দন্তরুচি

দন্তরুচি

প্রেমের জন্য পাগল হইয়া যাইতে বড় কাহাকেও দেখা যায় না। ইতিহাসে একটিমাত্র পাকা নজির আছে : পারস্য দেশে মজনু লয়লার জন্য দেওয়ানা হইয়া গিয়াছিল। আমি আর একটি দৃষ্টান্ত জানি; তিনি বাংলাদেশের নীরদবাবু। বর্তমানে তিনি কাঁকেতে আছেন।

নীরদবাবুর বয়স কত হইয়াছিল আমরা ঠিক জানি না, কিন্তু তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত—বড় জোর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। বেশ মজবুত দেহ, মাথায় টাক পড়ে নাই; বিপত্নীক হইবার পর হইতে নিয়মিত ব্যায়াম করিতেন। সম্প্রতি তাঁহার দাঁতগুলি—

বিজ্ঞান ও ডাক্তারী শাস্ত্রের এত উন্নতি হইয়াছে, কিন্তু দাঁতের কোনও ব্যায়াম আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই—ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয়। কায়কল্পের তপস্বী বাবা মালবীয় মহাশয়ের দাঁতের কি ব্যবস্থা করিলেন জানিবার জন্য আমরা সকলেই উৎসুক আছি।

প্রেমের সহিত দাঁতের সম্বন্ধ নাই—কোনও কোনও লেখক এরূপ মনে করেন। প্রেম চিবাইয়া খাইবার বস্তু নয়, তাহা মানি। কিন্তু সাধারণত প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে দন্তরুচি-কৌমুদী যে অবহেলার বস্তু নয়, তাহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। শকুন্তলার যদি একটিও দাঁত না থাকিত, অথবা রোমিও যদি সদ্যোজাত শিশুর মতো ফোগলা হইতেন, তাহা হইলে তাঁহাদের প্রেম কতদূর অগ্রসর হইত, তা বিবেচনার বিষয়।

কিন্তু যাক্‌, বাজে কথার মোহে নীরদবাবুর নিকট হইতে আমরা দূরে চলিয়া যাইতেছি। শৈশবকালে নীরদবাবুর যাহারা নামকরণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মনে সম্ভবত পরিহাসের অভিপ্রায় ছিল না, কিন্তু বর্তমানে তাঁহার জনৈক সংস্কৃতজ্ঞ বন্ধু এই বলিয়া তাঁহাকে পরিহাস করিতেন যে, তাঁহার নামটি নিম্নোক্তভাবে সিদ্ধ হইয়াছে। যথা—নিঃ+রদ ঃঃ নীরদ। কিন্তু ব্যাকরণ-ঘটিত রসিকতায় আমাদের রুচি নাই।

তাছাড়া, হোয়াট্‌’স্ ইন্ এ নেম!

নীরদবাবু হঠাৎ একটি পার্টিতে গিয়া প্রেমে পড়িয়া গিয়াছিলেন। যুবতীটি চঞ্চলা, রসিকা, কলহাস্যনিপুণা—প্রথম আলাপেই নীরদবাবুর সহিত অন্তরঙ্গের মতো চটুল রহস্যালাপ করিয়া হাস্যবিচ্ছুরিত দশনচ্ছটায় তাঁহার চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দিয়াছিলেন। ফলে, নীরদবাবুর বিপত্নীক হৃদয়কোটরে বহুকালরুদ্ধ বাষ্প বয়লারের মতো তাঁহাকে ফাটাইয়া দিবার উপক্রম করিয়াছিল।

কিন্তু তিনি বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া কেবল মুচকি মুচকি হাসিয়াছিলেন। এই আত্মনিগ্রহের ফলে তাঁহার মুখমণ্ডল আরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

ইহা হইতে কেহ যেন না মনে করেন যে, নীরদবাবু অত্যন্ত লাজুক অথবা বাক্যবিন্যাসে অপটু; তাহা হইলে তাঁহার প্রতি ঘোর অবিচার করা হইবে। পরন্তু তিনি পরম উদ্যোগী পুরুষ, প্রথম দিনের ত্রুটি সংশোধনের জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার অন্তরে পুনরায় সপত্নীক হইবার বাসনা জাগরূক হইয়া উঠিয়াছিল।

নীরদবাবুর মনোহারিণী মহিলাটির নাম—সুদতি দেবী। সম্ভবত, নামটির কোনও মানে আছে, অভিধান দেখিলেই পাওয়া যাইবে। আজকাল অনেক মহিলারই নামের অর্থ জানিবার জন্য অভিধানের শরণাপন্ন হইতে হয়। কিন্তু, হোয়াট্‌’স্ ইন্‌ এ নেম!

উদ্যোগ-আয়োজন সম্পূর্ণ করিয়া একদিন নীরদবাবু সুদতি দেবীর গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন। প্রতিবেশীগণ মুগ্ধবিস্ময়ে দেখিল, তাঁহার মুখে শুভ্রমধুর হাসি ফুটিয়াছে।

ক্রমে প্রণয় দানা বাঁধিতে আরম্ভ করিল। সুদতি দেবীর গৃহে নীরদবাবুর যাতায়াত নিত্যনৈমিত্তিক হইয়া উঠিল। যাতায়াতের কোনও বাধা নাই কারণ শ্রীমতী সুদতি সম্পূর্ণ স্বাধীনা, কোনও একটি বালিকা-বিদ্যালয়ের নৃত্য ও সংগীতের শিক্ষয়িত্রী। ছাত্রীদিগকে নিয়মিত নৃত্য শিক্ষা দিবার ফলে শ্ৰীমতীর যৌবন অতিশয় দৃঢ় ও স্থায়ী হইয়া উঠিয়াছিল; মুখ সর্বদাই হাস্যবিম্বিত। তাহা দেখিয়া নীরদবাবুর দন্তগুলিও সানন্দে বিকশিত হইয়া থাকিত। এইরূপে হাসিতে হাসি মেশামেশি হইয়া উভয়ের মনে রাসায়নিক মাদকতার উদ্ভব হইতে লাগিল।

সত্যই প্রণয়ী ও প্রণয়িনীর হাসিতে অদ্ভুত মাদকতা আছে। কিন্তু কোথা হইতে এই মাদকতা জন্মগ্রহণ করে—কেহ জানে না; হয়তো অশোকফুল্ল রক্তাধরে ইহার জন্ম, হয়তো কুন্দশুভ্র দন্তপংক্তিতে ইহার উদ্ভব! কে বলিতে পারে?

হাসিই তো প্রণয়ের প্রধান অভিব্যক্তি।

দুইজনের মনের কথা হাসির ইঙ্গিতে দুইজনের কাছে প্রকাশ পাইল—অর্থাৎ দুইজনেই রাজী। দুইজনের প্রাণেই যৌবন-জলতরঙ্গ! কে রোধ করিবে? হরে মুরারে!

উভয়েই বিবাহ করিবার জন্য বদ্ধপরিকর। কিন্তু মনের কথা মুখ ফুটিয়া বলা দরকার—নচেৎ বিবাহ হইবে কি করিয়া? শুধু হাসিলে আর যাহাই হোক বিবাহ হয় না। শেষে নীরদবাবুই প্রস্তাব উত্থাপন করিবেন মনস্থ করিলেন।

কিন্তু নীরদবাবুর প্রাণে যৌবনের সঙ্গে কাব্যের জলতরঙ্গও জোয়ারের বেগে প্রবেশ করিয়াছিল। গতানুগতিকভাবে ঘরের কোণে বিবাহের প্রস্তাব করা তাঁহার পছন্দ হইল না। তার চেয়ে মুক্ত আকাশের তলে, গঙ্গার তীরে, সন্ধ্যার সমাগমে পশ্চিম-দিগ্বধূ যখন সোনার স্বপ্ন দেখিবে, সেই সময় নির্জন বনপথে দুইজনে হাত ধরাধরি করিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে—

নীরদবাবু স্থির করিলেন, আগামী রবিবারে তিনি শ্রীমতী সুদতিকে লইয়া মোটরযোগে বটানিকাল-গার্ডেনে বেড়াইতে যাইবেন।

নিজের মোটর চালাইয়া নীরদবাবু বটানিক্যাল-উদ্যানের অভিমুখে চলিয়াছেন; পাশে সুদতি দেবী, নির্জন পথের উপর দিয়া হু হু করিয়া মোটর চলিয়াছে, বায়ুর সুবেগভরে সুদতি দেবীর অঞ্চল উড়িতেছে,—সোনালী অপরাহ্নে উন্মথিত পথের ধুলি যেন আবীর হইয়া উঠিয়াছে।

নীরদবাবুর প্রাণে দুরন্ত আবেগ উপস্থিত হইল। তিনি এক হাতে স্টিয়ারিং ধরিয়া সুদতির দিকে ফিরিলেন, গদ্‌গদ স্বরে বলিলেন, ‘সুদতি, আমি বিপত্নীক।’

সুদতি সম্ভবত পূর্বেই এ সংবাদ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তিনি কেবল মৃদুমধুর হাস্য করিলেন। সন্ধ্যালোকে তাঁহার দাঁতগুলি ঝিকমিক করিয়া উঠিল।

নীরদবাবু কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। নির্জলা সত্য কথা কখনও এরূপ ক্ষেত্রে সুফলপ্রসূ হয় না। তিনি নিজের অবিমৃষ্যকারিতা সংশোধন করিবার জন্য বলিলেন, ‘কিন্তু আমার বয়েস—ইয়ে—পঁয়ত্রিশ বছর।’

সুদতি দেবী সলজ্জভাবে মুখটি নিচু করিয়া বলিলেন, ‘আমার বয়েস —একুশ।’

চিত্রগুপ্ত যদি অন্তরীক্ষে থাকিয়া উক্ত কথাবার্তা শুনিতে পাইতেন তাহা হইলে নিজের হিসাব-নিকাশ লইয়া বড়ই বিপদে পড়িতেন। কিন্তু নীরদবাবুর প্রাণ আর ধৈর্য মানিল না, তিনি স্টিয়ারিং-হুইল ছাড়িয়া দিয়া দুই হাতে সুদতির হাত চাপিয়া ধরিয়া আহ্লাদভরে বলিলেন, ‘সুদতি, আমি তোমাকে—হি-হি-হি তোমার দাঁতগুলি ঠিক মুক্তোর মতো—মানে, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’

মোটরখানা বোধ হয় এই সুযোগেরই অপেক্ষা করিতেছিল, সে নিমেষের মধ্যে পথের ধারের একটা খানা উল্লঙ্ঘন করিয়া পরিপূর্ণ একটি ডিগবাজি খাইয়া চিত হইয়া শুইয়া পড়িল।

সুদতি ও নীরদবাবু ঘাসের উপর ছিটকাইয়া পড়িলেন। দৈবক্রমে দুইজনের দেহই অক্ষত রহিল বটে, কিন্তু আকস্মিক বিপর্যয়ে মাথা ঘুলাইয়া গেল। বহিঃচেতনা ফিরিবার সঙ্গে নীরদবাবু দেখিলেন—তিনি পা ছড়াইয়া ভূমিতলে বসিয়া আছেন এবং তাঁহার সম্মুখে দুই পাটি দাঁত! চমকিয়া নীরদবাবু দাঁতের পাটি নিজ মুখের মধ্যে পুরিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সুদতি দেবীর প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। তিনিও ঘাসের উপর বসিয়া ছিলেন; নীরদবাবু দেখিলেন, সুদতি দেবীও তাড়াতাড়ি দুই পাটি দাঁত মুখের মধ্যে পুরিতেছেন।

কিন্তু এ কি হইল! নীরদবাবুর দাঁত তাঁহার মাড়িতে বসিতেছে না কেন? ওদিকে সুদতি দেবীরও সেই অবস্থা। তবে কি—তবে কি—?

হাঁ, তাই বটে। দাঁত অদল-বদল হইয়া গিয়াছে। মোটরের ঝাঁকানিতে উভয়েরই বাঁধানো দাঁত ছিটকাইয়া পড়িয়াছিল…

হরে মুরারে!

অপরাহ্ন ক্রমে নিবিড় হইয়া আসিতেছে; পশ্চিম-দিগ্বধূ বোধ হয় সোনার স্বপ্নই দেখিতেছেন। নীরদবাবু দাঁতের পাটির দিকে তাকাইয়া হাবলার মতো দন্তহীন হাসি হাসিতেছেন।

নীরদবাবু যে পাগল হইয়া গিয়াছেন, তাহা প্রতিবেশীরা ক্রমশ জানিতে পারিল। একদিন তাহারা দেখিল, নীরদবাবু স্রেফ মাথায় হ্যাট ও পায়ে বুটজুতা পরিয়া খোলা ছাদে পায়চারি করিতেছেন এবং মাঝে মাঝে চিৎকার করিয়া উঠিতেছেন, ‘ফোগলা! ফোগলা! হি-হি-হি!’

শ্লীলতা রক্ষার খাতিরে পাড়ার বিবাহিত লোকেরা পুলিসে খবর দিল; তদবধি নীরদবাবু কাঁকেতে আছেন।

১২ ফাল্গুন ১৩৪৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *