দর্পচূর্ণ পালা

দর্পচূর্ণ পালা

আজ অষ্টম রজনীর পালা। শূর্পণখার দর্পচূর্ণ। এর আগে হয়ে গেছে রামের মায়ের পোয়াতি হওয়া, রাম-লক্ষ্মণের জন্ম, তাড়কা বধ, হরধনু ভঙ্গ, রামের বিয়ে, মন্থরার বজ্জাতি আর রাম-সীতার বনবাস। আজ অষ্টম রজনীতে শূর্পণখার দর্পচূর্ণ। বিশ্বামিত্র মুনি মাইক হাতে নিয়ে সেই থেকে নানারকম ‘বিশেষ ঘোষণা’ করে চলেছেন। তবে পালা নিলামের কথাই বেশি করে বলা হচ্ছে। ‘আজ অষ্টম রজনীতে অষ্টমঙ্গলার মালার এসপেশাল নিলাম হইবে। যে ভাগ্যবানের ঘরে এই মালা যায় তাঁর সর্বকাজ শুভ হয়, কুনজর কেটে যায়, বদহাওয়া ঘুরে যায়, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয় না, বউ-শাউড়ির মিল হয়। আইবুড়ির বিয়ে হয়, বেকার ছেলের চাকরি হয়…।’ মাইক বাজছে ব্যাটারিতে। এইসব বিশেষ ঘোষণার মাঝে মাঝে ক্যাসেটে গান বাজছে। দুটি মাত্র ক্যাসেটই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। গোষ্টগোপালের পল্লিগীতির রিমেক, আর বাবুল সুপ্রিয়। খালবাঁধের ওপর চারকোনায় চারটি বাঁশ পুঁতে নীল পলিথিন বেঁধে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। খালের ওপারে মেদিনীপুর জেলা। এপারে হুগলি। ওপারের গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে, এপারেরটা সি পি এম-এর। মাঝে বাঁশের সাঁকো।

মাঠ দাপানো হেমন্তের হাওয়ায় পলিথিন ক্রমাগত শব্দ করে যাচ্ছে। মাঠের ধান রোদ্দুরের রং খেয়ে হলুদবরণ। খালবাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে ধানখেত দেখছে কেউ কেউ। কতবার দেখেছে এই ধানখেত, তবু পুরনো হয় না। কমবয়েসিরা সব আগেভাগেই ভিড় করেছে পলিথিন তলায়। ওখানে সাজগোজ হচ্ছে। টিনের বাক্সর মধ্যে রয়েছে মাথার মুকুট, চুলের খোঁপা। সন্ন্যাসীর দাড়ি…। যে লোকটা তৃতীয় রজনীতে তাড়কা রাক্ষসী, ষষ্ঠ রজনীতে মন্থরা, সেই আজকে শূর্পণখা সাজছে। খুব মজার লোক। লোকটা একটু মোটাসোটা, ভুঁড়িওলা। রাম, লক্ষ্মণ, সীতাও মেকআপ নিচ্ছে কিন্তু শূর্পণখাকে ঘিরেই ভিড় বেশি। একটা বেশ বড়সড় ব্রেসিয়ারের ভেতরে প্রচুর ছেড়া মশারির টুকরো গুজে শূর্পণখা লক্ষ্মণকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। লক্ষ্মণ জানে ওকে এখন কী করতে হবে। মুখের বিড়িতে দুটো সুখটান দিয়ে শূর্পণখার ব্রেসিয়ারের হুক বেঁধে দিল। লাল স্কার্টপরা ইস্কুলের মেয়েগুলো লজ্জা পেয়ে সরে গেল। ছেলেগুলো হাসাহাসি করতে লাগল। তাতেই প্রশ্রয় পেয়ে লক্ষ্মণ শূর্পণখার সামনে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করে বলল, হয়নি, আরও ন্যাকড়া গোঁজ। এরপর নিজেই কিছুটা ন্যাকড়া ঠেসে দিল। পরমাণিকদের ঘরের ছেলেটা বাসস্টপের কাছে দৰ্মার বেড়া দিয়ে ডবল আয়না ফিট করে নতুন সেলুন দিয়েছে। ছেলেটা শূর্পণখাকে জিজ্ঞাসা করে—বলি তাড়কা রাক্ষসীর পালায় অত বড় বড় কী দিয়ে বানিয়ে ছিল গো? শূর্পণখা হাত নাড়িয়ে বলল, ভেতরে দুটো লাউয়ের বোঁটায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম যে, পরের দিন আবার ডালে দিয়ে খেয়ে ফেললাম। এবার হাসির রোল উঠল।

এইসবই তো মজা। এক মাস ধরে চলবে। গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি বসেছে বেশ কিছুদিন হল। তার চড়েনি এখনও, তবে দড়ি চড়েছে। দড়িতে ভোটের প্রতীক চিহ্ন ঝোলানো কাগজগুলিকে জলবাতাস এতদিনে নিয়ে নিয়েছে বলে দড়িগুলোই রয়ে গেছে শুধু। ভোটের চিহ্নমাখা দড়িতে দোয়েল দোল খায়। শুধু এইসব মজায় তো মানুষ মজে না আর, রামযাত্রার দিকে তাই বছরভর অপেক্ষা থেকেই যায়। বিদ্যুত না এলেও টিভি চলে কয়েকটা ঘরে। ব্যাটারিতে। দু’মাইল দূরের ফুড়সুনচণ্ডিতে ভিডিও হল আছে, ওখানেও ভিড় হয়। তবে এইসব রামযাত্রার মজাই আলাদা। এটা তো উৎসব। মানুষ পুরনোকে ছাড়ে না সহজে। এত যে পরিবর্তন, এত কিছু, তবু গ্রামে গেলে দেখা যায় কুম্ভকাররাই এখনও মাটির পাত্র বানায়। কর্মকাররাই হাটের কোণে হাপর ঠেলে; এ তো গেল গ্রামের কথা। কিন্তু ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, কমপিউটার, মাইক্রো-আভেন, মিক্সি গ্রাইন্ডার সমন্বিত উচ্চবিত্ত কিচেনেও আমরা এখনও ধরে রাখি প্রাচীন প্রস্তর যুগ। শিল নোড়াটাকেও রেখে দিই।

এই রামযাত্রার দলটা গত ৭/৮ বছর যাবৎ এখানে আসে আশ্বিন-কার্তিকে। এ বছর পার্টির নতুন মাতব্বরদের কেউ কেউ বলছিল রামযাত্রা বন্ধ করে দাও কারণ রামকে নিয়ে এখন খুব মৌলবাদ হচ্ছে। কিন্তু মৌলবি নিজামুদ্দিন, মানে কমরেড নিজামুদ্দিন রামযাত্রা বন্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন। মৌলবি সাহেব হচ্ছেন এই খিজিরপুর গ্রামের প্রধান।

খিজিরপুরে হিন্দু-মুসলমান প্রায় আধাআধি। এতদিন কোনও ঝুট-ঝামেলা হয়নি। কারবালা মাঠও আছে, শীতলার থানও আছে। ঝাড়ফুঁক, শেকড়বাকড়, দোয়াদরুদ, সবই একসঙ্গে চলে। তবে হালে একটু আধটু কেমন যেন হচ্ছে। গোঁসাইদের একটা রাধামাধব মন্দিরের পাশে একটা টিনের চালা করে হনুমান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মসজিদে দুটো মিনার উঠেছে, ব্যাটারি লাগানো মাইকে আজান দেওয়া হয়। মুসলমানদের মধ্যে কয়েক জনের পা-জামার ঝুলটা যেন হঠাৎ করে কমে গেছে মনে হয়। তবে এই রামযাত্রার আসরে অনেক মুসলমানই রামযাত্রা দেখতে আসেন। মাথায় টুপি পরা কয়েকজনও পিছনের দিকে বসেছেন। মুসলমান মহিলাদের মধ্যে আসরে এলে কয়েকজন এখনও বোরখা পরেই আসেন। সীতার দুঃখে বোরখার ভিতরে থাকা চোখের পানি ওরা কালো বোরখায় মুছে ফেলে। রামযাত্রাটির অধিকারীর নাম শশধর পাত্র। মেদিনীপুরের কালিয়াচকে ওর ঘর। ও বশিষ্ঠ মুনির রোল করেছে, সীতার বাবা জনক রাজাতে ও নেমেছিল, কিন্তু ওর ফাটাফাটি রোল হচ্ছে কুম্ভকর্ণ। রাম এ বছরে নতুন। আসল রাম গত বছর হলদিয়া টাউনে লেবারের কাজ করতে গিয়েছিল বর্ষায়, আর ফেরেনি। কারেন্ট খেয়ে মরেছিল। শশধরের কাছে একথা শুনে সবাই খুব দুঃখ পেয়েছিল।

রামযাত্রা শেষ হয়ে গেলেও রাম-লক্ষ্মণ থেকে যায়। শুকনো পাতায়, বাতিল মৌচাকে, জমাজলের শ্যাওলায় সীতার দুঃখ রয়ে যায়। শুকনো মাঠের হাওয়ায় একা কেউ সীতাহারা রাম হয়ে গিয়ে গান গায়—

যা রে লক্ষ্মণ দেশে যা রে

দেশে গিয়ে বলবি মা কে

হয়ে আমি সীতা হারা

রয়েছি যে পাগল পারা

খাওয়া নাওয়া ভুলে আমি

রয়েছি দারুণ শোকে

দেশে গিয়ে বলবি মা কে

যারে লক্ষ্মণ দেশে যা রে…।

এবছর যে ছেলেটি রাম করছে, ও এবছরই প্রথম রাম করছে। আগে নাকি ঢোল বাজাত। ও দেখতে বেশ ভাল। চোখা নাক, বড় বড় চোখ, লম্বা চেহারা। আগের রামের চেয়েও গলায় বেশি সুর। বনবাসে যাবার সময় কৌশল্যার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় রাম গান দিয়েছে—কেঁদো না কেঁদো না মাগো অঞ্চলেতে মুছ আঁখি, পদরেণু দাও গো মাতা সর্বদা এই মাথায় রাখি। সবার চোখেই জল এসেছে। এই গানটা এবারের নতুন।

প্রাইমারি ইস্কুলের ঘরে রামযাত্রার দলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বেলা এগারোটা পর্যন্ত স্কুল, তাই সকাল হলেই বেরিয়ে যেতে হয়। স্কুল ছুটি হলে ওরা ঘরে ঢোকে। স্কুলের বাইরে তেঁতুলতলায় চালডাল ফুটিয়ে নেয়। খাওয়া-দাওয়ার পরে স্কুলের বারান্দায় ওরা একটু গড়িয়েও নেয়। স্কুলের কাচ্চাবাচ্চারা অনেক সময় দুপুরবেলায় ঘুমন্ত নাটুয়াদের দেখতে আসে। ‘উই দ্যাখ উটা তাড়কা রাক্ষসী, মুখে মাছি বইসেছে। উটা দশরথ রাজা। লুঙ্গিটা ছিঁড়া। উটা নারদ মুনি।’

ছোলাবাদামওলা এসে গেছে। কাঠের পাটার উপরে ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ-লঙ্কা কুঁচোনো চলছে। রেল বিভাজন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, শেয়ারবাজার, ত্বকের যত্ন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খবর কাগজের টুকরোয় পেঁয়াজকুঁচি, লঙ্কা, লেবুর রস মিশিয়ে ছোলাবাদাম তৈরি করছে ওরা।

সূর্য ডুবল সেই বুগির বিলের হিজিবিজি গাছগাছালির পেছনে। কাকেরা ফিরছে, বকেরা ফিরছে। তিন ইটের উনুনে খড়কুটো জ্বালিয়ে চা করে দিল সীতা। ঢোলে চাঁটি পড়ল। মঞ্চের চারিপাশে রাখা হল চারটে ধামা। হ্যাজাকে পাম্প করতে উবু হয়ে বসল রাবণ রাজা। প্রথম রজনীতে ক্লাবের ছেলেরা ডিজেলের জেনারেটর এনেছিল। বড্ড শব্দ হয়, ডায়লগ শোনা যায় না। বাঁশের দুই খুঁটিতে দুটো ‘হ্যাচাক’ বাঁধা হল দড়ি দিয়ে। মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে ‘যাত্রা-যাত্রা-যাত্রা রামযাত্রা। আজকের পালা শূর্পণখার দর্পচূর্ণ। আপনাদের সকলকে সাদর আমন্ত্রণ। আমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ-আমন্ত্রণ। রামযাত্রা দেখতে এলে কিছু কিছু চাল, ডাল, আলু, পয়সা সঙ্গে আনিবেন। মঞ্চের সামনে রাখা ধামায় মাগন রেখে দিয়ে যে যার আসনে বসে পড়বেন। সঙ্গে যে যার আসন নিয়ে আসবেন।’

বাঁধের ওপর লম্বা রাস্তার দুইদিকে মানুষজন বসেছে। যে যার বাড়ি থেকে যেমন পেরেছে আসন, পিঁড়ি, চাটাই নিয়ে এসেছে। মঞ্চের সামনে গোটাকত মোড়াও রাখা আছে গণ্যমান্যদের জন্য। গ্রামের ছেলে ভূদেব ভাল আড়বাঁশি বাজায়। ও বাজনদারদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। বলেছে সীতাহরণের পর রামের বিলাপে ও বাঁশি ফাটাবে।

মূলযাত্রা শুরু হবার আগে একজন লোক পাটের দাড়ি-গোঁপ লাগিয়ে গেঞ্জির ভিতরে কাপড়-চোপড় ঢুকিয়ে ভুঁড়ি বানিয়ে নাচতে নাচতে ‘ফার্স দিতে’ শুরু করলেন। মিনিট পাঁচেক ফার্স চলার পর রাম এলেন। রাম এসেই ডায়লগ দিলেন—আঃ, কী মনোহর এই পঞ্চবটী বন। পাখির কুজন, মৃদুমন্দ সমীরণ, পরির ড্যান্স। এইমাত্র গোদাবরীর শীতল বারিতে অবগাহন করে এসেছি, আঃ, গা জুড়িয়ে গেল গো। এবার ভাত খাব। বউ গেঁড়ি-গুগলি দিয়ে লাউশাক রান্না করেছে। ঠেসে ভাত খাব। খুব খিদে পেইছে। যাই তাড়াতাড়ি ঘরকে যাই। সীতা, বলি ও সীতা…।

এমন সময় শূর্পণখা ঢোকে। মিউজিক ঝনঝন। শূর্পণখা রামের দিকে লোভীর দৃষ্টিতে তাকায়। বলে—আহা মরে যাই। কী রূপ গো। একেবারে যেন সত্যিকারের মরদ। যেমন চোখ, তেমন নাক, তেমন চওড়া কাঁধ। যেন শারুক খাঁ। ওগো, নাম কী তোমার?

আমার নাম রাম। তোমার নাম কী?

আমি কামরূপিনী রাক্ষসী শূর্পণখা। একটু আলিঙ্গন দাও।

ছি ছি একথা বলে না। আমি বিয়ে হওয়া লোক! অন্য মেয়েছেলে আমি স্পর্শ করি না।

বিয়ে হওয়া লোক? হাঃ হাঃ হাঃ। ওই যে কুটিরে থাকো, একটা রোগা মতো মেয়েছেলের সঙ্গে, সে কি তোমার পত্নী? তবে আর একজন ব্যাটাছেলেকে দেখি যে? তুমি মিথ্যে কথা বলছ রাম। তোমরা দুই বন্ধু মিলে একটা মেয়েছেলেকে ধরে এনে ফুর্তি করতে এসেছ, সে কি আমি বুঝি না ভেবেছ?

ছি ছি ছি নারী, এমন কথা বলে না। একথা শুনলেও পাপ হয়। আর একজন ব্যাটাছেল্যা হল আমার প্রাণাধিক ভাই লক্ষ্মণ। আমরা পিতৃসত্য পালনের জন্য বনবাসে এসেছি। সীতা আমার সহধর্মিণী সতী।

সতী? হাঃ হাঃ হাঃ ওই রোগা মেয়াঁছেলেটার মধ্যে কী আছে? গায়ে যদি একটু মাংস থাকত। ওকে আমি খেয়ে ফেলব। আমার একবেলার টিপিন হয়ে যাবে। তারপর তোমার সঙ্গে সুখে ঘর করব। এই দ্যাখ আমার কেমন রূপ, কেমন যৌবন…

শূর্পণখা ওর ন্যাকড়া ঠাসা বুক রামের সামনে নাচাতে থাকে আর গাইতে থাকে

এই মৌ মৌ মৌ।

মৌ বনে

কত মধু

জমে থাকে…

ঠিক এমন সময় হাজির হলেন গ্রামপ্রধান নিজামুদ্দিন সাহেব। সঙ্গে খালের ওপাড়ের কানাপুখুরি গ্রামের প্রধান পরেশ সানা। ওরা দু’জনে পরস্পর বিরোধী দলের হলেও আজ একসঙ্গে রামযাত্রা দেখতে এসেছেন। ওদের দেখে দু-চার জন দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্লাবের ছোঁড়ারা মোড়া খালি করে দিল। শূর্পণখা গান থামিয়ে দিল। ক্লাব সেক্রেটারি মন্টু মিশ্র বলল, একটু লেট করে ফেললেন আপনারা। এই মাত্র শুরু হয়েছিল। মাথায় শিং সাঁটা শশধর পাত্র যে খর রাক্ষস হবে, সে এসে বলল, আরে তাতে কী, তাতে কী, ওরা নয় আবার ফের থেকে শুরু করবে।

আবার ফের থেকে শুরু হল। অবশ্য, নতুন করে আর ফার্স দেওয়া হল না। রামের ডায়লগ শুরু হল ফের।

আঃ কী মনোহর এই পঞ্চবটী বন। মৃদুমন্দ সমীরণ, পাখির কূজন, সম্মুখে সজ্জন, ঋষিজন…বলেই পরেশ সাহা মৌলবির দিকে হাত দেখাল।

মৌলবি সাহেব দাড়িতে হাত বুলোত বুলোতে মিটি মিটি হাসতে লাগলেন।

যাত্রা চলতে থাকল। শূর্পণখার প্রেম নিবেদন, রামের প্রত্যাখান হল। রাম-লক্ষ্মণকে দেখিয়ে বলল, আমার ভাই এখনও বিয়ে করেনি, তুমি ওকে বললা। শূর্পণখা লক্ষ্মণকে নাচ দেখাল। মিনিট পাঁচেক খেমটা নাচার পর লক্ষ্মণকে প্রেম নিবেদন করল।

লক্ষ্মণ বলল, হে শূর্পণখা, শুন৷ আমি নিজেই হলাম গিয়ে চাকর। রামের চাকর। আমাকে বিয়ে করে চাকরানি হতে যাবে কেন তুমি? বরং এক কাজ করো। রামকেই ভাল করে পটাও। ভাল করে পটাতে পারলেই রাম গলে যাবে। সীতাকে ত্যাগ করে তোমাকেই বিবাহ করবে। শূর্পণখা কী করে বুঝবে যে দুই ভাই মিলে ওকে মুরগি করছে। শূর্পণখা তখন বলল, অত পটানোর মধ্যে আমি নেই। অতসব পারব না বাপু। সীতাকে খেয়ে ফেললেই তো ল্যাটা চুকে যায়। এই বলে সীতার দিকে তেড়ে গেল। আর লক্ষ্মণ তখন নানা পোজ করে খড়্গটা নাচাতে লাগল। শেষ কালে শূর্পণখার নাকে গিয়ে যেই না লাগল, নানারকম মিউজিক বেজে উঠল। শূর্পণখা লুকোনো আলতার শিশিটা নাকে ঢেলে দিল, দর্শকরা হাততালি দিয়ে উঠল।

যাত্রাটা এখানেই শেষ নয়। এর পরে আর একটু আছে। শূর্পণখা কাঁদতে কাঁদতে ওর এক ভাই খর-এর কাছে গিয়ে নাকিসুরে নালিশ করল। খর তাঁর সেনাপতি দূষণকে বলল, যাও রাম-লক্ষ্মণকে এক্ষুনি বধ করে এসো। দূষণ যুদ্ধ করতে গেল। রাম বলল, তবে রে সন্ত্রাসবাদী, নে, মর—এই বলে তির ছুড়ল, দূষণ মরে গেল।

সীতা তখন একটা মালা নিয়ে রামকে বলল—তোমার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে আমি এই মালাখানি তোমার গলায় পরাতে চাই। রাম সীতার হাত থেকে মালাটি নিয়ে বলল, শুন প্রিয়তমে, তোমার দেওয়া এই মালাখানি আমি গ্রহণ করলাম। তবে এটা আমি লক্ষ্মণের গলাতেই পরাতে চাই কারণ লক্ষ্মণই হল প্রকৃত বীর যে শূর্পণখার দর্পচুর্ণ করেছে। এসো লক্ষ্মণ, ভাই আমার, এই পুষ্পমাল্যখানি তোমার গলাতেই পরাতে চাই।

লক্ষ্মণ রামের পায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলে, রাম লক্ষ্মণের গলায় জবা, স্থলপদ্ম, করবী, নতুন ফোটা গাঁদার সমন্বয়ে তৈরি মালাটি পরিয়ে দিল। ঢোল, কাঁসি, বাঁশি, হারমোনিয়াম বেজে উঠল। তালিও পড়ল।

শশধর পাত্র বলল, আপনারাও এবার রাম, লক্ষ্মণ, সীতাকে মালা দিন। সঙ্গে ওদের মুড়ি, চিঁড়ে, ফল, ফুল, মিষ্টি যে যা পারেন দিন। ওরা বনবাস করতেছেন। অথচ বন কোথায়, সব সাফ হয়ে গেছেগা। ফলমূল নাই। আপনারা দিলেই রাম খেতে পাবে। আর মালা যদি দেন তবে ফুলের মালা না দিয়ে টাকার মালা দেন, আপেলের মালা দেন, কমলা লেবুর মালা দেন।

এই ব্যাপারটা এখানে নতুন নয়। একজন একটা কমা বিস্কুটের মালা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। কমা বিস্কুট হচ্ছে নকল বিস্কুট। ব্রিটানিয়া থিনের মতোই দেখতে কিন্তু নকল। আটার তৈরি। কমা লাকস, কমা সানলাইট, কমা পন্ডস এরকম অনেক কিছুই ‘কমা মাল’ বিক্রি হয় হাটে। যে দান করলেন তাঁর নাম নরেন খুঁটি। সীতা-রাম-লক্ষণ কোরাসে গান ধরল—নরেন খুঁটি দানি ভাল দান করেছে রামায়ণের এই আসরে মান রেখেছে। শূর্পণখা এই সময় প্লাস্টিকের লাল প্লেট হাতে আসরে নেমে গেল। একটা বউ একটা টাকা দিল। শূর্পণখা গেয়ে উঠল—বউদিমণি ছেল্যা কোলে একশো পয়সা দান করেছে।

এইসময় দু-একজন উঠে যাবার উদ্যোগ করতেই শূর্পণখা লতা মঙ্গেশকারের ‘না যেয়ো না রজনীর এখনো বাকি’ সুরে গান ধরল—

না, যেয়ো না, মালা যে রয়েছে বাকি

রাম নামে দিয়ো না ফাঁকি

এখনও যে পালা বাকি

না, যেয়ো না…

তবু দু-চারজন উঠে গেল। শূর্পণখা রঙ্গ করল—যে যা পারছে চাটা বগলে তুলে ঘর যাচ্ছে। যা আছে কপালে ছেঁড়া কাঁথা বগলে। এসো হে লক্ষ্মণ, বিপদ বিলক্ষণ, সব হয়ে যাচ্ছে ফাঁকা, শুরু কর মালা ডাকা।

কমরেড মৌলবি এবং সাদা পাঞ্জাবি পরা তৃণমূল একই সঙ্গে হাসতে থাকে, তাইতে তেনাদের আশেপাশের লোকেরাও হেসে ওঠে। শূর্পণখা বলে যে পালিয়ে যাবে তাকে ছারপোকা কামড়াবে।

রামচন্দ্র লক্ষ্মণের গলা থেকে মালাটা তুলে নিয়ে দু-হাতে ধরে দর্শকদের দেখায় বলে, মালা ডাক দিচ্ছি। দয়া করে আপনারা ডাকবেন।

শূর্পণখা বলে, হে মা জগধারী মা গো…।

রামচন্দ্র—জগধারী নয়, জগদ্ধাত্রী।

শূর্পণখা—ভুল হয়ে গেছে। হে মা জগধ্যারিণী মাগো, যারা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের ঘরে এমন ছারপোকা দিয়ো যেন সারারাত কুটুউস কুটুস, কুটুউ-উস্‌, কুটুস।

রামচন্দ্র—এই মালা ডেকে নিন। আজকের আসরে মান্যগণ্য ব্যক্তিরা আছে, আজ মনে হয় ভাল ডাক পাব। রাত্রে মণ্ডা খাব। আপনারা না খাওয়ালে রাম বেচারা খেতে পারে না।

একজন বলল, পাঁচ টাকা পাঁচ টাকা।

অন্য একজন সাত টাকা হাঁকল।

কানাপুখুরির সাদা পাঞ্জাবি পরা নেতা পরেশ সাহা হাত উঁচু করে ডেকে উঠল, দশ টাকা। তখন শূর্পণখা—

আরে নেতা দাদা কী দিল

হাটে যেন মুলোর কিলো

আরে, রামের মালার বহুত মূল্য

এর দাম হাঁকুন সোনার তুল্য।

দর্শকের একজন বলল—এত রাম রাম করোনি। রাম নিয়েই যত ঝামেলা হচ্ছে চাদ্দিকে। শূর্পণখা তখন কোমর নাচিয়ে বলল,

রামেই বাবরি, রামেই রাবড়ি

আবার হুইস্কির ভাই রাম

রামেই ঘোঁট, রামেই ভোট

রামেই অর্থ মোক্ষ কাম।

অর্থ মানে তো জানেন মহাশয়রা, রামের নামে যে যা পারছে টাকাপয়সা লুটছে, আমরা আর ক’পয়সা? মোক্ষ মানে হল গে গদি। রামের চাল চেলে কত নেতা গদি পাচ্ছে। আর কাম মানে সে কাম নয় গো, যা আপনারা ভাবছেন। কাম মানে হল কামনা-বাসনা। ইচ্ছা। রামায়ণে যখন রাম রাক্ষসদিগকে মারে, তখন আমাদের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। আমার তো মস্তানদের হাতে মার খাই, কিন্তুক চুপ মেরে থাকি। উদের উলটায়া মারতে পারি না। তাই যখন রাম রাক্ষস মারে, সুন্দরী মেয়াঁ বিয়া করে, বন্ধু পাতায়, ভাল কথা বলে, ভাল কাজ করে, তখন আমাদের কামনা মিটে। ওইটাই হল কাম।

ঠিক কিনা?—মৌলবি-কমরেডের দিকে চোখ রেখে শূর্পণখা জিজ্ঞাসা করে। শূর্পণখা এরপর আবার দু’হাতে মালাটা তুলে ধরে। হাত উঁচু করলে ওর ন্যাকড়া ঠাসা স্তন প্রকটতর হয়। ঠোঁটের উপরে আলতার রং লেগে আছে। বলে, হাঁকেন, হাঁকেন দেখি কে কত হাঁকতেছেন।

রামের মালা।

পরেশ সাহা বললেন, পঁচিশ টাকা দিচ্ছি। খুশি তো? বলে হাসলেন। মৌলবি নিজামুদ্দিন এক লাফে হাঁকলেন পঞ্চাশ টাকা। নেতা পঞ্চাশ বলায় দু-চার জন কচি কমরেড হাততালি দিয়ে উঠল।

পরেশ সাহা একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে উঠল সিক্সটি।

ইস্কুল মাস্টার তরুণ মাইতি তাত্ত্বিক নেতা। ওর পকেটে দু-তিনটে কলম, বগলে খবরের কাগজ আর পকেটে ফিল্টার উইলস থাকে। উনি এসে নিজামুদ্দিন সাহেবের কানের কাছে মুখ রেখে কী যেন বলে গেলেন। এরপর সভা কিছুক্ষণ চুপচাপ। মৌলবি সাহেব মাথা চুলকোচ্ছেন একা। শূর্পণখা বলল—কী হল গো? সব চুপ যে? আর উঠবেনি? আর একটু উঠুক? ন’গ্রামে অষ্টমঙ্গলার মালা একশো টাকা উঠেছিল।

রাম এসে বলল, তা হলে কি তৃণমূলই জিতে গেল?

কিছু ছেলেপিলে হই হই করে উঠল। বোঝা গেল ওরা তৃণমূল। পরেশবাবু মালাটা পেলে ওরা পরেশদা জিন্দাবাদ করবে।

নিজামুদ্দিন আবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, পঁচাত্তর। চারদিকে চাইলেন। বেশ একটা হই হই ভাব ফিরে এল ফের। লক্ষ্মণ বুঝল আসর জমেছে। হ্যাজাকটা নামিয়ে উবু হয়ে বসে দম দিতে লাগল।

পরেশ সাহা দু’হাত তুলে বললেন, একশো। নতুন দম পাওয়া হ্যাজাকের আলোয় ওর জামাটা তখন আরও সাদা।

নিজামুদ্দিন মৌলবি উশখুশ করছেন। তাত্ত্বিক তরুণের দিকে এক ঝলক তাকালেন। তাত্ত্বিক নেতার চোখের নিষেধ পড়ে নিলেন নিজামুদ্দিন।

শূর্পণখা আবার বলতে লাগল—আর কোনও ভাল মানুষের পো আছেন এখানে, অষ্টমঙ্গলার মালা যিনি একশোর বেশি দিয়ে ডেকে নেবেন?

দেড়শো দিচ্ছি, দেড়শো…। নিজামুদ্দিন দাড়িতে হাত বুলোত বুলোতে অতীব শান্ত স্বরে বললেন।

আমি তবে দুশো। পরেশ সাহা রীতিমতো উত্তেজিত। সভাময় হই হই রই রই।

নিজামুদ্দিন আবার দাড়িতে হাত দিতেই তাত্ত্বিক নেতা ছুটে এলেন। বললেন, বলছি না রাম নিয়ে অত বাড়াবাড়িতে যাবেন না…।

নিজামুদ্দিন কোনও কথা কইলেন না। কলরব শুনতে থাকলেন। পরেশদা জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনলেন। পাশে তাত্ত্বিক নেতা দাঁড়িয়ে আছেন। নিজামুদ্দিন দাড়িতে হাত রাখলেন। শুনলেন—

দুশো টাকা… এক

দুশো টাকা… দুই

আমিও খোদার বান্দা। আমি হারব না ইনসাল্লা। আড়াই শো…।

এইভাবে পাঁচশো টাকা দাম উঠে গেল। পরেশ সাহার তিনটে পাম্প সেট আছে ভাড়া খাটে। জমিজমা ছাড়াও একটা সারের দোকান আছে। তা সত্ত্বেও নিজামুদ্দিনের পাঁচশো ডাকের উপর উনি আর চড়ালেন না। পাঁচশোর পর চুপ করে গেলেন।

রামচন্দ্র গেয়ে উঠল—

নিজামুদ্দিন দানি ভাল পাঁচশো টাকায় মালা নিলেন

রামায়ণের এই আসরে নিজামুদ্দিন মান রাখিলেন

খিজিরপুর গ্রামের মান রাখিলেন

রামায়ণের মান রাখিলেন

নিজামুদ্দিন মুমিন ভাল রামের প্রতি ঈমান দিলেন…।

খুব কাঁসি, খঞ্জনী, ঢোলের শব্দ হতে লাগল। এত টাকা কখনও নীলামে ওঠেনি।

নিজামুদ্দিনের হাতে মালা, ডাক ঘিরে লোকজন। কেউ বলছে শাবাশ। কেউ বলছে মৌলবি সাহেবই আমাদের গাঁয়ের মান রাখলেন। একজন বলল, আপনিই আমাদের পার্টিকে জেতাবেন, নইলে ওই তৃণমূল পার্টি ফাট লিয়ে লিত।

নিজামুদ্দিন একটু গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন, ওসব কিছু নয়, শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যই মালাটা ডেকে নিতে হল। রামের মালা একজন মোসলমান নিয়ে একটা দৃষ্টান্ত তৈয়ার করল। এর আগেও রামায়ণ পালা হয়েছে, কিন্তু কোনও দিন কোনও মোসলমান মালা ডাকেনি। আজকে যখন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চক্রান্ত চলছে সেখানে আজ আমি একটা সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে খুব গর্বিত হয়েছি।

মৌলবি সাহেবের বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যেস আছে বোঝাই যায়।

এমন সময় রাম মৌলবি সাহেবের কাছে আসে। বলে, আপনি জনাব খুব হক কথা বলেছেন। কিন্তু বলি, আমার নাম জব্বার। জব্বার আলি।

জব্বার আলি? মোসলমান?

আজ্ঞে।

ঈমানদার?

আজ্ঞে।

নমাজ পড়ো?

পড়ি আজ্ঞে। তবে পালা থাকলে এশার নামাজটা আদায় হয় না। ওই যে পালা করি, তখন উটাই নামাজ মনে হয়। বেয়াদপি মাপ করবেন জনাব।

শারদীয় সংবাদ প্রতিদিন, ২০০৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *