ভলিউম ১৬ – দক্ষিণের দ্বীপ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী
১
বসন্তের এক চমৎকার সকাল। ওমর শরীফ-তিন গোয়েন্দার ওমর-ভাইয়ের সঙ্গে হেঁটে চলেছে কিশোর আর মুসা, রকি বীচ এয়ার ক্লাবের দিকে। বিমানে উড়বে, তারপর ওখানেই দুপুরের খাবার সারার ইচ্ছে ওদের। বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে রানওয়ে আর অন্যান্য বাড়িগুলো। পাশে একটা পার্ক। মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে। পার্কের ভেতর দিয়েও যাওয়া যায়। সেদিক দিয়েই চললো ওরা, সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখতে মাখতে। টুঁইই টুঁইই করে একটা নাম না জানা পাখি ডাকছে ফুলের ঝাড়ে, দেখা যায় না।
এতো ভালো লাগছে, পার্ক থেকেই বেরোতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। তবে বিমানে ওড়াটাও কম মজার নয়। সুযোগ পেলেই আসে এখানে, ওড়া চর্চা করে।
ঢোকার মুখে দেখা হয়ে গেল লোকটার সঙ্গে। খাটো, একহারা শরীর, ক্লিন শেভ, ইটের মতো লাল চুল ছোট করে ছাটা, রোদে পোড়া চামড়া। মুখ দেখলে মনে হয় কোনো কথা বললেই বুঝি মারমুখো হয়ে উঠবে। তোবড়ানো একটা ব্রায়ার পাইপ দাঁতে কামড়ে রেখেছে। তাকিয়ে আছে সবুজ মাঠের দিকে, যার বুক চিরে চলে গেছে রানওয়ে।
লোকটার দিকে তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে নিয়েছিলো ওমর, কি মনে হতে আবার তাকালো। থমকে দাঁড়ালো সে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। তারপর প্রায় চিৎকার করে উঠলো, আরে, ডজ না! হ্যাঁ, ডজ ম্যাকমবার! তুমি এখানে কি করছো? এতোদিন পর! কেমন আছো?
দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরিয়ে নিলো ছোটখাটো মানুষটা। তার চোখও বড় বড় হয়ে গেছে। ওমর না! আমাদের সেই দুর্ধর্ষ ওমর শরীফ, মরুর বুনো ঘোড়া!
মনে আছে তাহলে?
থাকবে না আবার। তোমার মতো বেদুইন ডাকাতকে ভোলা যায় নাকি? হাত বাড়িয়ে দিলো ডজ।
হাতটা ধরলো ওমর। তারপর একটানে নিয়ে এসে বুকে ফেললো। জড়িয়ে ধরলো একে অন্যকে, বেদুইনের কায়দায় কোলাকুলি করে স্বাগত জানালো।
তার পর? কেমন আছো, ভাই?
ভালো।
আরও কিছু কুশল বিনিময়ের পর দুই কিশোরের দিকে তাকালো ডজ। ওমরকে জিজ্ঞেস করলো, ছাত্র বুঝি?
ছাত্র এবং বন্ধু। পরিচয় করিয়ে দিলো ওমর, ও কিশোর পাশা। আর ও মুসা আমান। নামকরা গোয়েন্দা ওরা।
তা-ই নাকি? হাত বাড়িয়ে দিলো ডজ। এক এক করে হ্যান্ডশেক করলো কিশোর আর মুসা।
ডজের পরিচয় দিলো ওমর, ক্যাপ্টেন ডজারন ম্যাকমবার। আমরা ডাকি ডজ। ইরাকী বাহিনীতে একই স্কোয়াড্রনে ছিলাম আমরা। ইরাক-ইরানের যুদ্ধের সময় যা খেল দেখিয়েছে না ও। হুট হুট করে যখন তখন প্লেন নিয়ে ঢুকে পড়তো। শত্রু এলাকায়। একদিন খুব নিচু দিয়ে উড়ে শত্রুর বাংকার আবিষ্কার করতে গিয়ে বাড়ি লাগালে টেলিগ্রাফের খুঁটির সঙ্গে। তারপর গায়েব। আমরা তো ভেবেছি মরেই গিয়েছে। প্লেনটা পাওয়া গেছে বিধ্বস্ত অবস্থায়। কিন্তু ডজের খোঁজ নেই। বহুদিন আর কোনো খবর পাইনি। থামলো ওমর। ডজের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর একদিন খবর পেলাম, দক্ষিণ সাগরের এক দ্বীপে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। আমাদের ডজারন ম্যাকমবার।
যে বলেছে, সে একটা আস্ত মিথ্যুক, কড়া গলায় প্রতিবাদ করলো ডজ। কারণ ওখানে বিলাসেও গা ভাসিয়ে ছিলাম না আমি, কোনো একটা বিশেষ দ্বীপে বাসও করছিলাম না। আমি তখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।
তা বেশ করেছিলে, ওমর বললো। যার যা স্বভাব তা-ই তো করবে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি কেন আমরা? এতোদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা। একটু খাতির-টাতির করা দরকার। খেয়েছো?
এখানেই খেয়ে নেবো ভাবছিলাম। আমি এসেছিলাম ক্লাবটা দেখতে। হলিউড-ফলিউড দেখে দেখে আর সময় কাটছিলো না। রকি বীচ ক্লাবের নাম শুনেছি। অনেক পুরনো আমলের বিমানও নাকি আছে এখানে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে কল্পনাই করিনি।
আমিও না। এখানকার মেম্বার আমি। এরা দুজনও, কিশোর আর মুসাকে দেখালো ওমর। এসো। আগে গিয়ে বসি। খাওয়া-দাওয়া হোক। দক্ষিণের দ্বীপে নারকেল আর কলা কেমন ফলালে সেই গল্প শোনাও আমাদেরকে। তারপর ক্লাবটা দেখানো যাবেখন। এসো।
নারকেল ফলাবো! ফুহ্! জঘন্য লাগে আমার! দেখলেই বমি আসে এখন। তোমারও আসতো, যদি আমার মতো এতো নারকেল খেতে হতো, মুখ বাঁকালো ডজ। সুইং ডোর ঠেলে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো ওমরের পিছু পিছু।
জানালার কাছে একটা টেবিল বেছে নিয়ে এসে বসলো চারজনে।
তো, আমেরিকায় কি করছো? জানতে চাইলো ওমর। মেনু কার্ড টেনে নিলো সে। ছুটিতে বেড়াতে এসেছো? বাড়ি গিয়েছিলে?
ডজের বাড়ি বৃটেনে। মাথা নাড়লো সে, না, যাইনি। বেড়ানোর কথা বলছো? এখানেও জঘন্য লাগছে আমার। দুনিয়ার কোথায় গেলে যে ভালো লাগবে বুঝতে পারছি না। আসলে দক্ষিণ সাগর মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে আমার। আরেকটা মেনু কার্ড, টেনে নিলো সে। এই, শিক কাবাব হলে কেমন হয়? ভেড়ার মাংসের?
চমৎকার হয়!
দারুণ! বলে উঠলো মুসা।
ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো ডজ। জোরে হেসে উঠলো, ভোজন রসিক মনে হচ্ছে?
ধরে ফেলেছেন তাহলে, হাসতে হাসতে বললো কিশোর।
দ্বীপের কথা আর বলবেন না, ডজ ভাই.‥
বাধা দিয়ে ডজ বললো, শুধু ডজ। ওসব ভাবটাই শুনতে ভালো লাগে না। শুধু ডজ।
আচ্ছা, ঠিক আছে, শুধু ডজ। মাথা ঝাঁকাল মুসা। দ্বীপের খাবারের কথা বলছেন তো? সেকথা আর মনে করিয়ে দেবেন না, ডজ ভাই…
আবার ভাই।
থুককু। মনে থাকে না। নিজের চেয়ে বয়সে বড় কাউকে দেখলেই… যাকগে, ডজ। হ্যাঁ, দক্ষিণের কিছু দ্বীপে আমরাও বেরিয়ে এসেছি, ডজ। শুয়াপোকার বাচ্চা পর্যন্ত খেয়ে এসেছি আমরা তিনজনে…
তিনজন? আরেকজন কোথায়?
গানের অফিস চালাতে গেছে। রবিন মিলফোর্ড, বললো ওমর। আমাদের আরেক বন্ধু। ওরা তিনজনে মিলে একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছে। নামঃ তিন গোয়েন্দা। সংক্ষেপে তিন গোয়েন্দার কথা ডজকে জানালো সে।
ভালো, খুব ভালো, মাথা দুলিয়ে বললো ডজ। ওমর শরীফের সঙ্গে যখন এতো মাখামাখি, তখনই বুঝেছি স্বভাবও একই হবে। বেপরোয়া, অ্যাডভেঞ্চারাস, দুঃসাহসী…
কাকে কি বলছো? তুমি কি আর কম নাকি?
সেজন্যেই তো তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। হাঁ হাঁ করে হাসলো ডজ। অন্য তিনজনের মাঝেও সংক্রমিত হলে হাসিটা।
খাবারের অর্ডার দিয়ে আবার ডজের দিকে তাকালো ওমর, হ্যাঁ, এবার বলো। কি জন্যে আমেরিকায় এসেছে? বেড়াতে আসেনি। তোমার আচরণ বলে দিচ্ছে।
সত্যি কথা বলবো? টাকার জন্যে এসেছি। শুনেছি, এখানে নাকি বাতাসে টাকা ওড়ে।
ঠিকই শুনেছে। তবে তার পেছনে ছোটার লোকেরও অভাব নেই। প্রতিদিন ধরার জন্যে হন্যে হয়ে ছুটছে কোটি কোটি লোক। বেশির ভাগই ধরতে পারছে না, মুখ চুন করে বাড়ি ফিরছে। এই আমার কথাই ধরো না। অনেক তো ছুটলাম, বড় লোক আর হতে পারলাম না। কিছুদিন থেকে ভাবছি, পুলিশের চাকরিতে যোগ দেবো। ভালো অফার এসেছে।
চেহারা কিন্তু চকচক করছে তোমার, ডজ বললো। পকেটে পয়সা না থাকলে অমন হয় না। টাকার জন্যে নয়, পুলিশে যোগ দেয়ার যদি ইচ্ছে হয়ে থাকে তোমার, তাহলে ওই বেদুইনগিরি করার লোভে। অ্যাডভেঞ্চার। তা কতো জমিয়েছো?
ব্যাপারটা কি, বলো তো? এতোই টানাটানিতে পড়ে গেলে? ঠিক আছে, লাগলে অল্পস্বল্প ধার দিতে পারি।
অল্পতে হবে না, বেদুইন, বিষন্ন কণ্ঠে বললো ডজ, গাদা গাদা দরকার আমার। আর ধারটারের মধ্যেও যাচ্ছিনে। আমি চাইছি পার্টনার।
গাদা গাদা বলতে কতো বোঝাচ্ছে?
ধরো, শুরুতে হাজার পঞ্চাশেক।
শিস দিয়ে উঠলো ওমর। কেন? দ্বীপ কিনবে নাকি?
দ্বীপফীপের দরকার নেই আমার। নাক দিয়ে ঘোৎ ঘোঁৎ করলো ডজ। বিনে পয়সাতেই হাজারটা দ্বীপ দখল করে নিতে পারি, ইচ্ছে করলে। পয়সা লাগে না। সাগরের ওই দক্ষিণ অঞ্চলটায় খালি পড়ে আছে হাজারে হাজারে। থাকার লোকও নেই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও গিয়ে থাকতে পারো। না ভাই, ওসব নয়। আমার উচ্চাকাঙ্খা আরেকটু বেশি।
বলে ফেলো। দেখি সাহায্য করা যায় কিনা।
উজ্জ্বল হলো ডজের মুখ। সত্যি সাহায্য করবে আমাকে? টাকার ব্যবস্থা করে দেবে?
সেই টাকা দিয়ে তুমি কি করতে চাও, তার ওপর নির্ভর করে দেয়া না দেয়া। তোমাকে তো আমি চিনি। আর স্মৃতিশক্তিও অতোটা খারাপ না আমার। আগেও বহুবার নানারকম উর্বর বুদ্ধি এসেছিলো তোমার মাথায়। কোটিপতি হবার অনেক পরিকল্পনা করেছিলে। কয়েকবার ফতুর করেছে আমাকে। আর ফতুর হতে রাজি আমি।
ছুরি কাঁটা তুলে নিয়েছিলো ডজ। নামিয়ে রেখে হেলান দিলো চেয়ারে। স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ওমরের দিকে। এক ঝুড়ি মুক্তো যদি দিয়ে দেয়া হয় তোমাকে, নিজেকে আর ফতুর ভাববে?
হাসলো ওমর। বাড়িয়ে বলার স্বভাবও গেল না তোমার। একমুঠো বললেও নাহয় বিশ্বাস করতাম।
এক ঝুড়িই বলছি! বড় এক ঝুড়ি! জোর দিয়ে বললো ডজ। আর এখানকার গহনার দোকানে যেসব মটরের দানার মতো দেখলাম, সেরকম নয়। আরও অনেক বড়। পায়রার ডিমের সমান।
তাহলে তো ভালোই হয়, স্বীকার করলো ওমর। তারপর মাথা নাড়লো অবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে, কিন্তু তা তো তুমি দিতে পারবে না। কারণ সেই মুক্তো আনতে হলে ডালাস কিংবা হলিউডের বড়বড় বাড়িতে যেতে হবে তোমাকে। দুর্গম দুর্গ একেকটা। সেসব বাড়িতে ঢোকার সাধ্য বড় বড় ডাকাতেরও নেই। তবে সঙ্গে যদি নিয়ে এসে থাকো, আলাদা কথা।
সঙ্গে আনতে পারলে কি আর তোমার কাছে টাকা চাইতাম নাকি? গুঙিয়ে উঠলো ডজ। তবে আমি দেখেছি।
নাকি অন্য কেউ দেখে তোমাকে বলেছে? সেকথাই শোনাচ্ছাে।
গ্লাস তুলে নিয়েছিলো, দড়াম করে নামিয়ে রাখলো ডজ। আরেকটু জোরে আছাড় দিলেই ভেঙে যেতো। চেহারার মারমুখো ভাবটা আরও প্রকট হয়ে গেছে।
দেখ, বেদুইন, আমি বলছি আমি দেখেছি। নিজের চোখে। বিশ্বাস করো দয়া করে!
মাথা ঝাঁকাল ওমর। বেশ, এতোই যখন জোর দিয়ে বলছো, বিশ্বাস করলাম। কিন্তু দেখলেই যখন, পকেটে ভরে কয়েকটা নিয়ে এলে না কেন?
পারলে কি আর আনতাম না নাকি? আরেকটা হুইস্কি আনতে বলো। গল্পটা শোনাচ্ছি। তাহলেই বুঝতে পারবে।
হুইস্কি আনার অর্ডার দিলো ওমর। সিগারেট কেস বের করে টেবিলের ওপর রাখলো। ডালা তুলে বেছে নিয়ে ঠোঁটে লাগালো একটা। লাইটার দিয়ে ধরালো। মুখ তুলে তাকালো ডজের দিকে। শুরু করো। অনেক দিন ভালো গল্প শুনিনি।
বিশ্বাসই যদি না করো, অহেতুক বকবক করে সময় নষ্ট করতে চাই না আমি। গম্ভীর হয়ে গেল ডজ।
না শুনলে বুঝবো কি করে? সত্যিই বলবে তো, নাকি বানিয়ে বানিয়ে? তোমার তো আবার কল্পনার দৌড় একটু বেশি।
একটা শব্দও বাড়িয়ে বলবো না। যা সত্যি, শুধু তা-ই।
নীরব একটা মুহূর্ত ডজের দিকে তাকিয়ে রইলো ওমর। বেশ, বলো। বিশ্বাস করবো।
হ্যাঁ, শুরু করুন, কৌতূহলী হয়ে উঠেছে কিশোর।
একটা কথাও বাড়িয়ে বলবো না আমি, আবার বললো ডজ। গেলাসে লম্বা একটা চুমুক দিলো। যে লোকের কাছে শুনেছো, আমি দক্ষিণের দ্বীপে আছি, সে ঠিকই বলেছে। তবে আরামে ছিলাম, একথা ঠিক নয়। ওরকম জায়গায় আরামে থাকা যায় না। সভ্যতার ছিটেফোঁটা আছে কিনা ওখানে সন্দেহ। যা-ই হোক, গিয়ে তো উঠলাম। বসে থাকতে ভালো লাগে না। কিছু একটা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মনের মতো কাজ পেলাম না। আমি হলাম গিয়ে বৈমানিক, প্লেন চালানো আর বোমা ফেলা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। ওখানে ওরকম লোকের দরকার হয় না কারো। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কি করি, কি করি! পকেটের টাকাও প্রায় শেষ। কোথাও যেতে হলে ভাড়ার টাকা লাগে। শেষে তাহিতির পাপিতি দ্বীপে যাওয়ার জন্যে জাহাজের একটা তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কাটলাম। মোটামুটি বাস করার মতো একটা জায়গা ওটা।
গিয়েছি আমরা, মুসা বললো।
তার দিকে তাকালো ডজ। গিয়েছে, না? তাহলে তো জানোই। সব রকমের লোক আছে ওখানে। সৎ লোক যেমন আছে, তেমনি আছে অসৎ লোক। ভদ্রলোক আছে, আছে অভদ্রলোক। ব্যবসায়ী, চোর-ডাকাত, শাদা, কালো, বাদামী, হলুদ, যতো রকমের মানুষ আছে দুনিয়ায়, সব রকমের পাওয়া যাবে ওখানে। সমস্ত দুনিয়ায় ঘুরেফিরে আর কোথাও ঠাঁই না পেয়ে গিয়ে যেন ওঠে ওই তাহিতির বন্দরে। একটা ব্যাপারে সবার মিল রয়েছে, সকলেই পোড় খাওয়া লোক। সাধারণ কেউ গিয়ে বাঁচতে পারবে না ওখানে। আমার যা মনে হয়েছে, বেশির ভাগই ভালো। তবে যেগুলো শয়তান, মহা শয়তান। একেবারে খাটাশ। থেমে দম নিলো ডজ। বার কয়েক চুমুক দিলো গেলাসে।
আবার বলতে লাগলো, সব কিছু মিলিয়ে, চমৎকার একটা জায়গা তাহিতি, আমার তা-ই মনে হয়েছে।
আমারও, মুসা বললো।
বাহ্, স্বভাব চরিত্রে মিলে যাচ্ছে দেখি! হাত বাড়িয়ে দিলো ডজ। হাত মেলাও। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তোমরা যখন গিয়েছে, নিশ্চয় সব জানো…
আমি যাইনি, ওমর বললো। যা বলার বলো।
এককালে সোসাইটি অ্যাইল্যান্ড বলা হতো দ্বীপটাকে। তখন ফ্রান্সের দখলে ছিলো ওটা। চীনারা থেকেছে বহুদিন। জাপানীরা দ্বীপটা নিয়ে বহু গুতোগুতি করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। চীনারা এখনও আছে। মায়া কাটাতে পারে না। দেখার মতো একটা বন্দর। জাহাজ আসছে যাচ্ছে। পোড় খাওয়া সব মানুষ, দ্বীপের প্রধান রপ্তানী দ্রব্য নারকেলের ছোবড়ার মতো শুকনো, রোদে পোড়া। রপ্তানী দ্য আরও আছে। নানা রকমের ঝিনুক এবং মুক্তো। আশপাশের দ্বীপে যতো মুক্তো তোলা হয়, সব নিয়ে আসা হয় পাপিতিতে, বিক্রির জন্যে। ব্যাপারিরা কিনে চালান করে দেয় প্যারিসে কিংবা অন্য কোনো বড় শহরে। সেখানে মুক্তার চাহিদা রয়েছে। যা-ই হোক, ভূগোলের জ্ঞান অনেকই দিলাম। এবার আসল কথায় আসি।
জাহাজে তো উঠলাম। ভেসে চললাম এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে। একদিন গিয়ে পৌঁছলাম পাপিতিতে। গিয়েই কাজ পেয়ে গেলাম। আমার মনের মতোই বলতে হবে। অবশ্যই জাহাজের চাকরি। দ্বীপ থেকে দ্বীপে যাই। কয়েক দিনের বেশি ভালো লাগলো না এই চাকরি। মালবাহী জাহাজ থেকে নেমে চাকরি নিলাম, এক ব্যবসায়ীর দোকানে। দোকানদারি করলাম কিছুদিন। ভালো লাগলো না। বসে রইলাম কয়েক দিন। আরও খারাপ লাগলো। কথা বলার লোকের অভাব হয় না ওখানে। যদি কেউ মানিয়ে নিতে পারে, আরামেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে ওরকম একটা দ্বীপে। দুই বেলা রুটি জোগাড়ের জন্যে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। দেখার জিনিসের অভাব নেই। তবু মাঝে মাঝে মনে হতো, ওই সবুজ দ্বীপ, রূপালী সৈকত, নীল লেগুন আর ঝলমলে মুক্তার চেয়ে অনেক ভালো আমাদের স্কটল্যান্ডের ধোঁয়াটে কুয়াশা ওঠা মেঘলা দিনগুলোও। পালিয়ে আসতে ইচ্ছে করতো। আসতে পারতাম, কিন্তু আসিনি। চেষ্টা করতে লাগলাম কিছু একটা করার। ওখানে অনেকে বড়লোক হয়েছে, আমি পারবো না কেন? টাকা নিয়ে স্কটল্যান্ডে ফিরতে পারলে বাকি জীবনটা আরামে কাটিয়ে দিতে পারবো। অনেক উপায় আছে টাকা রোজগারের, কিন্তু আমার হাতে ধরা দিতে চাইলো না। হাতে আসি আসি করেও আসে না, কেবলই ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।
কিভাবে? কৌতূহল বাড়ছে কিশোরের।
কিভাবে? সেসব গল্প বলতে গেলে কয়েক ঘণ্টায় কুলোবে না। অনেক সময় দরকার। তবে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। পমোটাস দ্বীপে একদিন এক দোকানে একটা ডাইভিং স্যুট নজরে পড়লো। জিনিসটা দোকানের মালিকের শখের জিনিস। বিক্রি করতে রাজি হলো না। তবে আমার চাপাচাপিতে ধার দিতে রাজি হলো এক শর্তে। যদি মুক্তো খুঁজে বের করতে পারি, তাহলে তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে দিতে হবে তাকে। ওটা নিয়ে চলে গেলাম আরেক পরিচিত লোকের কাছে। ঝরঝরে একটা বোট আছে তার। আরও একটা ভাগ দিতে হবে, এই কথা আদায় করে নিয়ে বোটটা নিয়ে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলো সে। স্যুট পেলাম, বোট পেলাম, আর ভাবনা কি? বেরিয়ে পড়লাম মুক্তো শিকারে। নিগ্রোরা ওখানে ভীষণ পরিশ্রম করে। গাধার মতো খাটতে পারে। আমিও ওদেরই মতো গাধা হয়ে থাকলাম পুরো একটা বছর। ডুবলাম ভাসলাম, ডুবলাম ভাসলাম, কতো হাজার বার যে ডুব দিয়েছি সাগরে, হিসেবই করতে পারবো না। বেশ কিছু মুক্তোও জোগাড় করলাম। ছোটখাটো একটা ব্যাগ ভর্তি। তিন ভাগের দুই ভাগ দিয়েও আমার যা থাকবে, যথেষ্ট। আর দরকার নেই। নিয়ে রওনা হলাম পাপিতিতে। পরের দিনই আঘাত হানলো সাইক্লোন। ওখানে ঝড়ের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যখন তখন চলে আসে। ভাঙা একটা কাঠ ধরে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছলাম মেরিয়েটা দ্বীপে, জান নিয়ে কোনোমতে ধুকতে ধুকতে। রোদে পুড়ে উঠে গেছে পিঠের চামড়া। নতুন চামড়া গজানোর জন্যে পড়ে থাকতে হলো হাসপাতালে। আর মুক্তোগুলো? যেখান থেকে তুলেছিলাম সেই সাগরের তলায়ই আবার ফিরে গেছে বোটটা সহ। আরেকবার একটা মালবাহী জাহাজে চাকরি নিয়ে চলেছি। একটা ক্যানুতে দেখলাম দুজন লোক, মারকুইস দ্বীপের লোক। মুক্তোর জন্যে ডুব দিচ্ছে। বড় বড় তিরিশটা ঝিনুক তুলে ফেলেছে, একটাও খোলা হয়নি। হাতে কাজকর্ম কিছুই নেই। ভাবলাম কিছু তো একটা করি। ঝিনুকগুলোর জন্যে দুটো পূরনো পাইপ আর এক কৌটো তামাক দিতে চাইলাম। লাফিয়ে উঠলো ওরা। লুফে নিলো প্রস্তাবটা। কারণ তিরিশটা কেন, তিরিশ হাজার ঝিনুক খুলেও অনেক সময় একটা মুক্তো পাওয়া যায় না। তবে ঝিনুকেরও দাম আছে, সেটা অন্য ভাবে। বীজ হিসেবে। টন টন ঝিনুক কিনে নিয়ে গিয়ে সাগরের বিশেষ জায়গায় ফেলে, যারা মুক্তোর চাষ করে। ওসব ঝিনুকের অনেক দাম। তবে এমনিতে তিরিশটা ঝিনুকের কোনো দামই নেই ব্যাপারটা আমার পাগলামি হিসেবেই ধরে নিলো ওরা। কিন্তু আমি তখন কাজ খুজছি, হাত চালানোর মতো যে কোনো কাজ। ডেকে বসে খুলতে শুরু করলাম ঝিনুকগুলো। একটা কথা বলে নিই। কিশোর আর মুসার দিকে ফিরে বললো, তোমাদেরকে বলছি না। তোমরা নিশ্চয় জাননা। ওমরকে বললো, এমনিতে সাধারণত যেসব ঝিনুক দেখা যায়, দক্ষিণ সাগরের ওসব মুক্তোওয়ালা ঝিনুক সেরকম নয়। অনেক বড়। কয়েক পাউন্ড ওজন। অনেক সময় নিয়ে খুললাম প্রথমটা কিছু নেই। দ্বিতীয়টা খুললাম। ওটাতেও কিছু পেলাম না। এক এক করে উনত্রিশটা ঝিনুক খুলে ছড়িয়ে ফেললাম ডেকের ওপরে। আমার ভাগ্যে কিছুই মিললো না। আর একটা মাত্র ঝিনুক বাকি। ওতে কিছু পাওয়ার আশা করলাম না। সবগুলোর চেয়ে ছোট ওটা। খাবার সময় লোকে কি করে? প্রথমে বড়টা বেছে নেয়, সে যা-ই হোক। মিষ্টি হোক, মাছ হোক, যেটাই হোক, প্লেটের বড়টার দিকেই ঝোঁক মানুষের। আমিও তা-ই করেছিলাম। প্রথমে বড়টা বেছে নিয়ে খুলেছিলাম, তারপর ওটার চেয়ে ছোটটা। এভাবে খুলতে খুলতে বাকি রয়ে গিয়েছিলো সব চেয়ে ছোটটা। বেশ অবহেলা নিয়েই ফাঁক করলাম ওটা। ভেতরে আঙুল ঢোকালাম। নরম মাংসের মধ্যে শক্ত কি যেন লাগলো। বের করে আনলাম। মুক্তোই! থ্রাশ পাখির ডিমের সমান বড়। এমন মুক্তো জীবনে দেখিনি। ডেকের ওপর পড়ে রইলো। ঝিনুক থেকে বের করার পর ভেজা মুক্তোর রঙই অন্যরকম লাগে। আগুনের মতো জ্বলে। প্যারিসে নিয়ে গেলে ওই একটার দামই বিশ হাজার ডলারের কম হবে না। বেশিও হতে পারে। এর আগে আমিও এতো বড় আর সুন্দর মুক্তো দেখিনি। বোকা হয়ে গেলাম যেন। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক ওই সময় জোরে বাতাস লাগলো, ঢেউয়ে কাত হয়ে গেল জাহাজ। ডেকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল মুক্তোটা। চিৎকার করে উঠে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম, থাবা দিয়ে তুলে নিতে চাইলাম ওটাকে। ধরতে পারলাম না। চোখের সামনে গড়িয়ে গিয়ে সাগরে পড়ে গেল। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো ঝিলিক দিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেল নীল সাগরে। আরেকবার চিৎকার করে উঠেছিলাম, যেন ওটাকে ফেরানোর জন্যেই। কিন্তু কথা শুনলো না মুক্তোটা। চলে গেল। মুক্তো সম্পর্কে অনেক গুজব রয়েছে। অনেক কিংবদন্তী। দ্বীপের লোকেরা বলে, অনেকের ভাগ্যে মুক্তো সয় না। তাকে দেখা দিয়ে আবার ফিরে যায় সাগরে অনেকের আবার দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে। আমার ভাগ্যে যে কোনটা ঘটলো, বুঝতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলাম। কতো মুক্তোই হাতে এসেছে, একটাও বিক্রি করতে পারিনি। যা-ই হোক, আসল গল্পটা এবার বলি।
বছর দেড়েক আগে, টাকাপয়সা নেই আমার হাতে। শেষে এক জাহাজে চাকরি নিলাম। মালিক করসিকার লোক, ভীষণ পাজি। নাম গুডু কারনেস। অনেক বদনাম আছে লোকটার। তার শয়তানী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি। চিনতে দেরি হয়নি। ওসব দ্বীপে তো চিনতে সময় লাগে না। সবাই খোলামেলা। বুঝেও কিছু করতে পারলাম না। চাকরিটা না নিয়ে উপায় ছিলো না আমার। আর কোনো কাজ পাচ্ছিলাম না। মারকুইসাস হয়ে পমোটাস ঘুরে এসেছে সবে তার জাহাজ। জাহাজটারও অদ্ভুত নাম রেখেছে। দুনিয়ার ভয়ংকরতম হাঙরের নামে নাম, হোয়াইট শার্ক; যতোটা নোংরা করা সম্ভব করে রেখেছে। তেলাপোকা আর ছারপোকায় বোঝাই। নারকেলের ছোবড়ায় একরকম পোকা হয়, সাংঘাতিক যন্ত্রণা দেয়, সেই পোকারও অভাব নেই। আর তেলাপোকাও যা একেকখান। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ওসব তেলাপোকার কথা আরেকদিন বলবো তোমাকে। রাতে ঢেকেঢুকে না ঘুমালে ঘুমের মধ্যেই পায়ের তলার চামড়া খেয়ে সাফ করে দেবে, টেরও পাবে না। সকালে উঠে যখন আর দাঁড়াতে পারবে না তখন বুঝবে মজা। হারামীর একশেষ। ওই জাহাজে করেই রওনা হয়ে পড়লাম একদিন পাপিতি বন্দর থেকে। লম্বা একটা পাড়ি জমাবে গুডু কারনেস। ছয় মাস, এমনকি নয়মাসও লেগে যেতে পারে।
যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম তার চেয়েও খারাপ কারনেস। আস্ত শয়তান। ভীষণ মুখ খারাপ। আমি বাদে আরও আটজন নাবিক তার জাহাজে। স্থানীয় লোক। ওগুলোও মহা বদমাশ। বোধহয়, একারণেই ওদেরকে বাছাই করেছে সে। সাধারণত স্থানীয় মানুষেরা ভালো হয়, তাহিতি, মারকুইস, পমেটোর লোকেরা। কিন্তু কারনেসের লোকগুলোর বাড়ি ওসব অঞ্চলে হলেও বেজায় খারাপ। পরে শুনেছি, মানুষের মাংস খাওয়ার অপরাধে অস্ট্রেলিয়ায় জেল খাটতে হয়েছে ওদের। তাতে আর অবাক হইনি তখন। ততোদিনে জেনে গেছি, কপালে দুঃখ আছে আমার। তবে কতোটা দুঃখ আছে তা যদি জানতাম, দ্বীপ থেকে নড়তামই না; যতোই না খেয়ে মরি। সাগরে বেরোনোর পর জানতে পারলাম কারনেসের জাহাজে কি আছে। স্থানীয়দের কাছে স্পিরিট বিক্রি করা ওখানে বেআইনী। ওসব খেলে কতোটা ক্ষতি হয়, ভালো করেই জানে স্থানীয়রা। তার পরেও খায়। আর সাপ্লাই দেয়ার লোকেরও অভাব নেই। নানারকম কায়দা করে চালান দেয়া হয় ওগুলোকে। এই যেমন সেন্টের শিশিতে ভরে, কিংবা তেলের বোতলে ভরে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না আমার। কারনেসের সঙ্গে কথা বললাম। স্বীকার করলো সে, আছে। নিজেও প্রচুর গিলে সে। অন্য ব্যবসায়ীদের মতো সেন্টের কিংবা তেলের বোতলেও ভরেনি সে, এতোই বেপরোয়া। সরাসরি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়, কেয়ারই করে না আইনের। ওর ওসব ব্যবসায় আমি জড়াতে চাই না, সাফ বলে দিলাম। তর্কাতর্কি হলো, ঝগড়া হলো। শেষমেষ বোকার মতো হুমকি দিয়ে বসলাম আমি ওকে। পুলিশকে বলে দেব। বলার সময়ও বুঝিনি, আমাকে পুলিশের কাছে পৌঁছতেই দেবে না সে।
যাই হোক, আমি আমার মতো আছি। আর কারনেস তার সলোমন আইল্যান্ডের গলাকাটা ডাকাতগুলোকে নিয়ে সারাদিনই মদে চুর হয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করতে পারো, ওই অবস্থায় জাহাজ চলছিলো কি করে? চলছিলো। তার কারণ কারনেসের লোকগুলো সব পাকা নাবিক। ওসব অঞ্চলের সব লোকই ভালো নাবিক। সমুদ্র সম্পর্কে অসীম জ্ঞান। ছোট একটা ক্যানুতে করেও বিশাল সাগর পারি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। কম্পাস-টম্পাস বাদেই দুহাজার মাইল দূরের অন্য কোনো দ্বীপে চলে যেতে পারে, একটুও ভুল করে না। বিশ্বাস করো, এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। প্রথমে আমরা গেলাম পমোটোসে। ঠিক দ্বীপ বলা যায় না। ওটাকে, একসারি প্রবালের দেয়াল বলাই ভালো। পানি থেকে বেশি উঁচু নয়। তাই অনেকে এর নাম দিয়েছে লো আরচিপেলাজো। স্থানীয়রা নাম দিয়েছে বিপদের দ্বীপ, এটাই মানিয়েছে ভালো। ওখানকার সাগরে জাহাজ চালানো যতোটা কঠিন, পৃথিবীর আর কোনো সাগরেই ততটা নয়। মারকুইসাসের দিকে চললাম আমরা। ওটা হলো পমোটোস থেকে একেবারে ভিন্ন জাতের। আগ্নেয় শিলায় বোঝাই, আর রয়েছে ঘন জঙ্গল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মস্ত কোনো মহাদেশ ছিলো একসময় ওই জায়গাটায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সাগরের নিচে চলে গেছে। উঁচু পার্বত্য অঞ্চলগুলো ডোবেনি, বেরিয়ে রয়েছে এখনও পানির ওপরে। দেখে অবশ্য সেরকমই মনে হয়। হাজার হাজার ফুট উঁচু বড় বড় পাহাড় যেন তালগোল পাকিয়ে রয়েছে। পাহাড়ের এরকম চেহারা আর কোথাও দেখা যায় না। কোনো কোনোটা তো বিশাল। হ্যাঁ, যা বলছিলাম।
দুটো দ্বীপপুঞ্জকেই ম্যাপে দেখে মনে হবে খুব বুঝি কাছে। আসলেই কাছে, অবশ্যই দক্ষিণ সাগরের বেলায়। ওখানে পাঁচশো মাইল কিছুই না। এখানে আমেরিকায় এই দূরত্ব অনেক বেশি। ওখানে শত মাইলের হিসেবটাকে কিছুই মনে করা হয় না। বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ নিয়ে হয়তো বেরিয়ে পড়লে, চলছে তো চলছেই, ছহাজার সাত হাজার মাইল পেরিয়ে গেলে, এতো মাইলের মধ্যে ছোট একটা প্রবাল প্রাচীর দেখা না গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওখানে ওরকমই। মারকুইসাসের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। ভালো বাতাস পাওয়ার জন্যে সামান্য একটু বায়ে কেটে চালাচ্ছে নাবিকেরা। বোধহয় তাতেই, কিংবা বাতাসের কারণে সরে গেল জাহাজ। একটা দ্বীপ দেখতে পেলাম। নাবিকেরা তো বটেই, কারনেসের কাছেও দ্বীপটা নতুন। আগে কখনও দেখেনি। গ্যালাপাগো থেকে ল্যাডরোনি পর্যন্ত এলাকা যাদের নখদর্পণে, তাদের নজরে ওই দ্বীপ পড়েনি! অবাকই হলাম। ওরা হলো না। প্রশান্ত মহাসাগরে দ্বীপের অভাব। নেই, কখন কোন একটা দ্বীপ নজর এড়িয়ে গেল, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই ওদের। যেহেতু অচেনা দ্বীপ, নোঙর করার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না কারনেস। দ্বীপটা নির্জন। ওখানে থেমে তার কোন লাভ হবে না। এইখানে এসেই আমার আসল গল্প শুরু, এবং এখানেই আমার প্রাণ প্রায় যেতে বসেছিলো।
কদিন ধরে একনাগাড়ে মদ গিলে চলেছে কারনেস। ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে জাহাজ চালানোে আমি শিখে গেছি ভালোমতোই। চালাচ্ছি। আর কোনো উপায়ও ছিলো না। জাহাজে তখন একমাত্র আমিই সুস্থ রয়েছি। বাকি সবগুলোর অবস্থা কাহিল। কোনখান দিয়ে চলেছি আমরা কিছুই বুঝতে পারবে না কারনেস, বাইরে না বোরোলে। আর বেরোনোর মতো অবস্থাও তখন নেই তার। দ্বীপটার কাছ ঘেঁষে গেলাম, পাঁচশো মাইল দূর দিয়ে গেলাম, কিছু জানবে না। না জানায় ভালোই হয়েছে আমার জন্যে, পরে বুঝতে পারবে। সাগর মোটামুটি শান্ত। তখন ঠিক দুপুর। প্রচন্ড গরম। দ্বীপটাকে কাছে থেকে দেখলাম। প্রবালে তৈরি, অ্যাটল বলে ওগুলোকে। পাশ দিয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে জাহাজ। মনে হয় জাহাজটাই স্থির হয়ে আছে, দ্বীপটা ভেসে যাচ্ছে। চার্টে অবস্থান দেখে নিলাম। সেক্সট্যান্টটা রাখলাম হুইলের কাছে। কখন আবার উঠে এসে রীডিং দেখতে চায় কারনেস কে জানে। সব কিছু রেডি রাখলাম। কে বকা শুনতে যায় খামোকা। লংগি চিউড আর ল্যাটিচিউড দুটোই মনে রাখলাম। পরে লগবুকে লিখে নেবো। ওরকম বহুবার করেছি। কখনো ভুল হয়নি। ডেকেই ছায়ায় শুয়ে পড়লাম। বাতাসের অপেক্ষায় রয়েছি। ভালো বাতাস না হলে ঠিকমতো চলবে না জাহাজ। কেন, নিশ্চয় বুঝতে পারছে। হোয়াইট শার্ক স্কুনার জাতের জাহাজ। ইঞ্জিন থাকলেও পালের দরকার হয়। নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি। অলস ভাবনা। কারনেসের কথা, আমার কথা, আরও অনেক কথা। ডেকের কিনারে উপুড় হয়ে রয়েছি। হঠাৎ এমন একটা জিনিস চোখে পড়লো, ধক করে উঠলো বুক। আরেকটু হলেই বোধহয় কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে সাগরে পড়ে যেতো চোখ। সাগরের যেখানটায় সাংঘাতিক গভীর থাকার কথা, আচমকা যেন সেখানটা উঠে চলে এসেছে কোন জাদুমন্ত্রের বলে! জাহাজের, খোলের নিচেই একেবারে, পঁচিশ-তিরিশ ফুট গভীর হবে। আরেকটু উঠলেই ঘষা লাগবে জাহাজের তলায়। উঠে গিয়ে যে হুইল ঘোরাবো, সে কথাও মনে রইলো না। এতোই অবাক হয়েছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যেমন হঠাৎ উঠলো তেমনি হঠাৎ করেই নেমে গেল সাগরের তল। বিশ্বাস করলাম না। ভাবলাম, গরম আর রোদ এমন কিছু করেছে, যাতে চোখে ভুল দেখেছি। কিন্তু। ডেকের কিনারে বসে তাকিয়েই রইলাম। মনে হতে লাগলো আবার দেখতে পাবো। ঘটলোও তাই। অদ্ভুত কান্ড। মুহূর্তের জন্যে দেখা যায় তল, তারপরই মিলিয়ে যায়, আবার দেখা যায়, আবার গায়েব। গায়ে কাঁটা দিলো। ব্যাপারটা কি! হঠাৎই বুঝে ফেললাম। সাগরের তল উঠছে নামছে তা নয়। ঢেউ। অনেক চওড়া আর উঁচু ঢেউ। খুব ধীরে আসছে। সেজন্যেই জাহাজটা যে একবার উঠছে ঢেউয়ের মাথায়, একবার নামছে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। যখন ঢেউয়ের নিচে নামছে, তখন তল চোখে পড়ছে, ওপরে উঠলেই হারিয়ে যাচ্ছে আবার। আর উঁচু কতো জানো একেকটা ঢেউ? চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট। নিচে কিন্তু বালির চড়া নয়, প্রবাল। ঘাবড়ে গেলাম। ভীষণ ধারালো। কোনোমতে যদি একটা ঘষা লাগে জাহাজের তলায়, তরমুজের মতো চিরে ফেলবে। আর আছড়ে পড়লে গুড়িয়ে যাবে ডিমের খোসার মতো। এখানে জাহাজ সামলানো আমার কর্ম নয়। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম।
ছুটে এলো কারনেস আর তার দলবল। যতোটা মাতাল ভেবেছিলাম ওদেরকে ততোটা হয়নি। চেঁচিয়ে শুধু বলতে পারলাম, জাহাজ সামলাও! কি হয়েছে জানতে চাইলো কারনেস। ডেকের কিনারে এসে দেখতে বললাম। এলো ওরা। পাথর হয়ে গেল যেন আমারই মতো। ওদের মতো মানুষও অবাক হয়েছে বুঝতে পারলাম। আর আমার তো কথাই নেই। তাকিয়ে রয়েছি নিচের দিকে। কি দৃশ্য, বলে বোঝাতে পারবো না। লাল, নীল, সবুজ, আরও কতো রঙ প্রবালের না দেখলে বুঝবে না। যেন এক অপরূপ বাগান তৈরি হয়ে আছে সাগরের তলায়। প্রবাল দেখে অবাক হইনি, ওরকম অনেক দেখেছি দক্ষিণ সাগরে। অন্য জিনিস দেখে হয়েছি। ঝিনুক। হাজারে হাজারে, বাসনের সমান বড় একেকটা। একেকজোড়া করে গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে। ভালো করে তাকাতে বুঝলাম ব্যাপারটা কি। খুলে রয়েছে ঝিনুকগুলো, খোসাগুলো ফাঁক করে চিত হয়ে আছে। খাওয়ার জন্যে ওরকম করে খুলে যায় ওরা। খুব ভালো করেই জানি ওরকম ঝিনুকের ভেতরেই মুক্তো থাকে। সাগরের তলায় তিল ধারণের জায়গা নেই, শুধু ঝিনুক আর ঝিনুক, খুলে রয়েছে। খোলা জায়গায়, প্রবালের খাঁজে, যেখানেই ঠাই, পেয়েছে শুধু ঝিনুক আর ঝিনুক, সোয়ালো পাখির বাসার মতো আঁকড়ে রয়েছে যেন প্রবালের গা। কতো লক্ষ-কোটি ডলারের সম্পদ পড়ে রয়েছে ওখানে কল্পনা করে পা কাঁপতে লাগলো আমার, দুর্বল হয়ে এলো, যেন দেহের ভার রাখতে পারবে না। মনে হতে লাগলো এরকম দৃশ্য শুধু স্বল্লেই দেখা সম্ভব। এতো কিছুর মধ্যেও কি এক অদ্ভুত উপায়ে যেন সজাগ হয়ে গেল আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। অকারণেই ঝট করে ফিরে তাকালাম কারনেসের দিকে। একেবারে সময় মতো। তাকিয়ে ভালো করেছিলাম। তার চোখে এক ধরনের বন্য দৃষ্টি, কলজে ঠান্ডা করে দেয়। ওরকম আর কখনো কোনো মানুষের চোখে দেখতে চাই না আমি। হাত চলে গেছে পকেটে। ওখানেই তার পিস্তলটা থাকে, জানি আমি। চেহারাটা কুৎসিত হয়ে উঠেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, খুব বেশি নেই এখানে, কি বলো? আমাদের দুজনের নেয়ার মতো হবে না। লাফিয়ে সরে গেলাম। আর একটা মুহূর্ত দেরি হলেই গুলি খেতে হতো। অল্পের জন্যে মিস হয়ে গেল বুলেট।
তখন আমার অবস্থা কল্পনা করতে পারছো? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে রয়েছি। কারনেসের হাতে পিস্তল, খুনের নেশা চেপেছে তার মাথায় আমার কাছে অন্ত্র বলতে কিছুই নেই। ছুরি বের করে ফেলেছে তার সাগরেদরা। পালানোর পথ নেই। লুকানোর জায়গা নেই। সারা জাহাজে এমন একটা জায়গা নেই যেখানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে রেহাই পাবো। ঝাঁঝরা করে দেয়া হবে আমার শরীর। বুঝতে পারলাম, আমার দিন শেষ। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়লো, মুক্তোর খেত দেখেছে বটে কারনেস, কিন্তু সেটার অবস্থান জানা নেই তার। আমরা কোথায় রয়েছি, জানে না। জানি শুধু একমাত্র আমি। লগবুকে লিখিনি। তবে সেক্সট্যান্টটা দেখলে জেনে যাবে কারনেস। পরে এসে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে। আমি যদি মরি, তাকেও পেতে দেবো না ওই মুক্তো। সেক্সট্যান্টের রীডিং ছাড়া কিছুতেই বের করতে পারবে না কারনেস; আমরা কোথায় রয়েছি। এমনিতেও মরেছি, ওমনিতেও। গুলির পরোয়া আর করলাম না। মরিয়া হয়ে দিলাম ছুট। গুলি করলো কারনেস। তাড়াহুড়োয় আবার মিস করলো। পৌঁছে গেলাম হুইলের কাছে। থাবা দিয়ে তুলে নিলাম সেক্সট্যান্টটা। সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম আনন্দে। আবার গুলি করলো কারনেস। কিন্তু ওর গুলিতে আমার মরণ লেখা নেই। ঈশ্বরের দয়া। ঠিক এই মুহূর্তে জোরে এক ঢেউ এসে বাড়ি মারলো জাহাজের গায়ে। ভীষণ দুলে উঠলো জাহাজ। পড়ে গেলাম আমি। কারনেসও পড়লো। কিন্তু তার সাগরেদরা বহাল তবিয়তেই রইলো। ছুরি নিয়ে তেড়ে এলো আমাকে খুন করার জন্যে। মোরব্বা হওয়ার চেয়ে সাগরে ঝাপিয়ে পড়ে মৃত্যু অনেক ভালো মনে হলো আমার। দ্বিধা করলাম না আর। ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম পানিতে। প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগলাম। প্রাণের ভয়ে সাঁতরাচ্ছি। উঠতে উঠতে দেরি করে ফেললো কারনেস। ততক্ষণে আমি দূরে চলে গেলাম। গুলির রেঞ্জের বাইরে যেতে পারিনি। কিন্তু অতো দূর থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে ঢেউয়ের মাঝে একটা মানুষের গায়ে লাগানো আর সম্ভব ছিলো না। তবু গুলির পর গুলি করতে লাগলো সে। আমার আশেপাশে এসে পড়লো কয়েকটা। গায়ে লাগলো না।
কিছুতেই আমাকে পালাতে দিতে রাজি নয় কারনেস। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, পাল ঠিক করছে সাগরেদরা। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে আমাকে ধাওয়া করলো। জানি, পালাতে পারবো না। ধরা আমাকে পড়তেই হবে। সাগরের মাঝে কোথায় যাবো? বাতাসও বইতে শুরু করেছে। খানিক আগে যেরকম শান্ত ছিলো সেরকম নয়। দুবার আমার পাশে চলে এলো জাহাজ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ডুব মারলাম। এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকলো কারনেস। লাগাতে পারলো না। বাতাসের বেগ বাড়লো। ভীষণ গড়াতে লাগলো জাহাজ। এই অবস্থায় রেলিঙের কিনারে দাঁড়িয়ে গুলি করা খুব কঠিন। বাতাস আরেকটু বাড়তে গুলি করা বাদ দিয়ে জাহাজ সামলাতেই ব্যস্ত হতে হলো ওকে। নইলে যাবে কাত হয়ে ডুবে কিংবা প্রবালে বাড়ি খেয়ে ছাতু হবে। ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে সরে যেতে লাগলো স্কুনারটা। আমি বাঁচবো না, জানি। তবে শান্তিতে মরতে পারবো, এই যা। সেটাও আর তেমন সুখকর কল্পনা মনে হলো না কয়েক মিনিট পরে। কিন্তু মরা ছাড়া আর করবোটাই বা কি? কল্পনা করতে পারছো? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে। ডাঙা নেই। হাঙরের ঝাঁক। তার ওপর প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস। সাংঘাতিক না?
হ্যাঁ, মারাত্মক, স্বীকার করলো ওমর।
একেবারে ঠিক শব্দটা বলেছো। মারাত্মক। অনেকক্ষণ বলে বলে গলা শুকিয়ে এসেছে ডজের! চুমুক দিতে লাগলো গেলাসে। দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো, একটা খড়ও নেই যে ধরে ভাসবো। জাহাজডুবি হলে অনেকেই অনেক কিছু পায়, ধরতে পারে, আমার নেই। তবে চিত হয়ে থাকলে অনেকক্ষণ ভেসে থাকা যায়। যদি হাঙরে না ধরে। পানি গরম। চিত হয়ে ভেসে রইলাম। খুব আস্তে পা দিয়ে লাথি মারছি পানিতে, ভেসে থাকার জন্যে। বেশি জোরে নাড়াতে সাহস পাচ্ছি না, যদি হাঙরের নজরে পড়ে যায়। কাপড় খুলে ফেলে দিলাম, বোঝা কমানোর জন্যে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম কখন ভেসে ওঠে হাওরের পিঠের পাখনা। শাই শাই করে ছুটে আসে পানি কেটে। দুএকটা এলো কাছাকাছি, তবে কোনোটাই মানুষখেকো নয়, কামড়াতে এলো না আমাকে। দিগন্তে হারিয়ে গেল জাহাজটা। আমার চারপাশে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। আমি জানি, মরবো, তবু ইচ্ছে করে তো আর ডুবে যেতে পারি না। ভেসেই রইলাম। রাত হলো। বাতাস পড়ে গেল। শান্ত হতে লাগলো সাগর। ভেসেই রয়েছি তখনও। মনে হতে লাগলো, কেন ভেসে থাকছি? যন্ত্রণা আরও দীর্ঘ হচ্ছে! মরে গেলেই তো হয়! কিন্তু একেবারে নিরাশার মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। টিকে থাকতে চায়। আমারও হয়েছিল সেই অবস্থা। মরা দরকার, মরলেই ভালো হয়, কিন্তু মরতে আর পারছি না। কেউ যে আমাকে তুলে নেবে, তারও কোনো-আশা নেই। কয়েক হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে তখন কোনো জাহাজ আছে কিনা, কারনেসের স্কুনারটা ছাড়া, সন্দেহ। আর থাকলেই বা কি? জানতে পারছে না আমি রয়েছি ওখানে। বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো জাহাজ এসে আমাকে উদ্ধার করার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার কপাল ভালো, বাঁচবো, তাই এমন একটা স্রোতে পড়ে গেলাম, যেটা আমাকে টেনে নিয়ে চললো। কোথায় যাবো, জানতাম না। উত্তর মেরুর দিকে, না দক্ষিণ আমেরিকার দিকে। যেদিকেই যাই, বাঁচবো না এটা ঠিক, ধরেই নিয়েছিলাম। সকাল বেলা দেখতে পেলাম ওটাকে। কাছেই। খুব নিচু, পানির সমতল থেকে সামান্য উঁচুতে। দ্বীপটা দেখলাম না, চোখে পড়লো শুধু নারকেল গাছের মাথা। মনে হলো, পানি থেকে গজিয়ে উঠেছে। আশা হলো মনে। সাঁতরাতে শুরু করলাম সেদিকে। ভালো করেই জানি, শুধু পানিতে নারকেল গাছ জন্মাতে পারে না। ডাঙা আছেই। আজব একটা ব্যাপার ঘটলো আমার মধ্যে, বাঁচার সম্ভাবনা দেখা দিতেই। যতোক্ষণ জেনেছি, মৃত্যু নিশ্চিত, ভয়-ডর-আশঙ্কা কোনো কিছু ছিলো না। যেই বাঁচার আশা দেখলাম অমনি সেসব এসে চেপে ধরলো। সেই সঙ্গে উদ্বেগ আর উত্তেজনা। মনে হতে লাগলো গাছগুলোর কাছে। পৌঁছার আগেই হাঙরে ধরে খেয়ে ফেলবে, কিংবা ডুবে যাবো সাঁতরাতে না পেরে।
কাছে পৌঁছে গেলাম। এটা সেই দ্বীপ, জাহাজ থেকে যেটা দেখেছিলাম। আরেকটু হলেই তীরে গিয়ে তরী ডুবতে বসেছিলো আমার। ভীষণ ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো তীরে। চুবিয়ে মারার জোগাড় করেছিলো। সেই দশটা মিনিট জীবনে ভুলতে পারবো না আমি। প্রতিটা অ্যাটল ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রবালের দেয়াল, তার ভেতরে লেগুনের শান্ত পানি। কিন্তু সেখানে যাওয়া সহজ নয়। কোন দিক দিয়ে মুখ বুঝতে পারলাম না। কিছু লেগুন আছে প্রশান্ত মহাসাগরে যেগুলোতে ঢোকার কোনো মুখই থাকে না সাগরের দিক থেকে। তার বাইরের দেয়ালগুলোতে যে কি ভয়ানক বেগে ঢেউ আছড়ে পড়ে না দেখলে বুঝবে না। প্রচন্ড কোনো শক্তি পাহাড়ের মতো অনড় কোনো কিছুকে নড়াতে চাইলে যে কান্ডটা ঘটবে, অনেকটা সেরকম ব্যাপার, আর কোনো ভাবে বোঝাতে পারছি না। হাজার হাজার টন পানির বোঝা নিয়ে একেকটা ঢেউ গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে। দেখে মনে। হবে এমন শক্ত কোনো জিনিস নেই যা ঠেকাতে পারে ওই ঢেউকে। কিন্তু আটকে ফেলছে প্রবালের দেয়াল। ঢেউয়ের গোড়ায় ধরে টান মেরে যেন ছিনিয়ে নিচ্ছে ওটার ভিত। পুরো একটা মিনিট শূন্যে ঝুলে থাকছে পানির পর্বত, তারপর হাজারো বজ্রের মিলিত শব্দকে এক করে ধসে পড়ছে হড়মুড় করে। টগবগ করে যেন ফুটছে ওখানে সাগর, শাদা ফেনা তৈরি করছে, লম্বা একটা শাদা রেখা সৃষ্টি করছে সেসব ফেনা, যেন ফেনার স্থূপকে টেনে লম্বা করে দিচ্ছে অদৃশ্য কোনো হাত। সরে যেতে চাইছে পরাজিত ঢেউয়ের সঙ্গে, কিন্তু দেয়ালের মায়া কাটাতে না পেরে রয়ে যাচ্ছে পরের ঢেউটা আসার অপেক্ষায়। চলছে এভাবেই। বছরের পর বছর, একটানা। থামাথামি নেই। মাঝে মাঝে যেন খেপে গিয়ে সমস্ত রাগ প্রবালের ওপর ঢেলে দেয় সাগর, ঝাল মেটাতে চায়। সেটা হারিকেনের সময়। ওই সময় কোনো নৌকা কিংবা মানুষ ঢেউ আর দেয়ালের মাঝখানে পড়লে ভর্তা হয়ে যাবে। যাই হোক, আমি যখন পৌঁছলাম তখন হারিকেন ছিলো না। সাঁতরাতে থাকলাম দেয়ালের ধার দিয়ে। পেয়ে গেলাম একটা পথ। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ঢেউ এসে ধরে ফেললো আমাকে। ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেয়ালের ভেতরে, এক্কেবারে সময়মতো, কারণ তখন কয়েকটা হাঙর আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিলো আমার প্রতি। কয়েক মিনিট ধরেই আমার পিছে লেগেছিলো। ভেজা একটা কম্বলের দলার মতো গিয়ে নেতিয়ে পড়লাম সৈকতে।
লোক-টোক ছিলো দ্বীপে? তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো মুসা। উত্তেজনায় কাঁপছে তার কণ্ঠ। সাংঘাতিক আগ্রহ নিয়ে শুনছে ডজের গল্প।
না, জবাব দিলো ডজ। আগেই তো বলেছি নির্জন। রবিনসন ক্রুসো হয়ে গেলাম। একা, শুধু একা আমি, আর কেউ নেই। সে অন্তত একটা পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলো দ্বীপে, আমি তা-ও পেলাম না। সৈকতে পড়ে থাকতে দেখলাম। শুধু নানারকম ঝিনুক আর নারকেল। প্রথম ভাবনাটা হলো পানির জন্যে। যদি মিষ্টি পানি না থাকে? কিন্তু ঈশ্বর কাউকে বাঁচাতে চাইলে সব ব্যবস্থা করেই দেন। আমাকেও দিলেন। পানি আছে দ্বীপে। ওই নোনা পানির মাঝে কোথেকে যে এলো ওই মিষ্টি পানি, বলতে পারবো না। এই প্রশ্নের জবাব আমি কিছুতেই বের করতে পারিনি। পানি খেলাম। নারকেল খেলাম। বালিতে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করলাম শরীরে। তারপর উঠলাম দ্বীপটা ঘুরে দেখতে। কোন স্বর্গে উঠেছি জানার আগ্রহ হলো খুব। খুবই সুন্দর দ্বীপ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লেওনের দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না, এতোই সুন্দর। কিন্তু সৌন্দর্য দেখার অবস্থা তখন নেই আমার। একটা কথা এখন জোর গলায় বলতে পারি, রবিনসন ক্রুসোর গল্প পড়তে যতো ভালো লাগে, বাস্তবে তার মতো অবস্থায় পড়লে লাগে ঠিক উল্টোটা। যেমন খারাপ লাগে, তেমনি অসহায়। যতোই ভাবতে লাগলাম বাকি জীবনটা এখানেই একা কাটাতে হবে, ততোই চুপসে যেতে লাগলাম ভেতরে ভেতরে। ভাবো একবার, এতো টাকার মুক্তো পেলাম, জানি কোথায় আছে, তুলে নিতে পারলেই রাজার হালে কাটাতে পারি জীবনটা। তা না, হয়ে গেলাম রবিনসন ক্রুসো। আর কোনো জাহাজ না আসুক, মুক্তোর খোঁজে কারনেসের জাহাজ আসতে পারে, হয়তো বাড়ি ফেরার একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে, এই আশায় তাকিয়ে রইলাম সাগরের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেললাম, জাহাজ আর এলো না। আর দেখলাম না তার স্কুলারটাকে।
ওই দ্বীপে কতোদিন ছিলেন আপনি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
মাত্র তিন মাস। আরেকবার আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে হয়। রাটুনা থেকে দুজন মারকুইজান এসে ক্যানুতে করে নিয়ে যায় আমাকে। একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে। মেয়েটার মারকুইজান নামের ইংরেজি অর্থ করলে হয় সাগরের হাসি, আর ছেলেটার ঝিনুক। ওরকম নামই পছন্দ ওখানকার লোকের। কঠিন নাম নয়। সহজ। বেশির ভাগই সাগর কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে রাখে। মনে রাখা বোধহয় সহজ, সে-জন্যেই। মাছ ধরতে বেরিয়েছিলো দুজনে, অ্যালবিকোর মাছ। ছোট একটা ঝড়ে পড়ে, স্রোতের মুখে পড়ে যায়। ভেসে যায় দূর সাগরে। তাতে মোটেও উদ্বিগ্ন হয়নি ওরা। ওরকম হরহামেশাই ঘটে। সাগরে ভেসে যায়, আবার বাড়ি ফেরে। সাগরও ওদের কাছে ডাঙার মতোই। ডাঙায় যেরকম সহজ ভঙ্গিতে ঘটতে পারে, পানিতেও তেমনি সাঁতরাতে পারে। পানিকে একটুও ভয় করে না। ভাসতে ভাসতে এসে আমার দ্বীপটা চোখে পড়েছিলো ওদের। পানি আর নারকেলের জন্যে চলে এসেছিলো। পেয়ে গেল আমাকে। কি হাসাটাই না হাসলো আমাকে ওখানে দেখে, যেন এক মস্ত রসিকতা। ওদের কাছে ওরকম দ্বীপে থাকাটা তো কিছু না, সেজন্যে কিছুই মনে করলো না। তবে আমি খুশি হয়েছিলাম ওদেরকে দেখে, সাংঘাতিক খুশি। সাথে করে আমাকে রাটুনায় নিয়ে গেল ওরা।
তারপর ক্যানুতে করে এ দ্বীপ থেকে সে দ্বীপ, সে দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ করতে করতে দুমাস পরে গিয়ে নুকা-হিভায় পৌঁছুলাম। ওই অঞ্চলের সব চেয়ে বড় দ্বীপ ওটা। আরও তিন মাস অপেক্ষা করতে হলো আমাকে জাহাজের জন্যে। জর্জি গ্রিম এলো তার স্কুনার নিয়ে, তুলে নিলো আমাকে। তাহিতিতে পৌঁছে দিলো। জানতে পারলাম, কারনেস ফিরে এসেছিলো, তারপর আবার চলে গেছে। এসেই তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ায় আমি ভাবলাম, নিশ্চয় মুক্তোর সন্ধানে গিয়েছে সে। যাবেই। তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এতো টাকার সম্পদ দেখে এসে কোন্ মানুষটা আনতে যাবে না? সে গেলেও আমি চিন্তা করলাম না। আসল অবস্থান জানা নেই তার। কিছুতেই বের করতে পারবে না অতো বড় মহাসাগরের মাঝে। শুধু আমি জানি কোথায় আছে সেই ঝিনুকের খেত। আর গাধাটা আমাকে খুন করতে না চাইলে অবশ্যই জানিয়ে দিতাম ওকে।
মুক্তোগুলো তুলে আনার জন্যে ভাবনাচিন্তা শুরু করলাম। দ্বীপের এক জাহাজের মালিককে লোভ দেখানোর চেষ্টা করলাম। আমার সঙ্গে গেলে তাকে আধাআধি বখরা দেয়ার কথাও বললাম। রাজি হলো না। বিশ্বাসই করলো না আমার কথা। ওসব অঞ্চলে এরকম গল্প প্রায়ই এসে বলে নাবিকেরা, বেশির ভাগই মিথ্যে। তাই কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না। হেসেই উড়িয়ে দেয়। আর ওদেরই বা দোষ দেব কি। আমি নিজের চোখে না দেখলে কেউ এসে যদি ওই গল্প আমার কাছে বলতো, আমিও বিশ্বাস করতাম না। আমিও মুখের ওপর হাসতাম। যদিও এরকম খেত অনেক পাওয়া গেছে। মুক্তোও তুলে নিয়ে এসেছে কেউ না কেউ।
রাটুনায় থাকার সময় স্থানীয়রা আমাকে কয়েকটা ছোট মুক্তো উপহার দিয়েছিলো। অন্যান্য দ্বীপেও পেয়েছি কিছু। বিক্রি করে টাকাও পেয়েছি। কিন্তু এততাই সামান্য, তা দিয়ে বড় ধরনের একটা অভিযান চালানো সম্ভব নয়। অনেক খরচ। জাহাজ ভাড়া করতে হবে, ডুবুরির পোশাক লাগবে, আরও অনেক জিনিস। তাহিতিতে বেশিদিন থাকতে সাহস হলো না। কোন দিন ফিরে চলে আসে কারনেস, ঠিক নেই। মুখোমুখি হলে আমাদের একজনকে মরতেই হতো, খুনের দায়ে অ্যারেস্ট হতো আরেকজন। টাকা জোগাড়ের জন্যে চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেও একই অবস্থা। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। দুএকজন যা-ও বা করলো, এতো বেশি খবর জানতে চাইলো, বলাটা উচিত মনে করলাম না। ওরা একেবারে জায়গার ঠিকানাই চায়। বলে দিলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরাই যদি চলে যায় কিছুই করতে পারবো না। শেষে ভাবলাম, পৃথিবীতে এখন টাকার জায়গা বলতে আমেরিকা আর জাপান। জাপানীরা বেশি চালাক, ওদেরকে রাজি করাতে পারবো না। বাকি থাকলো আমেরিকা। চলে এলাম। মনে করলাম যদি কেউ ইনটারেস্টেড হয়…
তেমন কাউকে পেয়েছো? জানতে চাইলো ওমর।
না।
পাবে বলেও মনে হয় না। আসলে, কাউকে বিশ্বাসই করাতে পারবে না। আর কেউ যদি করেও, এতোবড় জুয়া খেলতে রাজি হবে না।
জুয়া! প্রায় চিৎকার করে উঠলো ডজ, জুয়া বলছে, কেন? সোজা আমি জায়গাটায় নিয়ে চলে যেতে পারি।
নোটবুক আর পেন্সিল বের করলো ওমর। তাহিতি থেকে তোমার দ্বীপটার দূরত্ব কতো? নাম কি?
কোনো নাম নেই। ম্যাপে বের করতে পারিনি। ওদিকের অনেক দ্বীপের নামই ম্যাপে নেই। নেভির চার্টে হয়তো থাকতে পারে।
হু। বেশ, তাহলে একটা নাম ঠিক করে ফেলা যাক। যাও, ওটার নাম রেখে দিলাম ডজ আইল্যাও। তাহিতি থেকে কদ্দূর?
আটশো মাইল মতো হবে।
লেগুনে জাহাজ ঢোকানো যাবে? নিরাপদ?
তা যাবে।
প্লেন তো নেয়া যাবে না। এক কাজ করা যেতে পারে। ফ্লাইং বোট। ল্যান্ড করা যাবে?
উড়ে যাওয়ার কথা ভাবছো নাকি?
কেন নয়?
গাল চুলকালো ডজ। না, তেমন অসুবিধে নেই। তবে একবারও কথাটা মনে আসেনি আমার। পকেটে টাকা না থাকলে বুদ্ধিও খোলে না। স্কুনারে করে যাওয়ার চেয়ে তাতে খরচ বেশি পড়বে।
কিন্তু যাওয়া যাবে তাড়াতাড়ি।
তা যাবে।
ফ্লাইং বোট থেকে পানিতে নামা যাবে? ডুব দিয়ে ঝিনুক তোলার জন্যে?
যাবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে। ওখানকার সাগর শান্তই থাকে দেখেছি।
ডাইভিঙের অভ্যাস তো নিশ্চয় করে ফেলেছো। এতোদিন ওখানে থেকে যখন মুক্তো তোলার কাজ করেছো।
ভালোমতো।
কি কি জিনিস লাগবে, জান তো? ভুলচুক করবে না?
নিশ্চয় জানি। করবো না।
তাহলে, ফ্লাইং বোটের ব্যবস্থা যদি করে দিই, আর সমস্ত খরচ-খরচা জোগাড় করে দিই, মুক্তোর বখরা দিতে রাজি আছো?
দেবো না মানে! নিশ্চয়ই দেবো! চেঁচিয়ে উঠলো ডজ। তুমি সব খরচ দেবে, আমি তুলে আনার ব্যবস্থা করবো। আধাআধি ভাগ হবে।
আধাআধিতে চলবে না। এতো টাকা আমি একলা দিতে পারবো না। কিশোরের সাহায্য লাগবে। কি কিশোর, তোমার চাচার কাছ থেকে কিছু জোগাড় করতে পারবে?
পারবো বলতে একটুও দ্বিধা করলো না কিশোর। চাচাকে চেনে সে। এরকম ঝুকি নেয়ার অভ্যাস আছে তার। অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন জীবনে। মেরিচাচীর বাধা না থাকলে এই অভিযানে শুধু টাকা দেয়াই নয়, তিনি নিজেও বেরিয়ে পড়তেন, জানে সে। তবে, তিন ভাগ করলে চলবে না। আমার সঙ্গে মুসা আর রবিনও যাচ্ছে। পাঁচ ভাগ করতে হবে। কি বলো, মুসা?
আমি অবশ্যই যাবো, মুসা জবাব দিলো। তবে মুফতে বখরা নিতে চাই না। বাবাকে বলে, আমিও কিছু টাকার বন্দোবস্ত করতে পারবো আশা করি, যদি মাকে না শোনাই।
ভেরি গুড, ওমর বললো। আর রবিন?
তার বাবাও যে কিছু দেবেন না, তা নয়, কিশোর বললো। তবে রবিন যেতে পারবে কিনা সেটাই কথা। আজকাল ও ভীষণ ব্যস্ত, গানের ব্যবসায়। মিস্টার বার্টলেট লজ ইদানীং তাকে বেতনের টাকা তো দেনই, কমিশনও দিতে আরম্ভ করেছেন। ফলে ইস্কুলের পড়ালেখা আর মিউজিক ছাড়া এখন আর কিছু বোঝে না রবিন।
হুঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। রবিনটা যে এভাবে বদলে যাবে, কল্পনাই করিনি কোনোদিন। তার কণ্ঠে দুঃখের সুরটা অপ্রকাশিত থাকলো না।
দেখা যাক, বলে। যেতে রাজি হলে ভালো। না হলে আমরা দুজনেই যাবো। এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার মিস করা যায় না। কি বলো?
তা তো বটেই। দক্ষিণ সাগরে গিয়ে আরেকবার শুঁয়োপোকা খেতে হলেও আপত্তি নেই আমার, তবু যাবো।
তার কথায় হাসলো ডজ। না, শুয়োপোকা আর খেতে হবে না, এটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি। তবে প্রচুর নারকেল খেতে হতে পারে।
নারকেল তো ভালো জিনিস। আমার মজাই লাগে।
তাহলে, কাজের কথায় এলো ডজ। কবে রওনা হচ্ছি আমরা?
জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেলেই। এখনই একটা চেক নিয়ে যেতে পারো। যা যা লাগবে লিস্ট করে নিয়ে কিনতে শুরু করে দাও। তবে খরচ যতোটা কম করা যায় সেই চেষ্টা করবে। ফ্লাইং বোটের ব্যবস্থা আমি করবো।
দুই ঢোকে গেলাসের বাকি পানীয়টুকু শেষ করে ফেললো ডজ। হাত বাড়ালো, দাও, চেক। এখুনি বেরিয়ে যাই। আর ভাবনা নেই। ওই মুক্তো এখন আমাদের!
একটা ঝুড়ি কিনতে ভুলো না যেন, হেসে মনে করিয়ে দিলো ওমর। তুমি বলেছিলে ঝুড়ি বোঝাই করে মুক্তো আনতে পারবে। তার কম হলে চলবে না আমাদের।
২
যদিও একটা দিনও নষ্ট করেনি ওরা, তারপরেও দক্ষিণ সাগরে ওদের প্রথম সাময়িক ঘাঁটিটাতে পৌঁছতেই এক মাস পার হয়ে গেল। অনেক কাজ করতে হয়েছে। বসে বসে প্ল্যান করেছে ওমর, এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে কিশোর। কারণ এই বুদ্ধিটুদ্ধিগুলো তার মাথায়ই ভালো খেলে। জিনিসপত্র কিনতে ডজকে সাহায্য করেছে মুসা। ডাইভিঙের ব্যাপারটা কিশোরের চেয়ে ভালো বোঝে সে। রবিন সত্যিই আসতে পারেনি, পারলো না বলে অনেক দুঃখ করেছে। তবে রকি বীচে থাকতে অনেক সাহায্য করেছে সে, জিনিসপত্র জোগাড়ের কাজে। আরও নানারকম সাহায্য করেছে। হঠাৎ করে জরুরী কাজে বার্টলেট লজ ইউরোপে চলে না গেলে সে অবশ্যই বসে থাকতো না মিডজিকের ব্যবসা নিয়ে; আসতোই সঙ্গে।
ওমর আর কিশোরকে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে। যেমন প্রথমেই ভাবতে হয়েছে, দ্বীপে বিমান নামানোর ব্যাপারটা। কি করে নিয়ে যাবে? অনেক জটিলতা আছে। নিয়ে যাওয়ার জন্যে সরকারী অফিস থেকে অনুমতি জোগাড় করতে হয়। তবে সেটা সহজ কাজ। কঠিন কাজটা হলো বিমানটাকে জায়গামতো নিয়ে যাওয়া। আর কোন ধরনের বিমান নিয়ে গেলে সুবিধে হবে সেটাও বুঝতে হবে।
যেরকম জায়গা, বিমান নিয়ে যাওয়ার দুটো উপায় আছে। এক, জাহাজে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া। দুই, উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। সহজে যাওয়া আর খরচ কমাতে চাইলে জাহাজে তুলে নিয়ে যাওয়াটাই ভালো। আরেকটা বড় সমস্যা হলো, এসব কাজের জন্যে বিমান ভাড়া দিতে চায় না কেউ। কিনতে হবে। আধুনিক বিমানের অনেক দাম। কম দামে পুরনো আমলের জিনিস পাওয়া যায়। তবে কাজ চলার মতো মজবুত আর ভালো জিনিস পাওয়াটা সহজ নয়। তবু খুঁজতে শুরু করলো ওমর।
পেয়েও গেল বিমান বাহিনীর পুরনো বিমান ফেলে রাখার গুদামে। অনেক পুরনো আমলের একটা ফ্লাইং বোট, টুইন ইঞ্জিন। বেশি চলেনি। তবে পড়ে থেকে থেকে অনেক জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। তা নিয়ে ভাবে না ওমর। নিজেই সারিয়ে নিতে পারবে। একটু বেশি খাটতে হবে আরকি। লম্বা ডানাওয়ালা মনোপ্লেন ওটা। বড় ট্যাঙ্ক। একবার তেল ভরে নিলে অনেক দূর যাওয়া যায়।
দরাদরি করে বেশ শস্তায়ই জিনিসটা কিনে নিয়ে এলো ওমর। মেরামতের কাজ শুরু করে দিলো। তাকে এ-ব্যাপারেও সাহায্য করতে লাগলো কিশোর আর মুসা, খুশি হয়েই। বিমান সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হয়ে যাবে তাতে। কাজও চলতে লাগলো, সেই সঙ্গে আলোচনাও, কোথায় কিভাবে নিয়ে যাবে বিমানটাকে। ডজ পরামর্শ দিলো, জিনিসপত্র সব নিয়ে আগেই রওনা হয়ে যাবে সে। গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রাখবে। এতো পুরনো একটা ফ্লাইং বোট নিয়ে তাহিতিতে গেলে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হবেই। একটা হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। সেটা এড়ানো গেলেই ভালো। গোপন একটা মিশনে চলেছে ওরা, এতো মানুষের নজরে পড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তার চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার কোনো এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে যদি রারাটোঙ্গা দ্বীপে পেট্রোল আর তেল পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে খুব ভালো হয়। দ্বীপটা যেহেতু অস্ট্রেলিয়ার প্রধান জাহাজ-পথটাতেই পড়ে, তেল পাঠানোর অসুবিধে হবে না। তাই সরাসরি রারাটোঙ্গায় চলে যেতে চায় সে। সেখানে বিমানটার জন্যে খানিকটা তেল রেখে দেবে। বাকিটা জলপথে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে ভেইটিতে। কুক দ্বীপপুঞ্জের সব চেয়ে ছোট দ্বীপগুলোর একটা হলো ডেইটি। দ্বীপ ছোট হলে হবে কি, অনেক বড় একটা লেগুন আছে ওখানে। ফ্লাইং বোট নোঙর করিয়ে রাখার চমৎকার ব্যবস্থা হতে পারে ওই লেগুনে। বার বার তেল ভরা যাবে ওখানে রেখে। রারাটোঙ্গা থেকে বিমানটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ওখানে। ভেইটি থেকে ডজকে তুলে নিয়ে সোজা রওনা হয়ে যাবে বিমানটা ভজ আইল্যান্ডের উদ্দেশে। এই ব্যবস্থায় অনেক সুবিধে। অকারণ অনেক ঝুঁকি এড়ানো যাবে।
আরও কিছু পরিকল্পনা করা হলো। তবে সবগুলোর মধ্যে ডজের পরামর্শটাই উপযুক্ত মনে হলো। ওমরের মন খুঁতখুঁত করতে লাগলো যদিও। এর চেয়ে ভালো আর কোনো বুদ্ধি বের করতে না পেরে অবশেষে সেটাই মেনে নিলো সে। বিমানটাকে তুলে দেয়া হলো একটা স্টীমারে। রারাটোঙ্গায় নামিয়ে দেবে। ওটার সঙ্গেই যাবে ওমর, কিশোর আর মুসা।
সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ডজ। মাসখানেক পরে রারাটোঙ্গায় পৌঁছে কিশোররা দেখলো প্ল্যানমাফিক তেল রেখে ভেইটিতে চলে গেছে সে।
তেল-টেল ভরে, বিমানটাকে একবার পরীক্ষামূলক ভাবে উড়িয়ে দেখলো ওমর। ঠিকই আছে। তিন অভিযাত্রীকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওটা ভেইটির উদ্দেশে। ওখানে পৌঁছে দেখলো একটা অ্যাক্সিডেন্ট করে ফেলেছে ডজ, এতে ওদের পরিকল্পনায় একটা বড় রকম পরিবর্তন হয়ে গেল। সে ঠিকমতোই পৌঁছেছে ওখানে, তেল আর জিনিসপত্রও বহাল তবিয়তেই আছে, কিন্তু তার নিজের হাতটা রয়েছে স্লিঙে ঝোলানো। বেশ লজ্জিত হয়েই সে তার এই দুর্ঘটনার কাহিনী শোনালো।
ভেইটিতে সময়মতোই পৌঁছেছিলো সে। দ্বীপটায় মানুষের বসবাস নেই। পালতোলা ছোট যে জাহাজটায় করে সে ওখানে পৌঁছেছে তার ক্যাপ্টেন স্থানীয় লোক, পলিনেশিয়ান, নাম হাইপো-বললো, একটা কাজে তাহিতিতে ফিরে যাচ্ছে। ফেরার পথে খাবার পানি নেয়ার জন্যে আবার থামবে ভেইটিতে। শুনে ডজের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। অযথা দ্বীপে বসে থেকে একা একা কি করবে? জিনিসপত্র রেখে চলে যেতে পারে হাইপোর সঙ্গে। জাহাজটা তো ফিরবেই, তখন আবার না হয় ফিরে আসা যাবে। তাহিতিতে গিয়ে বরং গুডু কারনেসের খোঁজখবর নেয়া ভালো। লোকটা কোথায় আছে এখন, কি করছে, জানা থাকলে সুবিধে। ডজ মুক্তোর খেতটা আবিষ্কারের পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। হয়তো ইতিমধ্যে ওটা বের করে ফেলেছে কারনেস। ফেলে থাকলে খবরটা চেপে রাখতে পারবে না। সেটাই জানার জন্যে তাহিতিতে চললো আবার ডজ।
বন্দরে পা দিয়েই প্রথম যে লোকটার ওপর চোখ পড়লো তার, সে হলো স্বয়ং কারনেস। তাড়াতাড়ি আবার জাহাজে উঠে পড়তে চেয়েছিলো ডজ, পারলো না, দেখে ফেললে তাকে কারনেসের এক সাগরেদ। একটা গন্ডগোল বাধিয়ে হামলা করে বসলো। হাতে ছুরির খোঁচা খেলো ডজ।
দ্বীপের গভর্নরকে ব্যাপারটা জানাতে পারতো সে। তাতে হয়তো কারনেসকে পাকড়াও করতে পুলিশ। কিন্তু কেন এই শত্রুতা তা জানার চেষ্টা করতেনই গভর্নর। মুক্তোর খেতের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় ছিলো তাতে। কাজেই বাড়াবাড়ি না করে সোজা এসে আবার জাহাজে উঠলো ডজ। হাইপোকে অনুরোধ করলো তখনি তাকে ভেইটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
নিয়ে এসেছে হাইপো। কিশোররা আসার একটু আগে ভেইটিতে পৌঁছেছে ডজ। তখনও নোঙর করা রয়েছে হাইপোর জাহাজ। যায়নি।
জখমটা এক পলক দেখেই বুঝতে পারলো ওমর, ডাইভিঙের ক্ষমতা নেই এখন ডজের। মুক্তো তোলার জন্যে সাগরে ডুব দিতে পারবে বলেও মনে হলো না। অনেকখানি মাংস কেটেছে, চিরে একেবারে হাঁ হয়ে আছে। পচবে কিনা কে জানে! জ্বর এসে গেছে ইতিমধ্যেই। এই অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। এমনিতেই ওসব গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ঘা শুকাতে দেরি হয়। তা-ও ঠিকমতো ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা গেলে। অভিযানে যাওয়া বাদ, ভাবলো ওমর। বরং এখানে থেকে এখন ভালোমতো ওষুধ দিয়ে ডজের জখমের চিকিৎসা করা দরকার।
অযথা বসে থাকতে হবে। তার চেয়ে বরং তাহিতিতে চলে যাওয়া ভালো, ভাবলো সে, হাইপোর জাহাজটা যখন রয়েছে। লোকটার যেতে কোনো আপত্তি নেই, সে ভাড়া পেলেই খুশি। তাহিতিতে বিমান নামাতে চায়নি ডজ, লোকের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয়ে। সেটা এড়ানো গেছে। জাহাজে করে এখন ওমর আর আরেকজন যদি যায়-মুসা কিংবা কিশোর, যে কোনো একজন হতে পারে, তাহলে কারো চোখে পড়বে না। কতো নতুন লোকই তো তাহিতিতে যায়, আসে। আরেকটা ভয় ছিলো ডজের, কারনেসের চোখে পড়ার ভয়। সে ভয় করেও আর লাভ নেই। যা ঘটার ঘটে গেছে, চোখে পড়েই গেছে লোকটার। হাইপোর জাহাজে করে গিয়ে এখন আবার ওমররা তাহিতিতে নামলে কারনেস দেখে ফেলবে, আর অনেক কিছু অনুমান করে ফেলবে। করুক। তাতে আর কিছু যায় আসে না। ডজকে দেখেই হয়তো যা করার করে বসে আছে সে। বরং গিয়ে এখন খোঁজ নেয়া দরকার কতোটা বুঝেছে কারনেস, আর কি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
কাজেই সেই রাতেই হাইপোর জাহাজে করে তাহিতিতে ফিরে চললো কিশোর আর ওমর। মুসাকে রেখে এসেছে ডজের কাছে। জখম বেশি খারাপ হয়ে গেলে যাতে বিমানে করে উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারে তাহিতিতে।
এরকম ছোট জাহাজে বিশাল মহাসাগরে বেরোনো কোনো নতুন অভিজ্ঞতা নয় কিশোরের কাছে। আগেও এসেছে এখানে। শুধু নারকেল গাছের কান্ড সম্বল করে ভেসে পড়েছিলো বিপজ্জনক সাগরে। রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো জাহাজ ঘিরে হাঙরের ঘোরাফেরা। খাবারের গন্ধ পেয়ে গেছে যেন প্রাণীগুলো, কাছছাড়া হতে চাইছে না আর।
বাতাস চমৎকার। আবহাওয়াও ভালো। নিরাপদেই তিনদিন পরে তাহিতিতে এসে পৌঁছলো জাহাজ। বেশি সময় ওখানে থাকার ইচ্ছে নেই ওমরের। কারনেসের খোঁজ নেয়া হয়ে গেলেই ফিরে যাবে ভেইটিতে।
ডজের পরামর্শ মতো প্রথমেই দুজনে চলে এলো রেস্টুরেন্ট ডু পোর্টে। প্রায় ভরে গেছে জায়গাটা। মানুষ আর তাদের বিচিত্র আচরণ দেখতে ভালো লাগে কিশোরের। কৌতূহল নিয়ে তাকালো। মানুষ দেখার জন্যে এরকম জায়গা খুব কমই আছে। ভালো পোশাক পরা কয়েকজন টুরিস্ট দেখা গেল। তাদের বেশির ভাগই আমেরিকান। জাহাজের ক্যাপ্টেন রয়েছে কয়েকজন, ওরা সব স্থানীয় লোক। শ্বেতাঙ্গ রয়েছে বেশ কিছু, দাঁড়িওয়ালা, নানা দেশ থেকে এসেছে জীবিকা আর রোমাঞ্চের সন্ধানে। পৃথিবীতে যতো রঙের চামড়ার মানুষ আছে, কালো থেকে হলুদ, সব আছে এখানে। রয়েছে চীনা ব্যবসায়ী। পলিনেশিয়ান আছে কয়েকজন, কানের পেছনে আর চুলে রঙিন ফুল গোঁজা। ঢুকতেই ইংরেজি, ফরায়ী, জার্মান, চীনা আর আরও অসংখ্য ভাষার মিলিত কণ্ঠ এসে কানে ধাক্কা মারলো যেন কিশোরের।
এক কোণে দুটো চেয়ার দেখে এগিয়ে গেল ওমর। কিশোরকে নিয়ে বসে খাবারের অর্ডার দিলো। গলা নামিয়ে কিশোরকে বললো, কোথেকে তদন্ত শুরু করবো বুঝতে পারছি না। হাইপো তো বললো কাজ সেরে আসবে। তাকে দিয়ে যদি কোনো সুবিধে হয়। কি বলো?
কারনেসের কথা তাকে বলেছেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। জাহাজে তো দেখলাম আপনাদের দুজনের খুব ভাব।
না। তবে ও আন্দাজ করে ফেলেছে, কারনেসের সঙ্গে মন কষাকষি চলছে আমাদের কোনো কারণে। ডজকে মারতে দেখেছে ও। শত্রুতা যে আছে বুঝে গেছে। মুক্তোর কথা জেনেছে কিনা কে জানে। ভেইটিতে আমরা অনেক কথা বলছি। আড়ি পেতে কিছু শুনে থাকতে পারে।
যদি আড়ি পাতে। বিশালদেহী, স্বাস্থ্যবান পলিনেশিয়ান লোকটাকে খারাপ মনে হয় না কিশোরের। আমার মনে হয় ওকে বিশ্বাস করতে পারি আমরা। তার সাহায্য পাবো। এখানকার লোক সে। তার ওপর নাবিক। এখানকার অনেক গুজবই তার কানে যাবে। তার কাছে…ওই তো, এসে গেছে।
কিশোর লক্ষ্য করলো, শুধু ওরা দুজনেই নয়, হাইপো ঢোকার পর অনেক জোড়া চোখই তার দিকে ঘুরে গেছে। সে চোখগুলোতে কৌতূহল। সোজা কিশোরদের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো সে। একটা চেয়ার টেনে বসলো। আপনারা ক্যাপ্টেন কারনেসের খোঁজ করছেন তো? ইংরেজি আর ফরাসী ভাষার একটা অদ্ভুত মিশ্রণে কথা বলে সে। ফিসফিস করে বললো।
চিন্তিত ভঙ্গিতে একটা মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলো ওমর। মাথা ঝাঁকালো। হ্যাঁ, খুঁজছি।
খারাপ লোক।
আমারও তাই বিশ্বাস।
সাবধানে থাকবেন।
কেন? আমাদের সঙ্গে কেন লাগতে আসবে সে? চিনিই তো না।
ওই লোক সবার সঙ্গেই ঝগড়া বাধায়। কালও গন্ডগোল করেছিলো।
তার মানে এখানেই আছে?
হ্যাঁ। তার স্কুনার হোয়াইট শার্ক পাপিতি বন্দরে নোঙর করা রয়েছে। রাটুনা থেকে এসেছে আজ সকালে। কাল ভোরেই আবার জাহাজ নিয়ে বেরোবে। মালপত্র বোঝাই করছে জাহাজে, অনেক জিনিস।
গন্ডগোলটা কি করেছে?
রাটুনা থেকে জোর করে একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছে কাজ করানোর জন্যে। কাল বন্দরে নেমেই পালানোর চেষ্টা করেছিলো ছেলেটা। ধরে ফেলে তাকে প্রচন্ড মার মেরেছে কারনেস। সে বলছে, জাহাজে কাজ করার জন্য চুক্তি করেছে ছেলেটা, আগাম টাকাও নিয়েছে, এখন পালারে কেন? জোর করে ধরে আবার জাহাজে তুলেছে।
কাল ভোরে চলে যাচ্ছে, না?
হ্যাঁ। গভর্নর তাকে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন।
কোথায় যাচ্ছে?
বলেনি। কারনেস আর তার সাগরেদরা ছাড়া আর কেউ কিছু জানে না। কেউ জিজ্ঞেস করতে গেলে শুধু চোখ টেপে ওরা, আর মিটমিট করে হাসে।
আপনি জানলেন কি করে?
আমার লোকেরা শুনে এসেছে। বন্দরে নেমেছিলো, সেখান থেকে।
ছেলেটার কি অবস্থা? রাটুনা থেকে যাকে ধরে এনেছে?
কি জানি! হাত ওল্টালো হাইপো। তবে খারাপই হবে। কারনেসের হাতে কেউ পড়লে তার আর ভালো হওয়ার উপায় নেই। সবাই ভয় পায় লোকটাকে।
গভর্নরও?
মনে তো হয়। নইলে ধরে কিছু করেন না কেন? শুধু বেরিয়ে যেতে বলেছেন।
এতোই খারাপ, বিড়বিড় করলো কিশোর। তো, ছেলেটা পালিয়েছিলো কিভাবে? ওরকম একজন লোকের হাত ফসকে?
জাহাজের রেলিঙ টপকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। পানিকে ওরা ভয় পায় না।
কি যেন ভাবছে কিশোর। আনমনেই বিড়বিড় করলো, রাটুনা থেকে ধরে আনলো…পানিকে ভয় পায় না…হাইপোর চোখের দিকে তাকালো। ছেলেটার নাম বলতে পারেন?
পারবো না কেন? সবাই জানে। ঝিনুক।
ঝট করে কিশোরের দিকে তাকালো একবার ওমর। হাইপোর দিকে ফিরলো। কি বললেন!
ঝিনুক।
হুঁ, যা ভেবেছিলাম! নিচু গলায় বললো কিশোর।
কি ভেবেছিলে? জানতে চাইলো হাইপো। অবাক হয়েছে।
না, কিছু না, আরেক দিকে মুখ ফেরালো কিশোর। সে কি ভাবছে বুঝতে পারলো ওমর। হাইপোকে জিজ্ঞেস করল, রাটুনা থেকেই এনেছে তো?
নিশ্চয়।
আর কোনো সন্দেহ রইলো না কিশোর কিংবা ওমরের। রাটুনাতে গিয়েছিলো কারনেস। কোনো ভাবে জেনেছে, ঝিনুকই উদ্ধার করে এনেছে ডজকে। তার মানে যে দ্বীপ থেকে এনেছে সেটার অবস্থান বলতে পারবে এবং তার অর্থ ওই দ্বীপের কাছাকাছিই কোথাও রয়েছে মুক্তোর খেত। ছেলেটাকে ধরে এনেছে সেই জায়গা চিনিয়ে দেয়ার জন্যে।
এখানে এসে ভালোই করেছি, বুঝলে? কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললো ওমর। একটা জরুরী খবর জানা গেল। এখুনি ভেইটিতে ফেরা দরকার। দেরি করা… দরজার কাছে একটা হৈ চৈ শুনে ফিরে তাকালো সে। হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল সবাই। সব কটা চোখ ঘুরে গেছে সেদিকে। মোটা, গাট্টাগোট্টা একজন ইটালিয়ান লোক ঢুকেছে। ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। মুখের মসৃণ চামড়া কালো দেখাচ্ছে রক্ত জমায়। আধবোজা চোখ। আস্তে করে মোচড় দিচ্ছে গোঁফে। তাকে দেখে সবাই যে এমন চমকে গেছে, এটা যেন উপভোগ করছে খুব।
চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে পড়েছিলো হাইপো, বসে পড়লো আবার। হাত রাখলো ওমরের বাহুতে। কারনেস! তার কণ্ঠে অস্বস্তি।
তাতে কি হয়েছে? আপনি তো আর কিছু করেননি। এতো ভয় পাওয়ার কি হলো?
বুঝতে পারছেন না আপনি। আমার ওপর ওর কুনজর পড়লে বিপদে পড়ে যাবো। আমি কিছুই করতে পারবো না।
কেন পারবেন না?
কারনেস শাদা মানুষ। শাদা মানুষের গায়ে হাত তুললে মুশকিল হবে।
অবাক হয়ে গেল ওমর। ঔপনিবেশিক শাসনের ছোঁয়া এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি এই অঞ্চল থেকে। এখনও এখানকার মানুষের মনে রয়ে গেছে শাদা মানুষের ভয়। নিশ্চয় এখনও ওদেরকে অত্যাচার করে শ্বেতাঙ্গরা। মাথা ঝাঁকালো সে, বুঝেছি। পকেট থেকে টাকা বের করলো বিল দেয়ার জন্যে। চোখের কোণ দিয়ে একটা নড়াচড়া দেখতে পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। ওদের টেবিলের কাছাকাছি এসে থেমেছে করসিকান লোকটা। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে হাইপোর দিকে।
এই কুত্তা! খেকিয়ে উঠলো কারনেস, আমার জাহাজের কাছে ঘুরঘুর করছিলি কেন?
আপনার জাহাজের কাছেও যাইনি আমি, ক্যাপ্টেন কারনেস, তাড়াতাড়ি জবাব দিলো হাইপো।
বাঁকা হয়ে গেল কারনেসের ঠোঁটের এক কোণ। আরও কুৎসিত করে তুললো মুখটাকে। মুঠো হয়ে গেল আঙুল। ব্যাটা মিথুক… বলতে গিয়েই থেমে গেল। তাকালো ওমরের দিকে। উঠে দাঁড়িয়েছে সে।
দেখুন, কঠিন কণ্ঠে বললো ওমর। এটা আমার টেবিল। আপনাকে ডেকেছি বলে তো মনে পড়ে না।
চুপ হয়ে গেছে সবাই। থমথমে পরিবেশ।
জ্বলন্ত চোখে ওমরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কারনেস। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তোমাকে কথা বলতে কে বলেছে? বসো!
তার ধমকের পরোয়াই করলো না ওমর। ভদ্রভাবে কথা বলো। তোমার সাগরেদ পেয়েছো নাকি আমাকে?
বসো! চেঁচিয়ে উঠলো, কারনেস। আমার কাজ আমাকে করতে দাও।
কি করবে?
এই কুত্তাটাকে ভর্তা বানাবো।
মাথা নাড়লো ওমর। না, তা তোমাকে করতে দেয়া হবে না। কিছু করতে গেলে আমাকে নাক গলাতেই হবে।
অবাক হলো যেন কারনেস। আমি কে জানো?
জানি। তুমি কে, কী, ভালো করেই জানি। তোমার নাম কারনেস। একটা সাধারণ গুন্ডা। যে মনে করে এই দ্বীপটা তার সম্পত্তি। সরো, আমার টেবিলের সামনে থেকে!
চোখের পলকে পকেটে হাত চলে গেল লোকটার। বেরিয়ে এলো একটা ছুরি। ঝিক করে উঠলো আলোয়।
বিদ্যুৎ খেলে গেল ওমরের শরীরে। এসব ছুরি-টুরির থোড়াই পরোয়া করে সে। থাবা দিয়ে পানির একটা গেলাস তুলে নিয়েই ছুঁড়ে মারলো কারনেসের মুখে। একলাফে এগিয়ে এলো। ধা করে গিয়ে বাঁ হাতটা আঘাত হানলো লোকটার সোলার প্লেক্সাসে। প্রচন্ড আঘাতে ঝটকা দিয়ে সামনে ঝুঁকে এলো করসিকানের মাথা। ওমরের ডান হাতের ঘুসি লাগলো তার চোয়ালে। মাঠ পার করে দেয়ার জন্যে ক্রিকেট বলকে ব্যাট দিয়ে বাড়ি মারলে যেমন হয় শব্দ হলো সেরকম।
গুঙিয়ে উঠলো কারনেস। টলে উঠলো। ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কলাগাছের গোড়া কেটে দেয়া হলো যেন, ধীরে ধীরে কাত হয়ে তেমনি ভঙ্গিতে উল্টে পড়লো লোকটা, চেয়ার টেবিল নিয়ে। সেই টেবিলের সামনে বসেছিলো একজন তরুণ আমেরিকান, লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, দারুণ! দারুণ মার মেরেছেন! দেখালেন বটে!
ঘরের কেউ নড়লো না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত ডলছে রেস্টুরেন্টের মালিক, কিন্তু কিছুই করতে এগোলো না। যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো ওমর। তাকিয়ে রয়েছে কারনেসের দিকে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আবার করসিকান। মাথা নেড়ে যেন ভেতরটা পরিষ্কার করতে চাইছে। শুয়োরের চোখের মতো খুদে কুকুতে চোখ জোড়ায় তীব্র ঘৃণা। দ্রুত একবার দৃষ্টি ঘুরে এলো সারা ঘরে, তার এই হাস্যকর পরিণতিতে কে কতোটা খুশি হলো যেন দেখলো। ঘুরে এসে চোখজোড়া আবার স্থির হলো ওমরের ওপর। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। দ্বিধা করলো একটা মুহূর্ত। তারপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে বললো, আবার দেখা হবে আমাদের।
আলোয় আর দেখা করতে এসো না, শান্তকণ্ঠে বললো ওমর। অন্ধকার রাতে আমার পেছন দিক থেকে এসো, যদি আমাকে মারতে চাও। আরেকবার সামনে পড়লে দাঁত কটা খসিয়ে দেবো, মনে থাকে যেন। যাও, ভাগো! চুরি করে মদ বিক্রি করে গিয়ে। যেটা ভালো পারো।
আরেকবার সারা ঘরে চোখ বোলালো কারনেস। কয়েকজন হাসছিলো, তার চোখে চোখ পড়তেই হাসি মিলিয়ে গেল ওদের। ছুরিটা আবার পকেটে ভরলো করসিকান। তারপর শান্ত পায়ে এগোলো দরজার দিকে। বেরিয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে।
একসাথে কথা বলে উঠলো অনেকগুলো কণ্ঠ। কিশোরের মনে হলো, ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়লো যেন শব্দগুলো।
ভালো হয়েছে! আচ্ছা, শিক্ষা হয়েছে! বললো একটা কণ্ঠ। শয়তানটাকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার ছিলো!
তাহলে কেন এতোদিন দিলেন না? জিজ্ঞেস করলো ওমর। ভালোমতো একবার দিয়ে দিলেই তো ঠান্ডা হয়ে যেতো। ঘরের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, নিন। খাওয়া শুরু করুন। আপদ বিদেয় হয়েছে।
উঠে দাঁড়ালো একজন লম্বা, সুন্দর চুলওয়ালা স্ক্যানডিনেভিয়ান লোক। পরনে নাবিকের পোশাক, পুরনো, মলিন হয়ে গেছে। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমার নাম স্ট্রাডস স্যানটোজ। একটা কাজের কাজ করেছেন। আমার একটা জাহাজ আছে। সাহায্যের দরকার পড়লে জানাবেন, খুশি হয়েই করবো।
থ্যাংকস, স্যানটোজ, ওমর বললো। মনে থাকবে আপনার কথা। আর বসলো না। কিশোর আর হাইপোর দিকে ফিরে বললো, চলো।
দরজার দিকে এগোলো সে। প্রশংসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো ঘরের সব কটা চোখ। বাইরে বেরিয়েই হাইপোকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাজ শেষ হয়েছে?
হয়েছে, বস। শেষ।
জাহাজ ছাড়া যাবে?
যক্ষুণি বলবেন।
গুড। আমি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করবো। ঝিনুক ছেলেটার ব্যাপারটা তদন্ত করতে অনুরোধ করবো। কারনেসের হাত থেকে ওকে ছাড়িয়ে আনা দরকার।
জ্যোৎস্নায় আলোকিত বন্দরের দিকে তাকিয়ে বললো হাইপো, দেরি হয়ে গেছে, বস।
মানে? কি বলতে চান?
কারনেসের জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। হাত তুলে দেখালো হাইপো, ওই যে তার স্কুনার, চলে যাচ্ছে।
ওমর আর কিশোরও দেখলো। ধীরে ধীরে বন্দরের মুখের দিকে এগিয়ে চলেছে একটা জাহাজ নোঙর থেকে পানি ঝরছে এখনও।
এইমাত্র ছাড়লো, তিক্ত কণ্ঠে বললো ওমর। আর কিছুই করার নেই। তবে আমার বিশ্বাস, কারনেসের সঙ্গে আবার দেখা হবে আমাদের। চলুন, ভেইটিতে ফিরে যাই।
হাইপোর জাহাজটা যেখানে নোঙর করা রয়েছে, সেদিকে হেঁটে চললো তিনজনে।
৩
ভেইটিতে ফিরে দেখা গেল, ডজের জখমের অনেক উন্নতি হয়েছে। ঝিনুক কারনেসের হাতে পড়েছে শুনে চমকে গেল সে। ঘাবড়ে গেল রীতিমতো।
ফুঁসে উঠলো ডজ, সোজা মুক্তো খেতের দিকে যাচ্ছিলো ব্যাটা। পথে রাটুনা থেমেছে খাবার পানি নেয়ার জন্যে। থামতেই হবে। কয়েকটা কারণ। মিষ্টি পানি আছে। ওখানকার যে কটা দ্বীপ আছে, তার মধ্যে ওটাই সব চেয়ে বড়। লোকেরা নিশ্চয় বলেছে আমি কয়েক দিনের জন্যে উঠেছিলাম ওখানে। এজন্যে ওদেরকে দোষ দেয়া যায় না। এমনিতেই ঘটনা ওসব জায়গায় খুব কম ঘটে। আর আমার মতো একজন বিদেশীর ওখানে থাকাটা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ওদের মাঝে, সহজে ভুলবে না। এটা একটা খবরের মতো খবর ওদের কাছে। কারনেস নেমে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে আমার কথা। আর তা-ই সে করেছে। জেনেছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক, নামের দুটো ছেলেমেয়ে সাগরের মাঝের এক দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে এনেছে আমাকে। মেয়েটার গায়ে হাত দেয়ার সাহস করবে না কারনেস। কারণ মেয়েদের অপমান সহ্য করবে না দ্বীপের লোকে। এরকম অন্যায় করে অনেক বিদেশীকে মুন্ডু খোয়াতে হয়েছে। তাই ছেলেটাকে ধরেছে সে। লোভ-টোভ দেখিয়েই হয়তো বের করে নিয়ে এসেছে দ্বীপ থেকে। রসদপত্র ফুরিয়ে গিয়েছিলো হয়তো, তাই ফিরে গিয়েছিলো তাহিতিতে। এখন যখন বেরিয়ে গেছে, নিশ্চয় আবার গেছে মুক্তো খেতের দিকে।
মন দিয়ে শুনলো হাইপো। একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল, ঠিকই বলেছেন। অনেক মালপত্র কিনেছে সে। ডুবুরির পোশাক কিনেছে।
কি করে জানলেন? তীক্ষ্ণ হলো ডজের কণ্ঠ।
হু চি মিনের কাছে নারকেলের ছোবড়া বিক্রি করি আমি। ওর কাছে ডুবুরির পোশাক আছে। এবার গিয়ে শুনলাম সেটা নাকি বেচে দিয়েছে কারনেসের কাছে।
কেন নিয়েছে সে-তো বোঝাই যায়, ওমর বললো। ওসব নিয়ে আলোচনা করে আর লাভ নেই। দেরি করা যাবে না এখন। কারনেসের আগে গিয়ে পৌঁছতে হবে আমাদের।
এই তাড়াহুড়োটা করতে হতো না, বিড়বিড় করলো ডজ। ছেলেটাকে ধরেই সর্বনাশটা করলো।
ছেলেটা তাকে কতোটা বলবে, তার ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু। মুখ খুলবে?
কি জানি। মারকুইজানরা কখন যে কি করবে বলা কঠিন। ওদের দাদাৱা ছিলো মানুষখেকো, ভুলে যেও না। মানুষ খাওয়ার ব্যাপারে কানাঘুষা কিছু কিছু এখনও শোনা যায়। ভীষণ জেদী। যদি কোনো বিদেশীকে পছন্দ করে তো, তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে। আর না করলে, তার কথাই শুনবে না। কেটে ফেললেও একটা কথা বের করবে না মুখ থেকে। কারননসকে পছন্দ করার কোনো কারণই নেই ঝিনুকের। হয়তো ভুল জায়গায় নিয়ে চলে যাবে। ইচ্ছে করে।
পথে আবার রাটুনায় থামবে নাকি কারনেস? জানতে চাইলো ওমর। কি মনে হয়? দরকার আছে?
আছে। তাহিতি থেকে ডজ আইল্যান্ড অনেক দূরে। যেতে যেতে খাবার আর পানি ফুরোবেই। রাটুনায় থামতে বাধ্য হবে সে।
তাহলে এক কাজ করলেই পারি, কিশোর পরামর্শ দিলো। আগেই গিয়ে রাটুনায় বসে থাকি আমরা। কারনে গেলেই ধরবো। ঝিনুককে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো।
হুঁ, বুদ্ধিটা মন্দ না, ডজ বললো। কারনেসও ভাববে সে বেরিয়ে গেছে। জাহাজ নিয়ে তার পিছু নিলেও আগে দ্বীপে পৌঁছতে পারবো না আমরা। সে তো আর জানে না যে প্লেন আছে আমাদের। ওর আগে গিয়ে ওত পেতে থাকবো আমরা, এটা কল্পনাই করতে পারবে না।
পারি, আর না পারি, মুসা বললো। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?
ওমরও ভেবে দেখলো কথাটা। পছন্দ হলো।
লেগুনের পানিতে ভাসছে ফ্লাইং বোট। ওড়ার জন্যে তৈরি। কিশোরকে নিয়ে ওর চলে যাওয়ার পর বসে থাকেনি মুসা। বিমানটাকে স্টার্ট দিয়ে পানিতেই চালিয়েছে কিছুক্ষণ। কোনো খুঁত আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করেছে। ট্যাঙ্কে ভরার পর পেট্রোল যা বাকি রয়ে গেছে, আর যেসব জিনিস তখুনি নেয়ার প্রয়োজন নেই, সেগুলো সুবিধে মতো জায়গায় লুকিয়ে ফেলেছে। যাতে প্রয়োজনের সময় এসে বের করে নিতে পারে।
রওনা হতে কোনো অসুবিধে নেই। হাইপো আর তার হাসিখুশি তিনজন নাবিককে ধন্যবাদ জানালো ওরা। তারপর গিয়ে উঠলো বিমানে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ওমর। মিনিট কয়েক পরেই শাদা রেখা তৈরি করে নীল পানিতে ছুটতে শুরু করলো বিমান। জয়স্টিক চেপে ধরেছে সে। ইনসট্রুমেন্ট বোর্ডের ওপর সাঁটানো রয়েছে চার্ট।
কয়েক ঘণ্টা ধরে মাঝারি গতিতে সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চললো ওরা। মাঝে মাকে নিচে দেখা গেল দ্বীপ, নীল মখমলের মাঝে সবুজ পান্নার মতো। একবার নিচে কালো একটা ফুটকির মতো দেখে ডজ জানালো ওটা আদিবাসীদের ক্যানু। শেষ বিকেলে দিগন্তের দিকে হাত তুলে দেখালো, স্কুনার! নিশ্চয় কারনেস!
আরেকটু পরেই সামনে লম্বা একটা ঝিলিমিলি দেখা গেল। আবছা থেকে স্পষ্ট হতে লাগলো ওটা। ভজ ঘোষণা করলো, রাটুনা এসে গেছে। ঘন নীল আকাশে এখন সবুজ একটা প্রতিবিম্ব। এসব জায়গায় বিমান থেকে দ্বীপগুলোকে ওরকমই দেখায়, দূর থেকে আরো কাছে এগোলে আকাশ থেকে যেন পানিতে নেমে পড়লো সবুজ রঙের ঝিলিমিলি। ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে পর্বতের উঁচু চূড়াগুলো।
আগেও দেখেছি এসব, কিশোর বললো। তার পরেও নতুন মনে হয়। যতোবারই দেখি, অবাক হই।
হওয়ারই জিনিস, ডজ বললো। আমি তো কতদিন ধরে আছি। বার বার দেখেছি। তার পরেও পুরনো হয় না। বেশির ভাগ দ্বীপই তৈরি করেছে প্রবালকীট। পানির সমতলের বেশি ওপরে উঠতে পারেনি সেজন্যেই। পমেটো ওই রকম দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু মারকুইস দ্বীপপুঞ্জ আলাদা। বড় বড় পাহাড় পর্বত যেন সাগরের ভেতর থেকে ঠেলে উঠেছে। প্রথমবার দেখে কেমন ভয়ই লাগতো। হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড়। প্রবালের তৈরি দ্বীপের চেয়ে অবশ্য ওই পাহাড়ওয়ালা দ্বীপগুলোর সৈকতই সুন্দর। ধবধবে শাদা বালি। পাহাড়ের গোড়ায় ঘন জঙ্গলও আছে।
সাপটাপ নেই তো? মুসা জিজ্ঞেস করলো। অতো সুন্দর বনে সাপ থাকলে ভালো লাগবে না।
না, তা নেই। তবে বিষাক্ত পোকামাকড়ের অভাব নেই। দশ ইঞ্চি লম্বা শতপদী আছে। ওগুলো সাপের চেয়ে কম বিষাক্ত না। কামড়ে দিলে টের পাবে।
কিছুটা নিচে নামলো ওমর। ডজ তাকে দেখালো, ওই যে, গ্রাম। সৈকতের কিনারে কয়েকটা কুঁড়ে চোখে পড়ছে। নারকেল পাতার ছাউনি। দ্বীপের আরেক ধারে আরেকটা গ্রাম আছে। তবে সেটার চেয়ে এই গ্রামটা বড়। লোকজন এখানেই বেশি। সৈকতের ধারে যেখানে খুশি নামাতে পারো। টিলাটকর কিছু নেই। তবে ক্যানু থাকতে পারে।
গাঁয়ের ওপরে ধীরে ধীরে চক্কর দিতে লাগলো ওমর। উচ্চতা কমিয়ে আনলো আরও। তারপর নাক নিচু করে উড়ে গেল নীল পানির দিকে। যেখানে পানির গা ঘেঁষে রয়েছে একফালি বাঁকা শাদা সৈকত।
চিলের মতো ডানা মেলে দিয়ে যেন ভেসে ভেসে নামতে শুরু করলো ফ্লাইং বোট। সামনে ঝুঁকে এসে কোন জায়গায় নামতে হবে ওমরকে দেখিয়ে দিলো ডজ।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় কিশোর মন্তব্য করলো, পৃথিবীর দেশ বলে মনে হয় না! একেবারে স্বর্গ!
তা ঠিক, কথাটা ডজও স্বীকার করলো। এতো সুন্দর জায়গা পৃথিবীতে কমই আছে। তবে স্বর্গেও সাপ থাকে।
সাপ! অবাক হয়ে বললো মুসা। এই না বললেন নেই!
আরে না না, ওই সাপের কথা বলছি না, ডজ বললো, ব্যাখ্যা করে কিভাবে বোঝাই! বলতে চাইছি ভালোর পাশাপাশিই মন্দ জিনিস তৈরি করে রাখে প্রকৃতি। এই যেমন রুটিফল আর কলার কথাই ধরো। কতো ভালো খাবার। ওই পাহাড়ের গোঁড়ায় প্রচুর জন্মায়। তেমনি জন্মায় বিষ। বনের ভেতরে বিষাক্ত অর্কিড জন্মায়। এমন সব মাছি আছে কামড়ালে সাংঘাতিক জ্বালা করে। সাগরে যেমন মুক্তো আছে, তেমনি রয়েছে হাঙর আর অন্যান্য ক্ষতিকর জিনিস। জ্যান্ত প্রবাল তো পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিসগুলোর একটি। কিন্তু গিয়ে ঘষা লাগিয়ে দেখ না। কেটে রক্ত তো বেরোবেই, বিষও ঢুকে যেতে পারে। সবার ওপর রয়েছে অসুখ, দক্ষিণ সাগরের এই স্বর্গগুলোতে। একশো বছর আগে এই দ্বীপটাতেই শুধু ছিলো দশ হাজার মানুষ। এখন আছে মোটে দুশো। বাকি সব মরেছে শাদা মানুষের বয়ে নিয়ে আসা অসুখে। কেউ এনেছে যক্ষ্মা, কেউ কুষ্ঠ। আর কয়েক বছর পরে এখানে একজন মানুষ থাকবে কিনা সন্দেহ! পঙ্গপালের মতো মরে সাফ হয়ে গেছে এখানে মানুষ…
পানিতে নেমে পড়েছে ফ্লাইং বোট। ছুটলো গায়ের দিকে। বিমানের শব্দ শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে গায়ের লোক। জটলা করছে সৈকতের ধারে। কেউ কেউ উত্তেজনায় নাচতে শুরু করেছে।
এই প্রথম এখানে প্লেন নামছে। জানালার বাইরে মাথা বের করে দিলো ডজ। চেঁচিয়ে বললো, কাওহা!
আরও বেড়ে গেল সৈকতে উত্তেজনা। ডজকে চিনেছে। তাকে চেনা সহজ, লাল রঙের চুলের জন্যে। ঝপাঝপ কয়েকটা ক্যানু টেনে নামানো হলো পানিতে। ছুটে এলো বিমানের পেছনে। ঘিরে ফেললো এসে। কেউ কেউ সাঁতরে চলে এলো। নারী, পুরুষ, ছেলেমেয়ে, সব রকমের মানুষ। চেঁচিয়ে ডজের নাম ধরে ডাকতে লাগলো ওরা, স্বাগত জানাচ্ছে, তবে ডজ নামটা বলছে না, বলছে লাল চুল। কাওহা কাওহা বলে তার জবাব দিচ্ছে ভজ। শান্ত পানিতে বিমানের নোঙর ফেলে ক্যানুতে নামলো বৈমানিকেরা। নিয়ে আসা হলো ওদেরকে নারকেল গাছে ঘেরা সৈকতে।
উঁকি দিয়ে শরীরে অনেক বেশি আঁকিবুকি আঁকা বয়স্ক একজন লোককে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো ডজ। পরিচয় করিয়ে দিলো, ওর নাম অশান্ত সাগর। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো যখন অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ওমরের নাকে নাক ঘষার আগে মোড়ল ভালোমতো তার মুখটা শুকে নিলো। মোড়ল ইংরেজি তেমন জানে না। বললো সে, ফরাসী ভাষা জানে। তবে তার মাতৃভাষা মারকুইসাসে কেউ কথা বললেই বেশি খুশি হয়। আমি কিছু কিছু জানি। আলোচনা চালাতে পারবো।
মোড়লের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন তরুণ ওদেরকে দেখিয়ে ডজকে বললো ওমর, ওদের ভাবভঙ্গি তো সুবিধের লাগছে না। মনে হচ্ছে মাথায় মুগুরের বাড়ি মারার জন্যে হাত নিসপিস করছে ওদের।
মোড়লের সঙ্গে কথা বললো ডজ। লোকগুলোর দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে আবার ডজের দিকে ফিরলো মোড়ল। মারকুইসাসে কিছু বললো। সঙ্গীদেরকে জানালো ডজ, ওরা ভয় পাচ্ছে। জোর করে আমরা ধরে নিয়ে যেতে পারি, এই ভয়। ভয়টা পাইয়েছে ওদের কারনেস, ঝিনুককে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে।
ওদের বলো, ওমর বললো। ঝিনুককে ছাড়িয়ে আনতে যাবো আমরা।
আবার মোড়লের সঙ্গে কথা বললো ডজ। মোড়ল কি বললো সেটা অনুবাদ করে শোনালো, খুশি হয়েছে ওরা। বলছে এই দ্বীপকে আমরা নিজেদের বাড়ির মতো মনে করতে পারি। তারপর নিজে থেকে বললো, ওরা যা বলে, ঠিক তাই বোঝায়। ফাঁকি-ঝুঁকি নেই। যাকে পছন্দ করবে তাকে সব দিয়ে দিতে রাজি। এখুনি আমাদের জন্যে একটা ঘর বানাতে হুকুম দিয়ে দিয়েছে মোড়ল। রাতের বেলা ভোজ হবে।
ঘর বানিয়ে দেবে, ঠিক আছে, ওমর বললো। তবে খাবার দাওয়াতটা রাখতে পারবো কিনা সন্দেহ। আসার সময় কারনেসের স্কুনার দেখে এসেছি। সত্যিই যদি তারটাই হয়, তাহলে সন্ধ্যার পর পরই পৌঁছে যাবে সে। ভোজফোজের মধ্যে না গিয়ে তার ওপর নজর রাখাটা জরুরী।
আরেক দফা লম্বা আলোচনা হলো ডজের সঙ্গে মোড়লের। ওমরের দিকে ফিরে ডজ বললো, ও বুঝতে পেরেছে। কয়েকজন যোদ্ধাকে পাহাড়ে পাঠিয়ে দেবে নজর রাখার জন্যে। স্কুনারটাকে দেখা গেলেই আমাদের হুঁশিয়ার করে দেবে।…আহ্, ওই যে আসছে সাগরের হাসি, ঝিনুকের বান্ধবী। বছর পনেরোর এক কিশোরী এগিয়ে এলো। খুব সুন্দরী। পরনে হালকা নীল রঙের পোশাক, দ্বীপের লোকেরা যেমন পরে। ছেলে আর মেয়েতে কোনো ভেদাভেদ নেই, একই রঙের কাপড় পরে। চমৎকার স্বাস্থ্য। তেল চকচকে বাদামী চামড়া। হাসতে হাসতে এসে হাত চেপে ধরলো জজের, কোনো জড়তা নেই, বললো, কাওহা, কাওহা।
আদর করে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো ডজ, মেয়েদেরকে এখানে অভ্যর্থনার জবাব দেয়ার এটাই নিয়ম। বললো, ঝিনুককে ছাড়িয়ে আনতে যাবো আমরা।
বন্ধুর নাম শুনে মেঘ জমলো যেন মেয়েটার বাদামী মুখে। ওর জন্যে আমার খুব খারাপ লাগে। কাঁদি।
ডজ, এসো, ডাকলো ওমর। প্লেন থেকে কিছু খাবার নামিয়ে নিয়ে আসি। আর মোড়লের জন্যে কিছু উপহার। তার পর কথা বলা যাবে যতো খুশি। এসো।
বিমান থেকে মাল নামানো, কোনো কাজই না, কিন্তু ইচ্ছে করেই এগিয়ে এলো অনেকে, সাহায্য করার জন্যে। মানা করলেও শোনে না। বরং মুখ বেজার করে ফেলে। আপাতত মোড়লের ঘরে ওদেরকে নিয়ে আসা হলো। পরে নতুন ঘর তৈরি হলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে।
তোমার দ্বীপ থেকে কত দূরে আছি? ডজকে জিজ্ঞেস করলো ওমর।
বিশ-তিরিশ মাইল। এর বেশি না।
এই দ্বীপেই আমাদের হেডকোয়ার্টার করলে কেমন হয়?
পেট্রোলের অসুবিধে হবে। বার বার যেতে আসতে অনেক তেল খরচ হবে, অতো নেই স্টকে। আবহাওয়া ভালো হলে ওড়ারও দরকার পড়বে না, পানিতে ট্যাক্সিইং করে চলে যেতে পারবো। রোজ সকালে রওনা হতে হবে তাহলে। রোজ এভাবে নিয়মিত যেতে-আসতে থাকলে সন্দেহ করে বসতে পারে এখানকার লোকে। সেটা উচিত হবে না। যতো কম লোক জানাজানি হয় ততোই ভালো। ওদের লোভ নেই, এটা ঠিক। কিন্তু বিদেশী কোনো জাহাজ চলে আসতে পারে। ফাঁস হয়ে যেতে পারে খবরটা।
মাথা ঝাঁকাল ওমর। ঠিকই বলেছো। যাকগে, সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আগে কারনেসের ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করে নিই।
হালকা খাবার খেয়ে নিলো ওরা। ঘুরতে বেরোলো কিশোর আর মুসা। উঁচু উঁচু অসংখ্য নারকেলের জটলার ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয়েছে কুঁড়েগুলো। বেরিয়ে চলে এলো ওরা সৈকতে। শান্ত নিথর হয়ে আছে সাগর। দিগন্ত সীমায় হেলে পড়ছে সূর্য! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আকাশের ঘন নীল, মাঝেমাঝে লালচে-হলুদ রঙের ছোপ। মৃদু বাতাস বইছে, যেন সাগরের শেষ নিঃশ্বাস, থিরথির করে কাঁপছে নারকেলের ডগা। আশ্চর্য এক নীরবতা। সামনে ছড়ানো শাদা সৈকত। জীবনের কোনো চিহ্নই নেই, কিছু ঋষি কাঁকড়া বাদে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকছে, যেন বোঝাতে চাইছে-না, না, আমরা জীবন্ত কিছু নই, পাথর। কিন্তু কাছে গেলেই ঝট করে বেরিয়ে আসছে দাঁড়া। বিদ্যুতের গতিতে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ছে অসংখ্য গর্তের কোনো একটাতে। সৈকতের কিনার ধরে হাঁটতে হাঁটতে সামনে বাধা দেখতে পেলো ওরা। পথ রুদ্ধ করে দিয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেছে, পাথরের দেয়াল। দেখলে মনে হবে হয় আকাশ থেকে ঝুপ করে পড়েছে হঠাৎ করে, কিংবা ধীরে ধীরে সাগরের নিচ থেকে ঠেলে মাথা তুলেছে। বেশি দূরে যেতে ওদেরকে মানা করে দিয়েছে ডজ। থামলো ওরা। এই সময় পেছনে শোনা গেল হালকা পায়ের আওয়াজ। ফিরে তাকিয়ে দেখলো হাতে একটা আদিম মাছ ধরার বড়শি নিয়ে এগিয়ে আসছে সাগরের হাসি।
অনেক টুপা, হেসে হাত তুলে কাঁকড়াগুলোকে দেখালো সে। মাছও অনেক আছে। দেখবে? এসো। দুজনের মধ্যে হাত ধরার জন্যে মুসাকেই বেছে নিলো সে টেনে নিয়ে চললো পাথরের দেয়ালের পাশের একটা বড় চাঙড়ের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চললো কিশোর।
চাঙড়টা আসলে দেয়ালেরই অংশ। ওপরে উঠে বোঝা গেল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চূড়াটা কেটে চলে গেছে। জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লো সাগরের হাসি। সাথে করে নিয়ে এসেছে অনেক কুঁচো চিঙড়ি। বড়শিতে সেগুলো গেঁথে পানিতে ফেলে দেখতে দেখতে অনেক মাছ ধরে ফেললো। একেকটা করে মাছ ধরে, আর সেগুলোর স্থানীয় নাম বলে, মুসাকে দিয়ে আবার উচ্চারণ করায় সেগুলোর।
শুনে কিশোরও শিখে ফেলেছে। তাকিয়ে রয়েছে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানির দিকে। একেবারে তল পর্যন্ত দেখা যায়। যেন ভিডিওতে নেচারাল ওয়ার্ল্ড দেখছে। আজব, সুন্দর সেই জগৎ। বিশাল এক অ্যাকুয়ারিয়াম যেন। খেলে বেড়াচ্ছে নানা রকম রঙিন মাছ। কোনোটা চুপ করে ভাসছে, কোনোটা ছোটাছুটি করছে, তাড়া করছে একে অন্যকে, পাথরের খাঁজ থেকে সুডু়ং করে বেরিয়ে আসছে কেউ, কেউ বা আবার ধীরে সুস্থে গিয়ে ঢুকে পড়ছে।
মস্ত একটা বান মাছ দেখতে পেলো। পুরো পনেরো ফুট লম্বা। কুৎসিত, ভয়ংকর মুখ। পাথরের কালো গর্ত থেকে বেরিয়ে পিছলে গিয়ে যেন ঢুকে পড়লো আরেকটা পাথরের ফাটলের ভেতরে। দেখতে দেখতে এতেই তন্ময় হয়ে গেল, অনেকক্ষণ থেকেই যে নীরব হয়ে আছে সাগরের হাসি, সেটা লক্ষ্যই করলো না। করলো অনেক পরে, যখন তার গায়ে কনুই দিয়ে গুতো দিলো মুসা।
পাথরের দেয়ালের গায়ে কালো বিষন্ন চেহারার একটা গুহামুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা। নিশ্চয় কিছু দেখতে পেয়েছে। মুসাও দেখেনি, কিশোরও পাচ্ছে না। তবে পেলো খুব তাড়াতাড়িই। চামড়ায় একধরনের শিরশিরে অনুভূতি হলো কিশোরের, ভয় পেলে কিংবা বেশি অবাক হলে এরকমটা হয় মানুষের। কালো কিছু একটাকে নড়তে দেখেছে।
সাগরের হাসির তীক্ষ্ণ চিৎকার ফালা ফালা করে দিলো যেন অখন্ড নীরবতা। গাঁয়ের দিকে ফিরে মুখের ওপর দুই হাত জড়ো করে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, ফেকি! ফেকি! ফেকি!
চিৎকার শুনেই ছুটে ঘর থেকে বেরোলো চার-পাঁচজন মানুষ। হাতে মাছ মারার বর্শা। দৌড়ে আসতে লাগলো এদিকে। কাছে এসে ওরাও চেঁচাতে শুরু করলো। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করছে সাগরের হাসিকে। হাত তুলে গুহাঁটা দেখিয়ে মেয়েটা আবার বললো, ফেকি!
পানির আরও কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো লোকগুলো, দ্বিতীয়ার বাঁকা চাঁদের মতো গোল হয়ে। ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিলো কিশোর আর মুসা। কিন্তু ঠেলে সরিয়ে দেয়া হলো ওদেরকে। মনে হলো বিপজ্জনক কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বেশি দূরে সরলো না গোয়েন্দারা। গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে রইলো কালো গুহাঁটার দিকে।
ঝট করে বেরিয়ে এলো একটা লম্বা লিকলিকে বাহু। আরেকটা। তারপর আরেকটা।
মোচড় দিয়ে উঠলো কিশোরের পেট। এই জীব আগেও দেখেছে সে, তবু চমকে গেল। কিলবিলে ওই কুৎসিত গুড়গুলো দেখলে অনেকেরই হয়, এরকম, জানা আছে তার, ওয়াপোকা দেখলে যেমন হয়। ঘেন্না লাগে, শিউরে ওঠে শরীর।
কাঁপতে কাঁপতে একটা শুঁড় উঠে এলো লোকগুলোর দিকে। লাফিয়ে কিশোরদের কাছে সরে এলো সাগরের হাসি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, টাটা-টা-টা! ছেলেদের দিকে চেয়ে হেসে বললো, ভয় লাগছে? আমরা ভয় পাই না। ও আমার ভাই। লম্বা, জোয়ান একটা লোককে দেখালো সে। দুর্দান্ত সাহসী। ঠিক মেরে ফেলবে। অনেক ফেকি মেরেছে। এটাকেও মারবে।
জীবটা কি? শরীরটা এখনও বেরোয়নি, আন্দাজ করতে পারছে কী, তবু জিজ্ঞেস করলো।
ফেকি! কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে অশুদ্ধ উচ্চারণে অনুবাদ করে দিলো সাগরের হাসি, ডেবিল ফিশ! ডেবিল ফিশ! ডেভিল ফিশ, অর্থাৎ শয়তান মাছ।
এই জীবের সঙ্গে লড়াইয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে মুসার, অথৈ সাগর অভিযানে যখন এসেছিলো। মরতে মরতে বেঁচেছিলো সেবার। দ্বিতীয়বার আর এর কবলে পড়তে চায় না। ওই শুঁড়ের ভয়ংকর ক্ষমতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলো সেবার। ভয়ে ভয়ে দেয়ালের দিকে পিছিয়ে গেল সে।
কিশোর নড়লো না। বেরিয়ে এলো শুঁড়ের চেয়ে কুৎসিত শরীরটা। জীবটাকে কেউ দেখে না থাকলে তার কাছে হরর ছবির ভয়াবহ দানব বলে সহজেই চালিয়ে দেয়া যাবে। মস্ত, কালচে-লাল একটা মাংসের দলা যেন। সেটা থেকে বেরিয়ে রয়েছে অসংখ্য আঁচিল, দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। মুখটা হাতির মুখের মতো, শুঁড় বাদ দিয়ে। গোল গোল বিশাল দুটো চোখ, শরীরের তুলনায় অনেক বড়, তাতে একধরনের শয়তানী উজ্জ্বলতা, এতোই কুৎসিত, না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। মোট আটটা বাহুঁ, হাতির শুঁড়ের মতো গুটিয়ে নিয়ে আবার লম্বা করে দিচ্ছে, একেকটা চোদ্দ-পনেরো ফুটের কম হবে না। লাফ দিয়ে এসে পড়লো একটা শুঁড়ের মাথা, কিশোরের কয়েক ফুটের মধ্যে। ভয় পেয়ে লাফিয়ে সরে গেল সে কয়েক পা। লোকগুলো সরছে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে একনাগাড়ে খুঁচিয়ে চলেছে ওদের পায়ের কাছে এসে পড়া শুঁড়গুলোকে।
পরোয়াই করছে না যেন বিশাল অকটোপাস। গর্ত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে পড়েছে, এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। একটা মানুষকে ধরতে পারলেই রাতের খাবার হয়ে যাবে তার। শিকার ধরতে গেলে কিছুটা আঘাত সইতেই হয়, কাজেই বর্শার খোঁচাগুলো হজম করে যাচ্ছে সে।
পানি থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেন উড়ে এসে কিশোরের পায়ের কাছে পড়লো একটা শুঁড়ের মাথা। ছুঁয়ে ফেললো পা। লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল কিশোর। জড়িয়ে ধরতে পারলে আর মুক্তি ছিলো না ওই গুঁড়ের কবল থেকে। ঠান্ডা ভেজা স্পর্শ। নিজের অজান্তেই গলা চিরে বেরিয়ে এলো চিৎকার। তার হাত ধরে একটানে সরিয়ে নিলো মুসা, দেয়ালের কাছে, শুঁড়ের নাগালের বাইরে।
ভোজালি দিয়ে এক কোপে শুঁড়ের মাথাটা কেটে আলাদা করে ফেললো একজন যোদ্ধা। টিকটিকির লেজের মতো কুৎসিত নাচ শুরু করলো কাটা অংশটা।
রাগে ব্যথায় ভীষণ খেপে গেল অকটোপাস। যে করেই হোক মানুষ শিকার করবেই, পণ করে ফেললো যেন সে। একসঙ্গে পানি ওপরে তুলে দিলো আটটা শুঁড়। এরই জন্যে অপেক্ষা করছিলো যোদ্ধারা। প্রচন্ড আক্রমণ চালালো। কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে লাগলো শুঁড়গুলো।
পানিতে মাথা তুলেছে অকটোপাস। যন্ত্রণায় শরীর মোচড়াচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে কাটা শুঁড়ের মাথা থেকে। রীতিমতো হরর ছবি। অনেকটা মানুষের মতো করেই গোঙাতে আরম্ভ করেছে মৃত্যু যন্ত্রণায়। শরীরের যেখানে সেখানে বর্শা বিদ্ধ হচ্ছে। আক্রমণ করছে না আর, অস্ত্রই নেই, করবে কি দিয়ে? অদ্ভুত আচরণ করছে। মুসার মনে হলো, অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত, বুঝে গেছে জীবটা। গর্তের ভেতরে থেকে লড়াইয়ের সময় অকটোপাসের বুদ্ধির যে পরিচয় পেয়েছিলো সে, তাতেই এরকমটা ভাবতে পারলো।
খোঁচানোর বিরাম নেই। যতো তাড়াতাড়ি শেষ করে দেয়া যায়, সেই চেষ্টা করছে যোদ্ধারা।
আনন্দে নাচতে শুরু করেছে সাগরের হাসি। ওকে খাবো! ওকে খাবো! মজার মাংস! মুসা আর কিশোরের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো হাততালি দিয়ে হাসতে লাগলো সে। তোমরাও খাবে!
তুমি খেয়ো। হাত নেড়ে বললো কিশোর, আমি এর মধ্যে নেই। বাপরে বাপ, কি বিচ্ছিরি! শুয়াপোকা এর চেয়ে অনেক সুন্দর!
মুসা কিছু বললো না। খাবারটা কেমন হয়, না দেখে আগেই মানা করে দিতে রাজি নয়।
পানি থেকে তোলা হলো মৃত অকটোপাসটাকে। ওখানেই কুপিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হতে লাগলো। সাগরের হাসিও যোগ দিলো সেই কাটাকাটিতে।
ঘন হয়ে আসছে গোধূলী। ঘরে ফিরে চললো কিশোর আর মুসা! কুঁড়েতে ফিরে দেখলো কথা বলছে ডজ আর ওমর। অকটোপাসের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা ওদেরকে বলতে যাবে, এই সময় পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে এলো চিৎকার, আসছে! আসছে!
জাহাজটাকে দেখতে পেয়েছে, ডজ বললো। চলো, দেখি, কতোটা এগোলো।
৪
বেশি দূরে যেতে হলো না। সৈকতেই এসে জড়ো হয়েছে গাঁয়ের লোক। উত্তেজিত হয়ে কলরব করছে। কয়েকজনের কথা শুনলো ডজ। ফিরে সঙ্গীদেরকে জানালো, অবাক কান্ড! কারনেই এসেছে। তবে এদিকে না এসে চলে গেছে কার আরেক ধারে। ওখানে নোঙর ফেলেছে। এটা ভাবা উচিত ছিলো আমাদের। এখানে জাহাজ ভেড়াতে সাহস করবে না, এ-তো জানা কথা। গায়ের লোকে ধরে খুন করে ফেলবে। এখুনি কয়েকজনে গিয়ে কাজটা সেরে আসতে চাইছে। আমি ওদের মানা করেছি। অন্তত আমরা যতোক্ষণ এখানে রয়েছি কোনো খুনখারাপি চলবে না।
তাহলে কি করা যায়? পরামর্শ চাইলো ওমর। ঘুরে যেতে হলে কতদূর?
হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। ঘুরে যেতে হলে ক্যানুতে চড়ে। তাতে পনেরোবিশ মাইলের কম হবে না।
শিস দিয়ে উঠলো ওমর। এতো? দ্বীপের মাঝখান দিয়ে সরাসরি গেলে?
সাত-আট মাইল। তবে যাওয়াটা অতো সোজা না। খানিক দূর গিয়েছিলাম একবার, পুরোটা যেতে পারিনি। যাওয়া যায় না তা নয়। তবে সাংঘাতিক কঠিন। যেতে হয় পাহাড় ডিঙিয়ে, তিন হাজার ফুট উঁচু। ভয়ানক বিপজ্জনক। শুধু যে পড়ে মরার ভয় আছে তা নয়, বুনো জানোয়ারও আছে।
এখানে বুনো জানোয়ার? মুসা অবাক।
মহাসাগর পেরিয়ে এই দ্বীপে জানোয়ার এলো কোত্থেকে? কিশোরও বুঝতে পারছে না।
এসেছে। ষাঁড় আর কুকুর। কুত্তাগুলো হলো সব চেয়ে খারাপ। আমি অবশ্য দেখিনি, শোনা কথা বলছি। একপাল শাদা কুত্তা নাকি বাস করে পাহাড়ে। হিংস্র। আগে পোষা ছিলো, ছাড়া থাকতে থাকতে বুনো হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে তিমি-শিকারীদের এক জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়েছিলো ওগুলোকে, ফেরার সময় ফেলে চলে গেছে জাহাজের মালিক। গরুও বোধহয় অনেক আগে ওভাবেই ফেলে যাওয়া হয়েছে। আশপাশের অনেক দ্বীপে বনবেড়াল আছে, আগে পোষা ছিলো। ফেলে যাওয়ার পর বনে থাকতে থাকতে বন্য হয়ে গেছে।
হুঁ, ওমর বললো। ওসব জানোয়ারকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যাওয়া যাবে কিনা তাই বলো। কারনেসকে ঠেকাতেই হবে। ছেলেটাকে অন্তত কেড়ে রেখে দেয়া উচিত।
দেখি, অশান্ত সাগরকে জিজ্ঞেস করে। মোড়লের কাছে এগিয়ে গেল ডজ। কথা বলে ফিরে এলো। বললো, হ্যাঁ, যাওয়া যাবে বলছে। তবে পথ খুব খারাপ। গাইড হিসেবে তার কয়েকজন লোক দিতেও রাজি হয়েছে।
তাহলে তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া দরকার। অস্ত্র-টস্ত্র নেবো নাকি? রাইফেল?
বেশি বোঝা নিলে অসুবিধে হতে পারে। যা দরকার শুধু তা-ই। আমরা তো আর যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। পিস্তল নিলেই যথেষ্ট।
বেশ। মোড়লকে বলো এখুনি রওনা হতে চাই আমরা।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই রওনা হলো ওরা। সঙ্গে চললো ছয়জন যোদ্ধা। মশাল জ্বেলে নিয়েছে। দেখতে দেখতে চলে এলো পাহাড়ের গোড়ায়। আঁকাবাকা পাহাড়ী পথ ধরে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলো। দুপাশে ঘন জঙ্গল। মশালের আলোয় আরো বেশি ঘন লাগছে, মনে হচ্ছে লতাপাতার দুর্ভেদ্য দেয়াল। এর মধ্যে প্রবেশ করা যাবে না।
কিছুদূর এগোনোর পর হাতে একটা আলতো ছোঁয়া পেলো মুসা। তার বাহু খামচে ধরলো নরম একটা হাত। অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলো, সাগরের হাসি। হাসলো। মশালের আলোয় ঝিক করে উঠলো শাদা দাঁত। এলাম।
মেয়েটার খালি পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো মুসা। যে হারে ধারালো পাথর খোঁচা খোঁচা বেরিয়ে রয়েছে, তাতে জুতো না থাকলে কেটে পা ফালাফালা হয়ে যাওয়ার কথা। বললো, কেটে যাবে তো!
কাটবে না, হেসে বললো সাগরের হাসি। কতো উঠলাম। প্রবালের ওপর দিয়েও হাঁটতে পারি খালি পায়ে।
পাশাপাশি চলছে কিশোর। বিশ্বাস করলো কথাটা। কথা শুনে ফিরে তাকিয়ে ওমর বললো, এই, তুমি এসেছো কেন?
আসুক, ডজ বললো। ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। বিপদে ফেলবে ভাবছো তো? ফেলবে না। বরং সাহায্য করবে। ঝিনুক ওর বন্ধু। ও যাবেই। বলেও ফেরাতে পারবে না।
আর কিছু বললো না ওমর। মশালের আলোয় জঙ্গল দেখতে দেখতে চললো। বুনো ফুল ফুটে আছে। অর্কিডের অভাব নেই, অনেক জাতের, অনেক ধরনের। একধরনের দানবীয় পাতাসর্বস্ব গাছ জন্যে রয়েছে, এর নাম কুমারীর চুল। ওই চুলের মাঝে বিচিত্র অলংকরণ সৃষ্টি করেছে অর্কিডগুলো। কিছু লতানো অর্কিড ঝুলে রয়েছে বড় গাছের ডাল থেকে। হাজারে হাজারে গিনিপিগ রয়েছে। হুটোপুটি করছে, ছুটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে।
যতোই উঠছে খাড়া হচ্ছে আরও পথ। দুপাশে খাড়া হয়ে আছে পাহাড়ের দেয়াল, গিরিপথের মতো লাগে। কখনও হঠাৎ করে শেষ হয়ে যাচ্ছে দেয়াল, তার পরে রয়েছে গভীর গিরিখাত। পড়লে ছাতু হয়ে যেতে হবে। কখনও পথ মোড় নিচ্ছে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে। নারকেল আর রুটিফল গাছ পড়ে আছে অনেক নিচে, এখানে উঠতে পারেনি। আরেকটু এগিয়ে বড় বড় পাথরের চাঙরের ভেতরে হারিয়ে গেছে পথ। কখনো তার ভেতরে ঢোকা যায়; কখনো যায় না। তখন এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে হয়।
একটা খোলা জায়গা পেরোনোর সময় নিচে তাকালো কিশোর। অদ্ভুত একটা শৈলশিরা চোখে পড়লো। ধারের ওপরটা করাতের দাঁতের মতো হয়ে আছে। আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ছিলো ওটা একসময়, বুঝতে পারলো। আরো অনেক নিচে পানিতে ভাসতে দেখা যাচ্ছে বিমানটাকে, ওটার রূপালি ডানায় চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। বিমান আর মনে হচ্ছে না এখান থেকে, এতোই ছোট দেখাচ্ছে। বরং মনে হয় পানিতে ভেসে আছে ডানা মেলে দেয়া কোনো নিশাচর পতঙ্গ। লেগুনের বাইরে সাগরকে লাগছে রূপালি চাদরের মতো। পানি বলে মনে হয় না। যেন এই পৃথিবীর কোনো কিছু নয় ওসর, অপার্থিব।
উঠেই চলেছে পথ। অনেক পাহাড়ে চড়েছে মুসা, কিন্তু এরকম পাহাড় আর দেখেনি। মনে হয় যেন পৃথিবীর বুকের বিশাল এক ফোড়া ফেটে গিয়েছিলো। পুঁজের বদলে বেরিয়ে এসেছিলো পাথর। সেসব ছড়িয়ে রয়েছে। আর ফোঁড়ার মুখের কাছটা বিকৃত হয়ে গেছে।
পথ এখানে সরু। একপাশে গভীর খাদ। পাশাপাশি চলার আর উপায় নেই। একসারিতে এগিয়ে চলেছে মশালধারীরা। শুধু তাদের দিকে চোখ রেখে এগিয়ে চলেছে কিশোর। পাশে খাদের দিকে তাকাতে সাহস করছে না। যদি মাথা ঘুরে পড়ে যায়?
কিশোরের মনের অবস্থা কি করে জানি টের পেয়ে গেছে সাগরের হাসি। হাসতে লাগলো সে। পাহাড়ী ছাগলের মতো আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় হালকা পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না।
একটা জায়গায় এসে সমতল হয়ে গেছে খানিকটা জায়গা। তার ওপাশ থেকে নামতে আরম্ভ করেছে পথ। দ্রুত নেমে গেছে পেয়ালা আকৃতির একটা খাদের মধ্যে। কোনো গাছপালা নেই তাতে। ওটাই মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের নিচের গহ্বর, অনুমান করতে পারলো কিশোর। ওখানে নেমে থামলো যোদ্ধারা। বিশ্রাম নিতে। মশালের আলোও নিভু নিভু হয়ে এসেছে। থামতে পেরে খুব খুশি হলো কিশোর।. গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। দরদর করে ঘামছে।
কিন্তু শুয়েও সারতে পারলো না, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে হলো আবার। রক্ত জমাট করা একটা চিৎকার শুনতে পেয়েছে। নেকড়ের ডাকের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। যোদ্ধারাও উঠে পড়েছে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, কুকুর! কুকুর! ভয় পেয়েছে ওরা।
খাইছে! বলে সাগরের হাসির হাত ধরে একটানে তাকে পেছনে সরিয়ে দিলো মুসা। পিস্তল বের করলো।
ওমরও পিস্তল বের করে ফেলেছে। ওই যে! এসে গেছে! তাকিয়ে রয়েছে কুকুরগুলোর দিকে। চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে লাগছে শাদা জানোয়ারগুলোকে। সোজা ছুটে আসছে এদিকেই।
গুলি করলো সে। প্রায় তার গায়ের ওপর এসে পড়লো একটা মৃত জানোয়ার।
গুলি করেই সাগরের হাসিকে টেনে নিয়ে একপাশে সরে গেল মুসা। গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে কুকুরগুলো। মানুষকে ধরতে পারলে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
কিশোর আর ডজও গুলি চালাতে লাগলো।
রুদ্ধ জায়গায় প্রচন্ড শব্দ হতে লাগলো গুলির। প্রতিধ্বনি উঠতে লাগলো। সেই সঙ্গে কুকুরের আর্তনাদ আর গর্জন। নরক গুলজার শুরু হয়ে গেল যেন।
মশালগুলো জ্বালিয়ে ফেলেছে আবার যোদ্ধারা। শুকনো ঘাস জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দেখতে দেখতে ঘাসের একটা চক্র তৈরি করে ফেললো ওরা। আগুন লাগালো। তার মধ্যে ঢুকে পড়তে অনুরোধ করলো অভিযাত্রীদেরকে।
ঢুকে পড়লো সবাই। আগুনের বৃত্তের বাইরে এসে থেমে গেল কুকুরগুলো। চারপাশ ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়লো। লম্বা টকটকে লাল জিভ বের করে দিয়েছে। ঝুলছে ওগুলো, লালা গড়াচ্ছে। কয়েক মিনিট মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকলো ওগুলো। আগুন পেরিয়ে এসে ধরতে পারবে না বুঝে অন্য কাজে মন দিলো। মরা আর আহত সঙ্গীদেরকে ছিড়ে ছিড়ে খেতে শুরু করে দিলো। মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে মানুষদের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচাচ্ছে। জানোয়ারগুলোর হিংস্রতা দেখে গায়ে কাঁটা দিলো কিশোরের।
এখন কি করবো? জিজ্ঞেস করলো ওমর।
যোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ডজ। ফিরে তাকিয়ে বললো, ওরা বলছে, নতুন করে মশাল বানিয়ে নেবে। আগুনকে ভয় পায় কুকুরগুলো। এগোতে সাহস করবে না।
কিছু একটা করা দরকার, গম্ভীর হয়ে বললো ওমর। এভাবে আটকে থাকলে কারনেস ওদিকে চলে যাবে।
আরেক ধরনের মশাল বানাতে শুরু করলো যোদ্ধারা। শুকনো ঘাসকে শক্ত করে পাকিয়ে নিয়ে লাঠির মাথায় বাঁধলো। যে ঘাস তুলছে, তাকে আগের মশাল নিয়ে পাহারা দিলো অন্যেরা। তবে ওদের দিকে এখন আর তেমন খেয়াল নেই কুকুরগুলোর। ভোজে ব্যস্ত। মশাল বানানো শেষ করার পর এলো কুকুর তাাড়নোর পালা। যোদ্ধারা শুকনো ডালের মাথায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারতে শুরু করলো ওগুলোর দিকে। সেই সঙ্গে পাথর। কয়েক রাউন্ড গুলিও চালানো হলো, মেরে ফেলা হলো আরও কয়েকটাকে।।
এই বার ঘাবড়ালো কুকুরের পাল। পালালো। পেছনে মশাল হাতে তেড়ে গেল যোদ্ধারা। তবে বেশি দূর গেল না। কুকুরগুলো আবার সাহসী হয়ে উঠলে মুশকিল।
রওনা হলো আবার ওরা। জ্বালামুখটা পেরিয়ে এলো দ্রুত। ঝপ করে যেন হঠাৎ নিচে নেমে গেছে পথটা। সামনে আবার আরম্ভ হয়েছে জঙ্গল। পায়ের নিচে এখন নরম শ্যাওলা। হাঁটছে ওরা আর বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। আর কোনো সাড়া নেই কুকুরগুলোর।
বেশ সুন্দর একটা ফুল দেখতে পেলো মুসা। পাপড়িগুলো কেমন পালকের মতো ছড়িয়ে গেছে, কোমল মনে হচ্ছে দেখে। হাত বাড়িয়ে সেটা ছিড়তে গেল, সাগরের হাসিকে উপহার দেয়ার জন্যে। খপ করে তার হাত চেপে ধরলো মেয়েটা সরিয়ে আনতে আনতে বললো, পাকে!
ডজও দেখলো ফুলটা। ছুঁয়ো না। ওটা পাকে!
পাকেটা কি জিনিস? জানতে চাইলো কিশোর।
ছুঁয়ে দেখ, তাহলেই বুঝবে। জীবনে ভুলবে না আর। আগুনের পোড়ার মতো জ্বলতে শুরু করবে। বিছুটি এর কাছে কিছু না।
ঠিকই বলেছিলো ডজ, স্বর্গেও সাপ থাকে-ভাবলো কিশোর। দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলো খুব সুন্দর, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মাঝেও এমন সব ব্যাপার রয়েছে, যা অনেক ভালো লাগাকেই ম্লান করে দেয়।
আরও ঘণ্টাখানেক একনাগাড়ে হাঁটলো ওরা। শেষ দিকে নামলো হুড়মুড় করে বৃষ্টি। নারকেল গাছের এলাকা শুরু হয়েছে তখন। থেমে মশাল নিভিয়ে ফেললো যোদ্ধারা। ডজকে একজন বললো, এর বাইরে বেরোলেই সৈকত, শুনেছি।
আমি আগে যাই, ওমর বললো। দেখে আসি। বলেই হাঁটতে আরম্ভ করলো। হারিয়ে গেল নারকেল কুঞ্জের ভেতরে। ফিরে এলো একটু পরেই। ঠিকই। জাহাজটা দেখে এলাম। তীর থেকে শখানেক গজ দূরে। আলো একটা জ্বলছে বটে, তবে কোনো সাড়াশব্দ নেই। লোকগুলো জাহাজে আছে না ডাঙায় বুঝতে পারলাম না। ছোট একটা গা দেখে এলাম পানির কিনারেই। ওখানে গিয়ে থাকতে পারে।
আমার মনে হয় না কারনেস গিয়েছে, ডজ বললো। গেলে তার সাগরেদরা গিয়েছে। সে জাহাজেই রয়ে গেছে। লোকগুলো গায়ে মদ খেতে গেছে।
মদ? মুসার প্রশ্ন।
হ্যাঁ। নারকেলের ফুল থেকে তৈরি করে এখানকার লোকে।
তাই নাকি! নারকেলের ফুল থেকে মদ…
ব্রান্ডির চেয়ে কোনো অংশে খারাপ না…
আচ্ছা, মদের আলোচনা বাদ দাও এখন, হাত নেড়ে বাধা দিলো ওমর। কাজের কথা বলো। কারনেসটার একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার। যেমন কুকুর তেমন মুগুর পেটা করা উচিত। তবে আগেই কিছু করবো না। যদি শয়তানী করে, তাহলে। সৈকতে কিছু ক্যানু দেখে এলাম। একটায় করে জাহাজে গিয়ে তাকে সোজাসুজি বলতে হবে ঝিনুককে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে। এক ক্যানুতে করেই আমরা সবাই যেতে পারবো। আমি কারনেসকে সামলাবো। কিশোর, তুমি আর মুসা পাহারায় থাকবে, সাগরেদগুলো ফিরে আসে কিনা দেখবে। ডজ, তুমি থাকবে নৌকায়। যোদ্ধাদেরকে বলো, আমরা না ফেরাত যেন এখানেই থাকে।
আবার সৈকতের দিকে রওনা হলো ওমর। নারকেল কুঞ্জের ভেতর থেকে বেরোনোর আগেই চোখে পড়ে ঝলমলে সাগর। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে গলিত রূপা। তার পেছনে এলো অন্য তিনজন।
নীরব নির্জন সৈকত। জীবনের চিহ্ন নেই। খোলা জায়গায় বেরোলো না ওরা, একধারে কয়েকটা রুটিফল গাছ জন্মে রয়েছে, তার নিচে এসে দাঁড়ালো। গাঁয়ের উঠনে আগুনের কুন্ড জ্বলছে। শুধু ওই আগুন আর স্কুনারটা প্রমাণ করছে যে এখানে মানুষ আছে। গাছের ছায়ায় ছায়ায় নীবে এগিয়ে চললো ওরা, ক্যানুগুলোর দিকে। বালির ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে ওগুলো। একটা ক্যানু টেনে নামালো চারজনে মিলে। পানিতে পড়েই টলে উঠলো ওটা। জীর্ণ দশা। মেরামত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সবগুলো ক্যানুর একই অবস্থা। কিশোরের ভয়ই হলো, চারজনে উঠলে না ডুবে যায়। তবে ডুবলো না নৌকাটা। সাবধানে দাঁড় বাইতে শুরু করলো ওমর আর মুসা। জাহাজের দিকে এগিয়ে চললো যতোটা সম্ভব কম শব্দ করে আর ঢেউ না তুলে। আস্তে করে এসে স্কুনারের গায়ে ভিড়লো নৌকা। মুসার তুলে রাখা দাঁড়ের পানি ফোটা ফোটা ঝরছে, তার শব্দও কানে আসছে, এতোই নীরব হয়ে আছে চারপাশ।
বেয়ে ওপরে উঠে গেল ওমর। তার পেছনে উঠলো মুসা আর কিশোর। ডজ নৌকায় বসে রইলো।
থাকো, ফিসফিস করে বললো ওমর। পিস্তল তো আছে। গুলি চালাতে দ্বিধা করবে না।
দেখেশুনে করবেন, নীরবে হাসলো মুসা। আমাদের গায়ে আবার লাগিয়ে দেবেন না।
কম্প্যানিয়ন ওয়ের দিকে চললো তিনজনে। সবে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছেছে। ওরা, এই সময় গর্জে উঠলো একটা কণ্ঠ, কে?
যে কেবিন থেকে কথা বলেছে লোকটা, একটানে ওটার দরজা খুলে ফেললো ওমর। নাকেমুখে এসে ধাক্কা মারলো যেন তামাকের ধোঁয়া আর কড়া মদের গন্ধ। হ্যারিকেন জ্বলছে। ধোঁয়ার জন্যে ছড়াতেই পারছে না হলদেটে আলো, অন্ধকার কাটেনি। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। তার ওপরে একটা চার্ট বিছিয়ে দেখছে কারনেস। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো সে। দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওমর, যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এটা। আচমকা গাল দিয়ে উঠে এক ধাক্কায় একপাশে সরিয়ে দিলো টেবিলটা। খেঁকিয়ে উঠলো, এখানে কি?
তোমার কাছেই এসেছি, কঠিন গলায় জবাব দিলো ওমর। সেই রাটুনা ছেলেটাকে চাই।
তাই নাকি? রাগে ফুসতে শুরু করলো কারনেস।
হ্যাঁ, তাই। আসতে বলবে, নাকি আমরাই গিয়ে ডেকে আনবো?
তোমাকে তোমাকে আমি…
বুঝেছি। আমরাই ডেকে নিয়ে যাচ্ছি। এই কিশোর, ছেলেটা কোথায় দেখ তো?
ঝিনুকের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সরু করিডর ধরে এগোলো কিশোর। কয়েকবার ডাকতেই সাড়া এলো দুর্বল কন্ঠে। একটা দরজার সামনে এসে থামলো কিশোর। ওটার ভেতর থেকেই শব্দটা এসেছে। কিন্তু দরজায় তালা দেয়া। ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ঝিনুক, তুমি ভেতরে আছো?
আছি।
করিডরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জুতোসহ একটা পা পাল্লার ওপরে তুলে দিলো কিশোর। তারপর ঠেলা দিলো। হলো না কিছু। আরো জোরে ঠেলতে লাগলো। চাপ সইতে না পেরে তালা ছুটে গিয়ে ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পাল্লা। নাকে এসে লাগলো দুর্গন্ধ। কিছু দেখতে পাচ্ছে না অন্ধকারে। পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বাললো। মেঝেয় বসে আছে একটা ছেলে।
তোমার নাম ঝিনুক? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ। আমি ঝিনুক।
গুড। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। এসো, ওঠো।
দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। ঘর থেকে বেরিয়ে কিশোরের পেছন পেছন চললো।
এই যে, নিয়ে এসেছি, ওমরকে বললো কিশোর। দরজায় আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে ওমর। হাতে পিস্তল।
খাঁচায় আটকা জানোয়ারের মতো আচরণ করছে কারনেস। মুখ খারাপ করে গালাগাল করছে। হুমকি দিচ্ছে বার বার।
এবার ছেড়ে দিলাম, ওমর বললো। আর যদি দেখি কখনও শয়তানী করেছে, এমন শিক্ষা দেবো তোমাকে বুঝবে তখন। বরফের মতো শীতল হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠ। ঘর থেকে বেরোবে না বলে দিলাম। তোমার মাথা দেখলেই গুলি চালাবো আমি, মনে রেখো। কিশোরকে নির্দেশ দিলো, ছেলেটাকে নৌকায় নিয়ে যাও।
ডেকের কিনারে এসে দেখলো ওরা, তীরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ডজ। আরেকটা নৌকা নামানো হয়েছে। অনেকগুলো ছায়ামূর্তি নড়ছে তাতে। কারনেসের সাগরেদরা ফিরে আসছে, নিচু গলায় বললো সে। কি করবো? দেখলে গন্ডগোল করবেই।
না, করবে না, বলে উঠলো আরেকটা কোমল কণ্ঠ। ক্যানুর কিনার থেকে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো কিশোর, চাঁদের আলোয় সাগরের হাসির হাসি হাসি মুখটা। বললো, আরে তুমি। তুমি এখানে কি করছো?
দেখাচ্ছি, বলেই ডুব দিলো মেয়েটা। খুব হালকা একটা আলোড়ন তুলে তলিয়ে গেল মাছের মতো।
নৌকায় নামো, নির্দেশ দিলো ওমর। সৈকতে ফেরা দরকার।
ওদের ক্যানুটা এগোতে লাগলো সৈকতের দিকে, অন্য ক্যানুটা আসছে জাহাজের দিকে। দ্রুত। ডেকে বেরিয়ে এসেছে কারনেস। চেঁচিয়ে আদেশ দিলো তার সাগরেদদেরকে। আঞ্চলিক ভাষায়।
কি বললো, ব্যাটা? ডজকে জিজ্ঞেস করলো ওমর।
আমাদেরকে ডুবিয়ে দিতে বললো।
চেষ্টা করেই দেখুক।
তবে লড়াইটা আর হলো না। কারনেসের আদেশ পালন করার জন্যে ঠিকই তৈরি হয়েছিলো তার লোকেরা। নৌকার মুখও ঘুরিয়েছিলো কিশোরদের ক্যানুর কয়েক গজের মধ্যে এসে। কিন্তু হঠাৎ করেই এমন একটা কান্ড ঘটলো, যা কল্পনাও করতে পারেনি বিরোধী দল। পানিতে ঝপ করে একটা শব্দ হলো। মড়মড় করে উঠলো নৌকার পচা কাঠ। পরক্ষণেই কাত হয়ে গেল ক্যানুটা। একে অন্যের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়লো লোকগুলো। পর মুহূর্তেই পানিতে। চেঁচাতে শুরু করলো ওরা। তাদের চিৎকারকে ছাপিয়ে পানির ওপরে ছড়িয়ে পড়লো যেন মেয়েলী কণ্ঠের খিলখিল হাসি।
টা-টা-টা-টা! চেঁচিয়ে উঠলো ঝিনুক। অকটোপাস মারার সময় সাগরের হাসিকেও এরকম শব্দ করতে শুনেছে কিশোর, অনুমান করলো বেশি উত্তেজিত কিংবা আনন্দিত হলেই বোধহয় ওরকম শব্দ করে এখানকার লোকে। ঝিনুক বলছে, দিয়েছে। নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছে সাগরের হাসি! সে-ও ঝাপ দিলো পানিতে।
কিশোর আশা করলো, তার মাথাটা ভেসে উঠবে এখনই। উঠলো না। সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক, কারো মাথাই আর দেখতে পেলো না।
মুসাও খুঁজছে দুজনকে। না দেখে বললো, খাইছে! ডজ, ঠিকই বলেছিলেন! এগুলো মানুষ না, মাছ!
জাহাজের দিকে সাঁতরাতে শুরু করেছে কারনেসের সাগরেদরা। এছাড়া আর কিছু করারও নেই ওদের, জানে এখন ওমরদেরকে ধরতে এলে হয় বৈঠার বাড়ি খাবে, কিংবা পিস্তলের গুলি। ছুরির খোঁচা খাওয়ারও আশঙ্কা আছে। কে যায় শুধু শুধু মরতে।
নিরাপদেই তীরে পৌঁছলো অভিযাত্রীরা। ঝিনুক আর সাগরের হাসির জন্যে অপেক্ষা করবে ভেবেছিলো, কিন্তু ডাঙায় উঠে দেখলো ওরা দুজনই ওদের অপেক্ষায় রয়েছে।
যাক, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো ওমর। যা করতে এসেছিলাম, করেছি। এবার বাড়ি ফেরা যাক।
গায়ের দিক থেকে এগিয়ে এলো কয়েকজন লোক। তবে খারাপ লোক মনে হলো না ওদেরকে। মারমুখো হয়ে আসেনি। ঝিনুক আর সাগরের হাসির সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে আবার ফিরে চললো ওরা।
নিজের দলকে নিয়ে রওনা হলো ওমর, যোদ্ধারা যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে। ঝিনুককে দেখে খুব খুশি হলো ওরা।
অনেক পরিশ্রম করেছে। খানিকক্ষণ জিরাতে বসলো কিশোররা। সবাইকে বিস্কুট আর চকলেট ভাগ করে দিলো ডজ। খেতে খেতে ঝিনুককে জিজ্ঞেস করলো, কারনেস শয়তানটা তোমাকে অনেক প্রশ্ন করেছে, না?
করেছে। কোন দ্বীপে আপনাকে পাওয়া গেছে জানতে চেয়েছে বার বার।
বলেছো?
না। বলেছি, অনেক দূরে। বিশ্বাস করেনি। আমাকে মিথুক বলেছে। মেরেছে। ধমক দিয়েছে, না বললে একেবারে মেরে ফেলবে।
হয়েছে, আর কিছু করতে পারবে না, ছেলেটার কাঁধ চাপড়ে দিলো ডজ।
ঢাল বেয়ে যখন পাহাড়ে চড়ছে ওরা, তখনও মৃদু ভাবে কানে আসতে থাকলো কারননসের চেঁচামেচি।
আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে ভোর হয়ে গেল। বোধহয় একারণেই কুকুরগুলোর আর কোনো সাড়াশব্দ পেলো না এখানে এসে। যদিও মশাল জ্বেলে তৈরিই রয়েছ যোদ্ধারা। দিনের আলোয় পথ চলতেও সুবিধে। পাহাড়ের যেসব জায়গা ভয়াবহ মনে হয়েছিলো রাতের অন্ধকারে, এখন আর ততোটা বিপজ্জনক লাগছে না। চলার গতিও বাড়লো।
অবশেষে নারকেল কুঞ্জে ঘেরা গায়ে প্রবেশ করলো ওরা। ঝিনুককে দেখে এমন কান্ড শুরু করলো গায়ের লোকে, এমন করে স্বাগত জানাতে লাগলো, যেন কবর থেকে ফিরে এসেছে সে।
অনেক পরিশ্রম করেছে। অভিযাত্রীরা সবাই ক্লান্ত! কারনেসের স্কুনারটা ফিরে আসতে পারে, আবার কোনো শয়তানীর চেষ্টা করতে পারে সে। অশান্ত সাগরকে কড়া নজর রাখার ব্যবস্থা করতে বলে তিন সহকারীকে নিয়ে কুঁড়েতে এসে ঢুকলো ওমর। ঘুমাতে হবে। ডজ আইল্যান্ডে যাওয়াটা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলো আগামী দিন ভোর পর্যন্ত।
৫
চমকে জেগে গেল কিশোর। কানে আসছে চিৎকার। কিছুই বুঝতে না পেরে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে ছুটলো। মনে হচ্ছে কোনো গোলমাল হয়েছে। দরজা থেকেই সৈকত চোখে পড়ে। ভোর হয়ে গেছে। পুবের আকাশ লাল। মৃদু বাতাসে যেন অস্বস্তি বোধ করছে, এমনি ভঙ্গিতে কাঁপছে নারকেল পাতা। লেগুনের পানি শান্ত। আগের জায়গাতেই ভাসছে ফ্লাইং বোট। একটা নড়াচড়া চোখে পড়তেই ঝট করে তাকালো সেদিকে। সৈকত ধরে দৌড়ে আসছে সাগরের হাসি। আসছে! আসছে! চিৎকার করছে সে, শয়তানটা আসছে!
কি হয়েছে? ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলো ওমর। উঠে পড়েছে বিছানা ছেড়ে। জ্যাকেট চড়াচ্ছে গায়ে।
কারনেস আসছে বলে!
দুই লাফে দরজার কাছে চলে এলো ওমর। কই?
দেখতে তো পাচ্ছি না।…হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই যে! পাথরের দেয়ালটার দিকে দেখালো কিশোর। লেগুনে ঢোকার মুখে খুদে একটা দ্বীপ পড়ে। ওটার পেছনে দেখা যাচ্ছে স্কুনারের পাল। সব কটা পালই ফুলে উঠেছে ভোরের বাতাসে। সাগরের পানিতে রাজহাঁসের মতো স্বচ্ছন্দে ভেসে চলেছে জাহাজ। আরেকটু এগিয়ে ঘুরে গেল ওটার নাক। ঢুকে পড়লো লেগুনে। সোজা এগিয়ে আসতে লাগলো সৈকতের দিকে।
করছে কি? পাল নামায় না কেন? কাঁধের ওপর দিয়ে বললো ডজ। সে-ও এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে।
খাইছে! ওটা… মূসার কথা শেষ হওয়ার আগেই কিশোরও বুঝে ফেললো। চেঁচিয়ে উঠলো, প্লেনটাকে ভাঙতে যাচ্ছে! ধাক্কা মারবে!
একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো সে। তারপরেই নড়ে উঠলো। মুসা, এসো! বলেই সৈকতের দিকে দৌড় দিলো কিশোর। যেখানে ক্যানুগুলো রয়েছে। ওদের পেছনে ছুটলো সাগরের হাসি।
ধরো, ধরো, হাত লাগাও! একটা ক্যানুকে টানতে শুরু করলো কিশোর, পানিতে নামানোর জন্যে। বেজায় ভারি। বললো, নাহ! নামানো যাবে না! বলে একটা মুহূর্তও আর দেরি না করে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়লো। কিছুই বুঝতে না পেরে মুসাও নামলো তার সঙ্গে। সাগরের হাসিও নামলো।
বিমানটার দিকে সাঁতরাচ্ছে কিশোর। পাশে চলে এলো মুসা আর সাগরের হাসি। কিশোরের চেয়ে ভালো সাঁতরায় মুসা, তার চেয়েও অনেক ভালো সাগরের হাসি, একেবারে মাছের মতো। মুসা জিজ্ঞেস করলো, কি করবে?
নোঙরের দড়িটা কেটে দিতে হবে! হাঁপাতে শুরু করেছে কিশোর। মুসা, জলদি!
আমি যাচ্ছি, বলেই গতি বাড়িয়ে দিলো সাগরের হাসি। পানির ওপর দিয়ে পিছলে চলে যেতে লাগলো যেন। অনেক পেছনে পড়ে গেল মুসা আর কিশোর।
একশো গজ দূরে রয়েছে বিমানটা। কিশোরের মনে হলো, কয়েক মাইল। জাহাজটার আগে সে কিছুতেই পৌঁছতে পারবে না, বুঝে গেছে। মুসাও না। সাগরের হাসিই এখন একমাত্র ভরসা। ওরা অর্ধেক যাওয়ার আগেই পৌঁছে গেল মেয়েটা। নোঙরের দড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে। কোমর থেকে ছুরি টেনে নিয়ে কাটতে শুরু করলো দড়ি। ভোরের রোদে ঝিক করে উঠছে ছুরির ফলা। জাহাজটাও প্রায় পৌঁছে গেছে। ভালো বাতাস পেয়েছে। ফুলে উঠছে সব কটা পাল।
সাগরের দিক থেকে বইছে বাতাস, দড়ি কাটা হয়ে গেল। বিমানটাকে ঠেলে নিয়ে আসতে লাগলো তীরের দিকে। নাক ঘোরাতে শুরু করলো হোয়াইট শার্ক। ধাক্কা মারবেই, যে করেই হোক।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কিশোর। ঝড়ের গতিতে চিন্তা চলছে মগজে। কিছু একটা করা দরকার, কিছু একটা…আবার সাঁতরাতে শুরু করলো সে বিমানের দিকে। জাহাজের ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করে চলে এলো বিমানের কাছে। নোঙরের দড়িটা চেপে ধরলো। মুসাকে বললো, ধরো! দড়িটা ছেড়ে দিয়েই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো একটা উইং ফ্লোট। যেগুলোর ওপর ভর করে পানিতে ভেসে থাকে ফ্লাইং বোট। একপাশে কাত হয়ে গেল বিমান। পরোয়াই করলো না সে। মুসা দড়ি ধরেছে কি না সেটাও দেখতে গেল না। ফ্লোট থেকে এক ডানার ওপরে চড়লো। নাকের ওপর বসে জাহাজটার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সাগরের হাসি। কি করবে বুঝতে পারছে না। ডানার ওপর দিয়ে দৌড় দিলো কিশোর। মেয়েটাকে চুপ করে বসে থাকতে বললো। পিঠের ওপর দিয়ে পার হয়ে এসে নামলো আরেক ডানায়। চলে এলো ডানার একেবারে প্রান্তে। ওদিক দিয়েই এগোচ্ছে স্কুনারটা। লোহায় বাঁধানো গলুইয়ের একটা ধাক্কা লাগলেই চুরমার হয়ে যাবে ফ্লাইং বোট। ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে পারলে সরিয়ে নেয়া যেতো, কিন্তু সময় নেই। কারনেসও বুঝতে পারছে সেটা। হুইল ধরে দাঁড়িয়েছে। মুখে কুৎসিত হাসি। নিশ্চিত হয়ে গেছে, তারই জিৎ হবে।
তবে একটা ব্যাপার সে জানে না, যেটা কিশোর জানে। উইং ফ্লোটের ওপর খুব হালকা হয়ে ভাসে ফ্লাইং বোট। একটা বাচ্চা ছেলেও টেনে ওটাকে সহজেই সরিয়ে ফেলতে পারে। তবে কোনো কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে। দাঁড়ানোর মতো সেরকম কোনো জায়গা পায়নি কিশোর। তাই বিমানের ওপরই দাঁড়িয়েছে।
নোঙরের দড়ি ধরে রেখেছে মুসা। কিশোরের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে। ধাক্কা দেয়ার আগেই দু হাত বাড়িয়ে স্কুনারের গলুইয়ের নিচেটা ধরে ফেলতে চায় কিশোর। তাহলে আর বিমানের গায়ে ধাক্কা লাগবে না। জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে বিমানটাও সরতে থাকবে।
দুরুদুরু করছে কিশোরের বুক। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে গলুইয়ের নিচের লোহাবাঁধানো জায়গাটার দিকে। ঠেকাতে পারবে তো? চট করে তাকালো একবার জাহাজের নোঙরটার দিকে। কাদা লেগে রয়েছে। পানি ঝরছে ফোটা ফোটা। বলা যায় না, রেগে গিয়ে ওটা তার মাথার ওপরে ছেড়ে দিতে পারে কারনেস।
দুই পা ফাঁক করে শক্ত হয়ে দাঁড়ালো কিশোর। এসে গেছে গলুই। ধাক্কা প্রায় লাগে লাগে এই সময় হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো গলুইয়ের নিচের অংশ। প্রচন্ড একটা ঝাঁকুনি লাগলো। পলকের জন্যে মনে হলো তার, পায়ের নিচ থেকে পিছলে সরে যাচ্ছে বিমানের ডানা। দুলুনিতে পড়ে যাচ্ছিলো সে আরেকটু হলেই। কোনোমতে সামলে নিয়ে জোরে এক ঠেলা মারলো জাহাজের গায়ে। জাহাজ সরলো না, সেটাকে সরানোর চেষ্টাও করেনি সে, পায়ের ধাক্কায় বিমানটাই বরং সরলো। এবার আর তাল সামলাতে পারলো না কিশোর। মাথা নিচু করে পড়ে গেল পানিতে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো কানের ভেতর। বিশাল একটা ছায়া উঠে আসছে মাথার ওপরে। ডাইভ দিয়ে নিচে নেমে যেতে লাগলো সে। বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি করছে ফুসফুস। ফেটে যাবে যেন। কিন্তু ওঠার উপায় নেই। জাহাজের তলায় বাড়ি লেগে ছাতু হয়ে যাবে খুলি। হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করে ছায়াটার নিচ থেকে সরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো সে। সে সরলো, না ছায়াটাই সরলো, বলতে পারবে না। সুযোগ পেয়েই উঠতে শুরু করলো ওপরে। যখন মনে হলো, আর টিকবে না ফুসফুসটা, ঠিক ওই মুহূর্তে ভুস করে মাথাটা ভেসে উঠলো ওপরে। হাঁ করে শ্বাস টানতে শুরু করলো সে।
দীর্ঘ কয়েকটা সেকেন্ড একভাবে ভেসে থেকে বাতাস টানলো সে। শক্তি ফিরে এলো খানিকটা। মুখ ঘুরিয়ে তাকালো বিমানটার কি হয়েছে দেখার জন্যে। স্পষ্ট হয়নি এখনও দৃষ্টি। আবছা ভাবে দেখলো, তার দিকে সাঁতরে আসছে সাগরের হাসি। তীরের দিকে বিমানটাকে টেনে নিয়ে চলেছে মুসা। মুসার মুখটা দেখা যাচ্ছে ককপিটের জানালায়। স্টার্ট নিয়েছে ইঞ্জিন। তীরে দাঁড়িয়ে আছে ওমর আর ডজ। দুজনের হাতেই পিস্তল।
চলতে শুরু করলো বিমান।
ওটাকে ধরতে পারবে না বুঝেই যেন সমস্ত আক্রোশ কিশোর আর সাগরের হাসির ওপর এসে পড়লো কারনেসের। জাহাজের নাক ঘোরালো ওদের দিকে। মেরেই ফেলবে। গুলি আরম্ভ করলো ওমর আর ডজ। কিন্তু হুইল হাউসে কারনেসের গায়ে লাগাতে পারলো না একটা গুলিও।
বিমানটাও ছুটে আসছে।
কিশোরের হাত ধরে টান মারলো সাগরের হাসি। ডুব দাও! বলেই ডুব মারলো সে।
কিশোরও ডুব দিলো। সাঁতরে চললো তীরের দিকে। কোনোমতে অল্প পানিতে চলে যেতে পারলেই হয়, যেখানে পৌঁছতে পারবে না জাহাজ। আবার যখন বাতাসের জন্যে তাগাদা দিতে লাগলো ফুসফুস, তখন ভাসলো। দেখলো, অনেকটা সরে এসেছে জাহাজের কাছ থেকে। আবার দিলো ডুব। আবার ভাসলো। আর ডুবলো না। নিরাপদ জায়গায় চলে এসেছে। এখানে আর পৌঁছতে পারবে না স্কুনার। আর পারলেও ধরতে পারবে না ওকে।
তীরের অনেক কাছাকাছি চলে গেছে সাগরের হাসি। দৌড়ে আসছে ঝিনুক। পানির কিনারে এসে একটা মুহূর্ত থমকালো। দেখলো পুরো অবস্থাটা। তারপর নেমে পড়লো পানিতে কিশোরকে সাহায্য করতে এগোলো।
ফ্লাইং বোট নিয়ে উড়াল দিলো মুসা।
তীরে উঠে ধপাস করে বালিতেই বসে পড়লো কিশোর। থু থু করে মুখ থেকে ছিটিয়ে ফেললো নোনা পানি আর বালি।
নাক ঘুরিয়ে ফেলেছে স্কুনাটা। আর কিছু করার নেই, বুঝে গেছে কারনেস। ফিরে যাচ্ছে খোলা সাগরে।
জাহাজটা বেরিয়ে যাওয়ার পর লেগুনে নামলো আবার মুসা।
জিরিয়ে নিয়ে কাপড় পরে ডজ আর ওমরের সঙ্গে নাস্তা সেরে নিলো কিশোর ও মুসা। তারপর বিমানে করে রওনা হলো ডজ আইল্যান্ডের উদ্দেশে। ঝিনুক আর সাগরের হাসিকেও নেয়া হয়েছে সঙ্গে। এতোগুলো মানুষ নিয়ে আকাশে উড়তে বেশ কষ্টই হলো ফ্লাইং বোটের। তবে যেটুকু অসুবিধে হয়েছে, তা ওঠার সময়। ওপরে উঠে আর কিছু হলো না। উড়ে চললো নিরাপদেই।
দশ মিনিটের মধ্যেই নজরে এলো ডজ অ্যাইল্যান্ড।
দ্বীপের লেগুনে বিমান নামালো ওমর। দক্ষিণ সাগরের অনেক দ্বীপেরই লেগুন দেখেছে কিশোর আর মুসা। তবে এটার মতো এতো সুন্দর আর দেখেনি। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলো কিশোর। জীবনে এই প্রথম প্লেনে চড়েছে ওরা। দারুণ খুশি। গড়গড় করে কি যেন বললো আঞ্চলিক ভাষায়। কয়েকটা শব্দ শুধু বুঝলো কিশোর আর মুসা। ডজকে জিজ্ঞেস করলো, কি বলেছে।
ওরা বলছে, ডজ জানালো। বিদেশী মানুষের কাজকারবারই আলাদা। এমন কোনো মজার কান্ড নেই, যা তারা করতে পারে না। বাক্সের ভেতর থেকে গান বের করে দিতে পারে। ক্যানুতে ডানা লাগিয়ে আকাশে উড়তে পারে।
হাসলো দুই গোয়েন্দা। এসব কথায় কান দিচ্ছে না ওমর। সে তখন নোঙরের জায়গা খুঁজছে। বিমানের উইং ফ্লোট চিরে দিচ্ছে যেন লেগুনের শান্ত পানিকে, লাঙল দিয়ে মাটি ফাড়ার মতো করে। বিশাল ঢেউ উঠছে। এখানেই রাখলাম, কি বলো? ডজের দিকে তাকালো সে।
রাখো, যেখানে খুশি, ডজ বললো।
ক্যাম্পের কাছাকাছি রাখাই ভালো। চোখের আড়াল করা উচিত না। একবার করেই তো শিক্ষা হয়েছে।
ওই যে ওই নারকেল গাছগুলোর কাছাকাছি নিয়ে রাখো। তীরের কাছেও পানি বেশ গভীর। প্লেন থেকেই লাফ দিয়ে ডাঙায় নামতে পারবো। জুতো ভেজাতে হবে না। ওই যে, ওটাই আমার কুঁড়ে। নারকেল পাতায় তৈরি ছাউনিটা দেখলো ডজ।
তিনটে মাস থেকেছো ওর মধ্যে! বিড়বিড় করলো ওমর।
থেকেছি। বিল্ডিং আর এখানে পাবো কোথায়।
ডজ যে জায়গাটা দেখিয়েছে ধীরে ধীরে বিমানটাকে সেখানে নিয়ে এলো ওমর। ইঞ্জিন বন্ধ করলো। পানি ওখানে এতো পরিষ্কার, মনে হয় নেইই, অবিশ্বাস্য লাগে।
প্রবালের একটা চড়ায় নামলো সে। বললো, এখানেই বাঁধি। জিনিসপত্র নামিয়ে নিয়ে যাবো। যাতে সকালে উঠেই কাজে লেগে যেতে পারি।
চোখা পাথরের মতো বেরিয়ে থাকা এক টুকরো প্রবালে বিমানের দড়ি বাঁধা হলো। ভেসে যাওয়ার ভয় নেই। টান লেগে ছুটবেও না, কারণ সামান্য ঢেউও নেই পানিতে। রসদপত্র আর পেট্রোল তীরে নামানো হলো প্রথমে। তারপর বয়ে আনা হলো ডজের কুঁড়েতে। ঘরটা অতো খারাপ না। মেরামত করে নিলে সবারই জায়গা হয়ে যাবে। সাগরের হাসি আর ঝিনুকও অভিযাত্রীদের কাজে সাহায্য করলো। অনর্গল বকবক করে যাচ্ছে ওরা আঞ্চলিক ভাষায়। ভালো লাগলো অন্যদের। ছেলেমেয়ে দুটো সহজ করে রেখেছে পরিবেশ। ডাইভিঙের পোশাক আর অন্যান্য সরঞ্জাম বিমানেই রেখে দেয়া হলো। আগামী দিন সকালে কাজে লাগবে ওগুলো।
মুক্তো খেতটা কোনদিকে? ওমর জানতে চাইলো।
ওদিকে, হাত তুলে দেখালো ডজ। কাল এই সময়ে অনেক ঝিনুক তোলা হয়ে যাবে আমাদের।
আচ্ছা, একটা কথা, মুসা বললো। ঝিনুক খুলতে যাবে কে? যে রকম বড় বড় বললেন। ঝিনুক খোলা খুব কঠিন।
হাসলো ডজ। ঠিকই। একটা দুটো হলে সম্ভব। কিন্তু আমাদেরকে যতোগুলো তুলতে হবে, অতোগুলো জ্যান্ত অবস্থায় ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খোলা.. হাত নাড়লো সে। কিছুতেই পারবো না। তুলে এনে সৈকতে ছড়িয়ে রাখতে হবে, পচানোর জন্যে। ঝিনুক মরে গেলে আপনা আপনি ডালা ফাঁক হয়ে যাবে।
এতো ঝিনুক পচে নিশ্চয়ই খুব গন্ধ বেরোয়? ওমর জানতে চাইলো।
খুব মানে? ভয়াবহ! এতো দুর্গন্ধ পৃথিবীতে আর কিছুর আছে কি না জানি। তবে ভয় নেই। আমরা ওগুলোকে ফেলবো দ্বীপের একধারে, বাতাস যেদিকে বইবে তার উল্টো দিকে। তাহলেই আর গন্ধ লাগবে না।
আলোচনা আর খাবার তৈরি একসাথে চললো। তারপর খেতে বসলো ওরা। তখুনি একবার মুক্তো খেত দেখতে যেতে চাইলো কিশোর। ওমর রাজি হলো না। বললো, প্লেনটা একবার পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে পরে কোনো বিপদ না ঘটায়। আর ক্যাম্পেও সব কিছু গোছগাছ করা দরকার। ডজ বললো, সে ডুবুরির পোশাক আর সরঞ্জামগুলো পরখ করবে। তাকে সাহায্য করতে চাইলো মুসা।
আপাতত কিশোরের কিছু করার নেই। সে সাগরের হাসি আর ঝিনুককে নিয়ে চললো লেগুন দেখতে। ওটা কেমন, ভাবতে একটা শব্দই শুধু মাথায় এলো তার পরীর রাজ্য। রঙের বাহার অভিভূত করে ফেললো তাকে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানিতে গাঢ় নীল আকাশের ছায়া পড়ে পানিকেও নীল করে তুলেছে। এর পটভূমিতে নারকেলের ঘন সবুজ পাতাকে লাগছে ছবির মতো। পানিতে সাঁতার কাটছে হাজার রকমের মাছ। কোনোটা ছোট, কোনোটা বড়। রামধনুর সমস্ত রঙই রয়েছে ওগুলোর শরীরে। যেমন রঙ তেমনি ছটা। রীফের গায়ের কাছে এখানে ওখানে দেখা যাচ্ছে প্রবালের ছড়াছড়ি। সূর্য রশ্মি তেরছা ভাবে এসে পড়েছে তার ওপর। কোথাও কোথাও এমন লাগছে, মনে হচ্ছে মেঘ করেছে পানির তলায়। কোথাও তুষার-শুভ্র প্রবাল পাথরের বিশাল চাইয়ের মতো মাথা তুলেছে পানির ওপরে, ভাসমান বরফখন্ড ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না ওগুলোকে। লেগুনের নিচেটা যেন রূপকথার এক রহস্যময় জগৎ। প্রবালের বিচিত্র আকার, আজব চেহারা। রঙও তেমনি। লালই আছে কয়েক রকম। ঘন লাল, রক্ত লাল, টুকটুকে লাল, ফ্যাকাসে লাল, গোলাপী। আছে নীল, সবুজ, হলুদ। মোট কথা একজন শিল্পীর তুলি দিয়ে যতগুলো রঙ তৈরি করা সম্ভব, সবই আছে এখানে। অসাধারণ সুন্দর। জ্যান্ত উদ্ভিদের মতো লাগছে গোলাপী আর আশমানি রঙের প্রবালের ডালপালা। কোনোটা বড় পাতার মতো দেখতে, কোনোটা কৌণিক, কোনটা আবার বিশাল ব্যাঙের ছাতার মতো। সে-এক উজ্জ্বল পৃথিবী। কোথাও কোনো অসামঞ্জস্য নেই। কঠিন অথচ দেখতে লাগে কোমল। সব কিছুতেই যেন জাদুর পরশ। অবিশ্বাস্য! এই সুন্দরের মাঝে দুই ফুট লম্বা একটা শুঁয়াপোকার মতো জীবকে বুকে হেঁটে এগোতে দেখে গায়ে কাঁটা দিলো কিশোরের। মনে পড়ে গেল ডজের কথা, সৌন্দর্য আর কদর্যের ঠাই এখানে পাশাপাশি।
জীবটাকে দেখে কিশোরের মুখ বিকৃত করে ফেলা নজর এড়ালো না সাগরের হাসির। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো সে পানিতে। স্বচ্ছন্দে ডুবে গেল পানির তলায়। তুলে নিয়ে এলো জীবটাকে। কিশোরের চেহারা দেখে খিলখিল করে হাসলো। ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে এলো ওপরে। কুকুরের মতো গা ঝাড়া দিয়ে শরীর থেকে পানি ফেলছে।
কিশোর অনুমান করলো দ্বীপটা তিন কি চার মাইল লম্বা। পাশে একেবারেই কম, মাত্র কয়েকশো গজ। তা-ও সব চেয়ে চওড়া অংশটায়। লেনের দিকটায় হ্রদের পানির মতোই শান্ত পানি, কিন্তু সাগরের দিকটায় ঢেউ আছড়ে ভাঙছে ভীমবেগে। হাজারো বজ্রের আওয়াজ তুলে ফাটছে পানির পর্বত, অনবরত পানি ছিটাচ্ছে বৃষ্টির মতো। প্রবালের ওপর এসে জমা হয়েছে হাজারে হাজারে ঝিনুকের খোসা, সাগরে যতো রকম আর আকারের থাকতে পারে সব রকম-কিশোরের অন্তত তা-ই মনে হলো। আছে মাছের কঙ্কাল। বড় বড় দাঁতও পড়ে থাকতে দেখা গেল। সেগুলো কোন জীবের বুঝতে পারলো না সে। তবে যারই হোক, সে-যে দৈত্যাকার প্রাণী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢেউ আসছে, আর সঙ্গে করে বয়ে আনছে ওসব।
দ্বীপে উদ্ভিদের প্রজাতি তেমন বেশি নেই। এসব অঞ্চলের প্রধান যে গাছ, নারকেল, তা আছে প্রচুর পরিমাণে। পানির ধার ঘেঁষেও জন্মেছে অনেক। ওপরের উঁচু দিকটায় জন্মেছে ঘন সবুজ ঘাস। কিছু অচেনা ঝোঁপ হয়ে আছে, তাতে উজ্জ্বল রঙের ফুল ফুটেছে। সব চেয়ে উঁচু জায়গাটাও পানির সমতল থেকে পঁচিশ ফুটের বেশি উচু হবে না। হারিকেনের সময় নিশ্চয় ওখানেও পানি উঠে যায়। নোনা পানির এই অত্যাচারের কারণেই এসব অঞ্চলে উদ্ভিদ তেমন জন্মাতে পারে না।
ডাঙায় জীবনও অনেক কম, পানির তুলনায় প্রায় শূন্য বললেই চলে। যারা আছে তারাও বেশির ভাগই পানির জীব। বালিতে ঋষি কাঁকড়ার ছড়াছড়ি, হাজারে হাজারে, অদ্ভুত খোলাওলো বিচিত্র শব্দ করে বন্ধ করছে, আবার খুলছে। পাথরের ওপর নুড়ি পড়লে যেরকম আওয়াজ হয়, বন্ধ করার শব্দটা অনেকটা তেমন। এছাড়া আছে কিছু সামুদ্রিক পাখি।
বিকেলের দিকে ভাটায় যখন টান পড়লো, আশ্চর্য রকম নীরব হয়ে গেল তখন পরিবেশ। কেমন যেন গায়ে লাগে সেই নীরবতা। অসহ্য মনে হয়। বিষন্ন করে দেয় মন। সাংঘাতিক নিঃসঙ্গ মনে হলো নিজেকে কিশোরের। এখানে তিনটে মাস একা একা থাকলে কি করে ডজ! পাগল যে হয়নি এটাই যথেষ্ট। অস্বাভাবিক মনের জোর আর সহ্য ক্ষমতা তার। কিশোর হলে পারতো না। অনেকে তো সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যাই করে বসে। তাড়াতাড়ি ফিরে এলো সে অন্যদের কাছে। সবাই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে। পরিবেশের চাপ ওদের ওপরও পড়েছে, বোঝা যায়। এমনকি সাগরের হাসি আর ঝিনুকও অগ্নিকুন্ডের দিকে তাকিয়ে ঝিম মেরে রয়েছে।
অবশেষে নীরবতা ভাঙলো ওমর, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললো, পাহারায় থাকতে হবে। কারনেসকে বিশ্বাস নেই। প্রথম পালা তোমার।
ঠিক আছে, বস, পরিবেশটাকে হালকা করার জন্যে হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো কিশোর। আগুনের দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে নেই আমরা, অন্য কোনো গ্রহে চলে গেছি! আশ্চর্য! আগেও তো দক্ষিণের দ্বীপে এসেছি, আটকা পড়েছি, পানির অভাবে মরতে বসেছি, তখন তো এরকম লাগেনি!
লাগেনি, ডজ বললো। তার কারণ, তখন বাঁচার জন্যেই ব্যস্ত ছিলে। চুপ করে বসে থাকার সময়ই ছিলো না। ফলে বিষন্নতাটা টের পাওনি। যে কোনো জায়গাতেই থােক, বাড়িতেও, কাজকর্ম না থাকলে, শুধু শুধু বসে থাকতে হলে মন খারাপ হয়ে যায়।
আস্তে ঘাড় নাড়লো কিশোর। হ্যাঁ, তা বটে।
৬
কাঁকড়ার যন্ত্রণায় রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনি কিশোর। ঘরের মধ্যে এসে ঢুকেছে ওগুলো, বার বার গায়ের ওপর উঠেছে। মুসা আর ওমরের ঘুম ভেঙেছে ওগুলোর জ্বালায়। তবে ডজ, সাগরের হাসি আর ঝিনুকের কিছু হয়নি। ওদের অভ্যেস, হয়ে গেছে।
ঝিনুক তুলতে যাওয়ার জন্যে ফ্লাইং বোটে চড়লো ওরা। সকালটা বেশ ভালো। ওরকম একটা কাজে যাওয়ারই উপযুক্ত। এমনকি খোলা সাগরও শান্ত।
ট্যাক্সিইং করে চললো ওমর। পাশে বসে নির্দেশ দিতে লাগলো ডজ, কোনদিক দিয়ে যেতে হবে। বাইরে যদিও ঢেউ প্রায় নেই, তবু লেগুনে ঢোকার মুখটায় জোয়ারের পানি ঢোকার তীব্র স্রোত রয়েছে। বিমানটাকে এগোতে বাধা দিচ্ছে। তবে ঠেকাতে পারলো না। কারণ দুটো এঞ্জিন রয়েছে। তাছাড়া ওটার উইং ফ্লোটগুলো পানিতে তেমন ডোবে না। কামড় বসাতে পারলো না পানি। নৌকা-টৌকা হলে অবশ্য অন্য কথা ছিলো।
খোলা সাগরে বেরোতেই হাত তুলে একটা দিক নির্দেশ করলো ডজ, ওদিকে যেতে হবে। ওড়ার দরকার নেই। সাগর যে রকম শান্ত, এভাবেই চালিয়ে চলে যাওয়া যাবে। তবে প্রবালের দেয়াল-টেয়াল আছে কি না লক্ষ্য রাখতে হবে। এসব সাগরে ওসবের বিশ্বাস নেই। কোথায় যে পানির তলায় ঘাপটি মেরে থাকে, কিছু বোঝা যায় না। এমনিতে মনে হবে শুধু পানি, কিন্তু ফুটখানেক নিচেই হয়তো রয়েছে দেয়াল। লাগলে ফ্লোটের বারোটা বেজে যাবে।
জানালার পাশে বসে দেখছে কিশোর। সাগরের ওপর দিয়ে এভাবে ট্যাক্সিইং করে ছুটে যেতে দারুণ লাগছে তার। জাহাজ কিংবা স্পীড বোট এতো জোরে ছুটতে পারে না। কোথাও কোনো বাধা নেই। শুধুই ছুটে চলা। আনন্দে বেসুরো গলায় গানই গেয়ে উঠলো সে।
পনেরো মিনিট একটানা সামনে ছুটলো ওমর। তারপর গতি কমাতে বললো ডজ। তার মনে হলো জায়গাটার কাছে পৌঁছে গেছে। চেনার মতো কোনো চিহ্ন নেই। কয়েকশো গজের মধ্যে চলে এলেও বোঝার উপায় নেই। সাগরে এমনকি যন্ত্রের রিডিংও সঠিক হয় না। গড় কিংবা প্রায় ধরে নিতে হয়।
গতি একেবারে কমিয়ে ফেললো ওমর। ডজকে জায়গাটা খুঁজে বের করার সুযোগ দিলো।
বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করলো। বের করতে না পেরে বললো, আশপাশে থাকতে পারে। এক কাজ করো। গতি এরকমই থাক। চক্কর দিতে শুরু করো তো।
যে ভাবে যা করতে বলা হলো, সে ভাবেই করতে লাগলো ওমর। সব কটা চোখ এখন পানির দিকে। সাগরের তল খুঁজছে।
দেখি, রাখ তো এখানে, ডজ বললো ওমরকে। ভাসুক। পেট্রোল খরচ বাঁচবে। ডজ আইল্যান্ড দেখা যায় ওখান থেকে। সেটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে খেতটা কোন জায়গায় হতে পারে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। এখানেই আছে কোথাও। মুশকিলটা হলো, এখন সাগর শান্ত। আমি দেখেছি ঢেউয়ের সময়। এখন ডুব দেয়া সহজ বটে, কিন্তু জায়গাটা খুঁজে বের করা কঠিন।
স্টার্ট বন্ধ করলো না ওমর, তবে গতি বন্ধ করে দিলো। সাগরের ওপর ভেসে রইলো ফ্লাইং বোট। একটু একটু করে সরছে। পেরিয়ে গেল কয়েকটা নীরব মুহূর্ত। এখনও সব কটা দৃষ্টি পানির দিকে, সাগরের তল খোঁজায় ব্যস্ত।
আমাদের এই কান্ড দেখলে এখন, হেসে বললো মুসা। পাগল বলতো লোকে। ফ্লাইং বোটে বসে সাগরের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকা। হাহ হাহ।
হ্যাঁ, ওমরও হাসলো।
তোমাদের সন্দেহ হচ্ছে মনে হয়? ভুরু কোঁচকালো ডজ। এখানে নেই ভাবছো নাকি?
না না, তা ভাবছি না। তবে যে রকম করে খুঁজছি আমরা সেটা হাস্যকর।
এই দেখ, ওটা কি? আচমকা চিৎকার করে উঠলো কিশোর। কি যেন দেখলাম মনে হলো!
কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো সাগরের হাসি। বললো, আমি দেখে আসি। বলেই খুব সামান্য একটা ঢেউয়ের আঙটি তৈরি করে ডুবে গেল গানিতে।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। কয়েক মুহূর্ত একই জায়গায় থেকে মুখ নিচু করে নিচের দৃশ্য দেখলো সাগরের হাসি। তারপর ডুবতে শুরু করলো। মাছ যেভাবে আস্তে আস্তে পাখনা দোলায় অনেকটা তেমনি করে পা দোলাচ্ছে মেয়েটা। পানি এতো পরিষ্কার, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওকে। এক ঝাঁক মাছ চলে গেল ওর শরীরের ওপর দিয়ে। অদৃশ্য হয়ে গেল সাগরের হাসি। আর ওঠে না। ভয়ই পেয়ে গেল কিশোর। সাগরের এই মাঝখানে কিছু হলো না তো তার!
সাগরের হাসিকে আবার ভেসে উঠতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। মাথা তুললো মেয়েটা। হাতটা তুলে দেখালো। মস্ত একটা ঝিনুক নিয়ে এসেছে। নাক উঁচু করে দম নিতে লাগলো। শিসের মতো শব্দ বেরোতে লাগলো নাক দিয়ে। এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে কিশোর, অনেকক্ষণ পানির নিচে ডুব দিয়ে এসে এভাবেই দম নেয় দক্ষিণ সাগরের উভচর মানুষগুলো।
মেয়েটার হাতে ঝিনুক দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো ডজ। ওই তো! পেয়েছে, পেয়েছে! সাগর এখানে বেশি হলে একশো ফুট গভীর। কেন দেখা যাচ্ছে বুঝতে পারছি। সূর্য অনেক নিচুতে রয়েছে। খাড়া রোদ না পড়লে দেখা যাবে না তল। আমি যখন দেখেছি, তখন ঠিক দুপুর, মাথার ওপরে ছিলো সূর্য।
হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছে, একমত হয়ে মাথা দোলালো ওমর।
ঝিনুকটা বিমানের ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়ে উঠে এলো সাগরের হাসি। উত্তেজিত কণ্ঠে মারকুইজান ভাষায় দ্রুত কিছু বললো ডজকে। নিচের দিকে দেখাতে লাগলো।
ও বলছে, অনুবাদ করে বললো ডজ। সাগরের তলা এখানে পাহাড়ের ঢালের মতো নেমে গেছে। আর ওদিকটায় গভীরতা কম। আমি যা ভেবেছিলাম। আসলে সাগরের তল নয় এটা, একটা ডুবো পর্বতের চূড়া। ওমর, ওদিকটায় নিয়ে যাও।
চালাতে শুরু করলো ওমর। ফ্লাইং বোটটাকে নিয়ে এলো ডজের নির্দেশিত স্থানে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাখো এখানেই! চেঁচিয়ে বললো ডজ। তল দেখতে পাচ্ছি। ওই তো! বলেছিলাম না? পানি বেশি হলে বিশ-তিরিশ ফুট হবে!
অন্যেরও তাকিয়ে দেখলো, ঠিকই বলছে ডজ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সাগরের তল। অসংখ্য ঝিনুক ছড়িয়ে আছে, ডালা ফাঁক করা।
দেরি করলো না ডজ। ডাইভিং স্যুট পরতে আরম্ভ করলো। তার দিকে তাকিয়ে মুসাও উসখুস করে উঠলো ওই পোশাক পরে ডুব দেয়ার জন্যে। কাজটা বিপজ্জনক, তার পরেও আনন্দ পায় সে। খুব ভালো ডুবুরি মুসা। কানে বাজছে ওস্তাদের কণ্ঠস্বর, অনেকে পেশা হিসেবে নেয় কাজটাকে। ভয়ানক বিপজ্জনক পেশা। দুনিয়ার কোনো বীমা কোম্পানিই ডুবুরির জীবন বীমা করতে রাজি নয়। কারণ যে কোনো মুহূর্তে যা খুশি ঘটে যেতে পারে তার।
ঠিক যেন সেই ওস্তাদের কথাগুলোই নকল করে বলতে লাগলো ডজ, মুসার সেরকমই মনে হলো, বিপদে পড়াটা এখানে কিছুই না। অনেক ব্যাপার আছে। সেগুলো এখন কোনোটাই মনে করতে চাই না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। বাথটাবের মতো বড় বড় ঝিনুক আছে সাগরে, এখানটায়ও থাকতে পারে। টন খানেক ওজন হবে। ডালা ফাঁক করে ছড়িয়ে পড়ে থাকে অনেক সময়, শিকার ধরার জন্যে। ওটার মধ্যে পা পড়লে আর রক্ষা নেই। ঝট করে বন্ধ হয়ে যাবে ডালা। টেনে খোলা অসম্ভব। কপাল ভালো হলে তখন ডাইভারের কোনো একজন সঙ্গী গিয়ে যদি পা কেটে আলাদা করে তুলে আনতে পারে। আর কোনো উপায় নেই। সাগরের হাসি আর ঝিনুককে দেখিয়ে বললো, ওরা এসেছে, খুব ভালো হয়েছে। ওরকম অবস্থায় পড়লে কি করতে হবে জানে। দুজনের সঙ্গে কথা বললো সে। একটা করে হাতকুড়াল তুলে দিলো ওদের হাতে। মাথা ঝাঁকাল দুজনেই। হাসি হাসি ভঙ্গিটা দূর হয়ে গেছে মুখ থেকে।
এসব কথা কিশোরেরও জানা আছে। সে আর রবিনও মুসার সাথে একই সময়ে ট্রেনিং নিয়েছে। তবে মুসা জাতসাঁতারু, ওরা নয়। কিছুদিন দক্ষিণ সাগরের কোনো দ্বীপে মুসাকে রেখে দিলে সে-ও ঝিনুক কিংবা সাগরের হাসির সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে পারবে।
সংকেতগুলো মনে আছে তো? কিশোর, মুসা আর ওমরের দিকে তাকিয়ে বললো ডজ। ঈশ্বর যেন সেরকম অবস্থায় না ফেলেন! দড়িতে চারটে টান দিলে বুঝতে হবে, ভয়ানক বিপদে পড়েছি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তখন দড়ি টেনে তুলে আনতে হবে। ওরকম করার প্রয়োজন সাধারণত পড়ে না, দশ লাখে একবার হয়তো পড়তে পারে, আমি যদ্দুর জানি। তবু, ওই একটা বার আমার কপালেও ঘটতে পারে। টানতেই থাকবে, দড়ি ছিড়ে যায় যাক, তবু থামবে না। তবে সংকেত না পেলে কক্ষণাে ওরকম করবে না, বুঝলে? শেষ কথাটা ওমরের দিকে তাকিয়ে বললো সে।
হ্যাঁ, বুঝেছি, শান্তকণ্ঠে বললো ওমর।
বেশ। এবার আমাকে সাজিয়ে দাও, এই কথাটা কিশোর আর মুসাকে উদ্দেশ্য করে বললো ডজ।
ডাইভিং স্যুটের বেল্ট বাঁধতে তাকে সাহায্য করলো দুই গোয়েন্দা। সব শেষে হেলমেটটা মাথায় গলিয়ে সকেটে বসিয়ে দিলো। নাটগুলো টাইট করে দিলো দুজনে। বেজায় ভারি পোশাক। পা টেনে টেনে এগোলো ডজ বিমানের দরজার পাশে ঝুলিয়ে রাখা মইয়ের দিকে, ওটা বেয়েই নামতে হবে।
নেমে গেল নিচে। পানিতে মাথা ডোবানোর আগে এক মুহূর্ত থেমে ওপরের দিকে তাকালো। হেলমেটের কাচের ঢাকনার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার মুখ। হাসলো। তারপর ডুবে গেল। ডাইভিং স্যুটের সঙ্গে যুক্ত এয়ারপাম্পের হ্যান্ডেল ঘোরাতে শুরু করে দিয়েছে মুসা। কিশোর ছাড়ছে লাইফ লাইন। স্কুবা ডাইভিঙে যেসব পোশাক ব্যবহার হয়, ওগুলোতে এতো সব ঝামেলা করতে হয় না। তবে ওগুলো নিয়ে বেশি দূর যেমন নামাও যায় না, বেশিক্ষণ ডুবেও থাকা যায় না পানিতে। কারণ পিঠে বাধা অক্সিজেন সিলিন্ডারে থাকে সীমিত অক্সিজেন। আর নিজের দায়িত্বে ঘুরে বেড়ায় ডুবুরি। কিছু ঘটলে বাইরের কেউ জানতে পারে না তার কিছু হয়েছে।
মিনিটখানেক পরে দড়ি হঠাৎ ঢিল হয়ে যাওয়ায় বোঝা গেল তলায় পৌঁছেছে ডজ। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে দড়িতে বাঁধা একটা তারের ঝুড়ি নামিয়ে দিলো ছেলেটা, ঝিনুক ভোলার জন্যে। ওর হাতে কুড়াল। তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে।
কয়েকটা মিনিট কেটে গেল। দড়িতে একটামাত্র টান পড়লো।
ঝুড়ি তোলো, নির্দেশ দিলো কিশোর।
তোলা হতে লাগলো। পানির অনেক নিচে থাকতেই দেখা গেল ঝুড়িটা। বিশ-পঁচিশটা বড় বড় ঝিনুকে বোঝাই। কোথায় রাখতে হবে দেখিয়ে দিলো ওমর। কেবিনের মেঝেতে ওখানে ঝিনুকগুলো ঢেলে দিয়ে আবার ঝুড়িটা নিচে পাঠিয়ে দিলো ঝিনুক।
কয়েকবার করে চললো এরকম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অনেক ঝিনুক জমে গেল কেবিনে। সেগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হলো মেঝেতে, বিমানের ভারসাম্য সমান রাখার জন্যে। নইলে একদিকে বেশি কাত হয়ে যাবে। সবচেয়ে কম গভীর জায়গাটা প্রায় খালি করে ফেললো ডজ। তারপর সরে গেল আর একটু গভীরে মাঝে মাঝে ওপর থেকে তাকে দেখা গেল হালকা রঙের প্রবালের ওপর দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার সময়। কিন্তু গাঢ় রঙের প্রবালের মাঝে যেখানে অন্ধকার হয়ে আছে, সেখানে থাকলে দেখা যায় না। পানিতে বেশিক্ষণ ডুবে থাকলে, কিংবা গভীর পানিতে থাকলে ডুবুরির রক্তে এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। তখন তাকে তাড়াতাড়ি তোলার চেষ্টা করলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়। এতে অকল্পনীয় কষ্ট পেয়ে মারা যায় রোগী। তবে ডজ এখন যে গভীরতায় রয়েছে, তাতে সেরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই।
ডজের উঠে আসার ইঙ্গিত পেয়ে হাঁপ ছাড়লো কিশোর। কয়েক মিনিট পর তার মাথা ভেসে উঠলো পানির ওপরে। দুর্বল ভঙ্গিতে মই বেয়ে উঠে এসে মেঝেতে বসে পড়লো সে। তার হেলমেট খুলে নেয়া হলো।
ভালোই তুলেছি, তাই না? ঝিনুকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো ডজ। জিরাতে এলাম।
নিচেটা কেমন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
চমৎকার। দুএকটা বিশ্রী খাঁজ আছে অবশ্য। ডাঙার ওপরের পাহাড়েও থাকে ওরকম। তাতে হোঁচট খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আরেকটা বাজে জিনিস হলো প্রবাল, আকৃতির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। লাইফ লাইন আর এয়ার টিউবের ওপর কড়া নজর রাখতে হয়েছে সারাক্ষণ। প্রবালে ঘষা লেগে কিংবা জড়িয়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। স্রোতও বেশ জোরেই টানে।
দড়ি প্যাঁচ লাগে নাকি?
লাগে মানে? প্রবালে ওটাই তো বেশি লাগে। সব চেয়ে বড় ভয় এখানে।
ডাইভিং স্যুট খুললো না ডজ। আরেকবার নামার ইচ্ছে। যতগুলো তুলেছি, আরও অতগুলো তুলবো, বললো সে। ঝিনুককে বললো আবহাওয়ার দিকে নজর রাখতে। কারণ কখন বাতাস বইতে আরম্ভ করবে তার ঠিক নেই। ঝিনুকই সেটা ভালো বুঝতে পারবে। সাগরে হঠাৎ ঢেউ উঠলে বিপদে পড়তে চায় না ডজ।
তবে আবহাওয়া পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আগের মতোই শান্ত রয়েছে সাগর। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ডজ। নেমে গেল পানিতে।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট পেরোলো। বিমানে যারা বসে আছে তাদের কাছে অনেক দীর্ঘ লাগছে। তবে ঝিনুক তোলার বিরাম নেই। কিছুক্ষণ পর পরই ঝুড়ি ভর্তি করে পাঠাচ্ছে।
অনেক হয়েছে, অবশেষে ঝিনুকের স্কুপের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো ওমর। আর বেশি তুললে বিপদে পড়তে পারি।
বিপদ? বুঝতে পারলো না মুসা।
বাতাস বইতে শুরু করলে আর ঢেউ উঠলে মহাবিপদ হবে। এতো ভার নিয়ে কিছুতেই আকাশে তোলা যাবে না প্লেন। সীসার মতো ভারি হয়ে যাবে, উঠতেই চাইবে না পানি থেকে। বাঁচার তাগিদে তখন ঝিনুক ফেলেও দেয়া লাগতে পারে। এতো কষ্ট করে তুলে এনে ফেলার কোনো মানে হয় না। তার চেয়ে কম রাখাই ভালো। আকাশের দিকে তাকালো সে। আকাশ অবশ্য ভালোই আছে। হঠাৎ খারাপ হবে বলে মনে হয় না। তবে এখানকার আবহাওয়াকে বিশ্বাস না করাই ভালো।
সেটা খুব ভালো করেই জানে কিশোর আর মুসা। আগের বার এখানে এসে হারিকেনের রূপ দেখছিলো ওরা। ভাবলেই পিলে চমকে যায়।
ভাবতে চাইলো না কিশোর। বললো, আর বেশি তুলবেও না। ঘড়ি দেখলো সে। উঠে চলে আসবে। লাইফ লাইনটাকে এমন ভাবে ছুঁলো, যেন বড়শি ফেলে মাছের অপেক্ষায় রয়েছে, ফাৎনায় টান পড়লেই মারবে কষে টান।
আরও কয়েক মিনিট পেরোলো। টেনে তোলার সংকেত আর আসে না। অনেকক্ষণ হলো, কিশোর বললো, আর কোনো ঝিনুকও তো পাঠাচ্ছে না।
কেউ জবাব দিলো না। ধীরে গড়িয়ে চলেছে সময়, মিনিটের পর মিনিট কাটছে। ঘড়ির দিকে তাকালো ওমর। তারপর ইনস্ট্রমেন্ট বোর্ডের দিকে। এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। ঘোষণা করার মতো করে বললো।
নড়ছে, বললো কিশোর। দড়িতে টের পাচ্ছি। তবে বেশি না। ঝিনুকের খোলে পা দিলো না তো? বড়গুলোর?
বিমানের পিঠের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিচে তাকিয়ে রয়েছে সাগরের হাসি বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ কোনো কথা বলছে না। হঠাৎ কোমর থেকে একটানে ছুরিটা খুলে নিয়ে দাঁতে কামড়ে ধরলো। পিছলে নেমে গেল পানিতে। মাথা নিচু করে দ্রুত সাঁতরে নেমে যেতে লাগলো।
চট করে মুসার চোখে চোখে তাকালো কিশোর। দৃষ্টি ফেরালো ওমরের দিকে।
শ্রাগ করলো ওমর। বুঝলাম না কেন ওরকম করলো! নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
খাইছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। উঠে আসছে! এতো তাড়াহুড়ো করছে কেন?
ভুস করে পানির ওপরে মাথা তুললো সাগরের হাসি। মুখ থেকে পানি ছিটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ফেকি! ফেকি! দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে বললো, অনেক বড়!
ফেকি! খোদা! অকটোপাসের কথা বলছে! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কিশোরের চেহারা। ওমর ভাই, কি করবো? টেনে তোলার চেষ্টা করবো?
ও তো বললো সংকেত না দিলে না টানতে, কঠিন হয়ে উঠেছে ওমরের মুখ।
ভাবভঙ্গিতে আর ভাঙা ইংরেজিতে মেয়েটা জানালো, অকটোপাসের সঙ্গে লড়াই করছে ডজ। সাগরের হাসি তাকে সাহায্য করতে যেতে সাহস করেনি। দড়িতে জড়িয়ে যেতে পারে। আটকে গিয়ে দম আটকে মরবে তখন।
মুসা, থেমো না! কিশোর বললো, পাম্প চালিয়ে যাও! দড়ি টান দিলো সে। একটুও উঠলো না। টানটান হয়ে গেল দড়ি। কাঁপছে, মৃদু।
এভাবে হবে বলে মনে হয় না! উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় ভারি হয়ে উঠেছে মুসার নিঃশ্বাস। অন্য কিছু করা দরকার!
মিনিটখানেক সময় দিয়ে দেখা যেতে পারে! কিছু করার সিদ্ধান্ত ওমরও নিতে পারছে না। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। হয়তো তাড়িয়ে দিতে পারবে। প্রয়োজন হলে নিশ্চয় তোলার জন্যে সংকেত দিতো।
হাতটাত সব জড়িয়ে ধরেছে কি না তাই বা কে জানে! কিশোর বললো। হয়তো নড়তেই দিচ্ছে না! জানোয়ার তো না ওগুলো, শয়তানের চেলা!
দাঁড়াও! টেনো না!
মিনিটখানেক কেউ কোনো কথা বললো না। দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। মূর্তির মতো।
ঝিনুক, অবশেষে বললো ওমর। নিচে গিয়ে দেখবে কি হয়েছে?
হাত থেকে ঝুড়ির দড়িটা ছেড়ে দিলো ঝিনুক। কোমর থেকে ছুরিটা নিয়ে দাঁতে কামড়ে ধরে ঝাপ দিতে যাবে এই সময় চিৎকার করে উঠলো কিশোর, টানছে!…এক…দুই…তিন… চার! তার মানে টানতে হবে, যতো জোরে পারা যায়! টানতে শুরু করলো সে। একচুল নড়লো না দড়ি। যেন পাথরে আটকে গেছে। ওমরভাই! ঝিনুক! ধরো!
দুজনেই ছুটে এলো তাকে সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু তিনজনে মিলে টেনেও এক ইঞ্চি তুলতে পারলো না দড়ি।
ইয়াল্লা! বলে উঠলো ওমর। আর জোরে টান দিলে ছিড়ে না যায়! খসখসে হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠ। না টেনে আর কিছু করারও নেই। মুসাকে পাম্প চালিয়ে যেতে বলে আবার টান দিলো দড়িতে। তিনজনে মিলেই টানছে। দড়ি আর নড়ে না।
হবে না, দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিড়বিড় করলো কিশোর। বোধহয় পেঁচিয়ে ফেলেছে কোনো কিছুতে। দেখি আরেকবার চেষ্টা করে। সাগরের হাসি, এসো, তুমিও ধরো।
চারজনে মিলে টানতে শুরু করলো। ঘাম বেরিয়ে এসেছে সকলেরই। টানের চোটে একপাশে কাত হয়ে গেছে বিমানটা। তবু এক ইঞ্চি নড়লো না দড়ি। মনে হচ্ছে ওমরের অনুমানই ঠিক। পেঁচিয়ে গেছে কিছুতে।
সোজা হয়ে দাঁড়ালো ওমর। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। ও বলেছে যততক্ষণ দড়ি না ছেড়ে, টানতে। ঠিক আছে। হয় সে উঠবে, নয়তো দড়ি ছিড়তে যাচ্ছি আমি। এটাই ওর শেষ সুযোগ! কিশোর যেখানে ধরেছে, তার পেছনের দড়ির অংশটুকু নিয়ে একটা সীটের পায়ায় পেঁচিয়ে বাঁধলো সে। সবাইকে দড়ি ছেড়ে দিতে বলে গিয়ে উঠে বসলো পাইলটের সীটে। থ্রটলে চেপে বসলো আঙুলগুলো। মৃদু ঝিরঝির করে চলছিলো এঞ্জিন, সেটা রূপান্তরিত হলো গর্জনে। সামনে টান দিলো বিমান। ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে গেল দড়ি। প্রচন্ড চাপে ডানে কাত হয়ে গেল বিমান। ডানার ডগা পানি ছুঁই ছুঁই করছে। কিন্তু আগে আর বাড়তে পারছে না। শেষে ডানে কেটে, চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করলো।
কতোটা দিয়েছেন? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
হাফ থ্রটল।
আরো লাগবে। দড়ি নড়ছে না। চালিয়ে যান।
ভয় লাগছে, প্লেনটাই না উল্টে যায়!
যাবে না। টানুন।
আরও গম্ভীর হয়ে গেল এঞ্জিনের গর্জন।
উঠছে? উঠছে! চিৎকার করে উঠলো কিশোর।
আরো জোর বাড়ালো ওমর। বুনো ঘোড়ার লাগাম পরানো হয়েছে যেন, খেপে গেছে, ওরকম আচরণ করছে বিমান। যেখানটায় ঘুরছে ওটা, সেখানে ফেনার ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়েছে।
আসছে। আবার চেঁচিয়ে বললো কিশোর। দড়ি ধরে টানতে শুরু করেছে সে। ঠেলে বেরিয়ে আসবে যেন চোখ, পরিশ্রমে।
হঠাৎ থ্রটলের পাওয়ার কেটে দিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল ওমর, কিশোরকে সাহায্য করার জন্যে। ঝিনুক আর সাগরের হাসিকেও ডাকলো। টানো! টানো! ছাড়বে না!
মুসা পাম্প ছাড়ছে না। উঠে আসছে ডেজা দড়িটা, প্রতিবারে এক ফুট করে।
ওমাথায় ডজ ছাড়াও আর কিছু আছে, ওমর বললো। ভাগ্যিস, নতুন দড়ি। মোটা দেখে লাগিয়েছিলো ডজ।
নাইলন না হলে যতো মোটাই হোক, টিকতো না, মুসা বললো।
হ্যাঁ। ঝিনুক, কুড়াল নিয়ে গিয়ে দাঁড়াও।
এক ফুট এক ফুট করে উঠে আসছে দড়ি। সাংঘাতিক কাত হয়ে গেছে বিমান। এখন শুধু কিশোর আর ওমর টানছে। সাগরের হাসিও চলে গেছে দরজার কাছে, উবু হয়ে বসে তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আসছে! আসছে! ওই তো! একটু থেমে আবার চিৎকার করে উঠলো তীক্ষ্ম কণ্ঠে। আসছে! ফেকি আসছে! হাতে ছুরি, সামান্য ফাঁক হয়ে আছে দাঁত। চকচকে চোখ। পুরোপুরি বন্য লাগছে এখন তাকে, আদিম মানবী, ভয়াবহ শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্যে তৈরি।
পানির ওপরে ঝটকা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা শুঁড়, বীভৎস ভঙ্গিতে পেঁচালো আর খুললো, প্রজাপতির শুঁড়ের মতো করে। কিলবিল করে উঠলো।
খবরদার! টান ছাড়বে না! চিৎকার করে বললো ওমর।
টেনে ডুবিয়েই না ফেলে!
টান ছেড়ো না! প্লেন ডুববে না। ওই তো, আরও উঠছে। ডজকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে অকটোপাসটা। ধরে রাখো, ছেড়ো না। বলে দড়ি ছেড়ে দিলো ওমর। তুলে নিলো একটা হাতকুড়াল। সাগরের হাসিকে তখন যেটা দিয়েছিলো। কোপ মারলো পানিতে।
দড়ি কাটবেন না! সাবধান! চেঁচিয়ে হুশিয়ার করলো কিশোর।
কিশোর, আমিও যাই! হাত নিসপিস করছে মুসার। পাম্পের কাছে এভাবে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না ওর।
না! তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। যা করছো করো।
ওমর কিছুই বললো না। কুপিয়ে চলেছে। ভেসে উঠলো একটা, কাটা শুঁড়। এখনও পাক খুলছে আর বন্ধ করছে। টিকটিকির লেজের মতোই যেন শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেলেও মরে না। আরেকটা শুঁড় বেরিয়ে এসে বিমানের কাঠামো পেঁচিয়ে ধরে টান দিলো। কাত করে ডুবিয়ে দেয়ার ইচ্ছে যেন বিমানটাকে। ধা করে কোপ মারলো ওমর। শুঁড় কেটে প্লাইউডে বসে গেল কুড়ালের ফলা। হ্যাচকা টান দিয়ে তুলে আনলো আবার।
কুড়াল দিয়ে কোপাতে বোধহয় ভালো লাগেনি ঝিনুকের, সেটা রেখে দিয়ে ছুরি দিয়ে খোঁচা মারছে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে। সাগরের হাসিও খোঁচাচ্ছে। দুজনে পানির একবারে কাছাকাছি চলে গেছে। সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে একটা শুঁড় এসে টেনে নিতে পারে ওদেরকে পানিতে।
দড়ি ছাড়ছে না কিশোর। টেনে ধরে রেখেছে। বাঁকা হয়ে গেছে তার শরীর। টপটপ করে ঘাম ঝড়ছে কপাল থেকে।
দেখা যাচ্ছে, অকটোপাসের বড় বড় চোখ, কেমন সম্মােহনী দৃষ্টি। কুড়াল রেখে দিয়ে পিস্তল বের করলো ওমর। পিরিচের মতো বড় চোখদুটোর মাঝখানে সই করে গুলি শুরু করলো। খালি করে ফেললো ম্যাগাজিন।
আচমকা ঢিল হয়ে গেল দড়ি। চিত হয়ে পড়ে গেল কিশোর। কোনোমতে উঠে দেখলো, পানিতে ভাসছে ধূসর রঙের একটা মাংসের দলা, তাতে যেন জোড়া লেগে রয়েছে কতোগুলো কুৎসিত শুঁড়, তার কয়েকটা আবার কাটা, আরও ভয়ংকর লাগছে। ধক করে উঠলো বুক। ডজ কি নেই! না, আছে। ওই তো, হেলমেট দেখা যায়। নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো ওমর আর সাগরের হাসি। টেনে তুললো ডজকে। চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে রইলো ডুবুরি।
হেলমেটটা খোল! নির্দেশ দিয়েই ককপিটের দিকে ছুটলো ওমর। গর্জে উঠলো এঞ্জিন।
ম্যাকো! ম্যাকো! বাচ্চা মেয়ের মতো হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সাগরের হাসি। হাত তুলে দেখালো। ফেকিকে এবার শেষ করবে!
সবাই দেখলো, কয়েকটা হাঙর এসে হাজির হয়েছে। কামড়াতে শুরু করেছে অকটোপাসটাকে। সাবাড় করতে সময় লাগবে না, বোঝা গেল। কেঁপে উঠলো কিশোর। ডজকে তুলতে আরেকটু দেরি হলেই…ভাবতে চাইলো না সে। মুসাকে ডাকলো তাকে সাহায্য করার জন্যে। হেলমেট খুলতে শুরু করলো। নিথর হয়ে পড়ে আছে ডজ। ছাই হয়ে গেছে মুখের রঙ। সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো মুসা, খাইছে! মরেই গেল নাকি!
ছুটে গিয়ে কেবিন থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে নিয়ে এলো সে। আঙুল দিয়ে টেনে ঠোঁট ফাঁক করে মুখের ভেতরে ঢেলে দিলো খানিকটা ব্র্যান্ডি।
ততোক্ষণে লেগুনের কাছে পৌঁছে গেছে বিমান। প্রায় ওড়ার গতিতেই ছুটছে। পানির ওপর দিয়ে। কয়েকবার লাফিয়ে উঠেই পড়েছিলো কয়েক ইঞ্চি করে। মুখের কাছে পৌঁছেও গতি কমালো না ওমর। তীব্র গতিতে ঢুকে পড়লো সরু চ্যানেলে। নিয়ে এলো শান্ত পানিতে, যেখানে নোঙর করেছিলো। এঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে অন্যদেরকে সাহায্য করলো ডজকে তীরে নামাতে।
নারকেল গাছের ছায়ায় এনে আস্তে করে বালিতে শুইয়ে দেয়া হলো তাকে। চোখ মেললো ডজ। নীল আকাশের ছায়া পড়লো তার চোখে। দুর্বল কণ্ঠে ককিয়ে উঠলো, ঝিনুকগুলো আছে তো?
নিজে যে মরতে বসেছিলে, সেটা নয়, প্রথমেই ঝিনুকের চিন্তা, স্বস্তি মেশানো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো ওমর। তোমাকে যে বাঁচাতে পেরেছি এতেই আমরা খুশি। চুলোয় যাক ঝিনুক। কিশোর, ধরো তো, স্যুটটা খুলে ফেলা যাক। ডজকে জিজ্ঞেস করলো, খুলতে পারবে তো? তোমার অসুবিধে হবে?
না। আমি ভালো আছি। কয়েকটা আঁচড় শুধু লেগেছে।
কয়েকটা আঁচড় যে কি পরিমাণ পোশাক খুলতেই দেখতে পেলো সবাই। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনো জায়গা আর বাকি নেই, কালো কালো দাগে ভরা। থেঁতলে গেছে। ওসব জায়গায় শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে চাপ দিয়েছিলো দৈত্যটা। তবে জখম তেমন নেই, রক্ত বেরুচ্ছে না, হাতের ছুরির ক্ষতটা বাদে। কেননা কোনো জায়গা এখনও কাঁচা রয়েছে, যা পুরোপুরি শুকায়নি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দুই এক ফোটা রক্ত। উঠে বসলো সে। কয়েক ঢোক ব্র্যান্ডি পেটে পড়তেই আরেকটু সুস্থ হলো।
ঝিনুক তোলার অভিযান তাহলে আমাদের শেষ? চোখে প্রশ্ন নিয়ে ভজের দিকে তাকালো ওমর।
কেন? এটা কোনো একটা ব্যাপার হলো নাকি? ডুবুরির জীবনে প্রায় প্রতিদিনই ওরকম ঘটনা ঘটে।
হাঁ করে ডজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। তার মানে… তার মানে, আপনি আবার ওই জায়গাটায় নামবেন?
নিশ্চয়। আগের চেয়ে নিরাপদ ভাবলো এখন নিজেকে।
কেন? মুসার প্রশ্ন।
এজন্যে, ওখানে আর ওরকম দানব নেই, ডজ বললো। জানা কথা। এক রাজ্যে দুই রাজা বাস করতে পারে না। একটাই থাকে, আর সেটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সাগরের আতঙ্ক ওই শয়তানগুলো, সাধে কি আর ডেভিল ফিশ বলে। অনেকেই ভয় পায় ওগুলোকে, এড়িয়ে চলে।
হাঙররা পাচ্ছে না, কিশোর বললো।
মরা বলে। জ্যান্ত হলে আসতো না। হাসলো ডজ। এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে গেল, যেন শক্ত হয়ে গেছে পা। অকটোপাসটাকেও খুব একটা দোষ দিই না। গাধামীটা আমিই করেছি। কালো একটা গর্ত দেখতে পেলাম। মাছটাছ কিংবা অকটোপাসের বাচ্চা দেখলাম না তার মধ্যে। ওরকম গর্তে যা প্রায়ই থাকে। ওগুলো কোনো ক্ষতি করতে পারে না। মানুষ দেখলেই বরং সরে যায়, বিশাল মাকড়সার মতো দেখতে লাগে। ভেতরে কিছু নেই দেখে অবাকই লাগলো। তবে গুরুত্ব দিলাম না। ভাবলাম, এরকম গর্তে অনেক ঝিনুক থাকবে। দেখতে গেলাম। কপাল ভালোই বলতে হবে আমার। কারণ প্রথম শুঁড়ের মাথাটা এসে আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো আমার হেলমেট। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম ওটা কি। তারপর যা করার তা-ই করলাম। হাত দুটো তুলে ফেললাম ওপর দিকে, যাতে শরীরের সঙ্গে পেঁচিয়ে ধরে আটকে ফেলতে না পারে। ভাগ্যিস, তুলেছিলাম! আরেকটা শুঁড় এসে জড়িয়ে ধরলো আমার কোমর। তখন আমার হাত তোলা না থাকলে শেষ করে ফেলতো। লড়াই করার একটা সুযোগ অন্তত পেলাম। ছুরি বের করে ফেলেছি আগেই। খোঁচাতে শুরু করলাম। বোধহয় মিনিট বিশেক ওরকম লড়াই করেছি। তবে আমার মনে হয়েছে কয়েক যুগ। গর্তের ভেতর থেকে জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো জীবটা। চারটে শুঁড় ব্যবহার করেছে আমাকে কাবু করার জন্যে। বুঝলাম, বাকি চারটে দিয়ে পাথর আঁকড়ে ধরেছে, গ্যাট হয়ে বসে থাকার জন্যে। আসলে চারটে শুঁড়ই আমাকে শেষ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। বাকিগুলো আর খাটাতে যাবে কেন? আমাকে তোলার সংকেত দিয়ে তখন লাভ নেই। তুলতে পারবে না। হাত দিয়ে টেনে তো দূরের কথা, যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে টানলেও উঠতো কিনা সন্দেহ। তাই জোর যাতে কমানো যায় সেই চেষ্টা চালালাম। চারটে শুঁড়ের গোটা দুই যদি কেটে দেয়া যায় তাহলে জোর কমবে। আমার বড় ভয় ছিলো, দড়ি আর এয়ার টিউবের লাইন না ছিড়ে ফেলে। তাহলে আর কেউ বাঁচাতে পারতো না আমাকে। দড়িটা টানটান হয়ে ছিলো বলেই পেঁচিয়ে যায়নি কোনো কিছুতে। অনেক চেষ্টা করে আমার গায়ে পেঁচানো দুটো শুঁড়ের মাথা কেটে দিলাম। আরও দুটো বের করে আনলো তখন ওটা। পেঁচিয়ে ধরলো। ভাবলাম, সংকেত দিই। তার পরে মনে হলো, না, ছিড়ে যেতে পারে। আরেকটু জোর কমানো যাক। কিন্তু দুর্বল হয়ে গেছি ততোক্ষণে। আর সেটা বুঝতে পেরেছে জানোয়ারটা। টানতে শুরু করলো নিজের দিকে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তখন চোখজোড়া। শয়তানীতে ভরা। একবার ভাবলাম, যাই, গিয়ে ছুরি দিয়ে খোঁচা মেরে গেলে দিই। কিন্তু ওই চেষ্টা করাটাই বোকামি। চোখের কাছে কিছুতেই পৌঁছতে দেবে না আমাকে। একটু পর পরই কালি ছুঁড়ে অন্ধকার করে দিচ্ছে পানি, যাতে ওর শরীর কিংবা শুঁড় দেখতে পারি আমি। প্রায় শেষ করে এনেছিলো আমাকে। পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠছিলো হাত। নড়নোর শক্তিও পাচ্ছিলাম না আর। একটা হাত পেঁচিয়ে ফেললো শরীরের সঙ্গে। আরেকটাও আটকে ফেলবে যে কোনো সময়। দড়ি না টেনে আর উপায় নেই। আমাকে টেনে তার মুখের দুই গজের মধ্যে নিয়ে গেছে। টান দিলাম। পর পর চার বার। তার পর আর কিছু মনে নেই।
হুঁ, আনমনে মাথা দোলালো মুসা। অকটোপাসের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইটা যে কেমন, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি। আপনাকে তো সাহায্য করার জন্যে অনেকেই ছিলাম আমরা, আমাকে করার কেউ ছিলো না। কেউ জানতোই না যে আমাকে অকটোপাসে ধরেছে।
হ্যাঁ, বুদ্ধির জোরেই বেঁচে এসেছিলে সেদিন, কিশোর বললো। আর কপাল অসম্ভব ভালো ছিলো বলে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো ওমর। যা-ই বলো, ডজকে বললো সে। আর তোমাকে ওখানে নামতে দিতে রাজি নই আমি। আমার ভালো মনে হচ্ছে না।
অহেতুক ভয় পাচ্ছো। একদিন বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু হবে না আমার। আর, হাসলো সে। লক্ষ লক্ষ টাকা কামাতে চাইলে ওরকম একআধটু ঝুঁকি নিতেই হবে। টাকা জিনিসটা তো আর সহজে পাওয়া যায় না।
দেখা যাক, ওমর বললো। ভাবনাচিন্তা করি। ঝিনুক যা তুলে এনেছো সেগুলো কি করবো?
সৈকতে ফেলে রাখতে হবে। পশ্চিম দিকে। ওপরে, যাতে জোয়ারের পানি নাগাল না পায়। দিন দুয়েকের মধ্যে পচে যাবে। দেখতে পারবো, অকটোপাসের সঙ্গে লড়াই করে কি আনতে পেরেছি। হাসলো ভজ। ঝিনুক খোলাটা একটা মহা উত্তেজনার কাজ, দারুণ খেলা। বোঝার উপায় নেই, কোনটা খুললে বেরিয়ে পড়বে অনেক টাকার সম্পদ।
হু। আপাতত পেটপূজাটা সেরে নেয়া যাক। খিদে পেয়েছে। খেয়েদেয়ে তুমি রেস্ট নাও। আমরা ঝিনুকগুলো সরিয়ে ফেলবো।
৭
যতোটা ভাবা গিয়েছিলো, তার চেয়ে বেশি কাহিল হয়ে পড়লো ডজ। দুই দিন লাগলো তার শক্ত হতে। থেতলানো জায়গাগুলোতে ব্যথা। তার অবস্থা দেখে সবাই তো ভয়ই পেয়ে গেল। ওদের মনে হতে লাগলো, ঝিনুক তোলার কাজটাই বাতিল করে দিতে হবে। সেকথা বলাও হলো ডজকে।
ডজ মানতে নারাজ। তার এক কথা, এক জায়গায় বড় অকটোপাস একটাই থাকে। সেটা যখন মারা পড়েছে, নিরাপদেই এখন ডুব দেয়া যায়। তার কথা শুনতে প্রায় বাধ্য করলো সে অন্যদেরকে।
কাজেই তৃতীয় দিনে আবার চললো ফ্লাইং বোট, মুক্তো খেতের উদ্দেশে।
বেশ কয়েকবার ডুব দিলো ডজ। দুপুরের দিকে, বেজায় কাহিল হয়ে পড়লো সে। সেদিনের মতো ঝিনুক তোলা স্থগিত রেখে দ্বীপে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো ওমর।
ডজ জানালো, ঢালের অগভীর অংশটায় ঝিনুক আর বেশি নেই, তোলা হয়ে গেছে। এরপর তুলতে হলে আরও নিচের দিকে নামতে হবে। আরও বেশি পানিতে ডুবে অতো নিচে নামার ক্ষমতা তার নেই। স্বীকার করলো একথা। অবশ্য আর ঝিনুক তোলার দরকারও নেই। যা তুলেছে, তাতে যদি মুক্তো পাওয়া যায়, যথেষ্ট হবে। সেগুলো নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে যা টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে বড় জাহাজ ভাড়া করতে পারবে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে, অভিজ্ঞ জাপানী ডুবুরি ভাড়া করে আরও গভীর থেকে ঝিনুক তোলার জন্য নিয়ে আসতে পারবে। এই এলাকার মুক্তো সব সাফ করে নিয়ে বিদেয় হবে তখন, তার আগে নয়।
দ্বীপে ফিরে চললো বিমান। কি ভাবছিলো ডজ, হঠাৎ মুখ তুনে হাসলো। এই শোনো, বিকেলটা শুধু শুধু বসে না থেকে ঝিনুকগুলো কিন্তু খুলে ফেলতে পারি। নিশ্চয়, এতোদিনে পচন ধরেছে ঝিনুকগুলোতে। দুর্গন্ধ এখন ততোটা হবে না।
কথাটা ঠিক। হুল্লোড় করে উঠলো সবাই।
ওমর বললো, ভালো কথা বলেছে।
লাঞ্চ সেরে আর একটা মুহূর্ত দেরি করলো না ওরা। সবাই উত্তেজিত হয়ে আছে ঝিনুকের ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে। চলে এলো দ্বীপের পশ্চিম ধারে, যেখানে পচার জন্যে ফেলে রাখা হয়েছে ঝিনুক।
এসেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো ওমর, কিশোর আর মুসা। ওদের অবস্থা দেখে হেসে ফেললো ডজ আর দুই পলিনেশিয়ান। মরা ঝিনুকগুলোর দিকে এগোতে এগোতে ডজ বললো, এখনই এই, আরও পচলে কি করতে? তা-ও তো বাতাস বইছে উল্টো দিকে, সরাসরি নাকে এসে লাগে না। নইলে দুর্গন্ধ কাকে বলে বুঝতে। হাসলো সে। তার পরেই কি মনে পড়ায় হাসি মুছে গেল। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালো সাগরের দিকে।
কি হলো? জিজ্ঞেস করলো ওমর।
একটা কথা, তার দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা ঝাঁকাল ডজ। এতোগুলো ঝিনুক একবারে পচতে দেয়া ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। ভয়াবহ গন্ধ, কল্পনা করতে পারবে না। সাগরের বিশ মাইল দূর থেকে পাওয়া যাবে। আর এই গন্ধ একবার যার নাকে লেগেছে, জীবনে ভুলবে না সে।
তুমি বলতে চাইছো কারনেসও পেয়ে যাবে?
মাথা কঁকালো ডজ। হ্যাঁ। তারপর গন্ধ শুকে ওকে এখানে এসে হাজির হওয়াটা কিছুই না তার জন্যে।
তা বোধহয় ঠিকই বলেছে।
অবশ্যই ঠিক বলেছি। তবে আর কিছু করার নেই এখন। ভবিষ্যতে আর এরকম ভুল করবো না। অল্প অল্প করে তুলে এনে পচাবো। মুক্তো বের করে নিয়ে হয় খোলাগুলো পুঁতে ফেলবো, নয়তো পানিতে ফেলে দেবো।
হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে। যদি আর এভাবে তোলার দরকার পড়ে আমাদের। জাহাজ নিয়ে এলে তো অন্য রকম ব্যবস্থা হবে।
হাতে করে একটা প্লাষ্টিকের বালতি আর একটা বিস্কুটের টিন নিয়ে এসেছে ডজ। বালতিতে পানি ভরে নিয়ে চলে এলো ঝিনুকগুলোর কাছে। গভীর আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে অন্যেরা, বিশেষ করে কিশোর, ওমর আর মুসা।
একটা ঝিনুক তুলে বালতির ওপরে এনে ডালার ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে দিলো ডজ। শক্ত কিছু লাগে কিনা দেখলো। তারপর ঝিনুকের ভেতরের নরম অংশটা বের করে ফেললো পানিতে। ডালাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো একপাশে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ঝুড়িতে রাখলো সাগরের হাসি।
একে একে চল্লিশটা ঝিনুক খুললো ডজ। যতোই খুলছে, হতাশা বাড়ছে। খোলাগুলো ছুঁড়ে ফেলছে। একটা মুক্তোও বেরোয়নি এতোক্ষণে। তবে, একচল্লিশ নম্বর ঝিনুকটা খুলে ভেতরে আঙুল ঢুকিয়েই চিৎকার করে উঠলো। বের করে আনলো ছোট নুড়ির সমান শাদা একটা জিনিস। তুলে দেখালো। রোদ লেগে ঝিক করে উঠলো যেন ওটার ভেতরের সুপ্ত আগুন।
মুক্তোটাকে চুমো খেলো সে। বললো, আমাদের সৌভাগ্য নাম্বার ওয়ান। এই শুরু হলো।
হাত থেকে হাতে ঘুরতে লাগলো মুক্তোটা।
দাম কতো হতে পারে? জিজ্ঞেস করলো মুসা। হাতের তালুতে রেখে মুক্তোটা দেখছে।
পাঁচ হাজারের কম বললে ঘুসি মারবো পাইকারের নাকে, হেসে জবাব দিলো ডজ।
যে হারে চলছে, ওমর বললো। তাতে এক বাটি ভরতেই অনেক সময় লাগবে। ঝুড়ি ভরতে অনেক দিন।
তবে ভরে ফেলবো, জোর দিয়ে বললো ডজ। অতো তাড়াহুড়ো করলে চলে না। মুক্তো বের করতে হলে ধৈর্য রাখতে হয়। একচল্লিশটা খুলে যে একটা পেয়েছি, এটা অনেক বেশিই মনে হয়েছে আমার কাছে। অনেক সময় কয়েক হাজার ঝিনুক খুলেও একটা মেলে না। আবার তার পর হয়তো পর পর ছয়-সাতটা খোলা হলো, দেখা যাবে সবগুলোতেই মুক্তো রয়েছে। এটা এক ধরনের জুয়াখেলা বলতে পারো। মরা ঝিনুকগুলোর ওপর হাত বোলালো সে। এগুলো হাজারে হাজারে খুলতে হবে বলে মনে হয় না। তবে হলে খুব হতাশ হব।
তার কথার সমর্থনেই যেন পরের ঝিনুকটাতেই পাওয়া গেল একেবারে পাঁচটা মুক্তো। তবে বেশি বড় নয়, ভালোও নয়। কমদামী জিনিস। যা-ই হোক, পাওয়া তো গেল। আশা বাড়লো ওদের। দ্রুত হাত চালালো ডজ। তার কাজ দেখেই বোঝা যায়, এই কাজে অভ্যস্ত সে।
কলরব করে উঠলো সবাই যখন অনেক বড় একটা মুক্তো বের করলো ডজ। দেখতে অনেকটা পানের মতো। রেফারেন্স বইতে লিখে রাখার মতো জিনিস এটা। কোনো একদিন হয়তো এটা শোভা পাবে কোনো রাজার মুকুটে, কিংবা রাজকুমারীর টায়রায়। আর পত্রিকায় যখন সেই ছবি দেখবে, কি একটা ধাক্কা খাবে, ভাবো? মনে করবে না, এটা তুমিই তুলেছিলে সাগরের তল থেকে! পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার ডলারে বিকোবে এটা। বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বললো সে।
খুব সুন্দর, কিশোর বললো।
তবে এতো সুন্দর আর লাগবে না, তিক্ত কষ্ঠে বিড়বিড় করলো ডজ। এখন যেমন লাগছে।
কাজ চলতে লাগলো। বিস্কুটের টিনে জমা হচ্ছে একের পর এক মুক্তো। একপাশে বড় হচ্ছে ফেলে দেয়া খোলার স্তূপ। শেষ ঝিনুকটাও খুলে ছুঁড়ে ফেলা হলো। কতগুলো মুক্তো পাওয়া গেল গুনতে লাগলো ডজ। পাঁচটা বড় বড় মুক্তো, অনেক দাম হবে সেগুলোর। উনিশটা পাওয়া গেছে মাঝারী আকারের। একটা ডাবল বাটন–দুটো মুক্তো জোড়া লেগে থাকলে ওগুলোকে বলে ডাবল বাটন আর দুই মুঠো সীড পার্ল-ছোট মুক্তো, কম দামী।
যাক, ভালোই পাওয়া গেল, ডজ বললো। অন্তত আফসোস করতে হবে না আর কিছু পেলাম না বলে। সব মিলিয়ে লাখ খানেকের বেশি চলে আসবে।
মুক্তো-টুক্তো তো ভালোই চেনেন, আইডিয়া আছে, মুসা বললো। কালচারড পার্লের কথা কিছু বলতে পারবেন? ওগুলোর নাম বেশ শোনা যায়। জাপানীরা নাকি ছোট ছোট খামার করে ওই মুক্তোর চাষ করে। খোলা ঝিনুকের পেটের ভেতরে হঠাৎ করে বালির কণা ফেলে দেয়, যাতে রস ছাড়তে পারে ঝিনুক। মুক্তো তৈরি হয়ে যায় ওই কণার চারপাশে রস জমে শক্ত হয়ে।
ওগুলো মুক্তো হলো নাকি? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লো ডজ। আসল মুক্তোর সঙ্গে ওসবের কোনো তুলনাই হয় না। আর কিছুদিন পর ওগুলো স্টেশনারি দোকানেই কিনতে পাবে। গয়নায় লাগিয়ে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করলেও অবাক হবো না।
এতোই শস্তা?
এতোই শস্তা।
কেন? ঝিনুকের পেট থেকেই তো আসে।
এলে কি হবে? রাসায়নিক কোনো গোলমাল রয়েছে হয়তো। ঝিনুকের পেট থেকে বের করার সময় চকচকেই থাকে, আসল মুক্তোর মতো। তারপর দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাড়াহুড়োয় তৈরি অনেক জিনিসের মতোই। আসল মুক্তোর মতো আভা থাকে না ওর ভেতরে। আর খোসা ছাড়ানো যায়।
খোসা! মুক্তোর? অবাক হয়েছে মুসা।
হ্যাঁ, খোসা। পেঁয়াজের খোসার মতো। একটার ওপরে আরেকটা জড়িয়ে থাকে। কথা বলছে, আর বালতির পানিতে হাতড়াচ্ছে ডজ, মুক্তো রয়েটয়ে গেল কিনা দেখছে।
ভুলেই গিয়েছিলাম, আচমকা বলে উঠলো কিশোর। আরেকটা আছে।
সবগুলো চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। ওমর জিজ্ঞেস করলো, কী?
সেই প্রথম মুক্তোটা, সাগরের হাসি যেটা তুলে এনেছিলো। রেখে দিয়েছিলাম। একটা গাছের গোড়ায়। যাই, নিয়ে আসি। দৌড়ে গিয়ে আধখোলা একটা ঝিনুক নিয়ে ফিরে এলো কিশোর। চেহারা দেখে তো মনে হয় না এর ভেতরে কিছু আছে। ঝিনুকটা ছোট। দেখতে বিশ্রীই বলা চলে। খোলার নানা জায়গায় দাগ, নিশ্চয় কোনো রোগ হয়েছিলো। শ্যাওলা লেগে রয়েছে এখনও, শুকিয়ে গেছে। অনেক বয়েস। বালিতে বসে পচা মাংসে আঙুল ঢুকিয়ে দিলো সে। শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। মুখ তুলে তাকালো সবার দিকে।
হাসলো ডজ। প্রথম মুক্তোটা পেলে ওরকমই হয়।
এটা আমার প্রথম নয়, কাঁপা গলায় বললো কিশোর। বড় বলেই! দুই আঙুলে ধরে মার্বেলের মতো বড় একটা মুক্তো বের করে আনলো সে। শাদা নয় ওটা, গোলাপী। এই জিনিস আগেও দেখেছে সে। একটা নয়, অনেকগুলো, আস্ত একটা হার। তবে সেগুলোর কোনোটাই এটার মতো বড় ছিলো না। এতো জীবন্তও নয়। হ্যাঁ, ভেতরের আগুন এমনভাবে ঝলকাচ্ছে, তার কাছে জ্যান্তই লাগছে জিনিসটা।
চুপ হয়ে গেছে সবাই। ডজ যতগুলো পেয়েছে, তার কোনোটাই এটার মতো নয়। অবশেষে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো সে, গোলাপী মুক্তো! নামই শুনেছি শুধু এতোদিন দেখিনি। প্যারিসে নিয়ে গেলে ঈশ্বরই জানে কতো পাওয়া যাবে!
খোসাটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে কিছু বলতে যাবে কিশোর, এই সময় আবার চোখ পড়লো ওটার ওপর। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। অন্যেরাও তাকালো। দেখলো ডালার ফাঁকে গোলাপী একটা জিনিস চকচক করছে। সবাই চুপ। কোনো শব্দ নেই। নীরবে গিয়ে দ্রুত ঝিনুকটা আবার কুড়িয়ে নিলো কিশোর, বের করে আনলো আরেকটা গোলাপী মুক্তো। বাঁ হাতের তালুতে দুটো মুক্তোই রেখে সবাইকে দেখালো।
কথা হারিয়ে ফেলেছে যেন ডজ। যখন বললো, গলা কাঁপতে লাগলো তার, কি সুন্দর! ব্যাঙ ঢুকেছে যেন তার গলায়, ঘড়ঘড় স্বর বেরোচ্ছে। দেখ, দেখ সবাই ভালো করে! কারণ আর কোনোদিন এমন দৃশ্য দেখতে পাবে না। লক্ষ লক্ষ বছর বাঁচলেও না। বহু বছর ধরে এদিকের সাগরে মুক্তো খুঁজে বেরিয়েছি আমি। আমারই মতো অনেকেই খুঁজে বেড়িয়েছে, এখনও খুঁজছে। ওদের কেউ কেউ জীবনের পঞ্চাশ-ষাট বছর এর পেছনে খরচ করে দিয়েছে। তা-ও এরকম কেউ দেখেনি, অন্তত আমার জানা মতে নেই কেউ। ওরকম একটা মুক্তোই ঝিনুক থেকে বের করে দেখার ভাগ্য খুব কম মানুষের হয়, একসঙ্গে দুটোর কথা তো ভাবাই যায় না! আমার যে কেমন লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না!
ভালোই হয়েছে, কিশোর বললো। এখন একটা করে রাখতে পারবো আমরা।
মানে?
একটা আমাদের, আর একটা সাগরের হাসির। ঝিনুকটা সে-ই তুলেছে। একটা তার পাওয়া উচিত।
পাগল হয়েছে! গলা চেপে দম আটকে দেয়া হয়েছে যেন ডজের। ওরকম একটা জোড়া ভাঙবে? অসম্ভব! রীতিমতো অপরাধ হয়ে যাবে সেটা। একই সঙ্গে জন্মেছে মুক্তোদুটো, একই সঙ্গে থাকা উচিত। তুমি বুঝতে পারছে না দুটো একসাথে থাকার কি মানে। ওর একটা মুক্তোর দামই হবে পঞ্চাশ-ষাট হাজার পাউন্ড। আর দুটো একসাথে থাকলে যা দাম হাঁকবে তাতেই বিক্রি হয়ে যাবে। রাজা তার রাজত্ব ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যাবে ওদুটো পাওয়ার জন্যে!
হ্যাঁ, ওগুলোর একসাথেই থাকা উচিত, ডজের সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালো ওমর।
ঠিক আছে, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। তাহলে দুটোই সাগরের হাসিকে দিয়ে দিই। একসাথেই থাকুক।
আরে না না, পাগল নাকি… কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল ডজ। বোধহয় ছোট হতে চাইলো না।
ঠোঁট ওল্টালো সাগরের হাসি। সহজ কণ্ঠে বললো, আমার ওসব দরকার নেই। কি করব? তার চেয়ে পিং মিনের দোকান থেকে কিছু লাল পুঁতি যদি কিনে দাও, এদুটো তোমাদেরকে দিয়ে দিতে পারি।
নিশ্চয় দেবো! তাড়াতাড়ি বললো ডজ। যত চাও ততো দেবো!
দেবে! খুব খুশি সাগরের হাসি। চোখ জ্বলজ্বল করছে। যতো চাই, দেবে!
দেবো।
পাগল নাকি! বিড়বিড় করলো মুসা। কয়েকটা পুঁতি কিনে দিলেই ওরকম দুটো মুক্তো…
মুসার দিকে তাকালো সাগরের হাসি। ওগুলো দিয়ে কি করবো আমি? পুঁতি পেলে হার বানিয়ে গলায় পরতে পারবো। ওগুলো ফুটোও করা যাবে না, মালাও গাঁথা যাবে না।
এরকম যুক্তির পর আর কথা চলে না। চুপ হয়ে গেল মুসা।
ডজ বললো, এতো পুঁতি কিনে দেবো, যতো খুশি মালা বানাতে পারবে। রাটুনায় পিং মিনের দোকানে নিয়ে যাবো। তোমার ইচ্ছে মতো কিনে নিও। পাউডার, স্নাে, লিপস্টিক, যা খুশি।
গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর। তার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে ঠকানো হচ্ছে।
সেটা বুঝতে পেরে হেসে ডজ বললো, তুমি ভাবছো ঠকাচ্ছি। তা ঠকাচ্ছি বটে। তবে দিতে তো চাইলে, নিলো না তো। এর চেয়ে অনেক বেশি খুশি হবে ও পুতি পেলে। মুক্তোগুলো জোর করে দিলে হয়তো নেবে, কিন্তু একটু পরেই ফেলে দেবে। ওর কাছে এগুলোর কোনো মূল্য নেই। তার চেয়ে ও যা পছন্দ করে সেটা দিলেই কি ভালো হয় না? মুক্তোগুলোও থাকবে।
আর কিছু বললো না কিশোর।
উঠে দাঁড়ালো ডজ। হাতটাত ধুয়ে গিয়ে চা খাওয়া দরকার। বাপরে বাপ, কি পচা গন্ধ! একেবারে গলার মধ্যে ঢুকে গেছে! বিস্কুটের টিনটা তুলে নিয়ে বললো, এগুলো কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার। প্লেনে রাখা ঠিক হবে না এখন, অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। একবারে যাওয়ার সময় তুলে নিলেই হবে।
লেগুনের ধারে ক্যাম্পে ফিরে এলো ওরা। নারকেল গাছের গোড়ায় বালির ওপরে পড়ে রয়েছে বিশাল একটা প্রবালের চাঙড়। কি করে এলো কে জানে। হয়তো ঝড়ে নিয়ে এসে ফেলেছে। যেভাবেই আসুক, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ডজের। টিনটা লুকানোর ভালো একটা জায়গা পেয়েই খুশি সে। চাঙড়ের তলায় বালিতে পুঁতে রাখলো টিনটা।
চা খাওয়ার পর সিগারেট ধরিয়ে নারকেল গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে আয়েস করে টানতে শুরু করলো ওমর। পাইপ ধরালো ডজ। ভালোই পেয়েছি, কি বল, বললো সে। বাকি ঝিনুকগুলো পচলে বের করে নিয়ে রওনা হতে পারি। যদি আবহাওয়া গন্ডগোল না করে।
আর যদি রেশনে টান না পড়ে, বললো ওমর। আরও তিনদিনের খাবার হবে বলে মনে হয় না। ছয়টা মুখ, কম তো নয়।
মাছ ধরতে পারি। পানিতে তো অভাব নেই। খাবারের অসুবিধে হবে না। তিনটে মাস কাটিয়ে দিয়েছি এখানে, কোনো সরঞ্জাম ছাড়া। এখন তো বড়শি সুতো সবই রয়েছে। কোন কোন মাছ খেতে ভালো, সাগরের হাসি আর ঝিনুক জানে। ওদের দিকে ফিরলো ডজ। এই, কিছু মাছ ধরে আনো না। খাওয়ার জন্য।
কথাটা মনে ধরলো। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো দুজনে।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে মুসা বললো, চলো, আমরাও যাই।
চলো।
পানির ধার ঘেঁষে শাদা বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চললো চারজনে। মাছ ধরার জন্যে জায়গা বাছাই করতে শুরু করলো সাগরের হাসি। কয়েকটা জায়গায় থেমে দেখলো। শেষে ছোট একটা গুহার সামনে এসে থামলো সে। খাড়া নেমে গেছে প্রবালের দেয়াল। আয়নার মতো শান্ত নিথর হয়ে আছে পানির ওপরটা। স্বচ্ছ। নিচে অলস ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করছে নানারকম মাছ, দেখা যাচ্ছে। ছোট একটা খাড়ি। বিশ ফুট গভীর হবে। দেয়ালের গা থেকে নেমে গেছে সিড়ির মতো ধাপ। একধারে জন্মে রয়েছে কয়েকটা নারকেল গাছ, দেখে মনে হয় একটাই গোড়া, সেটা থেকে বেরিয়েছে কান্ডগুলো, বাঁশের মতো। মাথা নুইয়ে রেখেছে পানির ওপর। পানিতে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব পড়েছে ওগুলোর। মনে হয় যেন পানির নিচে গজিয়েছে মাথা উল্টো করে।
দেয়ালের গা কামড়ে রয়েছে অসংখ্য শামুক। কয়েকটা তুলে আনলো সাগরের হাসি। খোলা ভেঙে ভেতরের মাংস বের করে বড়শিতে গেথে পানিতে ফেললো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে টোপ গিললো মাছ।
একের পর এক মাছ তুলে বালিতে ফেলতে লাগলো সে। এতো দ্রুত, বিশ্বাসই হতে চাইছে না দুই গোয়েন্দার। মেয়েটার হাত থেকে ছিপটা নিলো কিশোর। বড়শিতে টোপ গেঁথে দিলো সাগরের হাসি। সে ছিপ ফেললো। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনটে মাছ ধরে ফেললো।
যেগুলো খেতে ভালো, বেছে বেছে সেগুলোকে আলাদা করলো ঝিনুক। কিশোর বললো, হয়েছে। রাতে হয়ে যাবে। আর দরকার নেই।
এতো তাড়াতাড়ি মাছ ধরা শেষ হয়ে যাওয়ায় নিরাশই হলো মুসা। কাজকর্ম না থাকলে ভালো লাগে না। অহেতুক কতো আর বসে থাকা যায়?
আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি। ছিপ সরিয়ে রেখে ভোঁদড়ের মতো স্বচ্ছন্দে পানিতে নেমে গেল সাগরের হাসি। মিনিটখানেক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুসা। পানির নিচে এমন সহজ ভঙ্গিতে সাঁতার কাটছে মেয়েটা, দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। ডাঙার মানুষ নয় যেন, জলকুমারী। সাঁতার কাটার ইচ্ছেটা আর দমিয়ে রাখতে পারলো না মুসা। উঠে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলতে শুরু করলো। সেদিকে তাকিয়ে হাসলো কিশোর, আর পারলে না? তোমারও এখানেই জন্মানো উচিত ছিলো। হাহ হাহ।
গাছের নিচে শুকনো নারকেল পড়ে আছে। কুড়াতে কুড়াতে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালো একবার, তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলো।
জুতো খুলে রেখে পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো মুসা। সাগরের হাসিকে দেখার জন্যে নিচে তাকালো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একেবারে তল পর্যন্ত। কিন্তু মেয়েটা নেই। কোথায় গেল? অস্বস্তি বাড়তে লাগলো। হাত নেড়ে ডাকলো ঝিনুককে। এই ঝিনুক, দেখে যাও।
কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি উঠে এসে মুসার পাশে দাঁড়ালো কিশোর।
ঝিনুকও এলো। পানির নিচে চোখ বোলালো একবার। অবাক হয়েছে, চেহারাই বলে দিচ্ছে তার। খোলা লেগুনের দিকে খুঁজলো একবার। নেই দেখে আবার দৃষ্টি ফেরালো গুহাঁটার দিকে। অস্বস্তি ফুটেছে চোখে। সেটা দেখে ভয়ই পেয়ে গেল কিশোর আর মুসা। ওরকম গুহা মানেই এখন ওদের জন্যে আতঙ্কের জায়গা। অকটোপাস কিংবা অন্য কোনো জলদানবের বাড়ি।
পানিতে ঝাপিয়ে পড়লো ঝিনুক, ঢেউ উঠলো। সেটা না কমা পর্যন্ত নিচের দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পারলো না কিশোর আর মুসা।
ঝিনুকও গায়েব। তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না কোথাও। এক মিনিট গেল…দুই মিনিট। পরস্পরের দিকে তাকালো দুই গোয়েন্দা। দুজনে একই কথা ভাবছে। এমনকি পলিনেশিয়ানরাও পানির নিচে এতোক্ষণ দম বন্ধ করে থাকতে পারে না। কেমন অসহায় বোধ করতে লাগলো দুজনেই।
দেয়ালের ধার ধরে কিছুদূর দৌড়ে গেল মুসা। ঝিনুক কিংবা সাগরের হাসি আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলো। কিছুই নেই। সাগরের তলটা এখানে বেশ অন্ধকার, পানি বেশি গভীর হলে যেরকম হয়।
সাগরের হাসি যে গায়েব হয়েছে, পাঁচ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোনো মানুষের সাধ্য নেই, পানির নিচে ডুব দিয়ে এতোক্ষণ দম আটকে রাখে। নিশ্চয় অকটোপাসে ধরেছে! বিড়বিড় করলো মুসা।
ওমর আর ডজকে ডাকার জন্যে বলতে যাবে কিশোরকে, এই সময় যেন জাদুর বলে ভুস করে একটা মাথা ভেসে উঠলো। সাগরের হাসি! ফুচ করে মুখ থেকে পানি বের করে দিয়ে খিলখিল করে হাসলো।
কোথায় গিয়েছিলে? মুসার প্রশ্ন। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।
জবাবে আরেকবার খিলখিল হাসি। আবার বললো, সাঁতার কাটতে। পানিতে মুখ ডুবিয়ে ফু দিয়ে ভুরভুর করে বুদবুদ তুলতে লাগলো।
তুমি মানুষ না! মাছ!
ঝিনুকও ভেসে উঠলো। দুজনে মিলে সাঁতরে চললো লেগুনের মাঝখানে। কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসতে শুরু করলো। মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। নীরবে ওদের সাঁতার কাটা দেখছে।
মুসার দিকে হাত নেড়ে ডাকলো সাগরের হাসি, এসো।
পানিতে নামার কথা ভুলেই গিয়েছিলো মুসা। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো। সাঁতরে চলে এলো মেয়েটার কাছে।
এসো আমার সঙ্গে, মেয়েটা বললো। এসো, দেখাচ্ছি। বললো ঝিনুক।
কি দেখাবে?
সাগরের তল। খুব সুন্দর।
দেখতেই তো পাচ্ছি। আর কি দেখবো?
এসোই না।
কাছে এলো ঝিনুক। হ্যাঁ, এসো। জোরে দম নাও। ভয় লাগছে না তো?
না।
এসো তাহলে।
লম্বা শ্বাস টেনে ডুব দিলো মুসা। নামতে লাগলো নিচের দিকে। তার দুপাশে রয়েছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক। কিছুদূর নেমে, গুহাঁটার দিকে ইঙ্গিত করলো মেয়েটা। তিনজনেই সাঁতরাতে শুরু করলো ওটার দিকে। পানির বিশ ফুট নিচে রয়েছে এখন। আরও কাছে আসার পর মুসা বুঝলো, পানির ওপর থেকে প্রথমে যে গুহা দেখেছিলো, এটা সেটা নয়। আরেকটা।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের সঙ্গে ঢুকে পড়লো ভেতরে। ভয় ভয় লাগছে। অকটোপাস নেই তো? না বোধহয়। তাহলে ওদের দুজনকে আগে ধরতো। ওরা যে হারিয়ে গিয়েছিলো তখন, নিশ্চয় এই গুহাতেই ঢুকেছিলো। বাতাসও আছে। নইলে কিছুতেই পাঁচ মিনিটের বেশি সময় এখানে শ্বাস নিতে পারতো না সাগরের হাসি।
ঠিকই আন্দাজ করেছে মুসা। ওপরে ভেসে উঠলো সে, ওদের দেখাদেখি। পানির নিচের বেশ বড় একটা গুহায় ঢুকেছে ওরা। একধারে তাকের মতো দেখা গেল। তার ওপর উঠে পা দুলিয়ে বসলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। সাঁতরে এসে মুসাও উঠে বসলো।
গুহার সৌন্দর্য দেখে থ হয়ে গেল সে। পানির বেশি ওপরে নয় ছাতটা। জোয়ারের সময় ভরে যায় কিনা কে জানে। তবে সেটা নিয়ে আপাতত ভাবছে না মুসা। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে এক অপরূপ পরীর রাজ্য! ঘন নীল পানি। আলো আসছে কোথা থেকে বুঝতে পারছে না। নানা রঙের প্রবালের ছড়াছড়ি চারপাশে। রঙিন মাছের ঝাঁক।
অনেকক্ষণ দেখার পর জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললা মুসা। বললো, চলো, যাই। বেশি দেরি করলে ওরা আবার ভাববে।
বাইরে বেরিয়ে পানিতে মাথা তুলে দেখলো; নিচের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। উদ্বিগ্ন। মুসাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, কোথায় গিয়েছিলে?
গুহার ভেতরে। দারুণ জায়গা। যাবে নাকি?
মাথা নাড়লো কিশোর। নাহ, আরেক দিন।
মাছ নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলো ওরা।
ঝিনুক মরে পচন শুরু হতে অন্তত দুটো দিন সময় লাগবে। অযথা বসে না থেকে এই দুদিন মুক্তোর খেত থেকে ঝিনুক তুলে আনতে পারলেই লাভ, যা পাওয়া যায়। সেই আশাতেই যেতে লাগলো অভিযাত্রীরা। আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়িই, সতর্ক সংকেত জানালো ঝিনুক। এগিয়ে আসছে ঝড়।
জায়গাটাতে অকটোপাসের ভয় আপাতত নেই, ডজের সঙ্গে এব্যাপারে একমত হলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক দুজনেই। ডজের সঙ্গে সঙ্গে ওই দুজনও নামতে লাগলো। ডুবুরির গোশাকের দরকার হয় না ওদের। বড় করে দম নিয়ে ডুব দেয়, খানিক পরে ভেসে ওঠে দুই হাতে করে ঝিনুক নিয়ে। দেখে মুসারও নামার লোভ হলো। গভীর পানিতে কি করে ডুব দিতে হয়, জানা আছে তার, অভিজ্ঞতাও আছে। তবু বার বার করে তাকে শিখিয়ে দিলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। ওদের পদ্ধতি কিছুটা আলাদা। এতে সুবিধেই হলো মূসার।
ঝিনুক তোলার চেয়ে পানিতে নেমে খেলা করার দিকেই আগ্রহ বেশি সাগরের হাসি আর ঝিনুকের। মুসাও ওদের সঙ্গে যোগ দিলো।
দ্বিতীয় দিনের কথা। পানিতে নেমে ওরকম খেলা করছে তিনজনে। সাঁতরে দুজনের কাছ থেকে কিছুটা দূরে এসেছে মুসা। হঠাৎই দেখতে পেলো ওটাকে। শরীর বাকিয়ে ঘুরছে বিশাল এক হাঙর।
নাক নিচু করে এগিয়ে আসতে শুরু করলো ওটা। লম্বায় বিশ ফুটের কম হবে না। পেটটা শাদা, বাকি শরীরও শাদাই, তবে কিছুটা ময়লা। ধড়াস করে এক লাফ মারলো মুসার হৃৎপিন্ড। সঙ্গে ছুরিও নেই, যে বাধা দেবে। জানে যদিও, এতো বড় দানবের বিরুদ্ধে সামান্য ছুরি দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। ওপরে উঠে যে, পার পাবে তারও উপায় নেই। হাঙরটা নেমে আসছে ওপর দিক থেকেই। ফুসফুসের বাতাসও ফুরিয়ে এসেছে। এখন রওনা হলেও ওপরে উঠতে উঠতে শেষ হয়ে যাবে বাতাস। কি করবে?
দানবটা যদি তাকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে থাকে; তাহলে কোনোমতেই রক্ষা নেই। ফুসফুসে বাতাস থাকলেও না, না থাকলেও না। তবু হাত-পা গুটিয়ে রেখে বাঁচার চেষ্টা তো অন্তত করে দেখতে হবে।
ওপরে উঠতে শুরু করলো মুসা। বোধহয় এতোক্ষণ তাকে নজরে পড়েনি হাঙরটার, কিংবা দ্বিধায় ছিলো, কোন ধরনের জীব, আক্রমণ করবে কিনা, এসব। এখন মনে হলো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কারণ, আবার মুসার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে ওটা। দ্রুত এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
৮
এই সময় মুসা দেখলো ঝিনুক আর সাগরের হাসি নেমে আসছে। পানি এতই পরিষ্কার, মনে হচ্ছে পানিতে নয় ডাঙাতে রয়েছে ওরা। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে হাঙরটার দিকে সাঁতরে যাচ্ছে ঝিনুক। এখনও উঠছে মুসা, শেষ হয়ে আসছে শক্তি। যেন দুঃস্বপ্নের মাঝে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখছে দৃশ্যটা। ধীরে ধীরে ঘুরছে বিশাল দানবটা, তাকে ধরার জন্যে আসছে। ওটার মাথার কাছ দিয়ে চলে গেল ঝিনুক। পলকের জন্যে মুসা দেখলো, তার হাতটা উঠল নামলো একবার দ্রুত, সাপের মত ছোবল মারলো যেন ছুরি। হাঙরের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত, বেরিয়ে এলো। আবার আঘাত হানলো ঝিনুক। পাক খেয়ে ঘুরে গেল হাঙর। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। বেরিয়ে পড়েছে মারাত্মক দাঁতের সারি। কাছাকাছি রয়েছে সাগরের হাসি, তাকে কামড়াতে গেল ওটা। ওপর দিকে ছুরি চালিয়ে হাঙরের পেট কেঁড়ে দিলো মেয়েটা।
হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করেছে মুসা। পানিতে লাথি মেরে ভেসে উঠতে চাইছে ওপরে। পানি আর আগের মত পরিষ্কার নয়, রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে হাঙর। ঘোলাটে লাল পানির ভেতরে এখন কি ঘটছে, আর দেখা গেল না। একটাই ভাবনা, যে করেই হোক, ভেসে উঠতে হবে। মনে হচ্ছে এই বুঝি পায়ে কামড় বসালো হাঙরটা। ফুসফুসের বাতাস শেষ। যখন ভাবলো, আর উঠতেই পারবে না, এই সময় পানির ওপরে ভেসে উঠলো মাথা। হাত বাড়িয়েই রেখেছে ডজ আর কিশোর। একটানে তাকে তুলে নিলো ওপরে।
কয়েক সেকেন্ড কেবিনের মেঝেতে চিত হয়ে রইলো মুসা। জোরে জোরে দম নিচ্ছে। অবশেষে কোনমতে জিজ্ঞেস করলো, ওরা উঠেছে?
না, জবাব দিলো ডজ।
কিন্তু…নিচে…একটা হাঙর…
জানি। দেখেছি। ওটাকে মারতেই গেছে দুজনে।
ওদেরকেই মেরে ফেলবে তো!
তা পারবে না। এরকম লড়াই অনেক করেছে ওরা। মারকুইজানদের সঙ্গে পারে না হাঙর। পেছন থেকে না জানিয়ে হঠাৎ এসে যদি ধরে ফেলতে পারে, তো পারে, নইলে সম্ভব না। হাঙর শিকার করতে ওস্তাদ মারকুইজানরা। ওদের কাছে খেলা।
আমার কাছে মোটেও খেলা মনে হয়নি, বিড়বিড় করলো মুসা। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো নিচে কি ঘটছে দেখার জন্যে।
পানিতে ভাসলো সাগরের হাসির মাথা। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে এলো ওপরে। ফুচচ করে মুখ থেকে পানি ফেলে বললো, আউফ! ম্যাকো!
তার পর পরই উঠে এলো ঝিনুক। কাঁধের একটা কাটা থেকে রক্ত পড়ছে। সেটা দেখে চিৎকার করে উঠলো মুসা, খাইছে! কামড়ে দিয়েছে!
নাআহ, তেমন কিছু না, ডজ বললো। সামান্য আঁচড়। সিরিশ কাগজের মত ধারালো হাঙরের চামড়া, ঘষা লাগলে ছড়ে যায়।
মেঝেতে বসে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগলো দুই পলিনেশিয়ান। নিজেরা নিজেরা কথা বলছে।
কি বলে? জানতে চাইলো ওমর।
বলছে, মারতে পারেনি। তার আগেই এসে হাজির হয়েছে একটা সোর্ডফিশ। ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে। রক্তের গন্ধে হাজির হয়েছে। ওরা বলছে, হাঙরের চেয়ে বড় ওটা।
নিশ্চয় ততটা ডেনজারাস নয়, তাই না?
তা বলা যায় না। হাঙরের মত যখন তখন মানুষকে আক্রমণ করে না বটে, তবে যদি করে, তো বাঁচার আশাও শেষ। হাঙরের কবল থেকে ফেরা যায়; ওদের কবল থেকে না। সাংঘাতিক শক্ত তলোয়ার দিয়ে জাহাজের তলা ফুটো করে দেয়, মানুষ তো কিছু না।
বিশ্বাস করেন, একথা? মুসার প্রশ্ন।
করব না কেন? অ্যাডমিরালটি রেকর্ড দেখলেই বুঝবে। প্রাইমাউথের জাহাজ দা ফরচুনকে একবার আক্রমণ করেছিলো সোর্ডফিশ। তামার পাত লাগানো ছিল জাহাজটার তলায়। পাতের ওপরে ছিলো তিন ইঞ্চি পুরু লোহাকাঠ, তার ওপরে বার ইঞ্চি পুরু ওককাঠের তক্তা। সেসব তো ফুড়েছেই, ওপরে রাখা একটা তেলের ড্রামও ফুটো করে দিয়েছিলো। আরেকবার একটা ব্রিটিশ জাহাজ-নামটা ভুলে গেছি, ওটারও তলা ফুটো করেছিলো সোর্ডফিশ। সমস্ত পাম্প চালিয়ে দিয়ে পানি সেচতে সেচতে বন্দরে ফিরেছিলো জাহাজটা। সোর্ডফিশকে ছোট করে দেখো না।
তাহলে কেটে পড়া দরকার, শঙ্কিত হয়ে উঠলো ওমর। জাহাজেরই যদি এই গতি করে, ফ্লাইং বোটের ওপর খেপে গেলে সর্বনাশ করে দেবে। এক ইঞ্চি ধাতব পাত ওটার জন্যে কিছুই না, বুঝতে পারছি। তার কথা শেষ হতে না হতেই পানিতে জোর আলোড়ন উঠলো। এই, কি হল?
সবাই তাকালো সেদিকে। পানিতে প্রচন্ড আলোড়ন, সেই সাথে ফেনা। দেখ দেখ! চিৎকার করে উঠলো কিশোর।
সবার চোখ পড়েছে সেদিকে। পানিতে লাফিয়ে উঠলো বিশাল এক হাঙর। মুসাকে আক্রমণ করেছিলো যেটা সেটাও হতে পারে কিংবা অন্যটা। একটা মুহূর্ত যেন ঝুলে থাকলো শূন্যে, তারপর ঝপাস করে পড়লো। মস্ত ঢেউ উঠলো পানিতে। পরক্ষণেই একটু দূর ভেসে উঠলো সোর্ডফিশটা। নিশ্চয় ওটাই হাঙরটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল।
আপু! আপু! চেঁচিয়ে উঠলো ঝিনুক। জলদি পালান!
ওমর, জলদি! তাগাদা দিলো ডজ। ঝিনুক যখন ভয় পেয়েছে, তার মানে..
আর শোনার জন্যে দাঁড়ালো না ওমর। ককপিটের দিকে দৌড় দিলো। শখানেক গজ দূরে রয়েছে সোর্ডফিশ। বিমানটাকে বোধহয় কোন শয়তান জানোয়ার ভেবে ছুটে আসতে শুরু করলো আক্রমণ করার জন্যে।
চালু হয়ে গেল একটা ইঞ্জিন। তার পর পরই দ্বিতীয়টা। সবে চলতে শুরু করেছে বিমান, এই সময় প্রচন্ড এক আঘাতে কেঁপে উঠলো থরথর করে। ঝাঁকি দিয়ে পানির ওপরে উঠে গেল কয়েক ইঞ্চি। সীট থেকে প্রায় উড়ে চলে গেল ওমর। যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণের কেউ রইলো না। কোনমতে উঠে গিয়ে সীটে বসে আবার জয়স্টিক চেপে ধরলো সে।
মুহূর্ত পরেই তিরিশ ফুট দূরে ভেসে উঠলো সোর্ডফিশ। দ্রুত বিমানটাকে ওটার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো ওমর। কিন্তু ওড়ার আগেই আবার এক ভয়াবহ ঝাঁকুনি। ভোজবাজির মত যেন কেবিনের মেঝে ফুড়ে উদয় হলো একটা বিশাল তলোয়ারের মাথা। পলকের জন্যে। তারপরই এক হ্যাচকা টানে সরে গেল ওটা। গলগল করে পানি ঢুকতে শুরু করলো ফুটো দিয়ে। একটা তোয়ালে দিয়ে পানি বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো কিশোর। চেঁচাতে লাগলো, ওমরভাই, জলদি! জলদি করুন! দুই মিনিটও লাগবে না ডুবতে!
ককপিটের দিকে ছুটে গেল মুসা। তাড়াতাড়ি ওড়ান! ফুটো করে দিয়েছে!
চেষ্টা তো করছি!
পঞ্চাশ ফুট গিয়ে ঘুরতে শুরু করলো সোর্ডফিশ। আবার এসে খোঁচা মারার ইচ্ছে বোধহয়। আবার আসছে! বলেই পিস্তল বের করে গুলি করতে লাগলো ডজ। ওটার গায়ে লাগলো কিনা বোঝা গেল না, তবে ততক্ষণে মাছটার চেয়ে গতি বেড়ে গেছে বিমানের। কেবিনে ফিরে এসে মুসা দেখলো তুলকালাম কান্ড শুরু হয়েছে সেখানে। পানি বন্ধ করার চেষ্টা করছে সবাই প্রাণপণে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই ভেসে গেছে মেঝে। কিশোর বললো মুসাকে, ওমর ভাইকে চালিয়ে যেতে বল। থামলে আরও বেশি ঢুকবে।
ছুটে এসে ওমরকে খবরটা জানালো মুসা।
তুলতেই পারছি না! ফাসফেঁসে কণ্ঠে বললো ওমর। একেতো ঝিনুকের ভার, তার ওপর পানি…উঠতেই চাইছে না!
কি করব?
সমস্ত ভার ফেলে দিতে হবে। আগে গিয়ে ডুবুরির সরঞ্জামগুলো ফেল। ওগুলোই সব চেয়ে ভারি।
ছুটে কেবিনে ফিরে এলো মুসা। জানালা দিয়ে দেখলো, ডজ আইল্যান্ড প্রায় মাইল দুয়েক দূরে এখনও। তীব্র গতিতে ট্যাক্সিইং করে ছুটছে বিমান। তবে ওড়ার শক্তি অর্জন করতে পারছে না কিছুতেই। ওমর ভাই বলেছে, ডাইভিং গীয়ারগুলো ফেলে দিতে। বোঝা কমাতে।
একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলো না ডজ। টেনে নিয়ে এলো বেজায় ভারি ডাইভিং কিট, সাথে লাগানো চল্লিশ পাউন্ড ওজনের বুটসহ। দরজা দিয়ে ফেলে দিলো পানিতে। ওগুলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগেই ফেললো হেলমেটটা। তার পর একে একে পাম্প, লাইন, আর আরও যা যন্ত্রপাতি আছে, সব।
ঝিনকুগুলোর দিকে হাত বাড়ালো মুসা। তাকে বাধা দিলো সাগরের হাসি, না, দরকার নেই। আমি নেমে যাচ্ছি। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। তার পেছনে গেল ঝিনুক।
ধরো! ধরো! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর।
ভয় নেই, ডজ বললো। মাত্র এক মাইল। ওটুকু সাঁতরানো কিছুই না ওদের জন্যে।
অনেকখানি ভারমুক্ত হয়ে গিয়ে অবশেষে উঠতে শুরু করলো বিমানটা। পানি ছেড়ে ওপরে উঠতেই ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো কেবিনের পানি। আরও কমে যেতে লাগলো ভার। লেগুনের ওপর যখন চক্কর মারতে শুরু করলো ওটা, সব পানি বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে।
ওমরের কাছে এসে দাঁড়ালো কিশোর। তাকে বললো ওমর, সবাইকে গিয়ে বলো, বেশি পানিতে নামালে আবার পানি ঢুকে ডুবে যাবে। পানির কিনারে নামিয়ে বালিতে তুলে ফেলার চেষ্টা করবো। পানি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সবাই লাফিয়ে নেমে যায়। ভার কম থাকলে বালিতে তোলা সহজ হবে।
ছুটে এসে সবাইকে কথাটা বললো কিশোর।
যতটা সম্ভব আস্তে পানিতে নামানোর চেষ্টা করলো ওমর। কিন্তু বিমানের পেট পানি ছুঁতে না ছুঁতেই আবার গলগল করে পানি ঢুকতে আরম্ভ করলো। সোজা সৈকতের দিকে ছোটালো সে।
পঞ্চাশ গজ দূরে থাকতে প্রথম লাফ দিলো মুসা। বিশ মাইল গতিতে ছুটছে তখন বিমান। মাথা তুললো বিমানের পেছনে ঢেউ আর ফেনার মধ্যে। তার পেছনে গেল কিশোর। সবার শেষে ডজ। পানিতে হাবুডুবু খেল তিনজনেই, সব চেয়ে বেশি কিশোর।
আবার যখন কেবিনে এসে উঠলো তিনজনে, কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ওমরকে। ঝিনুকগুলো বের করে সৈকতে ফেলার চেষ্টা করছে। তিনজনকে দেখে কাজের ভার ওদের ওপর ছেড়ে দিয়ে ককপিটে ফিরে এলো সে। একটু একটু করে ইঞ্জিনের জোর বাড়িয়ে বালিতে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো বিমানটাকে। ঝিনুক ফেলতে শুরু করেছে অন্য তিনজনে। এতে আরও কমে যেতে লাগলো। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে চললো বিমান।
সমস্ত জিনিসপত্র বের করে আনা হলো বিমান থেকে। কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখতে বসলো ওমর। ডজের উদ্দেশ্যে বললো, তুমি তো মানাই করেছিলে। বললে কি দরকার। এ জন্যেই বুঝলে, এ কারণেই ওগুলো আনতে চেয়েছি আমি। জানতাম প্রবালে ঘষা খেয়ে ফুটো হয়ে যেতে পারে। পাতগুলো এনে ভাল করেছি, কি মনে হয়?
নীরবে মাথা ঝাঁকালো শুধু ডজ।
আরেকটু হলেই মারা পড়েছিলো, কিশোর বললো। ডজের বড়জোর তিন ইঞ্চি দূর দিয়ে গিয়েছিলো মাথাটা। একটু সরে লাগলেই এতক্ষণে…, কথাটা শেষ করে হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো সে।
বাপরে বাপ, যে জায়গার জায়গা, হেসে বললো ওমর। বিমানের তলায় আরমার প্লেট লাগিয়ে নেয়া দরকার। যাকগে। ক্ষতি বেশি হয়নি। পাত কেটে লাগিয়ে ফুটোটা বন্ধ করে ফেলা যাবে। বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত হবে, তবে ঝিনুক তোলার এখানেই ইতি।
আর বোধহয় দরকারও নেই, মুসা বললো।
না। অনেক হয়েছে, সায় জানালো ডজ। যা পেয়েছি নিয়ে চলে যাই। পরে আসা যাবে।
ওই যে ওরা আসছে, কিশোর বললো। আরেকটু দেরি হলেই ভাবনায় পড়ে যেতাম।
একটুও ক্লান্ত মনে হলো না দুই পলিনেশিয়ানকে। স্বচ্ছন্দে সাঁতরে আসছে। কাছে এসে হাত তুলে হেসে বললো, কাওহা! যেন পুরো ব্যাপারটাই একটা রসিকতা।
ঝিনুকগুলো রোদে ফেলে রাখতে হবে, ডজ বললো। আশা করি কালই খুলতে পারব। এই, হাত লাগাও, কিশোর। আর মুসাকে বললো সে। শেষ করে ফেলি।
এগুলোতেও নিশ্চয় কিছু পাওয়া যাবে, ঝিনুকগুলো দেখিয়ে ওমর বললো। স্কুনার একটা কিনে ফেলতে পারবে, ডজ। আরও মুক্তো তুলতে ফিরে আসতে পারবে।
চোয়াল ডললো ডজ। কি জানি। আসতে তো চাইই। তবে মুক্তো পাওয়া এবং ধরে রাখার জন্যে ভাগ্য লাগে। আমার সেটা আছে বলে মনে হয় না। যা কিছু ভালো হয়েছে সব তোমাদের ভাগ্যে।
ননসেন্স! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো ওমর। ওসব বিশ্বাস কর নাকি। কাল বিকেলে রাটুনায় ফিরে যাচ্ছি আমরা। এর মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।
৯
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলো ওরা। কাজে লেগে গেল। বিমানটা মেরামত করতে গেল ওমর, কিশোর আর মুসা। ধাতুর পাত কেটে টুকরো করে ফুটোটা বন্ধ করবে। ডজ, ঝিনুক আর সাগরের হাসি গেল ঝিনুকগুলো খুলে দেখতে। পানির ধার থেকে দূরে সৈকতের ওপরে বসে খুলতে শুরু করল ওরা। মাঝে মাঝে শোনা যেতে লাগলো ওদের চিৎকার, মুক্তো পেলেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠছে।
ভালই কাটলো দিনটা। বিকেলের শেষে আকাশের নীল যখন মলিন হয়ে এলো, মেরামতের কাজ তখন শেষ করে এনেছে ওমররা। আর মাত্র কয়েকটা ঝিনুক খোলা বাকি ডজদের। প্রথম দিনের মত এত ভাল আর বেশি ঝিনুক পাওয়া গেল না, তবে মন্দ পায়নি। ঝিনুকগুলো ঠিকমত পচার সময় পায়নি, নরম হয়নি, ফলে খুলতে সময় লাগছে।
সব মিলিয়ে ঝুড়ি না ভরলেও ডজের হ্যাটের অর্ধেকটা যে ভরা যাবে মুক্তো দিয়ে তাতে সন্দেহ নেই। নতুন সরঞ্জাম কিনে নিয়ে এসে খেতের বাকি ঝিনুকগুলোও সাবাড় করে দিয়ে যাবার ইচ্ছেটা তার একটুও কমলো না, বরং বাড়লো।
মুক্তোগুলো সব একসাথে রাখতে রাখতে ডজ বললো, তোমরা গিয়ে কিছু মাছ ধরে আনলে পার। খাওয়া যেত।
কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। হেসে বললো, প্রতি বেলাতেই যে হারে মাছ খাচ্ছি, শেষে না মাছের গন্ধই বেরোতে শুরু করে গা দিয়ে।
বড়শি নিয়ে রওনা হলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। কিশোরও তাদের সঙ্গে চললো।
পশ্চিমের আকাশে বিচিত্র রঙ। প্রশান্ত মহাসাগরের অপরূপ সূর্যাস্তের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ওমর। তারপর চোখ ফেরালো আবার জায়গাটার দিকে, যেখানটা মেরামত করেছে। শেষবারের মত পরীক্ষা করে দেখলো সব ঠিক আছে কিনা। ককপিটে এসে ইনস্ট্রমেন্ট বোর্ডের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। বেরিয়ে দ্রুত চলে এলো ডজের কাছে। মুসাও তখন ওখানে।
কি ব্যাপার? ওমরের মুখ দেখেই আন্দাজ করে ফেলেছে ডজ, খারাপ খবর আছে।
ব্যারোমিটারের রিডিং ভাল না, জানালো ওমর।
আকাশের দিকে তাকালো ডজ। কই, ভালই তো আবহাওয়া। খারাপ লাগছে না।
আকাশ-ফাঁকাশ দেখে বোঝা মুশকিল। রিডিং তিরিশের নিচে নেমে গেছে। পড়ছেই।
চমকে গেল ডজ। কী!
মাথা ঝাঁকাল ওমর। গিয়ে দেখ বিশ্বাস না হলে।
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো ডজ। ব্যারোমিটার দেখতে গেল না। বললো, জলদি গোছগাছ করে নিতে হবে। যেরকম নামছে বলছো, বড় রকমের ঝড় আসবে। এখনি উড়তে হবে।
পারা যাবে না।
কেন?
জোয়ার না এলে পানিতে নামানো যাবে না প্লেনটাকে।
এতক্ষণ থাকা যাবে না। ঠেলেঠুলে নামাতে হবে। রাটুনায় গিয়ে পৌঁছতে পারলে যত বড় ঝড়ই আসুক, কিছু করতে পারবে না আমাদের। কিন্তু এখানে থাকলে পাঁচ মিনিটে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে প্লেনটাকে চল।
ফুরফুর করে বাতাস বইছে। মনে হয় খুব ভাল, আসলে তা নয়। ইতিমধ্যেই লেগুনের বাইরে দেয়ালের গায়ে বড় হয়ে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে ঢেউ। বজ্রের মত গর্জন করছে, আর সেই সাথে অনেক ওপরে ছিটিয়ে দিচ্ছে পানির কণা।
আরও আগেই বোঝা উচিত ছিলো আমার, বিড়বিড় করলো ডজ।
এখন আর ভেবে লাভ নেই। চল দেখি নড়ানো যায় নাকি। মুসার দিকে ফিরে ওমর বললো, জলদি ওদের ডেকে নিয়ে এস। মাছ আর লাগবে না।
দৌড় দিলো মুসা। জরুরী অবস্থা এখন।
বিমানের নাকের কাছটায় রইলো ওমর। ঠেলতে লাগলো। নড়লও না বিমান। যেন বালিতে শেকড় গজিয়ে গেছে ওটার। পানির দিকে তাকিয়ে বললো, জোয়ার অবশ্য এসে গেছে। আর দশ মিনিট পরেই ভাসিয়ে ফেলবে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো, আল্লাহ! দেখতে দেখতে কি কান্ড হয়ে গেল!
ঢোকার মুখটা দেখুন না! মুসা বললো।
লেগুনে ঢোকার প্রণালীটাতে এখন আর পানি আছে বলে মনে হয় না। শুধু ফেনা। পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে। হ্যাঁ, হয়ে গেছে কাজ! ডজ বললো। আসছে। আর কোনই সন্দেহ নেই।
দশ মিনিটের মধ্যেই রওনা হতে না পারলে, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ওমর বললো। রাটুনায় পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। ঝড়ের মধ্যে অন্ধকার সাগরের ওপর দিয়ে ওড়ার সাহস নেই আমার। রাটুনায় ল্যান্ডিং লাইটও নেই যে আলো দেখে নামতে পারব। সময় থাকতে এখানে একটা জায়গা খুঁজে বের করা দরকার, যেখানে একটু আশ্রয় মিলবে।
কিছু বলছে না ডজ। তাকিয়ে রয়েছে সাগরের দিকে।
পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল ওমর। মুসা ফিরে এসেছে, একা।
ওরা কোথায়? জানতে চাইলো ডজ। আমরা এখুনি রওনা হব।
পেলাম না, জবাব দিলো মুসা।
পেলে না মানে? যাবে কোথায়? দ্বীপেই আছে।
সারাটা দ্বীপ খুঁজে এসেছি। ওরা নেই। কিশোরের জুতো পেয়েছি, আর বড়শি দিয়ে ধরা কিছু মাছ। ওদের চিহ্নও নেই।
জুতো কোথায় পেলে?
এই তো, কাছেই। প্রবালের ওপর পড়ে ছিলো। একটা খাড়ির ধারে।
ডজের দিকে তাকালো ওমর। ব্যাপারটা কি? গেল কোথায়?
মাথা নাড়লো ডজ। বুঝতে পারছি না। ক্ষতি হবে না কিশোরের। সাগরের হাসি আর ঝিনুক রয়েছে তার সঙ্গে। এসময় কি করতে হবে ভাল করেই জানে ওরা।
জানলেই ভাল। কিন্তু কথা হল, ওদেরকে না নিয়ে তো যেতে পারছি না আমরা। প্লেনটা ভাসিয়ে রাখি। তৈরি হয়ে থাকি। ওরা এলেই রওনা দেব।
পনের মিনিট পেরিয়ে গেল। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে পশ্চিমের আকাশ। তার ভেতরে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে দৃশ্যটা। ভয় ভয় করে। ইতিমধ্যেই দিগন্ত রেখার নিচে অনেকখানি নেমে গেছে সূর্য, যেন পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে যেন টুপ করে ডুবে গেল। অন্ধকার নামতে শুরু করলো।
গেল! হাত নেড়ে বলল ওমর। আজকে ফেরার আশা শেষ। রাতে আর পারব না। কিন্তু ওরা গেল কোথায়? আর তো চুপ করে থাকতে পারছি না।
প্লেনটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। রীফের দিকে হাত তুলে দেখালো মুসা। এখুনি কিছু করতে না পারলে সর্বনাশ করে দেবে।
এই প্রথমবার দেখলো, প্রবালের দেয়াল ছাপিয়ে লেগুনে ঢুকতে আরম্ভ করেছে সাগরের পানি। ঢেউ এসে ঝাপিয়ে পড়ছে ওপাশে, ঠেলে পানি ঢুকিয়ে দিচ্ছে লেগুনের ভেতর, ফলে ভেতরেও ঢেউ উঠছে এখন। পানি ফুলে ওঠায় বিমানটাও ভেসে উঠেছে। ভীষণ দুলছে।
নোঙরে ভার বেঁধে দেয়া দরকার, ওমর বললো। তাহলে দুলুনি কিছুটা কমতে পারে।
সত্যি সত্যি যদি ঝড় আসে, এক ডজন নোঙর বাঁধলেও লাভ হবে না, ডজ বললো। ছিড়ে নিয়ে চলে যাবে। চোখের পলকে।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো ওমর। সেজন্যে তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। কিছু একটা করতেই হবে। বড় বড় প্রবালের চাঙড় এনে নাক আর লেজের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখব। নোঙরের কাজ করবে।
এটা অবশ্য করা যায়, ডজ বললো। টিকবে বলে মনে হয় না। তবু, চেষ্টা করি।
মুসা, আরেকবার গিয়ে দেখ কিশোরদেরকে পাও কিনা। আমি আর ডজ কাজটা সেরে ফেলি।
মাথা ঝাঁকিয়ে তাড়াহুড়া করে রওনা হয়ে গেল মুসা।
আধ ঘণ্টা পরেই ফিরে এল। ততক্ষণে ছয়টা নোঙর বেঁধে ফেলা হয়েছে বিমানের, ভাল সময়ে এর যে কোন একটাই বিমানকে আটকে রাখতে যথেষ্ট। পেলাম না, মুসা জানালো। কিশোরের জুতো আগের জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। সাঁতার কাটতে নেমেছিলো মনে হয়। ওমর ভাই, ভয় লাগছে আমার। কিছু হলো তো?
একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইলো ওমর। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে বললো সে। কিছু একটা হয়েছে। নইলে ফিরে আসতো। পানিতেই কোন একটা ব্যাপার ঘটেছে। ডুবে মরেছে, এটা ভাবতে পারছি না। তবে কোন ভাবে বাইরের সাগরে গিয়ে পড়লে কি হবে বলা যায় না। ঢেউয়ের টানে ভেসে চলে যেতেই পারে।
তাহলে তো আরও অনেক কিছুই ঘটতে পারে, বললো ডজ। হাঙরে ধরে খেয়ে ফেলতে পারে…
তা পারবে না, বাধা দিয়ে বললো ওমর। একজনকে হয়ত খেতে পারে, একসঙ্গে তিনজনকে সম্ভব না। বিশেষ করে ঝিনুক আর সাগরের হাসিকে। ওই একটা ঘটনাই ঘটে থাকতে পারে। দেয়ালে চড়েছিল হয়ত কিশোর। ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়েছে তাকে। বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে পড়েছে তখন সাগরের হাসি আর ঝিনুক। ওরাও ভেসে গেছে। ঢেউয়ের জন্যে এখন আর ফিরতে পারছে না। এক মুহূর্ত ভাবল সে। অন্ধকার না হলে উড়ে গিয়ে দেখতে পারতাম। কিন্তু এখন প্লেন নিয়ে ওঠাই যাবে না। উঠলে আর নামতে পারবো না। যা ঢেউ, নামতে গেলেই বাড়ি মেরে উল্টে ফেলবে। এক মিনিট লাগবে ডোবাতে।
বিশাল ঢেউয়ের ভারি গর্জন যেন সমর্থন করল ওমরের কথা। ভয়ংকর গতিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দেয়ালের গায়ে, তার আঘাতে কাঁপছে এখন দ্বীপটা। বাতাসের বেগ বাড়ছে। নারকেলের পাতা ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, ওমর বললো।
করবটা কি তাহলে? বিড়বিড় করলো ডজ। কিছু তো করা দরকার। চুপ থাকতে পারি না।
চল, সবাই মিলে আরেকবার খুঁজি, গম্ভীর হয়ে বললো ওমর। ফল হবে বলে মনে হয় না। মুসা, তুমি পুবে যাও। ডজ মাঝখানটায় গিয়ে খোঁজ। আমি যাচ্ছি পশ্চিম দিকে।
আলাদা হয়ে খুঁজতে বেরোল তিনজনে। কিশোর আর দুই পলিনেশিয়ানের নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে।
ঘণ্টাখানেক পরে আগের জায়গায় ফিরে এসে ওমর দেখলো, মুসা আর ডজ দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতে হলো না, ওদের মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলো। আর কিছু করার নেই আমাদের, তিক্ত কণ্ঠে বললো সে। সকালের জন্যে বসে থাকতে হবে। ঝড় যদি থামে, আর প্লেনটা আস্ত থাকে তাহলে আরেকবার খুঁজতে বেরোব আরকি। থমথম করছে তার মুখ। আল্লাই জানে ওদের কি হলো!
ধীরে ধীরে কাটছে সময়।
মুসার মনে হলো কয়েক শো বছর পরে অবশেষে হালকা হয়ে এলো পুব আকাশের অন্ধকার। ভোর যতই এগিয়ে এলো, বাড়তে থাকলো-ঝড়ের বেগ। দেয়ালের ওপর দিয়ে পানি পাঠাতে আর চেষ্টা করতে হচ্ছে না এখন ঢেউকে, আপনাআপনিই ঢুকে পড়ছে। সাগর আর লেগুন এখন প্রায় এক হয়ে গেছে। কয়েক ঘণ্টা আগেও নীরব আর শান্ত ছিলো যে সৈকত সেখানে এখন ঢেউ আছড়ে ভাঙছে। বাঁধা গরুর মতো দড়ি টানাটানি করছে বিমানটা, যেন দড়ি ছিড়ে পালাতে চাইছে।
আরেকটু জোর বাড়লে টিকবে না, ওমর বললো। ব্যারোমিটারটা দেখে আসিগে। কোমর পানিতে ভিজে এসে অনেক কায়দা কসরৎ করে বিমানে উঠলো সে। ককপিটে ঢুকলো। ইনট্রুমেনটস বোর্ড দেখে ফিরে এসে নামলো আবার পানিতে। কিংবা বলা যায় পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হলো তাকে।
কি দেখলে? জিজ্ঞেস করলো ডজ।
উনত্রিশ।
ভাল। এসেই গেল তাহলে।
এখন উড়তে না পারলে আর কোনদিনই পারব না। লেগুনের দিকে হাত তুললো ওমর। অবস্থা দেখেছ। আরেকটু পরেই বাইরের সঙ্গে এর কোন তফাৎ থাকবে না। মহাবিপদে পড়ে গেলাম। কিশোররাও ফিরল না। এই ডজ, কি করি?
যাওয়াই উচিত, গলায় জোর নেই ডজের। ঝড় থামলে আবার ফিরে আসা যাবে। খুঁজতে হবে ওদের। আর বসে থেকে এখন প্লেনটাই যদি ভেঙে যায়, আমরাও ফিরতে পারবো না। ওরা এলে ওরাও পারবে না। মোটকথা সবাই আটকা পড়বো তখন।
বেশ, ওঠ গিয়ে, ওমর বললো। খুব সাবধান। যে হারে টানে পানি, পা ফসকে ভেসে গেলে আর আসতে পারবে না।
একজন আরেকজনের হাত ধরে একটা শেকল তৈরি করলো ওরা। পানির টানের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কোনমতে যেন নিজেদেরকে টেনে তুললো বিমানে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ওমর। ইঞ্জিন, ঢেউ, বাতাস আর নারকেল পাতার মিলিত শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বললো, দড়ি কেটে দাও! কণ্ঠস্বরটা নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো। ডজ, আগে সামনেরগুলো কাট। মুসা, তুমি পেছনে যাও। আমি না বললে কাটবে না। সাবধান।
এমনিতেই টান টান হয়ে আছে দড়ি। ডজ ছুরি ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই আলাদা হয়ে গেল। এক হ্যাচকা টানে বিমানটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল ঢেউ। এমন টানতে শুরু করলো, যেন লেজ ছিড়েই নিয়ে চলে যাবে। থ্রটল দিলো ওমর। চেঁচিয়ে বললো, মুসা, কাট।
চাবুকের মত লাফিয়ে উঠলো কাটা দড়ির মাথা। গায়ে বাড়ি লাগলে চামড়া উঠে যেত। সরে এল সে। সাংঘাতিক দুলে উঠল বিমান। মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মুসা। পড়েই থাকলো। দাঁড়ানোর চেয়ে এটা সহজ।
ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে বিমান। সামনে পানির ছিটে ফোয়ারার মত হয়ে এসে ককপিটের জানালায় লাগছে। এর ভেতর দিয়ে কিছু দেখাই মুশকিল। অনুমানের ওপরই সামনে ছোটালো ওমর। কোন ভাবে এখন দেয়ালে বাড়ি লেগে গেলে সব শেষ। পর পর দুই বার ঢেউয়ের খাঁজে পড়ল বিমান, যেন হঠাৎ করে শূন্য থেকে নিচে এসে পড়লো। ধক করে উঠলো ওমরের বুক। মনে হলো, এই বুঝি বাড়ি লাগল দেয়ালে। তবে নিতান্ত অলৌকিক ভাবেই যেন বেঁচে গেল দুবারই।
ঢেউয়ের মাথায় উঠে সারতেও পারলো না বিমানটা, নাকের ওপর এসে ভেঙে পড়লো আরেকটা ঢেউ। চুবিয়ে মারতে চাইছে। ঘোরানোর চেষ্টা করলো ওমর। কিছু করতে পারলো না। নিয়ন্ত্রণ নাগালের বাইরে চলে গেছে। তবে কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে। আবার সাড়া দিলো বিমানের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। ততক্ষণে আরেকটা ঢেউয়ের খাজে নেমে পড়েছে বিমান। ঢেউয়ের দিকে আর নাক না ঘুরিয়ে দুটো ঢেউয়ের মাঝের খাঁজ দিয়ে তীব্র গতিতে ট্যাক্সিইং করে ছুটলো ওটা। দ্রুত কমে যাচ্ছে মাঝের ফাঁক। বুঝতে অসুবিধে হলো না সাগরের দিক থেকে গড়িয়ে আসছে আরেকটা ঢেউ। যদি বিমানের পিঠে ভেঙে পড়ে, তাহলে আর বাঁচতে হবে না। মরিয়া হয়ে জয়স্টিক ধরে টান দিলো ওমর। ওড়ার এটাই শেষ সুযোগ।
মাতাল হয়ে গেছে যেন বিমানটা। ঢেউয়ের কথা শুনবে, না ইঞ্জিনের বুঝতে পারছে না। অবশেষে টলমল করে যেন ওড়ারই চেষ্টা করলো। মায়া কাটালো পানির। ফ্লোটের গায়ে এসে বাড়ি মারলো ঢেউ। কাঁপিয়ে দিলো বটে, তবে রুখতে পারলো না বিমানটাকে। জোর করতে পারলো না। মস্ত একটা উড়ুক্কু মাছের মত যেন ঢেউয়ের নিচ থেকে লাফ দিয়ে বেরোল ফ্লাইং বোট। ককপিটের জানালায় এসে পড়লো পানির ফোয়ারা। সামনের সব কিছু চোখের আড়াল করে দিল ক্ষণিকের জন্যে।
চেপে রাখা দমটা ফোঁস করে ছেড়ে সীটে হেলান দিলো ওমর। সীট বেল্টের বাঁধন শক্ত করলো। রাটুনার দিকে কোর্স ঠিক করলো বটে, তবে সরাসরি যেতে পারছে একথা বলা যাবে না। কারণ সরাসরি সেদিক থেকেই ধেয়ে আসছে বাতাস। নাকটা কোণাকোণি করতে বাধ্য হলো সে। তারমানে দ্বীপের দিকে না গিয়ে চলে যাবে খোলা সাগরের দিকে, এই পথে চললে। চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ব্যারোমিটারে। সাড়ে আটাশ।
রাটুনা দেখা গেল। শাদা হয়ে গেছে সাগর। তার মাঝে যেন ফ্যাকাসে সবুজ মরুদ্যান। আতঙ্কিত হয়ে ল্যান্ড করার জায়গা খুঁজলো সে। শাদা আর সবুজের মাঝখানে এক জায়গায় সরু এক চিলতে পানি দেখা গেল, সাগরের সঙ্গে যেটার রঙের অমিল রয়েছে। নিশ্চয় ওটাই লেগুন। দেয়াল ডিঙিয়ে এখনও সাগরের ঢেউ ঢুকতে পারেনি ওখানে।
সেদিকেই চললো ওমর। লেগুনের ওপরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বাইরে সাগরের তুলনায় একেবারে শান্ত রয়েছে ওখানকার পানি, বলা চলে। বাতাসে উড়ছে নারকেলের ছেড়া পাতা। অনেক পাতা এসে পড়েছে পানিতে। সরের মত ভাসছে। কতটা পুরু হয়ে, বোঝা কঠিন। বেশি পুরু হলে বাড়ি লেগে ফ্লোটের ক্ষতি হতে পারে। তবে এখন আর বিমান বাঁচানোর কথা ভাবছে না ওমর, নিজেদের বাঁচার কথা ভাবছে। রাটুনায় যখন একবার পৌঁছতে পেরেছে, ঝড় থামলে ডজ আইল্যান্ডে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেই।
কোথায় নামাবে জায়গা বাছাই করে নিলো সে। গতিবেগ একটুও কমলো না, পুরো খুলে রেখেছে থ্রটল। পানিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো যেন বিমান। সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল একপাশে। নারকেল পাতার স্তূপ আঁকড়ে ধরেছে ওদিকের উইং ফ্লোট। কয়েক গজ এগোতে এগোতেই অন্য ফ্লোটটাকেও ধরল। থামাতে পারলো না। টেনেহিচড়ে আরও কয়েকগজ গিয়ে তারপর থামল বিমান।
আরও গজ বিশেক যেতে পারলে নামা যেত। তীরের কাছাকাছি, পানি আছে, তবে মাটি নাগাল পাওয়া যাবে।
ইঞ্জিন বন্ধ করে অন্য দুজনের দিকে ফিরলো ওমর। মনে হচ্ছে কিছু সময় থাকতে হবে এখানে। তা নাহয় থাকলাম, আসল বিপদ কাটিয়ে এসেছি। কিশোরদের জন্যে ভয় লাগছে এখন।
ঝড় থামলে না হয় গিয়ে দেখা যেত, ভীষণ মুষড়ে পড়েছে মুসা। তার কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে। কিশোর মারা গেছে, এটা বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক থাকতে, এটাও বিশ্বাস করে না। তাহলে হলোটা কি?
এখানে থাকার চেয়ে চল গাঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, ডজ বললো। ঝড় থামলে লোক নিয়ে এসে পাতা কেটে প্লেনটা বের করে দ্বীপে যাব আবার। মুসা, ভয় পেয়ো না। সাগরের হাসি আর ঝিনুক থাকতে কিশোর মরতে পারে না। নিশ্চয় কোথাও নিরাপদেই আছে ওরা। আমাদের অজানা কোনখানে।
এই ঝড়ের মধ্যে নামবে? ওমরের প্রশ্ন। শুনেছি, ঝড়ের সময় কামানের গোলার মতো নারকেল ওড়ে এসব অঞ্চলে। মাথায় লাগলে ছাতু বানিয়ে দেবে।
তাই তো! ভুলে গিয়েছিলাম। বাতাস না কমলে বেরোনো যাবে না।
ঠিক আছে, বসেই থাকি। সীটে হেলান দিলো ওমর। পাতায় ঢেকে যাবে আরকি আমাদের ওপরটা। তা যাক। ভাল কথা, মুক্তোগুলো কোথায় রেখেছ?
মুক্তো! চোখ মিটমিট করলো ডজ। তুমি আননি? আমার কি আনার কথা নাকি?
দেখার মত হলো ডজের চেহারা। মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে বললো সে, আগেই বলেছি, আমি একটা হতভাগা! পোড়া কপাল! মুক্তো কি আর আমার মত লোকের কপালে সইবে! দুহাতে মাথা চেপে ধরলো সে। রয়ে গেছে দ্বীপেই। পাথরের নিচে যেখানে রেখেছিলাম।
ঘুরতে ঘুরতে এসে মাথার ওপরে হাতে পড়লো একটা নারকেল পাতা।
বাহ, চমৎকার! এভাবে পড়তে থাকলে ছাতটাও কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে আল্লাহই জানে! ওমরের কণ্ঠে সন্দেহ।
১০
কোথায় যে গেছে কিশোর, মুসার অন্তত এটা বোঝা উচিত ছিলো। কিন্তু উত্তেজনা আর বিপদের সময় হাত-পা যতটা সহজে খেলে ততটা খেলে না তার মগজ। সে জায়গাটায় মুসা গিয়েছে, কিন্তু সেকথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি ওমর কিংবা ভজকে। তাহলে ওরা হয়ত অনুমান করতে পারতো।
ডজের অনুরোধে গুহার কাছে এসে মাছ ধরতে বসলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। তাদের পাশে কিশোর। দেখতে দেখতে যথেষ্ট মাছ ধরা হয়ে গেল। আগের দিনের মতই প্রস্তাব দিলো সাগরের হাসি, সাঁতরাতে নামবে। বলেই নেমে পড়ল।।
ঝিনুকও কি আর বসে থাকে? নেমে পড়লো সে-ও। কিশোর ভাবলো, গুহাঁটা দেখেই আসা যাক। এত সুন্দর যখন বলেছে মুসা।
সাগরের হাসি আর ঝিনুককে বললো সেকথা। ওরা তো বলতেই রাজি। ঢুকে পড়লো তিনজনে।
গুহাঁটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল কিশোর। মুসার মত এত সহজে আগ্রহ নষ্ট হলো তার, দেখছেই, দেখছেই। কোন দিক দিয়ে যে বেরিয়ে যাচ্ছে সময়, খেয়ালই রাখছে না।
অবশেষে যখন খেয়াল হলো, তাকে বসেই মুখ ফিরিয়ে দুই সঙ্গীকে বললো সে, চল, যাই। আর দেরি করলে রাত হয়ে যাবে। পানির দিকে তাকিয়ে কি ভাবলো। দেখ, পানির রঙ কেমন বদলে যাচ্ছে। না?
তাকের ওপর দাঁড়িয়ে সাগরের হাসি আর ঝিনুকও তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে। তাকের কিনার ধরে দুই হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে উঁচু করলো কিশোর। এক দোলা দিয়ে আলগোছে ছেড়ে দিতে যাবে এই সময় চিৎকার করে উঠলো সাগরের হাসি, ম্যাকো! ম্যাকো?
শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালো কিশোর। কিংবা বলা যায় ভীষণ চমকে গিয়ে শরীরটাকে ছেড়ে দিলো। ধপ করে বসে পড়লো আবার তাকের ওপর। কি বললে?
পানির দিকে হাত তুলে রেখেছে সাগরের হাসি।
মস্ত একটা তিনকোণা পাখনা ভেসে উঠেছে পানিতে। গুহার প্রবেশ মুখের কাছে। এগিয়ে আসতে লাগলো ধীরে ধীরে।
পুরো একটা মিনিট নীরবে তাকিয়ে রইলো কিশোর। লেগুনের পানিতে এখানে এই প্রথম হাঙর দেখলো। বাধা দিতে আর একটা সেকেন্ড দেরি করলে সাগরের হাসি কি ঘটত ভেবে শিউরে উঠলো। কি করবো? প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো সে।
বসে থাকতে হবে, বললো ঝিনুক। আর তো কোনো উপায় দেখি না।
সাত দিনেও যদি না যায় ওটা?
আমাদেরও থাকতে হবে।
তাকে উঠে দাঁড়ালো কিশোর। সে যেখানে রয়েছে তার ফুট দশেক দূরে ভেসে উঠলো বিশাল হাঙরের পিঠ। এত বড় ওটা, গুহাঁটা যেন প্রায় ভরে গেল। ছোট ওই বদ্ধ জায়গায় তিমির চেয়ে বড় লাগলো ওটাকে। যেখানে রয়েছে ওরা, নিরাপদেই থাকবে। কারণ তাকটা পানি থেকে তিন ফুট উঁচুতে, কোন জায়গায় দুই ফুট। ওপরে থাকলে কিছু হবে না, কিন্তু পানিতে পা নামালে মহা বিপদে পড়বে। পা কামড়ে ধরে টেনে নিতে পারে হাঙরটা। আর তার অর্থ ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
আটকা পড়লাম আমরা! বললো সে। বেরোতে পারব না। কিন্তু ব্যাটা এখানে এল কেন মরতে?
অনেক বড় ঝড় আসছে, ঝিনুক বললো। হয়ত হারিকেন। বড় বড় মাছ যখন লেগুনে ঢোকে, গুহায় ঢোকে, বুঝতে হবে বাইরের সাগরের অবস্থা খারাপ।
তাহলে এখন কি করব? এসব অবস্থায় কি করতে হয় তোমরাই ভাল বোঝ।
থাকতে হবে, আরকি।
মারা যায় না? কিংবা তাড়ান? তোমরা তো হাঙরের সঙ্গে লড়াই কর।
সেটা খোলা জায়গায় হলে। এখানে গুহার ভেতরে পারব না। আটকে ফেলবে সহজেই। ওদের ক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। বুদ্ধির জোরেই কেবল কাবু করা যায়।
বিশাল পাখনাটার দিকে তাকালো আবার কিশোর। নৌকার পালের মত খাড়া হয়ে আছে। ওরা খুব চিন্তা করবে। আমাদেরকে না পেয়ে।
বসলো সাগরের হাসি। তাকের কিনারের দেয়াল থেকে আলগা একটুকরো প্রবাল খুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো হাঙরটাকে সই করে। গাল দিলো আঞ্চলিক ভাষায়।
ধীরে সুস্থে শরীর নাড়লো হাঙরটা। দেখিয়ে দিলো ধূসর-শাদা পেট।
তোমাদের দেবতাকে ডাক, কিশোরকে পরামর্শ দিলো ঝিনুক। চিন্তিত লাগছে তাকে।
কিছু বললো না কিশোর। সে-ও ভাবছে। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। কালো হয়ে গেছে নীল পানি। তার মানে সূর্য ডুবে গেছে। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে। ওদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্যেরা। পাবে না ওপরে। তখন মূসার হয়ত, মনে পড়বে গুহাঁটার কথা। মাছ আর জুতো ফেলে এসেছে ওপরে। ওগুলো দেখে সে আন্দাজ করে ফেলবে, ওরা কোথায় রয়েছে। তখন দেখতে আসতে পারে। ওকে হুঁশিয়ার করার কোন উপায়ই নেই। সোজা এসে পড়বে হাঙরের মুখে। নিজেদের চেয়ে মুসার জন্যে এখন বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লো সে।
জীবনে অনেক বিপদে পড়েছে কিশোর। সেগুলো থেকে উদ্ধারও পেয়েছে কোন না কোন ভাবে। কখনও নিজের বুদ্ধির জোরে, কখনও অন্যের সাহায্যে। কিন্তু এই বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথই খুঁজে পাচ্ছে না সে। কোন বুদ্ধি বের করতে পারছে না। কতদিন থাকবে এখানে হাঙরটা, সেটা এখন আর বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, মুসা খুঁজতে আসবে।
শান্ত পানিতে কাঁপন উঠেছে এখন। হাঙরটা চুপ করে রয়েছে, আলোড়নটা তার সৃষ্ট নয়। পানি একবার উঠছে একবার নামছে। সেদিকে তাকিয়ে ঝিনুককে বললো কিশোর, ঠিকই বলেছ। ঝড়ই আসছে।
ঝড় থেমে গেলেই ম্যাকো চলে যাবে, বললো ঝিনুক।
ঝড়টা কতক্ষণ থাকবে?
দুই দিন। তিন দিন। ঠিক নেই।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো কিশোর। প্রবালের টুকরো ভেঙে ভেঙে ছুঁড়ছে সাগরের হাসি। যেন ঝাল মেটাচ্ছে হাঙরের ওপর। গায়েই যেন লাগছে না এই আঘাত, কিংবা অপমান গায়ে মাখছে না হাঙর। চুপ করে রয়েছে সেটা। দ্রুত অন্ধকার হয়ে গেল। আলোর কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। তার মানে একটা রাত এই গুহার ভেতরে অন্ধকারে কাটাতে হবে, যদি মুসা না আসে। আল্লাহ্, না আসুক, প্রার্থনা শুরু করলো কিশোর। না আসুক! অন্ধকারেই থাকব আমরা!
ঘুটঘুটে অন্ধকার। পানির ওঠানামার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দও নেই। হাঁটুতে থুতনি রেখে রাত কাটাতে তৈরি হলো কিশোর। জীবনের দীর্ঘতম রাত।
রাত যেন আর শেষই হতে চায় না। ভোরের আলো আসতে এত দেরি হচ্ছে, একসময় কিশোরের মনে হল দেয়াল ধসে পড়ে গুহার মুখটাই বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে। পানির ওঠানামার শব্দ বাড়ছে। তার মানে বাইরে ঝড়ও বাড়ছে। ঘুমানো তো দূরের কথা, চোখের পাতাও এক করতে পারছে না সে। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, তাকিয়ে রয়েছে তবু।
অবশেষে দেখা গেল আলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। নাহ, গুহার মুখটা খোলাই আছে, দেয়াল ধসে পড়েনি। কিন্তু আলো বাড়লেও পানির রঙ আর নীল হলো না। ধূসর, একঘেয়ে, বিষন্ন। আবার দুশ্চিন্তা হতে লাগলো মুসার জন্যে। রাতের অন্ধকারে পানিতে নামেনি বটে, কিন্তু এখন আলো ফুটেছে। নিশ্চয় দেখতে আসবে।
গুহার দেয়ালে হেলান দিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক। যেন ঘরের ভেতরে রয়েছে। ভাবনার কিছুই নেই এখানে। কোন বিপদ নেই, ভয় নেই। আস্তে করে ঝিনুকের কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল সে। জেগে গেল ঝিনুক। সাগরের হাসিও। পানির রঙ দেখাতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল, পাখনাটা দেখা যাচ্ছে না। তার মানে কি হাঙরটা নেই?
ভালো করে দেখে ঘোষণা করলো সাগরের হাসি, নেই, চলে গেছে। স্বস্তির কাপা নিঃশ্বাস পড়লো কিশোরের। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে যাবে, এই সময় গম্ভীর মুখে ঝিনুক বললো, ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে না বটে। হয়ত নিচে ডুবে রয়েছে। নামলেই ধরবে।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল যেন কিশোর। এটা ভাবেনি। সত্যি, নিচে ডুব দিয়ে থাকতেই পারে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন হাঙরটা ভাসলো না, উঠে দাঁড়ালো ঝিনুক। বললো, আমি যাচ্ছি।
হাঙরটা যদি থাকে? কিশোরের প্রশ্ন।
লড়াই করবো। হয় ম্যাকো মরবে। নয়তো আমি।
মাথা নাড়লো কিশোর। তবে নিষেধ করতে পারলো না ঝিনুককে। করতে হলে অন্য কোন উপায় বাতলে দিতে হবে এখান থেকে মুক্তির। সেটা যখন পারছে না, কি আর বলবে।
আমি যাই, আবার বললো ঝিনুক। তোমরা থাক। ম্যাকো না থাকলে ফিরে আসব।
এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে চলেছে কেন ঝিনুক, বুঝতে পারছে কিশোর। মুসার কথা ভেবে। তাকে যেতে না দেয়াই উচিত। কিন্তু এবারও মানা করতে পারলো না। ভাবলো, সে নিজেও যাবে। সাহায্য করবে ঝিনুককে। পরক্ষণেই বাতিল করে দিলো চিন্তাটা। বদ্ধ জায়গায় উপকার তো করতেই পারবে না, গিয়ে আরও সমস্যা বাড়াবে ঝিনুকের। অসহায় দৃষ্টিতে সাগরের হাসির দিকে তাকালো সে। পানির দিকে চেয়ে রয়েছে মেয়েটা। বোধহয় ম্যাকোকে খুঁজছে।
ওই মুহূর্তে ছুরি কামড়ে ধরে পানিতে ঝাঁপ দিলো ঝিনুক। কোমরের ছুরির বাঁটে হাত ছোঁয়ালো সাগরের হাসি। তৈরি রয়েছে। দরকার হলেই যাতে ঝাঁপ দিতে পারে।
কয়েকটা সেকেন্ড পানির দিকে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। তারপর আচমকা কোমর থেকে ছুরিটা টেনে বের করে দাঁতে কামড়ে নিয়ে দিলো ঝাঁপ। কিশোর কিছু বলার সময়ও পেল না, বাধা দেয়া দূরে থাক। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো পানির দিকে।
বেশ আলোড়ন উঠতে লাগলো। যেন হঠাৎ করেই সাংঘাতিক তোলপাড় শুরু হয়েছে তলায়। গুহামুখের কাছে কালো ছায়া দেখতে পেল বলে মনে হলো তার। মিনিট কাটছে। উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠেছে স্নায়। ভেসে উঠলো ঝিনুকের মাথা। ডেকে বললো, জলদি এস!
ম্যাকো গেছে?
জলদি এস! বড় বড় ঢেউ!
একবার দ্বিধা করলো কিশোর। তার পরই ঝাঁপ দিলো পানিতে নেমে চললো ঝিনুকের পিছু পিছু। ভয়ে বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি এসে পা কামড়ে ধরলো হাঙরটা।
ঠেলে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরতে চাইছে তাকে স্রোত। ঢোকার সময় এই স্রোত ছিলো না। এখন এলো কোথা থেকে? হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে চললো ঝিনুক। সুড়ঙ্গের মুখের ভেতরে ঢুকতেই যেন অদৃশ্য এক দানবের হাত হ্যাচকা টানে বাইরে বের করে নিয়ে গেল তাকে। তারপর ছুঁড়ে দিলো ওপর দিকে।
কি করে ডাঙায় উঠলো কিশোর, বলতে পারবে না। শুধু মনে আছে, পেছন থেকে তাকে ঠেলছে ঝিনুক, আর চুল ধরে তাকে টেনে তুলছে সাগরের হাসি। হাঁটু পানিতে থাকতেই পেছন থেকে এসে ধাক্কা মারলো মস্ত এক ঢেউ। তিনজনকেই প্রায় ছুঁড়ে ফেললো সৈকতে।
ধপ করে বসে পড়লো কিশোর। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো ঝিনুক। হাত তুলে দেখালো ঢেউয়ের দিকে। মস্ত একটা পাখনা ভেসে উঠেছে। শিউরে উঠলো কিশোর। ওরা যখন বেরিয়ে আসছে তখনও কাছাকাছিই ছিল হাঙরটা।
গুহায় অসুবিধে হচ্ছিলো, ঝিনুক বললো। অনেক বড় তো। হাঁসফাস লাগছিলো হয়ত। তাই বেরিয়ে পড়েছে।
চারপাশে তাকানোর সুযোগ পেলো এতক্ষণে কিশোর। অনুভব করলো ঝড়ের শক্তি। বাতাসের অদৃশ্য থাবা তার দেহ আঁকড়ে ধরে যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কাত হয়ে যাচ্ছে নারকেলের পাতা, ছিড়ে চলে যাচ্ছে ডালের গোড়া থেকে। লেগুনের দেয়ালের নিচে যেন কয়েক কোটি দৈত্যের তান্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে। এমন করে ফুসছে সাগর। শাদা ফেনায় ভরে গেছে লেগুনের পানি। দেখে বিশ্বাসই হয় না, ঝলমলে রোদের সময় ওটা নীল ছিলো। কালচে-ধূসর আকাশের মতই এখন রঙ হয়ে গেছে পানির।
বিমানটাকে খুঁজতে গিয়ে হাঁ হয়ে গেল কিশোর। ছোট্ট একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে। নেই। সে ভাবলো, প্রচন্ড ঢেউ নোঙর ছিড়ে নিয়ে গেছে ওটাকে, ডুবিয়ে দিয়েছে। মুসারা কোথায়? সাগরের হাসি আর ঝিনুককে বললো সে, দেখতে যাচ্ছে। বাতাসের মধ্যে মাথা নিচু করে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলো কতটা ভয়ংকর ঝড়। প্রচন্ড বাধার বিরুদ্ধে যেন লড়াই করতে করতে এগোতে হলো তাকে। যেখানে ক্যাম্প করেছিলো ওরা সেখানে এসে দেখলো কোন মানুষ নেই। মাটিতে বিছিয়ে রয়েছে নারকেল পাতা। ইতস্তত পড়ে থাকা কয়েকটা কাঠের বাক্স প্রমাণ করছে এখানে ক্যাম্প ছিলো। হতাশ কণ্ঠে চিৎকার করে যেন নিজেকেই বোঝালো সে, ওরা চলে গেছে!
সৈকতের দিকে তাকালো। যেখানে বিমানটা বাঁধা ছিলো। বিড়বিড় করে বললো, নিশ্চয় ঝড় শুরু হতেই চলে গেছে।
ওসব নিয়ে পরে ভাববে। আপাতত মাথা গোঁজার একটা ঠাই দরকার। দ্বীপের মাঝখানের দিকে চললো সে। ওখানে নারকেল গাছের জটলার ভেতরে ঢুকে বসার ইচ্ছে। কিন্তু এমন ভাবে ছোটাছুটি করছে নারকেলের পাতা, নিরাপদ মনে করতে পারলো না জায়গাটাকে।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের দিকে তাকালো। হাত নেড়ে সেদিকেই যাওয়ার ইঙ্গিত করলো ওরা। ওরাও সেদিকে চলেছে। নিশ্চয় কোন কারণ আছে। এসব ঝড় দেখে অভ্যস্ত পলিনেশিয়ানরা। ঝড়ের সময় আত্মরক্ষা করতে হয় কিভাবে জানে।
নারকেলের জটলার ভেতরে পৌঁছে গেল ওরা। মুখের কাছে দুহাত এনে কিশোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ঝিনুক বললো, বাতাস পড়ে গেলেই আসবে, বড় জোয়ার।
বোধহয় জলোচ্ছ্বাসের কথা বলছে ঝিনুক। পাগল হয়ে যাওয়া বিশাল ঢেউয়ের দাপাদাপির দিকে তাকিয়ে কিশোর বললো, এর চেয়ে বড়?
হ্যাঁ। দ্বীপ ভাসিয়ে দেবে। এস। যেন ঝিনুকের কথার সমর্থনেই বিশাল এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো সৈকতে, পানি উঠে চলে এল অনেকখানি ওপরে।
এস এস!
নারকেল উড়ছে না আর। কারণ ওড়ার মত নেইই। সব পড়ে গেছে, বিছিয়ে রয়েছে গাছের তলায়। মোটা একটা গাছ বেছে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো সাগরের হাসি। গাছের চারপাশ ঘিরে খাঁজ কাটছে। কাটা শেষ করে নিজের শরীর পেঁচিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধলো গাছের সঙ্গে, দড়িটা বসিয়ে দিয়েছে খাঁজের মধ্যে। ক্যাম্পের কাছে দড়ি পড়ে ছিলো, ওখান থেকে তুলে এনেছে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো, গাছে ওঠার জন্যে। তার সঙ্গে একই গাছে।
ঠিক কি করতে চাইছে সাগরের হাসি তখনো বুঝতে পারছে না কিশোর। যা করতে বলা হলো করলো সে। মেয়েটার কাছে উঠে এলো। আরেকটা খাঁজে দড়ি বসিয়ে কিশোরের চারপাশে পেঁচিয়ে বাঁধলো সাগরের হাসি।
ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে ব্যাপারটা কিশোরের কাছে। বাতাসে দুলছে নারকেলের কান্ড, মাঝে মাঝে এত বেশি নুয়ে পড়ছে তার ভয় লাগছে ভেঙেই না যায়। মাটি থেকে অনেক ওপরে রয়েছে। দড়ি ছিড়ে গেলে কি হতে পারে কল্পনা করতে চাইলো না সে।
ক্রমেই এগিয়ে আসছে ঢেউ, পানি উঠছে দ্বীপে। সব চেয়ে উঁচু জায়গাটায় উঠতেও দেরি হবে না, বুঝতে পারছে কিশোর। এখনও গুহার ভেতরে থাকলে কি অবস্থা হতো ভেবে গায়ে কাঁটা দিলো তার। হাঙরে না খেলেও পানিতে ডুবেই মরতে হতো। নিশ্চয় এতোক্ষণে পানিতে ভরে গেছে গুহাঁটা।
মাথা ঘুরিয়ে তাকালো কিশোর। আরেকটা গাছে উঠে একই ভাবে নিজেকে বেঁধেছে ঝিনুক। এই বাতাসের মধ্যে নারকেলের কান্ড আঁকড়ে থাকা যে কতটা কঠিন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান। ওই মুহূর্তে তার মনে হলো এসব অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে গোয়েন্দাগিরি অনেক ভালো এবং সহজ।
তার দিকে তাকিয়ে হাসলো ঝিনুক। বাপরে, বাপ! সাহস আছে ওদের! ভাবলো কিশোর।
গাছের কান্ড আঁকড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কখন থামবে সেটা ঝড়ের ইচ্ছে।
এক ঘণ্টা পেরোল, দুই ঘণ্টা। তারপর আচমকা নীরব হয়ে গেল সব কিছু। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি মাথার ওপরে নীল আকাশও চোখে পড়লো একটুকরো।
যাক, ঝড়টা তাহলে গেল। হাঁপ ছাড়লো কিশোর।
কিন্তু মাথা নাড়লো সাগরের হাসি। উহু! শেষ হয়নি। এটা ঝড়ের মধ্যিখাটা। আবার আসবে বাতাস।
মেয়েটা কি বলছে বুঝতে পারলো কিশোর। মনে পড়ল অথৈ সাগর অভিযানের কথা। সেবারেও হারিকেনের মাঝে পড়েছিল জাহাজ। ঝড়ের মধ্যিখান বলতে কেন্দ্রবিন্দু বোঝাচ্ছে সাগরের হাসি। ঝড়ের কেন্দ্রে বাতাস থাকে না, সেটা পেরোলেই আবার আগের মত জোরালো তুফান শুরু হবে।
বেশিক্ষণ থাকলো না ওই নীরবতা। হঠাৎ যেমন থেমে গিয়েছিল, তেমনি হঠাৎই আবার এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো বাতাস। মাথার ওপর থেকে হারিয়ে গেল নীল আকাশ। ধেয়ে এল ঢেউ।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একটানা বয়ে চললো ঝড়। বিকেল চারটের দিকে কমে এলো বাতাসের বেগ। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তিতে একবারে কাহিল হয়ে পড়েছে কিশোর। গাছ জড়িয়ে ধরে রাখার শক্তিও যেন নেই।
পানি নেমে যেতে শুরু করলো। মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো সূর্য। দিগন্তসীমার কাছাকাছি নেমে গেছে। বিরাট এক আগুনের গোলার মত লাগছে এখন ওটাকে।
নামবে কিনা জিজ্ঞেস করলো কিশোর। মাথা নাড়লো সাগরের হাসি। এখনও সময় হয়নি।
সূর্য ডুবলো। সাগরের হাসি ঘোষণা করলো, এবার নামা যেতে পারে। নেমেই ভেজা মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো কিশোর। শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি ব্যথা হয়ে গেছে। লবণে শক্ত হয়ে গেছে চুল এমনকি ভুরু পর্যন্ত।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। তবে সকলেই খুশি। ঝড়টা কাটাতে পেরেছে। আর বেঁচে তো রয়েছে এখনও। কোন কিছু নিয়েই একটুও উদ্বিগ্ন হলো না দুই পলিনেশিয়ান।
খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠলো ওরা। এগোল ক্যাম্প এলাকার দিকে। দ্বীপের চেহারা বদলে দিয়ে গেছে ঝড়। প্রবালের অনেক চড়া গায়েব হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় মাটি খুবলে নিয়ে গেছে ঢেউ। পানিতে ভেসে গেছে অনেক পাতা, কিছু কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখনও। তবে তার চেয়ে বেশি জমে রয়েছে সামুদ্রিক আগাছা। আর রয়েছে ঝিনুক। অগুনতি। নানা জাতের, নানা আকারের। ওসবের মাঝে কিলবিল করছে কাঁকড়ার দল। আরও নানা রকম জলজ প্রাণী উঠে এসেছিলো ঢেউয়ে, নামার সময় আর যেতে পারেনি, আটকা পড়েছে বালিতে।
ক্যাম্প এলাকাটা সব চেয়ে উঁচু ওই দ্বীপে। ওখানে পানি ওঠেনি। কাছাকাছি ঝাপটা দিয়ে গেছে শুধু ঢেউ। পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে রেখে গেছে। প্রবালের চাঙড়ের খাঁজে একটিন গরুর মাংস আটকে থাকতে দেখলো কিশোর। কয়েক টিন কনডেনসড মিল্ক, আর এক টিন বিস্কুট পাওয়া গেল, বালিতে অর্ধেক গাঁথা অবস্থায়। খিদেয় চো চো করছে পেট। তর সইছে না আর। সাগরের হাসির কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে মাংস আর বিস্কুটের টিন কাটলো সে। মুখে দিয়ে চিবুতে গিয়ে টের পেল জিভই নাড়তে পারছে না। শুকিয়ে যেন আঠা হয়ে লেগে গেছে মুখের ভেতরে। পানি দরকার। ঝর্নাটার দিকে চলল সে। কিন্তু গিয়ে অবাক হয়ে গেল। যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই ওটা। বালিতে ঢাকা পড়ে গেছে।
দুই পলিনেশিয়ানও এসেছে তার পিছু পিছু। তাদের দিকে চেয়ে গুঙিয়ে উঠলো কিশোর, পানি নেই! এবার মরব!
হেসে উঠলো সাগরের হাসি। না, মরব না। পানি অনেক আছে। পড়ে থাকা অনেক ডাব দেখালো সে।
তাই তো! ভুলেই গিয়েছিলো কিশোপ। চিন্তা দূর হলো।
একটা ডাব তুলে নিলো সাগরের হাসি। ছুরি দিয়ে মুখটা কেটে ছিদ্র করে তুলে দিলো কিশোরের হাতে।
মিষ্টি পানিতে ভরে গেল কিশোরের মুখ। জিভ নাড়তে কষ্ট হচ্ছে এখনও। আস্তে আস্তে ভিজিয়ে নরম করে আনলো। পানি খাওয়ার পর ডাবটাকে দুই টুকরো করে ভেতরের নরম মিষ্টি শাস খেলো সে। অনেকটা বল ফিরে পেলো শরীরে।
ভেজা মাটিতে বসে নীরবে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া চালিয়ে গেলো ওরা। ধীরে ধীরে খাচ্ছে। গরুর মাংস, বিস্কুট আর নারকেল।
শেষ হলো খাওয়া। চাঁদ উঠেছে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। সাগরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কিশোর, ওমররা প্লেন নিয়ে নিরাপদ জায়গায় যেতে পেরেছে তো? নাকি ডুবে মরেছে সাগরে? কালকের মধ্যে যদি ফিরে না আসে, তাহলে বুঝতে হবে বেঁচে নেই ওরা।
বেশিক্ষণ দুশ্চিন্তা করার সুযোগ পেলো না কিশোর। এতে ক্লান্ত হয়েছে শরীর, বসেও থাকতে পারছে না আর। শুয়ে পড়লো বালিতে। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
১১
সকালে আগে ঘুম ভাঙলো কিশোরের। চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো নীল আকাশের দিকে, পুরো দুই মিনিট। কি যেন একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে, অনুভূতি বলছে। হঠাৎ মনে পড়লো। গন্ডগোলটা আর কিছু না, আগের দিনের ঝড়। বিপদে রয়েছে ওরা। নড়তে ইচ্ছে হলো না। বাতাস তাজা। গায়ে পরশ বোলাচ্ছে যেন ভোরের কাঁচা রোদ। বেশ আরাম। মাথার নিচে হাত দিয়ে চিত হয়ে থেকে ভাবতে শুরু করলো সে।
কি করেছে ওমর ভাই? তার জায়গায় সে নিজে হলে কি করতো? ওদেরকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি, কারণ ঝড় আসছিলো, বিমানটাকে বাঁচানোর জন্যে শেষে মুসা আর ডজকে নিয়ে উড়ে চলে গেছে। অবশ্যই ফিরে আসবে আবার। ঝড়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে ওরা, ভাবতেই পারলো না কিশোর। এত সহজে মরবে না। যে কোন মুহূর্তে এখন ফিরে আসতে পারে।
চোখ মেললো সাগরের হাসি। উঠে বসে কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। লেগুনের দিকে ফিরলো। সাগরের দিকে চোখ পড়তেই হাসি মিলিয়ে গেল মুখ থেকে। বলে উঠলো, সর্বনাশ! কারনেস!
লাফিয়ে উঠে বসলো কিশোর। লেগুনে ঢোকার প্রণালী দিয়ে ঢুকছে স্কুনারটা। ঝড়ে পড়েছিলো, অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত। একটা পালও আস্ত নেই। কারনেসের হোয়াইট শার্ক, কোন সন্দেহ নেই। দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত জাহাজটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো কিশোর, কি করবে? ঝিনুকের পা ধরে ঝাঁকানি দিলো, এই ঝিনুক, ওঠ।
উঠে বসলো ঝিনুক। জাহাজটা দেখে দূর হয়ে গেল ঘুম। ভয় দেখা দিলো চোখে।
নড়ো না, হুঁশিয়ার করলো কিশোর। হয়ত আমাদেরকে দেখেনি। এসেছে কোন কারণে। আমাদের না দেখলে চলে যাবে শীঘ্রি।
মাথা নাড়লো ঝিনুক। না, যাবে না। ঝড়ে পড়েছিল। অনেক ক্ষতি হয়েছে জাহাজের। এখানে থেমে মেরামত করবে।
ঠিক, সাগরের হাসি বললো। না হলে আসছে কেন?
নিশ্চয় পানি আর খাবারের খোঁজে, কিশোর বললো। দ্রুত একবার চোখ বোলালো দ্বীপটায়। লুকানোর জায়গা খুঁজলো। চল, ওদিকটায় চলে যাই। নারকেল কুঞ্জের অন্য পাশটার কথা বললো সে।
উঠে দাঁড়াতে গেল সাগরের হাসি আর ঝিনুক। বাধা দিলো কিশোর। কারনেসের চোখে পড়ে যেতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ওরা কুঞ্জের দিকে। ভেতরে বালির একটা ঢিবি আছে। তার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকলে জাহাজ থেকে দেখা যাবে না।
গাছপালার ভেতরে ঢুকেই উঠে দাঁড়ালো কিশোর। দৌড় দিলো ঢিবির দিকে। ওটার আড়ালে আসার আগে পেছন ফিরে তাকালো না একবারও। বসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকিয়ে দেখলো লেগুনে ঢুকে পড়েছে জাহাজটা। নোঙর ফেলছে। ডেকে লুটোপুটি খাচ্ছে ছেড়া পাল। ওগুলো মাড়িয়েই হাঁটাচলা করছে নাবিকেরা। কারনেসের গলাকাটা সাগরেদের দল। হুইল ধরে থাকতে দেখা গেল কারনেসকে।
কিছুই করার নেই, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া। তা-ই করলো কিশোর আর দুই পলিনেশিয়ান। কিশোর ভাবছে, কারনেস কি করবে? আশা করলো, একটুক্ষণ থেকেই নারকেল নিয়ে চলে যাবে জাহাজটা। তবে যতই সময় যেতে লাগলো, নিরাশ হতে থাকলো সে। ডেকটা যতটা সম্ভব গোছগাছ করলো নাবিকেরা। তার পর ডিঙি নামানোর আদেশ দিলো কারনেস। পানির ওপর দিয়ে স্পষ্ট ভেসে আসছে তার কণ্ঠ। ডিঙি নামানো হলো। তাতে চড়ে বসলো কারনেস আর দুই সাগরেদ। দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে কিশোর। কপালে মনে হয় দুঃখ আছে আমাদের। কারনেস নিশ্চয়, অনুমান করেছে, এই দ্বীপের কাছাকাছিই কোথাও রয়েছে মুক্তোর খেত। দ্বীপে নেমে ঝিনুকের খোসাগুলো দেখলে শিওর হয়ে যাবে। আরও একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাবে, যে আমরাও উঠেছি দ্বীপে। খুঁজতে শুরু করবে।
জবাব দিলো না সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক। তাকিয়ে রয়েছে।
তীরে নামলো কারনেস। চোখ বোলালো দ্বীপের লেগুনের দিকের অংশটায়। পরিত্যক্ত ক্যাম্পটা চোখে পড়লো। দাঁতের ফাঁকে সিগার। কি ভেবে এগিয়ে গেল কয়েক পা। থামলো। দেখলো। আবার এগোল। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিলো একটা জিনিস। ঝিনুকের খোলা। এখান থেকেও দেখতে পাচ্ছে কিশোর।
ব্যস, হয়ে গেছে কাজ! অস্বস্তি বেড়ে গেল কিশোরের। ক্যাম্প দেখতে পেয়েছে কারনেস। ঝিনুকের খোলা পেয়েছে। ওটা কিভাবে কিজন্যে খোলা হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হবে না পাকা মুক্তো শিকারীর।
হাত নেড়ে দুই সঙ্গীকে ডাকলো কারনেস। ওরা কাছে এলে খোলাটা দেখালো।
ঘণ্টাখানেক দ্বীপে থাকলো ওরা। তারপর ফিরে গিয়ে উঠল ডিঙিতে। জাহাজের দিকে রওনা হলো। তীর থেকে একশ গজ দূরে নোঙর করা হয়েছে।
আশা হলো আবার কিশোরের। তীরে নেমে ক্যাম্প আর ঝিনুকের খোলা পাওয়ার পরেও যখন কিছু করেনি, আর করবে না। ফিরে যাবে কারনেস।
কিন্তু নড়লো না জাহাজটা। নোঙর তোলার কোন লক্ষণই নেই। জাহাজ আর পাল মেরামতে ব্যস্ত নাবিকেরা। যতই সময় যাচ্ছে উৎকণ্ঠা বাড়ছে কিশোরের। বিমানটা কখন এসে হাজির হয় কে জানে। তাহলে শুরু হবে বড় রকমের গন্ডগোল।
সারাটা দিন গেল। পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলো সূর্য। তখনও দেখা নেই বিমানের। আসেনি বলে বরং স্বস্তিই বোধ করছে কিশোর। ভালই হয়েছে। কারনেস চলে যাওয়ার পর আসুক। তাহলে অহেতুক গোলমাল এড়ানো যাবে।
কিন্তু জাহাজটার নড়ার কোন লক্ষণই নেই।
ঝিনুকের দিকে ফিরলো কিশোর। আচ্ছা, ছোট একটা নৌকায় করে এখান থেকে রাটুনায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
এক মুহূর্ত ভাবলো ঝিনুক। একদিন। বড় জোর দুদিন।
জাহাজের পাশে বাধা ডিঙিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ওই নৌকাটা হলে?
ঝিনুক জানালো, রাতের বেলা রওনা হতে পারলে পরদিন গিয়ে তার পরদিন সকালে রাটুনায় পৌঁছতে পারবে।
পথ চিনে যেতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করলো না কিশোর। সে নিশ্চিত, একটুও ভুল না করে চলে যেতে পারবে সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক।
তাহলে, ঘোষণা করলো যেন কিশোর। রাতে কারনেসরা ঘুমিয়ে পড়লে নৌকাটা চুরি করবো আমরা।
কিশোরের কথা শুনে খুব খুশি সাগরের হাসি আর ঝিনুক। উত্তেজনা ফুটলো চেহারায়। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালো ডিঙিটার দিকে, যেন ওটা মহামূল্যবান একটা বস্তু।
ভাবছে কিশোর, ডিঙি চুরি করাটা কিছুই না। অন্ধকারে নিঃশব্দে সাঁতরে চলে যেতে পারবে ওটার কাছে। তারপর বাঁধন খুলে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেই হল। ভয় একটা আছে অবশ্য, হাঙরটার। ওটা এখনও লেগুনে রয়েছে কিনা কে জানে। সারা দিনে একবারও ওটার পাখনা দেখা যায়নি যদিও। তবু থাকতে পারে। কিছু করার নেই। ডিঙিটা পেতে চাইলে ঝুঁকিটা নিতেই হবে।
এখানকার গোধূলি খুব সংক্ষিপ্ত। এসেই চলে যায়। সেদিনও গেল। অন্ধকার নামলো। একটামাত্র আলো জ্বলছে জাহাজে। নাবিকদের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় রইলো কিশোর। অন্ধকারে এখনও যেতে পারে, ডেকের ওপর দেখা যাচ্ছে না কাউকে। কিন্তু বলা যায় না। বেরিয়ে আসতে পারে। তাড়াহুড়ো করে অযথা বিপদে পড়ার কোন মানে হয় না।
কোন শব্দ নেই জাহাজে। ডেকে একবারের জন্যেও আর কেউ আসেনি। সারাদিন খেটেছে নাবিকেরা। সন্ধে হতে না হতেই তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। উঠে। দাঁড়াল কিশোর। চাঁদ ওঠেনি এখনও। তবে তারার আলো আছে। আকাশটাকে লাগছে বিশাল এক গম্বুজের মতো। ভেতরের দিকে যেন ঝুলে রয়েছে তারাগুলো।
সাগরের হাসির দিকে ফিরে বললো সে, একসাথে সবার যাওয়ার দরকার নেই আমাদের। তুমি নারকেল কুড়িয়ে নাও, যত বেশি পার। আমি আর ঝিনুক গিয়ে নৌকাটা নিয়ে আসি।
লেগুনের কিনারে চলে এলো ঝিনুক আর কিশোর। পানিতে পা দিলো। কোমর পানিতে নেমে সাঁতরাতে শুরু করলো। অন্ধকারে পানির ওপরে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে জাহাজটা। কালো বিশাল একটা ভূতুড়ে অবয়ব। নিঃশব্দে সাঁতরে চললো দুজনে।
আলোটার দিকে কিশোরের চোখ। ওটা কারনেসের কেবিন। সে জেগে থাকতে পারে। হয়ত বসে বসে মদ গিলছে। খোলা বাতাসের জন্যে বেরিয়ে আসতে পারে। বলা যায় না। সতর্ক থাকা দরকার। ওকে দেখলেই ডুব মারতে হবে।
মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে ডিঙিটা। নীরব হয়ে আছে জাহাজ। কোন শব্দ নেই। কেউ বেরোচ্ছে না ডেকে। ডিঙির কাছে পৌঁছে আস্তে হাত দিয়ে খামচে ধরল সে ওটার কিনারা। কান পেতে রইল। না, কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না। আস্তে করে দুহাতের সাহায্যে টেনে তুললো নিজেকে। ডিঙির পাটাতনে নামতে গিয়ে পড়লো নরম কিছুর ওপর। ভয়ানক চমকে গেল সে। নরম জিনিসটা কি বুঝতে পেরেছে। মানুষ!
ডিঙিতে ঘুমিয়েছে লোকটা। অন্ধকারে কোন ফাঁকে নেমেছে ও, ঢিবির আড়ালে বসে দেখতে পায়নি কিশোর। জেগে গেল লোকটা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। জাপটে ধরলো কিশোরকে।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করলো কিশোর। কিন্তু অসুরের শক্তি লোকটার গায়ে। তাকে পেড়ে ফেলে গলা টিপে ধরলো। ছটফট করতে লাগলো কিশোর। বাতাসের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ফুসফুস। কানে আসছে অনেক লোকের চেঁচামেচি। ডেকে বেরিয়ে এসেছে নাবিকেরা।
আরেকবার ছাড়া পাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলো কিশোর। প্রচন্ড ঘুসি এসে লাগলো চোয়ালে। হাজারটা তারা জ্বলে উঠলো যেন মাথার ভেতরে। জ্ঞান হারালো সে।
বেশিক্ষণ অচেতন থাকলো না। হুঁশ ফিরলে দেখলো ডেকে পড়ে আছে। প্রায় চোখের কাছে জ্বলছে একটা হ্যারিকেন। অনেকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাকে।
চোখ মেলতেই তার দিকে তাকিয়ে কুৎসিত হাসি হাসলো কারনেস। ওঠ ওঠ। নরম গলায় ডাকলো সে। কিশোরের মনে হলো বেড়ালের ঘড়ঘড়ে স্বর বেরোল লোকটার গলা দিয়ে।
উঠে বসলো কিশোর। এরকম একটা কান্ড ঘটবে কল্পনাই করতে পারেনি। যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনও। মাথা ঝাড়া দিয়ে মগজের ঘোলাটে ভাবটা দূর করার চেষ্টা করলো। সে একাই ধরা পড়েছে? নাকি ঝিনুকও? তবে পালিয়ে গেলেও বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। সকাল হলেই ধরা পড়তে হবে।
আবার তাহলে দেখা হলো, আঁ? দাঁত বের করে হাসলো কারনেস।
জবাব দিলো না কিশোর।
তোমার দোস্তরা কোথায়? শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলো কারনেস।
জানি না, তিক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো কিশোর।
মিছে কথা বলবে না বলে দিলাম!
মাথা নাড়লো কিশোর। না, মিথ্যে বলছি না। ঝড়ের সময় হারিয়ে গেছে ওরা। দ্বীপের নিচে একটা গুহার ভেতরে আটকা পড়েছিলাম আমি। হাঙর ঢুকেছিলো গুহায়। ওটার জন্যে বেরোতে পারছিলাম না। সকালে বেরিয়ে দেখি, নেই। জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্যে তখন নারকেল গাছে চড়ে বসে রইলাম।
এমন ভঙ্গিতে বলেছে কিশোর, বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো কারনেস। মসৃণ গলায় জিজ্ঞেস করলো, অনেক মুক্তো পেয়েছে, না?
অল্প কিছু, অস্বীকার করার কোন কারণ দেখতে পেলো না কিশোর। বেশি তুলতে পারিনি। একটা সোর্ডফিশ প্লেনের তলা ফুটো করে দিয়েছিলো। ডুবুরির সাজসরঞ্জাম সব পানিতে ফেলে দিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি আমরা।
মুক্তোগুলো কোথায়?
ওদের কাছে।
খেতটা কোথায়, জান?
মোটামুটি।
ঠিক আছে। সকালে আমাকে দেখাবে।
আচ্ছা। কথা দিলো বটে কিশোর, তবে দেখাবে কিনা ভাবতে হবে। আসলে সময় চাইছে সে। এখনই কারনেসের বিরোধিতা শুরু করে মার খেতে চায় না।
কোমরের খাপ থেকে ছুরি বের করলো কারনেস। ইচ্ছে করেই চোখা মাথাটা তুললো কিশোরের দিকে। হুমকি দেয়ার জন্যে। বললো, সাবধান, চালাকির চেষ্টা করবে না। তাহলে কি করবো জানো? দিয়ে দেব তোমাকে। আমার সাগরেদদের হাতে। ওরা নিয়ে গিয়ে জবাই করবে। কেটে মাংস খাবে তোমার। অনেক দিন মানুষের মাংস খায় না। পেলে খুব খুশি হবে।
কিশোরকে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলো কারনেস।
প্রায় টেনেহিঁচড়ে কিশোরকে নিচে নামিয়ে আনলো দুজন নাবিক। একটা ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো ওরা। বোটকা গন্ধ। গন্ধেই চিনতে পারলো কিশোর, এই ঘরেই বন্দী করে রাখা হয়েছিলো ঝিনুককে।
১২
প্রচন্ড মাথা ধরেছে কিশোরের। দপদপ করছে চোয়ালের যেখানটায় ঘুসি খেয়েছে। তার পরেও ঘুম এলো।
ওপরে ডেকে চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। আঞ্চলিক ভাষায় অনর্গল কথা বলছে নাবিকেরা। মুখ খারাপ করে গালাগাল করছে কারনেস। কাকে, কেন, কিছুই বোঝা গেল না। গোল একটা ফুটো দিয়ে আলো আসছে। ভোর হয়ে গেল? অবাকই লাগলো কিশোরের। ঘুম কত দ্রুত সময় পার করে দেয়।
বাইরের করিডরে পায়ের আওয়াজ হলো। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। দুজন নাবিক ঘরে ঢুকলো। আগের রাতে যারা কিশোরকে এখানে রেখে গেছে তারা দুদিক থেকে এসে চেপে ধরলো তাকে। আবার টেনে নিয়ে চললো ওপরে।
ডেকে পায়চারি করছে কারনেস। কিশোরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ। পিচিক করে থুথু ফেললো ডেকের ওপরেই। ধীরে ধীরে এগোল শিকারি বেড়ালের মত। হাতের আঙুল একবার খুলছে, একবার মুঠো করছে। তোমার সাথে দ্বীপে আর কে ছিল? লোহা, ঘষলো যেন শিরিষ দিয়ে এমনই কণ্ঠস্বর।
চুপ করে রইলো কিশোর।
ফেটে পড়লো কারনেস। কে নৌকা চুরি করেছে?
লম্বা দম নিলো কিশোর। তাহলে এই ব্যাপার। ডিঙিটা নেই। নিশ্চয় তাকে ধরে আনার পর ফিরে এসেছিলো ঝিনুক। নৌকাটা নিয়ে চলে গেছে। আশা হলো মনে। তবে সেটা চেহারায় প্রকাশ পেতে দিলো না। কিন্তু তার পরেও কি করে যেন বুঝে ফেললো কারনেস। ঠাস করে চড় মারলো।
মাথা সরানোরও সুযোগ পায়নি কিশোর। আরেকটু হলেই উল্টে পড়তো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছলো সে।
আর কে ছিলো তোমার সাথে? আবার গর্জে উঠলো কারনেস।
আর চুপ করে থাকার কোন মানে হয় না। লাভ হবে না। নৌকা যখন চুরি হয়েছে, কেউ না কেউ ছিলোই দ্বীপে এটা বুঝে ফেলেছে কারনেস। অস্বীকার করে অযথা মার খেতে হবে। বললো, ঝিনুক। মনে মনে আশা করলো, এতক্ষণে নিশ্চয় সাগরের হাসিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে ঝিনুক।
তীব্র ঘৃণা দেখা দিলো কারনেসের চোখে। শুঁয়োপোকার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায় মানুষ সেভাবে তাকালো কিশোরের দিকে। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে পিষে ফেলতে চায় যেন। ওই নোংরা কানাকাটা! জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে করসিকান। কোথায় গেছে? এত জোরে চিৎকার করে উঠলো সে, চমকে গেল কিশোর। পিছিয়ে গেল এক পা।
গেলে রাটুনাতেই গেছে, আর কোথায়।
আকাশের দিকে নজর চলে গেল কারনেসের। তার মনে কি ভাবনা চলেছে অনুমান করতে পারলো কিশোর। রাটুনায় পৌঁছার আগেই নৌকা-টাকে ধরতে পারবে কিনা ভাবছে সেকথা। পারবে না। এক বিন্দু বাতাস নেই। সাগরের পানিও লেগুনের মত শান্ত, এক বিরাট আয়নার মত লাগছে। এক রত্তি মেঘ নেই আকাশে। বাতাস যে আসবে তার কোন সম্ভাবনাই নেই।
সেটা বুঝে আরও রেগে গেল কারনেস। মাথায় আগুন ধরছে তার, বুঝতে পারছে কিশোর। ভয় পেয়ে গেল। এখন বেফাস কিছু করে বসলে মরতে হবে।
কিশোরের গলা চেপে ঠেলতে ঠেলতে মাস্তুলের কাছে নিয়ে গেল কারনেস। ছুরি বের করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, আমার সঙ্গে চালাকির মজা দেখাচ্ছি!
মাথা গরম করলো না কিশোর। গলায় চাপ রয়েছে। ফ্যাসফ্যাস করে কোনমতে বললো, আমাকে মেরে ফেললে মুক্তোর খেতটা আর খুঁজে পাবেন না।
দ্বিধা করলো কারনেস। গলার চাপ বাড়িয়েই আবার ঢিল করে ফেললো। কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এলো এক পা। হ্যাঁ, মুক্তো। আরও কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। ফিরে তাকিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় আদেশ দিলো। নাবিকদেরকে।
লোকটাকে যে কি ভীষণ ভয় পায় সেটা নাবিকদের আচরণেই বোঝা গেল। লংবোট নামাতে দৌড়ে গেল ওরা। দেখতে দেখতে নামিয়ে ফেললো জাহাজের পাশে পানিতে। তাতে চড়ে বসলো ছজন লোক, দাঁড় তুলে নিলো।
এসো আমার সঙ্গে, কিশোরকে বললো কারনেস। ওরা উঠলে দাঁড় বাইতে শুরু করলো লোকগুলো। তীরে পৌঁছলো।
অবাক হয়ে কিশোর ভাবছে, কি করবে লোকগুলো? একটু পরেই বুঝতে পারলো। ঢেউয়ের সঙ্গে যে ঝিনুকগুলো তীরে এসে পড়েছে, সেগুলো কুড়াতে এসেছে ওরা। অনেক ঝিনুক পড়ে থাকতে দেখলো কিশোর। শুকনোয় তো আছেই, পানিতেও আছে। অল্প পানিতে ছেয়ে রয়েছে লেগুনের নিচে। তবে ওগুলোর প্রতি কোন আগ্রহ বোধ করলো না সে। চারজন লোক ঝিনুক কুড়িয়ে এক জায়গায় করছে, একজন বয়ে নিয়ে গিয়ে তুলছে নৌকায়। ছয় নম্বর লোকটা নারকেল কুড়াচ্ছে।
কিশোরকে নিয়ে ক্যাম্পের কাছে চলে এলো কারনেস। যেখানে যা পেলো, কাজে লাগার মত, তুলে নিতে আরম্ভ করলো। অভিযাত্রীদের ফেলে যাওয়া জিনিস। মাঝে মাঝে কথা বলছে কিশোরের সঙ্গে, প্রশ্ন করছে। পারলে জবাব দিচ্ছে কিশোর।
তাড়াহুড়া করছে কারনেস। কেন, সেটা বুঝতে পারলো কিশোর। কারনেসের ভয়, ঝিনুক পালিয়েছে। গিয়ে দলবল নিয়ে ফিরে আসতে পারে। তাই পালাতে চাইছে কারনেস, লেগুন থেকে বেরিয়ে দূরে চলে যেতে চাইছে।
পাথরের নিচে, শ্যাওলার ভেতরে খোঁজাখুঁজি করছে কারনেস। নীল আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেছে সূর্য। বেলা যতই বাড়ছে, গরমও বাড়ছে। নিরাসক্ত চোখে তার কাজকর্ম দেখছে কিশোর। সে একটা কথাই ভাবছে, কি করে পালাবে। কিন্তু কোন উপায়ই বের করতে পারছে না। এক কাজ করতে পারে। দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। চলে যেতে পারে দ্বীপের নিচের সেই গুহায়। তবে তাতে হাঙরের ভয় আছে। আর কারনেসের লোকেরাও যে গুহাঁটা খুঁজে বের করতে পারবে না তা নয়। তার ওপর রয়েছে গুলি খাওয়ার ভয়। সে দৌড় দিলেই কোমর থেকে রিভলভার নিয়ে গুলি চালাবে কারনেস। গুহায় ঢোকার ভাবনাটা বাতিল করে দিলো সে।
একটা পাথরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কারনেস। ওটার নিচেই মুক্তোর টিনটা লুকিয়ে রেখেছিল ডজ। এইবার কিছুটা আগ্রহী হলো কিশোর। পাথরের চারপাশে শ্যাওলার স্তূপ জমে রয়েছে। টেনে টেনে কিছু সরালো কারনেস। কিছু সরালো পা দিয়ে। ঘুরে দাঁড়াতে যাবে এই সময় একটা জিনিস চোখে পড়লো তার।
ধক করে উঠলো কিশোরের বুক। মনে হলো হৃৎপিন্ডের গতিই বুঝি থেমে যাবে। এত গরমেও ঠান্ডা শিহরণ জাগলো শরীরে। চিকণ ঘাম দেখা দিলো কপালে। জিনিসটা সে-ও দেখতে পেয়েছে। বালির ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে টিনের একটা অংশ। সেই বিস্কুটের টিনটাই, চিনতে অসুবিধে হলো না তার। ওপরের বালি অনেকখানি ধুয়ে নিয়ে গেছে পানি, ফলে বেরিয়ে পড়েছে টিনটা।
কিশোর আশা করলো, দেখতে পেলেও টিনটা ছোঁবে না কারনেস। কারণ পুরনো একটা জিনিস বালিতে দেবে রয়েছে, কোন মূল্য নেই ওটার। কিন্তু কারনেসের কাছে আছে। এখানে কিশোরদের আনা জিনিস যা-ই পাচ্ছে তুলে নিচ্ছে লোকটা। কি করবে আল্লাহই জানে। লাথি দিয়ে টিনের ওপরের বালি আরও সরালো কারনেস। তারপর টেনেটুনে বের করে আনলো ওটা বালির নিচ থেকে। ওই সময় একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকালেই তার কাছে ফাঁস হয়ে যেত ব্যাপারটা। কারণ একেবারে শাদা হয়ে গেছে তার মুখ।
টিনের অবস্থা দেখে পছন্দ হলো না কারনেসের। ছুঁড়ে ফেলে দিলো। হাঁপ ছাড়তে যাচ্ছিলো কিশোর, ছাড়া আর হলো না। টিনের মুখটা হয় ঠিকমত লাগেনি, নয়তো জোর ঝাকুনিতে গেল খুলে। ছড়িয়ে পড়লো ওটার ভেতরের জিনিস।
পাথরের মূর্তি হয়ে গেল যেন কারনেস। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো জিনিসগুলোর দিকে। বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপরই জোরে এক চিৎকার দিয়ে দৌড় দিলো। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মুক্তোগুলোর কাছে। কাঁপা হাতে তুলে রাখতে শুরু করলো আবার টিনের মধ্যে। একবার তাকালো কিশোরের দিকে। উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। ঘামছে দরদর করে। দৌড়ে এলো তার সাগরেদরা। উত্তেজিত হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় কিচির মিচির করে কি বলতে লাগলো ওরা বুঝতে পারছে না কিশোর।
অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। টিনটা যে কেন ফেলে গেছে ডজ, মাথায় ঢুকছে না কিশোরের। এত কষ্ট করলো ওরা ওগুলোর জন্য, সব শেষ, কোনই লাভ হলো না। এসব জিনিসের লোভ নেই তার, নির্দ্বিধায় ওই একটিন মুক্তো দান করে দিতে পারে, কিন্তু এখন তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কারণটা আর কিছু না, অভিযানের ব্যর্থতা। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। রাগ হতে থাকলো ডজের ওপর, আর কারনেসের প্রতি তীব্র ঘৃণা। ওই মুহূর্তে বুঝতে পারলো কেন এসব মূল্যবান রত্নের জন্যে মানুষ মানুষকে খুন করে।
কারনেস মুক্তোগুলো পাওয়ার খানিক আগে ঝিনুকের প্রথম চালানটা নিয়ে রওনা হয়েছিলো লংবোট। জাহাজের কাছে পৌঁছে গেছে। দুজন লোক গেছে সঙ্গে। চিৎকার করে জানতে চাইলো, কি হয়েছে। তীর থেকে জানালো ওদের সঙ্গীরা। দ্রুত ঝিনুকগুলো ডেকে ছুঁড়ে ফেলে নৌকা নিয়ে ফিরে এলো ওরা।
অনেক ঝিনুক পড়ে রয়েছে এখনও। সেগুলো তোলার নির্দেশ দিল কারনেস। লোকটার লোভ দেখে আরও তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। এতগুলো মুক্তো পেয়েছে, তার পরেও আরও পাওয়ার লোভে ঝিনুক তুলে নিয়ে যাচ্ছে। জাহাজ বোঝাই করে মুক্তো দিয়ে দিলেও হবে না, আরও চাইবে, আরও।
নিজে দাঁড়িয়ে ঝিনুক তোলা দেখতে লাগল কারনেস। তদারক করছে। কোনটা বাকি রয়ে গেল কিনা দেখছে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে কিশোরের দিকে। কিশোরের গম্ভীর হয়ে যাওয়া মখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, খুব মজা পাচ্ছে যেন। ক্ষোভ, রাগ সব দূর হয়ে গেছে তার। খোশমেজাজে আছে। একবার জিজ্ঞেস করলো, এগুলো যে আছে বলনি কেন?
জানতাম না।
কণ্ঠের তিক্ততা চাপতে পারলো না কিশোর। তাতে আরও মজা পেল লোকটা। হেসে উঠলো। অনেক কষ্ট থেকে আমাকে বাচিয়ে দিলো তোমার বন্ধুরা। এতগুলো মুক্তো রেখে গেল। কিশোরের দিকে একটা ডাব ছুঁড়ে দিলো সে। ছুরি দিয়ে আরেকটা ডাবের মুখ কাটলো নিজে খাওয়ার জন্যে।
ডাবটা দেখে পিপাসার কথা মনে পড়লো কিশোরের। কারনেসের কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে মুখ কাটতে লাগলো। গলা শুকিয়ে গেছে।
শেষ ঝিনুকটা যখন নৌকায় তোলা হলো, পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই ছুঁই করছে তখন সূর্য। নৌকায় উঠলো দাঁড়ীরা। যার যার জায়গায় বসলো। কিশোর ভাবলো, তাকে ফেলেই চলে যাবে কারনেস। তাতে বরং খুশিই হবে কিশোর। কারণ ওমররা ফিরে আসবেই। কিন্তু তাকে নিরাশ করলো কারনেস। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এক ধরনের অদ্ভুত দৃষ্টি ফুটেছে চোখে। নৌকায় ওঠার ইশারা করলো।
উঠলো গিয়ে কিশোর। তার পেছনেই বসলো কারনেস। নৌকা ছাড়তে বলার আগে শেষবারের মত সৈকতে চোখ বোলালো সে, কিছু ফেলে যাচ্ছে কিনা দেখলো। আরেকবার ফেরার কোন ইচ্ছেই নেই তার। নৌকা ছাড়তে বললো সে।
জাহাজের দিকে এগিয়ে চললো নৌকা। একেবারে নিরাশ হয়ে পড়েছে কিশোর। সারাটা দিন বিমানের অপেক্ষা করেছে। ভেবেছে এই বুঝি এলো, এই বুঝি এলো। শব্দ শোনা গেল। কিন্তু এলো না ওটা। এখন রাত হয়ে আসছে। আজ আর আসবে না বিমানটা। এলেও আগামী দিন।
জাহাজের গায়ে এসে ভিড়লো নৌকা। ডেকে উঠতে বলা হলো কিশোরকে। উঠলো সে। সাগরের দিক থেকে ধেয়ে এলো এক ঝলক বাতাস। আলোড়ন তুললো লেগুনের পানিতে। মৃদু দুলতে লাগলো জাহাজ। আনন্দে চিৎকার করে উঠলো কারনেস। তার খুশির কারণ বুঝতে পারলো কিশোর। প্রকৃতিও যেন কারনেসের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে। প্রথমে পাঠিয়েছে ঝড়, মুক্তোগুলো দ্বীপে ফেলে রেখে বিমানটাকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। সেগুলো পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে কারনেসকে। এখন পাঠিয়েছে বাতাস। স্কুনারটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। পরদিন ওমররা আসতে আসতে অনেক দূরে চলে যাবে ওটা। ধরার আর কোন উপায়ই থাকবে না হয়তো।
মুক্তোর টিনটা বগলে চেপে নিচে চলে গেল কারনেস। ফিরে এলো একটু বাদে। ওটা ছাড়া অন্য কোন পরিকল্পনা ছিলো হয়ত তার, বাতাস আসায় সেটা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিচু গলায় নির্দেশ দিতে আরম্ভ করল তার নাবিকদের। ওরা ফিরে তাকালো কিশোরের দিকে। ওদের দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল সে। নিশ্চয় তার ব্যাপারেই কিছু আলোচনা হয়েছে।
আমার জাহাজটা তোমার পছন্দ হয়নি, কিশোরকে বললো কারনেস। ভাল কথা। এখানেই থেকে যাও! রেখে যাওয়া হবে তোমাকে।
এতে বরং খুশিই হলো কিশোর। এটাই চাইছিলো। বললো না কিছু।
তবে, কারনেস বললো, অনেক কিছু জেনে ফেলেছ তুমি। বলে দিলে বিপদে পড়বো আমি। তাই যাতে বলতে না পার সেই ব্যবস্থা করে যাব। আবার নাবিকদের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকালো। রওনা হয়ে গেল হুইলের দিকে।
ক্যাপস্টানের দিকে দৌড়ে গেল চারজন নাবিক। নোঙর তোলার সময় ঝনঝন করে উঠলো শেকল। দ্রুত কালো হয়ে আসা আকাশের পটভূমিতে দুলে উঠলো একটা শাদা পাল।
দুজন নাবিক রয়ে গেল কিশোরের পাশে। ফুলে উঠলো পাল। লেগুনের মুখের দিকে রওনা হয়ে গেল জাহাজ। কি করতে বলা হয়েছে লোকগুলোকে?
সতর্ক নজর রাখলো কিশোর। রেখেও কিছু করতে পারলো না। জোর করে তাকে ধরে শুইয়ে ফেললো লোকগুলো। কারাত আর জুডোর সাহায্যে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলো সে। কিছুই করতে পারলো না। অসম্ভব শক্তি লোকগুলোর গায়ে। চেপে ধরে রেখে সাহায্যের জন্যে ডাকলো অন্যদেরকে। একজন একটা দড়ি পেঁচিয়ে বাঁধলো তার কোমর। আরেক মাথা বাঁধলো একটা লোহার পাইপের সঙ্গে। আতঙ্কিত হয়ে পড়লো কিশোর। ওদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে। পানিতে ফেলে দেয়া হবে তাকে, হাত-পা বেঁধে। লোহার পাইপের ভার তাকে টেনে নিয়ে যাবে। লেগুনের তলায়। কিছুতেই ভেসে উঠতে পারবেনা।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করলো সে। দুএকজনের নাকে ঘুসিও মারলো। লাভ হলো না কিছু। এতগুলো শক্তিশালী হাত থেকে মুক্তি পেলো না। উপুর করে ফেলে মুচড়ে তার হাত নিয়ে আসা হলো পিঠের ওপর। দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। আরেকজন পা বেধে দিলো। শিকারীর হাতে অসহায় খরগোশ যেন সে, কিংবা কসাইয়ের কাছে ছাগল। বয়ে নিয়ে আসা হলো রেলিঙের কাছে। খিকখিক করে তার কানের কাছে হেসে উঠল একটা লোক। দুজনে দুদিক থেকে ধরে তুলে দোলা দিয়ে তাকে রেলিঙের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিলো। ঝপাং করে পানিতে পড়লো সে।
পড়েও সারতে পারলো না। টেনে নিয়ে চললো তাকে লোহার পাইপ। মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে লাগলো ছাড়া পাওয়ার জন্যে। সব দিক থেকে চেপে ধরতে শুরু করেছে যেন কালো পানি।
অবশেষে শেষ হলো নিচের দিকে টানা। তার মানে তলায় পৌঁছে গেছে। লোহার পাইপ, বালিতে ঠেকেছে। চারপাশে শুধুই ঘন অন্ধকার।
১৩
রাটুনাতেই রয়েছে ওমর, মুসা আর ডজ। কিশোরের মতো মারাত্মক বিপদে নেই ওরা, তবে অসুবিধেয় পড়েছে। প্রচন্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে কিশোরদের জন্য। উৎকণ্ঠাও খুব খারাপ জিনিস। শরীরের ওপর ভীষণ চাপ দেয়।
ওমর আশা করেছিলো লেগুনে থাকলে ঝড়ে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না বিমানটার। ভেবেছে, কিছু পাতাটাতা এসে পড়তে পারে, তাতে আর কি এমন হবে? কল্পনাই করতে পারেনি সে কতটা ক্ষতি হবে। প্রথমেই ধরা যাক, বড় একটা নারকেলের ডালের কথা। তুমুল গতিতে উড়ে এসে একটা ডানার ওপর আছড়ে পড়েছে ওটা। যদিও খসে যায়নি ডানাটা, তুবড়ে গেছে। ওড়া অসম্ভব, যতক্ষণ না ওটা মেরামত হয়। আর শুধু পাতাই যে কি করতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঝড়ের মধ্যে উড়ে এসে বৃষ্টির মত অঝোরে ঝড়ে পড়েছে যেন। হারিকেন শেষ হতে হতে পাতার নিচে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেল বিমানটা।
সেই পাতা সরানোই এক মহা ঝামেলার ব্যাপার। সরিয়ে বেরোনোর পথ তো পরিষ্কার হলো, কিন্তু তীরে যাবে কি করে? পানির ওপরে পাতার স্তর এতটা পুরু নয় যে ওদের ভার রাখতে পারবে। হেঁটে যাওয়া যাবে না। আবার সাঁতরে যাওয়াও মুশকিল। একটা কাজই করা যায়। চারপাশ থেকে লতাপাতা জোগাড় করে ফেলে ফেলে একটা সাঁকোমত তৈরি করে তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। পাতা ঠেলে সাঁতরে যাওয়ার চেয়ে সেটা কোন অংশেই সহজ মনে হলো না ওদের কাছে।
রাত হয়ে গেল। তীরে পৌঁছতে পারলো না ওরা। বিমানের মধ্যে বসে বসে একটা বিনিদ্র রাত কাটাতে হলো ওদের। কিশোরদের ভাবনা না থাকলে এতটা কষ্ট পেতে হতো না। শরীরের কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্ট অনেক বেশি। তবে শারীরিক কষ্টও কিছু কম হলো না। বিমানটা যেখানে নেমেছে তার কাছেই রয়েছে একটা খড়ি। তার ওপাশে জলাভূমি। সেখান থেকে এসে হাজির হলো মশার ঝাঁক। ছেকে ধরলো। কিছুই করার নেই ওগুলোর বিরুদ্ধে। মসকুইটো কয়েল কিংবা স্প্রে কোনটাই নেই বিমানে।
ভোরের আলো ফুটতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো ওরা। মশার যন্ত্রণা অন্তত কমবে। সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। সাঁকো তৈরি শেষ হয়নি তখনও। ক্লান্ত শরীর নিয়েই কাজে লাগলো ওরা। অনেক কষ্ট আর কায়দা কসরৎ করে ভাসমান সেই পাতার সাঁকো দিয়ে এসে নামলো তীরে। রওনা দিলো গায়ের দিকে। সেটাও কম দূরে নয়। পাঁচ ছয় মাইল তো হবেই। সাধারণ সময়ে ভালো রাস্তা পেলে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। কিন্তু গায়ে জোর নেই। তার ওপর ঘন জঙ্গল। জীবনে অনেক জঙ্গল দেখেছে ওমর, এত ঘন দেখেনি। প্রতিটি ইঞ্চি পথ লতাপাতা কেটে তৈরি করে নিতে হচ্ছে। তার ওপরে রয়েছে ভয়ংকর গরম। দ্রুত শরীরকে অবসন্ন করে দেয়।
শত শত মশার কামড়ের দাগ একেকজনের শরীরে। দিনের বেলা এখন জঙ্গলে হামলা চালালো এক ধরনের মাছি, স্যান্ড ফাই। কামড়ে ভীষণ জ্বালা। রক্ত বেরিয়ে যায়। এতে বাধার পরেও এগোনো থেমে থাকলো না। তবে পানির কিনার থেকে পোয়াটাক মাইল পেরোনোর পরেই এমন আরেকটা বাধা পড়লো সামনে, দিশেহারা হয়ে গেল ওমর।
একটা নদীর মুখ। নদী না বলে সাংঘাতিক জলাভূমি বললেই ঠিক হয়। পাহাড়ের গোড়ায়। যদি খালি পানি থাকতো, তেমন অসুবিধে হত না। তবে পেরিয়ে গেলেই চলতো। একশ গজের বেশি চওড়া নয়। কিন্তু পানিতে জন্মে রয়েছে কচুরীপানা। বড় বড় ফুল ফুটে রয়েছে। অন্য সময় হলে বরং মুগ্ধই হতো ওমর, দেখে চোখ জুড়াতো। এখন সে অবস্থা নয়। ঘন হয়ে জন্মানো শুধু কচুরীপানা পেরোনোই এক অসম্ভব ব্যাপার। তার ওপর তার ভেতরে যদি থাকে এক ফুট লম্বা হাজার হাজার বিষাক্ত, শতপদী তাহলে তো কথাই নেই। না যাবে সাঁতরানো, না ওপর দিয়ে হেঁটে পেরোনো।
স্তব্ধ হয়ে কয়েক মিনিট বসে রইলো ওখানে ওরা। কি করা যায়? সরাসরি পার হওয়ার আশা ছাড়তেই হলো। জলার পাশ দিয়ে জঙ্গল কেটে ঘুরে এগোনে ছাড়া বিকল্প নেই। শেষে তা-ই করতে লাগলো। জানে না কতদূর গড়িয়ে রয়েছে জলাটা। তবে আশার কথা, কাছেই পাহাড় রয়েছে। উপত্যকার পরে যেখান থেকে ঢাল শুরু হবে, সেখানে আর নদী থাকতে পারবে না। এটা অবশ্য ডজের অনুমান। ঠিকই অনুমান করেছে সে। আস্তে আস্তে সরু হয়ে আসছে নদী। শেষে এতই সরু হয়ে গেল, খাল বলা চলে এখন। তার পরেও পার হওয়া গেল না, শতপদীর ভয়ে। এগোতে থাকলো ওরা। যতটুকু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আর সরু হচ্ছে না নদী। অবশেষে ভাগ্য কিছুটা সদয় হলো ওদের ওপর। একটা জায়গায় ঝড়ে কাত হয়ে পড়ে গেছে একটা রুটিফল গাছ, আর পড়েছে একেবারে খালের ওপর লম্বা হয়ে, এপার থেকে ওপারে যাবার সাঁকো তৈরি করে দিয়ে।
খাল পেরোলো ওরা। ততক্ষণে রাত হয়ে এসেছে। অন্ধকার নামতে দেরি নেই। সারাটা দিন কাটিয়ে জঙ্গলে ঘুরে মরে গাঁয়ের দিকে মাত্র একটা মাইল এগোতে পেরেছে।
সাঁকো পেরিয়ে এসে দেখলো, এখানকার জঙ্গলও একই রকম ঘন। রাতে এগোনো সম্ভব না। দিনের জন্যে অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু বসে থাকতে চাইলো না ওমর। বললো রাতেই চলবে। ডজ রাজি হলো না। সে এখানকার জঙ্গল চেনে। বললো সেই চেষ্টা করাটাই স্রেফ পাগলামি। সামনে অনেক বাধা থাকতে পারে। আরও জলা থাকতে পারে। চোরাকাদা থাকতে পারে। আর যদি কিছু না-ও থাকে, সারারাত পথ হারিয়ে অযথা ঘুরে মরতে হতে পারে বনের ভেতর।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে আধমরা হয়ে গেছে ওরা। গড়িয়ে পড়লো বনের ভেজা মটিতে। একধরনের অদ্ভুত ফাঙ্গাস জন্মে রয়েছে। অন্ধকারে জ্বলে। বাতাসে একধরনের সোঁদা গন্ধ। নিঃশ্বাস নিতে গেলে মনে হয় ফুসফুসে চাপ লাগছে। বিমানে থাকতে বন থেকে মশা গিয়ে হামলা চালিয়েছিলো, আর এখানে তো মশার রাজত্বেই এসে ঢুকেছে ওরা। কাজেই কামড়ানোর পরিমাণটা অনেক বেশি। ভয়াবহ আরেকটা রাত কাটাতে তৈরি হলো তিনজনে।।
এখন বুঝতে পারছি, বিষন্ন কণ্ঠে বললো ওমর। মুক্তো কেন এত দামী। দুহাতে একনাগাড়ে চাপড় মারছে শরীরের যেখানে সেখানে।
রাত বাড়তেই মশার অত্যাচারও এতই বেড়ে যেতে লাগলো যে আগুন জ্বালাতে হলো ওদেরকে। ধোঁয়ার ভেতরে গা ডুবিয়ে বসতে হলো। সেই ধোঁয়ার ঝাজে পানি এসে গেল চোখে, গলার ভেতরে জ্বালা ধরালো, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো। মশার কামড়, না সেই ধোঁয়া কোনটা যে ভাল বোঝাই কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।
এতেও এত কষ্ট হত না, ওমর বললো। হাসিমুখে সহ্য করে নিতাম, যদি জানতাম কিশোররা ভাল আছে।
জবাব দিলো না ডজ কিংবা মুসা। খারাপ সম্ভাবনাগুলোই কেবল আসছে মনে। সেগুলো আর প্রকাশ করতে চাইলো না।
স্থির হয়ে আছে যেন সময়, কাটতেই চাইছে না। মাঝে মাঝে জলার দিকে তাকাচ্ছে মুসা। শিউরে উঠছে। আলোজ্বলা ফাঙ্গাস ওখানেও আছে। নড়ছে চড়ছে থেকে থেকে। কারণটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তার। কোন প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ওপর দিয়ে। বনের ভেতর থেকে আসছে বিচিত্র ডাক, চলাফেরার আওয়াজ। সেগুলো যে কিসের ডজও বলতে পারলো না। ধোঁয়ার ওপাশে উড়ছে বড় বড় মথ। ডানা মেলে দিয়ে উড়ছে, গিয়ে বসছে পাতার ওপর। নিঃশব্দে উড়ে এল একটা বিশাল বাদুড়। ড্রাকুলার গল্প পড়া আছে মুসার। ভূতের ভয়ে এমন এক চিৎকার দিলো, লাফিয়ে উঠলো ওমর আর ডজ। বাদুড়টাও চমকে গেল। কাছেই একটা গাছের ডালে গিয়ে ঝুলে রইলো।
এত অন্ধকারও আর কখনও দেখেনি মুসা। মনে হচ্ছে ভারি নিরেট কোন জিনিসের মত চেপে বসেছে ওদের ওপর। এত অত্যাচারের মাঝেও ঢুলতে শুরু করলো সে। দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। পায়ে কিসের ছোঁয়া লাগতে টুটে গেল তন্দ্রা। আগুনের আলোয় আতঙ্কিত চোখে দেখলো লালচে-বাদামী একটা শতপদী এসে পায়ে উঠেছে। দশ ইঞ্চি লম্বা। জুতোর ওপরে অনেকখানি উঠে এসেছে প্যান্ট। পায়ের সেই খালি জায়গাটায় উঠেছে ঘিনঘিনে প্রাণীটা। চিৎকার দিয়ে উঠে থাবা মেরে ওটাকে ফেলে দিলো সে। পায়ের চামড়ায় দেখতে পেলো দুটো লাল বিন্দু। দেখতে দেখতে ফুলে উঠলো জায়গাটা। অকল্পনীয় ব্যথা। ডজ বললো, কয়েক দিন ধরে থাকবে ব্যথাটা।
একনাগাড়ে পাইপ টেনে চললো ডজ। সমস্ত সিগারেট শেষ করে ফেললো ওমর।
আল্লাহ, ভোর মনে হয় হচ্ছে, বিড়বিড় করলো মুসা। আর একটা রাত যদি এই জঙ্গলে কাটাতে হয়, সোজা পাগলা গারদে পাঠাতে হবে আমাকে। আগের বার এসে দক্ষিণ সাগরের এই দ্বীপগুলোকে মনে হয়েছিলো বেহেশত, এখন মনে হচ্ছে দোজখ।
উঠে দাঁড়ালো ওমর। শক্ত হয়ে গেছে শরীর, নড়তেই চায় না। ঝড়াঝুড়া দিয়ে হাত-পাগুলোকে সচল করলো। চল, রওনা হওয়া যাক।
ভোর তখনও হয়নি। শুধু অন্ধকার ফিকে হয়েছে কিছুটা। এরই মাঝে বন কেটে এগোতে শুরু করলো ওরা।
গত দুদিনে শরীরের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। আর সহ্য করতে পারছে না শরীর। বন থেকে বেরোতে যদি বেশি দেরি হয়, তাহলে আর বেরোতেই পারবে না। তবে বন আর বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখলো না ওদের। পাতলা হয়ে এলো। বাইরের খোলা অঞ্চলে বেরিয়ে ধপ করে বসে পড়লো মুসা। চিত হয়ে শুয়ে পড়লো বালিতে। চারপাশে তাকাচ্ছে ডজ। পানি খুঁজছে। একপাশে জলা ছাড়া পানির আর কোন উৎস চোখে পড়লো না। সেই জলার পানি ছুঁয়েও দেখলো না। গিজগিজ করছে জীবাণুতে। খেলেই মরবে।
কয়েক মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিলো ওরা। তারপর উঠল।
সান্ত্বনা দিয়ে ওমর বললো, আর বেশিক্ষণ লাগবে না। গায়ের কাছে চলে এসেছি। গিয়েই পানি খেতে পারব।
পা টেনে টেনে এগিয়ে চললো তিনজনে। প্রথম নারকেল গাছটার গোড়ায় এসেই দাঁড়িয়ে গেল। ঝড়ে অনেক নারকেল পড়ে রয়েছে। তর সইলো না আর। খেতে বসে গেল। প্রথমে খেল পানি, তার পরে শাস। লোভীর মত।
গায়ের কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়ালো মুসা। তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। সে কি দেখেছে দেখার জন্যে অন্য দুজনও তাকালো। ঘন গাছের আড়ালে ছায়ার মত মিশে যেতে দেখলো একজন আদিবাসীকে। ঝিনুকদের গায়ের মানুষের চেয়ে অন্য রকম মনে হলো লোকটাকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শাদা চক কিংবা কাদা দিয়ে অদ্ভুত সব দাগ আঁকা।
আমার ভাল্লাগছে না, বিড়বিড় করে বললো ডজ। কিছু একটা ঘটছে এখানে।
কি ঘটছে? জানতে চাইলো ওমর।
লোকটাকে দেখলে? কেমন রঙ মেখেছে। যুদ্ধের সাজ। হাতের মুগুরটাও লড়াইয়ের সময় ব্যবহার করে। বহু দেখেছি ওরকম। আইনের বিরুদ্ধ কাজ এটা। তার পরেও লেগে যায় ওরা। ডজের কথার সমর্থনেই যেন দিড়িম দিড়িম করে ঢাক বেজে উঠলো। কয়েকবার বেজে থেমে গেল। দূর থেকে শোনা গেল আবার। থামলো। বিরতি দিয়ে আবার বেজে উঠলো এপাশে। শুনছো? মেসেজ পাঠাচ্ছে। সংবাদ আদান প্রদান করছে। আমরা এখান থেকে যাওয়ার পর নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে, যার ফলে খেপে গেছে লোকগুলো। আমাদের ওপর এখন কোন কারণে খেপে না গেলেই হয়। তাহলে সোজা ধরে কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলবে।
এখন তো আর নরখাদক নয় ওরা, বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
তার দিকে তাকালো ডজ। জোর দিয়ে বলতে পার না। কেউ স্বীকার করে না বটে। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোকে অবশ্য বাদ দেয়া যায়। তবে বুড়োগুলোকে বিশ্বাস নেই। মানুষের মাংসের লোভ আছে ওদের। আগে খেয়েছে তো। কর্তৃপক্ষ কড়া নজর রেখেছে ওদেরকে ঠেকানোর জন্যে। তার পরেও বলা যায় না।
ওসব ভেবে লাভ নেই, ওমর বললো। তবে গলায় জোর নেই তার। চল, গিয়ে দেখি কি হয়েছে।
গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুজন আদিবাসী। ওদের ঠিক সামনে। দুজনের গায়েই রঙ মাখা, হাতে মুগুর। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অভিযাত্রীদের দিকে, তারপর ছুটে পালালো।
গায়ে এসে ঢুকলো অভিযাত্রীরা। কোন পুরুষমানুষ চোখে পড়লো না। শুধু দুতিনজন মহিলা। ঢাকের আওয়াজ হচ্ছে না আর।
সব চেয়ে বয়স্ক মহিলাটার কাছে এগিয়ে গেল ওমর। জিজ্ঞেস করলো, গাঁয়ের লোক কোথায়?
জবাব দিলো না মহিলা। আরেক দিকে মুখ ফেরালো।
ঝোপের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললো তখন ওমর, অশান্ত সাগর, আমি জানি আপনারা কাছাকাছিই আছেন। আমাদের ওপর চোখ রাখছেন। বেরিয়ে আসুন।
ঝোঁপ ফাঁক করে বেরিয়ে এল একটা ছিপছিপে শরীর। এক তরুণ। শাদা রঙ দিয়ে বন্ধনী আঁকা হয়েছে কপালে। সারা শরীরে দাগ।
বিশ্বাস করতে পারছে না যেন ওমর। ঝিনুক, তুমি!
হ্যাঁ, আমি, এগিয়ে এলো ঝিনুক।
যুদ্ধ ঘোষণা করেছ কার বিরুদ্ধে? ডজ জিজ্ঞেস করলো।
ওই শয়তানটার।
কোন শয়তানটার?
গুডু কারনেস।
১৪
দম ফুরিয়ে এসেছে কিশোরের। মৃত্যু অবধারিত। ছটফট করছে না আর মুক্তি পাওয়ার জন্যে। লাভ নেই। ভাবছে, মরতে কি খুব কষ্ট হবে? কততক্ষণ লাগবে প্রাণ বেরোতে?
হালকা একটা ছোঁয়া লাগলো শরীরে। চমকে উঠলো সে। হাত চেপে ধরলো নরম আরেকটা হাত। না না হাত আসবে কোথা থেকে? হাতের মত কিছু। হয়ত অকটোপাসের গুড়। এসে গেছে তাহলে খুন করার জন্যে! ভাল। সরে গেল চাপটা, পেটের কাছে। হাত বুলিয়ে যেন বোঝার চেষ্টা করছে কোনখান থেকে খাওয়া শুরু করবে। খুঁজে পেলো কোমরে পেঁচানো দড়িটা, যেটার সঙ্গে লোহার পাইপ বাঁধা রয়েছে। তারপর তাকে অবাক করে দিয়ে যেন পোচাতে শুরু করলো দড়িতে।
ফুসফুসের বাতাস প্রায় শেষ। আর কয়েক সেকেন্ড টিকবে বলে মনে হয় না। দড়িটা কাটা হয়ে গেল। তার হাতের বাঁধনে পোচ মারা শুরু হলো এবার। অলৌকিক কান্ডই হোক আর যা-ই হোক, কার কাজ বুঝতে পারলো সে। মানুষ। ছুরি দিয়ে প্রথমে পাইপের দড়ি কেটেছে, এখন হাতেরটা কাটছে। পায়েরও কেটে দেয়া হলো। ওঠার কথা আর বলতে হলো না কিশোরকে।
ওপরে ভেসে হাঁ করে বাতাস টানতে লাগলো কিশোর। চোখের কোণ দিয়ে অন্ধকারেও দেখতে পেলো আরেকটা মাথা ভেসে উঠেছে তার পাশে। কে? জিজ্ঞেস করলো সে।
ফিসফিস করে জবাব এলো, আমি, সাগরের হাসি।
তুমি! যাওনি?
চল, ডাঙায় চল। কারনেস দেখে ফেলবে।
তীরে এসে উঠলো দুজনে। চলে এলো নারকেল গাছের আড়ালে।
তুমি এলে কোত্থেকে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর।
আমি যাইইনি। এখানেই ছিলাম।
কোথায়? কিশোর অবাক।
কারনেসের জাহাজে। পালের নিচে লুকিয়ে ছিলাম।
আনমনে মাথা নাড়লো কিশোর। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না এভাবে মুক্তি পেয়ে যাবে।
ঝিনুক কোথায় তাহলে?
রাটুনায় চলে গেছে।
কিন্তু জাহাজে গেলে কি করে তুমি? উঠলে কখন?
তুমি ধরা পড়তেই ডুব দিয়ে সরে এলো ঝিনুক। আমাকে বললো। সাঁতরে গিয়ে লুকিয়ে জাহাজে উঠলাম, দেখতে লাগলাম তোমাকে নিয়ে কি করে ওরা। ওরা ঘুমাতে যাওয়ার পরেও জাহাজ থেকে নামলাম না। রাতে নৌকা নিয়ে চলে গেল ঝিনুক। আমাকে থাকতে বলে গেল। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে।
ভাগ্যিস থেকেছিলে! নইলে এতক্ষণে শেষ হয়ে যেতাম!
হেসে উঠলো সাগরের হাসি। জানালো, ঝিনুক লোক নিয়ে ফিরে আসবে। অশান্ত সাগরকে বলে অনেক যোদ্ধা নিয়ে আসবে, বলে গেছে। এবার আর ছাড়বে কারনেসকে। অনেক জ্বালান জ্বালিয়েছে সে।
ও চলেই গেছে, না? অন্ধকার সাগরের দিকে তাকালো কিশোর। জাহাজটা চোখে পড়লো না।
হ্যা। ঝিনুক এসে ওকে খুঁজে বের করবে।
কারনেসের জাহাজে রয়েছে ওরা? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো ওমর। মুশকিল হয়ে গেল।
হ্যাঁ, মাথা নাড়লো মুসা। জাহাজ থেকে কিশোর আর সাগরের হাসিকে উদ্ধার করা কঠিনই। কারনেস মেরেই ফেলে কিনা ওদেরকে কে জানে!
কি করা যায়, বল তো? ওমরের দিকে তাকালো ডজ। নৌকা নিয়ে গিয়ে জাহাজটাকে ধরা যাবে না।
বিমানটা নিয়ে যেতে হবে।
কি করে? মেরামত করতেই তো অনেক সময় লেগে যাবে। ততোক্ষণে অনেক দূরে চলে যাবে কারনেস।
উড়তে পারবো না, কিন্তু ট্যাক্সিইং করে যেতে অসুবিধে কোথায়? পাতার দঙ্গল থেকে ওটাকে বের করে নিয়ে গিয়ে খোলা পানিতে ফেলতে পারলেই তো হয়ে গেল।
তাই তো। এটা তো ভেবে দেখিনি।
অভয় পেয়ে বেরিয়ে এসেছে গাঁয়ের লোকে। যুদ্ধে যাওয়ার আর দরকার নেই, ওদেরকে বোঝাল ওমর। অশান্ত সাগরকে অনুরোধ করলো, কিছু লোক দিতে, যাতে নৌকা নিয়ে গিয়ে বিমানটাকে সরিয়ে আনতে পারে। ওটার চারপাশের জঞ্জাল সাফ করে দিতে পারলেই হলো, এর বেশি আর কিছু করা লাগবে না।
খুশি হয়েই লোক দিলো অশান্ত সাগর। ওদেরকে নিয়ে রওনা হলো আবার ডজ, ওমর আর মুসা। তবে অবশ্যই খাওয়া-দাওয়ার আর খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর। তাদের সঙ্গে চললো ঝিনুক।
বনের ভেতর দিয়ে গেল না আর। অত্যন্ত দুর্গম পথ, বললো অশান্ত সাগর। পারতপক্ষে ওই বনে কেউ ঢুকতে চায় না, একথাও জানালো। সৈকতে চলে এলো দলটা। সাথে এসেছে তিরিশজন অদিবাসী, সবাই যুদ্ধের সাজে সেজেছে। ঝিনুকের সঙ্গে লড়াই করতে যেতে চেয়েছিলো। যেতে পারলো না বলে কিছুটা নিরাশ হয়েছে যেন।
কয়েকটা ক্যানুতে চড়লো সবাই। যুদ্ধে যেতে পারেনি তাতে কি হয়েছে, আরেকটা বিশেষ কাজ তো করতে যাচ্ছে। সেটাকে লড়াইয়ের সামিল ধরে নিলো বোধহয় যোদ্ধারা, দাঁড় বাইতে বাইতে বিচিত্র ভাষায় সুর করে যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে চললো।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিমানের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। পাতার দঙ্গল যতই পুরু হোক, এতগুলো মানুষের কাছে টিকতে পারলো না বেশিক্ষণ। পরিষ্কার করে ফেলা হলো আশপাশের অনেকখানি জায়গা। তারপর বিমানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে তিনটে ক্যানু টেনে সরিয়ে আনলো ওটাকে পরিষ্কার পানিতে।
রাত হয়ে গেল কাজ সারতে সারতে। পুরোপুরি অন্ধকার। কিন্তু ভোরের অপেক্ষায় আর থাকতে চায় না ওমর। তখুনি রওনা দেবে ডজ আইল্যান্ডে। তার পরিকল্পনার কথা খুলে বললো সে। বড় একটা শক্ত ক্যানু বাঁধা হলো বিমানের পেছনে। দশজন আদিবাসীকে উঠতে বলা হলো তাতে। ঝিনুক ও আরও চারজন আদিবাসী সহ মুসা আর ডজকে নিয়ে বিমানে উঠলো ওমর। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো খোলা সাগরের দিকে। টেনে নিয়ে চললো ক্যানুটাকে।
চাঁদ উঠলো। নারকেল কুঞ্জের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর আর সাগরের হাসি। দ্বীপের সেদিকটায় চললো যেখানে থেকে সাগরের অনেকদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালো। ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো কিশোরের বুক। লেগুন থেকে সাগরে বেরোনোর মুখটার কাছে রয়েছে স্কুনারটা। যায়নি। থেমে আছে। ওদের কাছ থেকে বড়জোর একশো গজ দূরে।
ঝপ করে বড় একটা পাথরের আড়ালে বসে পড়লো সাগরের হাসি। কারনেস ফিরে এসেছে! ফিসফিস করে বললো সে।
কিশোরও বসলো তার পাশে। স্তব্ধ হয়ে গেছে। এটা আশা করেনি। একটা চিৎকার উঠলো জাহাজে। যতই লুকাক, চোখে পড়ে গেছে ওরা।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাগরের হাসি। দৌড় দাও! যত জোরে পার! চিৎকার করে বললো কিশোর। বলেই ছুটলো।
পেছনে গর্জে উঠলো একটা রাইফেল। কাছেই একটা প্রবালের চলটা তুলে দিয়ে বিইইং করে সাগরের দিকে উড়ে গেল বুলেট। ফিরেও তাকালো না কিশোর। আবার গুলি হলো। কয়েক গজ দূরে আরেকটা প্রবালের চলটা তুললো বুলেট। চাঁদের আলোয় ছুটন্ত নিশানার গায়ে গুলি লাগানো সহজ নয়।
কয়েকটা নারকেল গাছের আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো দুজনে। তাকালো জাহাজটার দিকে। নোঙর তুলে ফেলেছে ওটা। প্রণালী দিয়ে লেগুনে ঢুকেছে।
কিছু দূর এগিয়ে লেগুনের শান্ত পানিতে এসে আবার থামলো জাহাজ। লংবোট নামাতে ব্যস্ত হলো নাবিকেরা। চেঁচিয়ে আদেশ দিচ্ছে কারনেস। ভীষণ রেগে গেছে সে। এবার ধরতে পারলে গুলি করে মারবে, কোন সন্দেহ নেই।
কি করা যায়? ভাবতে শুরু করলো কিশোর। নৌকা নিয়ে দ্বীপে পৌঁছতে দেরি হবে না লোকগুলোর। ধরে ফেলবেই। তবে যতক্ষণ দেরি করিয়ে দেয়া যায়। সকাল পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলে, আর ওদের কপাল ভাল হলে ওমর ভাই এসেও যেতে পারে। কিংবা লোকজন নিয়ে ঝিনুক। দ্বীপের সরু অংশটায় রয়েছে ওরা। চওড়া দিকটায় যাবে বললো সাগরের হাসিকে। ছুটলো। ওদিকে উঁচুনিচু অনেক টিলাটক্কর রয়েছে। লুকানোর জায়গা মিলতে পারে।
গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটছে দুজনে। যাতে গুলি করতে না পারে কারনেস। ঝড়ে নানারকম জঞ্জাল এনে ফেলেছে বালিতে। নারকেল পাতা, শ্যাওলা, ঝিনুকের খোসা। সেসবের জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছে দৌড়ান। কিন্তু কোন কিছুই ঠেকাতে পারলো না ওদেরকে। চলে এলো দ্বীপের চওড়া দিকটায়। বেশ উঁচু একটা টিলা রয়েছে ওখানে। ঢালের গায়ে মিশে থেকে আস্তে মুখ বাড়িয়ে তাকালো কিশোর। দেখলো, পৌঁছে গেছে লংবোট। টেনে সৈকতে তুলছে নাবিকেরা। রাইফেল বগলে চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে কারনেস।
চলেই তো গিয়েছিল, বিড়বিড় করে বললো কিশোর। আবার ফিরে এলো কেন ব্যাটা?
চুপ করে রইলো সাগরের হাসি।
ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে কিশোরের মগজে। এই দ্বীপে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকা অসম্ভব। জায়গাই নেই তেমন। নারকেল গাছে চড়ে বসে থাকতে পারে। বড়জোর রাতটা টিকতে পারবে তাতে। আলো ফুটলেই চোখে পড়ে যাবে। জ্যান্ত নামার আর সুযোগ পাবে না তখন। গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে গাছ থেকে। লুকানোর আরেকটা জায়গা হলো দ্বীপের নিচের গুহাঁটা। ওতে লুকালে হয়তো কয়েকদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে, যদি নাবিকেরা ডুব দিয়ে খুঁজতে না আসে। ওখানে লুকানোর সব চেয়ে বড় বিপদ হল হাঙর। ঝড়ের সময় ঢুকেছিলো। এখনও লেগুনেই আছে, না বেরিয়ে গেছে? থাকলে ওদেরকে ধরলো না কেন? কয়েকবার তো লেগুনে নামতে হয়েছে ওদেরকে। থাকুক না থাকুক, ওখানেই গিয়ে লুকানোর সিদ্ধান্ত নিলো কিশোর। কারনেসের হাতে ধরা দিলেও মরতে হবে। তার চেয়ে গুহায় ঢোকার ঝুঁকিটাই নেয়া যাক। ভাগ্যে যদি থাকে হাঙরের পেটে যাওয়া, ঠেকাতে তো আর পারবে না।
কিন্তু এগোতে গিয়ে থমকে গেল সে। কি করে আন্দাজ করেছে কারনেস, কে জানে। কিংবা এমনিই হয়তো একজন লোককে পাহারায় রেখেছে ওদিকটায়, যেদিক দিয়ে গুহায় যেতে হয়। অন্যখান দিয়ে পানিতে নেমেও যাওয়া যায়। তবে যেদিক দিয়েই যাক, চাঁদের আলোয় কারনেসের লোকের চোখে পড়ে যাবেই ওরা।
কিশোরের মত একই ভাবনা চলেছে সাগরের হাসির মাথায়। বললো, নারকেল গাছে চড়তে হবে। তার পর সুযোগ বুঝে চলে যাব গুহায়। সকাল হতে দেরি আছে। অনেক সময় পাওয়া যাবে।
তা ঠিক। টিলার পাশ দিয়ে চলে এলো দুজনে একটা নারকেল কুঞ্জের ভেতরে। দুজনে দুটো গাছ বেছে নিয়ে চড়তে শুরু করলো।
কিশোরের অনেক আগেই উঠে গেল সাগরের হাসি। পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসলো। একেবারে মিশে গেছে। কিশোরও দেখতে পাচ্ছে না। ভালমত আলো না ফুটলে তাকে বের করতে পারবে না কারনেসের লোকেরা।
সাগরের হাসির মত একই ভাবে পাতার আড়ালে ঢুকলো কিশোর। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে এখন পুরো দ্বীপটা। খোঁজাখুঁজি করছে নাবিকেরা। রাইফেল হাতে পায়চারি করছে কারনেস।
ওদের গাছের নিচে চলে এলো একজন। ওপরের দিকে তাকাল। কিশোরের ভয় হতে লাগলো দেখে ফেলবে। পা বাড়াতে গিয়ে আচমকা চিৎকার করে উঠলো লোকটা। ধক করে উঠলো কিশোরের বুক। দেখে ফেললো? না। বসে পড়েছে লোকটা। পায়ের পাতা উল্টে দেখার চেষ্টা করছে। নিশ্চয় ভাঙা শামুকে পা কেটে গেছে।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে গেল লোকটা।
কি হলো? জিজ্ঞেস করলো কারনেস। চেঁচালে কেন?
পা কেটে ফেলেছি।
ওরা কোথায়?
দেখিনি।
হু। যাবেটা কোথায়? দিনের বেলা খুঁজে বের করবো।
একটা পাথরের ওপর গিয়ে বসলো কারনেস। রাইফেলটা কোলের ওপর রেখে সিগারেট ধরালো। খুঁজেই চলেছে তার লোকেরা।
ধীরে ধীরে মাথার ওপরে উঠল চাঁদ। চলতে শুরু করল পশ্চিমে। মলিন হয়ে আসছে জ্যোৎস্না। কিশোরের মনে হচ্ছে বড় বেশি দ্রুত যেন ডুবতে চলেছে চাঁদটা। কেটে যাচ্ছে রাত। অনেকবার বিপদে পড়েছে জীবনে। রাত যেন তাড়াতাড়ি কাটে সেই প্রার্থনা করেছে তখন। আজ করতে লাগলো, না কাটার জন্যে। কারণ রাত ফুরিয়ে গেলেই মরতে হবে।
১৫
কিছুক্ষণ থেকেই ইঞ্জিনের শব্দ কানে আসছিলো কিশোরের। বিমানটা আসছে ভেবে বার বার আকাশের দিকে তাকিয়েছে। কিছুই চোখে পড়েনি। কারনেসকেও চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখেছে। কয়েকবার করে পাথরের ওপর থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়েছে।
আরও বাড়লো শব্দ। সাগরের দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো ওটাকে। পুব আকাশে তখন ভোরের আলোর আভাস। আকাশ দিয়ে নয়, জলপথে ছুটে আসছে বিমানটা। ট্যাক্সিইং করে।
এইবার আর স্থির থাকতে পারলো না কারনেস। একজনকে পাঠালো জাহাজে, কিসের শব্দ দেখে আসার জন্যে। দরকার হলে যেন মাস্তুলে চড়ে দেখে, সেকথাও বলে দিলো।
দাঁড় বাওয়ার জন্যে আরেকজন নাবিককে সঙ্গে করে রওনা হলো লোকটা। লংবোট নামিয়ে তাতে চেপে বসলো। কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেল জাহাজে। মাস্তুলে ওঠা আর লাগলো না তার। জাহাজের ডেক থেকেই দেখতে পেলো বিমানটাকে। চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। আঞ্চলিক ভাষায় চেঁচিয়ে জানালো কারনেসকে কি দেখতে পেয়েছে।
নৌকা নিয়ে আসার নির্দেশ দিলো কারনেস। ফিরে এলো লংবোট। তাড়াতাড়ি দলবল নিয়ে গিয়ে তাতে চাপলো কারনেস। জাহাজে গিয়ে উঠলো। দূরবীন দিয়ে ভাল করে দেখলো বিমানটাকে। পেছনের ক্যানুতে বসা লোকগুলোকেও দেখলো। প্রমাদ গুণলো সে। বুঝতে পারলো সামনাসামনি লড়াইয়ে পারবে না ওদের সঙ্গে। তাড়াতাড়ি জাহাজ ছাড়ার নির্দেশ দিলো সে।
লেগুনের মুখের কাছে যাওয়ার আগেই পৌঁছে গেল বিমানটা। নারকেল গাছ থেকে নামলো না কিশোর আর সাগরের হাসি। ওখানে বসে বসেই সমস্ত ঘটনা দেখতে লাগলো।
তার পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। গুলি করতে করতে জাহাজের দিকে এগিয়ে এলো বিমান। কারনেস এতই ভয় পেয়ে গেছে, গুলি চালানোর কথাও যেন ভুলে গেল। তার লোকেরা গিয়ে ঢুকেছে জাহাজের খোলে। আদিবাসীদের যুদ্ধের সাজই ঘাবড়ে দিয়েছে ওদেরকে। তাছাড়া জেনে গেছে অনেকগুলো আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বিমানে। শুধু কারনেসের একটা রাইফেল আর একটা পিস্তল দিয়ে ঠেকানো যাবে না ওদেরকে। তাছাড়া লোকবলও বেশি বিমানের। ফলে যা করার তাই করেছে ওরা। লুকিয়েছে গিয়ে।
জাহাজের কাছে চলে এলো বিমান। দড়ি খুলে ক্যানুটাকে নিয়ে গিয়ে জাহাজের গায়ে ভেড়ালো আদিবাসীরা। উঠে গেল জাহাজে।
মিনিট কয়েক পরেই দেখা গেল, ডেকে তুলে আনা হয়েছে কারনেসের গলাকাটা ডাকাতদের। হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো।
কিন্তু পালের গোদাটা গেল কোথায়? খুঁজছে কিশোরের চোখ। দেখতে পেলো। জাহাজের পাশের একটা দড়ি ধরে ঝুলে রয়েছে, পেছন দিকটায়। পানির একেবারে কাছাকাছি। তবে বেশিক্ষণ বাঁচতে পারলো না। আদিবাসীদের চোখে পড়ে গেল।
ধর! ধর! কলরব উঠলো। দড়ি থেকে হাত ছেড়ে দিলো কারনেস। পড়লো পানিতে। সাঁতরাতে শুরু করলো তীরের দিকে।
এই সময় পাখনাটা ভেসে উঠতে দেখলো কিশোর। লেগুনের পানি কেটে দ্রুত ছুটে চলেছে ত্রিকোণ পাখনাটা, পালের মতো উঁচু হয়ে আছে। হাঙর! ছুটে যাচ্ছে কারনেসের দিকে। যেন ওরই জন্যে অপেক্ষা করছিলো এতোক্ষণ ওটা। তাহলে কিশোররা যখন পানিতে নেমেছিলো তখন ছিল কোথায়? নিশ্চয় গুহার ভেতরে, ভাবলো কিশোর, এর আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
জাহাজে যারা রয়েছে তারাও দেখতে পেয়েছে। একসঙ্গে হৈ চৈ করে উঠলো ওরা। অনেক পরে দেখতে পেলো কারনেস! আতঙ্কে বিকট চিৎকার করে উঠলো। তাড়াতাড়ি হাত পা ছুড়ে তীরে পৌঁছার চেষ্টা করলো। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। তীর অনেক দূর।
তার কাছে চলে এসেছে হাঙরের পাখনা। ডুবে গেল। পরক্ষণেই ঝটকা দিয়ে নিচে ডুবে গেল কারনেসের মাথা। আবার ভাসলো। চিৎকার করে উঠলো। আবার ডুবলো। ভাসলো। চিৎকার। ডুবলো।
অপেক্ষা করে রয়েছে দর্শকেরা। কিন্তু আর ভাসতে দেখা গেল না তাকে।
উচিত সাজা হয়েছে! পাশের গাছ থেকে বললো সাগরের হাসি। কিশোর কিছু বলতে পারলো না। তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে। কারনেসের মত লোকেরও এই পরিণতি মেনে নিতে পারছে না সে। ভীষণ খারাপ লাগছে।
হৈ হৈ করে উঠল জাহাজে দাঁড়ানো আদিবাসীরা। চেঁচিয়ে বলছে, ঠিক হয়েছে। উচিত সাজা হয়েছে! শয়তানটাকে খেয়েছে ম্যাকো!
বন্দিদেরকে লংবোটে নামাতে শুরু করলো ওরা। ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো না কিশোর। সব কজনকে নামিয়ে নিজেরাও নেমে এলো ক্যানু আর লংবোটে। একজন বাদে। সে চলে গেল নিচে।
একটু পরেই বুঝতে পারলো, কেন জাহাজটা থেকে সবাইকে নামিয়ে আনা হয়েছে। শেষ লোকটাও বেরিয়ে এসে তাড়াহুড়া করে নৌকায় নামলো। সরে আসতে লাগলো দুটো নৌকাই। ক্যানু থেকে চেঁচিয়ে কিছু বললো ঝিনুক। বিমানটাও সরে আসতে লাগলো জাহাজের কাছ থেকে।
কারণটা বুঝতে পারলো এতক্ষণে কিশোর। ধোয়া দেখা গেল। জাহাজে। আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। গাছের মাথায় থেকেই চিৎকার করে বললো সে, ওমরভাই! জলদি! আগুন নেভাতে বলুন!
কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দের জন্যেই বোধহয়, লোকের হট্টগোলের জন্যেও হতে পারে, তার চিৎকার কানে গেল না কারও। আগুন নেভাতে গেল না কেউ।
পিছলে গাছ থেকে নামতে গিয়ে দুই উরু ছিলে গেল কিশোরের। কেয়ারই করলো না। গোড়ায় নেমেই দিলো, দৌড়। সৈকতের কিনারে পৌঁছতে পৌঁছতেই আগুন ছড়িয়ে পড়লো অনেকখানি। ডেকের নিচে বোঝাই করা নারকেলের ছোবড়ায় নিশ্চয় আগুন লাগানো হয়েছে।
কিনারে এলে ডজকে যখন বোঝাতে সমর্থ হলো কিশোর, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সমস্ত জাহাজে জড়িয়ে গেছে আগুন। ওটাতে এখন গিয়ে ঢোকা আর আত্মহত্যা করা সমান কথা।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে ডজ। তার চোখের সামনে পুড়লো জাহাজটা, ডুবে গেল, কিছুই করলো না সে। একেবারে চুপ। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে যেন। চেয়ে চেয়ে দেখলো তার অত সাধের মুক্তোগুলো নিয়ে তলিয়ে গেল জাহাজটা।
কিশোরের কানে বাজতে লাগল ডজের কথাঃ যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে গেল মুক্তো, রাখতে আর পারলাম না।
পাশে এসে দাঁড়ালো সাগরের হাসি। এইমাত্র গাছ থেকে নেমে এলো।
নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্যাম্পের কাছে নারকেল গাছের ছায়ায় বসে কিশোরকে জানালো ওমর আর মুসা, কেন আসতে দেরি হয়েছে ওদের।
কিশোর বলতে লাগলো, সে কি করে মরতে মরতে বেঁচেছে।
খাইছে! শুনতে শুনতে বলে উঠলো মুসা। সাগরের হাসি না থাকলে তো…
হ্যাঁ, না থাকলে এতক্ষণে হাওরের পেটে চলে যেতাম। একটা মুহূর্ত চুপ করে রইলো কিশোর। কিন্তু এত কিছু করেও লাভ হলো না। যার জন্যে এসেছিলাম তা আর নিয়ে যেতে পারব না। আগুনে পুড়ে নিশ্চয় চুণাপাথর হয়ে গেছে সব মুক্তো।
দুঃখ করে লাভ নেই, যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিলো ওমর। মুক্তো তোলার জন্যে দরকার হলে আবার আসা যাবে, টাকাপয়সা জোগাড় করে। তবে যে অ্যাডভেঞ্চারটা হল, তাতেই আমি খুশি। এই একটিবার অন্তত আমার টাকা খোয়ানোর জন্যে একলা ডজকে দায়ী করতে পারছি না। হাসলো সে। নিষ্প্রাণ দেখালো হাসিটা।
কিসের কথা বলছেন? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো সাগরের হাসি। একটু দূরে বসে ওদের কথা শুনছিলো।
মুক্তো। যেগুলো তুলেছিলাম, ওমর বললো। কিশোর বলছে, টিনটা পেয়ে গিয়েছিলো কারনেস। জাহাজে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলো। পুড়ে সব নষ্ট হয়েছে। আর পাওয়া যাবে না।
না, হয়নি, সাগরের হাসি বললো।
হয়নি! একসাথে বলে উঠলো ডজ, ওমর আর দুই গোয়েন্দা।
না, হয়নি। আমি নিয়ে এসেছি।
নিয়ে এসেছ! ডজ বললো।
কিভাবে? জানতে চাইলো ওমর।
জাহাজে উঠলাম, বললো সাগরের হাসি। পালের নিচে লুকিয়ে রইলাম। কারনেস দলবল নিয়ে দ্বীপে গেল। একটু পরে ওদের চিৎকার শুনলাম, মুক্তোর টিনটা পেয়ে গেছে। ওটা নিয়ে ফিরে এলো জাহাজে। ডেকের একটা জানালা দিয়ে দেখলাম টিনটা কোথায় রাখছে কারনেস। ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলে এক সুযোগে জানালা দিয়ে ঢুকে চট করে নিয়ে চলে এলাম ওটা।
কোথায় রেখেছ? উত্তেজনায় কাঁপছে ডজ।
লেগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি, শান্তকণ্ঠে বললো সাগরের হাসি।
চিৎকার করে উঠলো ডজ। শুনলে! কি বললো শুনলে! পানিতে ফেলে দিয়েছে। চুল খামচে ধরলো সে। এজন্যেই বুঝলে, এজন্যেই ফিরে এসেছিলো কারনেস। জাহাজ ছাড়লে কেবিনে গিয়ে টিনটা খুঁজে পায়নি। তার হয়তো সন্দেহ হয়েছে, দ্বীপে আরও কেউ আছে। যে টিনটা চুরি করেছে। সেটা নেয়ার জন্যেই ফিরেছিলো সে।
সবাই উঠে দাঁড়ালো। তাদের ভাবভঙ্গিতে অবাক হলো সাগরের হাসি। তাকাতে লাগলো একেক জনের মুখের দিকে। মুক্তো নিয়ে এরকম করে বিদেশী মানুষ, ব্যাপারটা খুব বিস্মিত করে তাকে।
হ্যাঁ, এই মুক্তোর জন্যেই ফিরে এসেছিলো কারনেস, বিড়বিড় করলো কিশোর।
আমারও তাই মনে হচ্ছে, সাগরের হাসিও একমত হলো।
তখন আমাকে বলনি কেন? বলার সময় পেলাম কোথায়? আর আর…
ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দাওনি, এই তো?
কোথায় ফেলেছ ওটা? জানতে চাইলো ডজ।
দ্বিধা করলো সাগরের হাসি। আসুন, দেখাচ্ছি।
আবার উত্তেজনা দেখা দিলো অভিযাত্রীদের মাঝে। আদিবাসীদের অনুরোধ করলো ডজ, ক্যানুটা দিতে। সেটাতে করে চলে এলো লেগুনের সেইখানটায় যেখানে নোঙর করে ছিলো হোয়াইট শার্ক। সবাই নিচে তাকাতে শুরু করলো। ওপর থেকেই দেখতে চায় লেগুনের তলায় কোথায় পড়ে আছে মুক্তোর টিনটা। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাগরের হাসি। ডুব দিলো।
হাঙরটা যদি আসে? কিশোরের প্রশ্ন।
এলে ওটার কপালে দুঃখ আছে। মেয়েটার জন্যে ভাবছো তো। ভেবো না।
দাঁড় বেয়ে ওদের সঙ্গে এসেছে ছয়জন আদিবাসী। তাদের মুখের দিকে তাকালো কিশোর। মনে পড়লো রাটুনায় অকটোপাস শিকারের কথা। বুঝতে পারলো, হাঙরটার কাপালে দুঃখ আছে কেন বলছে ডজ। সাগরের হাসির সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই ছুরি হাতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওরা।
ভেসে উঠলো মেয়েটা। ঝাড়া দিয়ে চুল থেকে পানি ফেললো। দেখেছি, বললো সে। মিনিট দুয়েক ক্যানুর ধার খামচে ধরে দম নিলো সে। তারপর লম্বা খাস টেনে গভীর পানিতে ফুসফুসটাকে বেশিক্ষণ ডুবে থাকার উপযুক্ত করে, আবার ডুব দিলো।
সবাই তাকিয়ে রয়েছে নিচের দিকে। টানটান উত্তেজনার মাঝে কাটতে লাগলো দীর্ঘ মুহূর্তগুলো। অবশেষে শেষ হল উত্তেজনা। ভাসলো আবার সাগরের হাসি। ডান হাতটা তুলে ধরলো। টিনটা বাড়িয়ে দিলো নৌকার দিকে।
প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে টিনটা নিয়ে নিলো ডজ। খুলে ফেললো ডালা। ঝকঝক করে উঠলো মুক্তোগুলো। আছে! সবই আছে! উত্তেজনায় খসখসে হয়ে গেছে তার কণ্ঠ।
পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তব লাগছে! ওমর বললো। এই অভিযানের পর কোন ঘটনাকেই আর অসম্ভব মনে হবে না আমার কাছে!
নৌকায় উঠলো সাগরের হাসি। হাঙরটা আসেনি। দেখাও যায়নি ওটাকে। হয়ত কারনেসকে দিয়ে ভূরিভোজের পর সাগরে বেরিয়ে গেছে। কিংবা আবার গিয়ে গুহায় ঢুকেছে ঘুমানোর জন্যে।
তীরে ফিরে এলো ক্যানু। টিনটা শক্ত করে ধরে রেখেছে ডজ। আর কোন ভাবেই এটাকে হাতছাড়া করতে চায় না।
আর থেকে কি হবে, ওমর বললো। রওনা হওয়া দরকার। রাতের আগেই ফিরে যেতে চাই রাটুনায়।
বিমানে এসে উঠলো অভিযাত্রীরা। সাগরের হাসি আর ঝিনুকও উঠলো ওদের সঙ্গে। দুটো নৌকাকে বাঁধা হলো এখন বিমানের লেজের সঙ্গে। এত বোঝা টেনে নিতে অসুবিধে তেমন হবে না ওটার, তবে গতি কমে যাবে। কমুক। ভাবলো ওমর। তার পরেও ঠিক সময়ে ফিরে যেতে পারবে রাটুনায়, যদি আর। ঝড়টড় না ওঠে। আকাশের দিকে তাকালো। ঘন নীল রঙ। মেঘের চিহ্নও নেই। সহসা আর হারিকেনের সম্ভাবনা নেই।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ওমর। চলতে শুরু করলো বিমান।
মিনিট পনের পরে উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকালো কিশোর। নারকেলের পাতা দুলতে দেখলো বাতাসে। ধীরে ধীরে দিগন্তে মিলিয়ে গেল ওগুলো। ততক্ষণ চেয়েই থাকলো সে। অদ্ভুত এক বিষন্নতায় ভরে গেছে মন। ভাবছে আর কোনদিন দেখতে পাবে না দ্বীপটা।
আবার আসব, বিড়বিড় করলো কিশোর। আবার ফিরে আসব এ দ্বীপে!
তার কথাটা শুনে ফেললো ডজ। হাসলো। হ্যাঁ, এইই হয়। আশ্চর্য এক আকর্ষণ এসব দ্বীপের। কাছে টানে। কিছুতেই যেন এর মায়া কাটাতে পারে না মানুষ। বার বার ফিরে আসতে চায়।
***