অধ্যায় ৩
ফুলশয্যার পর দিন সকালে বেশ দেরি করে ঘুম থেকে উঠল আশেক। শূন্য বিছানা দেখে বুঝলো রোজি আরো আগেই উঠে পড়েছে। শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরের ব্যস্ততা কানে গেল তার।
বিছানা ছেড়ে উঠে বের হয়ে দেখলো বাইরের দুয়ারে আর্জুমান্দ চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন, তার পাশে একটা জল চৌকিতে বসে আছে চার্লি। গল্প করছে তারা।
এই ছেলেটার সঙ্গে আর্জুমান্দের অদ্ভুত সম্পর্ক। কখনও তারা নানী-নাতি তো, কখনও মা-ছেলে।
সেই কবে, আশেক তখন এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে, আর্জুমান্দ তাকে হাতিরপুলের বাজারে পাঠিয়েছিল রোজকার মতোন। এক টুকরি সদাই কিনে কুলি হিসেবে রোগা- পটকা দশ-বারো বছরের এক ছেলেকে নিয়ে আসে সে। বাজার থেকে আসার সময়ই কথা হয়, জানতে পারে, ছেলেটার মা-বাবা নেই, থাকে রাস্তার ফুটপাতে। জানেই না ঠিক কবে থেকে এ রাস্তায় আছে। তার জীবনের গল্পটা শুনে আশেকের মন হু হু করে ওঠে। চার্লির কষ্টটা তার চেয়ে আর কে বেশি বুঝবে! বাড়িতে এসে আর্জুমান্দকে জানায় সবটা। ছোট্ট ছেলেটাকে কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বোলান আর্জুমান্দ। তার চোখদুটো ছলছল করে উঠেছিল।
সেই যে চার্লি তাদের বাড়িতে ঢুকলো, আর যায়নি।
রান্নাঘরে উঁকি দিলো আশেক, সেখানে ব্যস্ত আছে রোজি। একটু আগে গোসল করে এসেছে, মাথার চুল এখনও ভেজা গামছা দিয়ে পেচানো। পরনের আটপৌরে শাড়িতে দারুণ লাগছে তাকে। খুব ইচ্ছে করলো মেয়েটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু নিজেকে বিরত রাখলো সে।
বাইরের দুয়ার থেকে আর্জুমান্দের কথা ভেসে আসছে। “নার্গিসকে চেনোস…সিনেমা করত যে…?”
“সঞ্জয় দত্তের মা?”
“হুম…ওর কথাই বলছি। নার্গিসের মায়ের নাম ছিল জদ্দান বাঈ…ঢাকায় আইতেন মুজরা করতে।”
“তুমি তারে দেখছো?!” বিস্মিত চার্লি। “বাপরে! তোমার বয়স তো তাইলে অনেক!”
“আসলেই অনেক। কতো কী যে দেখলাম এই জিন্দেগিতে!” কথাটা বলেই চেয়ারের হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি।
দূর থেকে চার্লিকে ঘরের ভেতরে আসার জন্য ইশারা করলো আশেক।
“কী হইছে, ভাইজান?” কাছে এসে জানতে চাইলো।
“রোজি কখন পার্লারে যায়?” চাপা কণ্ঠে জানতে চাইলো সে। “…ফিরা আসে কখন?”
“আপায় তো বিকালে যায়…আহে রাইতে।”
“তুই যাস কখন?”
“আমি দরকার পড়লে যাই…নানীর শরীর খারাপ থাকলে যাই না। আমি গেলে তারে দেখবো কে?” এরপরই ভুরু কুঁচকে গেল ছেলেটার। “এইটা জিগাইতাছেন ক্যান, ভাইজান?”
গলার স্বর আরো নিচে নামিয়ে ফেলল আশেক। “পাভেল কই থাকে, জানোস কিছু?”
“হেয় তো এহন বিরাট নেতা…ধানমণ্ডির শঙ্করে থাকে, এই মহল্লায় আর আহে না।“
একটু ভেবে নিলো আশেক। “আমি বিকালের দিকে বাইরে যামু…তুই রোজিরে এইটা কইস না, ঠিক আছে?”
“এই তো ফালাইলেন বিপদে,” অসহায়ের মতো বলে উঠল চার্লি। “রোজিআপার দিকে চায়া আমি মিছা কথা কইবার পারি না।”
“আরে গাধা, রোজি তরে কিছু জিগাইবোনি! তুই নিজ থেইকা কিছু কইস না।” কথাটা বলেই বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো আশেক।
তার দিকে দুবোর্ধ্য দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো চার্লি। একটা আশঙ্কাও জেঁকে বসেছে ভেতরে। পনেরো বছর জেল খেটে বের হয়েই পাভেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে!
ওর সঙ্গে কী কাজ?!