দময়ন্তীর মুখ

দময়ন্তীর মুখ

আজকের সকালটি সোনার মতন উজ্জ্বল। কুয়াশা নেই, মেঘ নেই, বরফমাখা পাহাড় শৃঙ্গগুলিতে রোদ ঠিকরে পড়ছে, সেদিকে চোখ রাখা যায় না। বাতাসের তরঙ্গ একমুখী নয়, কেমন যেন এলোমেলো, যেন বাতাস আপন মনে কোনো খেলায় মেতে আছে। একটা কাঠঠোকরা পাখি উড়ে এসে বসলো খুব কাছে। এখানে কাছাকাছি বড়ো গাছ নেই, তবু পাখিটা কোথা থেকে যেন আসে মাঝে মাঝে। পাখিটা রাজকুমারের মতন রূপবান। মাথায় মুকুটের মতন চূড়া, অঙ্গে চিত্রিত মখমলের মতন পোশাক, গর্বিত পা ফেলে সে আস্তে আস্তে হাঁটে। তার দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলেন অর্চিষ্মান। পাখিটাকে যতবার দেখেন, ততবার তাঁর বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

গুহা থেকে বাইরে এসে এই সুন্দর সকালটি দেখে অর্চিষ্মানের মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। যদিও শরীরটা ভালো নেই, সারা রাত ভালো করে ঘুম হয়নি, মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। উঠে বসে বুকে হাত বুলিয়েছেন। ওষুধ খাওয়ার প্রশ্ন নেই, গত প্রায় চল্লিশ বছর তিনি ওষুধ কাকে বলে জানেন না। এই পাহাড়ের রাত্রির বিশাল নিস্তব্ধতার মধ্যে তিনি নিজের প্রাণবায়ুকে ফিসফিস করে বলেছেন, শান্ত হও, শান্ত হও। যদি চলে যেতে হয়, শান্তভাবে যাও।

আজ সকালেও বুক ভার হয়ে আছে, পা দুটি দুর্বল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার ঊর্ধ্বে উঠে গেল তাঁর মন, দৃশ্য সৌন্দর্যের মহিমা তাঁকে আপ্লুত করে দিল। কাঠঠোকরা পাখিটির চরণ-ছন্দের দিকে চেয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। কম্বলটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে বসলেন গড়ুর সিংহাসনে। সেটি আসলে একটি বড়ো পাথরের চাঁই। এখানকার প্রত্যেকটি পাথরের তিনি নিজস্ব নাম দিয়েছেন। আর দুটি পাথরের নাম মহাকূর্ম এবং থিরবিজুরি। কোনো রহস্যময় কারণে থিরবিজুরি পাথরটিকে তাঁর মনে হয় নারী, সেজন্য তিনি ওই পাথরটির ওপরে কখনও বসেন না।

এর পর এল দুটি প্রজাপতি। এরকম রৌদ্র ঝলমল সকালেই ওরা আসে। কুয়াশা, বৃষ্টি, তুষারপাত আর হিমেল হাওয়ার দিনে ওরা কোথায় থাকে কে জানে! প্রজাপতি দুটি একটুক্ষণ ওড়াউড়ি করে বসলো ঘাস ফুলে। কী অপূর্ব ওদের ডানায় রঙের বিন্যাস। এতগুলি বছরেও প্রজাপতি সম্পর্কে অর্চিষ্মানের বিস্ময়বোধ কাটেনি। কেন ওরা এত সুন্দর, উত্তর পাননি সে প্রশ্নের। ওদের শরীরের বুঝি ওজন নেই, ছোট্ট একটা ফুলের ওপরেও সাবলীল ডানা মেলে বসে, বাতাসের সঙ্গে দোল খায়।

চোখ মুখ ধুতে যেতে হবে নদীতে। বেশি দূরে নয়। এই গুহামুখ থেকেই শোনা যায় নদীর কলকল ধবনি, সেই শব্দ ঢেকে দেবার মতন আর কোনো শব্দ এখানে নেই। ওইটুকু হেঁটে যেতেই অর্চিষ্মান আজ আলস্য বোধ করছেন। তবু একটু পরে উঠে দাঁড়ালেন, কোমরে একটা ব্যথা মোচড় দিয়ে গেল। আগে কখনও এরকম ব্যথা অনুভব করেননি। বয়েসের থাবা! এবার বুঝি সত্যি বার্ধক্য এল। অর্চিষ্মান আবার প্রজাপতি দুটির দিকে চোখ ফেরালেন, নিজেকে ভুলে ওদের দিকে মনোযোগ দিলেন, অস্ফুট স্বরে বললেন, সুন্দর, সুন্দর!

নদীর পথটা ঢালু, নামা সহজ, তবু যাতে হোঁচট খেয়ে না পড়ে যান, সেই জন্য অর্চিষ্মান একদিকের পাথর ধরে ধরে এগোতে লাগলেন। প্রতিদিন সকালে নদীটিকে প্রথম দর্শনে তাঁর ভালো লাগে। অর্চিষ্মানের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই, তবু নদীটিকে দেখলেই তাঁর বলতে ইচ্ছে করে আমার, আমার।

পাহাড়ের বরফ গলা জল থেকে নেমে এসেছে খুবই ছোটো নদী, একটু দূরেই গিয়ে মিশেছে অন্য নদীতে। এ নদীর কোনো নাম ছিল না, অর্চিষ্মান নাম দিয়েছেন খরসা। খরস্রোতা থেকে খরসা। মুখে মুখে নামটা চালু হয়ে গেছে। অর্চিষ্মান যখন থাকবেন না, তখন তাঁর দেওয়া নামটা থেকে যাবে।

যেমন স্রোত, তেমনই ঠান্ডা জল। এতগুলো বছর কেটে গেল, তবু এখনও জলে হাত দেবার আগে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হয়। ছেলেবেলায় শীতকালে পুকুরে স্নান করতে গেলে যেমন জলে নামতে ইচ্ছে করতো না, একসময় গামছাটা ছুড়ে দিয়ে, সেটা ডুবে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হত, এখানেও সেরকম ইচ্ছে হয়। কিন্তু অর্চিষ্মানের গামছা নেই, স্নানের পর গায়েই জল শুকোয়।

জলে অর্চিষ্মান নিজের মুখের ছায়া দেখলেন। মুখের দাড়ি গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে সামান্য অংশই দেখা যায়, আজ যেন অনেকদিন পর নিজেকে দেখলেন, কেমন যেন অচেনা লাগল। চক্ষু দুটির জ্যোতি কমে এসেছে, এটাও অসুস্থতার লক্ষণ। কিছুতেই শরীরকে গুরুত্ব দেবেন না বলে অর্চিষ্মান আকাশের দিকে তাকালেন। এমন ঝকঝকে নীলাকাশ বুঝি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। মেঘশূন্য এমন নীলিমা এখানেও খুব দুর্লভ, কখন যে মেঘ এসে যাবে, চতুর্দিক অন্ধকার করে ঝড় বইবে তার ঠিক নেই। এই তো গত পূর্ণিমায় এমন ঝড় উঠেছিল যে তিনদিন টানা চলেছে, এক মুহূর্তের জন্যও থামেনি।

অর্চিষ্মান সেই নিবিড় নীলের দিকে তাকিয়ে শরীরের কষ্টের কথা ভুলে গেলেন। তাঁর মনে হল, কালস্রোত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে, তবু আকাশে তার কোনো রেখা পড়ে না। আকাশ চিরতরুণ।

নমস্তে বাঙালিবাবা!

নদীর ওপার দিয়ে একটা ভেড়ার বাচ্চা কোলে করে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে একজন মাঝবয়েসি মানুষ। ভেড়াটা কোনোভাবে আহত হয়েছে। খুব সম্ভবত শীর্ষিবাবার আশ্রমে নিয়ে যাচ্ছে। শীর্ষিবাবা গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে অনেক রুগণ মানুষ, এমনকি পশুপাখিও সুস্থ হয়ে ওঠে।

অর্চিষ্মান হাত তুলে বললেন, জিতা রহো! লোকটির অবশ্য আর কথা বলার সময় নেই। সে ছুটছে।

এত বছরেও বাঙালিবাবা নামটা ঘুচল না। তাঁর গুরু যোগত্রয়ানন্দ অর্থাৎ যোগী অর্থাৎ যোগীবাবা অর্চিষ্মানের একটা অন্য নাম দিয়েছিলেন। তাঁর অঙ্গে গেরুয়া জড়িয়ে দিয়ে নাম দিয়েছিলেন বসভেশ্বরস্বামী, কিন্তু সে নাম চলেনি। অর্চিষ্মান হিন্দি ভালোই শিখেছেন, এই হিমালয়ে সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যে হিন্দি ভাষাই লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা, কিন্তু তাঁর উচ্চারণে বাংলা টান যায়নি। দু-তিনটে বাক্য শুনলেই অন্যরা বুঝে যায়, বাঙালি।

অর্চিষ্মানের পূর্বাশ্রমের নামটাও একেবারে ঘুচে যায়নি। কেউ কেউ যে মনে রেখেছে, সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। এই তো গত বছরই ডিসেম্বর মাসে দুজন যুবক খুঁজে খুঁজে পাহাড়ের এতদূরে পৌঁছে গিয়েছিল। তারা একটা লিটল ম্যাগাজিন চালায়, তারা অর্চিষ্মান গুহঠাকুরতার সাক্ষাৎকার ছাপাতে আগ্রহী। অর্চিষ্মান খুব হেসেছিলেন। লোকালয় থেকে বহুকাল বিচ্যুত, গুহানিবাসী এক সাধুর সাক্ষাৎকার পাঠ করে কার কী লাভ হবে? মানুষকে জানাবার মতন তো তাঁর কিছুই নেই। নিজেই এখনও অনুসন্ধানী।

ছেলে দুটি এত কষ্ট করে, প্রচুর উৎসাহ নিয়ে এসেছে বলে মায়া হয়েছিল অর্চিষ্মানের, তিনি ওদের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর না দিলেও আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।

ওরা ওদের পত্রিকার দুটি সংখ্যা প্রায় জোর করেই রেখে গেছে। অর্চিষ্মান পড়ে দেখতে চান না। কত বছর যে ছাপার অক্ষর পড়েননি, তার হিসেব নেই। এখানে সাল-তারিখের খেয়াল রাখারও প্রয়োজন হয় না। ওই পত্রিকার মলাটে লেখা আছে, ইংরেজি পঁচানম্বই সাল। তাতেই অর্চিষ্মানের খেয়াল হল যে, এই পাহাড়ে কেটে গেল ছত্রিশ বছর।

ছেলে দুটি বলেছিল, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির ইনডেক্স কার্ডে এখনো অর্চিষ্মান গুহঠাকুরতার নাম আছে। সেখানে তাঁর কবিতার বইটি এখনও পাওয়া যায়। একজন সাহিত্যিক সম্প্রতি আত্মজীবনী লিখেছেন, তাতে আড়াই পৃষ্ঠা জুড়ে আছে অর্চিষ্মান গুহঠাকুরতার কথা, সেই অংশটি পড়েই যুবাদুটি ছুটে এসেছে। এসব শুনেও অর্চিষ্মান শুধু হেসেছিলেন। তাঁর মনে কোনো কৌতূহল জাগেনি।

আপনি কেন সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন এই পাহাড়ে? ওদের বারবার এই প্রশ্নের উত্তরে অর্চিষ্মান বলেছিলেন, নিয়তি!

মানুষের নিয়তি কি মানুষ নিজেই নির্ধারণ করে? অথবা মনের অনেক গভীরে, অতলান্ত প্রদেশে এমন কিছু প্রক্রিয়া চলে, যেখানে মানুষের যুক্তিগ্রাহ্য জীবনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

উনিশশো ঊনষাট সালে চন্দননগর থেকে এগারোজনের একটি অভিযাত্রী দল এসেছিল সুন্দরডুঙ্গা হিমবাহ অভিযানে। সেই দলের ম্যানেজার ছিল এক তরুণ কবি। পাহাড়ে চড়া কিংবা ট্রেকিং-এর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, সে অনেকটা জোর করেই দলে ঢুকে পড়েছিল। লোকে বলে, পাহাড় নাকি মানুষকে টানে। অর্চিষ্মানকেও টেনে এনেছিল নগাধিরাজ হিমালয়? ঠিক তা নয়।

বেস ক্যাম্প ছিল উমলায়। রোমান্টিক তরুণ কবিটি কাহিল হয়ে গিয়েছিল শীতে, বা হাঁটুতে খানিকটা চোটও লেগেছিল, উমলা থেকে আর সে এগোতে পারেনি। সুন্দরডুঙ্গা ও পিণ্ডারি অভিযান সার্থক করে দলটি ফিরে এলো, এক রাত সহর্ষে নাচ-গান করে কাটালো, তারপর নীচে নেমে আসার উদ্যোগ করতেই তরুণ কবিটি জানালো, সে ওখানে আরও কিছুদিন থেকে যেতে চায় একা একা। বন্ধুদের অনেক অনুরোধ ও পেড়াপিড়িতেও সে ফিরতে সম্মত হল না।

প্রথমে ভেবেছিল, সেই সৌন্দর্যমণ্ডিত পাহাড় প্রকৃতির মধ্যে অন্তত মাসখানেক থাকবে, কিন্তু কেটে গেল মাসের পর মাস, বছর, যুগ এই তিনযুগ পেরিয়ে গেছে।

কলকাতা ছেড়ে আসার আগে এরকম কোনো বাসনা বা সিদ্ধান্ত তার মনের কোণেও ছিল না। কোনোরকম আধ্যাত্মিক টানও আগে কখনও অনুভব করেনি অর্চিষ্মান। কবিদের সাহচর্য, শহুরে জীবনের উত্তেজনাই তার পছন্দ ছিল, প্রকৃতির রূপের আকর্ষণ তার চেয়ে বেশি হল কী করে?

কারুর প্রতি অভিমান? নারী?

সে রকম একটা গৌণ কারণ ছিল বটে। খুব গৌণই বলা উচিত।

ছত্রিশ বছর আগে, অভিযাত্রী দলের সঙ্গে জুটে যাবার সময়, দময়ন্তী আর তার স্বামী এসে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল অর্চিষ্মানদের বাড়ির খুব কাছাকাছি। জানলা খুললে এ বাড়ি ও বাড়ি দেখা যায়। দময়ন্তীদের বাড়ির দোতলায় প্রশস্ত, ঢাকা বারান্দা, সেখানে চায়ের টেবিল পাতা, অর্চিষ্মানের ঘর থেকে স্পষ্ট দেখা যেত, ওরা স্বামী-স্ত্রী সকালে সেখানে চায়ের ট্রে নিয়ে বসেছে। এই দৃশ্য অর্চিষ্মানের অসহ্য বোধ হত।

সেই জন্যই সে আর ফিরল না? এটা একেবারে ছেলেমানুষির পর্যায়ে পড়ে। তখন কৃষ্ণনগর কলেজে চাকরি পেয়েছে অর্চিষ্মান, বাড়ি থেকে রোজ ট্রেনে যাতায়াতের ক্লান্তি কম নয়, সে তো কৃষ্ণনগরেই বাড়ি নিয়ে যেতে পারত। কৃষ্ণনগর জায়গাটি বেশ, সাহিত্যের পরিবেশ আছে। দময়ন্তীর কাছ থেকে দূরে সরে যাবার জন্য তাকে হিমালয়ের গিরিকন্দরে আশ্রয় নিতে হবে কেন?

নিয়তি, না খেয়াল? প্রথম দিকে খানিকটা খেয়ালের বশেই কি সে থেকে যেতে চায়নি? বুকের মধ্যে সেরকম কিছু অভিমানের তীব্র কুয়াশা ছিল না, বরং তার কবিসত্তা এই পরিবেশে স্পন্দিত হয়েছিল। মাসখানেকের বেশি এরকম ভালো লাগার বোধ থাকে না, তারপর ফিরে যাওয়াই ছিল স্বাভাবিক।

এখানকার একজন মানুষ তাকে আকৃষ্ট করেছিল। উমলা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল যোগত্রয়ানন্দের আশ্রম। অনেকেই সেখানে যায়, তরুণ কবি অর্চিষ্মানও সেখানে গিয়েছিল কৌতূহলবশে। ধর্ম সম্পর্কে তার মন ছিল মুক্ত, নিজে কোনো ধর্মাচরণ না করলেও অপরের ধর্মাচরণের ব্যাপারে অশ্রদ্ধা ছিল না। যার যা ভালো লাগে। ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই অস্পষ্ট, এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও পরিচালক একজন কেউ আছে না নেই, তা স্পষ্টভাবে বলা খুব দুষ্কর। এক এক সময় তার মনে হত ঈশ্বর এক অলীক কল্পনা মাত্র। আবার কখনও মনে হত, এই বিশ্বের সৌন্দর্য, কল্যাণ প্রবহমানতার জন্য যদি ঈশ্বর দায়ী হন, তাহলে কুশ্রীতা, হানাহানি, অশুভ শক্তির অভ্যুত্থান, এসবের জন্যও কি তিনিই দায়ী?

যোগত্রয়ানন্দ বা যোগীবাবার আশ্রমের বাইরে বেশ বড়ো একটা বাগান। নানা বর্ণের, কত বিচিত্র সব ফুল। আশ্রমে প্রবেশ করার আগে অর্চিষ্মান সেই বাগানে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরেছিল। ফুলের বাহার দেখতে দেখতে অর্চিষ্মানের হঠাৎ মনে হয়েছিল, প্রতিটি গাছের ফুল আলাদা, এক একটি ফুলের কী অপূর্ব ডিজাইন, কতরকম রঙের তরঙ্গ এবং তা একেবারে নিখুঁত। এত রকম ফুলের সৃষ্টি করল কে? প্রকৃতির এই সৃষ্টির পেছনে কি কোনো চিন্তাশীল মন কাজ করেনি? চিন্তা না করলে সব আলাদা আলাদা হবে কী করে? শুধু তো ফুল নয়, এতরকমের গাছ, মানুষ, পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মুখ আলাদা। কারখানায় প্রস্তুত সব জিনিস একরকম হয়, প্রকৃতির কারখানার পিছনে কি তা হলে ঈশ্বর নামে একজন শিল্পী আছেন? কিন্তু একা সেই ঈশ্বর বসে বসে এত কোটি কোটি ফুল-গাছ-মানুষ-জন্তু-কীট-পতঙ্গেও ডিজাইন আঁকছেন, এও তো অবাস্তব ব্যাপার!

যোগীবাবা বসেছিলেন উন্মুক্ত স্থানে, একটি বাঘের চামড়ার ওপরে। মোটাসোটা, দীর্ঘকায় মানুষটি, কোনো রকম উগ্রভাব নেই, বরং মুখখানি দেখলেই ভালো লাগে। কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথা বলছেন, নিজেকে জাহির করার ভাব নেই। প্রথম দিন অর্চিষ্মান যোগীবাবার সঙ্গে কোনো কথা না বলে, কিছুক্ষণ বসে থেকে ফিরে এল।

অর্চিষ্মানের আগে ধারণা ছিল সাধুগিরি এক ধরনের নিরাপদ ব্যাবসা। মূলধন লাগে না, কোনো খাটাখাটনি করতে হয় না, কিছু চটকদার কথা বলার ক্ষমতা থাকলেই হল। তাতেই কিছু চ্যালা জুটে যায়, তারা সেবা করে, খাবারদাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায় স্বচ্ছন্দে। সবাই জানে, উপমা আর যুক্তি এক নয়, কিন্তু সব সাধুই কথায় কথায় উপমা দিয়ে ভক্তদের মাত করে। মানুষের গুঢ় জিজ্ঞাসার উত্তরে সাধুরা একটা গল্প শুনিয়ে দেয়।

যোগীবাবার আশ্রমের পরিবেশটা অর্চিষ্মানের পছন্দ হয়েছিল। হই-চই নেই, দাও দাও ভাব নেই, পিছন দিকে একটি গম্ভীর পাহাড়চূড়া, সামনে সযত্নে রক্ষিত বাগান। যোগীবাবা নিজে বাগানে ঘুরে ঘুরে ফুলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।

দিন তিনেক যাবার পর অর্চিষ্মান একদিন যোগীবাবাকে প্রশ্ন করল, সাধুজি, আপনি যে এখানে আশ্রম করে আছেন, তা কীসের জন্য? আপনি কী পেয়েছেন?

ফুলবাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যোগীবাবা আকাশের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই পেয়েছি।

অর্চিষ্মান চমকে গেল। এত সহজ উত্তর? অনেক বড়ো বড়ো যোগী সাধকও ঈশ্বরকে পেয়ে যাওয়ার কথা সরাসরি স্বীকার করেন না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্য কথা বলেন। এই লোকটা ভণ্ড, মিথ্যেবাদী নাকি?

সে জিজ্ঞেস করল, আপনার ঈশ্বর দর্শন হয়ে গেছে?

এর উত্তরে যোগীবাবা যদি হ্যাঁ বলতেন, তাহলে অর্চিষ্মান হয়তো আর কখনো ও আশ্রমে আসত না।

যোগীবাবা সামান্য হেসে বললেন, ঈশ্বর আকাশে থাকেন কিনা তা আমি জানি না। না, আমার আজও ঈশ্বর দর্শন হয়নি। আমি আকাশের দিকে দেখালাম, তার মানে আমি আকাশকে পেয়েছি। গাছের দিকে তাকিয়ে গাছকে পাই, মানুষের দিকে তাকিয়ে মানুষকে পাই, সবকিছুর ওপরে আকাশ।

এমন স্নিগ্ধস্বরে যোগীবাবা কথাগুলি বলেছিলেন, অর্চিষ্মান মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই মানুষটিও কবি।

যোগীবাবার সঙ্গে ভাব জমে যাবার পর তিনি অর্চিষ্মানকে এই আশ্রমে এসে থেকে যাবার জন্য আহ্বান জানালেন। এর আগে অর্চিষ্মান ছিল পাহাড়িদের গ্রামের একজনের বাড়িতে। দৈনিক মাত্র দুটি টাকা দিলে তারা রুটি, ডাল, সবজি বানিয়ে দিত। ঘর ভাড়া কিছু লাগত না। খানিকটা যোগীবাবার ব্যক্তিত্বের টানেই সে চলে এল আশ্রমে।

এখানে তাকে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম মানতে হয়নি। যোগীবাবা তাকে কোনো পুজো-আচ্চা বা ধ্যানের অনুজ্ঞা দেননি। বলেছিলেন, যা মন চায় তাই করবি, পাহাড় দেখবি, নদী, গাছপালা দেখবি, খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখবি, সব কিছুর অন্তঃস্তল পর্যন্ত দেখবি, তাতেই হৃদয় পবিত্র হয়ে যাবে।

সেই অল্প বয়েসের অস্থিরতার অর্চিষ্মান বেশ কিছুদিন যোগীবাবাকে নানান প্রশ্ন করে জব্দ করতে চেয়েছে। পারেনি।

একদিন সে জিজ্ঞেস করেছিল, যোগীবাবা আপনি তো বলেন ঈশ্বর মঙ্গলময়। পৃথিবীতে যে এত অমঙ্গল, এত হানাহানি, তা কি ঈশ্বর দেখতে পান না? আপনি কী জানেন, জাপানে অ্যাটম বোমা ফেলে একদিনে লক্ষ লক্ষ লোক মারা হয়েছিল? সেই সব নিরীহ মানুষ কি সবাই পাপী ছিল? তারা মরলো কেন? হত্যাকারীরাও কোনো শাস্তি পায়নি। এটা ঈশ্বরের কোন লীলা?

যোগীবাবা সরলভাবে বলেছিলেন, আমি এ প্রশ্নের উত্তর জানি না। ঈশ্বরের হয়ে ওকালতি করার দায়িত্বও কেউ আমাকে দেয়নি। আমি ঈশ্বরকে খুঁজি আমার নিজস্ব শান্তির জন্য। জানি না কোনোদিন তাঁর দর্শন পাবো কিনা। তবে মাঝে মাঝে যেন আভাস পাই। একদিন শুধু তাঁর জ্যোতির্ময় প্রভাটুকু অন্তত দেখতে পাবো আশা করে আছি।

আর একদিন অর্চিষ্মান বলেছিল, মানুষের জীবনে ঈশ্বরকে খুঁজতেই হবে কেন? ঈশ্বর যদি থাকেন তো থাকুন। আমি এমন কিছু কিছু মানুষকে জানি, যাঁদের ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই, ঈশ্বরকে নিয়ে মাথাও ঘামান না। তাঁরা লোক ঠকান না। অযথা মিথ্যা কথা বলেন না, সৎভাবেই জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন।

যোগীবাবা বলেছিলেন, ভালো, খুব ভালো। যার যা ভালো লাগে। আমি দেখেছি, অবিশ্বাসে বড়ো অশান্তি, বিশ্বাসে শান্তি। অবিশ্বাস নিয়েও যদি কেউ শান্তিতে জীবন কাটাতে পারে তা কাটাক না। তারাও শ্রদ্ধেয়।

একটু থেমে তিনি আবার বলেছিলেন, অবিশ্বাস থেকেও কেউ কেউ বিশ্বাসে পৌঁছে যায়। মাঝখানে সুদীর্ঘ কষ্টকর পথ। পৌঁছোবার পর সব ক্লান্তি দূর হয়, তারপর বড়ো শান্তি রে, বড়ো শান্তি। অপার, সুগভীর শান্তি। না পৌঁছোলে বোঝা যায় না। আমার মনে হয় তুই পারবি, তুই পৌঁছে যাবি।

অর্চিষ্মানের সেদিন খানিকটা কৌতুকের সঙ্গেই মনে হয়েছিল, তাই নাকি? আচ্ছা দেখাই যাক।

মাস দেড়েক কেটে যাবার পর ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কলকাতা থেকে ছুটে এসেছিলেন বাবা। অল্প বয়েসে মাকে হারিয়েছে অর্চিষ্মান। বাবা, দুই দাদা, এক দিদি ও পিসিমাকে নিয়ে সংসার। বাবার শত অনুরোধ, আদেশ, কান্নাকাটিতেও বিচলিত হয়নি অর্চিষ্মান, সে ফিরে যেতে চায়নি। বাবাকে বলেছিল, আমার ইচ্ছে হলে ঠিক ফিরে যাবো, আমি দেখতে চাই আর কতদিন এখানে ভালো লাগে। আমি চিঠি লিখবো মাঝে মাঝে।

এরপরেও বড়োদাদা এসেছিল একবার, দুতিনজন বন্ধুও এসেছিল দেখা করতে। অর্চিষ্মান তখন মোহমুগ্ধ হয়ে আছে, তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না।

যোগীবাবা তাকে বলেছিলেন, ঈশ্বরের জন্য হন্যে হয়ে চোখ বুজে তপস্যা করে কোনো লাভ নেই। চোখ খুলেই তাঁকে পাওয়া যায়। এই পৃথিবীর সব সৃষ্টির মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বরের দিব্যজ্যোতির স্পর্শ। সেই জন্য, গাছপালা, ফুল, পাখি, নদী পাহাড় এই সবকেই আগে চিনতে হয়। একদিন না একদিন এদের মধ্যেই দেখা যাবে সেই জ্যোতি।

সেইজন্য অর্চিষ্মান প্রকৃতিকে ভালোভাবে চেনবার চেষ্টা করছিল। কোনো কোনো ফুলগাছের সামনে তো সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত বসে থেকেছে। দেখেছে কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটা। দেখেছে মৌমাছি, প্রজাপতিদের খেলা। দেখেছে জীবনের স্রোত।

ফুলগুলি কেন এত সুন্দরভাবে সেজে পাপড়ি মেলে ধরে তা বোঝা যায়। ভ্রমর বা মৌমাছিদের অমন সাজগোজ করার দরকার নেই। কিন্তু প্রজাপতিরা কেন এত সেজে আসে? ওদের ডানায় কেন এত রঙের কারুকাজ। প্রকৃতির যে এত রূপ, তার সব কিছুর মধ্যেই কোনো না কোনো প্রয়োজনের কথাও লেখা আছে। এত স্বল্পজীবী প্রজাপতির ডানার শিল্পকীর্তির মধ্যে কোন প্রয়োজন? পাখিরা ওদের ধরে ধরে খেয়ে ফেলে।

ফুলগাছের কাছে কিরনা নদীর ধারে বসে থাকাই ছিল অর্চিষ্মানের ধ্যান। সেই ধ্যানে প্রায়ই বিঘ্ন ঘটাত দময়ন্তীর মুখ।

খানিকটা অভিমান থাকলেও দময়ন্তীর জন্য তার বুকে তেমন গভীর কোনো বেদনাবোধ ছিল না। দময়ন্তীর কাছ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল দময়ন্তীর বিয়ের অনেক আগে।

শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় নাগরদোলায় চাপতে গিয়ে আলাপ। অর্চিষ্মানের সঙ্গে ছিল কয়েকজন বন্ধু, দময়ন্তীর সঙ্গেও ছিল কয়েকজন বান্ধবী। চোখাচোখির টান। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া, ঠিকানা বিনিময়। দময়ন্তী থাকে আসানসোলে, অর্চিষ্মান থাকে দমদম ক্যান্টরমেন্টের কাছে। ঠিকানা নিলেও অর্চিষ্মান প্রথমে চিঠি লেখেনি, দময়ন্তী অর্চিষ্মানের একটি কবিতা পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসার চিঠি পাঠিয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল চিঠির বন্যা। প্রথম প্রথম সপ্তাহে একটা দুটো, তারপর প্রতিদিন, এমন কী একদিনে দুটি চিঠিও লিখেছে অর্চিষ্মান।

নতুন দাঁত ওঠা শিশু যেমন সব কিছু কামড়াতে চায়, একজন তরুণ কবিরও সেরকম সব সময় আঙুল নিশপিশ করে। ভাষার মাধ্যমে জীবনযাপন। ভাষার মাধ্যমে মুক্তি। ভাষা নিয়ে আত্মরতি। অর্চিষ্মান তখন শুধু কবিতাই লেখে না, পুস্তক সমালোচনা, ছোটোখাটো প্রবন্ধ, রম্যরচনাও লিখেছে বেশ কিছু। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাকে পছন্দ করেন, তার একটি কাল্পনিক ভ্রমণকাহিনি পড়ে সাগরময় ঘোষ একদিন বলেছিলেন, তোমার গদ্যের হাতও বেশ ভালো, তুমি একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করবে নাকি, অর্চি? সে লাজুকভাবে মাথা নীচু করে বলেছিল, ওরে বাবা, উপন্যাস কি লিখতে পারবো, সাগরদা! সে যে খুব শক্ত! মুখে এই কথা বললেও ‘দেশ’ সম্পাদকের এই প্রস্তাবে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল অর্চিষ্মান।

টানা তিন বছর ধরে চলেছিল চিঠি লেখালেখির পালা। এর মধ্যে দময়ন্তীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল মাত্র একবার। মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে আসানসোল থেকে দময়ন্তী এসেছিল কলকাতায়, চিঠিতে আগেই ঠিক করা ছিল, বিয়েবাড়ি থেকে কিছুক্ষণের জন্য পালিয়ে এসে দময়ন্তী দাঁড়িয়েছিল ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের পুকুরের ধারে। দুজনে পাশাপাশি হেঁটেছে, চিঠিপত্রে পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে এলেও কথাবার্তায় সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কেউ কারুর অঙ্গ স্পর্শ করেনি। না, তা ঠিক নয়। একবার শুধু দময়ন্তীর চাঁপা ফুলের মতন একটি আঙুল ছুঁয়ে দিয়েছিল অর্চিষ্মান। সেইটুকুই যথেষ্ট।

এতদিনে অর্ধেক ছাপার খরচ দিয়ে একটা ছোটো প্রকাশনী থেকে অর্চিষ্মান গুহঠাকুরতার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেই বই পেয়ে দময়ন্তী লিখেছিল, তুমি প্রত্যেকটি কবিতা ছাপার আগে কপি করে আমার কাছে পাঠাবে। আমি প্রথম পড়তে চাই। তুমি আমার কবি। আমি জানি, আমার কবি একদিন নোবেল প্রাইজ পাবে।

তিন বছর পর দময়ন্তী এম এ পড়তে এলো কলকাতায়। টালিগঞ্জে তার মামার বাড়িতে উঠল। দমদম থেকে টালিগঞ্জ, দূরত্ব অনেকখানি। দময়ন্তীর মামার বাড়িটি মস্ত বড়ো, অনেক লোকজন, ছেলেমেয়েদের মেলামেশার কোনো বাধা নেই। সে বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছে অর্চিষ্মান, একতলাতে দুখানা বৈঠকখানা, দুপুরের দিকে গেলে নিরিবিলিতে কথা বলা যায় অনায়াসে।

এক মেঘলা দুপুরে ওরা ছোটো বসবার ঘরটায় বসেছিল অনেকক্ষণ। একপাশে পুরনো আমলে একটি সোফা পাতা, আর একদিকে একটি গোল শ্বেতপাথরের টেবিল ঘিরে কয়েকটি চেয়ার। দময়ন্তী বসে আছে সোফায়, ধূপের ধোঁয়া রঙের শাড়ি পরা, মাথার সব চুল খোলা। প্যান্ট শার্ট পরা অর্চিষ্মান বসে আছে একটু দূরের চেয়ারে, হাতে সিগারেট। এক মাথা চুল, গালে দু-তিন দিনের দাড়ি, পাশের খোলা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা করবী গাছের ঝোপ। আকাশে মাঝে মাঝে গুরুগুরু শব্দ হচ্ছে। জানিয়ে দিচ্ছে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা। কথাবার্তা থামিয়ে ওরা চেয়ে আছে পরস্পরের দিকে। এক এক সময় নীরবতাই বাঙ্ময়। চোখে চোখে প্রবাহিত হচ্ছে ওদের হৃদয়। এতদিন পরে এই প্রথম ওদের শরীর জেগে উঠেছে, চুম্বকের মতন পরস্পরকে টানছে, দুজনেরই ঠোঁটে দারুণ তৃষ্ণা, যে-কোনো মুহূর্তে অর্চিষ্মান উঠে যেতে পারে দময়ন্তীর কাছে।

সেই মুহূর্তটা এল না। কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ওপর থেকে নেমে এল দময়ন্তীর মামাতো দাদা তপন, সঙ্গে তার এক বন্ধু, বন্ধুটির নাম অভিজিৎ, সে এয়ারফোর্সের অফিসার। লম্বা, ফর্সা অত্যন্ত সুদর্শন যুবা, পোশাকের ভাঁজ নিখুঁত, মাথার চুল কপালে এসে পড়ে না।

তারপর থেকে অভিজিৎকে প্রায়ই দেখা যায় ও-বাড়িতে। একসঙ্গে গল্প, হাসিঠাট্টা হয়। বাংলা কবিতার ধার ধারে না অভিজিৎ কিন্তু সে অশিক্ষিত নয়, বিদেশি বই পড়েছে অনেক। মোটামুটি জার্মান ভাষা জানে।

আইস স্কেটিং রিংকে একটি বিলিতি দলের নাচের অনুষ্ঠান চলছে, অভিজিৎ একদিন প্রস্তাব দিল, সবাই মিলে সেটা দেখতে যাওয়া হোক। তার চেনাশুনো আছে, ভিতর থেকে সে টিকিট জোগাড় করতে পারবে। দময়ন্তীর খুব উৎসাহ, সে বলল, হ্যাঁ চলো, চলো। তপন যেতে পারবে না, বৈষয়িক ব্যাপারে তাকে যেতেই হবে উকিলের বাড়িতে। দময়ন্তীর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অর্চিষ্মান বলল, আমিও যেতে পারবো না, সন্ধেবেলা আমার বিশেষ কাজ আছে। দময়ন্তী তবু আবদারের সুরে বলল, চলো, চলো, দেখো, গেলেই তোমার ভালো লাগবে। অর্চিষ্মান তবু রাজি হল না। এর পরেও কি দময়ন্তী একলা যাবে অভিজিতের সঙ্গে? হ্যাঁ, ওরা দুজনেই গেল।

সেই দিন থেকেই সম্পর্কের শেষ। এর আগেও অভিজিৎ একবার দময়ন্তীকে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে চিনে খাবার খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন অবশ্য তপন ছিল সঙ্গে। ওসব জায়গা যাবার সাধ্য ছিল না অর্চিষ্মানের।

একদিন অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে নাচ-গান দেখতে গেলে কী এমন আসে যায়? ব্যাপারটা তা নয়। অর্চিষ্মান বুঝে গেল, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই যুদ্ধে সে অংশ নেবে না। অভিজিৎ একজন অস্ত্রধারী যোদ্ধা আর অর্চিষ্মান কবি। এদের মধ্যে কি লড়াই হতে পারে? কবিরা কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যায় না। কাপুরুষতা নয়, অরুচি, উপেক্ষা। লোকে মনে করবে পরাজয়। তা করুক। স্বেচ্ছা-পরাজয় কবির অহংকারকে উস্কে দেয়, তার সৃষ্টি ক্ষমতা বেড়ে যায় অনেকখানি।

অর্চিষ্মান আর কোনোদিন দমদম থেকে টালিগঞ্জে যায়নি।

পনেরো দিন পর দময়ন্তী চিঠি লিখেছিল। উত্তর না পেয়ে আর একটি। অর্চিষ্মান কী উত্তর দেবে? সেদিন দময়ন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে অর্চিষ্মান যে তাকে যেতে নিষেধ করেছিল, তা কি সে বোঝেনি? চোখের ভাষাই যদি বুঝতে ভুল করে তাহলে আর চিঠি লিখে কী হবে?

ছ-মাসের মধ্যে অভিজিতের সঙ্গে দময়ন্তীর বিয়ে হয়ে গেল। চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হবার পর অভিজিৎ বিয়ে করবে ঠিক করে উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধানে ঘুরছিল। তারপর সে যখন দময়ন্তীকে নির্বাচন করল, তখন এ বিয়ে হবেই। জয়ী হবার জন্যই সে এসেছে।

অর্চিষ্মান তাতে আঘাত পায়নি। এটা সত্যি কথা। নিজের হাতে গড়া একটা মূর্তি হঠাৎ ভেঙে ফেললে সেই শিল্পী যেমন নিজেকেই দোষ দেয়, তার মনোভাব হয়েছিল সে রকম।

কিন্তু অভিজিৎ দমদম ক্যান্টরমেন্টের কাছেই বাড়ি নিতে গেল কেন? সে হয়তো অর্চিষ্মানের বাড়ি কোথায় তা জানত না, কিন্তু দময়ন্তীর তো জানা ছিল। আসতে যেতে প্রায়ই দেখা হয়ে যাবে। পাড়া-প্রতিবেশী হিসেবে ভাব হবে, দু-বাড়িতে আসা-যাওয়া, অর্চিষ্মানের পিসিকে দময়ন্তী পিসি বলে ডাকবে, অভিজিৎ চায়ের নেমন্তন্ন করবে, চোখের সামনে গর্ভবতী হবে দময়ন্তী, এই চিন্তাই অসহ্য বোধ হয়েছিল অর্চিষ্মানের।

কিন্তু সেজন্যই সে হিমালয়ে পালিয়ে আসেনি। হয়তো তার মনের গভীরে প্রকৃতির প্রতি জোরালো টান ছিল। পাহাড়ের গম্ভীর নীরবতা দেখে সে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিল। মানুষের জীবনে ভালো লাগাটাই তো আসল। কেউ প্রভুত্ব ভালোবাসে, কেউ পছন্দ করে একাকিত্ব।

যোগীবাবার সান্নিধ্যে তার মনের ব্যাপ্তি বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। একটা গাছকেও তীব্রভাবে ভালোবাসা যায়। একগুচ্ছ ফুল, একটা স্বচ্ছতোয়া নদীও হতে পারে ভালোবাসার সামগ্রী। মাঝে মাঝে সে একটা অতীন্দ্রিয় অনুভূতিও বোধ করে। এই দৃশ্যমান সবকিছুর আড়ালে যেন রয়েছে একটা শক্তি। বিকেলের আকাশের রং ফেরা দেখে মনে হয়, এটাই কী ঈশ্বরের করুণার প্রকাশ।

দময়ন্তীকে একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তা সম্ভব নয়। এক এক সময় বিশাল পাহাড়কেও আড়াল করে দময়ন্তীর মুখ ভেসে ওঠে। তারপরই সেই মুখখানি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

সে আগে কোনো মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশেনি, পরেও না। একদিন শুধু চুম্বনের জন্য উদ্যত হয়েছিল, তাও শেষ পর্যন্ত হল না। নারী তার কাছে অনাঘ্রাতাই রয়ে গেল। কোনো আফসোস নেই। নারীর চেয়ে প্রকৃতিও কম কিছু দেয় না। আর যদি ঈশ্বরের জ্যোতির সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে আর কোনো দিকেই মন যায় না।

অর্চিষ্মান একদিন খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিল। সেই মেঘলা দুপুরে পরস্পর গাঢ় চোখাচোখির দৃশ্যটা মনে পড়তেই তার পুরুষলিঙ্গের উত্থান হল। উত্তপ্ত হয়ে উঠল শরীর। কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল।

এ কী হল তার? সে তো দময়ন্তীকে আর কামনা করে না, তবে কেন শরীরের এই চাঞ্চল্য? শরীর কি মনের অধীন নয়? নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল। অনেকক্ষণ ঠায় বসে থেকে সে একসময় উঠে গেল যোগীবাবার কাছে।

যোগীবাবার সঙ্গে তার অনেক বিষয়েই খোলাখুলি কথা হয়। বিনা দ্বিধায় তাঁকে সব ঘটনাটা জানিয়ে দিল। যোগীবাবা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। যেন ধ্যানস্থ হলেন চোখ বুজে। তারপর একসময় তিনি অর্চিষ্মানের হাত ধরে বললেন, তুই আমারটা ধরে দেখ।

অর্চিষ্মান সবিস্ময়ে দেখল, যোগীবাবার পুরুষাঙ্গ লোহার মতন শক্ত!

তিনি বললেন, বেটা, আমি কখনও যোষিৎ সঙ্গ করিনি। তোর মতন কোনো প্রেমিকাকে পিছনে ফেলে আসিনি। ছোটোবেলা থেকেই আমার মিলনেচ্ছা ঈশ্বরের সঙ্গে। তীব্র মিলনেচ্ছাতে এ রকম হয়। এটা শরীরের নিয়ম। দেখবি, এমন দিন আসবে, যখন কোনো নারীর কথা চিন্তা না করলেও ঈশ্বর অনুভূতি হলে পুরুষার্থ জাগ্রত হবে।

যোগীবাবার কথা একদিন ফলে গিয়েছিল। মন থেকে মুছে গেছে দময়ন্তী, আর তার মুখ মনে পড়ে না। সে অনেক পরের কথা।

যোগীবাবার মৃত্যুর পর সাধক অর্চিষ্মান সেই আশ্রম ছেড়ে পাহাড়ের অনেক ওপরে উঠে গিয়ে এক গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। যোগীবাবার ইচ্ছে ছিল, অর্চিষ্মান এই আশ্রমের ভার নিয়ে নেন। কিন্তু বাবার অন্য শিষ্যদের মধ্যে ঈর্ষার ভাব দেখে তিনি সরে এসেছেন। সব সাধু তো এক হয় না। অনেক সাধুর টনটনে স্বার্থজ্ঞানও অর্চিষ্মানের চোখে পড়েছে।

এখানে গ্রাসাচ্ছাদনের কোনো চিন্তা নেই। অর্চিষ্মান নিজের জন্য কিছুই কখনও রান্না করেন না। মাইল পাঁচেক দূরে পোটালা গ্রাম একটি লঙ্গরখানা আছে, গুজরাটের এক সমিতি সেটা চালায়। সেই লঙ্গরখানায় যেতেও হয় না, সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকরা এসে রুটি, গুড়, ছাতু, বাতাসা দিয়ে যায়। খুব ঝড়বৃষ্টির সময় তারা আসতে পারে না, তাতেই বা কী, দু-তিন দিন না খেয়ে থাকলেও কিছু ক্ষতি হয় না শরীরের। অবশ্য মনটা ছটফট করে, কখন আসবে, এই বুঝি এল এরকম অনুভূতি হয়।

মৃত্যুর আগে দুদিন যোগীবাবার বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অর্চিষ্মানের খুব জানতে ইচ্ছে করেছিল, শেষ পর্যন্ত তিনি ঈশ্বরের জ্যোতি দেখতে পেলেন কিনা। শেষ দিনটিতে যোগীবাবার মুখে দেখেছিল অপূর্ব এক হাসি। কী পেয়েছেন তিনি?

কিছু একটা আছে, কোনো এক সময় সেই অনির্বচনীয়কে পাওয়া যাবে, এই বোধটাই জীবনকে উদ্দীপ্ত করে রেখেছে। সারাদিন পাহাড়ের রং বদলায়, মেঘ এসে গুম গুম শব্দ করে, এই সব কিছুর মধ্যেই যেন একটা রহস্য আছে। এতগুলি বছরের মধ্যে একটি দিনও অর্চিষ্মানের একঘেয়ে লাগেনি। তাঁর শাস্ত্র পাঠ করার দরকার হয় না, নিজের উপলব্ধিতেই তিনি এই বিশ্ব বিন্যাসের মধ্যে এক চৈতন্যের সন্ধান পেয়েছেন।

নদীতে স্নান করে ভিজে গায়ে রোদ্দুরে দাঁড়ালেন অর্চিষ্মান। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটার মতন শব্দ হচ্ছে। শরীরটা আজ এত গণ্ডগোল করছে কেন? তিনি কাঠঠোকরা পাখিটিকে খুঁজলেন, পেলেন না। সে উড়ে গেছে। প্রজাপতিরাও নেই। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন, হে সুন্দর, আমাকে শরীর ভুলিয়ে দাও।

আজ যেন বেশি শীত লাগছে। মেঘলা দিনের চেয়ে রৌদ্র ঝলমলে দিনে শীত বেশি পড়ে। এতগুলি বছরে শরীর তীব্র শীতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাতে একটা কম্বলেই চলে যায়।

ভিজে গায়েই কম্বলটা জড়িয়ে নিয়ে অর্চিষ্মান এক পা এক পা করে এগোলেন গুহার দিকে। এখন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কাঠের আগুন জ্বেলে গা সেঁকতে পারলে ভালো হয়।

গুহা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না অর্চিষ্মান। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। কপালটা ঠুকে গেল পাথরে।

আর উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। সর্বাঙ্গ একেবারে অবশ। তিনি ভাবলেন, এ কি তাঁর শেষ মুহূর্ত? তবে আসুক সেই মুহূর্ত, কোনো খেদ নেই।

হঠাৎ যেন অর্চিষ্মানের শরীরের সমস্ত ব্যথা বেদনা চলে গেল। শরীরই যেন নেই, শুধু মন, একেবারে নির্ভার। তাঁর চোখে ফুটে উঠল প্রগাঢ় মুগ্ধতা। দৃশ্যের পর দৃশ্য ঢেউ খেলে যেতে লাগল। পাহাড়চূড়া থেকে গড়িয়ে এল তরল সোনা। তারপর সেই সোনা বদলে গিয়ে হল সাদা রঙের স্নিগ্ধ ধোঁয়া। কোথায় যেন অনেকগুলি আরতির ঘন্টা বেজে উঠল। একরাশ ফুলের পাপড়ির মতন প্রজাপতি ঢেকে দিল সামনের পাথরটা। তারপর সেই ধোঁয়া ভেদ করে এগিয়ে এল একটা আলোর রেখা।

এই কী সেই ঈশ্বরের জ্যোতি। ধন্য, ধন্য এই জীবন। এই আলোর মতন পরম সুন্দর আর কিছু নেই।

সেই আলোর রেখায় ফুটে উঠল একটি মুখ। সেই মুখ দময়ন্তীর।

অর্চিষ্মান প্রথম চিনতে না পেরে চমকে উঠলেন। এই কি ঈশ্বরের রূপ? না, না, এ তো দময়ন্তী, সেই যৌবনের দময়ন্তী, একদিন যার শুধু একটা আঙুল স্পর্শ করেছিলেন অর্চিষ্মান। শেষের দিকে বছরের পর বছর আর দময়ন্তীকে মনে পড়েনি। অথচ এখন অবিকল সেই মুখ, সেই মুখে মাখা রয়েছে বিষাদ।

ভারী ক্লান্ত গলায় দময়ন্তী বলল, অর্চি, তুমি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসনি।

অর্চিষ্মান বললেন, এখন আর সে কথা কেন? কেন এখন এলে? আমি তো আর সেই অর্চিষ্মান নই। তুমি কেন ঈশ্বরের জ্যোতি আড়াল করে দাঁড়ালে?

দময়ন্তী যেন সে কথা শুনতে পেলে না। সে আবার বলল, তুমি আমাকে ভালোবাসনি, তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার গড়া এক নারীকে। আমাকে যত চিঠি লিখেছ, সে সব চিঠি তোমার নিজেকেই লেখা। তোমার ভাসার সাধনা। তুমি আমাকে গ্রহণ করতে চাওনি, তাই প্রথম সুযোগেই একজন পুরুষের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে তুমি দূরে সরে গেলে।

অর্চিষ্মান কাতরভাবে বললেন, না, না, তা ঠিক নয়। যে কটা বছর আর কেউ আসেনি, আমি তোমাকেই শুধু ভালোবেসেছি। তাতে কোনো মিথ্যে ছিল না।

দময়ন্তী বলল, এই তোমার ভালোবাসা? আমি চিঠি দিয়ে তোমাকে ডেকেছি, তুমি সাড়া দাওনি। আমাকে ফেলে কত দূরে চলে গেলে, এতগুলি বছরে আমার কথা একবারও ভাবনি।

অর্চিষ্মান বললেন, এ জীবনে তোমাকে ছাড়া আর কোনো নারীকেই আমি চিনিনি। পাছে তোমার কথা ভুলে যাই, তাই আর কোনো নারীর সঙ্গে মিশিনি। আমার সেই ভালোবাসা অটুটভাবে রেখে দিয়েছি বুকের মধ্যে। প্রথম প্রথম তোমার কথা মনে পড়লে কী কষ্ট যে হত, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সেইজন্য আমি আস্তে আস্তে তোমার মুখচ্ছবিখানি বদলে দিয়েছি। এই যে পাহাড়, এই যে ছোটো নদী, ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি এমনকি কাঠঠোকরা পাখিটির মধ্যেও ভাগ ভাগ করে দিয়েছি তোমাকে। আকাশের রংফেরা তুমি, বাতাসের সুগন্ধ তুমি, পাথরের ডৌল তুমি। সবই তুমি। দময়ন্তী, এইবার এসো, আমাকে তুলে ধরো।

সেই আলোর রেখাটি অর্চিষ্মানের নিষ্পন্দ শরীরে মিশে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *