দরিয়া-ই-নুর – ৮

অধ্যায় ৮

ডিসেম্বরের শেষের দিকে আশেকের মধ্যে এক ধরণের চাপা উত্তেজনা দেখা দিলো। ব্যাপারটা রোজির চোখ এড়ালো না। স্বামীর দিকে তাকালেই মনে হয় কিছু একটা লুকাচ্ছে তার কাছ

থেকে। সহজে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না আজকাল। চোখে চোখ পড়লে কেমন জানি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

“তর কী হইছেরে?” এক রাতে বলল রোজি, আশেক পাশেই শুয়ে আছে কিন্তু ঘুমাচ্ছে না। “আমার কাছ থিকা কিছু লুকাইতোছ না তো?”

ভড়কে গেল মির্জা আশেক। “আরে, আমি আবার কী লুকামু? কী কস্ এইসব?”

“সারা দিন কই যাস, কী করোস?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “এমনে এমনে কেউ সারা দিন টো টো করে? তুই তো মনে হয় কিছু একটা নিয়া খুব ব্যস্ত আছোস!”

“তর খালি আজাইরা সন্দেহ,” নরম কণ্ঠে বলল আশেক। “বুঝার চেষ্টা কর, ঘরে বেশিক্ষণ থাকলে দম বন্ধ হইয়া যায় আমার। তুই সারাদিন থাকোস পার্লারে…আমার একলা একলা এই বাড়িতে ভালা লাগে না।”

রোজিকে এ কথা আগেও বলেছে আশেক। “বুঝলাম, কিন্তু তুই যাস কই?”

“খালি ঘুইরা বেড়াই না…কাজ-কামেই ঘুরি।”

“কীসের কাজ?”

“আমি ঠিক করছি ফার্নিচারের একটা কারখানা দিমু।“

জেলে নিয়মিত যেত রোজি, সে জানে আশেক জেলখানায় কাঠমিস্ত্রির কাজ শিখেছিল। বেশ ভালো আসবাব বানাতে পারতো।

“কাজটা আমি ভালা পারি…ওইটা কাজে লাগাই, কী কস্?”

“হুম,” সায় দিলো মেয়েটা। “কিন্তু কারখানা দিতে তো অনেক ট্যাকা লাগবো।”

“বেশি লাগবো না। আমার কাছে কিছু আছে, ঐটা দিয়াই হইয়া যাইবো।”

“তর কাছে ট্যাকা আছে?” অবাক হলো রোজি।“

জেলে যে কাজ করছি ঐ ট্যাকা তো জমা আছিল…বাইর হওনের সময় দিয়া দিছে।”

“কতো?”

“এক লাখের একটু কম।”

“ঐটা দিয়া কারখানা দেওন যাইবো?”

“এহন ছোট্ট কইরা দিমু…পরে আস্তে আস্তে বাড়ামু।”

এবার আশেককে জড়িয়ে ধরলো রোজি। কথাগুলো শুনে সে আশ্বস্ত হয়েছে।

“জায়গা খুঁজতাছি, কিছু কারিগরও দরকার।”

স্বামীকে আরো শক্ত করে ধরলো। “চিন্তা করোস ক্যান…আমি তো আছিই।”

মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশেক। একটা ব্যাপার তাকে খুঁচিয়ে গেল ভেতরে ভেতরে-রোজিকে সে মিথ্যে বলেছে। “আমারে মাফ কইরা দিস্।”

আশেকের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালো রোজি। “এইটা কইলি ক্যান?”

“এই যে, তর লগে যা করছি…”

“বুঝলাম না?”

“পনেরোটা বচ্ছর নষ্ট করছি, তরে আর আর্জুমান্দরে কষ্ট দিছি।”

রোজি আস্তে করে একটা হাত তুলে দিলো আশেকের মুখের উপর। “তরে আমি বহুত আগেই মাফ কইরা দিছি, এইসব আর কইবি না।”

চুপ করে রইলো আশেক। মামলা কোর্টে ওঠার পর আদালতের কয়েদখানায় রোজি যখন প্রথম তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, সে কথা মনে পড়ে গেল তার। মেয়েটা বিশ্বাসই করতে পারেনি সে এমন কাজ করেছে। অনেক কান্নাকাটি করেছিল। আশেক বলেছিল তাকে, আর্জুমান্দের চিকিৎসার খরচ জোগাতেই কাজটা করেছে, কিন্তু কোনো খুন করেনি। মেয়েটার মাথা ছুঁয়ে বলেছিল শেষ কথাটা। রোজি বিশ্বাস করেছিল তার কথা।

“সব কিছু নতুন কইরা শুরু করবি…” আস্তে করে বলল রোজি। “আমারে আর কষ্ট দিবি না।”

মেয়েটার মাথা বুকে চেপে ধরলো মির্জা আশেক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *