ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
বিলাসবিহারীর প্রচণ্ড কীর্তি—পল্লীগ্রামে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার শুভদিন আসন্ন হইয়া আসিল। একে একে অতিথিগণের সমাগম ঘটিতে লাগিল। শুধু কলিকাতার নয়, আশপাশ হইতেও দুই-চারিজন সস্ত্রীক আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কাল সেই শুভদিন। আজ সন্ধ্যায় রাসবিহারী তাঁহার আবাস-ভবনে একটি প্রীতিভোজের আয়োজন করিয়াছিলেন।
সংসারে স্বার্থহানির আশঙ্কা কোন কোন বিষয়ী লোককে যে কিরূপ কুশাগ্রবুদ্ধি ও দূরদর্শী করিয়া তুলে, তাহা নিম্নলিখিত ঘটনা হইতে বুঝা যাইবে।
সমবেত নিমন্ত্রিতগণের মাঝখানে বসিয়া বৃদ্ধ রাসবিহারী তাঁহার পাকা দাড়িতে হাত বুলাইয়া অর্ধমুদ্রিতনেত্রে তাঁহার আবাল্য-সুহৃৎ পরলোকগত বনমালীর উল্লেখ করিয়া গম্ভীর-কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, ভগবান তাঁকে অসময়ে আহ্বান করে নিলেন—তাঁর মঙ্গল-ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার এতটুকু নালিশ নেই; কিন্তু সে যে আমাকে কি করে রেখে গেছে, আমার বাইরে দেখে সে আপনারা অনুমান করতেও পারবেন না। যদিচ আমাদের সাক্ষাতের দিন প্রতিদিন নিকটবর্তী হয়ে আসচে, সে আভাস আমি প্রতিমুহূর্তেই পাই, তবুও সেই একমাত্র ও অদ্বিতীয় নিরাকার ব্রহ্মের শ্রীচরণে এই প্রার্থনা করি, তিনি তাঁর অসীম করুণায় সেই দিনটিকে যেন আরও সন্নিকটবর্তী করে দেন। এই বলিয়া তিনি জামার হাতায় চোখের কোণটা মুছিয়া ফেলিলেন। অতঃপর কিছুক্ষণ আত্ম-সমাহিত ভাবে মৌন থাকিয়া পুনরায় অপেক্ষাকৃত প্রফুল্ল-কণ্ঠে কথা কহিতে লাগিলেন। তাঁহাদের বাল্যের খেলাধূলা, কিশোর বয়সের পড়াশুনা—তারপর যৌবনে সত্যধর্ম গ্রহণের ইতিহাস বিবৃত করিয়া কহিলেন, কিন্তু বনমালীর কোমল হৃদয়ে গ্রামের অত্যাচার সহ্য হল না—তিনি কলকাতায় চলে গেলেন। কিন্তু আমি সমস্ত নির্যাতন সহ্য করে গ্রামে থাকতেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। উঃ—সে কি নির্যাতন! তথাপি মনে মনে বললাম, সত্যের জয় হবেই। তাঁর মহিমায় একদিন জয়ী হবই। সেই শুভদিন আজ সমাগত—তাই এখানে এতকাল পরে আপনাদের পদধূলি পড়ল। বনমালী আমাদের মধ্যে আজ নেই—দু’দিন পূর্বেই তিনি চলে গেছেন; কিন্তু আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, ওই, তিনি উপর থেকে আনন্দে মৃদু মৃদু হাস্য করচেন। এই বলিয়া তিনি পুনরায় মুদিত নেত্রে স্থির হইলেন।
উপস্থিত সকলের মনই উত্তেজিত হইয়া উঠিল—বিজয়ার দু’চক্ষে অশ্রু টলটল করিতে লাগিল। রাসবিহারী চক্ষু মেলিয়া সহসা দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ওই তাঁর একমাত্র কন্যা বিজয়া। পিতার সর্বগুণের অধিকারিণী—কিন্তু কর্তব্যে কঠোর! সত্যে নির্ভীক! স্থির! আর ঐ আমার পুত্র বিলাসবিহারী। এমনি অটল, এমনি দৃঢ়চিত্ত। এরা বাহিরে এখনও আলাদা হলেও অন্তরে—হ্যাঁ, আর একটি শুভদিন আসন্ন হয়ে আসচে যেদিন আবার আপনাদের পদধূলির কল্যাণে এঁদের সম্মিলিত নবীন-জীবন ধন্য হবে।
একটি অস্ফুট মধুর কলরবে সমস্ত সভাটি মুখরিত হইয়া উঠিল। যে মহিলাটি পাশে বসিয়া ছিলেন, তিনি বিজয়ার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া একটু চাপ দিলেন। রাসবিহারী একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, ঐ তাঁর একমাত্র সন্তান—এটি তাঁর চোখে দেখে যাবার বড় সাধ ছিল; কিন্তু সমস্ত অপরাধ আমার। আজ আপনাদের সকলের কাছে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করচি—এর জন্যে দায়ী আমি একা। পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মত যে মানব-জীবন, এ শুধু আমরা মুখেই বলি, কিন্তু কাজে ত করি না! সে যে এত শীঘ্র যেতে পারে সে খেয়াল ত করলাম না!
এই বলিয়া তিনি ক্ষণকালের নিমিত্ত নীরব হইলেন। তাঁহার অনুতাপবিদ্ধ অন্তরের ছবি উজ্জ্বল দীপালোকে মুখের উপর ফুটিয়া উঠিল। পুনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া শান্ত গম্ভীর-স্বরে বলিলেন, কিন্তু এবার আমার চৈতন্য হয়েচে। তাই নিজের শরীরের দিকে চেয়ে, এই আগামী ফাল্গুনের বেশী আর আমার বিলম্ব করবার সাহস হয় না। কি জানি, পাছে আমিও না দেখে যেতে পারি।
আবার একটা অব্যক্ত ধ্বনি উত্থিত হইল। রাসবিহারী দক্ষিণে ও বামে দৃষ্টিপাত করিয়া বিজয়াকে উদ্দেশ করিয়া বলিতে লাগিলেন, বনমালী তাঁর যথাসর্বস্বের সঙ্গে মেয়েকেও যেমন আমার হাতে দিয়ে গেছেন, আমিও তেমনি ধর্মের দিকে দৃষ্টি রেখে আমার কর্তব্য সমাপন করে যাবো। ওঁরাও তেমনি আপনাদের আশীর্বাদে দীর্ঘজীবন লাভ করে সত্যকে আশ্রয় করে কর্তব্য করুন। যেখান থেকে ওঁদের পিতাকে নির্বাসিত করা হয়েছিল সেইখানে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত হয়ে সত্যধর্ম প্রচার করুন, এই আমার একমাত্র প্রার্থনা।
বৃদ্ধ আচার্য দয়ালচন্দ্র ধাড়া মহাশয় ইহার উপর আশীর্বাদ বর্ষণ করিলেন।
রাসবিহারী তখন বিজয়াকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, মা, তোমার বাবা নেই, তোমার জননী সাধ্বীসতী বহু পূর্বেই স্বর্গারোহণ করেছেন, নইলে এ কথা আজ আমার তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে হত না। লজ্জা করো না মা, বল, আজ এখানেই আমাদের এই পূজনীয় অতিথিগণকে আগামী ফাল্গুন মাসেই আবার একবার পদধূলি দেবার জন্যে আমন্ত্রণ করে রাখি।
বিজয়া কথা কহিবে কি ক্ষোভে, বিরক্তিতে, ভয়ে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। সে অধোবদনে নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। রাসবিহারী ক্ষণকালমাত্র অপেক্ষা করিয়াই মৃদু হাসিয়া কহিলেন, দীর্ঘজীবী হও মা, তোমাকে কিছুই বলতে হবে না—আমরা সমস্ত বুঝেছি।
তাহার পরে দাঁড়াইয়া উঠিয়া, দুই হাত যুক্ত করিয়া বলিলেন, আমি আগামী ফাল্গুনেই আর একবার আপনাদের পদধূলির ভিক্ষা জানাচ্ছি।
সকলেই বার বার করিয়া তাঁদের সম্মতি জানাইতে লাগিলেন। বিজয়া আর সহ্য করিতে না পারিয়া অস্ফুটস্বরে বলিয়া উঠিল, বাবার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যে—প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাসে কথাটা সে শেষ করিতেও পারিল না।
রাসবিহারী চক্ষের পলকে ব্যাপারটা অনুভব করিয়া গভীর অনুতাপের সহিত তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিলেন, ঠিক ত মা, ঠিক ত! এ যে আমার স্মরণ ছিল না। কিন্তু তুমি আমার মা কিনা, তাই এ বুড়ো ছেলের ভুল ধরে দিলে।
বিজয়া নীরবে আঁচলে চোখ মুছিল। রাসবিহারী ইহাও লক্ষ্য করিলেন। নিঃশ্বাস ফেলিয়া আর্দ্রস্বরে বলিলেন, সকলই তাঁর ইচ্ছা। একটু পরে কহিলেন, তাই হবে। কিন্তু তারও ত আর বিলম্ব নেই।
সকলের দিকে চাহিয়া কহিলেন, বেশ, আগামী বৈশাখেই শুভকার্য সম্পন্ন হবে। আপনাদের কাছে এই আমাদের পাকা কথা হয়ে রইল। বিলাসবিহারী, বাবা, রাত্রি হয়ে যাচ্ছে—কাল প্রভাত থেকে ত কাজের অন্ত থাকবে না,—আমাদের আহারের আয়োজনটা—না—না, চাকরদের উপর আর নির্ভর করা নয়—তুমি নিজে যাও,—চল, আমিও যাচ্ছি—তা হলে আপনাদের অনুমতি হলে আমি একবার—বলিতে বলিতেই তিনি পুত্রের পিছনে পিছনে অন্দরের দিকে প্রস্থান করিলেন।
যথাসময়ে প্রীতি-ভোজনের কার্য সমাধা হইয়া গেল। আয়োজন প্রচুর হইয়াছিল, কোথাও কোন অংশে ত্রুটি পড়িল না। রাত্রি প্রায় বারোটা বাজে, একটা থামের আড়ালে অন্ধকারে একাকী দাঁড়াইয়া বিজয়া পালকির জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। রাসবিহারী তাহাকে যেন হঠাৎ আবিষ্কার করিয়া একেবারে চমকিয়া গেলেন—এখানে একলা দাঁড়িয়ে কেন মা? এসো এসো—ঘরে বসবে এসো।
বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, কাকাবাবু, আমি বেশ দাঁড়িয়ে আছি।
কিন্তু ঠাণ্ডা লাগবে যে মা?
না, লাগবে না।
রাসবিহারী তখন পাশে দাঁড়াইয়া ‘ঘরের লক্ষ্মী’ প্রভৃতি বলিয়া আর একদফা আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। বিজয়া পাথরের মূর্তির মত নির্বাক হইয়া এই সমস্ত স্নেহের অভিনয় সহ্য করিতে লাগিল।
অকস্মাৎ তাঁহার একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। বলিলেন, তোমাকে সে কথাটা বলতে একেবারেই ভুলে গেয়েছিলাম মা। সেই মাইক্রস্কোপের দামটা তাঁকে আমি দিয়ে দিয়েছি।
আট-দশ দিন হইয়া গেল, নরেন্দ্র সেই যে সেটা রাখিয়া গেছে, আর আসে নাই। এই কয়টা দিন যে বিজয়ার কি করিয়া কাটিয়াছে, তাহা শুধু সেই জানে। তাহার পিসীর বাড়ির দূরত্বটাই সে জানিয়া লইয়াছিল, কিন্তু সে যে কোথায় কোন্ গ্রামে তাহা জিজ্ঞাসা করে নাই। এই ভুলটা তাহাকে প্রতিমুহূর্তে তপ্ত শেলে বিঁধিয়া গেছে; কিন্তু কোন উপায় খুঁজিয়া পায় নাই। এখন রাসবিহারীর কথায় সে চকিত হইয়া বলিল, কখন দিলেন?
রাসবিহারী একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, কি জানি তার পরের দিনেই হবে বুঝি। শুনলাম, তুমি সেটা কিনবে বলেই রেখেছ। কথা, কথা। যখন কথা দেওয়া হয়েছে, তখন ঠকাই হোক আর যাই হোক, টাকা দেওয়াও হয়েছে—এই ত আমি সারা জীবন বুঝে এসেছি মা। দেখলাম সে বেচারার ভারী দরকার—টাকাটা হাতে পেলেই চলে যায়—গিয়ে যা হোক কিছু করবার চেষ্টা করে। হাজার হোক সেও ত আমার পর নয় মা, সেও ত এক বন্ধুরই ছেলে। দেখলাম চলে যাবার জন্যে ভারী ব্যস্ত—পেলেই চলে যায়। আর তোমার দেওয়াও দেওয়া, আমার দেওয়াও দেওয়া। তাই তখনি দিয়ে দিলাম। তার ধর্ম তার কাছে—দশ টাকা বেশী নিয়ে থাকে, নিক।
বিজয়ার মুখের ভিতর জিভটা যেন আড়ষ্ট হইয়া গেল,—কিছুতেই যেন তার কথা ফুটিবে না এমনি মনে হইল। কিছুক্ষণের প্রবল চেষ্টায় বলিয়া ফেলিল, কোথায় তাঁকে টাকা দিলেন?
রাসবিহারী কেমন করিয়া জানি না, প্রশ্নটাকে সম্পূর্ণ অন্য বুঝিয়া চমকাইয়া উঠিয়া কহিলেন, না—না, বল কি, টাকাটা দু’বার করে নিলে নাকি? কিন্তু কৈ সে রকম ত তার মুখ দেখে মনে হল না? আর কাকেই বা দোষ দেব। এমনি করে লোকের কথায় বিশ্বাস করে ঠকতে ঠকতেই ত দাড়ি পাকিয়ে দিলাম। না হয়, আর দু’’শ গেল। তা সে টাকাটা আমিই দেব—চিরকাল এই রকম দণ্ড বইতে বইতে কাঁধে কড়া পড়ে গেছে মা, আর লাগে না। যাক সে আমি—
বিজয়া আর কিছুতেই সহিতে না পারিয়া রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, কেন আপনি মিথ্যে ভয় করচেন কাকাবাবু? দু’বার করে টাকা নেবার লোক তিনি নন—না খেতে পেয়ে মরবার সময় পর্যন্ত নন। কিন্তু কোথায় দেখা হল? কবে টাকা দিলেন?
রাসবিহারী অত্যন্ত আশ্বস্ত হইয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, যাক বাঁচা গেল! টাকাটাও ত কম নয়—দু’শ যাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত! হঠাৎ দেখা হতেই—কে দাঁড়িয়ে? বিলাস? পালকির কি হল, বল দেখি? ঠাণ্ডা লেগে যাচ্ছে যে! যে কাজটা আমি নিজে না দেখব, তাই কি হবে না! বলিয়া অত্যন্ত রাগ করিয়া তিনি ও-ধারের একটা থামকে বিলাস কল্পনা করিয়া অকস্মাৎ দ্রুতবেগে সেই দিকে ধাবিত হইলেন।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
এমন একদিন ছিল, যখন বিলাসের হাতে আত্মসমর্পণ করা বিজয়ার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ছিল না। কিন্তু আজ শুধু বিলাস কেন, এতবড় পৃথিবীর এত কোটি লোকের মধ্যে কেবল একটিমাত্র লোক ছাড়া আর কেহ তাহাকে স্পর্শ করিয়াছে ভাবিলেও তাহার সর্বাঙ্গ ঘৃণায় লজ্জায় এবং কি-একটা গভীর পাপের ভয়ে ত্রস্ত সশঙ্কিত হইয়া ওঠে। এই জিনিসটাকেই সে রাসবিহারীর নিমন্ত্রণ সারিয়া পালকিতে উঠিয়া পর্যন্ত নানাদিক দিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করিতে করিতে বাটী আসিতেছিল।
তাহার সম্বন্ধে তাহার পিতার মনোভাব ঠিক কি ছিল, তাহা জানিয়া লইবার যথেষ্ট সুযোগ ঘটে নাই। কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর পরে তাহার নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের ধারাটা যে বিলাসবিহারীর সহিত সম্মিলিত হইয়া প্রবাহিত হইবে তাহা স্থির হইয়া গিয়াছিল। কোনমতেই যে ইহার ব্যত্যয় ঘটিতে পারে, এ সম্ভাবনা কোন দিন তাহার মনে উদয় হয় নাই।
অথচ এই যে একটা অনাসক্ত উদাসীন লোক আকাশের কোন্ এক অদৃশ্য প্রান্ত হইতে সহসা ধূমকেতুর মত উঠিয়া আসিল এবং একনিমেষে তাহার বিশাল পুচ্ছের প্রচণ্ড তাড়নায় সমস্ত লণ্ডভণ্ড বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া তাহার সুনির্দিষ্ট পথের রেখাটা পর্যন্ত বিলুপ্ত করিয়া দিয়া কোথায় যে নিজে সরিয়া গেল—চিহ্ন পর্যন্ত রাখিয়া গেল না—ইহা সত্য কিংবা নিছক স্বপ্ন ইহাই বিজয়া তাহার সমস্ত আত্মাকে জাগ্রত করিয়া আজ ভাবিতেছিল। যদি স্বপ্ন হয় সে মোহ কেমন করিয়া কতদিনে কাটিবে, আর যদি সত্য হয় তবে তাহাই বা জীবনে কি করিয়া সার্থক হইবে?
ঘরে আসিয়া শয্যায় শুইয়া পড়িল কিন্তু নিদ্রা তাহার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কাছেও ঘেঁষিল না। আজ যে আশঙ্কাটা তাহার মনে বার বার উঠিতে লাগিল তাহা এই যে, যে-চিন্তা কিছুদিন হইতে তাহার চিত্তকে অহর্নিশ আন্দোলিত করিতেছে তাহাতে সত্য বস্তু কিছু আছে, কিংবা সে শুধুই তাহার আকাশকুসুমের মালা? এর নিদারুণ সমস্যার গ্রন্থিভেদ করিয়া তাহাকে কে দিবে?
তাহার মা নাই, পিতাও পরলোকে; ভাই-বোন ত কোনদিনই ছিল না—আপনার বলিতে একা রাসবিহারী ব্যতীত আর কেহ নাই। তিনিই বন্ধু, তিনিই বান্ধব, তিনিই অভিভাবক। অথচ কোন্ শুভ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে যে তিনি এমন তাড়া করিয়া তাহাকে তাহার আজন্ম-পরিচিত কলিকাতার সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেশে আনিয়া ফেলিয়াছেন সে আজ বিজয়ার কাছে জলের ন্যায় স্বচ্ছ হইয়া গেছে। এই স্বচ্ছতার ভিতর দিয়া যতদূর দৃষ্টি যায়, আজ সমস্তই তাহার চোখে সুস্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। বিদেশ যাত্রায় নরেনকে অযাচিত সাহায্য দান, নিজের গৃহে এই খাওয়ানোর আয়োজন, সম্মানিত অতিথিদের সম্মুখে এই বিবাহের প্রস্তাব, তাহার সলজ্জ নীরবতার অর্থ মৌন-সম্মতি বলিয়া অসংশয়ে প্রচার করা—তাহাকে সকল দিক দিয়া বাঁধিয়া ফেলিতে এই বৃদ্ধের চেষ্টা-পরম্পরার কিছুই আর তাহার কাছে প্রচ্ছন্ন নাই।
কিন্তু রহস্য এই যে, অত্যাচার-উপদ্রবের লেশমাত্র চিহ্নও রাসবিহারীর কোন কাজে কোথাও বিদ্যমান নাই, অথচ বৃদ্ধের বিনম্র স্নেহসরস মঙ্গলেচ্ছার অন্তরালে দাঁড়াইয়া কত বড় দুর্নিবার তাড়না যে তাহাকে অহরহ ঠেলিয়া জালের মুখে অগ্রসর করিয়া দিতেছে—উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের উপায়-বিহীনত্বের ছবিটা এমনি সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিল যে, একাকী ঘরের মধ্যেও বিজয়া আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রির মধ্যে সে মুহূর্তের জন্য ঘুমাইতে পারিল না; তাহার পরলোকগত পিতাকে বারংবার ডাকিয়া কেবলই কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, ‘বাবা, তুমি ত এঁদের চিনতে পেরেছিলে, তবে কেন আমাকে এমন করে তাঁদের মুখের মধ্যে সঁপে দিয়ে গেলে?’
এক সময় সে যে নিজেই বিলাসকে পছন্দ করিয়াছিল, এবং তাহারই সহিত একযোগে পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও নরেনের সর্বনাশ কামনা করিয়াছিল, সেই কামনাই আজ তাহার সমস্ত শুভ-ইচ্ছাকে পরাভূত করিয়া জয়লাভ করিতেছে, মনে করিয়া তাহার বুক ফাটিতে লাগিল। সে বার বার করিয়া বলিতে লাগিল, স্নেহে অন্ধ হইয়া কেন পিতা এই সর্বনাশের মূল স্বহস্তে উন্মূলিত করিয়া গেলেন না; কেন তাহারই বুদ্ধি-বিবেচনার উপর সমস্ত নির্ভর করিয়া গেলেন? আর তাই যদি গেলেন, তবে কেন তাহার স্বাধীনতার পথ এমন করিয়া সকল দিক দিয়া রুদ্ধ করিয়া গেলেন? সমস্ত উপাধান সিক্ত করিয়া সে কেবলই ভাবিতে লাগিল তাহার এই ক্রুদ্ধ অভিমানের নিষ্ফল নালিশ আজ সেই স্বর্গবাসী পিতার কানে কি পৌঁছিতেছে না? আর প্রতিকারের উপায় কি তাহার হাতে আর একবিন্দুও নাই?
পরদিন পরেশের মায়ের ডাকাডাকিতে যখন ঘুম ভাঙ্গিল, তখন বেলা হইয়াছে। উঠিয়া শুনিল, তাহার বাহিরের ঘর নিমন্ত্রিতগণের অভ্যাগমে পরিপূর্ণ হইয়া গেছে—শুধু সে-ই উপস্থিত নাই। এই ত্রুটি সারিয়া লইতে সে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি করিবে কি—আজিকার সারা দিনব্যাপী উৎসবের হাঙ্গামা মনে করিতেই তাহার ভারী যেন একটা বিতৃষ্ণা জন্মিল।
শীতের প্রভাত-সূর্যালোক বাগানের আমগাছের মাথায় মাথায় ভরিয়া গিয়াছে, এবং তাহারই পাতার ফাঁকে ফাঁকে সম্মুখের মাঠের উপর দিয়া রাখাল বালকেরা খেলা করিতে করিতে গরু চরাইতে চলিয়াছে। দেশে আসিয়া পর্যন্ত এই দৃশ্যটি দেখিতে তাহার কোন দিন ক্লান্তি জন্মে নাই। অনেক দিন অনেক দরকারী কাজ ফেলিয়াও সে বহুক্ষণ পর্যন্ত ইহাদের পানে চাহিয়া বসিয়া থাকিত। কিন্তু আজ সে ভাবিয়াই পাইল না এতদিন কি মাধুর্য ইহাতে ছিল! বরঞ্চ এ যেন একটা অত্যন্ত পুরানো বাসী জিনিসের মত তাহার কাছে আগাগোড়া বিস্বাদ ঠেকিল। এই দৃশ্য হইতে সে তাহার শ্রান্ত চোখ-দুটি ধীরে ধীরে ফিরাইয়া লইতেই দেখিতে পাইল, কালীপদ এক-এক লাফে তিন-তিনটা সিঁড়ি ডিঙ্গাইয়া উপরে উঠিতেছে। চোখাচোখি হইবামাত্র সে মহাব্যস্ততার ইঙ্গিত জানাইয়া হাত তুলিয়া বলিয়া উঠিল, মা শিগগির, শিগগির! ছোটবাবু ভয়ানক রেগে উঠেছেন। আজ এত দেরিও করতে আছে!
কিন্তু অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ একরাশি বারুদের মধ্যে পড়িয়া যে বিপ্লবের সৃষ্টি করে, ভৃত্যের এই সংবাদটাও বিজয়ার দেহ-মনে ঠিক তেমনি ভীষণ কাণ্ড বাধাইয়া প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। কিন্তু হঠাৎ সে কথা কহিতে পারিল না, তাহার দুই প্রদীপ্ত চক্ষু হইতে অসহ্য দাহ ঠিকরিয়া পড়িতে লাগিল। কালীপদ সেই চোখের পানে চাহিয়া ভয়ে জড়সড় হইয়া কি-একটা পুনরায় বলিবার চেষ্টা করিতেই, বিজয়া আপনাকে সামলাইয়া লইয়া কহিল, তুমি নীচে যাও কালীপদ—বলিয়া নীচের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল।
এ বাটীতে ‘ছোটবাবু’ বলিতে যে বিলাসবিহারীকে এবং ‘বড়বাবু’ বলিতে তাহার পিতাকে বুঝায়, বিজয়া তাহা জানিত। কিন্তু এই দুটি পিতা-পুত্র এখানে এত বড় হইয়া উঠিয়াছেন যে, তাঁহাদের ক্রোধের গুরুত্ব আজ চাকর-বাকরদের কাছে বাড়ির মনিবকে পর্যন্ত অতিক্রম করিয়াছে, এ খবর বিজয়া এই প্রথম পাইল। আজ সে স্পষ্ট দেখিল, ইহারই মধ্যে বিলাস এখানকার সত্যকার প্রভু এবং সে নিজে তাহার শাসিত কৃপার পাত্রী। এ তথ্য যে তাহার মনের আগুনে জলধারা সিঞ্চিত করিল না তাহা বলাই বাহুল্য।
আধ-ঘণ্টা পরে সে যখন হাতমুখ ধুইয়া, কাপড় ছাড়িয়া প্রস্তুত হইয়া নীচে নামিয়া আসিল, তখন চা খাওয়া চলিতেছিল। উপস্থিত সকলেই প্রায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া অভিবাদন করিল, এবং তাহার মুখ-চোখের শুষ্কতা লক্ষ্য করিয়া অনেকগুলা অস্ফুট-কন্ঠের উদ্বিগ্ন প্রশ্নও ধ্বনিয়া উঠিল। কিন্তু সহসা বিলাসবিহারীর তীব্র কটুকণ্ঠে সমস্ত ডুবিয়া গেল। সে তাহার চায়ের পেয়ালাটা ঠক্ করিয়া টেবিলের উপর নামাইয়া রাখিয়া বলিয়া উঠিল, ঘুমটা এ-বেলায় না ভাঙলেই ত চলত। তোমার ব্যবহারে আমি ক্রমশঃ ডিস্গস্টেড্ হয়ে উঠচি, এ কথা না জানিয়ে আর আমি পারলাম না।
বিরক্তি জানাইবার অধিকার তাঁহার আছে—এ একটা কথা বটে! কিন্তু এতগুলি বাহিরের লোকের সমক্ষে ভাবী স্বামীর এই কর্তব্যপরায়ণতা নিরতিশয় অভদ্রতার আকারেই সকলকে বিস্মিত এবং ব্যথিত করিল। কিন্তু বিজয়া তাহার প্রতি দৃক্পাতমাত্র করিল না। যেন কিছুই হয় নাই, এমনিভাবে সে সকলকেই প্রতি-নমস্কার করিয়া যেখানে বৃদ্ধ আচার্য দয়ালবাবু বসিয়াছিলেন, সেই দিকে অগ্রসর হইয়া গেল। বৃদ্ধ অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। বিজয়া তাঁহার কাছে গিয়া শান্তকণ্ঠে কহিল, আপনার চা খাওয়ার কোন বিঘ্ন হয়নি ত? আমার অপরাধ হয়ে গেছে—আজ সকালে আমি উঠতে পারিনি।
বৃদ্ধ দয়াল স্নেহার্দ্র স্বরে একেবারেই ‘মা’ সম্বোধন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, না মা, আমাদের কারও কিছুমাত্র অসুবিধে হয়নি। বিলাসবাবু, রাসবিহারীবাবু কোথাও কোন ত্রুটি ঘটতে দেননি। কিন্তু তোমাকে ত তেমন ভাল দেখাচ্ছে না মা; অসুখ-বিসুখ ত কিছু হয়নি?
ইনি সর্বদা কলিকাতায় থাকেন না বলিয়া বিজয়া পূর্ব হইতে ইঁহাকে চিনিত না। কালও সে ভাল করিয়া ইঁহাকে লক্ষ্য করিয়া দেখে নাই কিন্তু আজ ঘরে পা দিয়া দেখিবামাত্রই এই বৃদ্ধের শান্ত, সৌম্য মূর্তি যেন নিতান্ত আপনার জন বলিয়া তাহাকে আকর্ষণ করিল এবং ইঁহার স্নিগ্ধ সুকোমল কণ্ঠস্বরে তাহার স্বর্গীয় পিতার কণ্ঠস্বরের আভাস জ্ঞাপন করিল।
দয়াল একটা কৌচের উপর বসিয়াছিলেন, পাশে একটু জায়গা ছিল। তিনি সেই স্থানটুকু নির্দেশ করিয়া কহিলেন, দাঁড়িয়ে কেন মা, বোস এইখানে; অসুখ-বিসুখ ত কিছু করেনি?
বিজয়া পার্শ্বে বসিয়া পড়িল বটে, কিন্তু জবাব দিতে পারিল না, ঘাড় বাঁকাইয়া আর একদিকে চাহিয়া রহিল। অশ্রু দমন করা তাহার পক্ষে যে উত্তরোত্তর কঠিন হইয়া উঠিতেছিল। বৃদ্ধ আবার সেই প্রশ্ন করিলেন। প্রত্যুত্তরে এবার বিজয়া মাথা নাড়িয়া কোনমতে শুধু কহিল, না।
এই ধরা-গলার সংক্ষিপ্ত উত্তর বৃদ্ধের লক্ষ্য এড়াইল না—তিনি মুহূর্তকালের জন্য মৌন থাকিয়া, ব্যাপারটা অনুভব করিয়া মনে মনে শুধু একটু হাসিলেন। যিনি এ বাটীর মালিকের জায়গাটি কিছু পূর্বেই দখল করিয়া বসিয়াছেন তিনি যদি তাঁর ভাবী-পত্নী গৃহস্বামিনীকে একটু তিক্ত সম্ভাষণ করিয়া থাকেন ত আনাড়ীদের কাছে তাহা যত রূঢ়ই ঠেকুক, যাঁরা যৌবনের ইতিহাসটুকু পড়িয়া শেষ করিয়া দিয়াছেন, তেমন জ্ঞানবৃদ্ধ কেহ যদি মনে মনে একটু হাস্যই করেন ত তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না।
তখন বৃদ্ধ তাঁহার পার্শ্বোপবিষ্টা এই নবীনা অভিমানিনীটিকে সুস্থ হইবার সময় দিতে নিজেই ধীরে ধীরে কথা কহিতে লাগিলেন। এত অল্প বয়সেই এই সত্য-ধর্মের প্রতি তাহাদের অবিচলিত নিষ্ঠা ও প্রীতির অসংখ্য প্রশংসা করিয়া অবশেষে বলিলেন, ভগবানের আশীর্বাদে তোমাদের মহৎ উদ্দেশ্য দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি লাভ করুক; কিন্তু মা, যে মন্দির তুমি তোমার গ্রামের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলে, তাকে বজায় রাখতে তোমাদের অনেক পরিশ্রম, অনেক স্বার্থত্যাগের আবশ্যক হবে। আমি নিজেও ত পাড়াগাঁয়েই থাকি; আমি বেশ দেখছি, এ ধর্ম এখনও আমাদের পল্লীসমাজের রস নিয়ে যেন বাঁচতেই চায় না। তাই আমার মনে হয়, একে যদি যথার্থই জীবিত রাখতে পার মা, এ দেশে একটা সত্যিই বড় সমস্যার মীমাংসা হবে। তোমাদের এই উদ্যমকে আমি যে কি বলে আশীর্বাদ করব এ আমি ভেবেই পাইনে।
বিজয়ার মুখে আসিয়া পড়িতেছিল, বলে, মন্দির-প্রতিষ্ঠায় আমার আর কোন উৎসাহ নেই, এর লেশমাত্র সার্থকতা আর আমি দেখতে পাইনে। কিন্তু, সে কথা চাপিয়া গিয়া মৃদুস্বরে শুধু জিজ্ঞাসা করিল, একটা জটিল সমস্যার সমাধান হবে আপনি কেন বলছেন?
দয়াল কহিলেন, তা বৈ কি মা। আমার আন্তরিক বিশ্বাস, বাঙলার পল্লীর সহস্রকোটি কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিতে শুধু আমাদের এই ধর্মই পারে। কিন্তু এও জানি, যার যেখানে স্থান নয়, যার যেখানে প্রয়োজন নেই, সে সেখানে বাঁচে না। কিন্তু চেষ্টায়, যত্নে যদি একটিকেও বাঁচাতে পারা যায়, সে কি মস্ত একটা আশা-ভরসার আশ্রয় নয়? আমাদের বাঙালী-ঘরের দোষ-গুণের কথা তুমি নিজেও ত কম জানো না, সেইগুলি সব অন্তরের মধ্যে ভাল করে একটুখানি তলিয়ে ভেবে দেখ দেখি।
বিজয়া আর প্রশ্ন না করিয়া চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিল। স্বদেশের মঙ্গল-কামনা তাহার মধ্যে যথার্থই স্বাভাবিক ছিল, আচার্যের শেষ-কথাটায় তাহাই আলোড়িত হইয়া উঠিল। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সংস্পর্শে একটা মস্ত নামের অন্তরালে থাকিয়া বিলাস তাহার হৃদয়ের অত্যন্ত ব্যথার স্থানটাতেই পুনঃপুনঃ আঘাত করিতেছিল। সে বেদনায় ছট্ফট্ করিতেছিল, অথচ প্রতিঘাত করিবার উপায় ছিল না বলিয়া তাহার সমস্ত চিত্ত সমস্ত ব্যাপারটার বিরুদ্ধেই ক্রোধ ও বিরক্তিতে প্রায় অন্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু দয়াল যখন তাঁহার প্রশান্ত মূর্তি ও স্নিগ্ধকণ্ঠের আহ্বানে বিলাসের চেষ্টার এই বিশেষ দিকটায় চোখ মেলিতে তাহাকে অনুরোধ করিলেন, তখন বিজয়া সত্য সত্যই যেন নিজের ভ্রম দেখিতে পাইল। তাহার মনে হইতে লাগিল, বিলাস হয়ত বাস্তবিকই হৃদয়হীন এবং ক্রূর নয়, তাহার কঠোরতা হয়ত প্রবল ধর্মানুরক্তির একটা প্রকাশমাত্র। মানুষের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্তের ত অভাব নাই। তাহার মনে পড়িল, সে কোথায় যেন পড়িয়াছে, সংসারে সকল বড় কার্যই কাহারো-না-কাহারো ক্ষতিকর হয়; যাঁহারা এই কার্যভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন, তাঁহারা অনেকের মঙ্গলের জন্য সামান্য ক্ষতিতে ভ্রূক্ষেপ করিবার অবসর পান না। সেই জন্য অনেক স্থলেই তাঁহারা নির্মম ও নিষ্ঠুরের মত দেখিতে হন। চিরদিনের শিক্ষা ও সংস্কারবশে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরাগ বিজয়ার কাহারও অপেক্ষা কম ছিল না। সেই ধর্মের বিস্তৃতিতে দেশের এতখানি মঙ্গল নির্ভর করিতেছে শুনিয়া তাহার উচ্চশিক্ষিত সত্যনিষ্ঠ মন বিলাসকে অন্তরে ক্ষমা না করিয়া পারিল না। এমন কি, সে আপনাকে আপনি বলিতে লাগিল, ‘সংসারে যাহারা বড় কাজ করিতে আসে তাহাদিগের ব্যবহার আমাদের মত সাধারণ লোকের সহিত বর্ণে বর্ণে না মিলিলেই তাহাদিগকে দোষী করা অসঙ্গত, এমন কি অন্যায়; এবং অন্যায়কে অন্যায় বুঝিয়া কোন কারণেই প্রশ্রয় দিতে পারিব না।‘
বেলা হইতেছিল বলিয়া সকলেই একে একে উঠিতেছিলেন। বিজয়াও উঠিয়া দাঁড়াইল। রাসবিহারী ছেলেকে একটু আড়ালে ডাকিয়া কি একটা কথা বলিবার পরে, বিলাস এই সুযোগটার জন্যই যেন প্রতীক্ষা করিতেছিল, কাছে আসিয়া বলিল, তোমার শরীরটা কি আজ সকালে ভাল নেই বিজয়া?
আধ-ঘণ্টা পূর্বেও হয়ত বিজয়া প্রশ্নটাকে একেবারেই উপেক্ষা করিয়া যা হোক একটা-কিছু বলিয়া চলিয়া যাইত, কিন্তু, এখন সে মুখ তুলিয়া চাহিল। সহজভাবে বলিল, না, ভালই আছি। কাল রাত্রে ঘুম হয়নি বলেই বোধ করি একটু অসুস্থ দেখাচ্চে।
বিলাসের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। এমন অনেক লোক আছে, যাহারা আঘাতের বদলে প্রতিঘাত না করিয়া কিছুতেই থাকিতে পারে না। নিজের সমূহ ক্ষতি বুঝিয়াও আত্মসংবরণ করিতে পারে না। বিলাস তাহাদেরই একজন। তাহার প্রতি বিজয়ার আচরণ প্রতিদিন যতই অপ্রীতিকর হইতেছিল, তাহার নিজের আচরণও ততোধিক নিষ্ঠুর হইয়া উঠিতেছিল। এইরূপে ঘাত-প্রতিঘাতের আগুন প্রতি মুহূর্তেই যখন মারাত্মক হইয়া দাঁড়াইতেছিল, এবং পক্বকেশ অভিজ্ঞ পিতার পুনঃ পুনঃ সনির্বন্ধ অনুযোগ সহিষ্ণুতার পরম লাভ ও চরম সিদ্ধির নিভৃত গভীর উপদেশ অনভিজ্ঞ উদ্ধত পুত্রের কোন কাজেই লাগিতেছিল না, তখন বিজয়ার মুখের এই একটিমাত্র কোমল বাক্য বিলাসের স্বভাবটাকেই যেন বদলাইয়া দিল। সে স্বাভাবিক কর্কশকণ্ঠ যতদূর সাধ্য কোমল করিয়া কহিল, তা হলে তুমি এ-বেলায় রোদে আর বার হয়ো না। সকাল সকাল স্নানাহার সেরে যদি একটু ঘুমোতে পার, সেই চেষ্টা করো। সিজন চেঞ্জের সময়টা ভাল নয়—অসুখ-বিসুখ না হয়ে পড়ে। এই বলিয়া মুখের চেহারায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করিয়া, বোধ করি বা নিজের ব্যবহারের জন্য একবার ক্ষমা চাহিতেও উদ্যত হইল; কিন্তু এ বস্তুটা তাহার স্বভাবে নাকি একেবারেই নাই, তাই আর কিছু না কহিয়া দ্রুতপদে ভদ্রলোকদিগের অনুসরণ করিয়া বাহির হইয়া গেল।
যতদূর দেখা যায় বিজয়া তাহার প্রতি চাহিয়া রহিল। তাহার পরে একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে তাহার উপরের ঘরে চলিয়া গেল। কিছুকাল অবধি একটা অব্যক্ত পীড়া কাঁটার মত তাহার মনের মধ্যে খচ্খচ্ করিয়া অহরহ বিঁধিতেছিল, আজ তাহার অকস্মাৎ বোধ হইল, সেটার যেন খোঁজ পাওয়া যাইতেছে না।
সন্ধ্যার পর ব্রাহ্মমন্দিরের প্রতিষ্ঠা যথারীতি সম্পন্ন হইয়া গেল। ভিতরের বিশেষ একটা জায়গায় দুখানা ভাল চেয়ার আজ পাশাপাশি রাখা হইয়াছিল। তাহার একটাতে যখন অত্যন্ত সমারোহের সহিত বিজয়াকে বসান হইল, তখন পার্শ্বের অন্য আসনটা যে কাহার দ্বারা পূর্ণ হইবার অপেক্ষা করিতেছে, তাহা কাহারও বুঝিতে বিলম্ব হইল না। পলকের জন্য বিজয়ার মনের ভিতরটা হুহু করিয়া উঠিল বটে, কিন্তু ক্ষণেক পরেই বিলাস আসিয়া যখন তাহার নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া বসিল, তখন সে জ্বালা নিবিতেও তাহার বেশী সময় লাগিল না।