অধ্যায় ৫
বিকেলে ধানমণ্ডির শঙ্কর বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, তার শেষ মাথায়, রাস্তার বামদিকে ছোট্ট একটা অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল মির্জা আশেক। তার মাথায় সানক্যাপ, চোখে সানগ্লাস।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যুবশাখার একটি অফিস, ভেতরে পাঁচ-ছয়জন মানুষ উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে ডেস্কের ওপাশে বসা নেতার দিকে। পরনে সাদা-নীলের ফ্লোরাল শার্ট আর ক্রিম রঙের প্যান্ট। মাথার চুল সামনের দিকে কমে এসেছে। সুন্দর করে ছাটা গোঁফ, ক্লিনশেভ গাল।
“গত বছর রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের কাজটা তুমি পাইছিলা না?” এক লোককে জিজ্ঞেস করলো সেই নেতা।
বিশাল ভুড়িওয়ালা একজন মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“তাইলে সিটি কর্পোরেশনের এই কাজটা ওয়াহেদ পাইবো। কালাম, তুমি টেন্ডার ড্রপ করবা না, ঠিক আছে?”
কোনো রকম জবাব পাবার আগেই নেতা অবাক হয়ে তাকালো দরজার দিকে, কয়েক মুহূর্ত পরই ভুরু দুটো কুঁচকে গেল তার।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আশেক সানগ্লাসটা খুলে ফেলল আস্তে করে, তারপর সানক্যাপটাও।
নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারলো না নেতা। আস্তে করে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। “তোমরা একটু বসো, আমি আসতাছি,” লোকজনকে বলে তড়িঘড়ি উঠে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
“কেমন আছো, পাভেল?”
“মির্জা!” বিস্ফারিত চোখে বলে উঠল। “কবে বাইর হইলা?”
“পরশু।”
“বাইশ বছর হইয়া গেছে?!” কণ্ঠে তার বিস্ময়।
“সাত বচ্ছরের সাজা মওকুফ করছে সরকার…সাধারণ ক্ষমা পাইছি।“
ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লাগলো পাভেলের। মির্জাকে নিয়ে পার্টি অফিসের পাশে একটা লাল টকটকে প্রাইভেটকারের
কাছে গেল সে। “আছো কেমন?”
“আছি…পনেরো বছর জেল খাটার পর মানুষ যেমন থাকে!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “তুমি তো খুব ভালা আছো। শুনলাম, অনেক বড় নেতা হয়া গেছো।”
মুচকি হাসি দিলো পুরনো বন্ধু। “এই আর কি…সবই তোমাগো দোয়া।” একটু থেমে আবার বলল, “তোমার মায়ে বাঁইচা আছে এখনও?”
“আছে তো…“
“আমি পরীবাগ ছাড়ছি অনেক আগে…যাই টাই না ওই দিকে।”
মলিন হাসি দিলো মির্জা আশেক।
“রোজির খবর কি? এহনও আছে তোমার লগে?”
“হ। পাগল একটা…পনেরোটা বচ্ছর নষ্ট করলো আমার লাইগা।”
অবাকই হলো পাভেল। আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ মেরে রইলো।
“একটা দরকারে আইছিলাম তোমার কাছে,” বলল আশেক। “কী দরকার, কও?”
“তুমি তো খুব ব্যস্ত, আমারে একটু সময় দিতে হইবো…ডিটেইল না কইলে বুঝবা না।“
“ঠিক আছে, তুমি তাইলে একটু ওয়েট করো, আমি ওগো বিদায় দিয়া আসতাছি।” রাস্তার পাশে একটা চায়ের টঙের দিকে তাকালো সে। “এইখানে এক কাপ চা দে,” তারপর আবার ফিরলো বন্ধুর দিকে। “তুমি চা খাও…” কথাটা বলেই পার্টি অফিসে ঢুকে পড়লো আবার।
একটু পর টঙের এক পিচ্চি এসে চা দিয়ে গেলে চায়ের কাপে চুমুক দিলো আশেক। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, সব কিছুর মতো এই এলাকাটাও বেশ বদলে গেছে। আগে যেখানে একতলা-দোতলা বাড়ি ছিল, সেখানে উঠেছে বড় বড় নতুন দালান।
অনেক সময়ই চলে গেছে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো চায়ে চুমুক দিলো। এত বছর জেল খাটার পর যে কাজটা এখন করতে চাচ্ছে, তার কি কোনো দরকার আছে? ভুল করছে না তো? না করলেই কি নয়?
মন থেকে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিলো। দীর্ঘ দিন ধরে পরিকল্পনাটা করেছে, এখন কাজে নামার সময় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগলে চলবে না।
পার্টি অফিস থেকে লোকগুলো চলে যাবার পরই বের হয়ে এলো পাভেল। “চলো, নিরিবিলি কোথাও গিয়া বসি।”
আশেককে নিয়ে লাল গাড়িটায় উঠে বসলো সে।
“ধানমণ্ডি আর আগের মতোই নাই। রেস্টুরেন্ট আর ইউনিভার্সিটি দিয়া ভইরা গেছে,” গাড়িটা নিজেই ড্রাইভ করছে পাভেল।
“হুম…একদম চেনা যায় না।”
“মানুষের হাতে নতুন টাকা আসলে খালি খায় আর ড্রেস কিনে। এই যে বিল্ডিংগুলা দেখতাছো…” রাস্তার দু-পাশে অসংখ্য মাল্টিস্টোরিড ভবনের দিকে ইঙ্গিত করলো। “…সবগুলাতে রেস্টুরেন্ট আছে। এই ব্যবসাটা কিন্তু ভালাই।”
দু-পাশের অসংখ্য রেস্টুরেন্টের সাইনগুলোর দিকে তাকালো আশেক। পাভেলের এসব কথাবার্তায় মনোযোগ নেই তার, মাথায় কেবল ঘুরছে অন্য একটা চিন্তা—কীভাবে বন্ধুকে রাজী করাবে।
রাস্তার পাশে এক মাল্টিস্টোরিড ভবনের পার্কিংলটে গাড়িটা রেখে লিফটে করে ‘স্কাই লার্ক’ নামের একটি রুফটপ রেস্টুরেন্টে
চলে এলো তারা। এখানকার লোকজন পাভেলকে দেখে সম্ভ্রমের সাথে সালাম দিলো। রেস্টুরেন্টের এককোণে, কাচের দরজা ঠেলে ছোট্ট একটা অফিসে ঢুকে পড়লো সে।
“এইটা কি তোমার…?” ডেস্কের সামনের একটা সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলো মির্জা আশেক।
“বেশিদিন হয় নাই দিছি…” ডেস্কের ওপাশে গিয়ে বসলো পাভেল। “এখন কও, কী খাইবা?”
“চা।”
হেসে ফেলল পুরনো বন্ধু। “এতদিন পর দেখা তোমার লগে, একটু ভালামন্দ খাও…দুই দোস্তে মিল্যা-ই খাই।”
“তাইলে তোমার যা ভালা লাগে অর্ডার দাও।“
ইন্টারকমটা তুলে পাস্তা, পিজ্জা আর কফি অর্ডার দিলো। “এখন কও, কী কইতে আইছো?”
“ভাবছিলাম জীবনটা বুঝি শ্যাষই হইয়া গেল, কিন্তু জেলে কিছুদিন থাকনের পর বুঝলাম, জীবন আসলে এত সহজে শ্যাষ হয় না।“
পাভেল কিছুই বলল না, চুপচাপ অপেক্ষা করলো আসল কথাটা শোনার জন্য।
“আমি আবার নতুন কইরা সব শুরু করবার চাই, দোস্ত।”
“ঠিকই কইছো, জীবনের এখনও অনেক বাকি। রোজি আছে, তোমার মা আছে, ওগোর জন্যেও তো কিছু করা দরকার।“
“কিন্তু আমার তো কিছুই নাই,” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।
বন্ধুর দিকে স্থিরচোখে তাকালো পাভেল। “দুদুর আর কোনো খোঁজ পাও নাই?”
“নাহ্। আমি তো আছিলাম জেলে…ওর খোঁজ কেমনে করুম?”
“সবগুলান ট্যাকা ওর কাছেই আছিল?”
“হুম।” বিমর্ষ হয়ে গেল মির্জা আশেকের মুখটা।
“ক্যামনে এত বড় বলদামি করলা, মাথায় আসে না। যে মানুষটারে ঠিকমতো চিনো না, কই থাকে, বাড়ি কই, কার পোলা, কিচ্ছু জানো না…এত্তগুলান ট্যাকা দিয়া বিশ্বাস করলা তারে!” মাথা দোলালো আক্ষেপে। “দুদু যখন কইলো ট্যাকাগুলান সব ওর কাছে রাখতে, তখনই আমার সন্দেহ হইছিল। আমি ওর ফান্দে পা দেই নাই। “
মির্জা আশেক স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কেবল।
“আমার তো মনে হয় হাত ভাঙ্গনের কাহিনিটাও ভুয়া…চালাকি কইরা স্পটে থাকে নাই।“
“বাদ দাও…এখন এইসব বইলা কী লাভ!”
“তা-ও ঠিক,” সায় দিলো পাভেল। “তাইলে কও, তুমি কী করতে চাও এখন?”
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে অবশেষে বলল, “আমারে একটু হেল্প করা লাগবো।”
“ট্যাকা লাগবো তোমার?…কতো?”
“আমি ধার চাইতে আসি নাই, দোস্ত।
“তাইলে?”
“একটা হীরা বেচতে চাই।”
ভুরু কুঁচকে গেল পাভেলের। “হীরা বেচবা?…আমার কাছে?!”
“তোমার কাছে না, অন্য একজনের কাছে বেচুম কিন্তু তোমার হেল্প লাগবো।”
খুবই বিস্মিত হলো পাভেল। “তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবার পারতাছি না। খুইলা কও তো?”
মির্জা আশেক আবারো গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “তুমি কি জানো, বহুত দামি একটা হীরা আছে এই দেশে?”
ঠোঁট ওল্টালো আশেকের বন্ধু।
“এই দেশে যতো হীরা আছে তার মইদ্যে এইটাই সবচোয়া বড়…ছাব্বিশ ক্যারেটের। হীরাটার নাম ‘দরিয়া-ই-নুর।’ এইটার দাম ষাইট-সত্তুর কোটি ট্যাকার কম হইবো না।”
ভুরু কপালে উঠে গেল পাভেলের। “কও কী!
আশেক তার পকেট থেকে একটা পেপার কাটিং বের করলো। বুঝতে পারছে, দরিয়া-ই-নুরের গল্পটা একটুও বিশ্বাস করছে না তার বন্ধু। “এইটা পড়ো…বুঝবা। “
পেপারকাটিংটা জনপ্রিয় একটি দৈনিকের, তাতে চোখ বোলালো পাভেল :
বাংলাদেশে যতো রত্ন-পাথর আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আর দামি হীরার নাম দরিয়া-ই-নুর। দেখতে অনেকটা বিখ্যাত হীরা কোহিনূরের মতো। এর ওজন ২৬ ক্যারেট। দীর্ঘদিন মারাঠা রাজাদের কাছে ছিল, পরে হায়দ্রাবাদের নওয়াব সেই আমলে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকায় কিনে নেন। কোহিনূরের মতো এটাও পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ লুট করে নিয়ে যায়। সম্ভবত সেখানেই এর নাম দেয়া হয় ‘দরিয়া-ই- নুর’-বাংলায় যর অর্থ আলোর সমুদ্র।
বহু হাত ঘুরে অবশেষে দরিয়া-ই-নুর পাঞ্জাবের শাসক রণজিৎ সিংহের কাছে চলে আসে। ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্জাব দখল করে নিলে কোহিনূর এবং দরিয়া-ই-নুরসহ মহারাজ দিলীপ সিংহের খাজাঞ্চিখানার সব মূল্যবান সম্পদ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে চলে যায়। এ সময় দরিয়া-ই- নুরের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬৩ হাজার টাকা। কোহিনুর রানী ভিক্টোরিয়াকে উপহার দেওয়া হলেও অন্যান্য মণিমুক্তাগুলো কোম্পানির কাছেই রয়ে যায়। ১৮৫০ সালে লন্ডনে এক প্রদর্শনীতে দরিয়া-ই-নুরের আশানুরূপ দাম না ওঠায় হীরাটি ভারতে ফেরত এনে নিলামে বিক্রি করা হয়, ঢাকার নওয়াব খাজা আলীমুল্লাহ ৭৫ হাজার টাকায় এটা কিনে নেন। নওয়াবরা হীরাটিকে একটি বাজুবন্দে বসিয়ে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। পরবর্তী কালে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ দরিয়া-ই-নুর সরকারের কাছে বন্ধক রেখে যখন ঋণ নিয়েছিলেন তখন এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা। খাজা সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর দরিয়া-ই-নুরকে ঢাকার নওয়াব এস্টেটের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর কলকাতা থেকে এনে ভারতীয় ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্কের ঢাকা শাখায় জমা রাখা হয়। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত আছে দরিয়া-ই-নুর। ১৯৮৫ সালে বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষায় হীরাটি অকৃত্রিম বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পেপার কাটিংটা পড়ার পর বিস্ময়ে মুখ তুলে তাকালো পাভেল। এরইমধ্যে তাদের খাবার চলে এসেছে।
“এইবার বিশ্বাস হইলো তো?”
“কিন্তু এইটা তুমি কেমনে বেচবা? জিনিসটা তো ব্যাঙ্কের ভল্টে আছে অনেক বচ্ছর ধইরা!”
মুচকি হাসি ফুটে উঠল মির্জা আশেকের মুখে। “খুব জলদি ব্যাঙ্কের ভল্ট থেইকা হীরাটা আমার হাতে আইসা পড়বো।“
কথাটা শুনে তাজ্জব হয়ে গেল পাভেল। “জেল খাইটা বাইর হইছো দুই দিনও হয় নাই, এখনই আবার ডাকাতি করার প্ল্যান করতাছো!” আলতো করে মাথা দোলালো সে। “তোমার মাথাটা গেছে! কী কইতাছো, হুঁশ আছে?”
পাভেল ধরেই নিয়েছে, পনেরো বছর আগে বিরাট বড় একটা দান মেরেও কপালের দোষে ধরা পড়ে যাওয়া আশেক এখন আরেকটা বড় দান মেরে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
“আমি কি কইছি ডাকাতি করুম?” আস্তে করে বলল মির্জা। “তাইলে?” আরো বেশি অবাক হলো পাভেল।
আশেক তার অভিনব পরিকল্পনাটির কথা জানালো : জেলখানায় তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল এক লোকের, তার ভাই সোনালি ব্যাঙ্কের সিনিয়র অফিসার। পুরো পরিকল্পনাটা ঐ ভদ্রলোকের। ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে দরিয়া-ই-নুর সরিয়ে সেখানে নকল একটি হীরা রেখে দেয়া হবে। যেহেতু হীরাটা কখনও বিক্রি করা হবে না, তাই আসল না নকল সেটাও জানা যাবে না কোনোদিন। দীর্ঘ এই সময়ে মাত্র একবারই হীরাটা যাচাই করে দেখা হয়েছিল, সেটাও ১৯৮৫ সালে। এতদিন পর এই ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে আবারো সেটা পরীক্ষা করা হবে জহুরি দিয়ে। এরপর ত্রিশ-চল্লিশ বছরে আর পরীক্ষা করা হবে কি না সন্দেহ। দরিয়া-ই-নুর সরিয়ে ফেলার দারুণ সুযোগ এখনই।
“দুই বচ্ছরের প্ল্যান,” মির্জা আশেক বলল। “অনেক ভাইবা দেখছি, কোনো রিস্ক নাই…জিনিসটা সরাইবো ঐ ব্যাঙ্কার।”
“বিক্রি করতে আমার হেল্প লাগবো ক্যান?” সন্দেহের সুর পাভেলের কণ্ঠে
“হীরা বিক্রি করা সহজ কাম না, দোস্ত। এইটার মার্কেট অনেক ছোটো, কিন্তু ব্যবসাটা হয় কোটি কোটি ট্যাকার। দরিয়া- ই-নুরের মতো বড় হীরা কিনার মতো কাস্টমার এই দেশে দুইজন আছে কি না সন্দেহ।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো পাভেল। ষাট-সত্তুর কোটি টাকা দিয়ে একটা হীরা কেনার লোক খুব বেশি থাকার কথাও নয়।
“পরিচিত সার্কেল ছাড়া কাস্টমার পাওয়া যায় না। আর বেচাবিক্রির কামটাও করা লাগে গোপনে। ইচ্ছা করলেও যে কেউ দরিয়া-ই-নুর বেচতে পারবো না।”
“তুমি তো ছাড়া-ই পাইলা দুইদিন আগে, এই হীরাটার কাস্টমার জোগাড় করবা কেমনে?”
“বায়ার জোগাড় হইয়া গেছে,” জানালো আশেক।
“জেলখানার একজন ব্যবস্থা করছে এইটা।”
অবাক হলো পাভেল। “জেলের ভিতর থেইকা…?!”
সায় দিলো মির্জা আশেক। “জেলখানা বড়ই আজব জায়গা, দোস্ত…কতো রকম মানুষ যে আছে জানো না। পকেটমার থেইকা শুরু কইরা ব্যাঙ্ক ডাকাইত…খুনি থেইকা রেইপিস্ট, নেতা, আমলা, পুলিশ, মিলিটারি…আজব একটা দুনিয়া। সেই দুনিয়ায় আমি আছিলাম পনেরোটা বচ্ছর।”
বন্ধুর দিকে চেয়ে রইলো পাভেল।
“মনু জায়গীরদার নামের একজনের লগে আমার খুব খাতির হইছে জেলে, সে হীরা-জহরত আর অ্যান্টিকের ব্যবসা করে। এক পাওয়ারফুল পলিটিশিয়ান তার কাছে একটা হীরা চাইছিল, মনু জায়গীরদার রাইগা গিয়া তারে মা-বাপ তুইলা গালাগালি করে। এরপর ঐ নেতা তারে অ্যান্টিক স্মাগলিং করার কেসে ফাঁসায়া জেলে ঢুকায়া দেয়। বায়ারের খোঁজ এই মনুভাই দিছে আমারে। জেলে থাকতেই ফোনে বায়ারের লগে কথা কইছি আমি।”
পাভেল জানে, টাকা দিলে জেলে সবই পাওয়া যায়। ফোনকল তো সামান্য বিষয়। “কতো দিয়া কিনবো ঐ বায়ার?”
“দশ কোটি।”
ভুরু কুঁচকে গেল পাভেলের। “তুমি না কইলা এইটার দাম ষাইট-সত্তুর কোটি…?”
“ওপেন অক্শন হইলে ষাইট-সত্তুর কোটিরও বেশি দাম উঠতো, কিন্তু ব্ল্যাকমার্কেটে আসল দামের অনেক কমে বেচতে হয়।”
“তাই বইলা এত কম?”
“দশ কোটি কইলাম কম না। “
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো পাভেল। দশ কোটি টাকা আসলেও কম নয়। “কিন্তু এইখানে আমি কী হেল্প করুম, বুঝবার পারতাছি না?”
মির্জা আশেক গভীর করে শ্বাস নিলো। “ডামন্ড বেচা-কেনার দুনিয়াটা অন্য রকম। কোটি কোটি ট্যাকার লেনদেন…বেঈমানি আর ধোঁকাবাজি হয় অনেক। কাস্টমার আর সেলার, দুজনেই সাবধানে থাকে।” একটু থেমে আবার বলল, “বায়ার যদি বুঝবার পারে আমি একলা, আমার আগে-পিছে কেউ নাই, তাইলে চোখ পাল্টাইতে কতোক্ষণ?…জিনিসটা লইয়া আমারে ট্যাকা না দিলে কী করার থাকবো, কও?”
“হুম, তা ঠিক,” সায় না দিয়ে পারলো না আশেকের বন্ধু। “এই জিনিস তুমি একা একা বেচবার পারবা না।”
“বায়ার জানবো তুমি আমার পার্টনার, রাজনীতি করো। তোমার লগে আরো কিছু মানুষজন থাকলে ভুলেও উল্টাপাল্টা কিছু করার চিন্তা মাথায় আনবো না।”
গাল চুলকে গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলো পাভেল।
“তুমি ছাড়া বিশ্বাস করার মতো কেউ নাই আমার। বয়স হইছে, নতুন কইরা কিছু শুরু করতে গেলে অনেক টাইম লাগবো। এই দানটা মারতে পারলে আমার আর কোনো চিন্তা
করা লাগবো না।” একটু থেমে আবার বলল, “তোমার আমার কোনো রিস্ক নাই…জিনিসটা সরাইবো ঐ ব্যাঙ্কার…তুমি খালি আমারে বেচনের টাইমে একটু হেল্প করবা, আর কিছু না।
সব শোনার পরও পাভেল পুরো ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে দেখলো। পনেরো বছর আগেই কোটিপতি বনে গেছে সে, রাজনীতি আর কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা করে এখন ভালো অবস্থায় আছে। কয়েক কোটি টাকার জন্য ঝুঁকি নেবে না সে।
“কপাল খারাপ, তাই ধরা পড়ছি, জেল খাটছি,” আবেগাক্রান্ত হয়ে বলল আশেক। “কিন্তু বার বার রিমান্ডে নিলেও
তোমাগো কারোর নাম কই নাই। সবতেরে সেভ করছি!…আমার লাইগা এইটুক করো, দোস্ত।”
পাভেলও জানে কথাটা সত্যি। মির্জা আশেককে দু-বার রিমান্ডে নিয়েও পুলিশ তার মুখ দিয়ে বাকি সঙ্গিদের নাম বের করতে পারেনি। কপাল দোষে ধরা পড়ে যায় আশেক। সচিবের বাড়ির দারোয়ান তাকে দেখেই চিনে ফেলেছিল।
সত্যি বলতে, লোকটা এর আগে তাকে কখনও সামনাসামনি দেখেনি। দেখেছে টিভির পর্দায়!
দেড়-দু’মাস আগে, রোজার ঈদের সময় কোনো এক চ্যানেলে অনেকগুলো বাংলা সিনেমার মধ্যে আশেকের করা সেই ফ্লপ সিনেমাটাও দেখানো হয়েছিল।
দারোয়ানের কাছ থেকে সচিবের শ্যালক, সেই পুলিশ অফিসার সব শুনে এফডিসিতে গিয়ে খোঁজ করে আশেকের। সেখান থেকেই জানতে পারে, সে কোথায় থাকে, তার আসল নাম কি। এমন কি তার একটা ছবিও জোগাড় করে ফেলে। এরপরই বাসরঘর থেকে আশেককে গ্রেফতার করে পুলিশ আর পাভেল আত্মগোপনে চলে যায়। সে ধরেই নিয়েছিল, মার খেয়ে তার বন্ধু সব বলে দেবে পুলিশকে। কিন্তু শত নির্যাতনের মুখেও কারোর নাম বলেনি মির্জা আশেক।
“আমার উকিল পরামর্শ দিছিলো, ফাঁসি থেইকা বাঁচতে হইলে তোমাগো নাম যেন বইলা দেই, তারপরও আমি কই নাই। পরে উকিল আমারে বুদ্ধি দেয়, আমি যে ভুয়া নাম-পরিচয়ের দুইজন মানুষের কথা কই বিচারকরে।”
মির্জা আশেকের দিকে স্থিরচোখে তাকালো পাভেল।
“সনু আর লাবু নামের দুইজনের কথা স্বীকার করি আদালতে। ওগো লগে আমার পরিচয় হইছিল কাঁটাবনে গাঞ্জা কিনতে গিয়া। আমরা একলগে গাঞ্জা খাইতাম…ওরাই আমারে সচিবের বাড়িতে ডাকাতি করার বুদ্ধিটা দিছিল।”
“পুলিশ ওগোরে খোঁজে নাই? ওরা যে ভুয়া এইটা তো জাইনা যাওনের কথা।“
মুচকি হেসে মাথা দোলালো মির্জা। “আমি কইছি, ওরা ট্যাকা নিয়া ভাগছে। মাত্র দুই মাসের চিন-পরিচয়…কই থাকে না থাকে কিচ্ছু জানি না।“
প্রশংসায় ভুরু কপালে উঠে গেল পাভেলের। “তোমার উকিল তো ভালাই বুদ্ধি দিছিল।”
কিন্তু সত্যিটা হলো, তারপরও ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাটা সহজ ছিল না। বাড়ির দারোয়ান ছিল প্রধান সাক্ষী, আশেকের উকিল সানাউল্লা তাকে কঠিন জেরা করে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছিল। এক পর্যায়ে তার কাছ থেকে জানতে চায়, ডাকাতেরা চলে যাবার পর কে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছিল-লোকটা মুখ ফসকে বলে ফেলে, সচিবের কাজের ছেলেটা! ব্যস, এই একটা বেফাঁস কথাই আদালতে হৈচৈ ফেলে দেয়, খুনটা নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ। এ ঘটনার পর লাপাত্তা হয়ে যায় ঐ দারোয়ান। আশেকের উকিল দাবি করে, আদালতে মিথ্যে সাক্ষী দিতে গিয়ে ধরা পড়ে লোকটা পালিয়ে গেছে। কিন্তু সচিবের উকিল অভিযোগ করে, আশেকের ঘনিষ্ঠ লোকজন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দারোয়ানকে দিয়ে এ কথা বলিয়েছে। তাদের পরামর্শেই লোকটা আত্মগোপনে চলে গেছে, যাতে করে কঠিন জেরার মুখে পড়ে আসল সত্যটা ফাঁস না করে দেয়।
দুই পক্ষের এমন বাদানুবাদের ফলে আদালত বিভ্রান্ত হয়। শেষপর্যন্ত সচিবের বাড়ির কাজের ছেলের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আশেকের জড়িত থাকাটা অকাট্যভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি, সেজন্যেই তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
আশেকের ধারণা, মুখ ফসকে সত্যিটা বলার পর ঐ ধুর্ত পুলিশ নিজেকে আর তার বোনজামাইকে বাঁচাতে বেচারি দারোয়ানকে গুম করে ফেলেছিল।
“তুমি যে আমাগো কারোর নাম কও নাই, এইটা আর কেউ মনে না রাখলেও আমি রাখছি,” আশেককে চুপ থাকতে দেখে আস্তে করে বলল পাভেল। “আমি দুদুর মতো বেঈমান না।”
আলতো করে মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মির্জা আশেক। “এখন কও, ডিলটা কেমনে হইবো?”
“পেমেন্টেটা করবো ক্যাশে। দশ কোটি ট্যাকা মুখের কথা না, দোস্ত…আগেই আমারে গোপন একটা জায়গায় নিয়া যাইবো বায়ারের লোক। আমি নিজে টাকাগুলান সব চেক কইরা লাগেজে ভইরা বায়ার আর তার লোকজরে নিয়া জায়গা মতোন চইলা আসুম।“
“হুম।”
“ট্যাকাগুলান দেওনের আগে বায়ার তার জহুরিরে পাঠাইবো হীরাটা পরীক্ষা করতে। আসল হইলে বায়ার ট্যাকাগুলান দিয়া দিবো আমাগো, আর আমরা তারে জিনিসটা দিয়া দিমু। কিন্তু হীরাটা নিয়া যাওনের সময় বায়ার আমারেও লগে কইরা নিয়া যাইবো।”
“তোমারে নিয়া যাইবো ক্যান?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো পাভেল।
আশ্বস্ত করার হাসি দিলো মির্জা। “এইটা ওগোর ইন্সুরেন্স। যতোক্ষণ না ওরা নিরাপদ কোনোখানে যাইবো, আমারে ছাড়বো না।“
পাভেল বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। “ডিলটা কোনখানে করবা?”
“গুলশান দুইয়ে নতুন একটা ফাইভস্টার হোটেল হইছে, ওইখানে লেনদেন করবার চায় বায়ার। কিন্তু এত্তগুলান ট্যাকা মুভ করা খুব রিস্কি।”
“রাস্তায় গাড়ি চেক করবার পারে পুলিশ।”
“হ,” কথাটা বলে আশেপাশে তাকালো আশেক। “তোমার এই রেস্টুরেন্টে ডিলটা করতে পারলে ভালা হইতো। টাকাগুলা মুভ করা নিয়া আর ভাবা লাগতো না। কিন্তু বায়ার রাজি হইবো কি না বুঝবার পারতাছি না।”
“তুমি কথা কও…দেখো রাজি হয় কি না। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“ঠিক আছে।” হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মির্জা আশেক।
“ধরো তোমার কথামতো হেল্প করলাম, তাইলে আমি কতো পামু?”
অঙ্কটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ছিল, তাই একটুও সময় নিলো না মির্জা। “দুই কোটি।“
ভুরু কুঁচকে গেল পাভেলের। “ভাগটা কেমনে হইবো…কে কতো পাইবো?”
“ঐ ব্যাঙ্কার আর তার ভাইরে দিতে হইবো পাঁচ কোটি, আমি তিন আর তুমি দুই।“
“সমান সমান ভাগ হইলে ভালা হইতো না?”
মাথা নাড়ালো আশেক। “হীরাটা ব্যাঙ্ক থেইকা সরাইবো ঐ ব্যাঙ্কার…তারে বেশিই দিতে হইবো।”
“সেইটা ঠিক আছে, কিন্তু জিনিসটা বেচা তো কঠিন কাজ…ঐটা করুম তুমি আর আমি। আমাগো ভাগটা আরেকটু বাড়ানো যায় না?”
মাথা চুলকালো আশেক। “দোস্ত, কিছু মনে কইরো না, তুমি তো ভালাই আছো, টাকা-পয়সা আল্লায় কম দেয় নাই…আমার কিন্তু কিচ্ছু নাই।”
কথাটা শুনে চুপ মেরে গেল পাভেল। সচিবের বাড়ি থেকে সে পেয়েছিল এক কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা, সেই টাকাই আজকে তাকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। নইলে পাড়া-মহল্লার ছিঁচকে মাস্তান থেকে খুব বেশি দূর কি যেতে পারতো?
ঐ টাকাটা পাবার পরই রাতারাতি সে কন্ট্রাক্টরি ব্যবসায় ঢুকে পড়ে, বছর ঘুরতেই গাড়ি-বাড়ি আর প্রতিপত্তি অর্জন করে ফেলে। টাকার জোরে রাজনীতিতেও ভালো অবস্থায় চলে যায়। তার সংগঠনের মহানগর শাখার একটি সম্পাদক পদ বলতে গেলে কিনেই নিয়েছিল সে।
অন্য দিকে আশেক কিছু পায়নি, উল্টো জেল খেটেছে পনেরোটা বছর।
আশেক মাত্র বলতে যাবে, তার ভাগ থেকে আরো পঞ্চাশ লাখ টাকা দেবে, এমন সময় পাভেল বলে উঠল, “ঠিক আছে।” মির্জা আশেকের আত্মবিশ্বাস ছিল, শেষপর্যন্ত পাভেল এ প্রস্তাবে রাজি হবে। “এই মাসের ২৭ তারিখে হীরাটা হাতে পামু…বায়ার ঐদিনই কিনবো।“
একটু গাল চুলকে নিলো পাভেল। “যেমনে কইতাছো, কাজটা তো খুব একটা রিস্কি মনে হইতাছে না?”
সরাসরি বন্ধুর চোখে চোখ রাখলো মির্জা আশেক। “কাজটায় যদি রিস্ক থাকতো, বিশ্বাস করো, আমি জীবনেও এইটা করতাম না। পনেরো বচ্ছর জেল খাটছি, মইরা গেলেও আবার জেলে যাওনের রিস্ক আমি নিমু না। “
মাথা নেড়ে সায় দিলো পাভেল। “চিন্তা কইরো না, আমি সব ব্যবস্থা করতাছি।”