দজ্জাল মেয়ে
পৃথিবী জুড়ে সবাই যখন নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন করে, আমার তখন হাসি পায়। কারণ আমাদের দেশে এতকাল মিটিং-টিটিং না করেই, হাতরুটির বেলনা আর মুড়ো ঝাঁটার সাহায্যে আমরা যে নিজেদের অধিকার রক্ষা করে এসেছি, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। বক্তৃতা-টক্তৃতা করেও যা হয় না— সে চেষ্টাও নিরিবিলিতে প্রচুর করা হয়েছে— একটা সামান্য কাঠের বেলনা দিয়ে যদি তা সম্পন্ন করা যায়, তা হলে মন্দ কী? ভেবে দেখুন কত সময়, পরিশ্রম আর খরচ বেঁচে যায়।
দাক্ষিণাত্য আমাদের এক বন্ধুর দেশ। সেখানকার মেয়েরা কোনওকালেও পরদার আড়াল হয়নি। তাদের আচার-আচরণ দেখে এখনও তার পরিচয় পাওয়া যায়। কী তাদের দাপট! দেখে ভক্তি হয়। তারই মধ্যে আমাদের বন্ধুর পিসিমা ছিলেন অনন্যা। তাঁর ভয়ে পিসেমশাই মুখে রা কাড়তেন না। বন্ধুবান্ধবরা তাই নিয়ে হাসাহাসি করতেন। বলতেন— এ-রাম! বউকে ভয় পায়!
গাঁয়ের কুয়োতলার সামনে শম্ভু বলে এক বন্ধুর বাড়িতে রোজ তাঁদের বৈকালীন আড্ডা বসত। গাঁয়ের গিন্নিরা আর মেয়েরা ওই সময় পানীয় জল তুলতে এসে, কুয়োর পাড়ে গল্পগুজব করত। একদিন তাদের মধ্যে পিসিমাকে দেখে, শম্ভু বলল, ‘ওই যে তোর বউ! তুই তো ওর সামনে ঠোঁট ফাঁক করতে ভয় পাস!’ তাই শুনে বাকিদের কী বিশ্রী হাসি!
পিসেমশায়ের আঁতে ঘা লাগল। তিনি বললেন, ‘ও তোমাদের ভুল ধারণা। তোমাদের মতো কথায়-কথায় বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করি না বটে, কিন্তু দরকার হলে কষে দু’কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ি না! ও মাথা নিচু করে শোনে, তা জানিস! ওকে আমি থোড়াই কেয়ার করি! চাও তো তার প্রমাণ দিতে পারি!’
বন্ধুরা আরও মজা পেয়ে বলল, ‘বেশ দশ টাকা বাজি। কাল বিকেলে তুমি আমাদের সামনে বউকে আচ্ছাসে দু’কথা শোনালে, ও কেমন মাথা নিচু করে শোনে, তার প্রমাণ দিও।’
বাড়ি ফিরেই পিসেমশাই পিসিমাকে বললেন, ‘কাল দশ টাকা রোজগার করতে চাও?’ পিসিমা ইডলি তুলতে তুলতে বললেন, ‘কী করতে হবে?’ পিসেমশাই ঢোঁক গিলে বললেন, ‘কিচ্ছু না। আমি কুয়োতলায় গিয়ে তোমাকে দুটো কড়া কথা বলব, তুমি মাথা নিচু করে শুনবে।’
পিসিমা ইডলির পাত্র চাপা দিয়ে বললেন, ‘এগারো টাকা।’ পিসেমশাই বললেন, ‘বেশ, তাই সই!’ আত্মসম্মানের কাছে একটা টাকা কিচ্ছু না।
পরদিন যথাসময়ে পিসিমা কুয়োতলায় পৌঁছে, জল তুলে, বন্ধুদের সঙ্গে দুটো কথা বলছেন, এমন সময় পিসেমশাই সেখানে দাপাতে দাপাতে গিয়ে বললেন, ‘তুমি ভেবেছ কী লক্ষ্মীয়াম্মা! বাড়ির কাজ ফেলে রোজ সন্ধ্যা অবধি গালগল্প আমি আর সইব না। যাও, বাড়ি যাও!’
তাই শুনে বন্ধুদের এবং পাশের বাড়ির দালানে বসা পুরুষ দর্শকদের অবাক করে দিয়ে, পিসিমা কাঁচুমাচু মুখ করে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। ওতেই পিসেমশাইয়ের কাল হল। অনাস্বাদিত বিজয়গর্ব তাঁর মাথায় চড়ল। গিন্নিকে মাথা নিচু করে বেণী দুলিয়ে চলে যেতে দেখে, তিনি আর লোভ সামলাতে পারলেন না। দিলেন বেণী ধরে হেঁচকা টান।
আর যায় কোথা! অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে পিসিমা বললেন, ‘এ মতো তো কথা ছিল না!’ বলে এক নিমেষের মধ্যে পিসেমশাইকে একেবারে মাটির সঙ্গে বিছিয়ে দিয়ে, দুম-দুম করতে করতে বাড়ি চলে গেলেন। ব্যাপার দেখে পিসেমশায়ের বন্ধুরা থ’! বলাবাহুল্য কেউ টাকাকড়ি পেল না।
কথায় বলে মেয়েদের অসাধ্য কিছু নেই, তারও একটা নমুনা দিচ্ছি। তবে এ গল্পের সত্যমিথ্যার জন্য আমি দায়ী নই। লোকে বলত কলকাতায় বা তার আশপাশে, দুশো টাকা ভাড়ার মধ্যে এমন বাড়ি ছিল না, যেখানে লাটুবাবু আর তাঁর স্ত্রী কিছুদিন বাস করেননি। সব বাড়ি ছাড়ার একটাই কারণ, সেটি হল ওই গিন্নি। হয় বাড়ি পছন্দ নয়, নয় বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া, নয় পাশের বাড়ির ভাড়াটেদের বরদাস্ত করা যায় না, নয় আর কিছু।
এমনি করে খুঁজে খুঁজে যখন শহরের সমস্ত দুশো টাকার ভাড়া-বাড়ি শেষ করে এনেছেন, তখন আপিস ফেরার পথে এক দালাল এসে লাটুবাবুকে ধরল। বেহালা অঞ্চলে নাকি একটা চমৎকার বাড়ি পাওয়া যেতে পারে, সেখানে এক রাত বাস করতে পারলে, পরের ছয় মাস ভাড়া দিতে হবে না এবং তার পরেও ওই দুশো টাকা।
লাটুবাবু সঙ্গে সঙ্গে দালাল সমভিব্যাহারে মালিকের বাড়ি গিয়ে চুক্তিপত্র সই করে এলেন। সেখান থেকে বেরিয়েই দালাল বলল, ‘দেখুন একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি, এখন তাই বিবেকে বাধছে।’ ‘কী আবার কথা?’ ‘বাড়িটা একবার দেখলেনও না—’ ‘দেখার কী আছে, সব বাড়িই এক। গিন্নি কোথাও বেশি দিন থাকেন না। কিন্তু কথাটা কী শুনি?’
আমতা আমতা করে সে বলল, ‘ইয়ে— মানে রোজ রাতে যে লোকটা আসে, সে মানুষ নয়।’ লাটুবাবু একবার থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘ওসব গিন্নি সামলাবেন। আমার রোজ নাইট ডিউটি থাকে। কাল ভোরে এসে বাড়িটা একবার দেখিয়ে দেবেন।’
হাতে হাতে জিনিসপত্র গোছানো হল। যাযাবর পরিবারের বাড়তি জিনিস থাকে না। পরদিন সকালে বাড়ি দেখে গিন্নি মহা খুশি। এমন ভাল বাড়িতে তিনি নাকি জন্মে কখনও থাকেননি। আশেপাশে লোকালয় নেই, সব খোলা মাঠ। তাই দেখে লাটুবাবুও অনেকটা আশ্বস্ত হলেন।
হাতে হাতেই জিনিসের বেশিরভাগ গোছানো হয়ে গেল। সন্ধ্যার আগে খেয়েদেয়ে টিফিন নিয়ে লাটুবাবু তাঁর খবরের কাগজের আপিসে গেলেন। ভোরে এসে ভয়ে ভয়ে দরজার কড়া নাড়লেন। কাজটা বোধহয় ভাল হয়নি। কে জানে কী দেখতে কী দেখবেন।
গিন্নি কিন্তু হাসিমুখে দরজা খুলে দিয়ে, পরটা ভাজতে বসলেন। খেতে খেতে লাটুবাবু চারদিকে চেয়ে দেখলেন, সব কিছু কাল যেমন রেখে গেছিলেন তেমনি আছে। খালি শ্বশুরমশায়ের কাঁঠাল কাঠের মুগুরটা তাকের ওপর শোভা পাচ্ছে।
সেদিকে তাকাতেই, তাঁর পাতে আরও দুটো পরটা দিয়ে গিন্নি বললেন, ‘কী দেখছ? কাল রাতে যে ভারী মজা হয়েছিল। কোথা দিয়ে কে জানে, এক ব্যাটা চোর এসেছিল। অমনি সুড়সুড় করে ওপরে উঠে যাচ্ছিল। পকেট থেকে একগাছা দড়ি ঝুলছিল।
‘আমি রান্নাঘরে বাসনের বাক্স খুলেছিলাম। ব্যাটাকে দেখে বাক্স থেকে বাবার ওই মুগুরটা না নিয়ে, পেছন থেকে ছুটে গিয়ে ব্যাটার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আগাপাছতলা এমনি পেটান পেটালাম যে হতভাগা ট্যাঁফু করতে পারল না। কীসব গায়ে দিয়ে এসেছিল, খালি খালি ফসকে যাচ্ছিল, যেন শূন্যে খামচাচ্ছি! তবু ছাড়িনি, শ্যাম গোঁসাইয়ের মেয়েকে চেনেনি লক্ষ্মীছাড়া। শেষটা মারের চোটে নাকটা ভেঙে গিয়ে থাকবে।
‘তখন আবার পায়ে পড়ে বলতে লাগল, ‘হেঁই মা, ছাঁড়ান দিন, ছাঁড়ান দিন, আঁর কঁক্ষনও এঁখানে আঁসব না, এঁই নাঁকে খঁৎ দিলাম!’
‘তাপ্পরেই এমনি চালাক, প্রায় আমার মুঠোর মধ্যে থেকে খসে কোথায় সে পালাল। মুগুর হাতে কত খুঁজলাম আর দেখতে পেলাম না। এ্যাঁ, ও কী হল!’
কী আর হবে, লাটুবাবু মুচ্ছো গেলেন।
বলাবাহুল্য, নেই-মানুষটা আর আসেনি। ছয় মাস বিনি ভাড়ায় থাকার পর, লাটুবাবু সস্তা দরে বাড়িটা কিনে ফেলেছেন।