ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ৯

নয়

রাশেদ সাহেব যখন এমনি একটা বাজে অস্বস্তির মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় এক সন্ধ্যাবেলা টেলিগ্রাম পেলেন-পারভিন রীচিং ফিফটিথ্ মর্নিং-সাহানা।

সাহানা? অবাক হলেন, কোন্ সাহানা! পরক্ষণে মনে পড়ল। সাহানা মেয়েকে ঢাকায় পড়তে পাঠাবার জন্য একটা চিঠি লিখেছিল বটে। তা এত শিগগির ঘটবে ব্যাপারটা তখন মনে হয়নি। যাক, স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন একটুখানি। তবু বুলুর একজন সঙ্গী জুটবে। ভর্তিটর্তি হতে নিশ্চয়ই দেরি হবে কয়দিন আর সে ক’দিন অন্তত বুলুর দিনরাতের একজন সঙ্গী হল।

আর সেজন্য নিজেই পারভিনের থাকবার জায়গা ঠিক করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেন। রাখীর ঘরে আরেকটা খাট পাতা হল। নিজের ঘরে রেক্সিনে ঢাকা একটা ছোট টেবিল ছিল, সেটা এনে দিলেন, তার সঙ্গে কুশন-আঁটা চেয়ার। একটা বাড়তি আলনাও পাওয়া গেল। রাত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিজেই বেরুলেন বিছানার চাদর আর বালিশের কভারের কাপড় কিনতে।

বুলু আব্বার ব্যস্ততা দেখে বিরক্ত হয়। বলে, আব্বার সব কাজে বাড়াবাড়ি, আগে আসুক মেয়েটা-বাসায় কি বাড়তি বিছানা ছিল না?

রাশেদ সাহেব হাসেন, তোরা তো জানিস না, দেখিসও নি, পারভিনের মা কেমন মেয়ে ছিল। সেকালের সিমলা পাবলিক ইস্কুলে পড়া মেয়ে। তখনকার দিনে, যখন আমরা ভারিক্কি সংসারী হয়ে গিয়েছি, তখনও আমার মতো মানুষ ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। কী ফটাফট ইংরেজি বলত, বাপরে! একবার এসেছিল কলকাতার বাসায়, মোটে একবার-তখন বোধহয় মনি হয়েছে সবে, তোর মায়ের আঁতুড় কাটেনি। বাসায় উঠল কিন্তু বিকেল হতে-না-হতেই হোটেলে চলে গেল। কারণ আমরা নাকি নিজেরাই কষ্টে আছি, অসুখবিসুখের বাড়ি। তোর ছোট মামাকে, মানে বোঝ, সেই তখনকার দিনের একজন এফ.আর.সি.এস. ডাক্তারকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত।

রাশেদ সাহেব এমন ভঙ্গিতে কথা বললেন যে দুই মেয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। বুলু হাসি চাপতে চাপতে বলে, তাহলে বলুন শালার বউকে ভয় পেতেন আপনিও।

ভয় মানে? নিদারুণ ভয়। তোর বড় মামাকে বলত, হিপো। বোঝ ব্যাপারখানা, ভাশুরকে কী শ্রদ্ধা-সম্ভাষণ। সালেক ভাইয়ের কথা উঠলেই বলত, য়ু মিন দ্যাট হিউজ হিপ অফ হিউম্যান ফ্রেশ।

কিন্তু আমরা যে শুনেছি উনি নিজেই…

আরে সে তো পরের ঘটনা। আগে তো ছিল হালকা পাতলা ঝরঝরে শরীর। তারেক তো একবার দেখেই বিয়ে করবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। অমন সুন্দর চেহারা সহজে চোখে পড়ে না। মোটা হয়েছে তো পরে। শোকে দুঃখে ওর কি আর কিছু আছে। তোর মায়ের অসুখের সময় গিয়েছিল সেবার। তখন বেচারার চলাফেরা করতে পর্যন্ত কষ্ট হয়। আমাকে দেখে বলল, আমার কথা বলবেন না, আমি এখন কুমড়ো হয়ে গিয়েছি— এ রিয়েল রাউন্ড রাইপ কুকুম্বার।

কুকুম্বার মানে কি কুমড়ো? বুলুর সন্দেহ হয়।

মানে দিয়ে কী হবে? ও শব্দ বানাত-ওর শব্দ শুনলে হাসতে হাসতে মরে যেত মানুষ। যদি জিজ্ঞেস করত কেউ তোর মতো, তাহলে বলত– কুকুম্বার মানে কুমড়ো নয় বুঝি? তাহলে দ্যাট্স এ সিরিয়াস মিসটেক, আস্ক দ্য ব্রিটিশ টু কারেক্ট। এমন গম্ভীরভাবে বলত যে কার সাধ্যি বোঝে ঠাট্টা করছে।

আব্বার গলার স্বর বিষণ্ন শোনে তখন দুই বোন।

একটু এক্সেনট্রিক, কিন্তু ওর মন খুব ভালো। অত বড় জমিদার বংশের একমাত্র মেয়ে-তিনটি বাচ্চা নিয়ে বিধবা হল—কতই বা বয়স তখন। তারপর এই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল-এদিকে দেশভাগ হয়ে এসে পড়ল এপারে-সব পড়ে থাকল ওপারে-দেখাশোনার লোক নেই-বদলিতে যা পেল, তা আর কতটুকু।

আব্বাকে বিষণ্ন হতে দেখে বুলু প্রসঙ্গ ফেরাতে চাইল। বলল, আব্বা, পারভিন নাকি ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়েছে, কাপড়চোপড় দারুণ শৌখিন? কী জানি, হতেও পারে-রাশেদ সাহেকে একটু চিন্তিত দেখায়। বললেন, হলে ওর মায়ের জন্যই হয়েছে। তিনটে আয়া ছিল তিন বাচ্চার জন্য। পাঁচবার পোশাক বদলানো হত। ইস্তিরিতে ভাঁজ থাকলে ধোপার বারোটা বেজে যেত। অমন মায়ের মেয়ে পারভিন, ওর আর দোষ কী!

স্টেশনে রাখীকে যেতে হল। আব্বা যেতে চেয়েছিলেন। বুলু যেতে দেয়নি। বলেছে, সকালে অফিস, স্টেশন থেকে ফিরেই তাড়াহুড়ো করবেন—কী দরকার, তার চাইতে রাখীই যাক।

কিচ্ছু অসুবিধে হয়নি। সেকেন্ড ক্লাস কামরার দরজায় রিজার্ভেশান স্লিপে নাম লেখা ছিল। আঁটো সালোয়ার কামিজ পরনে, চোখে সানগ্লাস, যে মেয়েটি কামরা থেকে নেমে এল তার দিকে যে-কেউ চোখ তুলে তাকাবে। মেয়েটির পুষ্ট শরীরের রেখাগুলো পোশাকের আড়ালে থেকেও ভারি প্রখর। রাখী এগিয়ে গেল, পাবনা থেকে আসছেন?

জী-আপনি?

আমি রাখী, তুমি পারভিন না?

ওহ্ রাখী আপা! প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মধ্যেই পারভিন রাখীকে জড়িয়ে ধরল দুহাতে। তুমি নিজে আসবে ভাবতেই পারিনি। ফুফাজান কেমন আছেন? বুবু? দুলাভাই?

ভালো, সবাই ভালো। চলো।

পারভিনের পেছনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটিকে কেমন চেনাচেনা লাগল রাখীর। পারভিন তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিল, আমার লোক এসে গেছে, মেনি থ্যাংকস। ছেলেটি মুখ কালো করে চলে যাচ্ছিল। পারভিন থামাল, জাহিদ ভাই, পরিচয় করিয়ে দিই-আমার রাখী আপা। আর ইনি জাহিদ হাসান, এম. এ. শেষ করে ‘ল’ পড়ছেন। রাখী হাত তুলে আদাব দিয়ে মৃদু হাসল। তারপর কুলির মাথায় মোট চাপিয়ে দুজনে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে বাইরে বেরিয়ে এল।

ভারি মজার মেয়ে পারভিন, সর্বক্ষণ বকবক করতে পারে। ফিলিমের কাগজের পাগল। ইংরেজি বাংলা উর্দু হিন্দি সবরকম গান গাইল। গিটার বাজিয়ে শোনাল। কমিক দেখিয়ে হাসাল সবাইকে। আর থেকে থেকে আয়নার সামনে গিয়ে মুখ দেখল। এইসব করছে কিন্তু মুখের বিরাম নেই। কথা আর ফুরোয় না মেয়ের-য়ুনিভার্সিটিতে মেয়েরা কি কেউ সালোয়ার কামিজ পরে যায় না? টিচাররা কেমন? ভীষণ বদরাগী নাকি? আচ্ছা কী পরব আমি বলেন তো বুবু? সব সাবজেক্টেই কিন্তু আমার ভালো নম্বর। রাখী আপা, ইংরেজির খুব দাম তাই না? আমি তাহলে ইংরেজিই পড়ি। আচ্ছা ঢাকার ফিলিম স্টুডিওতে গিয়েছ কখনো রাখী আপা? আমাদের পাবনার একটা মেয়ে না হিরোয়িন হচ্ছে, তোমরা শুটিং দেখেছ? আমি একটা বই পড়লাম সেদিন, ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ। জেমস্ বন্ড পড়োনি? ওহ্ সিম্পলি ওয়ান্ডারফুল। কী বললে? ভালো লাগে না তোমার। অমন বই কিন্তু হয় না। আম্মা আবার কবিতার ভক্ত। ব্রাউনিং-এর কবিতা পড়তে বলেন, যত্তো সব রাবিশ।

যতক্ষণ রাখী বাসায় ছিল ততক্ষণ এইসব শুনতে শুনতে তার প্রাণান্ত হল। বুবু একসময় বলল, তুই কি বাড়ি থেকে এসেছিস, না সোজা একেবারে হেমায়েতপুরের হাসপাতাল থেকে?

পারভিন হাসে, বলে, কী যে বলেন বুবু, আমি বুঝি বেশি কথা বলি? আম্মার কাছে থাকলে বুঝতে! আম্মা তো ঘুমোতে ঘুমোতেও কথা বলে। আম্মা পাগল হয়ে যাবে, দেখো তোমরা। আমার ধারণা, আব্বা ঐজন্যই মরেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *