশুদ্ধ পায়ের একটা লাথি সজোরে কষিয়ে দিলেন সামনেই দাঁড়িয়েছিল যে ছেলেটি তার তলপেটে। পরক্ষণেই মোটা রুলকাঠটায় এমন একটা ঠক করে আওয়াজ উঠল যে মনে হল ছেলেটির ডান হাতের আঙুলগুলো বুঝি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

ছেলেটি একবার ককিয়ে উঠেই কুঁচকে গেল যন্ত্রণায়। বাঁ হাতটা তার তলপেটটা চেপে ধরেছে, আর ডান হাতখানা সজোরে হাতপাখা নাড়ার মত নাড়িয়ে চলেছে সমানে।

ও-সি কিন্তু থামলেন না। মারের পরই শুরু করলেন ভারী গলার বজ্ৰহুঙ্কার, ‘শালা শূয়ার-কি-বাচ্চা—ঘড়িটা কোথায় পাচার করেছিস বল?’

জবাব দেবে কি, কথা বলার ক্ষমতা পর্যন্ত তখন লোপ পেয়ে গেছে ছেলেটির। মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট গোঙানি ছাড়া আর কোন শব্দই বেরোচ্ছে না।

ও-সি-র মুখখানা ক্রদ্ধ নেকড়ের মত ছুঁচলো হয়ে উঠল, ‘গলা টিপলে দুধ বেরোয়, শালা এই বয়সেই জাত-হারামী হয়ে গেছ। পেট থেকে কথা না বের করতে পারলে, আজ তোর নাড়ীভুঁড়িগুলো পর্যন্ত টেনে বার করে আনব।’ পরক্ষণেই দরজার দিকে ফিরে হুঙ্কার ছাড়লেন তিনি, ‘দরোয়াজা। দরোয়াজা!’

দরোয়াজা এসে দাঁড়াতেই ও-সি বললেন, ‘লকআপকো বোলাও—’

লকআপ এলে ছেলেটিকে ঘর থেকে নিয়ে যেতে হুকুম দিলেন ও-সি এবং সঙ্গে সঙ্গে আদেশ, ‘নন্দুকো লেআও।’

নন্দু এল, কিছুক্ষণ পরে তাকে ফেরত পাঠিয়ে আনানো হল আরেকটি ছেলেকে। এদের দুজনের ক্ষেত্রেও সেই একই আচরণ, শালীনতা-বর্জিত একই সম্ভাষণ। মাথার ওপর পাখাটা ঘুরছে বনবন করে, তবু দরদর করে ঘামছিলেন ও-সি। খানিকটা গুমোট গরমের জন্যেও বটে, আবার উত্তেজনার জন্যে হওয়াটাও বিচিত্র কিছু নয়।

চোখের সামনে থেকে তৃতীয় ছেলেটিকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পর দরজা পর্যন্ত একবার পায়চারি করে নিলেন ও-সি, তারপর টেবিলের ওপর সশব্দে রুলারটা ফেলে দিয়ে বসে পড়লেন তাঁর চেয়ারে। এবার নিশ্চয় সনাক্তকরণের প্রশ্ন উঠবে। জানি না ওই তিনটি ছেলেই রেলব্রিজের তলার সেই তিন মক্কেল কিনা, তবে তৃতীয় ছেলেটি সম্বন্ধে কোন সন্দেহই নেই যে এই ছেলেই সেই ছেলে, ঝিরঝিরে বৃষ্টির অন্ধকারে রিক্সা থামিয়ে যার হাত আমার পকেট হাতড়েছিল। সতীশের ছেলেকে আমি কোনদিন দেখিনি, সুতরাং চিনিও না। তবে এই ছেলেটির মুখের আদল অনেকটা সতীশের মতই বটে। সেই রকম নাক-চোখ-কপাল, চুলের ভাঁজ। মুখের ভাবে নিরীহ সারল্য। বয়সে এই ছেলেটিই বোধ হয় সবচেয়ে ছোট।

কিন্তু এখন আমার করণীয় কি? যদি সত্যিই সতীশের ছেলেকে আমি সনাক্ত করি ছিনতাইকারীদের একজন বলে, তাহলে ঘড়ি-টাকাপয়সা যা গেছে, হয়তো ফেরত পেয়ে যাব এবং ছেলেটিও তার কৃত অপরাধের যোগ্য শাস্তিই পাবে। কিন্তু সতীশের কান্নায় ভুলে যদি ওকে ছেড়ে দিই, তাহলে তো আবার সেই অন্ধকার রেলব্রিজের তলাতেই গিয়ে দাঁড়াবে ও। এইভাবে প্রশ্রয় পেলে হয়তো একদিন আরও বড় কোন অপরাধীর সামিল হয়ে উঠবে। অঙ্কুরে বিনাশ না করলে সব বিষাক্ত চারাই তো একদিন মহীরূহের আকার নেয়।

কোনটা করব আমি? কোনটা? ধরিয়ে দেব সতীশের ছেলেকে? কিন্তু তাতেই কি খুব-একটা লাভ হবে কিছু? অসংখ্য দাগীর মধ্যে দিন কাটিয়ে, জেল থেকে যখন বেরিয়ে আসবে সে, তখন নিশ্চয়ই রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হয়ে উঠবে না; বরং উল্টোটা হবার সম্ভাবনাই বেশি। নির্দয় নিষ্ঠুর এক অত্যাচারী সমাজবিরোধী। কঠিন চোয়াল, গালের নিচ পর্যন্ত টানা জুলপি, গলায় সরু চেন, হাতে স্টিলের বালা। রেল কিংবা ব্যাঙ্ক-ডাকাতিতে ক্ষিপ্র, ছোরা-পিস্তল-বোমা চালানোয় দক্ষ এক কারিগর।

তৃতীয় ছেলেটি বেরিয়ে যাবার পর মুহূর্ত কয়েকের একটা বিরতি। তারপরই আমার দিকে তাকিয়ে যথারীতি ও-সি-র প্রশ্ন, ‘এদের কাউকে চিনতে পারলেন, স্যার?’

ও-সি-র কথা যেন শুনেও শুনতে পাইনি আমি। আমার মাথায় তখন অসংখ্য চিন্তা এলোমেলোভাবে কাটাকুটি খেলে যাচ্ছে। আমার চোখের সামনে পাশাপাশি জেগে উঠেছে দুই প্রজন্মের ছবি। একটি অন্ধ, অসৎ আর অশিক্ষিত পিতার, যে সারা জীবন উঞ্ছবৃত্তি করে একটুকরো জমি কি দুখানা ঘর, কি কিছু টাকা সঞ্চয় করেই ভাবে যে সংসারের প্রতি তার কর্তব্য শেষ। আরেকটি উদ্ধত, উচ্ছৃঙ্খল, উন্মত্ত সন্তানের, যার সামনে দিশাহীনতার বিস্তীর্ণ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। এই দুই প্রজন্ম তো আজ ঘরে ঘরেই।

আমার বিমূঢ়তা লক্ষ্য করে কিনা জানি না, ও-সি আবারো আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন, এদের কাউকে চিনতে পারলেন কিনা বলুন?’

কিন্তু কি বলব? বিবেকদংশনে ক্ষতবিক্ষত সতীশের সারা জীবনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ওই আকুল কান্না যেন আমার কণ্ঠ রোধ করে দিচ্ছে, আমার চেতনার মধ্যে কেবলই জেগে জেগে উঠছে একটি কিশোর বালকের নিরীহ সরল মুখ। সুস্থ পরিবেশ পেলে যার চোয়াল কোনদিনই কঠিন হবে না, জুলপি গালের নিচে নামবে না, স্টিলের বালা হাতে উঠবে না, লক্ষ্য অব্যর্থ হবে না ছোরা-পিস্তল-বোমায়।

আমার সমস্ত বিচার-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যাচ্ছে কি?

আমি ও-সি-র মুখের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মুখে কোন কথা যোগাল না আমার। হাজারো চিন্তার জটিল আবর্তের মধ্যেও আমার কানে গমগম করে ধ্বনিত হতে থাকল ও-সি-র কণ্ঠ, ‘বলুন…চিনতে পারলেন…বলুন…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *