তিন
বর্ষা প্রায় শেষ। শরৎ পাঁজিতে এসেছে অনেকদিন-কিন্তু আসল চেহারায় দেখা দিয়েছে অল্প ক’দিন হল। হালকা শাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে আকাশে। বাড়ির গেটের কাছে কামিনীগাছে ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে। শিউলিগাছে অসংখ্য কুঁড়ি—দুএকদিনের মধ্যে ফুলের মহোৎসব দেখা যাবে। লনের দুপাশে দোপাটি এখন কমে আসছে। একাকী বারান্দায় দাঁড়ালে কেমন ছুটি-ছুটি ভাব লাগে।
রাখী আজকাল একেক দিন বাইরে বার হয়। হ্যাঁ, একাকী। কোনোদিন নাসিমার কাছে যায়। কোনোদিন নার্গিসদের বাসায় আসে। তারপর দুজনে মিলে সিনেমা— কিংবা শুধুই পথে পথে বেড়ানো!
নার্গিসের বেশি উৎসাহ। মেয়েটা দিনকে দিন যেন খেপে উঠছে। কায়সারের অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। ওর দিকে আর ও মনোযোগ দিতে চায় না। এখন সিরাজ, নতুন সি.এস.পি. সিরাজের সঙ্গে দেখা হলে ভারি মিষ্টি করে হাসে। কথা বলে খুশিখুশি গলায়। রেস্তরাঁয় বসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। অথচ ঐ সিরাজের সঙ্গে বছরখানেক আগে কী ব্যবহারটাই না করেছিল। আর এমন ফাজিল হয়েছে নার্গিস আজকাল। একদিন বলল, রাখী টেবিলের নিচে কোনো ছেলের পা মাড়িয়ে দিয়েছিস কখনো!
রাখী অবাক, কেন!
একদিন কারো পা মাড়িয়ে দিয়ে দেখিস, কী হয়।
বাহ্ মিছিমিছি একজনের পা মাড়াতে যাব কেন?
আহা মাড়িয়ে দেখিস না একদিন, নার্গিস হাসে। বলে, দেখবি কীরকম খেলা শুরু হয়ে যায়। ফর্সা লোক হলে দেখবি লাল টকটকে হয়ে যাবে। তুই তো হঠাৎ লেগে-গেছে এরকম একটা ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে থাকলি-কিন্তু ঐ বেচারার হয়ে যাবে মুশকিল। ভেবে ভেবে কূল পাবে না, এটা তোর ইঙ্গিত, নাকি নেহাতই অ্যাকসিডেন্ট।
রাখী নার্গিসের চোখে চোখ রাখে, তুই ঐরকম করেছিস কখনো?
হ্যাঁ কত্তো—সেই ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই কত পা মাড়ালাম। আর একটা কায়দা আছে—
নার্গিস তারপর তার নতুন কায়দা বর্ণনা করে। আর রাখীকে বসে বসে তাই শুনতে হয়।
নার্গিস কত যে ভাবে ঐসব। একদিন রাখীর বিরক্ত লাগে। প্ল্যান করে ঐরকমভাবে প্রেম করা আর দিনরাত ঐসব চিন্তা নিয়ে থাকা-কেমন করে পারে মানুষ! একদিন বলেছিল, তোর এখনো ঐসব ভালো লাগে নার্গিস? কোন্ সব?
এই যে এক্ষুনি বললি, ছেলেদের নিয়ে খেলা করতে?
হ্যাঁ, মজার জিনিস না এসব! কেন, তোর ভালো লাগে না?
না, রাখী নজর দূরে সরিয়ে নিয়ে জানিয়েছিল, আমার ভারি বিরক্ত লাগে।
নার্গিস বিচিত্র-চোখে তাকিয়ে দেখেছিল রাখীর দিকে সেদিন। তারপর বলেছিল, কী জানি বাপু, তোর কী ধারণা জীবন সম্বন্ধে। আমার কিন্তু ভাই গম্ভীর আর কাঠখোট্টা হয়ে থাকা পোষাবে না।
রাখী সেদিন আর কথা বাড়ায়নি। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করেছে নার্গিসকে। তবে হ্যাঁ, নাসিমাকে বেশ লাগে ওর। ওদের বাড়িতে হৈচৈ কম। বারান্দায় বসলে শান্ত হয়ে আসে মনটা, এমনিতে ফ্ল্যাটবাড়ি, কিন্তু ভারি চুপচাপ। বারান্দায় দেয়ালজুড়ে মানিপ্ল্যান্টের লতাপাতা-ঘরময় সবুজ রঙের ছায়া।
আর নাসিমাও অমনি, ওদের বাড়ির মতোই ধীর, শান্ত। কথা বলে কত কম। জিজ্ঞেস করলে বলে, না রাখী, আমার অন্য কোনো অ্যাম্বিশান নেই, আমি কিছু হতে চাই না। জীবন যেমন আসে, তেমনিভাবে গ্রহণ করার জন্য আমি তৈরি।
রাখী কথাটা বুঝতে পারে না। ইউসুফের কথা মনে পড়ে যায়। জানতে ইচ্ছে করে, ইউসুফকে নিয়েও কি তোর কোনো অ্যাম্বিশান নেই? কিন্তু কিছু বলে না। লাভ নেই কোনো। কোনো ব্যাপারেই ওর নিজের কোনো মত নেই। ইউসুফ একটা মফস্বল কলেজে চাকরি নিয়েছে। ওর একটা ভালো চাকরি জুটুক, শুধু এইজন্যে ওর অপেক্ষা তারপর?
তারপর আবার কী! মানুষের জীবন যেরকম হয়, আমারও তেমনি হবে। ঘর-সংসার পাতব, স্বামীকে ভালোবাসব, ছেলেপুলে মানুষ করব—এই তো সবাই চায়। বল্, চায় না? রাখীর দিকে তাকিয়ে নাসিমা শুধায়।
রাখী চুপ করে থাকে। সত্যিই কি সবাই তাই চায়? সে নিজে কি তাই চেয়েছে? বিয়েটা কি খুবই দরকার? বিয়ে করে সুখী হওয়াতেই কি জীবনের আসল সুখ? কই, সে নিজে তো কখনো সেরকম ভাবেনি! আর ভালোবাসা কাকে বলে নাসিমা? ইউসুফকে যদি না পাস তুই তাহলে? তাহলে কি তোর সুখ উবে যাবে? তাহলে কি ভাববি, তোর সমস্ত জীবনের সাধ ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে?
মনে-মনে বলে এসব রাখী। নাসিমা জানতে পারে না। পারলেও অবশ্যি নাসিমা কিছু মনে করত না। আর নাসিমাকে সেজন্যেই ওর ভালো লাগে। রাখী, একদিন নাসিমা শুধাল, তোর কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে মানে? রাখী হাঁ হয়ে থাকে।
মানে বিয়ে, না চাকরি।
রাখীর হাসি পায় তখন। বলে, কী জানি, আমিও তোরই মতো ভবিষ্যতের কাছে হাত পেতে বসে আছি, যা পাই তাতেই আমার চলবে। শুধু তোর ইউসুফ আছে, আমার কেউ নেই।
নাসিমা অস্পষ্ট হাসে। বলে, সত্যিই কি কেউ নেই?
রাখীর তখন চিন্তা হয়। সত্যিই কি কেউ নেই? তার এই একুশ বছর বয়স হল-সুন্দর চেহারা, আর এমন স্বাস্থ্য। হ্যাঁ স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য বলতে কী বোঝায়? রাখীর রাগ হয় শব্দটা শুনলে খবরের কাগজের লোমনাশক সাবানের বিজ্ঞাপন যেন। হ্যাঁ, এই চেহারা আর স্বাস্থ্য-এই নিয়ে সে একুশ বছর পর্যন্ত চলে এল। এর মাঝে কি কেউ নেই? কেউ কি এসেছিল তার জীবনে?
রাখী যখন ভাবে, তখন ক্লাসের সব ছেলেমেয়েদের মুখ একসঙ্গে ভেসে ওঠে। শুধু য়ুনিভার্সিটি নয়, ইস্কুলে পড়ার সময়কার পাড়ার ছেলেরা, কলেজে পড়ার সময় যেসব ছেলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত, সবার চেহারা একসঙ্গে দেখতে পায়। আর তখন বেদম হাসি পায়।
নাসিমা আহত হয়। বলে, থাক্ ওসব কথা, তোর খালি ঠাট্টা-অন্য কথা বল।
রাখীকে কিন্তু নাসিমার কথাটা বেশ ভাবিয়ে তুলল। নাসিমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সারাটা পথ রিকশয় ভাবতে ভাবতে এল সে। সত্যিই তো, কেউ কি তার জীবনে এসেছিল। একবার মনে হয় জামান সাহেবকে। জামান সাহেবকে তবে কি সে ভালোবাসে? পরক্ষণে আরেকটি ছেলের মুখ ভেসে ওঠে। ছেলেটির নাম জানে না সে-আবু বকর নাকি আবু সায়ীদ, এই ধরনের কী একটা নাম হবে। সে ফার্স্ট ইয়ারে তখন—ছেলেটি একদিন নির্জন সিঁড়িতে হাত চেপে ধরে বুকের কাছে টেনে নিতে চেয়েছিল রাখীকে। আর কী যে হয়েছিল সেদিন, অমন যে ধীর শান্ত, ভিতু ভিতু চেহারার রাখী-সেই রাখী সেদিন ভয়ানক খেপে গিয়ে চড় থাপ্পর মেড়ে আঁচড়ে খামচে একাকার করে দিয়েছিল ছেলেটিকে। কান্নাকাটি করে সে এক ভয়ানক সীন। আর ঐরকম চিৎকার শুনে চারদিক থেকে অন্য ছেলেরা ছুটে এসে কী মার ছেলেটাকে! বেচারাকে যুনিভার্সিটি থেকে চলেই যেতে হল।
এখন খারাপ লাগে কথাটা ভাবলে। নিজের ওপর রাগ হয়। কী হত? হাত ধরেছিল, কাছে টেনেছিল—তাকে শান্তভাবে বুঝিয়ে দিলেই তো পারত। বেচারা গাঁয়ের বড়লোকের ছেলে, মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। সে নিজে অতটা না করলেও পারত। কতদিন ছেলেটার আহত রক্তাক্ত মুখ তার মনের মধ্যে হানা দিয়ে ফিরেছে।
নাকি সেই ছেলেটাই!
রাখীর এখন চিন্তা হয়। সেই ছেলেটাকেই কি নিজের অজান্তে তার ভালো লেগেছিল? ভালো না-লাগলে তার জন্যে কষ্ট কেন হয়েছিল পরে? কেন তার কথা ভেবে খারাপ লাগত?
কে জানে-রাখী বলতে পারে না, কেউ এসেছিল কি না তার জীবনে। একেক সময় কীরকম মনে হয়, কেউ যেন আছে। আছে একটি অপরিচিত মানুষ-যার দীর্ঘ দেহ সে মনের ভেতরে দেখতে পায়, যে আছে আবছা ছায়ার আড়ালে। যার হাত দেখতে পায়, পা দেখতে পায়-দূর থেকে দেখা কুয়াশার মধ্যে একটা শিলুয়েটের মতো ছায়াও দেখা যায়, কিন্তু মুখটা দেখা যায় না। মুখ স্মরণ করতে পারে না। সে একবার মনে হয় জামান। পরক্ষণে মনে হয়, না জামান নয়। বোধহয় আবু বকর না আবু সায়ীদ, নাকি আরো অন্য কেউ? যে ছিল কাছাকাছি, যে তার অজ্ঞাতে মনের ভেতরে একটা ছায়া রেখে গেছে শুধু, যাকে ধরতে পারছে না সম্পূর্ণ করে। অথচ সে সবসময় রয়েছে তারই কাছাকাছি।
কে সে? ভাবতে ভাবতে রাখী হয়রান হয়ে যায়। শেষে নিজের ওপরই বিরক্তি হয়। ধুত্তোর, কীসব ভাবতে আরম্ভ করেছে সে আজকাল। এসব ভাবনা তো তাকে কোনোদিন ভাবতে হয়নি। আলসেমিতে থাকলে বোধহয় এ-ই হয়। নাসিমা, নার্গিস ওদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করলে এইসব উদ্ভট চিন্তা ঘুরেফিরে এসে মনের মধ্যে হানা দেবেই।
সুতরাং সে বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দিল। বরং সংসারের কাজের দিকে মন দেবে বলে ঠিক করল। আর সেইসঙ্গে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে একটার পর একটা দরখাস্ত ছাড়তে লাগল।
কিন্তু মজা হল, বাইরে দরজা বন্ধ করে দিলেই কি আর বাইরের পৃথিবীটা উবে যাবে?
একদিন আব্বা এসে খবর দিলেন, রমজান সাহেবের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে শিগগিরই। রমজান সাহেব মানে নাসিমার আব্বা।
রাখীর অবাক লাগে। কী মেয়ে নাসিমা, ভাবো? বিয়ে এত কাছে কিন্তু খবরটা তাকে জানায়নি। তবে কি ইউসুফ কোনো ভালো চাকরি পেল? আব্বা আরেক দিন এসে জানালেন, সেজান আর বাবর আলীর মুক্তির দাবিতে প্রসেশন বেরিয়েছে দেখলাম। আরেক দিন হাসান ভাই এসে বলেন, জানো রাখী বিবি, তোমার জন্য একটি চাকরি ঠিক করতে যাচ্ছি, বেশ মোটা সাইনের চাকরি, করবে তো?
এইসব খবর রাখীকে ভাবায়। আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। দ্যাখে রাস্তায় চলমান মানুষ, শরৎকালের নীল আকাশ, য়ুক্যালিপটাসের দোল খাওয়া ডাল আর কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। একদিন দ্যাখে লনের ওপর একঝাঁক প্রজাপতি উড়ছে। কোথায় দূরে একটা পাখি ডেকে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে-ভারি তীক্ষ্ণ গলার স্বর, কিন্তু দেখা যায় না পাখিটাকে-বোধহয় দোয়েল। রাখী এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে দ্যাখে পাখিটাকে।
আর এমনি একাকী সময়ে একদিন সে বেরুল। না, কারো কাছে যাবে না সে। একাকী ঘুরবে রাস্তায় রাস্তায়। কিন্তু রাস্তায় ঘোরা হল না। মাঝপথে সুমিতার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
সুমিতা কোথায় যেন যাচ্ছে। ঘাড়ে একটা ব্যাগ ঝোলানো, রিকশর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সুমিকে দেখে রাখী রিকশ থামাল। কতদিন সুমির সঙ্গে দেখা হয় না। ওর হোস্টেল য়ুনিভার্সিটির কত কাছে, কিন্তু গত চার বছরের যে ক’দিন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তা হাতে গোনা যায়! রিকশয় উঠলে শুধাল, কি রে তোর ব্যাগে কী?
কিছু না, এই সামান্য কাগজপত্র-তুই কোথায়?
এমনি ঘুরছি।
তোর পরীক্ষার খবর কে যেন বলছিল। সেদিন সুমিতা জানায়। বলে, সময় হয় না, হাসপাতালে কাজের চাপ বেড়েছে, এদিকে আবার রাজবন্দিদের মুক্তির জন্যে ছোটাছুটি যাচ্ছে। ভেবেছিলাম যাব একদিন।
বুবু কেমন?
ভালো।
কী করবি এবার?
রাখী ধাক্কা খায় মনে-মনে। ঐ এক প্রশ্ন, কী করবি এবার? কিছু বলে না রাখী। শুধায়, এদিকে কোথায় যাচ্ছিলি? পরক্ষণে মনে পড়ে, সুমির আবার কিছু কিছু রাজনীতির সঙ্গেও সম্পর্ক আছে। বলে, পার্টির কোনো ব্যাপার নাকি?
সুমি হাসে, না, রাজনীতির ব্যাপারে তোরও অ্যালার্জি হয় নাকি আজকাল? রাখী বুঝতে পারে না। বলে, কী রকম?
আজকাল ছেলেমেয়েরা রাজনীতি করছে দেখলে লোকে ঠাট্টা করে। সে যাক, যাবি আমার সঙ্গে?
কোথায়?
দূরে নয়, কাছেই। পেইন্টিং-এর একজিবিশন হচ্ছে প্রেসক্লাবে।
রাখীর এমনিতেই কোনো কাজ নেই। ভাবল, বেশ তো, ছবি-টবি দেখা যাবে, নতুন ব্যাপার হবে একটা। তবু জিজ্ঞেস করে, খুব অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু নয় তো?
সুমি হাসে, কেন?
আমি ঐ অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি একদম বুঝতে পারি না।
প্রেসক্লাবের গেটের কাছে পৌঁছে দ্যাখে, নার্গিস। সঙ্গে সিরাজ আর কায়সার। ওরা তিনজনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
রাখীকে দেখে নার্গিস হেসে উঠল, কী রে তুইও এসেছিস?
রাখীকে কায়সার শুধাল, কী খবর, ভালো?
হ্যাঁ, ঘাড় কাত করে রাখী। মৃদুস্বরে পাল্টা শুধায়, আপনি ভালো?
সিরাজও পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে, কী খবর?
রাখী জবাবে হাসে শুধু। নার্গিসের কাণ্ড দেখে ভারি অস্বস্তি লাগছে তার তখন। কী কাণ্ড দ্যাখো, দুই প্রেমিককে দুপাশে নিয়ে সে একজিবিশন দেখতে এসেছে। একবার ভাবল, সুমিকে বলবে কথাটা। সুমি তখন বারান্দায় উঠে গেছে। কাছাকাছি এগিয়ে সে ডাকে, সুমি শোন্!
ঐসময় সে চোখটা ডাইনে ফিরিয়েছে আর অমনি চমকে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাকে। হ্যাঁ, গেটের ডানদিকে লনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।
দাঁড়ালি কেন? আয়, অনুচ্চ গলায় ডাকে তখন সুমি।
সুমির ডাকে চমক ভাঙে রাখীর, প্রায় বিভ্রান্ত স্বরে জবাব দেয়, হ্যাঁ চল্।
পেইন্টিং-এর একজিবিশন। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য সম্ভবত কয়েকজন শিল্পীর এই আয়োজন। কামরুল হাসান, আমিনুল ইসলাম, রশীদ চৌধুরী আরো যেন কে কে-রাখী সবার নাম জানে না। সুমিতা মনোযোগের সঙ্গে ছবি দেখছিল। ইতিমধ্যে নার্গিস এসেছে, কোন্ সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি। ফিসফিস করে নিজের থেকেই বলে চলেছে। যেন রাখীকে ছবি বোঝাবার দায়িত্বটা তার ওপর দিয়ে রেখেছে কেউ। একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, দ্যাখ্ একেই বলে এক্সপ্রেশনিজম। সেই যে ভ্যানগগ, একটা ফিলিম এসেছিল ঢাকা, দেখিসনি? লাস্ট ফর লাইফ, ঐ ভ্যানগগ-পাগল মতো আর্টিস্ট-নিজের কান কেটে একটা মেয়েকে উপহার দিয়ে এসেছিল। আর ওর এক বন্ধু ছিল, নাম বোধহয় গগাঁ— সাউথ সী আইল্যান্ডে চলে গেল ছবি আঁকবার জন্য। ঐখানেই পরে বেচারা মারা পড়ল। ওঁরাই হলেন এক্সপ্রেশনিজমের সার্থক শিল্পী।
কে শোনে কার কথা। স্লবারির চূড়ান্ত একেবারে। সিরাজকে ওদিকে আবার কায়সার বোঝাচ্ছে-আমিনুল কেন যে কিউবিজমের দিকে ঝুঁকল, ওদিকে তো ওর হাত খোলে না। নার্গিস যেন মুগ্ধ হয়ে গেছে এমনি ভাব করছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছে-উহ্ বিউটিফুল! দ্যাখো দ্যাখো, এ ছবিটি দ্যাখো—কী সুন্দর ড্রয়িং। রঙের কাজই কি কম? তবে বোধহয় এখানে ভারমিলিয়ন রেডটা না দিলেই পারত। দেগা’র একটা এইরকম ছবি দেখেছিলাম। দেগা কিউবিস্ট না?
কায়সারকেই বোধহয় জিজ্ঞেস করেছিল। কায়সার জবাব দিল, তুমি বোধহয় ডালি’র কথা বলছ। তবে পিকাসো আর ব্র্যাক-
রাখী বাকিটুকু শুনতে পেল না। সুমিতা হাত ধরে টানল, এদিকে আয়-কী সব বকবকানি শুনছিস।
রাখী আসলে কিছুই শুনছিল না। কেবলি সেজানের কথা মনে আসছিল। কেবলি মনে হচ্ছিল, এই এক্ষুনি এসে পড়বে সেজান। এসেই শুধাবে, কী করবে এবার? এম. এ. পাস তো হল।
সেজানের অন্য কথা মনে নেই। শুধু ওই একটি কথা মনে আছে। মনি ভাইয়ের ঘাড়ে হাত রেখে শুধাচ্ছে, কী করবে এবার রাখী?
বারবার করে মনে পড়ে। ঘুরেফিরে ঐ একটা আশঙ্কা চমকে চমকে উঠতে থাকে মনের ভেতরে। কতদিন পরে আজ দেখল। রাখীকে কি দেখেছে সেজান? দেখলেও কি চিনতে পেরেছে?
রাখী, তোর কী হল? সুমিতা জিজ্ঞেস করে, কী ভাবছিস?
রাখীর যেন সম্বিত ফেরে। বলে, কই না তো, কিছু ভাবছি না তো!
আয় ওদিকে যাই।
রাখী তখন সেজানকে দেখতে পাচ্ছে। সে বারান্দায় আলোর নিচে এসে দাঁড়াল। আগের চাইতে ভালো হয়েছে স্বাস্থ্য। দুচোখের নিচেকার চিরকালের কালো দাগটা মুছে গেছে। শাদা ধবধবে পোশাক। যার সঙ্গে কথা বলছিল, সে ডাকে, চলুন বেরুনো যাক।
রাখী দেখল, সেজান এ ঘরের দিকে নজর রেখে বলছে, তুমি যাও, আমি একজনের জন্যে অপেক্ষা করছি। পরে দ্যাখা কোরো।
সেজানের কথা শুনে রাখীর জানতে ইচ্ছে করে, আর কে আছে এখানে, কার জন্যে অপেক্ষা করছে সে?
কই, আপনি কিছু বললেন না যে? কায়সার এগিয়ে এসে শুধাল।
আমি কী বলব, রাখী মুখ নিচু করে।
বাহ্ একজিবিশন কেমন লাগছে, কোন্ ছবিটা ভালো লাগল?
রাখী এবার হেসে ফেলল, দেখুন, আর্টের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
ইতিমধ্যে সুমি এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। বলল, নে চল্ এবার যাওয়া যাক।
কেন যে, রাখী ভেবে পায় না। বুকের ভেতরে কেমন করে ওঠে বারান্দার দিকে পা বাড়াবার সময়। বারান্দায় পা রেখেছে, ঠিক তক্ষুনি এগিয়ে এল, এসে একেবারে সামনে দাঁড়াল।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজন। বোধহয় মুহূর্তের জন্য। রাখীকে দেখছে সেজান। রাখী একবার চোখ তুলে তাকিয়ে মুখ নিচু করে নিল। কেবলি মনে হচ্ছিল, এই বুঝি জিজ্ঞেস করবে, রাখী, তুমি কী করবে এবার?
সেজানের গলার স্বর শান্ত, খাদে নামানো। বলল, তোমরা সবাই ভালো ছিলে? কী যে হয়েছে। রাখীর গলা দিয়ে স্বর বেরুতে চাইছে না। মাথা নেড়ে কোনোরকমে বলল, হ্যাঁ ছিলাম।
খালুজান ভালো?
হ্যাঁ, জোর করে নজর তুলল রাখী। এমন কেন লাগছে তার, সেই ইন্টারমিডিয়েট পাস করার সময় যেমন লেগেছিল?
হাসান ভাই কেমন? বুবু?
হ্যাঁ সবাই ভালো,
আপনি?
আ।ম ভালো, তুমি কেমন ছিলে? সেজান হেসে উঠল এবার। বলল, দ্যাখো, কতদিন পর দেখা হল-আর মজার ব্যাপার, আজই আমি ছাড়া পেয়েছি।
রাখীকেও হাসতে হয় তখন। বলে, বাসায় যাবেন, আব্বা আপনার কথা প্রায় বলেন।
হ্যাঁ যাব, আজই যাওয়া উচিত ছিল-খালুজানকে আমার কথা বোলো-আচ্ছা চলি।
রাখীকে অমনি দাঁড় করিয়ে রেখেই সেজান সুমিতাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রাখীর মনে হল, কেমন যেন হঠাৎই চলে গেল লোকটা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওর দীর্ঘ শরীর করবী গাছের আড়াল হল। সুমি ডাকে, আয় চল্ এবার, আর দাঁড়িয়ে কেন? হ্যাঁ চল, রাখী পা বাড়ায়।
হাঁটতে হাঁটতে সুমিতা জিজ্ঞেস করে, কে রে ভদ্রলোক?
মনি ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন।
সুমিতা ঈষৎ বিরক্ত হয়। বলে, ঐ পরিচয়ে কি আমি চিনব?
মনি ভাইয়ের বন্ধু, সেজান আহমদ।
কী করেন?
কী করেন, বড় কঠিন প্রশ্ন। রাখী ডাইনে বাঁয়ে তাকায়। সত্যি তো কী করে সেজান? রাখী নিজেকেই মনে প্রশ্ন করে। শেষে বলে, না কিছু করেন না।
সে কী, কিছুই করেন না ভদ্রলোক?
না, তা নয়। কী যে বলবে রাখী! শেষে বলতে হল, রাজনীতি করেন, ঐ জেলটেল খাটেন আর কী।
সুমি দাঁড়িয়ে পড়ল, তার মানে? কী বলছিস তুই!
কেন?
মানে সেজান আহমদ, যার নামে পোস্টার পড়েছে-যার মুক্তির জন্য দাবি তোলা হয়েছিল, সেই লোক?
কী জানি, হবে হয়তো, পোস্টারের খবর আমার জানা নেই।
সুমি তখন ভীষণ রেগেছে। বলল, আচ্ছা রাখী, এটা কীরকম ভদ্রতা তোর?
মানে? রাখী ঠিক বুঝতে পারে না।
একপাশে ঐভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে তুই অতক্ষণ ধরে কথা বললি। ভদ্রতার খাতিরেও অন্তত আমার সঙ্গে পরিচয়টা তোর করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তুই যে আজকাল কী হয়েছিস
প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়েও বেশ কিছুক্ষণ হাঁটে দুজনে। রাত বেশি হয়নি। ভারি সুন্দর জোছনা উঠেছে আকাশে। বাতাসে কেমন ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। রাখী একবার আকাশের দিকে চোখ ফেরাল। ঝকঝক করছে তারা। সুমির কৌতূহলের শেষ নেই। বলে, কোথায় থাকেন সেজান সাহেব, জানিস?
রাখী অপ্রস্তুত হয়। ভাবে, তাই তো, জিজ্ঞেস করা হল না কোথায় থাকে। সুমিকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে, না, জানি না কোথায় থাকে। বাহ্, এতদিন পর জেল থেকে বেরুল লোকটা, কোথায় উঠেছে জিজ্ঞেস করবি না? আশ্চর্য মেয়ে বাপু তুই।
বাহ্, ও কোথায় থাকে সেটা জেনে আমার কী লাভ?
লাভ আবার কী, সাধারণ সৌজন্য বলে তো একটা কথা আছে। আর অমন করছিলি কেন কথা বলবার সময়? চেনা মানুষের সঙ্গে অমন করে কথা বলে কেউ? মনে হচ্ছিল খুব ভয় পেয়েছিস তুই।
রাখী বিব্রত বোধ করে সুমির কথা শুনে। নিজেকে মনে-মনে প্রশ্ন করে তখন সে, তাই তো অমন করছিলাম কেন আমি? অমন ছেলেমানুষের মতো আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম কেন— ছি ছি। মনের ভেতরে বারবার করে নিজেকে বলতে লাগল, অমন ছেলেমানুষির কোনো মানে হয়!
কি রে, রিকশয় পাশাপাশি অনেকটা পথ আসবার পর জিজ্ঞেস করে সুমি, চুপ করে আছিস কেন, কী হল তোর?
বাহ্, চুপ করলাম কখন? রাখীর ভারি রাগ হয় নিজের ওপর, কেন সে চুপ করে আছে? শেষে বলে, সুমি আজ আর তোর ওখানে যাব না, আমি বরং এবার বাড়ি যাই, রিকশটা থামা।
রাখী সেদিন ঘুমোতে যাবার আগে অনেকক্ষণ জানালার ধারে বসেছিল। বাড়িতে ফিরে আসা অবধি কেবলই মনে হচ্ছিল, কী করবে সে? ঘরে শুয়ে-বসে থাকা, নইলে এখানে-সেখানে এক-আধটু ঘুরে বেড়ানো, এই কি তবে তার জীবন হয়ে দাঁড়াল?
পুরনো কোনোকিছুর সঙ্গে আর সে নিজেকে জড়াতে পারছে না, ক্রমেই যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। নাকি সে বদলাচ্ছে? তার শরীর মন জীবনের একটা ধাপ পার হয়ে নতুন আরেক ধাপের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে? দুচোখে ঘুমের ভার নেমে আসার আগে তার হঠাৎ মনে হল, কারা যেন কথা বলছে কোথায়। কে? সে কান পাতে। কিন্তু না, কানে আসে না তার। তাহলে কি আব্বা কাউকে কিছু বললেন? সারাটা বাড়ি নিঃশব্দ। বারান্দার বাতিটা একাকী জ্বলে যাচ্ছে। নিশ্চয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। হঠাৎ তার মনে হয়, শব্দটা বোধহয় বুবুর ঘর থেকে আসছে। বুবু আর হাসান ভাই কি তাহলে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে ফের? কথাটা মনে হতেই তার মন তেতো হয়ে ওঠে মুহূর্তের মধ্যে। সারাজীবন কি ওরা ঝগড়া করে কাটাবে? সে বুঝতে পারে না।
একসময় নীলবাতি জ্বেলে বিছানায় বালিশ আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়ে সে। বালিশে মুখ ডুবিয়ে রাখে। হ্যাঁ, সে এখন ঘুমোতে চায়। কিন্তু ঘুম আসে না, নানান কথা মনে পড়ে। মায়ের কথা মনে পড়ে, মনি ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, তারপর হঠাৎ মনের ভেতরে সেজানের মুখটা দেখতে পায় সে। ঐ মুহূর্তে হঠাৎ তার গরম বোধ হয়। মনে হয়, কেউ যেন তাকে চেপে ধরে রেখেছে। কাপড়-জামাগুলো ভীষণ আঁটসাঁট লাগে। উঠে বসে কাপড়- জামা আলগা করে। তারপর ফের শোয় সে। জানালার দিকে নজর মেলে রাখে। পর্দা উড়ছে জানালার আর থেকে-থেকে দেখা যাচ্ছে মিটিমিটি কয়েকটা তারা। সে তারা দেখতে দেখতে একসময় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যায়।