চার
দ্যাখো, আমি নিজের জন্যে কখনো কিছু চাইনি। তাই আমার সঞ্চয় নেই, তোমাদের জন্যে হয়তো আমি কিছুই রেখে যেতে পারব না। আজকাল আমার টায়ার্ড লাগে—তাই বলছি, যা করবার, ভালো করে চিন্তাভাবনা করে করো! আর আমার মতামতের কথা যদি বলো-তাহলে এইসব ব্যাপারে আমার কোনো মতামত নেই। আমি পুরনো কালের মানুষ, অনেক পুরনো ভ্যালুজ আমার মনের মধ্যে জেঁকে বসে আছে। আমার মতামত তোমাদের হয়তো পছন্দ হবে না।
রাখী সকালে চায়ের টেবিল ছেড়ে ওপরে গিয়েছিল টেলিফোন ধরতে। টেলিফোনে নার্গিসের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে নেমে আসছিল, তখনই শুনল কথাগুলো! আব্বা হাসান ভাইকে বলছেন। বুবু চুপচাপ বসে, হাসান ভাই টেবিলের ওপর কনুই রেখে হাতের ওপর গাল পেতে শুনছে। রাখী ঘরের ভেতরে নজর পড়ার পর ভেতরে আর ঢুকল না। পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু আপনার মতামতটাই তো আমি জানতে চাইছি, হাসান ভাই আগ্রহ দেখাতে চেষ্টা করে।
না, আমার কোনো মতামত নেই, আব্বার গলায় ঈষৎ বিব্রত ভাব শোনা যায়।
কেন, হাসান ভাই মুখ তোলে, ব্যবসা কি খারাপ?
খারাপ কি ভালো সেটা তো কথা নয়। আমি তো বললাম তোমাকে – তোমাদের এ যুগটাই আমি বুঝতে পারি না! এ যুগটাই তো টাকার যুগ, যেমন করে হোক, যে করে হোক টাকা চাই মানুষের। মানুষ টাকা চায় শুধু টাকার জন্য, কোনোকিছু বিল্ডাপ করার জন্য নয়। প্রফেশন হিসাবে ব্যবসাকে কেউ নিতে চায় না। কোনোরকম ক্রিয়েটিভ এফোর্ড দেখি না কোথাও—সর্বত্র গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা। আমার কী মনে হয় জানো?
কী? হাসান ভাই যেন-বা অলক্ষ্যে হাসে।
আসলে একটা ঠিকেদারি সোসাইটি গড়ে উঠছে এদেশে। ব্যবসা, ইন্ডাস্ট্রি, চাকরি-সর্বত্রই ঐ ঠিকেদারি মনোভাব দেখা যাচ্ছে। শর্টকাট পথে বড় হবার পাগলামিতে পেয়ে বসেছে সবাইকে। চাকরি ছেড়ে দেওয়াটাকে যদি তুমি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ভালো মনে করো, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি চাকরি ছেড়ে দেবে। তবে আমার কথা হল, যা করবে, ভেবেচিন্তে করবে। ভবিষ্যতের কথা মানুষ এমনিতেই কিছু বলতে পারে না। সময় কেমন দ্রুত দেখতেই পাচ্ছ! ভবিষ্যতে আরো কী ঘটবে কেউ কিছু জানে না। আমার নিজের ধারণা, মানুষের ইনসিন্সিয়ারিটির খেসারত দিতেই হবে—মানুষ এই যে খালি দায় এড়িয়ে সুখের দিকে যেতে চাইছে-এ ভালো নয়। আসলে মানুষকে একটা লক্ষ্য খুঁজে পেতে হয়। একটা ভিত্তির ওপর মানুষকে দাঁড়াতে হয়। সে যা-ই করুক না কেন। ফ্লোটিং রুটলেস অবস্থা শেষপর্যন্ত পতন ডেকে আসবেই। একটা পারপাস অফ লাইফ থাকতে হয়, কোনো- না-কোনো ভাবে।
আব্বা এই সময় উঠে দাঁড়ালেন। উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে কী যেন দেখলেন, তারপর ফিরে এসে বসলেন আবার নিজের আসনে। হাসান ভাই বোধহয় উঠবে। বুবুর কাছে চাবি চাইল। বুবু উঠে গেলে রাখী ধীরপায়ে বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়াল। আব্বার কথা তখনও শেষ হয়নি।
আমার নিজের জীবন দিয়ে জানি-আমি ঐ পারপাস অফ লাইফ খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছিলাম-আব্বা আবার বলতে শুরু করেন। কিন্তু আমার বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি মিডিওকোর মানুষ। অন্যকিছু নয়, আমার শুধু একটা সাধ ছিল-আমি শুধু শান্তি আর সুখ পেতে চেয়েছিলাম জীবনে। গ্লানি যেন না থাকে, অপমান যেন না থাকে, পাপ যেন না থাকে—এইরকম একটা জীবন আমি পেতে চেয়েছিলাম! ভেবেছিলাম, ছেলেমেয়েরা পবিত্র হোক, সুখী হোক, কিন্তু ঐ যে বললাম, আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আমার চিন্তায় ভুলও ছিল। হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারি। মানুষের নিজের জীবন শুধু নিজেরই নয়। নিজেকে সে আলাদা করে রাখতে পারে না। এই ভুলের জন্যই আমি ফেইল করলাম। মনির মৃত্যুই আমার ফেইলিওর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
হাসান ভাই মাঝখানে মৃদুস্বরে কী যেন বলে ঐসময়। রাখী পুরো শুনতে পায় না।
এখন রয়েছ তোমরা, আব্বা বলতে থাকেন, আমার এখন শুধু একটাই ইচ্ছে-তোমরা সুখী হও। আমার আর ক’দিন, আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। তোমাদের কাছে এইটুকুই শুধু আমার প্রত্যাশা–তোমরা সুখী হতে চেষ্টা করো। টাকাপয়সা বেশি হোক কি কম হোক, তাতে কিছুই এসে যায় না-শুধু তোমরা সুখী হও, এইটুকু আমার সাধ
আব্বা, আমি উঠব এবার, হাসান ভাই উঠে দাঁড়ায়।
একটু বসো, আমার আর একটা কথা আছে-এতসব কথা যখন উঠেই গেল—কথাটা হয়ে যাক।
আমি জানি না, আব্বার কথা ধীর হয়ে আসে। রাখী শুনল, তার কথা বলছেন আব্বা। বলেন, তোমরা রাখীর কথা ভেবেছ কিনা, কিন্তু আমার মনে হয়, ওর সম্বন্ধে ভাববার সময় হয়েছে।
ওর বিয়ের কথা বলছেন তো?
হ্যাঁ, বিয়ের কথাও বলতে পারো, তবে ঠিক বিয়ের কথাই শুধু নয়, ওর গোটা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেই ভাবনা হয় আমার। আমি চাই না এক্ষুনি ও বিয়ে করুক, কিন্তু তবু সে ভাবনাটিও হচ্ছে একেক সময়! রায়হান সাহেব তার ছেলের জন্যে বলেছিলেন, ছেলেটি বিলেতে ডাক্তারি পড়ছে-এ বছরই দেশে ফিরবে। আমি কিছু বলিনি, আমার কিছু বলবারও নেই-এ ব্যাপারে রাখীই প্রথম কথা বলবে, তারপর তোমরা রয়েছ। আমার মনে হয় তোমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর করতে পারো।
হাসান ভাই যেন হেসে উঠল, আপনি মিছিমিছি ভাবছেন, রাখীর বিয়ে কোনো প্রব্লেম নয়। অনেকে আমার কাছে রাখীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে এসেছে-প্রত্যেকেই ভালো ভালো বিজনেস এক্সেকিউটিভ, অনেক টাকাপয়সা ওদের।
হাসান, আব্বার গলার স্বরে কেমন হতাশা শোনা যায়। বলেন, তুমি টাকাপয়সার কথা কেন তুলছ? টাকাপয়সা দিয়ে কী হয়? টাকাপয়সা কি আমি কম জোটাতে পারতাম? আমার কলিগদের তো দেখেছ তুমি। টাকাপয়সা নয়, একটা ভালো, ভদ্র ছেলে হলেই রাখী সুখী হবে। পেটের ভাত জোটাবার মতো রোজগার কি ও নিজে করতে পারবে না, বলো? যদি চাও তাহলে তেমন একটি ছেলের খোঁজ করো, এ রিয়েল ম্যান উয়িথ হিউম্যান কোয়ালিটিজ।
কেন, টাকাপয়সা যাদের থাকে, তাদের কি হিউম্যান কোয়ালিটিজ নেই? হাসান ভাইয়ের প্রশ্নটা বারান্দা পর্যন্ত চলে আসে।
বাহ্, থাকবে না কেন, আব্বা বলেন, কিন্তু আমার কথা হল, টাকাপয়সা থাক বা না থাক, বেশি থাক বা কম থাক—তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি চাই রাখীর বিয়ে হোক এমন একটি ছেলের সঙ্গে যার সঙ্গে ওর টেম্পেরামেন্ট খাপ খাবে, যাকে রাখী ভালোবাসতে পারবে।
ঐ কথার উত্তরে কিছু বলে কিনা বোঝা যায় না। রাখী দেখতে পায় হাসান ভাই উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, আমি এখন চলি। আব্বা, তেমন খোঁজ পেলে আপনাকে জানাব।
হাসান ভাই পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেলে, বুবু চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। আর রাখীও ধীর পায়ে চলল।নজের ঘরে।
রাশেদ সাহেব জানালার পাশে দাঁড়ালেন। যে কথাটা একটু আগে উচ্চারণ করেছেন, সেটা যেন তার মনের ভেতর থেকে ফুরিয়েও ফুরোচ্ছে না। ঐসঙ্গে আরেকটা কথাও বেরিয়ে এসেছিল প্রায়। বলতে পারেননি। বলা কি যায়? বলতে চাইছিলেন, রাখী যেন স্বামীকে ভালোবাসতে পারে ওর মায়ের মতো। বললেন না। বললে নিশ্চয় হাসত হাসান। এমনিতেই এত কথা মিছিমিছি বলেছেন। মুখের দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় হাসান কৌতুক বোধ করছিল এতক্ষণ। একটা ওল্ড হ্যাগার্ডের মুখে এই ধরনের কথা কৌতুকের নয় কি? নিজেকে শুধালেন, কী দরকার ছিল এত সব কথা বলার, কেউ তো শোনেনি, এমনকি বুলু পর্যন্ত না।
বুলু পর্যন্ত উশখুশ করছিল উঠে যাবার জন্য। রাশেদ সাহেবের তখন বুলুর বিয়ের কথা মনে পড়ে। কী তেজ মেয়ের। একদিন কেমন জানিয়ে দিল, ওকে আমি ভালোবাসতে পারব না। ঐটুকু একফোঁটা মেয়ের সে কী কথা! আর সেই বুলু আজ তাঁর কথা শুনে উঠে যাবার জন্য উশখুশ করছিল। যেন কত দেখেছে জীবনকে— এমনি একটা ভারিক্কি ভাব বুলুর মুখে লক্ষ করেছেন। বুলুও কি বদলেছে তাহলে?
রাশেদ সাহেব বুলুর ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন না। চুপচাপ শান্ত মেয়ে। কিন্তু ঐ মেয়েই বিয়ের ব্যাপারে তুমুল কাণ্ড করে বসেছিল একদিন। তারপর আবার চুপ ভয়ানক ধীর আর শান্ত, মনেই হয় না যে বুলুর মতো একজন মানুষ বাড়িতে আছে।
বুলু কি হাসানের মতোই নতুন কিছু ভাবছে, নাকি বয়স? বুলুর বয়স হচ্ছে বলে সে হিশেবি হয়ে উঠেছে।
বুলুর আবার বয়স! রাশেদ সাহেবের হাসি পায় একটুখানি। ওর জন্মই হল এই সেদিন। ও যখন পেটে আসে তখন সালমা বলেছিলেন, তোমার মেয়ে হবে দেখে নিও। তোমার জন্যে আগে মেয়েই দরকার, আমি না থাকলে তোমাকে কে দেখবে?
কোথায় যেন!
রাশেদ সাহেব স্মৃতির ভেতরে চলে যান। মনে-মনে হিশেব করেন, কোন্ সাল সেটা? উনিশ শো চৌত্রিশ, নাকি উনিশ শো ছত্রিশ? বোধহয় তখন রংপুরে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে তার, রংপুরেই তখন কানুনগো তিনি। নতুন চাকরি নিয়ে সদ্য এসেছেন। বাসা হয়েছে রাধাবল্লভ-এ। দূরদুরান্তে ট্যুর করতে হয়। জমিজমার নকশা, রেকর্ড, পরচা, দাখিলা, সেটেলমেন্ট—এই নিয়ে ভজকট কাজ। সালমা একাকী থাকেন বাসায়, সঙ্গে থাকত ওর বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া কী মায়মুনার মা। তবু ভয় লাগত সালমার। ট্যুর থেকে ফিরে এসে স্বামী ঘরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। বলতেন, তুমি এ চাকরি ছেড়ে দাও—আমার একলা থাকতে ভীষণ ভয় করে। অশ্বত্থ গাছে প্যাচা ডাকে সারারাত। আর বাড়িটাও কেমন ভূতুড়ে!
অথচ বয়স হয়েছিল সালমার। দুবছর আগে যখন বিয়ে করেন তখন সালমা বেশ বয়স্ক মেয়ে, উপরন্তু গেছো মেয়ে বলে বাপের বাড়িতে তার দুর্নাম ছিল।
সারারাত স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতেন। স্ত্রীর রাশ রাশ চুলে মুখ ঢেকে যেত রাশেদ সাহেবের। সকালবেলা জেগে উঠেও গলা ছাড়তে চাইতেন না। স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলতেন, না আমার ঘুম এখনো ভাঙেনি।
স্ত্রীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে হত রাশেদ সাহেবকে। স্বাস্থ্য ভালো ছিল সালমার। স্ত্রীর শরীর কত রাত তাঁকে মাতাল করে দিত। কত রাত ঘুমোতেন না দুজনে।
আবার তো চলে যাবে ট্যুরে, যদি তোমাকে আমি শেষ বেলা দেখতে না পাই-এইসব কথা বলতেন। বলবার সময় পানিতে দুচোখ ভরে উঠত আর তখন আরো জোরে গলা জড়িয়ে ধরতেন স্বামীর।
সালমার মতো মেয়ে বলেই অমন পারত। ওর পক্ষে তাই স্বাভাবিক ছিল। আজকাল ভাবলে ওই স্বাভাবিকতার কথাটাই বেশি করে মনে হয়। স্বয়ম্বরা মেয়ে সে। সেই উনিশশো পঁয়ত্রিশ ছত্রিশে ঐরকম হওয়া সম্ভব ছিল না। আজকাল যেমন ছেলেমেয়েরা মেলামেশা করে, প্রেম করার সুযোগ পায়-তেমন মেলামেশা কিংবা প্রেম সেই যুগে গ্রামের কোনো সম্ভ্ৰান্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু সালমা ছিল একেবারেই অন্যরকম।
পুরনো এইসব স্মৃতি জেগে উঠলে স্মিত হাসি ফোটে রাশেদ সাহেবের মুখে। অতীতের এইসব কথা এখনও তার মন ভরে যায় একেবারে। বহুবার এসব গল্প তিনি ছেলেমেয়েদের কাছে করেছেন। কী ছেলেমানুষই না ছিলেন তখন।
সেটা বোধহয় ম্যাট্রিক পাসের বছর। ছোট খালার বাড়িতে গিয়েছেন বেড়াতে, সেই সুদূর উত্তরের বিহারের সীমান্তে। জমিদার মানুষ ছোট খালুজান, ছোট তরফের জমিদার তারা। তার বড়ভাই তখনো বেঁচে রুগ্ণ আর বৃদ্ধ। ঐসময় তাঁদের সমৃদ্ধিতে ক্ষয়ের টান ধরেছে। একের পর এক জোত মাড়ওয়ারি মহাজনের ঘরে বাঁধা পড়ছে। আস্তাবলের ঘোড়াগুলো একের পর এক মরে যাচ্ছে। একটা হাতি ছিল সেটা পাগল হয়ে গেল। এমনি সব বিপর্যয় একের পর এক আসছিল। ঐরকম সময়ে তরুণ রাশেদ পেয়েছিলেন সায়ীদাবাদ এস্টেটের ছোট তরফে।
আগে যাননি কখনো, সেবার ছোট খালাকে পৌঁছাতে গেলেন। তখন সদ্য ম্যাট্রিক পাস করেছেন-কারমাইকেল কলেজের ছাত্র, এদিকে আবার আধুনিকও হয়েছেন। পাঞ্জাবি ফুলশার্ট ছেড়ে হাফশার্ট পরেন। তিন ইঞ্চি চওড়া পাঁচ বকস লাগানো কোমরালা জিনের ট্রাউজার্স বানিয়েছেন। মিহি ধুতি পরতে অসুবিধা হয় না তখন। ফজরের নামাজ তখন প্রায়ই কাজা হয়ে যায়। ইংরেজি কবিতার বই বালিশের নিচে থাকত। তখনকার দিনের প্রায়-নিষিদ্ধ বই ওমর খৈয়ামের সচিত্র ইংরেজি অনুবাদ অতি যত্নে লুকিয়ে রাখতেন।
আর ঠিক সময় দেখা হয়ে গেল সালমা বেগমের সঙ্গে।
ছোট খালার শাশুড়ি তখনও বেঁচে। বিশালকায়া মহিলা তখন বয়সের ভারে একেবারে জবুথবু। পুরু কাচের ইরানি চশমা ব্যবহার করেন, গায়ে কাপড় রাখতে পারেন না গরমের জন্য, তাই ঘরের বাইরেও বার হন কম। তাছাড়া বিশাল শরীরটা নিয়ে তার এমনিতেই ঝামেলা। কোথাও গেলে লোহার মোড়া বইবার জন্য একজন দাসী দরকার হয় তার।
তখনকার দিনের নিয়মে ঐরকম বাড়ির অন্তরে ঢোকার অধিকার ছিল না কোনো আঠারো-বিশ বছরের যুবকের। কিন্তু ও-বাড়ির অন্তঃপুরে অনেক বাইরের হাওয়া এসে লেগেছে ততদিনে। ছোট খালুজান সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলে-পড়া মেয়ে বউ হয়ে এসেছে বাড়িতে। প্রবাসী, সওগাত, মডার্ন রিভিয়্যু পত্রিকা আসছে বাড়ির ভেতরে। আর সেজন্যই সম্ভবত রাশেদ সাহেবের মতো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনরা বাড়ির অন্দরে আসতে পারত। বয়স্কা গুরুজন মহিলাদের সাথে দেখাও করতে পারত।
বাড়িটাই ছিল অদ্ভুত, রাশেদ সাহেবের শ্বশুরবাড়ির কথা মনে পড়ে। বিরাট এলাকা জুড়ে বাড়ি। একদিকে বাগান, পুকুর, মসজিদ- অন্যদিকে খামারবাড়ি, গোলাঘর, গোয়াল, আস্তাবল। মাঝখানে প্রকাণ্ড উঁচু পাঁচিল ঘেরা অন্দরমহল। অন্দরমহলে আবার পাঁচিল তোলা ভাগাভাগি। বাড়ির লোকেরা কীরকম, আধা-হিন্দি মেশানো অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত। বারান্দায় দেয়ালে আরবি দোয়া লেখা থাকত। মাঝে মাঝে ফারসি বয়েত ও দেখা যেত ঘরের কি বারান্দার দেয়ালে। দুপুর হোক, বিকেল হোক, সময়ের হিশেব নেই, পুকুরপাড়ের মসজিদ থেকে কোরান তেলাওয়াতের শব্দ অবিরাম ভেসে আসত। বড় বড় কানঅলা ছাগলের নিস্পৃহ বিচরণ, থামের মাথায়, ছাদের কার্নিশে অনবরত কবুতরের বকবকম, ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে, উঠোনে কে যেন চালের না ভুট্টার গুঁড়ো শুকোতে দিয়েছে। মুখে বসন্তের দাগ, কালোমতো একটা ছেলে হাতে লম্বা লাঠি নিয়ে হাঁস-মুরগি তাড়াচ্ছে, উঠোনময় ক’টা রাজহাঁস মেজাজি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে—সব একসঙ্গে মনে পড়ে রাশেদ সাহেবের। একট টুকরো ছবি যেন। ফুরিয়ে আসা সমৃদ্ধির শেষ অবশেষটুকু তখনও অভিজাত মুসলমানদের ঘরে একটুখানি জিরিয়ে নিচ্ছে। দীর্ঘ কষ্টকর যাত্রা আরম্ভের আগে নিঃস্ব বৃদ্ধের একটুখানি পা বিছিয়ে গড়িয়ে নেওয়া যেন। গোলেস্তা বোস্তাঁ পড়া মন্থর দুপুর, কারবালা জঙ্গের পুঁথি পাঠে মর্মরিত জোছনা ছলচ্ছল রাত্রি, আজানের দিগন্ত কাঁপানো সুবেহ্ সাদেক আর সন্ধ্যারাতের কাওয়ালির মজলিশ-সব একসঙ্গে মনে পড়ে রাশেদ সাহেবের।
সেই বাড়িতে একদিন ছোট খালার ভাসুরের মেয়েটিকে দেখে ফেললেন। ছোট খালার শাশুড়িকে সবে সালাম করেছেন, ঠিক ঐসময় মেয়েটির আবির্ভাব হামানদিস্তা হাতে নিয়ে। দাদির জন্যে পান ছেঁচে দেওয়ার আয়োজন করেছিল হয়তো। দাদি চোখে কম দেখেন বলেই কি না কে জানে, ছুটে একবারে পালিয়ে মুহূর্তের জন্যই আড়াল হল। তারপর আবার চপল চোখের দৃষ্টি মেলে দরজার আড়াল থেকে দেখল। ঐ একপলকের দেখাতেই রাশেদ সাহেবের মোহ লেগেছিল হয়তো। মেয়েটির কৌতূহলী চোখের চপল দৃষ্টি দেখে কিছুটা বিমূঢ়ও হয়ে পড়েছিলেন। চোখ নামাবার কথা তার মনে হয়নি। আর যতক্ষণ ঐ ঘরে ছিলেন ততক্ষণই। দেখলেন-না, মেয়েটি বারবার করে উঁকি দিয়ে তাঁকে দেখছে।
তারপর দুপুরবেলা বেশ কয়েকবার হাসির শব্দ শুনলেন। যেন বা বেলোয়ারি কাচের ঝড়ের প্রবল হাওয়ার দোলা লেগেছে। তখন বারান্দায় খেতে বসেছেন আর সবার সঙ্গে। ঐসময় দৃশ্যটা চোখে পড়ল তার। উঠোনের মাঝখানে পাঁচিলছোঁয়া পেয়ারাগাছের ডালে কে যেন ঢিল ছুড়ছে! একটু পর আঁশি এনে একটা ডাঁশা পেয়ারা ছেঁড়ার বিফল চেষ্টা হল। মাঝে মাঝেই উত্তোলিত একজোড়া মেহেদি-ছোপানো হাত দেখলেন আর থেকে-থেকেই ঐ বেলোয়ারি কাচের আওয়াজের মতো হাসি শুনলেন। একসময় মনে হল, পাঁচিলের ওপারের মানুষটা যেন লম্বা হচ্ছে। তারপরই চকিতে দেখলেন, কোনোকিছুর ওপর মানুষটার উঠে দাঁড়ানো এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট চিৎকার করে পড়ে-যাওয়া। বারান্দায় বসে খেতে-খেতে গোটা প্রক্রিয়াটি লক্ষ করছিলেন রাশেদ সাহেব। অনুমানেই বুঝলেন মেয়েটি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েছে এবং এ মেয়ে আর কেউ নয়। এ হল সেই মেয়ে, যার কালো চোখের তারায় সকালবেলা বাইরের আলো ঝিকিমিকি হতে দেখেছেন।
ওপারে তখন তীব্রকণ্ঠে গালাগাল বর্ষিত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে ছোট খালা ছুটে গিয়েছেন ওপারে, কয়েক মিনিট পরে ফিরেও এসেছেন। ফিরে এসে বলেন, কী গেছো মেয়েরে বাবা, ক’টা দিন চুপ করে থাকতে পারে না। এ সম্বন্ধটাও যদি ভেঙে যায়, তাহলে ও মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুঃখ আছে সবার।
রাশেদ বুঝলেন মেয়েটির আঘাত গুরুতর। কিন্তু তখনও তার চোখের সামনে ভাসছিল উত্তোলিত সেই মেহেদি-ছোপানো দুখানি গোলাপি রঙের হাত, ফর্সা মুখের আদলটুকু এবং কানে বাজছিল সেই খিলখিল হাসির শব্দটা।
খালুজান তখন বাসায় নেই। পাঁচিলের ওপারটা ক্রমেই যেন অস্থির হতে লাগল। নারীকণ্ঠের গালাগাল এবং আক্ষেপ যেন বেড়েই চলেছে। বাড়ির পুরুষ চাকরদের দু-একজনকে উঠোনে দেখা গেল।
রাশেদ তখন ছটফট করছেন। তারও ইচ্ছে হচ্ছে তিনিও কিছু করেন মেয়েটির জন্য। বারবার করে মনে পড়ে তার স্যুটকেসে আয়োডেক্সের কৌটো আছে। কিন্তু মুখ ফুটে কাকে বলবেন সেকথা?
তার এসময় বেড়াতে যাবার কথা। ছোট খালা এসে বলেন, তুই বরং না- বেরুলি আজ। বাড়িতে পুরুষমানুষ কেউ নাই, গোমস্তাকে পাঠানো হয়েছে ডাক্তারের কাছে, যদি না পায়, তাহলে তোকে কিষণগঞ্জ যেতে হতে পারে।
ছোট খালা যাবার সময় নিজের মনে মন্তব্য করলেন, ও মেয়েকে বেঁধে রাখা দরকার। বিয়ের কথাবার্তা চলছে এ সময়…
চলে যাচ্ছিলেন, তখন ডাকলেন রাশেদ। বললেন, আমার কাছে আয়োডেক্স মলম আছে, মালিশ করে দিলে উপকার হতে পারে।
শিগগির দে, এতক্ষণ বলিসনি কেন!
রাশেদের তখন মনে হয়েছিল, ভাগ্যিস তিনি ফুটবল খেলতে শিখেছিলেন, নইলে স্যুটকেসে ভরে কে আয়োডেক্স নিয়ে ঘুরে বেড়ায়?
পরের দিনই ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু পরের দিন তো হল না-তার সাতদিন পরও রওনা হতে পারলেন না।
কেন?
এখন ঠিক মনে করতে পারেন না। কিন্তু এটুকু মনে আছে ঐ ক’দিন ভারি দুশ্চিন্তায় কেটেছিল তার।
তারপর একদিন শুনলেন সালমা সেরে উঠেছে। দুদিন পরই সে দাদির ঘরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পান ছেঁচে দিতে এল।
মাথা নিচু করে, হামানদিস্তার আরো বেশি শব্দ তুলে অস্পষ্ট স্বরে জানিয়েছিল সালমা— না, ব্যথাটা এখন আর নেই।
সেই প্রথম কথা। তারপর থেকে রাশেদ প্রায় রোজই সকালবেলা দাদির ঘরে যেতে লাগলেন। দাদিকে আলেফ লায়লার কিস্সা পড়ে শোনালেন আর সালমার কাছাকাছি হতে চেষ্টা করলেন। পান ছেঁচে পিরিচে করে এনে সে দাদুর পায়ের কাছে এসে বসত আর রাশেদের কথা শুনত।
রাশেদের, সেই উনিশ বছরের রাশেদ আহমদের, তখন কেমন যেন ঘোর লেগেছিল। সালমাকে একটি দুটি কথা বলবার জন্যে মনের ভেতরটা আকুলিবিকুলি করে উঠত। যেদিন সালমা আসত না, সেদিন কিস্সা পড়ার সময় অন্যমনস্ক হতেন, বারবার দরজার দিকে তাকাতেন, বারবার ভুল হত তার। দাদি চোখ বুজে থেকেই বলতেন, আজ কি সায়েবের মন ঠিক নেই? রাশেদ লজ্জা পেতেন। কিন্তু মনের ভেতরকার আকুলিবিকুলি ভাবটা যেত না। দিনে দিনেই বাড়তে লাগল অস্থির ভাবটা। কেবলি মনে হত, কী একটা কথা যেন তার বলবার আছে, কী একটা জানবার আছে-কিন্তু বলতে পারছেন না।
কী কথা বলবেন সেটাই যে মস্ত সমস্যা তখন। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা পড়েছেন, এমনকি উদ্ভ্রান্ত প্রেমেও পড়া হয়েছে লুকিয়ে লুকিয়ে। পড়তে গেলে লাইন মুখস্থ হয়ে যায় এমন ভালো লাগে তখন শরৎচন্দ্রের বই। কিন্তু তবু রাশেদ তার মনের কথা আর খুঁজে পান না। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে রাখতেন আর শৈবালিনী প্রতাপের সংলাপ মনে পড়ত। কখনো মনে-মনে শরৎচন্দ্রের শেখর হতেন, কখনো নরেন কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তার বলবার কথাটি খুঁজে পেতেন না কোনোভাবেই।
আর ঠিক এমনি দিনে সালমার মা কী কারণে শাশুড়ির ঘরে উঁকি দিতেই দুজনকে খাটের দুপাশে দেখতে পান এবং তার পরদিন থেকেই দাদির ঘরে ঐসময় সালমার আসা বন্ধ হয়ে যায়।
কী অস্থির যন্ত্রণা তখন। কাউকে কিছু বলতে পারেন না। একাকী ঘুরে বেড়ান। কথা বলেন কম। একেকবার ভাবেন, চলে যাবেন। কিন্তু যেতে ও পারেন না।
এখন ভাবলে হাসি পায়। কিন্তু জীবন তো ঐরকম ছেলেমানুষি দিয়েই গড়তে গড়তে গড়ে ওঠে, নিজস্ব আদল পায়। এখন তো বোঝেন, ঐ যন্ত্রণা, ঐ অস্থিরতাই তার জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল!
একদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ির পেছনের আমবাগানের মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসছিলেন আর তখনই কানে এসেছিল হাসির ঝঙ্কারটা। গলার স্বর চিনতে ভুল হয়নি তার। জানতেন, ওরকম হাসি ও-বাড়িতে একজনই হাসতে পারে।
ইস্কুলের ডানপিটে ছেলে এবং কলেজের ফুটবল টিমের রাইট আউট রাশেদ আহমদের মগজে চকিতে নতুন বুদ্ধি খেলেছিল। সন্ধ্যার দিকে বাগানের ওদিকটায় কেউ আসে না। সেই ফাঁকে কি পাঁচিলের ওপারে মানুষটাকে একনজর দেখে নেওয়া যায় না? দুটি একটি কথা হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব?
বাতাবিনেবুর গাছটা সাহায্য করেছিল এবং গোসলখানার ছাদটা।
পরের দিনই এ দুঃসাহসিক কাজটা করেছিলেন এবং করে সফলও হয়েছিলেন।
আসলে সন্ধ্যা হয়ে যাবার পর আমবাগানের গাঢ় ছায়ায় অন্ধকারে কিছুই দেখা যায়নি, ছায়ামূর্তির মতো দেখেছিলেন শুধু। তবে কথা শুনতে পেয়েছিলেন, সালমার হাসি কানের কাছে বেজে উঠেছিল। আর তাতেই যেন কোথায় পরম শান্তি ছিল।
দিন তিনেক পর হঠাৎ সালমার সঙ্গের ছেলেটি ‘ভূত ভূত’ বলে চিৎকার করে উঠল। আর চিৎকার দিয়েই পড়িমরি করে ছুট দিল।
কী ঘটছে, বুঝে ওঠার আগেই তিনি গোসলখানার ছাদ থেকে বাতাবিনের গাছ হয়ে পাঁচিল টপকে একেবারে আমবাগানের অন্ধকারে। তারপর আর ভূত নেই।
তুমুল কাণ্ড তখন বাড়ির ভেতরে। লোকজনের ছোটাছুটি, চেঁচামেচি, হৈ হৈ ব্যাপার একেবারে। রাশেদ এদিকে চুপচাপ নিজের ঘরে এসে বসেছেন, যেন কিছুই জানেন না। ছোট খালা এসে বলেন, সে কি রে, এতবড় জোয়ান ছেলে তুই, আর তুই কি না ভূতের ভয়ে ঘরের মধ্যে সেঁদিয়ে রইলি।
অগত্যা বেরুতে হল। কোথায় ভূত, কী বাজে কথা বলছেন, কে দেখেছে—এইসব বলতে সালমাদের আঙিনায় গিয়ে পৌঁছলেন। তারপর রান্নাঘর বাঁয়ে রেখে পেঁপেগাছ ক’টার নিচে দিয়ে অকুস্থলে গিয়ে দাঁড়ালেন। আর ঠিক সেই সময়, সেই পেঁপেগাছের নিচে, ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারে, যখন অদূরে উচ্চকিত বাতির লাল শিখা চমকাচ্ছে, উত্তেজিত ক’জন মানুষ অযথা কলরবে ব্যস্ত, ঠিক তখনই রাশেদ শুনলেন তার কানের কাছে কেউ এসে চাপা গলায় বলছে, কালই চলে যান আপনি, একী পাগলামি আরম্ভ করেছেন? অমন অস্থির হওয়ার কী হয়েছে? পরশু সকালবেলা থেকে যেন আপনাকে আর না দেখি।
কয়েকটি অদ্ভুত ভর্ৎসনার কথা। কিন্তু তা যে কী নিদারুণ হয়ে উঠবে রাশেদ মিয়ার উনিশ বছরের জীবনে তা যদি কেউ জানত?
সারারাত ছটফট করলেন। তারপর সকালে উঠেই আকস্মিকভাবে ঘোষণা করলেন—আজই আমি রওনা হব। আর দেরি করা যায় না।
ছোট খালা একটুখানি অবাক হলেন। কেমন যেন ধরেই নিয়েছিলেন রাশেদ বোধহয় আরো কিছুদিন থেকে যাবে তার কাছে। মন খারাপ হল তার। কিন্তু কিছু বলতেও পারলেন না। অনেকদিন হল এসেছে ছেলেটা, এতদিন তো আটকে রাখলেন, আর কত?
কিন্তু রাশেদ ভাবছিলেন অন্য কথা। কেন সালমা তাঁকে চলে যেতে বলল? কেন একেবারে দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে দিতে চায়? ও কি মনে করেছে ওকে আমি বিপদে ফেলব? ওর ঘোরতর অপমান হয়ে যাবে আমি এখানে থাকলে? নাকি সালমা ভাবছে, আমি আপদ বিশেষ, আমি চলে গেলেও ওর শান্তি। সালমার গলার স্বরে ঝাঁঝ কতখানি তীব্র ছিল, তাই স্মরণ করে দেখলেন বারবার করে।
তবে স্থির কোনো ধারণায় আসতে পারেন না। একেক সময় অভিমান হয়। ভাবেন, সেই ভালো, চলেই যাবেন, যদি তাতে সালমা খুশি হয়।
সারা সকাল ঘরবার করলেন। অসহ্য একটা কষ্ট বুকের ভেতরে মাথা কুটে তাঁকে প্রাণান্ত করল। একটু একটু করে দুপুর হল। মুহূর্তের পর মুহূর্ত ক্ষয়ে আসতে লাগল, কেটে যেতে লাগল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু সালমাকে চোখের দেখাও একবার দেখতে পেলেন না। বড় আশা ছিল তার-একবার অন্তত সালমা কোনো-না-কোনো ছুতোয় দেখা করবে। বেলা গড়িয়ে গেলে জিনিসপত্তর গোছাবার সময় আরো ঘা খেলেন। মন আরো দমে গেল। তার গল্পের বই ‘দত্তা’ ছোট খালার কাছ থেকে পড়তে নিয়ে গিয়েছিল সালমা। দেখলেন, বইখানা কখন আবার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে গেছে।
বইখানা হাতে নিয়ে বসে থাকলেন অনেকক্ষণ। বুকের ভেতরে তখনও কষ্ট। মনে হচ্ছে, বড় আশার, অনেক সাধনার ধন কেউ যেন দিতে চেয়েও না দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল। একবার ভাবলেন, না এ বই আর ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন না, থাক পড়ে এখানেই। আরেকবার ভাবলেন, বইখানা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে রেখে যাবেন।
কিন্তু কোনোটাই হয়নি। বইখানা ছিঁড়তে মন সরেনি, ফেলে যেতেও পারেননি। কেবলি মনে হচ্ছিল, বইখানায় সালমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে। মনে হচ্ছিল, এ বই সালমা শুয়ে শুয়ে বুকের ওপর রেখে পড়েছে। সেই উনিশশো পঁয়ত্রিশের রাশেদ আহমদ, উনিশ বছরের তরুণ রাশেদ, সায়ীদাবাদ থেকে ফিরেছিলেন বুকের ভেতরে কষ্টের ভার নিয়ে। কাউকে বলার উপায় ছিল না। কোনো প্রতিকারের আশা ছিল না। প্রাচীন আভিজাত্য আর কঠিন শাসনের দেয়াল ভেদ করে বুকের কথা মুখ ফুটে বলবার ক্ষমতা কারুরই ছিল না। হ্যাঁ, সেই উনিশশো পঁয়ত্রিশেও। বুদ্ধদেব বসুরা যখন ‘রজনী হল উতলা’ লিখে ফেলেছেন, নজরুল যখন উল্লসিত প্রেমের বন্দনা গান করেছেন-তখনও বাঙালি মুসলমান ঝিমোচ্ছে। অনন্ত অন্তঃপুরে তখনও কালের যাত্রার ধ্বনি কোনো প্রতিধ্বনি তুলতে পারেনি। কিন্তু সালমা বেগম?
তখন কত বয়স ওর। চৌদ্দ, না পনেরো? নাকি ষোলো? বলতে পারবেন না, ঠিক কত বয়স হয়েছিল সালমার। তবে সালমা ঐ ‘দত্তা’র শেষ পৃষ্ঠায় পেনসিল দিয়ে ঠিকই লিখে রেখেছিল-“নরেন খুব ভালো লোক, সে ধৈর্য হারায় নাই বলিয়া বিজয়াকে পাইয়া ছিল। নরেনকে আমার খুব ভালো লাগিয়াছে।”
এখনো যেন মেয়েলি ছাঁদে অপটু হাতের লেখাগুলো দেখতে পান।
কী ছেলেমানুষি সালমার! ঐটুকু লেখায় নিজের মনের কথা কতটুকু আর প্রকাশ পায়? কিন্তু ঠিক অপেক্ষা করেছিল সে। এক বিয়ের প্রস্তাবে পা মচকে গিয়েছিল, আর এক প্রস্তাবে অসুখ বাধিয়ে বসল। তারপরের প্রস্তাবের সময় ঘটকের টাকে কে যে ইট ছুড়ে মেরেছিল ছাদের ওপর থেকে, সে-ব্যাপারটা এখনো রহস্য হয়ে রয়েছে সবার কাছে। ঐ ঘটনার পর আর কোনো প্রস্তাব আসেনি।
রাশেদ সাহেব ব্যাপারটা আগাগোড়া স্মরণ করে হাসেন।
সে-যুগেও সালমা যা করেছিল তা আর দশটা মেয়ে করত না, সে-যুগেও তো আমরা মিসফিট ছিলাম, আর এ-যুগেও ঐ মিসফিটই রয়ে গেলাম, তার মনে হয়, সালমা বেঁচে থাকলে কী হত? সেও কি বদলাতে পারত? কে জানে। উনিশশো পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়ষট্টি। ত্রিশ বছরের পার্থক্য-কিন্তু পঁয়ত্রিশ বছরের এ সময়টা গেল কী দ্রুত, কী প্রবল স্রোতের আবর্তে ভরা। তখন ছিল সংস্কার আর এখন বাধা হয়েছে টাকাপয়সা। তবে টাকাপয়সার হিশেবটা তখনও ছিল। মেয়ের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আর ভবিষ্যতের কথা কেউ কেউ তুলেও ছিলেন। কিন্তু আসল ব্যাপার ছিল মুরব্বিদের কথা টিকবে, না ছেলেমেয়েদের কথা টিকবে? ভালোবাসা নয়, সততা নয়, আন্তরিকতা নয়। ওসব কিছুই নয়, কর্তৃত্ব জাহিরের ব্যাপারটাই আসল।
সালমা বাপের বাড়ির লোকজনের কোনো কথা মানেনি। ওর জেদ কোথায় গিয়ে ঠেকত কে জানে, ছোট খালা আর খালুজান না থাকলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেত নিশ্চয়ই।
সালমার ঐ জেদ, তার ভালোবাসার ঐ জেদ বিয়ের পরও ছিল। বাপের বাড়ি যেতে চাইত না। বলত, ওখানে গেলে সবসময় তোমার কাছে থাকা যাবে না, ওখানে আমার যেতে ইচ্ছে করে না।
এখন বোঝেন, সালয়া আসলেই জীবনকে ভালোবেসেছিল-তার সেই ভালোবাসা কখনো স্বামীকে, কখনো সন্তানকে, কখনো সংসারকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রাখতে চেয়েছে।
কিন্তু সময়কে ঠেকাতে পারল?
সময় নিজের নিয়মে বয়ে গেল। কারো মুখের দিকে তাকাল না, ইচ্ছে- অনিচ্ছের কথা ভাবল না। তার আপন খেয়ালে কখনো বেগে, কখনো ধীরে জীবনকে রক্তাক্ত করে চলে গেল। একেক সময় প্রশ্ন জাগে, সময় জীবনের এত বিস্ময়কর চেহারা দেখাতে পারে কেমন করে? তাহলে কি সময় মাত্রই দুর্বোধ্য বিস্ময়ে ভরা? আগের থেকে জীবনকে কোনোভাবেই দেখতে দেবে না? শুধুই আড়াল করে রাখবে? তিনি নিজে তো শক্তপায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। ভবিষ্যতের একটা ছবিও ছিল তার সামনে। কিন্তু জানতেন কি সালমা থাকবে না, জানতেন কি, মনি মরে যাবে?
এখন তার মনে হয়, সময় শুধু হতাশা, পরাজয় আর মৃত্যু বয়ে আনে। সময় মানেই দুঃখ আর যন্ত্রণা। সময় শুধুই গ্রাস করে নেয় সবকিছু, বাকি রাখে না কিছুই। জীবনকে শুধুই অজগরের মতো গিলে গিলে খায়
এ-সবই আবেগতাড়িত মনের কথা। স্ত্রী আর ছেলের কথা মনে এলে ভীষণ কষ্ট হয় তার। যখন গুছিয়ে আনছিলেন সবকিছু, যখন মনমতো সংসার সাজাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন-তখনই চলে গেল সালমা, তারপর মনি।
রাশেদ সাহেব একাকী ঘরে আরো কিছুক্ষণ হয়তো থাকতেন। স্মৃতিচারণার মধ্যে আরো হয়তো ডুবতেন। কিন্তু একাকী থাকা গেল না। শুনলেন রাখী ডাকছে, আব্বা গোসল করে নিন, বেলা হল।
মেয়ের মুখের দিকে চোখ তুললেন। দেখলেন, ঠিক যেন সালমা। গলার স্বরটা পর্যন্ত অবিকল মায়ের পেয়েছে। সেই ছোট্ট কপাল, ধারালো নাক, কোমল চিবুক আর উজ্জ্বল কালো চোখ-এমনকি ঠোঁটের ডৌল, আর বাঁ চোখের নিচের ছোট্ট তিলটি পর্যন্ত।
এ মেয়ের কপালে দুঃখ আছে দেখে নিও, মায়ের চেহারা মেয়েদের পেতে নেই-সালমা প্রায়ই বলত।
রাখীর দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখলেন। মেয়ের মনে এই মুহূর্তে কষ্ট না খুশি, অনুভব করতে চাইলেন। একটু পর সহজ হবার জন্যে নিজের মনে হেসে উঠলেন আবার কী বাজে একটা কুসংস্কার, মিছিমিছি তিনি ও মেয়েলি কুসংস্কারের কথা ভাবছেন। একসময় ডাকলেন, রাখীবাঈ!
শান্ত গলার স্বর। রাখী বুঝল আব্বা আজ পুরনো কথা ভাবছেন। আব্বা যখন নিজের মনের ভেতরে একাকী হয়ে যান তখনই এরকম হয়। তখনই তার গলায় এমনি স্বর বেজে ওঠে। সে এগিয়ে গেল দু’পা। আব্বার মাথায় হাত রাখল। পাকা চুল টানল দুটো-একটা আর অপেক্ষা করল, আব্বা কোন্ কথা বলেন।
রাখীবাঈ, রাশেদ সাহেব বলেন, আমার কেমন যেন মনে হয়, তুই নিজের কথা একদম ভাবিস না। নিজের কথা ভাববার সময় হয়েছে তোর। এম. এ. পাস করলি, এরপর তোর ভাবনা অন্য কেউ ভেবে দেবে না।
আচ্ছা সে নাহয় ভাবব, এখন গোসল করতে যান-রাখী আব্বাকে তাড়া দেয়।
রাশেদ সাহেব মৃদু হাসেন। মেয়ে যে তাঁকে পুরনো ভাবনা-চিন্তা থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে তা বোঝেন। বলেন, রাখীবাঈ, তোর জন্যে আমার ভাবনা হয়।
কিন্তু আমি যে নিজের কথা ভাবি না, এমন কথা কে বলেছে? রাখী বলে।
রাশেদ সাহেব মেয়ের চোখের দিকে তাকান, সত্যি তুই নিজের কথা ভাবিস?
হ্যাঁ আব্বা, ভাবি, ভাবতাম না আগে, কোনোদিন ভাবিনি, এখন ভাবছি।
কিন্তু-রাখী থামে।
কিন্তু কী?
কিন্তু ভেবে কী লাভ আব্বা, যা ভাবি, তা তো হয় না।
রাশেদ সাহেব ঈষৎ চমকান মনের ভেতরে। রাখীর অবস্থাও কি তার নিজের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে? রাখীর কথার পর আর কথা বেরুতে চাইল না তার। সত্যি তো, যা ভাবা যায় ঠিক সেইরকম ঘটনা তো কখনো ঘটে না।
আব্বা, আমি ঠিক বুঝতে পারি না, রাখী যেন বলার মতো অনেক কথা একসঙ্গে খুঁজে পায়। বলে, একেক সময় মনে হয়, আমার যেন কত কিছু করবার আছে। আবার একেক সময় মনে হয়, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। আমার দায় নেই, দায়িত্ব নেই। একেক সময় আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না আব্বা।
মেয়ের কথা শুনে অস্পষ্ট ভয় কাঁপে রাশেদ সাহেবের বুকের ভেতরে। মনে পড়ে মনি অমন কথা বলত। যখন ও শয্যাশায়ী তখন একদিন এইরকম কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ওর সেই প্রশ্ন শুনে আজকের মতোই কেমন একটা অজানা ভয় কেঁপে গিয়েছিল বুকের ভেতরে। মনি জিজ্ঞেস করেছিল, মানুষের জীবন এমন কেন আব্বা? কেবলি ক্ষয়ে যায়? নতুন করে কিছু গড়া কি কিছুতেই সম্ভব নয়?
মনির কথা তখন তিনি বুঝতে পারেননি। আজ রাখীর কথায় মনির সেই বিষণ্ণ এবং অচেনা প্রতিধ্বনি শুনলেন যেন। তার পুরনো স্মৃতি, তার চিন্তাভাবনা, তার সাধ, ভালোবাসা, সমস্ত কিছু মথিত করে ভবিষ্যৎ তার চোখের সামনে প্রকাণ্ড একটা প্রশ্ন হয়ে দুলে উঠেছিল সেদিন। আজও সেই
প্রশ্নটাকে যেন দোল খেতে দেখলেন চোখের সম্মুখে। জীবন মানেই কি খালি ব্যর্থতা আর মৃত্যু? জীবনকে কি নিজের পথে কিছুতেই আনা যায় না?
প্রশ্নটা ফের নতুন করে জেগে উঠল তার মনের ভেতরে। আর তাতেই ভয় কাঁপল বুকে। ভয় তো অন্যকিছুতে নয়, ভয় অচেনাকে, অস্পষ্টতাকে, দুর্বোধ্যতাকে, সন্দেহকে। ইচ্ছে হল বলেন, রাখীবাঈ, জীবনকে তুই সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছিস-এ বড় বিপজ্জনক—তুই যে কী করবি, সেটা তুই নিজেই জানিস না। কথাটা তার বলতে ইচ্ছে হল, কিন্তু শেষপর্যন্ত বলেন না। কেননা নিজের জীবন দিয়েই তো জানেন, যে ভয় সম্পর্কে সাবধান হওয়া যায়, সেই ভয়ই জীবনকে ঘিরে ধরে চারদিক থেকে। সাবধান হয়েও কিছু হয় না।