দধীচি সংবাদ (নভেলেট)
আমার হাতে ধরা কিম্ভূতকিমাকার বস্তুটার দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিম্ভূতকিমাকার লোকটা। গলার কণ্ঠাকে অতিকষ্টে কয়েকবার ওঠানামা করিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ওটা কী?’
‘ঘূর্ণিকা।’ শান্ত স্বরে জবাব দিলাম।
‘ঘূ-ঘূ-উ-উর্ণিকা? হতভম্ভ সুরে সে বলে উঠল। তার কপালের কাটা দাগটা বারকয়েক কেঁপে উঠল।
বললাম, ‘বিলিতি ভাষায় যাকে বলে রিভলভার—।’
‘ও—’ সে যেন এবার আশ্বস্ত হল ‘আমি ভেবেছিলাম কী না কী।’
এবার অবাক হলাম আমি। বাংলা শব্দে ভয় পেয়ে তার ইংরেজি অনুবাদে আশ্বস্ত হয় এরকম লোক আমি অন্তত প্রথম দেখলাম। আমার রিভলভারটা সাধারণত কাপড়ের সরু প্যাড দিয়ে সর্বদা জড়ানো থাকে। তাতে শব্দও কম হয়, এবং আঙুলের ছাপটাপের বালাই থাকে না। সেইজন্যেই হয়তো লোকটা মালটাকে প্রথমে চিনতে পারেনি। এখন পারছে।
রিভলভারটা তাক করে ধীরে-ধীরে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, বলুন তো, এমন কোনও কারণ কি আপনার জানা আছে, যার জন্যে আমি আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেই এখান থেকে চলে যাব?’
‘আছে—আমি বাঁচতে চাই।’ ঢোক গিলে সে বলল।
হাসলাম ‘মানছি। কিন্তু আমিও যে বাঁচতে চাই—পুলিশের হাত থেকে। সুতরাং, আমার জন্যে আপনাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। জানেন, দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে দধীচি মুনিও—।’
‘আ—আমার নামও দধীচি—তালুকদার!’ ভয়ে-ভয়ে তড়িঘড়ি বলে উঠল লোকটা।
‘শুনে বড়ই প্রীত হলাম। কারণ, ”দধীচির তনুত্যাগ” কবিতাটাও আমারই লেখা। আমার নাম কবি শ্রীহেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—’ এবং গুলি করলাম।
তারপর ঝুঁকে পড়ে তুলে নিলাম টাকার থলেটা।
বাইরে আসতেই অন্ধকারের আড়াল থেকে ছায়ার মতো বেরিয়ে এল ওরা চারজন। অবনী, নয়ন, পরাশর এবং রোশনলাল। আমি রিভলভার পকেটস্থ করে টাকার থলেটাকে হাতস্থ করে দোকানের দরজা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ওদের প্রতীক্ষায় রইলাম। ওরা সর্তক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে-তাকাতে, আমার কাছে এগিয়ে এল। চাপা গলায় প্রশ্ন করল রোশন, ‘হেমদা, (আমার নাম সত্যিই হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন) কোনও গোলমাল হয়নি তো?’
‘না। গাড়ি কোথায়?’
‘পাশের গলিতে।’
‘চলো।’ বলে আমি পা চালালাম। আমাকে অনুসরণ করল ওরা চারজন। যেতে-যেতে আড়চোখে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, নয়ন আর পরাশর একটু যেন বিহ্বল দৃষ্টিতেই ‘তালুকদার স্টোর্স’ দোকানটার দিকে চেয়ে আছে।
কালো অস্টিনটার কাছে পৌঁছে বহুদিনের অভ্যস্ত ভঙ্গিতে দরজা এক হ্যাঁচকায় খুলে সিটে বসলাম। রোশন বসল গিয়ে ড্রাইভারের আসনে—আমার পাশে। পেছনের সিটে গাদাগাদি করে (কারণ, অবনীর অবনী-প্রমাণ শরীর) অবনী, নয়ন আর পরাশর।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই একবার তাকালাম হাতঘড়ির দিকে। সাড়ে ন’টা। বলা বাহুল্য ‘রাত’ সাড়ে ন’টা।
গ্রে স্ট্রিট ধরে কিছুটা এগোনোর পর মুখ খুলল নয়ন, ‘হেম, আশা করি এতক্ষণে তালুকদার স্টোর্সের ভেতরের কেস জানার অধিকার আমরা পেয়েছি?’
এখানে বলা প্রয়োজন নয়ন আমার চেয়ে বয়েসে বড় না হলেও ছোট নয়। আমাকে ও নাম ধরেই ডাকে। লেখাপড়া এককালে করেছিল—করেছিল প্রেম এবং বিয়েও। তার পরিণতি সন্তান এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় ছোটবেলা থেকে। একই পাড়ায়—দাসপাড়ায়—আমরা মানুষ। নয়ন খারাপ লাইনে এলেও নীতিবাগীশ চরিত্রের দশ পার্সেন্ট এখনও ছাড়তে পারেনি। নিজেকে এখনও ও সমাজের স্বাভবিক একজন মানুষ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নয়নের কথায় ঘুরে ওর দিকে তাকালাম। টাকার থলেটা ছুড়ে দিলাম ওর কোলে। অন্ধকারে ওর চোখ দুটো যেন জ্বলছে। অন্যান্য অবয়ব অস্পষ্ট।
বললাম, ‘এটাই হল কেস।’
তারপর পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে তুলে ধরে বললাম, ‘আর এটা হল শুট-কেস। মানে, গুড়ুম-গুড়ুম।’
গাড়ির স্টিয়ারিং-এ রোশনলালের হাত কেঁপে উঠল। একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে এল পেছনের সিট থেকে।
নয়ন চুপ।
আমি মনে-মনে হাসলাম।
শোভাবাজার এলাকায় আজ রাতে আমরা তিনটে কাজ করেছি। প্রথম দুটো বড় কাজ—বড় দোকানে। শেষেরটা, অর্থাৎ ‘তালুকদার স্টোর্স’-এর কাজটা, বলতে গেলে হঠাৎই ঘটে গেছে। কারণ, মদনমোহনতলার চিলড্রেন পার্কের পাশ দিয়ে আমরা যখন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে পড়ছিলাম, তখনই আমার নজরে পড়েছে টিমটিমে আলো জ্বালা দোকানটা। গাড়ি থামাতে বলে আমি নেমে পড়েছি। ওরা চারজন তখন নীরব অসম্মতি নিয়ে চুপচাপ বসেছিল। তারপর নেহাতই নিয়তির লিখনে দধীচি তালুকদারের তনুত্যাগ এবং কেস ও শুট-কেস-এর জন্ম।
‘এই থলেটায় মাত্র পঁয়ষট্টি টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা রয়েছে।’ জানলার কাছে হাত নিয়ে রাস্তার আলোয় গণনা-পর্যায় শেষ করে নয়ন বলল। ভর্ৎসনা আর ব্যঙ্গের ছোঁওয়া ওর গলায়।
আমার চোখ সামনের নির্জন-অন্ধকার ট্রাম রাস্তায়। জবাব দিলাম, ‘কে যেন বলে গিয়েছেন, ”ক্ষুদ্র বলিয়া করিয়ো না অবহেলা”—আগের দুটো আমদানির তুলনায় তালুকদারের তালুক ক্ষুদ্রই বটে—কিন্তু তা বলে—!’
‘হেমদা—!’ চাপা স্বরে গর্জে উঠল পরাশর। হয়তো কী বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিলাম ‘পরাশর, আর একটা কথা মুখ দিয়ে বেরোলে জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব!’
সবাই আবার চুপ।
কারণ, আমাকে ওরা চেনে। ওরা জানে, কারও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে ছিঁড়তে আমি বড় ভালোবাসি!
মুরারিপুকুরের ডেরায় পৌঁছে শ্বাস-প্রশ্বাস সহজ হয়ে এল আমাদের। রাস্তার বাকি অংশটা আমরা নীরবে অতিক্রম করে এসেছি। অস্টিনটা গ্যারেজের দিকে চালিয়ে নিয়ে চলল রোশনলাল। কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি একটা চালাঘর—বর্তমানে গ্যারেজের ভূমিকায় অভিনয় করছে।
গাড়ি থেকে সবাই নেমে দাঁড়ালাম। রোশন গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে কাঠের দরজা টেনে দিল। তারপর আমরা একসঙ্গে এগোলাম শ’খানেক মিটার দূরে টলোমলো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের টিন-কাঠ দিয়ে তৈরি ডেরার দিকে। যাওয়ার পথে নীরবে টাকার থলেটা আমার হাতে তুলে দিল নয়ন। আমি একবার ওর মুখের দিকে চেয়ে থলেটা নিলাম। অন্য টাকার ব্যাগ দুটো তখন অবনীর হাতে। গাড়ির পেছনের সিট থেকে ও-ই হাতে করে নিয়ে এসেছে।
জং ধরা তালায় জং ধরা চাবি লাগিয়ে একটু কসরত করতেই তালা খুলল। দরজার অবাধ্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দকে অগ্রাহ্য করে ভেতরে ঢুকলাম। আমাকে অনুসরণ করল অবনী, নয়ন, পরাশর আর রোশনলাল। পকেট থেকে লাইটার বের করে সশব্দে জ্বালালাম। অভ্যন্তরীণ জমাট অন্ধকার পিছু হটল। এগিয়ে গিয়ে বাঁ-দিকের ভাঙা টেবিলে দাঁড় করানো মোমবাতিতে আগুন ধরালাম। ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলাম লাইটারের আলো।
লাইটার পকেটে রেখে হাতের ইশারা করতেই অবনী এগিয়ে এল আমার কাছে। টাকার থলেটা আমার হাত থেকে বাঁ-হাতে নিয়ে এগিয়ে চলল দর্মার বেড়ায় ঢাকা দেওয়ালের ওপিঠে লুকিয়ে থাকা একটা খুপরি-ঘরের দিকে।
আমাদের আস্তানাটা নড়বড়ে হলেও আকারে ছোট নয়। বেড়া-কাঠের দেওয়ালে একটা মা-কালীর ফটো, একটা ক্যালেন্ডার, আর আছে সিনেমার পুষি-নায়িকাদের গোটাতিনেক চৌম্বকধর্মী ছবি—আঠা দিয়ে দেওয়ালে সাঁটা। আসবাবপত্র বলতে বাঁ-দিকে দাঁড়ানো খোঁড়া টেবিলটা। একটা কাঠের বেঞ্চ। একটা প্রাগৈতিহাসিক বেতের মোড়া। দুটো কালি পড়া হ্যারিকেন। কয়েকটা পুরোনো খবরের কাগজ। একটা ট্রানজিস্টর—এখনও তা থেকে শব্দ-টব্দ বেরোয়। আর একটা জল ভরা কুঁজো—মুখে গেলাস চাপা দেওয়া।
এসব গেল বাইরের ঘরের কথা। এবার আসি খুপরি-ঘরের কথায়। বড় ঘরটার পেছনের অংশে একটা দর্মার আড়াল দেওয়া। তার ডান পাশে এক পাল্লার একটা দরজা মতন। সেটা পেরোলেই একটা ছোট ঘর। সেখানে দুটো তক্তাপোশে দুটো তেলচিটে বিছানা। একপাশে কাঠের শেলফে গোটাকয়েক মালের বোতল, অ্যাসিডের বোতলও রয়েছে দুটো—মাঝে-মাঝে তালা-টালা ভাঙতে-টাঙতে কাজে-টাজে লাগে। তক্তাপোশের নীচে আছে একটা পুরোনো জং ধরা ট্রাঙ্ক। তাতে কিছু যন্ত্রপাতি এবং হড়কানো অর্থ-সম্পত্তি রাখা হয়। এখন অবনী ঢুকেছে পেছনের সেই খুপরি ঘরে। টাকার থলে তিনটে রাখতে।
ফেরার সময় নিজের বুদ্ধিতেই মালের দুটো বোতল নিয়ে এল অবনী। সঙ্গে দুটো চিঁড়েভাজার প্যাকেট—কখন কিনেছে কে জানে। ততক্ষণে ভাঙা টেবিলের ভাঙা মোমবাতির আলোয় আমরা মোড়া, বেঞ্চ ইত্যাদি দখল করে বসেছি। অবনী এসে ধপাস করে বসে পড়ল মেঝেতেই। বোতল দুটো বাড়িয়ে ধরল যথাক্রমে আমার এবং রোশনলালের দিকে। নয়ন নেশায় অভ্যস্ত নয়। ওর নীতিবাগীশ ক্যারেকটারের দশ পার্সেন্টের এক পার্সেন্টের উদাহরণ।
কিছুক্ষণ গলা ভেজানোর পর টলোমলো পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল অবনী। একটু জড়ানো এবং রূঢ় স্বরে বলল, ‘হেমদা, তালুকদার স্টোর্সের লোকটাকে খুন করে তুমি ভালো করোনি।
পরাশর মৃদু স্বরে বলল, ‘একটা মানুষের জীবনের দাম মাত্র পঁয়ষট্টি টাকা?’
‘লোকটাকে জানে মেরে ফেলার খুব একটা জরুরত ছিল কি?’ রোশনলালের দ্বিধাগ্রস্ত মনের প্রশ্ন ভেসে এল।
আমি এক ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পেছনের ঘরের দিকে এগোতে, এগোতে বললাম, ‘নয়ন, এদের অমৃতবাণীগুলো টুকে নিয়ে কাগজে ছেপে দিস।’
নয়ন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি বাড়ি চললাম, কাল দেখা হবে।’
তক্তপোশে শরীর এলিয়ে দিয়ে তখনও শুনতে পাচ্ছি ওরা তিনজন জড়ানো গলায় পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছে। শোনা যাচ্ছে প্রায়-খালি বোতলের ঠুং-ঠাং শব্দ।
অন্ধকারে জেগে রইলাম। একটা কথা স্পষ্ট বুঝলাম, আজকের খুনটাকে ওরা চারজন সহজ মনে নিতে পারছে না। তা হলে কি আমার সাবধান হওয়া উচিত? কিন্তু রিভলভার একমাত্র আমি ছাড়া আর কারও কাছে নেই। অবশ্য একটা জোগাড় করাও তেমন কঠিন কিছু নয়। মনে হয়, এই দধীচি তালুকদার মারা গিয়ে আমার চার ‘বন্ধুকে’ আজ ‘শত্রু’ করে দিয়ে গেছে।
অবশেষে বুঝলাম, আমি—হেম বাঁড়ুয্যে—ভয় পেয়েছি।
প্রথম দুর্ঘটনাটা ঘটল পরদিন সকালেই।
আমার মানসিক অঙ্কে এত অল্প সময়ের তফাতে এটা আশা করিনি।
সকালে ঘুম ভাঙতেই গত রাতের দধীচি তালুকদার এবং পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা আমার মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করেছে। সুতরাং সেই আড়ষ্ট আচ্ছন্ন ভাবটা কাটাতে বিছানায় উঠে বসে হাত বাড়িয়েছি শেলফের দিকে। আধখালি একটা বাংলার বোতল টেনে নিয়েছি। আলগা করে গলায় ঢালতে যাব, নজরে পড়ল খুপরি-ঘরের দরজা ঠেলে কেউ ঢুকছে।
স্বাভাবিকভাবেই মনোযোগ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হল। চোখের কোণ দিয়ে দরজার ওপর নজর রেখে বোতলটা গলায় উপুড় করে দিয়েছি, চমকে উঠলাম রোশনলালের স্বরে—।
‘ওস্তাদ!’
এবং বিপর্যয়টা তখনই ঘটল আর সেইসঙ্গে বাঁচাল আমার প্রাণ।
কারণ ততক্ষণে বোতলের তরল, আমার চমকানোর সুযোগে, চলকে পড়েছে আমার বুকে গলায়, গায়ে। আর তক্ষুনি অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, বোতলের যে-তরল আমি গলায় ঢালতে যাচ্ছিলাম, সেটা মদ নয়, ঘন নাইট্রিক অ্যাসিড।
বেশ মনে আছে, এক বীভৎস চিৎকারের সঙ্গে-সঙ্গে বিছানায় আমি লুটিয়ে পড়েছি, আর মুণ্ডহীন ধড়ের মতো লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠেছে আমার অ্যাসিডে জ্বলে যাওয়া শরীর। রোশনকে যেন এগিয়ে আসতে দেখেছিলাম বিছানার কাছে…তারপর আর কিছু মনে নেই…।
সজ্ঞান যখন হলাম তখনও আমি বিছানায় শুয়ে। বুকে-গলায় অপটু হাতের পটি—রোশনলালের প্রাথমিক চিকিৎসার স্বাক্ষর। চেতনা ফিরতেই শোয়া অবস্থা থেকে এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসলাম। তীক্ষ্ন যন্ত্রণা গ্রাহ্য করলাম না। বাঁ-হাতে বালিশের নীচ থেকে প্যাড জড়ানো রিভলভারটা বের করে নিলাম। টলোমলো পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রোশনলালের চোখে ভয়ের ছায়া কেঁপে উঠল।
আমি অমায়িক স্বরে প্রশ্ন করলাম, ‘রোশন, তুমি আমার ঘরে কেন ঢুকেছ?’
এতক্ষণ যেটা খেয়াল করিনি, এবার সেই খবরের কাগজটাই আমার চোখের সামনে তুলে ধরল রোশন। তিননম্বর পৃষ্ঠার এক কোণে দধীচি তালুকদারের অপমৃত্যু-সংবাদ। ও বলল, ‘এই খবরটাই তোমাকে দেখাতে আসছিলাম—।
মৃদুস্বরে বললাম, ‘ওরা দেখেছে?’
‘হ্যাঁ, দেখেছে।’
লম্বা পা ফেলে দর্মার দরজা সরিয়ে বাইরের ঘরে এলাম।
অবনী আর পরাশর ভাঁড়ে চা আনিয়ে খাচ্ছিল। আচমকা আমাকে মারমুখী ঢঙে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল। রোশনলাল চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘রোশন, কী হয়েছে ওদের খুলে বলো।’
‘ওরা জানে। তোমার চিৎকার শুনে ওরা ঘরে গিয়েছিল।’ মৃদুস্বরে রোশন উত্তর দিল।
আমি একপলক তাকালাম আমার গায়ে লাগানো কাপড়ের পটির দিকে। তারপর মুখ তুলে জানতে চাইলাম, ‘মালের বোতল আর অ্যাসিডের বোতলের জায়গা পালটির কাজটা কে করেছে?’
ওরা চুপ।
চকিতে অবনীর দিকে এক পা এগিয়ে গেলাম। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো আমার রিভলভার ধরা বাঁ-হাতের উলটোপিঠ আছড়ে পড়ল ওর ফোলা-ফোলা গালে। ওর মুখটা অবাধ্যভাবে ডানপাশে কয়েক ডিগ্রি ঘুরে স্থির হয়ে রইল। ফরসা গাল ফেটে বেরিয়ে এল রক্তের রেখা। অবনীর দৃষ্টি নিষ্পলক।
‘কে করেছে, অবনী?’
‘আমি নয়।’ বিড়বিড় করে ও জবাব দিল।
‘পরাশর?’ ঘুরে তাকালাম পরাশরের দিকে।
‘আমি জানি না।’
আমি হাসলাম। রোশন, অবনী, পরাশর মেঝের দিকে তাকিয়ে। হাসতে-হাসতেই বললাম, ‘অতএব তোমরা যখন মিথ্যে কথা বলছ না, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে, আজ সকালে হঠাৎ মাথাখারাপ হয়ে গিয়ে আমি দশ বছরের পুরোনো কালীমার্কার নেশা ছেড়ে নাইট্রিক অ্যাসিডের নেশা শুরু করতে গেছি—আর তাতেই এই কেলো…’
আমি জোরে হেসে উঠলাম।
ওদের তিনজনের শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠল। ওরা ভয়ের চোখে আমার দিকে তাকাল। কারণ, আমার হাসির শব্দ ছাপিয়ে রিভলভারের সেফটি ক্যাচ খোলার শব্দ ওদের কানে গেছে।
সাজানো দুর্ঘটনা আমি একেবারে পছন্দ করি না। কারণ সাজানো দুর্ঘটনা কাপুরুষের হাতিয়ার। আর, পুরুষের অবলম্বন…।
রিভলভারটা তুলে ধরতেই সদর দরজা সশব্দে খুলে গেল। বিস্মিত নয়নের প্রবেশ এবং প্রশ্ন, ‘কী ব্যাপার, হেম, কী হচ্ছে এসব?’
হঠাৎ আমি গভীরভাবে ভাবতে লাগলাম। ক্ষিপ্র চিন্তায় সিদ্ধান্তে পৌঁছে রিভলভার নামিয়ে নিলাম। বললাম, ‘নয়ন, জল ঢেলে পা ধুয়ে আয়। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে তোর মেহেরবানি কবুল করে এই তিনটে কুত্তা অন্তত কিছুক্ষণ তোর পা চাটুক।’
আর দাঁড়ালাম না। স্থবির হয়ে দাঁড়ানো রোশনের হাত থেকে খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে ঢুকে পড়লাম খুপরি ঘরে।
আসন্ন দ্বিতীয় দুর্ঘটনার জন্যে মনকে ধীরে-ধীরে তৈরি করতে লাগলাম।
আমার তালিকায় অ-সন্দেহভাজনের সংখ্যা চিরকালই শূন্য। সুতরাং খবরের কাগজের খবরটা প্রথমে মনোযোগ দিয়ে পড়লাম:
গতকাল শোভাবাজার মদনমোহনতলা এলাকায় জনৈক দোকানদার কোনও এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়। সেইসঙ্গে দোকানের ক্যাশ বাক্সের টাকা অদৃশ্য হয়। পুলিশের সন্দেহ গতরাতের অন্যে দুটো ডাকাতির সঙ্গে এ-খুনের সম্পর্ক রয়েছে। তদন্ত চলছে।
অতঃপর শুরু হল আমার বিশ্লেষণ। প্রথমে নয়ন সেনের পালা।
ভেবে দেখলাম, গতকাল রাতে ও খুপরি-ঘরে ঢোকেনি। আজ সকালেও এসেছে দেরিতে। সুতরাং মদের বোতল এবং নাইট্রিক অ্যাসিডের বোতলের জায়গা বদলের কাজটা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
অতএব বাকি রইল অবনী, পরাশর আর রোশনলাল। এদের তিনজনেরই ছিল সমান সুযোগ। তা ছাড়া গত রাতে অবনী আমার সামনেই ও-ঘরে ঢুকে মদের দুটো বোতল বের করে এনেছিল। হয়তো সেই সময়েই…।
চিন্তা করতে গিয়ে দেখলাম, পরাশর আর রোশনলালের পারসোনাল লাইফ সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানি না।
অবনীর বাবা গাড়ি কেনা-বেচার দালালি করত। অবনীই আমাকে জুটিয়ে দিয়েছিল এই ঝরঝরে অস্টিনটা। অবনী বিয়ে করেনি। সংসার ছেড়ে ও আমার সঙ্গে আছে আজ চারবছর। ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ একটা মালের দোকানে।
পরাশর বারতিনেক জেল খাটার পর কেমন করে যেন আমার সঙ্গে ভিড়ে গেল।
সেও প্রায় বছর তিনেকের কথা। পরাশরের বয়েস অল্প। চোখে-মুখে কেমন একটা একরোখা ভাব রয়েছে। সম্ভবত ওয়াগন-ব্রেকার হিসেবে পুলিশের সঙ্গে ঘন-ঘন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ওর চেহারায় এই অদ্ভুত কাঠিন্য এনে দিয়েছে।
রোশনলাল বয়েসে মাঝামাঝি। এই দু-নম্বরি পথে ও আছে অনেকদিন। কিন্তু ওর নার্ভাস-প্রকৃতিটা এখনও ওর সঙ্গ ছাড়েনি। গুণের মধ্যে, রোশন ভালো গাড়ি চালায়।
নয়ন বাড়ি ছেড়ে বিয়ে-থা করেছে আজ দশবছর। অনেকদিন টানাপোড়েনের মধ্যে কাটিয়ে অবশেষে ও হাত পেতেছিল আমার কাছে। ক্রমে-ক্রমে একরকম নিরুপায় হয়েই ও আমার সঙ্গে মিশে গেছে। মাঝে-মাঝে তাই দুঃখ করে বলে, ‘আমি মারা গেলে আমার না-খেতে পাওয়া ছেলেমেয়েগুলোকে আর আমার বউটাকে দেখিস।’
নয়নের ধারণা ওর বউ চরিত্র বিক্রি করেছে। আমার কিন্তু তা মনে হয় না। কারণ ললিতাকে আমি বিয়ের আগেও চিনতাম।
এতদিন একসঙ্গে কাটানোর পর আমাকে চিনতে ওদের আর বাকি নেই। বড়লোক বাবা-মায়ের কোল ছেড়ে কীসের নেশায় যে এ-পথে পা বাড়িয়েছি সে-কথা আজ আর স্পষ্টভাবে মনে পড়ে না। মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়া আমার পেশা নয়, নেশা। আমার এ-নেশার কথা ওরা চারজনও জানে। তা হলে দধীচি তালুকদারকে খুন করার জন্যে ওরা কেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে?
ভেবে দেখলাম, এই চারজনের মধ্যে কোনও একজন প্রতিহিংসা মেটাতে চায়। কারণ? কারণ, হয়তো পঁয়ষট্টি টাকার বিনিময়ে প্রাণহানির ব্যাপারটা সে ঠিক সরল মনে হজম করতে পারছে না, তাই প্রতিবাদে মুখর হয়েছে।
সেই বিশেষ একজনের মুখোশ খোলার নিটোল পরিকল্পনা মনে-মনে ছকে নিয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরের ঘরে এলাম।
ওরা চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে।
পরাশর মাথা নীচু করে হাতের নখ খুঁটছে। নয়নের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। অবনী মুখ নেড়ে কী যেন চিবোচ্ছে—সম্ভবত চানাচুর। রোশন একদৃষ্টে চেয়ে আছে দেওয়ালে সাঁটা জনপ্রিয় নায়িকার জনপ্রিয় বুকের দিকে।
আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ওরা চারজন চোখ ফেরাল আমার দিকে। এবং আশ্বস্ত হল। কারণ, আমার হাতে রিভলভার নেই।
একপাশে পড়ে থাকা মোড়াটা টেনে নিয়ে বসলাম। নয়নের দিকে চেয়ে বললাম, ‘নয়ন, তোদের চারজনের একজন আমাকে খুন করতে চাইছে।’
‘সেটা তোর ধারণা—’ ও তাচ্ছিল্যভাবে জবাব দিল।
‘ধারণা, কিন্তু কারেক্ট।’ শীতল স্বরে জবাব দিলাম, ‘যাক সে কথা।…সেই একজনকে আমি আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। তারপর আর কোনও প্রশ্ন কাউকে করব না। হেম বাড়ুয্যেকে তোমরা চেনো। তোমাদের মতো ভেড়ুয়াদের শায়েস্তা করে সে মাথার চুল পাকিয়েছে। সুতরাং সেই একজনকে এই পৃথিবীতে জন্মেছিল বলে রীতিমতো দুঃখ করতে হবে।
কথা শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম। ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ‘নয়ন, তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু। ললিতাও আমাকে অনেক দিন ধরে চেনে…জানে। ওকে বিধবা করতে হলে আমি নিজেই ভীষণ কষ্ট পাব। বিশ্বাস কর, সত্যি বলছি।’
ডেরা ছেড়ে পা বাড়ালাম রাস্তার দিকে। ডাক্তারখানায় যাব। কারণ, রোশনের অপটু হাতের ব্যান্ডেজ বুকে বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছে। মোটামুটি একটা চিকিৎসা করানো দরকার।
যাওয়ার পথে মুচিবাজার পার হতে গিয়ে মনে পড়ল, রথের দিন আমি আর নয়ন বছরের-পর-বছর ধরে ফুটপাথে পাঁপড় ভাঁজা কিনে খেয়েছি। স্কুলেও একসঙ্গে গিয়েছি বেশ কিছুদিন। তারপর…।
কৈশোরের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা মনে পড়ল বলতে ইচ্ছে করে: কৈশোর তোমার মতো গদ্দারি এই দুনিয়ার আর কেউ আমার সঙ্গে করেনি!
প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক পর—বেলা বারোটা নাগাদ—টলতে-টলতে ডেরায় ফিরলাম। নয়ন বেঞ্চে বসে খবরের কাগজটা পড়ছিল, আমার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। কাগজটা ফেলে রেখে ছুটে এল আমার কাছে। আমার অনিশ্চিত ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরটাকে জাপটে ধরল! উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী রে, হেম? কী হয়েছে তোর?’
আমার গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। নয়নের কাঁধে ডানহাতটা রাখলাম। মাথা ঝুঁকিয়ে ফিসফিস করে বলতে চাইলাম, ‘আমাকে বাঁচা, নয়ন। ওরা আমাকে খুন করতে চাইছে।’ নয়ন নীরবে আমাকে নিয়ে চলল খুপরি-ঘরের দিকে।
বিছানায় শুয়ে করমচা-লাল চোখে চোখ রাখলাম নয়নের চোখে। কাঁপা হাতে ওর ডানহাতটা চেপে ধরলাম। চাপা স্বরে প্রশ্ন করলাম, ‘ওরা কোথায়?’
নয়ন অবাক চোখে আমার মুখের, শরীরের ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়েছিল, বলল, ‘খেতে গেছে—হোটেলে। কিন্তু হেম, কী হয়েছে তোর? মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে।’
‘হ্যাঁ, নয়ন। আজ সকালের কেস তো তুই জানিস। রোশনের বেঁধে দেওয়া ব্যান্ডেজ নিয়ে আমি গিয়েছিলাম ডাক্তার পালের কাছে, আরিফ রোডে। সেই ব্যান্ডেজ কেটে নতুন ব্যান্ডেজ করতে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে গেছেন। অবাক হয়েছি আমিও। কারণ, ব্যান্ডেজ বাঁধার আগে কেউ—হয়তো রোশনই—আমার কাটা জায়গায় ধুলো আর লোহার মরচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে। ডাক্তার পাল শুধু বললেন, ‘হেমবাবু আর ঘণ্টা পাঁচ-ছয় অপেক্ষা করলেই পারতেন, ডাক্তার খরচটুকু বেঁচে যেত। টিটেনাসের সঙ্গে শ্মশানের যা রিলেশান, তাতে শেষ নিঃশ্বাসটুকুও ঠিকমতো ফেলার আর টাইম পেতেন না।” টিটেনাস টক্সয়েড নিয়ে, নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে, ফিরে আসতে-আসতে শুধু একটা কথাই আমার মাথায় ঘুরছিল—অবনী, পরাশর, রোশন—ওদের তিনজনের একজন আমাকে খুন করতে চায়। কে বল তো?’
আমার আগ্রহে ফেটে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে নয়ন বিহ্বলভাবে মাথা নাড়ল ‘জানি না। তবে এখনও আমার মনে হচ্ছে তুই কোথায় একটা ভুল করছিস।’
‘না, নয়ন।’ চাপা হিংস্র স্বরে গর্জে উঠলাম, ‘ভুল আমার হয়নি। শুধু তোকেই বলে রাখছি, আসল লোককে বের করার তুরুপের তাস আমার হাতের মুঠোয়। যে-কোনও মোমেন্টে আমি তার মুখোশ খুলে দিতে পারি! কিন্তু আজকের দিনটা আমি ওয়েট করব। তারপর…।’
‘এখন একটু বিশ্রাম কর।’
দু-হাতে নয়নের হাত চেপে ধরলাম।
‘নয়ন, আমার যে ঘুমোতেও ভয় করছে। বুকভরা ভয় নিয়ে কেউ কখনও গদ্দারদের সঙ্গে একই ছাদের নীচে ঘুমোতে পারে?’
নয়ন উঠে দাঁড়াল। ওর মুখে আচমকাই নেমে এল কঠিন ছায়া। ও বলল, ‘খুব পারে। ললিতার সঙ্গে একই ছাদের নীচে আমি ঘুমোচ্ছি আজ দশবছর।’ নয়ন পা বাড়াল বাইরের ঘরের দিকে। যেতে-যেতে বলে গেল, ‘ভয় পাস না। নয়ন সেন এখনও তোর বন্ধুই আছে। তা ছাড়া ওরা তিনজন ফিরুক। আমি ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।’
বিকেল পাঁচটায় ঘুম ভাঙলে টের পেলাম, শরীরে অসহ্য ব্যথা। এবং তার সঙ্গে তেজি খিদে। অতি কষ্টে সোজা হয়ে বসলাম। মাথাটা আচমকা ঝিমঝিম করে উঠল। মনে হল, কেউ যেন লোহার সাঁড়াশি দিয়ে রগের পাশ দুটো চেপে ধরেছে।
শুরুর আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেলে উঠে দাঁড়ালাম। হাত বাড়িয়ে শেলফ থেকে মালের বোতল তুলে নিলাম। অতি সন্তর্পণে বোতলের তরল পদার্থ পরনের জামার এক কোণে সামান্য ঢাললাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন কোনও অ্যাসিডের প্রতিক্রিয়া নজরে পড়ল না, তখন ধীরে ধীরে গলায় উপুড় করে দিলাম বোতলটা। শুকনো জিভের তেতো আস্বাদটা কালী মার্কার কৃপায় কেটে গেল। বোতলটা তাকে ফিরিয়ে রাখতে যেতেই আমার অবসাদে ক্লান্ত হাত কেঁপে উঠল। মেঝেতে ঠিকরে পড়ল বোতলটা। ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ‘বাংলা’র তীব্র গন্ধে খুপরি-ঘরটা ভরে গেল।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা ঠেলে উঁকি মারল নয়ন। বলল, ‘ও—তুই উঠেছিস। দাঁড়া আসছি—’ বলেই পলকের মধ্যে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ক্লান্ত শরীরের ভারসাম্য রাখতে বিছানার ওপরে বসে পড়লাম।
একটু পরে একটা ঠোঙায় করে মুড়ি, পেঁয়াজ, আর গোটাকয়েক তেলেভাজা নিয়ে এল নয়ন। বলল, ‘নে—খেয়ে নে। রাসুকে চা আনতে বলেছি।’
আমি ওর দ্বিতীয় কথার অপেক্ষা না করে মুড়ির ঠোঙায় হাত চালাতে শুরু করলাম।
খেতে-খেতে হঠাৎই লক্ষ করলাম, নয়নের জ্বলজ্বলে চোখজোড়া আমার মুখে সেঁটে আছে। আমাকে অবাক চোখে তাকাতে দেখে ও বলল, ‘নাঃ, তুই দেখছি এখনও আমাকে খুব বিশ্বাস করিস, হেম!’
‘কেন?’
‘কারণ, আমার দেওয়া খাবার তুই সন্দেহ করিসনি।’
আমি কোনও জবাব দিলাম না।
নয়ন নিজের মনেই বলে চলল, ‘আমি দুপুরে ওদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তোকে সরানোর চেষ্টার ব্যাপারটা ওরা তিনজনেই সমানে ডিনাই করছে। কী জানি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘ওরা কোথায়?’ খেতে-খেতেই প্রশ্ন করলাম।
‘বাইরের ঘরে শুধু অবনী রয়েছে। রোশন আর পরাশর বেরিয়েছে।’
‘অবনীকে ডাক।’
নয়ন গলার স্বর উঁচু পরদায় তুলে ওকে ডাকল।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অবনী এবং রাসুর চায়ের দোকানের নুলো ছেলেটা এক ভাঁড় চা নিয়ে খুপরি-ঘরে এসে ঢুকল। অবনীর হাতে খবরের কাগজটা।
অবনী চুপচাপ সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আমি ছোঁড়াটার হাতে পনেরোটা পয়সা দিয়ে চায়ে চুমুক দিলাম। তারপর অবনীর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, ‘অবনী, আজ সকালে রোশন যখন আমার বুকে ব্যান্ডেজ করে দেয় তখন এ-ঘরে আর কে-কে ছিল?’
‘আমি আর পরাশর।’
‘কেউই ঘর ছেড়ে যায়নি?’
‘পরাশর একবার বাইরে গিয়েছিল ব্যান্ডেজের কাপড় আনতে। ওর দেরি হচ্ছিল বলে আমি রোশনকে তোমার কাছে থাকতে বলে বাইরের ঘরে একবার বিড়ি ধরাতে গিয়েছিলাম। তখনই দেখি পরাশর ফিরে আসছে।’
আমি ঘুরে তাকালাম নয়নের দিকে।
‘ব্যান্ডেজের কেসটা ওদের বলেছিস?’
‘হ্যাঁ, বলেছি—কিন্তু…।’
‘কিন্তু ওরা সবাই সে-কথা ডিনাই করেছে, তাইতো?’ আমি ব্যঙ্গভরে হাসলাম।
অবনী রুক্ষ স্বরে বলে উঠল, ‘আর কিছু জানতে চাও, হেমদা?’
আমি নিঃশব্দে ডানহাত ঢুকিয়ে দিলাম বালিশের তলায়। রিভলভারটা পরখ করতে-করতে চাপা স্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ, জানতে চাই। জানতে চাই তোমাদের মধ্যে কার আয়ু আগামীকাল শেষ হতে চলেছে। আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় বড় অল্প, তাই না অবনী?’ এবার ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। নয়নের নীরব অনুনয়ের দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। শান্ত স্বরে বললাম, ‘অবনী, তুই আর ওই কুত্তার বাচ্চাদুটো কাল সকালে এখানে হাজির থাকিস। তখনই দেখবি হেম বাঁড়ুয্যের দাবার শেষ চাল! তালুকদার স্টোর্সের ওই বুড়োর জন্য সাগরের ঢেউ তোদের বুকে আছাড় মারছে, তাই না? এবার ফোট।’
একইসঙ্গে আমরা অভিব্যক্তির ইশারা পেয়ে বেরিয়ে গেল অবনী।
আমি ফিরে এসে বসলাম বিছানায়। নয়নকে বললাম, ‘ওরা ফিরলে আমাকে খবর দিস। আর শোন, অবনীর কাছ থেকে খবরের কাগজটা আমাকে দিয়ে যাস।’
‘আচ্ছা।’ উঠে দাঁড়াল নয়ন: ‘তবে আমি বেশি রাত করব না, হেম। ছোট ছেলেটার একটু জ্বর-জ্বর মতো হয়েছে। মানুষের মরার চেয়ে বেঁচে থাকাতেই বেশি কষ্ট।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল নয়ন।
একটু পরে নয়নের দিয়ে যাওয়া খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে সেই বিশেষ খবরটা আমি আবার পড়তে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম আমার মারকাটারি প্ল্যানের কথা।
তৃতীয় দুর্ঘটনাটা একেবারে চরমে পৌঁছল।
রাত তখন সাড়ে এগারোটা। খাওয়াদাওয়া সেরে বেশ কিছুক্ষণ হল ঘুমিয়েছি। ঘুমোনোর আগে ওদের তিনজনকে ডেকে আগামীকাল সকালই যে গদ্দারের লুকিয়ে থাকার টাইম লিমিট সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছি। যথারীতি নিজেদের সাফাই দিয়েছে ওরা তিনজনেই। তারপর বাইরের ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে।
এমনিতে ঘুম আমার গভীরে। কিন্তু আজ, বিশেষ করে বুকের জ্বালা আর মনের অন্ধ আক্রোশ, এই দুয়ের জন্যে অন্যান্য রাতের মতো সহজে ঘুম আসেনি। অন্ধকারে শুয়ে-শুয়ে ভেবেছি তিনজনের মধ্যে কে? অবনী? পরাশর? রোশনলাল? নাকি যাকে রেখেছি সব সন্দেহের সীমার বাইরে, সেই নয়ন সেনই এ দুর্ঘটনাগুলোর পরিচালক এবং প্রযোজক।
এই জটিল চিন্তাভাবনার মধ্যেই একটা চাপা খসখস শব্দ আমার কানে এল। কানে এল দর্মার দরজা সরানোর শব্দ।
বুঝলাম, কেউ খুপরি-ঘরে ঢুকছে।
স্বাভাবিক সতর্কতায় বাঁ-হাত চলে গেল বালিশের নীচে। আঁকড়ে ধরলাম প্যাড জড়ানো রিভলভারের বাঁট। জমাট অন্ধকার ভেদ করে দরজার দিকে নজর ফেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফালতু চেষ্টা। তাই সাবধানে বিছানা ছেড়ে নেমে এলাম মেঝেতে। গড়িয়ে গড়িয়ে সবেমাত্র ঠান্ডা মেঝে ছুঁয়েছি, দর্মার দরজা পুরোটা খুলে গেল। দরজায় ভেসে উঠল একটা ছায়াশরীর।
নাকে মদের হালকা গন্ধ, হাতে রিভলভার, মনে ঝঞ্ঝা—এই তিনকে সঙ্গী করে আমি অপেক্ষায় রইলাম। বুকের ভেতরে একপাল সৈন্য নিখুঁত তালে মার্চ করে চলেছে—ধুপ…ধুপ…ধুপ…ধুপ…।
অন্ধকারের পটভূমিতে জমাট অন্ধকার শরীরটাকে আমার বিছানার দিকে আরও খানিকটা এগোতে দেখে আমি রিভলভারটা ডানহাতে নিয়ে উঁচিয়ে ধরলাম। আর ঠিক তখনই যন্ত্রণায় ‘উঃ’ করে চেঁচিয়ে উঠলাম। না, আমার বুকের ব্যথা নয়, বিকেলে ভেঙে যাওয়া বোতলটার একটুকরো কাচ—যা পরিষ্কার করার সময় পরাশরের নজরে পড়েনি। সেই কাচে কনুই লাগতেই আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অস্ফুট আর্তনাদ।
সঙ্গে-সঙ্গে অন্ধকারের বুক চিরে দেখা গেল নীল আলো। আগন্তুকের রিভলভারে গুলি ছুটে এসেছে আমার বিছানা লক্ষ্য করে। আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। আক্রোশ ফেটে পড়ল আমার রিভলভারের নল। পাগলের মতো দরজা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে চললাম। কারও ছুটে পালানোর দুদ্দাড় শব্দ পেলাম। তারপরই একটা গুঞ্জন ভেসে এল পাশের ঘর থেকে। শোনা গেল পরাশর, অবনী আর রোশনের গলা, ‘কী হল, হেমদা?’
আমি মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই ওরা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে হুড়মুড় করে এসে ঢুকল আমার ঘরে। আমি রিভলভারটা শক্ত মুঠোয় চেপে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর বসে পড়লাম বিছানায়। অন্ধ ক্রোধে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছে না।
ওদের প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে শুধু বললাম, ‘নয়নকে ওর বাড়ি থেকে কেউ ডেকে নিয়ে এসো—এখুনি।’
নীরবে ঘর ছাড়ল রোশনলাল। আমি বিছানা ছেড়ে পা বাড়ালাম বাইরের ঘরের দিকে।
বাইরের ঘরে আসবাবপত্র কম থাকায় একটু খোঁজাখুজি করতেই পাওয়া গেল রিভলভারটা। সদর দরজা হাট করে খোলা। যেন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা, এই অপকীর্তি বাইরের কোনও লোকের। রিভলভারের ম্যাগাজিন খুলে দেখি তাতে কোনও গুলি নেই।
রিভলভারটা বাঁ-হাতে পকেটে পুরে হ্যারিকেনের আলোটা জোর করে দিলাম। ওদের ডেকে বললাম মোমবাতিটা এ-ঘরে নিয়ে আসতে এবং অন্য হ্যারিকেনটাও জ্বেলে দিতে।
ওরা নীরবে আদেশ পালন করলে কাঠের বেঞ্চটা আঙুল দিয়ে দেখালাম: ‘অবনী, পরাশর, তোমরা ওই বেঞ্চটায় বোসো।’
আমি গিয়ে বসলাম মোড়াটায়। তারপর চলল চুপচাপ অপেক্ষা।
প্রায় আধঘণ্টা বাদে ফিরে এল রোশনলাল, সঙ্গে নয়ন। নয়নের চোখে-মুখে ঘুমের ছাপ। দেখে বোঝা যাচ্ছে, কোনওরকমে তালিমারা পাঞ্জাবি আর চটিটা গায়ে-পায়ে গলিয়ে ও চলে এসেছে।
আজ নয়ন আর প্রশ্ন করল না, ‘কী ব্যাপার, হেম? এত রাতে হঠাৎ তলব?’ কারণ, ও বোধহয় ঘরের থমথমে পরিবেশ এবং আমার মুখ দেখে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল।
নয়নের দিকে চেয়ে হেসে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘নয়ন, তুই কষ্ট করে টেবিলটায় বোস। রোশন, তোমার জন্যে অবনীর পাশে জায়গা খালি রয়েছে—যাও, বোসো।’
সকলে বসার পর সংক্ষেপে নয়নকে নতুন ঘটনার কথা জানালাম। তারপর পকেট থেকে বের করে নিলাম অচেনা রিভলভারটা। প্রশ্ন করলাম, ‘এটা কার?’
সবাই চুপ।
‘ঘড়ির কাঁটায় আমার দেওয়া আটচল্লিশ ঘণ্টা শেষ না হলেও আমার হিসেবে সে-আটচল্লিশ ঘণ্টা আজ, একটু আগেই, শেষ হয়ে গেছে। এ-কথা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে, অবনী, রোশন, অথবা পরাশর—তোমরা তিনজনের একজন আমাকে খুন করতে চাও।’
‘বাজে কথা!’ বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অবনী।
‘অবনী, বোসো। আর একটু পরেই যখন এ-ঘরে একটা বডি পড়ে থাকবে তখনই বোঝা যাবে কার কথা কতটুকু ঠিক।’
অবনী বসল। ওদের মুখে একটা উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের ছাপ।
‘ঘটনার শুরু কাল রাতে—’ আমি দাঁড়িয়ে থেকেই বলতে শুরু করলাম, ‘যখন তালুকদার স্টোর্সের লোকটা আমার হাতে খুন হয়। আমার মনে হয়েছিল, সেই খুনটাকে তোমরা কেউই ভালো চোখে দ্যাখোনি—এমনকী নয়নও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তোমরা আমাকে মার্ডার করতে চাইবে। অথচ তাই ঘটছে। তিন-তিনবার আমাকে—হেম বাঁড়ুয্যেকে—মার্ডার করার চেষ্টা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাপার আমি বিন্দুমাত্রও লাইক করি না। সুতরাং—’ ফিরে তাকালাম নয়নের দিকে ‘নয়ন, ও-ঘর থেকে কালকের কাগজটা নিয়ে আয়।’
নয়ন কাগজটা নিয়ে এসে দিল আমার হাতে। তারপর আবার গিয়ে বসল ভাঙা টেবিলে—ওর জায়গায়।’
কাগজটা ভাঁজ করা অবস্থায় রেখেই বলে উঠলাম, ‘রোশন, তালুকদার স্টোর্সের লোকটাকে তুমি চিনতে? খবরের কাগজে লোকটার নাম দিয়েছে, কিন্তু ঠিকানা দেয়নি।’
‘না, চিনি না—।’ জবাব দিল রোশনলাল।
‘অবনী?
‘আমি কী করে জানব—।’
‘পরাশর?’
পরাশর নীরব।
আমি হাসলাম। রিভলভার হাতে নাচাতে-নাচাতে বলে চললাম, ‘লোকটা হেভি সহজ-সরল। প্রথমে আমার হাতে এটা দেখে বুঝতেই পারেনি এটা রিভলভার। অবশ্য কপালে গুলি বেঁধার পর এই কিম্ভূতকিমাকার মালটা যে কী, সেটা বুঝতে লোকটার এতটুকুও অসুবিধে হয়নি—।’
‘হেমদা!’ গর্জে উঠল অবনী, ‘তালুকদার স্টোর্সের লোকটাকে খুন করতে তোমার লজ্জা করল না?’
আমি হিংস্রভাবে হাসলাম, ‘কেন, তোমার তাতে কী প্রবলেম হয়েছে?’
‘ক্ষতি-অক্ষতির কোশ্চেন না। তবুও বেহুদা মার্ডার করবে?’
‘তোমার দেখছি বিবেক জেগে উঠেছে! কিন্তু বিবেক শুধু তোমারই রয়েছে—নয়ন, রোশন, পরাশরের নেই?’
‘নেই কে বলল? আছে।’ উঠে দাঁড়াল নয়ন: ‘হেমকে আমি আগেও সে-কথা বলেছি।’
‘ওস্তাদ—’ এবারে রোশন মুখ খুলল, ‘পঁয়ষট্টি টাকা কখনও একটা জানের দাম হতে পারে না।’
‘পারে, খুব পারে। ওরকম একটা ভিতু কুত্তার জানের দাম ওর চেয়ে বেশি কোনওদিন ছিল না।’
‘হেমদা।’ উঠে দাঁড়াল পরাশর: ‘দধীচি তালুকদার তোমার কী ক্ষতি করেছিল যে, তুমি তাকে সামান্য ক’টা টাকার জন্যে খুন করলে?’
আমার মাথার ভেতরে যেন বজ্রপাত হল! মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। রিভলভারের বাঁটে আমার পাঁচ আঙুল ইস্পাত হয়ে চেপে বসল। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। শত চেষ্টাতেও গলার স্বর অবাধ্য ভঙ্গিতে কেঁপে উঠল: ‘পরাশর, দধীচি তালুকদারের নাম তুমি কী করে জানলে?’
বেঞ্চ ছেড়ে কাঁপতে-কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। অবনী। বিস্ফোরণের আভাস পেয়ে চাবুকের মতো তৎপর হয়ে দাঁড়াল নয়ন। হতভম্ব রোশনলাল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ওরা তিনজনেই বিড়বিড় করতে লাগল, ‘দধীচি তালুকদার—দধীচি তালুকদার।’
পরাশর আমার প্রশ্নের জবাবে বলে উঠল, ‘খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি।’
নিষ্পাপ অভিব্যক্তিতে কাগজটা ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ও উন্মাদের মতো পাতা হাতড়ে খবরটা বের করল। বারকয়েক মনে-মনে সেটার ওপর চোখ বুলিয়ে যখন মুখ তুলে তাকাল তখন ওর মুখের চামড়ায় ধূসর প্রলেপ। কিন্তু আর তো ফেরার পথ নেই! আমার ফাঁদে ও পা দিয়ে ফেলেছে।
কয়েক মুহূর্ত নিটোল নিস্তব্ধতা।
তারপর মুখ খুললাম, ‘পরাশর, দধীচি তালুকদার তোমার কে হয়?’
পরাশর বেপরোয়া হয়েই জবাব দিল, ‘আমার বাবা!’
শব্দ দুটো যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে গোটা ঘরটায় ফিরতে লাগল: আমার বাবা। আমার বাবা। আমার বাবা। আমার…।
এখন বুঝলাম, রক্তের সম্পর্ক মানুষকে কী করে বেপরোয়া করে তোলে। আমার মনে পড়ল অ্যাসিড ভরতি বোতলের কথা, বুকে বাঁধা ব্যান্ডেজের কথা, সবশেষে রিভলভারের গুলিটার কথা।
ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘পরাশর, এ পর্যন্ত আমি একবারও দধীচির নাম তোমাদের সামনে বলিনি। খবরের কাগজেও এ নিয়ে কিছু লেখেনি। তাই আজ সকালেই আমি প্ল্যান করেছিলাম, তোমাদের যার মুখ দিয়ে ও-নাম বের করাতে পারব, বুঝব গত তিনটে অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে সে-ই দায়ী। অতএব, ঈশ্বর দধীচি তালুকদারের পুত্র ঈশ্বর পরাশর তালুকদার, তোমার স্বর্গজীবন সুখের হোক—।’
রিভলভারের চাপা শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই গুলির ধাক্কায় রোশনের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়ল পরাশর। ওর মুখে পলকের জন্যে ফুটে উঠল বিস্ময়ের ছায়া। তারপর ওর শরীরটা সশব্দে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। কপাল থেকে সরু রক্তের ধারা গড়িয়ে এল বাইরে।
রোশন নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জানতে চাইল, ‘ওস্তাদ, দধীচি তালুকদারের কপালে কি কোনও কাটা দাগ ছিল?’
‘হ্যাঁ, ছিল। কেন?’
রোশন চুপ।
অবনী বড়-বড় পা ফেলে তড়িতে এগিয়ে গেল ভাঙা টেবিলটার কাছে। ওর বলিষ্ঠ দু-হাতে টেবিলটাকে মাথার ওপর তুলে মেঝেতে এক আছাড় মারল। প্রচণ্ড শব্দে গোটা ডেরাটা থরথর করে কেঁপে উঠল। আমরা নির্বাকভাবে দেখলাম, অবনী এক হ্যাঁচকায় ভেঙে নিল টেবিলটার একটা ভারী পায়া। ফিরে এসে প্রতিদ্বন্দ্বীর ভঙ্গিতে পা ফাঁক করে দাঁড়াল আমার কাছ থেকে হাত-ছয়েক দূরে।
নয়ন আর রোশন গিয়ে দাঁড়াল অবনীর পাশে। ওরা তিনজনে মিলে আমাকে কেন্দ্র করে ছ’-হাত ব্যাসার্ধের এক বৃত্তচাপের জন্ম দিল।
আমার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে নয়ন বলল, ‘হেম, দধীচির নামটা আমি এই মুহূর্তেই প্রথম শুনলাম।’
‘আমিও।’ একইসঙ্গে জবাব দিল অবনী আর রোশনলাল।
‘পরাশর জানত, তালুকদার স্টোর্স দোকানটা ওর বাবার—’ নয়ন বলল, ‘কিন্তু আমি জানতাম না যে—।’
‘তার মালিক দধীচি তালুকদার।’ বক্তা অবনী ও রোশন।
‘হেম, দধীচিকে খুন করে আমার বোনকে তুই বিধবা করেছিস।’ ফিসফিসে ভেজা স্বরে বলল নয়ন, ‘আমার ছোট বোন সুনন্দাকে আমি বড় ভালোবাসি।’
‘হেমদা, আমার নাম অবনী তালুকদার। দধীচি আমার দাদা। বাড়ি ছেড়েছি বহুদিন—কিন্তু তবুও সে আমার বড়ভাই। ছোট একটা দোকান চালায় বলে শুনেছি…।’ গম্ভীর স্বরে বলে উঠল অবনী।
‘ওস্তাদ, এই দধীচি তালুকদার একদিন নিজের জান কবুল করে আমার জান বাঁচিয়েছিল।’ থেমে-থেমে রোশন বলল।
আমার সমস্ত ভাবনা-চিন্তা লোপ পেল। সব কিছু যেন জটিল থেকে জটিলতর হতে লাগল। পরাশর, অবনী, নয়ন, রোশন—ওদের চেহারাগুলো যেন দ্রুতগতিতে পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বুঝলাম, আমি শ্রীহেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দধীচির তনুত্যাগে যার সূত্রপাত করেছি, বৃত্র-সংহারেই তার শেষ। সেই রক্তের ঋণ শোধ করতেই ওরা এতটা কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠেছে।
‘আমাকে ক্ষমা করিস, হেম।’ নয়নের চাপা স্বর কানে এল।
আচ্ছন্ন দৃষ্টি কাটিয়ে দেখি রোশনের হাতে ঝকঝকে স্টিলেটা। অবনীর হাতে ভারী কাঠের পায়াটা। আর নয়ন, ওর রক্তাভ দু-চোখ জলে চিকচিক করে জ্বলছে।
আমাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ওদের বৃত্তের ব্যাসার্ধ ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে লাগল। পরাশরের শূন্য দৃষ্টি এই শেষ দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইল। ওদের শরীরের ছায়া একসময় আমার গায়ে এসে পড়তেই কেমন যেন শীত-শীত করে উঠল।
আমি হেম বাঁড়ুয্যে, জীবনে এই প্রথম শিউরে উঠলাম।
এবং জানি, এই শেষবার!