দরমাহাটার রসিকলাল ঘোষের পরিবারবর্গ
ফরাসী সরকারের দেওয়ান কালীচরণ ঘোষ থেকে এই বংশের ইতিহাসের সূত্রপাত। কালীচরণের পুত্র রামদুলাল চন্দননগর ছেড়ে কলকাতায় বসবাসের জন্য চলে আসেন– সে সময় ইংরেজরা এখানে কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করেছেন। পর্তুগীজ বণিকদের কলকাতার এজেন্ট হয়ে তিনি ধনী হয়ে ওঠেন। ইউরোপীয় ও দেশীয় উচ্চতর সমাজের মহাসমারোহপূর্ণ কত রজনী যেখানে অতিবাহিত হয়েছে, এদেশীয় অভিজাত মহল যেখানে মহামান্য প্রিন্স অব ওয়েস্েেক সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন, সেই সুবিখ্যাত ‘বেলগাছিয়৷ ভিলা’ প্রথমে ছিল এই রামদুলাল ঘোষের ‘বাগানবাড়ি; তাঁর কাছ থেকে বাগানবাড়িটি কিনে দ্বারকানাথ ঠাকুর তার নানান উন্নতিসাধন করে নাম দেন ‘বেলগাছিয়া ভিলা’। এই সুন্দর ‘ভিলা’ এখন পাইকপাড়ার রাজাদের সম্পত্তি। রামদুলালের মৃত্যু হয় ১০৮ বছর বয়সে। তাঁর পুত্র রামধন ঘোষও কয়েকটি ইউরোপীয় বণিক প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট ছিলেন– এই রামধনই ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম নীলকুঠির প্রতিষ্ঠাতা– তাঁর নীলকুঠি ছিল বিহারে। নীলের ব্যবসায়ে এবং ভগ্নীপতির (বা শ্যালকের) জামিনদার হয়ে রামদুলাল সর্বস্বান্ত হয়ে যান, তাঁর সকল সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যায়। তাঁর তিন পুত্র : রসিকলাল, দ্বারকানাথ এবং ভুবনমোহন। এঁদের মধ্যে প্রথম দু’জন দক্ষতা, কর্মক্ষমতা এবং অনুসন্ধিৎসা দ্বারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন।
রসিকলালের জন্ম ১৮১৭-তে। তাঁর শিক্ষা শুরু হয় রাজা রামমোহন রায়ের বিদ্যালয়ে। মানবপ্রেমিক এবং এদেশীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে পরম উৎসাহী ডেভিড় হেয়ারের কাছ থেকে রসিকলাল তাঁর ইংরেজি জ্ঞানের জন্য প্রশংসাপত্র লাভ করেন। বীরভূমের সিংহ পরিবারে শিক্ষক হয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ভারতের অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানীর চাকরি পান তাঁর শিক্ষা, জ্ঞান ও কর্মদক্ষতার জন্য তিনি (স্যার) জে পি গ্র্যান্ট, হবহাউস, আর পি হ্যারিসন, ই পি হ্যাংরিসন ডবল মেপল্স এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। ধীরে ধীরে তিনি ঐ অফিসের চীফ্ অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং পরে গেজেটেড্ অফিসারের পদে উন্নীত হন। কর্মোপলক্ষে তিনি যে সকল ইউরোপীয়ের সংস্পর্শে আসেন তাঁদের সকলেরই শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হন। রসিকলাল ধর্মপ্রাণ নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন; তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মাতৃভক্তি; তাঁর মা ভারতের দূর দূরান্তরে অবস্থিত তীর্থক্ষেত্রে যাবার বাসনা করলে, তিনি সানন্দে সে ব্যয় বহন করেন। মহাধূমধামের সঙ্গে তিনি পূজাপার্বণের অনুষ্ঠান করতেন এবং ঐ সকল অনুষ্ঠান উপলক্ষে ব্রাহ্মণ, পন্ডিত, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আপ্যায়িত করতেন। দরিদ্রের প্রতিও তাঁর গভীর সহানুভূতি ছিল। আট পুত্র রেখে ৫২ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গোপাললাল কুচবিহারের মাননীয় মহারাজার মুদ্রণ বিভাগের অধীক্ষক।
দ্বারকানাথও শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। জ্যেষ্ঠের মতো তিনিও মিলিটারি অ্যাকাউন্টস অফিসে সম্মানিত পদে উন্নীত হতে পেরেছিলেন। ইনিও জ্যেষ্ঠের মতো মাতৃভক্ত ছিলেন। দুই ভাই-ই মায়ের মৃত্যুর পূর্বে পরলোকগমন করেন। মা, হরিমনি দাসী পুরীধাম যান চৌদ্দবার, হরিদ্বার তিনবার, বৃন্দাবন আটবার এবং অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রেও এইভাবে ভ্রমণ করেন। শেষ বয়সে তিনি বারাণসীতে থাকতেন। সেখানে ৮৫ বছর বয়সে ১৮৮০-তে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি কনিষ্ঠ পুত্র ভুবনমোহন, দুই কন্যা ও বহু নাতিনাতনী রেখে যান।
রামধনের তৃতীয় পুত্র ভুবনমোহনের তিন পুত্র। তাঁর মধ্যম পুত্র দেবনাথকে তাঁর মেজদাদা দ্বারকানাথ তাঁর জীবিতকালেই পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করেন।