নবম পরিচ্ছেদ
সেইদিন হইতে বিজয়ার মনের মধ্যে এই আশাটা অনুক্ষণ যেন তৃষ্ণার মত জাগিতেছিল যে, সেই অপরিচিত লোকটি যাইবার পূর্বে অন্ততঃ একটিবারও তাঁহার বন্ধুকে লইয়া অনুরোধ করিতে আসিবেন। যত কথা তাহাদের মধ্যে হইয়াছিল, সমস্তগুলি তাহার অন্তরের মধ্যে গাঁথা হইয়া ছিল, একটি কথাও সে বিস্মৃত হয় নাই। সেইগুলি সে মনে মনে অহর্নিশ আন্দোলন করিয়া দেখিয়াছিল যে, বস্তুতঃ সে এমন একটা কথাও বলে নাই যাহাতে এ ধারণা তাঁহার জন্মিতে পারে যে তাহার কাছে আশা করিবার তাঁহার বন্ধুর একেবারে কিছু নাই। বরঞ্চ তাহার বেশ মনে পড়ে নরেন, যে তাহার পিতৃবন্ধুর পুত্র, এ উল্লেখ সে করিয়াছে; সময় পাইলে ঋণ-পরিশোধ করিবার মত শক্তি-সামর্থ্য আছে কিনা, তাহাও জিজ্ঞাসা করিয়াছে; তবে যাহার সর্বস্ব যাইতে বসিয়াছে তাহার ইহাতেও কি চেষ্টা করিবার মত কিছুই ছিল না! যেখানে কোন ভরসাই থাকে না সেখানেও ত আত্মীয়-বন্ধুরা একবার যত্ন করিয়া দেখিতে বলে। এ বন্ধুটি কি তাঁহার তবে একেবারে সৃষ্টিছাড়া!
নদীতীরের পথে আর সাক্ষাৎ হয় নাই। কিন্তু সে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রত্যহই এই আশা করিত যে, একবার না একবার তিনি আসিবেনই। কিন্তু দিন বহিয়া যাইতে লাগিল—না আসিলেন তিনি, না আসিল তাঁহার অদ্ভুত ডাক্তার বন্ধুটি।
বৃদ্ধ রাসবিহারীর সহিত দেখা হইলে তিনি ছেলের সঙ্গে যে ইতিমধ্যে কোন কথা হইয়াছে ইহার আভাসমাত্র দিলেন না। বরঞ্চ ইঙ্গিতে এই ভাবটাই প্রকাশ করিতে লাগিলেন যেন সঙ্কল্প একপ্রকার সিদ্ধ হইয়াই গিয়াছে। এই লইয়া যে আর কোনপ্রকার আন্দোলন উঠিতে পারে, তাহা যেন তাঁহার মনেই আসিতে পারে না। বিজয়া নিজেই সঙ্কোচে কথাটা উত্থাপন করিতে পারিল না। অগ্রহায়ণ শেষ হইয়া গেল, পৌষের ঠিক প্রথম দিনটিতেই পিতাপুত্র একত্র দর্শন দিলেন। রাসবিহারী কহিলেন, মা, আর ত বেশী দিন নেই, এর মধ্যেই ত সমস্ত সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলতে হবে।
বিজয়া সত্য সত্যই একটু বিস্মিত হইয়া কহিল, তিনি নিজে ইচ্ছে করে চলে না গেলে তো কিছুই হতে পারে না।
বিলাসবিহারী মুখ টিপিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন; তাহার পিতা কহিলেন, কার কথা বলচ মা, জগদীশের ছেলে ত? সে তো কালই বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
সংবাদটা যথার্থই বিজয়ার বুকের ভিতর পর্যন্ত গিয়া আঘাত করিল। সে তৎক্ষণাৎ বিলাসের দিক হইতে এমন করিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল, যাহাতে সে কোন মতে না তাহার মুখ দেখিতে পায়। এই ভাবে ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া আঘাতটা সামলাইয়া লইয়া আস্তে আস্তে রাসবিহারীকে জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর জিনিসপত্র কি হল? সমস্ত নিয়ে গেছেন?
বিলাস পিছন হইতে হাসির ভঙ্গিতে বলিল, থাকবার মধ্যে একটা তে-পেয়ে খাট ছিল—তার উপরেই বোধ করি তাঁর শয়ন চলত, আমি সেটা বাইরে গাছতলায় টেনে ফেলে দিয়েছি, তাঁর ইচ্ছে হলে নিয়ে যেতে পারেন—কোন আপত্তি নেই।
বিজয়া চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু তাহার মুখের উপর সুস্পষ্ট বেদনার চিহ্ন লক্ষ্য করিয়া রাসবিহারী র্ভৎসনার কণ্ঠে ছেলেকে বলিলেন, ওটা তোমার দোষ বিলাস। মানুষ যেমন অপরাধীই হোক, ভগবান তাকে যতই দণ্ড দিন, তার দুঃখে আমাদের দুঃখিত হওয়া, সমবেদনা প্রকাশ করা উচিত। আমি বলছি নে যে, তুমি অন্তরে তার জন্যে কষ্ট পাচ্চ না, কিন্তু বাইরেও সেটা প্রকাশ করা কর্তব্য। জগদীশের ছেলের সঙ্গে তোমার কি দেখা হয়েছিল? তাকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বললে না কেন? দেখতুম যদি কিছু—
পিতার কথাটা শেষ হইতেও পাইল না—পুত্র তাঁহার ইঙ্গিতটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করিয়া দিয়া মুখে একটা শব্দ করিয়া বলিয়া উঠিল, তাঁর সঙ্গে দেখা করে নিমন্ত্রণ করা ছাড়া আমার ত আর কাজ ছিল না বাবা! তুমি কি যে বল তার ঠিকানাই নেই। তা ছাড়া আমার পৌঁছোবার পূর্বেই ত ডাক্তারসাহেব তাঁর তোরঙ্গ, প্যাঁটরা, যন্ত্রপাতি গুটিয়ে নিয়ে সরে পড়েছিলেন। বিলাতের ডাক্তার! একটা অপদার্থ হাম্বাগ কোথাকার! বলিয়া সে আরও কিসব বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু রাসবিহারী বিজয়ার মুখের প্রতি আড়চোখে চাহিয়া ক্রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, না বিলাস, তোমার এ-রকম কথাবার্তা আমি মার্জনা করতে পারিনে। নিজের ব্যবহারে তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত—অনুতাপ করা উচিত।
কিন্তু বিলাস লেশমাত্র লজ্জিত বা অনুতপ্ত না হইয়া জবাব দিল, কিজন্যে শুনি? পরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, পরের ক্লেশ নিবারণ করার শিক্ষা আমার আছে, কিন্তু যে দাম্ভিক বাড়ি বয়ে অপমান করে যায়, তাকে আমি মাপ করিনে। অত ভণ্ডামি আমার নেই।
তাহার জবাব শুনিয়া উভয়েই আশ্চর্য হইয়া উঠিল। রাসবিহারী কহিলেন, কে আবার তোমাকে বাড়ি বয়ে অপমান করে গেল? কার কথা তুমি বলছ?
বিলাস ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, জগদীশবাবুর সু-পুত্র নরেনবাবুর কথাই বলছি বাবা। তিনিই একদিন ঠিক এই ঘরে বসেই আমাকে অপমান করে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে চিনতুম না তাই—বলিয়া ইঙ্গিতে বিজয়াকে দেখাইয়া কহিল, নইলে ওঁকেও অপমান করে যেতে সে কসুর করেনি—তোমরা জান সে কথা?
বিজয়া চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া চাইতেই, বিলাস তাহাকেই উদ্দেশ করিয়া বলিল, পূর্ণবাবুর ভাগ্নে বলে পরিচয় দিয়ে যে তোমাকে পর্যন্ত অপমান করে গিয়েছিল, সে কে? তখন যে তাকে ভারি প্রশ্রয় দিলে। সে-ই নরেনবাবু! তখন নিজের যথার্থ পরিচয় দিতে যদি সে সাহস করতো তবেই বলতে পারতুম, সে পুরুষমানুষ! ভণ্ড কোথাকার!
সহসা পিতাপুত্র উভয়েই সবিস্ময়ে দেখিল, বিজয়ার সমস্ত মুখ বেদনায় একেবারে শুষ্ক বিবর্ণ হইয়া গেছে।
দশম পরিচ্ছেদ
বড়দিনের ছুটির আর বিলম্ব নাই। সুতরাং জগদীশের বাটীর প্রকাণ্ড হলঘরটা মন্দিরের জন্য, এবং অপরাপর কক্ষগুলি কলিকাতার মান্য অতিথিদের নিমিত্ত সজ্জিত করা হইতেছে। স্বয়ং বিলাসবিহারী তাহার তত্ত্বাবধান করিতেছেন। সাধারণ নিমন্ত্রিতের সংখ্যাও অল্প নয়। যাঁহারা বিলাসেরই বন্ধু, স্থির হইয়াছিল তাঁহারা রাসবিহারীর বাটীতে এবং অবশিষ্ট বিজয়ার এখানে থাকিবেন। মহিলা যাঁহারা আসিবেন তাঁহারাও এইখানেই আশ্রয় লইবেন। বন্দোবস্তও সেইরূপ হইয়াছিল।
সেদিন সকালবেলায় বিজয়া স্নান সারিয়া নীচে বসিবার ঘরে প্রবেশ করিতে গিয়া দেখিল, প্রাঙ্গণের একধারে দাঁড়াইয়া পরেশ একহাতে মায়ের কোঁচড় হইতে মুড়ি লইয়া চিবাইতেছে, অপরহস্তে রজ্জুবদ্ধ একটা গরুর গলায় হাত বুলাইয়া অনির্বচনীয় তৃপ্তি লাভ করিতেছে। গরুটাও আরামে চোখ বুজিয়া গলা উঁচু করিয়া ছেলেটার সেবা গ্রহণ করিতেছে।
এই দুটি বিজাতীয় জীবের সৌহৃদ্যের সহিত তাহার মনের পুঞ্জীভূত বেদনার কি যে সংযোগ ছিল বলা কঠিন; কিন্তু চাহিয়া চাহিয়া অজ্ঞাতসারে তাহার চক্ষু দুটি অশ্রুপ্লাবিত হইয়া গেল। এ বাটীতে এ ছেলেটি তাহার ভারী অনুগত। সে চোখ মুছিয়া তাহাকে কাছে ডাকিয়া সস্নেহে কৌতুকের সহিত কহিল, হাঁ রে পরেশ, তোর মা বুঝি তোকে এই কাপড় কিনে দিয়েছে? ছিঃ—এ কি আবার একটা পাড় রে?
পরেশ ঘাড় বাঁকাইয়া, আড়চোখে চাহিয়া নিজের পাড়ের সঙ্গে বিজয়ার শাড়ীর চমৎকার চওড়া পাড়টা মনে মনে মিলাইয়া দেখিয়া অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। তাহার ভাব বুঝিয়া বিজয়া নিজের পাড়টা দেখাইয়া কহিল, এম্নি না হলে কি তোকে মানায়! কি বলিস রে?
পরেশ তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিল, মা কিচ্ছু কিনতে জানে না যে।
বিজয়া কহিল, আমি কিন্তু তোকে এমনি একখানা কাপড় কিনে দিতে পারি, যদি তুই—কিন্তু ‘যদি’তে পরেশের প্রয়োজন ছিল না। সে সলজ্জ হাস্যে মুখখানা আকর্ণ-প্রসারিত করিয়া প্রশ্ন করিল, কখন দেবে?
দিই, যদি তুই আমার একটা কথা শুনিস।
কি কথা?
বিজয়া একটু চিন্তা করিয়া বলিল, কিন্তু তোর মা কি আর কেউ শুনলে তোকে পরতে দেবে না।
এ সম্বন্ধে কোনপ্রকার প্রতিবন্ধক গ্রাহ্য করিবার মত মনের অবস্থা পরেশের নয়। সে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, মা জানবে ক্যাম্নে? তুমি বল না, আমি এক্ষুণি শুনব।
বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুই দিঘ্ড়া-গাঁ চিনিস?
পরেশ হাত তুলিয়া বলিল, ওই ত হোথ্থা। গুটিপোকা খুঁজতে কতদিন দিঘ্ড়ে যাই।
বিজয়া প্রশ্ন করিল, ওখানে সবচেয়ে বড় কাদের বাড়ি, তুই জানিস?
পরেশ বলিল, হিঁ—বামুনদের গো। সেই যে আর বছর রস খেয়ে তিনি ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছ্যালো। এই যেন হেথায় গোবিন্দের মুড়কি-বাতাসার দোকান, আর ওই হোত্থায় তেনাদের দালান।গোবিন্দ কি বলে জানো মাঠান? বলে, সব মাগ্যি-গোণ্ডা, আধ পয়সায় আর আড়াই গোণ্ডা বাতাসা মিলবে না, এখন মোটে দু’ গোণ্ডা। কিন্তু তুমি যদি একসঙ্গে গোটা পয়সার আনতে দাও মাঠান, আমি তা হলে সাড়ে-পাঁচ গোণ্ডা নিয়ে আসতে পারি।
বিজয়া কহিল, তুই দু’পয়সার বাতাসা কিনে আনতে পারবি?
পরেশ কহিল, হিঁ—এ হাতে এক পয়সার সাড়ে পাঁচ গোণ্ডা গুণে নিয়ে বলব, দোকানী, এ হাতে আরো সাড়ে-পাঁচ গোণ্ডা গুণে দাও। দিলে বলব, মাঠান বলে দেছে দুটো ফাউ—নাঃ? তবে পয়সা দুটো হাতে দেব, নাঃ?
বিজয়া হাসিয়া কহিল, হাঁ, তবে পয়সা দিবি। আর অমনি দোকানীকে জিজ্ঞেস করে নিবি, ওই যে বড় বাড়িতে নরেনবাবু থাকত, সে কোথায় গেছে! বলবি—যে বাড়িতে তিনি আছেন, সেটা আমাকে চিনিয়ে দিতে পার দোকানী? কি রে পারবি ত?
পরেশ মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিল, হিঁ—পয়সা দুটো দাও না তুমি। আমি ছুট্টে গে নে আসি।
আমি যা জিজ্ঞেসা করতে বললুম?
পরেশ কহিল, হিঁ—তা-ও।
বাতাসা হাতে পেয়ে ভুলে যাবিনে তো?
পরেশ হাত বাড়াইয়া বলিল, তুমি পয়সা আগে দাও না! আমি ছুট্টে যাই।
আর তোর মা যদি জিজ্ঞেস করে, পরেশ, গিয়েছিলি কোথায়, কি বলবি?
পরেশ অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত হাস্য করিয়া কহিল, সে আমি খুব বলতে পারব। বাতাসার ঠোঙা এমনি কোরে কোঁচড়ে নুকিয়ে বলব, মাঠান পাঠিয়ে ছ্যালো—ঐ হোত্থা বামুনদের নরেনবাবুর খবর জানতে গেছলাম। তুমি দাও না শিগ্গির পয়সা।
বিজয়া হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, তুই কি বোকা ছেলে রে পরেশ, মায়ের কাছে কি মিছে কথা বলতে আছে? বাতাসা কিনতে গিয়েছিলি, জিজ্ঞেস করলে তাই বলবি। কিন্তু দোকানীর কাছে সে খবরটা জেনে আসতে ভুলিস নে যেন। নইলে কাপড় পাবিনে, তা বলে দিচ্ছি।
আচ্ছা, বলিয়া পরেশ পয়সা লইয়া দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলে, বিজয়া শূন্যদৃষ্টিতে সেই দিকেই চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। যে সংবাদ জানিবার কৌতূহলের মধ্যে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতা নাই, যাহা সে যে-কোন লোক পাঠাইয়া অনেকদিন পূর্বেই স্বচ্ছন্দে জানিতে পারিত, তাহাই যে কেন এখন তাহার কাছে এতবড় সঙ্কোচের বিষয় হইয়া উঠিয়াছে, একবার তলাইয়া দেখিলে এই লুকোচুরির লজ্জায় আজ সে নিজেই মরিয়া যাইত। কিন্তু লজ্জাটা নাকি তাহার চিন্তার ধারার সহিত অজ্ঞাতসারে মিশিয়া একাকার হইয়া গিয়াছিল, তাই তাহাকে আলাদা করিয়া দেখিবার দৃষ্টি যে কোনকালে তাহার চোখে ছিল, ইহাও আজ তাহার মনে পড়িল না।
কয়েকখানা চিঠি লিখিবার ছিল। সময় কাটাইবার জন্য বিজয়া টেবিলে গিয়া কাগজ-কলম লইয়া বসিল। কিন্তু কথাগুলা এমনি এলোমেলো অসংবদ্ধ হইয়া মনে আসিতে লাগিল যে, কয়েকটা চিঠির কাগজ ছিঁড়িয়া ফেলিয়া তাহাকে কলম রাখিয়া দিতে হইল।পরেশের দেখা নাই। মনের চাঞ্চল্য আর দমন করিতে না পারিয়া বিজয়া ছাদে উঠিয়া তাহার পথ চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বহুক্ষণে দেখা গেল সে হনহন করিয়া নদীর পথ ধরিয়া আসিতেছে। বিজয়া কম্পিতপদে শঙ্কিত-বক্ষে নীচে নামিয়া বাহিরের ঘরে ঢুকিতেই ছেলেটা বাতাসার ঠোঙা কোঁচড়ে লুকাইয়া চোরের মত পা টিপিয়া কাছে আসিয়া সেগুলি মেলিয়া ধরিয়া বলিল, দু’ পয়সায় বারো গোণ্ডা এনেছি মাঠান।
বিজয়া সভয়ে কহিল, আর দোকানী কি বললে?
পরেশ ফিসফিস করিয়া বলিল, পয়সায় ছ’ গোণ্ডার কথা কাউকে বলতে মানা করে দেছে। বলে কি জান মা—
বিজয়া বাধা দিয়া কহিল, আর সেই বামুনদের নরেনবাবুর কথা—
পরেশ কহিল, সে হোতা নেই—কোথায় চলে গেছে। গোবিন্দ বলে কি জানো মাঠান, বারো গোণ্ডায়—
বিজয়া অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া রুক্ষস্বরে কহিল, নিয়ে যা তোর বার গোণ্ডা বাতাসা আমার সুমুখ থেকে—বলিয়া সরিয়া জানালার গরাদে ধরিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
এই অচিন্তনীয় রূঢতায় ছেলেটা এতটুকু হইয়া গেল। সে এত দ্রুত গিয়াছে এবং আসিয়াছে, এগার গণ্ডার স্থানে কত কৌশলে বার গণ্ডা সওদা করিয়াছে, তবুও মাঠানকে প্রসন্ন করিতে পারিল না মনে করিয়া তাহার ক্ষোভের সীমা রহিল না। সে ঠোঙা দুইটা হাতে করিয়া মলিনমুখে কহিল, এর বেশী যে দেয় না মাঠান!
বিজয়া ইহার জবাব দিল না, কিন্তু এদিকে না চাহিয়াও সে ছেলেটার অবস্থা অনুভব করিতেছিল। তাই খানিক পরে সদয়কণ্ঠে কহিল, যা পরেশ, ওগুলো তুই খেগে যা।
পরেশ সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, সব?
বিজয়া মুখ না ফিরাইয়া কহিল, সব। ওতে আমার কাজ নেই।
পরেশ বুঝিল এ রাগের কথা। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া তাহার কাপড়ের কথাটা স্মরণ হইতেই আরও একটা কথা মনে পড়িয়া গেল।আস্তে আস্তে কহিল, ভট্চায্যিমশায়ের কাছে জেনে আসব মাঠান?
কে ভট্চায্যিমশাই? কি জেনে—বলিয়া উৎসুককণ্ঠে প্রশ্ন করিয়াই বিজয়া মুখ ফিরাইয়াই থামিয়া গেল। মুখের বাকী কথাটুকু তাহার মুখেই রহিয়া গেল, আর বাহির হইল না। বারান্দার উপর ঠিক সম্মুখেই অকস্মাৎ নরেন্দ্রকে দেখা গেল এবং পরক্ষণেই সে ঘরে পা দিয়া হাত তুলিয়া বিজয়াকে নমস্কার করিল।
পরেশ বলিল, কোথায় গেছে নরেন্দরবাবু—
বিজয়া প্রতি-নমস্কারেরও সময় পাইল না, নিদারুণ লজ্জায় সমস্ত মুখ রক্তবর্ণ করিয়া ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, আচ্ছা যা, যা,—আর জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই।
পরেশ বুঝিল, এও রাগের কথা। ক্ষুণ্ণস্বরে কহিল, কাণা ভট্চায্যিমশাই ত তেনাদের পাশের বাড়িতেই থাকে মাঠান। গোবিন্দ-দোকানী যে বললে—
বিজয়া শুষ্ক হাসিয়া কহিল, আসুন, বসুন।
পরেশের প্রতি চাহিয়া বলিয়া উঠিল, তুই এখন যা না পরেশ। ভারী ত কথা, তার আবার—সে আর একদিন তখন জেনে আসিস না হয়। এখন যা।
পরেশ চলিয়া গেলে নরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, আপনি নরেনবাবুর খবর জানতে চান? তিনি কোথায় আছেন তাই?
অস্বীকার করিতে পারিলেই বিজয়া বাঁচিত, কিন্তু মিথ্যা বলিবার অভ্যাস তাহার ছিল না। সে কোনমতে ভিতরের লজ্জা দমন করিয়া বলিল, হাঁ। তা সে একদিন জানলেই হবে।
নরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, কেন? কোন দরকার আছে?
প্রশ্ন তাহার কানের মধ্যে ঠিক বিদ্রূপের মত শুনাইল। কহিল, দরকার ছাড়া কি কেউ কারও খবর জানতে চায় না?
কেউ কি করে না করে, সে ছেড়ে দিন। কিন্তু তার সঙ্গে তো আপনার সমস্ত সম্বন্ধ চুকে গেছে; তবে আবার কেন তার সন্ধান নিচ্চেন? দেনাটা কি সব শোধ হয়নি?
বিজয়ার মুখের উপর ক্লেশের চিহ্ন দেখা দিল, কিন্তু সে উত্তর দিল না। নরেন নিজেও তাহার ভিতরের উদ্বেগ সম্পূর্ণ গোপন করিতে পারিল না।পুনরায় কহিল, যদি আরও কিছু ঋণ বার হয়ে থাকে তা হলেও আমি যতদূর জানি, তার এমন কিছু আর নেই, যা থেকে সেই বাকি ঋণটা পরিশোধ হতে পারবে। এখন আর তাঁর খোঁজ করা—
কে আপনাকে বললে আমি দেনার জন্যেই তাঁর অনুসন্ধান করছি?
তা ছাড়া আর যে কি হতে পারে, আমি ত ভাবতে পারিনে। তিনিও আপনাকে চেনেন না, আপনিও তাঁকে চেনেন না!
তিনিও আমাকে চেনেন, আমিও তাঁকে চিনি।
নরেন হাসিল, কহিল, তিনি আপনাকে চেনেন, এ কথা সত্যি, কিন্তু আপনি তাঁকে চেনেন না। ধরুন, আমিই যদি বলি, আমার নাম নরেন, তা হলেও ত আপনি—
বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, তা হলেও আমি বিশ্বাস করি, এবং বলি এই সত্যি কথাটা অনেকদিন পূর্বেই আপনার মুখ থেকে বার হওয়া উচিত ছিল।
ফুঁ দিয়া আলো নিবাইলে ঘরের চেহারা যেমন বদল হয়, বিজয়ার প্রত্যুত্তরে চক্ষুর নিমেষে নরেনের মুখ তেমনি মলিন হইয়া গেল। বিজয়া তাহা লক্ষ্য করিয়াই পুনশ্চ কহিল, অন্য পরিচয়ে নিজের আলোচনা শোনা, আর লুকিয়ে আড়ি পেতে শোনা, দুটোই কি সমান বলে আপনার মনে হয় না? আমার ত হয়। তবে কিনা আমরা ব্রাহ্ম, এই যা বলেন।
নরেনের মলিনমুখ এইবার লজ্জায় কালো হইয়া উঠিল। একটুখানি মৌন থাকিয়া বলিল, আপনার সঙ্গে অনেক রকম আলোচনার মধ্যে নিজের অলোচনাও ছিল বটে, কিন্তু তাতে মন্দ অভিপ্রায় কিছুই ছিল না।শেষ দিনটায় পরিচয় দেব মনেও করেছিলাম, কিন্তু হয়ে উঠল না। এতে আপনার কোন ক্ষতি হয়েছে কি?
এ প্রশ্ন গোড়াতেই করিয়া বসিলে এ পক্ষেও উত্তর দেওয়া নিশ্চয়ই শক্ত হইত। কিন্তু যে আলোচনা একবার শুরু হইয়া গেছে, নিজের ঝোঁকে সে অনেক কঠিন স্থান আপনি ডিঙাইয়া যায়। তাই সহজেই বিজয়া জবাব দিতে পারিল। কহিল, ক্ষতি একজনের ত কতরকমেই হতে পারে। আর যদি হয়েও থাকে, সে ত হয়েই গেছে, আপনি ত এখন তার উপায় করতে পারবেন না। সে যাক। আপনার নিজের সম্বন্ধে কোন কথা জানতে চাইলে কি—
রাগ করব? না না। বলিয়াই তৎক্ষণাৎ প্রশান্ত নির্মল হাস্যে তাহার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। এতদিন এত কথাবার্তাতেও এই লোকটির যে পরিচয় বিজয়া পায় নাই, একমুহূর্তের হাসিটুকু তাহাকে সে খবর দিয়া গেল। তাহার মনে হইল, ইহার সমস্ত অন্তর-বাহির একেবারে যেন স্ফটিকের মত স্বচ্ছ। যে লোক সর্বস্ব গ্রহণ করিয়াছে, তাহার কাছেও ইহার না না-ই বটে, এবং ঠিক এইজন্যই বোধ করি সে তাহার মুখের পানে চোখ তুলিয়া আর প্রশ্ন করিতে পারিল না, ঘাড় হেঁট করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি এখন আছেন কোথায়?
নরেন বলিল, আমার দূর-সম্পর্কের এক পিসি এখনো বেঁচে আছেন, তাঁর বাড়িতেই আছি।
আপনার সম্বন্ধে যে সামাজিক গোলযোগ আছে, তা কি সে গ্রামের লোকেরা জানে না?
জানে বৈ কি?
তবে?
নরেন্দ্র একটুখানি ভাবিয়া বলিল, যে ঘরটায় আছি, সেটাকে ঠিক বাড়ির মধ্যে বলা যায় না, আর আমার অবস্থা শুনেও বোধ করি, সামান্য কিছুদিনের জন্যে তাঁর ছেলেরা আপত্তি করে না। তবে বেশী দিন থেকে তাঁদের বিব্রত করা চলবে না, সে ঠিক। বলিয়া সে একটুখানি থামিল। কহিল, আচ্ছা, সত্যি কথা বলুন তো, কেন এসব খোঁজ নিচ্ছিলেন? বাবার আরও কিছু দেনা বেরিয়েছে, এই না?
উত্তর দিবার জন্যই বোধ করি বিজয়া তাহার মুখপানে চাহিল। কিন্তু সহসা হাঁ—না কোন কথাই তাহার গলা দিয়া বাহির হইল না।
নরেন্দ্র কহিল, পিতৃঋণ কে না শোধ দিতে চায়, কিন্তু সত্যি বলচি আপনাকে, স্বনামে-বেনামে এমন কিছু আমার নেই, যা বেচে দিতে পারি।শুধু মাইক্রস্কোপ্টা আছে, তাও বেচে তবে বিদেশে যাবার খরচটা যোগাড় করতে হবে। পিসিমার অবস্থাও খারাপ—এমন কি, সেখানে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত—বলিয়াই সে হঠাৎ থামিয়া গেল।
বিজয়ার চোখে জল আসিয়া পড়িল; সে ঘাড় ফিরাইল।
নরেন্দ্র বলিল, তবে যদি এই দয়াটা করেন, তা হলে বাবার দেনাটা আমি নিজের নামে লিখে নিতে পারি। ভবিষ্যতে শোধ দিতে প্রাণপণে চেষ্টা করব। আপনি রাসবিহারীবাবুকে একটু বললেই আর তিনি এ নিয়ে এখন পীড়াপীড়ি করবেন না।
পরেশ আসিয়া দ্বারের বাহির হইতে কহিল, মাঠান, মা বলচে, বেলা যে অনেক হয়ে গেল—ঠাকুরমশাইকে ভাত দিতে বলবে?
সুমুখের ঘড়িটার প্রতি চাহিয়া নরেন্দ্র চকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, লজ্জিত হইয়া বলিল, ইস্! বারোটা বাজে! আপনার ভারী কষ্ট হল।
বিজয়া চোখের জল সামলাইয়া লইয়াছিল; কহিল,আপনি কি জন্যে এসেছিলেন, সে ত বললেন না?
নরেন্দ্র তাড়াতাড়ি বলিল, সে থাক। বলিয়া প্রস্থানের উপক্রম করিতেই বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার পিসিমার বাড়ি এখান থেকে কত দূর? এখন সেখানেই ত যেতে হবে?
নরেন্দ্র কহিল, হ্যাঁ।দূর একটু বৈ কি—প্রায় ক্রোশ-দুই।
বিজয়া অবাক হইয়া বলিল, এই রোদের মধ্যে এখন দু’ ক্রোশ হাঁটবেন? যেতেই তো তিনটে বেজে যাবে।
তা হোক, তা হোক, নমস্কার। বলিয়া নরেন পা বাড়াইতেই বিজয়া দ্রুতপদে কবাটের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কহিল, আমার একটা অনুরোধ আপনাকে আজ রাখতেই হবে। এত বেলায় না খেয়ে আপনি কিছুতেই যেতে পারবেন না।
নরেন্দ্র অতিশয় বিস্মিত হইয়া বলিল, খেয়ে যাব? এখানে?
কেন, তাতে কি আপনারও জাত যাবে নাকি?
প্রত্যুত্তরে পুনরায় তেমনি প্রশান্ত হাসিতে তাহার মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল; কহিল, না, সে ভয় আমার দুনিয়ায় আর নেই। তা ছাড়া ভগবান আমার প্রতি আজ ভারী প্রসন্ন, নইলে এত বেলায় সেখানে যে কি জুটত, সে ত আমি জানি।
তবে একটু বসুন, আমি আসচি, বলিয়া বিজয়া তাহার প্রতি না চাহিয়াই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।