দণ্ড উপনিবেশে
‘এক অদ্ভুত ধরনের যন্ত্র এটা, পর্যটককে বললেন অফিসার, আর একরকম মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে লাগলেন যন্ত্রটা; ওটা তার কাছে নিঃসন্দেহে অনেক চেনা। পর্যটক ভদ্রলোক মনে হয় স্রেফ ভদ্রতার খাতিরেই কমান্ড্যান্টের অনুরোধ গ্রহণ করেছিলেন– অবাধ্যতা ও ঊর্ধ্বতনের প্রতি অসম্মানজনক আচরণের কারণে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া এক সৈনিকের দণ্ড কার্যকর হওয়া দেখার অনুরোধ। প্রাণদণ্ড কার্যকর হওয়া নিয়ে অবশ্য স্বয়ং এই শাস্তি উপনিবেশেই কারো মধ্যে তেমন বিরাট কোনো আগ্রহ নেই। যা হোক, অফিসার আর পর্যটক ছাড়া এখানে– এই গভীর বালুভরা ছোট উপত্যকায়, যেটাকে ঘিরে রেখেছে মরুময় সব ঢাল –আর শুধু আছে দণ্ডিত লোকটা, আলুথালু চেহারার বোকা-বোকা মুখ হাঁ-করা এক জীব, আর একজন সৈনিক যার হাতে ধরা রয়েছে ভারী একটা শেকল। ওটাতে জড়ো করা আছে ছোট ছোট আরো শেকল, যেগুলো দিয়ে বাঁধা আছে দণ্ডিত লোকের গোড়ালি, কবজি আর ঘাড়; আর এই বড় ও ছোট শেকলগুলো আবার জোড়া দেওয়া আছে একসঙ্গে। সত্যি বলতে, দণ্ডিত লোকটার মধ্যে এমন এক পোষা কুকুর গোছের মনিবভক্তির ব্যাপার আছে যে মনে হচ্ছে তাকে চারপাশের ঢালগুলোতে যদি দৌড়াদৌড়ির জন্য ছেড়েও দেওয়া হয়, তবু চিন্তা নেই, দণ্ড কার্যকরের ঠিক আগেভাগে স্রেফ একটা বাঁশি বাজালেই সে ফিরে আসবে।
যন্ত্রটার ব্যাপারে পর্যটকের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। তিনি দণ্ডিত লোকটার পেছনে প্রায় পরিষ্কার এক অনাগ্রহী চেহারা নিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছেন; ওদিকে অফিসার ব্যস্ত শেষ সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে, এই হামা দিয়ে চলে যাচ্ছেন যন্ত্রটার তলায়– গভীরভাবে ওটা পোঁতা আছে মাটিতে– তো এই একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছেন এর উপরদিককার অংশগুলো দেখতে। এসব কাজ একটা সামান্য কোনো মেকানিককে দিয়ে দিলেই হয়, কিন্তু না, অফিসার নিজেই খুব উৎসাহ নিয়ে সারছেন ওগুলো –হতে পারে তিনি এই যন্ত্রটার বিরাট ভক্ত কিংবা অন্য কোনো কারণ আছে, যেজন্য এই কাজগুলো অন্য আর কাউকে দেওয়া সম্ভব না। সবকিছু এখন রেডি!’ তিনি শেষমেশ হাঁক দিলেন আর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন নিচে। ভয়ংকর ক্লান্ত তিনি, মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছেন; তার উর্দির কলারে গোঁজা রয়েছে মেয়েদের দুটো হালকা রুমাল। এই উর্দিগুলো গ্রীষ্মমণ্ডলের এসব দেশের হিসাবে বেশি ভারী,’ বললেন পর্যটক; অফিসার ভেবেছিলেন উনি যন্ত্রের বিষয়ে কিছু জিগ্যেস করবেন। তা ঠিক,’ অফিসার বললেন, তৈরি-রাখা এক বালতি পানিতে তিনি তার হাতে লেগে থাকা তেল-কালি ধুচ্ছেন, কিন্তু ওগুলো পরলে মনে হয় দেশে আছি; দেশের ছোঁয়া আমরা হারাতে চাই না। এখন আসুন, যন্ত্রটা দেখুন একটু,’ ঝট করে বললেন তিনি, একটা তোয়ালে দিয়ে হাত মুছছেন আর একই সঙ্গে যন্ত্রটার দিকে দেখাচ্ছেন, এ পর্যন্তই হাত লাগানোর কাজ, এরপর যন্ত্রটা চলবে একদম নিজে নিজেই। মাথা নাড়লেন পর্যটক আর অফিসারকে অনুসরণ করলেন। সম্ভাব্য যেকোনো ঘটন-অঘটন থেকে নিজেকে বাঁচাতে অফিসার এবার যোগ করলেন: বলছি না যে মাঝেমধ্যে এটা বসে যায় না; আশা করছি আজ তেমন কিছু ঘটবে না, কিন্তু কিছু সম্ভাবনা তো থাকেই। যা-ই বলেন না কেন, টানা বারো ঘণ্টা তো চলতে হয় ওটাকে। কিন্তু ওরকম কিছু ঘটলেও দেখা যায় সেগুলো খুব সামান্য ব্যাপার, আমরা মেরামত করে ফেলি মুহূর্তের মধ্যে।
‘বসুন না? অবশেষে বললেন তিনি, একগাদা বেতের চেয়ার থেকে একটা টেনে এনে পর্যটককে দিলেন; না করতে পারলেন না পর্যটক। তিনি দেখলেন তিনি বসে আছেন একটা গর্তের কিনারায়, ওটার ভেতরটা একনজর দেখে নিলেন। বেশি গভীর না ওই গর্ত। গর্তের এক পাশে কোদলানো মাটিগুলো ঢিবি করে একটা বাঁধ বানিয়ে রাখা; ওটার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে এই যন্ত্র। জানি না,’ বললেন অফিসার, ‘কমান্ড্যান্ট সাহেব আপনাকে যন্ত্রটা ব্যাখ্যা করেছেন কি না। পর্যটক একটা অনিশ্চিত অঙ্গভঙ্গি করলেন; এটাই চাইছিলেন অফিসার, যাতে করে তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করতে পারেন যন্ত্রটাকে। এই যন্ত্র,’ বললেন তিনি, একটা সংযোজক রড ধরে ওটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, ‘আমাদের এর আগের কমান্ড্যান্টের আবিষ্কার। একদম প্রথম দিককার পরীক্ষাগুলোতে আমি নিজে অংশ নিয়েছিলাম; এই কাজের প্রতিটা স্তরেই– একদম শেষ হওয়া পর্যন্ত । জড়িত ছিলাম। কিন্তু এটা আবিষ্কারের কৃতিত্ব ওনার একার। আপনি আমাদের প্রাক্তন কমান্ড্যান্টের কথা শুনেছেন কখনো? না? আচ্ছা। আমি একটুও বাড়িয়ে বলব না যদি বলি এই শাস্তি-উপনিবেশ তৈরি হওয়া আর এটা চালানোর পুরো কাজটাই ওনার করা। যখন তিনি মারা যান, আমরা –তার বন্ধুরা– তত দিনে বুঝে গেছি এই উপনিবেশকে উনি এমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ অস্তিত্ব দিয়েছেন যে তার উত্তরাধিকারীর মাথা যদি নতুন আইডিয়াতে গিজগিজও করে, তবুও ওনার রেখে যাওয়া ব্যবস্থার সামান্য পরিবর্তনও কেউ করতে পারবে না, অন্তত সামনের বেশ অনেক বছর তো নয়ই। আমাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণীই বাস্তবে ফলেছে; নতুন কমান্ড্যান্ট একই কথা স্বীকার করেছেন। আহা, আপনি আমাদের আগের কমান্ড্যান্টকে দেখেননি! –তবে, নিজেকেই থামালেন অফিসার, এই যে আমি বকেই যাচ্ছি, আর ওনার অমর সৃষ্টি এই যে আমাদের সামনেই। দেখতেই পাচ্ছেন, এর মোট তিনটা অংশ। সময়ের সঙ্গে প্রত্যেকটা অংশের আলাদা আলাদা ডাকনাম তৈরি হয়েছে। নিচের অংশের নাম বিছানা, উপরেরটা নকশাবিদ, আর এই যে মাঝের অংশ, আগের দুটোর মাঝখানে ঝুলে আছে, এর নাম আঁচড়া।’ মানে জমিতে দেওয়ার মই? জিগ্যেস করলেন পর্যটক। খুব একটা মনোযোগের সঙ্গে কথা শুনছিলেন না তিনি; এই ছায়াহীন উপত্যকায় রোদের তেজ ফেটে পড়ছে; মাথা ঠিক রাখাটাই এক সমস্যা। তবে সে কারণেই অফিসারের প্রশংসা না করে পারছেন না তিনি, লোকটা তার আঁটসাঁট কুচকাওয়াজি উর্দি পরে –ওটা থেকে ঝুলছে কাঁধের ভারী সামরিক অলংকরণগুলো আর অনেক রেশমি কাজের বিনুনি– বিষয়টা ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন কী মহা উৎসাহে আর একই বেসঙ্গে হাতের ড্রাইভার দিয়ে কোথাও কোনো ঢিলা ভ্রু পেলেই সেটা টাইট করে চলেছেন। অন্যদিকে সৈনিকটার অবস্থা মনে হচ্ছে পর্যটকের মতোই। সে তার দুই কবজিতে লাগিয়ে রেখেছে দণ্ডিত মানুষটার শেকলগুলো, আর এক হাত রাইফেলে ঠেকিয়ে মাথা পেছনে বেঁকিয়ে, মনোযোগ দিচ্ছে না কোনোকিছুতেই। পর্যটক তাতে অবাক হলেন না একটুকুও, কারণ অফিসার কথা বলছেন ফরাসিতে; সৈনিক কিংবা দণ্ডিত মানুষ– কেউই ফরাসি ভাষা বোঝে না। সেজন্য ব্যাপারটা অদ্ভুত যে, ভাষা না-বোঝা সত্ত্বেও দণ্ডিত লোকটা ওরকম মন দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে অফিসারের কথা বোঝার। ঢুলুঢুলু এক একগুঁয়েমি নিয়ে সে সেদিকেই তাকাচ্ছে যেদিকে অফিসার আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন, আর যখন পর্যটক কোনো কথা জিগ্যেস করে থামিয়ে দিচ্ছেন অফিসারকে, তখন সেও, অফিসারের মতোই, দৃষ্টি ঘোরাচ্ছে পর্যটকের দিকে।
‘হ্যাঁ, আঁচড়া,’ বললেন অফিসার, ‘একদম উপযুক্ত নাম। আঁচড়ার দাঁতের মতো করেই এতে সুইগুলো বসানো, আর পুরো জিনিসটা কাজ করে আঁচড়ার মতোই, শুধু পার্থক্য এটুকু যে এটা এক জায়গাতেই থাকে আর এর কাজ আঁচড়ার চাইতে অনেক বেশি শৈল্পিক। একটু পরেই আপনি দেখতে পারবেন। এখানে, বিছানায়, শোয়ানো হয় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে।– দেখুন, আমি আগে চাচ্ছি আপনাকে যন্ত্রটা একটু বোঝাতে, তারপর আসল কাজের জন্য ওটা চালু করা যাবে। ওভাবে আগালে আপনি পুরো ব্যাপারটা অনেক ভালোভাবে ধরতে পারবেন। তা ছাড়া, নকশাবিদ অংশের একটা খাজকাটা চাকা অনেক বেশি পুরোনো হয়ে গেছে; ঘোরার সময় ওটা মারাত্মক খরখর আওয়াজ করে; তখন আপনি নিজের কথাও নিজে শুনতে পাবেন না; খুচরা যন্ত্রপাতি এখানে পাওয়া কি যে দুর্ভাগ্যজনক সমস্যা।– তো, এই হচ্ছে বিছানা, যেমনটা বলছিলাম আর কী। এর পুরোটা ঢাকা আছে ভারী তুলোর আস্তর দিয়ে, উদ্দেশ্যটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে খানিক পরেই। এই তুলোর আস্তরের উপরে আসামিকে শোয়ানো হয় উপুড় করে, অবশ্যই ন্যাংটো অবস্থায় তাকে শুইয়ে রাখার জন্য এই যে চামড়ার বাধুনিগুলো– এগুলো হাতের জন্য, এগুলো পায়ের, আর এইটা গলার। এখানে বিছানার এই মাথায় আছে– যেখানে আমি বলেছি যে শুরুতেই আসামিকে শোয়ানো হয় মুখ নিচের দিকে দিয়ে– তুলোর এই পিণ্ড, যেটা আমরা আসামির মুখের মধ্যে সোজা ঢুকিয়ে দেওয়ার সময় সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এর কাজ হচ্ছে চিৎকার থামানো আর দণ্ডিতকে জিভে কামড় দিতে বাধা দেওয়া। তুলোর পিণ্ড মুখে ভরে নেওয়া ছাড়া কোনো গতিও নেই, কারণ তা না করলে গলার বাঁধুনি সোজা ঘাড় ভেঙে দেবে।’ ‘পেঁজা তুলো এগুলো?’ সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলেন পর্যটক। অবশ্যই, মৃদু হেসে বললেন অফিসার, ‘নিন না, নিজেই দেখুন। পর্যটকের হাত ধরে তিনি বিছানার উপরে হাতটা বুলিয়ে দিলেন। বিশেষভাবে বানানো ব্যান্ডেজের তুলো এগুলো, সেজন্যই আপনার কাছে এত অচেনা লাগছে; একটু পরেই আপনাকে বলছি এর কাজ কী।’ এতক্ষণে পর্যটকের কিছুটা আগ্রহ হওয়া শুরু হলো যন্ত্রটা নিয়ে; তিনি মাথা উঁচু করে ওটার দিকে তাকালেন, এক হাত তুলে সূর্যের আলো থেকে চোখ ঠেকিয়ে। বিরাট একটা জিনিস। বিছানা আর নকশাবিদ দুটো আকারে সমান, দেখতে মনে হয় কালো রঙের দুটো সিন্দুক। নকশাবিদটা বিছানার প্রায় দুই মিটার উপরে লাগানো; চার কোনায় চারটে পেতলের রড দিয়ে জোড়া দেওয়া আছে ওদুটো, রডগুলো যেন ঝিলিক দিচ্ছে সূর্যের আলোয়। দুই সিন্দুকের মাঝ বরাবর, একটা স্টিলের বেল্টের উপর, ঝুলছে আঁচড়া।
অফিসার কিন্তু পর্যটকের প্রথম দিককার অন্যমনস্কতা বলতে গেলে খেয়ালই করেননি, কিন্তু এখন তার মধ্যে যে আগ্রহ জেগে উঠেছে তা তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন; তাই পর্যটককে ভালোমতো যন্ত্রটা দেখার সময় দেওয়ার জন্য তিনি তার ব্যাখ্যায় বিরতি দিলেন একটু। দণ্ডিত আসামি পর্যটকের নকল করে চলেছে; পার্থক্য এটুকু যে সে তার হাত তুলে চোখ ঢাকতে পারছে না, না-ঢাকা চোখে পিটপিট করে উপরে তাকিয়ে আছে তীব্র আলোর দিকে।
‘অল রাইট, বুঝলাম, মানুষটা শুয়ে আছে বিছানায়,’ বললেন পর্যটক; তিনি চেয়ারে পেছনে ভর দিয়ে বসলেন তার পায়ের উপর পা তুলে।
‘হ্যাঁ,’ বললেন অফিসার, মাথার ক্যাপ সামান্য পেছনে সরিয়ে আর তার তাপে পোড়া মুখটায় হাত বুলিয়ে, এবার শুনুন! বিছানা আর নকশাবিদ– দুটোরই আছে নিজস্ব বৈদ্যুতিক ব্যাটারি; বিছানার নিজের জন্যই লাগে ওটা, আর নকশাবিদের ব্যাটারি আঁচড়ার জন্য। মানুষটাকে যেই বেঁধে শোয়ানো হবে, বিছানা ঘোরা শুরু করবে। পাশাপাশি আর উপর-নিচ– একই সঙ্গে দুদিক থেকেই থরথর কাঁপবে ওটা, খুব সূক্ষ্ম আর দ্রুত গতির ঝকানি। স্বাস্থ্যনিবাসগুলোয় এই ধরনের জিনিস আপনি দেখে থাকবেন; কিন্তু আমাদের বিছানার ক্ষেত্রে এর প্রতিটা নড়াচড়াই নিখুঁতভাবে হিসাব করা; হতেই হবে, আঁচড়ার চলার সঙ্গে একদম এক তালে সংগতি রাখার অন্য কোনো উপায় নেই। আর এই আঁচড়াই হচ্ছে শাস্তি কার্যকর করার মূল জিনিস।
‘কিন্তু এই শাস্তির ধরনটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?’ পর্যটক জিজ্ঞাসা করলেন। ‘আপনি সেটাও জানেন না?’ ঠোঁট দুটো কামড়িয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন অফিসার: ‘মাফ করবেন– আমার ব্যাখ্যাগুলো একটু এলোমেলো লাগতে পারে, আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সত্যি হচ্ছে, আগের কমান্ড্যান্ট নিজেই এই ব্যাখ্যাগুলো দিতেন, কিন্তু নতুন কমান্ড্যান্ট সে দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন; তার পরও আপনার মতো সম্মাননীয় একজন ভিজিটরকেও যে’– পর্যটক দুই হাত দিয়ে চেষ্টা করলেন এই সম্মান এড়াতে, কিন্তু অফিসার অনড়– ‘আপনার মতো সম্মাননীয় একজন ভিজিটরকেও যে আমাদের শাস্তি কী চেহারা নেয় তা এমনকি একটু বলাও হবে না, তা ওনার আরেকটা নতুন রীতি যা কিনা–’ এই পর্যায়ে তিনি ঠিক কোনো গালি ব্যবহার করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নিজেকে সংযত করে নিয়ে স্রেফ বললেন: ‘আমাকে এ ব্যাপারে জানানো হয়নি; আমার দোষ না। তবে কথা হচ্ছে, আমিই আসলে আমাদের এই শাস্তির ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজে সবচেয়ে উপযুক্ত অবস্থায় আছি, কারণ আমার কাছে এই এখানে আছে’– তিনি তার বুকপকেটে টোকা দিলেন– ‘আমাদের আগের কমান্ড্যান্টের নিজ হাতে আঁকা এ বিষয়ের নকশাগুলো।
‘কমান্ড্যান্টের নিজের আঁকা?’ জিগ্যেস করলেন পর্যটক: “উনি কি তাহলে একই সঙ্গে এতকিছু ছিলেন? সৈনিক, বিচারক, প্রকৌশলী, ওষুধ-বিশেষজ্ঞ, নকশাবিদ– সব?
‘আসলেই তাই,’ বললেন অফিসার, মাথা নাড়লেন একটা ভাবুক, চকচকে চোখে। তারপর নিজের হাত দুটো ভালো করে দেখলেন; ওরা এই নকশাগুলো ধরার জন্য উপযুক্ত সাফ বলে মনে হলো না তার; অতএব বালতির কাছে গেলেন তিনি, হাত দুটো আবার ধুলেন। এরপর তিনি বের করলেন একটা ছোট চামড়ার ফোল্ডার, বললেন: ‘আমাদের শাস্তি খুব কঠিন কিছু না। দণ্ডিত আসামি যে আইন ভেঙেছে তা তার গায়ে লেখা হবে আঁচড়াটা দিয়ে। যেমন ধরুন, এই আজকের আসামি’– অফিসার দণ্ডিত লোকটাকে দেখালেন –‘ওর গায়ে লেখা হবে: সম্মান করো তোমার ঊধ্বর্তনকে!
পর্যটক দণ্ডিত মানুষটাকে দ্রুত একনজর দেখলেন: অফিসার তার দিকে আঙুল তুলতেই সে মাথা নুইয়ে দাঁড়াল, মনে হচ্ছে তার শ্রবণশক্তির সবটা দিয়ে চেষ্টা করছে অফিসারের কথা বুঝতে। কিন্তু তার পুরু আর অসন্তোষে বাঁকানো ঠোঁট দুটোর নড়াচড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে কিছুই ধরতে পারেনি। পর্যটকের মাথায় ঘুরছে অনেকগুলো প্রশ্ন, কিন্তু লোকটাকে দেখতে দেখতে তিনি শুধু এটুকুই জিজ্ঞাসা করলেন: ‘ও কি ওর শাস্তিটা জানে?’ ‘না, অফিসার বললেন, চাচ্ছিলেন কথাটা ব্যাখ্যা করতে কিন্তু পর্যটক থামিয়ে দিলেন তাকে তার নিজের শাস্তি সে জানে না?’ ‘না, আবার বললেন অফিসার, এক মুহূর্তের জন্য থামলেন যেন বা আশা করছেন পর্যটক তাকে প্রশ্নটা জিগ্যেস করার ব্যাখ্যা দেবেন, এরপর বললেন: ‘ওটা তাকে জানানোর তো কোনো মানে হয় না। সে তো তার গায়ের মাংসেই জেনে যাচ্ছে সেটা। পর্যটক– আর কিছু বলার নেই ওনার– অনুভব করলেন যে দণ্ডিত মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে জানতে চাইছে, তাকে বলা পুরো কার্যপ্রণালিতে তার সায় আছে কি না। সুতরাং, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা অবস্থা থেকে আবার সামনে ঝুঁকলেন পর্যটক, নতুন প্রশ্ন করলেন: “কিন্তু সে জানে তো যে তার বিরুদ্ধে রায় হয়ে গেছে? না, তাও জানে না সে,’ বললেন অফিসার, পর্যটকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন যেন বা তার কাছ থেকে আরো অদ্ভুত কিছু কথাবার্তা শোনার আশা করছেন। মানে বলতে চাচ্ছেন, ভুরু মুছতে মুছতে বললেন পর্যটক, এই এখন পর্যন্ত সে জানে না তার আত্মপক্ষ সমর্থনটা কীভাবে নেওয়া হয়েছে? তার আত্মপক্ষ সমর্থনের তো কোনো সুযোগই ছিল না, অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন অফিসার, যেন তিনি নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন আর পর্যটককে এসব স্বতঃসিদ্ধ জিনিস শোনার বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে চাইছেন। কিন্তু আসামির তো তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ অবশ্যই থাকা উচিত,’ বললেন পর্যটক,– বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
অফিসার বুঝতে পারছেন তার যন্ত্র ব্যাখ্যা করার ব্যাপারটা লম্বা সময়ের জন্য ঝুলে যাওয়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছেন তিনি; তাই তিনি পর্যটকের কাছে গেলেন, তার হাত ধরলেন, দণ্ডিত আসামির দিকে দেখালেন– যেহেতু এটা পরিষ্কার যে সে-ই এখন সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, তাই এখন সে শক্ত হয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে –সৈনিকও একটা টান মারল তার শেকলে –আর বললেন: ‘ব্যাপারটা এমন। শাস্তির এই উপনিবেশে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিচারক হিসেবে। আমার বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও। কারণ আমি ছিলাম সব দণ্ডবিধি বিষয়ে আগের কমান্ড্যান্টের সহকারী আর যন্ত্রটা অন্য কারো চেয়ে যেহেতু আমিই বেশি জানি। যে নীতির ওপরে আমি আমার সিদ্ধান্তগুলো নিই তা হচ্ছে: অপরাধ সব সময়েই প্রশ্নাতীত একটা ব্যাপার। অন্য আদালতগুলো এই নীতিতে চলতে পারে না কারণ, সেগুলোতে থাকে একের অধিক সদস্য, আর তা ছাড়া সেগুলোর উপরেও থাকে আরো আদালত। এখানে বিষয়টা সে রকম না, কিংবা আমাদের আগের কমান্ড্যান্টের সময়ে অন্তত সে রকম ছিল না। স্বীকার করতে হচ্ছে, নতুনজন আমার রায়ে হস্তক্ষেপ করার কিছু আগ্রহ এরই মধ্যে দেখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি ওনাকে নিরস্ত করতে সফল হয়েছি, আর আমি তা হতেই থাকব।– আপনি নির্দিষ্ট করে এই কেস্টার বিষয়ে ব্যাখ্যা চাচ্ছিলেন; সাধারণ একটা কেস্ এটা, সবগুলোই তাই। আজ সকালে আমাকে একজন ক্যাপ্টেন জানাল যে এই লোক– যাকে রাখা হয়েছে ঐ ক্যাপ্টেনের চাকর হিসেবে, তার দরজার বাইরে সে শোয়– কাজের সময়ে ঘুমাচ্ছিল। দেখুন, এ ব্যাটার কাজই হচ্ছে প্রতিবারের ঘণ্টা বাজতেই উঠে দাঁড়ানো আর ক্যাপ্টেনের দরজায় স্যালুট করা। বিরাট কোনো কঠিন কাজ নয়, তবে খুব দরকারি কাজ তো বটেই; কারণ ওর ঊর্ধ্বতনকে পাহারা দেওয়া আর তার জন্য অপেক্ষা করা– দুটো কাজের জন্যই ওর দরকার সব সময় সতর্ক থাকা। গত রাতে ক্যাপ্টেন চাইল দেখবে যে এই চাকর ব্যাটা ঠিকমতো তার দায়িত্ব পালন করছে কি না। রাত দুটো বাজতে ক্যাপ্টেন দরজা খুলল, দেখল এ লোক কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ক্যাপ্টেন তার ঘোড়ার চাবুকটা নিয়ে এল আর মারল এর মুখে। তখন উঠে ক্ষমা চাওয়ার বদলে, এই লোক তার প্রভুর পা পেঁচিয়ে ধরল, তাকে কঁকি দিল আর চেঁচিয়ে বলল: “ওই চাবুক ফেলে দে, নয়তো আমি তোকে গিলে খাব।”– এই হচ্ছে এই কেসের ফ্যাক্টস্। এক ঘণ্টা আগে ক্যাপ্টেন এসেছিলেন আমার কাছে; আমি তার বক্তব্যটা লিখে নিলাম আর তারপরই রায় দিয়ে দিলাম। আর ওকে শেকল পরাতে বললাম। সোজাসাপটা ব্যাপার। আমি যদি এর বদলে ওকে প্রথমে ডাকতাম, জেরা করতাম, তাতে বিভ্রান্তি বাড়তই শুধু। সে মিথ্যা বলত; আমি যদি সফলও হতাম ওর মিথ্যাগুলো খণ্ডন করতে, তখন ও সেগুলোর বদলে বলত আরো নতুন সব মিথ্যা; তারপর আরো। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমার কাছে ধরা খেয়ে গেছে ও, আমি ওকে ছাড়ছি না।– এখন সব পরিষ্কার? সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, দণ্ড কার্যকর করা শুরু হয়ে যাওয়া উচিত আর আমি এখনো যন্ত্রটা আপনাকে পুরো ব্যাখ্যা করেই উঠতে পারিনি। পর্যটককে নিজের আসনে বসার জন্য চাপ দিয়ে অফিসার ফিরে গেলেন যন্ত্রের কাছে, শুরু করলেন: দেখতেই পাচ্ছেন, আঁচড়ার আকৃতি মানুষের শরীরের আকৃতির সঙ্গে মিল রেখে করা; এই হচ্ছে শরীরের উপরের অংশের জন্য আঁচড়া, আর এগুলো পায়ের জন্য আঁচড়া। মাথার জন্য রাখা আছে শুধু এই ছোট্ট খোদাইযন্ত্রটা। আপনার কাছে এখন পরিষ্কার তো সব?’ তিনি বন্ধুত্বের ঢঙে ঝুঁকলেন পর্যটকের দিকে, সবচেয়ে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে তৈরি।
পর্যটক আঁচড়া দেখতে লাগলেন ভুরু কুঁচকে। বিচারপ্রক্রিয়া সম্বন্ধে যা জানলেন তিনি, তাতে তিনি অসন্তুষ্ট। তাকে অবশ্য মানতে হচ্ছে যে এটা একটা শাস্তি-উপনিবেশ, এখানে বিশেষ ব্যবস্থার দরকার আছে, আর সামরিক বিধিব্যবস্থা পুরোপুরি মেনে চলা ছাড়া এখানে কোনো বিকল্পও নেই। তবে তিনি নতুন কমান্ড্যান্টের ওপর খানিক আশা রাখছেন, ওনার কথা শুনে মনে হচ্ছে যত ধীরেই উনি যোক চাচ্ছেন নতুন কোনো ধরনের বিধিব্যবস্থা চালু করতে, এই অফিসারের সীমিত বিচারবুদ্ধি যেগুলো বুঝতে অক্ষম। এই চিন্তা থেকেই পর্যটক জিজ্ঞাসা করলেন: ‘কমান্ড্যান্ট কি রায় কার্যকর হওয়া দেখতে আসবেন?’ ‘তার নিশ্চয়তা নেই,’ আকস্মিক এই প্রশ্নে বিব্রত হয়ে বললেন অফিসার, তার বন্ধুত্বপূর্ণ চেহারা কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে: ‘ঠিক এ কারণেই আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো কোনো সময় নেই। আমাকে আসলে আমার ব্যাখ্যা সংক্ষেপ করে ফেলতে হচ্ছে, আফসোস থেকে গেল। কিন্তু আগামীকাল যন্ত্রটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলার পর –এর একমাত্র সমস্যা হলো এটা কী যে নোংরায় মাখামাখি হয়ে যায় –অতি অবশ্যই আমি আপনাকে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেব। তাহলে এখনকার মতো, শুধু দরকারি ব্যাখ্যাগুলো।– মানুষটাকে যখন বিছানায় শোয়ানো হবে, আর কাঁপতে থাকবে বিছানা, আঁচড়া নেমে আসবে শরীরের উপর। আঁচড়া অটোমেটিক নিজেকে ঠিক করে নেবে যেন সুঁইয়ের মাথাগুলো ঠিক শরীর ছুঁয়ে থেমে যায়; ঠিকঠাকমতো ওটা হয়ে যাওয়ার পরে, সঙ্গে সঙ্গে এই স্টিলের বেল্টটা টান টান হয়ে যাবে, একটা রডের মতো। এবার শুরু হবে আসল কাজ। সাধারণ চোখে শাস্তিগুলোর মধ্যে বাহ্যিক কোনো পার্থক্য ধরা পড়বে না। আঁচড়াটা দেখে মনে হবে যে সে তার কাজ করে যাচ্ছে একই ছন্দে। আঁচড়া কাঁপছে, সুচগুলো ঢুকে যাচ্ছে শরীরে, আর বিছানার কাঁপুনিতে কেঁপে কেঁপে শরীর নিজেকে তুলে ধরছে আঁচড়ার কাছে। যাতে করে সবাই শাস্তি কার্যকর হওয়াটা নিখুঁতভাবে দেখতে পারে, আঁচড়াটা তাই কাঁচ দিয়ে বানানো। সুচগুলো কাঁচের উপর চড়ানো বেশ টেকনিক্যাল সমস্যা হয়েছিল বটে, কিন্তু অনেকবার পরীক্ষার পর আমরা পেরেছি। কোনো চেষ্টাই বাদ যায়নি, বুঝতেই পারছেন। এখন দেখেন কাঁচের মধ্য দিয়ে যে-কেউ দেখতে পাবে শরীরের উপর খোদাইয়ের কাজটা কীভাবে চলে। এখানে আসুন না, নাকি, সুচগুলো একটু কাছ থেকে ভালো করে দেখুন।
পর্যটক ধীরে দুপায়ে দাঁড়ালেন, সামনে হেঁটে গেলেন, ঝুঁকলেন আঁচড়ার উপর। ‘দেখুন এখানে আছে,’ অফিসার বললেন, ‘বেশ করকম ভাবে রাখা মোট দুই ধরনের সুচ। প্রত্যেকটা লম্বা সুচের পাশে আছে একটা করে ছোট সুচ। লম্বাগুলো দিয়ে লেখা হয়, আর ছোটগুলো সব সময় রক্ত ধুয়ে ফেলার আর লেখাটা পরিষ্কার রাখার জন্য পানি ছিটিয়ে চলে। রক্ত আর পানির মিশ্রণটা তারপর চলে যায় এই ছোট চ্যানেলগুলোয়, শেষে ওগুলো গিয়ে পড়ে এই বড় চ্যানেলে, তারপর ওটা থেকে একটা ড্রেনপাইপ দিয়ে বাইরের গর্তে।’ অফিসার তার আঙুল দিয়ে রক্ত-পানির তরল যাওয়ার পথটা নিখুঁতভাবে দেখিয়ে দিলেন। এরপর তিনি যখন দৃশ্যটা সর্বোচ্চ সম্ভব জীবন্ত করার স্বার্থে পাইপের মুখে তার হাত গোল করে ধরেছেন, যেন পাইপ থেকে বেরোনো তরলটা ধরবেন, পর্যটক মাথা তুললেন আর এক হাত নিজের পেছনদিক ঠাহর করে করে চেয়ারের দিকে পেছনে হাঁটা শুরু করলেন। তারপর আতঙ্কের সঙ্গে তিনি খেয়াল করলেন –আঁচড়াটা কাছ থেকে পরীক্ষা করার অফিসারের সেই আমন্ত্রণ দণ্ডিত মানুষটাও গ্রহণ করেছে। শেকলের সাহায্যে সে ঘুমকাতর সৈনিককে টেনে খানিক সামনে নিয়ে এসেছে, আর কাঁচের উপর ঝুঁকে দেখছে। একটা ধাঁধা-লাগা চোখে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে যে ওই দুই ভদ্রলোক কী দেখছিল ওখানটায় এবং কোনো ব্যাখ্যা না-পাওয়ার কারণে সে খুঁজে পাচ্ছে না কিছুই। একবার সে এদিকে ঝুঁকছে তো আরেকবার ওদিকে, তার দুই চোখ বারবার পড়ছে গিয়ে কাঁচের উপরে। পর্যটক চাইলেন ওকে সরিয়ে দিতে, কারণ তার এই আচরণ নিশ্চিত কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু অফিসার এক হাত দিয়ে পর্যটককে শক্ত করে ধরে, অন্য হাতে বাঁধের ওখানটা থেকে একদলা মাটি তুললেন, আর সৈনিকের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। সৈনিক চমকে গিয়ে চোখ খুলল, দেখল দণ্ডিত লোকটা কী দুঃসাহসের কাজ করেছে, সে হাতের রাইফেল ফেলে দিল, মাটিতে পা ঠুকল জোরে, আর এমন জোরে দণ্ডিত লোকটাকে পেছনের দিকে টান দিল যে সে পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে; তারপর সৈনিক ওর পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল ওকে– মাটিতে পড়ে মোচড়াচ্ছে তার ঝনঝন আওয়াজ করা শেকলগুলোয় পেঁচিয়ে গিয়ে দাঁড়া করাও ওকে! চিৎকার করলেন অফিসার, তিনি বুঝতে পেরেছেন দণ্ডিত মানুষটার জন্য পর্যটকের মনোযোগে বিরাট ব্যাঘাত ঘটছে। পর্যটক এমনকি আঁচড়ার উপর ঝুঁকে পড়েছেন, তার কোনো খেয়ালই নেই সে-ব্যাপারে, তিনি শুধু ব্যস্ত মানুষটার ভাগ্যে কী ঘটছে তা দেখতে। ওর ব্যাপারে খেয়াল নাও!’ আবার চিৎকার দিলেন অফিসার। যন্ত্রটার পাশ দিয়ে ঘুরে দৌড়ে গেলেন তিনি, দণ্ডিত লোকটার বগলের নিচ দিয়ে নিজহাতে তাকে আঁকড়ে ধরলেন আর সৈনিকের সঙ্গে মিলে অনেক আছাড়-পাছাড়ের পরে সক্ষম হলেন ওকে খাড়া করাতে।
‘আমি এখন এর পুরোটাই বুঝতে পারছি,’ অফিসার ফিরে আসতেই পর্যটক বললেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা ছাড়া, বললেন অফিসার, পর্যটকের বাহু ধরে উপরের দিকে তাক করে: ‘ওখানে উপরে নকশাবিদ-এর মধ্যে আছে আঁচড়ার নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করার কলকবজা, আর ওগুলো বসানো হয়েছে ঠিক সেই নকশা অনুযায়ী যা কিনা শাস্তিটাকে ফুটিয়ে তুলবে। আমি এখনো আগের কমান্ড্যান্টের নকশাগুলোই ব্যবহার করছি। এই যে এগুলো’– তিনি চামড়ার ফোল্ডার থেকে বেশ কটা কাগজ বের করলেন– ‘তবে আপনাকে ধরতে দিতে পারছি না ওগুলো, ওরা আমার সবচেয়ে দামি সম্পত্তি। আপনি বসুন, আমি আপনাকে এখান থেকেই দেখাচ্ছি, আপনি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাবেন। তিনি প্রথম কাগজটা মেলে ধরলেন। পর্যটক খুশিই হতেন যদি কোনো প্রশংসার কিছু বলতে পারতেন, কিন্তু তিনি অনেকগুলো কাটাকাটি করা রেখার এক গোলকধাঁধা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না, রেখাগুলো পুরো কাগজ জুড়ে এত ঘন করে আঁকা যে ওদের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাগুলো খুঁজে পাওয়ার কাজটা সহজ না। এটা পড়ন, বললেন অফিসার। পারছি না,’ বললেন পর্যটক। কিন্তু পরিষ্কার তো দেখা যাচ্ছে, অফিসার বললেন। অনেক শিল্পিত আঁকা, পাশ-কাটানোর মতো করে পর্যটক বললেন, ‘কিন্তু আমি এর পাঠোদ্ধার করতে পারছি না। “ইয়েস, হাসতে হাসতে অফিসার বললেন, ফোল্ডারটা সরিয়ে রাখলেন আবার, ‘এটা বাচ্চাদের স্কুলে খাতায় আদর্শলিপি লেখার মতো কিছু না। অনেকক্ষণ ধরে একে দেখা লাগবে আপনার। কিন্তু আমি নিশ্চিত, শেষে গিয়ে আপনিও ঠিকই ধরতে পারবেন যে কী লেখা আছে এতে। দেখুন, এটা সরল সোজা কোনো লেখনী হতে পারে না; ব্যাপার হচ্ছে, শুরুতেই এ কাউকে মেরে ফেলতে পারবে না, গড়ে বারো ঘণ্টা পরে হতে হবে মৃত্যু; আর গুণে গুণে ছয় ঘণ্টার মাথায় আসতে হবে। সেই সন্ধিক্ষণ। কাজেই আসল লেখাটা ঘিরে থাকতে হবে অনেক অনেক অলংকরণ। শুধু যদি লেখাটার কথা বলেন, ওটা তো শুধু কোমর বেড় দিয়ে একটা সরু বৃত্তই আঁকবে মাত্র; শরীরের বাকি পুরোটাই তো তাহলে থাকছে অলংকরণের জন্য। আপনি এখন কি আঁচড়া আর পুরো যন্ত্রটার কাজ ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারছেন?– ঠিক আছে, তাহলে শুধু দেখুন এবার!’ সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠে গেলেন তিনি, একটা চাকা ঘোরালেন, নিচে চেঁচিয়ে বললেন: ‘দয়া করে সরে যান!’ আর চলতে শুরু করল যন্ত্র। শুধু ঐ ঘর্ঘর-শব্দ তোলা চাকাটা না থাকলেই সবকিছু চমৎকার হতো। এই বিরক্তিকর চাকাটা যেন ওনার কাছে বিস্ময় হয়ে এসেছে, তেমনভাবে অফিসার ওটার দিকে ঘুষি পাকিয়ে দেখালেন, তারপর মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে দুই হাত বাড়ালেন পর্যটকের দিকে, আর ঝটপট নেমে এলেন যন্ত্রের কাজটা নিচের থেকে দেখবেন বলে। এখনো কিছু একটাতে সমস্যা হচ্ছে, কিছু একটা যা একমাত্র তার পক্ষেই বোঝা সম্ভব; তারপর তিনি উপরে উঠে গেলেন, দুই হাত ঢুকিয়ে দিলেন নকশাবিদ অংশটার মধ্যে, আর তারপর দ্রুত নামার জন্য সিঁড়ি না ধরে সোজা একটা পোল বেয়ে নামতে লাগলেন; আর যেন এই বিরাট আওয়াজের মধ্যেও পর্যটক শুনতে পান তার কথা, তাই পর্যটকের কানে চিৎকার করে বললেন যত জোরে পারা যায়: ‘কোনটার পর কোনটা হচ্ছে ধরতে পারছেন? আঁচড়া লেখা শুরু করে; আসামির পিঠে প্রথম খসড়াটা লেখা শেষ হওয়া মাত্র পেঁজা তুলোর স্তরটা ঘুরে যায়, শরীরকে ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে, আঁচড়া তখন পেয়ে যায় লেখার জন্য নতুন জায়গা। ততক্ষণে লেখালেখি হয়ে যাওয়া কাঁচা অংশটা তুলোর উপরে একটু জিরিয়ে নেয়, তুলোগুলো বিশেষভাবে তৈরি বলেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায় তখনই, তার ফলে ওগুলোর উপরে আবার আরো গভীর করে লেখা সম্ভব হয়। তারপর শরীরটা যখন আবার আগের জায়গায় ঘুরে আসে, এখানে আঁচড়ার ধার ঘেঁষে থাকা দাঁতগুলো ক্ষত থেকে ছিঁড়ে উঠিয়ে নেয় তুলো, সোজা গর্তে ফেলে দেয় ওগুলো, তারপর আবার শুরু হয় আঁচড়ার কাজ। এভাবেই গভীর থেকে গভীরে লিখে চলে আঁচড়া, পুরো বারো ঘণ্টা ধরে। প্রথম ছয় ঘণ্টা আসামি মোটামুটি স্বাভাবিক বেঁচে থাকার সময়ের মতোই কাটায়, বলতে গেলে খুব কোনো ব্যথাই লাগে না। দুঘণ্টা পার হলে ওর মুখ থেকে তুলোর পিণ্ড সরিয়ে নেওয়া হয়, কারণ ওর আর তখন চিৎকার করার শক্তি নেই। এখানে এই যে ওর মাথার কাছে বৈদ্যুতিকভাবে গরম রাখা পাত্রে আমরা ওর জন্য চালের ক্ষীর রেখে দিই, ওর যদি মন চায় জিভ বাড়িয়ে যতটা পারা যায় খেতে পারে। ওদের একটাও এই সুযোগ ছাড়ে না। আমার অভিজ্ঞতা তো কম হলো না, আমি কিন্তু কাউকে ছাড়তে দেখিনি। ছয় ঘণ্টা আসা পর্যন্ত ভোজনের এই আনন্দটা ওর থাকে। ওই সময়টাতে আমি সাধারণত হাঁটু গেড়ে এখানে বসি আর বিস্ময়কর এই ব্যাপারটা দেখি। আসামি শেষ ঢোকটা সাধারণত গেলে না; সে স্রেফ মুখের মধ্যে ওটা ঘুরায় আর থু করে ফেলে দেয় গর্তে। আমাকে তখন ঝট করে বসে পড়তে হয়, না হলে ওর থুতু তো এসে আমার মুখে লাগবে। ছয়তম ঘণ্টায় এসে কী নিশ্চুপই না হয়ে যায় সে! সবচেয়ে জড়বুদ্ধির লোকটাও তখন বুঝতে শুরু করে। বোঝাটা শুরু হয় চোখের পাশ ঘিরে। ওখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে তা। এমন একটা দৃশ্য যে লোভ হয় ওর পাশে আঁচড়ার নিচে গিয়ে শুয়ে পড়ি। এরপর আর ঘটে না কিছুই, মানুষটা স্রেফ লেখার মর্মোদ্ধার করা শুরু করে, তার ঠোঁট দুটো এমনভাবে কোঁচকায় যে মনে হয় সে শুনছে কিছু। আপনি দেখেছেন যে চোখ দিয়ে লেখাটার মর্মোদ্ধার করা সোজা নয়; আর আমাদের আসামি এর মর্মোদ্ধার করে নিজের শরীরের ক্ষত দিয়ে। কোনো সন্দেহ নেই, এটা কঠিন কাজ; ছয় ঘণ্টা লাগে তার এ পর্যায়ে পৌঁছাতে। কিন্তু তারপর আঁচড়া তাকে পুরো বর্শাবিদ্ধ করে ফেলে, ছুঁড়ে তাকে ফেলে দেয় গর্তে, ওখানে গিয়ে তার শরীরটা ঝপাৎ করে পড়ে রক্ত পানি আর পেঁজাতুলোর উপর। এই সঙ্গে শেষ হয় বিচার; আর আমরা, সৈনিক ও আমি বেলচা দিয়ে ওর উপরে ছিটিয়ে দিই কিছু মাটি।
পর্যটক তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে, একটা কান অফিসারের দিকে দিয়ে, যন্ত্রটার কাজ দেখতে লাগলেন। দণ্ডিত মানুষটাও একই রকম দেখছে, কিন্তু না বুঝেই। সামান্য সামনে ঝুঁকে সে যখন চেষ্টা করছে দোল খাওয়া সুচগুলো চোখ দিয়ে অনুসরণ করতে, তখন অফিসারের কাছ থেকে সংকেত পেয়ে সৈনিকটা একটা ছোরা বের করল আর পেছন থেকে এক ঝটকায় কেটে ফেলল দণ্ডিতের জামা ও পাজামা, ওগুলো খুলে পড়ল তার গা থেকে; নিজের নগ্নতা ঢাকতে দণ্ডিত মানুষ চেষ্টা করল খুলে পড়া জামাকাপড়গুলো ধরতে, কিন্তু ততক্ষণে সৈনিক তাকে তুলে ফেলেছে শূন্যে আর তাকে ঝাঁকিয়ে তার গায়ের থেকে খুলে ফেলছে শেষ কাপড়টুকুও। অফিসার যন্ত্রটা থামালেন, এর পরে নীরবতা– আর এরই মধ্যে দণ্ডিত মানুষটাকে শোয়ানো হলো আঁচড়ার নিচে। ঢিলা করে দেয়া হলো শেকলগুলো, ওগুলোর জায়গায় বাঁধুনি দিয়ে বাঁধা হলো তাকে; প্রথম মুহূর্তে ব্যাপারটা তার কাছে স্বস্তির বলেই মনে হলো বোধহয়। আর এবার আঁচড়া নামানো হলো আরেকটু নিচুতে, কারণ লোকটা বেশ পাতলা গড়নের। যখন সুচের প্রান্তগুলো তাকে ছুঁলো, একটা কাঁপুনি বয়ে গেল তার চামড়ার উপর দিয়ে; সৈনিক যখন তার ডান হাতটা নিয়ে ব্যস্ত, সে তার বাঁ হাত বাড়িয়ে দিল কোন দিকে তা জানেও না; কিন্তু হাতটা গিয়ে পড়ল যেদিকে পর্যটক দাঁড়ানো সেই বরাবর। অফিসার চোখের পাশ দিয়ে বারবার দেখছেন পর্যটককে, যেন তার মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ব্যাপারটা –যা তিনি অন্তত ভাসা ভাসা হলেও ব্যাখ্যা করেছেন– তাকে কতটা মুগ্ধ করেছে।
হাতের কবজির বাঁধুনিটা ছিঁড়ে পড়ল; মনে হচ্ছে, সৈনিক ওটা বেশি জোরে টেনে ফেলেছে। অফিসারের সাহায্য দরকার হয়ে পড়ল, সৈনিক তাকে ফিতের ছেঁড়া অংশটা দেখাল। সুতরাং অফিসার তার কাছে গেলেন আর মুখটা পর্যটকের দিকে ঘুরিয়ে বললেন: যন্ত্রটা এত জটিল, একটা কিছু ছেঁড়া বা ভাঙা ঘটবেই এখানে বা ওখানে; কিন্তু তাই বলে তা দিয়ে যন্ত্রটার মহত্ত্ব বিচার করতে যাবেন না যেন। যা-ই হোক, ছেঁড়া বাঁধুনির বদলে নতুন কিছু আসতে সময় লাগবে না, আমি ওর বদলে একটা শেকল দিয়ে কাজ চালাব; যদিও মেনে নিচ্ছি ডান হাতের ওখানে যন্ত্রের কাঁপুনির সূক্ষ্মতা এতে খানিকটা নষ্ট হবে, আর শেকলটা লাগাতে লাগাতে তিনি যোগ করলেন: এই যন্ত্রের ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থের সংস্থান এখন বিরাট এক সমস্যা। আগের কমান্ড্যান্টের আমলে শুধু যন্ত্রের জন্য সরিয়ে রাখা একটা তহবিল ছিল আমার। এখানে একটা গুদামমতো ছিল, যাতে যন্ত্রের জন্য দরকারি সমস্ত খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া যেত। স্বীকার করছি, আমি প্রায় দুহাতে নিতাম ওখান থেকে –আগের আমলে; এখন না, যেমনটা কিনা নতুন কমান্ড্যান্ট বলতে চান। অবশ্য উনি তো সবকিছুর মধ্যেই আমাদের পুরোনো ব্যবস্থাকে আক্রমণ করার অজুহাত খুঁজে পান। এখন মেশিনের তহবিলটা থাকে ওনার নিজের নিয়ন্ত্রণে আর আমি যদি নতুন ফিতার জন্য পাঠাই তো পুরোনো ভাঙা ফিতাটা সাথে দেওয়া লাগবে প্রমাণ হিসেবে, তার পরও নতুনটা আসবে দশ দিন পরে আর আসার পরে দেখা যাবে খুবই বাজে মানের সেটা, কোনোকিছুর জন্যই কাজে লাগানোর মতো নয়। কিন্তু আমি তদ্দিন পর্যন্ত কী করে বাঁধুনি ছাড়া যন্ত্রটা চালাবো তা নিয়ে কারোই মাথাব্যথা নেই।
পর্যটক ভাবতে লাগলেন: অন্যের ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে নাক গলানো সব সময়েই গুরুতর একটা সিদ্ধান্ত। না তিনি এই দণ্ড উপনিবেশের কোনো নাগরিক, না তিনি সেই রাষ্ট্রের, যার অংশ এটা। এখন তিনি যদি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এই প্রক্রিয়ার নিন্দা জানাতে যান কিংবা এটা বন্ধ করতে চান, এরা তাকে বলবে: আপনি একজন বিদেশি, নিজের চরকায় তেল দিন। এ কথার কোনো উত্তর তিনি দিতে পারবেন না; তিনি হয়তো শুধু এটুকুই যোগ করতে পারবেন যে, এ বিষয়ে তার নিজের ব্যবহারেই তিনি নিজেই বিস্মিত, যেহেতু তিনি স্রেফ একজন দর্শক হিসেবেই দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোনোভাবেই অন্য কোনো দেশের আইনি পদ্ধতি বদলানোর বিষয়ে খবরদারি করতে নয়। তবে এখানকার কাণ্ডকারখানা নিশ্চিতই তাকে প্রলুব্ধ করছে তা করতে। এই পদ্ধতিটার অবিচার আর দণ্ড কার্যকরের অমানবিকতাটুকু নিয়ে তার কোনো সন্দেহই নেই। আর যেহেতু দণ্ডিত মানুষটাকে তিনি চেনেনই না, সে তার স্বদেশিও নয়, আর এমন কোনো লোকও নয় যার ব্যাপারে বিশেষ কোনো সহানুভূতি জাগতে পারে– কারো এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে পর্যটকের কোনো নিজস্ব স্বার্থ আছে এতে। পর্যটকের সঙ্গে আছে নামী-দামি মানুষের তাকে নিয়ে লেখা সুপারিশপত্র, তাকে এখানে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে, আর তাকে যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়াটা দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাতে এমনও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিচারপ্রক্রিয়াটা নিয়ে তার মতামত বরং প্রত্যাশাই করা হচ্ছে। সেটা হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি যেহেতু কমান্ড্যান্ট, যেমন তিনি এইমাত্র শুনলেন একদম পরিষ্কার ভাষায়, এই বিচার-প্রক্রিয়ার কোনো সমর্থক নন আর অফিসারের প্রতি ওনার আচরণ একরকম বৈরিতার পর্যায়েই পড়ে।
ঠিক এ সময়ে পর্যটক শুনলেন, অফিসার রাগে চিৎকার করছেন। এইমাত্র তিনি অনেক কষ্টের পরে দণ্ডিত মানুষটার মুখের মধ্যে তুলোর পিণ্ড পুরে দিতে সক্ষম হয়েছেন, আর তখনই মানুষটা, বমি করার প্রচণ্ড তাড়নায় চোখ দুটো বুজে দিল বমি করে। তাড়াতাড়ি অফিসার চেষ্টা করলেন তুলোর পিণ্ডটা থেকে তাকে দূরে সরাতে, আর তার মাথাটা ঘুরিয়ে গর্তের দিকে দিতে; কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, বমি গড়িয়ে পড়ছে যন্ত্র বেয়ে। সব ঐ কমান্ড্যান্টের দোষ! চিৎকার করে বলতে লাগলেন অফিসার, এক অন্ধ রাগে হাতের কাছের পেতলের রডগুলো ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন, “আমার যন্ত্রটা শুয়োরের খোয়াড়ের মতো নোংরা করা হলো। কাঁপা হাতে তিনি পর্যটককে দেখাতে লাগলেন কী ঘটেছে। আমি কি কম্যান্ড্যান্টকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পরিষ্কার করে বুঝাইনি যে শাস্তির পুরো এক দিন আগে থেকে সব খাবার দেওয়া বন্ধ করতে হবে? কিন্তু না, এখনকার ক্ষমাশীলতা বলে অন্য কথা। কম্যান্ড্যান্টের মহিলারা মানুষটাকে এখানে পাঠানোর আগে পেট ভরে মিষ্টিমুখ করিয়েছে। সারা জীবন সে খেল গন্ধ-পচা মাছ, আর এখন কিনা তাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে। ঠিক আছে, তাতে আমার কী সমস্যা, কিন্তু আমাকে একটা নতুন তুলোর পিণ্ড দিতে তাদের এত আপত্তি কেন, আজ তিন মাস ধরে আমি ওটা চেয়ে চেয়ে মরছি। ঐরকম একটা পিণ্ড মুখে নিয়ে কেউ কীভাবে অসুস্থ না হয়ে পারে বলুন, যেখানে এর আগে এক শরও বেশি মানুষ মরার সময় ওটা চুষেছে আর চিবিয়েছে?’
দণ্ডিত মানুষটা তার মাথা ঝুলিয়ে রেখেছে নিচমুখো করে, তার চেহারায় বেশ একটা শান্তি; সৈনিক ব্যস্ত ওর জামা দিয়ে যন্ত্র মোছামুছির কাজে। অফিসার এগিয়ে গেলেন পর্যটকের কাছে পর্যটক এক অচেনা উদ্বেগ থেকে পেছনে সরে গেলেন এক পা, কিন্তু অফিসার তার হাতে ধরে ফেললেন, নিয়ে গেলেন এক পাশে। আমি আপনাকে বিশ্বাস করে কিছু কথা বলতে চাই,’ তিনি বললেন, যদি আপনি অনুমতি দেন।’ ‘অবশ্যই, পর্যটক উত্তর দিলেন আর নিচের দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগলেন।
‘এই পদ্ধতির আর শাস্তির এই ধরনটার– আপনি যেটার এখন প্রশংসা করতেই পারেন– বর্তমানে আমাদের উপনিবেশে আর কোনো প্রকাশ্য সমর্থক নেই। আমি এর একমাত্র পক্ষের লোক, আর একই সঙ্গে আমিই আগের কমান্ড্যান্টের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যের একমাত্র সমর্থক। এই ব্যবস্থার আর কোনো উন্নতি নিয়ে আমার তো কোনো আশাই নেই, স্রেফ যা আছে সেটুকু ধরে রাখতেই আমার সব শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগের কমান্ড্যান্ট বেঁচে থাকতে এই উপনিবেশ ভরা ছিল তার সমর্থকে; ওনার বিশ্বাসের যে শক্তি তার কিছুটা আমার তো অবশ্যই আছে, কিন্তু ওনার ক্ষমতার কিছুই আমার নেই; এর ফলে ওনার সব সমর্থকেরা মিলিয়ে গেল একসময়, এখনো আসলে তারা সংখ্যায় কম না, কিন্তু তারা কেউ সে কথা স্বীকার করবে না প্রকাশ্যে। আপনি যদি আজকে চা-ঘরে যান, আজ মানে এই শাস্তি কার্যকরের দিনে, আর যদি শোনেন যে মানুষজন কী বলছে, মনে হয় না আপনি অস্পষ্ট আর অনিশ্চিত কিছু মন্তব্য ছাড়া অন্য কিছু শুনবেন। ওরা সবাই দেখবেন যে এই ব্যবস্থার সমর্থক, কিন্তু বর্তমান কমান্ড্যান্টের অধীনে আর তার এখনকার বিশ্বাসের কারণে, তাদের ঐ সমর্থন আমার তো সামান্যও কাজে আসবে না। আপনার কাছে আমি এখন জানতে চাচ্ছি: সারা জীবনের একটা ভালো কাজ’– যন্ত্রটা দেখালেন তিনি– ‘কি এইভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে এই কমান্ড্যান্টের জন্য আর তাকে চালানো মেয়েলোকগুলোর জন্য? তা কি হতে দেওয়া যায়? যদি কেউ আমাদের দ্বীপে মাত্র কদিনের জন্য ভিনদেশি হিসেবেও আসেন, এমনকি তিনিও কি পারেন তা হতে দিতে? কিন্তু হাতে সময় একদমই নেই, আমার বিচারক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে তারা; কমান্ড্যান্টের হেডকোয়ার্টারে এরই মধ্যে মিটিং চলছে, আমাকে রাখা হয় না সেখানে; এমনকি আজ এখানে আপনার আসাটাও আমার কাছে বর্তমান সময়েরই একটা সংকেত বলে মনে হচ্ছে; ওরা সব কাপুরুষের দল, আপনাকে পাঠিয়েছে, বিদেশি এক লোককে, আগাম সব খবরাখবর নেওয়ার কাজে।– আহা, আগের সেই দিনগুলোয় কী অন্যরকমই না ছিল শাস্তি কার্যকর হওয়ার ব্যাপারটা! দণ্ড কার্যকরের পুরো এক দিন আগে থেকে সম্পূর্ণ উপত্যকা ভরে যেত লোকে, সব আসত শুধু দেখতে; ভোরবেলায় কমান্ড্যান্ট হাজির হতেন তার ভদ্রমহিলাদের নিয়ে; বিউগলের শব্দে জেগে উঠত পুরো ক্যাম্প; আমি সামরিক কায়দায় জানাতাম যে সবকিছু প্রস্তুত; গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা– উচ্চপদস্থ সবাইকেই হাজির থাকতে হতো– যন্ত্রটা ঘিরে দাঁড়িয়ে যেতেন; এই বেতের চেয়ারের প সেই সময়ের দুঃখজনক স্মৃতি বইছে মাত্র। যন্ত্র নতুন করে সাফসুতরো করা হতো, ঝলমল করত ওটা; প্রায় প্রত্যেক শাস্তির আগে আমি ওটাতে নতুন খুচরা যন্ত্রাংশ লাগাতাম। শতজোড়া চোখের সামনে– একেবারে ঐ ঢালের মাথা পর্যন্ত দর্শকেরা দাঁড়িয়ে থাকত উত্তেজনায়, তাদের পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে –আসামিকে আঁচড়ার নিচে শোয়াতেন কমান্ড্যান্ট স্বয়ং, নিজে। আজ একটা সাধারণ সৈনিক যে কাজগুলো করে, তখন প্রধান বিচারক হয়েও আমার কাজ ছিল সেগুলোই, আর আমি সেটা নিতাম সম্মান হিসাবেই। তারপর শুরু হতো শাস্তি! কোনো বেসুরো শব্দে ব্যাঘাত ঘটত না যন্ত্রের কাজে। অনেকে এমনকি দেখা বন্ধ করে দিত, তাদের চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ত বালির উপর; তারা সবাই জানত: ন্যায়বিচার এখন নিজের গতিতে চলছে। ঐ নীরবতার মধ্যে দণ্ডিত মানুষটার গোঙানি ছাড়া, তুলোর পিণ্ডের অর্ধেক কমে যাওয়া গোঙানি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যেত না। এখন তো যন্ত্রটা আসামির মুখ থেকে এমন কোনো গোঙানির আওয়াজ বের করায় না যা কিনা তুলোর পিণ্ডের ঢেকে দেওয়ার ক্ষমতা নেই, কিন্তু তখনকার দিনে লেখার সুচগুলো থেকে বের হতো একধরনের গা-পুড়িয়ে দেওয়া তরল পদার্থ; ওটা ব্যবহারের অনুমতি আর আমাদের এখন নেই। আহ্, আর তারপর আসত সেই ছয়তম ঘণ্টার সন্ধিক্ষণ। সবাই কাছ থেকে দেখতে চাইত, অসম্ভব হয়ে পড়ত অত অনুরোধ রক্ষা করা। কমান্ড্যান্ট ওনার প্রজ্ঞার বলে নিয়ম জারি করলেন যে, শিশুরা পাবে অগ্রাধিকার; আমি নিজে অবশ্য, আমার পদাধিকারের কারণে, সব সময় যন্ত্রের কাছেই থাকতে পারতাম; প্রায়ই আমি ঐ ওখানটায় মাটিতে উবু হয়ে বসতাম দুই হাতে দুই বাচ্চা নিয়ে। কীভাবে আমরা যন্ত্রণাভরা ঐ মুখটায় আলোকপ্রাপ্তি ঘটার দৃশ্য, গিলতাম, কীভাবে এই ন্যায়বিচারের ঝলকানির সামনে পেতে দিতাম আমাদের গাল দুটো– শেষমেশ অর্জিত আর দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া এক ন্যায়বিচার! ও কমরেড, কীসব দিন ছিল সেগুলো!’ অফিসার স্বাভাবিকভাবেই ভুলে গেছেন যে তিনি কার সঙ্গে কথা বলছেন; তিনি পর্যটককে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরেছেন আর মাথা রেখেছেন তার কাঁধে। পর্যটক মহা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়লেন, অফিসারের মাথার উপর দিকে অধৈর্য নিয়ে তিনি তাকাচ্ছেন ইতিউতি। সৈনিক এরই মধ্যে শেষ করেছে তার যন্ত্র মোছার কাজ আর মাত্র একটা টিনের কৌটা থেকে কিছু চালের ক্ষীর ঢেলেছে খাবার পাত্রটায়। দণ্ডিত লোকটা তা দেখামাত্রই– ওকে দেখে মনে হচ্ছে পুরো সুস্থ হয়ে উঠেছে আবার –জিভ দিয়ে চেষ্টা করছে ক্ষীরটা ধরতে। সৈনিক ওকে ধাক্কা দিয়ে শুধু সরিয়েই দিচ্ছে, কারণ ক্ষীরটা আরেকটু পরে দেওয়ার জন্য রাখা; কিন্তু এটাও ভারি অনুচিত কাজ যে সৈনিক তার নোংরা হাত ওই ক্ষীরে ডুবিয়ে দেবে আর দণ্ডিত মানুষটার বুভুক্ষু দৃষ্টির সামনে তা খানিক খাবেও।
অফিসার দ্রুত নিজেকে সংবরণ করে নিলেন। আপনার অনুভূতি নিয়ে কোনো খেলা করার ইচ্ছা আমার নেই, তিনি বললেন, ‘আমি জানি এই আজকের দিনে বসে তখনকার ঐ সময়গুলো বোঝানো কত অসম্ভব। যা হোক, যন্ত্রটা এখনো কাজ করে আর নিজেই সে নিজের যথার্থতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট, পুরো দ্বীপে সে একা দাঁড়িয়ে থাকলেও এ কথা সত্য। আর শেষের ধাপে এসে এখনো অবিশ্বাস্য এক মসৃণতায় মৃতদেহ পড়ে গর্তে গিয়ে, যদিও এখন আর আগের মতো শত শত লোক মাছির মতো জড়ো হয় না গর্তের চারপাশে। আমাদের তখন গর্ত ঘিরে একটা শক্ত রেলিং পর্যন্ত দিতে হয়েছিল; বহু আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তা।’
পর্যটক অফিসারের কাছ থেকে তার মুখ লুকাতে চাইলেন, লক্ষ্যহীনভাবে তাকাতে লাগলেন অফিসারের চারপাশে। অফিসার ভাবলেন যে পর্যটক এই উপত্যকার হতশ্রী অবস্থা নিয়েই চিন্তামগ্ন; তিনি পর্যটকের হাত ধরলেন, তার চোখে তাকিয়ে কথা বলার জন্য ঘুরে এলেন সামনে আর জিজ্ঞাসা করলেন: ‘কী অপমান আর লজ্জার সবকিছু, দেখতে পাচ্ছেন?
কিন্তু পর্যটক কিছু বললেন না। অফিসার খানিকের জন্য তাকে একা ছাড়লেন; পা দুটো ফাঁক করে, কোমরের পেছনে হাত রেখে, তিনি শান্ত দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকলেন মাটির দিকে। তারপর পর্যটকের দিকে একটা উৎসাহের হাসি দিয়ে তিনি বললেন: ‘কাল যখন কমান্ড্যান্ট আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন, আমি তখন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমন্ত্রণটা আমি শুনলাম। কমান্ড্যান্টকে আমি চিনি। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, আপনাকে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে ওনার উদ্দেশ্য কী। যদিও আমার বিরুদ্ধে এগোনোর ক্ষমতা তার আছে, তবু সে সাহস এখনো করেননি তিনি; তিনি শুধু চাইছেন আপনার মতো একজন সম্মানিত বিদেশির বিচার-বিবেচনার সামনে আমাকে খোলাসা করে দিতে। সবকিছু নিখুঁতভাবে হিসাব করে নিয়ে নেমেছেন তিনি। এই দ্বীপে আপনার দ্বিতীয় দিন আজ, আগের কমান্ড্যান্ট এবং তার বিশ্বাসের ব্যাপারে আপনি জানেন না কিছুই, আপনার চিন্তা ইউরোপিয়ান ধ্যানধারণার ওপরে দাঁড়ানো, সম্ভবত আপনি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড বিষয়টাকেই সাধারণ অর্থে সমর্থন করেন না, আর বিশেষ অর্থে এই জাতীয় যান্ত্রিক মৃত্যুদণ্ড তো নয়ই, তা ছাড়া আপনি আরো দেখছেন যে এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছাড়াই, একদম নিরানন্দ এক পরিবেশে, আর মোটামুটি নষ্ট হয়ে যাওয়া এক যন্ত্রের ওপরে– এই সবকিছু মিলে (কমান্ড্যান্টের ভাবনা এমনই) আপনার কি এটাই মনে হবে না যে আমার প্রক্রিয়াটা ভুল? আর তা-ই যদি আপনার মনে হয় (আমি এখনো কমান্ড্যান্টের দৃষ্টিকোণ থেকে কথা বলছি), আপনি তো তা আর লুকিয়ে রাখবেন না, কারণ আপনি যাচাই-বাছাই করে নিয়ে যা বিশ্বাস করেন তার ওপর আপনার নিশ্চিত আস্থা অগাধ। অন্যদিকে আপনি নানা দেশের নানা ধরনের মানুষের এত রকম বিচিত্র জিনিস সম্মান করতে শিখেছেন যে, সম্ভবত আপনি আমাদের বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে অত জোর গলায় মুখ খুলবেন না, যেমনটা আপনি হয়তো করবেন নিজের দেশে। কিন্তু কমান্ড্যান্টের আসলে তার দরকারও নেই। মাত্র একটা আলগা কথার-কথায় বলা মন্তব্যই তার জন্য যথেষ্ট। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই মন্তব্য ওনার কাজে লাগছে, ততক্ষণ কিছু আসে যায় না তা আপনার সত্যিকারের মতামত কি না। তিনি আপনাকে প্রশ্ন করবেন ভয়ংকর ধূর্ততার সঙ্গে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আর তার মেয়েলোকগুলো চারপাশে বসে থাকবে গোল হয়ে, খাড়া করে রাখবে তাদের কান; আপনি হয়তো বলবেন, যেমন ধরুন: “আমাদের বিচারব্যবস্থা অন্যরকমের” কিংবা “আমাদের দেশে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার আগে তার কথা শোনা হয়”, কিংবা “আমরা দণ্ডিতকে তার শাস্তির কথা জানিয়ে থাকি”, কিংবা “মৃত্যুদণ্ড বাদে আমাদের দেশে অন্য শাস্তিও আছে”, কিংবা “একমাত্র মধ্যযুগেই আমরা নিপীড়নের পদ্ধতি ব্যবহার করতাম”। এই মন্তব্যগুলোর কোনোটাই মিথ্যা কথা নয়, আপনার কাছে তো ওগুলো প্রমাণ ছাড়াই প্রমাণিত– নির্দোষ সব মন্তব্য যা আমার বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে না কোনোভাবেই। কিন্তু কমান্ড্যান্টের প্রতিক্রিয়া কী হবে ওগুলো শুনে? আমি ওনাকে দেখতে পাচ্ছি, আমাদের এই সুবোধ কমান্ড্যান্ট, একপাশে ধাক্কা দিয়ে সরাবেন তার চেয়ার, ছুটে যাবেন তার ব্যালকনির দিকে, পরিষ্কার দেখছি তার মেয়েলোকগুলো দৌড়ে যাচ্ছে তার পেছন পেছন, আমি শুনতে পাচ্ছি তার গলা– মেয়েলোকগুলো ওটাকে বলে বাজখাই গলা–, তিনি যা বলছেন তা হলো: “পশ্চিমের এক বিখ্যাত গবেষক, যাকে সারা পৃথিবীর সব দেশের বিচারব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখার কাজ দেওয়া হয়েছে, তিনি এইমাত্র বললেন যে আমাদের নিজেদের ব্যবস্থাটা, পুরোনো প্রথার ওপর দাঁড়ানো আমাদের ব্যবস্থাটা– অমানবিক। ওরকম একজন সম্মানিত মানুষের রায় যেহেতু এটা, আমি তাই, খুবই স্বাভাবিক যে, ব্যবস্থাটা আর চলতে দিতে পারি না। আজ থেকে আমি তাই এই ঘোষণা করলাম যে– ইত্যাদি। আপনি তখন চাচ্ছেন এ কথার প্রতিবাদ জানাতে, তিনি আপনি যা বলেছেন বলে দাবি করছেন, আপনি তা বলেননি, আপনি আমার বিচারপদ্ধতিকে অমানবিক বলেননি, আপনার গভীর বিশ্বাস হলো আমার এই ব্যবস্থাটাই বরং সবচেয়ে মানবিক আর মর্যাদাকর, আপনি এমনকি এই যন্ত্রের প্রশংসাও করেন– কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে; আপনার পক্ষে আর ব্যালকনিতে পৌঁছানোই সম্ভব নয়, ওটা ততক্ষণে ভরে গেছে মেয়েলোকগুলোতে; আপনি চাচ্ছেন আপনার দিকে সবাই তাকাক, আপনি চাচ্ছেন চিৎকার করতে, কিন্তু একটা মহিলার হাত চেপে ধরেছে আপনার মুখ –আর সেই সঙ্গে আমি আর আগের কমান্ড্যান্টের কাজ, দুটোই শেষ।
পর্যটককে হাসি চাপা দিতে হলো; তাহলে যে কাজটা তিনি অত কঠিন ভেবেছিলেন, তা এত সোজা। তিনি এড়িয়ে যাওয়ার ঢঙে বললেন: ‘আমার ক্ষমতাকে আপনি বাড়িয়ে দেখছেন; কমান্ড্যান্ট আমার নামে লেখা সুপারিশপত্রগুলো পড়েছেন, তিনি জানেন আইনি পদ্ধতির বিষয়ে আমি কোনো জ্ঞানী কেউ না। আমি যদি কোনো মতামত দিই-ই, তা হবে একজন সাধারণ মানুষের মতামত মাত্র, অন্য কারো মতামতের চেয়ে তার ওজন বেশি হবে না একটুও, আর নিশ্চিত কমান্ড্যান্টের চাইতে তো অনেক কম হবেই, ওনার তো যতটুকু বুঝলাম এই দণ্ড-উপনিবেশে বিশাল ক্ষমতা। আর এই ব্যবস্থা নিয়ে ওনার মতামত যদি এতই সোজাসাপটা হয়ে থাকে যেমনটা আপনি বললেন, তাহলে বলতেই হচ্ছে এই ব্যবস্থার ইতি হতে আর দেরি নেই আর আমার ওই একটুখানি সহযোগিতার দরকার নেই কারো।
অফিসার কি এখন বুঝতে পেরেছেন? না, পারেননি তিনি। তিনি প্রচণ্ডভাবে মাথা ঝাঁকালেন, একটুখানির জন্য তাকালেন দণ্ডিত আসামি ও সৈনিকের দিকে –ওরা দুজনেই একটা ঝাঁকির সঙ্গে রেখে দিল তাদের ক্ষীর– পর্যটকের খুব কাছে ঘেঁষে এলেন, তার চোখের দিকে না তাকিয়ে বরং তার কোটের কোথাও চোখ রেখে নিচু গলায় বললেন: ‘আপনি কমান্ড্যান্টকে চেনেন না; তার কাছে এবং আমাদের বাকি সবার কাছে আপনার অবস্থান– মাফ করবেন যে আমাকে এমনটা বলতে হচ্ছে– সত্যি বলতে কি, কোনো বিষ নেই ওতে; আপনার প্রভাব বা ক্ষমতা অনেক বেশি এমন ভাবার কোনো কারণই নেই। আমি যখন শুনলাম, মৃত্যুদণ্ডটা আপনি একা দেখবেন, খুশিই হলাম আমি। কমান্ড্যান্টের এই আদেশের লক্ষ্য ছিলাম আমি, কিন্তু আমি এখন তা কাজে লাগাব আমারই সুবিধায়। অন্য কারো মিথ্যা ফিসফিস কিংবা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে মনোযোগ না হারিয়ে (আরো বেশি লোক এখানে থাকলে তা-ই হতো) আপনি বরং আমার ব্যাখ্যা শুনতে পেলেন মন দিয়ে, দেখতে পেলেন যন্ত্রটা আর এখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে দেখার আপনার সামান্য বাকি। কোনো সন্দেহ নেই আপনার রায় এরই মধ্যে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে; যদি সামান্য কোনো সন্দেহ থেকেও থাকে, মৃত্যুদণ্ডের দৃশ্য সেটুকু মুছে দেবে। সুতরাং আপনাকে আমি এখন মিনতি করছি দয়া করে কমান্ড্যান্টের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন!
পর্যটক তাকে আর বলতে দিলেন না। কিন্তু সেটা আবার কীভাবে সম্ভব?’ তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন। খুবই অসম্ভব। আমি না পারি আপনাকে সাহায্য করতে, না পারি আপনার স্বার্থের কোনো ক্ষতি করতে।
‘আপনি পারেন,’ বললেন অফিসার। কিছুটা আশঙ্কার সঙ্গে পর্যটক খেয়াল করলেন যে, অফিসার তার মুঠো দুটো পাকাচ্ছেন। “হ্যাঁ আপনি পারেন, আবার বললেন অফিসার, আরো জোর দিয়ে। আমার একটা পরিকল্পনা আছে, যা সফল হতে বাধ্য। আপনি মনে করছেন আপনার প্রভাব যথেষ্ট নয়। আমি জানি, যথেষ্ট ওটা। তবে ধরলাম যে আপনার কথাই ঠিক, তবু এই পুরোনো ব্যবস্থা যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে আমাদের সব রকম পথেই তো চেষ্টা চালাতে হবে, এমনকি যদি ছোটখাটো পথও হয়, নাকি? আপনাকে আমার পরিকল্পনাটা বলছি, শুনুন। এটা সফল করার জন্য খুব দরকার একটা কাজ হচ্ছে আজকে এই উপনিবেশে এই ব্যবস্থা নিয়ে আপনার রায় বিষয়ে যতটা পারা যায় আপনাকে চুপ থাকতে হবে। যতক্ষণ আপনাকে কেউ সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা না করছে, আপনার কোনো মতামতই দেওয়া উচিত হবে না; তবে যদি বলতেই হয়, তা হতে হবে সংক্ষিপ্ত আর গা-ছাড়া গোছের কিছু; এমনটাই যেন মনে হয় যে আপনার পক্ষে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা কঠিন, যে আপনার সবকিছু মিলে তিক্ত লাগছে, যে আপনাকে যদি খোলাখুলি কথা বলতে হয় তাহলে আপনি বরং গালিগালাজ আর অভিশাপ দেওয়া শুরু করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো মিথ্যা কথা বলতে বলছি না, একটুও না; শুধু বলছি খুব অল্প কথায় আপনার উত্তরগুলো দিতে, যেমন, “হ্যাঁ, মৃত্যুদণ্ড দেখলাম”, অথবা, “হ্যাঁ, সব ব্যাখ্যাই শুনেছি।” ওইটুকুই, এর বেশি না। আপনার তিক্ততার ব্যাপারটা, যেটা আমরা চাচ্ছি ওরা অনুভব করুক, অবশ্যই যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত, যদিও কমান্ড্যান্ট ঠিক ওভাবে চাচ্ছেন না জিনিসটা ঘটুক। কোনো সন্দেহ নেই তিনি ওটার পুরোপুরি একটা ভুল ব্যাখ্যা করবেন আর সবকিছু তার স্বার্থের অনুকূলেই ব্যাখ্যা করবেন। আমার পরিকল্পনা নির্ভর করছে এ বিষয়টুকুর ওপরই। আগামীকাল বিরাট এক মিটিং হবে কমান্ড্যান্ট হেডকোয়ার্টারে, প্রশাসনের সব উচ্চপদস্থ অফিসাররা থাকবেন সেখানে, কমান্ড্যান্ট নিজেই সভাপতিত্ব করবেন। নিঃসন্দেহে ওই মিটিং পাবলিকের দেখার বস্তু বানানোয় কমান্ড্যান্ট সফলকাম হয়েছেন। তিনি একটা গ্যালারি বানিয়েছেন যা সব সময় দর্শকে ভরা থাকে। আমাকেও বাধ্য হয়ে আলোচনায় অংশ নিতে হয়, যদিও ঘৃণা আর বিরক্তিতে কাঁপতে থাকি আমি। এখন কথা হচ্ছে, আপনাকে ওই মিটিংয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হবে নিশ্চিত; আজ যদি আপনি আমি যেমন বললাম সেভাবে কাজ করেন তাহলে আপনার আমন্ত্রণটা বরং হয়ে উঠবে জরুরি অনুরোধ। কিন্তু যদি কোনো অজ্ঞাত কারণে আপনাকে। আমন্ত্রণ জানানো না হয়, সে ক্ষেত্রে আপনাকে সেটা চেয়ে নিতে হবে; তখন আর পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপার থাকবে না ওটা। অতএব, আগামীকাল আপনি ওখানে, কম্যান্ড্যান্টের বক্সে বসে আছেন মেয়েলোকগুলোর সঙ্গে। তিনি বারবার তাকাচ্ছেন নিশ্চিত হতে যে আপনি উপস্থিত। তারপর স্রেফ দর্শকদের মন জোগানোর কথা মাথায় রেখে বলা কিছু ফালতু, হাস্যকর বিষয়ের পরে– বেশিরভাগ সময়েই ওগুলো জাহাজঘাটার কাজ বিষয়ে কোনো কথা, সারাক্ষণ ওরা জাহাজঘাটার কাজ নিয়ে কথা বলতেই থাকে! –আমাদের বিচারব্যবস্থার প্রশ্নটা তোলা হলো আলোচনার জন্য। কমান্ড্যান্ট যদি কথাটা তুলতে ভুলে। যান, কিংবা তাড়াতাড়ি না তোলেন, তাহলে আমি ব্যবস্থা নেবো যেন তা তোলা হয়। আমি দাঁড়িয়ে পড়ব আর আজকের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে রিপোর্ট করব। অতি সংক্ষেপে, শুধু এটুকুই বলব যে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ওই জাতীয় রিপোর্ট ওখানে দেওয়াটা স্বাভাবিক। নিয়মের মধ্যে পড়ে না, তবুও আমি দেব। কমান্ড্যান্ট তখন আমাকে একটা মধুর হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানাবেন, যেমনটা তিনি সব সময়ে করেন, আর তারপর নিজেকে আর সংযত রাখতে না পেরে, তিনি সুযোগটা নেবেন। “আমরা এইমাত্র শুনলাম”, তিনি বলবেন, এরকমই কিছু একটা বলবেন, “একটা মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবেদন। এর সঙ্গে আমি শুধু এটুকুই যোগ করতে চাই যে এবারের এই মৃত্যুদণ্ডটায় হাজির ছিলেন এক বিখ্যাত গবেষক যিনি, আপনারা সবাই জানেন, আমাদের উপনিবেশকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন তার আগমনের মাধ্যমে। আমাদের আজকের সভাকে তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত থেকে করেছেন আরো তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা কি এখন বরং এই বিখ্যাত গবেষকের কাছ থেকে শুনতে চাইবো না যে আমাদের সনাতন প্রথার মৃত্যুদণ্ড এবং এতে উপনীত হওয়ার পদ্ধতি বিষয়ে ওনার মতামত কী?” চারদিকে তখন হাততালি পড়ছে, নিশ্চিত; সবাই একমত, অন্য কারো চেয়ে আমিই বেশি চেঁচাচ্ছি। কমান্ড্যান্ট আপনাকে কুর্নিশ করলেন আর বললেন: “তাহলে, স্যার, আমাদের সবার তরফ থেকে আমিই প্রশ্নটা করছি আপনাকে।” এবার আপনি হেঁটে যাবেন কথা বলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটাতে। হাতটা কিন্তু এমন জায়গায় রাখবেন, যাতে করে সবাই দেখতে পায়, তা না হলে ঐ মেয়েলোকেরা ওগুলো ধরবে আর আপনার আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করবে।– আর এবার শেষমেশ আপনি বলা শুরু করলেন। আমি জানি না ঐ মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকা অতগুলো ঘণ্টার উত্তেজনা আমি সহ্য করব কী করে। আপনার বক্তৃতায় আপনি অবশ্যই কোনো সংযমের তোয়াক্কা করবেন না, সত্যকে বেরিয়ে আসতে দিন, রেলিংটার উপরে ঝুঁকে আসুন, কমান্ড্যান্টকে চিৎকার করে বলুন, সত্যিই চিৎকার করে ওনাকে জানান আপনার মতামত, আপনার অনড় মতামত। কিন্তু সম্ভবত ওভাবে বক্তৃতা দিতে চাইবেন না আপনি, আপনার স্বভাবের সঙ্গে ওটা যায় না, সম্ভবত আপনার দেশে ওরকম অবস্থায় মানুষ ভিন্নভাবে আচরণ করে, তাতে অসুবিধা নেই, ওটুকুতেই ভালোমতো চলবে, আপনাকে এমনকি উঠে না দাঁড়ালেও চলবে, স্রেফ দু একটা কথা বললেই হবে, নিচে অফিসাররা যেন শুনতে পায় সেটুকু জোর ফিসফিস করে বললেই হবে, তা-ই যথেষ্ট, আপনাকে এমনকি মৃত্যুদণ্ড নিয়ে জনসাধারণের অনাগ্রহ বিষয়েও কিছু বলা লাগবে না, কাঁচকোচ করা চাকা নিয়ে বা ভাঙা ফিতা বা ঐ বমি-জাগানো তুলোর পিণ্ড নিয়েও কিছু বলতে হবে না, ঐ সবকিছু আপনি আমার ওপরে ছাড়তে পারেন, আর বিশ্বাস করুন। আমার বক্তৃতা যদি তাকে তখন হলঘরটা থেকে বের করে না-ও ছাড়ে, তো অন্তত তাকে বাধ্য করবে দুই হাঁটু গেড়ে বসে পড়তে, ওনাকে তখন কবুল করতেই হবে: “প্রাক্তন কমান্ড্যান্ট, আপনার শক্তির কাছে আমি মাথা নত করছি।” –এটাই আমার পরিকল্পনা; এটার বাস্তবায়নে কি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন? অবশ্যই আপনি করবেন –কী বলছি আমি?– আপনাকে করতেই হবে। অফিসার পর্যটকের দুই বাহু ধরে বসলেন আর তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, শ্বাসের জন্য হাঁফাচ্ছেন। শেষের কথাগুলো তিনি এমন উঁচুমাত্রায় চিল্লিয়ে বলেছেন যে এমনকি সৈন্য আর দণ্ডিত আসামি দুজনেই নড়ে উঠল; যদিও ওরা বুঝতে পারল না কিছুই, তবু খাওয়া থামাল খানিকক্ষণের জন্য আর চিবাতে চিবাতে তাকিয়ে থাকল পর্যটকের দিকে।
পর্যটক কী উত্তর দেবেন তা তার নিজের কাছে একেবার শুরু থেকেই পরিষ্কার, তার জীবনে এতকিছু ঘটেছে যে এখানে হোঁচট খাওয়ার প্রশ্নই আসে না; তিনি মৌলিক অর্থেই। একজন সৎ আর নির্ভীক মানুষ। এসব সত্ত্বেও তিনি এখন, সৈনিক আর দণ্ডিত আসামির সামনে দাঁড়িয়ে, খানিক ইতস্তত করলেন। কিন্তু অবশেষে তিনি বললেন, তাকে বলতেই হতো: ‘না। অফিসার বেশ কবার চোখ পিটপিট করলেন, তবে চোখ দুটো পর্যটকের দিকেই নিবদ্ধ। আপনাকে কি ব্যাখ্যা করে বলব? পর্যটক জিজ্ঞাসা করলেন। অফিসার ‘হ্যাঁ’ বললেন নীরবে মাথা নেড়ে। আমি এই বিচারব্যবস্থার বিপক্ষের মানুষ, পর্যটক এবার বলতে লাগলেন, আপনি আমাকে আপনার বিশ্বাসের মধ্যে নেওয়ার আগে থেকেই।– যে বিশ্বাস আমি নিশ্চিত কোনো অবস্থাতেই ভাঙব না –আমি চিন্তা করছিলাম যে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমার দাঁড়ানো যুক্তিসংগত হবে কি না, আর আমার হস্তক্ষেপ থেকে সফলতা আসার সামান্য সুযোগও আছে কি না। প্রথমে কার সঙ্গে কথা বলতে তা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল শুরু থেকেই: অবশ্যই কমান্ড্যান্ট সাহেব। আপনি সেটা আরো পরিষ্কার করলেন, তার মানে আবার এটা বুঝবেন না যে আমার সিদ্ধান্ত আমি আপনার কথাতেই পাকাপোক্ত করেছি; বরং তার উল্টোই সত্যি, আপনার অকৃত্রিম বিশ্বাস আমার মনে বরং সহানুভূতি জাগিয়েছে, যদিও আমার সিদ্ধান্তের ওপরে তা কোনো প্রভাব ফেলেনি।
অফিসার চুপ থাকলেন, যন্ত্রের দিকে ঘুরলেন, পেতলের রডগুলোর একটা ধরলেন আর তারপর, সামান্য পেছনে ঝুঁকে, উপরে নকশাবিদ-অংশটার দিকে তাকালেন যেন বা পরখ করছেন সবকিছু ঠিক আছে কি না। সৈনিক আর দণ্ডিত আসামিকে দেখে মনে হচ্ছে ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব হয়েছে; আসামি সৈনিকের দিকে কিছু একটা ইঙ্গিতে বলছে, যদিও কাজটা কঠিন; কারণ, ফিতেগুলোতে শক্ত করে বাঁধা সে; সৈনিক তার দিকে নত হলো; দণ্ডিত মানুষটা তার কানে ফিসফিস করে কিছু বলল আর সৈনিক মাথা ঝাঁকাল।
পর্যটক অফিসারের কাছে গেলেন আর বললেন: ‘আপনি এখনো জানেন না আমি কী করতে চাচ্ছি। আমি নিঃসন্দেহে কমান্ড্যান্টকে জানাব আপনাদের পদ্ধতিটা নিয়ে আমার কী ভাবনা, কিন্তু আমি তা করবো একান্তে, কোনো পাবলিক সভায় না; আর আমি এখানে অতক্ষণ থাকছিও না যে আমাকে সভায় ডাকা যাবে; কাল ভোরেই আমি নৌকা ছাড়ব, না হলে অন্তত আমার জাহাজে গিয়ে তো উঠবই।
মনে হলো না যে অফিসার তার কোনো কথা শুনেছেন। তাহলে আমাদের পদ্ধতিতে আপনি আস্থা রাখতে পারছেন না? তিনি বিড়বিড় করে বললেন, হাসছেন যেভাবে কোনো বুড়ো মানুষ কোনো বাচ্চার অর্থহীন কথায় হাসে আর সেই হাসির আড়ালে তার সত্যিকারের চিন্তা লোকের কাছ থেকে লুকায়।
‘তাহলে সময় হয়েছে, তিনি অবশেষে বললেন, আর হঠাৎ তাকালেন পর্যটকের দিকে। তার চোখের উজ্জ্বলতার মধ্যে ধরা একধরনের আহ্বান, কোনো যোগসাজশে অংশ নেওয়ার জন্য একটা ডাক।
‘কিসের সময় হয়েছে?’ অস্বস্তির সঙ্গে জিগ্যেস করলেন পর্যটক, কিন্তু কোনো জবাব পেলেন না।
‘তুমি মুক্ত, অফিসার দণ্ডিত আসামিকে বললেন তার দেশীয় ভাষায়। মানুষটা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারল না। বললাম তো, তুমি মুক্ত,’ বললেন অফিসার। প্রথমবারের মতো দণ্ডিতের মুখ ঝলমল করে উঠল প্রাণশক্তিতে। এটা কি সত্যি? এটা কি অফিসারের সাময়িক কোনো খেয়াল যা একটু পরেই চলে যাবে? বিদেশি অতিথিই কি তার ক্ষমার ব্যবস্থা করলেন? কী হতে পারে আসলে? তার চেহারায় এসব প্রশ্ন। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য না। যা-ই হোক হবে, সে চাইছে যদি পারে তাহলে আসলেই মুক্ত হতে, আর আঁচড়ার নিচে যতটা পারা সম্ভব, নিজের শরীর এপাশে-ওপাশে ততটা ঝাঁকাতে লাগল সে।
‘তুমি আমার ফিতাগুলো ছিঁড়ে ফেলবে,’ অফিসার চিৎকার করে বললেন, ‘নড়াচড়া বন্ধ করো। আমরা খুলে দিচ্ছি।’ তিনি সৈনিককে একটা ইঙ্গিত করলেন আর তারা দুজনে শুরু করল বাঁধন খুলে দেওয়ার কাজ। দণ্ডিত মানুষটা বলল না কিছু, শুধু মুখ টিপে নীরবে হাসতে লাগলো, একবার তার মাথা ঘোরাচ্ছে বাঁয়ে অফিসারের দিকে, একবার ডানে সৈনিকের দিকে,আর দুজনের মাঝে দাঁড়ানো পর্যটকের দিকেও।
‘ওকে টেনে তোলো, অফিসার আদেশ দিলেন সৈনিককে। কাজটা করতে খানিক বিশেষ যত্নের দরকার পড়ল আঁচড়ার কারণে। দণ্ডিত আসামির পিঠ এরই মধ্যে কয়েকটা জায়গায় সামান্য ছিঁড়ে কেটে গেছে তার অস্থিরতার ফলস্বরূপ।
তবে এর পর থেকে অফিসার আর দণ্ডিত মানুষটার দিকে তেমন খেয়ালই দিলেন না। তিনি পর্যটকের কাছে হেঁটে গেলেন, তার ছোট চামড়ার ফোল্ডারটা বের করলেন আরেকবার, ওটার পাতা উল্টাতে লাগলেন, আর শেষ খুঁজে পেলেন তার খুঁজতে থাকা পাতা; সেটা দেখালেন পর্যটককে। পড়ন’ বললেন তিনি। আমি পড়তে পারি না, পর্যটক বললেন, আপনাকে আগেই বলেছি এ লেখার কিছুই আমি বুঝি না। স্রেফ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকুন লেখাটার দিকে,’ বললেন অফিসার, পর্যটকের পাশে এসে দাঁড়ালেন একই সঙ্গে পড়বেন বলে। যখন এতেও কাজ হলো না, তিনি হাতের একটা ছোট আঙুল বের করলেন শূন্যে আর ওটা কাগজের উপর দিয়ে– বেশ উপর দিয়ে যেন কাগজটায় কোনোভাবেই কোনো ছোঁয়া না লাগে– চালিয়ে গেলেন যেন পর্যটকের জন্য পড়াটা একটু সহজ হয়। আর পর্যটক সত্যি সব চেষ্টাই করলেন, কারণ তিনি চাচ্ছেন অফিসারকে অন্তত এ ব্যাপারটায় একটু খুশি করতে, কিন্তু তার পরও পড়তে পারলেন না কিছুই। অফিসার তারপর বানান করে করে পড়া শুরু করলেন লেখাটা, শেষে পুরো পড়লেন একসঙ্গে “ন্যায়নিষ্ঠ হও”, এতে লেখা। এখন তো নিশ্চয় পড়তে পারছেন, নাকি? পর্যটক কাগজের উপরে এতখানি ঝুঁকে এলেন যে অফিসার ওটা আরো দূরে সরিয়ে নিলেন, তার ভয় যদি ওটাতে ছোঁয়া লেগে যায়! পর্যটক কোনো উত্তর দিলেন না, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি এখনো পড়তে পারছেন না কিছু। এতে লেখা “ন্যায়নিষ্ঠ হও” –আবার বললেন অফিসার। তাই হবে,’ বললেন পর্যটক, আপনার কথা বিশ্বাস করছি আমি। ‘ঠিক আছে, অফিসার বললেন, কিছুটা হলেও খুশি তিনি। এরপর কাগজটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন; খুব যত্নের সঙ্গে তিনি কাগজটা ঢোকালেন নকশাবিদ এর মধ্যে, এরপর তাকে দেখে মনে হলো তিনি যন্ত্রের চলাটা পুরো ঢেলে সাজাচ্ছেন। প্রচণ্ড খাটুনির কাজ এটা– সবচেয়ে ছোট ছোট ছোট চাকাগুলোও ঠিক করতে হচ্ছে, আর এতই কাছ থেকে যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করতে হচ্ছে যে মাঝেমধ্যেই অফিসারের মাথা পুরো হারিয়ে যাচ্ছে নকশাবিদ-এর ভেতরে।
পর্যটক নিচের থেকে বিরামহীন দেখতে লাগলেন এই কাজ, তার ঘাড় শক্ত হয়ে এল, আর তার চোখ ব্যথা করতে লাগল আকাশ ভাসিয়ে দেওয়া রোদের আলোয়। সৈনিক আর দণ্ডিত লোক ব্যস্ত শুধু নিজেদের নিয়েই। দণ্ডিতের জামা আর পাজামা ফেলে দেওয়া হয়েছিল গর্তে, ওগুলো সৈনিক টেনে তুলল তার বেয়নেটের আগা দিয়ে। জামাটা এত নোংরা হয়ে গেছে যে বলার মতো না; দণ্ডিত লোকটা সেটা ধুলো বালতির পানিতে। এরপর সে তখন জামা আর পাজামা পরল, সে নিজে আর সৈনিক –দুজনেই ফেটে পড়ল হাসিতে, কারণ দুটো কাপড়েরই পেছনটা যে ফাড়া। মনে হয় দণ্ডিত লোকটা ভাবল যে সৈনিককে একটু মজা দেওয়া তার দায়িত্ব, তাই সে ঐ কাটা-ফাড়া কাপড়গুলো পরে সৈনিকের সামনে গোল হয়ে চক্কর দিয়ে নাচতে লাগল আর সৈনিক মাটিতে পা ফাঁক করে বসে হাসির দমকে চাপড়াতে লাগল নিজের হাঁটু। তবে এখানে ভদ্রলোকেরা আছে বলে তারা দুজনেই নিজেদের সামলেও নিতে লাগল কিছুটা।
অফিসার যখন অবশেষে উপরে তার কাজ শেষ করলেন, তিনি আরেকবার পুরো জিনিসটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেন– এর সবগুলো যন্ত্রাংশ– মুখে হাসি নিয়ে; এইবারে তিনি নকশাবিদ-এর ঢাকনা বন্ধ করলেন সজোরে, ঢাকনা এতক্ষণ খোলা ছিল; তারপর নেমে এলেন, তাকালেন গর্তটাতে, এরপর দণ্ডিত আসামির দিকে, দেখে খুশি হলেন যে সে তার কাপড়গুলো তুলেছে, হাত দেওয়ার জন্য হেঁটে গেলেন পানির বালতির কাছে, গা-গোলানো নোংরা পানি খেয়াল করতে তার দেরি হয়ে গেল, তিনি দুঃখ পেলেন যে এখন আর তার পক্ষে হাত ধোওয়ার কোনো রাস্তা নেই, শেষমেশ হাত দুটো ঢুকিয়ে দিলেন– এই বিকল্পে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না তিনি, কিন্তু তাকে মেনে নিতেই হচ্ছে– বালির মধ্যে, এরপর ওখানেই দাঁড়িয়ে তার উর্দির বোতামগুলো খোলা শুরু করলেন। ওই সময় একসঙ্গে তার হাতের উপর পড়ল মহিলাদের রুমাল দুটো, ওগুলো তিনি খুঁজে রেখেছিলেন উর্দির কলারের ভাঁজে। এই যে –তোমার রুমাল,’ তিনি বললেন, ওগুলো ছুঁড়ে মারলেন দণ্ডিত আসামির দিকে। আর ব্যাখ্যার ভঙ্গিতে পর্যটককে বললেন: ‘মহিলাদের থেকে পাওয়া উপহার।
দৃশ্যমান তড়িঘড়ির সঙ্গে তিনি প্রথমে তার উর্দি, পরে গা থেকে অন্য সব জামাকাপড় খুললেন বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে প্রতিটা কাপড় খুব যত্ন নিয়েই ধরলেন, এমনকি তার উর্দির রুপার বিনুনি সূক্ষ্মভাবে ছুঁলেন আঙুল দিয়ে, আর একটা নকশাদার সুতা ঝাঁকিয়ে সোজা করলেন অন্যগুলোর সঙ্গে। কিন্তু তার এত যত্নের কোনো মানে হয় না; কারণ প্রতিটা কাপড় যে-ই না ওভাবে তিনি ধরছেন, পরক্ষণেই সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। গর্তের মধ্যে, রুষ্ট এক ঝাঁকির সঙ্গে। তার কাছে এখন শেষ জিনিসটা বলতে তার বেল্টসহ ছোট তরবারিটাই আছে। খাপ থেকে ওটা খুললেন তিনি, টুকরো টুকরো করে ভাঙলেন, সব টুকরো জড়ো করলেন একসঙ্গে– তরবারি, খাপ আর বেল্টের টুকরোগুলো; আর এমন প্রচণ্ডতা নিয়ে ওগুলো ছুঁড়ে মারলেন নিজের কাছ থেকে যে, গর্তের নিচে একসঙ্গে ঠুনঠান শব্দ তুলে পড়ল ওগুলো।
এবার তিনি ওখানে দাঁড়িয়ে –উলঙ্গ। পর্যটক ঠোঁট কামড়ালেন, বললেন না কিছু। তিনি জানেন যে কী ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু অফিসারকে কোনোভাবে বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার তার নেই। যদি অফিসারের অতি পছন্দের এই বিচার-প্রক্রিয়া সত্যিই উচ্ছেদ হওয়ার দোরগাড়ায় পৌঁছে গিয়ে থাকে– সম্ভবত পর্যটকের হস্তক্ষেপের কারণে, সে ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব এড়াচ্ছেন না তিনি –তাহলে তিনি যা করতে যাচ্ছেন তাকে বেঠিক বলা যাবে না; তার জায়গায় হলে পর্যটকও ঠিক একই কাজ করতেন।
সৈনিক ও দণ্ডিত আসামি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না, শুরুতে তো তারা এদিকে দেখছিলই না। দণ্ডিত লোকটা খুশিতে ডগমগ যে সে তার রুমালগুলো ফিরে পেয়েছে, কিন্তু বেশিক্ষণ আর ওগুলো নিয়ে আনন্দ করার সুযোগ মিলল না তার, কারণ সৈনিক তার কাছ থেকে ওগুলো এক ঝটকায় ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। এবার দণ্ডিত লোকটা চেষ্টা করছে সৈনিকের বেল্টের নিচ থেকে ওগুলো –সৈনিক রুমাল দুটো নিরাপদে রাখার জন্য খুঁজে রেখেছে তার বেল্টের মধ্যে– টেনে নিতে, কিন্তু সৈনিক সে-ব্যাপারে সতর্ক। এভাবেই ওরা দুজন নিজেদের মধ্যে লাগাল কাড়াকাড়ি-মারামারি, অর্ধেক ফুর্তির ছলে। অফিসার পুরো নগ্ন হওয়ার পরেই কেবল এদিকে খেয়াল করা শুরু করল ওরা। বিশেষ করে দণ্ডিত লোকটাকে মনে হলো, কোনো বিরাট অবস্থান-উলটে-যাওয়া ঘটনার অনুমান সে করতে পারছে। যা ঘটছিল তার ক্ষেত্রে, এখন তা-ই ঘটছে অফিসারের ক্ষেত্রে। সম্ভবত এইবার একেবারে চূড়ান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে ঘটনাটা। সম্ভবত বিদেশি এই পর্যটক আদেশ দিয়েছেন এভাবে। একেই বলে প্রতিশোধ। তার নিজেকে ভুগতে হয়নি শেষটা পর্যন্ত, কিন্তু সে শোধ নিতে যাচ্ছে একদম ঐ শেষবিন্দু অবধিই। একটা চওড়া, নীরব হাসি ছড়িয়ে পড়ল এবার তার মুখে, আর লেগে থাকল ওখানেই।
অফিসার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যন্ত্রটার দিকে। আগে পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল যে তিনি যন্ত্রটা খুব ভালো বোঝেন, কিন্তু এখন তিনি ওটা কীভাবে সামলাচ্ছেন আর কীভাবে যন্ত্রটাও তার কথা শুনছে তা দেখে হতবিহ্বল হতে হয়। তাকে শুধু আঁচড়ার দিকে একটা হাত বাড়াতে হলো –তাতেই আঁচড়া উপর-নিচে ওঠানামা করল কয়েকবার, তাকে বরণ। করার জন্য সঠিক অবস্থানে পৌঁছা পর্যন্ত; তিনি স্রেফ বিছানার পাশটা ছুঁলেন আর ওতেই বিছানা কাঁপতে শুরু করল; তুলোর পিণ্ড তার মুখের কাছে চলে এল, অফিসার যে ওটা চাচ্ছিলেন না তা বোঝা গেল, কিন্তু তার এই ইতস্তত ভাব শুধু খানিকের জন্যই, শিগগিরই তিনি মেনে নিলেন, গ্রহণ করলেন পিণ্ডটাকে। সবকিছু এখন তৈরি, শুধু ফিতাগুলো এখনো ঝুলছে দুপাশে, তবে ওগুলোর কোনো কাজও নেই, অফিসারকে বিছানায় বেঁধে রাখার কোনো দরকার হবে না। কিন্তু দণ্ডিত লোকটার চোখে পড়ল ওই ঝুলতে থাকা ফিতাগুলো, তার হিসেবে এই চামড়ার ফিতা দিয়ে আসামিকে বাধা না পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড হয় না আসলে, সে প্রবলভাবে ডাকল সৈনিককে আর তারা দুজনেই দৌড়ে গেল অফিসারকে বাঁধার জন্য। অফিসার এরই মধ্যে এক পা বাড়িয়েছেন নকশাবিদকে চালানোর হাতলে লাথি মারার জন্য; তখন তিনি দেখলেন যে ওরা দুজন এসে পাশে হাজির; সুতরাং তিনি সরিয়ে নিলেন তার পা, নিজেকে ফিতায় বন্দী হওয়ার জন্য সমর্পণ করলেন। কিন্তু এবার আর হাতলটা তার পায়ের নাগালে থাকল না; সৈনিক কিংবা আসামি কেউই খুঁজেও পাবে। না যে হাতল কোথায়, আর পর্যটকও নিশ্চয় হাত লাগাবেন না এসবে। অবশ্য দরকার পড়ল না ওসব কিছুর, শেষ ফিতা বাঁধা মাত্রই যন্ত্র চলা শুরু করল; বিছানা কেঁপে উঠল, সুচগুলো নেচে উঠল চামড়ার উপরে, আঁচড়া সুন্দরভাবে উপর-নিচ করতে লাগল। পর্যটক খানিক সময় তাকিয়ে থাকলেন ওটার দিকে, এরপর তার মাথায় এল যে নকশাবিদের একটা চাকার তো ঘর্ঘর শব্দ করার কথা; কিন্তু কই, সবই তো নিশ্চুপ, এমনকি ক্ষীণতম শোঁ-শোঁ শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
এরকম নিঃশব্দে চলার কারণে যন্ত্রের দিকে আর মনোযোগ থাকল না পর্যটকের। তিনি তাকালেন সৈনিক আর দণ্ডিত আসামির দিকে। দুজনের মধ্যে দণ্ডিতকেই বেশি হাসিখুশি লাগছে, যন্ত্রের সবকিছুতেই তার অনেক আগ্রহ, এই সে নিচু হচ্ছে ঝুঁকে, এই উপরে হাত বাড়াচ্ছে, সব সময়েই তার তর্জনী উঁচিয়ে আছে সৈনিককে কিছু একটা দেখানোর কাজে। পর্যটক অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। তিনি দৃঢ়সংকল্প ছিলেন যে একেবারে শেষ পর্যন্ত এখানে থাকবেন, কিন্তু এই দুজনের কাণ্ডকারখানা আর সহ্য করতে পারছেন না তিনি। বাড়ি যাও,’ বললেন তিনি। সৈনিকের মনে হয় বাড়ি যেতে আপত্তি নেই, কিন্তু দণ্ডিত আসামির কাছে এই আদেশটা লাগল শাস্তির মতো। সে তার দুই হাত জোড় করে মিনতি জানাল এখানে থাকার জন্য, আর পর্যটক যখন তার মাথা নেড়ে ‘না’ জানালেন, বোঝালেন যে তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, আসামি তখন একেবারে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল প্রার্থনার ঢঙে। পর্যটক বুঝলেন আদেশ দিয়ে কোনো লাভ নেই, তিনি উদ্যত হলেন ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে খেদিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই সময় মাথার উপরে নকশাবিদ-এ একটা আওয়াজ শুনলেন তিনি। উপরে তাকালেন। সেই খাঁজকাটা চাকাই কি ঝামেলা বাধাতে শুরু করল? না, অন্য কিছু। আস্তে আস্তে নকশাবিদ-এর ঢাকনা খুলতে লাগল, একসময় পুরো খুলে পড়ল। একটা খাঁজকাটা চাকার দাঁতগুলো দেখা গেল, দাঁতগুলো উপরে উঠছে, একটু বাদেই পুরো চাকা হাজির হলো চোখের সামনে, মনে হলো কোনো দুর্দান্ত শক্তি যেন বা চেপে ধরেছে নকশাবিদকে, যে-কারণে এই চাকার জন্য ভেতরে আর কোনো জায়গা নেই; নকশাবিদ-এর প্রান্তসীমায় পৌঁছানো পর্যন্ত ঘুরল চাকা, মাটিতে পড়ল, তারপর বালিতে খাড়া হয়ে দৌড়াল কিছুটা পথ, আর শেষমেশ পড়ে গেল ডিগবাজি খেয়ে। কিন্তু উপরে দ্বিতীয় আরেকটা চাকা আবির্ভূত হতে শুরু করেছে, ওটার পেছনে আরো অনেকগুলো– বড় চাকা, ছোট চাকা, একদম ছোট ছোট চাকা যেগুলো আলাদা করে বোঝাই মুশকিল– সবগুলোর ভাগ্যে ঘটল একই ঘটনা। ভাববেন যে এতক্ষণে নিশ্চয় নকশাবিদের ভেতরটা খালি হয়ে গেছে, কিন্তু পরমুহূর্তেই একটা নতুন, সংখ্যায় অনেক বেশি এমন একটা দল, হাজির– ওগুলো মাথা তুলছে, মাটিতে পড়ছে, বালিতে দৌড়াচ্ছে আর তারপর ডিগবাজি খেয়ে শুয়ে পড়ছে। এই দৃশ্যে বিমোহিত হয়ে দণ্ডিত আসামি একদমই ভুলে গেছে পর্যটকের আদেশ, খাঁজকাটা চাকাগুলোয় পুরো মোহগ্রস্ত হয়ে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে একটাকে ধরবার আর সৈনিককে পীড়াপীড়ি করছে সেই কাজে তাকে সাহায্য করতে, কিন্তু প্রতিবারই ভয়ে হাত পিছিয়ে নিতে হচ্ছে তাকে; কারণ, ওটার পেছন পেছনই এসে পড়ছে আরেকটা চাকা যা –অন্তত যেই না মাটিতে গড়িয়ে দৌড় মারছে– তাকে করে তুলছে আতঙ্কিত।
পর্যটকের ব্যাপারে বলতে হয়, তিনি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত; দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে যন্ত্রটা খুলে পড়ছে; এর নির্ঝঞ্ঝাট কাজ করে যাওয়াটা এক অলীক মায়া ছিল মাত্র; তার মনে হলো অফিসারকে রক্ষা করা এখন তারই কর্তব্য, কারণ নিজের খেয়াল নিজে নেওয়ার মতো অবস্থায় অফিসার এখন আর নেই। কিন্তু নিচে পড়তে থাকা খাজকাটা চাকাগুলো তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এমনভাবেই দখল করে রেখেছিল যে, যন্ত্রের বাকি অংশের দিকে তাকানোর কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন; তবে এখন, শেষ খাজকাটা চাকাটা নকশাবিদ থেকে বের হয়ে আসার পরে, তিনি ঝুঁকলেন আঁচড়ার উপর –আর এক নতুন ও আরো বেশি পীড়াদায়ক বিস্ময়ের মুখোমুখি হলেন। আঁচড়া লিখছে না, সোজা কথায় –ছুরি বসাচ্ছে; আর বিছানা শরীরটা উল্টে দেওয়ার বদলে স্রেফ ওটাকে কাঁপতে কাঁপতে জোরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে সুচগুলোর উপর। পর্যটক চাইলেন বাধা দেবেন, যদি পারা যায় তো পুরো যন্ত্রটাই থামিয়ে দেবেন –কারণ অফিসার যে ধরনের নিপীড়ন ভোগ করতে চাচ্ছিলেন, এটা তা না, এটা পরিষ্কার খুন। তিনি হাত দুটো বাড়ালেন। কিন্তু আঁচড়া শরীরটা শিকে গাথার মতো গেঁথে নিয়ে এরই মধ্যে দুলে এক পাশে হেলে গেছে, যেমনটা সে করে বারোতম ঘণ্টায়। শতধারায় বয়ে যাচ্ছে রক্ত, তাতে পানি মেশানো না, পানি ছিটানোর নলগুলোও এইবার কাজ করেনি। আর এখন একদম শেষ জিনিসটাও কাজ করল নাঃ লম্বা সুচগুলো থেকে মুক্ত হলো না শরীর, রক্ত ঝরতে লাগল অঝোরে, আর নিচে না পড়ে বরং গর্তের উপরে ঝুলতে লাগল শরীরটা। আঁচড়া তার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া শুরু করল, কিন্তু যেন বা বুঝতে পারল সে তার বোঝা থেকে এখনো মুক্ত হয়নি, তাই যেখানে ছিল সেখানেই গর্তের উপরে দাঁড়িয়ে থাকল। “আসো, সাহায্য করো!’ পর্যটক চেঁচিয়ে বললেন সৈনিক ও দণ্ডিত আসামিকে আর তিনি নিজে ধরলেন অফিসারের পা দুখানা। তিনি চাচ্ছেন তার এদিক থেকে পা দুটো চাপ দিতে, আর ওদিকে ওরা দুজন ধরবে অফিসারের মাথা, যাতে করে তাকে ধীরে ছাড়িয়ে নেওয়া যায় সুচগুলো থেকে। কিন্তু ওই দুজন যন্ত্রের কাছে আসার ব্যাপারে মনস্থির করে উঠতে পারছে না; দণ্ডিত আসামি তো রীতিমতো অন্যদিকে ঘুরে হাঁটা দিল; পর্যটককে ওদের কাছে হেঁটে গিয়ে ওদের বাধ্য করতে হলো অফিসারের মাথার দিকে দাঁড়ানোর জন্য। এটা করতে গিয়ে তার চোখে পড়ল –অনেকটা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই– মৃতদেহের চেহারা। জীবিত অবস্থায় যেমন, তেমনই লাগছে মুখটা; ওনার বলা সেই ‘আলোকপ্রাপ্তির কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া গেল না ওতে; অন্য সবাই এই যন্ত্রের থেকে যা পেয়েছে, অফিসার তা পাননি; তার ঠোঁট দুটো শক্ত করে একসঙ্গে আঁটা, তার চোখ দুটো খোলা, দেখে মনে হয় তিনি জীবিত, চোখের দৃষ্টিতে একটা শান্ত প্রত্যয়ের ছাপ, আর তার কপাল কুঁড়ে চলে গেছে বিশাল লোহার শলার সুচাল মুখটা।
পর্যটক যখন সৈনিক আর দণ্ডিত আসামিকে সঙ্গে নিয়ে, ওরা হাঁটছে তার পেছনে, উপনিবেশের প্রথম বাড়িগুলোর কাছে পৌঁছালেন, সৈনিক ওগুলোর একটা দেখিয়ে বলল: ‘ঐ যে চা-ঘর।’
দালানগুলোর একটার নিচতলায় এক গভীর, নিচু, গুহার মতো কামরা– ধোঁয়ায় কালো হয়ে আছে এর ছাদ আর সব দেয়াল। রাস্তার দিকে এর পুরো প্রস্থের দিকটা খোলা। এই চা-ঘরকে উপনিবেশের অন্য বাড়িগুলো থেকে আলাদা করার মতো কিছু নজরে পড়ে না; সবগুলো বাড়িরই– শুধু কমান্ড্যান্টের হেডকোয়ার্টারের প্রাসাদতুল্য বাড়িগুলো বাদ দিলে –খুব জরাজীর্ণ অবস্থা; তা সত্ত্বেও পর্যটকের কাছে ওগুলো কোনো অতীতকালের অবশেষ বলে মনে হলো, তিনি ওগুলোতে খুঁজে পেলেন এক বিগত কালের শক্তি। চা-ঘরের দিকে আগালেন তিনি, ঘরটার সামনে রাস্তায় পড়ে থাকা খালি টেবিলগুলোর মাঝ দিয়ে পথ করে নিলেন, পেছনে এল তার দুই সঙ্গী; তারপর ভেতর থেকে আসা ঠান্ডা,আর্দ্র বাতাসে শ্বাস নিলেন। বুড়োটাকে এখানে কবর দেওয়া হয়েছে, সৈনিক বলল, ‘পুরোহিত তাকে কবরখানায় কবর দিতে রাজি হননি। কিছুটা সময় ওনারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কোথায় তাকে কবর দেবেন, শেষমেশ এখানে কবর দিলেন তাকে। অফিসার আপনাকে এ কথা বলতেন না কোনোভাবেই, কারণ তার জন্য এটাই সবচেয়ে লজ্জার বিষয়। তিনি কয়েকবার রাত্রিবেলায় এমনকি চেষ্টাও চালিয়েছেন বুড়োকে কবর থেকে তুলতে, কিন্তু প্রতিবারই তাড়া খেয়েছেন।’ ‘কবরটা কোথায়? পর্যটক জানতে চাইলেন, সৈনিকের কথা তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে তারা দুজন, সৈনিক আর দণ্ডিত আসামি, দৌড়ে গেল সামনের দিকে আর হাত বাড়িয়ে কবরের জায়গাটা দেখাল। তারা পর্যটককে নিয়ে গেল পেছনের দেয়ালের কাছে, সেখানে কয়েকটা টেবিলে বসে আছে কাস্টমারেরা। দেখে মনে হচ্ছে ওরা সব ডক শ্রমিক, শক্তপোক্ত কিছু মানুষ, মুখে ছোট কালো চিকচিকে দাড়ি। কারোরই গায়ে জ্যাকেট নেই, আর তাদের জামাগুলো ছেঁড়া; সব গরিব, নিপীড়িত মানুষ। পর্যটক এগিয়ে যেতেই ওদের কয়েকজন উঠে দাঁড়াল, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। বিদেশি লোক, চারপাশে এই ফিসফিস, ‘কবর দেখতে চাচ্ছে। তারা একটা টেবিল সরাল এক পাশে, আর ওর নিচে আসলেই একটা সমাধিফলক। সাধারণ একটা পাথর, টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখার মতো নিচু। ওটার গায়ে খুব ছোট অক্ষরে খোদাই করে কিছু লেখা, পর্যটককে হাঁটু মুড়ে বসতে হলো তা পড়ার জন্য। ওতে লেখা: ‘এখানে শুয়ে আছেন প্রাক্তন কমান্ড্যান্ট। তার অনুসারীরা, যাদের হয়তো এখন কোনো নাম নেই, তার জন্য এই কবর খুঁড়েছেন আর এই পাথরের ফলকটা বসিয়েছেন। এমনটা ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে যে নির্দিষ্ট কিছু বছর পরে কমান্ড্যান্ট আবার পুনরুজ্জীবিত হবেন, আর এই বাড়ি থেকে তার অনুসারীদের নিয়ে বেরিয়ে যাবেন উপনিবেশটা আবার দখলে নিতে। আস্থা রাখুন আর দেখতে থাকুন। পর্যটক যখন পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছেন, তিনি দেখলেন তাকে ঘিরে দাঁড়ানো লোকগুলো মিটিমিটি হাসছে, যেন বা তারাও তার সঙ্গে পড়েছে অভিলিখনটা, ওটা তাদের কাছে লেগেছে হাস্যকর, আর পর্যটকের মতামতও যেন একই রকম হয় সেই অনুরোধ জানাচ্ছে। পর্যটক ভান করলেন যে তিনি তাদের ওসব দেখেননি, তারপর তিনি তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন কিছু পয়সা, টেবিলটা কবরের উপরে ফের টেনে আনা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, চা-ঘর থেকে বেরোলেন আর পা বাড়ালেন জাহাজঘাটার দিকে।
সৈনিক ও দণ্ডিত আসামি চা-ঘরটাতে কিছু পরিচিতের দেখা পেয়েছে, তারা আটকে দিয়েছে ঐ দুজনকে। তবে ওরা খানিক পরে নিশ্চয় নিজেদের ছিঁড়ে বের করে নিয়ে এসেছে, কারণ পর্যটক নৌকার দিকে নামার লম্বা সিঁড়ির মাত্র মাঝামাঝি ধাপে পৌঁছেছেন, ওরা ছুটে আসতে লাগল তার দিকে। সম্ভবত ওরা শেষ মুহূর্তে এসে পর্যটককে জোর করতে চাইছে তার সঙ্গে তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি যখন সিঁড়ির নামায় একটা মাঝির সঙ্গে আপস-মীমাংসা করছেন তাকে স্টিমার অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্য, ঐ দুজন দৌড়ে নামতে লাগল সিঁড়িটা বেয়ে, নীরবে, চিৎকার করে ডাকার সাহস হলো না তাদের। কিন্তু ওরা যখন সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছাল, ততক্ষণে পর্যটক নৌকায় উঠে গেছেন আর মাঝি মাত্র নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে। তার পরও ওদের পক্ষে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে পড়া অসম্ভব ছিল না, কিন্তু পর্যটক নৌকার পাটাতন থেকে হাতে তুলে নিয়েছেন মোটা গিরার একটা ভারী রশি, ওটা দিয়ে তিনি ভয় দেখাতে লাগলেন ওদের, আর ওভাবেই ওদের বিরত রাখলেন লাফ দেওয়া থেকে।