তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

দন্ত কাব্য

দন্ত কাব্য

দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝলে না!’ এই দাঁত নির্ভর প্রবাদটিতে জীবনের কত বড় একটি সত্য লুকিয়ে আছে। সেই সঙ্গে আছে মানব-শরীরে দাঁতের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত। সংসারে একজন প্রয়োজনীয় মানুষের যখন যথোচিত মূল্য দিতে আমরা ভুলে যাই। গোলে-তালে নিজেদের স্বার্থ নিয়েই হইচই করি, তখন তিনি মহা-অভিমানে দাঁতের উপমা টেনে আনেন। যতক্ষণ সব ঠিকঠাক আছে, কারোর খেয়ালই থাকে না, থাকলে কি হয়, না, থাকলেই বা কি হয়। একজন প্রয়োজনীয় মানুষ আর প্রয়োজনীয় দাঁতের ভূমিকা প্রায় এক। আছে, আমরা কিন্তু আদৌ সচেতন নই। না থাকলেই হায় হায়। Your presence is felt much in your absence. রেমার্কক প্রায় একই সত্য একটু অন্যভাবে বলেছেন, ‘It is a strange fact that if the survivors had only paid half as much attention to many of the departed when they were still alive as they do when it no longer matters, then the corpses would most certainly have forgone the most expensive mausoleum but that’s what mankind is like.’ মানুষ একরকমই, কি মানুষের, কি দাঁতের, যত্ন করতে ভুলে যায়। চলে যাওয়ার পর যাবতীয় হাহাকার, যাবতীয় আদিখ্যেতা, যত পয়সাখরচ। মানুষের সমাধিতে যেমন মর্মর স্মৃতি স্তম্ভের অতুল শোভা, সেই রকম দাঁতের সমাধিতে নকল দাঁতের হাসি।

দন্তোৎপাটন ও নকল দাঁত খরচের ব্যাপার। দাঁত যখন ভোগায় তখন বেদ-বেদান্ত, ধর্মোপদেশ, সুন্দরী রমণী, নৃত্যগীত কোথায় সব ভেসে যায়। Music helps not the toothache. এ কথা আমার নয়, জর্জ হার্বাটের। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ দাঁতের উপমার সঙ্গে ঈশ্বরকে যুক্ত করেছেন। কেশব সেনকে দেখতে গেছেন আদি ব্রাহ্মসমাজের সভায়। পরে একদিন ভক্ত-বৈঠকে সেই স্মৃতিচারণ করছেন। বলছেন,

”কেশব সেনকে প্রথম দেখি আদি সমাজে। তাকের (বেদির) উপর কজন বসেছে, কেশব মাঝখানে বসেছে। দেখলাম যেন কাষ্ঠবৎ! সেজোবাবুকে বললুম, দ্যাখ ওর ফাতনায় মাছ খেয়েছে! ওই ধ্যানটুকু ছিল বলে ঈশ্বরের ইচ্ছায় যেগুলো মনে করেছিল (মান-টানগুলো) হয়ে গেল।”

ঠাকুর এইবার ধ্যানের প্রসঙ্গে আসছেন—”চক্ষু চেয়েও ধ্যান হয়।

কথা হচ্ছে, তবুও ধ্যান হয়। যেমন মনে করো, একজনের দাঁতের ব্যামো আছে, কনকন করে!”

জনৈক একজন হাসতে-হাসতে বলছেন—”আজ্ঞে, ওটা বেশ জানি।”

ঠাকুরও হাসছেন। হাসতে-হাসতে যোগ করছেন—

”হাঁগো, দাঁতের ব্যামো যদি থাকে, সব কর্ম করছে, কিন্তু দরদের দিকে মনটা আছে। তাহলে ধ্যান চোখ চেয়েও হয়, কথা কইতে-কইতেও হয়।”

ঈশ্বরকে যন্ত্রণাদায়ক দাঁতের মতো সদা স্মরণে রাখো, এই হল উপদেশ।

যদি প্রশ্ন করা হয়, দাঁতের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা কী? উৎপাটন। একটা মজার অভিধান লিখেছিলেন Ambrose Bierce এই শতকের আদিতে। বইটির নাম, The Devil’s Dictionary সেখানে আছে ডেন্টিস্টের সংজ্ঞা : ‘A Prestidigitator who, putting metal into your mouth, pulls coins out of your pocket.’

মহাকাল একালের মহা মাস্তানের মতো প্রথমে দাঁত আর চোখ ধরেই টানাটানি করেন। শঙ্কর সেই চিত্র এঁকেছেন অনন্য ভাষায় ও ছন্দে; ‘অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডং, দন্তবিঙ্কিনং জাতং তুণ্ডম।’ As you like it-এ শেক্সপিয়ারও এই একই কথা বলেছেন, Second Childishness and mere oblivion/Sans teeth, Sans eyes, Sans taste, Sans everything’.

সত্য সেই পরম এক—দাঁত আর চোখ গেল তো সব গেল!!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *