দরজা খুলে গিয়েছিল – পার্থ চট্টোপাধ্যায়
আমি করুণাশঙ্করকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সবই কি ম্যাজিক?
দিল্লির নামকরা জাদুকর করুণাশঙ্কর। আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ হওয়া ইস্তক যতবার দিল্লি যাই ততবারই তাঁকে ফোন করি : এসে গেছি, চলে আসুন এবার।
দিল্লিতে ডিফেন্স কলোনিতে আমাদের কোম্পানির গেস্ট হাউসে করুণাশঙ্কর আসেন। দারুণ গল্পবাজ ভদ্রলোক। সারা পৃথিবী চরকির মতো ঘুরছেন। বিচিত্র দেশের বিচিত্র মানুষ নিয়ে গল্প। তারপর দু—একটা ম্যাজিক দেখান। যেমন, এবার বললেন, আপনার পকেটে খুচরো পয়সা আছে? খুচরো পয়সা এখন মেলে না। চিত্তবাবু তাঁর ঝুলি থেকে বার করে দিলেন একটা আধুলি। কলকাতা থেকে দশ টাকা খুচরো করে এনেছেন। দিল্লির ট্যাক্সি—ওয়ালাদের তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন এগজ্যাক্ট ফেয়ার দিয়ে। তাঁর ঝুলিতে সিকি আধুলি ভরতি।
করুণাশঙ্কর বললেন, ‘আধুলিটা একবার আমার হাতে দিন। তারপর সেটি নিয়ে মন্ত্রপূত করে দিয়ে বললেন, এবার মুঠো করে ধরে থাকুন। হাতের মুঠোয় আধুলি ধরে আছি। ধীরে ধীরে দেখি সেটা গরম লাগছে। এত গরম যে হাতে রাখা যায় না। মনে হল এই বুঝি গরম উনুন থেকে নামানো হল। তাড়াতাড়ি আধুলিটা ফেলতে গিয়ে দেখি এক পুরু ভস্ম জমেছে হাতের তালুতে, আধুলির গায়ে। কোথা থেকে এল?
করুণাশঙ্কর বললেন, এটা ম্যাজিক। আমি বললাম, সবই কি ম্যাজিক? এই যে অনেক সময় অনেক সাধুসন্ত আঙুল ঘষে বিভূতি বার করেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি, একবার একজন—
করুণাশঙ্কর বললেন, ম্যাজিকের বাইরেও কিছু আছে। অনেক সময় অলৌকিক অতীন্দ্রিয় শক্তি কাজ করে। তবে এটা যখন তখন যার—তার দ্বারা হয় না। ঠিকমতো মিডিয়াম চাই। অবশ্য প্রেতই বলুন বা বুদ্ধির অতীত কোনো শক্তিই বলুন তিনি বহু অঘটন ঘটিয়ে থাকেন। বুদ্ধি দিয়ে আমরা তার ব্যাখ্যা করতে পারি না। অলৌকিক আছে, কিন্তু আমাদের ম্যাজিক কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এই যে এতক্ষণ আপনাকে যে খেলাটা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিলাম সেটা আর কিছু নয়, এক ধরনের কেমিক্যাল। ক্রমাগত ভস্ম উদগীরণ করে চলে। তবে অলৌকিক কিছু দেখতে চান যদি আপনাকে একটা জিনিস দিতে পারি, পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
—কী জিনিস দেখি।
করুণাশঙ্কর মানিব্যাগ থেকে একটি চোখ বার করলেন। একটি কাচের চোখ। চোখটি অনেকটা মানুষের চোখের মতো। কিন্তু মানুষের চোখ অত ত্রূ«র হয় না।
করুণাশঙ্কর বললেন, আমি যখন কিছুদিন আগে মালদ্বীপ গিয়েছিলাম তখন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। আমার ম্যাজিক দেখে খুশি হয়ে চোখটি আমায় উপহার দিয়ে বলেন, এটি এক ধরনের গোরুর চোখ। মালদ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রচলিত আছে—কালো গোরুর চোখ সংরক্ষিত করে মানি ব্যাগের মধ্যে রেখে দিলে যা প্রার্থনা করা যায় তাই ফলে যায়। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কোন ফল পেয়েছেন?
করুণাশঙ্কর বললেন, ওই যে বললাম, সবাই উপযুক্ত মিডিয়াম নয়। এই চোখটি এখনও পর্যন্ত উপযুক্ত মিডিয়ামের সন্ধানে আছে। এ পর্যন্ত তিনজন এই চোখ কাছে রেখে দিয়েছিলেন। তিনজনের কারও কোনো উপকার হয়নি। আপনি চতুর্থ ব্যক্তি। আপনি এটি নিয়ে রেখে দিতে পারেন।
আমি চিত্তবাবুকে বললাম, আপনি নেবেন?
চিত্তবাবু বললেন, আমি এসব বিশ্বাস করি না। আপনি ভূতের গল্প লেখেন আপনি ওটা রাখতে পারেন।
আমার জীবনে অলৌকিক অভিজ্ঞতার সংখ্যা অজস্র। ভৌতিক কাহিনির স্টকও প্রচুর। বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে আমার নিজের জীবনেই।
আমি বললাম, আমি রাখব। আমায় দিন।
করুণাশঙ্কর চোখটি আমার হাতে দিলেন। ওঃ কী বীভৎস চোখটা, মনে হচ্ছে গোরুটা যেন আমার দিকে চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে।
করুণাশঙ্কর বললেন, কলকাতায় ফিরে গিয়ে আপনি খুব ঝামেলায় পড়বেন। অর্থক্ষতি হবে।
আমি বললাম, আপনি কী করে বুঝলেন?
করুণাশঙ্কর বললেন, আমি জ্যোতিষ করি। আপনি জানেন, আপনার জন্ম—তারিখ আমি জানি, সেই দেখে হিসাব করলাম।
বললাম, আপনি আমার টেনসন বাড়িয়ে তুলছেন। আমি একে ডায়াবিটিসের রোগী।
করুণাশঙ্কর হেসে বললেন, মুশকিল আসানের জন্য আছে ওই চোখ। আপনার সমস্ত মুশকিল আসান করে দেবে ওই চোখ।
কলকাতায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সত্যি সত্যি এক বিরাট মুশকিলে পড়লাম।
বালিগঞ্জে আমি একটি নতুন ফ্ল্যাট কিনেছি। ফ্ল্যাটটিতে আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। তালাচাবি দেওয়া পড়ে আছে। মাঝে মাঝে যাই। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য এ পাড়াটা চট করে ছাড়তে পারি না। ওই ফ্ল্যাটের চাবিসুদ্ধ ব্যাগটি আমি আর খুঁজে পেলাম না। ডুপলিকেট চাবি বোকামি করে আলাদা করিনি। একসঙ্গে ব্যাগে ছিল। ব্যাগ আমার আলমারিতে ছিল। দিল্লি যাওয়ার আগে রেখে গিয়েছি। কোথায় যাবে এখান থেকে! ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। চাবি না পেলে ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারব না। অথচ ফ্ল্যাটে আমার কিছু কিছু দামি জিনিস রয়ে গেছে। যেমন দামি রিস্টওয়াচটা ফেলে এসেছি। একটি বিদেশি থ্রি ইন ওয়ান রয়েছে ওখানে। আরও আছে টুকিটাকি জিনিস।
কোথায় গেল চাবির ব্যাগ! স্ত্রী ছেলে মেয়ে সবাইকে জেরা করছি। কেউ বলতে পারছে না। তারা উলটে বলছে, তোমার ভুলো মন, তুমি কোথায় ফেলেছ দেখ।
তিনদিন বসে বসে ভাবলাম। দরজা ভাঙতে হলে চার—পাঁচশো টাকা খরচ। নতুন দরজা, ডামেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। পুরোনো লক ফেলে দিয়ে নতুন লক লাগাতে হবে। ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে ফতুর হয়েছি। এখন এত টাকা খরচ করার মতো মানসিক ইচ্ছা নেই।
কিন্তু তাই বলে এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাওয়া যায় না। একটা কিছু করা দরকার। চাঁদনি বাজারে যাব, নাকি আরও কিছুদিন অপেক্ষা করব?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল করুণাশঙ্করের উপহারের কথা—চোখ। মানিব্যাগ থেকে চোখটি বার করলাম। তারপর তাকে স্পর্শ করে মনে মনে বললাম, চাবিটা পাইয়ে দাও। ফ্ল্যাটে ঢুকতে হবে।
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল জীবনবাবুর টেলিফোন কলে। জীবনবাবু বলছেন, হ্যাঁ মশাই সকালে উঠে দেখি আপনার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, ভাবলাম আপনি আছেন। ভেতরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ।
আমি বললাম, কেন কেন?
—ভেতরে কিছু নেই। একেবারে ফাঁকা বাড়ি। আমি যতদূর জানি আপনার তো অনেক জিনিস ছিল—
পাগলের মতো বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখি, যে চাবির জন্য পনেরো দিন ধরে ফ্ল্যাটে যেতে পারিনি, সেই ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। তাড়াতাড়ি খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি, সব সাফ হয়ে গেছে। আমার এতদিনকার তিল তিল করে গড়ে তোলা সমস্ত সম্পদের একটিও নেই।
আমি ফ্ল্যাটের চাবি চেয়েছিলাম কিন্তু কী করে সেই অলৌকিক শক্তিকে বোঝাব এভাবে আমি এভাবে দরজা খুলতে চাইনি।
কিন্তু যেই খুলে থাকুক, যে ক্ষতিই হয়ে থাকুক দরজাটা যে খুলে গেল তা দেখেই আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
কিছুদিন পরে করুণাশঙ্করের একটিত চিঠি পেলাম দিল্লি থেকে।
প্রীতিভাজনেষু, ম্যাজিক দেখাতে আবার আমেরিকায় পাড়ি দিচ্ছি। আপনার কাছে আমার ক্ষমা চাইবার আছে। মালদ্বীপে কালো গোরুর চোখ বলে আপনাকে সেদিন যেটি দিয়েছিলাম, সেটি আসলে নাইলনের এক খেলনা হরিণের কাচের চোখ। আমার ছেলেকে ছোটোবেলায় কিনে দিয়েছিলাম হরিণটি। অনেকদিন পরে ভাঙাচোরা হরিণটি পড়ে থাকতে দেখে চোখটা কেটে নিয়ে আমার মানিব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম, এই মনে করে ম্যাজিকের কোনো কাজে লেগে যেতে পারে হয়তো। আপনাকে একটু ঘাবড়ে দেবার জন্য চোখটা দিয়েছিলাম আপনাকে। ওটা পত্রপাঠ ফেলে দিন। আপনার ঝামেলা—ঝঞ্ঝাটের যোগটা কিন্তু জ্যোতিষ মতে সত্যি।
চোখটা আমি তার অনেক আগেই ফেলে দিয়েছি। যেদিন ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গিয়েছিল সেইদিনই।