1 of 8

দরজি

দরজি

দরজি অর্থাৎ যাঁরা জামাকাপড় বানান। এই সীবন-শিল্পীদের কোথাও কোথাও কেউ কেউ খলিফা বলে থাকেন। বহুক্ষেত্রেই দরজি যদি মুসলমান হন, বলা হয় খলিফা সাহেব। এই খলিফ আরব্য রজনীর হারুন রশীদ বা কোনও সম্রাট বা শাহ নন, এই খলিফা মানে ওস্তাদ।

ওস্তাদ অর্থাৎ দক্ষ কারিগর। দরজিদের ক্ষেত্রে এই কারিগরি দক্ষতার সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল লোক ঘোরানো। এত মোলায়েম হেসে গ্রাহককে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে যাওয়া আর কোনও পেশায় দেখা যায় না।

দিল্লি বেড়াতে যাবে বলে যে নবীনা কিশোরীটি লাল ফুলফুল শালোয়ার কামিজটি বানাতে দিয়েছে, দিল্লি থেকে বেড়িয়ে ফিরে এসেও সে যদি তা উদ্ধার করতে পারে তা হলে সে ধন্য। আমার এক বন্ধুর মামা এই অঘ্রান মাসে একটা সার্জের ফুলশার্ট দরজির দোকানে বানাতে দিয়ে পাঁচ মাস হাঁটাহাঁটি করে চৈত্রের শেষাশেষি শার্টটি হাতে পেলেন। প্রখর মধ্যাহ্নকাল, গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হয়ে গেছে, এদিকে দরজিমশায়ের কাচাকা ছোট ঘরে যথারীতি লোডশেডিং। সেই মাতুল ভদ্রলোক নতুন পাওয়া গরম জামাটি ট্রায়াল দিতে দোকানের দমবন্ধ দু’ফুট বাই আড়াইফুট ট্রায়ালরুমে ঢোকেন। বেরতে দেরি হচ্ছে দেখে কানের এক কর্মচারী দরজা ফাঁক করে দেখেন মাতুল মহোদয় ওই গরমে, বদ্ধ ক্ষুদ্র কক্ষে বিলিতি সার্জের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে চোখ উলটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। সেদিন আবার টালা ট্যাঙ্কের পাম্প চুরি আর পলতায় জলবিরতি। কোথাও এক বিন্দু জল নেই, শেষে পাশের পানের দোকান থেকে কুড়ি বোতল লেমনেড এনে মাথায় ঢেলে তারপর ভদ্রলোকের জ্ঞান ফেরে। সেই লেমনেডের দাম কে দেবে, দরজি না খদ্দের তা এখনও স্থির হয়নি, কিন্তু লেমনেডের জলের রঙে দুগ্ধশুভ্র সার্জের পাঞ্জাবিতে যে অপরিচিত মহাদেশের মানচিত্র আঁকা হয়েছে তা তুলে ফেলা সহজ হবে না।

কিন্তু এসব তো সামান্য কথা। নির্মলবাবু বলে এক ভদ্রলোককে চিনতাম। ভদ্রলোক অতিশয় সজ্জন, শিক্ষিত ব্যক্তি, তা ছাড়া সদালাপী। কিন্তু ভদ্রলোকের একটা দোষ ছিল, ভদ্রলোকের একটু হাতটান ছিল। অবশ্য লোকজনের জিনিসপত্র সরাতেন না, একটা ব্যাঙ্কে কাজ করতেন, সেখান থেকেই মাঝে-মধ্যে প্রয়োজন ও সুবিধেমতো অল্পবিস্তর টাকা-পয়সা সরাতেন। যেমন হয়, অবশেষে ধরা পড়ে যান। বিচারে তহবিল তছরুপের গুরুতর দায়ে তাঁর পাঁচ বছর জেল হয়। জেলে যাওয়ার সময় নির্মলবাবু পকেটের কাগজপত্র, টাকা-পয়সা সব জেলের অফিসে জমা দিয়ে ভেতরে ঢোকেন, সেটাই নিয়ম। পাঁচ বছর পরে জেল থেকে বেরনোর সময় যখন সব ফেরত পেলেন, দেখলেন পুরনো কাগজপত্রের মধ্যে একটা দরজির দোকানের রসিদ রয়েছে। নির্মলবাবুর মনে পড়ল, মামলায় খালাস পেয়ে যাবেন আর খালাস পেলেই চুটিয়ে ফুর্তি করবেন এই আশায় একটা গরদের পাঞ্জাবি বানাতে দিয়েছিলেন। সে সাধ তাঁর পূরণ হয়নি, কিন্তু পাঁচ বছর পরে রসিদটি নিয়ে তিনি সেই দরজির দোকানে এবার গেলেন। দরজির দোকানটি একই রকম আছে, খুব রমরমা বহু লোকজন জামাকাপড়ের মাপ দিচ্ছে। পাঁচ বছরের পুরনো রসিদটা নির্মলবাবু সন্তর্পণে কাউন্টারে দেখালেন। এতদিন হয়ে গেছে কিন্তু কেউ কিছু মাথাই ঘামাল না, রসিদটি হাতে হাতে ঘরের পিছনে কারিগরি সেকশনে চলে গেল, সেখান থেকে এক ভদ্রলোক রসিদটি হাতে কাউন্টারে এসে নির্মলবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গরদের কাপড় তো?’ নির্মলবাবু যখন বললেন, ‘হ্যাঁ’, ভদ্রলোক বিনীতভাবে মোলায়েম হেসে বললেন, ‘দাদা, কিছু মনে করবেন না, একটু দেরি হয়ে গেল, একবার কষ্ট করে সামনের সপ্তাহের শেষের দিকে আসুন।’

এ গল্প নিশ্চয়ই অতিরঞ্জিত, কিন্তু খুব অতিরঞ্জিত নয়। দরজিরা বহু সময়েই খুব অসবিধা সৃষ্টি করেন। কত বিয়ের পাঞ্জাবি, ইন্টারভিউয়ের শার্ট, ছোট ছেলের পুজোর পোশাক দরজির দোকান থেকে শেষ মুহূর্তেও উদ্ধার করা যায় না। লোকে জামাইবাবুর পাঞ্জাবি পরে বিয়ে করতে যায়, পুরনো কলার ফাটা শার্ট পরে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায়, ছোট মেয়ে ময়লা ফ্রক পরে পুজো মণ্ডপের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

অন্যদিকে দরজিদের জন্যে তাঁদের খদ্দেররাও কম অসুবিধার সৃষ্টি করেন না। আমি একবার দেখেছিলাম একজন শৌখিন লোক এক দরজির দোকানে রাগারাগি করছেন, ‘বাঁ হাতের সামনের দিকটা হবে লাল এবং পেছনের দিকটা নীল, ডান হাতের সামনে নীল পেছনে লাল, আর তুমি করে দিলে বাঁয়ে নীল-লাল আর ডাইনে লাল-নীল। রইল তোমার জামা, এ জামা আমি নেব না।’ বিব্রত দরজি হাতজোড় করে বলছেন, ‘জামাটা নিয়ে যান দাদা, এ জামা আপনি ছাড়া আর গায়ে দেবার লোক আমি জোগাড় করতে পারব না।’

আরেক ধরনের লোক রয়েছে, তাদের ধারণা দরজি বুঝি কাপড় বেশি নিচ্ছে। এ বিষয়ে বিখ্যাত গল্প আছে। এক গৃহস্থকে তাঁর ছেলে পাঞ্জাবির জন্যে সাদা কাপড় পাঠিয়েছে। তিনি টেলারিং শপে গেছেন। দরজি মাপ নিয়ে যখন কাপড়টা তুলছে, তখন তাঁর কী মনে হল, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাপড় একটু বেশি হবে?’ দরজি বললেন, ‘তা একটু হতে পারে।’ তখন গৃহস্থ বললেন, ‘ঠিক আছে, বেশি কাপড় দিয়ে দু’-একটা রুমাল বানিয়ে দেবেন।’ দরজি বললেন, ‘তথাস্তু।’

রাস্তায় নেমে ভদ্রলোকের মনে হল অতিরিক্ত দুটো রুমালে যখন দরজির আপত্তি হল না, হয়তো একটা পাজামাও হয়ে যাবে। ভদ্রলোক ফিরে গেলেন দরজির দোকানে, দরজিকে তাঁর আবদার জানালেন। দরজি বললেন, ‘সে সম্ভব নয়।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘দেখুন না চেষ্টা করে।’ দরজি দেখলেন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, চুপ করে রইলেন। দরজিকে মৌন দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘আর ওই রুমাল দুটোও কাপড় বেঁচে গেলে করে রাখবেন।’

কিছুক্ষণ পরে আবার ভদ্রলোক ফিরে এসেছেন, সামনে শীত আসছে, কাপড় যদি একটু বেশিই থাকে তবে কাঁটছাঁট যা বাঁচবে তা দিয়ে একটা টুপিও বানিয়ে নিলে মন্দ হয় না। দরজি ততক্ষণে বাকরহিত হয়ে গেছেন। ভদ্রলোক এর পরে আরও দু’বার ফিরলেন, শেষ পর্যন্ত তিন মিটার কাপড়ে মোটামুটি ফরমাশ দাঁড়াল একটা ঢোলা হাতা পাঞ্জাবি, একটা ঢোলা পাজামা, দুটো আন্ডারওয়ার, দুটো ফতুয়া, দুটো রুমাল এবং একটা টুপি।

নির্দিষ্ট দিনে সেই ভদ্রলোক দরজির দোকান থেকে সবই পেলেন; পাঞ্জাবি, পাজামা, ফতুয়া, টুপি, রুমাল, যা যা যত সংখ্যক চেয়েছিলেন। কিন্তু এ কী? সবই অতি ছোট ছোট, পুতুলের জামাকাপড়। কোনও শিশুও সেগুলো পরিধান করতে পারবে না। শুধু বাচ্চা মেয়েদের পুতুল খেলায় কাজে লাগাতে পারে। ভদ্রলোকের রাগারাগিতে রাস্তায় লোক জমে গেল, কিন্তু দরজিমশায় নির্বিকার, তিনি বলছেন, ‘তিন মিটার কাপড়ে এতগুলো জিনিস এর চেয়ে বড় করা যাবে না, কেউ পারবে না।’

এর বিপরীত গল্পটি আরও জটিল। দামি গরম কাপড় বিলেত থেকে এনে দরজির দোকানে এক ভদ্রলোক কোট বানাতে গেছেন। দরজি মেপে বললেন, ‘এতে হবে না।’ ফেরত নিয়ে পাশের দোকানে যেতে সেখানকার মালিক হাসিমুখেই অর্ডার গ্রহণ করল। ভদ্রলোক যেদিন কোট আনতে গেছেন, দেখেন সেই দরজির দোকানে একটি ছোট ছেলে তারই কোটের কাপড়ে তৈরি একটা কোট গায়ে দিয়ে খেলছে। ওদিকে তাকাতে দোকানদার একটু মোলায়েম হেসে বললেন, ‘আপনার কাপড়টা থেকে অনেকটা কাটিং বেরিয়েছিল, তাই দিয়ে বানিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক দেখলেন তাঁর কোনও ক্ষতি হয়নি, আর তাঁর নিজের কোটটাও ভাল ফিট করেছে। তিনি নিজের কোটটা নিয়ে, সেই প্রথম দোকানে যে কাপড় কম হবে বলেছিল তাকে গিয়ে ধরলেন, ‘আপনি কী রকম দরজি, আমার কোট হয়েও ওই দরজির ছেলের একটা কোট হয়ে গেল; আর আপনি বলেছিলেন যে কাপড় কম হবে!’

একটি গলাবন্ধ কোটের গলা কাটতে কাটতে দরজি মশায় জবাব দিলেন, ‘আরে, ওর ছেলের বয়েস সাত আর আমার ছেলের বয়েস উনিশ, আমার ছেলের কোট কি ওতে হত, কাপড় কম পড়ত না?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *