তেরো
অফিস থেকে বেরুল একটা বিশ্রী তিক্ততা নিয়ে। অফিসের ব্যাপার নিয়ে আর সে ভাববে না। মাজহার সাহেবের চিঠিটা দেখল। কখন ব্যাগে রেখে দিয়েছে নিজেই জানে না। চিঠিটা হাতে নিয়ে দুমড়াল কিছুক্ষণ। তারপর ফেলে দিতে গিয়ে থামল। কী মনে করে ব্যাগের মধ্যেই আবার রেখে দিল। মাজহার সাহেবের ওপর খামোকা রাগ করার কোনো মানে হয় না। একজন পুরুষমানুষ একটি মেয়েকে যদি ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়,
তাহলে সেটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। হাসান ভাইয়ের কথা মনে পড়ল, লোকটা জানে সবকিছু, তার সম্বন্ধে এত কথাবার্তা হয়েছে, কিন্তু কিছুই বলেনি। হাসান ভাইয়ের ওপরই বরং কিছুটা রাগ হয় তার। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হয়, হাসান ভাই যদি শালীর বিয়ের জন্য মাজহার খানের মতো রোজগেরে পাত্র পছন্দ করে থাকে, তাহলেই বা তার দোষটা কোথায়?
রাখী রিকশয় বসে বসে নিজেকে বোঝাবার জন্যে মনে-মনে নানান যুক্তি দিয়ে গোঁজামিল দিতে চাইল। না, সে ভাববে না। যা ঘটেছে, এটাই তো স্বাভাবিক-সবকিছু স্বাভাবিক, মিছিমিছি সে ভাবছে।
য়ুনিভার্সিটির গেটে দেখা হতেই জামান রাখীর রিকশতে উঠে পড়ল। জামানকে ভারি উজ্জ্বল দেখতে লাগছে আজ।
আমি কিন্তু তোমার ওখানে যাবার জন্যে বেরিয়েছিলাম, এত দেরি করলে কেন?
কেন ডেকেছ? দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা না করে রাখী পাল্টা শুধায়।
চলো, কথা আছে।
কোথায়?
বাসায় যাই আপাতত।
তখন বিকেল, রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। হাসপাতালের সামনে দর্শনার্থীর ভিড়। জামান রাখীর পিঠের দিকে একটা হাতে ঘিরে রেখেছে। রাখীর অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। নিজের মনকে বোঝাতে চায়, এই তো স্বাভাবিক। জামান যে তাকে ঘনিষ্ঠভাবে আকর্ষণ করবে, গতদিনের ঘটনার পর এইতো স্বাভাবিক। এরকমই তো সবার বেলাতে হয়।
জামানের অস্ফুট স্বর গুনগুন করে কানের কাছে, জানো, কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি, রাতে জোছনা ছিল আকাশ ভরানো, শুধু তোমার কথা ভেবেছি। তুমি এত সুন্দর কেন? তোমাকে আমার এত ভালো লাগে কেন? অথচ দ্যাখো, তোমার আমার কোনো দিক থেকেই মিল নেই। আমরা দুজন দুই কাননের পাখি, এক রজনী দুইটি শাখার শাখী, তোমার আমার মিল নাই- মিল নাই, তাই বাঁধিলাম রাখী।
জামান গুনগুন করে চলেছে অনবরত। রাখী কিছু বলছে না। কী বলবে সে? একটা দিশেহারা আবেগ তখন তার বুকের ভেতরে মাথা কুটতে আরম্ভ করেছে। এ কোথায় যাচ্ছি আমি? কোন্ সর্বনাশ আমাকে টানছে? জামানের মুখের দিকে চাইল একসময়। কাছ থেকে জামানকে দেখতে অন্যরকম লাগে। জামানের কোটের বাটন হোলে গোলাপকলি। অস্পষ্ট হাসি পায় রাখীর। তারপর গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের সেই কৈফিয়ত তলবের ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত কী হল?
জানি না, জামান সিনেমার নায়কের মতো কথা বলে, আমি এই মুহূর্তে ওসব বাজে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই।
বাহ্, চাকরি গেলে খাবে কী?
কেন, তোমার তো চাকরি থাকবে, তুমি খাওয়াবে না?
আর তুমি কী করবে?
কেন, আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর।
রাখীকে হাসতে হল। বলল, আচ্ছা পাগল তুমি, লাইফ সম্বন্ধে সিরিয়াস হবে তো এখন।
না, কোনো দরকারই নেই। আমার কোনো লাইফই নেই তার আবার সিরিয়াস হব কী?
ভারি মজা তো, কেন লাইফটা কোথায় গেল?
আহ্ ফর গড্স রাখী, প্লিজ হোল্ড ইয়োর টাঙ—
রাখী চুপ করল। জামান এমন ছেলেমানুষ, অথচ এতকাল তাকে কী ভেবে এসেছে সে। মানুষের যে কত চেহারা। সত্যিই মানুষকে চেনা বড় কঠিন।
জামানের বাসার দোরগোড়ায় রিকশ থেকে নেমে রাখী জানিয়ে দিল, আমি কিন্তু এখুনি ফিরব।
জামান দরজা খুলে ডাকে, ভেতরে এসো।
রাখী ঘরের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ায়। জামান মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, তাকে দেখছে, চোখদুটি অধীর, জ্বলজ্বল হয়ে উঠেছে।
দেখতে দেখতে আরও কাছে এগিয়ে এসে রাখীর ঘাড়ে দুহাত রাখল, তারপর দুহাতে রাখীকে বুকের কাছে টেনে নিল। ভাঙা ভাঙা থরথর গলায় ডাকল, রাখী, মাই লাভ।
অনেকক্ষণ, রাখীর মনে হল যেন কত যুগ। একটা বিচিত্র রকমের অনুভূতি তার শরীরের ভেতর তখন ঝঙ্কার দিয়ে উঠতে চাইছে। ঘরটা কেমন অন্ধকার, হৃৎপিণ্ডের শব্দ তখন মাতাল ঘণ্টার মতো বেজে চলেছে। আর সে শব্দ ছাপিয়ে জামানের গলার স্বর রাখীর কানের কাছে থেকে-থেকে আছড়ে পড়ছে, আই, আই ক্যান ডাই নাউ, রাইট নাউ, আই ক্যান ডাই থাউজেন্ড ডেস্! ওহ্ হেভেন!
রাখী জানে না কতক্ষণ। হঠাৎ একসময় অনুভব করল, জামানের একটা হাত তার বুকের কাছে কিলবিল করছে। ঐ মুহূর্তেই একজোড়া উত্তপ্ত ঠোঁট আগুনের টুকরোর মতো তার ঠোঁটের ওপর চেপে বসল। আর সঙ্গে সঙ্গে, কে জানে কেন, রাখী জেগে উঠল। আর জেগে উঠেই জোরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ছাড়িয়ে নিয়েই সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দুচোখ ছাপিয়ে তখন তার পানি বেরিয়ে আসছে। জানে না কেন, বুকের ভেতরে কীরকম একটা অসহ্য কষ্ট হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত তারপর, দ্রুত হেঁটে পার হল গলির রাস্তাটুকু। তখন সন্ধ্যা হচ্ছে। না, পেছনে তাকাবে না সে। প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে রাস্তার মোড়ে এসে খালি রিকশ পেয়ে সে চেপে বসল।