দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ – ঋতা বসু

দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ – ঋতা বসু

বিখ্যাত ইম্প্রেসারিও টোটন রায় এবার পুজোর পর বালুরঘাটে কল-শোতে যাওয়ার জন্য সকলের আগে ফোন করল কমল গুপ্তকে। এখন বাংলা ছবিতে কমল গুপ্তই এক নম্বর। কমল গুপ্তকে একবার দলে নিতে পারলে আর দেখতে হবে না। ওঁর নামেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাবে।

টোটন রায় খুব ভয়ে ভয়েই ফোনটা করেছিল। ধরেই নিয়েছিল কমল গুপ্ত এককথায় এই প্রস্তাব নাকচ করে দেবে। কিন্তু টোটন রায়কে অবাক করে দিয়ে কমল গুপ্ত বলামাত্রই রাজি হয়ে গেল।

রাজি হওয়ার পেছনে কারণটা অবশ্য টোটন রায় জানে না। কমল গুপ্তর বাল্যবন্ধু শতদল বালুরঘাটের পঞ্চাশ মাইল দূরে গঙ্গারামপুর বলে একটা জায়গায় বিশাল এক খামার বানিয়ে দিব্যি আছে। কতবার বলেছে যাওয়ার জন্য। এই ব্যস্ত জীবন ছেড়ে কমল কিছুতেই সময় করে উঠতে পারেনি এতদিন।

শতদল ছেলেবেলা থেকেই সকলের চেয়ে আলাদা। পরীক্ষায় যে খুব ভাল করত তা নয়, কিন্তু ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে সে যে বন্ধুদের কত সমস্যার সমাধান করে দিত তার ইয়ত্তা নেই। কমল গুপ্ত সিনেমার নায়ক হতে পারে, কিন্তু বন্ধু মহলে এখনও আসল নায়ক শতদল।

স্কুল-জীবনের শেষের দিকে রাজীব মিত্র ভরতি হল। শতদল বলল, “তিন নম্বর পদ্ম এল ক্লাসে।”

রাজীবকে ঠাট্টা করে সে বলেছিল, “আমি এক নম্বর, কমল দু’নম্বর। তোমাকে কিন্তু বরাবর তিন নম্বর হয়েই থাকতে হবে।”

শতদলের ঠাট্টা কিন্তু রাজীব খুব একটা ভালভাবে নিল না। তখন সে বলেছিল, “আমি তিন নম্বর হওয়ার জন্য আসিনি। এক নম্বর হওয়াই আমার লক্ষ্য।”

কথাটা বলেছিল শতদল কিন্তু রাজীবের রাগটা এসে পড়ল কমলের ওপর। আর কী আশ্চর্য― কর্মজীবনেও তারা পাশাপাশি কাজ করে চলেছে। কমল সিনেমায় এক নম্বর হলে রাজীবকে টেলিভিশনের এক নম্বর বলা যায়। সে স্টেজেও নাটক করে। যথেষ্ট সুখ্যাতিও কুড়োয় তার অভিনয়ের জন্য। সকলেই জানে তারা বাল্যবন্ধু। ওপর ওপর বন্ধুত্বও বজায় আছে, অথচ কমল জানে রাজীব মনে মনে শত্রুতা পোষণ করে আসছে সেই ছেলেবেলা থেকে। কমলের ক্ষতি হলে তার মতো খুশি কেউ হবে না।

কমলের অবশ্য দৃঢ় বিশ্বাস, চট করে তার কোনও ক্ষতি হবে না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, মিরাকল বা দৈব অনুগ্রহ কারও কারও জীবনে ঘটে।

এই পেশায় এসে প্রথমদিকে ছোটখাটো কাজের জন্য স্টুডিয়োর দরজায় দরজায় ঘুরেছে। হতাশার চরম সীমায় যখন পৌঁছেছে তখন একটা ফিল্মের দলের সঙ্গে আউটডোরে গেল মধ্যপ্রদেশে। কাজ শেষ হয়ে গেল তিনদিনের মধ্যেই। ফিল্মের দল ফিরে এল কলকাতায়। কমল গুপ্তর কী জানি কেন ফিরতে ইচ্ছে করল না। যে-ক’টা টাকা পেয়েছিল তাই নিয়ে চলে গেল নর্মদার উৎসস্থল অমরকণ্টকে।

অমরকণ্টক বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র। শিব মাহাত্ম্যের জন্য শিবক্ষেত্র নামেও প্রসিদ্ধ। এখান থেকে সাধু-সন্ন্যাসীরা পায়ে হেঁটে নর্মদা পরিক্রমা করেন। দুর্গম পথ, বিপজ্জনক অরণ্য ব্যতিক্রম করে পরিক্রমা শেষ করেন গুজরাতের কচ্ছে; নর্মদা যেখানে সাগরে মিশেছে।

কমল গুপ্তের তখন অল্প বয়স। ধর্মশালায় রাতে শুয়ে থাকে আর সারাদিন নর্মদার ধারে অজস্র সাধু-সন্ন্যাসী তীর্থযাত্রী মন্দির দেখে বেড়ায়। এখানেই একদল তীর্থযাত্রীর সঙ্গে আলাপ হল। শুনল, তারা যাবে ওঁঙ্কাৱেশ্বর দ্বীপে বিখ্যাত জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দিরে। সেও তাদের সঙ্গে ভিড়ে গেল।

ওঁঙ্কাৱেশ্বর দ্বীপে এসে চারদিকের শোভা দেখে মুগ্ধ হল কমল। মনে হল এখানেই সারাজীবন থেকে যেতে পারলে বেশ হত। নাম যশ অর্থ যা না-পেয়ে জীবন ব্যর্থ মনে হচ্ছিল, তা একেবারে তুচ্ছ মনে হল।

মনের এইরকম অবস্থায় নর্দমার তীরে একটা পাথরের ওপর বসে সূর্যাস্তের শোভা দেখছে। কাছেই আর একটা পাথরের ওপর একজন সাধু বসে জপ করছেন। নর্মদার ধারে এ অতি পরিচিত দৃশ্য। কমল গুপ্ত ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি। হঠাৎ খেয়াল হল সাধুটি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়তে কমল গুপ্তর কেমন মনে হল যেন ইশারায় কাছে ডাকলেন। কাছে গিয়ে প্রণাম করতেই উনি মাথায় হাত ছোঁয়ালেন, মনে হল সমস্ত শরীর যেন জুড়িয়ে গেল। সাধু জিজ্ঞেস করলেন, “কাজকর্ম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? ফিরে যা, মন দিয়ে কাজ কর। ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবি। কোনওদিন কোনও কষ্ট হবে না।”

সাধুর কথায় বৈরাগ্যের ভাব দূর হয়ে মনে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার হল। ভাবল, সত্যিই তো, একটা কাজই তো ভাল করে করতে পারি― অভিনয় করা। সেটাই তো করা উচিত।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, চলে আসবার সময়ে সাধু যখন ঝোলা থেকে একটা সুন্দর সাদা শঙ্খ বার করে হাতে দিয়ে বললেন, “এটা খুব দু’প্রাপ্য দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ। সবসময়ে কাছে কাছে রাখবি। তোদের পেশায় খুব রেষারেষি। এই শঙ্খ যতক্ষণ তোর কাছে আছে কেউ তোর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।”

শঙ্খের জন্যই হোক, বা অন্য কোনও কারণে, কলকাতায় ফিরে আসবার পর পরপর কয়েকটি ছবিতে তার অভিনয় বিশেষ প্রশংসা পায়। বিদেশি পুরস্কারও জুটে যায়। তারপর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, কমল গুপ্ত মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তার এই উন্নতির মূলে দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ।

সে ঘুণাক্ষরে কাউকে এই শঙ্খের কথা বলেনি। খুবই সাবধানে গোপনীয়তা বজায় রেখে শঙ্খটা সবসময়ে সঙ্গে রাখে। আউটডোের শুটিংয়ে গেলেও সঙ্গে নিয়ে যায়।।

এবারও বালুরঘাট আসবার সময়ে নিয়ে এসেছে। দলে অন্যান্যদের মধ্যে রাজীবও আছে। কমলের একদিনের শো। কমল গুপ্ত তারপর গঙ্গারামপুর চলে যাবে, আগে থেকেই ঠিক করা আছে। শতদলকেও বলা আছে, তার কাছে দু’দিন থেকে কলকাতায় ফিরবে। শতদল রাজীবকেও নিয়ে যেতে বলেছে। রাজীবের তিনদিনই শো আছে। সেও সময় পেলে গঙ্গারামপুর যাবে বলে কথা দিয়েছে।

বালুরঘাট শহরে বেশ পরিচ্ছন্ন, মোটামুটি আধুনিক সুবিধাযুক্ত একটা গেস্টহাউস ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এই গেস্টহাউসগুলো হয়ে খুব সুবিধে হয়েছে। হোটেলের মতোই, তবে হোটেলের চেয়ে ছোট এবং ঘরোয়া টোটন রায় পুরোটাই পাঁচদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছে। শোয়ের তিনদিন বাদ দিয়ে আগে একদিন ও পরের একদিন।

বালুরঘাট পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। এখানে বাইরের আকর্ষণ বিশেষ না থাকায় এবং কলকাতায় সকলেই কম-বেশি ব্যস্ত থাকায় আড়ার সুযোগ হয়। না বলে, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গুটিগুটি সকলেই এসে জমায়েত হল গেস্টহাউসের বসার ঘরে।

বসার ঘরটি দেশি কায়দায় সুন্দর করে সাজানো। বেতের চেয়ার-টেবিল ছাড়াও মাটিতে উঁচু মোটা গদি দিয়ে বসবার ব্যবস্থাও আছে। টোটন রায় গেল স্টেজের ব্যবস্থাপনা দেখতে। আলো নির্দেশক, গাইয়ে, বাজিয়ে, নাটকের কুশীলব, মেকআপম্যান সব নিয়ে জনাপনেরো হবে, চায়ের আড্ডায় সকলেই হাজির।

আগামীকালের শোয়ের বিষয়ে কথা উঠল। রাজীব বলল, “কমল তো আমাদের দলের শোপিস। ও শুধু মুখ দেখাবে। আসল কাজ আমাদেরই করতে হবে।”

সেটা সত্যি কথাই। কমল গুপ্ত এই প্রথম এসেছে। এই ধরনের অনুষ্ঠানে কী করে দর্শক টেনে রাখতে হয় তা তার জানা নেই। তা ছাড়া শুটিংয়ের সময় ছাড়া বহুলোকের সামনে অভিনয় করতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সেজন্য টোটন রায়কে আগেই বলেছে নিজের অভিনীত কোনও চরিত্রের সংলাপ সে বলবে, তবে বাদ দেবে আবেগাপ্লুত অংশ। এ ছাড়া বনফুলের একটি হাসির কবিতা পাঠ করবে, যেটা মোটামুটি সবশ্রেণির দর্শকেরই ভাল লাগবে।

টোটন রায় কৃতার্থ হয়ে বলেছে, “ব্যস, ব্যস, ওতেই হবে। আপনার মুখ দেখতেই লোকে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে আসবে।”

এসব কথা অন্য কেউ জানে না। এই আড্ডার মাঝে সেসব বলে সুরটা কেটে দিতে ইচ্ছেও করল না কী হবে রাজীবের ঈর্ষার আগুনকে আর-একটু উসকে দিয়ে? সেজন্য হাসিমুখে খোঁচাটা হজম করে মনু পালকে বলল, “তোমাদের কৌতুক নকশাটা লোকের খুবই ভাল লাগবে। ওটা তো এবারের হট ফেভারিট। তুমি আর রাজীব মিলে একেবারে ফাটিয়ে দেবে।”

এই কৌতুক নকশাটা সত্যিই খুব মনোগ্রাহী। অনেকটা সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’-এর ধরনে একটি শহুরে তৃষ্ণার্ত বাবুকে ঘিরে কোল্ডড্রিঙ্কওলা ও ডাবওলার কথোপকথন। শেষে ডাবওলার কথার মারপ্যাঁচে কোল্ডড্রিঙ্কওলার পরাজয় ও বাবুর ডাবের জলপান।

রাজীব ভাবওলার পার্ট করে ও মনু পাল কোল্ডড্রিঙ্কওলার। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ধরনে স্টেজটাকেও সুন্দর করে সাজানো হয় এ-সময়। বেঞ্চ, টিকিটঘর দেখে মনে হয়, সত্যি প্ল্যাটফর্ম।

সবচেয়েসুন্দর, কোল্ডড্রিঙ্কওলারবাক্সওডাবওলার ঝুড়ির ডাবগুলো। ওগুলো যে সত্যিকারের ডাব নয়, তা বোঝে কার সাধ্য। ডাবওলার ঝুড়িতে অবশ্য একটা আসল ডাব থাকে। বাবুবেশী ভাস্কর ঘোষ একদম শেষে যেটার জলপান করে।

আড়ায় যথারীতি এক গল্প থেকে আর-এক গল্প চলতে লাগল। চোর, মাতাল, ভূত হয়ে যখন সাধু-সন্ন্যাসীতে পোঁছল তখন আড্ডার বেশিরভাগ সদস্যই সাধুদের ভণ্ডামির গল্প করতে লাগল। খানিকক্ষণ শোনার পর কমল গুপ্ত বলল, “তোমরা যা বলছ তা নিশ্চয়ই সত্যি। আছেও তো কত ভণ্ড সাধু-সন্ন্যাসী। আমি কিন্তু আমার জীবনে একজন প্রকৃত সাধুর দেখা পেয়েছি, যিনি আমার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছেন। এই বলে সে ওঁঙ্কারেশ্বর দ্বীপের পুরো ঘটনাটা বলল শুধু দক্ষিণাবর্ত শঙ্খের কথাটা বাদ দিয়ে।

সবটা শুনে রাজীব বলল, “তুমি ভাগ্যবান। সেখানে আমি হতভাগা যদি যাই দেখা পাব এক বকধার্মিকের আর কপালে জুটবে শঁখের বদলে শামুক।”

শাঁখের উল্লেখে কমল গুপ্তর বুকটা ধড়াস করে উঠল। রাজীব হঠাৎ কেন শাঁখের কথা বলল বুঝে উঠতে পারল না। ও জানলই বা কীভাবে? সে-ই কি অমরকণ্টক থেকে ফিরে কোনও দুর্বল মুহূর্তে গল্প করেছিল? কিছুতেই মনে করতে পারল না।

সর্বজনীন মামা কানু মিত্র বলল, “নাকের বদলে নরুণ শুনেছি। শাঁখের বদলে শামুক এই প্রথম শুনলাম।”

রাজীব মুচকি হেসে বলল, “এটা বর্ধমানের প্রবাদ। মানেটা একই।”

এই থেকে গল্প আবার প্রবাদবাক্যের দিকে চলে গেল। তারপর নানারকম জোকস বলাবলি হয়ে হাসিঠাট্টার মধ্যে আড্ডা শেষ হল। শাঁখের উল্লেখটা প্রবাদবাক্য ছাড়া আর কিছু নয় এটা ভাববার চেষ্টা করলেও কমলের মনে সূক্ষ্ম কাঁটার খচখচানিটা রয়ে গেল।।

ঘরে যেতে যেতে রাজীব জিজ্ঞেস করল, “কাল শতদল কখন আসছে?”

“সকালেই তো আসার কথা। বালুরঘাটে কী সব কাজ আছে। সন্ধেয় আমাদের শো দেখে রাতেই আমাকে নিয়ে গঙ্গারামপুরে ফিরে যাওয়ার কথা।”

রাজীব বলল, “আমারও খুব ইচ্ছে আছে এদিক থেকে ছুটি পেলেই দু’দিন শতদলের কাছে গিয়ে জিরিয়ে নেব। ওর সঙ্গে আড্ডাটাও খুব মিস করি। কাল তো সবাই ব্যস্ত থাকব― কথাই হবে না।”

পরদিন দুপুর থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। টেকনিশিয়ানরা আগেই চলে গিয়েছে স্টেজ সাজানোর সরঞ্জাম নিয়ে। চার-পাঁচটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাকিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য।

কমল গুপ্ত যথারীতি সুটকেসের মধ্যে যত্নে রাখা দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ প্রণাম করে রিসেপশনে এসে দেখল কয়েকজন অপেক্ষা করছে। রাজীব কলকাতায় ফোন করবার চেষ্টা করছে। ওর স্ত্রী ফোন করেছিল, কথা বলতে বলতে লাইন কেটে গিয়েছে। রাজীব বলল, “তোমরা এগোও। আমি আর একটু চেষ্টা করে দেখি।”

তারপর কমলকে উদ্দেশ করে আবার বলল, “শতদলকে বোলো যেন আগেই পালিয়ে না যায়। আমার সঙ্গে দেখা করে যেতে বোলো।”

কমলরা পৌঁছবার আধঘণ্টার মধ্যেই বাকিরা সবাই পৌঁছে গেল। তারপর শুরু হয়ে গেল ব্যস্ততা। শতদল এসে গ্রিনরুমে দেখা করে গিয়েছে। এতদিন বাদে শতদলকে দেখে রাজীবও খুব উচ্ছ্বসিত। বলল, “আমি বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি তোমার কাছে দু’দিন থেকে ফিরব। আর যাওয়ার আগে বলে যেয়ো শো কেমন লাগল।”

কমলের বিশেষ মেকআপ নেই। মেকআপম্যান এসে হালকা মেকআপ করে দিয়েছে। রাজীবরা নিয়মিত শো করে বলে তাদের সকলেরই নিজস্ব মেকআপ কিট আছে। রাজীব খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে বলল, “চলি, আমার দাড়িটাড়ি লাগিয়ে মেকআপ করতে একটু বেশি সময় লাগবে।”

কমলের অংশটুকু শেষ হতেই শতদল তাড়া লাগল, “চলো, চলো। এখন পঞ্চাশ কিলোমিটার যেতে হবে। এখনই বেরিয়ে পড়ি। নয়তো দেরি হয়ে যাবে।”

“রাজীবদের কৌতুক নকশা দেখবে না?”

“ওর ফকিরের অভিনয় তো দেখলাম। বাকিটা আবার কখনও হবে। এখন গেস্টহাউস থেকে তোমার জিনিসপত্র নিয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। রাস্তা খুব একটা ভাল নয়।”

গেস্টহাউসে এসে সুটকেস খুলেই কমলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সমস্ত ঠিক আছে, শুধু সুটকেসের মধ্যে সুন্দর চন্দনকাঠের বাক্স থেকে দক্ষিণাবর্ত শঙ্খটি উধাও।

কমলের ভেঙে পড়া চেহারা দেখে শতদল বলল, “দাঁড়াও। অত আপসেট হোয়ো না। কী ছিল এই বাক্সে?”

“কত যে দামি সেটা আমি কেমন করে বোঝাব?”

“এত দামি জিনিস তুমি এইভাবে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?”

“দ্যাখো, জিনিসটা তো আর সোনাদানা নয় যে, সাধারণ চোর-ডাকাত লোভ করবে। একটা দক্ষিণমুখী শঙ্খ। দক্ষিণমুখী শঙ্খ অন্য সাধারণ শঙ্খের তুলনায় দুষ্প্রাপ্য হলেও এত কিছু দামি নয় যে, কেউ এতটা ঝুঁকি নিয়ে চুরি করবে। অন্যান্য দামি জিনিস, ঘড়িটড়ি তো পড়েই আছে। চোর সেগুলো ছোঁয়নি পর্যন্ত।”

“তা হলে তোমার কী মনে হয়? কে নিল? আর কেনই বা নিল তোমার শঙ্খ?”

“সে অনেক কথা। আমি তোমাকে সংক্ষেপে বলছি। এক সাধু আমাকে এটা দিয়েছিলেন। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, আমি মনে করি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এই শঙ্খ। তোমাকে আমি পরে বলব কীভাবে এটা পেলাম। সে অনেক লম্বা গল্প। শুধু এটুকু জেনে রাখো আমার যাবতীয় উন্নতি, নাম, যশ, অর্থ, সবকিছুর পেছনেই এই শঙ্খ। এই শঙ্খ আমাকে ফিরে পেতেই হবে, যেমন করেই হোক। এর জন্য যত টাকা খরচ করতে হয়, করব।”

শতদল বলল, “দাঁড়াও, আমাকে প্রথম থেকে খুলে বলো। কখন শেষ দেখেছ শঙ্খটাকে?”

“বেরোবার আগে, যেমন বরাবর প্রণাম করে বেরোনোর অভ্যেস, তেমনই প্রণাম করে বেরিয়েছি। দরজা লক করে বেরিয়েছি বলে সুটকেস আর চাবিবন্ধ করিনি। চাবি রিসেপশনে রেখে হলে চলে গিয়েছি।”

“সেই সময়ে রিসেপশনে কারা ছিল?”।

“আমাদেরই দলের কয়েকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রাজীব কলকাতায় ফোন করবার চেষ্টা করছিল।”

“এদেরই মধ্যে কেউ তুমি গাড়িতে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে কাজ হাসিল করে। কে হতে পারে? তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো?”

কমল জোরের সঙ্গে বলল, “শুধু সন্দেহ নয়, আমি জানি কে নিয়েছে। তুমিও জানো কে নিতে পারে। একজনই আছে যে প্রতি মুহূর্তে আমার ক্ষতি হোক কামনা করে। শতদল, তুমি কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমার শঙ্খটা উদ্ধার করে দাও। স্কুলে তুমি আমাদের কত সমস্যার সমাধান করেছ। এটা তোমাকে করতেই হবে। আমি চাই না কোনও হট্টগোল হোক। রাজীব নিশ্চয়ই এখানে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে শাঁখটাকে। এটুকু সময়ের মধ্যে তো অন্য কোথাও পাচার করা সম্ভব নয়।”

“সেটা ঠিকই বলেছ। তবে রাজীব যেরকম ধূর্ত, ও যে ওর ঘরে রাখবে না এ-ব্যাপারে আমি স্থিরনিশ্চিত। মাঝখান থেকে তোমার গঙ্গারামপুরে যাওয়া হল না। যতক্ষণ শঙ্খ উদ্ধার না হচ্ছে তুমি কি আর গেস্টহাউস ছেড়ে নড়বে? এখন তোমাদের দল ফিরে আসবার পরে না যাওয়ার একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ বলতে হবে।”

“সে বলা যাবে। হাজার একটা কারণে আমরা না যেতেই পারি। বললেই হবে বালুরঘাট শহরে তোমার কিছু কাজ আছে। ইতিমধ্যে তুমি রাজীবের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বোঝবার চেষ্টা করো শঙ্খটা কোথায় রাখতে পারে। অন্যদের আমি বুঝতে দিতে চাই না। আমাদের ইন্ডাষ্ট্রিকে তো জানো, এক মুহূর্তে তিলকে তাল করে। শঙ্খের কথা জানাজানি হোক এ আমার ইচ্ছে নয়।”

শতদল মৃদু হেসে বলল, “এ ভারী মজার ব্যাপার। চোর কে তা জানা। শুধু গোপনে চোরের ওপর বাটপাড়ি করে চোরাই জিনিস উদ্ধার করতে হবে। দেখি অনেকদিন তো মাথাটাকে কাজে লাগাইনি। এখন অন্য কথা বলো। কী করে শঙ্খটা পেয়েছিলে, অন্যরা এসে পড়বার আগে সেই কথাটা বলো।”

সমস্ত ঘটনা শুনে শতদল বলল, “কত কিছুই তো ঘটে পৃথিবীতে, যা আমাদের বুদ্ধির অতীত। এই নাম যশ অর্থ তোমার হয়তো এমনিতেই হতে পারত, হয়তো এর পেছনে শাঁখের অবদানও নেই। কিন্তু তোমার যখন এত বিশ্বাস তখন ব্যাপারটা একদম উড়িয়েও দেওয়া যায় না। আমি সবটাই খোলা মনে দেখি। আমাদের জ্ঞানের পরিধি আর কতটুকু? জানার চেয়ে না জানার ভাগই বেশি তাতে। ওই শোনো গাড়ির আওয়াজ। তোমাদের দল এসে পড়ল। তুমি কিছু বোলো না, যা বলবার আমি বলব।”

কমল গুপ্ত ও শতদলকে দেখে সকলে অবাক হলেও আজ যাওয়া হবে না শুনে খুশিও হল। এখানকার দর্শক সমস্ত অনুষ্ঠানটা খুব উপভোগ করেছে বলে সবাই খুশির মেজাজেই আছে।

শতদল রাজীবকে বলল, “যাওয়া যখন হলই না কাল তোমাদের অনুষ্ঠান পুরোটা দেখব। সরকারি অফিসের কাজ আঠেরো মাসে বছর। আমার একটা জরুরি ফাইল গেস্টহাউসে পৌছে দেবে বলেছিল। এসে দেখি কোথায় কী? আমার পরিচিত সরকারি

অফিসারটিকে ফোন করে শুনি কাল নয়তো পরশু নাগাদ কাজ শেষ হবে। আমার খুবই খারাপ লাগছে এত প্ল্যান করে, কমল তুমি সবে এলে আমার কাছে যাবে বলে, অথচ আমিই আটকে গেলাম।”

কমল বলল, “তাতে কী হয়েছে, ওখানেও তো আড্ডাই হত। সেটা এখানেই হোক।”

রাজীব বলল, “সেই ভাল, একেবারে শোয়ের শেষে তিনজন একসঙ্গেই যাওয়া যাবে। সেই ছেলেবেলার স্কুলজীবনের মতো হইহই করা যাবে। কমল, তুমি কলকাতায় জানিয়ে দাও তুমি ক’দিন বাদে যাবে।”

পরদিন সকালটা সবাই আলস্যে গড়িয়ে কাটিয়ে দিল দশটা অবধি। ভাস্করদের দলটা তাস নিয়ে বসে গেল একদিকে। রাজীব, শতদল, কমল পুরনো দিনের গল্প করতে লাগল। সদাব্যস্ত টোটন রায়ও যোগ দিল কিছুক্ষণের জন্য। বারোটা নাগাদ শতদল উঠল। বলল, “যাই একটু তাড়া মারি গিয়ে। আমার কাজটা নয়তো কালকেও শেষ হবে না। দুপুরে খাওয়ার আগেই এসে পড়ব।”

কথামতো শতদল এসে গেল দুটো নাগাদ। ততক্ষণে খাওয়ার ঘরে এসে জুটেছে সকলে।

খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। আজ কমলের শো নেই, অতএব তার তাড়া নেই। সে আর শতদল ধীরেসুস্থে সন্ধের সময় গিয়ে একেবারে প্রথম সারির দুটো আসন দখল করে বসল।

কমল যতই বাইরে শান্তভাব বজায় রাখার চেষ্টা করুক না কেন, ছোটখাটো কথায় তার উদ্বেগ প্রকাশ পেতে লাগল। শতদলের নির্বিকার ভাব দেখে একবার বলেও ফেলল, “তুমি থাকো, আমি বরং গেস্টহাউসে গিয়ে ঘরগুলো খুঁজে দেখি।”

“তুমি শান্ত হয়ে বোসো। অন্যদের ঘরের চাবি কী বলে চাইবে? সব ঘর তো চাবিবন্ধ এখন। এদিকে লোক-জানাজানি হোক চাইছ না, তাতেই তো ব্যাপারটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন চুপচাপ বসে দ্যাখো কী হচ্ছে। কলকাতায় তো তোমার এমন সুযোগ ঘটে না।”

তারপরই শতদল এমন মনোযোগ দিয়ে গোটা অনুষ্ঠানটা দেখল যে, কমল আর একটা কথাও বলবার সুযোগ পেল না। প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপ, প্রত্যেকটি চরিত্র এমন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল যে, মনে হল এর ওপরে বোধহয় মস্ত একটা গবেষণামূলক লেখা লিখে ফেলবে। গানগুলো মন দিয়ে শুনল। কৌতুক নকশা উপভোগ করে এমন হাততালি দিল যে, মনেই হল না একটি অত্যন্ত ধূর্ত চুরির মোকাবিলা করার কথা শতদলের মনে আছে।

অনুষ্ঠান-শেষে অটোগ্রাফ-শিকারিদের উৎপাত ছাড়া হলে আর বিশেষ কিছু ঘটল না।

ফেরার পথে শতদল হঠাৎ খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ল অনুষ্ঠানের নেপথ্য কার্যকলাপ নিয়ে। সে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের এই সাজপোশাক, আলো, এগুলোর দেখাশোনা কে করেন?”

“যতদূর মনে হয় হরিপদবাবু।”

“জিনিসগুলো তোমাদের সঙ্গেই আবার কলকাতায় ফিরবে?”

“ঠিক আমাদের সঙ্গে না হলেও আগে বা পরে চলে যাবে আলাদা গাড়িতে। যত্ন করে প্যাক করতে হবে প্রত্যেকটা জিনিস।”

“কলকাতায় এগুলো কোথায় থাকবে?”

“টালিগঞ্জে বিরাট স্টোর আছে। সেখানেই চলে যাবে সব জিনিস। সেখানেই রাখা থাকবে। শো অনুযায়ী আবার ব্যবহার করা হবে।”

শতদলের ভুরুটা এতক্ষণ কুঁচকে ছিল। কমলের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের পালা সাঙ্গ করে এবার বাইরের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। কমল অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের বৃত্তান্ত তো আদ্যোপান্ত শুনলে, কিন্তু শঙ্খের কী হল? হাতে শুধু একটা দিন। এখানেই যদি চুরির কিনারা না হয়, কলকাতায় একবার চলে গেলে আর ওকে ধরা যাবে না।”

শতদল কোনও কথা না বলে হাতের একটা মুদ্রা করে বরাভয় দান করল।

পরদিন সকালে যথারীতি সকলে ঢিলেঢালা মেজাজে শুয়ে-বসে আলস্য করতে লাগল। আজ শেষ শো, পরদিনই ফেরা।

রাজীব শতদলকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কি আজ গঙ্গারামপুরে যাবে, না কাল? যদি কাল যাও তা হলে আমিও তোমাদের সঙ্গে যেতে পারি।”

“সেটা নির্ভর করছে আমার আজকের কাজের ওপর। যা পাওয়ার কথা সেটা যদি আজ পেয়ে যাই তা হলে বিকেলেই চলে যাব।”

“না হলে?”

“না হলে তখন ঠিক করব কী করা যাবে।” তারপর রাজীবের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে শতদল বলল, “নিজের বুদ্ধি বা কর্মক্ষমতার ওপর যতটুকু আস্থা আছে তাতে মনে করি আজই হয়ে যাবে। তুমি অতি অবশ্যই কাল চলে এসো। আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব।”

রাজীবের মুখে কি এক মুহুর্তের জন্য ধূর্ত হাসি খেলে গেল? না, শতদলের দেখার ভুল শতদল বুঝতে পারল না।

রাজীব নিরীহ ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, “ঠিক আছে, দুপুরে খাওয়ার সময়ে তো নিশ্চয়ই দেখা হবে। তখনই জানা যাবে তোমার কাজ হল কি না।”

কথা হচ্ছিল রাজীবের ঘরে বসে। শতদল উঠতে উঠতে বলল, “যাই দেখি গিয়ে টোটনবাবু তৈরি হলেন কি না। ওঁর গাড়িতে ব্যাঙ্ক পর্যন্ত একটা লিফ্‌ট নেব। চলি―” বলে শতদল হালকা মনে শিস দিতে দিতে টোটন রায়ের ঘরের উদ্দেশে রওনা দিল।

রাজীব যে ভয়ংকর ভ্রুকুটি করে তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল তা সে দেখতেই পেল না।

কমল আজ আর শান্তভাব বজায় রাখতে পারছিল না। আজই শেষদিন। যদি আজকের মধ্যে শঙ্খ না পাওয়া যায়, এরপর সে আর ভাবতেই পারছে না। দু’-চারজন ডেকে গেল বসবার ঘরে যাওয়ার জন্য। কমল―“মাথাটা একটু ধরেছে”, “শরীরটা ঠিক জুতসই নেই ভাই”, বলে অল্প হেসে পাশ কাটিয়েছে। আজ ওর পক্ষে হালকা হাসিঠাট্টায় যোগ দেওয়া অসম্ভব! শতদলও কোথায় যে গেল কিছু বলে গেল না। যতই বলুক নিশ্চিন্ত থাকো, নিশ্চিন্ত কি থাকা যায়?

একবার মনে হচ্ছে সোজা রাজীবকে গিয়েই ধরে, কিন্তু কোনও প্রমাণ ছাড়া কীই-বা বলবে গিয়ে? তানুমান করে দেখবে? টাকার টোপ ফেলবে? কোনওটাই যে ধোপে টিকবে না সেটা বেশ বুঝতে পারছে। সোজাসুজি দায়ী করলে প্রমাণ চাইবে, যেটা উপস্থিত হাতে নেই। অনুনয় করলে সান্ত্বনা দেবে, যেটা আরও অসহ্য। টাকা রাজীবেরও অজস্র আছে। অতএব কিছু টাকার বিনিময়ে সারাজীবনের শত্রু কমলকে শান্তি দেবে― এমন কাঁচা লোক আর যে-ই হোক, রাজীব অন্তত নয়।

এখন যেন আবছা করে মনে পড়ছে সেই প্রথম যৌবনে রাজীবের সঙ্গে একই সঙ্গে স্টুডিয়োর দরজায় দরজায় কাজের আশায় ঢুঁ মারত বলে একটা ওপর ওপর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। সেই সময়ে মধ্যপ্রদেশ থেকে ফিরে কোনও দুর্বল মুহূর্তে সে নিশ্চয়ই রাজীবকে শঙ্খের গল্পটা বলেছিল। তারপরই কমলের অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে উন্নতি দেখে তার মতো রাজীবও নিশ্চয়ই বিশ্বাস করে, এর মূলে আছে সেই দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ। তা না হলে ও সেদিন ‘শাঁখের বদলে শামুক’—এই কথাটা বলত না। পরে বর্ধমানের প্রবাদবাক্য বলে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও শঙ্খের অলৌকিক শক্তির কথা জনিত বলেই আচমকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

এতদিন সুযোগ পায়নি। এই প্রথম কাছাকাছি বাস করবার সুবাদে আর কালবিলম্ব না করে প্রথম সুযোগেই শঙ্খটা হস্তগত করেছে।

দুপুর একটা নাগাদ সকলে খাওয়ার ঘরে এসে গেল। তিনটের মধ্যে হলের উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। শতদলের এখনও পর্যন্ত কোনও পাত্তা নেই। একটা ফোন পর্যন্ত করেনি। আজ রাতটা শেষ হলেই কাল সকাল থেকে ঘরে ফেরার তাড়া। কমল ভাবছিল আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যদি এই চুরির কিনারা না হয় তা হলে সারাজীবনের মতো এই দুপ্রাপ্য দুর্মূল্য দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ হাতছাড়া হয়ে যাবে।

এসব ভাবতে ভাবতে ভাল করে খেতে পর্যন্ত পারল না। দু’-চারজন শরীর খারাপ কি না জিজ্ঞেস করল। কমল মাথাধরার গল্পটাই চালিয়ে গেল আরও কিছুক্ষণ। তারপর নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে টের পেল এক-একটা দল হলের উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। কমলের মনে হল, কী কুক্ষণে যে বালুরঘাটে এসেছিল, না হলে এসব কিছুই ঘটত না। তার শঙ্খ তার কাছেই থাকত বহাল তবিয়তে।

চমক ভাঙল রাজীবের ডাকে। রাজীব বলল, “যাওয়ার আগে দেখা করে গেলাম। শতদলের সঙ্গে তো দেখাই হল না। ওকে বোলো এ-যাত্রা বোধহয় আর গঙ্গারামপুরে যাওয়া হবে না। কলকাতা থেকে জোর তলব এসেছে। অতএব কাল ভোরেই ফিরে যাচ্ছি।”

এরপর গলায় মধু ঢেলে আবার বলল, “এঃ! তোমার মুখটা তো দেখছি একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে। আমার কাছে ভাল ঘুমের ওষুধ আছে। খাবে নাকি? দ্যাখো― ঘুমিয়ে উঠলে যদি মাথাধরা কমে।”

কমল বলল, “না, না, তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না। তোমরা এগোও। শতদল এলে আমরাও হয়তো গঙ্গারামপুরের দিকে রওনা হব।”

“হ্যাভ আ নাইস টাইম,” বলে রাজীব তার চিরপরিচিত ধূর্ত হাসিটা হেসে চলে গেল। কমল ঘরে শুয়ে শুয়ে শেষ গাড়িটা চলে যাওয়ার আওয়াজ পেল। সমস্ত গেস্টহাউসটা এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শতদল এখনও ফিরল না। একা একা অপেক্ষা করতে করতে কমলের এক-একটি মুহূর্ত যেন এক-এক ঘণ্টা বলে মনে হতে লাগল। সমস্ত শরীর যেন অসাড় হয়ে আসতে লাগল। আশা-নিরাশার টানাপোড়েন যখন অসহ্য হয়ে উঠল তখন আর শুয়ে থাকতে পারল না।

গেস্টহাউসের বাইরে বেরোতেই দেখল শতদল একটা সাদা অ্যামবাসাডার থেকে নামছে। নেমেই তাড়া লাগিয়ে বলল, “সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। গাড়ি ভাড়া করেই এসেছি। এক্ষুনি গঙ্গারামপুরের দিকে রওনা হব।”

কমল শঙ্খটা পাওয়া গিয়েছে কি না জিজ্ঞেস করতে সাহসই পেল না। শতদলের বোধহয় কমলের শুকনো মুখ দেখে মায়া হল। বলল, “এবার তুমি হাসতে পারো। তোমার সাতরাজার ধন আমার এই ব্যাগে রয়েছে। বিস্তারিত যেতে যেতে বলব। রাজীব। যে কতবড় ধুরন্ধর ভাবতে পারবে না।”

কমল একবার খেয়ে নেওয়ার কথা তুলতেই শতদল বলল, “ও নিয়ে ভাবনা কোরো না। আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।”

জিনিসপত্র মোটামুটি গোছানোই ছিল। গাড়ি শহর ছাড়িয়ে যেতেই কমল বলল, “এবার বলো কোথায় পেলে? কী করে পেলে? আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছি না।”

শতদল বলল, “তোমার মুখে শঙ্খ চুরির কথা শুনে প্রথমে যেটা মনে হল, এখানে চোর কে তা যখন জানা তখন শঙ্খটা খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হবে না। কারণ চোরও তো জানে তুমি তাকেই সন্দেহ করছ। অতএব সে কিছুতেই শঙ্খটা তার নিজস্ব জিনিসপত্রের মধ্যে রাখবে না, এ একেবারে চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়।।

“আমি ভাবতে লাগলাম কোথায় কোথায় ওর পক্ষে রাখা সম্ভব। এই এক গেস্টহাউসের মধ্যেই কোনও একটা জায়গায়, যা ওর চোখের সামনে অথচ অন্য লোক ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না। সেদিন সকালে তোমাদের সকলের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে আমি রাজীবকে খুবই লক্ষ করছিলাম। অত্যন্ত ক্যাজুয়ালি আডডা দিচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্যও চোখে সতর্ক ভাব দেখিনি বা কোনও একটা বিশেষ জায়গা বা জিনিস নিয়ে স্পর্শকাতরতা লক্ষ করিনি। আমি বুঝে গেলাম শঙ্খটা ও ধারেকাছে কোথাও রাখেনি।

“তারপর সন্ধেবেলা তোমার সঙ্গে শো দেখতে গেলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে আগাগোড়া রাজীবকেই লক্ষ করছিলাম। কৌতুক নকশাটা শুরু হওয়ার পর মনে আছে― তুমি বললে― ডাবগুলো ঠিক আমাদের ছেলেবেলার পয়সা জমাবার মাটির ভাঁড়ের মতো। বিদ্যুচ্চমকের মতো সমস্ত জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

“মেকআপ কিটের মধ্যে করে রাজীব শঙ্খটা নিয়ে গিয়েছিল। গোঁফদাড়ি এসব লাগানোর জন্য ওর কাছে আঠা ছিলই। গ্রিনরুমে মেকআপ নেওয়ার সময়ে আস্তে করে ডাবের মাথাটা চাড় দিয়ে খুলে ওর মধ্যে শঙ্খটা রেখে আবার আটকে দিয়েছিল। সব জিনিসপত্রের সঙ্গে এই ডাবগুলোও চলে যেত কলকাতায়। ও কলকাতা পৌঁছে সুযোগমতো স্টোর থেকে বার করে নিত বা নির্দিষ্ট ডাবটা ও মেকআপ কিটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে পারত। একটা ডাবের অদৃশ্য হওয়া অত কেউ লক্ষও করত না। সবটাই নির্ভর করছিল পারিপার্শ্বিক সুযোগ-সুবিধে, অবস্থার ওপর।

“আমি আজ সকালবেলা ব্যাঙ্কে যাওয়ার নাম করে টোটনবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় টোটনবাবুকে বললাম, আপনাদের অনুষ্ঠান তো নেতাজি ইনস্টিটিউটে হচ্ছে। ওটার গ্রিনরুমটা শুনেছি ভাল নয়। আমার একটা চেনা গ্রুপের আসার কথা। আমাকে একটু দেখেশুনে নিতে বলেছে। আপনি তো যাচ্ছেন, আমিও একটু দেখে আসি গিয়ে।’

“ওখানে গিয়ে এদিক-ওদিক দেখার ভান করলাম। টোটনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্টোরের চাবিটা আছে তো সঙ্গে?—স্টোরটাও একটু দেখে নিতাম তা হলে। ওদের আবার বিরাট সেট-টেট সব আনার কথা আছে।’

“টোটনবাবু বললেন, ‘চলুন না। আমি তো একবার করে খুলে চেক করে নিই প্রতিদিনই।’ স্টোরে ঢুকে চারপাশ দেখতে দেখতে এটা-ওটা নিয়ে প্রশ্ন করার ফাঁকে ডাবের ঝুড়ি থেকে ডাবগুলো তুলে তুলে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম― কোনটার মধ্যে শঙ্খটা থাকতে পারে। যেটা চাইছি সেটা পাওয়ামাত্র টোটনবাবুর অলক্ষ্যে হাতের ব্যাগের মধ্যে চালান করে দিলাম।

“এরপর টোটনবাবুর কাছে বিদায় নিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে যাওয়ার জন্য একেবারে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে চলে এলাম।”

শতদল থামতেই কমল জিজ্ঞেস করল, “শঙ্খটা না হয় পাওয়া গেল, কিন্তু রাজীব আমার বন্ধ ঘরে ঢুকে ওটা হাতাল কেমন করে? সেই কথাটা বলো। বেরনোর আগে পর্যন্ত শঙ্খটা তো আমার কাছেই ছিল।”

“এটা তো খুব সহজ। তুমি ঘর লক করে রিসেপশনে এসে দেখলে রাজীব ফোন করছে। তুমি চাবি রেখে পেছন ফিরতেই ও বিদ্যুদ্বেগে নিজের চাবিটার সঙ্গে তোমার চাবিটা বদলে রেখে দিল। ওর চাবিটা নিশ্চয়ই ওর হাতেই ছিল বা ফোনের পাশেই রাখা ছিল। আমার যতদূর মনে হয় তোমাকে জব্দ করবার ইচ্ছে থাকলেও কীভাবে করবে সে-বিষয়ে ওর স্পষ্ট ধারণা ছিল না। রিসেপশনে তুমি চাবিটা রাখতেই ওর কাছে সুযোগ এসে গেল।”

অন্ধকারের মধ্যে গাড়ি ছুটে চলেছে। টানা তিনদিন আশা, নিরাশা, সন্দেহ, সংশয়, নানারকম ভাবের সঙ্গে লড়াই করে কমল এতক্ষণে ক্লান্ত বোধ করছিল। শতদলের দেওয়া মাটির ডাবটা হাতে নিয়ে পেছনের সিটে আরামে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, “এর থেকে রাজীবের আশা করি শিক্ষা হবে। চোরের ওপরেও যে বাটপাড় থাকে সেটা বুঝতে পারবে। এই চুরিটা অন্য জায়গায় হলে তুমি থাকতে না, আমিও শঙ্খ ফেরত পেতাম না। এর থেকে শঙ্খের অলৌকিক শক্তির ওপরে আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল।”

৬ সেপ্টেম্বর ২০০০

অলংকরণ: নির্মলেন্দু মণ্ডল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *