দক্ষিণের কামরা

দক্ষিণের কামরা

সত্যি? এ্যাঁ? সত্যি মরেছে? ওই ডাইনি বুড়ি হ্যারিয়েট? মরেছে তাহলে? আঃ!—

দুঃখ? তা একটু হয়তো হওয়া উচিত। রক্তের সম্বন্ধ ছিল যখন। আপন মাসি ছিল সম্পর্কে। লোকতঃ ধর্মতঃ—

কিন্তু না, উচিত-অনুচিত বুঝি না, হচ্ছে না দুঃখ। কিছুতেই না। মাসির কাজ মাসি কিছু করেনি। মাকে একবস্ত্রে তাড়িয়েছে বাড়ি থেকে, তিনটে বোনঝি— সোফিয়া, জেন, আমান্ডাকে আঙুল মটকে শাপশাপান্ত করেছে পথেঘাটে, ওর জন্যে দুঃখ? তা আর না-হলে চলে?

ঠাকুরদার ছেলে ছিল না, দু-টি মোটে মেয়ে, হ্যারিয়েট আর জুলিয়েট। মাকে জপিয়ে জপিয়ে হ্যারিয়েট ছোটো বোনটাকে ফাঁকি দিল বিষয় থেকে। বাড়িটা লিখিয়ে নিল নিজের নামে। তারপর তাড়িয়ে দিল একদম।

জুলিয়েট অবশ্য আশ্রয় পেল। এক গরিব ভদ্রলোক ওই গাঁয়েরই, বিয়ে করলেন তাকে। তাও তিনি আবার মারা গেলেন কয়েক বছরের মধ্যেই। জুলিয়েটের তখন তিন মেয়ে— সোফিয়া, জেন, আমান্ডা। দিন কতক যেতে না-যেতেই জুলিয়েটও রওনা হয়ে গেল স্বামীর পিছু পিছু। তারপর বছরের পর বছর কাটে, কিন্তু হ্যারিয়েট রয়েছে বেঁচে। প্রকাণ্ড বাড়িটার দক্ষিণের কামরায় সে থাকে। জানলা খুললেই ছোটো মাঠখানার ওপারে বোনের কুঁড়ে দেখতে পায়, আর সেই কুঁড়ের দিকে তাকিয়ে আঙুল মটকে মটকে শাপশাপান্ত করে। বোনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিল, সে আজ পঞ্চাশ বছরের কথা। তারপর বোন মরেছে, সেও হল ত্রিশ বছরে মতো। তবুও রাগ পড়েনি হ্যারিয়েটের। জুলি নেই, কিন্তু তার নাকি মেয়ে আছে তিনটে। পথেঘাটে কখনো-সখনো হয়তো তাদের দেখেওছে হ্যারিয়েট, কথা বলেনি, ফিরে তাকায়নি, কিন্তু গালিগালাজে কসুর করেনি তবু।

পারলে মেয়েগুলোকে চিবিয়ে খেত বুড়ি, খেতে পারেনি, হয়তো দাঁত ছিল না বলেই। কম সে-কম আশি বছর তো হয়েছিলই ওর! ‘তাতে আর হয়েছে কী?’— বলেছিল মেজো বোন জেন একদিন, ‘আশি তো সামান্য, এক-শো আশিও বাঁচতে পারে।’

কিন্তু তা বাঁচেনি। মরেছে। আজই সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনল সোফিয়া আর আমান্ডা আর ফ্লোরা।

হ্যাঁ মেজো বোন জেনই শুধু বিয়ে করেছিল, এই তিন বোনের মধ্যে। তা, কচি মেয়ে ফ্লোরাকে রেখে সে মরে গেল দুই বছরের ভিতর, মেয়েটা পড়ল সোফিয়াদের ঘাড়ে। ওর বাপ আবার বিয়ে করে বসেছে কিনা!

সে যাহোক, মরেছে তাহলে। উইল? না, ওসব কিছু নেই। কাকে চিনত বুড়ি যে, উইল করে বাড়ি দিয়ে যাবে তাকে? তা ছাড়া, উইল করে যে কাউকে কিছু দিয়ে দেওয়া যায়, সেটা বোধ হয় জানাও ছিল না ওর। জানলে, সোফিয়াদের ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা সে কি করত না?

বাড়িটা পেয়েছে সোফিয়ারা। নিজেদের বাড়ি বেচে দিয়ে ওরা উঠে এসেছে এ বাড়িতে। গাঁয়ের কেউ কেউ নিষেধ করেছিল, ‘অত বড়ো বাড়ি কোন কাজে আসবে তোমাদের? বরং বেচে দিয়ে টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখো।’

সোফিয়া শক্ত মানুষ। কানে তোলেনি সেকথা। ঠাকুরদার বাড়ি, বেচবো কেন? টাকা? ওই বাড়ি থেকেই দেদার টাকা রোজগার হবে, দেখ না তাকিয়ে!

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই সংসার চালিয়ে আসছে একা সোফিয়া। গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি জুটিয়ে নিয়েছিল একটা, তার উপরে লেস বোনা, উলের জামা বোনা— এসব থেকেও আয় ছিল কিছু। বোনার ব্যাপারে আমান্ডাও অবশ্য সাহায্য করত।

এইবার সব ছাড়ল ওরা। সোফিয়া ছাড়ল মাস্টারি, আমান্ডা সেলাইফোঁড়। দুই জনে মিলে বোর্ডিং খুলে দিল মস্ত বাড়িটায়। উপর তলায় চারখানা ঘর, সবই ছেড়ে দিল অতিথিদের জন্য। নীচের তলায় সামনের ঘরখানাই হল খাওয়ার ঘরতার পাশে দুই বোন আর এক বোনঝির একটি শোবার ঘর, তারপরে ভাঁড়ার, তারপরে রান্নাঘর। সুন্দর বন্দোবস্ত। মবলগ আয় মাস গেলে নিশ্চয়ই হবে এ থেকে।

অতিথিদের জন্য ঘর চারখানা। তিনখানা গোড়া থেকেই ভাড়া হয়ে গেল। স্থানীয় লোকেরাই এসেছেন বোর্ডার হয়ে। একজন হলেন সহকারী পাদরি এখানকারই গির্জার, একজন মহিলা লাইব্রেরিয়ান, তৃতীয়টি এক ধনী বিধবা মিসেস এলভিরা সিমনস, শহরবাসে আনন্দ না-পেয়ে পল্লীজীবনের বৈচিত্র্য আস্বাদন করতে এসেছেন। তিনজনে যা দিচ্ছেন, তাতেই বোর্ডিংয়ের খরচা সব উঠে যাচ্ছে। এখনও দক্ষিণের কামরাটা খালি রয়েছে, ওইখানে কেউ এলেই, ব্যাস তাঁর কাছে যা প্রাপ্তি হবে, সেটাই পড়বে লাভের খাতে।

ঘরের উমেদার এই গাঁয়েই ছিল আরও দুই-একজন। কিন্তু গেরো দেখ! ওই দক্ষিণের কামরাতে থাকতে হবে শুনেই পায়ে পায়ে তারা পিট্টান দিয়েছে সবাই। কারণটা বোঝা যায়! এই সবে সেদিন ডাইনিবুড়িটা ওইঘরেই মারা গিয়েছে কিনা! যা নাম যশ ছিল বুড়ির। জ্যান্তে যার নাম ছিল ডাইনি, মরে সে যে পেতনি হয়নি, একথা চট করে গেঁয়ো লোকে বিশ্বাস করবে কেমন করে? না, এত দিন ভাড়াটে জোটেনি দক্ষিণের কামরার, তবে এইবার বুঝি জুটল।

দুপরের পরেই। ময়দা ঠাসতে ঠাসতে সোফিয়া বলছে আমান্ডাকে, ‘অ্যাক্টন থেকে সেই মাস্টারনি আসছেন রে! আজই!’

‘কোন ঘরে দিচ্ছ তাকে? দক্ষিণের ঘরটা না কি?’— আমান্ডার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ভয় আর সংশয়।

‘তা ছাড়া আর ঘর আমাদের খালি আছে কোথায় শুনি?’— সোফিয়ার কথায় ঝাঁজ রীতিমতো।

‘না, তাই বলছিলাম—’ ঢোঁক গেলে আমান্ডা।

‘বলাবলি ঢের হয়েছে, আর নয়’— রীতিমতো বিরক্তির সুরে সোফিয়া বলে, ‘বলি, ঘরখানার দোষটা কী, কেউ দেখিয়ে দিতে পারে? ব্যাপার তো এই যে, হ্যারিয়েট মাসি মারা গিয়েছিল ওই ঘরে! আচ্ছা, কেউ বুঝিয়ে দিক আমায়, ওই ঘরে ছাড়া আমার সে মরবে কোথায়? সারাজীবন বাস করে গেল ওই ঘরে, মরবার সময় যাবে কি রাস্তায়? মানুষের যদি আক্কেল কিছু থাকে—’

আমান্ডা কথা কইছে না। কিন্তু সোফিয়ার গজগজি সমানে চলছে, ‘অত যাদের খুঁৎমুতি, তারা যাক-না, আনকোরা নতুন বাড়ি বানিয়ে নিক-না গিয়ে! পুরোনো ঘরে যদি মাথা গুঁজতে হয়, তাহলে কোনো বায়নাক্কা না-থাকাই ভালো। এমন পুরোনো ঘর দুনিয়ায় আছে না কি কোথাও, যাতে কোনো-না-কোনোদিন কেউ-না-কেউ মরেনি?’

আমান্ডা একতরফা শুনে যাওয়ার ভূমিকা নিয়ে কাঁহাতক আর দাঁড়িয়ে থাকে। সে ছোট্ট করে টিপ্পনি কাটল একটু, ‘এ তো খুবই খাঁটি কথা!’

সোফিয়া মুখ তুলে চাইল তার দিকে, ‘খাঁটি কথা যখন, যাও তো লক্ষ্মী বোন, ঘরখানা খোলো গিয়ে। একটু রোদ বাতাস ঢুকতে দাও। ধুলোটুলো নিয্যস জমেছে, যদিও সেদিনই সব সাফসুতরো করে এলাম। যাও, মাস্টারনি তো একটু বাদেই এসে যাবে—’

আমান্ডা এখন দিদিকে কেমন করে বলে যে, একা যেতে তার ভয় করবে ও ঘরে? এই ভর দিনের বেলায়? দিদি তাহলে তাকে আস্ত রাখবে? নিজে সোফিয়া শক্ত মানুষ, কোনো মানুষকে কোনোদিন ডরায়নি, এটা আমান্ডার চোখে দেখা। আর ভূতকেও দিদি ডরায় না, এটা কানে শোনা আমান্ডার। শোনা অবশ্য সোফিয়ারই মুখ থেকে।

পায়ে পায়ে সেই দক্ষিণের কামরার দিকেই চলেছে আমান্ডা। উঠছে সিঁড়ি বেয়ে। পেরিয়ে যাচ্ছে বারান্দা। কিন্তু যতই যাচ্ছে, বুকের মধ্যেটা ঢিপঢিপ করছে তত জোরে জোরে, ততই ঘন ঘন। অবশেষে সেই অলক্ষুণে ঘরখানার দোরগোড়ায় এসে সে একটু না-জিরিয়ে পারল না আর। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রোদে ঝলমল রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। আলোই বল, আলোই সাহস। ঘরে ঢুকলেই আঁধারের আওতায় গিয়ে পড়তে হবে। অবশ্য মিনিটখানিকের জন্যই, যতক্ষণ না জানালাগুলো খুলে দেওয়া যায়। কিন্তু বরাত মন্দ হলে এক মিনিটেই কী না হতে পারে?

অবশেষে ঝড়াক করে একসময় দরজা খুলেই ফেলল আমান্ডা, আর তিলার্ধ দেরি না-করে একরকম দৌড়ে গিয়েই উলটো দিকের জানালা দুটো খট খট করে খুলে দিল চটপট। যাক, পহেলা ফাঁড়া কেটেছে। ঝলকে ঝলকে সোনা রোদ্দুর এসে আছড়ে পড়েছে ঘরের ভিতর, সমুদ্রবেলার জোয়ারের জলের মতো। ঘরের কোনো কোণ আর অস্পষ্ট নেই। ভয় আর কোথা থেকে বেরুবে হামাগুড়ি দিয়ে?

মস্তবড়ো খাট। ছত্রি বলো, পায়া বলো— সবেতেই ছিট কাপড়ের ঢাকনা। তাতে সবুজ জমিনের উপর নীল ময়ূরের ঝাঁক ছাপানো, বিছানার উপরে সাদা একটা আস্তরণ। আস্তরণটা তুলে নিয়ে বিছানাটি সুন্দর করে ঝাড়ল আমান্ডা, বালিশগুলো নেড়েচেড়ে আবার ঠিক করে সাজাল। তারপরে চাদরখানা আবার পাততে লাগল সবকিছু ঢেকে দেবার জন্য। হঠাৎ এ কীরকম হল?

খাটের কাঠামোতে নীল ময়ূরওলা সবুজ ছিট ছিল যে!

এ তাহলে কি দেখছে আমান্ডা? ছিটগুলো যে হলদে জমিনে লাল গোলাপের! ইয়া বড়ো বড়ো লাল গোলাপ। কেমনধারা হল এটা? দুই হাতে চোখ কচলে আবার তাকাল আমান্ডা। চোখ পিটপিট করে একবার, চোখ ছানাবড়ার মতো বিস্তারিত করে আর একবার, বার বার তাকাল আমান্ডা। নাঃ, হলদে জমিনের উপরে লাল গোলাপের বাহার তেমনই জ্বলজ্বল করছে খাটের গায়ে মাথায় সর্বত্র।

আমান্ডা অগত্যা ভেবে নিল, সবুজ নীলের ছিটগুলো সোফিয়া কোনো সময় হয়তো বদলে দিয়েছে এ ঘর থেকে। ঘরে ঢুকেই প্রথমটা যদি তার মনে হয়ে থাকে যে, আগের সেই সবুজ নীল ছিটই রয়েছে আগের মতো, তাহলে কী আর বলা যাবে, নিশ্চয়ই সেটা তার মনের ভুল। আগের সংস্কারই ভুল দেখিয়েছে তাকে।

চুলোয় যাক। তার কাজ ঝাড়পোঁছ করা, সেইটে করে চটপট বেরিয়ে পড়তে পারলেই ঝামেলা চুকল এখনকার মতো। মেহগনির বিউরো একটা, তার দেরাজে দেরাজে প্রসাধনের জিনিস রাখবে মাস্টারনি। বিউরোর মাথায় দোল-খাওয়া আয়না। মানানসই রকমের লম্বা মানুষ ওখানে দাঁড়ালে ঠিক তার মুখখানাই ফুটে উঠবে সেই আয়নায়। সবকিছুর উপর দিয়ে চটপট ঝাড়ন বুলিয়ে নিল আমান্ডা। চেয়ারে, টেবিলে— হ্যাঁ, ধুলো কিছু হয়েছে বই কী, তবে বেশি না। ঝাড়নের এক এক বাড়িতেই সব সাফ।

খাটের তলাটায় ঝাঁটা মারতে হবে একবার। থাকুক, আগে পাশের খোপটায় উঁকি মেরে আসা যাক একবার। হ্যাঁ, এঘরের বৈশিষ্ট্য হল ওই খোপটুকু। পাশের দরজা দিয়ে ওখানে যাওয়া যায়, মুখ-হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে, জল বেসিন তোয়ালে সবকিছু। তা ছাড়া দেয়ালে আছে সারি সারি হুক। হ্যারিয়েট মাসি ওতে টাঙিয়ে রাখত তার পোশাকগুলো। এ বাড়িতে প্রথম এসেই মাসির এক ডজনখানিক নানা রকমের পোশাক ওরা ওখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ছাদে, চিলের কোঠাতে একটা তোরঙ্গে তুলে রেখেছে সে সব।

ও ঘরে করবার কিছু নেই তেমন, এবারটি চোখ বুলিয়ে নেওয়া শুধু। পাশের দরজাটা খুলে ফেলল আমান্ডা। বড়ো ঘরের তুলনায় এটা অন্ধকার। হবেই তো অন্ধকার, কারণ জানালা নেই এ-খুপরিতে, যা-কিছু আলো আসে বড়ো ঘর থেকে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে গলাটা বাড়িয়ে দিল আমান্ডা, ভিতরটা দেখে নেবার জন্য।

কিছু দেখতে পাওয়ার আগেই একটা গন্ধ এল তার নাকে। ধঞ্চে শাকের গন্ধ। হ্যারিয়েট মাসির বিদঘুটে অভ্যাস ছিল, পাঁচ-দশ মিনিট বাদে বাদেই দুই-চার গাছা ধঞ্চে শাক টপ করে মুখে ফেলে দেওয়া আর আয়েশ করে চিবোনো। ওর এক ডজন জামা যখন আমান্ডারা এখান থেকে চিলের ঘরে নিয়ে যায়, তখন শুকনো ধঞ্চে শাক প্রায় প্রত্যেকটা জামার পকেট থেকে বার করে ফেলতে হয়েছিল।

জামাগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে কবে, ধঞ্চে এখনও এখানে রইল কী করে? অবাক হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়েছে আমান্ডা, লুকোনো ধঞ্চে আবিষ্কারের আশায়, হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা লেগে ঝোলানো জামা যেমন করে একদিক থেকে আর একদিকে উড়ে আসে, তেমনই করে, যদিও হাওয়া-টাওয়া এখানে নেই। থাকতে পারেই না জানালা না-থাকার দরুন, তেমনই করে দেওয়ালের দিক থেকে হঠাৎ একটা জামা উড়ে এসে পড়ল ঠিক আমান্ডার মুখে।

মানে? এর মানে কী? সব জামা তো ওরা কবে নিয়ে গিয়েছে এখান থেকে। একটা জামা রয়ে গেল কেমন করে? আমান্ডা দেখেছিল, হুক থেকে সব জামা, হলদে, নীল, গোলাপি, লাল, সাদায়-কালোয় মেশানো, কালোয়-লালে মেশানো, লালে-সবুজে মেশানো, কোনোটা পশমি, কোনোটা রেশমি, কোনোটা সুতি, হরেক রকমের এক ডজন জামা গাদা করে নিয়ে যাওয়া হল উপরে, ভাঁজ করা হল, বাক্সে বন্ধ করা হল, তারপর দরজায় তালা বন্ধ হল চিলের ঘরের—

অথচ আজ দেখা যাচ্ছে, হলদে-সবুজ গাউনটা পড়ে রয়েছে এই ঘরেই!

কানা! কানা! বিলকুল কানা তারা সবাই! সোফিয়া, আমান্ডা, ফ্লোরা, ঠিকে-ঝি মার্থা সবাই ছুঁচোর মতো কানা! প্যাঁচার মতো কানা! রয়ে গেল হলদে-সবুজ গাউনটা?

অতিমাত্র বিরক্ত হয়ে গাউনটা এক ঝটকায় হুক থেকে ছাড়িয়ে নিল আমান্ডা। নতুন বাসিন্দা ওই অ্যাক্টনের মাস্টারনি এসে এটা এখানে দেখলে কী মনে করত বলো দেখি! ভাগ্যিস সোফিয়া তাকে পাঠিয়েছিল একবার ঘরটা দেখে আসবার জন্য!

গাউনটা ইজিচেয়ারে ফেলে রেখে এইবারে খাটের তলাটায় পালকের ঝাড়ু বুলোতে লাগল আমান্ডা। দুই মিনিটে কাজ শেষ। এইবার সে ফিরে যেতে পারে এখান থেকে। তবে সোফিয়ার কাছে যাওয়ার আগে একবার ছাদে উঠতে হবে আবার, ওই হলদে-সবুজ গাউনটা—

কিন্তু গাউনটা কই? ইজিচেয়ারের উপরে নেই তো!

মানে? এইমাত্র, আমান্ডাকে যে দিব্যি গালতে বলো, সেই দিব্যি গেলে সে বলতে পারে এইমাত্র সেই গাউন ইজিচেয়ারে রেখে সে খাটের তলায় ঢুকেছিল। আর খাটের তলা থেকে বেরিয়েই সে দেখছে, গাউন নেই ইজিচেয়ারে?

নাঃ, মাথা! মাথাই খারাপ হয়েছে আমান্ডার! নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। তা ছাড়া আর কোনোরকম কারণ বাতলানো যায় না এ-ব্যাপারের। করব বলে মনে-করা এককথা, আর হাতে-কলমে করে ফেলা অন্য কথা। এই দুটোতে গুলিয়ে ফেলছে আমান্ডা। গাউনটা ইজিচেয়ারে এনে রাখার কথা ভেবেছিল ও— আনাও হয়নি, রাখাও হয়নি। ওটা নিশ্চয় এখনও ওই খোপে হুকেই ঝুলছে।

পাশের দরজা আবারও খুলল আমান্ডা। কই? গাউন কই?

আধো-আঁধার খুপরির কোণে কোণে দুই চোখ বিস্তারিত করে করে দেখতে লাগল আমান্ডা, না! নেই সে হলদে-সবুজ অপয়া গাউন, কোথাও তা নেই।

হঠাৎ গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল আমান্ডার, সে ছুটে বেরিয়ে এল দক্ষিণের কামরা থেকে। সব দোর হাঁ-করা পড়ে রইল, সে ছুটে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে।

সোফিয়ার খন্তি নড়ছে কড়াতে, ঘন ঘন শব্দ পাওয়া যায় এখান থেকেই। রান্নাঘরে কেক তৈরিতে ব্যস্ত সে। একটা কথা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল আমান্ডার। একটা কথা, একটা আশ্বাস। হয়তো, আমান্ডা যখন খাটের তলায় ব্যস্ত ছিল, হয়তো ঠিক তখনই সোফিয়া উপরে উঠেছিল একবারটি, আর ইজিচেয়ারের উপরে গাউন পড়ে থাকতে দেখে সেটা হাতে করেই তক্ষুনি নেমে এসেছে আবার। আমান্ডার পিঠ ছিল দরজার দিকে, সে দিদিকে দেখতে পায়নি।

কথাটা মনে হতেই অনেকখানি আশ্বস্ত হয়েছিল আমান্ডা। নেমে আসছিল এই সংকল্প নিয়ে যে, রান্নাঘরে ঢুকেই সে জিজ্ঞাসা করবে যে দিদি গাউনটা এনেছে কিনা! কিন্তু এখন—

যে লোক কেক বানাতে ব্যস্ত, সে কি কেক ছেড়ে উপরে উঠতে পারে? দুই মিনিট না-নাড়লে সে কেক পুড়ে যাবে না? সোফিয়া কক্ষনো যায়নি উপরে। ওকথা তাকে জিজ্ঞেস করলেই তুমুল বকুনি খেতে হবে।

কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবা, সে আর কতক্ষণ করা যাবে? দিদি হাঁকডাক শুরু করবে এক্ষুনি। শতেক কাজ পড়ে আছে। তার উপরে মাস্টারনির বাসও তো আসবার সময় হল। সে এলেই তাকে নিয়ে পড়তে হবে। অভ্যর্থনা করা, গোছগাছ করে দেওয়া, স্থিতু হবার সাহায্য করা, তার উপরে তেমন মিশুক লোক যদি হয়, অন্তরঙ্গ কথাও দুই-চারটে বলা— সবই বাড়িওয়ালির কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সোফিয়া রাঁধে চমৎকার, কাজেই রান্নাঘরেই তার সময় কাটে বেশি,বাড়তি কাজ, বাইরের কাজ পড়ে আমান্ডার ভাগে। ফ্লোরা, তা সে তো ছেলেমানুষ, দোকানে-টোকানে যায়, এই আর কী!

ওই আসে, ওই আসে করতে করতেই বাস এসে গেল। বাড়ির সামনেই দাঁড়ায় সব বাস। এদিক থেকে আমান্ডা,ওদিক থেকে সোফিয়া ছুটে বেরুল। কেকের কড়া উনুন থেকে নামিয়ে রেখেও আসতে হল সোফিয়াকে। কারণ খদ্দের প্রভুর সমান। মাস্টারনি নিজেকে উপেক্ষিত মনে না-করে।

বাস থেকে নামলেন এক দশাসই চেহারার পালোয়ান মহিলা। বৃহৎ তোরঙ্গটা নিজেই অক্লেশে তুলে বাড়ির সিঁড়িতে রাখলেন। করমর্দন করলেন সোফিয়ার, আমান্ডার, চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে এনেই বললেন, ‘সুন্দর জায়গা তো! গরমের ছুটির তিন মাস এখানে বেশ কাটিয়ে দিতে পারব। মনে হচ্ছে, হ্যাঁ, আমার নাম লুইজা স্টার্ক, চিঠিতেই নাম দেখেছেন অবশ্য।’

আমান্ডা তাঁকে তাঁর ঘরে নিয়ে চলল। সোফিয়া ফিরে গেল তার কেকের তদারকিতে। মহিলাটিকে মিশুক বলা যায় না বোধ হয়, তবে দরকারি কথাগুলো সশব্দে উচ্চারণ করতে তাঁর আপত্তি নেই। সে সব কথার জোরই আলাদা, যেন মাস্টারনি কথা কইছেন ছাত্রীদের সামনে, আর্ধেক আদেশ, আর্ধেক উপদেশ।

‘তা ঘর ভালোই, বড়ো বড়ো জানালা, রোদ্দুর বাতাস, আকাশে মেঘের খেলা, গাছে পাখির গান, বাঃ, বেশ!— এমনই একখানা ঘরই চেয়েছিলাম। বেশ থাকা যাবে—’

বলতে বলতে পাশের খুপরির দরজা খুলে ফেললেন মিস লুইজা স্টার্ক, আর সঙ্গেসঙ্গে পিছিয়ে এলেন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, ‘এ কীরকম কাণ্ড মিস আমান্ডা? আমান্ডা গিল বলেছিলেন, না? এ কীরকম কাণ্ড? আগের ভাড়াটের জামা এখনও ঝুলছে? নতুন লোক আসছে তা জেনেও আগের—’

আমান্ডা ওদিকে আড়ষ্ট। খোপের ভিতর হুকে ঝুলছে সেই হলদে-সবুজ গাউন! যা তখন অন্তর্হিত হয়েছিল ইজিচেয়ারের উপর থেকে, স্বর্গ-মর্ত্য আলোড়ন করেও আর খুঁজে বার করতে পারেনি আমান্ডা।

মিস স্টার্ক তখনও বকে যাচ্ছেন, ‘কী গন্ধ, ছিঃ ছিঃ, ধঞ্চে শাকের গন্ধ মনে হচ্ছে? ধঞ্চে শাকের গুদোম ছিল না কি খুপরিটা? আপনারা বুঝি বোর্ডারদের খুব ধঞ্চের চাটনি খাওয়ান? আমার ওটা একেবারেই চলবে না, মনে রাখবেন।’

খুপরির দিকে আর না-গিয়ে লুইজা স্টার্ক পোর্টম্যান্টো খুলতে লেগে গেলেন। জিনিসপত্র বার করে গুছিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে। আমান্ডা একটানে হলদে-সবুজ পোশাকটা হুক থেকে নামিয়ে এনে শক্ত মুঠিতে ধরল সেটাকে, আর সেই অবস্থাতেই সেটা নিয়ে ছুটল চিলের ঘরে, একেবারে তোরঙ্গে ওকে তালা বন্ধ করে রেখে আসবে সে।

মিস স্টার্ক জামাকাপড় বার করছেন, সেগুলি টাঙিয়ে দিয়েছেন খুপরির ভিতর হুকে হুকে। প্রসাধন সামগ্রীগুলি বার করে গুছিয়ে রেখেছেন বিউরোর দেরাজে দেরাজে। তারপর শুরু করেছেন নিজের সাজসজ্জা। ডিনার ছয়টায়। পাঁচটা বেজে গিয়েছে। দোলন দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি একখণ্ড লকেট আটকাচ্ছেন বুকে।

লকেটখানি খুব প্রিয় লুইজার। একখানা দামি ওনিক্স পাথর, তার উপর থেকে নীচে লম্ববান সারি সারি নানা রঙের উজ্জ্বল রেখা। বরাবরই ডিনারে বসা বা বাইরে বেরুবার সময় এই লকেট তিনি পরেন। আজও পরেছেন।

সাজপোশাক সেরে নিজের চেহারাটাকে কে একবার ভালো করে না-দেখে? লুইজাও দেখছেন। হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন, এ কী? এ লকেট কী তাঁর সেই লকেট? ও ওনিক্স হবে কেন? এ তো একটা চ্যাপ্টা সোনার ঢেলা। নানা রঙের উজ্জ্বল রেখার জায়গায় এতে রয়েছে কিছু কাঁচা-কিছু পাকা কয়েক গাছি চুলের একটা বিনুনি। এ কেমন ধারা হল?

তাড়াতাড়ি লকেট খুলে হাতে নিলেন ভালো করে দেখবার জন্য। এ আবার কী? হাতে নেওয়ামাত্রই সোনার ঢেলা আবার ওনিক্স হয়ে গেল যে!

আঃ, তাই বলো! ভুল দেখেছেন লুইজা। চোখ বোধ হয় খারাপ হয়ে আসছে একটু একটু। হতেও পারে। বয়স হল তো!

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ওনিক্স আবার গলায় পরলেন লুইজা। ব্যাস! ওনিক্স আবার সোনার ঢেলা! মাথা গরম হয়ে উঠল ভদ্রমহিলার। তারপর তিনি একবার খুলছেন, একবার পরছেন লকেট। খুললেই ওনিক্স, পরলেই সোনা। অবশেষে তিতিবিরক্ত হয়ে তিনি সেটা পরেই ফেললেন চূড়ান্তভাবে। সোনা তো সোনাই! সোনা কিছু নিন্দের নয়।

ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি চলে গেলেন ডিনারের ঘরে। মনে কিন্তু তাঁর ঘোর সন্দেহ জেগেছে একটা। সন্দেহটা এই যে, মাথাই তাঁর খারাপ হতে বসেছে, চোখ নয়। আশ্চর্য হবার কিছু নয়। চল্লিশ বছর মাস্টারি করার পরেও মাথা খারাপ হবে না একটুও। এও কি একটা কথার মতো কথা নাকি? বিশেষত, তাঁর মায়ের কোনো এক মাসি নাকি ছিল আধপাগলি।

ডিনারে অন্য অতিথিরাও আছেন। আলাপ পরিচয় হল। আগের থেকে যাঁরা আছেন, তাঁরা মিস স্টার্কের ঘরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যেমন আলো-হাওয়া, তেমনই শৌখিন আসবাব, খাটের ছিটকাপড়ের ঢাকনাগুলিই বা কী তোফা! হলুদ জামিনের উপরে লাল গোলাপগুলি সত্যি দাঁড়িয়ে দেখবার মতোই।

গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন লুইজা স্টার্ক, ‘হলুদ জমিনে লাল গোলাপ? সে-ঢাকনা তাহলে এঁরা তুলে নিয়েছেন। আমি তো দেখলাম, সবুজ জমিনে নীল ময়ূরের সারি।’

আমান্ডা উপস্থিত ছিল পরিবেশনের জন্য। তার বুকের ভিতর ধক করে উঠল এ কথা শুনে। শেষ যখন ওঘর থেকে এসেছে সে, ছিট কাপড়টা ছিল হলদে জমিনে লাল গোলাপ। ইতিমধ্যে তা আবার রং পালটে ফেলেছে নিজের?

তা ফেলুক। আমান্ডা কোনো কথা কইল না। ফাঁক পেতেই সরে পড়ল টেবিলের কাছ থেকে।

খাওয়া শেষ হতেই লুইজা উঠে পড়লেন, ‘বাসখানাতে ধকল গিয়েছে খুব দেহের উপর দিয়ে। সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ব ভাবছি।’

নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বার জন্য তৈরি হচ্ছেন লুইজা। গলার লকেট নিয়ে আবার সেই ম্যাজিক তখনকার মতো। গলায় থাকলে সোনা, খুলে হাতে নিলেই ওনিক্স। রেগেমেগে লকেটখানা দেরাজে পুরে ফেললেন লুইজা। মাথা খারাপ হচ্ছে, আর কিছু নয়। রাতটা যদি ঘুম হয়, এ ভাবটা কেটে যেতেও পারে। না-যদি হয়, ভেবে ঠিক করা যাবে যে, কাল কী করণীয়।

পোশাক-আশাক খুলে ফেললেন লুইজা। এগুলো এখন টাঙিয়ে দিতে হবে পাশের খুপরিতে। রাত্রিবাসটা সেখানেই ঝুলছে অন্যসব পরিচ্ছদের সঙ্গে, পেড়ে এনে পরতে হবে সেটা। তাহলেই প্রস্তুতি শেষ, শয্যার অঙ্গ ঢেলে দিয়ে নিদ্রার সাধনা।

খুপরির দরজা খুলতেই চক্ষুস্থির!

এসব কার পোশাক? সারি সারি ঝুলছে হুকে হুকে? এর একটাও তো লুইজার নয়! কার পোশাক এনে কে রাখল ঝুলিয়ে এখানে? আর লুইজার পোশাকগুলোই বা তারা নিয়ে গেল কোথায়? এ ওই বাড়িওয়ালীদেরই কাজ, তাতে সন্দেহ কী? ওরা ছাড়া কে করবে? ভয়ানক লোক তো ওরা!

রাগে রি রি করছে লুইজার মাথা থেকে পা পর্যন্ত। যে পোশাক ছেড়েছিলেন, তাই আবার পরে ফেললেন, তারপর গটগট করে নেমে গেলেন। রান্নাঘরে একা সোফিয়া তখন বাসনপত্র গুছিয়ে রাখছে। আজকের মতো কাজ তার শেষ।

লুইজা ফেটে পড়লেন ঘরে ঢুকেই। ‘এ কী ব্যাপার? পোশাক রাখবার জায়গায় আমার নিজের পোশাক একটাও নেই, তাদের জায়গায় ঝুলছে সারি সারি অন্য লোকের জিনিস? এ কীরকম রীতি-চরিত্র আপনাদের?’

সোফিয়া প্রায় এক মিনিট স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লুইজা স্টার্কের দিকে। তারপর বলল, ‘চলুন, আমি উপরে গিয়ে দেখছি ব্যাপারখানা কী।’

খুপরি খোলার পরে দেখা গেল, লুইজা স্টার্কেরই পোশাক ঝুলছে প্রতি হুক থেকে। অন্য কারও কোনো পোশাকের নামগন্ধও নেই সেখানে।

সোফিয়া তাকিয়েও দেখল না লুইজার দিকে, ‘কোনো গোলমাল হয়েছে বলে তো মনে হয় না! শুভরাত্রি।’— এই বলে সে ধীরে ধীরে নেমে গেল।

লুইজা মরমে মরে গেলেন তো বটেই, ভয় পেয়ে গেলেন নিদারুণ। নিজের জন্য ভয়। মাথা যে দস্তুরমতো খারাপ হয়েছে, তাতে সন্দেহ নাস্তি। এখন একটা জিনিসই করার আছে। ছুটি উপভোগ মাথায় থাকুক, এক্ষুনি শহরে ফিরে যাওয়া দরকার, ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে আর একদিনও দেরি করা ঠিক হবে না।

রাত্রি তাঁর কীভাবে কাটল তিনিই জানেন, সকালে আর নামলেন না। আমান্ডা তাঁর প্রাতরাশ ঘরেই পৌঁছে দিল যখন, তাকে বললেন, ‘খুবই দুঃখিত। মাথার অসুখ আমার আগে থেকেই আছে, কাল রাত্রে সেটা হঠাৎই বেড়ে গেল। আমার আর থাকা হচ্ছে না এখানে।’

আমান্ডা নীরব জিজ্ঞাসায় তাকাল অতিথির পানে, কিন্তু লুইজা স্টার্ক মুখে কলুপ এঁটে দিয়েছেন ওই কথার পরেই। আমান্ডার নির্বাক কৌতূহল মেটাবার দিকে কোনো আগ্রহই তাঁর দেখা গেল না।

দুপুরেই লুইজা স্টার্ক পোর্টম্যান্টো নিয়ে দোরগোড়ায় দাঁড়ালেন, বাস কখন আসে, তারই প্রতীক্ষায়। মিসেস এলভিরা সিমনস কোথা থেকে ফিরলেন যেন ঠিক তখনই। দেখা হতেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল? চলে যাচ্ছেন হঠাৎ?’

‘একটা পুরোনো অসুখ ছিল, বংশানুক্রমিকই বলা যায়। কাল রাতে আবার টের পেয়েছি সেটা। ডাক্তার দেখাতে দেরি করা উচিত নয়’— উত্তর দিলেন লুইজা।

একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে এলভিরা দ্বিধার সঙ্গে বলল, ‘তা ছাড়া আর কিছু নয়, আশা করি? বলি, ঘরে কোনোরকম—’

‘যিশু কহো! ঘরের আবার কী? খাসা ঘর, চমৎকার ঘর, অমন খোলামেলা ঝকঝকে ঘর বহু ভাগ্যে পাওয়া যায়—’

যেভাবেই কথাটা বলুন লুইজা, বলার পরই দেখতে পেলেন, বাস এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে উঠে পড়লেন বাসে।

বেচারি এলভিরা সিমনস! লুইজার কথায় তিনি ষোলো আনা বিশ্বাস করে বসলেন। দক্ষিণের কামরা যে খাসা ঘর, চমৎকার ঘর, এতে তাঁর বা অন্য বোর্ডারদের কোনোদিনই ছিল না সন্দেহ। ও-ঘর সম্বন্ধে তাঁদের আপত্তি ছিল অন্য কারণে। সে-কারণ যে অমূলক, তা তো প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন লুইজা স্টার্ক। একরাত্রি সেখানে বাস করেও তো দিব্যি সুস্থ শরীরে বহাল তবিয়তে তিনি গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। পুরোনো অসুখ? পুরোনো অসুখ সবাইয়েরই থাকতে পারে, সে অসুখ চাগাড় দিলে সবাইকেই শহরে ছুটতে হয় ডাক্তার দেখাবার জন্য—

যাহোক, আর দেরি করা নয়। দক্ষিণের ওই কামরাখানার উপরে চিরদিনই লোভ ছিল এলভিরার। নেননি শুধু কুসংস্কারের বশে। সে-কুসংস্কার যে কত বাজে, তা তো প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন ওই ভদ্রমহিলা। সুতরাং, এ সুযোগ আর ছেড়ে দেওয়া নয়।

নিজের ঘরে না-ঢুকে এলভিরা রান্নাঘরে গিয়ে সোফিয়াকে পাকড়ালেন, ‘দক্ষিণের কামরা আমিই নেব, আজ থেকেই—’

লাইব্রেরিয়ান এলিজা লিপিনকোট সেকথা শুনে মাথা নাড়ল। অনৈসর্গিকে ওর দারুণ আশঙ্কা। আড়ালে ডেকে এলভিরাকে সে বলল, ‘যে ঘরে ছিটকাপড়ের রং মুহুর্মুহু বদলায়, ময়ূর যেখানে দেখতে দেখতে গোলাপফুল হয়ে যায়, সে ঘর ভাড়া নেওয়ার মানে কী জানো? নিজের হাতে কবর খুঁড়ে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়া। ওই কর্মটি করো না সখি!’

সখী কিন্তু নাছোড়াবান্দা। মালপত্র নিয়ে দক্ষিণ কামরায় উঠল গিয়ে।

দিন কাটল ভালোই। রাত্রে শোবার পরই হল জঞ্জাল। যেই ঘুম আসছে, অমনি গলাটা করেছে সুড়সুড়। দুই-একবার গলায় হাত বুলিয়ে দেখলেন এলভিরা— কিছুই তো নয়!

তৃতীয় বারে কিন্তু হাতে ঠেকল কী একটা। কী? কী? একগাছা দড়ি। কীসের দড়ি? বোঝা গেল না। দড়িটা চট করে সরে গেল। গেল, কিন্তু ঘুমের চটক ভেঙে দিয়ে গেল এলভিরার। তিনি উঠে বসলেন বিছানায়। গরমের দিন, জ্যোৎস্না রাত, জানালা খোলা, হাওয়া আসছে ফুরফুর করে। আর সেই হাওয়ায় ভাসছে—

কী ভাসছে? একটা টুপি। মেয়েরা কেউ কেউ শোবার সময়ে যেরকম নাইটক্যাপ মাথায় পরে শোয়, সেইরকমই সাদা টুপি একটা। সেইরকমই, তবে এর ফিতে যেন বড়ো বেশি লম্বা। এলভিরার সন্দেহ হল ওই ফিতেটাই হয়তো তাঁর গলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে টুপিটা ধরতে গেলেন তিনি।

যাঃ, কোথায় টুপি! ফিতেসমেত টুপি হাওয়ায় মিশে গেছে একদম!

ধুত্তোর! চোখের ভুল ছাড়া আর কী হতে পারে? এলভিরা আবার শুয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে পড়লেন একটু। তারপর হঠাৎ জেগে উঠলেন ধড়মড় করে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে যে! মুখের উপর কী একটা জিনিস চাপা দেওয়া হয়েছে। আর গলা? গলায় সেই দড়ি। দড়ি-গলায় পেঁচিয়ে দিয়ে কে যেন জোরে জোরে টানছে তার দুই প্রান্ত ধরে।

গলায় ফাঁস! দম বন্ধ! এলভিরা প্রাণপণ করে দড়িটা চেপে ধরলেন। ধরতে গিয়ে কীসে যেন হাত ঠেকে গেল! কীসে? কীসে? সাঁড়াশির মতো শক্ত বাঁকানো কয়েকটা আঙুলে। কী শক্ত? অথচ কী ঠান্ডা? বরফের আঙুল! এলভিরা ভগবান স্মরণ করতে লাগলেন।

আঙুলের পেষণ আলগা হয়ে এল ক্রমশ, দড়ি খুলে গেল গলা থেকে, মুখের উপর থেকে টুপিটা টেনে ফেললেন এলভিরা। সত্যিই টুপি, সত্যিই তাতে ইয়া লম্বা দড়ি, তারের মতো শক্ত। টুপি হাতে নিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন এলভিরা। জ্যোৎস্নার ঢেউ ঢুকছে জানলা দিয়ে। সেই জ্যোৎস্নায় কী যেন ভাসছে। হাওয়ায় ভর করে ভাসছে। কী?

একখানা মুখ। কী বীভৎস! কী হিংস্র! একখানা মুখ— কোঁচকানো, থাঁতলানো মুখ একখানা! বুড়ো মানুষে মুখ! আশি বছরের বুড়ির মুখ! তার চোখ থেকে হিংসার আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। কী যেন শুনতে পাচ্ছেন এলভিরা!

‘আমার বিছানায় শুবি? আস্পর্ধা তো কম নয় তোর!’

এলভিরা ছুটে বেরুলেন ঘর থেকে সেই নিশুতি রাতে। ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়লেন তাঁর পুরোনো ঘরে, পরিত্যক্ত বিছানায়। শুয়ে শুয়ে ভগবান স্মরণ করতে লাগলেন সারারাত ধরে।

পরদিন ভয়ানক উত্তেজনা বাড়িতে। লুইজা স্টার্ক টুঁ শব্দটি করেননি, কিন্তু এলভিরা সবাইকে ডেকে হুবহু বর্ণনা দিয়ে গেলেন রাত্রির ঘটনার। সোফিয়া গম্ভীর, আমান্ডা-ফ্লোরা ভয়ে কাঁপছে, এলিজা লিপিনকোট বুকে ক্রশ আঁকছে আঙুল দিয়ে দিয়ে। আর থেকে থেকেই বলছে, ‘আমি তোমায় আগেই তো বলেছিলাম এলভিরা! আগেই তো বলেছিলাম।’

এইসময় পাদরি সাহেব একটা প্রস্তাব নিয়ে এলেন সোফিয়ার কাছে, ‘ঘরটা ভাড়া নেওয়ার কথা আমি বলছি না, সাহস থাকলেও সে-সামর্থ্য আমার নেই, পয়সার দিক দিয়ে। আমি চাই, কেবল দুই-এক রাত ওই ঘরে শুয়ে থাকবার অনুমতি। কোনো ভৌতিক প্রভাব যদি থাকে ও-ঘরে, আমি ভগবানের নামকে হাতিয়ার করে সে-শক্তির সঙ্গে লড়াই করব।’

সোফিয়ার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই। সে সানন্দে অনুমতি দিল।

কিন্তু পাদরি রাত্রে মোটে ঢুকতেই পারলেন না সে ঘরে। দরজা খোলা, কিন্তু সেই দ্বারপথে যেন অদৃশ্য পাহাড় একটা দাঁড়িয়ে আছে পাদরির পথ রোধ করে। পাদরি পালোয়ান না-হতে পারেন, কিন্তু গড়পড়তা প্রৌঢ় পুরুষের গায়ে যেরকম শক্তি থাকবার কথা, তার চেয়ে কম তাঁর কোনোদিনই নয়। কিন্তু আজ সেই অদৃশ্য বাধাকে অতিক্রম করবার মতো শক্তি তিনি নিজের দেহে খোঁজ পেলেন না। প্রাণপণে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও না।

শেষরাত্রে শ্রান্ত দেহে তিনি ফিরে গেলেন নিজের ঘরে।

পরের রাতে সোফিয়া বলল, ‘আজ আমিই শোব দক্ষিণের কামরায়।’

আমান্ডা আর ফ্লোরা কেঁদে ভাসিয়ে দিল, কিন্তু সোফিয়া গ্রাহ্য করল না তাদের অশ্রুকে। তার রোখ চেপে গিয়েছে। সে নিজে একবার দেখবে এই পেতনির কেরামতি!

রাত বেশি নয়। এগারোটা হবে। দোল-খাওয়া আয়নার সমুখে দাঁড়িয়ে মাথার চুল খুলছে সোফিয়া। এরপর পোশাক খুলবে, তারপর শুয়ে পড়বে বিছানায়।

চুল খুলছে। দেহটাতে স্বস্তি পাচ্ছে না মোটেই। চাপা সর্দির মতো কী যেন চেপে ধরেছে বুকটা-মাথাটা। কেমন যেন লাগছে। কে যেন কানে কানে ফিসফিস করছে। কান পেতে শুনতেই কথাগুলো বুঝতে পারল সোফিয়া, চিনতেও পারল। চিনতে পারল তার নিজের গলায়ই কথা বলে। সোফিয়া নিজেই নিজেকে বলে যাচ্ছে, ‘তোর মা একটা পাজি মেয়ে ছিল। তাকে তাড়িয়ে আমি ঠিকই করেছিলাম। তাড়াব তোদেরও। ঝাড়েবংশ ঝেঁটিয়ে বিদায় করবো তোদের।’

নিজেই বলছে, নিজেই শিউরে শিউরে উঠছে। জ্ঞান একেবারে তখনও হারায়নি তার। ভূতে-পাওয়া! একটা প্রবাদ আছে গাঁয়ে ঘরে, ভূতে পায় মানুষকে। হ্যারিয়েট মাসির ভূত পেয়ে বসছে সোফিয়াকে। তার মাথায় যে চিন্তা উদয় হচ্ছে,তা তার নিজের চিন্তা নয়। সেই মাসিরই চিন্তা। যে কথা তার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে, তা তার নিজের কথা নয়, সে কথা হ্যারিয়েট ডাইনির!

হঠাৎ, আরও একটা মোক্ষম চমক খেল সোফিয়া। আয়নায় ওই যে মুখখানা ফুটে উঠেছে, ও কার মুখ? সোফিয়ার মুখে তো অমন অষ্টাবক্র বলি রেখা নেই। তার গাল তো অমন তোবড়ানো নয়! তার মুখ তো অদন্ত নয় অমন, তার ঘোলাটে চোখে তো হিংসার আগুন ছোটে না অমন করে! মাথার চুল তো অমন শণের নুড়ি নয় তার!

ও-মুখ সোফিয়ার নয়, হ্যারিয়েট ডাইনির। সোফিয়া ডাইনি হয়ে গিয়েছে।

হুড়মুড় করে সে ছুটে বেরুল। নিজের ঘরে গিয়ে আমান্ডাকে টেনে তুলল, ‘আমান্ডা! আমান্ডা! তাকিয়ে দেখ তো! ভালো করে তাকিয়ে দেখ আমার দিকে। কাকে দেখছিস?’

আমান্ডা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন? দেখছি তোমায়, আবার কাকে দেখব?’

‘ঠিক বলছিস? আমায় দেখছিস তো? তোর দিদি সোফিয়াকে?’

আমান্ডার কাছে বার বার আশ্বাস পেয়ে তখন দুই হাতে চোখ ঢেকে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকল সোফিয়া।

কাঁপুনি থামলে সে বলল, ‘এ বাড়িটা বেচতেই হবে রে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *