অধ্যায় ২
ঢাকা শহরে ঝিঁঝিঁপোকা ডাকে এমন বাড়ি কয়টা আছে?
কিন্তু মির্জা আশেক ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে পাচ্ছে, আর সেটা অনেক বছর পর।
তার ঘরের পেছন দিকে চার-পাঁচটা বড় বড় গাছ আছে, ওগুলোর বয়স কতো কেউ জানে না। আর্জুমান্দের চেয়ে বেশিই হবে নিশ্চয়।
এ রকম বাড়ি এই শহরে এখন আর আছে কি না সন্দেহ।
ছয়-সাত কাঠার একটি জমি, দু-দিকে সব উঁচু উঁচু দালান। উত্তর আর পশ্চিম দিকে চলে গেছে সরু একটা গলি। শত বছরের পুরনো দালানে আছে তিনটি পাকা ঘর। ছাদগুলো বহুকাল আগে ধ্বসে গেলে সে জায়গায় টিন বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘরগুলোর সামনে বেশ ফাঁকা একটি জায়গা, অনেকটা গ্রাম্য উঠোনের মতো। কাচামাটির দুয়ারটা শীতকালে রুক্ষ আর শক্তপোক্ত হয়ে যায়, বাকি সময় সবুজ ঘাসে ঢেকে থাকে। কিন্তু বর্ষায় খুব ভোগায়। বৃষ্টি হলেই পানি জমে, তাই সদর দরজা থেকে ঘরের বারান্দা পর্যন্ত ইট বিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
পরীবাগেও এমন একটা বাড়ি আর নেই। আশেপাশের সবগুলো ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারা এই বাড়িটার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। যেতে যেতে পথিকেরাও অবাক হয়ে দেখে, এক টুকরো গ্রামীন বসতি যেন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এখানে!
মির্জা আশেক কল্পনাও করতে পারেনি পনেরো বছর পর আবার একই রকম ফুলশয্যা পাবে। তার ছোট্ট ঘরটা ঠিক পনেরো বছর আগের মতোই ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ভালো করেই জানে, এবারেরটা চার্লির কৃতিত্ব নয়, রোজি চেয়েছে বলেই এটা হয়েছে।
“তুই একটা পাগলি,” রোজির মাথায় হাত রেখে বলল আশেক। পনেরো বছর আগের অসমাপ্ত ভালোবাসা পূর্ণ করেছে একটু আগে। মেয়েটা এখন পরম নিশ্চিন্তে তার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। “আমার লাইগা পনেরোটা বচ্ছর অপেক্ষা করলি!”
আশেকের মুখের উপর একটা হাত উঠে এলো। “চুপ! এইসব নিয়া কোনো কথা কইবি না। “
“আমার তো বাইর হওনের কথা আছিল আরো পরে,” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। “তুই এক্কেবারেই অন্য রকম একটা মাইয়া।”
“কী রকম?” আশেকের বুকে থুতনি রাখল রোজি। তার গাঢ় কাজল আর কপালের টিপ লেপ্টে গেছে।
“কী কমু…এক্কেবারে অন্য টাইপের মাইয়া তুই।”
“তুই-ও…” আস্তে করে বলল রোজি। “…এক্কেবারে অন্য টাইপের পোলা।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো আশেক।
“আমারে বাঁচাইতে যেন কে আসছিল? ক্যারিয়ারের বারোটা বাজায়া কে জানি আমারে উদ্ধার করছিল?”
দু-হাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো আশেক। তার বুকে মুখ ঘষলো রোজি।
জেল থেকে বের হবার পর মির্জা আশেকের গালে ছিল আধা কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ। জেলখানার নাপিত তার চুল কেটে দিলেও দাড়িটা সে ইচ্ছে করেই ফেলেনি। কিন্তু বাড়িতে আসার পর আর্জুমান্দের কড়া আদেশ, এই জঞ্জাল ফেলে দিতে হবে। রোজি অবশ্য বলেছিল, চুলে কলপও লাগাতে, তবে সেটা আর করেনি। বাথরুমে গিয়ে দাড়ি কামাই করে ফিরে এসে আশেক দেখে দুয়ারে এক বালতি দুধ রাখা। আর্জুমান্দের কথায় বাধ্য হয়েই সেই এক বালতি দুধ দিয়ে গোসল করে জেলজীবনের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে ফেলেছে!
“এই দিনটার জন্য আমি কত্তো অপেক্ষা করছি, জানোস?” আলতো করে তার বুকে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল সদ্য কুমারিত্ব ঘোচানো মেয়েটি।
রোজির মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো আশেক। নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে দিতো চাইলো আরেক বার।
এমন সময় চারপাশ কাঁপিয়ে পটকা আর আতশবাজি ফুটতে শুরু করল, প্রকম্পিত হলো রাতের নির্জনতা। পৃথিবী প্রবেশ করছে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে-এ দেশের স্বাধীনতার বিজয় দিবসে।
শত শত, হাজার হাজার আতসবাজি আর পটকায় ঢাকা পড়ে গেল দু-জন নরনারীর আনন্দধ্বণি।