দরগাতলার জোড়া সাপ

দরগাতলার জোড়া সাপ

দরগাতলার ইটপাজা থেকে মাথা বের করে সাপ দুটো দেখে চমঙ্কার জ্যোৎস্না ফুটেছে।

 চারদিকের পৃথিবীতে অবিরাম ডাকছে কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় আর ঝিঁঝি পোকা। এ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। রাত কী নিঝুম হয়ে এল।

দরগাতলার সামনে কানি দুয়েক পোড়ো জমি। বাজা। ফসল ফলে না। সেই জমির মাঝামাঝি জায়গায় বিশাল এক বটবৃক্ষ। বৃক্ষটা কতকাল ধরে আছে এখানে, কে জানে। মাথায় ঝাঁপড়ানো ডালপালা। শরীর থেকে নেমেছে গোঁফদাড়ির মতো শেকড় বাকড়, ঝুরি। তীব্র জ্যোত্সা গায়ের জোরে আটকে রেখেছিল গাছটা। ফলে তলায় পড়ে সাপ দুটো সেই অন্ধকারের দিকে তাকাল।

বটবৃক্ষের অদূরে কোদালের মতো চিরল একখানা নদী, নদীর নাম করতোয়া। আগে নদীটা ছিল বেশ দূরে। দিনে দিনে পাড় ভেঙে এগিয়ে এসেছে। এখন পাড়ে তার বেশ কিছু ঝোপঝাড়। দিনমান নিঝুম হয়ে পড়ে থাকে জায়গাটা।

সাপ দুটো নদী তীরের দিকে একবারও তাকাল না। বটবৃক্ষের তলার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ইটপাজা থেকে প্রাচীন লম্বা শরীর টেনে বের করল। তারপর মাথা তুলে পোড়ো জমিটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখল। পোড়ো জমির সাদা মাটি জ্যোৎস্নায় চকচক করছে।

পোড়ো জমি ছাড়িয়েই ধানি মাঠ। দিগন্তব্যাপী। সেই মাঠে রাতের বেলা ধাড়ি সব মেঠো ইঁদুরের চলাচল। নাগালের মধ্যে দুটো ইঁদুর পেলেই দুজনের ভরপেট আহার হয়ে যাবে। চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চিন্ত। প্রাচীন লম্বা শরীর বিড়া পাকিয়ে দরগাতলার ইটপাজার আড়ালে পড়ে থাকা যাবে।

সাপ দুটো একত্রে জিভ বের করল। পর পর কয়েকবার। তারপর চলতে শুরু করল।

ধানি মাঠের দিকে যেতে হলে বটবৃক্ষের তলা হয়ে যেতে হয়।

জায়গাটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চোখ চলে না। মুখের সামনে আহার থাকলেও দেখা যায় না।

তবুও আলগোছে অন্ধকার বটবৃক্ষ তলাটা পেরিয়ে এল তারা। পেরুবার মুহূর্তে দুজন একসঙ্গে দেখতে পেল নদীর তীরের ঝোপঝাড়ের সামনে একটি মানুষ বসে আছে। দূর থেকে মুখটা দেখা যায় না তার। হাতের বিড়িটা টানে টানে জ্বলছে, দেখতে পায়। মানুষটা একাকী কেন বসে আছে এখানে! কী মতলব তার!

সাপ দুটো ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবে না। পেটে চব্বিশ ঘণ্টার খিদে। বিশাল লম্বা, তেল চকচকে কালো শরীর জ্যোৎস্নায় সম্পূর্ণ মেলে, জ্যোৎস্না কেটে কেটে ধানি মাঠের দিকে এগোয় তারা।

.

দরগাতলার অদূরে নদীতীরের ঝোপঝাড়ের সামনে সন্ধ্যার পর থেকে বসে আছে গজু। এখন রাত এক প্রহর। চরাচর নিঝুম হয়ে গেছে। কেবল ঝিঁঝি পোকার ডাক, কেবল নদী নিরন্তর বয়ে যাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আর কোনও শব্দ নেই কোথাও।

 নদী থেকে ওঠে আসছিল আবহমান হাওয়া। রাতের বেলা হাওয়াটা শীতল হয়। খালি গায়ে একটু একটু শীত টের পাচ্ছিল গজু। সেই শীতভাব কাটাবার জন্যে অবিরাম বিড়ি টেনে যাচ্ছিল সে।

 কিন্তু মেয়েমানুষটা এখন আসছে না কেন?

গজু তো নিজ কানে শুনল, রতনকে বলল, বাড়িডা নিটাল অইলেই বাইর অমু। তুমি দরগাতলার সামনে গাঙপাড়ে বইয়া থাইকো। গজু কি ভুল শুনেছে?

এত বড় ভুল তো সারা জীবনেও হয়নি গজুর। জীবন কাটল কালু ওস্তাদের সাগরেদি করে। চোখকান বড় সজাগ গজুর। চোখে দেখা জিনিস কখন ভুল হয় না তার, কানে শোনা জিনিস ভুল হয় না।

তাহলে?

পারু যে রতনারে কইল, তুমি থাইকো।

গজু কি ভুল শুনল।

কিন্তু ওস্তাদ যে কইত, তুই না থাকলে আমার দল ভাইঙ্গা যাইত গজু। হারা জীবন ডাকাতি করণ লাগত না। এতদিন জেলে পইচ্চা মরতাম। বরবাদ অইয়া যাইতাম। কথাটা সত্য। গজু টো না রাখলে, চোখকান সজাগ না রাখলে, কালু ওস্তাদের দল থাকত না। বহু আগে ভেঙে ছারখার হয়ে যেত। তাহলে আজ এতকালের সজাগ চোখকান কী করে গজুর সঙ্গে বেইমানি করে।

 নাভির কাছে, লুঙ্গির কোচর থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে গজু। ম্যাচ বের করে। নদীর হু হু হাওয়াটা আছেই। সেই হাওয়া বাঁচিয়ে কায়দা করে বিড়ি ধরায় তারপর বিড়ির প্যাকেট আর ম্যাচ জায়গামতো রাখতে গিয়ে আনমনে কোমরের সঙ্গে বাঁধা লাল গামছার আড়ালে যত্নে গুঁজে রাখা ভোজালিটা একবার ছুঁয়ে দেখে।

জিনিসটার উত্তাপই অন্যরকম। একবার ছুঁয়ে দিলেই শরীরে ফিরে আসে দশ মরদের বল। সাহস। ভোজালিটা কোমরে থাকলে পৌষ মাসের শীতেও খালি গায়ে নদীতীরে বসে থাকা যায়। শীত লাগে না। কিন্তু মেয়েমানুষটা?

নদীর দিকে তাকিয়ে পারুর কথা ভাবে গজু। ভাবে আর ফুক ফুঁক করে বিড়ি টানে। চারদিকের জ্যোৎস্না তখন এতটা তীব্র হয়েছে, নদীর জলে মুহূর্তের জন্যে উয়াস ছাড়তে ওঠা মাছও বুঝি দেখা যাবে। চাঁদখানা গোল হয়ে আছে মাথার ওপর। নদীর জলে জ্যোৎস্না পড়ে চকচক করছে। সেই জ্যোৎস্নার দিকে, জলের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।

গজু চোখ তুলে নদী তীরের ঝোপঝাড়গুলো দেখে। তারপর মোটা গর্দানটা ঘুরিয়ে দেখে বটবৃক্ষটা। তলায় গাঢ় হয়ে ছায়া জমে আছে গাছটার। ম্যালা দিনের পুরোনো গাছ। বয়স কত কে জানে! সারা গায়ে খোড়ল। অজস্র ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে চারদিকে। যেন বুড়ো মানুষের লম্বা দাড়িমোচ। বাতাসে পাতাগুলো ঝিরঝির করে নড়ছে। তার ওপর পড়েছে জ্যোৎস্না, দেখতে বেশ লাগে।

গজু খানিকক্ষণ গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার মুখ ফেরায় নদীর দিকে। নদীটিও! করতোয়া যার নাম। ভাঙে বছর বছর। আগে বটগাছটা ছিল নদীর পোয়া মাইল দূরে। ভাঙতে ভাঙতে কতদূর এগিয়েছে নদী। বটের গোড়া প্রায় ধরে ফেললো আর কী! এবার বর্ষায় কি এতকালের পুরোনো গাছটাও খাবে নদী?

 গজু মনে মনে বলল, রেহাই নাই। আর রেহাই নাই।

কিন্তু পারুর হইল কী। মাগিডা বাইর অয় না কেন অহনতরি?

ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে তাঁতীপাড়াটার দিকে তাকাল গজু। নদীর পাড় ঘেঁষে কয়েক ঘর তাঁতীর বাস। বছর দশেক হল দরগাতলায় এসে ঘর বেঁধেছে। দরগাতলার এখন যিনি পীর সাহেব তিনি খুবই দয়ালু ব্যক্তি। নদী তীরে নিজের বিরান জমি ছিল। বিশ-পঞ্চাশ কানির মতো। সেই জমির বেশির ভাগটা দিয়ে দিলেন তাঁতিদের। লোকগুলো থাক এখানে।

বড় দিলদরিয়া মানুষ পীর সাহেব। ফেরেশতার মতো উদার। হাত পেতে, বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে এসে কোনও মানুষ কখনও ফিরে যায়নি তার কাছ থেকে। তাঁতীরা এসে বলেছিল, হুজুর, আমরা গরিব হিন্দু। দয়া করেন। আমাগো জাগা দেন।

নদীতীরে নিজের জমি দিয়ে দিলেন হুজুর। দয়ালু মানুষ তো।

আর দয়ালু হবেন না কেন? কোন বংশের লোক দেখতে হবে না। তার ওপর নিজেও পীর। কামেলদার লোক। জগৎসংসারে এই একজন লোককেই মান্যগণ্য করে গজু। সমীহ করে। ভয় পায়। মানুষটার সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারে না। এই একটা জায়গায় বুকটা কাঁপে গজুর। হুজুরের চেহারা দেখলেই কাঁপে। চেহারায় কী একটা আছে হুজুরের।

নূরানি চেহারা কি একেই বলে?

আর গলার স্বর শুনলে তো কথাই নেই। মনটা শীতল হয়ে যায়। শরীরের ভেতরটা কাঁপে।

 ওস্তাদ একবার গজুকে বলেছিল, ল, যাই, একদিন দরগাতলার পীর সাবের বাইত যাই। নগদ টেকা-পয়সা পাওয়া যাইব। সোনাদানা পাওয়া যাইব। হুজুরের বড় মাইয়া আইছে ঢাকা থন।

শুনে আঁতকে ওঠেছিল গজু। জীবনে প্রথমবারের মতো দৃঢ়ভাবে কালু ওস্তাদকে বলল, ক্ষমা চাই ওস্তাদ। ইচ্ছা হইলে আমারে মাইরা হালান। তাও আমি ঐ বাইত যাইতে পারুম না। গলা দা রক্তা উইট্টা মরুম।

শুনে খ্যাক খ্যাক করে হেসেছে ওস্তাদ। হুজুররে তুই খুব মানচ গজু?

হ ওস্তাদ। হেয় দয়ালু পীর। ফেরেশতার লাহান। হের বাইত্তে ডাকাতি করলে নিবংশ অইয়া যামু।

তর তো পোলা একখানঐ।

হ। রতনা। পোলাডা মইরা গেলে আমি একদম পাগল অইয়া যামু।

কালু ওস্তাদ বলেছিল, পীর হুজুররে আমিও খুব মানি। জান গেলেও হের বাইতে আমি ডাকাতি করতে যামু না।

তয় আমারে কইলেন ক্যা?

দেকলাম, পীর হুজুররে তুই কেমন মানচ।

দেকলাম তুই ঠিকঐ আছচ। আর একখান কতা তরে জিগাই গজু, পোলাডারে তুই বহুত মহব্বত করচ?

 হ ওস্তাদ, হ। নিজের থিকাও বেশি।

সেই ছেলে রতনের পিরিতের মেয়েমানুষ হল পারু। যার জন্যে দরগাতলার নদীতীরে রাত এক প্রহরঅব্দি বসে আছে গজু। এই কথাটা যদি কালু ওস্তাদ শোনে? শুনলে হাসবে না! শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দেবে না গজুকে।

দিলে দিবে।

বিড়িতে শেষ টান দিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলল গজু। কী করুম, আমারডা মাইনষের শইল না। রতনার মায় মরছে ম্যালা দিন অইল। বয়েস অইল দুই কুড়ির উপরে। শইল্লে তাপখান অহনতরি কমে নাই। পারুরে দেইকা ম্যালাদিন ধইরা আমার শইল্লের ভিতরে উসপিস উসপিস করে। শইলডা কী ছেমড়ির! করতোয়ার বানের লাহান। হাইটা গেলে মনে অয় দশখান মাইয়ামাইনষের তেজ আছে ছেমড়ির শইল্লে। আমি পাগল অমুনা? কোন মাইনষে পারুরে দেইকা পাগল না অইয়া পারে। যে অইব না, হেই হালায় বেডাঐ না। রতনা তো এর লেইগাঐ গিয়া ভাজ খাইছে ছেমড়ির লগে। ছেমড়িডাও হালায় রতনারে দেইক্কা মইজা গেল। আরে আমি অইলাম রতনার জন্মদাতা বাপ। রতনার থেইকা আমার শইল্লে রস কম আছেনি! আমি তারে মজাইতে পারুম না।

ভেবে, ভেতরে ভেতরে রেগে গেল গজু। আমার পোলার লগে পিরিত কর আর যাই কর মাগি, তোমারে আইজ আমি ছাড়ুম না। তাঁতীপাড়ার দিকে তাঁত চলার শব্দটা থেমে গেছে অনেকক্ষণ। রাত অনেক হল। মানুষ এখন ঘুমুবে। এই সময়টার কথাটা রতনকে বলেছিল পারু।

 সেই অপেক্ষায় আছে গজু। রাত যাই হোক, না বেরিয়ে পারবে না পারু। পিরিতের মানুষকে কথা দিয়েছে।

 কিন্তু গজুর আর তো তর সয় না। শরীরের ভেতর একটা জন্তু ঢুকে বসে আছে দুপুরের পর থেকে। যখন তখন মাথাচাড়া দেয় জন্তুটা। জোর করে তাকে দমিয়ে রেখেছে গজু। কতক্ষণ, এইভাবে কতক্ষণ থাকতে পারে মানুষ।

গজু একসময় ওঠে দাঁড়াল। পারুদের বাড়ির দিকটা ঘুরে এলেই হয়। কী হালচাল দেখে এলেই হয়। বাড়িটা তো তাতীপাড়ায় ঢোকার মুখেই।

বসে থাকতে থাকতে কোমরে বাঁধা গামছাটা ঢিলে হয়ে গেছে। ওঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে ওঠল গামছায় গুঁজে রাখা ভোজালিটা। কষে গামছাটা বাঁধল গজু। ভোজালিটা যত্ন করে খুঁজে রাখল জায়গামতো। তারপর ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে আস্তেধীরে তাঁতীপাড়ার দিকে হাঁটতে লাগল।

দরগাতলাটা তাঁতীবাড়ি যাওয়ার মুখেই। নাড়ি ধোয়া পীরের মাজারটা আছে। লালসালু কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। আর আছে পুরোনো দরদালানের ধ্বংসাবশেষ। ইট পাঁজা। বড় কামেলদার লোক ছিলেন নাড়ি ধোয়া পীর। এইরকম জ্যোৎস্না রাতে করতোয়ায় নেমে পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে নদীর জলে ধুয়ে নিতেন তিনি। একজন তালবেলাম একরাতে হঠাৎ করে দেখে ফেলল ব্যাপারটা। দেখে ভয় পেয়ে গেল। তারপর পালাল। হুজুর অত বড় পীর, টের পেলেন সবই। পরদিনই তালবেলামকে ডেকে বললেন, যা দেখেছ কাউকে বোলে না। বললে গলা দিয়ে রক্ত ওঠে মরবে।

 তালবেলাম নালায়েক লোক। বয়সও কম ছিল। লোভ সামলাতে না পেরে একরাতে বউর পাশে শুয়ে বলল, আমি একখান জিনিস দেখছি। কেউরে কইলে গলা দিয়া রক্ত উইঠা মরুম।

.

বউটার কাঁচা বয়েস, ভাবল স্বামী তার কাছে মনের কথা কইতে চায় না। রঙ্গ করতাছে। জোর করে স্বামীকে ধরল সে। কী দেকছ, কওন লাগব আমারে। নইলে থাকুম না তোমার বাইত। এই রাত্রেই বাপের বাইত যামুগা।

তালবেলাম যত বোঝায়, কয়, হুজুর আমারে নিষুদ করছে। কইলে গলা দিয়ে রক্ত উইঠা মরুম।

বউটা কথা শোনে না। মান করে। আমারে তুমি ভাইল দিতাছ। এইভাবে সাতদিন গেল। বউর মান কমে না। তালবেলাম আর কী করে। সংসারে অশান্তি। একরাতে কথাটা সে বউকে বলে দিল। যেই না বলা, গলা দিয়ে রক্ত ওঠে মরল। পীর হুজুরের নিষেধ অমান্য করেছিল যে। মরণ ছাড়া আর কী হবে তার!

নাড়ি ধোয়া পীর হুজুর গত হয়েছে তিন পুরুষ আগে। মাজারটা আছে। বর্তমান পীর হুজুর নিজে তদারক করেন। তিনি ছাড়া মাজারে অন্য কেউ যায় না। গরম মাজার। একটু গরমিল হলে গলা দিয়ে রক্ত ওঠবে। নিশ্চিত মরণ। দুনিয়ার বেবাক ডাক্তার বাইটা খাওয়ালেও বাঁচাইতে পারব না কেউ।

আর নাড়ি ধোয়া পীর হুজুরের মাজারে আছে দুখান সাপ। কী সাপ কে জানে। তেল চকচকে কালো লম্বা শরীর। যখন তখন মাজারের আশেপাশে দেখা যায় তাদের। ইট পাজার আড়ালে দেখা যায়। কারো অনিষ্ট করে না।

লোকে বলে, সাপ দুখানা নাড়ি ধোয়া পীর হুজুরের প্রিয় দুই তালবেলাম। দেহান্তরিত হয়ে সাপ হয়েছে। কারো অনিষ্ট করে না সত্য, কিন্তু চোখের সামনে, পীর হুজুরের মাজারের আশেপাশে কোন পাপ কর্ম দেখলে সহ্য করবে না। বাড়ি গিয়ে হলেও দংশাবে।

সাপ দুটোর কথা মনে হতেই গজু একটু কেঁপে ওঠল। জ্যোৎস্নারাতে আহারে বেরোন তেনারা। বাগে পেলে পাপী মানুষের জান কবচ করবেন। পীর হুজুরের প্রিয় শিষ্য। হুজুর নিজেই দেহান্তরিত করিয়ে মাজার পাহারায় রেখে গেছেন তাদের।

কথাটা মনে করে, নাড়ি ধোয়া পীরহুজুরের মাজারের বহুদূর দিয়ে তাঁতীপাড়ার দিকে পা চালায় গজু। মনে মনে পীরহুজুরের উদ্দেশে বলে, পীরহুজুর আমি মহাপাপী। ম্যালা পাপ করছি জীবনে। ম্যালা মাইনষের গলায় ছুরি ধরছি, মালসামানা ছিনাইয়া লইছি! শইল্লের জ্বালায় আর একখান পাপ কাম করতে আইছি হুজুর। আপনে তো বেবাকঐ জানেন হুজুর। শইল্লের জ্বালা বড় জ্বালা। হের লেইগাই হুজুর, আপনা পেডের পোলার পিরিতির মাইয়া ছেইলাডারে ভোগ করুম আইজ। তয় আপনেরে আমি কতা দিতাছি, নাড়ি ধোয়া পীর, হুজুর, আপনেরে আমি কতা দিতাছি, এইডাই আমার শেষ পাপ কাম। কাইলথন আমি ভালা অইয়া যামু। জীবনে আর কুন পাপ করুম না।

পারুদের বাড়ির দিকটা খুব নিঝুম হয়ে আছে। তাঁত বন্ধ করে পারুর বাপভাইরা ঘুমিয়ে পড়েছে। এটাই বেরুবার সময় পারুর। প্রায় রাতেই রতনের সঙ্গে নদীতীরের ঐ ঝোপটার আড়ালে দেখা করে সে। গজু সব খবর রাখে। আজ দুপুরে নিজ কানে শুনেছে, পারু বলেছে রাইতে যামু। তই কইলাম থাইক্কো।

গজু তখন নাইতে যাচ্ছিল করতোয়ায়। রতন-পারু কেউ দেখেনি তাকে।

তখন থেকেই শরীরটা গরম হয়ে আছে গজুর। শরীরের ভেতর হিংস্র এক জন্তু যখন তখন ছটফটানি শুরু করেছে। গজু মনে মনে বলেছে, ডাকাতি ছাইড়া দিছি ম্যালাদিন। অইলে অইব কী, আইজ শেষ ডাকাতিডা করুম আমি। পারুর সতীত্ব ডাকাতি করুম। বিকেলবেলা কায়দা করে রতনকে পাঠিয়ে দিল বাদলবাড়ি। কালু ওস্তাদের কাছে।

কালু ওস্তাদ নিজেও আজকাল কামকাজ করে না। ছেড়ে দিয়েছে। বয়েস হয়েছে তো! কিন্তু দলটা আছে। সাগরেদরা আছে। ডাকাতি করেই ওস্তাদের বখরাটা দিয়ে যায়। ওস্তাদ একা মানুষ। বিয়ে-শাদি করে নাই। বউপোলাপান নাই। অত টেকা-পয়সা তার লাগে না। গজুকে দেয় কিছু।

 সেই টাকা আনতে রতনকে ওস্তাদের কাছে পাঠিয়েছে গজু। আসলে ভাঁওতা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। টাকাটা জরুরি না। হাতে যা আছে বাপপুতের মাসখানেক চলে যাবে। ব্যাপারটা কি টের পেয়েছিল রতন।

বিকেলবেলা গজু যখন বলল, ওস্তাদের কাছে যা রতন। টেকা-পয়সা লইয়া কাইল বিয়ানে আইয়া পড়িছ।

রতন জানে বাদলবাড়ি গেলে আজ রাতে ফেরার উপায় নেই অথচ পারু বলেছে—

রতন কাঁচুমাচু গলায় বলেছিল, কাইল বিয়ানে গেলে খাবি কী মামদার পো। উপাস দিবি! বুড়ো বয়সে আমারে না খাওয়াইয়া রাকবি!

রতন তারপর মন খারাপ করে চলে গেছে।

তখন থেকেই আমোদে আছে গজু। নন্দর দোকান থেকে দুপ্যাকেট বিড়ি কিনেছে। সেই বিড়ি কোমরে, ভোজালিটা কোমরে, গজু এসে বসেছে নদীতীরের ঝোপঝাড়ের আড়ালে।

বিড়ি টানতে টানতে, পারুর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রাত একপ্রহর।

কিন্তু পারু এখন বেরুচ্ছে না কেন?

ঠিক তখনি ঘরের ঝপ খুলে একটি মেয়েমানুষ নিঃশব্দে উঠোনে নামল। জ্যোৎস্নায় দূর থেকে মেয়েমানুষটাকে চিনতে পারল গজু। পারু।

দেখে উত্তেজনায় বুকটা ফেটে যেতে চাইল গজুর।

পারু তখন নাজুক পায়ে বাড়ি থেকে নামছে। সাবধানে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যায় তাকে। শাড়ি খান পাছকোমর করে পরেছে। হাঁটছে। এত সুন্দর ভঙ্গিতে, পরীর মতো লাগে পারুকে। আর সেই দৃশ্য দেখে দমবন্ধ হয়ে আসে গজুর। শরীরের উত্তাপ বেড়ে যায়। ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মনে মনে ডাকে আয় পারু, আয়। কখন কোন ফাঁকে কোমর থেকে ভোজালিটা বের করে হাতে নিয়েছিল, গজুর খেয়াল নেই। জ্যোৎস্নায় ভোজালির ধারটা নদীর জলের মতো ঝিলিক দিচ্ছিল।

হাতের ভোজালিটা একবার তাকিয়ে দেখে গজু। দেখে বুকের ভেতরটা জীবনে প্রথমবারের মতো কেন যে একটু কেঁপে ওঠে, বুঝতে পারে না।

পারু আসছে।

ধানি মাঠে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সাপ দুটো। আহার পায় না। ইঁদুরগুলো বেজায় চালাক। কেমন করে যে টের পেয়ে গেল সামনেই ওত পেতে আছে মৃত্যু। ঝুপঝাঁপ করে সাপ দুটোর মুখের ওপর দিয়ে পালিয়ে গেল তারা। সাপ দুটো ছোবল মারল কয়েকটাকে। ধরতে পারল না। ফলে মেজাজ তাদের তিরিক্ষি হয়ে গেল।

রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ধানি মাঠ থেকে ফিরল তারা। ফিরে সোজা চলতে লাগল নদীতীরের ঝোপঝাড়ের দিকে।

 তখনি দৃশ্যটা চোখে পড়ল তাদের। সেই মানুষটা এখন ওত পেতে বসে আছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আর অন্য একটা মানুষ আস্তেধীরে,এগিয়ে আসছে তার দিকে। দৃশ্যটা দেখেই পাপের গন্ধ টের পেল তারা। মুহূর্তে মাথায় লাফিয়ে ওঠল রক্ত। গতি বেড়ে গেল তাদের। মুহূর্তে মানুষ দুটোর মাঝামাঝি চলে এল। তারপর দুজন দুদিকে। মুখ করে, বিশাল ফনা তুলে মানুষ দুটোর মুখোমুখি দাঁড়াল। তীব্র জ্যোৎস্নায় সাপ দুটোর কুলোর মতো ফনা শূন্যে দুলতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *