ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

দক্ষিণায়নের দিন – ১১

এগারো

হাসান ফিরে এসেছে, কিন্তু নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরতে পারেনি। খলিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হবে কল্পনাও করেনি। সে যে বিদেশে পালিয়ে ইতিমধ্যে বিদেশি ফার্মের একজন বড়কর্তা হয়ে উঠেছে তা কে জানত। ডিপ টিউবওয়েল বসানোর বিশাল প্রজেক্ট। ওয়াপদার কাছ থেকে গোটা কাজটা নিয়েছে কোহেন মিলার কোম্পানি। তারই এঞ্জিনিয়ার কে চৌধুরী। হাসানকে দেখে হেসেছে, আর ঐ হাসি দেখেই হাসানকে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়েছে।

মার্কিন সাহায্যের কাজ। এদিকে আবার কোহেন মিলার কোম্পানি মূল ঠিকাদার। তারা সার্ভে, সয়েল টেস্ট, পাইপ সিংকিং- সব করবে। এমনকি টারবাইন জেনারেটর ইত্যাদি বসানো পর্যন্ত। দেশি কন্ট্রাক্টরদের দেবে শুধু পাম্পহাউস আর ওভারহেড ইলেক্ট্রিক লাইন বসানোর কাজটা। ঢাকা থেকেই সব খবর নিয়ে গিয়েছিল হাসান। কোহেন মিলারের বড়কর্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ফোরম্যান সুপারভাইজার সবারই সঙ্গে সে দেখা করে গিয়েছিল। ওদের মুখেই চৌধুরী নামটা প্রথম শোনে। কিন্তু সে চৌধুরী যে একেবারে খলিল চৌধুরী হবে ভাবতে পারেনি। তখনও চৌধুরী এসে পৌঁছায়নি।

ফোরম্যান গিয়োভানি বলেছিল, কাজটা বোধহয় তোমরাই পাবে। তবে সবকিছু ঠিক করবে চৌধুরী। সে এখন লেবাননে, রাজপুতনায় আমরা যে কাজটা করছি সেটা দেখে তবে সে এখানে আসবে। সামনের মাস নাগাদ অপেক্ষা করো— আমাদের সঙ্গে দেখা করে কোনো লাভ নেই। চৌধুরী এখানকার লোক। কারা এখানকার জেনুয়িন লোক সেটা তারই বুঝবার কথা।

হাসান খলিল চৌধুরীকে দেখে একবার ভেবেছিল, ফিরে চলে যায়। বহুদিনের পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী খলিল। কলেজে দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, চাকরিতেও কম রেষারেষি ছিল না। শেষপর্যন্ত প্রমোশন হয়েছিল হাসানের এবং সে খলিলের সুপারিশ-করা একটা বিল আটকে দিয়ে অ্যান্টিকরাপশনকে লেলিয়ে দেয়। আর তাতে ভয় পেয়ে খলিল দেশ ছেড়ে পালায়।

সেই খলিল চৌধুরীর কাছে উমেদার হয়ে যেতে হবে এখন। প্রথমটা হাসান বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার নতুন ফার্মের প্রথম কাজ পেতে যাচ্ছে সে- এ অবস্থায় ব্যক্তিগত মান-সম্মানের ব্যাপারটা সে দেখবে না— শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তাকে। তার কেমন আশা ছিল, খলিল তাকে একেবারে খালিহাতে ফিরিয়ে দেবে না। হয়েছিলও তাই। পরে যখন আসল আলাপ হল, তখন ফোরম্যান গিয়োভানি আর প্রোজেক্ট সুপারভাইজার মারভিন দুজনের সামনেই খলিল তাকে জানাল- এতবড় কাজ শুধু একটা ফার্মকে আমরা দিতে পারি না- যদিও ডেল্টা কর্পোরেশনের কোটেশন আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। আমাদের ধারণা, কিছু কিছু কাজ লোকাল ফার্মকে দিতেই হবে। লোকাল কো-অপারেশন না-পাওয়া গেলে কাজের ভীষণ অসুবিধা হয়। দুই পক্ষের সুবিধার জন্যে আমাদের এটা করতে হচ্ছে। কেননা ডেল্টার কোনো ব্রিকফিল্ড নেই, কিংবা নিজস্ব ফরেস্টও নেই— এখনে লোকাল ফার্মগুলো যদি ব্রিক সাপ্লাই না দেয়, কিংবা টিম্বার লগ বিক্রি করতে না চায়—

খলিল চৌধুরীর বক্তৃতা শুনে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল হাসানের। খলিল ডাঁটের সঙ্গে বক্তৃতা করে যাচ্ছিল আর বেকুব অধস্তন কর্মচারীদের মতো হাসানকে তাই শুনতে হচ্ছিল। কোনো উপায় ছিল না তার।

হাসান তবু শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছে। সুপারভাইজারকে সে চেপে ধরেছিল। মিস ইভান্সকে বেশ কয়েকদিন পাঠিয়েছে তার কাছে। প্রত্যেকদিন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তুলে দিচ্ছিল কেটির হাতে। শেষে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে মারভিন কেটির সঙ্গে উইকেন্ড করে আসবার পর কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছে হাসান।

কিন্তু খলিল তখনও অটল-একেবারে বরিশালী গোঁ। আর সেইজন্যে হাসানকে আশেপাশে জায়গাগুলো চষে বেড়াতে হয়েছে কয়েকদিন। স্থানীয় ঠিকাদারদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করতে হয়েছে-সেই কন্ট্রাক্ট দেখিয়ে তবে সে কাজটা আদায় করতে পারল।

কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, প্রথম তার পক্ষে যে টাকা ঢালা সম্ভব তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কিছু নয়। কোহেন মিলার যদি নিয়মিত টাকা না দেয়, তাহলে তাকে চিরকালের জন্যে ডুবতে হবে।

তাই হাসান ছয় লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট সই করে ফিরে এসেছে, কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারেনি।

ঢাকায় ফেরা অবধি সে কেবলি ছোটাছুটি করছে। ব্যাংকগুলোর দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিল, পার্টনারদের কাছে আরো বেশি টাকার জন্যে পীড়াপীড়ি করল, আর দিনের পর দিন সকাল-বিকাল কোহেন মিলারের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে লাগল।

তাছাড়া আর কোনো পথ নেই তার। হাসান একেক সময় ক্লান্তি বোধ করে। ভাবে, ছেড়ে দেবে কাজটা। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারে না, লেগেই থাকতে হয়। ভেবে দেখেছে, কোনো পথ নেই এড়িয়ে যাবার। সমৃদ্ধির পথ ঐ একটাই। বহু ঠেকে সে শিখেছে— টাকাই হল জীবনের সারবস্তু। একেক সময় আক্ষেপ করে সে চারদিকের অবস্থা দেখে। অতি তৃতীয় শ্রেণীর মূর্খ লোক দেখতে দেখতে ফুলেফেঁপে উঠছে। অর্থবান মূর্খ লোকেরাই সর্বত্র সম্মান পাচ্ছে, তাদেরই দাপট। তার সহপাঠী বন্ধুরা কতজন চাকরিতে না ঢুকে ব্যবসা আরম্ভ করে এখন দশ-বারোখানা করে বাড়ির মালিক, চার-পাঁচখানা করে মোটরগাড়ি চালায় ছেলেমেয়ে বউ মিলে। কেউ কেউ বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে এখন কোটিপতি। শুধু সে-ই মিছিমিছি সময় নষ্ট করেছে এতকাল চাকরি করে।

আর কে না জানে যে ব্যবসা করতে গেলে বহুরকমের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়-এও সেই রকমেরই একটা খারাপ পরিস্থিতি। একেক সময় হাসান কোহেন মিলার কিংবা খলিল চৌধুরীর সঙ্গে তার বর্তমান ত্রিশঙ্কু অবস্থাটাকে ব্যবসাগত খারাপ পরিস্থিতি বলে বিচার করতে চেয়েছে। ব্যবসার উঠতি পড়তি আছে, হয়তো এখন তার পড়তির সময় যাচ্ছে, কে জানে, পরের বার যে কাজে হাত দেবে, সেটাই হয়তো সহজ সুন্দর এবং লাভজনক কাজ হবে। যদি তা না হয়, তাহলেও ঘাবড়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। ব্যবসাকে ব্যবসার মতোই দেখতে হবে। টাকাটাই সেখানে আসল বস্তু। আজ যদি তার ফার্ম বড় হত, তাহলে খলিল তাকে এইভাবে উপেক্ষা দেখিয়ে অপমান করতে সাহস পেত না। এইভাবেই হাসান ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু তবু দুশ্চিন্তা যায় না। একেকবার মনে করে, সোজা খলিলের সঙ্গে গিয়ে আলাপ করবে। যদি তেমন বোঝে, তাহলে খলিলের হাতে পয়সা দিয়ে আসবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সাহসে কুলোয় না। খলিলকে বিশ্বাস করার মতো কারণ খুঁজে পায় না সে। খলিল যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়-তাহলে লজ্জা তো লজ্জা, অন্যদিকে বিপদও হতে পারে। সুতরাং এইসব সাত-পাঁচ চিন্তায় উদ্বিগ্ন থেকে হাসানকে দিনের পর দিন কোহেন মিলারের হেডঅফিসে ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছিল।

ওদিকে অবশ্যি ওর শক্ত ব্যবস্থা আছে। সাইটে সে দুজন ওভারশিয়ার আর একজন এঞ্জিনিয়ার রেখে এসেছে। নিয়মিত খবর নিচ্ছে খলিল চৌধুরী আবার নতুন কোনো ঝামেলা বাধায় কি না।

এইরকম অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যেও প্রথম কিস্তি আগাম টাকার জন্যে অনুরোধ করতেই অপ্রত্যাশিতভাবে টাকাটা পেয়ে গেল। কুড়ি হাজার টাকা প্রথমেই দেবে—কোনো কাজ না দেখেই— এতটা সে আশা করেনি। টাকাটা সহজে পেয়ে যাওয়াতে সে একদিন খলিলকে ধন্যবাদ জানাতে গেল।

খলিলের ভিন্ন মূর্তি তখন। বলে ফেলল, পুরনো কথা আমি মনে রাখিনি, কন্ট্রাক্ট তুমি এমনিই পেতে, টাকাও। কিন্তু মেয়েছেলে, টাকা এসব ঘুষ দিয়ে ভালো করোনি, ওতে বিদেশিদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যায়- এসব আর কোরো না।

হাসান খলিলের ঐ কথা শুনে বেকুবের মতো হেসেছে কিছুক্ষণ। খলিল তো জানে না এদেশে কত ধানে কত চাল। সে খলিলের কথা গায়ে মাখেনি। যেন জানত এ ধরনের কথা তাকে শুনতে হবে। আর সেজন্য তাকে তৈরিও থাকতে হবে। খলিল না হোক, কেউ-না-কেউ এ ধরনের কথা তাকে বলতই।

হাসান পার্টনারদের সঙ্গে পরামর্শ করে পুরো টাকাটাই সাইটে পাঠিয়ে দিল। এবার কিছুটা স্বস্তি। বাসায় ফিরে হাসান যেন চারদিকে তাকিয়ে দেখার অবসর পেল। দেখে তার স্ত্রী কেমন যেন নিরুত্তাপ, যেন গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। গোটা বাড়িটা অদ্ভুত রকম নিষ্প্রভ। রাশেদ সাহেবের কোনো সাড়া নেই। মনে হল রাখী বোধহয় এ বাড়িতে থাকে না। মাঝেমধ্যে পারভিনের অস্তিত্বটা টের পাওয়া যায় শুধু। যথারীতি খাওয়াদাওয়া সেরে শুতে গেল। লক্ষ করল বুলু তখনও ঘরে আসেনি। দেখে, বুলু বারান্দায় দাঁড়িয়ে। উঠে গিয়ে তখন বুলুর পাশে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, শোবে না?

বুলু মুখ ফেরায় না। শান্ত গলায় বলে, তুমি শোও, আমার ঘুম পাচ্ছে না। হাসানের বিরক্তি লাগে। কিন্তু কিছু বলে না। একইভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষে একসময়ে জানায়, শুনেছ বোধহয়, শেষপর্যন্ত টাকাটা পাওয়া গেল।

ভালো, এবারও মুখ ফেরায় না বুলু।

দ্যাখো, এসবের কোনো মানে হয় না, হাসান নিজের বিরক্তি চাপতে না পেরে বলে।

কোন্ সবের? বুলু এবার যেন মুখোমুখি হতে চায়।

তোমার এই ছেলেমানুষির, লাইফটা শুধু সেন্টিমেন্ট নয়।

বুলু ভাবেনি কখনো কিছু বলবে। সে ভাগ্যকে মেনে নিতে চেয়েছিল। হাসান কী করবে না-করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। একদা হাসানকে সত্য বলে ধরে নিয়ে আর সবকিছু অস্বীকার করেছিল সে। কিন্তু আজ, দীর্ঘকাল পরে, যখন হাসানকে সে নতুন চেহারায় দেখতে পাচ্ছে, তখন অন্ধকার মুখোমুখি মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে জবাব বেরিয়ে এল। বলল, তোমার কাছে লাইফ যা, আর সবার কাছে তা নাও হতে পারে। তুমি ফার্ম খুলেছ, টাকা রোজগার করে বড়লোক হবে, খুব ভালো কথা, কিন্তু তাতে আমার কী? টাকা নিয়ে আমি কী করব! টাকার তো কোনো দরকার নেই আমার। যা আছে তাতেই আমার চলে যাচ্ছে। লাইফকে আমি টাকা দিয়ে মাপতে যাব কেন?

হাসান রেগে ওঠে। মাঝরাতে এইরকম বাজে তর্কের কোনো অর্থ খুঁজে পায় না সে। ঘরের ভেতরে ঢোকে। তারপর বলে, তোমার কোনো অ্যাম্বিশন নেই বুলু, অ্যাম্বিশনহীন জীবন, জীবন নয়- দুনিয়ার সঙ্গে একটু তাল মিলিয়ে ভাবতে চেষ্টা করো।

হাসান তারপর অন্ধকারেই বিছানায় বালিশ আঁকড়ে ধরে শুয়ে পড়ে। তার মাথায় তখন ইট কাঠ আর সিমেন্টের চিন্তা। সংশয়, টাকাটা বাজে খরচ করে ফেলবে না তো এঞ্জিনিয়ার? ঐসময় আকাশে একবার মেঘ ডাকে, শেষ অক্টোবরের মেঘ। ঠাকুরগাঁয়ে কাজের জন্যে ইট কাটা হচ্ছে, বৃষ্টি হলে ক্ষতি হয়ে যাবে। দুলাখ ইট দিয়ে আর ক’দিন কাজ চালানো যায়? ইট, বৃষ্টি, সারি সারি পাম্প হাউস, তাড়া নোট এবং খলিল চৌধুরীর মুখ মনের মধ্যে দেখতে দেখতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *